৭
হাসান তারিক এখন ছোট্ট একটা সেলে। একটা দরজা এবং অনেক ওপরে একটা ছোট্ট জানালা ছাড়া আর ফুটো নেই ঘরে। মেঝেতে পাতা এক কম্বল ছাড়া আর কোন উপকরণ নেই! সেদিন লাইব্রেরী থেকে ফিরে আসার পর তাকে এখানে সরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি জানেন সর্বোচ্চ শাস্তি যাদের বরাদ্দ করা হয়, তারাই এসব সেলে আসে। ভিকটরের সাথে আগের মত কথা আর হয় না। দরজার গায়ের ছোট্ট জানালা খুলে সে খাবার দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, শরীর ভাল তো স্যার! ভিকটরের চোখটাকে তখন বড় বিষন্ন দেখায়। শুকনো রুটি, শুকনো কয়েক টুকরো গোশত তার দু’বেলার জন্য বরাদ্দ। নাস্তা তিনি আর পান না। গোশত হালাল হতে নাও পারে মনে করে গোশত তিনি নেন না, শুধু রুটিই খান। ভিকটর সেই ফুটো দিয়ে চোখে একরাশ মিনতি নিয়ে বলে, স্যার এভাবে খেলে তো আপনার শরীর থাকবে না।
কম্বলে বসে একটি চিঠি পড়ছিলেন হাসান তারিক। চিঠিটা কয়েক বার পড়েছেন। আবারও পড়ছেন। আজ দুপুরে খাবারের প্যাকেটে এই চিঠি পেয়েছেন। দুই রুটির মাঝখানে অতি সাবধোনে চিঠিটি লুকিয়ে রাখা ছিল। চিঠির নিচে কারো নাম নেই। তবে সম্বোধন ও সব মিলিয়ে বুঝা যায় চিঠিটি ভিকটরের কাছ থেকেই এসেছে।
চিঠি পড়ে প্রথমে স্তম্ভিত হয়েছেন, তারপর আনন্দিত হয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে আজ রাত আটটায় আপনার দরজা খুলে যাবে। যাকে সামনে পাবেন অনুসরণ করবেন। সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে, এর পরও কোন বাধা আসলে তা মুকাবিলা করেই পেছনের অফিসার্স গেট দিয়ে কারাগার থেকে বেরুতে হবে। বেরিয়ে রাস্তার ওপাশে স্টার্ট নিয়ে থাকা ৭৮৬৭ নং গাড়িতে উঠে বসতে হবে।
অন্ধকার কুঠরীতে বসে সময় বুঝার উপায় নেই। তবে সময়টা আটটার কাছাকাছিই হবে। বহুদিন পর একটা এ্যাকশনের গন্ধে হাসান তারিকের মাংসপেশীগুলো যেন সজীব হয়ে উঠেছে। এর মাঝেও একটা জিজ্ঞাসা মাঝে মাঝেই মনের কোণে উঁকি মারছে। কারা এটা করছে? আজিমভ ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবার পর ভিকটর হাসান তারিকের দেয়া খাবার জনৈক খাদি ইসমাইলকে দিত। ভিকটরের কাছে হাসান তারিক শুনেছিলেন আজিমভকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরেই খাদি ইসমাইল ও আরও তিনজনেক গ্রেপ্তার করে এনেছে। অর্থাৎ তারা একই দলের লোক।
হাসান তারিক দু’রাকাত নামায পড়ে নিয়ে প্রস্ত্তত হয়েই বসেছিলেন। দরজার তালা খোলার শব্দ কানে এল। সবগুলো ইন্দ্রীয় সজাগ হয়ে উঠল হাসান তারিকের। ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ভিকটর। হাতে সেই সার্ভিস ট্রে। তাতে চায়ের কাপ সাজানো। চোখাচোখি হতেই ইশারা করে হাঁটতে শুরু করল।
দরজাটা টেনে দিয়ে তার পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন হাসান তারিক। একটা করিডোর দিয়ে চলছিলেন তারা। করিডোরের মুখেই একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। মুষ্টিবদ্ধ হলো হাসান তারিকের হাত। কিন্তু না, কিছু হলো না। পুলিশকে হাসান তারিকের দিকে তাকাতে দেখেই ভিকটর বলল, হুকুম আছে। আর কিছু বলল না পুলিশ। এবার তারা ডাইনে মোড় নিয়ে আরেকটা বিল্ডিংয়ের ছায়া ধরে এগিয় চলল। দ্রুত হাঁটছে ভিকটর। হাসান তারিকও তার সাথেই আছেন।
বড় ফটক ওয়ালা একটা ঘরের সামেন গিয়ে পৌঁছলেন তাঁরা। ফটকের ওপরে লাল অক্ষরে লেখা আছেঃ ‘অফিসার্স প্যাসেজ’’। এখানে জানালা দিয়ে প্রথমে আইডেনটিটি কার্ড দেখাতে হয়, তারপর এখান থেকে গেট পাশ পাওয়া যায়। গেট পাশ নিয়ে ফটক দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। দরজাটা ইলেকট্রনিকের। যিনি গেট পাশ দেন, তিনিই তার বাঁ পাশের কি বোর্ডে লাল বোতামটা টিপে দেন, দরজা খুলে যায়। এ ঘর পেরুলেই একটুখানি খালি জায়গা। তারপরই গেটের সাথে লাগানো গার্ড রুম। গার্ড রুমে গেট পাশ দেখালেই বোতাম টিপে গেট খুলে দেয়া হয়। ভিকটর এবং হাসান তারিক সেই ফটক ওয়ালা ঘরের সামেন পৌঁছতেই ফটকের ইলেকট্রনিক দরজা খুলে গেল। তাঁরা ঢুকতেই আবার তা বন্ধ হয়ে গেল। হাসান তারিক দেখলেন ভেতের তিনজন লোক। হাসান তারিককে দেখে একজন এগিয়ে এল। ভিকটর পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি খাদি ইসমাইল।
গেট পাশ দেয়া অফিসারকে হাসান তারিক তার চেয়ারের পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন। তার ডান হাতের কাছে পড়ে আছে আধ পোড়া সিগারেট। বুঝলেন, সিগারেটের সাথে কিছু খাইয়ে ভিকটর তাকে আগেই কাবু করেছে।
এতক্ষণ বহন করে আনা চায়ের ট্রেটা মেঝেয় রেখে দিয়ে ভিকটর টেবিল থেকে ৪টা পাশ তুলে নিয়ে খাদি ইসমাইলের হাতে দিতে দিতে দ্রুত বলল, তুমি চা নিয়ে গার্ড রুমে ঢোকার পর একজন গেট পাশগুলো জানালা দিয়ে গার্ডকে দেবেন। গার্ড যখন ওগুলো চেক করতে শুরু করবে, তখন দু’জনে মিলে গাডরুমের গার্ড দু’জনকে কাবু করতে হবে। গেট খোলার জন্য বোতাম টেপার দায়িত্ব আমার। ওদেরকে এ্যালার্ম বাজাবার সুযোগ দেয়া যাবে না।
ভিকটর চলতে শুরু করেছে। হাসান তারিক চলতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে এলেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা অফিসারের টেবিলে। টান দিয়ে তার ডান পাশের ড্রয়ারটা খুলে ফেললেন। চোখটা হাসান তারিকের উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হ্যাঁ, আছে রিভলভর। লোডেড। রিভলভরটি পকেটে পুরলেন হাসান তারিক। খুলে ফেললেন বাঁ পাশের ড্রয়ারও। নিকশ সাদা রংয়ের আরেকটা রিভলভর। অপেক্ষাকৃত ছোট। হাতে তুলে নিলেন। অস্বাভাবিক ভারী। ব্যারেল ও ট্রিগারের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন হাসান তারিক। এ তো ল্যাসার রিভলভর। ট্রিগার বোতামটি লাল। অর্থাৎ রিভলভরটি লোডেড। রিভলভারটি পকেটে রাখতে যাবেন এমন সময় জানালার ওপাশ থেকে পায়ের শব্দ এল। চোখ তুলতেই চোখাচোখি হলো এক পুলিশ অফিসারের সাথে। অফিসারটি চোখে বিস্ময় বিমূড়তা, কিন্তু তা মুহুর্তের জন্য। পরক্ষনেই সে হাত দিল পকেটে। এর অর্থ হাসান তারিক বুঝেন। সাদা রিভলভর ধরা ডান হাতটি হাসান তারিক ওপরে তুললেন। পরের অবস্থাটা চিন্তা করে নিজেই শিউরে উঠলেন হাসান তারিক। কিন্তু উপায় নেই। পুলিশ অফিসারটির চোখ ভয়ে বিস্ফারিত দেখা গেল। হাসান তারিক চোখ বন্ধ করে শাহাদাৎ আঙুল দিয়ে চাপ দিলেন লাল বোতামটায়। মাত্র দু’তিন সেকেন্ড। চোখ খুললেন হাসান তারিক। পুলিশ অফিসারের দেহটা গড়াগড়ি যাচ্ছে। কিন্তু মাথাটা নেই। আরেকবার গোটা শরীর শির শির করে উঠল হাসান তারিকের।
মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেল গোটা ব্যাপারটা। ভিকটর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল এদিকে। রিভলভরটা পকেটে রেখে হাসান তারিক বললেন, ভিকটর তাড়াতাড়ি। এক্ষণি সব জানাজানি হয়ে যাবে।
ভিকটর চা নিয়ে গার্ডরুমের দিকে এগুল দ্রুত। করিডোরের মত বেশ লম্বা ঘর। কিন্তু আর কেউ নেই ঘরে। আজ উজবেকিস্তানে নতুন ফসল উঠার উৎসব। ঈদের বিকল্প আনন্দ অনুষ্ঠান হিসাবে কম্যুনিস্টরা একে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তাই সরকারী ভাবে বিভিন্ন প্রকার আনন্দানুষ্ঠানের ব্যাপক ব্যবস্থা করা হয় এদিনে। আজ উজবেকিস্তানে সাধারণ ছুটির দিন। তাই কারাগারের অফিসেও অপরিহার্য কিছু কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই। ভিকটর ঘর পেরিয়ে ফাঁকা চত্বরটায় গিয়ে নেমেছে। হাসান তারিকরা দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখলেন, ভিকটর চায়ের ট্রে নিয়ে গার্ডরুমে প্রবেশ করছে।
হাসান তারিক খাদি ইসমাইলকে বললেন, আপনি এদের নিয়ে গার্ডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ান অমি গার্ডরুমে ঢুকব।
হাসান তারিক পকেটে হাত পুরে গার্ডরুমের দিকে এগুলেন। নির্লপ্ত গতি। গার্ডরুমের জানালা দিয়ে একজন গার্ডকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ভিতরে তাকিয়ে কার সাথে যেন আলাপ করছে। ভিকটরের সাথে কি? এই তো সুযোগ। হাসান তারিক গার্ডরুমের পাশ ঘুরে দ্রুত গার্ডরুমে প্রবেশ করলেন। গার্ডরুমের দরজায় পা দিয়েছেন এমন সময় তীব্র সুরে বিপজ্জনক বিউগল বেজে উঠল। চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজন গার্ড। ভয়াবহ ধরনের অটোমেটিক কারবাইন টেনে নিল ওরা। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হাসান তারিকের রিভলভর দ্রুত গতিতে দু’বার অগ্নি বৃষ্টি করল। গুঁড়িয়ে গেল দুটি মাথা। ভিকটর মুহুর্তের হন্য হতচকিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ছুটে গেল জানালার পাশের কি বোর্ডে। চেপে ধরল নির্দিষ্ট বোতাম।
দরজা খুলে গেল। দ্রুত গতিতেই গেট থেকে বেরিয়ে এল তারা পাঁচজন। রাস্তার ওপারে স্টার্ট নেয়া একটা জীপ। লাল রিয়ার লাইটের উপরে জ্বলছে নাম্বার-৭৮৬৮। তারা গাড়ীর কাছে যেতেই দরজা খুলে গেল। দ্রুত গাড়ীতে উঠে বসলেন।
বিউগল কেঁপে কেঁপে তখনো বেজেই চলেছে। ভিকটর বলল, এদিকে আসার ইলেকট্রনিকের দরজা বন্ধ। এ গেটে আসার জন্য ওদের ঘুরে আসতে হবে। ততক্ষনে গাড়ীটি চলতে শুরু করেছে। মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনেই একটা রাস্তা পশ্চিমে বেরিয়ে গেছে এ জেল রাস্তা থেকে। দ্রুত জীপটি জেলখানার পাশের এ বিপজ্জনক রাস্তা ছেড়ে ঐ রাস্তায় গিয়ে পড়ল। জেলখানার দিকে থেকে তখন অনেকগুলো পুলিশের গাড়ীর একটানা ইমারজেন্সী সাইরেন ভেসে আসছে। বিউগলের তীব্র চিৎকার ইতিমধ্যে অনেকটা নেমে গেছে।
হাসান তারিকের পাশেই বসেছিল আমির উসমান। সে বলল, ভাই হাসান তারিক, মুবারকবাদ আপনাকে। আমি অভিভূত হয়েছি। তার কথা শেষ না হতেই ভিকটর বলে উঠল, আমি স্যারকে গোবেচারা ভদ্রলোক মনে করতাম, কিন্তু তিনি তো আগুন।
হাসান তারিক এদিকে কান না দিয়ে বললেন, ওরা অয়্যারলেসে গোটা পুলিশ নেটওয়ার্ককে জানিয়ে দেবে। গাড়ি সার্চ করা শুরু করবে ওরা। আমাদরে গাড়ি ওরা দেখেনি, গাড়ীতে আমরা আছি তাও জানে না। কিন্তু তার আগেই সরে পড়তে হবে।
এবার ড্রাইভার কথা বলল। বলল সে, সামনের ব্রীজটা পার হলেই আর কোন ভয় নেই ইনশাআল্লাহ। পরের যে পুলিশ পোস্ট তার আগেই মেইন রোড ছেড়ে দিয়ে আমরা পাশে চলে যাব।
সামনে দুরে একটা লাল আলো জ্বলছে। ড্রাইভার বলল, ওটাই ব্রীজের মুখ। লাল আলো দেখে মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠল হাসান তারিকের। চেকিং কি শুরু হয়েছে? না ওটা রুটিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের আলো? হেড লাইটের আলোতে ব্রীজটা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্টিল হেলমেটওয়ালা দু’জন পুলিশ। হাতে তাদের সাব মেশিনগান। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে হাসান তারিক বললেন থামতে বললে থামানই উচিত হবে।
কিন্তু….. কিছু বলতে শুরু করল ড্রাইভার।
হাসান তারিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাদের থামানোটা রুটিন চেকও হতে পারে, না থামলে তারা সন্দেহ করবে। তাতে ব্রাশ ফায়ারের মুখোমুখি হতে পারি আমরা।
আর যদি রুটিন চেক না হয়? বললড্রাইভার।
তাহলে পুলিশ দুটোর দায়িত্ব আমার। বললেন হাসান তারিক।
গাড়িটি ব্রীজের মুখে এসে পৌঁছেছে। ততক্ষণে ব্রীজের মুখের সবুজ আলো আবার জ্বলে উঠেছে। গাড়ীর ভীড় নেই বললেই চলে। চলতে শুরু করেছে গাড়ীগুলো। একজন পুলিশ অয়্যারলেসে কথা শুরু করল। আরেকজন পুলিশ ধীর গতি গাড়ীগুলোর দিকে একনজর চেয়েই চলে যেতে ইশারা করছে। হাসান তারিকদের গাড়ীও ঐভাবে চলে যাবার ইশারা পেল। ততক্ষণ প্রায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল একটা কোন কিছুর। এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাদা রিভলভরটা পকেটে চালান করে দিলেন হাসান তারিক।
হাসান তারিকদের গাড়ি ব্রীজে প্রবেশ করেছে। এমন সময় অয়ারলেসে কথা বলা পুলিশটি উত্তেজিতভাবে অন্য পুলিশকে কি যেন বলল। তারপর তারা রাস্তায় ছুটে এল, বন্ধ করে দিল গাড়ীর অগ্রসরমান গতি। জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন হাসান তারিক।
শুকরিয়া আদায় করলেন সকলেই।
মাইল খানেক যাবার পর গাড়ীটি হাইওয়ে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি রাস্তা ধরে শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। পেছনের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। হাসান তারিক কিছুক্ষণ পেছনের দিকটা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হলেন, না কেউ অনুসরণ করছে না।
গাড়িটি দক্ষিণ পূর্বে প্রায় মিনিট দশেক চলার পর দক্ষিণ দিকে আরেকটা বাঁক নিয়ে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেল। একটা গ্যারেজের গেটে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। সংগে সংগে খুলে গেল গ্যারেজের গেট। ভেতরে ঢুকল গাড়ি।
গাড়ি থামতেই ছুটে এল কয়েকজন। এদিকে গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়লেন। প্রথমেই ড্রাইভার জড়িয়ে ধরল হাসান তারিককে।
ড্রাইভারের নাম আনোয়ার ইব্রাহিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় সে ইব্রাহিমভ। দু’বছর আগে তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে ইতিহাসে ডিগ্রী নিয়ে বেরিয়েছে। পেশা হিসাবে নিয়েছে শিক্ষকতা। সে একটি বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। ড্রাইভিং লাইসেন্সও তার আছে। সাইমুমের তাসখন্দ ব্রাঞ্চের প্রধান।
আনোয়ার ইব্রাহিম হাসান তারিককে নিজের পরিচয় দেবার পর পরিচয় করিয়ে দিল খাদি ইসমাইলের সাথে। খাদি ইসমাইল উজবেকিস্তান সাইমুমের অপারেশন স্কোয়াডের আমুদরিয়া সেক্টরের একজন কমান্ডার। আজিমভের কমান্ডেই সে কাজ করত। আজিমভ ধরা পড়ার ১৫দিন পর সেও ধরা পড়ে যায় একজন কর্মীর সামান্য ভুলের কারণে।
হাসান তারিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলে উজবেকিস্তান সাইমুমের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল আমির উসামনের সাথে। আনোয়ার ইব্রাহিম জানান, ভিকটরের সাথে যোগাযোগ করা এবং আজকের অপারেশনের প্ল্যানটা তারই তৈরী। আমির উসমানের বয়স ৪৫ এর মত। উজবেক পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করেছে প্রায় ১৫ বছর। স্বাস্থ্যগত কারণে অব্যাহতি নিয়েছে চাকুরী থেকে। চাকুরীর সময় থেকেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সহায়তা দিয়ে আসছে। সরকারী চাকুরীতে যারা আছে তাদের সাথে যোগাযোগের সে একটি বড় সূত্র।
হাসান তারিক আমির উসমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে মোবারকবাদ জানিয়ে বললেন, আল্লাহ আপনাকে আরও কাজের শক্তি দান করুন। আমির উসমান বলল, আপনার দোয়া আল্লাহ আমাদের সবার জন্য কবুল করুন।
গ্যারেজের সাথেই একটা বড় তিনতলা বাড়ি। বাড়ি এবং গ্যারেজ দুটোরই মালিক আনোয়ার ইব্রাহিম। কম্যুনিস্ট পার্টির ক্যাডারের বাইরে যে দু’চারজন ভাগ্যবান লোকের তাসখন্দে বাড়ি আছে, আনোয়ার ইব্রাহিম তাদেরই একজন। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস স্মরণ করতে লজ্জা পায়, দুঃখ পায় আনোয়ার ইব্রাহিম।
আনোয়ার ইব্রাহিমের পিতামহ আবদুল্লাহ কম্যুনিস্ট প্রলোভনে ভূলে লাল ফৌজের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। ১৯৩০ সালে উজবেকিস্তানের এ অঞ্চলে যৌথ খামারের প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলিম জনসাধারণ তাদের ধ্বংসাবশিষ্ট শক্তি নিয়েই কম্যুনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তখন কম্যুনিষ্ট লৌহ শাসনের স্থানীয় লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে আবদুল্লাহ। অবর্ণনীয় অত্যাচার চলে মুসলিম কৃষকদের ওপর। তাদের বাড়ি-ঘর, ঘোড়া এবং কৃষি জমিই শুধু কেড়ে নেয়া হয় না, তাদের স্ত্রী- কন্যাকেও দখল করা হয়। সে সময় পরাজিত অবস্থায় একজন মুসলমানের প্রতি একজন কম্যুনিস্টের বিদ্রুপ উক্তি ছিল এই রকম-
‘আল্লাহর সাহায্যে আমরা তোমাদের থেকে জীবন ধারণের সব সামগ্রী নিয়েছি। এখন তোমাদের স্ত্রীদের পর্যন্ত আমরা যৌথ ব্যবস্থাধীনে আনব। এভাবে আমরা তাদের শয্যা শায়িনী করব। এভাবে পরস্পরে আমরা প্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারব’। আবদুল্লাহকে তার কাজের পুরস্কার হিসাবে কম্যুনিস্ট সরকার এই জমি দান করে এবং বাড়ি তৈরীরও ব্যবস্থা করে দেয়। বাড়ীর এই ইতিহাস কখনও আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে তুললে সে বলে, দাদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার কাজ আব্বা থেকেই শুরু হয়েছে। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার নাম তিনি রেখেছেন লাল ফৌজের বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর আনোয়ার পাশা ও ইব্রাহীম বাকেরের নাম অনুসারে। আনোয়ার পাশা লাল ফৌজের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন এবং ইব্রাহিম বাকের উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের পাহাড়ে প্রান্তরে দীর্ঘদিন প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর পর ১৯৩৫ সালে ধরা পড়েন এবং লাল ফৌজের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। এই নাম রাখা দাদার কাজের বিরুদ্ধে আব্বার নিরব, কিন্তু অত্যন্ত শক্ত প্রতিবাদ। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী ইতিহাস পড়েছি, কিন্তু তার পাশাপাশি আব্বার কাছে সত্যিকার ইতিহাসও পড়েছি। আব্বা গোপনে লাহোর থেকে এসব আনিয়ে নিয়েছিলেন।
গ্যারেজ এবং বাড়ীটি এখনও সরকারীভাবে আনোয়ার ইব্রাহিমের বটে, কিন্তু এর সব কিছুই আনোয়ার ইব্রাহিম সাইমুমকে দান করেছে। তিন তলার দুটি কক্ষ নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বাস করেন। এ দুটি কক্ষের উপযুক্ত ভাড়া ইব্রাহিম সাইমুমকে দেয়।
আমির উসমান হাসান তারিক সহ সবাইকে নিয়ে গ্যারেজের মধ্য দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। আমির উসমানের অফিস কক্ষে হাসান তারিক ও আমির উসমান গিয়ে বসলেন। অফিসটি দোতলায়। ঘরের বাইরে রুশ ভাষায় বিরাট একটা সাইনবোর্ড- ‘অফিস অফ দি লিগাল কনসালট্যান্ট (প্রাইভেট)’।
হাসান তারিক ও আমির উসমান টেবিলে মুখোমুখি বসে। কথা বলল প্রথম আমির উসমান। বলল, আপনাকে ওরা ধরে এনেছে এটা শুরু থেকেই আমরা জানি। এদেশে আমাদের সব কর্মীই এটা জানে। কিন্তু কোথায় কিভাবে যে আছেন এটা আমাদের জানা ছিল না। অতি সম্প্রতি আমরা এ ব্যাপারে জানতে পারি।
ভিকটরের সাথে কিভাবে আপনাদের যোগাযোগ হলো?
সে একটা ইতিহাস। ‘ফ্র’-এর গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিও’র তাসখন্দের অভ্যন্তর বিভাগের প্রধান উমর জামিলভ আপনার সন্ধান ইসলামিক স্টেট অব ফিলিস্তিনের মস্কোস্থ এ্যামবাসীকে জানায়। সেই সাথে জানায় সহজ শিকার হিসাবে ভিকটরের নাম। এ খবর আমরা পাওয়ার পরেই ভিকটরের সাথে যোগাযোগ করি।
‘রিও’-এর একজন অফিসার এটা করল? তাঁকে আপনারা জানেন? অপার বিস্ময় হাসান তারিকের চোখে।
আমরা তাঁকে জানি না, এখনো খোঁজ নিতেও পারিনি।
আমির উসমান থামল। হাসান তারিক কোন কথা বললেন না। তার ভাবনা এখন অন্য জায়গায়। আয়িশা আলিয়েভার কথা মনে পড়ল তার। উমর জামিলভ তাসখন্দ ‘রিও’ও অভ্যন্তর বিভাগের প্রধান হলে সেই তো ওখানে আলিয়েভার টপ ‘বস’ হবার কথা। তাহলে উমর জামিলভের হাতে কি আয়িশা আলিয়েভার ক্ষতি হতে পারে? আশার একটা আলো জেগে উঠতে চাইলো তার মনে। হাসান তারিকের কাছে আলিয়েভার লেখা চিঠি যে মুহূর্তে ওদের হস্তগত হয়ে যায়, তখন থেকেই হাসান তারিক আলিয়েভার জীবনের আশা পরিত্যাগ করেছিলেন।
হাসান তারিকের চিন্তাজাল ছিন্ন করে আমির উসমানই আবার কথা বলল। বলল সে, আজ রাতের মধ্যেই আমাদের পাহাড়ের ঘাঁটিতে পৌঁছতে হবে। গাড়ীর পথ এখন একটুও নিরাপদ নয়। পাহাড়-মালভুমির দুর্গম পথে আমাদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে। সময়ও লাগবে এর জন্য প্রচুর। আমির উসমানের কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল আনোয়ার ইব্রাহিম। বলল, চলুন খাবার তৈরী।
এই মুহুর্তে এর চেয়ে বড় সুখবর আমার জন্য কিছু নেই, বলে হেসে উঠে দাঁড়ালেন হাসান তারিক। উঠে দাঁড়াল আমির উসমানও।
ঘুম ভাঙতেই উঠে বসল রোকাইয়েভা। ঘরে আলো জ্বলছে তখনও। কেউ আসেনি। তাহলে এ ঘরে ভাইয়া আসেনি? মনটা আনচান করে উঠল। ছুটল ভাইয়ার ঘরের দিকে। শূন্য ঘর। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দোতলার বারান্দা থেকে গেট দেখা যায়। দেখল, গেট বন্ধ। পূর্ব আকাশে শুকতারা জ্বল জ্বল করছে। এখনও বেশ অন্ধকার। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কালকের রাতের আশংকাটা আবার মনে জাগল। দাদীর ঘরে এলো রোকাইয়েভা। দাদী ফজরের নামায শেষ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। রোকাইয়েভা বলল, দাদী ভাইয়া….. কথা শেষ করতে পারল না। গলাটা যেন বন্ধ হয়ে এল তার ।
চিন্তা করছিস কেন, আসবে।কত কাজে কত জায়গায় যেতে পারে।
কিন্তু টেলিফোন-ভাইয়ার টেলিফোন নিরব কেন? এমন তো কোনদিন হয়নি। ভাইয়া বাড়িতে না জানিয়ে তো কোথাও থাকেন না!
তোর ভাইয়া যে কাজ করে, অনেক সময় বলার সুযোগ নাওতো পেতে পারে?
কিন্তু তার অফিস? তিনি না পারলে অফিস তো জানিয়েছে? দাদী কোন উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখেও চিন্তার একটা কালো ছায়া। সত্যিই উমর জামিলব এমন তো কোন দিন করেনি। সে ডিউটি পাগল সত্য, কিন্তু বাড়ীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যে সে বিন্দুমাত্রও অবহেলা করে না। মনের এ চিন্তা চাপা দিয়ে দাদী বললেন, এখনও তো নামায পড়িসনি। যা নামায পড়ে আয়, মনটা ভালো হবে।
দাদী কুরআন শরীফ পড়ছিলেন। রোকাইয়েভা নামায পড়ে এসে তার পাশে বসল। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল রোকাইয়েভার। ভাইয়ার কোন খবর? ছুটে গেল সে বাইরে। একটি খাম হাতে ঘরে ফিরে এল। বন্ধ খাম। কারো নাম নেই খামে।
কে দিল? জিজ্ঞেস করলেন দাদী।
দারোয়ানকে কে যেন দিয়েছে। আপনাকে দিতে বলেছে।
পড়তো দেখি।
খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করল রোকাইয়েভা। চার ভাঁজ করা চিঠি খুলে পড়তে লাগল সে।
চিঠি পড়তে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল রোকাইয়েভা। তার হাত থেকে পড়ে গেল চিঠি। বিছানায় লুটিয়ে পড়ল রোকাইযেভার দেহটা। দাদী কুরআন শরীফ বন্ধ করে টেবিলে রেখে রোকাইয়েভার পাশ থেকে চিঠি তুলে নিলেন। পড়লেন-
দাদী, আমি জামিলভের এক ভাই। জামিলভ নেই। আপনারা, আমরা কেউ কোন দিন আর তাকে খুঁজে পাব না। তাসখন্দ জেল থেকে সাইমুম নেতা হাসান তারিক, তিনজন বিদ্রোহী নেতা এবং ভিকটর নামের একজন জেল কর্মচারী পালিয়েছে। ভিকটরের সন্দেহজনক গতিবিধি রিপোর্ট হওয়ার পরেও জামিলভ তাকে সুযোগ দিয়েছে, ব্যবস্থা গ্রহণের কোন নির্দেশ দেয়নি। অর্থাৎ জেল পালানোর ঘটনার সাথে তার যোগসাজস ছিল। সুতরাং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে জামিলভ দন্ডিত হয়েছেন।
দুঃখ করবেন না দাদী। এ দেশে জামিলভদের সারি বড় দীর্ঘ। আরও কত দীর্ঘ হবে কে জানে!
যুবায়েরভ।
চিঠি পড়া শেষ করলেন দাদী। কিন্তু মনে হচ্ছে চিঠি পড়া শেষ হয়নি তাঁর। চিঠি ঐভাবেই তাঁর হাতে ধরা। চোখ দুটি চিঠির ওপরই নিবদ্ধ। স্থির অচঞ্চল তিনি। দৃষ্টি শূন্য। যেন তিনি পাথর হযে গেছেন।
পল পল করে সময় কেটে গেল। পাশে বিছানায় পড়ে কাঁদছে রোকাইয়েভা। এক সময় মুখ ফিরিয়ে দাদী সেদিকে তাকালেন। দাদীর দুচোখে দুফোঁটা অশ্রু টলমল করে উঠল। রোকাইয়েভার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদিস না বোন, আমার জামিলভ বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। শহীদ সে। ওর জন্য গর্ব কর।
তারপর দাদী ধীরে ধীরে উঠলেন। জামিলভের কক্ষে এলেন। টেবিলের ওপর জামিলভের একটা বাঁধানো ফটো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন ডিগ্রী নিয়ে বেরোয়, তখনকার তোলা। ফটোটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, কাজ দিয়ে প্রমাণ করে যাবি বলেই কি মুখে কিছু কোনদিন বলিসনি?
দাদীর চোখের এক ফোঁটা পানি ফটোর স্বচ্ছ কাঁচে গিয়ে পড়ল। জানালা দিয়ে আসা সকালের এক টুকরো রোদে তা জ্বল জ্বল করে উঠল।
রোকইয়েভা দাদীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চেখের পানিতে গোটা মুখ তার ধোয়া। তার দিকে চেয়ে দাদী বললেন, জামিলভ তার পূর্ব পুরুষের মান রেখেছে। তোদের মুসলিম পূর্ব পুরষেরা জান দেয়াকে ভয় করেনি, যেদিন থেকে এ ভয় দানা বেঁধে বসল, সেদিন থেকেই আমাদের সর্বনাশের ঘোর অমানিশা শুরু।
আবার কলিং বেল বেজে উঠল। বেরিয়ে গেল রোকাইয়েভা। ফিরে এল হাতে একটি কাগজ নিয়ে। একটা সরকারী নির্দেশ পত্র। রোকাইয়েভার মুখটা যেন বেদনায় আরো নীল দেখা গেল।
কি ওটা? জিজ্ঞেস করলেন দাদী।
একটা নির্দেশ পত্র।
সরকারী নির্দেশ পত্র? কি আছে ওতে?
বিশ্বাসঘাতক জামিলভের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
কান্নায় ভেঙে পড়ল রোকাইয়েভা। দাদী রোকাইয়েভাকে টেনে নিয়ে পাশে বসালেন। বললেন, মন শক্ত কর বোন। আরো অনেক কিছুর জন্য আমাদের প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
একটু থামলেন দাদী। তারপর বললেন, জাতিকে ভালোবাসার বড় বড় কথা অনেক বলেছি, ভালোবাসি যে তার পরীক্ষাও তো দিতে হবে! তোর ভাই তা পেরেছে, তুই পারবি না রোকাইয়েভা?
‘পারবো’ বলে দাদীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রোকাইয়েভা।
তাসখন্দ কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারীয়েটের কমিটি রুম। নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক। মস্কো থেকে ছুটে এসেছেন ‘ফ্র’-এর প্রতিরক্ষা প্রধান কলিনকভ, গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিও’-এর চীফ কুলিকভ এবং মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের প্রধান সার্জি মোকলভ। এই মিটিংয়ে হাজির আছে উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের ‘ফ্র’-এর ফাস্ট সেক্রেটারীদ্বয় এবং দুই রাজ্যস্থ ‘ফ্র’-এর গোয়েন্দা ও পুলিশ প্রধানরা।
‘রিও’ চীফ কুলিকভ বলল, দেশের এই দক্ষিণাঞ্চলে সাম্প্রতিককালে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের কম্যুনিস্ট ব্যবস্থাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই আজকের বৈঠক। মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কলিনকভ এখন এ ব্যাপারে কিছু বলবে।
কলিনকভ নড়েচড়ে বসল। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, দেশের এ অঞ্চলে সম্প্রতি এক সংগে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাকে খুব ছোট করে দেখা যাচ্ছে না। জামিলভ ও আলিয়েভার বিশ্বাসঘাতকতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করতে পারছি না। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার চরিত্র একই রকম- ধর্মীয় স্বকীয়তা বোধের উন্থান। এই উথানটা ডেনজারস। আগুনের মত তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বহুদিন এই চেতনা উৎখাতের জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা উৎখাত হয়নি। গোপনে গোপনে তা সজীব সবল হয়ে উঠেছে। আগে এটা তেমন একটা নজরে পড়তো না, কিন্তু তা এখন নজরে পড়ার মত প্রবল হয়েছে। এ কথাগুলো আপনাদের কারো অজানা নয়, গত দু’বছরের পরিসংখ্যান আপনাদের সবারই নজরে আছে।
একদিকে এই অবস্থা, অন্যদিকে হাসান তারিকের জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং আহমদ মুসা গায়েব হওয়া আমাদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আপনারা জানেন, হাসান তারিক সাইমুমের একজন প্রথম সারির নেতা- যারা ফিলিস্তিনে একটা অসাধ্য সাধন করেছে্ আর আহমদ মুসাতো ফিলিস্তিন ও মিন্দানাও বিপ্লবের নায়ক। সংগঠন গড়ে তোলার একটা যাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে তার। এ ছাড়া গোটা মুসলিম বিশ্বে তার এমন একটা ইমেজ গড়ে উঠেছে যে, সে যেখানেই যায় একটা অপ্রতিরোধ্য আবেগ ও প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেই আহমদ মুসা প্লেন-ক্রাশের পর রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছে। তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধানের পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বাক্স সমেত আহমদ মুসাকে কে বা কারা উদ্ধার করেছে। বিধ্বস্ত বিমানের সব কিছুই আমরা পেয়েছি, একমাত্র ঐ বাক্স ছাড়া। বাক্স উদ্ধারের জন্য পাহাড়, উপত্যকা, নদী এবং নদী তীরবর্তী এলাকা সবই অনুসন্ধান করা হয়েছে। ‘ফ্র’- এর বিশ্বাস, সে এদেশেই আছে।
সুতরাং সব মিলিয়ে আমরা একটা উদ্বেগজনক অবস্থারই আলামত দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থায় আমাদের করনীয় কি তা নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব।
কলিনকভ থামল। এবার কথা বলল মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের প্রধান সার্জি মোকলভ। সে বলল, বর্তমান অবস্থার পেছনে আফগানিস্তানও একটা ফ্যাক্টর। এ সম্পর্কে স্যার কিছু বললে ভালো হত।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। বলল কলিনকভ, ‘তবে এ ব্যাপারে একথা বলাই যথেস্ট যে, আমরা সেদিক থেকে একটা অকল্পণীয় বিপদের সম্মুখীন যা আপনারা সকলেই জানেন। ভাষা, বংশ ও জাতিগত একটা সাদৃশ্যের কারণে আফগানদের ভাব ও মানসিকতা শুধু নয় সেখান থেকে গেরিলা ও চরদের অনুপ্রবেশের ঘটনাও বেড়ে গেছে। তারা ব্যাপকভাবে এদেশে আশ্রয়ও পাচ্ছে।
থামল কলিনকভ। সবাই কিছুক্ষণ নিরব। তারপর প্রথমে কথা বলল কুলিকভ। বলল, ফিলিস্তিন ও মিন্দানাওয়ে সাইমুম যে পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ করেছে সেটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তাদের ব্যাপারে আমাদের কর্মকৌশল ঠিক করা হোক এটা আমাদের প্রস্তাব।
ঠিক বলেছেন। আমি এটা নোট করলাম। কিন্তু এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইতিমধ্যে আমাদের কি করা দরকার?
কুলিকভই আবার কথা বলল। বলল সে, আমরা জামিলভ ও আলিয়েভার ক্ষেত্রে যে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি সেটা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের মুসলিম কর্মচারীদের এ কথা বুঝাতে হবে, বিদ্রোহ তৎপরতার প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা পেলেও তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডের নিচে হবে না। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আমাদের যেটা আছে, ঠিকই আছে। শুধু অতুর্কি অফিসারের সংখ্যা এখানে বাড়াতে হবে। যারা অন্য সব কিছুর সাথে স্থানীয় গোয়েন্দা অফিসারসহ স্থানীয় সকল কর্মচারী ও দায়িত্বশীলের কাজের প্রতিও গোপনে নজর রাখবে। আফগানিস্তানের পথে আসা এবং দেশের গোপন ছাপাখানায় ছাপা ইসলামী সাহিত্যর উৎস ও প্রচার বন্ধের লক্ষ্যেও অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একে বিদ্রোহ তৎপরতার সাথে শামিল করে এ অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডেরই ব্যবস্থা করা উচিত হবে। থামল কুলিকভ।
উজবেক ‘ফ্র’-এর ফার্স্ট সেক্রেটারী বলল, আমি মনে করি বর্তমান অবস্থায় এসব দমনের জন্য কঠোর শাস্তি ও মুসলিম কর্মচারী ও দায়িত্বশীলদের ওপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করা হলেই চলবে। একটা ভীতি সৃষ্টি করা গেলেই সাধারণ মানুষের কাছে বিদ্রোহীরা আর কোন আশ্রয় পাবে না।
তাজিক ‘ফ্র’-এর ফার্স্ট সেক্রেটারী চেরনেংকো মাথা নেড়ে উজবেক সেক্রেটারীর কথায় সায় দিল।
কুলিকভ বলল, উজবেক সেক্রেটারী ভালো প্রস্তাব করেছেন। আমরা স্থানীয় কর্মচারীদের অবিস্বাস করবো না, তবে তাদের ওপর নির্ভর করবো না, এই নীতি আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ‘ফ্র’-এর প্রতিরক্ষা প্রধান কলিনকভ বললো, কুলিকভ সুন্দরভাবে একবাক্যে উজবেক সেক্রেটারীর কথাটাকে প্রকাশ করেছেন। আর আমি আনন্দের সাথে বলছি, আমাদরে বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’- এর মনের কথাটাই আমাদের মুখে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। চিন্তার এই ঐক্যই আমাদের শক্তি। কথা শেষ করে কলিনকভ উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সবাই।