৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

স্পাইশিপ কারকভ। জাম্বুয়াংগো থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সোলো সাগরে ভাসছে। স্পাইশিপ হলেও রীতিমত কমব্যাট জাহাজের সব গুণ-বৈশিষ্ট তার মধ্যে আছে। বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র, সাবমেরিনকে ডেফথ চার্জ করার মত ভয়ংকর টর্পেডো এবং তার সাথে দূর পাল্লার কামান। কারকভের উন্মুক্ত ডেকে খুব সহজেই হেলিকপ্টার উঠা-নামা করতে পারে।
স্পাইশিপ কারকভের একটি কেবিন। বিশ্ব ইনটেলিজেন্স ‘রিও’র ফিলিপিন শাখার প্রধান কাগনোয়াভিচ বসে আছেন তার টেবিলে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ছিলেন তিনি। তার সামনে টেবিলে একটা রিপোর্ট পড়ে আছে। জাম্বুয়াগো থেকে পাঠিয়েছে কেজিবি অপারেটর। রাত ৯টা থেকে পিসিডা তার অপারেশন শুরু করেছে। অপারেশন শুরুর মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে টেলিফোন ও বেতার ভবন ওরা দখল করে নিয়েছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা নগরীতে অভিযান চালিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই পুলিশ যোগাযোগ পথের সবগুলো ব্রিজ-সেতু তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। সেনা ছাউনি অবরুদ্ধ। সংঘর্ষ চলছে।
কাগনোয়াভিচ চোখ খুললেন। সোজা হয়ে বসলেন। আবার চোখ বুলালেন রিপোর্টটিতে। কপাল তার কুঞ্চিত হয়ে উঠল। মনে পড়ল তার কয়দিন আগের কাগায়ান নগরীর কথা। একই নিয়ম, একই ভঙ্গী। কাগায়ানের বিস্তারিত রিপোর্ট তিনি পড়েছেন। ওদের অপারেশন যখন শুরু হয়, তখন করার কিছুই থাকে না। প্রশাসন ও প্রতিরোধের গোটা ব্যাবস্থাই ভেঙ্গে যায় মুহূর্তে। যারা জান দিতে দ্বিধা করে না তাদের সাথে কে পারবে? ফিলিস্তিনে ওরা এই শক্তির বলেই জিতেছে। জাম্বুয়াংগো নগরীর পতন ঘটলে মিন্দানাওয়ে আর পা রাখার কোন জায়গা থাকবে না খৃস্টান সরকারের। অপগন্ড কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান নিষ্ঠুর আচরণে না মাতলে মিন্দানাও হয়তো এত তাড়াতাড়ি হাতছাড়া হতো না। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কথা মনে হতেই আহমদ মুসার কথা মনে পড়ল কাগনোয়াভিচের। নড়ে চড়ে বসল কাগনোয়াভিচ। জাম্বুয়াংগোতে সরকারের পতন ঘটলে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কি আহমদ মুসাকে ধরে রাখতে পারবে, নাকি আহমদ মুসার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই তাদের যা প্রয়োজন সেই রেডিয়েশন বোমার খবর আদায় করে নিয়েছে? শেষের কথাটা মনে জাগতেই তীক্ষ্ণ একটা অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল কাগনোয়াভিচের মন।
এ সময় পাশের ইন্টারকমে ভেসে এল রেডিও রুম থেকে তিখনভ- এর কণ্ঠঃ স্যার, জরুরী মেসেজ আছে, আসতে চাই।
এস। উত্তর দিলেন কাগানোয়াভিচ। ইন্টারকম বন্ধ হয়ে গেল। একটু পরেই কাগজ হাতে ঘরে ঢুকল তিখনভ। নিঃশব্দে কাগজটি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল। একটু ঝুঁকে কাগজটি হাতে নিল কাগনোয়াভিচ। তিখনভ বেরিয়ে গেল।
মেসেজটিতে দ্রুত নজর বুলাল কাগনোয়াভিচ। জাম্বুয়াংগো শহরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। কার্যত পিসিডা’ই এখন শহর নিয়ন্ত্রন করছে। একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে জাম্বুয়াগো’র সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কর্ণেল ভ্যাসিলিভার ও কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান চীফ মাইকেল ফুট বন্দী আহমদ মুসাকে নিয়ে কারকভের দিকে যাত্রা করেছে। ওরা জরুরী ল্যান্ডিং-এর সুযোগ চায়।
‘‘স্পাইশিপ কারকভে ওরা ল্যান্ডিং সুযোগ চায়’-কথাটা ভাবতেই কপাল কুঞ্চিত হলো কাগনোয়াভিচের। সি,আই,এ- এর সাঙাৎরা কারকভে নামবে? প্রকৃতপক্ষে আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়ার জন্য আমরা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কু-ক্ল্যা্ক্স-ক্ল্যানকে এবং ফিলিপিনের কোন সামরিক গোয়েন্দাকে তো আমরা স্পাইশিপ কারকভে স্বাগত জানাতে পারি না।
অস্থির ভাবে উঠে দাঁড়াল কাগনোয়াভিচ। পায়চারী করতে লাগল। হঠাৎ মুখ তার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়ার তুলনায় এই ঝামেলা কিছুই নয়। ফিলিস্তিন বিপ্লবের নায়ক, মিন্দানাও বিপ্লবের নির্মাতা, আজকের বিশ্ব-কম্যুনিজমের এক নম্বর শত্রু আহমদ মুসাকে ‘ফ্র’ (FRW- World Red Forces) দীর্ঘদীন থেকে চায়। তাকে নিয়ে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কি প্রয়োজন! রেডিয়েশন বোমা তার চাই এই তো!
চেয়ারে ফিরে এল কাগনোয়াভিচ। নিজস্ব কোডে দ্রুত একটা মেসেজ ড্রাফট করল। সব জানিয়ে নির্দেশ চাইল সে মস্কোর ‘রিও’ (RIO)- হেড কোয়াটার্সের কাছে। তারপরে ইন্টারকমে ডাকল তিখনভকে মেসেজ পাঠাবার জন্যে।
স্পাইশিপ কারকভের একটি কক্ষ। ঘুমানোর দু’টো ডিভান, সোফাসেট, এটাচড বাথসহ কক্ষটি বেশ বড়। সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে কর্ণেল ভ্যাসিলিভার ও মাইকেল ফুট। গতকাল রাত ১১টায় হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার পর সোজাসুজি তাদের এ ঘরে এনে তোলা হয়েছে। তারপর থেকে এখানে তারা আছে। জাহাজ বলতে তারা এই কক্ষটাকেই বুঝেছে। ব্যাপারটা তাদের জন্য বড়ই অস্বস্তিকর। আহমদ মুসা কোথায় তারা কিছুই জানে না।
কর্নেল ভ্যাসিলিভার কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। দরজা খোলার শব্দ হল। ভেতরে প্রবেশ করল কাগনোয়াভিচ। হাসিমুখে কাগনোয়াভিচ হাত বাড়িয়ে দু’জনার সাথে হ্যান্ডশেক করে সোফায় বসতে বসতে বলল, মাফ করবেন মিঃ ভ্যাসিলি, মিঃ ফুট। গত রাত থেকে কয়েকটা জরুরী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে। জরুরী নির্দেশ এসেছে, ভারত মহাসাগরে যেতে হবে। তার জন্য বেশ কিছু কাজ সারতে হচ্ছে।
থামল কাগনোয়াভিচ। একটু সময় নিয়ে আবার শুরু করল, আপনাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে, এজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি নিরুপায়। সামরিক এই জাহাজে নীতিগত কারণেই আপনাদের গতিনিয়ন্ত্রন করা হয়েছে।
না, না দুঃখের কোন কারণ নেই। ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা হলেও হয়তো এটাই করতাম। বলল কর্নেল ভ্যাসিলিভার।
ধন্যবাদ। বলল, কাগনোয়াভিচ।
তারপর একটু থেমে আবার শুরু করল, মিঃ ফুট, মিঃ ভ্যসিলি আহমদ মুসাকে আপনাদের কেন প্রয়োজন?
রেডিয়েশন বোমার এখনও কোন সন্ধান আমরা পাইনি।
মিন্দানাও তো আপনাদের হাত ছাড়াই হলো, কি করবেন রেডিয়েশন বোমা দিয়ে? ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল কাগনোয়াভিচ।
একটু দ্বিধা করল মাইকেল ফুট। তারপর বলল, কিছু তো আপনি জানেনই। রেডিয়েশন বোমাকে কেন্দ্র করে মার্কিন সরকারের সাথে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের একটা গন্ডগোল চলছে।
চুরি করা বোমাগুলো মার্কিন অস্ত্রাগারে ফেরত দিতে চানতো? মুখে সেই হাসিটা টেনে বলল কাগনোয়াভিচ।
কথাটা তাই। অপরাধীর মত শুনাল মাইকেল ফুটের কন্ঠ।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। মাইকেল ফুট, ভ্যসিলিভারের মুখে-চোখে অস্বস্তি, কিছুটা অপমানেরও প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
কথা আবার কাগনোয়াভিচই শুরু করল। বলল, কথাটা বলে ফেলাই ভাল মাইকেল ফুট। কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম গতকাল ‘ফ্র’-এর সন্ধানী সাবমেরিন ইউনিট রেডিয়েশন বোমাগুলো খুঁজে পেয়েছে। উদ্ধারও করেছে। একটু দম নিল কাগনোয়াভিচ। মাইকেল ফুটের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। সেখানে বিস্ময় ও উদ্বেগ-দুই-ই আছে।
সে দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কাগনোয়াভিচ বলল, ভয়ের কিছু নেই মিঃ ফুট। মস্কোতে যায়নি। এইমাত্র আমাদের সরকার থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, আহমদ মুসাকে ‘ফ্র’ এর হাতে ছেড়ে দিলে রেডিয়েশন বোমাগুলো আপনাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। শুধু পাঁচটি বোমা আমাদের কেমিকেল ল্যাবরেটরীতে যাবে। এই পাঁচটি বোমা সাগর তলে হারিয়ে গেছে বলেও কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান পেন্টাগনের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে।
থামল কাগনোয়াভিচ। কোন কথা যোগাল না মাইকেল ফুটের মুখে। বিমূঢ মনে হলো তাকে। অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে কাগনোয়ভিচ গম্ভীর কন্ঠে বলল, সিদ্ধান্ত আপনাকে দ্রুতই নিতে হবে মাইকেল ফুট। ভেবে দেখুন, আহমদ মুসা ও রেডিয়েশন বোমা দুই-ই আমাদের হাতে। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মংগল চায় বলেই আমাদের সরকার এই অফার দিচ্ছে।
কথা শেষ করে কর্নেল ভ্যাসিলিভারের দিকে চাইল কাগনোয়াভিচ। একটু হেসে বলল, আপনি কিছু বলুন মিঃ ভার।
ভার আগের থেকেই রুষ্ট হয়ে উঠেছিল। কম্যুনিষ্ট অধিপত্যের প্রতি যে সহজাত ঘৃনা ছিল তা বেড়ে গিয়েছিল অনেকগুণ। হাতের মুঠোয় পেয়ে ভালোই খেলছে পুঁচকে গোয়েন্দা। অন্য সময় হলে দেখিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু মনের কথা মনে চেপে মুখে হাসি টেনে মিঃ ভার বলল, ঠিকই বলেছেন মিঃ কাগনোয়াভিচ, আপনার জায়গায় হলে আমিও এ কথাই বলতাম।
সৈনিক সুলভই কথা বলেছেন মিঃ ভার। বলে, হেসে মুখ ফিরাল সে মাইকেল ফুটের দিকে। মাইকেল ফুট গম্ভীর। গম্ভীর কন্ঠেই সে বলল, রেডিয়েশন বোমাগলো কবে, কোথায় পাব আমরা?
ধন্যবাদ মিঃ ফুট। চোখে মুখে খুশী ঠিকরে পড়লো কাগনোয়াভিচের। আবার বলতে শুরু করল, দক্ষিণ সাগরে আমাদের সাবমেরিন বহরে রেডিয়েশন বোমাগুলো রাখা হয়েছে। আপনারা চাইলে উত্তর বোর্ণিও’র কুদাত বন্দর অঞ্চলে আপনাদের যে ঘাঁটি আছে সেখানে আগামীকালই এগুলো পেতে পারেন।
একটু থেমে মুখে একটু বাঁকা হাসি টেনে কাগনোয়াডভিচ বলল, মিন্দানাওয়ের পর ইন্দোনেশিয়াই তো আপনাদের বড় টার্গেট। বোমাগুলো সেখানে আপনারা কাজেও লাগাতে পারেন যা পারেননি আপনারা মিন্দানাওয়ে।
কাগনোয়াভিচের পক্ষ থেকে এই কঠিন বিদ্রুপ সত্ত্বেও তার প্রস্তাবে মনে মনে খুশীই হলো মাইকেল ফুট। আসলে মিন্দানাওয়ের পর সোলো ও সেলিভিস সাগরের আশে-পাশে এটাই তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। এক সময় এখানে পিসিডার খুবই প্রভাব ছিল। এখান থেকে মিন্দানাও ও দ্বীপাঞ্চলগুলোতে পিসিডার জন্য অস্ত্র, অর্থ, খাদ্য সবকিছুই যেত। কিন্তু ইন্দোনেশীয় সরকারের প্রভাবশালী খৃস্টানদের কাজে লাগিয়ে কৌশলে এই অঞ্চল থেকে পিসিডার সব প্রভাব উৎখাত করা গেছে। মনের খুশীটা মনেই চেপে গম্ভীর কন্ঠে মিঃ ফুট বলল, আপনার প্রস্তাব মত আগামীকালই পৌঁছে দিন।
এই সময় দরজা ঠেলে চা নিয়ে ঘরে ঢুকল বেয়ারা। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে নিতে নিতে কাগনোয়াভিচ বলল, দু’ঘন্টার মধ্যে আমরা এখান থেকে যাত্রা করছি। যাবার পথে কুদাত বন্দরেই আমরা আপনাদের নামিয়ে দিতে চাই, কিংবা হেলিকপ্টার নিয়ে আপনারা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।
মাইকেল ফুট বলল, মিঃ ভার হেলিকপ্টার নিয়ে ম্যানিলায় ফিরে যাক। আমি কুদাত বন্দরেই নামব।
মিঃ ভার মাথা নেড়ে এই কথায় সায় দিল।
সবারই হাতে ধুমায়িত চায়ের কাপ। কিন্তু একমাত্র কাগনোয়াভিচ ছাড়া কারোরই মন ধুমায়িত কাপের দিকে নেই বলেই মেন হলো।
কারকভের খোলে ছোট একটি কক্ষে শুয়ে আছে আহমদ মুসা। শোবার ঐ একটি খাট ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে। এটাচড বাথ। সেন্ট্রি দেখিয়ে দিয়ে গেছে বাথরুমের টেপে খাবার পানি পাওয়া যাবে। একটা স্টিলের দরজা ছাড়া কক্ষে আর কোন জানালা নেই। সেন্ট্রাল সাপ্লাই ব্যবস্থা থেকে অক্সিজেন আসছে। না গরম না শীত অবস্থা। ভালই লাগল আহমদ মুসার। ওরা জাহাজের সেফটি সেলকে একেবারে কারাগার বানিয়ে ফেলিনি।
ডাক্তার একবার এসেছিল, ঔষধ দিয়ে গেছে। মাথার তীব্র ব্যাথাটা এখন অনেক কম মনে হচ্ছে। কিন্তু বিরাট ব্যান্ডেজের মাথাটা বেশ ভারি মনে হচ্ছে। আরও ভাল লাগল, রক্ত মাখা পোষাক ওরা পাল্টাবার সুযোগ দিয়েছে। নতুন একজোড়া প্যান্ট-সার্ট দিয়েছে পরার জন্য। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখল, জুতা জোড়া নেই, বদলে এক জোড়া নতুন জুতা দেয়া হয়েছে। আরও খেয়াল করল, হাতের আংটিটিও তার নেই। অর্থাৎ দেহটা ছাড়া নিজের বলতে তার এখন কিছুই নেই। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা, জুতা, জামা-কাপড়, আংটিতে কোন অদৃশ্য রহস্য থাকতে পারে, কাগনোয়াভিচ কোন সুযোগের দ্বারই আহমদ মুসার জন্য খোলা রাখতে চায় না। শিপে আসার পর গত ১৪ ঘন্টায় একবারই মাত্র কাগনোয়াভিচ এখানে এসেছিল। ঠান্ডা গলায় সে বলে গেছে, কারকভকে যেন সে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সেই জাহাজ মনে না করে এবং অবাঞ্চিত কোন কিছু করার মতলব যেন তার না হয়। সে বিরক্ত না করলে তাঁকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছা তাদের নেই।
কাগনোয়াভিচের চোখে চোখ রেখে আহমদ মুসা কথাগুলো শুনেছেন। কথাগুলো তার বিশ্বাস হয়েছে। তার মনে হয়েছে, কাগনোয়াভিচ তাকে বহন করছে মাত্র, তার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তার নেই। সুতরাং আপাতত জীবনযাত্রা তার নিরাপদ।
আর এদের পরিকল্পনা জানার আগে কিছু করার ইচ্ছাও তার নেই। ফিলিস্তিনে কাজ শেষ। মিন্দানাওয়ের কাজও শেষ হয়েছে। গোটা মিন্দানাও এখন পিসিডার নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। মুর হামসারের নেতৃত্বে এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্বাধীন ‘মরো রিপাবলিক’- এর ঘোষণা হয়ে গেছে। তার আর সেখানে কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং এখন কিছু করার আগে চলতি ঘটনা প্রবাহকে জানতে হবে।
পাশ ফিরে শুলেন আহমদ মুসা। স্টিলের খাট, লম্বালম্বি টানা স্প্রিং-এর বেঞ্চের ওপর তোষক পাতা। খাটের স্টিলের পায়া ফ্লোরের স্টিলের মেঝের সাথে স্ক্রু দিয়ে আঁটা। পাশ ফিরে শুতেই বালিশের সাথে সেটে থাকা ডান কান দিয়ে ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ কানে এল, সেই সাথে অনুভূত হলো নতুন এক সূক্ষ্ম কাঁপুনি। আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন। ঠিক জাহাজ এখন চলছে। কিছুক্ষন পর আরো নিশ্চিত হলেন, জাহাজ চলছে। জাহাজ ডান দিকে মোড় নিল স্পষ্ট অনুভব করলেন তিনি। কোথায় কোন দিকে চলছে জাহাজ, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। কিন্তু এখান থেকে স্থান-কাল কিছুই বুঝার উপায় নেই, এমন কি দিন রাতের পার্থক্যও নয়। তবে গত রাত ১১টা থেকে সময় যা গেছে তাতে এখন মধ্যদিন পার হবার কথা।
এ সময দরজায় ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। খুলে গেল দরজা। মনে হলো দরজায় ইলেকট্রনিক কি সিস্টেম রয়েছে, যে ঘরে ঢোকে তার দরজা খুলতে হয় না। সুইচ রুম থেকে অপারেটর সুইচ টিপলেই দরজা খুলে যায়। কিন্তু ঠিক কোন মুহূর্তে দরজা খোলা চাই, একথা সুইচ রুম থেকে জানবে কি করে? তাহলে সব দরজা কি ইলেকট্রনিক ক্যামেরা পাহারা দিচ্ছে? সব ঘরেও কি তাই? আহমদ মুসার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কাগনোয়াভিচ কেন বলেছিল এটা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের জাহাজ নয়, তা বুঝতে পারল। বুঝতে পারল, তার এই শুয়ে থাকাটাও কনট্রোল টিভির পর্দায় তারা দেখতে পাচ্ছে। একবার ভাবল, আলো নিভিয়ে দিলে বোধ হয় তাদের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায়। কিন্তু সুইচ কোথায়? এ ঘরের আলোর নিয়ন্ত্রণ ও তার হাতে নেই। সুইচ থাকলেই বা কি হতো? ইনফ্রা-রেড টিভি ক্যামেরা আলো অন্ধকারের তোয়াক্কা করে না।
দরজা খুলে ট্রলি ঠেলে খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল একজন বৃদ্ধ গোছের লোক। অটুট স্বাস্থ্য। দেখলেই মনে হয় পেটা শরীর, যেন দশজন মানুষের শক্তি তার দেহে। দীর্ঘ দেহী।
লোকটি নিরস্ত্র। দরজাতেও কোন সেন্ট্রি নেই। আহমদ মুসা খেয়াল করল, শিপে আসার পর এ দরজায় কোন সময়েই সেন্ট্রির অস্তিত্ব অনুভব করেননি। রাতে খাবার, সকালে নাস্তা যারা দিয়েছে তাদেরকেও নিরস্ত্রই দেখেছেন। এদের দুঃসাহসে বিস্মিত হলেন আহমদ মুসা। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের বোকামীর জন্য হাসি পেল আবার। টেলিভিশন ক্যামেরা যখন তাকে পাহারা দিচ্ছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া, এমনকি তার চাহনি পর্যন্ত যেখানে তারা কনট্রোল রুমে বসে দেখছে, তখন আর তাদের চিন্তা কিসের? ট্রলিটি খাটের কাছে এনে খাবার সাজিয়ে দিল লোকটি। আহমদ মুসা উঠে বসল। দুপুরের খাবার এসেছে। এখন তাহলে কয়টা? যোহরের নামায তো পড়া হয়নি। এশার নামায সে পড়েছেন ঠিক সময় মতই। ঘুম থেকে উঠে অনুমানেই নামায় পড়ে নিয়েছেন তিনি। কিবলাও ঠিক করতে পারেননি।
লোকটির হাতে ঘড়ি দেখে সময় জিজ্ঞাসা করলেন আহমদ মুসা। লোকটি মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। দেহ ও মুখের গড়নের দিক থেকে লোকটি খাস রাশিয়ান। আহমদ মুসার প্রশ্ন সে বুঝতে পারেনি। বলল, আমি ইংরেজী বুঝি না।
এবার আহমদ মুসা রুশ ভাষায় প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করলেন।
বেলা ২টা। বলল লোকটি। আহমদ মুসা রুশ ভাষা জানে দেখে লোকটির মুখে প্রথমে বিস্ময়, তারপর খুশীর রেখা দেখা দিল। আহমদ মুসা আবার বলল, পশ্চিম কোন দিক, দয়া করে কি বলবেন? লোকটি মুখ তুলল। চোখে তার জিজ্ঞাসা, কিছুটা সন্দেহও। বলল, এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না।
দ্রুত সে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছিল। সাজানো শেষ হলে রুমালে হাত মুছতে মুছতে বলল, পশ্চিম দিক আপনার কেন প্রয়োজন?
আমি মুসলমান। দিনে পাঁচবার নামায পড়ার জন্য কিবলা মুখী হওয়া প্রয়োজন। বলল, আহমদ মুসা।
কিবলা পশ্চিম দিকে?
কিবলা বা কাবা মক্কা নগরীতে। আর মক্কা নগরী এখান থেকে পশ্চিম দিকে।
আচ্ছা, আমি অফিসারকে আপনার কথা জানাব। বলে সে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
খাবারে মনযোগ দিলেন আহমদ মুসা। সাদামাটা খাবার। রুটি, গরুর গোষত, সালাদ, সুপ আর মদ। দুবেলাই মদ ফেরত দিয়েছেন তিনি। তবুও আবার দিয়েছে।
খাবার শুরু করেছেন আহমদ মুসা। এসময় আবার দরজা খোলার শব্দ হলো। দরজা খুলে ঢুকল ন্যাভাল ড্রেস পরা একজন তরুণ অফিসার। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন?
হ্যাঁ, বলল আহমদ মুসা, পশ্চিম কোনদিকে?
কেন?
আমি মুসলমান। কিবলামুখী হয়ে আমাদের নামায পড়তে হয় আপনি জানেন।
অফিসারের মুখে ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি ফুটল যেন। সে হাসিটা অবজ্ঞার, না কৌতুকের বুঝা গেল না। বলল সে, আপনার শোবার খাটটা মোটামুটি ভাবে ঘরের উত্তর দিকেই থাকবে।
ধন্যবাদ। বললেন আহমদ মুসা। অফিসারটি ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দরজা বন্ধ করে সে চলে গেল।
খাবার পর আহমদ মুসা মুখ হাত ধুয়ে অজু করে এলেন। মিনিট দু’য়েক খাটে বসে বিশ্রাম নেবার পর উঠে দাঁড়িয়ে খাবার ট্রলি ঘরের মাঝ বরাবর সরিয়ে নিলেন। বেশ অনেকখানি জায়গা বেরুল। তারপর খাটকে ডান হাতে আর দরজাকে বাঁ হাতে রেখে আহমদ মুসা নামাযে দাঁড়ালেন। মেঝের কার্পেটটা নতুন এবং নরম। নামায এতে হবে কিনা তাঁর জানা নেই। বিকল্প কোন উপায় যখন নেই, তখন আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ অবস্থাকে নিশ্চয় মঞ্জুর করবেন।
নামাযে দাঁড়াতে গিয়ে হাসি পেল তাঁর। আগের দু’টো নামাযে তাঁর দিক ঠিক হয়নি। দক্ষিণমুখী হয়ে নামায পড়েছেন তিনি।
যোহরের শেষ দু’রাকাত সুন্নাত নামাযে সবে দাড়িয়েছেন, কক্ষের দরজা ক্লিক করে খুলে গেল। মনে হলো কে যেন কক্ষের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা নামায শেষ করলেন। তারপর মুনাজাত শেষ করে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন সেই বৃদ্ধ লোকটি দাঁড়িয়ে। দেখছে আহমদ মুসার নামায।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে শোবার বিছানার দিকে ফিরে যেতে যেতে বললেন, ধন্যবাদ আপনাকে, অফিসার পশ্চিম দিক চিনিয়ে দিয়ে গেছে।
মনে হলো কথাগুলো তার কানে গেল না। সে ট্রে’র কাছে সরে এল। বাসন-কোসন গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, আমার আব্বা গির্জায় যেতেন, বাইবেল ছিল আমাদের বাড়ীতে।
এখন নেই?
না।
কেন?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে বলল, আল্লাহ কি সত্যিই আছেন?
সুপরিকল্পিত অপরুপ এই জগৎ কি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ নেই? পাল্টা প্রশ্ন করলেন আহমদ মুসা। কোন জবাব দিল না লোকটি। খাবার ট্রলি ঠেলে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
আহমদ মুসার কেন জানি মনে হলো, বিশ্বাসের আগুন লোকটির মধ্য থেকে এবেবারে নিভে যায়নি। কিন্তু কথা বলতে পারল না কেন? হঠাৎ তাঁর মনে হলো, পাহারাদার টেলিভিশন ক্যামেরার সাথে শব্দ গ্রাহক যন্ত্রও অবশ্যই আছে। এই সাদামাটা কথাটা এতক্ষণ বুঝতে দেরী হওয়ায় নিজের ওপর খুব রাগ হলো তার।
বিছানায় গা এগিয়ে দিলেন আহমদ মুসা। জাহাজ চলছে। সেই একটা সূক্ষ্ণ কাঁপুনি বালিশে স্পন্দন তুলছে। আহমদ মুসা হিসেব কষলেন, কম্পনের ঢেউটা পশ্চিম থেকে ছুটে আসা এবং জাহাজের একটা পাশ যখন মোটামুটি উত্তর দিকেই থাকছে, তথন পশ্চিম দিকেই এগুচ্ছে। অর্থাৎ জাহাজ এগুচ্ছে ভারত মহাসাগরের দিকে। এখন এ কথা তাঁর কাছে পরিস্কার যে, ‘ফ্র’-এর গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিও’ কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবং ফিলিপিন সরকারকে কাঁচকলা দেখিয়েছে। এমন কি হেলিকপ্টারে করে যারা তাঁকে নিয়ে এল তারা নিশ্চয় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পায়নি। হাসি পেল আহমদ মুসার, চোরের ওপর বাটপারী করেছে কে জি বি।
মালাক্কা প্রণালী পার হয়ে তীর বেগে এগিয়ে চলেছে কারকভ। কাগনোয়াভিচ তার চেয়ারে গা এলিয়ে চুরুট টানছে। সন্ধ্যার মধ্যে বোম্বে পৌঁছতে হবে। আরব সাগর সহ গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ‘ফ্র’ নৌবাহিনীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ ইয়েমেন ও সকুত্রা দ্বীপ হাতছাড়া হবার পর মরিশাস ছিল তাদের শেষ অবলম্বন। মরিশাসে ভারতীয় প্রভাব ছিল তাদের স্বার্থের রক্ষাকবচ। কিন্তু মরিশাসের নতুন সরকার ‘ফ্র’ নৌবাহিনীকে শুধু বন্দর-সুযোগ দিতেই অস্বীকার করেনি, সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুমকি দিয়েছে। ফলে ভারত মহাসাগরের এই বিশাল এলাকায় এখন ‘ফ্র’ নৌবাহিনীর পা রাখার জায়গা নেই। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, মরিশাস, সোমালিয়া, আরব উপদ্বীপ এবং পাকিস্তান যে ব্যুহের সৃষ্টি করেছে তাতে ভারতের পশ্চিম উপকূল কার্যত অবরুদ্ধ। বোম্বাই উপকূলে আন্তর্জাতিক জলসীমায় অপরিচিত সব জাহাজের আনাগোনা বেড়ে গেছে। কারকভের ওপর দায়িত্ব পড়েছে এই গোটা ব্যাপারের ওপর নজর রাখার। কারকভের আনবিক চোখকে ফাঁকি দেয়া কারো পক্ষ থেকে সম্ভব নয়। কারকভের ওপর অর্পিত আরেকটা দায়িত্ব হলো, শত্রু পক্ষ থেকে চুরি করা কোড-মেসেজকে ডিকোড করা। আর শত্রুর রেডিও অয়্যারলেস জ্যাম করে দেয়া।
আরো একটা দায়িত্ব রয়েছে, সে কথা মনে হতেই এক ধরনের রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। কারকভের এই শেষ মিশনটা হলো, মার্কিন এডমিরালের সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় ভারতীয় নৌবাহিনীর সাথে লেনদেনের কি চুক্তি হলো তার ইতিবৃত্ত খুঁজে বের করা। মর্কিনীদের সাথে মধুচন্দ্রিমার যে গোপন খায়েশ ভারত সরকারের কারো কারো মনে জেগেছে তাকে রোধ করার দায়িত্ব পড়েছে কারকভের ওপর। এ ব্যাপারে কারকভ এক্সপার্ট। মার্কিন কোডে ভূয়া তথ্য রিলে করে সেই তথ্য ডিকোড করে ভারতকে বুঝাতে হবে যে, ভারতকে বোকা সাজিয়ে রেখে পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকাকে দিয়ে ভারতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সব প্রস্তুতি পশ্চিমীরা সম্পন্ন করেছে। তারপর দেখা যাবে ভারত পাকা ফলের মতই ‘ফ্র’-এর হাতে ধরা দিচ্ছে।
পাশের কম্যুনিকেশন রেডিও থেকে ভেসে আসা একটা মিষ্টি শব্দ কাগনোয়াভিচের ভাব-তন্ময়তা ছিঁড়ে দিল। চুরুটটি তাড়াতাড়ি এ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে রেডিও’র রিসিভারটি তুলে নিল হাতে। টেলিফেনের মতই এ দিয়ে কথা বলা যায়, শুনা যায়।
রিসিভারটি কানে লাগিয়ে কাগনোয়াভিচ বলল, কারকভ থেকে কাগনোয়াভিচ, সকাল ১০ টা। ডাইনে আন্দামান।
ওপর থেকে কথা ভেসে এল, টি কে গ্রীসিন নাম্বার-৩। তাসখন্দের কোড নাম টি. কে.। আর গ্রীসিন নাম্বার-৩ ওখানকার ‘রিও’ চীফ।
আমি শুনতে পাচ্ছি, বলুন বলল কাগনোভিচ।
আমরা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছি, নতুন মিন্দানাও সরকার এ অভিযোগ করেছে। এশিয়া-আফ্রিকার গোটা মুসলিম বেল্টে এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আহমদ মুসা এখানে ‘ফ্র’- এর হাতে না পৌছা পর্যন্ত ঝুঁকি আছে। ভারতেও ওদের শক্তি অনেক। সুতরাং বোম্বাই বন্দরে আহমদ মুসাকে খোলাখুলি ভাবে নামানো চলবে না।
একটু থামল গ্রীসিন। কাগনোয়াভিচ বলল, তাহলে আমাদের প্রতি কি নির্দেশ? – বলছি, গ্রীসিন বলল।
তারপর ঢোক গিলে আবার শুরু করল, বোম্বাইতে তোমরা পৌঁছবে ৭টার দিকে। আমরা আমাদের বোম্বাই কনসুলেটকে বলে দিয়েছে, কারকভ বন্দরে পৌছার সংগে সংগেই একটা বিশেষ কফিন শিপে পৌঁছবে। রাত ৯টায় এ্যারোফ্লোটের বিমান বোম্বাই থেকে ছাড়বে। সুতরাং তার আগেই যেন আহমদ মুসাকে বিমানে পৌঁছানো হয়। এই নির্দেশ আমরা কনসুলেটকেও দিয়েছি। আমাদের একজন অফিসারের লাশ এ্যারোফ্লোটে করে তাসখন্দে পাঠানো হচ্ছে, এ খবর আমাদের কনসুলেট পোর্ট অথরটি ও প্রশাসনকে যথামসেয় জানিয়ে রাখবে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল গ্রীসিন।
আর কিছু নির্দেশ, কমরেড? বলল কাগনোয়াভিচ।
না, আর সব তো তুমি জানই। কোন পরিস্থিতিই যাতে আহমদ মুসাকে এখানে ‘ফ্র’- এর হাতে পাঠানোর পথে বাধা হতে না পারে, সে নির্দেশ আমরা আমাদের কনসুলেটকে দিয়েছি। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সব রকম সাহায্য দেবে।
ওপার থেকে কথা থেমে গেল। সংগে সংগে ‘কট’ করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে নিভে গেল লাল সংকেতটাও।
অথৈই সাগরের নীল পানি কেটে এগিয়ে চলেছে কারকভ তীরের ফলার মত। নীলের শান্ত বুকটি দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে ভেঙে পড়ছে। এক বিরামহীন শব্দ সেখানে। নীলের বুকে বুদ্ধুদের সফেদ সারি দ্রুত সরে যাচ্ছে পেছনে, তারপর আবার এক হয়ে যাচ্ছে নীলের সাথে। বৃদ্ধ দিমিত্রি তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে দিকে তাকিয়ে। সূর্য তখন ২০ ডিগ্রী কোণে ঢলে পড়েছে ভারত মহাসাগরের ওপর। সরল রেখার মত সূর্যের রক্তিম শলাকা এসে চোখে লাগছে। মাথা ঘুরিয়ে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। টেবিল থেকে কলমটি নিয়ে পকেটে পুরে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে।
নাস্তার ট্রলিটি ঠেলে আহমদ মুসার কেবিনে পৌঁছল দিমিত্রি। তাকে প্রবেশ করতে দেখে আহমদ মুসা উঠে বসলেন।
ট্রলিটি ঠেলে আহমদ মুসার একদম সামনে এনে রাখা হলো। সেই একই নাস্তা। দু’ স্লাইস রুটি। এক খন্ড মাখন। কফি।
রুটির প্লেটটি সামনে টানতে গিয়ে মনে হলো তার নিচে ভাঁজ করা একখন্ড কাগজ। চট করে তাকালেন আহমদ মুসা বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধ চোখ নামিয়ে নিল।
বৃদ্ধ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আহমদ মুসা খেতে বসলেন। বাঁ হাতে প্লেট ধরে ডান হাতে খাচ্ছেন এমন একটা ভাব দেখিয়ে সন্তর্পণে প্লেটের নিচ থেকে ভাঁজ করা কাগজটি মুঠোয় পুরলেন।
খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়েছেন আহমদ মুসা। বৃদ্ধ দিমিত্রি ট্রলি নেবার জন্য এল। প্লেট পিরিচ গুছাতে গিয়ে প্লেটের তলা শূন্য দেখে বৃদ্ধের চোখ উজ্জ্বল দেখাল বলে আহমদ মুসার মনে হলো।
ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে গেল দিমিত্রি। ক্লিক করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা বসেই কাগজটির ভাঁজ খুললেন। কিন্তু খুলেই চমকে উঠে হাতের মুঠোতে তা দলা পাকিয়ে ফেললেন। ঘরে টেলিভিশন ক্যামেরার চোখ খোলা আছে তা ভুলেই গিয়েছিলেন আহমদ মুসা।
উঠে তিনি বাথরুমে গেলেন। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে চারদিকে ভালো করে নজর বুলিয়ে দেখলেন, না এমন কোন জায়গা নেই যেখানে টেলিভিশন ক্যামেরার গোপন চোখ সেট করা যেতে পারে। একটা বাথটাব, একটা মুখ ধোয়ার বেসিন এবং একটা পায়খানার বেসিন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আহমদ মুসা বাথটাবের ওপর বসে দলা পাকানো কাগজটির ভাঁজ খুললেন। একটি চিঠি। পড়লেন তিনি-
‘‘সেদিন আপনার জিজ্ঞাসার জবাব দেইনি, কারণ টেলিভিশন ক্যামেরা ও সাউন্ড রেকর্ডারের কাছে ঘরের কিছুই গোপন থাকে না, আপনার মত বুদ্ধিমান লোক তা জানেন। আজ থেকে ১০/২০ বছর আগে হলে আপনার প্রশ্নের উত্তরে না বলতাম। কিন্তু আজ বয়স বাড়ার সাথে সাথে এক অসহনীয় শূন্যতা ও হতাশা অনুভব করছি, অনুভব করছি একজন সক্রিয় স্রষ্টার অস্তিত্ব ছাড়া এর কোন উপশম নেই। আজ রাত ৯টায় বোম্বাই থেকে এ্যারোফ্লোট বিমানে করে আপনাকে তাসখন্দে পাঠানো হচ্ছে। কোথাও পাঠাবার কোন মেসেজ থাকলে তা খাবার প্লেটের নিচে রাখবেন।’’
এক ধরনের টিস্যু পেপারে চিঠিটি লেখা। চিঠি পড়ে মুখ ধোয়ার বেসিনে তা ফেলে দিয়ে পানির টেপ খুলে দিলেন। অজু করে নিলেন আহমদ মুসা। অল্পক্ষণ পরেই কাগজের কোন অস্তিত্ব বেসিনে আর থাকল না। তোয়ালে দিয়ে মুখ হাত মুছে বেরিয়ে এলেন তিনি।
বৃদ্ধ দিমিত্রির চিঠি নতুন দিগন্ত খুলে দিল আহমদ মুসার সামনে। তিনি তাহলে তাসখন্দ যাচ্ছেন? অজান্তেই যেন এক শিহরণ জাগল তাঁর মনে। মাতৃভুমি সিংকিয়াংকে কতদিন দেখেনি। গোটা মধ্য এশিয়াই তো তুর্কিস্থান-তাঁর মাতৃভূমি। বিধ্বস্ত একটা জাতির আবাসভূমি মধ্য এশিয়া। নিপীড়নের কত ঝড়, কত সাইক্লোন বয়ে গেছে সেখানে। মনটা তাঁর অধীরে হয়ে উঠল। আমুদরিয়া, শিরদরিয়ার দেশ, দুর্লংঘ পাহাড়, দুর্গম মরুভূমি আর সোনাফলা উপত্যকার দেশ, দুর্ভাগা উজবেক, তাজিক, তাতার, কিরঘিজ ও কাজাখদের দেশ মধ্য এশিয়ার এক দুর্নিবার আকর্ষণ তাঁকে টানছে। হাসান তারিকের কথাও তাঁর মনে পড়ল। তাকে ‘ফ্র’ কোথায় রেখেছে? যেখানেই রাখুক, সে বেঁচে থাকলেই হয়।
মাগরিবের নামাযের বোধহয় কিঞ্চিৎ দেরী আছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন আহমদ মুসা। চোখ দুটো বন্ধ করলেন। মনের পর্দায় তাঁর ভেসে উঠল হিন্দুকুশ আর তিয়েনশান পর্বতমালার শেষহীন সারি। তার দু’পাশে অসংখ্য মুসলিম জনপদ। যেন সব আপন জনদের তিনি দেখতে পাচ্ছেন। চোখের কোণ দুটি তাঁর ভারি হয়ে উঠল। তিনি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শুকরিয়াহ আদায় করলেন তাঁকে এই সুযোগ দিয়ে দয়া করার জন্য। আল্লাহ যেন তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত এই মযলুম মুসলমানদের কাজে লাগান, এই প্রার্থনা করলেন। বৃদ্ধ দিমিত্রির কথা তাঁর মনে পড়ল। হাসি পেল একটু। মেসেজ লিখবে কিভাবে? কালি-কলম কোথায়? ভাবল আহমদ মুসা, বৃদ্ধকে বলে দেবেন সুযোগ পেলে তাঁর খবরটা মিন্দানাও অথবা ফিলিস্তিন সরকারকে সে যেন জানিয়ে দেয়। বোম্বাই-এর ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ’ অফিসে জানালেও চলবে।
মনে হলো ঘরের আলোটা আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল। সূর্য কি তাহলে ডুবল? মাগরিব নামাযের জন্য উঠে বসলেন আহমদ মুসা। নামায পড়ে উঠে দেখলেন, মেঝেতে কার্পেটের ওপর তার নিজের জামা-কাপড় পড়ে আছে। ধুয়ে পরিষ্কার করা। কে, কখন রেখে গেছে খেয়াল করেনি আহমদ মুসা।

Top