৩৯. ধ্বংস টাওয়ারের নীচে

চ্যাপ্টার

ড. হাইম হাইকেলের বেডরুম।
আহমদ মুসা একটা সোফায় বসে। তার মুখোমুখি সোফায় বসে ড. হাইম হাইকেল। আহমদ মুসা কথা বলছিল।
বলছিল পেছনের বিশাল কাহিনীটা। বলছিল ইউরোপের গোয়েন্দা সংস্থা ‘স্পুটনিক’-এর ধ্বংস থেকে শুরু করে আজোরস দ্বীপের কথা, আজর ওয়াইজম্যানের সাথে সংঘাত সংঘর্ষের কথা, স্পুটনিকের গোয়েন্দাদের উদ্ধারের কথা এবং আজর ওয়াইজম্যান ড. হাইম হাইকেলের কনফেশন টেপ নিয়ে আসার কথা। বলছিল ড. হাইম হাইকেলের সন্ধানে আহমদ মুসার নিউইয়র্কে আসার কথা এবং তাকে সন্ধান করতে গিয়ে বিপদ ও ষড়যন্ত্রের চক্রজালে জড়িয়ে পড়ার কথা। বলছিল তার ফিলাডেলফিয়া যাওয়া এবং সেখানকার ঘটনা-দূর্ঘটনার কথা। সবশেষে বলেছিল তার ডেট্রোয়েটে আসা, বিপদে পড়া ও ড. হাইম হাইকেলকে উদ্ধারের কথা। সুদীর্ঘ কাহিনী সংক্ষেপে বলার পর ইতি টানতে গিয়ে বলল, ‘স্যার, কাহিনীর এসব ভূমিকা, আসল কাহিনী শুরুই হয়নি।’
আহমদ মুসার কাহিনীর মধ্যে ডুবে গিয়েছিল ডক্টর হাইম হাইকেল। তার চোখে-মুখে আনন্দ, বেদনা ও বিস্ময় যেন একসাথে এসে আছড়ে পড়েছে।
আহমদ মুসা থামলেও ড. হাইম হাইকেল কোন কথা বলল না। তার চোখ দুটো যেন আঠার মত লেগে আছে আহমদ মুসার উপর। তার বোবা দৃষ্টিতে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা।
এক সময় মুখটা নত হয়ে গেল ড. হাইম হাইকেলের। মুহূর্ত কয় পরে মুখ তুলে বলল, ‘তুমি আরেক আরব্য রজনী শোনালে আহমদ মুসা! আনন্দের বিষয় হলো, এ আরব্য রজনী কল্পনার নয়।’
বলে থামল ড. হাইম হাইকেল। মুখটি আবার নিচু হলো তার। একটু পরেই মুখ তুলল। চোখ দুুুটি তার ছলছল করছে। বলল, ‘বাস্তব এই আরব্য রজনীর তুমি সিন্দাবাদ। আমার জন্যে, আমার পরিবারের জন্যে যা করেছ তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব না। শুধু প্রার্থনা করব, সিন্দাবাদের কিস্তি যেন কূলে ভিড়ে।’
একটু থামল আবার ড. হাইম হাইকেল। রুমাল দিয়ে চোখ দুটি মুছে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি আহমদ মুসা তোমার মিশন কি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমার কনফেশন টেপ স্পুটনিকের গোয়েন্দাদের হাতে গেল কি করে?’
আহমদ মুসা বলল, ‘ঐ মহলের সাধারণ একটা ধারণা সেটা স্পুটনিক আপনার কাছ থেকে পেয়েছে। প্রথমে আমিও এটাই মনে করতাম। পরে আমি কামাল সুলাইমানের কাছে ঘটনা শুনেছি। কামাল……….।’
ড. হাইম হাইকেল কথা বলে ওঠায় আহমদ মুসা থেমে গেল। ড. হাইম হাইকেল বলছিল, ‘মাফ করবেন, কে এই কামাল সুলাইমান?’
‘তিনি স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা। আজর ওয়াইজম্যানের হাতে বন্দী সাত গোয়েন্দার তিনিও একজন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, বলুন।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
আহমদ মুসা শুরু করল, ‘কামাল সুলাইমান বিশ বছর আগের টুইনটাওয়ার ধ্বংসের সেই কাশুন্দি ঘেঁটে সত্যটা বের করার জন্যে ওয়াশিংটন এসেছিলেন। এখানেই তিনি দেখা পেয়েছিলেন বৃদ্ধ এক ইহুদী পরিবারের। আর সেই ইহুদী পরিবারের এক বৃদ্ধের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন কনফেশন টেপ।’
‘তার নাম কি? রাব্বী উইলিয়াম কোলম্যান কোহেন?’ জিজ্ঞাসা ড. হাইম হাইকেলের।
‘জি।’ বলল আহমদ মুসা।
কিছুটা বিস্ময় ফুটে উঠল ড. হাইম হাইকেলের চোখে-মুখে। বলল, ‘অবিশ্বাস্য ঘটনা! এ ধরনের কনফেশন সিনাগগের বাইরে যাওয়ার বিধান নেই। তার উপর রাব্বী উইলিয়াম কোহেনের মত লোক এমন কিছু করতে পারেন না। তিনি কোন নীতি-বিরুদ্ধ কাজ করবেন বলে তা বিশ্বাস করা মুষ্কিল।’
‘বিশ্বাস করা মুষ্কিল হলেও এটাই ঘটেছে এবং ঘটাটাই ছিল স্বাভাবিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি রকম?’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘সে ছিল এক মজার ঘটনা। কামাল সুলাইমান একটু অসুস্থতা নিয়ে ওয়াশিংটনের একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। তার কক্ষের মুখোমুখি কক্ষটিতে ভর্তি হলেন একজন বৃদ্ধ রাব্বি। বয়সের ভারে অত্যন্ত দূর্বল, তার উপর অসুস্থ। একা হাঁটা তার জন্যে কষ্টকর ছিল। তার কোন এ্যাটেনডেন্ট ছিল না। ক্লিনিকের নার্স তাকে দেখাশুনা করতো, কিন্তু সবসময়ের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। মুখোমুখি দুঘরের দরজা ও জানালা একটু খোলা রাখলে দুঘর প্রায় এক হয়ে যেত। বৃদ্ধ রাব্বি ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনেই যখন নার্স তাকে হুইল চেয়ার থেকে তুলে শুইয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন কামাল সুলাইমান তাকে সাহায্য করে। তারপর থেকে কামাল সুলাইমান বৃদ্ধের খোঁজ খবর রাখত এবং প্রয়োজনে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতো। ব্যাপারটা অবশেষে তার রুটিন কাজে পরিণত হয়ে যায়। প্রথম দিকে এভাবে সহযোগিতা নিতে বৃদ্ধ সংকোচ বোধ করত, কিন্তু পরে কামাল সুলাইমানের আন্তরিকতায় তা দূর হয়ে যায়। বৃদ্ধ তাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সমাজে, দেশে ছেলে-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনরা কি এভাবেই পিতা-মাতার সেবা করে? কামাল সুলাইমান বলেছিল, জ্বি হ্যাঁ। আর এটা ছেলে-সন্তানদের শুধু দায়িত্ব হিসেবে করা হয় না, এটা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি তাদের ভালোবাসার অংশ। এইভাবে দুজনের মধ্যে পিতা-পুত্রের মত একটা হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে বৃদ্ধ রাব্বীর রোগের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। তার সাথে দুজনের সম্পর্কও আরও গভীর হয়। বৃদ্ধ রাব্বীর আত্মীয় বলতে তেমন কেউ ছিল না। রুটিন খবরাখবর সিনাগগের লোকরাই নিত। স্বজন না থাকায় বিরাট শূন্যতার কিছুটা যেন বৃদ্ধের পূরণ হয় কামাল সুলাইমানকে দিয়ে। কামাল সুলাইমান মুসলমান এ কথা বৃদ্ধ শুরুতেই জেনে ফেলে। পরে বৃদ্ধের কক্ষেও কামাল সুলাইমান মাঝে মাঝে নামাজ পড়ত। কামাল সুলাইমান ধার্মিক বলে তার প্রতি বৃদ্ধের ভালোবাসা যেন আরও বেড়ে যায়। ধর্ম নিয়েও তাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়। একদিন বৃদ্ধ তাকে বলে, ‘এখনকার অবস্থা যাই হোক, ইহুদী ধর্ম বা জুদাইজমের সবচেয়ে কাছের ধর্ম ইসলাম। ধর্ম অনুশীলনের দিক দিয়েও ইহুদী ও মুসলমানরা পরষ্পরের খুব কাছাকাছি। বিশ্বাস কর, আমি ইহুদী না হলে মুসলমান হতাম।’ এধরনের কথায় কথায় একদিন বৃদ্ধ রাব্বী উইলিয়াম কোহেন কামাল সুলাইমানকে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাকুরি, ব্যবসা কোন উদ্দেশ্যই তোমার নেই, তাহলে কেন তুমি আমেরিকা এসেছ? তোমার মত কাজের ছেলে শুধু ঘুরে বেড়িয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করবে, এটা স্বাভাবিক নয়।‘ এইভাবে কথার প্যাঁচে পড়ে কামাল সুলাইমান তার উদ্দেশ্যের কথা বৃদ্ধকে বলে ফেলে এবং জানায় যে, সে নিশ্চিত নিউইয়র্কের টুইনটাওয়ার মুসলমানরা ধ্বংস করেনি। কে করেছে, সেটা উদ্ধার করতে তার সারা জীবনও যদি ব্যয় করতে হয় তবু সে করবে।’ কামাল সুলাইমানের কথা বৃদ্ধ শুধু শোনে, কিছুই বলে না। ধীরে ধীরে প্রসংগটি সে এড়িয়ে যায় অন্য কথার ছলে। বৃদ্ধের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় পৌছে যায় বৃদ্ধ রাব্বী উইলিয়াম কোহেন। মাঝে মাঝেই সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। জ্ঞান ফিরে পেলেই সে দেখত কামাল সুলাইমান শিয়রের কাছে বসে। এমনি একটা মুহূর্তে একদিন বৃদ্ধ কামাল সুলাইমানের একটা হাত তুলে নিল হাতে। বৃদ্ধের চোখ দুটি অশ্রু সজল হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধ বলে, ‘প্রভুর কাছে যাওয়ার সময় আসন্ন। জানি না, প্রভুর সন্তুষ্টি আমি পাব কিনা। তাঁর জন্যেই আমি শেষ একটি কাজ করে যেতে চাই।’ থামে বৃদ্ধ। কামাল সুলাইমান বলে, ‘কি কাজ?’ বৃদ্ধ বলে, ‘তোমাকে সাহায্য করতে চাই।’ ‘কি সাহায্য?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে কামাল সুলাইমান। বৃদ্ধ কোন উত্তর না দিয়ে বলে, ‘ঐ আলমারিতে গতকাল সিনাগগ থেকে আনা যে ছোট্ট বাক্সটি আছে, সেটা আমার কাছে নিয়ে এস।’ বাক্সটি কামাল সুলাইমান নিয়ে এলে বৃদ্ধ বাক্স থেকে ভেলভেটের একটা ছোট্ট থলে বের করে কামাল সুলাইমানের হাতে তুলে দেয়। ক্লান্ত কণ্ঠে ধুঁকতে ধুঁকতে বলে বৃদ্ধ, ‘বেটা, তোমার জীবন তোমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই থলেটাও তোমার কাছে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।’ বৃদ্ধ দম নেবার জন্যে থেমে যায়। কামাল সুলাইমান বিস্মিত কণ্ঠে বলে, ‘জনাব এতে কি আছে?’ বৃদ্ধ কষ্ট করে টেনে টেনে বলে, ‘তোমরা যা খুঁজছ বেটা……।’ কথাগুলো উচ্চারণ করেই বৃদ্ধের ক্লান্ত কণ্ঠ থেমে যায়, বুজে যায় চোখ দুটি। কয়েক মুহূর্ত পরে বৃদ্ধ আবার চোখ খুলে বলে ক্ষীণ কণ্ঠে, ‘বেটা, কোরআনের সুরা ইয়াসিন কি তোমার মুখস্থ আছে?’ ‘আছে।’ বলে কামাল সুলাইমান। বৃদ্ধ উজ্জ্বল চোখে অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘তুমি ওটা পড়তে থাক, আর সাক্ষী থাক…..। আমি ঘুমাব।’ বলে বৃদ্ধ চোখ বুজে। কামাল সুলাইমান তাড়াতাড়ি উঠে ডাক্তার, নার্সদের ডাকে। তারা ছুটে আসে। যখন ডাক্তার, নার্সরা বৃদ্ধকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন কামাল সুলাইমান বৃদ্ধের শিয়রে দাঁড়িয়ে মনে মনে সুরা ইয়াসিন পাঠ করছিল। বৃদ্ধ আর চোখ খোলেনি। কামাল সুলাইমান ভেলভেটের সেই থলেতে পেয়েছিল আপনার কনফেশন টেপ।’ থামল আহমদ মুসা।
নিরব রইল ড. হাইম হাইকেল। তার সমগ্র চেহারা বেদনায় পাংশু। আর অশ্রুর প্রস্রবণ বইছে তার চোখ থেকে। নত মুখে অনেকক্ষণ অশ্রু মোচনের পর মুখ তুলল। বলল, ‘এখন আর আমার কোন বিস্ময় নেই আহমদ মুসা। মহান রাব্বী ঠিকই করেছেন। আর ইসলাম গ্রহণ করে তিনি তার বিজ্ঞতারই প্রমাণ রেখে গেছেন।’
‘স্যার, সুরা ইয়াসিন পাঠ করতে বলা এবং সাক্ষী থাকতে বলার অর্থ আপনিও এটাই করেন?’ বলল উৎসাহিত কণ্ঠে আহমদ মুসা।
‘এর আর কোন অর্থ নেই বৎস।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘আল হামদুলিল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
ড. হাইম হাইকেল মুখ তুলল। তাকাল আহমদ মুসার আনন্দিত মুখের দিকে। তারও মুখে একটু স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। সোফায় হেলান দিয়ে বসল সে। বলল, ‘এবার আহমদ মুসা, তোমার কথা বল।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘স্যার, রাব্বী উইলিয়াম কোহেন যে অমূল্য সাহায্য করেছেন, তার পরের সাহায্য আপনার কাছ থেকে চাই।’
‘তার মানে আমার কনফেশনে প্রয়োজনীয় যে কথা নেই, তা জানতে চাও, তাতে যে ফাঁকগুলো আছে তা পূরণ করতে চাও। এক কথায় কনফেশনে যা বলা হয়েছে তাকে প্রমাণ করার উপকরণ চাও। এই তো?’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ঠিক স্যার।’
‘কেন চাও? প্রতিশোধ নেবার জন্যে?’ জিজ্ঞাসা ড. হাইম হাইকেলের।
‘প্রতিশোধ নয় স্যার। সত্য উদ্ধার করতে চাই। বিশ্ববাসীকে সত্যটা জানাতে চাই। জাতির কপাল থেকে সন্ত্রাসী হওয়ার কলংক মুছে ফেলতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার চাওয়া যুক্তিসংগত। আমার পাপ সাংঘাতিক কেউ জানুক। সত্যটা বাইরে যাক, এটাও আমার মনের একটা চাওয়া ছিল, যদিও মূলত আমার মানসিক শান্তির জন্যেই আমি কনফেশন করেছিলাম। আমি আনন্দিত যে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছি, অন্যদিকে সত্যটা প্রকাশেরও একটা পথ হয়েছে। আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।’
বলে একটু থেমেই ড. হাইম হাইকেল আবার বলে উঠল, ‘তবে আমি বলার আগে তোমার কাছে কিছু শুনতে চাই। বিশ বছর আগের ঘটনা তো! তোমরা কতটুকু জান, জানার ক্ষেত্রে কতটা এগিয়েছ, ঘটনা সম্পর্কে কি ধরনের সিদ্ধান্তে পৌছার পরে তোমরা সত্য-সন্ধানের ফাইনাল ষ্টেজে নেমেছ, তা আমি জানতে চাই। প্রথমে বল, ঘটনার পেছনে কারা আছে বলে তোমরা মনে কর?’
‘এ ব্যাপারে গত বিশ বছরে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। তার মধ্যে আমার মতে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি হলো রুশ গবেষক ড. তাতিয়া কোরাজিনার কথা। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ঘটনা ঘটাবার জন্যে যে ১৪ জনকে দায়ী করা হয়েছিল, তারা এ ঘটনা ঘটায়নি। বরং ঘটনার সাথে জড়িত আছে বড় একটা গ্রুপ যারা পৃথিবীর রূপ পাল্টে দিতে চায়। এরা সাংঘাতিক শক্তিশালী। এদের আয়ত্বে আছে ৩০০ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ। গ্লোবাল গভর্নমেন্টের মাধ্যমে এরা এদের ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে চায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তিনি তো সেই ক্ষমতাধরের নাম করেননি। কে সেই ক্ষমতাধর?’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘সেই শক্তিকে চিহ্নিত করার জন্যে দুটি বিষয়ের আলোচনা দরকার। এক. এই ঘটনার দ্বারা কে বা কারা লাভবান হয়েছে? দুই. ঘটনা সম্পর্কে কারা আগাম জানত?’
‘লাভবান হওয়ার বিষয়ে বলা যায়, এই ঘটনার দ্বারা দুনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ইসরাইল। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের আগে পশ্চিমী জনমতের মধ্যে ইসরাইলের প্রতি বিরক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভুতি বাড়ছিল। নাইন-ইলেভেনের দায় মুসলমানদের বিশেষ করে আরবদের ঘাড়ে চাপানোতে রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আরবদের প্রতি সন্দেহ-সংশয় যতটা বেড়েছে, ততটাই সহানুভুতি বেড়েছে ইসরাইলের জন্যে। অন্যদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কণ্ঠরোধ করার সুযোগ পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে আফগানিস্তান ও ইরাক ধ্বংস হওয়া, সিরিয়া, লেবানন, মিসর, সউদি আরবের মত দেশের স্বাধীন গতি শৃঙ্খলিত হওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পরিমাণ মার্কিন সৈন্য অনির্দিষ্টকালের জন্যে আসন গেড়ে বসায় ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে এবং মার্কিনীদের কাছে ইসরাইলের মূল্য আরও বেড়েছে। অনুরূপভাবে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ফলে সীমাহীনভাবে লাভবান হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা যুদ্ধবাদী গোষ্ঠীর রাজনীতি। সবাই বলেছে টাওয়ার ধ্বংসের আগের পৃথিবী এবং পরের পৃথিবী এক পৃথিবী নয়। পৃথিবীর এই পরিবর্তন আমেরিকার ঐ যুদ্ধবাদী গ্রুপের পক্ষে গেছে। টাওয়ার ধ্বংসের জন্যে এমন এক শক্তিকে আমেরিকার তদানিন্তন সরকার দায়ী করে, যারা নির্দিষ্ট কিছু মানুষ কিংবা নির্দিষ্ট কোন দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিনীরা যখন যেখানে চাইবে, তাদের হাজির করবে এবং সেখানে হামলা তাদের জন্যে বৈধ হয়ে যাবে। আমেরিকা আফগানিস্তান ধ্বংস করেছে, কিন্তু অদৃশ্য শত্রু অদৃশ্যই রয়ে গেছে। যাদেরকে সন্দেহাতীতভাবে দোষী সাব্যস্ত করে সকল আইনের নাগালের বাইরে এক দ্বীপে বন্দী করে নির্যাতন চালিয়ে গেছে, তাদের টাওয়ার ধ্বংসের ব্যাপারে কোন দোষ পাওয়া যায়নি। সেই শক্তিকে অন্য এক রূপে ইরাকে আনা হয়েছে। তারপর ইরাক ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু সেই শক্তিকে পাওয়া গেল না ইরাকে, অদৃশ্য হয়ে গেল। এইভাবে অদৃশ্য শত্রুকে আমেরিকার ক্ষমতাসীনরা যেখানে ইচ্ছা আবিষ্কার করেন এবং সেখানে আগাম আক্রমণ করা তার জন্যে বৈধ হয়ে যায়। এই সর্বব্যাপী শত্রুর ভয় আমেরিকান জনগণের মধ্যে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, আমেরিকান জনগণেরও মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয় আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার নামে। একটি একক গ্লোবাল পাওয়ার লাভেল জন্যে যে সুযোগ তার প্রয়োজন ছিল, সেই সুযোগ নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকার যুদ্ধবাদী গোষ্ঠীর হাতে এসে যায়। সুতরাং টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে ইসরাইল এবং আমেরিকার একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়। ঠিক এই ভাবেই ঘটনা থেকে লাভবান হওয়া এই দুপক্ষেরই জানা ছিল ঘটনা সম্পর্কে আগাম খবর। টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার আগের দুএকদিন শেয়ার মার্কেটে অস্বাভাবিক লেন-দেন হয়। যে ক্ষমতাধররা এর মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করে, তারা টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে জানত। আমেরিকার সি.আই.এ, এফ.বি.আই-এর কাছে টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য ছিল, কিন্তু তারা প্রতিকারের পদক্ষেপ বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে সাহস করেনি। এ নিয়ে পরে লোক দেখানো তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়। তদন্ত কমিটিও ফলপ্রসূ কিছু করেনি। সম্ভবত যে সাহস সি.আই.এ, এফ.বি.আই-এর ছিল না, সে সাহস তদন্ত কমিটিরও থাকার কথা নয়। অন্যদিকে টাওয়ার ধ্বংসের ব্যাপারে ইসরাইলের পুরোপুরি জানা ছিল। টুইনটাওয়ারে চার হাজার ইসরাইলী কাজ করত, কিন্তু কেউ ঘটনার দিন কাজে যায়নি। কোন দেশের কত লোক মারা গেছে তার একটা তালিকা প্রকাশ পায় ঘটনার পরপরই, তাতে কোন ইসরাইলীর নাম ছিল না। পরে অবশ্য এ তথ্য গোপন করার চেষ্টা করা হয়। ঘটনার একদিন পর জেরুসালেম পোষ্ট লিখে, চার হাজার ইসরাইলী নিখোঁজ। অন্যদিকে ঘটনার ৮ দিন পর ওয়াশিংটন পোষ্ট লিখে ১১৩ জন ইসরাইলী মারা গেছে। ওয়াশিংটন পোষ্ট এই কথা বলার একদিন পর সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে বলেন ১৩০ জন ইসরাইলী নিহত হয়েছে। কিন্তু সবশেষে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ১১ দিন পর নিউইয়র্ক টাইমস মাত্র তিনজন ইসরাইলী নিহত হবার খবর লিখে। তারাও আবার ছিল ভ্রমণকারী, টুইনটাওয়ারের চাকুরে নয়। দ্বিতীয়ত ঃ টুইন টাওয়ার এলাকায় ঐ দিন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রোগ্রাম ছিল। সব ঠিকঠাক ছিল, শেষ মুহূর্তে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার নিষেধের কারণে প্রধানমন্ত্রী সেই প্রোগ্রাম বাতিল করেন। এফ.বি.আই. নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া সত্ত্বেও তিনি যাননি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইহুদীরা, ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগ পুরোপুরি এবং আমেরিকার সি.আই.এ ও এফ.বি.আই-এর একটা অংশ টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে জানত। এফ.বি.আই, সি.আই.এ শুধু জানত নয়, তারা ঘটনা ঘটার সময় প্রতিরোধ প্রতিকারের কোন ব্যবস্থাই করেনি। মাঠ পর্যায়ের এফ.বি.আই কর্মীরা যে তথ্য উপরে পাঠিয়েছিল, তা চাপা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দুনিয়ার সবাই জানে টাওয়ার ধ্বংসের আক্রমণকেও প্রতিরোধ করা হয়নি। প্রথম টাওয়ারে আক্রমণের পর দ্বিতীয় টাওয়ারে আক্রমণ করার মাঝে সময়ের যে ব্যবধান ছিল তাতে আমেরিকার সব জংগি বিমান, সব ক্ষেপণাস্ত্র সেখানে হাজির হতে পারতো। কিন্তু একটিও আসেনি। অথচ খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রথম টাওয়ারে আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে তার ছবি দেখেন, কিন্তু নিস্ক্রিয় থাকেন। আক্রমণ যেন হতে দেয়া হয়েছে। কেন তা করা হয়েছে? উত্তর একই রকম। কোন শক্তিমানের প্রতি ভয়ই সম্ভবত এই নিস্ক্রিয়তার কারণ।’ থামল আহমদ মুসা।
থামতেই ড. হাইম হাইকেল বলে উঠল, ‘কিন্তু বল, সেই শক্তিমান পক্ষ কে বলে তোমরা মনে কর?’
‘কোন ব্যক্তি নয়, কোন বড় গ্রুপের কাজ এটা। এ গ্রুপের কোন বিশেষ নাম আছে কিনা, জানি না। এ গ্রুপের পরিচয়মূলক আরও কিছু তথ্য সামনে আনলে তাদের চিহ্নিত করা সহজ হতে পারে।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। সোজা হয়ে বসে আবার বলা শুরু করল, ‘বলা হয় এই যুদ্ধবাজ গ্রুপের বিদেশ নীতি Neo-colonialism এর সমার্থক। এরা আমেরিকার সামরিক শক্তি বা গোয়েন্দা শক্তি ব্যাবহার করে ডিক্টেটর শাসক, ধনী রাজনৈতিক পরিবার, দুর্নীতি সৃষ্ট গণতান্ত্রিক দলকে কাজে লাগিয়ে বা তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে পৃথিবীর জাতিসমূহকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। পেছনে তাকিয়ে আমেরিকার আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপমূলক রেকর্ডের ও তৎপরতার দিকে নজর দিলে এর ডজন ডজন প্রমাণ পাওয়া যাবে, নাম উল্লেখ করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই স্যার। কিন্তু এর চেয়েও এই গ্রুপের ভয়ংকর কাজটা হলো অন্তর্ঘাত। এই গ্রুপের একটা পলিসি হলো, ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা নিজেরা ঘটিয়ে তার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েতার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের বৈধতা দাঁড় করানো। ঠিক হিটলারের জার্মানীর পার্লামেন্ট পোড়ানোর ঘটনার মত। হিটলার তার পার্লামেন্টে আগুন দেয়ার জন্যে কম্যুনিষ্টদের দোষারোপ করেছিল। কম্যুনিষ্ট কার্ডধারী একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। সে লোক আগুন দেয়ার অপরাধ স্বীকারও করেছিল। কিন্তু পরে দুনিয়া জেনেছে এই পার্লামেন্ট পোড়ানোর কাজ খোদ হিটলার করিয়েছিল। প্রমাণ হয়েছিল হিটলারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হারমান গোয়েরিং-এর অফিস থেকে পার্লামেন্ট ভবন পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই সুড়ঙ্গ পথে গিয়ে হিটলারের লোকরাই পার্লামেন্টে আগুন দিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে হিটলারের এই কৌশলটাকেই আমেরিকার একটি গ্রুপ এবং ইসরাইল তার রাষ্ট্রীয় পলিসি হিসাবে গ্রহণ করেছে। আমেরিকার এই যুদ্ধবাজ গ্রুপটির ‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ’ করার মত এক জঘন্য ষড়যন্ত্র প্রেসিডেন্ট কেনেডি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি এই গোপন কর্মকান্ডের বিবরণ তুলে ধরেছে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র উপর লেখা জেমস বামফোর্ড-এর বই ‘Body of secrets : Anatomy of the Ultra-Secret National Security Agency’-এর লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোপন দলিলের ভিত্তিতে লিখেন যে, পৃথিবী কাঁপানো ‘ইধু ড়ভ চরমং’ ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা শক্তিমান গ্রুপ কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন জনমতকে খেপানো এবং কিউবার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো ও তার দায় কিউবার উপর চাপানোর একটা পরিকল্পনা তৈরি করে। এই পরিকল্পিত সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্যে ছিল আকস্মিক এক দাঙ্গা ও রায়ট সৃষ্টির মাধ্যমে কিউবা সন্নিহিত মার্কিন ঘাঁটি গুয়ানতানামোর জংগি বিমান, যুদ্ধ জাহাজ ও অস্ত্র-গুদাম উড়িয়ে দেয়া, ফ্লোরিডার মিয়ামী এরিয়া, এমন কি খোদ ওয়াশিংটন এলাকায় কম্যুনিষ্ট কিউবার নাম জড়িত করে সন্ত্রাসী অভিযান, ফ্লোরিডা উপকূলে কিউবান রিফুজী ভর্তি একটা বোট ডুবিয়ে দেয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাছাইকৃত কিছু এলাকায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো এবং এর সাথে কিউবার সম্পর্ক থাকার দলিল তৈরি করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা, ‘মেকি রাশিয়ান বিমান’ দ্বারা মার্কিন বেসামরিক বিমানকে হেনস্থা করা, মার্কিন বেসামরিক বিমান ও জলজাহাজ হাইজ্যাক, এমন কি বেসামরিক বিমান গুলী করে ভূপাতিত করা। এই সন্ত্রাস-পরিকল্পনা প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাছে পেশ করা হলে তা এক কথায় তিনি বাতিল করে দেন। কেনেডি নিহত হবার পর ‘Assassination Record Review Board’ এই দলিল আবিষ্কার করে এবং ‘ন্যাশনাল আরকাইভস’ এই দলিল প্রকাশ করেছে।’
এ পর্যন্ত বলে আহমদ মুসা একটু থামল।
গম্ভীর ড. হাইম হাইকেল আহমদ মুসার দিকে পানির একটা গ্লাস ঠেলে দিয়ে বলল, ‘গলা একটু ভিজিয়ে নাও।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা একটু পানি খেয়ে আবার বলা শুরু করল, ‘প্রেসিডেন্ট কেনেডির আমলে শক্তিমান এই গ্রুপ যতটা শক্তিশালী ছিল, মনে হয় তারা পরে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার জলজ্যান্ত অনেক তথ্যকে তারা বেমালুম হজম করে ফেলেছে এবং ছয়কে নয়, আর নয়কে ছয় করতে সমর্থ হয়েছে। দুটাওয়ারের সাথে তৃতীয় একটা টাওয়ার সমূলে ধ্বংস হয়, অথচ বিমান তাকে আঘাত করেনি। এই টাওয়ার নিয়ে হৈ চৈ উঠেনি, কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি এবং তদন্তও করা হয়নি। কোন সিভিলিয়ান এয়ার লাইনারের পক্ষে অত নিচুতে অমন গতিতে এগিয়ে গিয়ে ঐ রকম নিখুঁতভাবে আঘাত করা সম্ভব নয়। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘গ্লোবাল হক’ (যা দেখতে বোয়িং ৭৩৭-এর মত) হাই আলটিচুড বিমান তার ভয়ানক শক্তিশালী ‘দূর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’র মাধ্যমেই মাত্র সিভিল এয়ারলাইনার দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। এই প্রবল সন্দেহ সম্পর্কেও তাদের কোন বক্তব্য নেই। তাছাড়া টাওয়ার বালি দিয়ে তৈরি ঘরের মত মাটির সাথে মিশে যায় প্লেনের আঘাতে নয়, বরং গোড়ায় সংঘটিত বিশেষ ধরনের বিস্ফোরণের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল্ডিং এক্সপার্টরা এই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের মত এ তথ্যও মানুষের কাছে পৌছতে পারেনি। অনুরূপভাবে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনগুলো প্রথমে যে যাত্রী-তালিকা প্রচার করে, তার মধ্যে কোন মুসলিম নাম ছিল না। পরে ১৪টি মুসলিম নাম তালিকায় আসে। কেন আসে, কিভাবে আসে, তার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। এমনি হাজারো তথ্যকে ঐ শক্তিমান গ্রুপটি দিনের আলোর মুখ দেখতে দেয়নি। এই গ্রুপটি এতই শক্তিশালী যে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে, নিউইয়র্ক টাইমস-এর ভাষায়, আমেরিকান পলিসি কার্যত এদেরই হাতে রয়েছে।’ থামল আবার আহমদ মুসা।
সোফায় হেলান দিয়ে বসা ড. হাইম হাইকেল সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘শক্তিমান পক্ষটির কাজ বললে, পরিচয় কিন্তু চিহ্নিত হলো না।’
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কি নামে তাদের আমি ডাকব। পরোলোকগত মার্কিন লেখিকা গ্রেস হারসেলের কথা মনে পড়ছে। তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গ্রন্থকার। তিনি ইসরাইল সফর করেন। তার ভিত্তিতে একটা বই লেখেন। বইয়ের নাম হলো, ‘জেরুসালেম সফর’। তিনি এ বইতে ইসরাইলী একজন সাংবাদিকের একটি গর্বিত উক্তি উদ্ধৃত করেন এবং সে উক্তি হলো, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যে, বর্তমানে হোয়াইট হাউজ আমাদের হাতে, সিনেট আমাদের হাতে, নিউইয়র্ক টাইমস আমাদের হাতে, এমতাবস্থায় আমাদের প্রাণের সাথে আর কারও প্রাণের তুলনা হয় না।’ লেখিকা গ্রেস হারসেল তার উক্ত বই সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তার অন্য একটি লিখায়। বলেছেন, ‘আমার এ বই অনেক বাধা-বিপত্তি, চক্রান্তের বেড়াজাল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হলো ১৯৮০ সালে। এরপর বেশ কয়েকটি গীর্জায় বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। সাধারণ খৃষ্টানরা বিশ্বাস করতে চাইল না আমার পরিবেশিত তথ্যসমূহ। কারণ, তৎকালে ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলের বিভিন্ন অত্যাচার, ভূমি দখল, বাড়িঘর বিধ্বস্ত করা, যখন-তখন গ্রেফতার ও অন্যান্য নির্যাতন সম্পর্কে আমেরিকান প্রচার মাধ্যমে কোন খবরই থাকত না। বিভিন্ন গীর্জায় বক্তৃতাকালে আমি যখন শ্রোতাদের আমার নিজের দেখা ঘটনাবলীর বর্ণনা দিতাম, আমাকে প্রশ্ন করা হত ‘আমরা তো সংবাদপত্রে এসব খবর পাই না?’ অথচ ইসরাইলের মত ছোট দেশে যত আমেরিকান সাংবাদিক কাজ করে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশেও এই পরিমাণ আমেরিকান সাংবাদিক নেই। এসব বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দিল, নিউইয়র্ক টাইমস, দি ওয়াল ষ্ট্রিট জার্নাল, দি ওয়াশিংটন পোষ্ট, আর আমাদের দেশের অন্যান্য প্রায় সব সংবাদপত্র হয় ইহুদী মালিকানাধীন অথবা ইহুদী নিয়ন্ত্রিত। আর এসব সংবাদপত্র ইসরাইলের সমর্থক। এতসব সাংবাদিক ইসরাইলে কাজ করে শুধু ইসরাইলীদের দৃষ্টিকোন থেকে সংবাদ প্রচারের জন্য।’ লেখিকা গ্রেস হারসেলের এই মন্তব্য তার What Christians dorit know about Israil শীর্ষক প্রবন্ধে ছাপা হয়। গ্রেস হারসেলের এই বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফোর্থ ষ্টেট’ অর্থাৎ মিডিয়া জগতকে যে অক্টোপাশের হাতে বন্দী দেখা গেছে, সেই অক্টোপাশই সেদিন হোয়াইট হাউজ ও পার্লামেন্টকে পুতুলে পরিণত করেছিল। এই অক্টোপাশ ইহুদী লবী এবং সরকার, সিনেট ও প্রশাসনে কর্মরত তাদের অনুগতরা এবং নব্যঔপনিবেশিক যুদ্ধবাজ এক গ্রুপ নিয়ে গঠিত ছিল বলে আমি মনে করি। এই অক্টোপাশই সেদিন টুইনটাওয়ার ধ্বংস করে তার দায় মুসলিম মৌলবাদী পরিচয়ের অদৃশ্য এক গ্রুপের ঘাড়ে চাপিয়ে পৃথিবীর সম্পদ, শক্তিকেন্দ্র দখল করার জন্যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবারিত সুযোগ করে নিয়েছিল। আমার কথা এ পর্যন্তই। এই কাজ সেদিন তারা কিভাবে করেছিল, সেটা আপনি বলবেন।’ থামল আহমদ মুসা।
ড. হাইম হাইকেল চোখ বুজে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। দেখছি, কোন দিক দিয়েই তুমি কারও পেছনে নও। সব দিকেই তোমার চোখ আছে। জটিল একটা বিষয়কে সরল অবয়বে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ। এখন তুমি একটা মডেল দাঁড় করাও যে ধরনের ছবি তুমি আঁকলে, তারা কিভাবে ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।’
‘এ ব্যাপারে নতুন কথা নেই। যে সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তাই আমি বলতে পারি।’
বলে একটু থামল। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘আমার বিশ্বাস সিভিল এয়ার লাইনার বিমান টুইন টাওয়ারে আঘাত করেনি, আঘাত করানো হয়েছে। হয় মার্কিনী বিমান গ্লোব হক’-এর বিমান হাইজ্যাক-এর অপ্রতিরোধ্য টেকনলজি কিংবা টুইনটাওয়ারে রিমোর্ট কনট্রোল ব্যবস্থা সিভিল এয়ার লাইনের বিমানকে টুইনটাওয়ারে টেনে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত ঃ বিমান হামলায় টুইনটাওয়ার ধ্বংস হয়নি। বিল্ডিং এক্সপার্টদের যেমন, তেমনি আমারও বিশ্বাস, টুইনটাওয়ারের বটমে বিশেষ বিস্ফোরক পাতা হয়েছিল। তৃতীয়ত ঃ টুইনটাওয়ার আক্রমণকারী কোন বিমানই হাইজ্যাক হয়নি। বিমানের যাত্রী ও ক্লুরা বুঝতেই পারেনি বিমানের কি হয়েছে, কোথায় যাচ্ছে। বিমানের কম্যুনিকেশন নেটওয়ার্ক নষ্ট করার কারণে বিমান বন্দরের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারেনি। বিমানের ব্ল্যাকবক্স থেকে এর সাক্ষী পাওয়া যাবে বলে ব্ল্যাক বক্স গায়েব করা হয়। চতুর্থত ঃ বিমান হাইজ্যাক ও টুইনটাওয়ার ধ্বংসের জন্যে যে ১৫ জন মুসলমানকে দায়ী করা হয়েছে, তারা বিমানে থাকলেও তারা নির্দোষ যাত্রী ছিল মাত্র। এরা ছিল এফ.বি.আই অথবা ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপের রিক্রুট। মিডিলইষ্ট, আফগানিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বকে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সাথে জড়াবার জন্যে এদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলিম নামের অনেক মানুষকে তারা এ ধরনের কাজের জন্যে তৈরি করা রেখেছে।’ থামল আহমদ মুসা।
গ্লাস থেকে একটু পানি খেল ড. হাইম হাইকেল। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তুমি অনেক ব্যাপারে অনেক কথা বলেছো। কিন্তু সব ব্যাপারে আমি বলতে পারবো না। কারণ ষড়যন্ত্রটা ছিল বেশ কয়েকভাগে বিভক্ত। একটার সাথে আরেকটার কোন প্রকার সম্পর্ক ছিল না। যারা বিমানের দায়িত্বে ছিল, তাদের কাজ ছিল টাওয়ার আঘাতকারী বিমান এবং এই বিমানকে টাওয়ারের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে টেনে নেবার জন্যে ‘গ্লোব হক’ বিমানের ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে টুইনটাওয়ারের দায়িত্ব যাদের ছিল, তাদের কাজ ছিল তিনটি। এক. টুইনটাওয়ারের আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঠিক সময়ে ‘সেফ ডেমোলিশন ডেভাইস’ (SDD)-এর বিস্ফোরণ ঘটানো, দুই. টাওয়ারে আঘাতকারী বিমান যখন এক মাইলের মধ্যে আসবে তখন টুইনটাওয়ারে বসানো বাড়তি চুম্বকীয় রিমোট কনট্রোল ব্যবস্থাকে সক্রিয় করা যাতে টুইনটাওয়ারে আঘাত নিশ্চিত হয় এবং তিন. টুইনটাওয়ারে আঘাত-পরবর্তী সময়ে বিমানের ব্ল্যাকবক্সসহ নেগেটিভ ডকুমেন্ট গায়েব করা, জাল ডকুমেন্ট ছড়িয়ে রাখা। আর যারা ‘গিনিপিগ’ -এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল, তাদের কাজ ছিল ‘গিনিপিগ’দের নাম নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট এয়ার লাইনসের যাত্রী তালিকায় সন্নিবেশিত করা এবং টুইনটাওয়ারের ঘটনায় তাদের মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রকাশ পাবার পর এদের হত্যা করা ও গায়েব করে ফেলা। এই তিনটি বিভাগ ছাড়াও……………।’
আহমদ মুসা ড. হাইম হাইকেলের কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘গিনিপিগ’ বলতে কাদের বুঝিয়েছেন? কথিত বিমান হাইজ্যাককারী মুসলমানদের?’
‘হ্যাঁ, আহমদ মুসা।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ স্যার। গত ২০ বছরে তাদের ক্ষেত্রে কেউ এই ‘গিনিপিগ’ শব্দ ব্যবহার করেনি। আপনিই মাত্র হতভাগ্যদের সঠিক অবস্থা তুলে ধরেছেন এই ‘গিনিপিগ’ শব্দ দ্বারা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। স্যরি, কথার মাঝখানে কথা বলার জন্যে। বলুন স্যার।’
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ষড়যন্ত্রের যে তিনটি গ্রুপের কথা বলেছি, তা ছাড়াও ছিল আরেকটা গ্রুপ। এর নাম ‘মিডিয়া গ্রুপ’। যার কাজ ছিল আমেরিকান এবং আমেরিকায় কার্যরত বিদেশী, বিশেষ করে ইউরোপীয় ও অষ্ট্রেলিয়ান মিডিয়াম্যানদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করা এবং টাওয়ার ধ্বংসের পরপরই তাদের মাধ্যমে পরিকল্পিত নিউজ প্রচারের ব্যবস্থা করা। এই গ্রুপেরই আরেকটা বড় কাজ ছিল প্রশাসন, সরকার ও পার্লামেন্টের যে সব দায়িত্বশীল লোক অবাঞ্জিত, বেফাঁস বা বৈরি কথা বলতে পারে তাদের কাছে ভুয়া তথ্য সরবরাহসহ সবরকম পন্থা প্রয়োগ করে তাদের মুখ বন্ধ রাখা বা বাঞ্জিত কথা আদায় করা।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
‘কিন্তু স্যার, এই সব ভাগ বা গ্রুপ মিলে যে দল তার নাম তো বলেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দলের কোন নাম ছিল না। ইসরাইল সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ, আমেরিকার ইহুদীবাদী লবীর কেন্দ্রীয় একটা গ্রুপ এবং আমেরিকার সরকার, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও পার্লামেন্টে তাদের অনুগতদের সমন্বয়ে গড়া ছিল এই দল। তবে তাদের ষড়যন্ত্র-কর্মসূচীর একটা নাম ছিল। নামটা হলো, ‘অপারেশন মেগা ফরচুন’ সংক্ষেপে OMF । তাদের অপারেশন সংক্রান্ত সব দলিলে সংক্ষিপ্ত ‘OMF’ নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের এই অপারেশনের নাম অনুসারে তাদের আমরা ‘অপারেশন মেগা ফরচুন গ্রুপ’ ‘OMF Group’ নামকরণ করতে পারি।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
‘তারপর স্যার।’ তাকিদ আহমদ মুসার।
‘তারপর তোমার জানার বিষয়টা কি?’ ড. হাইম হাইকেলের জিজ্ঞাসা।
‘অপারেশনের বিবরণ এবং তাদের অপরাধ প্রমাণ করার উপায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলেছি আহমদ মুসা, অপারেশন কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। আমার ভাগের বিবরণই আমার জানা।’ বলে একটু থামল ড. হাইম হাইকেল। মাথা নিচু করে একটু ভাবল বোধ হয়। তারপর মুখ তুলে কথা শুরু করল, ‘আমি যাদের ‘গিনিপিগ’ বলেছি, তাদের দায়িত্বে আমি ছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, শতশত মুসলিম নামের মানুষ ওদের হাতে রয়েছে, তাদেরকে সুবিধামত ব্যবহার করে ওরা মুসলমানদের ফাঁসাবার জন্যে। তুমি যেটা জান না সেটা হলো, বিশেষ করে আরব বিশ্ব ও আফ্রিকা থেকে সংগৃহীত হতাশ ও ভোগ-পাগল মুসলিম যুবকদের রিক্রুট করে এদের ব্রেনওয়াশ করা হয়েছে। এদেরকে পুতুলের মত কাজে লাগানো হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এরা উপকরণ হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরদ্ধে যুদ্ধ জিইয়ে রাখার জন্যে সন্ত্রাস সৃষ্টির প্রয়োজনে এদেরকেও ব্যবহার করা হয়েছে। আমার হাতে যাদের অর্পণ করা হয়েছিল, তারাই এদের কয়েকজন। এদের সংখ্যা ছিল উনিশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের প্রয়োজন চৌদ্দ জনের। সতর্কতার জন্যে ছয়জন বাড়তি লোক আনা হয়েছিল। ১৯ জনের প্রত্যেককেই আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল স্বাধীনভাবে একটা সেট প্রোগ্রাম দিয়ে। কিন্তু তারা ছিল অদৃশ্য পাহারার অধীনে। এদের সবার জন্যে টিকিট করা হয় এবং বোর্ডিং কার্ড নেয়া হয়। কিন্তু এরা কেউ বিমানে ওঠেনি। বিশেষ ব্যবস্থায় এদের ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। টাওয়ার ধ্বংসের পর এয়ারলাইন্স প্রথমে যে যাত্রী তালিকা দেয় তা বিমানে উঠা যাত্রীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বোর্ডিং কার্ডের কাউন্টার পার্টের ভিত্তিতে। পরে আমাদের ‘মিডিয়া টিম’-এর হস্তক্ষেপে এয়ারলাইন্স তাদের তালিকা সংশোধন করে বোর্ডিং কার্ড ইস্যুর ভিত্তিতে নতুন তালিকা প্রকাশ করে। যাতে আমাদের ‘গিনিপিগ’দেরও নাম এসে যায়।’
থামল ড. হাইম হাইকেল। সোজা হয়ে বসে কয়েক ঢোক পানি খেল। বলতে শুরু করল আবার, ‘ওদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে বের করে এনে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী একটা কনটেইনারে তোলা হয়। তারপর শুরু হয় সোয়া তিনশ মাইলের দীর্ঘ পথ যাত্রা। যাত্রার লক্ষ্য বোষ্টনের উত্তর-পূর্বে মাউন্ট মার্সি এলাকার দুর্গম রেডইন্ডিয়ান বসতি। মাউন্ট মার্সি পর্বতটি অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার উত্তর অংশের পশ্চিম ঢালে অবস্থিত। মাউন্ট মার্সির দক্ষিণ দিক অ্যাডিরমডাক পর্বতমালায় ঘেরা। আর পশ্চিমে মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে লেক অনটারিও এবং কানাডা সীমান্ত। লেক অনটারিও ও কানাডা সীমান্ত পশ্চিম দিক হয়ে উত্তর দিক ঘুরে অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালায় গিয়ে মিশেছে। এই বিচ্ছিন্ন, দূর্গম অঞ্চলে মাউন্ট মার্সির পশ্চিম পাদদেশে ঘনবনাকীর্ণ এক সবুজ উপত্যকা। এই উপত্যকা রেডইন্ডিয়ানদের জন্যে নির্দিষ্ট একটা স্থান। ঔপনিবেশিক বৃটিশদের সাথে ১৬৭৫-৭৬ সালে সংঘটিত বিখ্যাত ‘কিলফিলিপ যুদ্ধে’ পরাজিত ও বিতাড়িত রেডইন্ডিয়ানদের একটা ক্ষুদ্র অংশ চিড়িয়াখানার মত এই উপত্যকায় বাস করে। আমাদের টার্গেট ছিল এই রেডইন্ডিয়ানদের গোরস্থানের লাগোয়া পূর্ব নির্দিষ্ট একটা জায়গা। ভূ-তাত্বিক কর্মীর ছদ্মবেশে আমাদের লোকরা এখানে আগে থেকেই একটা গর্ত করে রেখেছিল। রাতের অন্ধকারে এখানেই পৌছা আমাদের লক্ষ্য। অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার উত্তরাংশের মাউন্ট মার্সি বরাবর পৌছে সড়ক থেকে আমাদের গাড়ি রাস্তার চিহ্নহীন পাথুরে ভূমিতে নেমে যায়। তারপর পাহাড়ের উপত্যকা, সুড়ঙ্গ ধরে ২০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি পৌছল রেডইন্ডিয়ানদের সেই গোরস্থানের কাছে। দিনটা ছিল ইন্ডিয়ানদের বাৎসরিক সম্মিলিত প্রার্থনা দিবস। রেডইন্ডিয়ান বসতির ওয়ান টু অল গিয়ে জড়ো হয়েছে তাদের সর্দারের বাড়িতে। এই সুযোগ নেয়অর জন্যেই দিনটা আমরা ঠিক করেছিলাম। গোরস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে আমাদের গাড়ি দাঁড়াবার পর রাতের জন্যে অপেক্ষা করা হয়। অপেক্ষাকালীন এই সময়েই কনটেইনারে বিশেষ এক ধরনের গ্যাস প্রয়োগ করে তাদের হত্যা করা হয়। তারপর রাতের অন্ধকারে রেডইন্ডিয়ানদের কবর লাগোয়া গর্তে ওদের গণকবর দিয়ে আমাদের গাড়ি ফিরে আসে বোষ্টনে। আমার দায়িত্বাধীন ভাগের কাজের এভাবেই ইতি হয়।’
থামল ড. হাইম হাইকেল। তার মুখ গম্ভীর। অপরাধ ও যন্ত্রণার কালো ছায়া তাতে।
‘আপনার মধ্যে এই অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া কবে শুরু হয়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তখন আমি ছিলাম কঠোর মনোভাবের এক ইহুদীবাদী কর্মী। আমি তখন মনে করতাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদী স্বার্থ রক্ষা ও গোটা দুনিয়ায় ইহুদী ইমেজ রক্ষা এবং ইহুদীদের উপর উদ্যত কৃপাণ সরিয়ে মুসলমানদের উপর ঘুরিয়ে দেবার জন্যে এই কাজের কোন বিকল্প নেই। নিরপরাধ লোকদের কন্টেইনারে তুলে নৃশংসভাবে হত্যা করা থেকেই আমার মনে প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে। এর সাথে যোগ হলো নিরপরাধ বিমানযাত্রীদের মর্মান্তিক মৃত্যু। কিন্তু এ সবের চেয়েও আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল সর্বব্যাপী সীমাহীন বীভৎস মিথ্যাচার এবং মিথ্যার উপর ভর করে মুসলিম নামের নিরপরাধ লাখো বনি আদমের উপর হত্যা, ধ্বংস ও দখল চাপিয়ে দেবার বিষয়টি। ‘অপারেশন মেগা ফরচুন’কে আমি আমার ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। পরে সব দেখে আমার মনে হলো আমরা আমাদের ধর্মকেই হত্যা করছি। আমার আরও মনে হলো, ইহুদীদের ‘হাসকালা’ ধর্মমত বৈষয়িক উন্নতি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদেরকে ধর্মহীন করে দিয়েছে। এই চিন্তা থেকেই ইহুদী বিশ্বাসের ‘হাসিডিক’ ধর্মমত আমি গ্রহণ করি। ‘হাসিডিক’ ধর্মমত ‘দয়া’ ও সানন্দ উপাসনার দিকেই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে বেশি। এই ধর্মমত গ্রহণের পরেই আমি মনের পাপ-যন্ত্রণা লাঘবের জন্যে সিনাগগে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে কনফেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমি মনে করছি, ঈশ্বর আমার কনফেশন গ্রহণ করেছেন। কনফেশনকে কেন্দ্র করে আমার যে দুঃখ-কষ্ট তা আমি মনে করছি ঈশ্বরেরই দেয়া আমার পাপ মোচনের জন্যে। সবশেষে তোমার আগমন, আমাকে উদ্ধার, আমার কাছে সাহায্য চাওয়া সবই ঈশ্বরই করাচ্ছেন। সুতরাং আমি তোমাকে সাহায্য করব, এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা।’
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ স্যার’, বলে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহৃত কজনকে কবর দেবার জন্যে অত দূরের স্থান বেছে নিলেন কেন?’
‘দুটি বিবেচনায় আমরা এটা করেছি। এক. রেডইন্ডিয়ানদের এই এলাকাটা দূর্গম ও নিরাপদ। কারও পক্ষে ওখানে যাওয়া এবং খোঁজ করা দুই-ই কঠিন। দুই. কোন কারণে সন্দেহ হলেও গণকবর খোড়াখুড়ি করা সম্ভব হবে না। রেডইন্ডিয়ানরা এটা করার কাউকে সুযোগ দেবে না। কারণ তারা সংগতভাবেই ভয় করবে গণকবর ও গণহত্যার সাথে ওদের সম্পর্কিত করার চেষ্টা করা হবে। দ্বিতীয়ত. এই খননকে তাদের গোরস্থানের শান্তি ও সম্মানের খেলাফ মনে করবে রেডইন্ডিয়ানরা।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
ড. হাইম হাইকেল থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ষড়যন্ত্রের আরও বিভাগ আছে বলেছেন আপনি। কিন্তু তাদের কাউকেই আপনি চেনেন না?’
‘হ্যাঁ অনেককেই চিনি। ইহুদী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কট্টর ইহুদীবাদী অধ্যাপক এবং একটি ঐতিহাসিক ইহুদী পরিবারের সন্তান হিসেবে ‘ও.এম.এফ গ্রুপ’ (OMF Group)-এর কাছে আমার বিশেষ একটা মর্যাদা ছিল। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনেকের কাছে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত হলেও অনেক কিছুই আমি শুনতাম ও জানার সুযোগ হতো।’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘তাহলে অন্যান্য গ্রুপের ব্যাপারেও আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার কি প্রয়োজন, কি জানতে চাও সেটা বললে বুঝা যাবে আমি ঐ বিষয় জানি কিনা।’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমার অনুসন্ধানের বিষয় হলো টাওয়ার ধ্বংসের কাজ কারা করেছে, তা বের করা এবং তার পক্ষে প্রমাণ যোগাড় করা। এখন দেখা যাচ্ছে ‘ও.এম.এফ গ্রুপ’ এটা করেছে। এই সত্যের পক্ষে আমি প্রমাণ যোগাড় করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথার তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না ড. হাইম হাইকেল। সে সোফায় গা এলিয়ে দিল। তার চোখে-মুখে ভাবনার প্রকাশ ঘটল। অল্পক্ষণ পর সোফা থেকে গা না তুলেই বলল, ‘আহমদ মুসা, এই বিষয়টা আমি কোনদিন চিন্তা করেই দেখিনি। ঘটনার বিবরণ বর্ণনা করা যায়, কিন্তু তা প্রমাণ করা কঠিন। ‘ও.এম.এফ গ্রুপ’ টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা ঘটিয়েছে, এই সত্য তোমার কথায় এসেছে, ঘটকদের একজন হিসাবে আমিও বলেছি, কিন্তু প্রমাণ করাটা বলার মত সহজ নয়।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
আহমদ মুসা গম্ভীর। সোজা হয়ে সোফায় বসল। বলল, ‘কিন্তু প্রমাণ করার মিশন নিয়েই আমি আমেরিকায় এসেছি। এ মিশন সম্পূর্ণ করেই আমি ফিরব ইনশাআল্লাহ।’
সোফায় সোজা হয়ে বসল ড. হাইম হাইকেল। তার ভ্রুকুঞ্চিত। ভাবছে সে মুখ নিচু করে। এক সময় মুখ তুলে বলল, ‘তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি আহমদ মুসা। তোমার কথা আমার মধ্যে সাহসের সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে, অসম্ভব বলে কিছুই নেই। কিন্তু আমার সামনে অথৈ অন্ধকার সমুদ্র, বাতিঘরের আলো কোথাও দেখি না।’
ভাবছিল আহমদ মুসাও। বলল, ‘স্যার, প্রমাণের বহু বিষয় আছে। কিন্তু অত কিছুর প্রয়োজন নেই। মৌলিক ধরনের কয়েকটা বড় বিষয় প্রমাণ করতে পারলেই আমাদের হয়ে যায়।’
‘সে বিষয়গুলো কি?’ জিজ্ঞাসা ড. হাইম হাইকেলের।
‘প্রথম বিষয় হলো, ষড়যন্ত্রের যে অংশটা আপনি সম্পাদন করেছেন, তা থেকে প্রমাণ করা যে, হাইজ্যাকাররা বিমান হাইজ্যাক করে তা দিয়ে টাওয়ার ধ্বংস করেছে, এ কথা মিথ্যা এবং কথিত হাইজ্যাকারদেরকে টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার ১২ ঘণ্টা পর হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত. প্রমাণ করা যে, হাইজ্যাকাররা নয়, ‘গ্লোব হক’ ও টুইনটাওয়ারে পাতা চুম্বকীয় রিমোট কনট্রোল ব্যবস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে যাত্রী বিমান টুইনটাওয়ারে আঘাত করতে সমর্থ হয়। তৃতীয়ত. টুইনটাওয়ার যাত্রী বিমান দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় ঠিকই, তবে টুইনটাওয়ার গুড়িয়ে ধ্বসে পড়ে টুইনটাওয়ারের গোড়ায় পাতা ‘সেফ ডেমোলিশ ডেভাইস’-এর বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে। এটা প্রমাণ করতে হবে। এই তিনটি বিষয়ের প্রমাণই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।’
ড. হাইম হাইকেল হা করে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাকে আহমদ মুসা। ঠিকই বলেছ তুমি। এখন আমার মনে হচ্ছে এই সহজ বিষয়টি আমার মাথায় আসেনি কেন?’
বলে ড. হাইম হাইকেল মুহূর্তের জন্যে একটু থামল। পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু প্রমাণ হওয়া এবং গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কাজ কিভাবে হবে? ধর প্রথমটার কথাই। গণকবরে যাদের হাড়গোড় আছে, তারাই ও.এম.এফ গ্রুপ কথিত বিমান হাইজ্যাককারী তা প্রমাণ করতে হবে। কিভাবে করবে? গোপনে ওখানে গিয়ে কবর থেকে হাড়গোড় তুলে আনা খুবই কঠিন। তার পরেও না হয় গেলে, হাড়গোড় তুললে, নিয়ে এলে, কার্বন টেষ্ট, ফরেনসিক টেষ্টসহ বিভিন্ন আইডেনটিফিকেশন টেষ্ট দ্বারা না হয় প্রমাণ করলে ওগুলোই সেই বহুল কথিত হাইজ্যাকারদের দেহ এবং ওদেরকে হত্যা করা হয়েছে গ্যাস প্রয়োগে (যে গ্যাস বিমানে থাকে না) আর হত্যার সেই ঘটনা ঘটেছে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ১২ ঘণ্টার পর। কিন্তু তোমার দাবীগুলো অথেনটিসিটি পাবে কিভাবে, দুনিয়ার মানুষ গ্রহণ করবে কেন?’
চিন্তা করছিল আহমদ মুসা। এক সময় তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ড. হাইম হাইকেল থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘স্যার আমি যা ভাবছি তা যদি আমি করতে পারি, তাহলে গণকবর আবিষ্কারের কথা গোটা দুনিয়া জানবে এবং তাদের ফরেনসিক টেষ্ট, দাঁত টেষ্ট, ইত্যাদি সব কিছুই গোটা দুনিয়াকে জানিয়েই করা হবে। অতএব বিশ্বাসযোগ্যতা না পাবার প্রশ্ন নেই।’
‘এই অসাধ্য সাধন কিভাবে সম্ভব?’ জিজ্ঞাসা ড. হাইম হাইকেলের।
‘আল্লাহর সাহায্য থাকলে সবই সম্ভব। আপনাকে সব বলব স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কথা শেষ করেই ড. হাইম হাইকেলের কিছু বলার আগেই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘স্যার, প্রমাণের দ্বিতীয় বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তায় আছি। এ ব্যাপারে আপনার সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখতে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।’
আহমদ মুসার কথা ড. হাইম হাইকেল মনোযোগ দিয়ে শুনল। কিন্তু কোন উত্তর দিল না। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ভাবছে সে। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলল। বলল, ‘প্রমাণের জন্য অন্তত প্রয়োজন ঐ দিন ঐ কাজে ‘গ্লোব হক’-এর ‘অফিসিয়াল লগ’ ও ‘অর্ডার শীট’ উদ্ধার করা। আর…………।’
ড. হাইম হাইকেলের কথা মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘এ ‘লগ’ ও ‘অর্ডার শীট’ কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘দৃশ্যত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘এয়ার সেফটি সার্ভিস’ (ASS) ডিভিশনে এটা থাকার কথা। কিন্তু আমি বিষয়টা সম্পর্কে নিশ্চিত নই।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল, ‘টাওয়ার ধ্বংসে ‘সেফ ডেমোলিশন ডেভাইস’ যে ব্যবহার হয়েছিল, সেটা প্রমাণ করার জন্যে ধ্বংস টাওয়ারের ডাষ্ট-এর বিশেষ ধরনের পরীক্ষা প্রয়োজন।’
‘কিন্তু ধ্বংস টাওয়ারের ডাষ্ট এখন এত বছর পর কোথায় পাওয়া যাবে? টুইনটাওয়ারের জায়গায় তো নতুন টাওয়ার গড়ে তুলে ঐ এলাকা ঢেকে ফেলা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিউইয়র্কের তিনটি প্রতিষ্ঠানে এই ডাষ্ট পাওয়া যাবে। ইন্টারন্যাশনাল টেরর মিউজিয়াম (ITM), ‘বিল্ডিং হিষ্টরী মিউজিয়াম’ (BHM) এবং ধ্বংস টাওয়ারের স্থানে নির্মিত নতুন টাওয়ার কমপ্লেক্সের ‘লিভিং মেমরি ল্যাবরেটরী’তে পাওয়া যাবে।’ কিন্তু এই ডাষ্ট পাউডারটাই বড় কথা নয়, এর প্রামাণ্য টেষ্ট রেজাল্ট প্রয়োজন।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ স্যার আপনার দেয়া তথ্যগুলো অমূল্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি অমূল্য বলছ। তুমি চেষ্টা করলেও এ তথ্যগুলো যোগাড় করতে পারতে। আসলেই তোমাকে সাহায্য করার মত তেমন কিছু আমার কাছে নেই।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘বলেন কি স্যার! আপনার প্রধান যে তথ্যের জন্য এসেছিলাম তা পেয়ে গেছি। তথাকথিত বিমান হাইজ্যাকারদের সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, এই একটা তথ্যই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। শুধু একেই যদি আমরা সত্য প্রমাণ করতে পারি, তাহলে মুসলমানদের কপাল থেকে সন্ত্রাসী হওয়ার কলংক তিলক মুছে ফেলা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু ‘ও.এম.এফ গ্রুপ’-এর সর্বব্যাপী ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতে হলে গোটা ষড়যন্ত্রকেই দিনের আলোতে আনতে হবে এবং এটা তুমিই পারবে আহমদ মুসা। আমেরিকান জনগণও তোমার কাছে আরও বেশি কৃতজ্ঞ হবে। তুমি আগেও তাদের অমূল্য উপকার করেছ। এই উপকার যদি তুমি করতে পার, তাহলে আমেরিকান জনগণ পুরোপুরিই মুক্ত হবে কুগ্রহের কবল থেকে।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
এ কথাগুলোর খুব অল্পই আহমদ মুসার কানে প্রবেশ করেছে। আহমদ মুসা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার মোবাইল নিয়ে।
ড. হাইম হাইকেল থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘এক্সকিউজ মি স্যার, আমি কয়েকটি টেলিফোন করে নিতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা প্রথমে টেলিফোন করল কামাল সুলাইমানকে জার্মানীতে। বলল, ‘কামাল জার্মানীর ‘মিউজিয়াম অব ওয়ার্ল্ড ইভেন্টস’-এর প্রেসিডেন্ট মি. ব্রেম্যান তোমার বন্ধু, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ ওপার থেকে বলল কামাল সুলাইমান।
‘তুমি মিউজিয়ামের তরফ থেকে মি. ব্রেম্যানের একটি করে চিঠি নিয়ে এস নিউইয়র্কের ‘ইন্টারন্যাশনাল টেরর মিউজিয়াম’-এর প্রেসিডেন্ট, ‘বিল্ডিং হিষ্ট্রি মিউজিয়াম’-এর প্রেসিডেন্ট এবং গ্রাউন্ড ফরচুন’-এর নতুন টাওয়ার কমপ্লেক্সের ‘লিভিং মেমরী ল্যাবরেটরী’-এর ডিরেক্টরের নামে। এই পৃথক পৃথক চিঠিতে মিউজিয়ামের তরফ থেকে লিখতে হবে মিউজিয়ামের রেকর্ড ও প্রদর্শনী বস্তু হিসাবে পৃথক দু’প্যাকেটে ৫ গ্রাম করে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ডাষ্ট ডোনেট করার জন্যে। তিনটি চিঠি নিয়ে মিউজিয়ামের প্রতিনিধি হিসাবে তোমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিউইয়র্ক আসতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি ভাইয়া। আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। ড. মুর হ্যামিল্টনের সাথে আসল কথাটা হয়েছে?’ ওপার থেকে বলল কামাল সুলাইমান।
‘হ্যাঁ। তার প্রেক্ষিতেই তো এ জিনিসগুলোর প্রয়োজন। কথা শেষ। এস। আস্সালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে নতুন আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করল।
ডায়াল করল ইলিনয় ষ্টেটের রেডইন্ডিয়ান রিজার্ভ কাহোকিয়ার অধ্যাপক আরাপাহোর কাছে।
ওপার থেকে প্রফেসর আরাপাহোর কণ্ঠ শুনেই আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
প্রফেসর আরাপাহো আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘তোমাকে চিনব না? তোমার কণ্ঠের একটা শব্দ কানে আসাই যথেষ্ট তোমাকে চেনার জন্যে। কেমন আছ তুমি? কেমন আছে বউমা? তুমি কি আমেরিকায়? না আমেরিকার বাইরে? তুমি আজোরাস আইল্যান্ডে এসেছ তা জানিয়েছ। তারপর আর কোন খবর জানি না।’
‘আমরা সবাই ভাল আছি জনাব। আমি নিউইয়র্ক থেকে বলছি। ওগলালা বোধ হয় কাহোকিয়ায়। কেমন আছে সে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওগলালা আমার পাশে বসে। টেলিফোনটা নেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে। তাকে দেব টেলিফোন। তবে তার আগে তোমার কথা শুনি। নিউইয়র্কে কোন কাজে এসেছ নিশ্চয়?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘জি, কাজ নিয়ে এসেছি এবং আপনার সাহায্য চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ তোমাকে এজন্যে যে, আমার কথা তুমি চিন্তা করেছ। বল তোমার কি প্রয়োজন, আমার সব কিছু তোমার জন্যে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলে একটু থামল। তারপর বলল, ‘আপনার কাছে মাউন্ট মার্সি’র ইন্ডিয়ান রিজার্ভ-এর কথা শুনেছিলাম।’
‘হ্যাঁ শুনেছিলে। কি হয়েছে? হঠাৎ একথা তুলছ কেন?’
‘মাউন্ট মার্সি’র ইন্ডিয়ান রিজার্ভ-এর সাথে আপনার পরিচয় কেমন স্যার?’
‘ভাল। ওখানে এক অনুসন্ধান কাজে আমি তিনমাস ছিলাম। তাছাড়াও বেশ কয়েকবার গেছি আমি সেখানে।’
‘স্যার আপনাকে আবার এক অনুসন্ধানে যেতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা সোৎসাহে।
‘আমাকে যেতে হবে এক অনুসন্ধানে? অনুসন্ধানটা তোমার এবং সেটা খুব বড় বিষয় হবে নিশ্চয়? কারণ তোমার হাতযশ বড় বিষয়কেই সব সময় টানে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো। তার কণ্ঠে আনন্দের সুর।
‘ঠিক ধরেছেন স্যঅর, সেটা হবে আমার অনুসন্ধান এবং তা বড় বিষয়ও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার যদি বিষয় হয়,তাহলে আমি একবার নয় একশ’বার যেতে রাজি আছি। কারণ তোমার বিষয় মানেই হলো মানুষের কোন কল্যানের কাজ, এখন বল কবে যেতে হবে?’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘এক সপ্তাহ পর যে কোন দিন আপনার সুবিধা অনুসারে। আমিও আপনার সাথী হতে চাই।’
‘তুমিও যাবে? চমৎকার। দিনগুলো তাহলে তো উৎসবের হবে। তাহলে সপ্তাহ পর দিন ঠিক করে তোমাকে জানাব। কিন্তু কাজটা কি বললে না তো?’
‘সাক্ষাতে ছাড়া বলা যাবে না। তবে আপনাকে মাউন্ট মার্সি’র রেডইন্ডিয়ান রিজার্ভে যেতে হবে প্রতœতাত্বিক অনুসন্ধানের এক মিশন নিয়ে, যাতে স্বাভাবিকভাবে খোঁড়া-খুঁড়িরও প্রোগ্রাম থাকবে। সেখানকার সবার এটা জানা উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে। আমি বুঝেছি। তোমার কাজ যাই হোক, কাজের প্রকৃতি বুঝেছি। আমি আজই মাউন্ট মার্সি’র কমিউনিটি সরদারকে লিখে জানাচ্ছি যে, আমার গবেষণার প্রয়োজনে কিছু প্রতœতাত্বিক অনুসন্ধানের জন্যে আমি আমার কয়েকজন লোককে নিয়ে মাউন্ট মার্সিতে আসছি।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।’
‘ওয়েলকাম। রাখলাম। ওয়াস্সালাম।’
আহমদ মুসা ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলতেই ওপার থেকে লাইনটা কট করে কেটে গেল।
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে ওয়াশিংটনে ডায়াল করল ঈগল সান ওয়াকারের কাছে।
ওপার থেকে সান ওয়াকারের কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম, সান ওয়াকার। চিনতে পেরেছ?’
ওপার থেকে সান ওয়াকার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘চিনব না মানে? আপনি……।’
সান ওয়াকারকে কথা সমাপ্ত করতে না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘থাক, নাম শুনতে চাই না তোমার কাছ থেকে। বল কেমন আছ? মেরি রোজ কেমন আছে?’
‘ভাল আমরা আহ…….।’ কথা শেষ করতে পারলো না সান ওয়াকার।
আহমদ মুসা আবার তাকে থামিয়ে দিল। বলল, ‘থাক বড়দের নাম নিতে নেই। শোন, মাউন্ট মার্সি’র রেডইন্ডিয়ান রিজার্ভে তোমার একটা ফ্রেন্ড ছিল না?’
‘ছিল নয়, আছে। সান ইয়াজুনো।’ বলল সান ওয়াকার ওপাশ থেকে।
‘সে এখন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘মাউন্ট মার্সিতে। সে মাউন্ট মার্সির রেডইন্ডিয়ান রিজার্ভের ফেডারেল কমিশনারের অফিসে চাকুরি করে। সেখানকার সিভিল এ্যাফেয়ার্স অফিসার সে। কিন্তু ভাইয়া হঠাৎ তাকে মনে পড়ল কেন?’ সান ওয়াকারের কণ্ঠ শেষ দিকে গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
‘সান ওয়াকার, তুমি কি তোমার বন্ধুর সাথে দেখা করবে?’ বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর এল না সান ওয়াকারের কাছ থেকে। একটু পর ওপ্রান্ত থেকে সে বলে উঠল, ‘ব্যাপার কি বলুন তো ভাইয়া। অন্য কেউ এমন কথা বললে রসিকতা মনে করতাম। কিন্তু আপনার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণের মূল্য আছে। আমার ভয় হচ্ছে বড় কিছু ঘটেছে কিনা!’
‘ঘটনা বড় সান ওয়াকার, কিন্তু তোমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তোমাকে আগামী সপ্তাহে সান ইয়াজুনোর ওখানে যেতে হবে। আমিও সে সময় ওখানে থাকব। ভয় করো না সান ইয়াজুনোর সাথে এ ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। তুমি ওখানে যাবে মাত্র। বলবে প্রতœতাত্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে তুমি ওখানে যাচ্ছ। ওখানে গিয়েই সব তোমাকে বলব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি ভাইয়া। ঠিক আছে। কবে যাচ্ছি আপনাকে জানাব। মাফ করবেন ভাইয়া, আমি কিন্তু ইচ্ছা করেই আপনার সাথে যোগাযোগ করিনি।’ বলল সান ওয়াকার।
‘জানি। কিন্তু তুমি কি জান আমার টেলিফোন নাম্বার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঘটনাক্রমে জেনে গেছি ভাইয়া। সেদিন এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়কে বিদায় জানাতে। লাউঞ্জে দেখা হলো সারা জেফারসন আপার সাথে। তিনি ইউরোপ যাচ্ছিলেন। ক’মিনিট কথা হয়েছিল লাউঞ্জে বসে তার সাথে। তিনিই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমরা তাঁর খবর রাখ?’ আমি বলেছিলাম, তিনি এসেছেন, কিন্তু ওয়াশিংটনে আসেননি। আমি যোগাযোগের সুযোগ পাইনি।’ আমার কথার পর তিনি আমাকে একটা নাম্বার দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর সাথে যোগাযোগ রেখ। তার নিজের প্রয়োজন তিনি জানান না, জানতে হয়।’ টেলিফোন নাম্বার পেলেও আমি যোগাযোগ করতে সাহস পাইনি ভাইয়া।’ বলল সান ওয়াকার।
‘সারা তোমাকে নাম্বার দিয়েছে? কিভাবে পেল? যেদিন সকালে সে ইউরোপ গেছে, তার আগের রাতে মাত্র আমি টেলিফোনের নতুন সেট পেয়েছি! এ নাম্বার তো তার জানার কথা নয়। বলত নাম্বারটা?’ আহমদ মুসা বলল।
নাম্বারটা নিয়ে দেখল তার টেলিফোনেরই নাম্বার। ভাবল আহমদ মুসা, নাম্বারটা নিশ্চয়ই এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন সারাকে দিয়েছে। বলল আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে, ‘ঠিক আছে সান ওয়াকার। তাহলে এই কথা থাকল, তুমি যাওয়ার আগে টেলিফোন করছ। আসি। আস্সালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়েই ফিরল ড. হাইম হাইকেলের দিকে। বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, আর একটা কল করব।’
‘আহমদ মুসা তুমি যা করছ, তাতে শত কল করলেও শোনার প্রতি আগ্রহ আমার উত্তরোত্তর বাড়বে। আমি বুঝতে পারছি না এত পরিকল্পনা তুমি কখন করলে? এইমাত্র তো আমার কাছে ঘটনা শুনলে!’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়নি। আপনার দেয়া সুনির্দিষ্ট তথ্যগুলোই এ কাজগুলোকে টেনে নিয়ে এসেছে। ধন্যবাদ স্যার।’ বলেই আহমদ মুসা তার মোবাইলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
মোবাইলের ডিজিটাল প্যানেলে কয়েকটা অংকে নক করল। সংগে সংগেই ওপার থেকে একটা ভারি কণ্ঠ ভেসে এল, ‘বল, জোসেফ জন, নিশ্চয় ড. হ্যামিল্টনের সাথে তোমার কথা হয়ে গেছে?’
‘জি জনাব। কথা হয়েছে, কিন্তু ইতি হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে না পৌছে তো তুমি আমাকে টেলিফোন করনি!’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল ওপার থেকে।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা দুজন বসে এখনও কথা বলছি। কথার মাঝখানেই কয়েকটা টেলিফোন করলাম। শেষ টেলিফোনটা আপনাকে করেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। তুমি দ্রুত আগাচ্ছ। এটাই দরকার। আমার কেমন সহযোগিতা দরকার বল।’ এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘কয়েকটা জিজ্ঞাসা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘সেফ এয়ার সার্ভিসেস (SAS) কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এর সদর দফতর কোথায়? ‘সেফ এয়ার সার্ভিসেস’-লগ রাখার দায়িত্ব কার?’ প্রশ্ন কয়েকটা করে থামল আহমদ মুসা।
ওপার থেকে জর্জ আব্রাহামের উত্তর আসতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হলো। একটু সময় পর ওপার থেকে ভেসে এল জর্জ আব্রাহামের কণ্ঠ, ‘আরেকটা প্রশ্ন তোমার বাদ পড়েছে। সেটা হলো, ওল্ড লগগুলো রক্ষার রীতি-বিধান কি? তাই কিনা জোসেফ জন?’
‘ধন্যবাদ জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়েলকাম, জোসেফ জন। উত্তরের জন্যে আমাকে ভাবতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে উত্তরগুলো তোমার হাতে পৌছে যাবে। আর কোন বিষয়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ জনাব, আপাতত এ পর্যন্তই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শোন জোসেফ জন, তুমি তোমার প্রজেক্টের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছ। তোমাকে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার সিলেকশন আগে করতে হবে। তারপর প্রথম কাজ প্রথমে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ জনাব। বুঝেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওকে। রাখলাম। বাই।’ ওপার থেকে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা তার মোবাইলের কল অফ করে দিল এবং ফিরে বসল ড. হাইম হাইকেলের দিকে।
আহমদ মুসা তার দিকে ফিরতেই ড. হাইম হাইকেল বলল, ‘তাহলে আগামী সপ্তাহেই মাউন্ট মার্সিতে যাচ্ছ? যাদের সাথে নিচ্ছ তারা বিশ্বস্ত? প্রফেসর আরাপাহো ও সান ওয়াকার দুজনেরই নাম আমি শুনেছি। তোমার বাছাই ঠিক। রেডইন্ডিয়ানরা সাথে থাকলে ওদের সোসাইটিতে মেশবার সুবিধা পাবে তুমি। ঈশ্বর তোমাকে সফর করুন। তবে ধ্বংস টাওয়ারের ডাষ্ট সংগ্রহের কৌশল তোমার চমৎকার হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে SAS এর লগ পাওয়াটাই তোমার জন্যে কঠিন হবে। তবে ঈশ্বর তোমার প্রতি খুব সদয়। তোমার কয়েকটা টেলিফোনই প্রমাণ করে ঈশ্বর যেন তোমাকে হাত ধরে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। গড ব্লেস ইউ মাই বয়।’
ড. হাইম হাইকেল থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আমি এখন উঠতে চাই।’
‘অবশ্যই। কিন্তু আরেকটা কথা শোন। তুমি খুবই হুশিয়ার, তবু বলি। যাকে আমরা ‘অপারেশন মেগা ফরচুন গ্রুপ’ (OMF-Group) বলছি, তারা কিন্তু ছড়িয়ে আছে সবখানে। আমাদের পুলিশ, এফ.বি.আই এবং সি.আই.এ’র মধ্যে মনে করা হয় প্রতি দুজনের একজন লোক ওদের। কথাটার মধ্যে খুব অতিরঞ্জন আছে বলে আমি মনে করি না।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘ব্যাপারটা আমিও জানি স্যার, কিন্তু আপনার দেয়া অংকটা উদ্বেগজনক।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তার মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ বুলাতেই দেখল জর্জ আব্রাহাম জনসনের নাম্বার। কি ব্যাপার তাঁর টেলিফোন কেন? এক ঘণ্টার মধ্যে উত্তর আমার হাতে পৌছে দিয়ে তারপর টেলিফোন করার কথা। আহমদ মুসা মোবাইল তুলে নিয়ে ‘গুড ইভিনিং স্যার’ বলে সাড়া দিতেই ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন ‘গুড ইভিনিং’ জানিয়ে বলল, ‘তোমার ঘড়িতে এখন সময় কত?’
‘ঠিক সাড়ে তিনটা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে তোমার ঘড়ি। শোন, এখন থেকে ঠিক আধা ঘণ্টার মাথায় তুমি গাড়ি নিয়ে ফিলোসফিক্যাল হলের উত্তর পার্শ্বের রোড সাইড কার পার্কিং-এর ১৫০০ নাম্বার পার্কিং ষ্ট্যান্ডে তোমার গাড়ি দাঁড় করাবে এবং গাড়িতেই বসে থাকবে। ঠিক পাঁচ মিনিট পর, একটা লাল গাড়ি এসে তোমার গাড়ির বাম পাশে দাঁড়াবে। গাড়ি দাঁড় করিয়েই গাড়ির ড্রাইভার থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তোমাকে ‘হ্যাল্লো মি. জে জে’ বলে সম্বোধন করে ছুটে এসে একান্ত বন্ধুর মত তোমার গাড়িতে উঠবে। তোমাকে প্রায় অদৃশ্য JAJ জলছাপ ওয়ালা নাম ঠিকানাবিহীন একটা সাদা বন্ধ ইনভেলাপ দেবে। তারপর কিছু কথা বলে সে বেরিয়ে যাবে। তুমি চলে আসবে। আর শোন তোমার গাড়ির নাম্বার প্লেট চেঞ্জ করে ওখানে যাবে। নাম্বার প্লেট তোমার রুমের খাটের নিচে পাবে। ওকে। কথা শেষ। রেখে দিলাম। বাই।’
ওপ্রান্ত থেকে লাইন কেটে দিল আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই।
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে ড. হাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসি স্যার। আমাকে এখনই একটু বাইরে বেরুতে হবে।’
‘উইশ ইউ গুডলাক।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ড. হাইম হাইকেলের কক্ষ থেকে।

আহমদ মুসা ১৫০০ নাম্বার কার পার্কিং ষ্টান্ডে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করছে।
এ রোড সাইড কার পার্কিংটা ফিলোসফিক্যাল হল থেকে পঞ্চাশ গজের মত দূরে হবে। সোজা মাথার সামনে একটা ছোট বাগান। প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরটা ফিলোসফিক্যাল হলকেও বেষ্টন করেছে। বাগানটা হলেরই অংশ বুঝল আহমদ মুসা।
পার্কিং-এর পার্ক ষ্টান্ড আছে ৭টা। সবগুলোই শূন্য। একটি মাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে, সেটা আহমদ মুসার।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় একটা লাল গাড়ি এসে পার্ক করল আহমদ মুসার গাড়ির বাম পাশে।
গাড়ির জানালা পথে আহমদ মুসা দেখতে পেল শক্ত ও লম্বা গড়নের এক বুদ্ধিদীপ্ত যুবককে।
গাড়ি দাঁড়াতেই যুবকটি তাকাল আহমদ মুসার গাড়ির দিকে। চোখা-চোখি হয়ে গেল আহমদ মুসার সাথে। যুবকটির চোখে ছিল অনুসন্ধানী দৃষ্টি এবং সেই সাথে প্রথম দৃষ্টিতেই ছিল একটা চমকে ওঠা ভাব। কিন্তু পরক্ষণেই যুবকটির মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল। হাসতে হাসতেই গাড়ি খুলে বেরিয়ে এল। বলে উঠল চিৎকার করে, ‘হ্যাল্লো মি. জে জে।’
ছুটে এল যুবকটি আহমদ মুসার গাড়ির দিকে।
গাড়ির কাছে আসতেই আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
যুবকটি গাড়িতে ঢুকে সিটে বসে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল। তারপর কোটের পকেট থেকে একটা ইনভেলাপ বের করে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘বোধ হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। পাওয়ার পর মুহূর্ত নষ্ট না করে ছুটতে হয়েছে।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। কথাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ও কৈফিয়ত ধরনের বলে মনে হলো তার কাছে।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা ইনভেলাপটিকে উল্টে-পাল্টে দেখল। আবারও ভ্রুকুঞ্চিত হলো তার। ইনভেলাপের কোথাও JAJ -এর জলছাপ নেই।
আহমদ মুসা তাকাল যুবকটির দিকে। বলল, ‘ইনভেলাপ বদল হয়েছে। আমার ইনভেলাপ কোথায়?’ শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
যুবকটি হেসে উঠে আহমদ মুসার কথা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, ‘আপনি কি জ্যোতিষী নাকি যে, ইনভেলাপ খোলার আগেই এমন কথা বলছেন। ইনভেলাপ খুলে দেখুন।’
‘ইনভেলাপের ভেতরটা পরে দেখব। আগে বলুন ইনভেলাপটা কোথায়?’ আগের মতই স্থির কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। ইনভেলাপ তো দিয়েছি। কি আছে দেখুন। তারপর তো বলবেন!’ বলল যুবকটি অনেকটা কৈফিয়তের সুরে।
আহমদ মুসা তার দুচোখের সবটুকু দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল যুবকটির মুখের উপর। ভাবনা তার মনে, যুবকটি বারবার ভেতরটা দেখতে বলছে কেন? এ ইনভেলাপ আসল ইনভেলাপ সে দাবী কিন্তু করছে না সে। তার মানে ভেতরটা ঠিক থাকা সম্পর্কে সে নিশ্চিত। আর এর অর্থ হলো ভেতরটা সে দেখেছে। আর তার দেখার অর্থটা কি?’
কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল যুবকটিকে, ‘মেসেজের ফটোকপি যেটা আপনি করেছেন, সেটা দি………।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। যুবকের ডান হাতটা যেটা ওপাশে ছিল, ছুটে এল রিভলবার নিয়ে। আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে তাক করল সে রিভলবার। বলল, ‘যা আমি কল্পনা করেছিলাম, তার চেয়েও তুমি চালাক। কিন্তু বেশি চালাকের……।
যুবকটিও কথা শেষ করতে পারলো না। আহমদ মুসার বাম হাত চোখের পলকে উঠে এসে যুবকটির রিভলবার ধরা হাতের কব্জী ধরে উপর দিকে পুশ করল, অন্যদিকে আহমদ মুসার মাথা তীরের মত নেমে গিয়ে আঘাত করেছে যুবকটিকে।
আকস্মিক আঘাতে যুবকটি ছিটকে গিয়ে গাড়ির দরজার সাথে ধাক্কা খেল। অন্যদিকে তার রিভলবার ধরা হাতকে উপর দিকে পুশ করার সময়ই যুবকটি গুলী করল। গুলীটা গিয়ে আঘাত করল গাড়ির ছাদকে।
যুবকটি সিট ও দরজার মাঝখানে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। তাকে শামলাতে গিয়ে আহমদ মুসার ডান হাত ওদিকে এনগেজ হয়ে পড়েছিল। আর বাম হাত যুবকটির রিভলবার ধরা ডান হাতের সাথে লড়াই করছিল। যুবকটি তার ডান হাতকে আহমদ মুসার দিকে এনে তাকে রিভলবারের টার্গেটে আনবার চেষ্টা করছিল। দুহাতের লড়াই-এ সুবিধা পাচ্ছিল যুবকটিই বেশি। কারণ আহমদ মুসার শক্তি ও মনোযোগের বিরাট অংশ ব্যয় হচ্ছিল যুবকটিকে চেপে রাখতে গিয়ে। অন্যদিকে কোনঠাসা অবস্থা থেকে মুক্তির চেষ্টা না করে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল আহমদ মুসাকে কোনোভাবে গুলীর আওতায় আনার জন্যে।
এক সময় আহমদ মুসা যুবকটিকে ডান হাতে চেপে রেখে নিজের দেহটাকে আলগা করে নিল। তারপর চোখের পলকে ডান হাতটা তুলে নিয়ে দুহাত দিয়ে যুবকের রিভলবার ধরা ডান হাত চেপে ধরে জোরে ঠেলে দিল যুবকের দিকেই। রিভলবারের নলও ঘুরে গেল যুবকের দিকেই। যুবকটি তার হাতের চাপ বাড়িয়ে দিল হাত ঘুরিয়ে নেবার জন্যে। এটা করতে গিয়ে রিভলবারের ট্রিগারের উপর তার তর্জনি আকস্মিকভাবে চেপে বসল ট্রিগারের উপর। সংগে সংগে একটা গুলী বেরিয়ে তার বুককে এফাড়-ওফোড় করে দিল।
আহমদ মুসা চারদিকে চেয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই।
আহমদ মুসা যুবকটির রিভলবার ধরা হাত বাম হাত দিয়ে ধরে রেখে ডান হাত দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। ওদিকে যুবকটির গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত যুবকটিকে গাড়িতে নিয়ে যুবকটির পকেটগুলো সার্চ করল। তার কোটের ভেতরের পকেটেই পেয়ে গেল চার ভাজ করা একটা বড় কাগজের শিট। একটু খুলেই বুঝল জর্জ আব্রাহাম জনসনের পাঠানো মেসেজের একটা কপি। কাগজটি পকেটে পুরল আহমদ মুসা। মানিব্যাগ ছাড়া কোন পকেটেই আর কোন কাগজ ছিল না।
আহমদ মুসা যুবকটির গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল। যুবকটির ডান হাতের কাছেই পড়ে থাকল তার রিভলবার। তদন্তকারীরা দেখবে রিভলবারটির একটা গুলী যুবকের বুকে এবং দেখবে রিভলবারের বাঁটে যুবকেরই হাতের ছাপ।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসা ফিরে এল তার গাড়িতে। যুবকের দেয়া ইনভেলাপ পড়েছিল গাড়ির সিটে। দ্রুত ইনভেলাপটি খুলে ভেতর থেকে কাগজ বের করল। খুলল। দেখল, যুবকের কাছ থেকে যে মেসেজটি পেয়েছে তারই মূল কপি এটা।
আহমদ মুসা ইনভেলাপসহ মেসেজের দুটো শিট পকেটে পুরল। দুহাত থেকে গ্লাভস খুলে পাশের সিটে রেখে গাড়ি ষ্টার্ট দিল। আর একবার চারদিকে চেয়ে দেখল রোড-সাইড বা এ পার্কে আর কোন গাড়ি নেই, মানুষও নেই।
আহমদ মুসার গাড়ি উল্টো পথে যাওয়া শুরু করল। ঘোরা পথ দিয়ে সে জেফারসন হাউজে ফিরে আসবে। চলছে গাড়ি।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল ড. হাইম হাইকেলের কথা। আসার সময় তিনি বলেছিলেন সি.আই.এ, পুলিশ ও এফ.বি.আই-এর প্রতি দুজনের একজন ‘অপারেশন মেগা ফরচুন গ্রুপ’ মানে ইহুদী লবির সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা সহানুভুতিশীল। কিন্তু তাই বলে এফ.বি.আই- প্রধানের বিশেষ গ্রুপের মধ্যেও ওরা ঢুকে পড়েছে! আহমদ মুসার ধারণা এফ.বি.আই-এর যে মেয়েটি সেদিন তাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে জেফারসন হাউজে রেখে গিয়েছিল, সে মেয়েটির মত এ যুবকটিও এফ.বি.আই-এর বিশেষ কেন্দ্রীয় গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট।
আহমদ মুসা জেফারসন হাউজে ফিরে নিজ ঘরে এসে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ভাবল, দুর্ঘটনার কথা এফ.বি.আই. প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনকে জানাতে হবে। তাঁর কিছু করণীয় থাকতেও পারে। কিন্তু তার আগে তাঁর পাঠানো মেসেজটা দেখা দরকার।
আহমদ মুসা মোবাইলটি বিছানায় বালিশের পাশে রেখে মেসেজ শিট নিয়ে শুয়ে পড়ল।
শুয়ে পড়ে আহমদ মুসা মেসেজ শিটটি চোখের সামনে তুলে ধরল। পড়া শুরু করল সে ঃ
‘বিশ বছরের পুরানো মিলিটারী ডকুমেন্টগুলোকে আনক্লাসিফায়েড করে ন্যাশনাল আরকাইভস ও মিলিটারী আরকাইভসে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টটি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট ছিল না। তাই আন-ক্লাসিফায়েডও হয়নি এবং সে কারণে ন্যাশনাল আরকাইভস-এ রাখার উপযুক্তও বিবেচনা করা হয়নি। অপ্রয়োজনীয় ও সময়োত্তীর্ণ বিধায় বিভাগ থেকেই একে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শুধু একটা কপি সংরক্ষণ করা হয় ‘মিউজিয়াম অব মিলিটারী হিষ্ট্রি’-এর মহাফেজখানায়। কিন্তু সেখানকার রেকর্ডে একে ‘মিষ্ট্রিয়াস মিসিং লিষ্টে’ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে কোন তদন্ত না হওয়ায় ডকুমেন্টটার ব্যাপারে আর কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
মেসেজ পড়ে হতাশ হলো আহমদ মুসা। আরও দুঃখ হলো এই কারণে যে, অকাজের এ বিষয়টা নিয়ে একজন লোকের জীবনও গেল।
এ সম্পর্কিত সাত-পাঁচ অনেক চিন্তা এসে চেপে ধরল আহমদ মুসাকে। গ্লোব হকের লগ ও অর্ডার শিট উদ্ধার না হলে প্রমাণ করা যাবে না গ্লোব হকের রিমোট কনট্রোল সেদিন দুটি সিভিল এয়ার লাইন্সের প্লেনকে টুইনটাওয়ারে টেনে এনেছিল। কিন্তু গ্লোব হকের ঐ লগ ক্লাসিফায়েড হলো না কেন? কেউ এর সাথে কোন গোপন, কৌশলগত বা অস্বাভাবিক কোন কিছু জড়িত দেখেনি বলেই বোধ হয়। রুটিন কোন কিছু তো ক্লাসিফায়েড হয় না। ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ঐ মিশনকেও রুটিন বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে! শীর্ষ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সবাই কি তাহলে ঘটনার সাথে জড়িত ছিল!
পাশ ফিরল আহমদ মুসা। আবার মনোযোগ দিল মেসেজটির দিকে। আবার পড়ল আহমদ মুসা হতাশা পীড়িত মন নিয়ে।
এবার হঠাৎ মেসেজের শেষ লাইনে চোখ আটকে গেল আহমদ মুসার। একটা জিনিসের হারিয়ে যাওয়াকে ‘মিষ্ট্রিয়াস মিসিং লিষ্টে’ আনা হলো, কিন্তু সে ব্যাপারে তদন্ত হলো না কেন? তদন্তের উপযুক্ত না হলে কোন বিষয়কে মিষ্ট্রিয়াস মিসিং লিষ্ট-এ আনা হবে কেন? আনা হলে রহস্য উদ্ধারের জন্যে তদন্ত হবে না কেন? বিষয়টাকে কি চাপা দেয়া হয়েছে? কেন চাপা দেয়া হলো? কোন চাপের কারণে কি? কে চাপ দিল? এ সব প্রশ্নের জবাব পেলে মিসিং ডকুমেন্টেরও খোঁজ পাওয়া যাবে নিশ্চয়। হতাশার মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে উঠল আহমদ মুসার সামনে। এই আলোর উৎস মিলিটারী হিষ্ট্রির মিউজিয়ামে তাকে যেতে হবে, ভাবল আহমদ মুসা।
আবার পাশ ফিরল আহমদ মুসা। হাতের কাছে পড়ল মোবাইলটা। মোবাইলটা হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা।
হাতের চার আঙুলের উপর মোবাইলটা রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি কয়েকটা ডিজিটাল নাম্বারে চাপ দিল। মোবাইলের স্ক্রীনে ভেসে উঠল এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের নাম্বার।
সংযোগ হয়ে গেল।
ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসনের কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি জোসেফ জন বলছি স্যার। গুড ইভিনিং।’
‘ইভিনিংটা গুড রাখলে কোথায়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন হাল্কা কণ্ঠে।
‘সব শুনেছেন জনাব?’
‘ঘটনার রেজাল্ট শুনলাম। ঘটনা তো তুমি বলবে। আমি নিশ্চিত যে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কি করেছিল সে?’
‘ইনভেলাপ পাল্টেছিল।’
‘ইনভেলাপ পাল্টেছিল? তার মানে ভেতরের মেসেজ পাল্টেছিল, অথবা কপি নিয়েছিল?’
‘কপি নিয়েছিল।’
‘ইনভেলাপ পাল্টানো বুঝলে কি করে?’
‘প্রথমেই আমি ইনভেলাপটা চেক করি। তাতে যে গোপন JAJ জলছাপ থাকার কথা তা পাইনি। তখনই বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে সে ডাবল এজেন্ট। সে ইনভেলাপ খুলে মেসেজ পাল্টেছে, অথবা কপি নিয়েছে। আমি যখন তার কাছে আসল ইনভেলাপ চাইলাম এবং অবশেষে চিঠির ফটোকপি তার কাছে চাইতে গেলাম, তখন সে রিভলবার বের করে।’
‘তারপর সে সম্ভবত নিজের রিভলবারে নিজের গুলীতেই প্রাণ হারায়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘জনাব রিভলবারেও তারই ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যাবে। তবে আমি তার এ পরিনতি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তাকে আটক করে মেসেজের কপি নিয়ে নিতে।’ আহমদ মুসা বলল। কণ্ঠ তার ভারী হয়ে উঠেছিল।
‘দুঃখ করো না জোসেফ জন। বিশ্বাসঘাতকের এই পরিণতিই কাম্য। তোমার জন্যে না হলেও আমার জন্যে এটা অপরিহার্যভাবে কাম্য ছিল। তোমাকে ধন্যবাদ জন। এখন বল, কি করবে তুমি? ‘লগ’ তো পাচ্ছ না।’
‘আমি হতাশ নই। আশার আলো দেখতে পাচ্ছি আমি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে, কোথায় তুমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছ?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
‘আপনার মেসেজের শেষ বাক্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সংগে সংগে ওপার থেকে জবাব এল না জর্জ আব্রাহাম জনসনের। একটু পর বলল, ‘বুঝেছি, তুমিই তদন্তে নামতে চাও। সত্যি আহমদ মুসা তুমি অনন্য। স্রষ্টা সব নেয়ামত তোমার উপর ঢেলে দিয়েছেন। আমি নিজেও কিন্তু এ পথটার কথা ভাবিনি।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল,‘ঠিক আছে, এখন এ পর্যন্তই। আমার কিছু করার থাকলে তা জানাতে দেরি করবে না। ধন্যবাদ। বাই।’
‘অবশ্যই জনাব। বাই।’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ওপার থেকে লাইন কেটে গেল।
আহমদ মুসাও কল অফ করে মোবাইল রেখে দিয়ে আবার একটা পাশ ফিরল। কিন্তু চোখ বন্ধ করতে পারলো না। হাতঘড়ির এ্যালার্ম বেজে উঠল।
আসরের নামাজের এলার্ম। উঠে বসল আহমদ মুসা।

Top