৩৯. ধ্বংস টাওয়ারের নীচে

চ্যাপ্টার

নিউইয়র্ক হাইওয়ে ধরে একটা গাড়ি এগিয়ে চলেছে ওয়াশিংটনের দিকে। গাড়ির আরোহী দুজন। ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা এবং তার পাশে কামাল সুলাইমান।
‘আমরা অর্ধেক পথ এগিয়েছি ভাইয়া। গণকবরের ১৪টি কংকালের সবরকম টেষ্ট সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে, ঐ ১৪ জনই আরব বংশোদ্ভুত এবং তাদেরকে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের দিনগত রাতে একই সময়ে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। এর অর্থ আরবদের কর্তৃক বিমান হাইজ্যাক করে টুইনটাওয়ারে আঘাত করার প্রচারিত কাহিনী মিথ্যা এবং সাজানো। অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া টুইনটাওয়ারের ডাষ্টের তিনটি পরীক্ষাই প্রমাণ করেছে বিশেষ ধরনের ডেমোলিশন বিস্ফোরক দিয়ে টাওয়ার ধ্বংস করা হয়েছে, বিমানের আঘাতে টাওয়ার ধ্বংস হয়নি।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘আমরা অর্ধেক পথ এগিয়েছি, এ কথা বলছ কেন? টুইনটাওয়ার ধ্বংসের জন্যে যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের ডকুমেন্ট আমাদের হাতে। অন্যদিকে টাওয়ার ধ্বংসের যে কারণ দেখানো হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণেরও ডকুমেন্ট আমাদের হাতে এসেছে। সুতরাং বলতে পারো পুরো পথই আমরা অতিক্রম করেছি। এখন আমরা উদ্ধার করতে যাচ্ছি সিভিল প্লেন কিভাবে টাওয়ারে আঘাত হানল, সেই রহস্য।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা ডা. আয়েশা আহমদের মামার কাছ থেকে ‘গ্লোবাল হক’-এর উড্ডয়ন রুট এর লগ ও ফটোগ্রাফ যোগাড়ের চেষ্টা করতে পারি। আমার বিশ্বাস তিনি আমাদের সাহায্য করবেন।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘আমরা ‘মিউজিয়াম অব মিলিটারী হিষ্ট্রি’র ওখানে কাজ সেরে নিউইয়র্কে ফিরেই ওখানে যাব ইনশাআল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গ্লোবাল হক’-এর মিসিং বলে কথিত লগ সম্পর্কে নতুন কিছু জানা গেছে ভাইয়া?’
‘আমি একটা টেলিফোনের অপেক্ষা করছি কামাল সুলাইমান।’
‘কে টেলিফোন করবেন।’ জিজ্ঞাসা কামাল সুলাইমানের।
‘এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন টেলিফোন করবেন। তিনি গত রাতে আমাকে টেলিফোন করে বলেছিলেন যে, মিলিটারী মিউজিয়ামের লগ সম্পর্কে স্পেসেফিক কিছু জানতে পারলে আমি সেখানে পৌছার আগেই তিনি আমাকে জানাবেন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তার মোবাইলটা বেজে উঠল।
মোবাইলটি তুলে সামনে ধরল আহমদ মুসা।
‘নিশ্চয় মি. আব্রাহাম জনসনের টেলিফোন।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘না বুমেদীন বিল্লাহর টেলিফোন।’ বলে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহর কলের উত্তর দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি জোসেফ জন। তুমি কখন ফিরলে?’
‘এই মাত্র। পৌছেই আপনাকে টেলিফোন করেছি।’
‘শোন, আমি যা খবর পেয়েছি, তাতে প্রফেসরকে কিছুদিন বাইরে থাকতে হবে, বাড়িতে তাঁর যাওয়া হবে না। আর তুমি তোমার আসল কাজ শুরু করে দাও। মূল রিপোর্টের আগে প্রারম্ভিক কয়েকটা রিপোর্ট করতে হবে। যেমন গণকবর আবিষ্কারের খবর, ধ্বংস টাওয়ারের ডাষ্ট পরীক্ষার উদ্যোগের খবর এবং এসবকে সামনে রেখে বলবে টাওয়ার ধ্বংস বিষয়ে সত্যানুসন্ধানের সামগ্রিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই রিপোর্টের পরদিনই মূল রিপোর্ট পত্রিকায় যেতে হবে। এরপর ‘লা-মন্ডে’ পত্রিকায় যা উঠবে না, সেসব বিষয়েও ফলোআপ পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তোমাকে পাঠাতে হবে FWTV এবং WNA সংবাদ মাধ্যমে। মূল তথ্য তো পাওয়া গেছে। তার ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি কর। পরে একটা বিষয় সংযোজন করলেই চলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। তবে আপনি যে প্রারম্ভিক রিপোর্টের কথা বলেছেন তা আমার মাথায় ছিল না। আপনি ঠিকই বলেছেন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের চেয়ে এটাই স্বাভাবিক হবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ধন্যবাদ বিল্লাহ। রাখলাম টেলিফোন। সব কথা মনে রেখ। বাই।’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
কল অফ করে মোবাইল ড্যাশ বোর্ডে রাখতেই মোবাইল বেজে উঠল আবার।
‘এবার নিশ্চয় জর্জ আব্রাহাম জনসন হবেন ভাইয়া।’ বলল কামাল সুলাইমান।
মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা।
ঠিক জর্জ আব্রাহাম জনসনই টেলিফোন করেছে।
‘গুড মর্নিং জনাব। কেমন আছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘গুড মর্নিং। ভাল আছি। তুমি নিশ্চয় পথে ড্রাইভ করছ?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘তাহলে তাড়াতাড়ি বলছি শোন। লগটা মিসিং বলে যে মন্তব্য ডকুমেন্ট আছে তা ঠিক নয়। একটা বিশেষ পক্ষ অফিসকে দিয়ে এটা করিয়েছে। লগটা ঠিক জায়গায় ঠিকই আছে। বলছি সেকশন ও ডেষ্ক নাম্বার। মুখস্থ করে নাও। MM-111/197, আরও শোন, ওখানে কিন্তু কড়া সিকিউরিটি। তাদের উপর ‘দেখা মাত্র গুলী’র স্থায়ী নির্দেশ দেয়া আছে। তার উপর তোমরা রিভলবার নিতে পারছো না। সুতরাং সাবধান। উইশ ইউ গুডলাক। বাই।’ বলে এপার থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা না করে টেলিফোন রেখে দিল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আল্লাহ লোকটির উপর রহম করুন। তাঁর সরকারের কোন লাভ নেই, বরং একদিক দিয়ে ক্ষতি আছে, তা সত্ত্বেও অমূল্য সাহায্য তিনি করছেন।’ স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘জর্জ আব্রাহাম জনসন সত্যিই আপনাকে ছেলের মত ভালোবাসেন ভাইয়া।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘তোমার কথা ঠিক কামাল সুলাইমান। তিনি আমাকে তার দ্বিতীয় ছেলে মনে করেন। কিন্তু তিনি ছেলেকেও এ ধরনের সাহায্য করবেন না। আসলে কামাল সুলাইমান, তিনি আমাদের উদ্দেশ্য-আদর্শকেও ভালোবাসেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া আরেকটা বিষয়, বর্তমান মার্কিন সরকার সম্ভবত চান টুইনটাওয়ার ধ্বংসের সত্য ঘটনা দিনের আলোতে আসুক। যে গ্রুপটা তখন মার্কিন প্রশাসন ও সরকারের একটা অংশকে কাজে লাগিয়ে ভয়াবহ কাজটা করেছিল, বিশ্বকে ও আমেরিকাকে বদলে দিতে চেয়েছিল তাদের মত করে, সেই গ্রুপটা ও তাদের হীন উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যাক বিশ্ববাসীর চোখে, এটা আমেরিকার বর্তমান সরকার আন্তরিক ভাবেই কামনা করেন। তবে এ কাজটা অন্যের হাতে হোক, এটা তারা চাচ্ছেন।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘হ্যাঁ কামাল সুলাইমান, তোমার কথা ঠিক, আজকের আমেরিকা বিশ বছর আগের সেই আমেরিকা নয়। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, টমাস জেফারসনের আমেরিকা আবার ফিরে এসেছে। এই আমেরিকা নিজের যেমন শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে চায়, তেমনি চায় অন্যেরও শান্তি, স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাক। এই আমেরিকা বিশ্বের জাতি ও দেশসমূহের মাথায় বসতে চাচ্ছে না, চাচ্ছে তাদের হৃদয়ে স্থান পেতে। সুতরাং আমেরিকা অবশ্যই চাইবে অতীতের একটি কালো দাগ তার গা থেকে মুছে ফেলতে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই কামাল সুলাইমান চিৎকার করে উঠল, ‘ভাইয়া ডান দিকে এক্সিট নিন। এ দিক দিয়ে ‘ইন্ডিপেনডেন্স’ এভেনিউতে না ঢুকলে অনেক ঘুরতে হবে।’
‘ধন্যবাদ কামাল সুলাইমান। কথায় মনোযোগ দিতে গিয়ে রাস্তার দিকে মনোযোগ ছিল না।’ এক্সিট নেবার জন্যে গাড়িটাকে সাইড লেনে নিতে নিতে বলল আহমদ মুসা।
ইন্ডিপেনডেন্স এভেনিউ ও কনষ্টিটিউশন এভেনিউ রাজধানী ওয়াশিংটনের প্রাণকেন্দ্রে। হোয়াইট হাউজ, পার্লামেন্ট ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান এই এলাকায়।
ইন্ডিপেনডেন্ট এভেনিউ-এর দক্ষিণ প্রান্তে এভেনিউ থেকে একটু ভেতরে এক বিরাট এলাকা জুড়ে ‘মিউজিয়াম অব মিলিটারী হিষ্ট্রি’।
মিউজিয়ামের চারদিক ঘিরে বড় বড় গাছ স্থানটাকে বাগানের রূপ দিয়েছে। মিউজিয়ামের দুপাশে পার্কিং প্লেস।
উত্তর পাশের পার্কিং প্লেসটা ছায়া ঘেরা ও অপেক্ষাকৃত নির্জন। তাছাড়া মিউজিয়ামের প্রাইভেট ও ইমারজেন্সি দরজা আছে, সেটাও এদিকেই।
আহমদ মুসা এই কারপার্কিং-এ তার গাড়ি পার্ক করলো।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মিউজিয়ামের ইন্টারন্যাল মানচিত্রটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। চারতলা বিল্ডিং। প্রতিটি ফ্লোরের রুম ও প্যাসেজের এ্যারেঞ্জমেন্ট প্রায় এই রকমের। পূর্ব দিকে মিউজিয়ামের এনট্রান্স। মিউজিয়ামে ঢোকার পর একটা বড় লাউঞ্জ। লাউঞ্জের দুপ্রান্ত থেকে দুটি প্রশস্ত সিঁড়ি উঠে গেছে চারতলা পর্যন্ত। একটা সিঁড়ি উপরে ওঠার জন্যে, অন্যটা নিচে নেমে আসার জন্যে।
মিলিটারী মিউজিয়ামটি সার্বক্ষণিকভাবে সর্বসাধারণের জন্যে খোলা নয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুমতি প্রাপ্তরাই শুধু মিউজিয়ামে ঢুকতে পারে।
মিউজিয়ামের সকল বিভাগ সকলের জন্যে অবারিত নয়। কিছু কিছু বিভাগ আছে যা দর্শনার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত নয়। এ ধরনের সেকশনগুলো চারতলায়। অর্থাৎ চারতলায় কোন দর্শনার্থী যায় না। জর্জ আব্রাহাম জনসন জানিয়েছেন, MM-111/117 সেকশনটা নিষিদ্ধের তালিকায় নয়।
সুতরাং তাদের গন্তব্য ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’-এ গিয়ে রেকর্ড লগ দেখায় কোন বাধা নেই। কিন্তু সমস্যা চারটি, যে ডকুমেন্টকে মিষ্ট্রিয়াস মিসিং তালিকায় তোলা হয়েছে তা, এক. দেখায় কোন বাধা আসবে কিনা, দুই. ক্যামেরা নিয়ে যেতে দিবে কিনা, তিন. ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা, এবং চার. সেকশনটি কোন তলায় তা জানাতে ভুলে গেছেন জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা মিউজিয়ামের মানচিত্র থেকে মুখ তুলল। বলল কামাল সুলাইমানকে সব সমস্যার কথা।
কামাল সুলাইমান বলল, ‘সেকশন চেনার সমস্যাটা ভাইয়া আমরা ‘ইনফরমেশন’ থেকে জেনে নেব। আমার মনে হয় প্রথম সমস্যাটা কোন সমস্যা হবে না। কারণ সেকশনটা দর্শনার্থীদের জন্যে নিষিদ্ধ নয় বলেই একে চারতলায় নেয়া হয়নি। মিসিং তথ্যটা দর্শনার্থীদের জন্যে এজন্যেই রাখা হয়েছে যাতে কোন দর্শনার্থী সেকশনটাতেই না যায়। গেলে বাধা দেয়ার কিছু নেই। সমস্যা দাঁড়াচ্ছে ক্যামেরা নেয়া ও ছবি তোলা নিয়ে।’
থামল কামাল সুলাইমান সমস্যা দুটির কোন সমাধান না দিয়েই। ভাবছিল সে।
‘কলম ক্যামেরাতো! একটা কাজ আমরা করতে পারি। আমরা ক্যামেরা থেকে ব্যাটারী এবং ফটোডিস্কটা আলাদা করতে পারি। তাতে ওদের স্ক্যানিং এড়ানো যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি থেকে নামার জন্যে তৈরি হলো আহমদ মুসা।
বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
মিউজিয়ামের লাউঞ্জে প্রবেশ করল আহমদ মুসারা। সোজা গিয়ে দাঁড়াল রিসিপশনের সামনে।
রিসিপশন ডেস্কে দুজন। একজন মেয়ে, একজন ছেলে।
আহমদ মুসাকে ডেষ্কের সামনে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এল।
‘গুড মর্ণিং ম্যাডাম। আমি জোসেফ জন আর আমার সাথে ইনি কুনার্ড সুলিভান। এই দুনামে রিসিপশনে দুটি প্রবেশ পত্র থাকার কথা।’
‘প্লিজ স্যার………’ বলে মেয়েটি রেজিষ্টারটি টেনে নিল। রেজিষ্টারে নজর বুলিয়েই মেয়েটি বলে উঠল, ‘ইয়েস স্যার, আপনাদের পাশ আছে। মেয়েটি দুটি পাশ আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার রেজিষ্ট্রারে দয়া করে সই করুন।’
আহমদ মুসারা প্রবেশপত্র নিয়ে রেজিষ্টারে সই করল।
সই করে আহমদ মুসা বলল, ‘ম্যাডাম MM-111/117 সেকশনটা কোন তলায় কোনদিকে হবে?’
মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো অন্য রিসিপশনিষ্ট আগ্রহ ভরে একধাপ এগিয়ে এল এবং বলল মেয়েটি কিছু বলার আগেই, ‘স্যার ও সেকশনটা তিন তলার ১৯৭ নাম্বার কক্ষে।’
রিসিপশনিষ্টের মুখের আকস্মিক এক পরিবর্তন এবং তার অতি উৎসাহ আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়াল না। কিন্তু এ নিয়ে চিন্তা করার সময় তার ছিল না। প্রবেশ পত্র হাতে পেয়েছে। এখন তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে।
সিঁড়িতে ওঠার মুখে স্ক্যানিং মেশিন।
স্ক্যানিং পেরল আহমদ মুসারা। স্ক্যানিং-এর সময় ব্যাটারী ও ফটো ডিস্ককে আলাদাভাবে দেখে তারা কোন সন্দেহ করেনি।
স্ক্যানিং আছে বলেই আহমদ মুসারা আজ রিভলবার নিয়ে আসেনি। কামাল সুলাইমানের কাছে একটা ক্লোরোফরম রিভলবার রয়েছে। প্লাষ্টিকের বলে তা স্ক্যানিং-এ ধরা পড়েনি। এটাই তাদের একমাত্র অস্ত্র। জর্জ আব্রাহাম জনসন তাদেরকে কৌশলে কাজ সারতে বলেছে। এখানে বড় কোন খুনোখুনি হোক তা তিনি চান না।
চারতলা এই মিউজিয়ামে লিফট ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা দর্শকদের জন্যে নয়।
আহমদ মুসা সিঁড়ি ভেঙে সোজা উঠে গেল তিন তলায়।
কক্ষগুলো সুন্দর গুচ্ছাকারে সজ্জিত। এ রকম অনেকগুলো কক্ষ নিয়ে তিন তলা।
আহমদ মুসারা খুঁজতে লাগল একশ’ সাতানব্বই নাম্বার কক্ষ।
আহমদ মুসারা আগেই শুনেছিল, মিউজিয়ামে কোন ইউনিফরম পরা পুলিশ নেই। সিকিউরিটি পুলিশরা সাধারণ পোশাকে বিভিন্ন রুম ও করিডোরে ছড়িয়ে আছে। দর্শকদের সাথে মিশে দর্শক হয়ে তারা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ব্যবস্থাটা আহমদ মুসাদের জন্যে বিপদজনক।
পেয়ে গেল তারা ১৯৭ নাম্বার কক্ষ। কক্ষটি উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে। কক্ষের দরজা ওয়ালা সম্মুখ দেয়াল মিউজিয়ামের উত্তরের বহিঃদেয়ালের মুখোমুখি। মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত করিডোর।
আহমদ মুসা রুম খোঁজাখুঁজির এক ফাঁকে কলম ক্যামেরাটিকে সেট করে নিয়েছে।
মাল্টি ডাইমেনশনাল এই মুভি ক্যামেরা অত্যন্ত শক্তিশালী।
যে কোন বড় গ্রন্থ বা রেজিষ্টারের উন্মুক্ত দুপাতার উপর শট নিলে এক সেকেন্ডের শত ভাগের এক ভাগের মধ্যে দুদিকের দুপাতার নিচের দশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নিখুঁত ফটো তুলতে পারে।
আহমদ মুসারা ১৯৭ নাম্বার কক্ষে প্রবেশ করল।
বিশাল কক্ষটিতে তখন পাঁচজন লোক। তাদের মধ্যে চারজন যুবক, একজন তরুণী। তারা বিভিন্ন জিনিস দেখায় ব্যস্ত।
গোটা কক্ষে ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’-এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, প্লেনের মডেল, বিভিন্ন দেয়াল চার্ট, রেজিষ্টার ও বইপত্র সুন্দরভাবে সাজানো।
আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমান আলাদাভাবে খুঁজছে লগ রেজিষ্টার।
তাদের পরিকল্পনা হলো, তারা দুজনে এক সঙ্গে থাকবে না। আহমদ মুসা লগ রেজিষ্টার থেকে ফটো নেবে। আর কামাল সুলাইমান চারদিকটা পাহার দেবে তাকে আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে।
ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় দরজা থেকে নাক বরাবর সামনে একটা ডেষ্কে আহমদ মুসা পেয়ে গেল লগ রেজিষ্টার।
লগ রেজিষ্টারটি খোলা। খোলা পাতার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ে হতবাক। লগের যে অংশটি সে চায় সেই পাতাটিই খোলা আকারে জ্বল জ্বল করছে।
এটা কি কাকতালিয় ঘটনা, না শত্রুপক্ষের এটা একটা নোটিশ?
যেটাই হোক এ নিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। তাকাল আহমদ মুসা কামাল সুলাইমানের দিকে। দেখল, আহমদ মুসার বামে কিছু দূরে একটা যন্ত্র পরীক্ষা করছে দুজন। তাদের অল্প দূরে কামাল সুলাইমান। অবশিষ্ট দুজন কামাল সুলাইমানের কিছু দূরে দরজার কাছাকাছি জায়গায়। আর তরুণীটি ঘরের পশ্চিম প্রান্তে পশ্চিমমূখী হয়ে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
আহমদ মুসার সাথে কামাল সুলাইমানের চোখাচোখি হল।
কামাল সুলাইমান পকেটে হাত দিল। এটা তার প্রস্তুত থাকার সংকেত।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। কলম ক্যামেরাটি হাতেই ছিল। কলম-ক্যামেরাটি সে রেজিষ্টারের নির্দিষ্ট পাতার উপরে ধরে ক্যামেরাটি অন করল। অফও করে দিল সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই।
আহমদ মুসা কলমটি পকেটে রাখতে যাবে। এই সময় তার বাম পাশ থেকে একটা শক্ত কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হাত তুলে দাঁড়াও আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা হাত না তুলেই ফিরল তাদের দিকে। দেখল, যারা একটা যন্ত্র পরীক্ষা করছিল সেই যুবক দুজন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলবার।
আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকাতেই ওদের একজন বলল, ‘চালাকির চেষ্টা করো না। হাত তোল। গুলী করতে আমাদের বাধ্য করো না।’
তার কথা শেষ হবার আগেই কামাল সুলাইমানের হাত পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছিল। দুপ দুপ করে শব্দ হলো দুবার।
ক্লোরোফরম বুলেট গিয়ে বিস্ফোরিত হলো যুবক দুজনের সামনে।
মুহূর্তেই ওরা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
ক্লোরোফরম বুলেট ছোড়ার পর কামাল সুলাইমান রিভলবার নামিয়ে এগুচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠল, ‘কামাল পেছনে……….।’
দরজার পাশে যে দুজন যুবক ছিল তারা দুজনেই পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাক করছে আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমানকে।
তাদের একজন চিৎকার করে উঠেছে, ‘তোরা বহু জ্বালিয়েছিল আমাদের। তোদের আজ বাঁচিয়ে রাখব না। কুকুরের মত মারব তোদের।’
কামাল সুলাইমানও তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমান কারও কিছু করার ছিল না। যুবক দুজন এতটা দূরে যে, তাদের উপর পাল্টা আক্রমণের সুযোগ নেই। কামাল সুলাইমানের ক্লোরোফরম রিভলবারও বিদঘুটে পজিশনে।
আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমান দুজনেরই স্থির দৃষ্টি যুবক দুজনের দিকে।
সময়ের এ রকম সন্ধিক্ষণে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবারের গুলীর শব্দ হলো পরপর দুবার।
যুবক দুজনের হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল। দুজনেরই দুহাত রক্তাক্ত।
আহমদ মুসারা তাকাল ঘরের পশ্চিম দিকে। দেখল, সেই তরুণীর হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকাতেই মেয়েটি বলল, ‘আসুন স্যার আপনারা আমার সাথে।’
বলে তরুণীটি দরজার দিকে হাঁটা দিল।
কামাল সুলাইমান তার ক্লোরোফরম রিভলবার তুলে ফায়ার করল আহত যুবক দুজনের দিকে। বলল, ‘ওরা চিৎকার করার আর সুযোগ পাবে না।’
হাঁটতে হাঁটতে মুখ ঘুরিয়ে তরুণীটি কামাল সুলাইমানকে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
তরুণীটির সাথে আহমদ মুসারা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তরুণীটি হাঁটতে লাগল করিডোর ধরে প্রথমে পশ্চিমে, তারপর উত্তরে।
‘আমরা কি বের হবো উত্তরে প্রাইভেট এক্সিট দিয়ে?’ বলল আহমদ মুসা তরুণীটিকে লক্ষ্য করে।
‘জি স্যার। সামনের গেট দিয়ে অনেক ঝামেলা হতে পারে। ওদের আরো লোক আছে। আপনারা দুজন ঢুকেছেন, এ খবর সব জায়গায় হয়ে গেছে।’
‘কিভাবে, আমাদের তো ওরা চিনে না।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘রিসিপশনে আপনারা সেকশনের কোড নাম্বার বলেছিলেন। এ থেকেই বিষয়টা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। শুধু ঘরের চারজন বোধ হয় জানত না যে, আপনারা দু’জন।’
তারা প্রাইভেট সিঁড়ি দিয়ে উত্তরের প্রাইভেট এক্সিটে নেমে এল।
প্রাইভেট এক্সিটে একজন তরুণী দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাদেরকে নিয়ে আসা তরুণী তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এদিক সব ঠিক-ঠাক?’
‘জি।’
‘ঠিক আছে তোমার কাজ শেষ। তুমি এখন চলে যাও।’
বলে সে এগুলো দরজার দিকে। দরজায় ডিজিটাল লক। তরুণীটি আনলক করল। দরজা খুলে গেল।
তরুণীসহ আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল।
গাড়ির পাশে গিয়ে পৌছল তারা।
মেয়েটি বলল, ‘স্যার আমাকে ওয়াশিংটনের সীমা পর্যন্ত আপনাদের পৌছে দিতে বলেছেন।’
‘ওয়েলকাম।’ আহমদ মুসা বলল।
মেয়েটি পেছন দিকের দুটি দরজা খুলে আহমদ মুসাদের বসিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
গাড়ি ষ্টার্ট নিল।
আহমদ মুসা বলল, ‘গাড়িতে বসার প্রোটোকল তো ঠিক হলো না।’
‘আপনারা মেহমান। আর আমি হোষ্টের পক্ষে আপনাদের সার্ভিস দিচ্ছি। প্রোটোকল ঠিক আছে।’ বলল তরুণীটি।
‘হোষ্ট কে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘অফিসিয়ালি বলা যাবে না। আর আন-অফিসিয়ালি শুনে কি লাভ।’ বলল তরুণীটি।
গাড়িটি নিউইয়র্ক হাইওয়েতে উঠলে তরুণী একটা ইমারজেন্সি পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল। আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমানও নামল।
কামাল সুলাইমান ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি কিভাবে ফিরবেন সে জিজ্ঞাসা জানি অবান্তর। আপনি আপনার ‘স্যার’কে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন। আর বোনকে কৃতজ্ঞতা জানাব না। কারণ, বোন উত্তরে বলবেন বোন হিসাবে সে দায়িত্ব পালন করেছেন।’
‘আপনি আমাকে বোন বলেছেন? আমি আপনাদের বোন?’ মেয়েটির গলা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। ছলছলিয়ে উঠল তার চোখ। বলল, ‘আমি যে সত্যিই আপনাদের বোন। আমি আয়েশা বেগ মোহাম্মদ।’
‘আপনি মুসলিম?’ আহমদ মুসা বলল বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে।
‘আপনি নয়, ‘তুমি’ বলুন ভাই। হ্যাঁ আমি মুসলিম। তবে মুসলিম নামে আমি চাকুরিতে ঢুকিনি। অনেক চেষ্টা করেও মুসলিম নাম নিয়ে এ ধরনের চাকুরি পাইনি। শেষে আমি ‘আলিশা বার্গম্যান’- এই ইহুদী নাম নিয়েছিলাম। এই নামেই চাকুরি পাই। অবশ্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি আমার মুসলিম নাম ফিরে পেয়েছি। স্যার আমাকে এই সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। কত খুশি হয়েছি বলতে পারবো না। তুমি জান কি কাজে তুমি আমাদের সহযোগিতা করলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ। স্যার আমাকে বলেছেন। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ একটি মহৎ কাজের সামান্য অংশে নিজেকে জড়িত করতে পেরেছি। তবে স্যার আমার মনে একটা প্রশ্ন। সেটা হলো, প্রমাণ যোগাড় যথেষ্ট নয়। প্রমাণগুলোকে আমেরিকার মানুষ এবং গোটা দুনিয়া গ্রহণ করতে হবে। এটা কি করে সম্ভব হবে?’ বলল আয়েশা বেগ মুহাম্মাদ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিথ্যাকে যেভাবে গ্রহণ করানো হয়েছিল, সত্যকে সেভাবেই গ্রহণ করানো হবে।’
‘সেটা কি? বুঝছি না আমি।’ বলল আয়েশা বেগ।
‘দুদিন অপেক্ষা কর। জবাবটা তুমিই বলবে, তোমার কাছ থেকেই শুনব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কথা সত্য হোক ভাই সাহেব।’
‘আমিন। আসি বোন। আবার দেখা হবে। আস্সালামু আলাইকুম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়াআলাইকুমুস সালাম। উইশ ইউ গুড ডেজ ভাইয়া।’
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠল। ষ্টার্ট নিল গাড়ি।
‘ভাইয়া আমরা কি যাচ্ছি ডা. আয়েশা আহমদের মামার ওখানে?’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘যাব বলেছি। কিন্তু ওরা প্রস্তুত থাকবেন কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ডা. আয়েশাকে জানিয়েছিলাম। উনি কনফারম করেছেন আজ বিকেলে অথবা সন্ধ্যার পর যে কোন সময়।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘ধন্যবাদ, কামাল সুলাইমান। আমরা যদি অফিসিয়াল ‘লগ’-এর সাথে সাথে ‘গ্লোবাল হক’-এর ‘এরিয়াল রুট’ ও এই রুটে উড্ডয়নের ছবি পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের চেষ্টা ষোলকলায় পূর্ণ হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহই করুন তাই যেন হয়। এটা হবে আমাদের জন্যে ‘সোবহে সাদেক’।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘আমিন।’ আহমদ মুসা বলল।
কেউ কথা বলল না এর পর। দুজনেই নিরব। দুজনের চোখে-মুখে আশা আনন্দ ও ভাবনার ছাপ। চোখের দৃষ্টি তাদের সামনে। ছুটছে গাড়ি।

কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা রেখে বলল বৃদ্ধ মরিস মরগ্যান, ‘দেখ আহমদ মুসা তুমি একটা জীবন্ত কিংবদন্তী। আমার এ বাড়িটা ধন্য হয়েছে তোমাকে পেয়ে। কিন্তু তোমরা আমাদের আয়েশার বন্ধু। তোমাদের তুমি বলব, কিছু মনে করো না।’
বলে বৃদ্ধ একটা দম নিল। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘তোমার কথা শুনলাম আহমদ মুসা। আনন্দিত হলাম যে, একটা মিথ্যার মুখোশ তোমরা উন্মোচন করতে যাচ্ছ। কিন্তু বিশ বছর পর সত্য উদ্ধার করে কি করতে চাও? প্রতিশোধ নিতে চাও, না কালোদাগের বিমোচন চাও? কোনটা বড় তোমাদের কাছে?’
মরিস মরগ্যান ডা. আয়েশা আহমদ এর মামা। ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’-এর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সে।
মরিস মরগ্যানের হিলটপস্থ বাড়ির সুন্দর বৈঠকখানায় বসে আহমদ মুসারা তার সাথে গল্প করছে। পূবদিকে চোখ ফেরালেই হাডসন নদীর নীল পানি চোখে পড়ে। নদীর গা ছুঁয়ে আসা সরস বাতাসের স্পর্শ অনুভব করতে পারছে তারা।
নিউইয়র্ক থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে হাডসন নদীর তীরে সুন্দর পাহাড়ী গ্রাম এই গ্রীন ফিল্ড। চাকুরি থেকে অবসর পাওয়ার পর মরিস মরগ্যান কাউন্ট্রির নিরব পরিবেশে প্রায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে।
‘আমরা একটা অসত্যের অবসান ঘটাতে চাই। মানুষকে জানাতে চাই প্রকৃত সত্য। কোন প্রতিশোধের চিন্তা আমাদের নেই। অপরাধীদের শাস্তির প্রশ্ন আছে। কিন্তু সে দায়িত্ব আমেরিকান সরকারের। এদিকটা আমরা ভাবছি না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটাই ভাল। ধন্যবাদ। বিচার চাওয়া ভাল। বিদ্বেষ ভাল নয়। যারা টাওয়ার ধ্বংসের কাজ করেছে, যারা এ নিয়ে মিথ্যাচারের মাধ্যমে উদোরপিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছে, তাদেরকে আমি আমার সমগ্র সত্তা দিয়ে ঘৃণা করি। ঘটনার একমাস পর আমি রিটায়ার নিয়েছি। অফার ছিল আরও দুবছর চাকুরি করার। কিন্তু অফার আমি গ্রহণ করিনি। যদিও জানতাম আমার আমেরিকা এজন্যে দায়ি নয়, এমন কি আমাদের সরকারও এর সাথে নেই। একটি স্বার্থের সিন্ডিকেট এই কাজ করেছে। এটা জেনেও করার কিছু ছিল না। আয়োজনটা এমন আট-ঘাট বেঁধে করা হয়েছিল যে, কাউকে কিছু বিশ্বাস করানো সম্ভব ছিল না। তাই নিরবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম।’
‘জনাব একটা প্রশ্ন, আপনি ষড়যন্ত্রের কথা কিভাবে বুঝেছিলেন?’
‘সেদিন আমার শিফট শুরু হলে ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’-অবজারভেটরীতে গিয়ে বসেছি। চোখ গেল স্কাই-স্ক্রীনে। হঠাৎ দেখলাম, নিউইয়র্কের আকাশে খালি চোখে দেখা যায় না এমন উঁচুতে আমাদের ‘গ্লোবাল হক’ দাঁড়িয়ে। তার অনেক নিচে বিপজ্জনক ফ্লাইং লেবেল দিয়ে সিভিল এয়ারলাইনার ছুটে আসছে। ‘গ্লোবাল হক’ ও ‘সিভিল এয়ার লাইনার’ এর গতি একই দিকে। ভ্রুকুচকে গেল আমার। ‘গ্লোবাল হক’-এর অপ্রতিরোধ্য ম্যাগনেটিক রিমোট কনট্রোল কি কোন হাইজ্যাক করা বিমানকে আটক করেছে? আমি তাড়াতাড়ি অ্যাডিশনাল রেকর্ডার এবং ‘রেয়ার ভিউ কলার’ চালু করে নিয়ে চোখে তুলে নিলাম ম্যাগনেটিক গগলস। এই গগলস অদৃশ্য ম্যাগনেটিক ওয়েভ¯্রােতকে রঙীন আলোর আকারে সামনে নিয়ে আসে। আমি গগলস চোখে লাগাতেই দেখতে পেলাম আমার ধারণা সত্য। ‘গ্লোবাল হক’ থেকে সবুজ আলোর একটা ধারা তীরের মত সোজা নেমে গিয়ে স্পর্শ করেছে সিভিল এয়ার লাইনারকে। প্লেনটি পরিণত হয়েছে একটি আলোকপিন্ডে। সবুজ আলোর ধারাটি প্লেনকে টেনে নিয়ে চলেছে। বুঝলাম, ‘গ্লোবাল হক’ হাইজ্যাক হওয়া একটা প্লেনের নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা এবং হাইজ্যাকারদের মেটালিক ও এক্সপ্লোসিভ সব অস্ত্রকে বিকল করে দিয়ে প্লেনটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেফ ল্যান্ডিং এর দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, প্লেন গিয়ে আঘাত করেছে পাশাপাশি দাঁড়ানো ডেমোক্রাসি ও লিবাটিং টাওয়ারের মধ্যে ডেমোক্রাসি টাওয়ারকে। আপনা আপনিই আমার কণ্ঠ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। আমি তাড়াতাড়ি টেলিফোন করলাম আমাদের এয়ার ডিফেন্স হেড অফিসে। এক অপরিচিত কণ্ঠ আমার টেলিফোন ধরল। আমি কম্পিত কণ্ঠে তাকে ঘটনা জানালাম। ‘ওকে’ বলে সে টেলিফোন রেখে দিল। তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আমি বিস্মিত হলাম। কে টেলিফোন ধরেছিল, এ যখন ভাবছি এবং দৃষ্টি ফেরাচ্ছি স্কাই স্ক্রীণের দিকে। ঠিক তখনই আমার সামনের স্কাই স্ক্রীনটা অন্ধকার হয়ে গেল। তার সাথে বিদ্যুতও চলে গেল। অবজারভেটরির এ কক্ষের বিকল্প বিদ্যুত ব্যবস্থা সক্রিয় হলো। আলো জ্বলে উঠল কক্ষে আবার। কিন্তু ‘স্কাই স্ক্রীন’ অন্ধকারই থাকল। আমি টেলিফোন করলাম মেইনটেন্যাস বিভাগে। তারা বলল, আমরা কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। সব কিছুই আমাদের ঠিক আছে। কিন্তু কাজ করছে না কোন কিছুই। এটা কি কোন ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক জ্যামিং? আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম। আমি এবার টেলিফোন করলাম, আমাদের ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’ বিভাগের চীফ জেনারেল আব্রাহামকে। তিনি বললেন, নিউইয়র্কে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ইমারজেন্সী চলছে। শীঘ্রই সব জানতে পারবে। তোমার ডিউটি রুমে তুমি অপেক্ষা করবে।’ তাঁর কথা আমাকে আরও আতংকে ঠেলে দিল। আমি বুঝতে পারলাম না, ইমারজেন্সী চললে আমাদের স্কাই স্ক্রীন আমাদের কাছে অন্ধকার হয়ে যাবে কেন? এইভাবে আতংক-উত্তেজনার মধ্যে আমার সময় কাটতে লাগল। এমনি এক সময়ে আমাকে আরও আতংকিত করে দিয়ে আমার অবজারভেটরী কক্ষের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল এক মুখোশধারী। গায়ে কালো ওভারকোট, মাথায় কালো হ্যাট। গ্লাভস পরা হাতে তার রিভলবার। সোজা এসে সে আমার পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিল। তারপর দ্রুত এগুলো স্কাই বোর্ডের দিকে। স্কাইবোর্ডের কম্পিউটারে তখন ছিল গত কয়েক ঘণ্টার স্কাইমনিটরিং ভিডিও রিপোর্ট। মুখোশধারী লোকটি সবজান্তার মত স্কাই বোর্ড থেকে কম্পিউটার ডিস্ক বের করে নিল। যাবার সময় সে বলল অস্বাভাবিক ভরাট কণ্ঠে, গত এক ঘণ্টার কথা একদম ভুলে যাবে। না হলে স্কাইবোর্ড থেকে ডিষ্ক বের করার মত করে তোমার মাথা থেকে মেমরি-মগজ বের করে নেয়া হবে।’ বলে বের হয়ে গেল লোকটি। আমার সামনের গোটা পৃথিবী ওলট পালট হয়ে গেল। আতংকিত নয়, ঘটনাটা আমাকে বাকহীন পাথর করে দিল। সম্বিত ফিরে পেলাম টেলিফোন বেজে উঠার শব্দে। ধরলাম টেলিফোন। আমার চীফ বস জেনারেল আব্রাহামের টেলিফোন। তিনি বললেন, ‘মি. মরগ্যান, শত্রুরা নিউইয়র্কে আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতীকে আঘাত হেনেছে। ইমারজেন্সী ঘোষণা করা হয়েছে। ডিউটিরুম ত্যাগ করবে না।’ আমি তাঁকে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার পুরো বিবরণ দিলাম। তিনি বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, ‘এত দূরে আমাদের অফিসেও হামলা! তুমি তাড়াতাড়ি সব লিখে আমাকে ফ্যাক্স করো। আমি ওটা আমাদের সিকিউরিটি, গোয়েন্দা ও পুলিশকে দিয়ে তারপর তোমার অফিসে আসছি। আমি লিখিত দিয়েছিলাম। সব বিভাগকে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু ফল হয়নি। আমি জানতাম ফল হবে না। জেনারেল আব্রাহাম আমার আগেই রিটায়ার নেন। ‘গ্লোবাল হক’-এর সেদিনের ভুমিার সাথে ‘শত্রুর আক্রমণ তত্ব’ আমি মিলাতে পারিনি। সেখান থেকেই আমার সন্দেহ শুরু।’ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল মরিস মরগ্যান।
‘অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে ঘটনার অবিশ্বাস্য এক কাহিনী জানার সৌভাগ্য হলো। আর একটা বিষয়, স্কাইবোর্ড থেকে এরিয়াল দৃশ্যের মনিটর রেকর্ড তো ওরা নিয়ে যায় সেদিনই। কিন্তু পরে ‘গ্লোবাল হক’-এর ‘এরিয়্যাল রুট’ ও ‘তৎপরতার’ ছবি কি করে পেলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্কাই বোর্ডের এ রেকর্ড ছাড়াও আমি অ্যাডিশনাল রেকর্ডও শুরু করি। শুরু থেকে ঘটনার দৃশ্য নেবার জন্যে ‘রিভিউ রেকর্ডার’ও চালু রেখেছিলাম। ওরা এটা টের পায়নি। ঘটনা সম্পর্কে আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হবার পর ঐ দুটি রেকর্ড-ডিষ্কের একটা কপি আমি দিয়েছিলাম জেনারেল আব্রাহামকে, আরেকটা কপি আমি রেখে দিয়েছিলাম আমার কাছে। অফিসে ছিল এক কপি। কিন্তু অফিস ও জেনারেল আব্রাহামের কপি হারিয়ে যায়।’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘তাহলে আপনার কপির কথা ওরা জানতো না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে। আমাকে ওরা সন্দেহও করেনি। কারণ আমি একেবারেই নিরব হয়ে গিয়েছিলাম।
কথা শেষ করেই মরিস মরগ্যান তার পকেট থেকে একটা ইনভেলাপ বের করল এবং তা এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা এই ইনভেলাপে ‘গ্লোবাল হক’ এর উড্ডয়ন থেকে টাওয়ার ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত অনেকগুলো ছবি আছে এবং একটি ডিষ্ক আছে এতে।’
‘ধন্যবাদ জনাব’ বলে ছবির ইনভেলাপ গ্রহণ করার সময় আহমদ মুসা বলল, ‘একটা জিজ্ঞাসা জনাব। এই ঘটনায় গোপন ও কৌশলগত ‘গ্লোবাল হক’ বিমান ব্যবহৃত হবার ব্যাখ্যা কি?’
‘ওটা অনেক উপরের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমি ঐ ব্যাপারে কিছুই জানি না। তবে যেটা আমি উপলব্ধি করেছি, সেটা হলো, ঐ দিন ‘গ্লোবাল হক’-এর সাপ্তাহিক রুটিন মহড়ার দিন ছিল। প্রতি সপ্তাহে একদিন ‘গ্লোবাল হক’-এর জন্যে রুটিন মহড়া নির্ধারিত। একে সামনে রেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের অপারেশনের দিন ঠিক করে। ‘গ্লোবাল হক’-এর মহড়ার উড্ডয়নকেই বিশেষ অপারেশনের কাজে ব্যবহার করা হয়। আমি নিশ্চিত মনুষ্যবিহীন ‘গ্লোবাল হক’কে ঘাঁটি থেকে যিনি কম্পিউটার কমান্ড দিয়েছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, ঘটনার এক ঘণ্টা পর তিনি রহস্যজনকভাবে নিহত হন। সন্দেহ নেই, কাজে লাগানোর পর তাকে হত্যা করা হয় যাতে অতিগোপনীয় বিষয়টা বাইরে না যায়। তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্তের সাথে সাথে গ্লোবাল হককে অপারেশনের কাজে ব্যবহারের সকল চিহ্ন তারা মুছে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যেই সেফ এয়ার সার্ভিস অফিস থেকে ‘গ্লোবাল হক’ সেদিন কি কাজে ব্যবহার হয়, তার সাক্ষী ফিল্ম ডাকাতি করে তারা নিয়ে যায়।’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘কিন্তু তারা ‘সেফ এয়ার অফিস’-এর রুটিন লগ তখন সরায়নি! কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ, দিনটি রুটিন মহড়ার ছিল বিধায় লগে অস্বাভাবিকত্ব কিছু ছিল না তবে সন্দেহ উদ্রেককারী একটা বিষয় ছিল। লগের সাথে ছিল রুটের মনিটরিং রিপোর্টও। এই রিপোর্ট থেকে প্রমাণ হতে পারে টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার সময় ‘গ্লোবাল হক’ নিউইয়র্ক ষ্টেটের আকাশে ছিল।’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘ও এ কারণেই তাহলে পরে এই লগকে মিসিং দেখানো হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই, এটাই কারণ।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই মরিস মরগ্যান আবার বলে উঠল, ‘তোমরা অনেক কথাই জান দেখছি। নিশ্চয় অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছ। একটা দুটো প্রমাণ দিয়ে ওদের কাবু করা যাবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা শক্তিমান, বুদ্ধিমান, অর্থবান ও অতুল প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রমাণ কি?’
‘বেশি নয় শুধু তিনটি বড় প্রমাণের উপর আমরা ভরসা করছি।’ বলে আহমদ মুসা হাইজ্যাকার বলে কথিত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার মাউন্ট মার্সি থেকে এবং ধ্বংস টাওয়ারে ডাষ্ট পরীক্ষার রিপোর্ট সম্পর্কে সংক্ষেপে সব কথা মরিস মরগ্যানকে জানাল।
‘ও গড! তোমরা অসাধ্য সাধন করেছ। কিন্তু বৎস, তোমরা যা যোগাড় করেছ, সেগুলো তুখোড় যন্ত্র, কিন্তু চালনা করবে কে?’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘সেজন্যে ক্ষেপণাস্ত্রেরও ব্যবস্থা করেছি জনাব। আগামী দুতিন দিনের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের কাজ দেখবেন আপনি। প্রার্থনা করুন যেন-আমরা সফল হই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বর তোমাদের সাহায্য করুন।’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘আমরা উঠতে চাই জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই উঠবে। স্মরণীয় সময় খুব সংক্ষিপ্তই হয়ে থাকে। খুব খুশি হয়েছি তোমাদের দেখা পেয়ে। তাছাড়া জান, আমাদের ভাগ্নীদের সিদ্ধান্তেও আমি খুব খুশি। ধর্ম বিশ্বাসকে নবায়ন করতে চাইলে, তার জন্যে বিশ্বে ইসলামই একমাত্র বিকল্প। তারা তাই করেছে।’ বলল মরিস মরগ্যান।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমাদের ধর্মে একটা কথা আছে, নিজের জন্যে যা পছন্দ করবে, অন্যের জন্যেও তা পছন্দ করা উচিত। এই কথাকে বোধ হয় এভাবেও বলা যায়, অন্যের জন্যে যা পছন্দ করবে, নিজের জন্যেও তা পছন্দ হওয়া উচিত।’
হাসল বৃদ্ধ মরিস মরগ্যানও। বলল, ‘তুমি অসাধারণ আহমদ মুসা। অত্যন্ত শক্ত কথা তুমি শুধু সহজ করে নয় সুন্দর করেও বলতে পার। কিন্তু এই সুন্দর কথা শোনার সুন্দর বয়স আমার নেই। অস্তাচলের সময়টা শুধু বিয়োগের, সংযোজনের নয়। প্রাকৃতিক বিধানও এটাই।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে নামল গাম্ভীর্যের একটা পাতলা ছায়া। বলল, ‘গতির জগৎ এই পৃথিবীর জন্যে একথা সত্য, কিন্তু মানব জীবনের অস্তাচল চিরন্তন স্থিতির জগতের সোবহে সাদেক মাত্র। মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়ে মানুষ এই স্থিতির জগতে প্রবেশ করে। শেষ নিঃশ্বাসের পূর্ব পর্যন্ত মানুষকে চিরন্তর স্থিতির জগতের জন্যে পাথেয় যোগাড় করতে হয়। এই পাথেয়র প্রকৃতি ও পরিমাণই নিরুপণ করে স্থিতির জগতে তার পাওয়া ও পজিশন কেমন হবে। সুতরাং অস্তাচলের শেষ পর্যন্তও পাথেয়র সংযোজন চলতে হবে।’
‘আহমদ মুসা তুমি পরম দর্শন-তত্বের কথা বলছ। আমি বলেছি মাটির মানুষের অনিত্য জীবনের কথা।’ বলল মরিস মরগ্যান।
‘গতির জগতে দুনিয়ার সবকিছুই অনিত্য। কিন্তু এই জগতের অনিত্য জীবনই অনন্তের পাথেয়। সুতরাং মাটির মানুষের জীবন অনন্তের সাথে সম্পর্কিত, বিচ্ছিন্ন নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
বৃদ্ধ মরিস মরগ্যানের চোখে-মুখে আনন্দ ও বিস্ময়ের ছাপ। বলল সে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে, ‘আমাদের অনিত্য জীবনটা অনন্তের পাথেয় সংগ্রহের জন্যেই, জীবনের অস্তাচল ক্ষয়মান হলেও পাথেয়র সংযোজন এ সময় বাড়িয়ে চলতে হবে, এই তো?’
‘ঠিক তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল বৃদ্ধ মরিস মরগ্যান। বলল, ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতির দিক দিয়ে তোমার কথা পরম এক সত্য। কিন্তু আমি কথাটা বলেছিলাম জীবনের জৈবিক দিক সামনে রেখে। এখন বল, আমার ভাগ্নীদের জন্যে যেটা ভাল মনে করেছি, সেটা নিজের জন্যে ভাল মনে করলেই কি পাথেয়র ব্যবস্থা আমার হয়ে যাবে?’
‘এ প্রশ্নের জবাব তো আপনি দিয়েছেন এই কথা বলে যে, ধর্ম বিশ্বাস নবায়ন করতে চাইলে তার জন্যে ইসলামই একমাত্র বিকল্প।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আমি ধর্ম বিশ্বাসকে নবায়ন বা পুনরুজ্জীবন করতে যদি না চাই?’ বলল মরিস মরগ্যান। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
মুখ টিপে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এইমাত্র আপনি বললেন জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতির দিক থেকে দুনিয়ার অনিত্য জীবনে আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্যে পাথেয় সংগ্রহের বিষয়টা একটা পরম সত্য। এই পরম সত্যটা মুলত ধর্মের সত্য। একমাত্র ধর্ম অবলম্বন বা অনুসরণ করেই এই পরম সত্য লাভ করা সম্ভব। সুতরাং ধর্ম বিশ্বাসের নবায়ন বা পুনরুজ্জীবন আপনাকে করতেই হচ্ছে।’
সংগে সংগে উত্তর দিল না মরিস মরগ্যান। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ভারী কোন চিন্তার গভীরে নিমজ্জিত সে। এক সময় সে ধীর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমার প্রায় ৮০ বছরের অচল নিস্ক্রিয় জীবনকালে তুমি আমাকে একি শোনালে আহমদ মুসা! আমার সামনে নতুন এক জীবন বোধের দরজা যে খুলে দিলে তুমি! আমি তো জীবনকে এভাবে কোন দিন দেখিনি! কেউ বলেনি আমাকে এভাবে! এখন মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে নয় ভয় হচ্ছে আমি আমার দুনিয়ার অনিত্য জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়েছি, তার মানে অনন্ত জীবনেও আমি কিছু পাব না, মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ ও বিড়ম্বিত হব আমি সেখানে!’ ভারী ও কম্পিত কণ্ঠে সে কথা শেষ করল। তার দুচোখের কোণায় অশ্রু চিক চিক করছে।
শান্ত কণ্ঠে ও সান্ত¦নার সুরে আহমদ মুসা বলল, ‘জনাব, সর্বশেষ যে বাক্য দিয়ে আপনি কথা শেষ করলেন, সে ধরনের কথা বলার সময় এখনও আসেনি। আপনার দুনিয়ার জীবন শেষ হয়নি, আখেরাতের অনন্ত জীবন এখনও অজানা দূরত্বে।’
‘অজানা দূরত্বে হলেও একথা তো আমি জানি, সে অনন্ত জীবনের জন্যে উপযুক্ত পাথেয় সংগ্রহের অনেক সময় আমার নেই।’ বলল মরিস মরগ্যান নরম কণ্ঠে। চোখের কোণায় জমে ওঠা দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার গন্ড দিয়ে।
‘আল্লাহর কাছে ‘উপযুক্ত পাথেয়’ বিবেচ্য বিষয় সব সময় নয়। যদি তিনি দেখেন তাঁর বান্দা উপযুক্ত পাথেয় সংগ্রহের জন্যে উপযুক্ত যাত্রা শুরু করেছে, কিন্তু যাত্রা শেষ করার সময় তার হয়নি, তাহলে করুণাময় আল্লাহ ফুল মার্ক অর্থাৎ উপযুক্ত পাথেয় তাকে দিয়ে দেন।’ এই কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগে ভারী হয়ে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠও।
ওদিকে মরিস মরগ্যান-এর দুচোখ দিয়ে দর দর করে নেমে এল অশ্রু। আকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সত্যি বলছ আহমদ মুসা! অনন্ত সে জীবন আমি সুন্দর করে পাব? এখনও সফল হবার সময় তাহলে আমার আছে? তাহলে আমার হাত ধর আহমদ মুসা। আমাকে নিয়ে চল ‘উপযুক্ত যাত্রা’ শুরুর পথে।’
বলে বৃদ্ধ মরিস মরগ্যান জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসার হাত।
মিসেস মরগ্যান অনেকক্ষণ এসে দাঁড়িয়েছে একটু দূরে, মরিস মরগ্যানের পেছনে। সেও শুনছিল উভয়ের কথা অবাক বিস্ময়ে।
সে এবার ধীরে ধীরে এসে স্বামীর পাশে বসল। সে তার হাত ন্যস্ত করল স্বামীর বাহুর উপর।
মরিস মরগ্যান আহমদ মুসার একটা হাত জড়িয়ে ধরলে আহমদ মুসাও দুহাত দিয়ে তার হাত জড়িয়ে ধরেছে।

Top