৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

তাসখন্দে তখন সন্ধ্যা নামছে। একটা সোফায় হেলান দিয়ে একটা পার্টি বুলেটিনে নজর বুলাচ্ছিল উমর জামিলভ। বয়স ৩০ বছরের বেশি হবে না। খাস উজবেক চেহারা। যৌবনের দীপ্তি ঠিকরে পড়ছে চেহারা থেকে। উজবেকিস্তানে ‘রিও’-এর অভ্যন্তর বিভাগের প্রধান। বয়স অনুসারে উন্নতি অনেক। বোধ হয় তার ভাল রেকর্ডই এর কারণ। উমর জামিলব কম্যুনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য ছিল।
নেমে আসা অন্ধকার বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা করে দিচ্ছিল। বই বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, সূর্য ডুবে গেছে।
তাড়াতাড়ি সে উঠে দাঁড়াল। এনগেজমেন্ট আছে, তাকে বাইরে যেতে হবে, তার আগে দাদীর কাছে যেতে হবে। অনেকক্ষণ ডেকে পাঠিয়েছেন।
সিড়ি ভেঙে দু’তলায় উঠে গেল সে। একদম দক্ষিণের ঘরে থাকেন তার দাদী। নিরুপদ্রপ নিরিবিলি একটি ঘর। দরজায় একটু দাঁড়াল জামিলভ। তারপর ধীরে ধীরে নক করল। কোন সাড়া নেই। দরজার হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল সে। তখনও আলো জ্বালা হয়নি ঘরে। আলোর সুইচটা টিপে দিল জামিলভ। ঘর ভরে গেল আলোতে। দেখল, ঘরের ডান পাশে পরিচিত সেই জায়গায় দাদী নামায পড়ছেন। সিজদায় ছিলেন, উঠে বসলেন। আজও লক্ষ্য করল জামিলভ, জায়নামাযটি বড্ড ছেঁড়া। জামিলভ যদিও এসব কাজ একান্তই অনর্থক মনে করে, তবু এই সেদিন সে দাদীকে বলেছে, তুমি অনুমতি দিলে একটি নতুন জায়নামায আমি এনে দেব। কিন্তু দাদী বলেছেন মক্কা শরীফ থেকে আনা এ জায়নামায তিনি ছাড়বেন না। আরও একটা শক্ত কথা দাদী সেদিন বলেছেন, তোর টাকার জায়নামাযে কি নামায হবে? দাদীর এই শক্ত কথাটা তার কোথায় যেন আঘাত করেছিল। মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সে। তারপর একটু ঢোক গিলে মুখে একটু হাসি টেনে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার টাকার দোষ কোথায়, দাদী?
দাদী চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। শুধু তাকিয়েই ছিলেন জবাব দেননি। মনে হয়েছিল তার চোখ দু’টি ভারি। স্নেহময়ী এ দাদীকে সে ছোটবেলা থেকে জানে। কিন্তু এই অতি পরিচিত দাদীর সেই দৃষ্টির সামনে সে সেদিন খুবই সংকোচ বোধ করেছে। আর কোন কথা জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয়নি।
দাদী আবার সিজদায় গেছেন। কোন কিছুর প্রতিই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। জামিলভ দেখে আসছে, নামাযের সময় দাদী অন্য মানুষ হয়ে যান। কম্যুনিজমের কট্টর ছাত্র জামিলভের মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, এটাই সেই ওপিয়াম যার কথা মার্কস বলেছে। কিন্তু একটা কথা সে বুঝতে পারেনি, অশরীরি এই ওপিয়ামের এত শক্তির উৎস কোথায়।
জামিলভ গিয়ে দাদীর খাটে বসল। পাশেই টেবিল। টেবিলের ওপরে দেয়ালে একটা কাঠের তাক। সেই তাকে দাদীর পুরানো পুস্তক, যাকে দাদী কুরআন শরীফ বলেন দাদীর নামায তখনও শেষ হয়নি। কুরআন শরীফ তাক থেকে তুলে নিল জামিলভ। অনেক পুরানো বাধাই খসে গেছে। পাতাগুলো খুব কষ্ট করেই গুছিয়ে রাখা হয়েছে তা বুঝাই যায়। আরবী ভাষায় কুরআন শরীফ। কিছু কিছু সে এখনও পড়তে পারে। মনে পড়ে ছোট বেলায় দাদীই তাকে আরবী শেখাতেন গোপনে গোপনে। কারণ এটা আববা পছন্দ করতেন না। আববা তখন তাসখন্দের পার্টি বস, তার বাড়ীতে এসব হয় তা প্রকাশ পেলে পার্টির শুধু পদ নয়, মেম্বার শিপও তার থাকবে না।
দাদী তার রুমে কুরআন শরীফ লুকিয়ে রাখতেন। সুযোগ পেলে পড়তেন, আর নাতিকে সুযোগমত কাছে পেলেই তালিম দিতে চেষ্টা করতেন। জামিলভ সেই পুরানো অভ্যাসটা একটু ঝালাই করতে কসরত শুরু করল। এমন সময় দাদীর গলা শুনা গেল, আহা, জামিল কি করছিস! বলে বয়সের ভারে ন্যুজ্ব দাদী উঠে এলেন। বললেন, তুই তো অজু করিস না, বিনা অজুতে আল্লাহর কালাম ধরে নারে
দাদী জামিলভের হাত থেকে কুরআন শরীফটি নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, পড়বি তো যা অজু করে আয়।
তুমি কিছু মনে করো না দাদী, নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। একটু মুচকি হেসে বলল জামিলভ।
সময়ের নষ্ট যে এটা নয় তা যদি তুই বুঝতিস রে।
আমি বুঝি দাদী।
কতটুকু ঝুঝিস তুই? বলতে পারিস তোর হাতের ছোট বড় পাঁচ আঙুলের যে বৈজ্ঞানিক বিন্যাস তা কবে কোন প্রকৌশলী করেছেন?
জানি, তুমি এখন আল্লাহর কথা বলবে। স্বয়ংক্রিয় এ সৃষ্টি রীতিতে আল্লাহর কি কোন প্রয়োজন আছে দাদী?
বেশী বুদ্ধিমান মনে করলে সে নাকি মুর্খ হয়ে যায়। তোরা তাই হয়েছিস। বলত দেখি, তোদের স্বয়ংক্রিয় কম্পুটারের কি কোন স্রষ্টা আছে?
জামিলভ হেসে উঠল। বলল, তর্কে তোমার সাথে পারব না দাদী। তার চেয়ে তোমার কাছে আমার একটি প্রস্তাব তোমার কুরআন তো একদমই খসে গেছে। বলত, অমি বাধাই করে এনে দিই।
কে বাঁধাই করবে?
কেন বাঁধাই-এর তো দোকান অছে।
তোমাদের বে-অজুদার বে-ঈমানাদার বাঁধাইকারদের হাতে আমি কুরআন শরীফ দেব না। কুরআন আমার এভাবেই থাক।
তোমার তো অসুবিধা হয় এতে। দাদী কোন উত্তর দিলেন না। একটু চুপ থাকলেন, মনে হয় মুহুর্ত ভাবলেন। তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কুরআন এবং মুসলিম জাতি ভিন্ন নয়রে। তোরা আমাদের মুসলিম জাতিকে ঐ কুরআন শরীফের মত ছিন্ন ভিন্ন করেছিস বলেই আজ কুরআন শরীফের এই অবস্থা।
জামিলভ সহসা কোন উত্তর দিতে পারল না। চিরাচরিতভাবে হেসে পরিবেশেটার মোড় পরিবর্তনের কোন শক্তি তার যোগাল না। দাদীর কথাটা বুকের কোথায় গিয়ে যেন আঘাত করেছে। কয়েকটা ঢোক গিলে সে বলল, দাদী, আমি তোমার নাতি। তুমি আমাকে আলাদা মনে করছ কেন?
দাদী কোন কথা বললেননা। ধীরে ধীরে উঠে এলেন চেয়ার থেকে। জামিলভের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, জামিল, আমি মুসলিম, কিন্তু তোরা আমার এ সমাজকে ধ্বংস করিসনি, ধ্বংস করছিস না? তোর বাপ ছিল তাসখন্দের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান। তুই বিশ্ব রেড গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফ্র’-এর একজন কর্মকর্তা। তোরা তো জানিস, কত লক্ষ মানুষের আহাজারি এই বাতাসে।
দাদী, এটা তো রাজনৈতিক প্রশ্ন। তোমার অস্বীকার করা উচিত নয়, ধর্ম শোষনের শিখন্ডী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এখানেই তোদের ভুল। ইসলামকে তোরা জানিস না। ইসলাম শোষণ করায় না; ইসলামের অভাবেই শোষণ হয়। তুই ভালো করে শুনে রাখ, ইসলাম তো তোদের মত রাজনীতি করে না, কিন্তু তোদের রাজনীতি যখন ইসলাম করে তখনই সব সমস্যার সমাধান, সব শোষণের অবসান ঘটে। তুই এত ইতিহাস পড়িস, ইসলামী খিলাফতের ইতিহাস একবার পড় না?
উমর জামিলভ দাদীর সামনে অস্বস্তি বোধ করছিল। এ প্রশ্নগুলোর জবাব তার কাছে নেই। দাদীর এসব প্রশ্নের কোন জবাব কোন দিনই সে দিতে পারেনি। কথার মোড়টা ঘুরিয়ে নেবার জন্য সে বলল, এসব কথা থাক দাদী, তুমি কি জন্য ডেকেছ তাই বল।
বলব?
বল।
আমি শাহ-ই-যিন্দে যেতে চাই। তুই আমাকে সেখানে নিয়ে যাবি।
হঠাৎ কোন উত্তর যোগাল না জামিলভের মুখে। ‘শাহ-ই-যিন্দে’ সমরখন্দের একটি প্রাচীন স্মৃতি সৌধ যা এখনও টিকে আছে। বলা হয় মহানবীর (স.) খালাত ভাই কুসুম বিন আব্বাসের কবরগাহের ওপর এই স্মৃতি সৌধটি নির্মিত। আরও বলা হয়ে থাকে উজবেক অঞ্চলে ইসলামের বাণী তিনিই বহন করে আনেন। এই স্মৃতি সৌধ জিয়ারত করার প্রতি মধ্যে এশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে একটি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ আছে। কম্যুনিস্ট সরকার একে সুনজরে দেখে না। যারা ওখানে যায় ‘ফ্র’-এর গোপন তালিকায় তারা ব্যাধিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত। তাদের প্রতি নজর রাখা হয়। জামিলভ তার দাদীকে ওখানে নিয়ে যাবে, ব্যাপারটা তার জন্য বড়ই অস্বস্তিকর। কিন্তু দাদীর এই আবেদন সে ফিরিয়ে দেয় কি করে?
জামিলভ কথা বলছে না দেখে দাদী বলল, জানি তুই খুব ব্যস্ত, কিন্তু রোকইয়েভা নেই। থাকলে তোকে বলতাম না।
রোকাইয়েভা জামিলভের ছোট বোন। পদার্থ বিজ্ঞানে মস্কোতে সে উচ্চতর ডিগ্রী নিচ্ছে। একজন যুবনেত্রী সে।
রোকাইয়েভার কথা বলতেই জামিলভের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, দাদী রোকাইয়েভা দু’একদিনের মধ্যে আসছে জানিয়েছে।
দাদী ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলল, তাহলে বেঁচে গেলি, কেমন।
না বাঁচিনি দাদী, শাহ-ই-যিন্দে তুমি তো যাচ্ছই। ঠোঁটের কোণায় হাসি টেনে কথাটা বলল জমিল।
এর অর্থ, আমি না গেলে তুই বেঁচে যাস?
দাদী, আমাদের কম্যুনিস্ট সমাজ ব্যবস্থায় শাহ-ই-যিন্দ শুধু অর্থহীন নয়, মানুষের জন্য ক্ষতিকরও।
ঠিকই বলেছিস, কম্যুনিস্ট সমাজ ব্যবস্থার জন্য অর্থহীন ও ক্ষতিকরই এটা, কিন্তু আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় ও উপকারী।
কিছু মেন করো না দাদী, ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই পুরাতনকে ধরে রেখে আর কি কোন লাভ আছে?
কাকে তুই ধ্বংস বলছিস জামিল, ইসলামকে? তোদের এ ধারণা ভুল। তোরা ইসলামকেও জানিস না, ইতিহাসও পড়িসনি।
থামলেন দাদী। তার দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে বাইরে। তিনি যেন হারিয়ে গেছেন আপনার মধ্যে। দাদীর এরূপ জামিলভের খুবই ভাল লাগে।
দাদী আবার মুখ খুললেন। বললেন, তোদেরই পুর্ব পুরুষ হালাকু-চেঙ্গিস বাগদাদ ধ্বংস করে এবং মুসলিম নর-মুন্ড দিয়ে পাহাড় সাজিয়ে ভেবেছিল ইসলামকে তারা শেষ করেছে। মুসলিম পুরুষদের হত্যা করে তাদের নারীদের জয় করে এনেছিল তোদের পূর্ব পুরুষরা। কিন্তু ধ্বংসের ছাই থেকে আবার জীবনের চারাগাছ গজাল। মাত্র কয়েক যুগের মধ্যেই গোটা মধ্য এশিয়া ইসলাম জয় করে নিল ঐ দুর্বল ও অবলা নারীদের দ্বারাই। তোর, আমার যিনি স্রষ্টা তাঁরই দেয়া জীবন ব্যবস্থা হলো ইসলাম। এ শেষ হয় না, শেষ করা যায় না একে। জামিল তোকে জিজ্ঞেস করি, এই তাসখন্দে এক তিল্লা শেখ মসজিদ ছাড়া সব মসজিদই তোরা একদিন শেষ করে দিয়েছিলি, আজকের খবর কি বলত?
দাদী চুপ করলেন। বিস্মিত জামিলভ দাদীর দিকে তাকিয়েছিল। তার দাদী এত ইতিহাস জানেন, নিষিদ্ধ এই ইতিহাস কোথায় পান তিনি। আর যুক্তিকে এমন অখন্ডনীয় করে পেশ করতে পারেন তার দাদী। দাদীর শেষ জিজ্ঞাসাটা তার কানে বাজছে! কি উত্তর দেবে সে? এই তাসখন্দ শহরে এক তিল্লা শেখ মসজিদ ছাড়া অন্য সবগুলোই শেষ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা শেষ হয়ে যায়নি। ছোট বড় মিলে ইতোমধ্যেই দু’শতাধিক মসজিদকে জনমতের চাপে বাধ্য হয়েই অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরও গোপন মসজিদ তো রয়েছেই।
দাদীর আবার কথা বললেন, জানি জবাব দিতে পারবি না। শোন জামিল, প্রবল এক স্রোতে তোরা গা ভাসিয়ে দিয়েছিস, কিন্তু এ স্রোত তোদের এক অকুল সাগরে নিয়ে ফেলবে, মুক্তির ডাঙ্গা কোনদিনই খুঁজে পাবি না। মুক্তি পেতে চাইলে স্রোতের মুকাবিলা করে নিজস্ব পথ রচনা করতে হবে।
দাদীর কথাগুলো জামিলভকে তীরের মত বিদ্ধ করল। চমকে উঠল জামিলভ। এতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা! তার দাদীর মধ্যে বিদ্রোহের একি আগ্নেয়গিরি! দাদীর এ রূপের কাছে নিজেকে খুবই ছোট, খুবই দুর্বল মনে হলো। ভয়ও জাগল মনে, এই আগ্নেয়গিরির বিস্তার কতখানি? মনে হল, বয়সের ভারে কাহিল তার দাদীর মধ্যে এই যে আগুন তা যেন গোটা দেশে উত্তাল তরঙ্গে ঝলকাচ্ছে। সবুজ তরমুজের মত সমাজের দৃশ্যমান পর্দাটা ফাঁক করলেই যেন ভেতরের সেই লাল সমুদ্র দেখা যায়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল জামিলভ। বলল, দাদী আমি এখন যাব এক জায়গায়।
বেরিয়ে এল জমিলভ। দাদীর কাছে এখন তাকে পলাতক মনে হচ্ছে। স্নেহময়ী দাদীকে ভালবাসত, সম্মান করতো, আজ তার সাথে মনে হচ্ছে ভয়ও যোগ হল।

তাসখন্দে ‘ফ্র’-এর সিকিউরিটি প্রিজন। রাজনৈতিক বিভাগের একটি সেল। তখন সকাল আটটা। ব্যয়াম সেরে শুয়ে পড়েছিল হাসান তারিক। ভোরে ফজরের পর সে মিনিট তিরিশ কুরআন তিলাওয়াত করে। কুরআন শরীফ পাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। সে মুখস্থই তিলাওয়াত করে। তারপর ঘন্টা দেড়েক ব্যায়াম করে। ব্যায়ামের পরে পাওয়া যায় নাস্তা। নাস্তা সেরে হাসান তারিক চলে যায় প্রিজন লাইব্রেরীতে। ‘ফ্র’ তাকে লাইব্রেরীতে সময় কাটাবার সুযোগ দেয়ায় সে কৃতজ্ঞ। অবশ্য এ সুযোগ তাকে কেন দেয়া হয়েছে সে জানে। লাইব্রেরীর যে বিশেষ বিভাগে সে যেতে পারে, সে বিভাগ পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। মার্কস, এ্যাংগেলস, লেনিন এবং সমসাময়িক কম্যুনিস্ট সাহিত্যের সব বই সেখানে পাওয়া যায়। ইতিহাসের ওপর রয়েছে বিপুল বই। মানুষের ইতিহাস, দেশ ও জাতি সমূহের ওপর গ্রন্থ রয়েছে সেখানে প্রচুর। আর রয়েছে পর্ণ ম্যাগাজিনের স্ত্তপ। সব কিছুই কম্যুনিস্ট নিয়মে লেখা। মানুষের মগজ ও চরিত্র ধোলাইয়ের লক্ষ্য নিয়েই লাইব্রেরী সাজানো। লাইব্রেরীর পরিবেশ একেবারেই নিরিবিলি। এক পাঠকের সাথে অন্য পাঠকের দেখা না হয়, এই পাকা ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। এ পর্যন্ত লাইব্রেরীতে কারো দেখা পায়নি হাসান তারিক। শুরু থেকে লাইব্রেরীতে একজনেরই দেখা সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য পেয়েছে। সে হলো মিস আয়িশা আলিয়েভা। বয়স বাইশ-তেইশ। সুন্দরী ও অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। মস্কো ইউনিভার্সিটির একজন সেরা ছাত্রী, গোল্ড মেডেলিস্ট। মার্কসীয় তত্ব নিয়ে, পৃথিবী ও মানুষের ইতিহাস নিয়ে তার সাথে দিনের পর দিন আলোচনা হয়েছে। কোন জটিল জিনিসও অদ্ভুত দ্রুত সে হৃদয়ংগম করতে পারে, আর তা প্রকাশ করার মধ্যেও তার এক শৈল্পিক নৈপুণ্য রয়েছে। প্রথমদিকে তাকে লাইব্রেরী পরিচালনার একজন দায়িত্বশীল মনে করেছিল হাসান তারিক, কিন্তু পরে তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে, সে গোয়েন্দা বিভাগের লোক।
একটু ঝিমুনি এসেছিল হাসান তারিকের। দরজানয় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে বসল। দরজা খুলে দেখল ভীমকায় ভিকটর দরজায় দাড়িয়ে নাস্তা নিয়ে। সাত ফিট দৈর্ঘ্যের বিশাল বপু ভিকটরকে দেখলে প্রথম দিকে তার কৌতুক বোধ হতো। কিন্তু তার ঐ ভীম দেহের মধ্যে যে একটা নরম দিল আছে তার পরিচয় পেয়ে সে অবাক হয়ে গেছে। এ পরিচয়টা একদিন এভাবে মেলে।
হাসান তারিক সকালের নাস্তা হিসাবে পায় বেশ কয়েকটা রুটি, মাখন ও ফল-মূল যার অর্ধেকটাই সে খেত না। ক’দিন এটা দেখে একদিন সে ফিসিফিস করে হাসান তারিককে বলল, স্যার, আপনি তো অর্ধেকটাও খান না। একটা অংশ কি আমি আপনার পাশের কয়েদীকে দিতে পারি? বেচারা একটা রুটি ছাড়া আর কিছু পায় না।
কিন্তু, এটা বেআইনী হবে না? প্রশ্ন করল হাসান তারিক।
হবে, কিন্তু আপনি রাজি থাকলে কেউ টের পাবে না। চারিদিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে কথা ক’টি বলল ভিকটর।
অপরাধী আসামির প্রতি তোমার এ দরদ কেন ভিকটর? আরেকটা খোঁচা দিল সে ভিকটরকে।
সে কাঁচু মাচু হয়ে নরম কন্ঠে বলল, ও চোর, ডাকাত নয় স্যার।
তাহলে কি?
দাগি বিদ্রোহী?
কিসের বিদ্রোহী?
‘ফ্র’-এর রেড সরকারের বিপক্ষে, তুর্কি জাতির পক্ষে।
ভিকটরের কথা শোনার সাথে সাথে হাসান তারিকের শরীরে একটি উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। বলল, ওর নাম কি?
আজিমভ।
হাসান তারিক কিছুক্ষণ অপলকভাবে ভিকটরের দিকে চেয়ে রইল। কে এই ভিকটর? সে জিজ্ঞেস করল, তুমিও কি মুসলমান?
না, ল্যাটিভিয়ান। আমার জাতিও এখানকার তুর্কিদের মতই দুঃখী।
হাসান তারিক আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি ভিকটরকে। আর জিজ্ঞেস করারও কিছু ছিল না। শেষের একটা কথায় সে সব বলে দিয়েছে। সেদিন থেকে ভিকটর তারিকের কাছে অন্য মানুষ- একটি বন্দী মানবাত্মা রক্তের অশ্রু ঝরছে যার অন্তর থেকে অবিরাম। আর সেদিন থেকে তারিকের নাস্তা আর খানার অর্ধেক যেত আজিমভের কাছে।
লোহার পাতের দরজার পর মোটা লোহার শিকের তৈরী দ্বিতীয় আরেকটা দরজা। এ দরজার ছোট্ট জানালা দিয়ে খাবার নিতে হয়। প্রতি দিনের মত সেদিন সে জানালা দিয়ে নাস্তা নিল। হাসান তারিক দেখল আগের মতই সেই পুরো নাস্তা। ভিকটরকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার আজিমভকে দাওনি?
না স্যার, আজিমভ নেই। মুখটি ভারী ভিকটরের।
কোথায়?
ফায়ারিং স্কোয়াডে। গত রাত চারটায়। শুনলাম সব দোষ নাকি সে স্বীকার করেছে।

কথা শেষ করে একটা কাষ্ঠ হসি হাসল ভিকটর। বড় একটা খোঁচা লাগল হাসান তারিকের মনে। নাস্তা ধরা হাতটা কেঁপে উঠল। বুক থেকে উঠে আসা একটা ঢেউ যেন গলায় এসে ভেঙে পড়তে চাইল।
হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, চিন তুমি আজিমভকে ভিকটর?
না। এটুকু জানি, ‘ফ্র’-এর রেড আর্মির একজন রিটায়ার্ড মেজর সে। আফগান যুদ্ধ থেকে আসার পর সে বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়েছে।
অর্ধেকটা নাস্তা ভিকটরকে ফেরত দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে হাসান তারিক বলল, এগুলো খাব না, তুমি নিয়ে যাও।
না খেলে থাকবে স্যার, পরে নিয়ে যাব। আগাম ফেরত নেবার আইন নেই।
কাউকে দাও।
মাথা নিচু করে মুহুর্ত চিন্তা করে বলল, কাল থেকে দেখব স্যার। আজ থাক। তারপর একটু থেমে বলল, দেখে দেখে বুকটা পাথর হয়ে গেছে স্যার। প্রতি মাসে দশ বারটা ফায়ারিং স্কোয়াডে যায়।
ওরা কারা? জিজ্ঞেস করল হাসান তারিক।
চোর ডাকাতের কারাগার এটা নয়। সবাই ওরা বিদ্রোহী।
কি ধরনের লোক ওরা, ভিকটর?
সবাই নামী-দামী। হয় আমলা না হয় পার্টির, অথবা সেনা বা পুলিশের হোমরা-চোমরা ধরনের কেউ। কৃষক ও মোল্লা বিদ্রোহীদের কোন বিচারের প্রয়োজন হয় না। ওরা আকস্মাৎ একদিন হারিয়ে যায়।
একটা হুইসেলের শব্দ পাওয়া গেল। ভিকটর বলল, সুপার ভিজিটে বেরিয়েছে, যাই স্যার। বলে নাস্তার ট্রলি ঠেলে নিয়ে চলে গেল ভিকটর।
নাস্তা সেরে আজ তাড়াতাড়িই লাইব্রেরীতে চলে এল হাসান তারিক। মনটা তার ভাল নেই। আজিমভের কথা ভুলতে পারছে না সে। লোকটিকে সে দেখেনি কিন্তু না দেখলে কি হবে, ভাইকে তো দেখার প্রয়োজন হয় না।
লাইব্রেরীর গেটে পৌঁছতে গেট সিকিউরিটি রুটিন মাফিক লাইব্রেরী কার্ড চেক করে হাসান তারিককে তার নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছে দিল। একমাত্র আলিয়েভার কক্ষ ছাড়া অন্য কোন কক্ষে যাবার অনুমিত তার নেই। নিয়ম হলো, বইয়ের ক্যাটালগ দেখে যে বই সে চাইবে সে বই তাকে এনে দেয়া হবে। আলিয়েভার কক্ষ পাশেই। কোন বইয়ের প্রয়োজন হলে তবেই সে আলিয়েভার কক্ষে যায়, তাছাড়া আলিয়েভাই তার কক্ষে আসে। খোঁজ খবর নেয়, কথাবার্তা বলে। প্রথম দিকে বাইরের কোন খবরই তার কাছ থেকে পাওয়া যেত না। কিন্তু পরে সে কিছু কিছু করে বলত-মিন্দানাওয়ে ইসলামের অভ্যূন্থানের খবর সে তার কাছ থেকেই পায়। মনে হয়েছিল খবরটায় যেন আয়িশা অলিয়েভাও খুশী হয়েছে। হাসান তারিক চট করে জিজ্ঞেস করেছিল আপনাকে তো খুশী মনে হচ্ছে।

জবাব দেয়নি আয়িশা আলিয়েভা। মুখটা তার গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য সে বলেছিল, আপনি আনন্দিত হয়েছেন তাই আমার আনন্দ।
তাই না কি? আলিয়েভার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছিল হাসান তারিক।
কেন নয়?
আয়িশা আলিয়েভাকে এতটা নীচে নামিয়ে আমি কল্পনা করতে চাই না।
কয়েকটা মুহূর্ত নিস্পলক চোখে তাকিয়েছিল আলিয়েভা হাসান তারিকের দিকে। পরে নিজের চোখটা বন্ধ করে স্বগতঃই যেন বলেছিল, সুপারম্যানরা সবাইকে সুপারম্যানই ভাবে, কিন্তু সেটা ঠিক নয়।
কিন্তু মিস আয়িশা, নিজের যা পছন্দ অন্যের জন্য তা পছন্দ করাই ইসলামের শিক্ষা।
আবারও মুহূর্তকাল চুপ থাকল আয়িশা আলিয়েভা। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আপনার সাক্ষাৎ না পেলে একথা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করি, এমন মানুষ হয়তো সম্ভব কিন্তু এমন মানুষের সমাজ কি সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়? কম্যুনিস্ট সমাজ কি একদিন সম্ভব ছিল?
হাসল আয়িশা আলিয়েভা। হঠাৎ টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল, এক্ষুনি আসছি। বলে সে বেরিয়ে গেল হাসান তারিকের ঘর থেকে। মিনিট খানেক পরেই আবার ঘরে ঢুকল। নিচু কন্ঠে বলল, দেখে এলাম কেউ আছে কিনা। তারপর টেবিলে বসে বলল, এবার আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। কম্যুনিস্ট সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য মানুষ নয়, অমানুষ প্রয়োজন যা আজকের সমাজে প্রচুর মিলে। কিন্তু আপনার সমাজ কায়েমের জন্য সুপারম্যান প্রয়োজন।
আয়িশা আলিয়েভা কথা শেষ করল। বিম্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাসান তারিক তার দিকে। একি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডালিস্ট সেই আয়িশা আলিয়েভা! হাসান তারিক বলল, কথাগুলো কি ঠিক ঠিক বললেন?
আলিয়েভার মুখে সেই হাসি। বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না? বিষয়টা খুব সোজা। কম্যুনিস্ট নীতিবোধ এবং মানুষ যুগ যুগান্ত ধরে যে নীতিবোধ গড়ে তুলেছে তা এক নয়। মানুষের নীতিবোধের দৃষ্টিতে কম্যুনিস্টরা অমানুষ। আগের কথা যেন একটু পাশ কাটাবার চেষ্টা করল আয়িশা আলিয়েভা।
ঠিক বলেছেন, তবে জগতে নীতিবোধ একটাই। কম্যুনিস্টদের যেটা সেটা বিচ্যুতি। মানুষের নীতিবোধের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে কম্যুনিস্টরা যে তাদের বাঞ্ছিত সমাজ পরিবর্তন ঘটানোর কথা চিন্তা করতে পারেনি ইতিহাসের কাছে কম্যুনিজমের এটাই সবচেয়ে বড় পরাজয়। তাদের আদর্শের অবাস্তবতারও এটাই বড় প্রমাণ। থামল হাসান তারিক। তারপর বলল, সুপারম্যান বলে কোন জিনিস নেই। যেমন জড়-জগৎ, যেমন পশুকুল, পাখিকুল, তেমনি মানুষই আপনার দৃষ্টিতে সুপারম্যান। এ সুপারম্যান তৈরী কঠিন নয়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং অবশ্যম্ভাবী যে পরকাল সে পরকালের জওয়াবদিহির সদা জারুক ভয়ই এ সুপারম্যান গড়তে পারে।
প্রথম দিকে আয়িশা আলিয়েভা পোষাক-আশাকেও ছিল আগুনের একটা নগ্ন স্ফুলিংগ। বাঁধ ভাঙা গতি ছিল সে স্ফুলিংগের। আর সম্মোহনী একটা আকর্ষণ ছিল তাতে। কিন্তু হাসান তারিক ছিল বরফের মত ঠান্ডা। সে ঠান্ডার সংস্পর্শে এসে আলিয়েভার সে সম্মোহনী আগুন একদিন নিভে গেল। হাসান তারিক আয়িশা আলিয়েভার সামনে তার চোখ সর্বদা নত করে রাখত। একদিন প্রশ্ন করল আলিয়েভা, আপনি মেয়েদের বড্ড ভয় করেন।
কেমন করে?
আপনি মেয়েদের দিকে তাকাতে ভয় পান।
না, মেয়েদের দিকে তাকাতে ভয় করি না, ভয় করি আল্লাহকে।
অর্থাৎ!
অর্থাৎ স্ত্রী এবং যাদের সাথে বিয়ে বৈধ নয় তাদের ছাড়া সবার ক্ষেত্রে চোখকে পর্দা করতে, দৃষ্টিকে সংযত রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে? আর আজকাল মাথাও গায়ের ওড়না মেয়েদের উঠে গেছে। একটি মুসলিম চোখ এ নগ্নতা দেখতে অভ্যস্ত নয়।
আলিয়েভা সেদিন আর কোন কথা বলতে পারেনি। এরপর থেকে তার পোষাকের পরিবর্তন ঘটল, আচরণেও। এইভাবে আলিয়েভা একজন বন্দী মানুষের ইচ্ছার কাছে অথবা তার মনের অবচেতন অংগনে জিইয়ে রাখা নীতিবোধের কাছে কম্যুনিস্ট নীতিবোধ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি।
হাসান তারিক অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে পড়ার টেবিলে। পড়ায় মন বসছে না। ভিকটরের দেয়া খবরের সবটা আজ তাকে সত্যিই বিচলিত করে তুলেছে। এখানকার মুসলমানরা কম্যুনিস্ট ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে মুক্তির জন্য এই যে জীবন দিচ্ছে, তার কিছুই বহির্বিশ্ব জানতে পারছে না। কত আজিমভ জীবন দিয়েছে, আরও কত আজিমভ জীবন দেবে কে জানে! এই ভাবনার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল হাসান তারিক।
‘কি ভাবছেন এত’- আলিয়েভার এই প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল সে। তাকিয়ে দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে আয়িশা আলিয়েভা। মাথায় সাদা রুমাল বাধা। সাদা উজবেকী গাউন- যা কোনদিন আর আলিয়েভা পরেনি। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই! মুখেও রংয়ের কোন কারুকাজ নেই- সেখানে এক শুভ্রতা। সব মিলিয়ে আলিয়েভো একখন্ড শুভ্র ফুল। হাসান তারিক বলল, বাঃ, এক নতুন পোষাকে আপনাকে দেখা গেল আলিয়েভা। কখন এসেছেন?
দরজায় দাঁড়িয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে আলিয়েভা তাকিয়েছিল হাসান তারিকের দিকে। চোখের দৃষ্টিতে এক গভীর বিষণ্ণতা। বলল, অনেকক্ষণ এসেছি, কি ভাবছিলেন এমন করে?
গলার স্বরটাও নতুন লাগল হাসান তারিকের কাছে। এমন নিস্তরঙ্গ কন্ঠ আয়িশা আলিয়েভার নয়। আলিয়েভার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসান তারিক বলল, তোমাকে মানে আপনাকে কেমন মনে হচ্ছে যেন আজ, আসুন…..।
হাসান তারিককে কথা শেষ করতে না দিয়ে আলিয়েভা বলল, আর ‘আপনি’ নয় ‘তুমি’।
গলাটা কেঁপে উঠল আলিয়েভার। তারপর বুকের কাছে গাউনের নিচ থেকে একটি খাম বের করে দ্রুত এগিয়ে এল হাসান তারিকের কাছে। খামটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটি রাখুন। আমি বিদায় নিতে এসেছি।
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে গেল। আলিয়েভার হাত থেকে চিঠি হাতে নিল হাসান তারিক। হাসান তারিক আবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল তার কি হয়েছে? কিন্তু দেখল, ফুলের পাঁপড়ির মত ঠোঁট দু’টি তার কি এক অব্যক্ত বেদনায় কাঁপছে। চোখ দু’টিতে তার আমুদরিয়া-শিরদরিয়ার সব পানি এসে যেন জমেছে। কোন কথাই সে বলতে পারছে না। মুহূর্তের জন্য চোখ বুঁজল হাসান তারিক। তারপর চোখ দু’টি নিচু রেখেই বলল, চিঠিতে কি আছে আমি জানি না। যখন চিঠি পড়ব, তখন আর তোমার কিছুই বলার সুযোগ হবে না।
একটু থামল হাসান তারিক। তারপর বলল, বড় দুঃখী আজ এই মধ্যে এশিয়ার মুসলমানরা। তুমি যা হও, যাই কর, ভুলে যেও না তুমি তাদেরই একজন। আমুদরিয়া শিরদরিয়ায় মুসলিম রক্তের যে স্রোত বইছে, ভুলে যেও না তা তোমারই স্বজনের।
শেষের কথাগুলো ভারী হয়ে উঠল হাসান তারিকের। চোখ তুলল, হাসান তারিক। দেখল, দুহাতে মুখ ঢেকেছে আলিয়েভা। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
হাসান তারিকের ইচ্ছে হলো বাইরে গিয়ে দেখে আসে আলিয়েভা কোথায়! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না আলিয়েভা এতক্ষণে হয়তো এ ভবনেই আর নেই।
আয়িশা আলিয়েভার দেওয়া খামটা তখনও হাতে। উল্টে-পাল্টে দেখল কোথাও কোন লেখা নেই, সাদা খাম। খামটি খোলা। চিঠি বের করে নিল খাম থেকে। চারভাঁজ করা চিঠি। খুলে পড়তে শুরু করল তারিক।

প্রিয় তারিক,
প্রিয় বলেই সম্বোধন করলাম। কারণ, আমার ফ্লাট, আমার অফিস আর আমি নিয়ে আমার যে ছোট্ট জগত সেখানে এই মুহূর্তে আপনার চেয়ে প্রিয় আর আমার কেউ নেই। আমি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী, সুন্দরীও। একদিন এজন্য আমার গর্বের অন্ত ছিল না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, এ দুটি জিনিসই আমার ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি।
আমার আব্বা মারা গেছেন আজ থেকে পনের বছর আগে। একটি ভাই মাত্র ছিলো। নাম আবু উমরভ।
ফ্র-এর রেড আর্মির একজন কর্নেল সে। সেই যে আফগান যুদ্ধে গেছে আর ফিরে আসেনি! কেউ বলে মারা গেছে, কেউ বলে সে মুজাহিদদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। আমি যখন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানস এ প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করলাম তখন ভেবেছিলাম শিক্ষকতার চাকুরী আমি পাচ্ছি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এ বৃত্তিকেই আমার পছন্দ বলে লিখেছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পেলাম না। আমার একজন সহপাঠি আগেই বলেছিল, কোন তুর্কিকে এ চাকুরী দেয়া হবে না। তার কথাই সত্য হলো। পাস করার পর আমাকে ফরেন সার্ভিসে যোগ দিতে বলা হলো। সেই সাথে আমাকে জানান হলো, ফরেন সার্ভিসে যোগ দেবার আগে দু’বছর আমাকে গোয়েন্দা বিভাগে কাটাতে হবে এ বৃত্তি আমার পছন্দ নয়, কিন্তু এ কথা প্রকাশের কোন সাধ্য আমার ছিল না। বেঁচে থাকতে হলে এ আদেশ মানতে হবে।
ফ্র-এর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যারেকটার এ্যাসাসিনেশান স্কোয়াডে আমাকে রাখা হলো। শুনলাম আমার রূপ আর বুদ্ধিই নাকি এর কারণ। বিদেশ থেকে আসা অনেক নামী-দামীদের সঙ্গ দিয়ে তাদের বাগে আনতে হবে যার জন্য রূপ আর গুণ দুই-ই প্রয়োজন। এর আগে দু’টো এ্যাসাইনমেন্ট আমি পেয়েছি। দু’টোতেই ফেল করেছি। নিজের ক্যারেকটার এ্যাসাসিনেট করতে চাইনি বলে কারো চরিত্র আমি এ্যাসাসিনেট করতে পারিনি। এই দায়িত্ব থেকে মুক্তির জন্য আমি সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তার উত্তরে তারা আপনার এ্যাসাইনমেন্টটা আমাকে দিয়েছে, বলে দিয়েছে আমি যদি এ এ্যাসাইনমেন্টে সফল হই, তাহলে এ দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং বিবাহ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়া হবে। আপনাকে শয্যা সঙ্গী করাই ছিল আমার এ্যাসাইনমেন্ট। এ জন্য যে জায়গাটি নির্দিষ্ট ছিল সেখানে ছিল গোপন টেলিভিশন ক্যামরা। দিনের পর দিন বিভিন্ন ভঙ্গিতে এখানে ছবি উঠত। এ ছবিগুলো দিয়ে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। এই ভাবে আপনাকে হাতের মুঠোয় এনে, আপনাকে মুসলিম বিশ্বে আপনার সংগঠনের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হতো কম্যুনিস্টদের বিশ্বজোড়া ‘ফ্র’-এর পক্ষে গোয়েন্দাগিরির জন্য।
তাদের এ আশা আমি পূরণ করেত পারিনি। আমার রূপ যৌবন যা এই প্রথমবারের মত বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমার নতুন জীবনের জন্য, আপনার পাথরের মত হৃদয়ে কোনই কম্পন সৃষ্টি করতে পারেনি। তৃতীয় বার ব্যর্থ হলাম আমি। এ ব্যর্থাতার নিশ্চয় ক্ষমা নেই। গতকাল আমি আমার ব্যর্থতার রিপোর্ট ডিপার্টমেন্টকে দিয়েছি। আজ সন্ধ্যায় আমাকে ডাকা হয়েছে। জানিনা কোন ভাগ্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আগে হলে ভয় পেতাম বর্তমান অবস্থায়। কিন্তু ভয় না করার শিক্ষা আমি আপনার কাছ থেকে পেয়েছি। যে কোন পরিণতির জন্য আমি আজ প্রস্ত্তত। শুধু একটাই দুঃখ, পরম প্রভুর বিচার দিনের যে জগতকে আপনি বিশ্বাস করতে আমাকে শেখালেন, সেই জগতের কোন পাথেয় আমার নেই। আর একটা দুঃখ, আপনাকে আর দেখতে পাব না কোন দিন।
দুনিয়াতে আমার আর কেউ নেই। যদি কোনদিন বাইরে বেরুতে পারেন, যদি আমার ভাই বেঁচে থাকে, আর তার যদি দেখা আপনি পান, মনে যদি থাকে এই দুঃখিনীর কথা, তাহলে বলবেন একজন মুসলিম উজবেক মহিলা হিসাবেই তার বোন মৃত্যুবরণ করেছে।
আপনার- আয়িশা আলিয়েভা

উমর জামিলভের অফিস কক্ষ। বিশাল টেবিল। রিভভিং চেয়ারে বসে আছে উমর জামিলভ। তার সামনে একটা ফাইল খোলা। ফাইলটি আয়িশা আলিয়েভার। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সে ফাইল।
গুরুতর অভিযোগ আলিয়েভার বিরুদ্ধে। তিন তিনবার তার মিশন ফেল করেছে। এটা শুধু ব্যর্থতা নয়, অবাধ্যতা বলে-এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পার্টি ও রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে সে তার বস্তাপঁচা নৈতিকতাকে বড় করে দেখেছে। এই অবাধ্যতা তাকে সকল প্রকার দায়িত্বের অনুপুযুক্ত এবং শাস্তিযোগ্য করে তুলেছে। এই অপরাথের নির্ধারিত শাস্তি হলো, সাইবেরিয়া অথবা সুদূর কোন লেবার ক্যাম্পের (শ্রম শিবির) জীবন বরণ করে নেয়া।
কিন্তু আলিয়েভার অপরাধ আরও গুরুতর। সে শত্রুর সাথে যোগাসাজস করেছে, শত্রুর কাছে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করেছে। লাইব্রেরী কক্ষের টেলিভিশন ক্যামেরা এবং টেপ এর সাক্ষী। ফাইলে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ফাইলে রয়েছে আলিয়েভার সেই সর্বশেষ চিঠিও যা সে হাসান তারিককে দিয়েছিল। আলিয়েভা যখন হাসান তারিককে চিঠি দেয় এবং হাসান তারিক যখন চিঠি পড়ছিল, সবই দেখেছে সিকিউরিটি লোকরা কনট্রোল রুম থেকে। চিঠি পড়তে অর দু’মিনিট দেরী করলে চিঠি আর পড়া হতো না হাসান তারিকের। যখন চিঠিটি পড়ছিল হাসান তারিক, সিকিউরিটির লোকেরা ছুটছিল সে রুমের দিকে। চিঠি পড়ার মুহূর্তকয় পরেই তারা সেখানে গিয়ে হাজির হয়। টেপ এবং চিঠি দুই-ই মনোযোগ দিয়ে পড়ল উমর জামিলভ। পড়তে পড়তে ঘেমে উঠেছিল সে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও কপালে জমে উঠেছে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাসান তারিকের কথার মধ্যে বার বার তার দাদীর মুখ সে ভেসে উঠতে দেখেছে।
দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মনটাকে শক্ত করল উমর জামিলভ। আলিয়েভার শেষ অপরাধটা অত্যন্ত গুরুতর। এ বিদ্রোহের একমাত্র শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াড। আর এ সুপারিশ করার দায়িত্ব তার ওপরই অর্পণ করা হয়েছে।
ইন্টারকমে নির্দেশ দিল, সাতটায় আয়িশা আলিয়েভা আসবে। এলেই এখানে পাঠাবে। ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ইয়েস স্যার।
ফাইলটি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল উমর জামিলভ। একটু রেস্ট নেবার জন্য ফাইল বন্ধ করল বটে, কিন্তু সংগে সংগে দেশের ফাইলটা খুলে গেল তার সামনে। দেশ বলতে আপাতত সে মধ্য এশিয়াকেই বুঝাচ্ছে। কি ঘটছে এখানে! প্রশাসন যাই বলুক না কেন, খবর তো আমাদের কাছে আছে। জনমত ক্রমশঃই বিগড়ে যাচ্ছে। আর যতই এ প্রবণতা বাড়ছে, শাসন ততই কঠোর করা হচ্ছে। কিন্তু ফল কি হচ্ছে তাতে? ‘ফ্র’-এর কম্যুনিস্ট শাসনের সাথে এ অঞ্চলের তুর্কিদের মনের ব্যবধান ক্রমশঃই বাড়ছে। বড় ক্ষতি করেছে আফগান যুদ্ধ। যা এ অঞ্চলের মানুষ কোনদিন কল্পনা করেনি, যা সম্ভব বলে কোনদিন ভাবেনি, আফগানদের সংগ্রাম আজ তাকেই সম্ভব প্রমাণ করে দিয়েছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ না বাঁধলে শত বছরেও এ চেতনা হয়তো মানুষের মনে জাগতো না।
৭টা বেজে ৫ মিনিট। দরজায় নক হলো। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, এস। দরজায় নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকল আয়িশা আলিয়েভা। পরণে সেই পোষাক, যে পোষাকে সে হাসান তারিকের কাছে গিয়েছিল। সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস।
বসল আয়িশা আলিয়েভা।
ধীরে ধীরে আলিয়েভার ফাইল খুলল উমর জামিলভ। খুলতে খুলতে গম্ভীর কন্ঠে বলল, কি জন্য তোমাকে ডাকা হয়েছে জান?
জানি স্যার।
কি জান? আলিয়েভের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল উমর জামিলভ।
আমার বিচারের জন্য।
এবার মুখ তুলল উমর জামিলভ। কি যেন সে পাঠ করতে চাইল আয়িশা আলিয়েভার মুখে। তারপর বলল, দন্ড কি তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ?
আমার স্বীকার করা না করার কি মূল্য আছে স্যার?
আলিয়েভা তুমি অবুঝ নও। তুমি নিজের ওপর অবিচার করছ। কিছুটা ধমকের সুরেই কথাগুলো বলল উমর জামিলভ। তারপর একটু থেমে আবার বলল, মিশন তোমার ফেল করেছে, এটার ব্যাখ্যা হয়তো দেয়া যায়। কিন্তু তোমার এ চিঠির অর্থ কি আলিয়েভা? বলে চিঠিটি এগিয়ে দিল আলিয়েভার দিকে। চিঠির নজর পড়তেই চমকে উঠল আলিয়েভা। কিন্তু তা মুহুর্তের জন্য। পরে তার মুখটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। চোখে-মুখে দৃঢ়তার একটা চিহ্ন ফুটে উঠল।
উমর জামিলভ আলিয়েভার দিকে তাকিয়েছিল। যেন পাঠ করছিল তার মুখকে। আবার কথা শুরু করল সে, হাসান তারিকের সাথে তোমার যে কথাগুলো হয়েছিল তা কি তোমার মনে পড়ে আলিয়েভা? দেখ তারও বিবরণ এখানে আছে। বলে ফাইল থেকে পিন আঁটা কয়েক শিট কাগজ দিল আলিয়েভার দিকে।
আলিয়েভা কাগজটিতে কি আছে না দেখেই বলল, আমি সবই স্বীকার করে নিচ্ছি স্যার।
স্বীকার তো তোমাকে করতেই হবে। তোমার কোন বক্তব্য আছে কিনা তাই বল।
জামিলভের স্বরটা এবার কঠোর শুনাল। মনে হলো, আলিয়েভার এ সরাসরি কথাগুলো সে পছন্দ করছে না। যেন সে চাইছে, আলিয়েভা কারণ দর্শাও অভিযোগের। আত্মপক্ষ সমর্থন করুক।
আলিয়েভা বলল, আমি দুঃখিত স্যার, আমার কোন বক্তব্য নেই। চিঠিতে আমি যা লিখেছি সজ্ঞানেই লিখেছি, টেপে আমার যে কথাগুলো আছে তা সচেতনভাবেই বলেছি।
একটু থামল আলিয়েভা। তারপর বলল, এখনও বলতে বললে এই কথাগুলো অমন করেই আমি বলব। আমি একটি কথাও মিথ্যা বলিনি।
শত্রুর সাথে যোগসাজস এবং শত্রুকে তথ্য সরবরাহের অভিযোগ তাহলে স্বীকার করে নিচ্ছ?
আমি আমার চিন্তা ও আমার কথা এমন একজনকে জানিয়েছি যাকে আমি শত্রু মনে করি না।
তুমি গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার তা তুমি জান?
জানি, কিন্তু আমার একটা ব্যক্তিসত্ত্বাও আছে।
আমি তোমার জন্য দুঃখিত আলিয়েভা, তুমি অবুঝের মত কথা বলছ, আর নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছ।
দুঃখিত স্যার, আমি এ দুর্বিসহ জীবন আর সইতে পারছি না। আমাদের ঈমান, আমাদের পরিচয় সবই তো কেড়ে নিয়েছেন, চরিত্রের পবিত্রতাটুকু তাও আমি রাখতে পারবো না। স্যার, এ জীবন কি কোন জীবিতের জীবন?
আবেগ রুদ্ধ হয়ে এল আয়িশা আলিয়েভার কন্ঠ। তার দিকে তাকিয়ে ছিল জামিলভ। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটি নীচে নেমে এল । নত হল মাথা। ভাবছে সে। আলিয়েভার এ কথাগুলোর কি দন্ড তার জানা আছে, কিন্তু তার ঐ জিজ্ঞাসার কোন জবাব তার কাছে নেই, যেমন জবাব জানা নেই তার দাদীর অনেক জিজ্ঞাসার।
ধীরে ধীরে জামিলভ বলল, আলিয়েভা বাস্তববাদী হও। বয়স তোমার কম। যদি তুমি অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তাহলে আমি চেষ্টা করব তোমার জন্য।
আলিয়েভা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, এ লাইনে এমন হৃদয় কারো আছে আমার জানা ছিল না। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ স্যার। কিন্তু আমি কিসের জন্য অনুতপ্ত হবো, কি জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব? এক সময় আমি অন্ধ ছিলাম, চোখ ফিরে পেয়েছি। আমি আর অন্ধ হতে পারবো না স্যার।
সেই নরম সুরে আবার জামিলভ বলল, আরো ভেবে দেখ আলিয়েভা, তোমার ঐ চোখের চেয়ে জীবনটা বড় কিনা?
রুমালে চোখ মুছে আলিয়েভা বলল, স্যার, এ চোখ চোখ নয়, জীবনের মূলমন্ত্র। এর জন্য হাজার নয় লাখ লাখ মানুষ হাসিমুথে তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, ইতিহাস তাদের কাহিনীতে ভরপুর। আমার এক ক্ষুদ্র জীবন তো কিছুই নয় স্যার।
বিস্মিত জামিলভ তাকিয়ে আছে আলিয়েভার দিকে। এ বিস্ময় দৃষ্টি তার কতক্ষণ থাকতো কে জানে। কিন্তু হলো না। টেলিফোন বেজে উঠল। লাল টেলিফোন! ত্রস্ত হাতে তুলে নিল রিসিভার। ওপার থেকে ভেসে এল উজবেকিস্তান ‘ফ্র’-এর ফার্স্ট সেক্রেটারী কোনায়েভের গলা। বলল, আলিয়েভার ফাইল কখন পাঠাচ্ছ?
অল্পক্ষণ, স্যার।
ঠিক আছে।
ওপার থেকে রিসিভার রাখার শব্দ পাওয়ার পর নিজের রিসিভার রেখে দিল জামিলভ। চেহারা তার বিমর্ষ।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল জামিলভ। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, তোমার সাথে আমার কথা শেষ আলিয়েভা।
আলিয়েভা উঠে দাঁড়াল। তার সাথে উঠে দাঁড়াল জামিলভও। উঠে গিয়ে নিজ হাতে সে দরজা খুলল। আলিয়েভার সাথে সেও বেরিয়ে এসে দরজার বাইরে দাঁড়াল। অস্ফুট প্রায় স্বরে বলল, দুনিয়াতে তোমার কেউ নেই একথা ভেব না আলিয়েভা। জান না তুমি, তোমার অনেক আছে। একটু থেমে জামিলভ বলল, তোমাকে আমার দেবার মত কিছু নেই, আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ কর।
জামিলভের কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াল আলিয়েভা। কিছু সে বলতে যাচ্ছিল। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে নিষেধ করল জমিলভ। আলিয়েভা কিছু বলল না। তার চোখ দু’টি মাত্র একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চলে গেল আলিয়েভা। নিজের চেয়ারে ফিরে এল জামিলভ। আলিয়েভার ফাইল খুলল। নোট শিট গাঁথাই আছে। কলম তুলে নিল জামিলভ। হাত বড় দুর্বল। কলম কাঁপছে। চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে তার। হঠাৎ মনে পড়ল ফার্স্ট সেক্রেটারী এ ফাইলের জন্য বসে আছেন। আর তার সাথেই বসে আছে এক সদস্যের ট্রাইবুন্যাল। তাড়াতাড়ি কলম চালাল জামিলভ। অপরাধের গদবাঁধা বিবরণী। তারপর দন্ডাদশের সুপারিশ। লেখা শেষ করল জামিলভ। হাত থেকে কলমটিই গড়িয়ে পড়ে গলে। আলিয়েভা, তার দাদী দু’জনেরই ছবি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। নিষ্পাপ দু’টি মুখ। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের ভিজা কোণ মুছে নিয়ে ইন্টারকমে ডেকে পাঠাল পি, এ, কে। ফাইল এখুনি পাঠাতে হবে।