১
‘বুঝলাম, হোটেল সাহারা থেকে তোমাদের উদ্ধারের কাহিনী এ জন্যেই তাহলে চেপে গেছ এতদিন। দারুণ রোমান্টিক কাহিনী’ বলল সুষমা রাও। সোফায় শাহ্ বানুর গলা জড়িয়ে ধরে বসে সুষমা।
শাহ্ বানু গলা থেকে সুষমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, বাঁচা-মরার লড়াইয়ের মধ্যে রোমান্টিকতা কোথায় পেলে?’
বল কি তুমি রোমান্টিকতা নয়? দোতলা থেকে স্বপ্ন-নায়কের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া, তা কাঁধে চলে প্রাচীরে ওঠা, তার হাতে ঝুলে নিচে নামা, ইত্যাদি রোজান্টিক নয় বলে মনে কর?’
আমি ঝাঁপিয়ে পড়িনি। দড়ির মই ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিলাম। এভাবে পাথরের উপর পড়লে বড় রকমেম কিছু ঘটতে পারতো। তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আর প্রাচীর পাও হওয়ার ময় যা ঘটেছে, ওরকম বিপদে এর চেয়েও বেশি কিছু ঘটতে পারে। আপতকালীন এসব বিষয় কেউ মনে রাখে না, মনে রাখার মত নয়। এখানে রোমান্টিকতা খোঁজা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।’ বলল শাহ্ বানু।
মনে রাখে না বলল, আচ্ছা বলত, ঐ ঘটনা তুমি আমৃত্য ভুলতে পারবে?’
‘মনে রাখা মানে আমি স্মরণ রাখা অর্থৈ বলিনি। বলেছি, মানুষ এমন ঘটনা রঙিন অর্থাৎ রোমান্টিক চোখে দেখে না। সে রকম দেখা একবারেই অস্বাভাবিক।’ শাহ্ বানু বলল।
‘তোমার সাথে এ নিয়ে তর্ক করবো না শাহ্ বানু। তবে বলব, চোখের পানিতে সুখের স্বপ্ন প্রতিবিম্বিত হতে পারে, হতাশার ঘনঘটার মধ্যে জীবনের প্রদীপ দীপ জলে উঠল বা দু’জীবনের মিলনের বীজ অংকুরিত হতে পারে। তুমি মানতে না চাইলেও এর লাখো দৃষ্টান্ত আছে পৃথিবীর ইতিহাসে।’ বলল সুষমা রাও।
‘দেখ সুষমা, পৃথিবীতে আহমদ মুসা আজ একজনই আছেন। তিনি তোমার ঐ ‘লাখোর মধ্যেকার একজন নন। তাই তোমার দৃষ্টান্ত অচল এখানে।’
‘আমি জানি শাহ্ বানু। আহমদ মুসা ভাইকে এই কথার বলার সাহস আমার নেই। আমি বলছি তোমার কথা। তোমার হৃদয়ের কথা।’
শাহ্ বানুর মুখ রাঙা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরণেই যন্ত্রণার এক কালো ছায়া এসে তা গ্রাস করে নিল। বলল শাহ্ বানু গম্ভীর কণ্ঠে, ‘কিন্তু আমাকে বলছ কেন?’
‘কারণ তোমার মুখে অমূল্য অনুরাগের এক রাঙা রূপ আমি বার বার দেখেছি। কিছুণ আগে ভাইয়ার সাথে কথা বলার সময় দেখেছি এবং এইমাত্রও দেখলাম।’
হাসল শাহ্ বানু। হেসে উঠলেও তার মুখের রাজকীয় লাবণ্য কিন্তু হেসে উঠল না। তাতে জড়ানো বেদনার প্রলেপ। বলল সে ধীর শান্তকণ্ঠে, ‘তুমি যেটা দেখেছ সেটা অন্যায় এবং এক অবাধ্যতা। আমি দুঃখিত তার জন্যে।’
অকষ্মাৎ ভারী হয়ে উঠেছে শাহ্ বানুর কণ্ঠ। তার শুকনো ঠোঁটে হাসি ফুটে আছে ঠিকই, কিন্তু তার দু’চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা অশ্র“।
মুহূর্তেই সুষমা রাওয়ের মুখ থেকে হাসি রসিকতার চিহৃ উঠে গেল। বিষ্ময়-বেদতনার ছায়া নামল তার চোখে-মুখে। বলল সে,’কি ব্যাপার শাহ্ বানু?’ উৎকণ্ঠা সুষমার রাওয়ের কণ্ঠে।
শাহ্ বানু চোখ মুছে হেসে উঠে জড়িয়ে ধরল সুষমা রাওকে। বলল, এস সুষমা এসব আমরা ভুলে যাই। আহমদ মুসা দেড় মাসের বাচ্চা রেখে এখানে এসেছেন এই জীবন-মৃত্যুর অভিযানে। এস আমরা তাঁর জন্যে এবং সেই মিষ্টি বাচ্চার জন্য দোয়া করি।
শাহ্ বানু জড়িয়ে ধরারয় সুষমা রাও নিশ্চল স্থির হয়ে গেছে। গোটা দেহ জুড়ে বয়ে গেল বেদনার এক স্রোত। বলল সুষমা রাও কাঁপা কণ্ঠে, ‘তুমি যা বলছ তা সত্য শাহ্ বানু? কার কাছে শুনেছ?’
‘আম্মার কাছে।’ বলল শাহ্ বানু।
শাহ্ বানু সুষমাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। আগের মতই স্থির, নিশ্চল বসেছিল সুষমা রাও। দু’জনই নিরব।
কয়েক মুহূর্ত পর সুষমা রাও তাকাল শাহ্ বানুর দিকে। বলল নরম ভারী কণ্ঠে, ‘এ ভুল তাহলে তুমি কেন করলে শাহ্ বানু।’
শাহ্ বানু নরম ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘প্রথমে আমি নিজেকেই বুঝতে পারিনি সুষমা। আর সবকিছু শুনলাম আমি আম্মার কাছে যে রাতে তোমার এখানে এসেছি সেই রাতে।’
বলে শাহ্ বানু জাড়িয়ে ধরল সুষমার দু’হাত। বলল, ‘আমি সবকিছু ভুলে যাব সুষমা। তুমি কিছু শুনেছ, জেনেছ সেটা তুমিও ভুলে যাও। রসিকতা করেও আমার সম্পর্কে তুমি ওঁর কাছে কোন কথা বলো না।’ কান্নায় ভেজা কণ্ঠস্বর শাহ্ বানুর।
চোখের কোণ ভিজে উঠেছে সুষমা রাওয়ের। বলল সে, ‘আমার খুব কষ্ঠ হচ্ছে শাহ্ বানু। আমিও তো একজনকে ভালবাসি। তুমি যা বলছ, আমি কি তা পারতাম? পারতাম না।’
চোখের অশ্রু দু’গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ল সুষমা রাওয়ের।
সুষমার হাত ছেড়ে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল শাহ্ বানু। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘তোমার ব্যাপারটার সাথে আমার তুলনা হয় না সুষমা। তুমি অন্যায়, অস্বাভাবিক কিচু করনি। কিন্তু আমার দ্বারা অন্যায় হয়েছে। অন্যায় তো মানুষেরই হয়। আমি শুধরে নে….।’ কান্নায় আটকে গেল শাহ্ বানুর কথা। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
সুষমা রাও শাহ্ বানুর দিকে মুখ তুলে বলল, ‘যদি অন্যায়ই মনে কর, যদি শুধরে নিতেই চাও, তাহলে কাঁদছ কেন।’ ভারী কণ্ঠ সুষমার।
‘এটা আমার দুর্বলতা। আমি শক্ত হতে পারব সুষমা।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল শাহ্ বানু।
কিছু বলতে যাচ্ছিল সুষমা। এ সময় বাইরে তার পিতার গলা শুনতে পেল।
সে তাড়িতাড়ি বলল, ‘শাহ্ বানু বাবা এসেছেন। নিশ্চয় এখানে আসবেন। তোমার নাম মনে আছে তো?’
দু’জনেই তাড়াতাড়ি চোখ-মুখ মুছে স্বাবাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।
সুষমা রাও তাড়াতাড়ি এগুলো দরজার দিকে। দরজাতেই দেখা হয়ে গেল তার আব্বা আন্দামানের গভর্নর বালাজী রাজীরাও মাধবের সাথে।
‘কেমন আছ মা? সুষমা তার আব্বার পায়ে প্রণামের উত্তরে মাথায় হাত রেখে বলল বিবি মাধব।
‘ভাল আছি বাবা। তুমি অফিসে যাওনি?’ সুষমা রাও বলল।
‘কয়দিন খুব পরিশ্রম গেছে মা। আজ একটু রেষ্ট নিব।’
সুষমা রাও তার পিতার হাত ধরে বলল, ‘এস বাবা, বসবে।’
পিতাকে নিয়ে সুষমা রাও ঘরে ঢুকল। ঘরের মাঝ বরাবর আসতেই শাহ্ বানু গিয়ে নিরবে কদমবুছি করল সুষমার আব্বার পায়ে।
সুষমার আব্বা বিভি দাধব অবাক হলো শাহ্ বানুকে ধেকে। তার মাথায় হাত রেখে ‘বেঁচে থাক মা’ বলেই জিজ্ঞাসা কলল, ‘কে তুমি মা?’
শাহ্ বানু মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সুষমা রাও বলল, ‘বাবা আমার বান্ধবী, সঙ্গীতা সাইগর। আমার সাথে পড়ে। বেড়াতে এসেছে আন্দমানে।’
‘বাঃ খুব ভাল । কিন্তু আমাকে তো বলনি? কবে এসেছে?’
‘গত সন্ধ্যায় এসেছে বাবা। তোমাকে বলব কি বাবা, তোমাকে পেলে তো! মা জানেন।’
‘বেশ ভাল। তা এদের বাড়ি কোথায়?’
‘ওরা মাদ্রাজের বাবা।’
‘আমাদের গেষ্ট উইং-এ একজন মহিলাকে দেখলাম। উনি কে জান?’
সুষমা রাও একটু চমকে উঠেছিল। মুহূর্তের জন্য উৎকণ্ঠার একটা ছায়াও নেমেছিল তার মুখে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নিযে দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘উনি সঙ্গীতার মা। বাবা তোমার সাথে তার দেখা হয়েছিল। কাজে যাচ্ছিলাম, ব্যস্ত ছিলাম। তাই কথা হয়নি।’ বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু মা সঙ্গীতার মা’র মাথায় কাপড় দেখলাম। সাইগলরা তো খুবই আধুনিক। ওদের মেয়েরাও সার্ট-প্যান্টে অভ্যস্ত। ওরা তো মাথা ঢাকে না।’
সুষমার বুকটা কেঁপে উঠল। ঠিক বলেছে তার আব্বা। সাইগলরা খুবই আধুনিক। তার ঠিক হয়নি ‘সঙ্গিতা’ নামের সাথে সাইগল লাগানো। যা হোক বিষয়টাকে কভার করার জন্যে সুষমা তাড়াতাড়ি বলল, ‘বাবা’ সবাই কিন্তু একরকম হয় না। বিষেশ করে মেয়েরা। দেখ না কউ সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে যায়। আবার কউ দেখ মাসেও একবার ঠাকুর-মুখো হয় না।’
কথাটা শেষ করেই তার পিতাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যাবার জন্যে বলে উঠল, ‘বাগানে কি জরুরি কাজ ছিল বাবা?’
‘বাগানটার রিমডেলিং হচ্ছে। বড় করা হচ্ছে বাগানটা। সমস্যা দেখা দিয়েছে একটা কবর নিয়ে। কবরটা না সরালে বাগান বড় করা যাবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে পুরাতত্ব বিভাগ। তারা বলছে কবরসহ জায়গাটা বৃটিশরা স্থায়ী ওয়াকফ করে গেছে। ও জমিতে হাত দেয়া যাবে না।’ বলল গভর্ণর বিবি মাধব।
‘হ্যাঁ বাবা, বাগানের লাগোয়া কবরটা আমি দেখেছি। মার্বেল পাথরে বাঁধানো। কবরটা এখানে এল কি করে?’
‘সত্যি, কবরটা এখানে আসার কথা ছিল না। এসেছে যে তার পেছনে ইন্টারেষ্টিং একটা কাহিনী আছে। আন্দামান জেলখানার জেলার হিসাবে এসেছিলেন একজন দার্শনিক পণ্ডিত লোক। তিনি দর্শন শাস্ত্রে উপর একটি জটিল বই পড়ছিলেন। অনেক শব্দের অর্থ দএবং কিছু বিষয় তার বোধগম্য হচ্ছিল না। তিনি জেল অফিসের সাবাইকে জানালেন, আন্দামানে এমন কেউ কি আছে যে তাকে শব্দগুলো বুজার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। জেলের এক অফিসার জেলারকে জানায়, আমাদের জেলে একজন কয়েদী আছে, সেই পারে এর ব্যাখ্যাদান করতে।
এই কথা শুনে জেলার অস্থির হয়ে ওঠেন। বলে, এখনি আমার এই গ্রন্থটি তার কাছে নিয়ে দাও। গ্রন্থটি সেই কয়েদিকে নিয়ে দেয় জেলের কয়েদীকে…………. শব্দ ও বিষয়সমূহের শুধু অর্থ-ব্যাখ্যাই করা হয়নি, অস্পষ্ট অনেক বিষয়কে ফুটনোট দিয়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা ও ফুটনোট পড়ে তিনি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন যে, এতবড় দার্শনিক তার জেলখানায় কিভাবে কোত্থেকে এল! তাঁর থাকার কথা শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের আসনে! জেলার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে চল। আমি দেখতে চাই এই মহান দার্শনিককে। অফিসাররা তাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। মাঠে একজন কয়েদীর কাছে তাঁকে নিয়ে দাঁড় করানো হলো। তিনি দেখলেন, খালি পা, ঘর্মাক্ত গা, কাঁচা-পাকা চুলের জ্যোতিস্মান চোখের এক বয়স্ক ব্যক্তি টুকরি ভরা মাটি মাথায় করে বয়ে নিয় আসছে। বিস্ময় ও বেদনায় বাকহীন হয়ে গেলেন জেলার। এতবড় একজন পণ্ডিত তার জেলখানায় মাটি কাটছে, মাথায় মাটি বইছে! জেলার সাহেব এই পণ্ডিত ব্যক্তির ভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁরই উদ্যোগে সেই পণ্ডিত কয়েদীর এখানে কবর হয়।’
‘এখান কেন?’ জিজ্ঞাসা সুষমার রাওয়ের।
‘সাগর তীরের এই সুন্দর উচ্চভূমিতে জেলার সাহেব কয়েদীদের জন্য পাঠাগার ও খেলা-ধুলার ব্যবস্থা সম্বলিত ক্লাব ও পার্ক গড়ে তোলেন। এখানেই তিনি কবর দেন পণ্ডিত কয়েদীর। সময়ের পরিবর্তনে সেই ক্লাব কমপ্লেক্সেই আজ গভর্নর হাউজ।’
‘কে ছিলেন এই পণ্ডিত কয়েদী বাবা?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না গভর্নর বিবি মাধব। একটু ভাবল, বলল, ‘কি বলব মা। তার নাম মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী। তিনি একজন অতি বড় পণ্ডিত ব্যক্তি, সেই সাথে একজন আপোষহীন যোদ্ধা। দর্শন শাস্ত্র, বিজ্ঞান, ইসলামী ধর্মতত্ব, সাহিত্য, প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। জটিল দর্শন বিষয়ে গ্রন্থ রচনাসহ বহু গ্রন্থ প্রণেতা তিনি। লাখনৌর নবাব সরকারে তিনি আট বছর প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বৃটিশরা লাখনৌ দখল করলে তিনি বৃটিশের অধীনে চাকরি করতে অস্বীকার করার পর পদত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসেন। স্থানীয় শাসক, জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহের বাণী প্রচারের জন্যে চারদিকে ঘোরা শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়ে ফতোয়া প্রচার করেন। ফতোয়াটি ভারতে তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘সাদিকুল আখবার’-এ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৭ সালের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহের পাশে তিনি ছিলেন। মোঘল শাসন কিভাবে চলবে ভবিষ্যতে তার দিক নির্দেশনার জন্যে তিনি একটি ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান’ রচনা করেন এবং দিল্লী সম্রাটকে উদ্বদ্ধ করেন নতুন পদ্ধতির শাসনের জন্যে। বৃটিশদের হাতে দিল্লীর পতন ঘটলে তিনি বিদ্রোহ সংগঠনের লক্ষ্যে দিল্লী ত্যাগ করেন। এর পর তিনি বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের নায়িকা ‘হযরত মহল’- এর পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং চেষ্টা চালাতে থাকেন দেশীয় শক্তিতে ঐক্রবদ্ধ করতে। এই সময় তিনি বৃটিশদের হাতে গ্রেফতার হন। অফিযোগ আনা হয় যে, তিনি দেশীয় রাজা-জমিদারদের বিদ্রোহ-রক্তপাতে উস্কানি দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন এবং হত্যা-খুনের মত অপরাধ করেছেন। ১৮৫৯ সালের ৪ঠা মার্চ এক রায়ে বৃটিশ কোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করেন এবং ১৮৬০ সালে ৬৩ বছর বয়সে তিনি আন্দামানে দ্বীপান্তর লাভ করেন। ২ বছর পর ১৮৬২ সালে তিনি এই দ্বীপেই ইন্তেকাল করেন।’
‘তাহলে তো বাবা তিনি ভারতের বিরাট একজন স্বাধীনাতা সংগ্রামী।’ বলল সষমা রাও।
‘না তিনি ভারতের নন, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী তার জাতির। তিনি ভারতে মুসলমানদের শাষন রক্ষার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন। চেয়েছিলেন দিল্লীর মোঘল সাম্রাজ্য টিকে থাক।’
‘একই তো কথা বাবা, দিল্লীর মোগল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা মানে ভারতের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা।’
‘তুমি জানো না, তখন শিবাজী পরিবারের নেতৃত্বে, মারাঠাদের কর্তৃত্বে হিন্দুদের আরেকটা স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। দিল্লী সাম্রাজ্য টিকে গেলে তো এই স্বাধনতা সংগ্রাম শেষ হয়ে যেত মা।’
‘কিন্তু বাবা, দিল্লী সাম্রাজ্য টেকেনি, তাকে কি মারাঠীদের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রাম টিকেছিল? বৃটিশরা কি সাবাইকে ধ্বংস করে দেয়নি?’
‘দিয়েছে, কিন্তু পরিণাম ভাল হয়েছে মুসলমানরা ভারতের সাম্রাজ্র চিরতরে হারিয়েছে। কিন্তু শিবাজী-মারাঠার উত্তরসূরীরা আজ ভারতের কর্তৃত্বে আসীন হয়েছে।’ বলল সুষমার পিতা বালাজী বাজীরাও মাধব।
‘থাক বাবা এ প্রসঙ্গ। আমি বুঝতে পারছি না বাবা, জেলার সাহেব তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পরেও জেল থেকে তার মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারিননি কেন?’ সুষমা রাও বলল।
‘তিনি তাঁর সাধ্যের অধীন সব চেষ্টা করেছিলেন মা। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছিলেন। কিন্তু জেল থেকে মুক্তি জনাব খয়রাবাদীর কপালে ছিল না। বিলাতের প্রিভি কাউন্সিল থেকে মুক্তির আদেশ শত ঘাট পেরিয়ে পৌঁছে খয়রাবাদী সাহেবের ছেলের হাতে। সেই আদেশ নিয়ে তাঁর সন্তান যখন আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের নামেন, তখন খয়রাবাদীকে এই কবরে নামানো হচ্ছিল। জেল থেকে মুক্তির আগেই তিনি দুনিয়া থেকে মুক্তি লাভ করেন।’
মুখ ভারী হয়ে উঠেছে সুষমার। ছল ছল করে উঠেছে তার দু’চোখ। তার পিতা থামলেও সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না সে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু পর বলল, ‘যে কবর এত বড় একজন মানুষের, যে কবরের সাথে জড়িয়ে আছে এতবড় ট্রাজেডি, সেই কবরে কেন হাত দেবেন বাবা? থাক না স্মৃতিটা।’
হাসল সুষমার পিতা বিবি মাধব। বলল, ‘ব্যক্তি, ব্যক্তির স্মৃতি এবং কবর এক জিনিস নয় মা? আর মুসলিম বিধানে কবর স্থায়ী করার ব্যবস্থা নেই।’
‘কিন্তু এরপরও বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজননে কবর স্থায়ী করা হচ্ছে। এটাও বিশেষ ধরণের একটা ক্ষেত্র বাবা।’
‘ঠিক আছে, ক্ষেত্রটাকে বিশেষ মনে করতে পার, কিন্তু এটা কবরের জন্যে বিশেষ স্থান নয় মা।’ বলল সুষমার পিতা।
‘বিশেষ কবরের জন্যে বিশেষ স্থান এখন এটা নয় বাবা। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশেষ কবরটি এ স্থানে হয়ে গেছে। তাই কবরটা বিশেষ বলে স্থানটাও বিশেষ হয়ে গেছে বাবা।’ বরল সুষমা রাও।
হেসে উঠল সুষমার পিতা গভর্নর বালাজী বাজীরাও মাধব। বলল, ‘সুষমা মা, তোমাকে আর্ট না পড়িয়ে আইন পড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু শোন আমার কন্যা, জাতীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকারের ‘প্রয়োজন’ আছে যার জন্যে অন্য সবকিছু জলাঞ্জলী দিতে হয়। আমাদেরকে এমন ধরনেরই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল সুষমার আব্বা গভর্নর বিবি রাও। শাহ্ বানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খুব খুশি হলাম মা, তোমরা এসেছ। কি যেন নাম তোমার?
‘সঙ্গিতা সাইগল।’ শশব্যাস্ত কাঁপা গলায় বলল শাহ্ বানু। মুহূর্তের জন্য তার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। মিথ্যা কথাটা বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল।
‘আসি মা’ বলে দু’জনকে বাই জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুষমার পিতা বালাজী বাজীরাও মাধব।
সুষমা রাও ও শাহ্ বানু তাকে ঘরের বাইরে পর্যন্ত এসে বিদায় জানাল।
সুষমার পিতা বালাজী বাজীরাও মাধব তার পার্সোনাল ষ্টাডিরুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসল।
পকেট থেকে বের করল মোবাইল। একটা কল করল সে।
ওপান্তে থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘স্যার, গুডমর্নিং স্যার, আমি রঙ্গলাল। নির্দেশ করুন স্যার।’
রঙ্গলাল গভর্নন হাউজের গোয়েন্দা ইনচার্জ।
‘শোন রঙ্গলাল। আমার মেয়ের সাথে মাদ্রাজের সঙ্গীতা সাইগল নামে একটি মেয়ে পড়ে। তুমি গোপনে খোঁজ নাও সেই সঙ্গীতা সাইগল ও তার মা এখন কোথায়?’ এ প্রান্ত থেকে বলল গভর্নর বিবি মাধব।
‘ওকে স্যার। আর কিছু নির্দেশ, স্যার।’ গোয়েন্দা অফিসার ওপ্রান্ত থেকে বলল।
‘ভাইপার দ্বীপে যে লাশগুলো পাওয়া গেছে, তার কোন হদিস মিলল?’
‘না স্যার। মনে করা হচ্ছে, কোন আন্তগ্যাং-এর মধ্যে কোন সংঘাত ওটা।’
‘এ ধরনের দায়সারা গোছের কথা ছেড়ে দাও। যাদের লাশ ওখানে পাওয়া গেছে, তাদের সাবার কপালে চন্দনের বিশেষ ধরনের তিলক আঁকা। এ ধরনের লোকরা জগৎমাতার সেবক হয়ে থাকে। এখন যেটা দেখার সেটা হলো, জগৎমাতার এই সেবকদের কারা হত্যা করল?’ বলল গভর্নর।
‘স্যরি স্যার। ওদের কাছে রিভলবার পাওয়া যায়নি, কিন্তু প্রত্যেকের পকেটে রিভলবারে বুলেট পাওয়া গেছে। ওদের রিভলবারগুলো প্রতিপক্ষরা নিয়ে গেছে মনে করা হচ্ছে। এই দিকটার কারণেই সম্ভবত ঐ কথা বলা হয়েছে। স্যরি স্যার।’ গোয়েন্দা অফিসার বলল।
‘ধন্যবাদ। হোটেল থেকে সোমনাথ শম্ভুজী এবং তার দু’রক্ষীকে যারা গায়েব করেছে, তারাই ভাইপার দ্বীপে জগৎমাতার সেবকদের হত্যা করেছে। সাহারা হোটেলের ভেতরেই কোন রহস্য আছে। গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশ কি হোটেলের সব বাসিন্দাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে?’ বলল গভর্নর।
‘নিয়েছে স্যার। শুধু পাওয়া যায়নি ‘বেভান বার্গম্যান’ নামের একজন আমেরিকান ট্যুরিষ্টকে। আর পাওয়া যায়নি আহমাদ শাহ্ আলমগীরের মা ও বোনকে। তারা সোমনাথ শম্ভুজীদের মতই যেন হাওয়অ হয়ে গেছে।’ গোয়েন্দা অফিসার বলল।
‘কিছুক্ষণ আগে পুলিশ প্রধান আমাকে জানিয়েছেন, সব তথ্য একত্র করার পর তাঁরা মনে করছেন যারা আহমদ আলমগীরকে গায়েব করেছে তারাই আবার আলমগীরের মা-বোনকে মিথ্যা ব্লাফ দিয়ে ভিন্ন নামে হোটেলে এসে তুলেছিল কোন উদ্দেশ্যে। পরে ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে এই আশঙ্কা থেকে তাদের আবার হোটেল থেকে সরিয়ে নিয়েছে তারা। কিন্তু কোন পথে সরিয়ে নিল, শম্ভুজীদের পাওয়া যাচ্ছে না কেন, এর জবাব পুলিশ প্রধানের কাছে নেই। আচ্ছা হাজি আব্দুল্লাহ আলীর খবর কি? উনি কি বলেন?’ জিজ্ঞেস করল গভর্নর।
‘সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত তিনি হোটেলে থাকেন, তারপর তিনি বাসায় চলে যান। সেদিনও তাই গেছেন।’
‘আপনারা বাড়িতে তার খোঁজ করেছেন? কথা বলেছেন তার সাথে হোটেলের সব ব্যাপার নিয়ে?’ গভর্নর বলল।
‘স্যার আমি এটুকু শুনেছি যে, পুলিশের উপস্থিতিতে হোটেলের লোকরাই তার বাসায় টেলিফোন করেছিল। হাজী সাহেব বাসায় ছিলেন না। বাসা থেকে বলা হয়েছিল, আটটার দিকে কোথাও তাঁর একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, সেখানেই তিনি গেছেন।’ বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
‘ঠিক আছে। আমি মনে করি, তাঁর উপর নজর রাখা………….। না থাক, ওটা আমি দেখব।’
বলে একটু থেমেই গভর্নর আবার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তোমাকে যেটা বলেছি, সেআ তাড়াতাড়ি জানা দরকার। এখনি কাজ শুরু কর।’
‘ইয়েস স্যার।’ বরল গোয়েন্দ অফিসারটি।
‘ওকে।’ বরৈ গভর্নর মোবাইল অফ করে দিল।
অস্বস্তি ও উদ্বেগের একটা ছায়া তার চোখে-মুখে উদ্বেগের কারণ হলো, তরুণী ও মহিলার যে পরিচয় তার মেয়ে সুষমা তাকে দিয়েছে, সেটা সে গ্রহণ করতে পারছে না। তরুণীর চোখে-মুখে সে শংকা-ভয়ের ছায়া দেখেছে। বেড়াতে আসা সাইগল পরিবারের কারও মুখে এই শংকা, ভয় থাকবে কেন? আর তরুণীটির চেহারা যেন তার কাছে চেনা মনে হচ্ছে এই চেহারা যেন সে কোথাও দেখেছে তাহলে কি ওদের কোন মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে? কেন দেবে? এখানেই তার অস্বস্তি লাগছে।
উদ্বেগ-অস্বস্তির ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল গভর্নর বিবি মাধব। ভাবল, মাদ্রাজ থেকে সাইগল পরিবারের খবরটা এলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে।
মোবাইলটা পকেটে রাখল বিবি মাধব।