৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

জাহাজ থেকে স্ট্রেচারে তোলার সময় জাম্বুয়াংগো বন্দরেই আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসার সংগে সংগেই অনুভব করেন হাত পা তার বাঁধা। বুঝতে পারেন তিনি এখন স্বাধীন নয়। পেছনের ঘটনা একবার স্মরণ করতে চেষ্টা করেন তিনি। মনে পড়ে, জাহাজের বেষ্টনি থেকে তো তাঁর বোট বের হয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু তারপর কি ঘটল? মনে পড়ে এক প্রচন্ড ধাক্কার কথা। তারপর আর কিছু মনে নেই। তাহলে তিনি ঐখানেই জ্ঞান হারান? কিন্তু সাথীরা কোথায়? মনটা তাঁর আনচান করে ওঠে। সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে।
একটা পিকআপ ভ্যানের ফ্লোরে এনে আহমদ মুসাকে নামানো হলো।
ঠিক নামানো তো নয়, স্ট্রেচার থেকে তাঁকে গড়িয়ে ফেলা হলো গাড়ীর মেঝেতে। মাথাটা ঠক করে বাড়ি খেল গাড়ির মেঝের সাথে। বেদনায় টন টন করে উঠল মাথাটা। গোটা শরীরে বেদনার একটা স্রোত বয়ে গেল। আহামদ মুসা ভাবলেন, তার অনুমান সত্য হলে কু-ক্ল্যাক্স ক্লানের হাতেই তিনি বন্দী। বুঝতে চেষ্ট করলেন, কোথায় এখন তিনি? চার পাশের প্রহরীদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, এরা ফিলিপিনো আর্মির সদস্য। স্থানটা কি জাম্বুয়াংগো হবে? ভাবলেন আহমদ মুসা। জাম্বুয়াংগোর কথা মনে আসতেই ব্যথায় চিন চিন করে উঠল মনটা। শিরীকে তিনি মুক্ত করতে এসে নিজেই এখন বন্দী। মনটা তাঁর খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল অবস্থার নাজুকতায়। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর কন্ঠে নিঃশব্দে উচ্চারিত হলো, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, আমি সব ব্যাপারে তাঁর ওপরই নির্ভর করছি।
গভীর প্রশান্তি নেমে এল আহমদ মুসার মনে। গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। আর কোন বন্দী যখন তার পাশে উঠল না আহমদ মুসা ধরে নিলেন বন্দী তিনি একাই। সাথীরা কি তাহলে সরে যেতে পেরেছে? অথবা তারা সবাই …..। আর ভাবতে পারেন না আহমদ মুসা। এক অবরুদ্ধ উচ্ছাস যেন তাঁর বুকটা ভেংগে দিতে চাইল।
বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল আহমদ মুসার। একটা ঝাঁকুনিতে সন্বিত ফিরে পেলেন। দেখলেন, তাকে একটা স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে। দু’জন সৈনিক স্ট্রেচারটি আর্মি ইনটেলিজেন্স হেডকোয়াটার্সের প্রশস্ত এবং অন্ধকার একটা ঘরে নিয়ে রাখল। দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবার সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এলঃ ডঃ কর্নেল ফ্রেসারকে নিয়ে এস, উনি একে দেখবেন।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর কোন কথা কানে এল না।
কণ্ঠটা আহমদ মুসার পরিচিত। স্মার্থার কণ্ঠ। সারা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার। তাহলে শিরীও এখানেই বন্দী? অজান্তেই হাত দুটি তার মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। ভাবনার গভীরে চলে গেল তাঁর মন।
লুকমান রশিদ, এহসান সাবরীরা কি জানতে পেরেছে সব। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোর পর ওদের সর্বশেষ আশ্রয় জাম্বুয়াংগো। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোতে যেমন করে আল্লাহর সাহায্য পিসিডা অঝোর ধারায় পেয়েছে, সে সাহায্য কি তারা জাম্বুয়াংগোতেও পাবে না? সব নির্ভরতা আমাদের তার ওপর! চোখ দু’টি তাঁর গভীর প্রশান্তিতে মুদে এল।
সশব্দে সেই দরজাটি খুলে গেল আবার। সুইচ টেপার শব্দও শোনা গেল সেই সাথে। আলোতে ভরে গেল ঘরটা। প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসার পরিস্কার মনে হলো, ঘরটা গোয়েন্দা দপ্তরের একটা অপারেশন রুম। পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকে একটি করে দরজা ও ছোট জানালা।
পশ্চিমের খোলা দরজায় দু’জন প্রহরী। হাতে সাব মেসিনগান।
দরজা দিয়ে দু’জন ঘরে ঢুকল। একজনকে মনে হল ডাক্তার। আরেকজন দীর্ঘাকৃতি, পেটা শরীর, চোখের দৃষ্টি তীব্র। ছোট করে ছাটা চুল। দু’হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো। লোকটি আহমদ মুসার পরিচিত নয়। তবে মনে হয় বড় কর্মকর্তাদের একজন।
লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কেমন বোধ করছেন আহমদ মুসা?
আহমদ মুসা কোন জবাব দিলেন না। হাল্কাভাবে উড়ে আসা এ বিদ্রুপবাণের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজনও ছিল না। আহমদ মুসা তাঁর দৃষ্টি স্থিরভাবে লোকটির দিকে তুলে ধরলেন শুধু।
লোকটি আবার মুখ খুলল। বলল, আমি জনপল, আমাকে চিনতে পারেন?
আপনি জনপল, তবে পোপ নন। কিন্তু পোপের চেয়ে বড়।
আপনি আমাদের পোপকে অসম্মান করলেন – বলল জনপল।
আমি বরং পোপকে সম্মান করেছি জনপল, বলল আহমদ মূসা ।
কেমন করে ?
পোপ স্বয়ং যা করছেন না, করতে বলছেন না, ততটা পর্যন্ত করে আপনারা খৃস্টধর্মকে কলংকিত করছেন, একথা বলে আমি পোপকে সম্মানই করছি।
আপনার ইংগিত কোন দিকে আহমদ মুসা?
আমি কি বলতে চাই কু-ক্ল্যাক্স-ক্লানের পূর্বাঞ্চালীয় বর্তমান প্রধান জনপল অবশ্যই বুঝেছেন।
ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে উঠল জনপলের। বলল সে, আপনি কোথায় আছেন তা বোধহয় ভুলে গেছেন আহমদ মুসা।
না ভুলে যাইনি। কিন্তু শ্বেতাংগ খৃস্টানরা তাদের ধর্ম ও বর্ণ স্বার্থের জন্যে যে শ্বেত সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে আমি তার বিরুদ্ধে।
আমরা তা জানি আহমদ মুসা। জানি বলেই আপনি এখানে এসেছেন। একটু থামল জনপল। বোধহয় একটা ঢোক গিললো। শুরু করলো আবার, বিরুদ্ধে বলেই সেদিন কাগায়ানে হত্যা করলেন আমাদের নেতা মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে, এ পর্যন্ত হত্যা করেছেন আমাদের হাজার হাজার কর্মীকে এবং আমাদের অস্তিত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের রেডিয়েশন বোমা আপনারা কুক্ষিগত করেছেন।
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল জনপল। একটু থেমে বলল, সে বিচারে আমরা পরে আসব। তারপর ডাক্তারের দিকে ফিরে জনপল বলল, ডঃ ফ্রেসার, আপনার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে আপনি আসুন।
গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জনপল। ডাক্তার এগিয়ে এল আহত আহমদ মুসার দিকে। হাতে তাঁর ছুরি, কাঁচি, তুলা, ঔষধ।
আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে বললেন, ধন্যবাদ ডাক্তার, আসুন। মানবতাবোধ একেবারে মরেনি তাহলে? স্মার্থাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

সেই হল ঘর। একটা দীর্ঘ ও প্রশস্ত তক্তপোষের সাথে নাইলনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আহমদ মুসার দেহ। তাঁর সামনে এক চেয়ারে বসা জনপল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। তার কপালে বিন্দ বিন্দু ঘাম। সে বলছিল, আমি জানি, আপনি সোজাভাবে কথা বলবেন না। কথা বলাবার যন্ত্রও আমাদের আছে। পাশেই বিদ্যুৎ আসন, দেখুন ছোবল দেয়ার জন্য কেমন হা করে আছে। ঐ পথে যেতে আমাদের বাধ্য করবেন না। শুধু আমাদের বলুন, রেডিয়েশন বোমাগুলো কোথায় রেখেছেন? এটা আমাদের জানালে আর কোন প্রশ্নই আমরা আপানাকে জিজ্ঞেস করব না।
আহমদ মুসা বললেন, তোমাদের এ বিদ্যুৎ আসনকে আমি চিনি। এর ভয় দেখিয়ে রেডিয়েশন বোমার কোন খবর আমার কাছ থেকে পাবে না। নিজে বাঁচার জন্য লাখো মানুষকে মারার অস্ত্র আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।
থামুন আহমদ মুসা। বাঘের মত গর্জন করে উঠল জনপল। উঠে দাঁড়াল সে। হাত দু’টি তার মুষ্টিবদ্ধ, চোয়াল দুটি মনে হচ্ছে পাথরের মত শক্ত। চোখে আগুন। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে সে। এক সময় সে হো হো করে হেসে উঠল। হাসিটা মনে হলো চাবুকের চেয়েও তীক্ষ্ণ।
সে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, তাহলে কথা বলবেন না, আহমদ মুসা? রেডিয়েশন বোমার কোন খবর তাহলে দেবেন না আমাদের? একটু থেমে বলল, জানেন আপনার শিরীও এখানে বন্দী আছে?
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, জনপল?
কি বলতে চাই দেখাচিছ। বলে হাতে দু’টো তালি দিল সে। সংগে সংগে দু’জন প্রহরী সামনে এসে দাঁড়াল। জনপল তাদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা শিরীকে নিয়ে এস।
অল্পক্ষণ পরে শিরীকে নিয়ে দু’জন প্রহরী ঘরে ঢুকল। শিরীর পরনে মরো রাজকুমারীর সেই পোষাকই রয়েছে। মলিন চেহারা। চোখ দু’টি লাল, ফোলা। কেঁদেছে অবিরাম।
আহমদ মুসাকে ঐভাবে দেখে দু’হাতে মুখ ঢাকল শিরী। টলতে লাগল তার দেহ। বসে পড়ল সে।
জনপল আবার আহমদ মুসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আহমদ মুসা, মরো রাজকুমারীর দিকে চেয়ে দেখ। এই মেয়েটি আপনার কি আমরা জানি। এখন বলুন এই মেয়েটিকে দুনিয়ার জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে আপনার জেদ ঠিক রাখবেন না এ মেয়েটিকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে রেডিয়েশন বোমার খবর দেবেন?
কেঁপে উঠল আহমদ মুসার গোটা দেহ এক অজানা আশঙ্কায়। বললেন আহমদ মুসা, তুমি কি বলতে চাও জনপল?
আমি বলতে চাই, আমি কথা শেষ করার পর এক মিনিট অপেক্ষা করব। এর মধ্যে যদি আপনি আমাদের কথায় সম্মত না হন, তাহলে এক মানুষ গেরিলার হাতে এই মরো রাজকুমারীকে তুলে দেব। আপনার চোখের সামনে সে নির্দয়ভাবে লুন্ঠন করবে মরো রাজকুমারীকে। শত চাবুকের ঘা যেন এক সাথে জর জর করে তুলল আহমদ মুসার দেহকে। মগজের প্রতিটি তন্ত্রী, মনের প্রতিটি পরতে এবং স্নায়ুর প্রতিটি কোষে যেন আগুন ধরে গেল। আহমদ মুসার লৌহ হৃদয়ও থর থর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে মনটাকে স্থির করলো আহমদ মুসা। বলল, জনপল, যেটাকে আমার জেদ বলছ সেটা আমার জেদ নয়, আমার দায়িত্ব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল জনপল। বলল, ৩০ সেকেন্ড পার হয়েছে আহমদ মুসা, আর ৩০ সেকেন্ড বাকী।
আহমদ মুসা শিরীর দিকে তাকালেন। দেখল শিরী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট দু’টি কাঁপছে। কিন্তু চোখে অশ্রু নেই, তার জায়গায় দৃঢ়তার এক আলোক দীপ্তি। অপার্থিব যেন সেই নূর – আলো ।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, ভয়ে কোন মুসলিম কখনও আত্মসমর্পণ করেছে এমন নজীর ইসলামরে সোনালী ইতিহাসে নেই।
আহমদ মুসা বললেন, আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত নই, জনপল। একটু থেমে বললেন আবার, আমি এবং শিরী- আমার, তোমার এবং সকলের রব যিনি সেই আল্লাহর ওপরই নির্ভর করছি।

কি ভয়াভহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন আহমদ মুসা এখনই টের পাবেন। বলে জনপল আবার হাতে তালি বাজাল। ঘরে ঢুকল সেই প্রহরী দু’জন।
টমকে নিয়ে এসো। দ্রুত কন্ঠে বলল জনপল।
অল্পক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকল টম নামের গেরিলা সদৃশ মানুষ। হেলে দুলে এগিয়ে এল সে। হো হো করে হেসে জনপল বলল, বহুদিন পর তোর ভাল খোরাক জুটিয়েছি টম। এদেশের একজন আনকোরা রাজকুমারী। এগিয়ে আয়!
বীভৎস এক হাসি দেখা গেল টমের মুখে। চিৎকার করে চোখ বুজল শিরী। দেহ জুড়ে এক অদম্য উচ্ছাস আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার। প্রতিটি পেশী ফুলে উঠল তার ধাক্কায়। নির্দয় নাইলনের রাশিগুলো তাতে আরো কেটে বসে গেল মাংসপেশীর ভেতরে। টম এগুচ্ছিল শিরীর দিকে। আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে অন্তরের অন্তহীন আকুতি তুলে ধরলেন প্রভূর সামনে প্রভূ হে, তুমি তো এমনি অবস্থায়ই সাহায্য করেছিলে লুতকে, মুসাকে, শুয়াইবকে …।
দ্রুত পায়ের খট খট শব্দে চোখ খুললেন আহমদ মুসা। দেখলেন স্মার্থা ঘরে ঢুকছে। ঘরের মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল স্মার্থা, মিঃ জন, থামতে বলুন টমকে।
মিঃ জন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, স্মার্থা তুমি কেন এখানে?
আপনার দেয়া কথা আপনি লংঘন করছেন মিঃ জন।
কি কথা?
শিরীর কোন অমর্যাদা হবে না এ শপথ আপনি আমার কাছে করেছিলেন।
হো হো করে হেসে উঠল জনপল। বলল, তুমি তো আচ্ছা ছেলেমানুষ স্মার্থা। তারপর হাসি থামিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল আমার কাজের মধ্যে এসো না, যাও এখান থেকে। তারপর টমকে বলল, দাঁড়িয়ে কেন?
টমকে থামতে বলো মিঃ জন। এবার স্মার্থার কন্ঠে যেন আদেশের সুর।
না টম থামবে না। এবার জনপলের কন্ঠও তীব্র হয়ে উঠল।
টম এগুচ্ছিল। মুহূর্তে একটি হাত স্মার্থার ওপরে উঠে এল। হাতে চকচকে রিভলবার। স্মার্থার চোখে আগুন। পর পর দু’বার ধুম্র উদগীরণ করল রিভলবার। বিরাট দেহের ছোট্ট মাথাটা একেবারে গুঁড়িয়ে গেল টমের।
বিস্ময়ে হতবাক জনপল একবার ভুলূন্ঠিত টমের দিকে তাকিয়ে তড়িত ঘুরে দাঁড়াল স্মার্থার দিকে। জনপলের হাতে রিভলবার। কিন্তু জনপলের রিভলবারটি উঁচু হবার আগেই স্মার্থার রিভলবার আরো দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল। নির্ভূল নিশানা। গুঁড়িয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে মিঃ জনপল হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।
স্মার্থা রিভলবার মাটিতে ফেলে দিয়ে ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকটা পাগলের মতই যেন আহমদ মুসার বাঁধন খুলে দিতে শরু করল।
দরজায় দু’জন প্রহরী কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল। হন্তদন্ত হয়ে কয়েকজন এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের একজনের হাতে রিভলবার। তারাও প্রথমে এসে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই আগন্তুক লোকটির পিস্তল উঠে এল স্মার্থাকে লক্ষ্য করে।
দরজায় পায়ের শব্দ পেয়ে শিরী ফিরে তাকিয়েছিল। স্মার্থার দিকে রিভলবার তাক করতে দেখে শিরী ‘স্মার্থা গুলী’ বলে চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল স্মার্থার দিকে। মনে হল যেন স্মার্থাকে আড়াল করতে চায় সে।
সঙ্গে সঙ্গে গুলীরও শব্দ হলো। গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল শিরীর পৃষ্ঠদেশে। উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শিরী স্মার্থার ওপর। স্মার্থা দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে শিরীর দেহটাকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কাছেই পড়ে থাকা জনপলের রিভলবার তুলে নিল। কিন্তু আর ফিরতে পারল না। এক ঝাঁক গুলী তার দিকে ছুটে এল। হামাগুড়ি অবস্থাতেই স্মার্থার দেহটা নেতিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।
এই সময় দূরে কোথাও প্রচন্ড বিস্ফোরণে ঘরটা কেঁপে উঠল। মুহূর্তকাল পরে আরও একটা, তারপর আরও একটা। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘরটা। তারপর খুব কাছ থেইে এক পশলা মেশিনগানের গুলীর শব্দ কানে এল। মুহূর্তকাল বিরতি, তারপর অবিরাম শুরু হলো মেশিগানের গুলী বর্ষণ। আহমদ মুসা বুঝতে পারল, পিসিডা শহরে প্রবশ করেছ, প্রবেশ করেছে এ বাড়িতেও। আনন্দে বুকটা ফুলে উঠল, ইয়াআল্লাহ, পিসিডাকে সাহায্য কর, বিজয়ী কর। জাম্বুয়াংগো বিজয়ের মাধ্যমে আমাদের মিন্দানাও বিজয় সম্পূর্ণ কর।
শিরীর কথা মনে পড়ল। মুহূর্তে আনন্দের রেশটা মুছে গেল আহমদ মুসার। শিরীর দেহটা আহমদ মুসার পাশে এসেই পড়েছিল। কিন্তু হাত নাড়াতে পারে না সে, কোন রকম পাশ ফেরার সাধ্যও তাঁর নেই। অস্ফুটে ডাকলেন, শিরী!
কোন জবাব নেই। বুকটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। তাহলে কি ….। তবু আবার ডাকলেন, শিরী! এবার স্বরটা একটু বড়। এবার ও কোন উত্তর নেই।
আহমদ মুসার মনে হচ্ছে, একটা হাল্কা কি যেন তার ডান বাহুটা আঁকড়ে আছে। কি এ বস্তু। কিন্তু তা দেখার সাধ্য আহমদ মুসার নেই। এই সময় ঘরে অনেকগুলো পায়ের ত্রস্ত শব্দ শোনা গেল। জ্বলে উঠল একটা টর্চ।
দ্রুত কন্ঠে একজন নির্দেশ দিল, তক্তা সমেত তুলে নাও আহমদ মুসাকে। ছুটে এল কয়েকজন। টর্চের আলোতে আহমদ মুসা দেখতে পেল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শিরীর দেহ। তার পাশেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। আর তারই একটা হাত উঠে এসে আঁকড়ে ধরে আছে আহমদ মুসার ডান বাহু। যেন একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে শিরী।
প্রহরীরা ছুটে এল। তুলে নিল তক্তা সমেত আহমদ মুসাকে। শিরীর হাতটা খসে পড়ল মেঝেতে। এই সময় মুর হামসারের মুখটা ভেসে উঠল আহমদ মুসার চোখের সামনে। আকস্মাৎ চোখ দু’টো ভারি হয়ে উঠল আহমদ মুসার। নেমে এল দু’চোখ থেকে অশ্রুর দু’টো ফোঁটা। মন নিঃশব্দে আওয়াজ করল, পারলাম না বন্ধু তোমার কাছে তোমার বোনকে ফিরিয়ে দিতে।
গোটা বাড়ি জুড়ে তখন সংঘর্ষ। ক্রমশঃই শব্দ আরও কাছে আসছে। আহমদ মুসা বুঝল, বাড়ি নিয়ন্ত্রণ পেতে পিসিডার আর দেরী নেই। কিন্তু এরা তাকে নিয়ে ওপরে ওঠছে কেন? কি করবে এরা? হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, এরা কি ছাদ দিয়ে পালিয়ে যাবে? ছাদে কি তাহলে হেলিকপ্টার আছে?
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। চিলেকোঠার কাছাকাছি আসতেই হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের পরিচিত শব্দ কানে এল। হেলিকপ্টার স্টার্ট নিয়েই ছিল। আহমদ মুসাকে নিয়ে ওঠা মাত্র হেলিকপ্টার উড়াল দিল।
সামনের সিট থেকে কে একজন বলল, আমাদের কামান্ডোরা অসাধ্য সাধন করেছ। তারা এতক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে হেলিকপ্টার আনা যেত না।
এখন কি নির্দেশ থাকল আমাদের ছেলেদের ওপর? বলল আরেকজন। উত্তরে পূর্বোক্তজন বলল, কর্নেল কর্ক-ই সে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে মোটামুটি কথা, আমাদের ছেলেরা এখন পেছন দরজা দিয়ে সরে পড়বে।
ভারি গলায় কে একজন বলল, কোথায় সরে পড়বে, গোটা শহরটা ওদের জালের মধ্যে। দেখলে না, কেমন করে গোটা শহর একসাথে জ্বলে উঠল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর একজন বলল, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
কাগনোয়াভিচের শিপে। খবর পেয়েছি আমাদের শিপটা বন্দরে আটকা পড়েছে।
আহমদ মুসা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল, যে কাগনোয়াভিচ উচিন ভর মাধ্যমে আলী কাউসারের সাথে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল ইনটেলিজেন্স সার্ভিস ‘রিও’ (Red Intelligence Organisation-RIO)- এর ফিলিপাইন শাখার প্রধান সেই কাগনোয়াভিচ?
আর্মি ইনটেলিজেন্স হেডকোয়াটার্স এতখানি সুরক্ষিত হবে তা ধারণা করেননি এহসান সাবরী। ঠিক ন’টাতেই তিনি পৌঁছে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গার্ড রুম থেকে একটি গুলীর শব্দ আসে। পরক্ষণেই গেটটি খুলে যায়। আরেকটি গুলীর শব্দ আসে এই সময় গার্ড রুম থেকে। সেই সাথে মেশিনগানের একঝাঁক গুলি আসে গেট লক্ষ্য করে। এইভাবে শুরুতেই তাদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।
আড়ালে থাকা সুনির্দিষ্ট অবস্থান থেকে তারা গুলী বৃষ্টি করছিল। বিস্ফোরণের পর বিদ্যুৎ চলে গেলেও তা খুব উপকারে আসেনি এহসান সাবরীর- আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ থাকায়। এহসান সাবরীরা ওদের দেখছিল না কিন্তু ওরা তাদের ঠিকই দেখছিল। সবচেয়ে মুস্কিল হয়েছে, এই বিশাল বিল্ডিংটিতে ঢোকার একটি মাত্র প্যাসেজ এবং একটি মাত্র দরজা।
পিসিডার বেপরোয়া ইউনিট গুলী বৃষ্টির মধ্যেই এগিয়ে যায় এবং ওদের পরাভূত করে। কিন্তু প্রবেশ দরজায় গিয়ে ধাক্কা খায় তারা। কথা ছিল, আবু সালেহ এ দরজা খোলারও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তা হয়নি। অবশেষে দরজা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হয়।
এভাবে প্রতি দরজায়, প্রতি বাঁকে বাধার সাথে যুঝে এহসান সাবরী যখন সেই হলকক্ষে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন হল ঘর খালি। টর্চের আলোতে ব্যাকুল ভাবে তিনি লাশগুলো পরীক্ষা করলেন, না আহমদ মুসা নেই। বুকের কাঁপুনি একটু কমল তাহলে কি আহমদ মুসা সরতে পেরেছেন? চোখের কোণায় তার এক উজ্জ্বল আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল।
লাশের ওপর টর্চের আলো ঘুরাতে গিয়ে একজনের পোষাক দেখে তিনি চমকে উঠলেন। গায়ে মরো মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক। তার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। শিরী নাতো? ভালো করে দেখার জন্য তিনি ঝুঁকে পড়লেন।
এই সময় একজন ছুটে এসে বলল, ছাদে হেলিকপ্টার……।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে এহসান সাবরী উঠে দাঁড়িয়ে ছুটলেন সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দিকে। কিন্তু ছাদে গিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন হেলিকপ্টারটি অনেক ওপরে এবং বাড়ীর চৌহদ্দির বাইরে। হাত থেকে স্টেনগানটা খসে পড়ল এহসান সাবরীর। বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মত কেঁদে উঠলেন এহসান সাবরীঃ আমার অভিযান ব্যর্থ, আমি ব্যর্থ হয়েছি, শিরী মৃত, আহমাদ মুসাকে ওরা নিয়ে গেল’।
হামিদ উনিতো এসে এহসান সাবরীর মাথায় হাত রাখল। মাথা তুলে হামিদ উনিতোকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা পারলাম না, হামিদ। কান্নায় ভেঙে পড়ল শেষের শব্দগুলো।
হামিদ উনিতো বলল, এহসান সাবরী ভাই, কান পেতে শুনুন, গোটা জাম্বুয়াংগো নগরীতে পিসিডা’র বন্দুকগুলো আনন্দ উৎসব করছে। আমরা বিজয় লাভ করেছি। এ বিজয় দিয়ে আমরা মিন্দানাওয়ের শহরাঞ্চলগুলো থেকেও উচ্ছেদ করলাম ফ্যাসিবাদীদের অবৈধ শাসনকে।
একটু থামলো হামিদ উনিতো। তারপর বলল, এই বিজয়ের স্থপতি যিনি, তিনি এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে নেই হয়তো, কিন্তু তিনি তো আছেন, এটাই আমাদের সান্তনা।
আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল হামিদ উনিতোর কন্ঠও।একটু থামল হামিদ উনিতো। তারপর বলল, যেখানেই তাঁকে নেয়া হোক, বিশ্বজোড়া ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মীদের চোখের বাইরে নেয়া তকে সম্ভব হবে না। আল্লাহ তাঁর নিগাহবান।
হেলিকপ্টারের শব্দ তখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে। পশ্চিম দিগন্তে কালো এক বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে হেলিকপ্টারটিকে। এহসান সাবরী, হামিদ উনিতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।

Top