৩৯. ধ্বংস টাওয়ারের নীচে

চ্যাপ্টার

মাউন্ট মার্সি রেডইন্ডিয়ান রিজার্ভ-এর ফেডারেল কমিশনার ওয়ারেন ওয়েলেসলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কাহোকিয়ার ইনষ্টিটিউট অব আমেরিকান রেডইন্ডিয়ান ষ্টাডিজ-এর প্রধান আরাপাহোর কথা।
প্রফেসর আরাপাহোর পাশে বসে আছে জোসেফ জন ওরফে আহমদ মুসা। তার পরিচয় সে প্রফেসর আরাপাহোর একজন সহকারী রেডইন্ডিয়ান বিশেষজ্ঞ।
আর কমিশনার ওয়ারেন ওয়েলসলির আমন্ত্রণে উপস্থিত আছেন ঈগল সান ওয়াকার। কমিশনার অফিসের সিভিল অফিসার সান ইয়াজুনো’র বন্ধু সে। তার মাধ্যমেই সান ওয়াকারের সাথে কমিশনারের পরিচয়। কমিশনার দেশবরেণ্য প্রতিভা সান ওয়াকারের প্রতি দুদিনেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। রেডইন্ডিয়ান বিষয়ক আলোচনা বলেই কমিশনার সান ওয়াকারকেও ডেকেছে। অফিসের আরও দুজন বৈঠকে হাজির। তাদের একজন ফেডারেল কমিশনার অফিসের প্রধান প্রশাসনিক অফিসার টমাস ওয়াল্টন এবং সিভিল এ্যাফেয়ার্স অফিসার সান ইয়াজুনো।
আলোচনা বসেছে ফেডারেল কমিশনারের অফিসে।
কথা শেষ করে থামল প্রফেসর আরাপাহো।
প্রফেসর আরাপাহো থামতেই কমিশনার ওয়ারেন ওয়েলসলি বলে উঠল, ‘আমাদের সম্মানিত অতিথি প্রফেসর আরাপাহোর কাছে এ বিষয়ে আমি আগেই শুনেছি। এখন আরও বিস্তারিত উনি বললেন। আমি এ ব্যাপারে প্রথমে মি. টমাস ওয়ালটনের বক্তব্য শুনতে চাই।’
‘ধন্যবাদ স্যার’, বলতে শুরু করল টমাস ওয়ালটন, ‘বিষয়টির সাথে আমাদের অফিসের তেমন কোন যোগসূত্র দেখছি না। আমাদের একটা ইনফরমেশন দেয়াই যথেষ্ট মনে করি। এ বিষয়টির সাথে কিছুটা যোগ আছে অপরাধ-আইনের। স্যার তো বললেনই থানার আপত্তি নেই। তবে কবর খননের সময় তারা হাজির থাকতে চায়। প্রফেসর স্যারও এটাই চান। এই অবস্থায় আমরা কোন সমস্যা দেখি না। থানার মত ঘটনার সময় আমরাও হাজির থাকতে চাই, এটুকু দাবি বোধ হয় আমরা করতে পারি।’
টমাস ওয়ালটন থামতেই কমিশনার ওয়ারেন ওয়েলসলি বলল, ‘ধন্যবাদ মি. ওয়ালটন। এবার সান ইয়াজুনো তোমার মত বল।’
‘স্যার আমি মি. ওয়ালটনের সাথে একমত। শুধু একটা কথাই যোগ করব। এ বিষয়ে এখানকার রেডইন্ডিয়ান কমিউনিটি কর্তৃপক্ষের অনুমতি দরকার। আমি প্রফেসর স্যারের কাছে শুনেছি তিনি এ বিষয়ে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেছেন। তারা এতে আপত্তি করেননি। আজ কমিউনিটি নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে বসছেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবেই তারা এর অনুমতি দেবেন। আমি মনে করি প্রফেসর স্যারকে যতটা পারা যায় আমাদের সহযোগিতা করা দরকার।’ বলল সান ইয়াজুনো।
কমিশনার তাকালো সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘তুমি এখানে অতিথি হলেও তোমার এ ব্যাপারে মতামত আমাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে। কিছু তুমি বল।’
‘প্রফেসর স্যার যে কাজ নিয়ে এসেছেন, সেটা আমাদের সকলের কাজ। আমি মনে করি, সকল প্রশ্ন, সকল জিজ্ঞাসা, সকল সন্দেহ, ইত্যাদির তাৎক্ষণিক সমাধান হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এতে সমাজ, দেশ সুস্থ থাকবে।’ সান ওয়াকার বলল।
সান ওয়াকার থামলে কমিশনার ওয়ারেন ওয়েলেসলি বলল প্রফেসর আরাপাহোকে লক্ষ্য করে, ‘হয়ে গেল মি. প্রফেসর। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি যা ভাবছিলাম, সকলের কাছ থেকে সেটাই শুনলাম। তাহলে আপনি কমিউনিটি নেতাদের সাথে আলোচনা করে কাজ শুরু করে দিন। কবে শুরু করছেন, আমাদের দয়া করে জানাবেন। আমরাও থাকব সাথে।’
‘ধন্যবাদ। খুব খুশি হলাম সহযোগিতার জন্যে। থানাও সাথে থাকবে। তাদের কাছ থেকে তারিখ কনফার্ম করে আপনাদের জানাব।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘আরও কিছু কথা হলো। তারপর বিদায় নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল প্রফেসর আরাপাহো এবং আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে এ সময় সান ওয়াকারও ছুটে এসে তাদের সাথে যোগ দিল। বলল, ‘কমিউনিটি নেতাদের বৈঠকে চলুন আমিও যাব।’
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের মিটিং বেশ আগে শুরু হয়ে যাবার কথা। এখানে আমাদের একটু বেশি সময় লাগল।’
‘মিটিং শুরু হতেই বেশ দেরি হয়েছে। থাক, শেষটা ভালই হয়েছে। চিন্তা নেই, কমিউনিটি নেতাদের মিটিং-এ আমাদের কোন ভূমিকা নেই। আমাদের কথা সবাইকে বলেছি। সবাই জানে। সবাই সানন্দে সহযোগিতা করতেও রাজি হয়েছে। অতএব কোন সমস্যা হবার কথা নয়। গড ব্লেস আস।’
কথা শেষ করেই বলল, ‘আর দেরি নয়, চল। মিটিং-এর শেষটা আমরা ধরতে চাই।’ বলে গাড়িতে উঠল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা ও সান ওয়াকারও গাড়িতে উঠল। আহমদ মুসা বসেছে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসারা যখন মিটিং-এ উপস্থিত হলো,তখন মিটিং শেষ পর্যায়।
মিটিং বসেছে মাউন্ট মার্সি রেডইন্ডিয়ান কমিউনিটির প্রধান সিনর সোপাহারোর বিশাল দরবার খানায়। দরবার খানার বিশাল হলের চারদিক জুড়ে সোফা ষ্টাইলের ঐতিহ্যবাহী গদি বসানো। কমিউনিটির বিভিন্ন অংশের সরদাররা বসেছেন সুদৃশ্য গদিগুলোতে। ঘরের মাঝ বরাবর দেয়াল ঘেঁষে স্থাপিত সিংহাসনাকৃতির বিশাল গদিতে বসেছে সিনর সোপাহারো। তার দুপাশে কয়েকটা গদি খালি।
আহমদ মুসারা দরবার হলে প্রবেশ করতেই মাউন্ট মার্সি’র রেডইন্ডিয়ান প্রধান সিনর সোপারাহো আনন্দ উচ্ছাসের সাথে বলল, ‘সম্মানিত প্রফেসর আসুন। আপনাদের সবাইকে এ দরবারে স্বাগত। আপনাদেরই এখন আশা করছিলাম। ঠিক সময়েই এসেছেন।
‘ধন্যবাদ সরদার।’ বলে প্রফেসর আরাপাহো দুহাত তুলে কমিউনিটির সব নেতাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সকলকে গুড ইভিনিং।’
তারপর প্রফেসর আরাপাহো আহমদ মুসা ও সান ওয়াকারকে নিয়ে এগুলো সিনর সোপাহারোর দিকে।
সিনর সোপাহারো উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল প্রফেসর আরাপাহোকে এবং নিজের ডান পাশের আসনটার দিকে ইংগিত করে প্রফেসর আরাপাহোকে বসতে বলল। বাম পাশের দুআসনে বসাল আহমদ মুসা ও সান ওয়াকারকে।
তারপর নিজে তার আসনে ফিরে গিয়ে সিনর সোপাহারো প্রফেসর আরাপাহোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘প্রফেসর স্যার, আপনার বিষয় নিয়ে আমি আমার সরদারদের সাথে আলোচনা করেছি। তারা সকলেই আপনার চিন্তার সাথে একমত। কিন্তু তারা কতগুলো কৌতূহল প্রকাশ করেছেন, যার জবাব আপনার কাছে আছে।’
‘ওয়েলকাম সরদার। আমি তাঁদের কৌতুহল মিটানোর সুযোগ পেলে খুবই খুশি হবো।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘প্রফেসর স্যার, অনেকের কৌতুহল, এখানে গণকবর থাকার কথা কেউ জানে না, এমনকি শোনেওনি কেউ, এ বিষয়টা অবহিত হলেন কিভাবে?’ বলল সিনর সুপাহারো।
‘ধন্যবাদ সরদার সিনর সুপাহারো। রেডইন্ডিয়ানদের বিষয়ে, রেডইন্ডিয়ানদের এলাকা বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য, ইনফরমেশন ইত্যাদি বরাবরই বিভিন্নভাবে আমাদের ইনষ্টিটিউটে আসে। কেউ চিঠিপত্রের মাধ্যমে জানান। কেউ রেকডকৃত অডিও ভিডিও ক্যাসেট পাঠান। পত্র-পত্রিকা ম্যাগাজিনও অনেকে পাঠান। মাউন্ট মার্সির গণকবরের সংবাদ এইভাবে কয়েকটি সূত্র থেকে আমার কাছে আসে। তারা জানান, রেডইন্ডিয়ানদের স্বার্থেই এর অনুসন্ধান প্রয়োজন। আমি এ বিষয়টার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু একটা সূত্র যখন আমাকে স্থান নির্দিষ্ট করে বলল, তখন আমি বিষয়টাকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছি এবং আপনাদের কাছে এসেছি।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
প্রফেসর আরাপাহো থামতেই এক পাশ থেকে সরদারদের একজন বলে উঠল, ‘স্যার তাদের স্বার্থ কি? তারা কেন চায় এটা খনন হোক?’
প্রফেসর আরাপাহো মিষ্টি হাসল। বলল, ‘পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে বা নিজের স্বার্থ কোরবানী দিয়েও সত্য সন্ধানে, রহস্য সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এখানে আমি মনে করি সত্য সন্ধানটাই মূখ্য।’
‘স্যার এটা করতে গিয়ে আমরা কোন সমস্যার জড়িয়ে পড়ব না তো?’ অন্য প্রান্ত থেকে আরেকজন সরদারের জিজ্ঞাসা।
‘বিষয়টা অতীতের সাথে সম্পর্কিত। বর্তমানের সাথে নয়। এই ইন্ডিয়ান রিজার্ভের কেউ-ই যেহেতু এ বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাই এখানকার কেউ এর সাথে সম্পর্কিত হবার প্রশ্নই ওঠে না।’
‘স্যার, খনন করে গণকবর যদি পাওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ আপনার কি হবে?’ আরেকজন সরদারের জিজ্ঞাসা।
‘সত্যটা জানতে চাই। গণকবরে ওরা কারা? রেডইন্ডিয়ান কিনা? কত দিন আগে ওদের এই পরিণতি ঘটে? এ বিষয়গুলো যদি জানা যায়, তাহলে আমাদের ইতিহাসের এক অংশ হবে এটা।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
প্রফেসর আরাপাহো থামল। কোন দিক দিয়ে কোন প্রশ্ন আর এল না। মুখ খুলল এবার সিনর সুপাহারো। বলল, ‘ধন্যবাদ প্রফেসর স্যার। আমি মনে করি সবাই আশ্বস্ত হয়েছে। আমার একটা পরামর্শ, আপনার এ উদ্যোগের সাথে আমরা তো আছিই, পুলিশ এবং ফেডারেল কমিশনার অফিসকে জড়িত করা দরকার।’
‘জি সরদার। ওদের সাথে কথা বলেছি। ওরা থাকবেন আমাদের সাথে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘তাহলে আর কোন কথা নয়। আমাদের পূর্ণ সম্মতি আছে। আপনি অগ্রসর হোন।’ সিনর সুপাহারা বলল হাসি ভরা মুখে।
প্রফেসর আরাপাহো উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ সরদার, ধন্যবাদ সকলকে।’
আরও দুচারটি কথার পর কফি পান পর্ব শেষে মিটিং-এর সমাপ্তি ঘোষণা হলো।
আহমদ মুসারা ফিরে এল সিনর সুপাহারোর অতিথি হিসেবে রয়েছে মাউন্ট মার্সিতে আসার পর থেকেই। আহমদ মুসারা এখানকার ট্যুরিষ্ট রেষ্ট হাউজে উঠেছিল। কিন্তু মাউন্ট মার্সি’র রেডইন্ডিয়ান কম্যুনিটির প্রধান তাদেরকে রেষ্ট হাউজে থাকতে দেয়নি। বলতে গেলে জোর করেই নিয়ে এসেছে তার আলিশান মেহমান খানায়।
আহমদ মুসা তার কক্ষে এসে ধপ করে বসে পড়ল, গাটা এলিয়ে দিল সোফায়। মনটা তার খুব হাল্কা লাগছে আজ। কয়েকদিন বেশ টেনশনে কেটেছে। প্রথম দিকে কমিউনিটি সরদাররা এ ব্যাপারটা বুঝতেই চায়নি। তাছাড়া এখানকার পুলিশও ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। ফেডারেল কমিশনারের অফিসও এর সাথেজড়িত হতে দ্বিধা করেছে। প্রফেসর আরাপাহোর ইমেজ ও অব্যাহত চেষ্টা এবং পেছনে থেকে সান ওয়াকারের বন্ধু সান ইয়াজুনোর চেষ্টা গোটা বিষয়কে অবশেষে সহজ করে দিয়েছে। পুলিশ আগেই রাজি হয়েছিল। ফেডারেল কমিশনারের অফিস ও কমিউনিটি সরদারদের গুরুত্বপূর্ণ সম্মতিও আজ পাওয়া গেল। এখন যে কোন মুহূর্তে কাজ শুরু করা যায়।
এসব ভাবনায় আহমদ মুসা যখন ডুবে আছে, তখন প্রফেসর আরাপাহো এবং সান ওয়াকার প্রবেশ করল আহমদ মুসার ঘরে।
ওদের দেখে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল।
সান ওয়াকার গিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল। আর প্রফেসর আরাপাহো আহমদ মুসার মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘জোসেফ জন ওরফে…… থাক নাম ধরব না। এখন বল, তোমার পরিকল্পনা কি? যে কোন সময়ে কাজ শুরু করতে পার। আমার প্রতœতাত্বিক খননকারী গ্রুপও আজ বিকেলের মধ্যে পৌছে যাবে।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। আপনি একটা অসাধ্য সাধনের মত কাজ করেছেন। আমি………’ আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না।
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘দেখ সাগর যদি নদীর গভীরতা নিয়ে প্রশংসা করে, সেটা খুবই লজ্জার। আমি তোমার প্রশংসা শুনতে আসিনি। আমি জানতে এসেছি তোমার পরিকল্পনা।’
স্যার আমি এখন টেলিফোন করব আমাদের ‘ক্রিশ্চিয়ান কার্টার’ ওরফে ‘বুবি’কে (বুমেদীন বিল্লাহকে)। আজই তাকে আসতে বলব। সে এলেই খনন কাজ শুরু করা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার জন্যে অপেক্ষা কেন?’ জিজ্ঞাসা প্রফেসর আরাপাহোর।
‘সে মূলত ফ্রান্সের লা’মন্ডে পত্রিকার সাংবাদিক। তাছাড়া সে ফ্রি ওয়ার্ল্ড (FWTV) এবং ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি (WNA)-এর আন্ডার গ্রাউন্ড রিপোর্টার। বিশ্বব্যাপি উপযুক্ত প্রচার এখন হবে আমাদের প্রধান অবলম্বন। এক্ষেত্রে সেই হবে আমাদের এখন প্রধান অস্ত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি জোসেফ জন। মিডিয়া যুদ্ধের মাধ্যমেই জয় নিশ্চিত করতে চাও। গড ব্লেস আস অল।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলেই আহমদ মুসা মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। মোবাইলের ডিজিটাল নাম্বারে নক করতে করতে প্রফেসর আরাপাহোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মাফ করুন স্যার, টেলিফোনটা সেরে নিই।’
কথা শেষ করতেই টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে ড. হাইকেলের কণ্ঠ শোনা গেল।
‘গুড ইভিনিং ড. হ্যামিল্টন। আপনি কেমন আছেন? ওখানে কি মি. কার্টার ওরফে ‘বুবি’ আছে?’ এ প্রান্ত থেকে বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম। গুড ইভিনিং। হ্যাঁ বুবি আছেন। ইউরোপ থেকে যার আসার কথা তিনিও আছেন। কেমন আছ তুমি? ওদিকের খবর কি?’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘এ দিকের খবর খুবই ভাল। ব্যবস্থা সব সম্পূর্ণ। দুএকদিনের মধ্যেই কাজ শুরু করব। ‘বুবি’কে পরে কিন্তু তার আগে ইউরোপ থেকে আসা মেহমানকে দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওকে। গড ব্লেস আস অল।’ ওপার থেকে বলল ড. হাইম হাইকেল।
পরক্ষণেই টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে কামাল সুলাইমানের কণ্ঠ শুনতে পেল আহমদ মুসা। বলল, ‘কাসু কেমন আছ? ওদিকে কতদূর এগুলে?’
‘সুখবর তিন ক্ষেত্রেই। যেমন আপনি চেয়েছিলেন সেভাবে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় প্যাকেট ম্যাটেরিয়াল যোগাড় করা হয়েছে। প্রত্যেক প্যাকেটেই প্রত্যয়নমূলক সিল সিগনেচার রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, আমি হোটেল ছেড়ে দিয়েছি।’ বলল কামাল সুলাইমান।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। সমস্যা বলতে কামাল সুলাইমান কি বলতে চেয়েছে বুঝেছে আহমদ মুসা। বলল, ‘ভাল করেছ। পরবর্তী কাজগুলো?’
‘যেদিন পেয়েছিলাম নমুনা, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী সেদিনই একটি করে প্যাকেটের ম্যাটেরিয়াল দিয়েছিলাম সেই নির্দিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু রেজাল্ট নিতে যাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা হন্যে হয়ে উঠেছে। পাহারা বসিয়েছে সবখানে।’ বলল কামাল সুলাইমান। বিষণœ কণ্ঠ তার।
‘ঠিক আছে। ধীরে চল। আজই ‘বুবি’কে এখানে পাঠিয়ে দাও। তাকে এখানে দরকার। শোনাও যাবে তার কাছ থেকে সব।’ বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
‘ঠিক আছে। ‘বুবি’র সাথে কথা বলবেন?’
‘আর প্রয়োজন নেই। তুমি তাকে বলে দাও। আজই যেন সে আসে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। পাঠাচ্ছি ওকে। আর কোন নির্দেশ?’ জিজ্ঞাসা কামাল সুলাইমানের।
‘সাবধানে যতটুকু এগুনো যায় এগোও আর খোঁজ নাও। পারলে ডেলিভারি নাও। সম্ভব না হলে সাধ্যমত খোঁজ খবর রাখ। মনে রেখ দুনিয়াতে একমাত্র শিশাই নিশ্চিদ্র। আর সবকিছুর মধ্যে ছিদ্র আছে, ফাঁক আছে। এই ফাঁকের সন্ধান কর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আপনার নির্দেশ বুঝেছি।’ বলল ওপার থেকে কামাল সুলাইমান।
‘ধন্যবাদ, কাসু। আজকের মত এখানেই শেষ। গড ইজ উইথ আস। বাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাই।’ কামাল সুলাইমান বলল।
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। কিছু বলার জন্যে আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই প্রফেসর আরাপাহো বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা, কোন খারাপ খবর?’
‘ভালোমন্দে মেশানো স্যার।’
‘কেমন?’
‘থ্যাংকস, কামাল সুলাইমান নিউইয়র্কের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ডাষ্ট যোগাড় করেছে। কামাল সুলাইমানের সাথে খোলামেলা কথা বলা গেল না। কিন্তু যতটুকু কথা হলো, তাতে বুঝলাম এই ডাষ্ট সংগ্রহ করার বিষয়টা ‘ওপারেশন মেগা ফরচুন’ গ্রুপ (ও.এম.এফ গ্রুপ) জেনে ফেলেছে এবং তারা কামাল সুলাইমানের হোটেলের ঠিকানাও পেয়ে যায়। কামাল সুলাইমানও এটা আঁচ করতে পারে। সে হোটেল ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র সরে গেছে। ডাষ্টগুলো নিউইয়র্কের তিনটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে ডাষ্টগুলোর পরিচয় প্রকাশ না করে। কামাল সুলাইমান আশংকা করছে, ও.এম.এফ গ্রুপ সবগুলো ল্যাবরেটরীর দিকে নজর রাখছে। সে কারণে রেজাল্ট সংগ্রহ করতে এখনও সে যায়নি। ফলে ওদিকে কাজটা থেমে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. কামাল সুলাইমানের পক্ষ থেকে ডাষ্ট পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে এটা কি তারা জানতে পেরেছে?’ সান ওয়াকার বলল।
‘বিষয়টা এত খোলামেলা ওর সাথে আলোচনা হয়নি। তবে আমার মনে হয় ওরা সন্দেহের উপর পাহারা বসিয়েছে, যাতে আমরা ডাষ্ট পরীক্ষা করতে না পারি। তিনটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্যে ডাষ্ট জমা দেয়া হয়েছে, ডাষ্ট সংগ্রহ করার এক ঘণ্টার মধ্যে ডাষ্টের তিনটি ভিন্ন পরিচয়ে এবং তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে। কামাল সুলাইমানই তিন নাতে তিন ব্যক্তি সেজেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘থ্যাংকস গড। সব আট-ঘাট বেঁধেই কাজটা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা নিশ্চয় ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ আমি জানি, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের এসব ল্যাবরেটরিতে প্রতিদিন টেষ্টের জন্যে শত শত কেস জমা হচ্ছে। এই অবস্থায় ডাষ্টের পরিচয় ও জমাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম না জানলে বাঞ্জিত জিনিস বের করা মুষ্কিল।’ সান ওয়াকার বলল।
‘তোমার কথাই যেন সত্য হয় সান ওয়াকার। সমস্যা হলো, ভিন্ন নামে জমা হলেও একই ব্যক্তি তিন জায়গায় গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর টিভি ক্যামেরায় এ ছবি উঠেছে।’ বলে আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘নিউইয়র্কের এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করছি, কাল সকালেই গণকবরের খনন কাজ শুরু হওয়া দরকার। আমার বিশ্বাস কাল সকালের মধ্যে আমাদের বিল্লাহ এখানে পৌছে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আজই পুলিশ, ফেডারেল অফিসসহ সবাইকে জানিয়ে দিতে হয়।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘জি স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অল রাইট। তাহলে এখনই কাজে নামতে হয়।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘খননের পরের বিষয়গুলো কি চিন্তা করেছেন ভাইয়া?’ জিজ্ঞাসা সান ওয়াকারের।
‘পরের কাজও তোমার এবং স্যারেরই বেশি। যে কয়টা দেহাবশেষ পাওয়া যাবে তার প্রত্যেকটি থেকে ৪টি করে দাঁত, প্রত্যেকটির থেকে দুপ্যাকেট করে দেহাবশেষ নিয়ে যেতে হবে শিকাগোতে পরীক্ষার জন্যে। আমার পরীক্ষার বিষয় তিনটি। এক. লোকগুলো কোন জাতি গোষ্ঠীর, দুই. লোকগুলো কয় তারিখে কতটার সময় নিহত হয়েছে, এবং তিন. তারা কিভাবে নিহত হয়েছে। স্যারের সাথে শিকাগোর সংশ্লিষ্ট দুটি ল্যাবরেটরীর কথা হয়েছে। তারা বলেছে দাঁত ও দেহাবশেষ পেলে তিন বিষয়েই তারা নিখুঁত তথ্য দিতে পারবে। সুতরাং স্যার এবং তোমাকেই এ মিশন নিয়ে শিকাগো যেতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু এই ডকুমেন্টগুলার প্রামাণ্যতা নিরুপিত হবে কিভাবে?’ সান ওয়াকার বলল।
‘এ ব্যাপারে আমি প্রফেসর স্যারের সাথে আলোচনা করেছি। আমার চিন্তা হলো, ‘গণকবর থেকে পাওয়া প্রত্যেকটা দেহাবশেষ বিষয়ে চারটা প্যাকেট হবে। দুটি দাঁতের প্যাকেট, আর দুটি দেহাবশেষের প্যাকেট। দাঁতের দুপ্যাকেটের প্রত্যেকটিতে দুটি করে দাঁত থাকবে। দেহাবশেষের দুটিতে একই জিনিস থাকবে। প্রত্যেকটা প্যাকেট সকলের উপস্থিতিতে সিল করা হবে এবং প্রত্যেকটি প্যাকেটে প্রত্যয়নমূলখ স্বাক্ষর থাকবে পুলিশের থানা কর্তৃপক্ষের, ফেডারেল কমিশনার অফিসের এবং রেডইন্ডিয়ান কমিউনিটি প্রধানের। অর্থাৎ প্রত্যেকটি দেহাবশেষের প্রত্যেক বিষয়ে দুটি করে সীল প্যাকেট হবে। দুটি প্যাকেটের একটি ল্যাবরেটরিতে দেয়া হবে পরীক্ষার জন্যে, আর একটি আমাদের হাতে থাকবে রেকর্ড হিসাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। নিñিদ্র ব্যবস্থা হয়েছে। প্রমাণের বিষয়টা নিয়েই আমার উদ্বেগ ছিল।’ বলল সান ওয়াকার।
‘কিন্তু একটা বিষয়, ‘অবশিষ্ট দেহাবশেষ থাকবে কোথায়?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘কোন গণকবর আবিষ্কৃত হবার পর এর দায়িত্ব বর্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষক কর্তৃপক্ষের উপর। সেই হিসেবে পুলিশ গণকবরের দেখা-শোনা করবে, যতদিন না উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাদের বিধি-ব্যবস্থা শেষ না করেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। ঠিক, এটাই আইন।’ বলে উঠে দাঁড়াল প্রফেসর আরাপাহো। বলল, ‘আমি যাই। ওদিকে গিয়ে দেখি, সকালেই কাজ আমরা শুরু করব। তুমি রেষ্ট নাও। বাই।’
প্রফেসর আরাপাহো চলে গেলে সান ওয়াকার বলল, ‘আমিও উঠি। সন্ধ্যার পর আসব।’
সান ওয়াকার যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল।
‘ঠিক আছে। এস। কিন্তু শোন, তুমি সান ইয়াজুনোকে বলো সে যেন ফেডারেল কমিশনার অফিস এবং পুলিশ ষ্টেশনের কথা-বার্তা, চিন্তা-ভাবনার দিকে নজর রাখে। তারা যত বেশি আমাদের সহযোগী হয়, ততই ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কিছু আশংকা করেননি তো?’ সান ওয়াকার বলল নিচু কণ্ঠে।
‘সে রকম কিছু কারও মধ্যেই আমি দেখিনি। আমি বলছি যেটা এ কারণে যে আমাদের সাবধান হতে দোষ নেই।’
‘তাহলে আমি সন্ধ্যায় এদিকে আসছি না। সান ইয়াজুনোর সাথে আমি পুলিশ ষ্টেশনের দিকেই যাব।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু তোমরা কালকে সকালের ব্যাপারে ওদের কিছু বলবে না। ওটা বলবেন প্রফেসর স্যার ফরমালি ওদেরকে।’
‘ঠিক আছে, চলি। আচ্ছা………।’ কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে সান ওয়াকার বলল, ‘মনেই থাকে না যে, আমাদের সালাম-কালাম সব শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে।’
‘তা রাখা হয়েছে, কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শিকায় তোলা নেই।’ আহমদ মুসা বলল হেসে উঠে।
‘সে ভুল হবে না অবশ্যই। আচ্ছা ভাইয়া, আজ সকালে কিন্তু ভাবীর কাছে আপনার টেলিফোন করার কথা ছিল, রাতে বলেছিলেন।’
‘ধন্যবাদ বিষয়টা মনে করিয়ে দেবার জন্যে। সকালে করেছিলাম, সন্ধ্যার পর আবার টেলিফোন করতে হবে।’
‘বিশেষ কোন খবর আছে?’
‘না, সকালে পাইনি। হাসপাতালে গিয়েছিলেন। মোবাইল বন্ধ ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হাসপাতালে কেন?’ প্রশ্ন করল সান ওয়াকার। তার চোখে-উদ্বেগ।
‘উদ্বেগের কিছু নেই রুটিন চেকিং। মেয়াদের শেষ দিকে তো! ওকে সব ব্যাপারে এখন সাবধান থাকতে হচ্ছে। ছোট-খাট ব্যাপারেও ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন হয়।’
‘ওখানকার সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথেও আপনার কথা বলা উচিত।’
‘মদিনাতুন্নবী স্পেশালাইজড ষ্টেট হাসপাতালের চীফ ড. ফাতেমার কেয়ারে উনি আছেন। আমি তার সাথে কথা বলেছি। আগে থেকেই তিনি আমার পরিচিত।’
‘থ্যাংকস গড। আসি। বাই।’ বলল সান ওয়াকার।
‘এস। বাই।’ বিদায় জানাল আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে।

‘নিউইয়র্ক অ্যাটোমিক ল্যাবরেটরী’র ডকুমেন্ট ডেলিভারি কাউন্টার।
সময় সকাল ৮টা। সবেমাত্র অফিস খুলেছে। দিনের কাজ গোছ-গাছ করে নিচ্ছে সবাই। ডেলিভারি কাউন্টার ল্যাবরেটরির সম্মুখভাগের একটি কক্ষ। কক্ষটির দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেই ডেলিভারী কাউন্টার। কাউন্টারে বসে আছে একজন যুবক এবং একজন তরুণী।
কাউন্টারের ফাইল-পত্র গোছ-গাছ করে সেলফের ফাইল, প্যাকেট চেক করে ঠিক-ঠাক করে রেখে দুজনে চেয়ারে এসে বসল।
ঘরে এসে প্রবেশ করল একজন লোক। মাথায় হ্যাট। দুপাশের কানের নিচ পর্যন্ত নামানো জুলফি।
গোঁফ অর্ধ চন্দ্রের আকারে মুখের উপরটা ঘিরে রেখেছে। পরনে কাউবয় প্যান্ট ও শার্ট। পায়ে ফিল্ড বুট।
লোকটার গোটাটাই একজন কাউবয়-এর প্রতিকৃতি।
লোকটা সোজা এসে যুবকটির সামনে দাঁড়াল। একটা ইনভেলাপ থেকে একটা রিসিট বের করে তুলে দিল যুবকটির হাতে।
যুবকটি রিসিটের উপর চোখ বুলাতেই ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠল তার। দ্রুত চোখ তুলে তাকাল সে লোকটির দিকে।
লোকটিরও দুচোখ বাজের মত আটকে ছিল যুবকটির উপর। যুবকটির চোখ-মুখের পরিবর্তন তার দৃষ্টি এড়ায়নি, হ্যাটের ছায়ায় তার চোখ-দুটি শক্ত হয়ে উঠেছে।
যুবকটি লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার একটু বসুন।’
‘ডকুমেন্ট আগেই কাউন্টারে আসার কথা। নির্দিষ্ট সময়ের চারদিন পরে আসছি।’ বলল লোকটি।
‘এসেছে স্যার। এবার ফাইনাল চেকটা করে আসি।’ বলে উঠে দাঁড়াল যুবকটি।
‘ঠিক আছে ডকুমেন্টটা দিন। আমি দেখতে থাকি। আপনি চেক করে আসুন।’ বলল লোকটি স্থির কণ্ঠে।
যুবকটি উঠে শেলফ থেকে একটা ফোল্ডার বের করে কাউন্টারে এল। বলল, ‘এই তো আপনার ডকুমেন্ট। একটু বসুন। আমি স্যারকে দিয়ে চেক করিয়েই নিয়ে আসছি।’
লোকটি কাউন্টারের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। বাজের মতই ছোঁ মেরে লোকটি যুবকটির হাত থেকে ফোল্ডারটি নিয়ে নিল।
যুবকটি চিৎকার করতে যাচ্ছিল।
কিন্তু লোকটি এক হাতে ফোল্ডার কেড়ে নিয়েছে, অন্য হাত দিয়ে বের করেছে রিভলবার এবং সে রিভলবার তাক করেছে যুবককে। সেই সাথে একবার রিভলবার ঘুরিয়ে এনেছে তরুণীর দিক থেকেও।
যুবকটি হা করেছিল, কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে চিৎকার বেরুল না। নিজেকে সামলে নিয়েই সে বলে উঠল, ‘স্যার আমাদের বিপদে ফেলবেন না। আমরা চাকুরি হারাব। ওটা আমাকে দিন।’
যুবকটি কোন কথা বলল না। রিভলবারের ট্রিগার টিপল পরপর দুবার যুবক ও তরুণীকে লক্ষ্য করে। রিভলবার থেকে দুজনের দিকে দুগুচ্ছ ধোয়া বেরিয়ে গেল। সংগে সংগেই দুজন সংজ্ঞা হারিয়ে ঢলে পড়ল।
লোকটি ফোল্ডারটা একবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে লোকটি পার্কিং-এ রাখা একটি ট্যাক্সি ক্যাবে উঠে বসল। বলল, ‘চলুন থার্ড এভেনিউ-এর স্প্রিং টাওয়ারে।’
গাড়ি চলতে শুরু করল।
কাউবয় বেশে কামাল সুলাইমান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। আরও শুকরিয়া আদয় করল হাতে পাওয়া রিপোর্টের জন্যে। ডাষ্টের কমপোনেন্ট এ্যানালিসিসে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ডাষ্টে ডেমোলিশন পাউডারের উপস্থিতি ধ্বংসকারী মাত্রায় রয়েছে।
থার্ড ষ্ট্রিটের স্প্রিং টাওয়ারে যখন কামাল সুলাইমানের গাড়ি পৌছল, তখন সকাল ৯টা।
স্প্রিং টাওয়ারের প্রথম তিনটি ফ্লোর নিয়ে ‘ল্যাবরেটরি অব ফিজিক্যাল এক্সপ্লেনেশন’ কাজ করছে। এক তলায় কাষ্টমারস সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের দুটি উইং। একটা ডিপোজিটস, আরেকটা ডিজবারসমেন্ট।
কামাল সুলাইমান প্রবেশ করল ডিজবারসমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। এর অনেকগুলো বিভাগ। কামাল সুলাইমান রিসিট বের করে দেখল তাকে বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস সেকশনে যেতে হবে। কামাল সুলাইমান এদিক-ওদিক খুঁজে এক প্রান্তে গিয়ে পেল সেকশনটি। প্রবেশ করল কক্ষে। কাউন্টারে দুজন যুবক বসে। কাউন্টারের সামনে একপ্রান্তে সোফায় বসে আছে আরও দুজন।
কামাল সুলাইমান কাউন্টারে গিয়ে এক টুকরো কাগজে লেখা একটা নাম্বার একজন যুবকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাম্বারের ডকুমেন্ট ডেলিভারির জন্যে রেডি কিনা।’
যুবকটি নাম্বার দেখেই তার রেজিষ্টারের দিকে তাকাল।
তাকানোর সংগে সংগেই তার চোখে-মুখে একটা উত্তেজনা ফুটে উঠল। তাকাল সে পাশের যুবকের দিকে এবং এগিয়ে দিল তার দিকে চিরকুটটি। দ্বিতীয় যুবকটি চিরকুটের নাম্বারটি দেখেই তাকাল সামনের সোফায় বসা যুবক দুজনের দিকে। বলল, এই যে শুনুন, ইনি ঐ ডকুমেন্টের খোঁজে এসেছেন।
সংগে সংগেই সোফায় বসা দুজন যুবক স্প্রিং-এর মত লাফিয়ে উঠল। একযোগে দৌড় দিল কামাল সুলাইমানের দিকে। তাদের দুজনেরই একটি করে হাত কোটের পকেটে।
চোখের পলকে কামাল সুলাইমানের ডান হাত পকেট থেকে ক্লোরোফরম রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এল। ওরাও তখন রিভলবার বের করছে। কামাল সুলাইমানের রিভলবার ‘দুপ’ ‘দুপ’ শব্দ করে উঠল দুবার। দুবার ট্রিগার টিপেই কামাল সুলাইমান তার রিভলবার ঘুরিয়ে নিল কাউন্টারের দুজন যুবকের দিকে। দেখল, যুবকদের একজন ইন্টারকমের বোতাম টিপে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছে। কিন্তু কামাল সুলাইমানের রিভলবার তাদের দিকে ঘুরতে দেখে থেমে গেছে।
কামাল সুলাইমান বাম হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ অফ করে দিয়ে বলল, ‘ওদের দুজনকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু তোমাদের দুজনের মাথা গুড়িয়ে দেব যদি ডকুমেন্টটা দিতে এক মুহূর্ত দেরি কর।’
বলে কামাল সুলাইমান বাম হাত দিয়ে দ্বিতীয় রিভলবার বের করে তাদের দিকে তাক করল। আর ডান হাতের ক্লোরোফরম রিভলবার পকেটে রেখে দিল।
যুবক দুজন কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘আমাদের আপত্তি নেই স্যার। কিন্তু আমাদের উপর নিষেধ আছে। দিচ্ছি স্যার।’
বলে যুবকটি একটু এগিয়ে তাদের পেছনের সেলফ থেকে একটা ফাইল বের করে কামাল সুলাইমানের হাতে দিল।
কামাল সুলাইমান ফাইলের ভেতর ত্বরিত একবার চোখ বুলিয়ে বন্ধ করে দিল। বলল, ‘নিষেধ করেছে কেন? ওরা কারা?’
‘জানি না, ওরা খুব পাওয়ারফুল স্যার। আমাদের কোম্পানীর প্রেসিডেন্টকেই ওরা বাধ্য করে ফেলেছে। আমাদের চাকরি থাকবে না স্যার। উপরন্তু আমাদের বিপদ হবে এ ফাইল আমরা দিয়েছি বলে। আপনি কিছুক্ষণ পরে এলে ফাইল পেতেন না। ওরা নিয়ে যেত। ওরা ফাইলও চায়, আপনাদেরকেও ধরতে চায়।’
‘ধন্যবাদ সহযোগিতার জন্যে। ভয় নেই তোমাদের চাকরি থাকবে। ওদের মত তোমরাও সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে থাকবে। তাহলে তোমাদের দোষ দেবার সুযোগ থাকবে না।’ বলে কামাল সুলাইমান প্যাকেট থেকে আবার ক্লোরোফরম রিভলবার বের করে ক্লোরোফরম বুলেট ফাটিয়ে ওদের সংজ্ঞাহীন করে দিল।
দ্রুত বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বেরুবার সময় ঘরটাকে লক করল যাতে করে এ বিল্ডিং থেকে তার বেরুনো পর্যন্ত এ ঘরে কেউ না ঢুকতে পারে।
বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল কামাল সুলাইমান। ট্যাক্সি ক্যাবে ফিরে এল।
সিটে বসে রুমাল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছতে মুছতে ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আরও একটা অফিসে যাব। এবার চলুন কুইন্স-এর মার্টিন লুথার কিং এভেনিউতে। এভেনিউ-এর উত্তর প্রান্তে পশ্চিম পাশ ঘেঁষে পার্ক আছে। পার্কের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে আরেকটা ষ্ট্রিট। পার্কের অপজিটে ষ্ট্রিটের মুখে একটা চারতলা বাড়ি। ওটা ‘ল্যাবরেটরি অব সাইন্সেস’। ওখানে যাব।
‘ওকে স্যার। কিন্তু জায়গাটাতো অনেক দূর।’ বলল ড্রাইভার।
‘আপনি কি অসুবিধা মনে করছেন?’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘না স্যার। আমার কোন অসুবিধা নেই। এখন ব্রীজ, ট্যানেল সবটাতেই প্রচন্ড জ্যাম। বেশ দেরি হবে। বোর হবেন। এজন্যেই বললাম।’ বলে ড্রাইভার ষ্টার্ট দিল। সেই সাথে অন করে দিল তার ক্যাসেট প্লেয়ার।
চলতে লাগল গাড়ি।
আর ক্যাসেট প্লেয়ারে নরম, মিষ্টি সুরের আরবী বাজনা বেজে উঠল।
একটু শুনল কামাল সুলাইমান। না, খাঁটি আরবী বাজনা, একটা বিখ্যাত আরবী যন্ত্র সংগীত।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো কামাল সুলাইমানের। বলল, ‘ড্রাইভার এমন ক্যাসেট আপনি কোথায় পেলেন? জানেন আপনি এ গান কোন ভাষার?’
‘জানি স্যার। আরবী ভাষার। আপনি পছন্দ করবেন বলে লাগালাম।’ ড্রাইভার বলল।
‘আমি পছন্দ করব কি করে বুঝলেন?’ কামাল সুলাইমানের কণ্ঠে বিস্ময়।
‘আপনি তো মুসলমান। তাই।’
‘আমি মুসলমান কি করে বুঝলেন?’ এবার কামাল সুলাইমানের কণ্ঠে বিস্ময়ের সাথে উদ্বেগও।
‘স্যার এ পর্যন্ত আপনি দুবার গাড়ি থেকে নেমেছেন। নামার সময় দুবারই আপনি বিসমিল্লাহ বলেছেন। আস্তে বললেও আমি শুনতে পেয়েছি। আবার প্রথমবার গাড়িতে উঠার সময়ও আপনি এইভাবে বিসমিল্লাহ বলেছেন।’ ড্রাইভার বলল।
‘বিসমিল্লাহ শব্দটা আপনি কি করে বুঝলেন? আর মুসলমানরা এটা বলে কি করে জানলেন?’
‘স্যার জানব না কেন? আমি তো মুসলমান।’
‘মুসলমান? কিন্তু আপনি তো পুরাপুরি আমেরিকান শ্বেতাংগ।’
‘জি স্যার। আমি তখন ছোট। সে সময় আমার আব্বা-আম্মাসহ গোটা পরিবার ইসলামে কনভার্ট হয়। আমি গত বছর আমার স্ত্রীসহ হজও করেছি স্যার।’
‘মোবারকবাদ। মোবারকবাদ। খুব খুশি হলাম। আপনার নাম কি?’
‘আগে আমার নাম ছিল ‘অ্যান্টনীয় আব্রাহাম’। ইসলামে আসার পর আমার নাম হয়েছে ‘আহমদ ইব্রাহিম’। নামটা রাখেন আমাদের এলাকা ব্রুকলিনের এক মসজিদের ইমাম।’
‘তুমি তোমার ধর্ম ইসলামকে খুব ভালবাস, তাই না?’
‘অবশ্যই স্যার। টাওয়ার ধ্বংসের পর দুঃসময়কালে আমার আব্বা ও আমরা আমাদের সবকিছু দিয়ে মুসলিম ভাইদের সাহায্য করেছি, বাড়িতে তাদের অনেককে আশ্রয় দিয়েছি। খৃষ্টান ও ইহুদী শ্বেতাংগদের অন্যায়ের মোকাবিলা করেছি।’ বলল ড্রাইভার।
‘টুইনটাওয়ার কারা ধ্বংস করেছে মনে করেন?’
‘যারাই করুক স্যার, মুসলমানরা করেনি। কারণ টুইনটাওয়ার, টুইনটাওয়ারের মালিক, কিংবা সেখানে যারা মরেছে, তাদের সাথে মুসলমানদের কোন শত্রুতা ছিল না। মুসলমানরা কারণ ছাড়া এ ঘটনা ঘটাবে তা যুক্তিসংগত নয়।’
‘সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু দায়টা মুসলমানদের ঘাড়ে চাপল কেন?’ জিজ্ঞাসা কামাল সুলাইমানের।
‘দায় তো কারও না কারও ঘাড়ে চাপাতেই হয়। মুসলমানদের ঘাড়ে চাপানো তখনকার সরকারের জন্যে লাভজনক ছিল।’
‘লাভজনক কোন দিক দিয়ে?’ বলল কামাল সুলাইমান। তার মুখে হাসি।
‘আমাদের তদানিন্তন সরকারের আফগান ও ইরাক পলিসির ক্ষেত্রে এটা লাভজনক হয়েছে। কিন্তু স্যার মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির বোঝা এখনও তাদের বইতে হচ্ছে।’
‘খুব সুন্দর বলেছেন।’
‘মাফ করবেন স্যার। আপনাকে আমেরিকান মনে হয়, কিন্তু উচ্চারণ আমেরিকান নয়।’
‘আমি আমেরিকান নই। কিন্তু আমেরিকান সেজেছি।’
‘স্যারের নাম কি জানতে পারি?’ বলল ড্রাইভার।
‘অবশ্যই। আমার নাম কামাল সুলাইমান। তবে এ নামে আমাকে এখন ডাকবেন না এবং আপনার নামটাও মুখে নেবেন না বাইরে। আমি এখন পুরোপুরি আমেরিকান। নাম কুনার্ড সুলিভান।’
‘বুঝেছি স্যার। মুসলমানদের বহু ক্ষেত্রেই নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়।’
কামাল সুলাইমান ও ড্রাইভার আহমদ ইব্রাহিমের মধ্যে এমন আলাপ চলল ‘ল্যাবরেটরি অব সাইন্সেস’ পৌছা পর্যন্ত।
বিশাল মার্টিন লুথার কিং এভেনিউ-এর ধার ঘেঁষে ‘ল্যাবরেটরি অব সাইন্সেস’ এর বিল্ডিংটা।
রাস্তার বিশালত্বের তুলনায় গাড়ি কম। মানুষ তো চোখেই পড়ে না।
ল্যাবরেটরির সামনে পার্কিং-এর জায়গা আছে।
কামাল সুলাইমান ড্রাইভারকে বলল, ‘এমন জায়গায় গাড়ি পার্ক করুন যাতে বেরুতে কোন অসুবিধায় পড়তে না হয়।’
‘ঠিক আছে স্যার।’ বলল ড্রাইভার।
‘আর স্যার নয়, ভাই বলবেন। সব সম্পর্কের চাইতে এই ভাই সম্পর্ক সবচেয়ে বড় মুসলমানদের জন্যে।’
‘ধন্যবাদ স্যা…… ভাই।’ বলল আহমদ ইব্রাহিম হাসি মুখে।
গাড়ি পার্ক হলে নামার সময় কামাল সুলাইমান কাঁধে ঝুলানো সাইড ব্যাগ থেকে দুটি ফোল্ডার ফাইল ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলল, ‘এ দুটি জিনিস আপনার কাছে কিছুক্ষণের জন্যে আমানত থাকল। আমি অফিস থেকে আসছি।’
বলে কামাল সুলাইমান বিসমিল্লাহ বলে গাড়ি থেকে নামল।
কামাল সুলাইমান প্রবেশ করল অফিসে।
প্রথমেই রিসিপশন।
রিসিপশনে দুজন লোক বসে।
কামাল সুলাইমানকে দেখেই তার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন তারই জন্যে তারা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে।
চিন্তার একটা কালো মেঘ উঁকি দিল কামাল সুলাইমানের মনে। কিভাবে এটা সম্ভব? তাহলে এখানে খবর পৌছেছে। তার চেহারা ও পোশাকের বিবরণও কি এসেছে। মনে মনে নিজেরই একটু সমালোচনা করল কামাল সুলাইমান, তার পোশাক পাল্টানো উচিত ছিল।
কিন্তু এখন তার পিছানোর পথ নেই। তাকে তৃতীয় ডকুমেন্টটি যোগাড় করতেই হবে। এটাই আমেরিকার সবচেয়ে সম্মানিত প্রামাণ্য ল্যাবরেটিরি। মনে পড়ল আহমদ মুসার উপদেশ, দুনিয়াতে একমাত্র শিশা ছাড়া সবকিছুর মধ্যে ফাঁক আছে। সেই ফাঁক বা দুর্বলতা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
দ্বিধা দূর হয়ে গেল কামাল সুলাইমানের মন থেকে।
সে মুখোমুখি হলো রিসিপশেনর। সে রিসিট দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল সেকশনটা কোন দিকে?
রিসিপশনের দুজনের মধ্যেই কেমন একটা চাঞ্চল্যের ভাব। তাদের একজন রিসিপশনের পাশেই টাঙানো বোর্ডের দিকে কামাল সুলাইমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘এই চার্টে সব দেখিয়ে দেয়া আছে স্যার।’
কামাল সুলাইমান দ্রুত চোখ বুলাল চার্টটায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরেই পেয়ে গেল সেকশনটা। পথটাও খুব ঘোরানো নয়। রিসেপশনের পরেই কাষ্টমার লাউঞ্জ। লাউঞ্জ থেকে তিনটি করিডোর তিনদিকে বেরিয়ে গেছে। যে করিডোরটা উত্তরে এগিয়ে গেছে সেটা শেষ প্রান্তে পৌছার আগে এ থেকে একটা শাখা পশ্চিম দিকে এগিয়েছে। বাঁক নেয়ার পর উত্তর পাশের প্রথম কক্ষটাই ডাষ্ট এবং সোয়েল সেকশন।
কামাল সুলাইমান রিসেপশনিষ্টদের উদ্দেশ্যে ‘ধন্যবাদ’ বলে ভেতরে এগুলো।
লাউঞ্জে মুখোমুখি সোফায় তিনজন লোক বসেছিল। কামাল সুলাইমান লাউঞ্জে ঢুকলে তিনজনই বিভিন্ন ঢং-এ হলেও তাকে দেখে নিল। তাদের চেহারা ও দৃষ্টিকে ল্যাবরেটরির কাষ্টমারের বলে মনে হলো না কামাল সুলাইমানের কাছে।
কামাল সুলাইমান তাদের এড়িয়ে উত্তরের করিডোরে ঢুকে গেল। তার একটি হাত প্যান্টের পকেটে ভয়ংকর স্প্রেগানটার উপর, আরেকটি হাত জ্যাকেটের ডান পকেটে ক্লোরোফরম গানটার গায়ে।
করিডোরের বাঁকে পৌছে কামাল সুলাইমান দেখল সোজা করিডোরটার শেষ প্রান্তে একটা দরজা। দরজা খোলা। দরজার পরে একটা প্রশস্ত ল্যান্ডিং। সেখানেও তিনজন লোক বসে। কামাল সুলাইমান নিশ্চিত ওরাও তারই জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বিস্মিত হলো কামাল সুলাইমান। তাকে চেনার পরেও কেন আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে না। তাহলে কি কামাল সুলাইমান ডকুমেন্ট হাতে নেয়ার পর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তাকে হাতে-নাতে ধরবে! খুশি হলো কামাল সুলাইমান। সেও এটাই চায়।
কামাল সুলাইমান বাঁক ঘুরে দ্রুত এগিয়ে ঘরটির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
নব ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল এবং সেই সাথে দরজার লক টিপে বন্ধ করে দিল দরজা।
কাউন্টারে একজন যুবক বসেছিল। আর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিল আরও তিনজন যুবক।
চারজনই টের পেয়েছিল দরজা লক করার দৃশ্য। ওরা দরজার দিকেই তাকিয়েছিল। যেন ওরা অপেক্ষা করছিল।
তিনজন দাঁড়ানো যুবকের একজনের হাতে ছিল মোবাইল। কামাল সুলাইমানকে প্রবেশ করতে দেখেই সে পকেটে রাখল মোবাইলটা। ওদের মুখে কিছুটা কৌতুকের হাসি।
কামাল সুলাইমানের দুহাত পকেটের দু’রিভলবার। সে আশা করেছিল ওরা আক্রমণে আসবে। তার খবরটা আগেই এরা পেয়ে গেছে মোবাইলে। কিন্তু না তারা আক্রমণে এল না। তারা তিনজনই কাউন্টার থেকে পাশে একটু দক্ষিণে সরে গেল। ব্যাপার তাহলে এটাই যে, ওরা শতভাগ নিশ্চিত হবার জন্যে ডকুমেন্টটা নেয়া অথবা অন্তত চাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়। মনে মনে হাসল কামাল সুলাইমান।
কামাল সুলাইমান কাউন্টারে বসে থাকা যুবকটির সামনে দাঁড়িয়েরিসিট ও ক্লোরোফরম রিভলবারসহ ডানহাত বের করল।
কামাল সুলাইমানের রিভলবার ধরা হাতটি দ্রুত তিনজন যুবকের লক্ষ্যে উপরে উঠে এল।
শেষ মুহূর্তে ওরাও টের পেয়ে গিয়েছিল। একজন যুবকের পকেটে রাখা হাত দ্রুত বের হয়ে এল। তার হাতে রিভলবার।
অন্য দুজন বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল আকস্মিক রিভলবারের মুখোমুখি।
কামাল সুলাইমান পরপর তিনবার ট্রিগার টিপল তার ক্লোরোফরম রিভলবারের। প্রথম ক্লোরোফরম বুলেট ছুটে গেল যে রিভলবার তাক করছিল সে যুবকের দিকে।
কিন্তু বেপরোয়া ক্ষিপ্র যুবকটি তার দিকে ক্লোরোফরম বুলেট বিস্ফোরিত হওয়ার মুখেই ট্রিগার টিপেছিল।
কামাল সুলাইমান রিভলবারের ট্রিগার টেপার অবস্থায়ই কাত হয়ে কাউন্টারের দিকে শরীরটাকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বুকটা তার রক্ষা পেলেও বাম বাহু রক্ষা পেল না। যুবকটির ছোঁড়া বুলেট বাম বাহুর একটা অংশ বিধ্বস্ত করে বেরিয়ে গেল।
এদিকে কামাল সুলাইমানের ছোড়া ক্লোরোফরম চোখের পলকে ওদের তিনজনকেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।
গলগলিয়ে রক্ত নামছিল কামাল সুলাইমানের বাম বাহু দিয়ে।
কিন্তু সেদিকে নজর দেবার সময় ছিল না কামাল সুলাইমানের। রিভলবারের শব্দ নিশ্চয় বাইরে ওরা শুনেছে। ওরা এখনই ছুটে আসবে।
কামাল সুলাইমান ফিরে দাঁড়িয়েছে কাউন্টারের যুবকটির দিকে।
কামাল সুলাইমান ইতিমধ্যে ক্লোরোফরম রিভলবার পকেটে রেখে ডান হাত দিয়ে বাঁ পকেট থেকে তার ভয়ংকর স্প্রেগান বের করে নিয়েছে।
টর্চ আকারের গানটি যুবকের দিকে তাক করে বলল, ‘রিসিটের ফাইলটি দিয়ে দাও, না হলে তোমার মাথা ভর্তা হয়ে যাবে।’
যুবকটি কাঁপছিল। বলল, ‘দিচ্ছি স্যার।’
বলেই যুবকটি ছুটল সেলফের দিকে।
যুবকটি ওদিকে গেলে কামাল সুলাইমান গানটি কাউন্টারে রেখে ডান হাত দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা গ্যাসমাস্ক ও মার্বেলের মত দুটি বল বের করে নিল।
ঘরের দরজায় এ সময় ধাক্কা শুরু হলো।
বুঝলো কামাল সুলাইমান ওরা এসে গেছে।
কামাল সুলাইমান-এর বাম হাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপরে তুলতে কষ্ট হচ্ছে। একহাত দিয়েই কামাল সুলাইমান গ্যাস-মাস্কটি পরে নিল মুখে।
অনেক কষ্টে গানটি বাম হাত দিয়ে ধরল। তার ডান হাতে থাকল দুটি গ্যাস বোম।
যুবকটি ফাইলটা নিয়ে কাউন্টারে এল।
‘খোল ফাইলটা, দেখি ঠিক আছে কিনা।’ কামাল সুলাইমান যুবককে নির্দেশ দিল।
যুবক মেলে ধরল ফোল্ডারটা।
ঠিক বিষয়ের রিপোর্ট ফাইলে আছে দেখল কামাল সুলাইমান।
বাইরে থেকে তখন দরজা ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে।
যুবককে ফাইলটি বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে বলল, ‘ফোল্ডারটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও।’
কম্পমান যুবকটি ফোল্ডারটা কামাল সুলাইমানের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে তুলে দিল।
‘থ্যাংকস’ বলে কামাল সুলাইমান পেছনে হটে দরজায় এল। দাঁড়াল দেয়াল ঘেঁষে। তারপর আস্তে ডান হাতটা নবের কাছে এগিয়ে নিয়ে দ্রুত নব ঘুরিয়ে দরজা আনলক করেই ডান হাত টেনে নিল।
দরজায় প্রচন্ড ধাক্কা চলছিল। আর মাঝে মাঝে নব ঘুরানো হচ্ছিল প্রাণপনে।
কামাল সুলাইমান দরজা আনলক করে হাত টেনে নিতেই বাইরের চাপে প্রচন্ড গতিতে দরজা খুলে গেল।
সংগে সংগেই কামাল সুলাইমান ডান হাতের একটা বল ছুড়ে মারল দরজার বাইরে। পটকা ফাটার মত শব্দ হলো। কোন ধোয়া বেরুল না। কিন্তু সংজ্ঞাহরনকারী মারাত্মক গ্যাস বাতাসের চেয়ে শতগুণ দ্রুত গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কামাল সুলাইমান দেখল, কাউন্টারের যুবকটি জ্ঞান হারিয়ে টেবিলের উপর লুটিয়ে পড়েছে।
এবার কামাল সুলাইমান মুখ বাড়ালো বাইলে। দেখল, দশ বারোটি সংজ্ঞাহীন দেহ করিডোর ভরে তুলেছে। তাদের মধ্যে আগের দেখা তিন তিন ছয়জনও আছে। অবশিষ্টরা অফিসের সিকিউরিটি বা কৌতুহলী লোক হবে।
কামাল সুলাইমান ছুটল।
কামাল সুলাইমান কাউন্টারে এসে দেখল, কাউন্টারের একজন ছুটে এসে টেলিফোন হাতে তুলে নিয়েছে।
রক্তাক্ত কামাল সুলাইমানকে দেখে তার হাত থেকে টেলিফোন পড়ে গেল। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এ সময় উপর তলা থেকে কজনকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল।
কামাল সুলাইমান হাতের অবশিষ্ট গ্যাস বোম মেঝেতে ছুড়ে মেরেই দৌড় দিল ল্যাবরেটরির কার পার্কিং-এর দিকে।
ড্রাইভার আহমদ ইব্রাহিম, ল্যাবরেটরির দিকে তাকিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল।
কামাল সুলাইমানকে দৌড়াতে দেখে এগুলো সে সামনে। কামাল সুলাইমানকে রক্তাক্ত দেখে বিস্ময় ও উদ্বেগে তার মুখ পাংশু হয়ে গেল।
‘কি ঘটেছে? আপনি ঠিক আছেন স্যা…….. ভাই?’
‘ঠিক আছি। বাম বাহুটা মাত্র আহত। গাড়ির দরজা খুলে দিন।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে কামাল সুলাইমান।
আহমদ ইব্রাহিম তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে ধরল।
গাড়িতে ঢুকে গেল কামাল সুলাইমান। বলল, ‘তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন। গাড়ি ছাড়–ন। পরে বলছি সব।’
উদ্বিগ্ন ড্রাইভার আহমদ ইব্রাহিম বুঝল কোন বড় বিপদ ঘটেছে কামাল সুলাইমানের এবং বিপদ তার এখনও কাটেনি।
আহমদ ইব্রাহিম তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিল। বলল, ‘কোন দিকে যাব?’
‘গাড়িটা আগে দূরে সরিয়ে নিন, তারপর বলছি।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘ভাই সাহেব আপনর বিষয় কিছুই জানি না আমি। শুধু জেনেছি আপনি আমার এক ভাই এবং এটা আপনিই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আপনি যদি ভাইকে বিশ্বাস করেন, তাহলে অনুরোধ করছি আমার বাসায় চলুন। আমার মনে হয় ওটা বুলেট ইনজুরি। আরও এক দেড় ঘণ্টা দেরি করা ক্ষতিকর হবে।’ বলল গম্ভীর কণ্ঠে আহমদ ইব্রাহিম।
হাসল কামাল সুলাইমান। বলল, ‘আপনি না করার পথ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। চলুন, আপনার বাসায় যাব।’
‘ধন্যবাদ, ভাই সাহেব।’ বলল আহমদ ইব্রাহিম হাসি মুখে।
সে নড়ে চড়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। ছুটে চলল গাড়ি।

Top