৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

গুলরোখ রাষ্ট্রীয় খামার। পাহাড়ের পাদদেশে ১০ হাজার হেকটর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই খামার। আমুদরিয়া নদী থেকে বয়ে আসা খালের পানিই এই খামারের প্রাণ। ধীরে ধীরে পানির সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে, বাড়ছে সেই সাথে খামারের পরিধি।
খামারের পূর্ব পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে খামারের রেসিডেন্সিয়াল ব্লক। রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের মাঝখানে কম্যুনিটি কমপ্লেক্স। কম্যুনিটি কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি সমাবেশ হল। এখানে নাচ, গান, নাটক গ্রুপের প্রোগ্রাম লেগেই থাকে। তার পাশে সাংস্কৃতিক স্কুল। এখানে নাচ, গান, নাটক ইত্যাদির প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলে। পাশেই একটা লাইব্রেরী রুম। লাইব্রেরীটা কম্যুনিস্ট আদর্শ, কম্যুনিস্ট অর্থনীতি, কম্যুনিস্ট কৃষি, কম্যুনিস্ট সংস্কৃতি প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রকাশনার বই দ্বারা ভর্তি। রাষ্ট্রীয় খামারের স্কুলও এই কম্যুনিটি কমপ্লেক্সে অবস্থিত। একটা খেলার মাঠও রয়েছে কম্যুনিটি কমপ্লেক্সে। বিকেল হলেই ভীড় বাড়তে থাকে কম্যুনিটি সেনটারে। এখানে নাচ, গান, নাটক আর ভদকার স্রোতে সকলকে বুঁদ করে রাখা হয়। মেয়েদের পর্দা বিদায় করা হয়েছে বহু বছরের চেষ্টায়। তবু দেখা যায় মাথায় রুমাল বাঁধা অনেকে অবাধ মেলামেশা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।
কম্যুনিটি সেন্টারের দক্ষিণ পাশে তাকালেই মাঠটার ওপারে একটা বড় বাংলো দেখা যায়। ওটা গুলরোখ খামারের ডিরেক্টর মুহাম্মাদ আতাজানভের বাড়ী। আতাজানভ উজবেকিস্তানের একজন সুপরিচিত কৃষিবিদ। তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে ডক্টরেট নিয়েছেন। দক্ষ একজন কৃষিবিদ। পাহাড়ের অনেক উষর উপত্যকা এবং অনেক মরু মাটিতে তিনি সবুজের সমারোহ এনেছেন। এই গুলরোখ খামারের ও তিনিই স্রষ্টা। আতাজানভ উজবেকিস্তান কৃষি কাউন্সিলেরও সদস্য।
সূর্য উঠলেও ভোরের ঠান্ডা আমেজ তখনও কাটেনি। আতাজানভ তাঁর সোয়ারের ঘোড়াটা আস্তাবলে বেঁধে ঘাম মুছতে মুছতে বাড়ীতে ঢুকে গেলেন। ফজর নামাযের পর উঁচু নীচু পাহাড়ী পথে অশ্বচালনা তাঁর নিয়মিত ব্যায়াম।
নাস্তা সেরে স্টাডিরুমে এসে বসলেন আতাজানভ। আলমারীতে বইয়ের ভীড়ে লুকোনো কুরআন শরীফ বের করে একটা চুমু খেয়ে টেবিলে নিয়ে বসলেন। রুশ ভাষায় লেখা কুরআনের তাফসীর। আফগান মুজাহিদদের কাছ থেকে জোগাড় করেছেন আতাজানভ।
কুরআন পড়ছিলেন আতাজানভ। এ ঘরে অভিধান নিতে এসে মেয়ে নাদিয়া তার আব্বার কুরআন পড়া দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। কুরআন থেকে মুখ তুলে আতাজানভ বললেন, কিছু বলবে?
না আব্বা, এমনি দেখছিলাম।
তুমি কুরআন পড়ছো তো?
পড়ছি। আচ্ছা আববা একটা কথা, কুরআনের তাফসীর পড়তে যেয়ে দেখছি, কতকগুলো নির্দিষ্ট গুণ থাকলে তবেই সে মূসলমান হবে। তাহলে বংশগত ভাবে কি মুসলমান হওয়া যায়?
যায় না। তবে মুসলিম হয়ে জন্মাবার পর যদি সে আল্লাহকে এক মানে, রাসূলকে রাসূল মানে তাহলে তার পরিচয় মুসলিম অবশ্যই হবে, কিন্তু মুসলিম হবার সব শর্ত এতে পূরণ হবে না এবং পরকালে মুক্তিও আসবে না।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্লাসে আদম শুমারীতে মুসলমানদের জনসংখ্যার উল্লেখ কেন নেই এই প্রশ্নের জবাবে স্যার বলেছিলেন, দেশে ক’জন মুসলমান আছে! বাপ মুসলমান হলে কি ছেলে মুসলমান হয়?
আদম শুমারীতে কাদের মুসলমান বলা হবে?
সত্যকে পাশ কাটাবার এটা একটা মতলব।মুসলমানেদর মুসলমানিত্ব নষ্ট করার ব্যবস্থাটা তো ওরাই করেছে।
আতাজানভ আবার কুরআন শরীফ পড়ায় মনোযোগ দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আতাজানভের ছেলে আট বছর বয়সের আহমদ আতাজানভ দৌড়ে এসে পিতার পাশে দাঁড়াল। আতাজানভ তাড়াতাড়ি কুরআন শরীফ বন্ধ করলেন। আহমদ বলল, এটা কি বই আব্বা?
এই একটা বই।
দেখি কি বই। বলে আহমদ বইটিতে হাত দিতে চাইল। আতাজানভ কুরআন শরীফ একটু টেনে নিয়ে বললেন, অজু না করে এ বই ধরে না! যও এখন পড়ো গে।
আহমদের আকর্ষণ যেন এতে আরো বাড়ল। বলল, কি লেখা আছে এতে, গল্প?
গল্প নয়, অনেক ভালো কথা।
কি ভাল কথা?
আল্লাহর কথা।
আল্লাহ কে?
মানুষ এবং সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন।
আহমদ তার পিতার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল, কি আব্বা, আমাদের স্যার তো বলেন, স্রষ্টা নেই। আগের মানুষ জানতো না তাই স্রষ্টার কথা বলত।
আতাজানভ বিপদে পড়ে গেলেন। এখন যদি স্রষ্টা আছেন এ কথা ছেলেকে বুঝিয়ে না দেন তাহলে ছেলের কাছে তিনি মিথ্যাবাদী হয়ে যান। আবার যদি বলা হয় স্যার ঠিক বলেননি, তাহলে আহমদের স্যার মিথ্যাবাদী হয়ে যায়। আর আহমদ নিশ্চয় ক্লাসে গিয়ে স্যারকে বলবে সে মিথ্যা কথা বলেছে। তখন ক্রুদ্ধ শিক্ষক আতাজানভের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসবে যে, তিনি স্কুলের শিক্ষা কারিকুলামের বিরোধিতা করছেন। আর এ অভিযোগের সাথে সাথেই আতাজানভের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অনুসন্ধান শুরু হবে। এসব ভেবে নিয়ে আতাজানভ আহমদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আহমদ, এসব কথা এখন বুঝবে না, আরও বড় হও বুঝিয়ে দেব, কেমন। যাও এবার পড়ো গে।
আহমদ যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে চলে গলে। নাদিয়া বলল, আব্বা, আহমদকে কুরআন শরীফের নামটা বললে কি ক্ষতি হত?
আতাজানভ বললেন, অসুবিধা এই ছিল, আমি কুরআন শরীফ পড়ি এই কথা সে ক্লাসে তার সহপাঠীদের এবং স্যারদের গিয়ে বলত। দেখ না, প্রতিদিন ক্লাসে কি হয় কেমন সে হুবুহু রিপোর্ট করে।
কিন্তু করলেই কি হত?
১০ নং ট্রাকটরের ড্রাইভারের ইয়াসিনভকে চিনতে?
কেন তার চাকুরী এবং খামার থেকে সদস্যপদ বাতিল হলো জান?
না।
গোয়েন্দা দফতরে রিপোর্ট গিয়েছিল, সে মোল্লার কাছে আরবী শিখেছে এবং কুরআন শরীফ পড়ে।
কিন্তু মোল্লারা কুরআন শরীফ পড়লে দোষ হয় না?
দোষ হয়, কিন্তু তাদের সহ্য করা হয়।
কেন?
দুটো কারণে। এক, বিশ্বকে বুঝানো যে, কুরআন শরীফ জানা এবং পড়া এখানে নিষিদ্ধ নয়। দেখনি, আমাদের খামারে একবার বাংলাদেশ থেকে একদল সফরকারী এলে তাদের সামনে মোল্লা মীর ইয়াকুবকে দিয়ে কুরআন শরীফ পড়ানো হয়েছিল? সফরকারীরা সে কি খুশী! অথচ এর একদিন আগেই ইয়াসিনভকে বরখাস্ত করে খামার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর দু’নম্বর কারণ হলো, মুসলমানদের মধ্যে একযোগে কোন ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণ তৈরী না করা। মুসলমানরা এখনও মোল্লাদের ভালোবাসে, তাদের সম্মান করে এবং তাদের কথা শোনেও!
ঠিক বলেছেন আব্বা, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নামায গোপনে আমার রুমে পড়ি। আমি জেনেছি যারা মসজিদে নামায পড়তে যায়, কিংবা যারা প্রকাশ্যে নামায পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা বিধান বিভাগ এবং কম্যুনিস্ট স্টুডেন্ট লীগ তাদের একটা রেজিস্টার সংরক্ষণ করে।
আতাজানভ কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলেন, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। ‘দেখি কে এল’ বলে উঠে দাঁড়ালেন আতাজানভ। কুরআন শরীফ আলমারীতে রেখে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এলেন।
আতাজানভ দরজা খুললেন। গেটে দাঁড়িয়ে কর্ণেল কুতাইবা। আতাজানভ অস্ফুট কন্ঠে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে তাঁকে স্বাগত জানালেন।
ড্রইং রুমে এসে বসলেন কর্নেল কুতাইবা। কপালে তাঁর বিন্দু বিন্দু ঘাম। পথ চলার ক্লান্তি তার চোখে মুখে।
কর্নেল কুতাইবা সাড়ে ছ’ফুট লম্বা দেহের বিশাল মানুষ, ইস্পাতের মত পেটা দেহ। মেদের সামান্য চিহ্ন দেহের কোথাও নেই। সারাদিন অসুরের মত খাটতে পারেন। কর্নেল কুতাইবার আসল নাম কর্নেল গানজভ নাজিমভ। ওয়ার্ল্ড রেড আর্মির একজন কর্নেল। চীন সীমান্তে যুদ্ধের সময় পায়ে আঘাত পান। এই আঘাতের কারণেই তাকে রিটায়ার করিয়ে দেয়া হয়। একটু খুঁড়িয়ে হাটেন। উজবেকিস্তানের খুব বড় ঘরের ছেলে নাজিমভ। তার পিতা শরীফ রশিদভ ছিলেন উজবেক সরকারের প্রধান। রিটায়ারের পর নাজিমভকে ভালো চাকুরী অফার করা হয়েছিল, তিনি যাননি। সড়ক পরিবহনের একটি হেভি ট্রাক বহরের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। নিজেও ট্রাক চালান। তাঁর ট্রাক বহর তাসখন্দ থেকে পামিরের বলতে গেলে মাথায় অবস্থিত তাজিকিস্তানের পামির বায়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউট পর্যন্ত যাতায়াত করে। তিনি সাইমুমের সাথে জড়িত হয়েছেন অনেকদিন। একটি ছোট্ট ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
নাজিমভ অত্যন্ত ভালোবাসতো তার দাদু ইমসাইল রহিমজানকে। রহিমজান তার যৌবনে যাই করুন পরে তার ভুল বুঝতে পারেন এবং ধর্মানুরক্ত হয়ে পড়েন। সবকিছু থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করতেন। ছেলে রশিদভ পার্টির ও রাষ্ট্রের উচ্চ পদ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পিতার খুব কমই খোঁজ নিতে পারত। রহিমজানও কষ্ট বোধ করতেন ছেলের কাজ কর্মে। দাদুর নিঃসঙ্গ জীবনের সাথী ছিল নাতি নাজিমভ। সেনাবাহিনীতে যাবার পরও ছুটি পেলেই নাজিমভ ছুটে আসত দাদার কাছে। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন দাদা-নাতি গল্প করে। নাজিমভ তার দাদুর মত নামায রোযা করতো না। দাদুও তাকে কোনদিন চাপ দেয়নি। শুধু বলতো, এখন বুঝছো না, বুঝবে একদিন।
দাদুর অসুখের খবর পেয়ে নাজিমভ ছুটি নিয়ে ছুটে এসেছিল দাদুর কাছে। দাদু যেন তার পথের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ডাক্তারের কাছে নজিমভ শুনলো, তার দাদুর অবস্থা ভালো নয়। নাজিমভ দাদুর কপালে হাত রেখে ব্যাকুলভাবে বলল, তোমার কষ্ট হচ্ছে দাদু?
কি কষ্ট দাদু?
আমি মরে গেলে আমার দেহটাকে তো তোমরা পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু আমি তো মুসলামান।
দাদু থামলেন হঠাৎ কোন জবাব দিতে পারল না নাজিমভ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল দাদুর দিকে। সে জানে দাদু কি বলতে চায়। কিন্তু কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় ইসলামী নিয়মে দাফন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দাদুই আবার কথা বললেন, জানি এসব কথা তোমাদের কাছে নিরর্থক। কিন্তু আমি তোমাদের মাফ করবো না। বলতে বলতে বৃদ্ধের গন্ড বেয়ে অশ্রুর দুটি ধারা নেমে এল। বৃদ্ধ দাদুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল নাজিমভ। বলল, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি দাদু, আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো।
নাজিমভ তার সবটুকু শক্তি দিয়েই চেষ্টা করেছে। কিন্তু দুর্বল এক কন্ঠ শত কণ্ঠের ভীড়ে হারিয়ে গেছে। পিতা রশিদভ ধমক দিয়ে নাজিমভকে বলেছে, মুর্খের মত আচরণ করো না, বাস্তববাদী হও।
ব্যার্থ হয়েছে নাজিমভ। ব্যর্থ নাজিমভ দাদুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আর থাকেনি। দাদুর দেহটাকে যান্ত্রিক দাহ-কেন্দ্রে নিয়ে যাবার জন্য যখন তৈরী করা হচ্ছিল, তখন নাজিমভ চোখ মুছতে মুছতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিল। চলে এসেছিল নিজ কর্মক্ষেত্রে। তারপর যুদ্ধে আহত হয়ে রিটায়ার করার পর একবার মাত্র বাড়ী গিয়েছিল।
এ ঘটনা নাজিমভের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে। ইসলামের ওপর পড়াশুনা শুরু করেন। এখন দুঃখী মুসলিম জনগণকে মুক্ত করে ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তাঁর নতুন নাম কর্নেল কুতাইবা। ইতিহাসের কুতাইবা ছিলেন মধ্য এশিয়া অঞ্চলের প্রথম মুসলিম বিজেতা।
কর্ণেল কুতাইবা এখন মধ্যে এশিয়া অঞ্চলের সাইমুমের প্রধান। আতাজানভ নাস্তা আগেই করেছিলেন। কুতাইবা নাস্তা করার পর দু’জনে বেরিয়ে পড়লেন। আতাজানভের জীপে দু’জন চেপে বসলেন। জীপ বেরিয়ে এল খামার কমপ্লেক্স থেকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কুতাইবা বললেন, আমরা দু’ঘন্টায় পৌছতে পারব নিশ্চয়?
আতাজানভ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। পাহাড়ী পথ বেয়ে এগিয়ে চলল জীপ।

গুলরোখ রাষ্ট্রীয় খামার থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ের ৪ হাজার ফুট উঁচুতে একটি হ্রদ এবং একটি সুন্দর উপত্যকা ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র। হ্রদের চারদিক বেষ্টন করে যে ফল ও ফুলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে তা দেখার মত। নাম দেয়া হয়েছে লেনিন স্মৃতি পার্ক। এই পার্ক থেকে একটা সুপরিসর উপত্যকা বেরিয়ে গেছে দক্ষিণ দিকে। এই উপত্যকায় ফলের চাষ হয়। গোটা গ্রীষ্মকালটা ভ্রমণকারীদের পদভারে জমজমাট থাকে এই পর্যটন কেন্দ্র। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, প্রভৃতি সব অঞ্চল থেকেই ছুটি ও অবসর বিনোদনের জন্য লোক আসে এখানে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ভীড় বাড়ে।
লেলিন স্মৃতি পার্ক ছাড়িয়ে উপত্যকার পথ ধরে এগিয়ে চলছিলেন আতাজানভ ও কর্ণেল কুতাইবা। উপত্যকার মাঝামাঝি জায়াগায় ঘন গাছে ঢাকা খামার বাড়ী। উপত্যকার রাষ্ট্রীয় খামারের পরিচালক আলদর আজিমভ এই খামার বাড়ীতে বাস করেন। আতাজানভের সহপাঠী ও বন্ধু এবং আতাজানভের মতই সাইমুমের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
আতাজানভ ও কুতাইবা খামার বাড়ীর গেটের কাছে পৌঁছে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে নিজেদের মাথায় হাত বুলালেন। সংগে সংগে খুলে গেল খামার বাড়ীর দরজা। দরজা খুলে দারোয়ান দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাজের মত তার চোখ। তার ডান হাতটা ঢিলা ওভারকোটের পকেটে। বুঝাই যায় ওখানে কি আছে।
বাড়িতে প্রবেশের পথে আরেকটা দরজা। দরজার সামনে গিয়ে দু’জনেই বিশেষ নিয়মে তাদের শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলি ঠোঁট দ্বারা স্পর্শ করলেন। দরজা খুলে গেল। এখানেও দরজার পাশে আরেক জন দাঁড়িয়ে, ঐ ভাবেই তার হাত ট্রাউজারের পকেটে।
দরজার পরেই চারকোণা একটি উঠান। এটাই বাড়ির বাইরের আঙিনা। আঙিনার উত্তর পাশের বারান্দার সিঁড়িতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আলদর আজিমভ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আমির উসমান, আনোয়ার ইব্রাহিম এবং হাসান তারিক।
আলদর আজিমভ, কুতাইবা এবং আতাজানভকে হাসান তারিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কুতাইবা বহুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন হাসান তারিককে। তারপর বললেন, আমাদের অতি কাছে থেকেও অনেক কষ্ট পেয়েছেন। দুর্ভাগ্য, আমরা জানতে পারিনি।
হাসান তারিক বললেন, না, দুঃখের কিছু নেই। আল্লাহ ঠিক যখন এ খবরটা আপনাদের জানাবার তখনই জানিয়েছেন এবং আলহামদুল্লিাহ আপনারা সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননি।
বারান্দা পেরিয়ে সবাই পাশের একটা রুমে ঢুকে গেলেন। সেখানে আরও ক’জন আগে থেকেই বসা ছিলেন।
এখানে একটু বলা প্রয়োজন, আলদর আজিমভের এই বাড়ী উজবেকিস্তান সাইমুমের অপারেশনাল হেড কোয়াটার্স। শুধু এই বাড়ী নয়, এই উপত্যকা প্রকল্পের সব লোকই সাইমুমের কর্মী। এই খামার বাড়ী ঘিরে উপত্যকায় ছড়ানো ছিটানো রয়েছে অনেকগুলো সংকেত শিবির। সবগুলোই সশস্ত্র। একেকটা সংকেত শিবির হাজার সৈন্যের বাহিনীকেও মুকাবিলা করার শক্তি রাখে। আবার বিপদের সময়ে উপত্যকা খালি করে পাহাড়ের গোপন দুর্গম পথে তারা অল্প সময়েই সীমান্তের ওপারে আফগানিস্তানে গিয়ে পৌঁছতে পারে।
কার্পেট পাতা মেঝেতে সবাই গোল হয়ে বসেছে। কুতাইবার একপাশে বসেছেন হাসান তারিক, অন্য পাশে বসেছেন আলদর আজিমভ। প্রথমে কথা বললেন কুতাইবা। বললেন, আজ একটা অতি গুরুত্ব-পূর্ণ, অতি জরুরী বিষয়ের আলোচনার জন্য এই পরামর্শ সভার অধিবেশন ডাকা হয়েছে। সে কথা বলার আগে আমি আমাদের ভাই, আমাদের মেহমান হাসান তারিক সম্পর্কে বলতে চাই। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি যে, তাঁর মত অভিজ্ঞ ও দক্ষ সাইমুম নেতাকে আমাদের পাশে পেয়েছি। তাঁর সম্পর্কে আপনারা সবকিছুই সামিজদাদের মাধ্যমে জেনেছেন। নুতন কিছুই বলার নেই।
থামলেন কুতাইবা। তারপর বলতে শুরু করলেন আবার, ইসলামিক রিপাবলিক অব ফিলিস্তিনের মস্কোস্থ এ্যামবেসী গতকাল আমাকে জানিয়েছে, বিশ্বজোড়া এক ছায়া সরকারের মালিক এখানকার ওয়ার্ল্ড রেড সংস্থা ‘ফ্র’ মিন্দানাও বিপ্লবের সময় আহত অবস্থায় আমাদের ভাই, আমাদের নেতা আহমদ মুসাকে বন্দী করে। বিমান তাঁকে নিয়ে আসে এদেশে। কিন্তু পামির এলাকায় প্লেন ক্রাশের পর তিনি হারিয়ে গেছেন। প্লেন ক্রাশে তিনি মারা যাননি, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথায় গেলেন তিনি, এটা এখনও এখানকার সরকার কিংবা অতুল শক্তিধর ‘ফ্র’ কেউই বহু চেষ্টা করেও জানতে পারেনি।
হাসান তারিক সহ সকলের মুখ হা হয়ে গেছে। বিস্ময়ে সকলের চোখ বিষ্ফারিত। হাসান তারিক, আলদর আজিমভ ও আতাজানভ সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা স্বপ্ন দেখছি না তো, আমাদের কান যা শুনছে তা ঠিকই শুনছে তো ইত্যাদি।
শুনতে স্বপ্নের মতই লাগছে, কিন্তু বাস্তব সত্য। ‘ফ্র’-এর হেলিকপ্টার ও গোয়েন্দা দল পামিরের ঐ এলাকা এখনও চষে ফিরছে।
সত্য বলে তো আমাদের বসে থাকার সময় নেই, আল্লাহ জানেন তিনি এখন কোথায় কিভাবে আছেন, বিশেষ করে আহত তিনি! বলল আমির উসমান।
তার সম্পর্কে আমরা দুই অবস্থার কথা চিন্তা করতে পারি, (এক) তিনি একভাবে লুকিয়ে আছেন, (দুই) তিনি কারও আশ্রয়ে আছেন। এই দুইটির যে কোনটি হলে, আমি তাঁর সম্পর্কে জানি, তিনি পথ বের করে আমাদের সামনে আসবেন। বললেন হাসান তারিক।
আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা এই দু’টোর যে কোন একটিই হোক। আসুন আমরা তৃতীয় কোন বিকল্প নিয়ে চিন্তা করবো না। বললেন কুতাইবা। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমাদের ক’জনকে এখনি তাজিকিস্তানের পামির এলাকার কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছা দরকার। তাদের সাথে নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানে লেগে যাওয়া প্রয়োজন।
থামলেন কুতাইবা। এবার আমির ওসমান বলল, আপনিই ঠিক করে দিন কে কোথায় যাবে। আমি শুধু এখানে একটা কথাই বলব, পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর। হাসান তারিক জেল থেকে পালিয়েছেন, আহমদ মুসা হারিয়ে গেছেন। অতএব ‘ফ্র’ এখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মত। অনুসন্ধানে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে।
আমি কি এ ব্যাপারে আপনাদের কোন কাজে লাগব? বললেন হাসান তারিক।
না। আপনি আপাতত এই হেড কোয়াটার্সে থাকবেন। এখানে আপনার অনেক কাজ। থামলেন কুতাইবা। তারপর বললেন, এখন বৈঠক এখানেই শেষ করছি। আমি আলদর আজিমভকে অনুরোধ করছি, আতাজানভ এবং হাসান তারিক ছাড়া সকলকে এক ঘন্টার মধ্য রওয়ানার ব্যবস্থা করে দিন, আমি প্রোগ্রাম তাদের দিচ্ছি। বলে কুতাইবা উঠে দাঁড়ালেন।

একটু পুরোনো মসজিদ, একটা মাদ্রাসা ভবন এবং আমির তাইমুরলংগের পীর সুফী আবদুর রহমানের কবরগাহ নিয়ে এখানকার হিসার দুর্গ। দুর্গ বলতে যা বুঝায় এখন তা নেই। দুর্গের একটা ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে মসজিদের দক্ষিণ পাশে। মসজিদ মাদ্রাসা সবই দুর্গের মধ্যে ছিল। মুসলমানরা কোন রকমে মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরগাহটা টিকিয়ে রেখেছে। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের পবিত্রতম স্থানগুলোর মধ্যে হিসার দুর্গ একটি। মুসলমানদের সেন্টিমেন্টের কারণেই হিসার দুর্গের মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরগাহে রেড সরকার হাত দিতে পারেনি।
মসজিদের দক্ষিণ পাশে ভাঙা দুর্গের পাশ ঘেঁষে মোল্লা আমির সুলাইমানের বাড়ী। তিনি সুফী আবুদর রহমানের উত্তর পুরুষ। সমজিদের ইমাম, মাদ্রাসার মুহাদ্দিস, কবরগাহের মুতাওয়াল্লী তিনি। তিনি মুসলমানদের অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র। সাইমুমের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য তিনি। রাত সাড়ে তিনটায় উঠেন আমির সুলাইমান। তাহাজ্জুদের নামায পড়েন, ফজরের নামায পড়েন। তারপর তাসবিহ-তাহলিল শেষে বেলা উঠলে চাশতের নামায পড়ে ঘরে ফেরেন।
সেদিন ঘরে নাস্তা করে আমির সুলাইমান আহমদ মুসার রুমে এসে বসলেন। আহমদ মুসাকে পেয়ে আমির সুলাইমান যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। এখন গোটা সময়টাই তিনি আহমদ মুসার কাছে বসে কাটান। গল্প শোনেন। ফিলিস্তিন ও মিন্দানাওয়ের গল্প শুনতে শুনতে গর্বে তার বুক ফুলে ওঠে। নিজের দেশের এক সোনালী ভবিষ্যত যেন তার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
আজ আহমদ মুসা উদগ্রীবভাবে আমির সুলাইমানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আসতেই আহমদ মুসা বললেন, জনাব একটা কথা বলব আপনাকে?
আহমদ মুসার কন্ঠস্বরে চমকে তাকিয়ে আমির সুলাইমান বললেন, কোন খারাপ কিছু নয় তো?
হয়তো খারাপ!
কি বলুন তো?
হিসার দুর্গের খাদেম ইয়াকুব সম্পর্কে আপনার মত কি, কেমন সে?
কেন, কিছু ঘটেছে?
বলুন, বলছি।
ছ’মাস আগে তাকে কাজে লাগিয়েছি। পিয়ান্দজের এক কলখজে চাকুরি করত। চাকুরী হারিয়ে বেকার ঘুরছিল। নামায-কালামে ভাল দেখে চাকুরী দিয়েছি।
সে এখানে আসে, না আপনি তাকে নিয়ে আসেন?
সেই আসে এখানে। তবে এইটুকু জেনেছি সে ঐ কলখজে চাকুরী করত।
আমি তাকে সন্দেহ করছি। আমি তিনদিন হলো এসেছি। প্রথম দিনেই তার চোখের ভাষা আমার মনে সন্দেহ জাগায়। গতকালের একটা ঘটনায় আমি সন্দেহ আর ধরে রাখতে পারছি না।
কি ঘটেছে গতকাল?
গতরাতে এশার পর আমি মাঠটায় পায়চারী করছিলাম। অন্ধকার রাত। আমি ফিরবার সময় ইয়াকুবের ঘরে কথা শুনলাম। ঠিক টেলিফোনে কথার মত। আমি শোনার জন্য দাঁড়াতেই কথা শেষ হয়ে গেল। আমি রাতে অনেক চিন্তা করেছি। আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে তাহলে সে অয়্যারলেসে কথা বলছিল।
অয়্যারলেসে কথা বলছিল, তাহলে সরকার কিংবা ‘ফ্র’- এর গুপ্তচর সে!
বিস্ময়-বিষ্ফারিত তার দৃষ্টি। চোখুমখ তার লাল হয়ে উঠেছে। আমির সুলাইমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আমির সুলাইমানের ছোট নাতি ছুটে এসে খবর দিল, দাদা মিলিটারি।
‘মিলিটারী!’ বলে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজায় এলেন আমির সুলাইমান। কিন্তু আর এগুতে পারলেন না। ‘ফ্র’-এর সামরিক বিভাগের ইউনিফর্ম পরা দু’জন অফিসার এগিয়ে আসছে দরজার দিকে। এসেই আমির সুলাইমানেক লক্ষ্য করে বলল, আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করলাম। একটুও নড়বেন না।
‘এই ঘরেই তো আপনার মেহমান থাকে’ বলে রিভলভর বাগিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল একজন অফিসার। ততক্ষণে আহমদ মুসা মেঝেয় নেমে পড়েছে। দরজায় অফিসারটির মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো, আমিই তাঁর মেহমান।
অফিসার তার পিস্তলটি আহমদ মুসার বুক বরাবর তাক করে রেখে পিছিয়ে গেল অনেকখানি। তারপর আহমদ মুসার আপাদমস্তকে একবার নজর বুলিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে বলল, ইউ আর গ্রেট আহমদ মুসা। পাওয়া গেছে আপনাকে। বলে সে আনন্দে কয়েক রাউন্ড গুলী ছুঁড়লো আকাশে।
গুলীর শব্দে আরও দু’জন অফিসার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। প্রথম অফিসারটি হেসে বলল, ভয় নেই, শিকার পাওয়া গেছে। তোমরা এঁদের দু’জনকে গাড়ীতে তোল। আমি এ ঘরটা একটু দেখে আসি।
পামির সড়ক থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে উত্তরে হিসার দুর্গের দিকে। রাস্তাটি পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে একটা বড় উপত্যকায় থেমে গেছে। তারপর আবার তা উঠে গেছে পাহাড়ে। এই পাহাড়ি পথের শেষ প্রান্তে হিসার দুর্গ।
কুতাইবার গাড়ি পামির সড়ক থেকে হিসার দুর্গের পথ ধরে চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে এগিয়ে চলছিল। সেই বড় উপত্যকার সামনের বড় চড়াইটার মাথায় উঠেই কুতাইবা দেখতে পেল উপত্যকা থেকে একটা গাড়ি উঠে আসছে। সংগে সংগে কুতাইবা সালামভকে গাড়ি থামাতে বললেন। চোখে দূরবীন লাগিয়ে দেখলেন ‘ফ্র’-এর পরিচয় চিহ্ন আকা ছয় সিটের একটা সামরিক কায়দার পিকআপ ভ্যান। ‘ফ্র’-এর ভ্যান হিসার দুর্গের দিক থেকে কেন? দূরবীণে চোখে ধরেই থাকলেন কুতাইবা। গাড়ি আরো কাছে এল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, গাড়ীর ছয়টি সিটে ‘ফ্র’-এর সামরিক ইউনিফর্ম পরা ছয়জন লোক। ভ্যানটি আরো এগিয়ে এসেছে। এবার সেই অফিসারদের চেহারা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তাদের সামরিক ইনসিগনিয়া পর্যন্ত। অফিসারদের একজন ‘ফ্র’- এর কর্নেল ও একজন ক্যাপ্টেন র্যাংকের। অবশিষ্ট চারজান লেফটেন্যান্ট।
একটা বাঁকে এসে গাড়ীটি ডানদিকে টার্ণ নিল। এবার গাড়ীর পেছনটা সামনে এসে গেল। কুতাইবা দেখলেন ভ্যানের ফ্লোরে পড়ে আছে দুজন লোক। গাড়ীর ঝাঁকুনিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের হাত-পা বাঁধা। কুতাইবার গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার চোখ দু’টি। দু’জনের একজনের মুখ দেখে চমকে উঠলেন কুতাইবা। ওকি! উনি তো আমির সুলাইমান। বন্দী তিনি। তার পাশে উনি কে? চেনা নয়, মাথায় ব্যান্ডেজ। হঠাৎ একটা আশংকা মনে উঁকি দিল। উনি কি আহমদ মুসা হতে পারেন? ওরা দুরবীণের চোখ থেকে হারিয়ে গেল। গাড়ি ঘুরে গেছে। এবার গাড়ীটি সোজা উঠে আসছে চড়াই-এর দিকে।
কুতাইবা চোখ থেকে দূরবীণ নামিয়ে নিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি। সালামভকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি একটু পিছিয়ে নাও। গাড়ি একটু পিছিয়ে এলে দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। সালামভকে সব কথা বুঝিয়ে বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চড়াই-এর মাথায় দু’জন দু’পাশের দুই পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকালেন।
গাড়ীটি উঠে আসছে চড়াই-এর দিকে। অফিসাররা তখন খুব হালকা মুঢে। কেউ ঝিমুচ্ছে, কেউ রেকর্ড প্লেয়ার থেকে ভেসে আসা ফিল্মী সংগীত উপভোগ করছে।
চড়াই ভেঙে উঠে আসা গাড়ি চড়াই-এর মাথায় এসে একটু দম নিয়েছে। ড্রাইভিং সিটে বসা অফিসারটি গিয়ার চেঞ্জ করছে। এমন সময় গাড়ীর ডান পাশে পাথরের আড়াল থেকে মুখোশ আঁটা কুতাইবা বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এলেন। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই কুতাইবার এম-ই-১০ অটোমেটিক মেশিন পিস্তলের ভয়ংকর ব্যারেলটা ড্রাইভারের পাশের জানালা দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল সামনের তিনজন অফিসারের দিকে। কুতাইবা পরিষ্কার রুশ ভাষায় বললেন, অস্ত্র হাতে নেবার কোন চেষ্টা করবেন না।
পেছনের তিনজন কুতাইবার পিস্তলের আড়ালে ছিল। এই সুযোগ তারা গ্রহণ করতে চাইল। একজন তার স্টেনগান তুলে নিয়েছিল। কিন্তু সে খেয়াল করেনি বাঁ পাশ থেকে সালামভ এসে দাঁড়িয়েছে তার জানালার পাশে। অফিসারটি তার স্টেগানের ট্রিগারে হাত দেবার আগেই সালামভের মেশিন-পিস্তল থেকে বৃষ্টির মত এক ঝাঁক গুলী বেরিয়ে গেল।
এম-ই-১০ অটোমেটিক মেশিন পিস্তল ভয়ানক এক ক্ষুদে অস্ত্র। মিনিটে ১২ শ’গুলী বেরোয় ওর ক্ষুদে ব্যারেল থেকে।
সালামভের পিস্তল যখন থামল দেখা গেল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে পিছনের তিনটি দেহই।
গুলি ছোঁড়ার সময় যে হতচকিত একটা মুহূর্ত তার সুযোগ নিয়েছিল ড্রাইভার। সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কুতাইবার পিস্তল ধরা হাতের ওপর। কিন্তু কুতাইবার বজ্রমুষ্টি এতটুকুও কাঁপেনি। মাত্র সেকেন্ডের জন্য চেপে ধরেছিলেন পিস্তলের ট্রিগার। এক পশলা বৃষ্টির মত বেরিয়ে গেল গুলী। তিনটি দেহই লুটিয়ে পড়ল সিটের ওপর।
কুতাইবা এবং সালামভ দুজনেই দ্রুত উঠে গেলেন ভ্যানের ওপর। আহমদ মুসা ও আমির সুলাইমান দু’জনেই অীত কষ্টে উঠে বসেছিলেন। কুতাইবাকে দেখে ‘মারহাবা’ ‘মারহাবা’ বলে আনন্দ প্রকাশ করলেন আমির সুলাইমান।
প্লাস্টিক কর্ডের বাঁধন কেটে দিলে দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। কুতাইবা আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, আমার অনুমান মিথ্যা না হলে আপনিই আহমদ মুসা, আমাদের নেতা।
আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, না ভাই, সবাই আমরা কর্মী, আল্লাহর সৈনিক।
আনন্দের অশ্রু কুতাইবার চোখে। তিনি বললেন, এ দেশবাসীর জন্য আজ আনন্দের দিন। আল্লাহর দান আপনি আমাদের জন্য।
সবাই নেমে এলেন ভ্যান থেকে। ভ্যানটাকে ঠেলে পাশের গভীর খাদে ফেলে দেয়া হলো। চার হাজার ফিট গভীর অন্ধকার খাদে হারিয়ে গেল ৬টি লাশ সমেত ভ্যানটি।
ভ্যান থেকে পাওয়া স্টেনগান ও পিস্তলগুলো গাড়ীতে তুলে নেয়া হলো। মুছে ফেলা হলো এখানে কোন প্রকার ঘটনা ঘটার সব চিহ্ন। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে যাত্রা শুরু করলেন পামির সড়কের দিকে।
আহমদ মুসা বলল, খুব জোর ঘন্টা চার-পাঁচ, তার পরেই ‘ফ্র’-এর লোকেরা ওদের সন্ধানে আসবে এই সড়কের দিকে।
একটু থেমে কুতাইবার দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ওদেরকে খুঁজে না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওরা হিসার দুর্গ এলাকার বসতির ওপর অত্যাচার করতে পারে।
তা ঠিক, কিন্তু এর কোন প্রতিকার আমাদের হাতে নেই। আল্লাহ ভরসা। নির্দোষ মানুষের ওপর এই অত্যাচারই হবে ওদের পতনের কারণ।
বললেন কুতাইবা।
আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ফ্র’-এর অত্যাচার ও আধিপত্যের বয়স অনেক হলো, বার্দ্ধক্যজনিত ভুল তার বাড়বে। আর এ ভুলগুলোই রচনা করবে আমাদের সাফল্যের পথ।
কুতাইবার হাতে ড্রাইভিং হুইল। তাঁর দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। উজ্জ্বল এক আনন্দ সে দৃষ্টিতে। সামনে দৃষ্টি রেখেই তিনি বললেন, ভাই আহমদ মুসা, এ পথ রচনার দায়িত্ব এখন আপনার। আমরা সবাই আপনার কর্মী।
আহমদ মুসা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলেন সামনে। তাঁর দৃষ্টি এখন এ পাহাড়ী পথের ওপর সীমাবদ্ধ নয়। মধ্য এশিয়ার পাহাড়, উপত্যকা, মরুভূমি এবং দুঃখী জনপদগুলো তাঁর চোখে ভাসছে। সেই সাথে ভেসে উঠছে এখাণে চেপে বসা দৈত্যাকায় শক্তি ‘ফ্র’-এর এক ভয়াল রূপ। চোখ বুজলেন আহমদ মুসা। ভেসে উঠল এবার তাঁর চোখের সামনে রক্ত ভেজা জনপদমালার এক দৃশ্য-রক্তাক্ত পামির। গাড়ি যেন দ্রুত প্রবেশ করছে সেই রক্তের দরিয়ায়। প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রী শক্ত হয়ে উঠছে আহমদ মুসার। হাত দু’টি তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে তাঁর অজান্তেই। চোখ খুললেন আহমদ মুসা। কোন জবাব দিলেন না কুতাইবার কথায়। তীব্র বেগে এগিয়ে চলছে তখন গাড়ি।

পরবর্তী ঘটনার জন্য দেখুন
‘‘রক্তাক্ত পামির’’

Top