আহমদ মুসা ইতিমধ্যেই জেনেছে আন্দামানে প্রবেশের জন্যে চার ধরনের অনুমতি আছে। ট্যুরিষ্টরা শুধুমাত্র তালিকা অনুযায়ী ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো ভিজিটের অনুমতি পায়। ব্যবসায়ীরা পোর্ট ব্লেয়ারের বাইরে কোথাও যাবার অনুমতি পায় না। আন্দামান-নিকোবর-এর বাসিন্দাদের জন্যেও অনুমতিপত্র আছে। কিছু কিছু এলাকায় বিনা অনুমতিতে তাদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এছাড়া এক ধরনের বিশেষ অনুমতিপত্র আছে। এই অনুমতি প্রাপ্তরা আন্দামান-নিকোবরের সব জায়গায় যেতে পারে। তবে ট্রাইবাল এরিয়া ও রস দ্বীপে যাবার আগে পুলিশকে শুধু জানাতে হয়।
আহমদ মুসা শুধুমাত্র আমেরিকান সরকারের কল্যাণে ভারতের ওয়াশিংটন দূতাবাসের মাধ্যমে এই বিশেষ অনুমতিপত্র পেয়েছে। আর এটা বিশেষভাবে সম্ভব হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সৌজন্যে।
আর এটা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার আরেকটা সুবিধা হয়েছে আহমদ মুসা মুসলিম নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করেনি। আসার আগে মুসলিম নামের পাসপোর্ট বাদ দিয়ে যুডীয়-খৃষ্টান নামের একটা নতুন পাসপোর্ট দিয়েছে এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন। এই পাসপোর্টে তার নাম হয়েছে ‘বেভান বার্গম্যান’। পাসপোর্টে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে ‘পরিবেশবাদী’ ও ‘পুরাতত্ববিদ’ হিসাবে। ভিআইপি ভিসা পেয়েছে সে।
এই পাসপোর্ট ও ভিসার কারণেই সে যথেষ্ট খাতির পেল কাউন্টারে গিয়ে। পাসপোর্ট দেখেই বডিচেকিং ও লাগেজ চেকিং না করেই তাকে ছেড়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসা জাহাজে উঠল। বিরাট জাহাজ।
জাহাজের টপ ফ্লোরে ভিআইপি কক্ষ নিয়েছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা জাহাজে ঢুকে উপরে ওঠার জন্যে এগুচ্ছিল। কথা কাটাকাটির শব্দ কানে এল তার। তাকিয়ে দেখল, জাহাজের লবীতে দুজন লোক একজন লোককে জাহাজ থেকে নামিয়ে নেবার জন্যে টানাটানি করছে। যাকে টানাটানি করছে তার পরনে পাজামা-শেরোয়ানী। মাথায় রামপুরী টুপী। মুখে ছোট করে ছাটা দাড়ী।
লোকটি প্রতিবাদ করছে, যুক্তি দেখাচ্ছে। কিন্তু কে শোনে প্রতিবাদ, যুক্তি। লোক দুজন তাকে আগে জাহাজ থেকে নামিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। বলছে, চল নিচে নেমে সব কথা শুনব। চারিদিকে সব লোক দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখছে। কেউ কিছু বলছে না, প্রতিবাদ করছে না।
লোক দুজন লোকটিকে টেনে-হেঁচড়ে নামিয়ে নিতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা ওপরে না উঠে এগুলো লোকদের দিকে।
তাদের সামনে গিয়ে আহমদ মুসা যারা টেনে-হিঁচড়ে নিচ্ছে লোকটিকে তাদের উদ্দেশ্যে বলল ইংরেজীতে ‘আপনারা কি পুলিশের লোক?’ আহমদ মুসা শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠে বলল।
লোক দুজন লোকটিকে ছেড়ে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি একজন আমেরিকান ট্যুরিষ্ট। নাম ‘বেভান বার্গম্যান।’ ইংরেজীতেই কথা বলছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসর ঋজু কণ্ঠ ও প্রশ্নের ধরন এবং অযাচিত পরিচয় দেয়ার নির্ভীক ষ্টাইল দেখে ও পরিচয় পেয়ে ওরা বোধ হয় দ্বিধাগ্রস্ততার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।
তাদের দু’জনের একজন বলল, ‘না, আমরা পুলিশের লোক নই। আমরা………..।’
লোকটিকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তাহলে কি আপনরা গোয়েন্দা?’
লোক দুজনের চোখে-মুখে বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। সেই লোকটিই আবার দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘না, আমরা গোয়েন্দা নই।’
আহমদ মুসা এবার তাকাল যাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে নিচ্ছিল তার দিকে। তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি এদের চেনেন? কোন লেন-দেন আছে এদের সাথে?’
‘না, এদের আমি চিনি না। কোন দিন এদের সাথে দেখাও হয়নি। লেন-দেনের তো প্রশ্নই ওঠে না।’ বলল লোকটি দ্রুত ও স্পষ্ট কণ্ঠে।
আহমদ মুসা ফিরে তাকাল লোক দুজনের দিকে। বলল, ‘আপনারা ওঁকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন কেন? আপনারা কি এ জাহাজের যাত্রী?’
ওদের একজন বলল, ‘না, আমরা যাত্রী নই।’
যাত্রী না হলে জাহাজে আপনারা প্রবেশ করলেন কেমন করে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
লোক দুজন তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিল না।
চারদিকে দাঁড়ানো লোকদের মধ্যে গুঞ্জন আগেই শুরু হয়েছিল তা এ সময় সরব হয়ে উঠল। কয়েকজন বলল, ‘এরা নিশ্চয় হাইজ্যকার।’
কয়েকজনের এই কথার রেশ ধরে এবার সবাই বলে উঠল, ‘নিশ্চয় হাইজ্যাকার এরা। পুলিশ ডাক। পুলিশে দাও এদেরকে।’
হৈ চৈ শুনে জাহাজের কয়েকজন এগিয়ে এল। সব শুনে তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ‘ঠিক আছে, এদেরকে পুলিশে দিচ্ছি। কি করে জাহাজে ঢুকল সেটাও দেখছি।’
বলে লোক দুজনকে ধরে তারা জাহাজ থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল।
শেরোয়ানী পরা লোকটি দুহাত জোড় করে চারদিাকের সবার শুকরিয়া আদায় করে আহমদ মুসার কাছে এসে দুহাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যার, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। ওরা নিশ্চয় আমাকে হাইজ্যাক করত। আরও কি করতে জানি না।’ বলতে গিয়ে লোকটি কেঁদে ফেলল।
সবাই তাকে সান্তনা দিল।
আহমদ মুসাকেও সবাই ধন্যবাদ দিল। বলল, ‘কি হচ্ছে, কি করতে হবে আমরা বুঝতেই পারছিলাম না।’
আহমদ মুসা লোকটির পিঠ চাপড়ে, সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে উপরে ওঠার জন্যে সিঁড়ির দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা কেবিনে গিয়ে ব্যাগ, ইত্যাদি গোছগাছ করে রেখে ঘণ্টাখানেকের মত গড়িয়ে নিল। তারপর ডেকলাউঞ্জে চলে এল। উদ্দেশ্য সমুদ্রের উন্মুক্ত সান্নিধ্য উপভোগ করা। কাছে থেকে সমুদ্রের লোনা স্বাদ গ্রহণ অনেক দিন ভাগ্যে জোটেনি।
রেলিং-এর ধার ঘেঁষে একেবারে প্রান্তের সারিতে এক ডেক চেয়ারে বসল আহমদ মুসা।
সামনে আদিগন্ত সমুদ্র। সীমাহীনতার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ভাল লাগে আহমদ মুসার।
সেই ভাল লাগার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
‘হ্যাল্লো মি. বার্গম্যান’-বাম দিক থেকে বাম কানের উপর আছড়ে পড়া শব্দে আহমদ মুসার আনমনা অবস্থা ভেঙে পড়ল।
তাকাল আহমদ মুসা বাম দিকে। দেখল, বয়ষ্ক এবং ভদ্র চেহারার একজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। বয়স পঞ্চাশের কম হবে না। স্বাস্থ্য ভাল। বয়সের চিহ্ন তার চেহারার উপর নেই।
আহমদ মুসার মনে বিস্ময়, লোকটি তার নাম জানল কি করে। দুএকদিনের মধ্যে কোথাও তার সাথে দেখা হয়েছে কিনা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে লোকটির দেখা মিলল না।
লোকটিও বুঝতে পেরেছে আহমদ মুসার অবস্থা। বলল, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না, এই ঘণ্টাখানেক আগে আমি আপনাকে চিনেছি।’
বলতে বলতে লোকটি আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কথা শেষ করেই সে বলল, ‘আপনার পাশে বসতে পারি মি. বার্গম্যান?’
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে সলজ্জ হেসে বলল, ‘অবশ্যই। বসুন। ওয়েলকাম।’
লোকটি বসল।
লোকটি হ্যান্ডশেকের জন্যে আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি শ্রী গংগাধর তিলক। আমি পোর্ট ব্লেয়ারের ‘ব্লেয়ার মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট হাইস্কুল এন্ড কলেজ’-এর প্রিন্সিপাল।’
পোর্ট ব্লেয়ারের সরকারী হাইস্কুল এন্ড কলেজ-এর প্রিন্সিপাল জেনে খুব খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে।
কিন্তু আহমদ মুসার আগেই শ্রী গংগাধর তিলকই আবার বলে উঠল, ‘এক নিমিষেই কখনো কখনো এক যুগের পরিচয় হয়ে যায়। সে রকমই হয়েছে। আপনি আমার ছেলের বয়সী হলেও এক নিমিষেই আমি আপনার ভক্ত হয়ে গেছি। দুঃখ যে, আপনার মত মানুষ লক্ষ নয়, কোটিতেও একজন পাওয়া যাবে না। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল গংগাধর তিলক।
‘স্যার, প্রতিবাদ করার মত লোক অনেক আছে, কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তারা সামনে এগোয় না। যদি তারা মনে করতো যে কোন অবস্থায় আইনকে পাশে পাওয়া যাবে, তাহলে প্রতিরোধ-প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে কেউ দ্বিধা করতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। ঠিক রোগ ধরেছেন আপনি। আইনের সহায়তা তো দূরে থাক, বাদী হতে গিয়ে আসামীও হতে হয়।’
বলে একটু থামল। আবার বলে উঠল, ‘আপনি আমেরিকান আপনার কাছেই শুনলাম। আন্দামান যাচ্ছেন সরকারী কোন কাজে, না ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে?’
‘বেড়ানের উদ্দেশ্যে।’
‘কম্যুনিকেশন কিন্তু খুব ভাল নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায়ে হাঁটা ও নৌকায় বেড়ানোর প্রধান মাধ্যম।’
‘এ দুটো মাধ্যমই আমার পছন্দনীয়।’
‘তাহলে আর কথা নেই।’
আহমদ মুসা শুরু থেকেই ভাবছিল। আন্দামানের বর্তমান সম্পর্কে কিছু জানার ইনি ভাল মাধ্যম হতে পারেন। আহমদ মুসা আলোচনার বিষয়টাকে ঐ দিকেই ঘুরিয়ে নিতে চাইল। বলল, ‘আমি জানতাম আন্দামান-নিকোবর শান্তি ও সম্প্রীতির একটা দ্বীপ। ভারতের যে কোন এলাকার চাইতে এখানকার সামাজিক পরিবেশটা ভাল। কিন্তু আসার আগে আমি ইন্টারনেটে পড়লাম, আন্দামানে সম্প্রতি বেশ কিছু রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে এবং জনপ্রিয় একজন ছেলে সম্প্রতি নিখোঁজ হয়েছে। বিষয়টা জেনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ব্যাপার কি বলুন তো?’
শ্রী গংগাধর তিলক তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। তার চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনি ঠিকই শুনেছেন। তবে একটু কম শুনেছেন। সৌদি আরবের একটা এনজিও একটা ছোট্ট দ্বীপ ভাড়া নিয়ে সেখানে একটা কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিল। কমপ্লেক্সটা সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে। এই সব ঘটনা আন্দামানের ইতিহাসকেই কলংকিত করেছে। বিশেষ করে আহমদ শাহ আলমগীর-এর নিখোঁজ হওয়া আন্দামানের সকলের মনকেই নাড়া দিয়েছে। ছেলেটি আমার প্রতিষ্ঠান থেকেই পাশ করেছে। সে অত্যন্ত ভাল ছাত্র এবং আমার প্রিয় ছাত্র ছিল। সে এক অবিশ্বাস্য চৌকশ ছেলে। সে কোন পরীক্ষায় মেযন দ্বিতীয় হয়নি, তেমনি কোন খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় সে কখনও দ্বিতীয় হতো না। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর সে খেলাধুলা ছেড়ে দেয়। না হলে খেলাধুলার বহু আইটেমে সে জাতীয় দলে স্থান পেয়ে যেত। সবাই মনে করত, ছেলেটি আন্দামান নিকোবরের মুখ উজ্জ্বল করবে। আহমদ শাহ আলমগীরের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা আন্দামানবাসীদের জন্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত।’
‘তার নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে আপনি কি মনে করছেন? মানুষ কি মনে করছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মনে করা হচ্ছে এই ভাল করাটাই তার জন্যে কাল হয়েছে। হিংসা পরবশ হয়ে কেউ এই কাজ করতে পারে।’
‘ছেলেটির কে আছে, তাদের বাড়ি কোথায়?’
‘ছেলেটির মা আছে, এক বোন আছে। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনও আছে। পোর্ট ব্লেয়ারের পশ্চিমে কাছেই হারবারতাবাদে তার পৈত্রিক নিবাস।’
‘আপনি এই যে রহস্যজনক মৃত্যুর কথা বললেন এবং এই যে ছেলেটি নিখোঁজ হলো, এসবের জন্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি? তদন্তের খবর কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, গ্রেফতার হয়নি।’
‘সাংঘাতিক ব্যাপার। তাহলে চক্রটি বেশ বড় নিশ্চয়। আন্দামান তো নিরাপদ নয়। আগে জানলে…………।’ কৃত্রিম একটা ভয় চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার।
কিন্তু আহমদ মুসা কথা শেষ করার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে শ্রী গংগাধর তিলক বলল, ‘না, না, ভয় করার কোন কারণ নেই। ঘটনাগুলো খুব দুঃখজনক হলেও আপনার জন্যে সান্তনার যে, আহমদ শাহ আলমগীরের নিখোঁজ হওয়াসহ রহস্যজন মৃত্যুর যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলোর শিকার মুসলমানরা। অন্য কোন ধর্মের লোকের কোন ক্ষতি হয়নি।’
‘শুধু মুসলমানরা শিকার হয়েছে? কেন?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল আহমদ মুসা নিপুণ এক অভিনেতার মত।
‘কেন আমি জানি না। কিন্তু এটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে।’ বলল গংগাধর তিলক।
‘ভারতের অন্যান্য এলাকার মত এখানে শিবসেনা, আর.এস.এস ইত্যাদির মত সংগঠন গোপনে তৈরি হয়েছে নিশ্চয়?’
‘এ ধরনের কোন প্রকাশ্য সংগঠন নেই। গোপনে থাকার যে কথা বলছেন, সেটা আমি জানি না।’ বলল গংগাধর তিলক।
‘আন্দামান-নিকোবর তো কেন্দ্র শাসিত। কেন্দ্রের নিয়োগ করা গভর্নর এখানকার শাসন পরিচালনা করেন। বিষয়টি কি গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল না গংগাধর তিলকের কাছ থেকে। কি যেন ভাবছিল। তার ঠোঁটে অস্পষ্ট এক টুকরো হাসি। বলল, ‘কি বলব বলুন। বেশির ভাগ লোকের ধারণা গভর্নরের ইংগিতেই কিডন্যাপ-এর ঘটনা ঘটেছে। কারণ গভর্নরের মেয়ের সাথে তার প্রেম আছে। গভর্নর বিবি মাধব ছেলেটাকে পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্যেই এটা করেছেন। কিন্তু আমার মতে ঘটনা তা নয়।’
‘কেন নয় বলছেন জনাব?’ আবার আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘যেদিন সে কিডন্যাপ হয় সেদিন আমাদের কলেজে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গভর্নর বিবি মাধব। কৃতিছাত্র হিসাবে আহমদ শাহ আলমগীরের শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের পুরষ্কার নেবার কথা ছিল। এ অনুষ্ঠানে আসার পথেই আলমগীর নিখোঁজ হয়ে যায়। সেদিনের গোটা সময়ের গভর্নর সাহেবের কথা-বার্তা, আচার-আচরণের আমি সাক্ষী। শিক্ষকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মানুষ সম্পর্কে আমার যতটুকু জানা হয়েছে, তার ভিত্তিতেই আমি বলছি আলমগীরের সেদিনের কোন ঘটনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না। এরপরও যদি জড়িত থাকেন, তাহলে বলতে চাই, তার চেয়ে বড় অভিনেতা আর নেই।’ বলল গংগাধর তিলক।
কথা শেষ করেই গংগাধর তিলক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি একটু যাই, কাজ আছে। আপনার সাথে কথা বলে খুব খুশি হলাম। আপনি শুধু সাহসী ও প্রতিবাদী নন, খুব সজ্জন ব্যক্তি বলেও আমি মনে করি আপনাকে। আমার প্রতিষ্ঠানে একদিন আসুন। আরো কথা হবে।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আপনার ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পেলে খুবই খুশি হবো।’
গংগাধর তিলক চলে গেল।
আহমদ মুসা দুধাপ এগিয়ে রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে চাইতে গিয়ে তার চোখে পড়ল, সেই শেরওয়ানীধারী যুবক কিছুটা দূরে রেলিং-এ দুহাতের কনুই ঠেস দিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে আছে।
শেরওয়ানীধারী যুবকও এদিকে তাকিয়েছে। সেও দেখতে পেল আহমদ মুসাকে।
দেখতে পেয়েই সে দ্রুত এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
কাছাকাছি হয়ে বলল, ‘স্যার বোধ হয় ভিআইপি কেবিনে আছেন?’
আহম মুসা খুব খুশি হয়েছে যুবককে এভাবে এখানে পেয়ে। আন্দামানের মুসলমানদের ব্যাপারে গংগাধর তিলকের চেয়ে অনেক বেশি জানা যাবে এই যুবকের কাছ থেকে। তাছাড়া তার আক্রান্ত হওয়ার কারণ কি, এটাও রহস্য হয়ে আছে আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা যুবকটির প্রশ্নের হ্যাঁ সুচক জবাব দিয়ে বলল, ‘আসুন, বসে কথা বলা যাক।’
‘ধন্যবাদ স্যঅর, আমেরিকাকে জানার আমার খুব আগ্রহ। এক স্বপ্নের দেশ বলতে পারেন ওটা আমার।’
বলতে বলতে দুজনে এক সাথে এগিয়ে এসে পাশাপাশি বসল।
বসেই যুবকটি বলে উঠল, ‘স্যার নিশ্চয় এশিয়ান- আমেরিকান? কোন দেশের?’
‘আপনিই বলুন কোন দেশের।’
‘তুরষ্ক থেকে মিসর পর্যন্ত কোন দেশের বংশোদ্ভুত হবেন।’
‘যথেষ্ট বুদ্ধি করে কথা বলেছেন। বুঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান রাখেন। এখন বলুন ঐ লোকদের সম্পর্কে। তারা কোথাকার এবং আপনার উপর চড়াও হয়েছিল কেন?’
‘লোকগুলো অবশ্যই ভারতের।’ বলে যুবকটি চুপ করল।
‘প্রশ্নের এক অংশের জবাব হলো, অন্য অংশের?’
‘আমি তো আগেই বলেছি তাদের চিনি না, তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি স্যার।’ বলল যুবকটি।
‘আপনার নামটাই কিন্তু এখনও জানা হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি। জি, আমার নাম, ‘ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহ।’
‘সুন্দর নাম। আপনার বাড়ি কি আন্দামানে?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘কি করেন?’
‘কিছু করতাম, এখন করি না।’
‘কি করতেন?’
‘গ্রীন আইল্যান্ডের রাবেতা কমপ্লেক্স মসজিদের একজন ইমাম এবং সেখানকার ইসলামিক স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলাম।’
ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহর পরিচয় পেয়ে আহমদ মুসা ‘মেঘ না চাইতে জল পাওয়া’র মত আনন্দিত হলো। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। বলল কিছু না জানার ভান করে, ‘ছিলেন মানে? এখন সেখানে ইমাম ও শিক্ষক হিসাবে নেই? চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন?’
যুবকটি গম্ভীর হলো। গভীর বেদনার ছায়া পড়ল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘রাবেতার সে কমপ্লেক্স ধ্বংস হয়ে গেছে। মসজিদ নেই, স্কুল নেই এবং আমার চাকুরীও নেই।’
‘ধ্বংস হয়েছে মানে? কিভাবে ধ্বংস হলো?’ বলল আহমদ মুসা মুখে কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে।
‘কে বা কারা একরাতে গোটা কমপ্লেক্সের মূলোচ্ছেদ করে সেখনে গাছ-পালা লাগিয়ে দিয়েছে। বুঝাই যায় না সেখানে কোন স্থাপনা ছিল। শুধু ধ্বংসই নয়, রাবেতার কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আন্দামান ও ভারতের নয়, তাদের রাতারাতিই এক জাহাজে তুলে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহ বলল।
‘কোন প্রতিবাদ-প্রতিকার হয়নি এই অবিচারের?’
‘কে প্রতিবাদ-প্রতিকার করবে? যারা করতে পারতো, তাদের তো দ্বীপ থেকে বাইরে চালান করে দেয়া হয়েছে। পরে অবশ্য রাবেতা দিল্লী সরকারের কাছে প্রতিবাদ করে প্রতিকার দাবী করেছে। দিল্লী প্রতিকার কিছু করেনি, বরং বলেছে, এ রকম কোন সংস্থা আন্দামানে আছে বা ছিল তা দিল্লী সরকারের জানা নেই, আন্দামান কর্তৃপক্ষও জানাতে পারেনি।’ যুবকটি বলল বেদনাপীড়িত কণ্ঠে।
‘সাংঘাতিক ব্যাপার? এই ধ্বংসের পিছনে সরকারের যোগ-সাজস আছে? না খোদ সরকারই এটা করেছে?’
‘কিছ জানি না। জানার চেষ্টা করতেও পারিনি। যদিও আমার বাড়ি আন্দামানে, তবু সেই রাতে আমাকে অন্য সবার সাথে আন্দামানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এতদিন নানা কারণে ফিরতে পারিনি। আজ ফিরছি।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে ভাবনার ছাপ। বলল, ‘আন্দামানে কোথায় বাড়ি আপনার? কে আছে সেখানে?’
‘পোর্ট ব্লেয়ারের দক্ষিণে ছোট শহর কালিকটে আমার বাড়ি। সেখানে আমার আব্বা-আম্মা ছাড়া আর কেউ নেই।’
ভাবনা দূর হয়নি আহমদ মুসার চেহারা থেকে। ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহ থামতেই সে বলে উঠল, ‘যারা আপনাদের রাবেতা কমপ্লেক্স ধ্বংস করেছে, তারাই কি চেন্নাই বন্দরে আপনাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছিল?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহর চোখে-মুখে। বলল, ‘আমি তো এইভাবে জিনিসটাকে দেখিনি। হতে পারে তারাই ঘটনা ঘটিয়েছে। আমি আন্দামানে যাই তারা তা নাও চাইতে পারে। তবে অন্যেরাও এ ঘটনা ঘটাতে পারে। বিশেষ করে মুসলমানরা এখানে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে এমন হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়।’
‘আপনি আন্দামানে কেন ফিরছেন? পরিবারের কাছে, না আরও কিছু করণীয় আছে আপনার?’
‘রাবেতা কমপ্লেক্স ধ্বংসের ব্যাপারে একটা কেস দায়ের করব। পুলিশ কিছু করলে তাদের সহযোগিতা করব। আর কিছু নয়। রাবেতা বলেছে পোর্ট ব্লেয়ারের কোন মসজিদকে কেন্দ্র করে ছোট-খাট অফিসের মাধ্যমে রাবেতার কিছু কাজ চালু রাখতে।’
‘আন্দামানে রাবেতার অফিস ধ্বংসের মত কাজ কে বা করা করতে পারে, এ ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা আছে কি?’
‘ধারণার জন্যে কিছু তৎপরতা চোখে পড়া দরকার। কিন্তু এমন কোন বৈরী বা সন্দেহ করার মত তৎপরতা কখনই চোখে পড়েনি। আন্দামান-নিকোবর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মানব হিতৈষী এনজিও হিসাবে রাবেতা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিল। এ সংস্থার দিকে কাউকে কখনও বৈরিতা তো দূরে থাক প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেও দেখিনি।’
‘কিন্তু আকস্মিকভাবে এমন ঘটনা ঘটা কি সম্ভব?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সম্ভব নয়, কিন্তু ঘটেছে?’
‘আপনি বলছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, কিন্তু এরই মধ্যে কয়েকজন মুসলিম যুবক খুন হয়েছে, আহমদ শাহ আলমগীর কিডন্যাপ হয়েছে, এর ব্যাখ্যা তাহলে কি?’
‘এ সবই অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। তবে হ্যাঁ, এগুলো সাম্প্রদায়িক ঘটনাও হতে পারে, তবে তা এখনও প্রমাণ হয়নি। রাবেতা অফিস ধ্বংস হবার মতই এগুলো রহস্যপূর্ণ। বিশেষ করে আহমদ শাহ আলমগীরের নিখোঁজ হওয়া সকলের মনকেই নাড়া দিয়েছে।’
‘আহমদ শাহ আলমগীর সম্পর্কে আপনি কি জানেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘খুব ভাল ছেলে। মাথা যেমন ভাল, তেমনি ভাল তার লিডারশীপ কোয়ালিটি। দেশ ও মানুষের উপকার হয়, এমন সব ক্ষেত্রেই তার অগ্রণী ভূমিকা। মনে হয় কয়েক জেনারেশন পর তার মধ্যে প্রকৃত মোগল রক্ত নতুন করে জেগে উঠেছে।’
‘এবড় জনপ্রিয় ছেলের শত্রু কে হতে পারে? কারও সাথে তার এমন কোন ঘটনা ছিল যারা এটা করতে পারে?’
‘সে পড়তো অন্ধ্র প্রদেশের হায়দরাবাদে। বাড়িতে ছুটি-ছাটার সময় আসতো। তার এমন শত্রু আন্দামানে ছিল বলে মনে হয় না।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি এখন উঠতে চাই। আপনাকে আবার আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ বলে উঠে দাঁড়াল ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহ।
চলতে শুরু করেই সে আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, সময় যদি পান, আমার বাসায় এলে খুব খুশি হবো।’ বলে সে তার একটি নেমকার্ড আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে আবার চলতে শুরু করল।
মনে মনে আহমদ মুসা বলল, সময় না পেলেও আপনার বাড়িতে যেতে হবে। আপনার সাথে দেখা করতে হবে বন্ধু।
এ বিষয়ে ভাবতে গিয়ে খুশি হলো আহমদ মুসা। আন্দামান গোটাটাই তার কাছে অন্ধকার ছিল। হোটেল ছাড়া কোন ঠিকানা তার জানা ছিল না। এখন তিনটি ঠিকানা তার হাতে। একটি গংগাধর তিলকের হাইস্কুল এন্ড কলেজ, দ্বিতীয়টি ইমাম ইয়াহিয়া আহমাদুল্লাহর বাড়ি এবং তৃতীয়টি নিখোঁজ আহমদ শাহ আলমগীরদের বাসার ঠিকানা। তাছাড়া সুষমা রাও সম্পর্কেও কিছু জানা গেছে। আহমদ শাহ আলমগীর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুষমা জানতে পারে।
মন প্রসন্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অনেক হালকা লাগল মনটাকে।
আবার সে দৃষ্টি ফেরাল সামনের আদিগন্ত সমুদ্রের দিকে।
আদিগন্ত সমুদ্র যেখানে আকাশের সাথে এক হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে তাদের সাথে একাকার হয়ে গেল আহমদ মুসার মনও। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
৪০. কালাপানির আন্দামানে

Tags