৩. মিন্দানাওয়ের বন্দী

চ্যাপ্টার

যেতে যেতে আহমদ মুসা ভাবল, জাহাজটি অস্ত্র বোঝাই হয়ে যাচ্ছে মিন্দানাও। অস্ত্রগুলো ব্যবহৃত হবে মিন্দানাও এর অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে। সুতরাং জাহাজটিকে পৌছতে দেয়া যায় না মিন্দানাওয়ের মাটিতে।
মনে মনে হাসল সে । এখন সে ‘রুথ থান্ডার’- নির্মম বজ্র।
কয়েক গজ সামনে এগিয়েই বামে ঘুরে সে ডেকে উঠার সিড়ি পেয়ে গেল।
মুহূর্তের জন্য টর্চ জ্বালাল সে । সিঁড়ির মুখের দরজা খোলাই আছে দেখা গেল। খুশী হলো আহমদ মুসা।
সিঁড়ির মুখের দরজা ঠেলতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে। উপরের ডেকে কি প্রহরী নেই? হঠাৎ এই সময় সিঁড়ির মাঝে পায়ের শব্দ শোনা গেল। আহমদ মুসা দ্রুত সিঁড়ি ছেড়ে করিডোরের দেয়ালে গিয়ে দাড়াল।
সিঁড়ির দরজা খুলে গেল। সিঁড়ির মুখে মুখ বাড়িয়ে কে একজন চাপা গলায় ডাকলঃ ব্রাডলি, ব্রাডলি?
কিছুক্ষণ থামল। বোধ হয় উত্তরের অপেক্ষা করল। তারপর ডাকল, ‘কোথায় রে ব্রাডলি। মজা দেখবি তো আয়।’
কোন সাড়া না পেয়ে ‘শালা ঘুমিয়েছে নিশ্চয়’ বলতে বলতে লোকটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। আহমদ মুসা ভাবল, যে প্রহরীটিকে সে ঘুম পাড়িয়েছে তার নামই তাহলে ব্রাডলি। এ লোকটি সে ব্রাডলির খোঁজেই আসছে।
করিডোরের মুখে দেয়ালের ভাঁজে আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে রইল। গুলী ছুঁড়ে শব্দ করা চলবে না, এটা আহমদ মুসা আগেই ঠিক করে নিয়েছিল।
লোকটি সিড়ি পথের ভাঁজ ঘুরে যখন করিডোরের মুখে পড়ল অমনি আহমদ মুসা রিভলভারের বাঁট দিয়ে প্রচন্ড এক আঘাত হানল ডান কানের নীচের ঘাড় লক্ষ্য করে।
অষ্ফুট এক শব্দ বেরুল লোকটির মুখ দেয়ে। টর্চটি সশব্দে খসে পড়ল নীচে। কিন্তু আহমদ মুসা লোকটির জ্ঞানহীন দেহটি ধরে রাখল।
এ লোকটিকেও আগের মত পূর্বোক্ত ঘরে ব্রাডলির পাশে গুঁজে দিয়ে আহমদ মুসা চলে এলো। সিঁড়ি ভেঙে খোলা দরজা পথে ডকে উঠল সে। চকিতে একবার চারদিকে সে দেখে নিল। না, কেউ কোথাও নেই।
তারকাখচিত উপরের আকাশ। চাঁদ নেই আকাশে। আদিগন্ত সাগরের বুকে যেন এক বিরাট কাল চাদর বিছানো। দু’পাশে পানি কেটে বিরাট শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে জাহাজটি।
মনে হল কতদিন থেকে মুক্ত বাতাসের দেখা পায়নি আহমদ মুসা। বুক ভরে সে নিঃশ্বাস নিল। কত প্রশান্তি এ মুক্ত বাতাসে।
মালপত্র বহনোপযোগী মাঝারি ধরনের জাহাজ এটি। উপরে বেশ কিছু ডেক কেবিনও রয়েছে। নীচের কেবিনগুলোর সবগুলোই বন্ধ-ভিতর থেকে বন্ধ। আলো দেখা যায় না কোন কেবিন থেকেই।
উপরের একটি কেবিনের কাঁচের গরাদ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।
রিভলভার বাগিয়ে ধীর পদক্ষেপ আহমদ মুসা সামনে এগুলো। নীচের কেবিনগুলো থেকে উপরে উঠার এ সংকীর্ণ সিড়ি দেখা গেল। সেই সিড়ি বেয়ে সে শিকারী বিড়ালের মত নিঃশব্দে উপর উঠে গেল।
কোথা থেকে যেন চাপা কথা ভেসে আসছে? উৎকর্ণ হল আহমদ মুসা। হাঁ, দক্ষিণ প্রান্তের কোন এক কেবিন থেকে কথা ভেসে আসছে?
শব্দ অনুসরণ করে আহমদ মুসা সামনে এগুলো। একটি কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। দরজা ভেজানো। কি হোলে চোখ লাগিয়ে সে স্মার্থা ও ক্যাপটেনকে দেখতে পেল। স্মার্থা নাইট গাউন পরা। মাথার চুল এলোমেলো। চোখে-মুখে ভয়ার্ত ভাব। হাতে তার রিভলবার। ক্যাপটেনের পরণে সেই আগের পোশাক।
স্মার্থা বলছিল, এ দুঃসাহসের জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে ক্যাপটেন। ক্যাপটেন বলল, তোমাকে পেলে আমি মরতেও রাজি আছি। জানো কতদিন থেকে আমি তোমার দিকে চেয়ে আছি। কাল তুমি নেমে যাচ্ছ মিন্দানাওয়ে। আর সুযোগ হয়তো হবে না কোনদিন।
-আমি সরদারকে সব কথা বলবো গিয়ে। জানো এর ফল কি দাঁড়াতে পারে?
-সরদারও সাধু নয় স্মার্থা।
একটু থামল ক্যাপটেন। পরে বললো, কোন ভয় দেখিয়েই তুমি আমাকে ফিরাতে পারবে না স্মার্থা। বলে সে দু’হাত বাড়িয়ে এগুতে লাগল স্মার্থার দিকে।
স্মার্থা দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে রিভলভারটি তুলে ধরে বলল, আর এক পা এগুলে গুলী করব ক্যাপটেন।
কিন্তু কথাটি স্মার্থার মুখ থেকে শেষ হবার আগেই ক্যাপটেন ঝাপিয়ে পড়ল তার উপর। স্মার্থার হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। স্মার্থাও পড়ে গেছে মেঝের উপর কাত হয়ে।
ক্যাপটেন তার মুখে এক হাত দিয়ে চেপে ধরে তাকে তুলে নিয়ে বিছানার উপর গিয়ে পড়ল।
স্মার্থা বোধ হয় তার হাত কামড়ে ধরেছিল। ক্যাপটেন উঃ বলে তার হাত স্মার্থার মুখ থেকে সরিয়ে নিল। কিন্তু নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না স্মার্থা। চীৎকার করে উঠল সে।
আহমদ মুসা দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। ক্যাঁচ করে এক শব্দ উঠলো দরজার স্প্রিং থেকে।
দরজার শব্দে পিছনে ফিরে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ক্যাপটেন।
ক্যাপটেন মেঝেয় পড়ে থাকা স্মার্থার রিভলভারের দিকে এগুচ্ছিলো। রিভলভারের উপর ঝুঁকে পড়েছিল সে।
আহমদ মুসার গম্ভীর কন্ঠ ধ্বনিত হলো, রিভলভারে হাত দিওনা ক্যাপটেন, হাত গুঁড়ো হয়ে যাবে।
ক্যাপটেন রিভলভারে হাত দিল না। কিন্তু চোখের নিমিষে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে দেহটিকে মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে ছুড়ে দিল আহমদ মুসার দিকে। তার জোড়া দুটি পা ছুটে এলো আহমদ মুসার তলপেট লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা ছিটকে এক পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাপটেনের লাথি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তার তার দু’টি পা আছড়ে পড়ল মাটিতে। আর কোন সুযোগ সে পেল না। আহমদ মুসার পয়েন্টেড সু’র মারাত্মক এক লাথি গিয়ে পড়ল ক্যাপটেনের তলপেটে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়ল সে।
ইতিমধ্যে স্মার্থা পোশাক পরে নিয়েছে। বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল সে। আহমদ মুসা স্মার্থার দিকে চেয়ে বলল, কিছু দড়ি পেতে পারি ম্যাডাম?
স্মার্থা কিছু না বলে সামনের কাপবোর্ড থেকে পল্লাষ্টিকের তৈরী একগুচ্ছ দড়ি এনে দিল তাকে।
ক্যাপটেনকে ভালো করে বেঁধে রেখে আহমদ মুসা স্মার্থাকে বলল, ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমি কি আরও কিছু সাহায্য পেতে পারি আপনার?
-কি সাহায্য চান?
-এক শিশি ক্লোরফরম পেলে উপকৃত হতাম।
-ক্লোরফরম কি উপকারে আসবে?
-এটা কি ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন করে?
-একটু ভেবে স্মার্থা বলল, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, কিন্তু এ কাজে তো আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি না।
আহমদ মুসা একটু হেসে বলল, হিসেবে ভুল হয়েছিল ম্যাডাম। মুহূর্তের জন্য শত্রু ভাবতে আপনাকে ভুলে গিয়েছিলাম। থামল আহমদ মুসা।
একটু থেমে আবার সে বলল, ক্যাপটেনকে আমার নিয়ে যেতে হচ্ছে। আর আপনাকে এ ঘরে বন্ধ থাকতে হবে। আশা করি বেঁধে রাখার দরকার হবে না।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা টেবিল থেকে স্মার্থার চাবির রিং নিয়ে ক্যাপটেনকে টেনে ঘরের বাইরে চলে গেল।
স্মার্থার ঘরে চাবি এঁটে সে মুহূর্তের জন্য ভাবল, ঘটনা যতদূর গড়িয়েছে, তাতে এখন তার সামনে দু’টি পথ- প্রথমতঃ জাহাজটিকে ধ্বংস করে ফেলা, দ্বিতীয়তঃ জাহাজটিকে দখল করা।
আহমদ মুসার কাছে আপাতত দ্বিতীয়টিই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো। প্রথমটি হবে সবশেষের সিদ্ধান্ত।
স্মার্থার ঘরটি দক্ষিণ প্রান্তের শেষ ঘর। স্মার্থার ঘরের সামনের করিডোরটি দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে। আহমদ মুসা ক্যাপটেনের সংজ্ঞাহীন দেহ দক্ষিণ দিকের করিডোরে রেখে প্রথমে ওয়্যারলেস রুমে যাবে ঠিক করল।
ক্যাপটেনের দেহ দক্ষিণ দিকের করিডোরে রেখে যখন সে পূর্বের করিডোরটির মুখে পা দিয়েছে, অমনি সে দেখতে পেল, দু’জন লোক উদ্যত রিভলভার হাতে ছুটে আসছে এদিকে। আর কখন যেন করিডোরের লাইটটিও জ্বলে উঠেছে।
লোক দু’টি এসে স্মার্থার দ্বারে করাঘাত করতে শুরু করল আর বলতে লাগল, কি হয়েছে স্মার্থা দরজা খোল, দরজা খোল। আহমদ মুসা চমকে উঠল। কোন সংকেতে কি ওরা ছুটে এসেছে? স্মার্থা কি কোন গোপন চ্যানেলে বিপদ সংকেত পাঠিয়েছে?
দাঁতে দাঁত চাপল আহমদ মুসা। প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য এখন মূল্যবান। তার কাছে এখন স্মার্থার রিভলভারসহ তিনটি রিভলভার রয়েছে।
ছয়ঘরা আমেরিকান রিভলভারটি সে হাতে তুলে নিল। ওরা তখনও দরজায় নক করছিল। আহমদ মুসা ধীরে সুস্থে পরপর দু’টি গুলী ছুড়ল। দরজার উপরেই দু’টি দেহ লুটিয়ে পড়ল। সামনে ছুটতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল সাইমুমের সেই তত্ত্বকথা- শত্রুকে পিছনে রেখে সামনে এগিয়ো না।
আহমদ মুসা ফিরে এসে ক্যাপটেনের সংজ্ঞাহীন দেহ ছুঁড়ে দিল পার্শ্বের বিক্ষুব্ধ সাগরের বুকে।
তারপর নিঃশব্দ গতিতে দ্রুত সে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। আহমদ মুসার ধারণা প্রহরীরা ডেক কেবিনগুলোতেই থাকে। সুতরাং ওদের ওপরে উঠার পথ আটকাতে হবে। সে নীচের সিঁড়ির মুখে গিয়ে পৌছল। নীচের সারিবদ্ধ ডেক কেবিনের করিডোরে এখন আলো জ্বলছে। মাঝখানের একটি কেবিনের দরজা খোলা। একজন মোটামত লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। কাঁধে অফিসারের ইনসিগনিয়া। হাতে সাবমেশিন গান। সে দরজায় দাড়িয়ে ভিতরের কাউকে যেন লক্ষ্য করে বলল, ‘‘স্টিফেন্স, জিমদের ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন, গুলীর শব্দই বা কোথেকে এলো, আমি দেখে আসি। ক্যাপটেনের নির্দেশ না পেলে এলার্ম বাজিও না।’’ বলে উপরে সিঁড়ির মুখের দিকে অগ্রসর হলো সে।
আহমদ মুসা উপরে উঠার সিড়ির বাঁকে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রইল। হাতে উদ্যত রিভলভার। লোকটি যেই সিড়ির বাঁকে এসে মোড় নিয়েছে, অমনি আহমদ মুসা রিভলভারের বাঁট দিয়ে প্রচন্ড আঘাত হানল লোকটির মাথায়। নিঃশব্দে তার দেহ গড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে।
তারপর সে দ্রুত নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে নীচে। বিড়ালের মত গুটিগুটি গিয়ে সে দাঁড়াল দরজা খোলা সেই রুমটির পাশে। দু’জনের আলাপ শুনা গেল। এই গভীর রাত্রিতে এই ধরনের জ্বালাতনে দু’জনেই বিরক্ত।
একজন বলছিল, মেয়েদেরকে কেন যে এসব কাজে সরদার টেনে আনে, আমি সেটাই বুঝি না। ওই স্মার্থা মেয়েটার প্রতি ক্যাপটেন সাহেব ও স্টুয়ার্ড বেটা দু’জনেরই চোখ পড়েছে। যতসব ঝামেলা।
অপরজন বলল, শুধু কি ক্যাপটেন আর স্টুয়ার্ড বেটা, তুমি কি চোখ বন্ধ করে আছ জন?
-চোখ খোলা থাকলেই কি লাভ বল? কত এলো, কত গেল, সে সব তো শুধু দেখেই গেলাম। ব্যাটারা মজা লুটবে কিন্তু ঠ্যালা সামলাবার বেলায় আমরা।
-কত ঠ্যালা জীবনে সামলিয়েছি জন সাহেব?
-দক্ষিণ মিন্দানাওয়ের ‘লানাডেলে, রেডিয়েশন বম্ব কে পেতে রেখে এসেছিল শুনি? এই যে বম্ব আবার যাচ্ছে, এগুলো কারা পাততে যাবে বলতো, ওরা না আমরা?
-বিনিময়ে কি কিছুই মিলে না?
-কিছু ডলার ছাড়া আর কি? এই যে স্মার্থাদের নেয়া হচ্ছে ওদেরকে শত্রুদের ভোগে লাগানো হবে। হায়রে বন্ধু না হয়ে যদি শক্র হয়ে জন্মাতাম।
এদের খোশালাপ হয়তো আরও চলতো। কিন্তু আহমদ মুসার সময় ছিল না এসব শোনার। সে ষ্টেনগান বাগিয়ে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়ল।
ঘরে বেশ কয়েকটি চেয়ার পাতা। আর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পিছনেই একটি লম্বা কী বোর্ড। প্রতিটি পয়েন্টে দু’টি করে চাবি টাঙ্গানো। ওগুলো ডেক কেবিনসমূহের ইন্টারলক ও আউটার লকের চাবি।
আহমদ মুসা ওদের দিকে ষ্টেনগান উচিয়ে বলর, তোমরা হাত তুলে পিছন ফিরে দাঁড়াও। তারা হাত তুলে দাঁড়াল বটে, পিছন ফিরল না।
ষ্টিফেন্স নামক লোকটির পিছনে ছিল সুইচ বোর্ড। সে হাত তুলে ধীরে ধীরে পিছন হটে সুইচ বোর্ডের দিকে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, সুইচ বোর্ডের দিকে গিয়ে লাভ হবে না বন্ধু, এলাম সুইচে হাত দেবার পূর্বেই তোমার লাশ খসে পড়বে মাটিতে।
ষ্টিফেন্স থমকে দাড়ালো, কিন্তু পরক্ষণেই সে দরজার দিকে চেয়ে সোল্লাসে বলে উঠল, ওস্তাদ।
আহমদ মুসার মুখে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠল। বলল সে, আবার চালাকি? তুমি দু’বার ক্ষমা পাবে না বন্ধু। বলে সে চেপে ধরল ট্রিগার। ষ্টিফেন্স অষ্ফুট আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসার মনোযোগ এই সময় স্বাভাবিভাবে ষ্টিফেন্সর দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল। জন এই সুযোগ হাতছাড়া করলো না। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে আহমদ মুসার উপর।
শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা তার দেহকে একদিকে বাঁকিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং জনের আঘাত কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তবু বাম পাঁজরে জনের ডান হাতের একটি মারাত্মক ‘ব্লু’ খেল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা একপাশে সরে যাওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে জন পড়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল তার সাথে। তার হাতের ষ্টেনগানটাও ছিটকে গিয়েছিল হাত থেকে।
ডান হাতে পাঁজরটি চেপে ধরে দম বন্ধ করে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মাথাটি তার ঝিম ঝিম করছিল।
জন পড়ে যাওয়ায় উবু অবস্থা থেকে উল্টে গিয়ে আহমদ মুসার ষ্টেনগানটি কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। মোক্ষম সুযোগ। আহমদ মুসার ডান পা বিদ্যুতগতিতে ছুটে গেল জনের তলপেট লক্ষ্যে। মুখ দিয়ে ক্যাঁৎ করে শব্দ করে আবার লুটিয়ে পঢ়ল সে মেঝেতে।
আহমদ মুসা এবার তাড়াতাড়ি ‘কী বোর্ড’ থেকে চাবিগুলো নিয়ে নিল। প্রত্যেক চাবিতে নম্বর রয়েছে। মোট বিশটি চাবি। ডেক কেবিনগুলোতে এদের আরো অনেক প্রহরী ও লোকজন রয়েছে, ওদের বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ করতে হবে-চাবি নিয়ে বেরুতে এটা স্থির করে নিল আহমদ মুসা। পিছনের দিকটা নিরাপদ না করে সে ওয়্যারলেস রুমে যাবে না।
ডেক কেবিনের আউটার লকের নম্বরের সাথে চাবির নম্বর মিলিয়ে আহমদ মুসা নীচের সবগুলো ডেক কেবিন বন্ধ করে দিল।
সর্বশেষে ষ্টুয়ার্ড রুমে চাবি এঁটে বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। না, কোন দিক থেকে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সে নিশ্চিত হলো নীচে আর কোন প্রহরী নেই কিংবা কোন লোকও নেই। থাকলে গুলীর শব্দে নিশ্চয় ছুটে আসতো।
রিভলবার বাগিয়ে ধরে নিঃশব্দ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে সে উপরে উঠতে লাগল।
ওয়্যারলেস রুমে যাবার আগে ক্যাপটেনের কক্ষ সে একবার দেখে নেবে, মনে মনে ঠিক করল আহমদ মুসা।
উপরে কেউ নেই। ক্যাপটেন কক্ষের দুই পাশে আর দু’টি কক্ষ খোলা ক্যাপটেনের কক্ষ বন্ধ। ক্যাপটেন স্মার্থার ওখানে যাবার সময় বন্ধ করে গিয়েছিল তাহলে।
আহমদ মুসা জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার বিম টর্চ বের করে নিল আবার। দু’মিনিটের মধ্যে খুলে গেল দরজা।
কক্ষে একটি স্টিলের আলমারী। একটি সেক্রেটারীয়েট টেবিল, একটি গদি আটা চেয়ার ও একটি সিঙ্গল খাট।
টান দিতেই ড্রয়ার খুলে গেল। ড্রয়ারে একটি চাবির রিং ও একটি দূরবীন পেল আহমদ মুসা। চাবিটি আলমারির, চিন্তা করল সে। দূরবীনটি তুলে নিতে গিয়ে ড্রয়ারের শেষ প্রান্তে একটি ডাইরি পেল সে। ডাইরীটিও তুলে নিল।
ডাইরীর মধ্যে ক্যাপটেনের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ও দৈনন্দিন হিসাব নিকাশ রয়েছে।
ডাইরীর পাতা উল্টাতে গিয়ে একটি চিঠি বেরিয়ে পড়ল। খামের মুখে সিল আটা। উপরের ঠিকানা চেয়ারম্যান , ‘ক্লু’-ক্লাক্স-ক্লান’, মিন্দানাও বেজ (দিভাও)।
আহমদ মুসা চিঠি পকেটে পুরতে পুরতে বলল, জাহাজ তাহলে ওদের মিন্দানাওয়ের দিভাও বেজে যাচ্ছে।
দূরবীনটিও পকেটে পুরলো সে। তারপর তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়্যারলেস রুমের দিকে চললো। ওপরে কোন প্রহরী চোখে পড়ল না মুসার।
জাহাজের ওয়্যারলেস কনট্রোল রুম। কক্ষটি ভিতর থেকে বন্ধ।
আহমদ মুসা দরজায় নক করল। নক করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে কে একজন মুখ বাড়াল। আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়েছিল। মুখ বাড়িয়ে লোকটি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে, কিন্তু কথা বেরুবার পূর্বেই আহমদ মুসার রিভলভারের বাট গিয়ে আঘাত করল তার মাথায়। দরজার উপরই সে কাত হয়ে পড়ে গেল।
এক মুহূর্ত নষ্ট করল না আহমদ মুসা। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল।
ভিতরে হোয়েলম্যান ছাড়াও একজন ওয়্যারলেস অপারেটর এবং চীফ নেভিগেটর ছিল। যে লোকটি মুখ বাড়িয়েছিল, সে ওয়্যারলেস অপারেটর। অপারেটরকে আর্তনাদ করে পড়ে যেতে দেখে চীফ নেভিগেটর উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সে দ্রুত সামনের ড্রয়ারের দিক ঝুঁকে পড়ল। আধখোলা ড্রয়ারের মধ্যে একটি কালো রিভলবার চকচক করছিল।
কিন্তু ড্রয়ার থেকে রিভলবারটি নিয়ে সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারল না, আহমদ মুসার রিভলভার নিখুঁতভাবে লক্ষ্য ভেদ করল। একটি বুলেট লোকটির কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটির দেহ ডেস্ক থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা কক্ষে প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দিল। ষ্টিয়ারিং হোয়েলের লোকটি পাথরের মত বসে ছিল। মুখ তার ছাইয়ের মত সাদা।
আহমদ মুসা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, শুনুন, গোটা জাহাজ আমাদের দখলে নির্দেশ মত জাহাজ না চালালে এই নেভীগেটরের মতই হবে তোমার অবস্থা।
নেভীগেটরের ডেস্ক থেকে মানচিত্র তুলে নিয়ে জাহাজের গতিপথ দেখে নিয়ে বলল, ড্রাইভার, এখন জাহাজ কোথায়?
লোকটি একবার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বলল, জাহাজ এখন সেলিবিস সাগরে। জাম্বুয়াংগো প্রণালী থেকে ১০০ মাইল দক্ষিণে রয়েছে।
আহমদ মুসা কম্পাসের দিকে চেয়ে দেখল। জাহাজ উত্তর মুখে এগিয়ে চলেছে। আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলল, জাহাজের মুখ একটু পশ্চিম কোণে ঘুরিয়ে নাও। ব্যাছিলান প্রণালী পার হবার পর জাম্বুয়াংগ ডাইনে রেখে উত্তর দিকে যেতে হবে।
সংগে সংগে জাহাজের মুখ একটু ঘুরে গেল। ঘণ্টা তিনেক চলার পর জাহাজ সোজা উত্তর দিকে এগিয়ে চলল।
আবদুল্লা হাত্তার শেষ কথাটি মনে আছে আহমদ মুসা। তাকে আপো পর্বতে যেতে হবে। মনে হয় আপো পর্বতই পিসিডার হেড কোয়ার্টার।
মানচিত্র দেখে হিসেব করল, আপো পর্বতের উপকূল এখন তিন শ’ মাইল দূরে। আগামীকাল সকালেই জাহাজ পৌছে যাবে।
অসংখ্য চিন্তার জট আহমদ মুসার মাথায়। জাহাজে প্রতিরোধ করার মত আর কেউ নেই-এ সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত। কিন্তু চিন্তা সামনের ভবিষ্যত নিয়ে। পিসিডার কাউকেই সে চিনে না। জাহাজ উপকূলে নেয়ার পর সে কি করবে? পিসিডার লোকদের কি সেখানে পাওয়া যাবে? তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সে কি পারবে? তাকে বিশ্বাস করবে কি তারা?
আহমদ মুসার সম্বল তার কোড নাম- ‘রুড থানডার-রুথ’। আবদুল্লাহ হাত্তার উত্তরাধিকারীর এ অতি গোপনীয় কোডনাম একমাত্র তার মনোনীত ব্যক্তির পক্ষেই জানা সম্ভব-একথা নিশ্চিয় পিসিডার কর্মিরা সবাই জানে। তাছাড়া পিসিডার সহকারী প্রধানের প্রকৃত নাম ও ‘কোড’ নাম সে জানে। এটাও তাতে সাহায্য করবে।
আহমদ মুসার আর একটি সুবিধা হল ভাষার আনুকূল্য। মিন্দানাওয়ের প্রধান ভাষা ‘তাগালগ’ ও ‘আরবী’। তাগালগ ভাষা সে জানে না বটে, কিন্তু আরবী তার প্রায় মাতৃভাষার মত। সুতরাং মিন্দানাওয়ের মানুষের সাথে তার আরবীতে কথা বলতে কোন অসুবিধা হবে না।
আহমদ মুসার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল।

Top