৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

জাহাজ থেকে স্ট্রেচারে তোলার সময় জাম্বুয়াংগো বন্দরেই আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসার সংগে সংগেই অনুভব করেন হাত পা তার বাঁধা। বুঝতে পারেন তিনি এখন স্বাধীন নয়। পেছনের ঘটনা একবার স্মরণ করতে চেষ্টা করেন তিনি। মনে পড়ে, জাহাজের বেষ্টনি থেকে তো তাঁর বোট বের হয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু তারপর কি ঘটল? মনে পড়ে এক প্রচন্ড ধাক্কার কথা। তারপর আর কিছু মনে নেই। তাহলে তিনি ঐখানেই জ্ঞান হারান? কিন্তু সাথীরা কোথায়? মনটা তাঁর আনচান করে ওঠে। সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে।
একটা পিকআপ ভ্যানের ফ্লোরে এনে আহমদ মুসাকে নামানো হলো।
ঠিক নামানো তো নয়, স্ট্রেচার থেকে তাঁকে গড়িয়ে ফেলা হলো গাড়ীর মেঝেতে। মাথাটা ঠক করে বাড়ি খেল গাড়ির মেঝের সাথে। বেদনায় টন টন করে উঠল মাথাটা। গোটা শরীরে বেদনার একটা স্রোত বয়ে গেল। আহামদ মুসা ভাবলেন, তার অনুমান সত্য হলে কু-ক্ল্যাক্স ক্লানের হাতেই তিনি বন্দী। বুঝতে চেষ্ট করলেন, কোথায় এখন তিনি? চার পাশের প্রহরীদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, এরা ফিলিপিনো আর্মির সদস্য। স্থানটা কি জাম্বুয়াংগো হবে? ভাবলেন আহমদ মুসা। জাম্বুয়াংগোর কথা মনে আসতেই ব্যথায় চিন চিন করে উঠল মনটা। শিরীকে তিনি মুক্ত করতে এসে নিজেই এখন বন্দী। মনটা তাঁর খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল অবস্থার নাজুকতায়। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর কন্ঠে নিঃশব্দে উচ্চারিত হলো, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, আমি সব ব্যাপারে তাঁর ওপরই নির্ভর করছি।
গভীর প্রশান্তি নেমে এল আহমদ মুসার মনে। গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। আর কোন বন্দী যখন তার পাশে উঠল না আহমদ মুসা ধরে নিলেন বন্দী তিনি একাই। সাথীরা কি তাহলে সরে যেতে পেরেছে? অথবা তারা সবাই …..। আর ভাবতে পারেন না আহমদ মুসা। এক অবরুদ্ধ উচ্ছাস যেন তাঁর বুকটা ভেংগে দিতে চাইল।
বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল আহমদ মুসার। একটা ঝাঁকুনিতে সন্বিত ফিরে পেলেন। দেখলেন, তাকে একটা স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে। দু’জন সৈনিক স্ট্রেচারটি আর্মি ইনটেলিজেন্স হেডকোয়াটার্সের প্রশস্ত এবং অন্ধকার একটা ঘরে নিয়ে রাখল। দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবার সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এলঃ ডঃ কর্নেল ফ্রেসারকে নিয়ে এস, উনি একে দেখবেন।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর কোন কথা কানে এল না।
কণ্ঠটা আহমদ মুসার পরিচিত। স্মার্থার কণ্ঠ। সারা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার। তাহলে শিরীও এখানেই বন্দী? অজান্তেই হাত দুটি তার মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। ভাবনার গভীরে চলে গেল তাঁর মন।
লুকমান রশিদ, এহসান সাবরীরা কি জানতে পেরেছে সব। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোর পর ওদের সর্বশেষ আশ্রয় জাম্বুয়াংগো। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোতে যেমন করে আল্লাহর সাহায্য পিসিডা অঝোর ধারায় পেয়েছে, সে সাহায্য কি তারা জাম্বুয়াংগোতেও পাবে না? সব নির্ভরতা আমাদের তার ওপর! চোখ দু’টি তাঁর গভীর প্রশান্তিতে মুদে এল।
সশব্দে সেই দরজাটি খুলে গেল আবার। সুইচ টেপার শব্দও শোনা গেল সেই সাথে। আলোতে ভরে গেল ঘরটা। প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসার পরিস্কার মনে হলো, ঘরটা গোয়েন্দা দপ্তরের একটা অপারেশন রুম। পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকে একটি করে দরজা ও ছোট জানালা।
পশ্চিমের খোলা দরজায় দু’জন প্রহরী। হাতে সাব মেসিনগান।
দরজা দিয়ে দু’জন ঘরে ঢুকল। একজনকে মনে হল ডাক্তার। আরেকজন দীর্ঘাকৃতি, পেটা শরীর, চোখের দৃষ্টি তীব্র। ছোট করে ছাটা চুল। দু’হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো। লোকটি আহমদ মুসার পরিচিত নয়। তবে মনে হয় বড় কর্মকর্তাদের একজন।
লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কেমন বোধ করছেন আহমদ মুসা?
আহমদ মুসা কোন জবাব দিলেন না। হাল্কাভাবে উড়ে আসা এ বিদ্রুপবাণের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজনও ছিল না। আহমদ মুসা তাঁর দৃষ্টি স্থিরভাবে লোকটির দিকে তুলে ধরলেন শুধু।
লোকটি আবার মুখ খুলল। বলল, আমি জনপল, আমাকে চিনতে পারেন?
আপনি জনপল, তবে পোপ নন। কিন্তু পোপের চেয়ে বড়।
আপনি আমাদের পোপকে অসম্মান করলেন – বলল জনপল।
আমি বরং পোপকে সম্মান করেছি জনপল, বলল আহমদ মূসা ।
কেমন করে ?
পোপ স্বয়ং যা করছেন না, করতে বলছেন না, ততটা পর্যন্ত করে আপনারা খৃস্টধর্মকে কলংকিত করছেন, একথা বলে আমি পোপকে সম্মানই করছি।
আপনার ইংগিত কোন দিকে আহমদ মুসা?
আমি কি বলতে চাই কু-ক্ল্যাক্স-ক্লানের পূর্বাঞ্চালীয় বর্তমান প্রধান জনপল অবশ্যই বুঝেছেন।
ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে উঠল জনপলের। বলল সে, আপনি কোথায় আছেন তা বোধহয় ভুলে গেছেন আহমদ মুসা।
না ভুলে যাইনি। কিন্তু শ্বেতাংগ খৃস্টানরা তাদের ধর্ম ও বর্ণ স্বার্থের জন্যে যে শ্বেত সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে আমি তার বিরুদ্ধে।
আমরা তা জানি আহমদ মুসা। জানি বলেই আপনি এখানে এসেছেন। একটু থামল জনপল। বোধহয় একটা ঢোক গিললো। শুরু করলো আবার, বিরুদ্ধে বলেই সেদিন কাগায়ানে হত্যা করলেন আমাদের নেতা মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে, এ পর্যন্ত হত্যা করেছেন আমাদের হাজার হাজার কর্মীকে এবং আমাদের অস্তিত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের রেডিয়েশন বোমা আপনারা কুক্ষিগত করেছেন।
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল জনপল। একটু থেমে বলল, সে বিচারে আমরা পরে আসব। তারপর ডাক্তারের দিকে ফিরে জনপল বলল, ডঃ ফ্রেসার, আপনার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে আপনি আসুন।
গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জনপল। ডাক্তার এগিয়ে এল আহত আহমদ মুসার দিকে। হাতে তাঁর ছুরি, কাঁচি, তুলা, ঔষধ।
আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে বললেন, ধন্যবাদ ডাক্তার, আসুন। মানবতাবোধ একেবারে মরেনি তাহলে? স্মার্থাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

সেই হল ঘর। একটা দীর্ঘ ও প্রশস্ত তক্তপোষের সাথে নাইলনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আহমদ মুসার দেহ। তাঁর সামনে এক চেয়ারে বসা জনপল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। তার কপালে বিন্দ বিন্দু ঘাম। সে বলছিল, আমি জানি, আপনি সোজাভাবে কথা বলবেন না। কথা বলাবার যন্ত্রও আমাদের আছে। পাশেই বিদ্যুৎ আসন, দেখুন ছোবল দেয়ার জন্য কেমন হা করে আছে। ঐ পথে যেতে আমাদের বাধ্য করবেন না। শুধু আমাদের বলুন, রেডিয়েশন বোমাগুলো কোথায় রেখেছেন? এটা আমাদের জানালে আর কোন প্রশ্নই আমরা আপানাকে জিজ্ঞেস করব না।
আহমদ মুসা বললেন, তোমাদের এ বিদ্যুৎ আসনকে আমি চিনি। এর ভয় দেখিয়ে রেডিয়েশন বোমার কোন খবর আমার কাছ থেকে পাবে না। নিজে বাঁচার জন্য লাখো মানুষকে মারার অস্ত্র আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।
থামুন আহমদ মুসা। বাঘের মত গর্জন করে উঠল জনপল। উঠে দাঁড়াল সে। হাত দু’টি তার মুষ্টিবদ্ধ, চোয়াল দুটি মনে হচ্ছে পাথরের মত শক্ত। চোখে আগুন। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে সে। এক সময় সে হো হো করে হেসে উঠল। হাসিটা মনে হলো চাবুকের চেয়েও তীক্ষ্ণ।
সে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, তাহলে কথা বলবেন না, আহমদ মুসা? রেডিয়েশন বোমার কোন খবর তাহলে দেবেন না আমাদের? একটু থেমে বলল, জানেন আপনার শিরীও এখানে বন্দী আছে?
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, জনপল?
কি বলতে চাই দেখাচিছ। বলে হাতে দু’টো তালি দিল সে। সংগে সংগে দু’জন প্রহরী সামনে এসে দাঁড়াল। জনপল তাদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা শিরীকে নিয়ে এস।
অল্পক্ষণ পরে শিরীকে নিয়ে দু’জন প্রহরী ঘরে ঢুকল। শিরীর পরনে মরো রাজকুমারীর সেই পোষাকই রয়েছে। মলিন চেহারা। চোখ দু’টি লাল, ফোলা। কেঁদেছে অবিরাম।
আহমদ মুসাকে ঐভাবে দেখে দু’হাতে মুখ ঢাকল শিরী। টলতে লাগল তার দেহ। বসে পড়ল সে।
জনপল আবার আহমদ মুসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আহমদ মুসা, মরো রাজকুমারীর দিকে চেয়ে দেখ। এই মেয়েটি আপনার কি আমরা জানি। এখন বলুন এই মেয়েটিকে দুনিয়ার জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে আপনার জেদ ঠিক রাখবেন না এ মেয়েটিকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে রেডিয়েশন বোমার খবর দেবেন?
কেঁপে উঠল আহমদ মুসার গোটা দেহ এক অজানা আশঙ্কায়। বললেন আহমদ মুসা, তুমি কি বলতে চাও জনপল?
আমি বলতে চাই, আমি কথা শেষ করার পর এক মিনিট অপেক্ষা করব। এর মধ্যে যদি আপনি আমাদের কথায় সম্মত না হন, তাহলে এক মানুষ গেরিলার হাতে এই মরো রাজকুমারীকে তুলে দেব। আপনার চোখের সামনে সে নির্দয়ভাবে লুন্ঠন করবে মরো রাজকুমারীকে। শত চাবুকের ঘা যেন এক সাথে জর জর করে তুলল আহমদ মুসার দেহকে। মগজের প্রতিটি তন্ত্রী, মনের প্রতিটি পরতে এবং স্নায়ুর প্রতিটি কোষে যেন আগুন ধরে গেল। আহমদ মুসার লৌহ হৃদয়ও থর থর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে মনটাকে স্থির করলো আহমদ মুসা। বলল, জনপল, যেটাকে আমার জেদ বলছ সেটা আমার জেদ নয়, আমার দায়িত্ব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল জনপল। বলল, ৩০ সেকেন্ড পার হয়েছে আহমদ মুসা, আর ৩০ সেকেন্ড বাকী।
আহমদ মুসা শিরীর দিকে তাকালেন। দেখল শিরী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট দু’টি কাঁপছে। কিন্তু চোখে অশ্রু নেই, তার জায়গায় দৃঢ়তার এক আলোক দীপ্তি। অপার্থিব যেন সেই নূর – আলো ।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, ভয়ে কোন মুসলিম কখনও আত্মসমর্পণ করেছে এমন নজীর ইসলামরে সোনালী ইতিহাসে নেই।
আহমদ মুসা বললেন, আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত নই, জনপল। একটু থেমে বললেন আবার, আমি এবং শিরী- আমার, তোমার এবং সকলের রব যিনি সেই আল্লাহর ওপরই নির্ভর করছি।

কি ভয়াভহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন আহমদ মুসা এখনই টের পাবেন। বলে জনপল আবার হাতে তালি বাজাল। ঘরে ঢুকল সেই প্রহরী দু’জন।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top