৪০. কালাপানির আন্দামানে

চ্যাপ্টার

অন্ধকুপের মত ঘরটি।
ডিম লাইটের মত একটা আলো জ্বলছে ঘরের মাঝখানে। সে আলো ঘরের সামান্য অংশেরই অন্ধকার তাড়াতে পেরেছে। আলোকিত অংশটিও ধোঁয়াটে। এর বাইরে ঘন অন্ধকারের দেয়াল।
ভীতিকর পরিবেশ।
মেঝেতে পড়ে আছে একটা তরুণের দেহ। বয়স বাইশ-তেইশের মত। একহারা বলিষ্ঠ দেহ। সুন্দর চেহারা। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ।
তার দেহ রক্তাক্ত। চাবুকের ঘায়ে ফেটে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত শরীর।
সংজ্ঞাহীন তরুণটি।
তার পড়ে থাকা দেহের ঠিক উপরে ছয় সাত ফিট উঁচুতে একটু দূরত্বের দুটি শিকল ঝুলছে। দুই শিকলেরই প্রান্তে হ্যান্ডকাফ লাগানো। হ্যান্ডকাফ দুটিও রক্তাক্ত। বুঝাই যাচ্ছে হ্যান্ডকাফ দুটি তরুণের দুহাতে লাগানো ছিল। দুই শিকলে তার দুহাত বেঁধে টাঙিয়ে রেখে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এক সময় ধীরে ধীরে চোখ খুলল যুবকটি। চোখ খুলে কোন দিকে চাইল না সে। উর্ধমুখী অবস্থায় তার চোখ খুলেছিল, দৃষ্টি তার উর্ধমুখী হয়েই থাকল।
তরুণটির মুখ থেকে কাতর কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল, ‘পানি’, ‘পানি’, ‘পানি’।
অন্ধকারের দেয়াল ভেদ করে তিনজন লোক এগিয়ে এল তরুণটির কাছে।
তাদের পরনে কালো প্যান্ট, কালো শার্ট এবং মাথায় তাদের ভারতের ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোদের মত কালো কাপড় বাঁধা।
কাছে এসে তাদের একজন বলল, ‘শাহজাদার জ্ঞান ফিরল তাহলে। জয় হোক শাহজাদা আহমদ শাহ আলমগীরের।’ তার মুখভরা বিদ্রুপের হাসি।
সে থামতেই আরেকজন বলে উঠল, ‘সম্রাজ্য কবে অক্কা পেয়েছে, আগ্রা দূর্গে কবে উড়েছে বৃটিশ পতাকা, এখন সেখানে উড়ছে ভারতের ত্রিরঙ্গা। কিন্তু এদের নামের বাদশাহী যায়নি! নাম রেখেছে আহমদ শাহ আলমগীর!’ বলে লোকটি হো-হো করে হেসে উঠল।
তরুণটির ক্লান্ত, কাতর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে চাও, মেরে ফেল। অনেককেই তো মেরেছ। দেরি করছ কেন?’
‘মরতে তোমাকেই হবেই। তুমি আমাদের মারাঠী কন্যা, পবিত্র নামে যার নাম সেই জিজা’র উপর তোমার অপবিত্র নজর ফেলেছ। মরতে তোমাকে হবেই। কিন্তু তার আগে আমাদের মহাবাপুজী ‘শিবাজী’র তৈরি ভবিষ্যত সম্পর্কিত ‘নীল নক্সা’র আধার ক্ষুদ্র চন্দন বাক্সটি আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। যতক্ষণ বা যতদিন তা না দেবে, ততদিন শতবার মৃত্যু চাইলেও তোমার মৃত্যু আমরা দেব না। কিন্তু দেব মৃত্যুর চেয়ে বড় যে কষ্ট, সেই কষ্টের পাহাড়।’
‘বার বার তোমাদের আমি বলেছি, বাক্সটা কি আমি জানি না। বাক্সটি আমি দেখিনি। এমন কোন বাক্স আমাদের কাছে নেই। তোমরা আমার বাড়ি সার্চ করে দেখতে পার।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তোমাদের বাড়িতে খোঁজা আমরা অবশ্য বাকি রাখিনি। গত এক বছরে তোমাদের বাড়িতে কয়েকবার ঢুকেছি। সব জায়গা সার্চ করেছি। সন্দেহজনক সবকিছু নিয়ে এসেছি। কিন্তু বাক্সটা পাইনি। তোমরা ওটা মাটির তলায় কিংবা অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছ।’ বলল সেই তিনজনের একজন।
‘আমি এ সম্বন্ধে কিছুই জানি না। আমি আমার আব্বা, দাদার কাছেও এমন বাক্স সম্পর্কে কোন গল্প শুনিনি। তোমাদের মহাবাপুজী’র এই বাক্স আমাদের কাছে আসবে কেন?’ আহমদ শাহ আলমগীর বলল।
‘আসবে কেন আমরাও জানতাম না। কিন্তু এক বছর আগে আমরা নিশ্চিত জেনেছি। আগেই আমরা শিবাজী পৌত্র ‘শাহুজী’র এক দলিল থেকে জানতাম, শাহুজীকে বন্দী করার সময় সম্রাট আওরঙ্গজেব এই বাক্সটিও শাহুজীর কাছ থেকে কেড়ে নেন। তারপর এ বাক্সটি অজানার অন্ধকারে চলে যায়। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ রেংগুনে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ঘটনাক্রমে তার ডাইরীটি একজন ভারতীয় পুরোহিতের হাতে পড়ে যায়। এই পুরোহিত ছিলেন বোম্বাই-এর একশ দশ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত শিবাজীর জন্মস্থান শিবন গিরি-দুর্গস্থ মন্দিরের সেবায়েত। সেবায়েত ডাইরীটিকে অতি-যতœ করে মন্দিরের এ্যান্টিক্স বিভাগের আলমারিতে রেখে দেন। গত বছর এই ডাইরীটি আমাদের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু এক সদস্যের চোখ পড়ে যায়। তিনি ডাইরীটির ফটো নিয়ে আসেন। এই ডাইরীর এক স্থানে সম্রাট বাহাদুর শাহ লিখেছেন, ‘আল্লাহর শোকর যে, বাক্সটি আমি শাহজাদা ফিরোজ শাহ-এর হাতে তুলে দিতে পেরেছি। আমাদের শাহজাদাদের মধ্যে ফিরোজ শাহ-ই সবচেয়ে ধর্মভীরু, দেশপ্রেমিক, সাহসী ও সংগ্রামী চরিত্রের। বাবরের সাহস, আকবরের দেশপ্রেম এবং আওরঙ্গজেবের ধর্মভীরুতা ও দৃঢ়তার অপূর্ব সমাবেশ তার মধ্যে আমি দেখেছি। আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে ওরা মোঘল রাজত্বের ইতি ঘটাতে চায়। মোঘল সাম্রাজ্য হয়তো এরপর থাকবে না। তবু আমার দায়িত্ব হিসাবে ভারতের মুসলমানদের পক্ষে মোঘল সম্রাজ্যের রক্ষক হিসাবে ফিরোজ শাহকেই আমি নির্বাচন করতে চাই। মোঘলদের গোপন অর্থভান্ডারের নক্সা ও চাবি, তুরষ্কের খলিফার পক্ষ থেকে মোঘল শাসন কর্তৃত্বের সনদ এবং শিবাজীর বাক্স তারই প্রাপ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, শিবাজীর বাক্সটি আমাদের কাছে এমন সম্পদ হয়ে উঠল কেন? কারণটা বলি। শিবাজীর বাক্সে রয়েছে কতগুলো বিচ্ছিন্ন তা¤্রলিপি। তা¤্র লিপিগুলো দুর্বোধ্য সংকেতের অনুসরণে একত্রিত করলে পাওয়া যায় শিবাজীর এক স্বপ্ন কাহিনী। সে কাহিনী বিভেদ, বিদ্বেষ এবং হিংসার। ভারতে শত শত বছরের মুসলিম শাসন হিন্দু-মুসলমানদের সহযোগিতা ও সহাবস্থানের যে অপূর্ব সমাজ সৃষ্টি করেছে, শিবাজীর স্বপ্ন তা ভেঙে দিয়ে মুসলমানদের সাথে তারা বৌদ্ধদের মত আচরণ করতে চায়। এই ধ্বংসাত্মক দলিলটি সম্রাট আওরঙ্গজেব ‘শাহুজী’র হাত থেকে উদ্ধার করার পর একে বংশীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এভাবেই শিবাজীর বাক্সটি মোঘলদের একটি পারিবারিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। যাক এ দিকের কথা। আমি শিবাজীর বাক্সের মধ্যেই পুরলাম মোঘল ধন-ভান্ডারের নক্সা ও চাবি এবং মোঘল রাজত্বের সনদপত্র। শাহজাদা ফিরোজ শাহ তখন দিল্লীর বাইরে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তৎপরতায় ব্যস্ত। বৃটিশদের তখনও পর্যন্ত অজানা গোপন পথ দিয়ে তাকে আগ্রা দুর্গে নিয়ে এলাম। সব জানিয়ে তার হাতে তুলে দিলাম বাক্সটি। তার সাথে সাথে তাকে দিলাম আমার মাথার মুকুট। তাকে বললাম পারলে ওটা তুমি পরো। না পারলে ওটা তুমি এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সমাধিতে রেখে দিয়ে তাঁকে জানিয়ো, আমরা তার অযোগ্য উত্তরসূরীরা পারছি না তার দেয়া দায়িত্বভার বহন করতে।’ এখানে শেষ বাহাদুর শাহের বাক্স সংক্রান্ত উক্তি। অনেক অনুসন্ধানের পর জেনেছি, শাহজাদা ফিরোজ শাহ ভারতের দেশীয় রাজা জমিদারদের উস্কিয়ে বিরোধী যুদ্ধ সংগঠিত করতে গিয়ে এক পর্যায়ে ধরা পড়েন এবং আন্দামানে নির্বাসিত হন। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পোর্ট ব্লেয়ারে নামার সময় তার লাগেজের যে লিষ্ট করা হয়, তার মধ্যে চন্দন কাঠের সেই বাক্সটি ছিল। জেল কর্তৃপক্ষ শাহজাদার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ঐ বাক্সসহ সব কিছুই তাকে ফেরত দেন। সুতরাং বাক্সটি তোমার আব্বার কাছে আছে। এখন বাক্সটি তোমার কাছে।
দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করল লোকটি।
‘চন্দন কাঠের কেন, কোন ধরনের বাক্সই আমার কাছে নেই।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর জোরের সাথে।
চিৎকার করে উঠল সেই লোকটিই। বলল, ‘খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না। মুখ একেবারে গুড়ো করে দেব।’ বলে সে প্রচ- এক ঘুসি চালাল আহমদ শাহ আলমগীরের মুখে।
ঠোঁটের কোণ কেটে গেল এবং নাক ফেটে বেরিয়ে এল রক্ত।
দুহাত মুখে চাপা দিয়ে যন্ত্রণা হজম করার চেষ্টা করল আহমদ শাহ আলমগীর।
তিনজনের অন্য আরেকজন বলল, ‘তোমার মা মোপলা বংশের তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তাহলে তোমার মা তো তোমার চেয়ে শক্ত হবে, তাই না?’
কথা বলল না আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তোমার বোনের নাম কি?’
‘আর্জুমান্দ শাহ বানু।’
‘বয়স কত?’
এ প্রশ্নের জবাব দিল না আহমদ শাহ আলমগীর।
‘সে তো সুষমা রাও এর সাথে চেন্নাই-এর ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তোমার বোনই বোধ হয় তোমার ও ‘সুষমা রাও’-এর মধ্যে দুতিয়ালী করেছে?’
‘না।’ পরিষ্কার জবাব দিল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তাহলে তুমিই সুষমা রাও এর ঘাড়ে চেপেছ? হায়দরাবাদের ইউনিভার্সিটি অব টেকনলজিতে তুমি পড়। এই ঘাড়ে চাপার জন্যেই বোধ হয় তুমি ঘন ঘন চেন্নাই আস?’
‘না। আমি আন্দামানে ফেরার সময় ওদিক দিয়ে বোনকে নিয়ে আসি এবং যাবার সময় তাকে ওখানে রেখে যাই।’
‘মোপলাদের রয়েছে আরবীয় সৌন্দর্য আর মোঘলদের তুর্কি সৌন্দর্য। এই দ্ইুয়ের সমাহার আর্জুমান্দ শাহ বানু তাই না?’
এই প্রশ্ন করে লোকটি থামতেই ওদের তিনজনের তৃতীয়জন বলে উঠল। এত ভনিতা না করে আসল কথাটাই বলে ফেল না। আগামী কালের মধ্যে বাক্সের সন্ধান আমরা যদি না পাই, তাহলে বেগম আর্জুমান্দ শাহ বানুকে আমরা এখানে নিয়ে আসবো। তারপর জান তোমার সামনে কি ঘটবে!’
‘তোমরা আমাকে নির্যাতন করো, মেরে ফেল আমাকে। কিন্তু আমার বোনের গায়ে তোমরা হাত দিতে পারবে না।’ উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘তোমাকে মেরে ফেলে আমাদের লাভ নেই। আমরা চাই বাক্স। ওটা এখন আমাদের প্রাণ। ওতে শুধু আমাদের ‘মহাবাপুজী’র পবিত্র দলিলই নেই, আছে মোঘল ধন-ভা-ারের চাবী। ঐ ধন-ভান্ডারের মালিক এখন আমরা। আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করছি, তুমি মুখ খোলনি। গ-ারের চামড়া তোমার গায়, আর গাধার মত তোমার সহ্য শক্তি। এবার আমরা দেখব, বোনকে শেষ হয়ে যেতে দেখলে তোমার এই সহ্যশক্তি কতক্ষণ থাকে।’
‘তোমরা বিশ্বাস কর, আসলেই আমার কাছে বাক্সটি নেই।’ কাতর কণ্ঠে বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
তার কথা শেষ না হতেই চিৎকার করে উঠল ওদের তিনজনের একজন, ‘বলেছি না যে, নেই, জানি না- এই ধরনের কথা আর উচ্চারণ করবে না।’ বলে সে সর্বশক্তি দিয়ে এক লাথি মারল আহমদ শাহ আলমগীরের পাঁজরে।
অন্য একজন বলে উঠল, ‘চল আমরা এখন যাই। কাল সকালে এসে শেষ কথা শুনে যাব। যদি মুখ না খোলে তাহলে যা ঘটার তাই ঘটবে।’
আরেকজন বলল, ‘ঠিক আছে আমরা এখন যাচ্ছি। মনে রেখ, তোমার মৃত্যু নেই। তোমার বোন যাবে, তারপর তোমার মা যাবে, কিন্তু তুমি থাকবে।’
বলেই সে অন্ধকারের দিকে তাকাল। বলল, ‘শোন তোমরা, একে পানি খাইয়ে যাও। আর এর হাত-পা বেঁধে রাখ। আর সর্বক্ষণ এর উপর চোখ রাখবে।’
ওরা তিনজন যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার অন্ধকারের দেয়ালের আড়ালে হারিয়ে গেল।
উদ্বেগ-আতংকে তখন আহমদ শাহ আলমগীরের চোখ-মুখ বিস্ফোরিত। তার মনে একটুও সন্দেহ নেই, ওরা যা বলেছে তাই করবে। কিন্তু কি করবে সে! কি করে রক্ষা করবে তার বোনকে, তার মাকে আর নিজেকে! আহমদ শাহ আলমগীর এখন বুঝতে পারছে, এরা বিরাট-বিশাল এক চক্র। শুধু আন্দামান নয়, গোটা ভারতে এরা ছড়িয়ে আছে। আত্মসমালোচনার আদলে সে ভাবলো, সুষমা রাওকে ভালবেসে কি সে নিজের পরিবারকে, নিজের জাতিকে বিপদে ফেলল! কিন্তু তার এতে দোষ কি! ওরা যা বলল সেভাবে আমি ওর ঘাড়ে চাপিনি। একটি হৃদয়ের পবিত্র আবেগকে, পবিত্র আকাক্সক্ষাকে সে স্বীকৃতি দিয়েছে মাত্র। জানি মারাঠী কন্যা, ব্রাহ্মণ কন্যা, জানি সে চির মোঘল বৈরী ও হিন্দু-রাষ্ট্র-চিন্তার আধুনিক জনক শিবাজীর বিখ্যাত পেশোয়া পরিবারের সন্তান, কিন্তু এসব পায়ে দলেই তো সে এসেছে। সে আমার দরজায় নক করেছে, আমি দরজা খুলে দিয়েছি মাত্র। এমনই ঘটে, ঘটেছে। আমাদের আন্দামানে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে কেউ কোনদিন কথা তোলেনি, কারও কাছেই এ বিষয়টা কোন ইস্যু ছিল না। এখন এ বিষয়টা বড় হয়ে উঠল কেন? কারা এরা? আন্দামানে কি তাহলে শান্তির দিন, স্বস্তির দিন শেষ হয়ে গেল?
উদ্বেগ-আর্তক আরও শতগুণ বেড়ে ঘিরে ধরল আহমদ শাহ আলমগীরকে। অসহায় মন তার ডেকে উঠল আল্লাহকে। আল্লাহর সাহায্যই শুধু তাদেরকে বাঁচাতে পারে, অটুট রাখতে পারে আন্দামানের শান্তি ও স্বস্তির জীবনকে। ভারতের সিকি শতক রাজ্য ও ৭টি ইউনিয়ন এলাকার মাত্র এক আন্দামান-নিকোবরই ছিল সব দিক দিয়ে অখ- এক শান্তির টুকরো, শান্তির দ্বীপ। একেও কি এখন অশান্তি এসে গ্রাস করবে!
আহমদ শাহ আলমগীরের চিন্তা আর এগুতে পারলো না। দুজন ষ্টেনগানধারীর পাহারায় একজন লোক পানি নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল।
তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল আহমদ শাহ আলমগীরের। পানি দেখার পর যেন সে পাগল হয়ে উঠল। প্রায় কেড়ে নিল পানির বোতল। ঢক ঢক করে গিলতে লাগল পানি বোতল থেকে। এক নিঃশ্বাসেই বোতল সে শেষ করে ফেলল।
আহমদ শাহ আলমগীর বোতল হাতে ধরা থাকতেই ওরা তার হাতে হ্যা-কাফ ও পায়ে শিকল পরিয়ে লক করে দিল।
ওরা ওদের কাজ শেষ করে যেমন যন্ত্রের মত এসেছিল, তেমনি যন্ত্রের মত চলে গেল।
আহমদ শাহ আলমগীর গা এলিয়ে দিল মাটিতে।

জিজা সুষমা রাও এর দুচোখ থেকে অঝোর ধারায় নামছে অশ্রু।
সুষমা রাও ভারতীয় একটি ইউনিয়ন টেরিটোরী আন্দামান-নিকোবর-এর গভর্নর বালাজী বাজী রাও মাধব-এর একমাত্র মেয়ে। বয়স বিশ-একুশ বছর হবে। দুধে-আলতা রংয়ের নিরেট আর্য-ব্রাহ্মণ কন্যা সে। তার সৌন্দর্যের অপরূপ সুষমার পাশে তার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বে রয়েছে এক সম্মোহনী শক্তি। কিন্তু অবিরল অশ্রুর বন্যায় সব কিছুই তার ঢেকে গেছে।
মুখ নিচু করে কাঁদছে সুষমা রাও।
তার পাশেই বসে তার মা ভারতী রাও। প্রবল অস্বস্তিতে ভরা বেদনা জর্জরিত তার মুখ।
তাদের সাথে সামনে সোফায় বসা বালাজী বাজী রাও মাধব। সবাই তাকে বিবি মাধব বলেই জানে। ক্রোধ-অসন্তুষ্টির প্রবল ছায়া তার চোখে মুখে। সে কথা বলছিল সুষমা রাওকে উদ্দেশ্য করে।
সুষমা রাও কান্নায় ভেঙে পড়লে সে থেমে গিয়েছিল। আবার শুরু করল সে। বলল, ‘মা, তুমি কি জান, তোমার নামের প্রথম অংশ ‘জিজা’ কার নাম?’
‘জি বাবা। শিবাজীর মার নাম।’ অশ্রুরোধের চেষ্টা করে বলল সুষমা রাও।
‘শুধু শিবাজী বললে তার অসম্মান হয় মা। তিনি আমাদের জাতির নতুন রাজনৈতিক জাগরণ ও সামরিক উত্থানের মহান জনক। তিনি আমাদের মহাবাপুজী। যাক। শোন, তোমার ‘জিজা’ নাম তোমার দাদু রাখেন। এর পেছনে এক স্বপ্ন তাঁর মধ্যে কাজ করেছে। মহান শিবাজী আধুনিক হিন্দু জাতির স্রষ্টা হলে, তার মা জিজা মহাশিবাজীর ¯্রষ্টা। তোমার নাম জিজা রাখার মাধ্যমে তোমার দাদু চেয়েছেন, জিজার মতই তুমি জাতিস্বার্থ দেখবে, জাতিকে ভালবাসবে। কিন্ত তুমি একি করলে মা, আমাদের আবহমান এক শত্রু পরিবারের প্রত্যক্ষ এক উত্তরাধিকারীকে তুমি ভালবেসেছ! ওদের বিরুদ্ধে মহান শিবাজী, তার পুত্র ‘শম্ভুজী’ এবং শম্ভুজীর পুত্র ‘শাহুজী’ আজীবন লড়াই করে গেছেন। সব কিছুই করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব কিন্তু এই মোঘল পরিবারকে বন্ধু বানানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কি করে সম্ভব? তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধের দগদগে স্মৃতি একজন মারাঠী কিংবা একজন হিন্দুও তার মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। সেই সর্বগ্রাসী পানিপথ যুদ্ধে আমরা ৪০ হাজার বললেও প্রকৃতপক্ষে ২ লাখ মারাঠী মারা গিয়েছিল। মারা গিয়েছিল আমাদের ৪০ জন সেনাপতি। তোমার প্র-পিতামহ পেশোয়া বালাজী বাজী রাও এর বড় ছেলে বিশ্বাস রাও ছিলেন পানিপথ যুদ্ধের নেতা। তিনি নিহত হন। নিহত হন প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও। এই আঘাত সহ্য করতে পারেননি বালাজী বাজী রাও। অসুস্থ হয়ে তিনিও মারা গেলেন। পানিপথ যুদ্ধের পর মারাঠীদের এমন কোন বাড়ি ছিল না, যেখানে ক্রন্দনের রোল ওঠেনি। আর এই পানিপথই ধ্বংস করে দিয়ে যায় হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন।’
‘কিন্তু বাবা, মাফ করবেন আমাকে। এই যুদ্ধের জন্যে মোঘলারা কতটুকু দায়ী? কেন সেদিন আমরা গিয়েছিলাম দিল্লী দখল করতে? এই অভিযানই তো এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধ ডেকে আনে।’ বলল সুষমা রাও কান্নাজড়িত কণ্ঠে।
‘আমরা দিল্লী দখল করতে না গেলে, তারা আসত মারাঠা দখল করতে। থাক এ কথা। আমার নামটাও তোমার দাদু ‘বালাজী বাজী রাও মাধব’ রেখেছিলেন কোন উদ্দেশ্যে জান? আমার নামের প্রথম অংশ তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধে আমাদের হৃদয়বিদারক পরিণতির প্রতীক এবং শেষ অংশ ‘মাধব’ আমাদের জাতির বিপর্যর কাটিয়ে উত্থানের স্মারক। কারণ বালাজী বাজী রাও-এর এক পুত্র মাধব রাও পরাজিত শক্তিকে সাময়িকভাবে হলেও সংহত করেছিলেন এবং অল্প সময়ের জন্যে হলেও মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে অনেকটা আশ্রিত করে তার মাধ্যমে দিল্লীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুতরাং দেখ, তোমার দাদুর মধ্যে কতবড় জাতীয় ও পারিবারিক আবেগ ছিল। এই আবেগ আমাদের প্রত্যেক মারাঠীর মধ্যে থাকা উচিত। তুমি এর এক ইঞ্চিও বাইরে যেতে পার না।’
গভর্নর বিবি মাধব থামলে সুষমা রাও কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবা এনিয়ে আমি এখন আপনার সাথে কোন তর্ক করব না। সে সময় এখন নয়। বাবা, আহমদ শাহ আলমগীরকে আপনার বাঁচাতে হবে। আমার যদি সত্যিই অপরাধ হয়ে থাকে, আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি গ্রহণ করব। আমি মরতেও রাজী আছি। বাবা, আপনি ওঁকে বাঁচান। আপনাদের রাষ্ট্রীয় শক্তি ছাড়া সন্ত্রাসীদের হাত থেকে কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আপনি দয়া করে তাকে উদ্ধারের উদ্যোগ নিন।’
বলতে বলতে সুষমা রাও ছুটে গিয়ে তার বাবার পায়ের কাছে বসে তার বাবার কোলে মুখ গুঁজল। নিঃশব্দ কান্নায় সে ভেঙে পড়ল।
এক ধরনের বিক্ষোভ ও বেদনায় ভারী হয়ে উঠেছে বিবি মাধবের মুখ। সে কান্নারত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে তুলে পাশে বসাল। বলল, ‘মা, ওকে শুধু ‘আলমগীর’ বলবে। আহমদ শাহ নয়। ঐ নাম শুনলে আমার বুক ফেটে যায়। মোঘলরা আমাদের প্রতিপক্ষ, কিন্তু আহমদ শাহ আবদালী সবচেয়ে বড় খুনি। তৃতীয় পানিপথে আমাদের বিপর্যয়ের কারণ এই আহমদ শাহ আবদালী। সেই খুন করেছে আমাদের বিশ্বাস রাও, সদাশীব রাওকে, ৪০ জন সেনাপতিকে এবং দুলাখ আমাদের ভাইকে।’
বলতে বলতে আবেগ-প্রবণ হয়ে উঠেছিল বিবি মাধব।
বোধ হয় নিজেকে শামলে নেবার জন্যেই একটু থামল সে। একটু পর শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘স্যরি মা, প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম। শোন মা, আলমগীরের শত্রুর সংখ্যা বিশাল, তাদের শক্তিও অসীম। সে নিখোঁজ হবার পরই পুলিশ তার উদ্ধারের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছে না।’
‘কিন্তু বাবা, এ পর্যন্ত অনেকগুলো রহস্যজনক খুন হয়েছে আন্দামান নিকোবরে। আমি চেন্নাই-এ থাকতেও কাগজে এসব পড়েছি। কিন্তু পুলিশ কোন সুরাহা করতে পারেনি। সুতরাং সাধারণ পুলিশ তৎপরতার দ্বারা আলমগীর উদ্ধার হবে বলে আমি মনে করি না।’
‘কিন্তু মা, এই কাজের জন্যে আমার হাতে পুলিশ ছাড়া আর কি আছে?’
‘সিবিআই-এর লোকরা এসে আবার চলে গেল কেন?’
‘তারা বলেছে, খুনগুলো সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং স্থানীয় শত্রুতা জনিত। কোন ষড়যন্ত্র বা বিশেষ কোন উদ্দেশ্য এর পেছনে নেই। এসবের তদন্তের জন্যে স্থানীয় পুলিশই যথেষ্ট।’
‘কিন্তু আলমগীর কোন শত্রুতাজনিত কারণে কিডন্যাপ হয়েছে, এটা কেউ মনে করছে না। আমিও মনে করি না। আশ-পাশের দ্বীপসহ পোর্ট ব্লেয়ারে আলমগীর এমন এক এবং একমাত্র ছেলে যার কোন শত্রু নেই। তার কিডন্যাপ অবশ্যই ষড়যন্ত্রমূলক। নানা কার্য কারণ থেকে এই কথা আমি নিশ্চিত করেই বলছি বাবা।’
‘সে ষড়যন্ত্রটা কি হতে পারে বলে তুমি মনে কর?’ বলল সুষমা রাও এর পিতা গভর্নর বিবি মাধব সোজা হয়ে বসে।
‘আমি তা জানি না বাবা। কিন্তু সাম্প্রতিক রহস্যজনক যে খুনগুলো হয়েছে তারা সবাই মুসলমান। ব্যাপারটাকে আমি কাকতালীয় বলে মনে করি না। আবার একটা কিডন্যাপের ঘটনা ঘটল সেও মুসলমান। আমার মনে হয়, খুনগুলো ও কিডন্যাপের উৎস একই হতে পারে।’
‘তোমার কথা তোমার কল্পনাও হতে পারে। পুলিশ তো তোমার মত করে ভাবছে না।’
‘সুতরাং বাবা, পুলিশ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আপনাকে কেন্দ্রের সাহায্য চাইতে হবে। আপনি তাড়াতাড়ি এই ব্যবস্থা করুন বাবা।’
‘তোমার বাবার ক্ষমতা সীমাহীন নয় বেটা। বিশেষ করে সিবিআই যে মন্তব্য করে চলে গেছে। তারপর দিল্লীর সাহায্য পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে গেছে। চাপ দিলেই বলবে পুলিশকে কেন কাজে লাগাচ্ছি না।’
‘তাহলে?’ সুষমা রাও-এর গলা কান্নায় জড়িয়ে গেল।
সুষমার বাবা বিবি মাধব পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি দেখছি মা। আমাদের গোয়েন্দা দফতরের সাথে তোমার চিন্তা নিয়ে আলোচনা করে দেখি তারা কি বলে? কিন্তু তোমাকে আবার একটা কথা বলছি মা, তুমি সব কথা বলেছ। আন্দামান সরকার চেষ্টা করবে তাকে উদ্ধারের জন্যে। তোমার কাছ থেকে কিন্তু তার সম্পর্কে আর কোন কথা আমি শুনব না। মারাঠী রাও পরিবারের কেউ কোন মোঘল সন্তান সম্পর্কে দুর্বলতা দেখাবে এটা অপমানজনক। এই অপমানকর কিছু যেন আর কানে না আসে।’
বলেই ওঠে দাঁড়াল বিবি মাধব। বেরিয়ে গের পারিবারিক ড্রইং রুম থেকে।
পিতা বেরিয়ে গেলেও পাথরের মত স্থির বসে থাকল সুষমা রাও। তার চোখে-মুখে বিস্ময়-বেদনা, আতংক-উৎকণ্ঠা ও অপমানের একটা সয়লাব এসে যেন আছড়ে পড়ল। তার মনে হলো, তীরে নামার সিঁড়ি এক সাথে ভেঙে পড়ল। উত্থাল সাগরে সব সহায় যেন তার কাছ থেকে সরে গেল। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
তার মা ভারতী রাও এসে তার পাশে বসল। মেয়েকে বুকে টেনে নিল। বলল, ‘ধৈর্য ধর মা। তোমার বাবার কথা নিয়ে মন খারাপ করার প্রয়োজন নেই। এখনকার প্রশ্ন হলো, আলমগীর উদ্ধার হওয়া, অন্যকিছু নয়।’
‘তাহলে তার উদ্ধার সম্পর্কে তো আম্মা কোন কথা বলতে পারবো না বাবাকে। তার মানে সে উদ্ধার হবে না, এটাই বাবা বোঝাতে চেয়েছেন।’ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল সুষমা রাও।
‘এভাবে বলো না মা। সব চেষ্টার পরও তো উদ্ধার নাও হতে পারে। এমনও তো হতে পারে, উদ্ধার চেষ্টা শুরুর আগেই সে নি……।’ কথা শেষ করতে পারল না সুষমার মা ভারতী রাও। সুষমা রাও মায়ের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ বুঝেছি, সর্বনাশা কথাটা উচ্চারণ করো না, মা। তোমরা সবাই বোধ হয় এটাই চাচ্ছ।’
বলে উঠে দাঁড়িয়ে সুষমা রাও ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভারতী রাও উঠে সুষমার পেছনে পেছনে ছুটল।

চেন্নাই থেকে আন্দামানগামী জাহাজে উঠতে গিয়ে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। একটা দেশ থেকে বের হবার সময় যে ধরনের চেকিং হয় তার সবই এখানে করা হচ্ছে। পাসপোর্ট চেকিং, ভিসা চেকিং, লাগেজ চেকিং থেকে শুরু করে আন্দামান-নিকোবরে প্রবেশের জন্যে কি ধরনের অনুমতি দেয়া হয়েছে তাও তারা দেখছে।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top