৪১. আন্দামান ষড়যন্ত্র

চ্যাপ্টার

পোর্ট ব্লেয়ারের বন্দর এলাকার কয়েক মাইল দক্ষিণে এবং কালিকট শহর এলাকার কয়েক মাইল উত্তরে এক নির্জন উপকূলে বোট নোঙর করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বোটটি টেনে উপরে তুলে একটা আড়ালে ঠেলে দিল। মনে মনে বলল, বোটটি শুধু অত্যন্ত সুন্দরই নয়, এর ইঞ্জিন অত্যান্ত পাওয়ারফুলও।
বোটটি ড্যানিশ দেবানন্দদের। ওদের মোট তিনটি বোটের মধ্যে সবচেয়ে ভালটাই আহমদ মুসাকে ওরা দিয়ে দিয়েছে। ওদের সাথে শলাপরামর্শ ও চিন্তা-ভাবনা করে সে নৌ পথে আসার সিদ্ধান্ত নেই। হেলিকপ্টার যোগাগের সুযোগ ঐ সময় তাদের ছিল না। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে আসার মতো রোড-কম্যুনিকেশণ নেই। আর ঐ রাতে ভাড়া গাড়িও মিলত না। এ প্রশ্ন তুলে সুষ্মিতা বালাজীই প্রস্তাব করে মটর বোটে নৌ পথে আসার।
এসব ভাবতে গিয়ে মনে ভেসে উঠল সুষ্মিতা বালাজীর ছছি। বিদায়ের সময় বোটটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়েছিল সুষ্মিতা বালাজীদের। সুষ্মিতা বালাজী কান্নাচাপা কণ্ঠে বলেছিল, ‘বোটটার দামটাই যদি এভাবে চুকাতে চান তাহলে সম্পর্কটা ছিন্ন করে যান।’
আহমদ মুসা আর কোন কথা বলতে পারেনি। ‘স্যরি আপা’ বলে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়েছে।
স্পীড বোটটি উভচর। আহমদ মুসা বোট চালিয়ে তীরে উঠে একটা ঝোপের আড়ালে রেখে বাইরে বের হয়ে আসার আগে অভ্যাসবশতই একটু স্পর্শ করে নিল পকেটে রিভলবারটা ঠিকঠাক আছে কিনা। আরেকটা ছোট্ট বিললবার আছে মোজার ভেতরে গুঁজে রাখা।
আহমদ মুসা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকাল। শংকরাচার্যের নির্দেশনা অনুসারে উপকূল থেকে সামনে তাকালে দেখা যাবে বিশাল মরা একটা মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। সে গাছটি ডানে রাখলে পাহাড়ে যে আঁকা-বাঁকা গলিপথ পাওয়া যাবে সেটা ধরে এগুতে হবে দু’আড়াই মাইল। গলিপথের একবারে নাক বরাবর মাথায় পাওয়া যাবে একটা ছোট পাহাড়, পাহাড়ের উপর মন্দির এবং মন্দিরের মাথায় একটি গৈরিক পতাকা। সে মন্দিরের উত্তর পাশে একটা ‘সাদা মাইক্রো’ দাঁড়ানো থাকবে। সেই মাইক্রোর খোলা দরজার সামনে হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। দু’জন লোক বড়ি সার্চ করবে। তারপর উঠে বসতে হবে গাড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৮টায়।
আহমদ মুসা সামনে তাকিয়েই দেখতে পেল সেই মরা গাছ।
এগুতে লাগল আহমদ মুসা সেই গাছ লক্ষ্যে।
কয়েক গজ এগুতেই একটা গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। শব্দটা আসছে সেই মরা গাছটির বাম দিক থেকে।
আহমদ মুসা একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল। আড়াল থেকে দেখতে পেল একটা নীল রঙের প্রাইভেট কার আসছে।
প্রাইভেট কারটি তার সামনে দিয়েই চলে গেল উপকূলের দিকে। ড্রাইভিং সীটের একজনকেই সে দেখতে পেল। লোকটির মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ে টি সার্ট। তাকে দেখে ভদ্রলোক মনে হলো না।
এই নির্জন উপকূলে লোকটি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?
কৌতুহল দমন করতে পারলো না আহমদ মুসা। ঝোপের আড়াল ধরে গাড়ির পিছু পিছু ছুটল সে। উপকূল পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াল গাড়িটি।
গাড়ি থেকে নামল ড্রাইভিং সীটের লোকটি। পেছনের সীটের দরজা খুলল। ভেতর থেকে পেনে বের করে আনল একজন লোককে। তারপর তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলল পানির দিকে।
আহমদ মুসা দেখল, লোকটি একজন স্বাস্থ্যবান যুবক। যুবকটি মৃত না সংজ্ঞাহীন বুঝতে পারলো না আহমদ মুসা। তাকে পাঁজাকোলা করে সাগরের দিকে নিয়ে যেতে দেখে ভাবল, লাশ সাগরে ফেলে দিতে এসেছে নিশ্চয়। কিন্তু আবার প্রশ্ন জাগল, লাশ শুধু সাগরে ফেলার জন্যে এতদূরে আনার দরকার কি!
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল আন্দামানে ডজন ডজন লোককে সাগরে ডুবিয়ে মারার কথা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে লোকটি কি সংজ্ঞাহীন? তাকে মেরে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছে?
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিল। বের হয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে।
লোকটি তখন পানির ধারে চলে গেছে। ফেলে দিয়েছে সংজ্ঞাহীন লোকটিকে পানিতে। তারপর এগিয়ে যাচ্ছে পানিতে পড়া লোকটির দিকে।
আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না লোকটি এখন কি করতে চায়। সংজ্ঞাহীন লোকটিকে ডুবিয়ে রাখলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তার মুত্যু ঘটবে। প্রমান হবে সে পানিতে ডুবে মারা গেছে।
গুলী করল আহমদ মুসা লোকটির হাঁটু লক্ষ্যে।
সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার থেকে নিঃশব্দে বের হওয়া গুলী গিয়ে আঘাত করল লোকটির হাঁটুতে। লোকটি পেছনে ছিটকে এসে পড়ল উপকূলের মাটিতে।
গুলী করেই দৌড় দিয়েছে আহমদ মুসা উপকূলের পানির দিকে।
গুলী খেয়ে আহত লোকটি বাঘের মত চোখে সমস্ত বিষ ঢেলে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
‘যেমন আছ ঠিক পড়ে থাক’ বলে তার কোমরের বেল্টের রিভলবার খুলে নিয়ে সংজ্ঞাহীন লোকটিকে পানি থেকে তুলে আনল। তুলে আনতে গিয়ে আহমদ মুসা উপকূলটির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করল। উপকূল ঢালু হয়ে পানি স্পর্শ করেছে, তারপর দু’তিন গজ পরেই হঠাৎ খাড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে। পানির রং ঢেউয়ের প্রকৃতি দেখে বুঝা যায়, সাগর অত্যন্ত গভীর। আরও লক্ষ্য করল, পানি বরাবর উপকূলের মাটিগেরুয়া রঙ্গে রাঙা। এখানে পূজাও হয় নাকি?’ ভাবল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসার খেয়াল হলো, ‘ইমাম ও শিক্ষক ইয়াহিয়া আহমদুল্লার লাশও তো এখানেই পাওয়া গিয়েছিল। পানিতে ডোবা আগের লাশগুলোও এখানে বা এ ধরনের স্থানেরই কি পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে লাশগুলোকে কি সাগর দেবতাকে অর্ঘ হিসাবে পেশ করা হয়।
আহমদ মুসা লোকটিকে এসে তীরে শুইয়ে দিল। লোকটার গোটা শরীর ভিজে গিয়োছিল। এই ভিয়ে যাওয়াটা তার সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল খুন করতে আসা লোকটির দিকে।
লোকটি আহত হাঁটু ধরে বসেছিল।
আহমদ মুসা কাছে যেতেই বলে উঠল, ‘তুই কে জানি না। কিন্তু যা করছিস তাতে তোকে মরতে হবে।’
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে তার দু’হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে পানির কিনারা থেকে অনেকটা উপরে নিয়ে এল। তার কপালে রিভলবার চেপে বলল, ‘কিভাবে কেন মরতে হবে বল, তারপর ভাবব তোকে মারব কিনা।
‘শুধু তোকে নয়, যাকে মারতে নিয়ে এসেছিলাম তাকেও মরতে হবে। আমাদের হাত থেকে কেউ ছাড়া পায়নি। বাঁচার উপায় তারও নেই।’ বলল নির্ভিক কণ্ঠে।
আহমদ মুসা তার কপাল থেকে রিভলবারের নল একটু সরিয়ে গুলী করল লোকটির কানের বাইরের প্রান্ত লক্ষ্যে।
কানের একটা অংশ ছিঁড়ে গুলী চলে গেল।
লোকটি আর্তচিৎকার করে কান চেপে ধরল। এবার তার চোখে-মুখে ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠল। বিষ্ফোরিত চোখ তুলি তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে।
গুলী করেই আহমদ মুসা রিভলবার নল ফিরিয়ে এনে তার কপালে চেপে ধরল। বলল, ‘ঠিকতম উত্তর না দিলে এবার মাথা গুড়ো হয়ে যাবে। বল, তোরা কারা? কে তোদের নেতা? কি দোষ ঐ লোকটির?’
লোকটির চোখে-মুখে মুত্যু ভয় উৎকটভাবে ফুটে উঠেছে। বলল,‘নেতা কে আমি জানি না। আমাকে নির্দেশ দিয়েছে মহাগুরু শংকরাচার্য।’
আহমদ মুসাও এই উত্তরই আশা করছিল। বলল, ‘এখন বল এই লোকটির দোষ কি? কে তাকে হত্যা করতে নিয়ে এসেছিলি?’
‘আমি সেটা জানি না স্যার। সত্যি বলছি। আমি শুধু একটা নির্দেশ পালনের জন্যেই এসেছিলাম।’
‘শংকরাচার্য কোথায়?’
‘আমি জানি না স্যার। লর্ড মেয়ো রোডের প্রত্নতত্ব অফিসের সামনে দাঁড়ানো গাড়ি নিয়ে আমি এখানে চলে এসেছি। এই ছেলেটি ঐ গাড়িতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিল।’
পুরাতত্ব অফিসের নাম শুনেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল ড্যানিশ দেবানন্দের কথা। পুরাতত্বের সব অফিসকেই ‘শিবাজী সন্তান সেনা’র তাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। সুতরাং ‘লর্ড মেয়ো রোড’-এর ঐ আস্তানা শংকরাচার্যের একটা ঘাঁটি হতে পারে। সংজ্ঞাহীন ছেলেটির ওখান থেকে নেয়ার অর্থ হলেঅ, সংজ্ঞাহীন ছেলেটির জ্ঞান ফিরলে তার কাছ থেকেও কিছু জানা যেতে পারে। এ চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা এ লোকটির পকেটে খোঁজ করে মোবাইল নিয়ে ফিরে এল সংজ্ঞাহীন ছেলেটির কাছে।
সংজ্ঞা এখনও ফেরেনি ছেলেটির।
ছেলেটির বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর। আরবীয় আরয চেহারা। ফর্সা রং, কাল চুল, টানা চোখ, উন্নত নাক। গায়ে হালকা নীল সার্ট, পরণে নীল প্যান্ট। সব মিলিয়ে একটা অভিজাত চেহারা। বুঝাই যাচ্ছে মুসলমান।
তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফেরানো দরকার। কি করা যায় এখন।
হঠাৎ মনে পড়ল আহম মুসার, ঐ লোকটার পকেটে মোবাইল এবং আরও অস্ত্র আছে কিনা খঁজে দেখার সময় একটা ছোট শিশিতে মদ দেখেছে।
কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা ছুটে গেল এবং লোকটির পকেটে থেকে মদের শিশি এসে ছিপি খুলে ছেলেটির নাকের সামনে ধরল।
নিঃশ্বাসের সাথে স্পিরিটের তীব্র গন্ধ প্রবেশ করল ছেলেটির নাক দিয়ে ভেতরে। নড়ে উঠল তার দেঞ। মুহূর্ত কয়েক পর ছেলেটি চোখ খুলল। বিষ্ময়-বিষ্ফারিত চোখে তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। চারদিকে তাকাল সঙ্গে সঙ্গেই।
চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে আবার। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আমি এখানে কেন? আপনি কেন? ওরা গেল কোথায়?’
‘ওরা মানে যারা তোমাকে ধরেছিল তারা?
‘জি, হ্যাঁ।’
‘ওরা তোমাকে সংজ্ঞাহীন করে একজনকে দিয়ে পাঠিয়েছিল সাগরে তোমাকে ডুবিয়ে মারা জন্যে। আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমাকে বাঁচিয়েছি। বাঁ দিকে যে লোকটি পড়ে থাকতে দেখলে, সেই এনেছিলো তোমাকে পানিতে ডোবানোর জন্য। ওর হাঁটুতে আমি গুলী করেছি।’
‘আপনি কে? দেখে তো এশিয়ারই বলে মনে হচ্ছে।’ ছেলেটি উঠে বসতে বসতে বলল।
‘বলব সব, এখনি ওদিকে একটু চল। ওর সামনে সব কথা বলা যাবে না।’
বলে আহম মুসা উঠে দাঁড়াল এবং ছেলেটিকেও উঠতে সাহয্য করল। তারপর আহত লোকটির দিকে একটু ঘুরে বলল, ‘তুমি যেভাবে পড়ে আছ, সেভাবে থাকবে। পালাতে পারবে না, কিন্তু মরবে তার ফলে।’
আহমদ মুসা গাড়ির সিটে উঠল। পাশের সীটে উঠতে বলল ছেলেটিকে।
ছেলেটি উঠে বসলে আহমদ মুসা বলল, ‘এই গাড়িতে করেই তোমাকে নিয়ে এসেছিল।’
আহমদ মুসা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটির দিকে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে দ্রুত বলল, ‘দেখ আমার হাতে সময় খুব কম। দ্রুত উত্তর দেবে। প্রথম প্রশ্ন, তুমি মুসলিম নিশ্চয়। তুমি কি জান কারা তোমাকে ধরেছিল, কারা খুন করতে চায় এবং কেন?’
‘দুঃখিত, এই প্রশ্নগুলোর কোনটিরই উত্তর আমার জানা নেই।’
ছেলেটি একটা থেকে একটা ঢোক গিলেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু আপনি জানলেন কি করে আমি মুসলামান?’
‘পরে বলব। আগে প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কালকে বিদেশ থেকে এসেছ। তুমি ঔ পুরতত্ব অফিসে কেন গিয়েছিলে? কেন তোমাকে ওরা ধরল?’
‘আপনি কি করে জানলেন আমি কালকে বিদেশ থেকে এসেছি। আপনাকে কখনই দেখিনি আমি।’ বিষ্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল ছেলটি।
‘পরে বলব, তুমি প্রশ্নের উত্তর দাও।’ গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
ছেলেটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার ব্যক্তিত্বের কাছে মুষড়ে পড়ল সে। বুঝল বাড়তি প্রশ্ন করা তার ভুল হয়ে গেছে। বলল সে ‘স্যরি স্যার। পুরাতত্ব বিভাগে আমার বন্ধু চাকরি করে। থাকেও সে অফিস সংলগ্ন বাড়িতে। আমি তারই খোঁজে গিয়েছিলাম।’
‘তারপর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তখন অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অফিসের উত্তর পাশের অংশের বাড়িটাতেই আমার বন্ধু থাকতো। আমি দরজায় নক করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ দরজা খুলল না। বুঝলাম বাসায় কেউ নেই। হতাশ হয়ে কি কি করব ভাবছি। এমন সময় একটা মাইক্রো এসে বাড়ির সামনে থামল। গাড়ি থেকে পাঁচ-ছয় জন নামল। তারা দু’জন মহিলাকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। মহিলা দু’জনের মুখ টেপ লাগিয়ে বন্ধ করা। আমি দু’জন মহিলাকে চিনতে পারলাম। ছুটে গেলাম তাদের দিকে। বললাম, ‘কি দোষ এদের? আমি এদের চিনি। ওদের ছাড়ুন। শুনুন আমার কথা।’
ওদের মধ্যে লম্বা-চওড়া সর্দার গোছের একজন ওদের আগে আগে যাচ্ছিল। আমার কথা শুনেই সে দু’জনকে নির্দেশ দিল আমাকে ধরার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গেই দু’জন এসে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। এসব ব্যাপার এত দ্রুত ঘটে গেল যে, আমার প্রতিরোধ করার সুযোগ হল না।’
‘ঐ দু’জন মহিলা কি একজন শাহ্ বানু, আরেকজন সাহারা বানু?”
‘হ্যা। আপনি জানলেন কি করে?’ ছেলেটির চোখ বিষ্ময়ে-বিষ্ফারিত।
‘পরে বলব। উত্তর দাও প্রশ্নের।’
‘স্যরি স্যার। হ্যাঁ মহিলা দু’জন ওরাই ছিলেন।’
আহমদ মুসা দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, ৮টা বাজতে এখনও এক ঘন্টা বাকি। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ভাবল সে, আমরা এখন সরাসরি সেই পুরাতত্ব অফিসে অভিযান চালাতে পারি। শংকরাচার্য ৮টার সময় জানবে যে আমি তাদের ফাঁদে পা দেইনি। এ খবর যে জানার আগেই আমরা তার কাছে পৌছে যাব। সুতরাং শাহ্ বানুদের উপর চড়াও হবার তাদের কোন সুযোগ হবে না। অন্য কোনভাবে এ খবর সে আগে-ভাগে জানবে তারও সম্ভাবনা নেই। এই উপকূলে তাদের যে পাহারা নেই, তা বুঝাই যাচ্ছে। তাবে একটা প্রশ্ন আহমদ মুসার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল, আমাকে এই উপকূলে মেরে ফেলার জন্যে। কেন?
চিন্তা করেই আহমদ মুসা চোখের পলকে গাড়ি ‍ঘুরিয়ে সেই আহত লাকটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়ির জানালা দিয়ে লোকটির দিকে রিভলবার তাক করল।
লোকটি আর্তকণ্ঠে বলল, ‘আমাকে মারতে পারে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। আমি একজন হুকুম তামিলকারী মাত্র।’
‘ঠিকআছে, গুলী করব না। কিন্তু একটা কথা বল, এই ছেলেটিকে হত্যা করার জন্যে শংকরাচার্য কি তোমাকে এই ঘাটেই আসতে বলেছিল, না অন্য কোথাও।’ বলল আহমদ মুসা শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠে।
‘আমার ‍উপর নির্দেশ ছিল ঘাটে নিয়ে একে ডুবিয়ে মারার। অনেকগুলো ঘাট আছে। আমি এই ঘাটে এসেছি কারণ ঘাটটিতে আসার রাস্তা আরও দু’টি কাছের ঘাটের চেয়ে অনেক ভাল।’
‘আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দাও, যেখান থেকে গাড়ি নিয় এসেছ, সেই পুরাতত্ব অফিসে কখনও ঢুকেছ?’
‘অনেক বার ঢুকেছি স্যার।’
‘অফিসে কি আন্ডার গ্রাউন্ড কক্ষ আছে?’
‘আছে স্যার। বাড়িটার অফিস অংশের উত্তর ও দক্ষিণ দু’পাশে দু’টি আবাসিক অংশ আছে। ঐ দু’অংশে দু’টি আন্ডার গ্রাউণ্ড কক্ষ আছে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি আবার ঘুরিয়ে নিল। তার পর গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লোকটিকে বলল, ‘গাড়ি আমি নিয়ে গেলাম, সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা কর, গাড়ি পেয়ে যাবে।’
গাড়ি ষ্টার্ট দেয়ার আগে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে একটা ছোট ব্যান্ডেজ প্যাকেট লেকটির দিকে ছুড়ে দিল।
গাড়ি ছুটতে শুরু করল।
‘স্যার, এখানে আসবে কি ওকে গাড়ি ফেরত দেবার জন্যেই?’ বলল ছেলেটি।
‘সবই জানতে পারবে। আমার আরও প্রশ্ন আছে।’
ছেলেটি একবার আহমদ মুসারি দিকে তাকিয়ে চুপ করল। মনে মনে বলল, কি বিষ্মকর মানুষরে বাবা! সবজান্তার মত সবকিছুই জানে। চেহারা, চোখ-মুখ থেকে বুঝা যাচ্ছে খুব ভাল একজন মানুষ। কিন্তু রিভলবার হাতে নিলে মনে হচ্ছেতার কোন দয়া-মায়া নেই। আবার ব্যান্ডেজ দিয়ে আসা থেকে বুঝা যায় তার দয়া-মায়া আছে। আর তার সাথে একজন রাশভারী বড় ভাইয়ের মত অথবা একজন সেনা কমান্ডারের মত ব্যবহার করছে, তার শুধু হুকুমই পালন করতে হবে, প্রশ্ন করা যাবে না। তবে হুমুকের মধ্যে হৃদয়ের স্পর্শ আছে। ভাল লাগছে হুকুম তামিল করতে। বাঁচিয়েছে বলেইয়, তাকে দেখে এবং কথা শুনেই মনে হচ্ছে সে একজন হৃদয়বান অভিভাবক।
ছেলেটির ভাবসা ভেঙে দিয়ে উচ্চারিত হল আহমদ মুসার কণ্ঠস্বর। আমার তার প্রশ্ন ছেলেটিকে, ‘তুমি শাহ্ বানুদের চেন কিভাবে?’
‘শাহ্ বানুদের সাথে আমার ছোটবেলা থেকে পরিচয়। ওরা ভাই আহমদ শাহ্ আলমগীর আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল। আমাদের বাড়ি পোর্ট ব্লেয়ারে। সেকেন্ডারী পাস করার পর আমি পড়ার জন্য লন্ডন চলে যাই। পরে আমার আব্ব-আম্মাও লন্ডন চলে গেছেন। ওখানেই সেটেলড। প্রতিবছর ছুটিতে আমি এখানে আসি। আমাদের পোর্ট ব্লেয়ারের বাড়ি ভাড়া দেয়া আছে। আমি শাহ্ বানুদের বাড়িতেই উঠতাম। আহমদ শাহ্ আলমগীর নিখোঁজ হওয়ার খবর আমি সাত আটদিন আগে পেয়েছি। খবর পেয়েই আমি চলে এসেছি। প্লেন থেকে নেমে সোজা শাহ্ বানুদের বাসায় চলে যাই। শাহ্ বানুদের পায়নি। কেউ সঠিক কিছু বলতে পারল না। পুরাতত্ব অফিসের আমার সেই বন্ধু আহমদ শাহ্ আলমগীরের ভাল বন্ধু। এ জন্যেই তার কাছে গিয়েছিলাম সে কিছু বলতে পারে কিনা জানার জন্যে।’
‘শুধু তাদের খোঁজ নেবার জন্যেই লন্ডন থেকে এসেছ?”
‘জি হ্যাঁ। একদিকে আহমদ শাহ্ আলমগীরের চিন্তা অন্যদিকে তার পরিবারের চিন্তা আমাকে উদ্বগ্ন করে তুলেছিল।’
‘এখন তুমি মুক্ত, কি করবে চিন্তা করেছ?’
‘আমি গতকাল যা দেখেছি সে ব্যাপারে পুলিশকে খবর দেব। পুলিশকে নিয়ে ঐ বাড়িতে যাব।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জান সবচেয়ে সংরক্ষিত আন্দামানের গভর্নরের বাড়িতে তাদেরকে রেখেছিলাম। সেখান থেকে তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। পুলিশের সহযোগতা ছাড়া এটা হয়নি।’
‘ছেলেটির চোখে-মুখে অনেক কৌতুহল ও অনেক প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখা গেল। সে প্রশ্নের জন্যে মুখও খুলেছিল। কিন্তু চেপে গেল। ধীরে ধীরে তার চেহারায় ফুঠে উঠল হতাশার চিহ্ন। বলল, ‘তাহলে কি হবে?’
‘কেন, উদ্ধারে আমরা যেতে পারি না?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি, আপনি দু’জনে?’ বলল ছেলেটি বিষ্ময়ে চোখ কপাল তুলে।
‘কেন তুমি গুলী চালাতে জান না?’
‘রিভলবার, বন্দুক হাতে নিলেও কোন মানুষকে লক্ষ্য করে কোন দিন গুলী করিনি।’
‘তাহলে শাহজাদী উদ্ধার হবে কিভাবে? আর কিছুটা অন্তত যুদ্ধ করতে না জেনে তুমি মোগল পরিবারের জামাই হবে কি করে।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
ছেলেটি চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে প্রথমে বিব্রতভাব, তারপর লজ্জায় ঢেকে গেল তার চেহারা। পরে লজ্জা সরে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল যন্ত্রণার একটা ম্লানিমা। বলল, ‘স্যার আপনি বিষ্মকর এক মানুষ। আপনি অবশ্যই সব জানবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন। যে যুদ্ধ জানে না, সে একজন শাহজাদীকে জয় করবে কি করে? এই কথাটা এতদিন আমি বুঝিনি বলেই মনে কষ্ট পেয়েছি স্যার।’
ছেলেটির মনে যন্ত্রণা আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করল। বেদনার একটা ছায়া নামল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল সে, ‘আমি ওটা রসিকতা করে বলেছি। তুমি শাহ্ বানু……।’ কথা শেষ করতে পারলনা আহমদ মুসা।
ছেলেটি বলল, ‘ঠিক স্যার।’
‘আসলে সে কি জানে তুমি তাকে কামনা কর?’
‘অবশ্যই সে বুঝে স্যার। কিন্তু সব সময়ই সে পাথরের মত ঠাণ্ডা। তার সাথে কথা-বার্তা সবই হয়। কিন্তু তার চোখে কোনদিন বিশেষ দৃষ্টি দেখিনি। খুব সাধারণ চোখে সে আমকে দেখে থাকে।’ বলল ছেলেটি ম্লান কণ্ঠে।
‘আচ্ছা থাক এ প্রসঙ্গ। তুমি ভেব না, আমি দেখব ব্যাপারটা। এখন বল তোমর নাম কি?’ তোমর পরিচয়ই তো জানা হয়নি।’
‘আমার নাম তারিক মুসা মোপলা। বলল ছেলেটি।
‘বাঃ সুন্দর নাম। আমার নামের সাথে মিল আছে। আবার তোমার নামের সাথে ইসলামের দু’মহান সেনাপতি ‘তারিক’ ও ‘মুসা’র নাম ‍যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বল ‘মোপলা’ শব্দটা যোগ হল কেন? তোমরা দক্ষিণ ভারতের মালাবার (কেরালা) অঞ্চলের মোপলা জনগোষ্ঠীর বলেই কি?’
‘তা তো বটেই স্যার। তাছাড়া আরও একটা দিক আছে। আব্বা বলেন, গৌরবময় একটা স্মারক হিসেবে মোপলা নামটা আমরা ধারণ করে আসছি। মোপলা শব্দটি মূলত ‘মক্কা পিল্ল’। যার অর্থ মক্কাবাসী। আমাদের পূর্ব পুরুষরা মক্কা থেকে ব্যাবসায় ও ধর্ম প্রচারের মিশন নিয়ে এসে মালাবার অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তারা ‘মক্কা পিল্ল’ বা ‘মক্কাবাসী’ হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত হতেন। মক্কা পিল্লাই আজকের ’মোপলা’। মোপলা নাম ধারণের মাধ্যমে মহান এক অতীতকে জীবিত রাখতে চাই আমরা।’
‘তোমরা আন্দামানে কেন? তোমাদের পূর্ব পুরুষরা বৃটিশ বিরোধী যুদ্ধে যুক্ত ছিল সেজন্যে?
‘আমার দাদা এবং তাঁর আরও এক চাচা বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে দীপান্তর দণ্ড লাভ করে ১৯২২ সালে আন্দামানে আসেন। আমার দাদার আব্বা আবদুল্লাহ আলী মোপলা ছিলেন মালাবারের এক প্রভাবশালী সর্দার। আমাদের বাড়ি ছিল মালাবারের তখনকার এক বন্দর ‘মুজিরিস’ (কেন্নানুর) শহরে। আমার দাদার আব্বা উক্ত আবদুল্লাহ আলী মোপলা মালাবারের ওয়ালুভানদক অঞ্চল থেকে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এভাবে একেকটা অঞ্চল একেকজন সরদারের হাতে দেয়া হয়েছিল। শুরুতেই বৃটিশরা ওয়ালুভানদক থেকে আমার দাদার আব্বা এবং এরনাদ অঞ্চলের সর্দারকে গ্রেফতার করে। তার ফলে যুদ্ধ দ্রুত শুরু হয়ে যায়। এরনাদ ও ওয়ালুভানদক তথা গোটা মালাবার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুদ্ধ শেষে যে এক হাজার জনের ফাঁসি হয় তাদের মধ্যে আমার দাদার আব্বা আবদুল্লাহ আলী মোপলা ছিলেন। হাজার হাজার নিহতের মধ্যে আমার দাদার আব্বার তিন ভাই ছিলেন। গোটা পরিবারের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল আমার দাদার আব্বা এবং তার এক চাচা। তারা আন্দামানে দ্বীপান্তর দণ্ড লাভ করেন। মালাবারের দুই হাজার মোপলা মুসলমান দ্বীপান্তর দণ্ড লাভ করে আন্দামানে আসেন।’
‘শাহ বানুর মা সাহারা বানুও তো মোপলা মেয়ে।’
‘জ্বি স্যার। ১৯২১ সালে মালাবারে বৃটিশ বিরোধী যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে যুদ্ধ সংগঠিত করার অভিযোগে মালাবারের এরনাদ এলাকার যে সরদারকে গ্রেপ্তার করা হয় তার নাম আবু বকর আবদুল্লাহ। তারও ফাঁসি হয়। তার ছেলে ওমর ফারুক আবদুল্লাহ আন্দামানে দ্বীপান্তর দণ্ড লাভ করেন। এই ওমর ফারুক আবদুল্লাহরই নাতনি মুহতারামা সাহারা বানু।’
‘সাহারা বানু তো ইরানী নাম। অবশ্য জানি না মোগল বা মোপলাদের মধ্যে এ ধরণের নাম আছে কিনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মোগলদের মধ্যে আছে স্যার। মোপলাদের মধ্যে নেই। আসল ব্যাপার হলো মুহতারামা সাহারা বানুর আব্বা হায়দরবাদে পড়ার সময় একজন ইরানী সহপাঠিনীকে বিয়ে করেন। সেখোন থেকেই মোপলাদের মধ্যে এ নাম এসেছে।’
‘ধন্যবাদ তারিক। তোমার কাছে অনেক কিছু জানলাম। শাহ বানুদের এত কিছু জিজ্ঞাসার সুযোগ হয়নি।’
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘বিরাট একটা ঝুঁকি নিয়েছি তারিক। তোমার বন্ধুর সেই পুরাতত্ব অফিসে শংকরাচার্য ও শাহ বানুদের পেতেই হবে। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি দু’কুলই হারাবো।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
উদ্বেগ দেখা দিল তারিকের চেহারায়। বলল, ‘আমি জানতে পারি কি ঘটনা?’
‘হ্যাঁ জানতে পার’ বলে আহমদ মুসা সংক্ষেপে তার আন্দামানে আসার উদ্দেশ্য এবং এ পর্যন্ত কি ঘটেছে তার বিবরণ দিয়ে বলল, গতকাল রাতে শংকরাচার্য আমাকে হুমকি দিতয়েছে আমি যদি আজ সকাল ৮টায় তাদের কাছে আত্মসমর্পণ না করি, তাহলে শাহ বানু ও সাহারা বানুদের লাঞ্চিত করা হবে, তাদের পবিত্রতা নষ্ট করা হবে। আমি আত্মসমর্পণের জন্য তাদের নির্দেশিত জায়গা ঐ উপকূলে সকালেই এসে নেমেছি। ওখান থেকে দু’আড়াই মাইল পশ্চিমে একটা নির্দিষ্ট স্থানে একটা গাড়ি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাতে ঠিক ৮টায় গাড়িতে গিয়ে শংকরাচার্যের লোকদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ঐ গাড়ি আমাকে বন্দী করে নিয়ে যাবে শংকরাচার্যের কাছে। আমি উপকূলে নেমে ঐ গাড়ির দিকেই যাত্রা করেছিলাম। এমন সময় তোমার ঘটনা ঘটল। তোমাকে যে পদ্ধতিতে ওরা হত্যা করতে চেয়েছিল, সেটা দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল শংকরাচার্য এ ঘটনার সাথে জড়িত। তারপর যখন আহত ঐ লোকটির কাছ থেকে শুনলাম পুরাতত্ব অফিস থেকে তোমাকে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছে, তখন আমার সন্দেহ দৃঢ় হলো। পরে তোমার কাছ থেকে নিশ্চিত জানলাম যে শাহ বানু ও সাহারা বানুকে ঐ পুরাতত্ব অফিসেই তোলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে আত্মসমপর্ণের সময়ের আগেই শাহ বানুদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন আত্মসমপর্ণের সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ করিনি, এ খবর শংকরাচার্যের কাছে পৌঁছার আগে আমাদের শাহ বানুদের কাছে পৌঁছতে হবে। ওদের না পাওয়ার কথা ভাবতেই পারছিনা আমি।’
তারিক অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে। সব আতংক, বিসম্য় ও বিমুদ্ধতা এসে ঘিরে ধরেছিল তারিক মুসা মোপলাকে। সে আতংকিত হয়ে পড়েছিল শাহ বানুদের সম্ভাব্য পরিণতির কথা শুনে। বিস্মিত হয়েছিল আন্দামানে আহমদ মুসার রোমঞ্চকর কাহিনী শুনে। বিমুদ্ধ হয়েছিল শাহ বানুদের স্বার্থে নিজেকে শত্রুর হাতে তুলে দেবার আহমসদ মুসার ত্যাগ দেখে।
আহমসদ মুসার থামার পরেও অনেকক্ষণ কথা যোগালনা তারিকরে মুখে। একটু পর বলল, ‘স্যার, রাতে ওরা অবশ্যই ওখানে ছিল। এত সকালে কোথাও স্থানান্তর করার কথা নয়, বিশেষ করে যখন আপনার সকাল ৮টায় আসার কথা। এখন মনে পড়ছে স্যার, ক্লোরোফরম করে আমাকে সংজ্ঞাহীন করা হয় সকালে। তার আগে একজন লোক আমাকে বলেছিল, তুই মরতে এসেছিলি কেন? যাদের বাঁচাতে এসেছিলি, তারা কিন্তু বেঁচে আছে, মরতে হবে তোকে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওদের কোন ক্ষতি হবে না তো? লোকটি বলেছিল, ওদের বাঁচিয়ে রাখা হবে অবশ্যই। ধরা হয়েছে বড় টোপ হিসেবে। টার্গেট শিকার না হওয়া পর্যন্ত তারা থাকবে। সুতরাং আমি মনে করি স্যার, ওঁদের পাওয়া যাবে।’
‘তোমার কথা সত্য হোক।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি প্রবেশ করেছে পোর্ট ব্লেয়ার শহরে।
প্রবেশ করল লর্ড মেয়ো রোডে।
কিছুক্ষণ চলার পর তারিক বলল, ‘আমরা এসে গেছি স্যার। সামনে বাঁ দিকের পুরনো বাড়িটাই পুরাতত্ব অফিস। বৃটিশ আমলে এই বাড়িটা ছিল আঞ্চলিক গোয়েন্দা অফিস।’
আহমদ মুসা বাড়িটা থেকে ২শ গজ দক্ষিণে একটা বাড়ির সামনে রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়ানো কাঁঠাল জাতীয় একটা গাছের নিচে গাড়ি দাঁড় করাল। সেখান থেকে পুরাতত্ব অফিস বাড়িটার পেছনে দিকেরও অনেকখানি দেখা যায়। আহমদ মুসা একটু ভেবে নিয়ে বলল, অফিস বিল্ডিংসহ দু’টি আবাস গৃহের কোনটিতে কি পেছনে ইমারজেন্সী এক্সিটের মত কোন দরজা আছে?’
তারিক মনে করার চেষ্টা করে বলল, ‘স্যরি। আমি জানিনা। বাড়িগুলোর পেছনের দিকে কোন সময় যাওয়া হয়নি।’
‘অল রাইট। আমি খুঁজে নেব। থাকলে পাওয়া যাবে।’
একটা বাক্যে কথাটার ইতি টেনে আহমদ মুসা পায়ের মোজায় গুঁজে রাখা এবং পকেটে রাখা দু’টি রিভলবার বের করে দেখল সম্পূর্ণ গুলি ভর্তি আছে কিনা। তারপর উপকূলে আহত লোকটার কাছ থেকে নেয়া রিভলভারটিতেও পাঁচটা গুলি ঠিকঠাক রয়েছে দেখল। এই রিভলবারটি আহমদ মুসা মাথার নিচে ঘাড়ে জ্যাকেটের কলারের বিশেষ পকেটে রাখল। কাজটা শেষ করে ঘুরল তারিকের দিকে।
তারিক অপলক চোখে আহমদ মুসার যুদ্ধসাজ দেখছে। তার মুখ বিস্ময় ও উদ্বেগে ভরা।
আহমদ মুসা নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘শোন তারিক, এখন ৭টা বেজে ৩৫ মিনিট। তুমি ঠিক আটটার সময় পুরাতত্ব অফিস-বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর মধ্যেই ইনশাআল্লাহ ফিরে আসব। আর যদি না…………..।’
কথা শেষ করতে পারলনা আহমদ মুসা। তারিকের ডান হাত ছুটে এসে আহমদ মুসার মুখ চেপে ধরেছে। বলল তারিক, ‘স্যার, অবশিষ্ট কথাটা বলবেন না। আল্লাহ এ রকম করবেন না।’ অশ্রুতে ছল ছল করছিল তারিকের দু’চোখ। তার কথার সাথে দু’ফোটা অশ্রু গড়িঢে পড়ল তার দু’গণ্ড বেয়ে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিক আছে বললাম না।’
আহমদ মুসা তারিকের পিঠ চাপড়ে সান্তনার সুরে বলল, ‘অশ্রু মুছে ফেল তারিক। এটা যুদ্ধক্ষেত্র। ইসলামের মহান সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ নিজেদের সব জাহাজ পুড়িয়ে ফেলে পিছু হটার পথ বন্ধ করে স্পেনের রণাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সেনাপতির নামে তোমার নাম। তোমাকে ভাবতে হবে, ন্যায়ের স্বার্থে অন্যায়ের প্রতিবাদে গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে আমি শির উঁচু করে দাঁড়াব। মনে রেখ অশ্রু মানুষকে দুর্বল করে।’
‘কিন্তু গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে বা পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই তো চলেনা।’
‘লড়াই করার দরকার নেই। তুমি তাদের সাথে একমত নও, এটা জানিয়ে দিতে হবে। এটা্ই শির উঁচু করে দাঁড়ানো।’
‘এতে কিন্তু বিজয় আসবেনা এবং অন্যায়ের প্রতিবিধান হবে না।’
‘বিজয় আসবেনা, কিন্তু আখেরাতে তোমার মুক্তি নিশ্চিত হবে। বিজয়ের ভাবনা তোমার নয়, আল্লাহর। বিজয় দেয়ার সময় হয়েছে কি হয়নি, এটা ঠিক করা একমাত্র তারই এখতিয়ার। এটা যদি তোমার ঈমান হয়, তাহলে দেখবে হতাশা কোন সময়ই স্পর্শ করবেনা তোমাকে এবং কাজ করার শক্তি ও উৎ’সাহ বহুগুণ বাড়বে। বিজয়ের চিন্তাই যে মানুষকে, বিজয় না আসা এ ধরণের মানুষদের দুর্বল ও হতাশাগ্রস্থ করে এবং এই হতাশাগ্রস্থততাই তাকে পথভ্রষ্ট করে চরমপন্থার দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং তোমার দায়িত্ব শতভাগ পালন করেছ কিনা সেটা দেখবে। সবাই তার দায়িত্ব শতভাগ পালন যদি করে, তাহলে এক সময় আল্লাহর দেয়া বিজয় আপনাতেই এসে দ্বারে করাঘাত করবে।’
বলে আহমসদ মুসা সালাম দিয়ে গাড়ি থেকে নামল।
সোজা ফুটপাতে উঠে গেল।
চলতে লাগল গাছতলা দিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে।
পলকহীন চোখে তারিক তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। বুঝল সে, তার স্যার একটা দূরত্ব পর্যন্ত পশ্চিমে এগিয়ে তারপর পুরাতত্ব বাড়ির পেছনে যাবার পথ ধরবে।
তারিক ঘড়ির দিকে তাকাল। ৭টা ৩৭ মিনিট। আর ২২ মিনিট হাতে আছে। সামনে থেকে হর্নের শব্দ কানে এল তারিকের। ঘড়ির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে তাকাল সামনের দিকে। দেখতে পেল, পুরাতত্ব বাড়ির সামনে একটা মাইক্রো এসে দাঁড়িয়েছে। তার দেখা গতকালকেরেই সেই মাইক্রোই।
হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল তারিকের। সতর্ক হয়ে উঠল সে।
পরক্ষণেই মাইক্রো থেকে পাঁচ ছয় জন লোক নেমে মাইক্রোর গেট খোলা রেখে গেটের সামনে দু’ভাগ হয়ে দাঁড়াল।
তারিক বুঝল মাইক্রোতে কাউকে এনে উঠানোর জন্য তারা অপেক্ষা করছে।
‘তাহলে কি শাহ বানুদের আবার………………।’ এতটুকু চিন্তা আসতেই আঁৎকে উঠল সে।
সে তৎক্ষণাৎ গাড়ির দরজা খুলে নেমে প্রাণপণে ছুটল আহমদ মুসার দিকে। ছুটার সাথে সাথে সে ‘স্যার’, ‘স্যার’ বলে চিৎকার করছে।
আহমদ মুসার কানে পৌঁছেছে তারিকের ডাক। দ্রুত সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ডান শোনার সাধে সাথে তার মনে শংকা জেগেছে।
আহমদ মুসা দেখল তাকে ঘুরতে দেখে তারিক হাত দিয়ে ইঙ্গিত করছে পুরাতত্ব অফিসের সামনের দিকে।
ইঙ্গিত দেখেই ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। তাহলে কি শাহ বানুদের কোথাও সরিয়ে নিচ্ছে! তারিকের পাগলের মত ছুটা ও চিৎকারের এটাই তো অর্থ হতে পারে।
এবার ছুটল আহমদ মুসা তাদের গাড়ির কাছে ফিরে আসার জন্যে।
তারিক থমকে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা তার কাছাকাছি আসতেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘স্যার, পুরাতত্ব অফিসের সামনে মাইক্রো। কাউকে গাড়িতে তোলার আয়োজন করছে।’
আহমদ মুসা কিছু না বলে তার ছুটা অব্যাহত রাখল।
গাছের তলা পর্যন্ত আসতেই আহমদ মুসা দেখতে পেলো, কয়েকজন কাউকে টেনে-হেঁচড়ে গাড়িতে তুলছে। পাশে ওদেরই অোরও লোক দাঁড়িয়ে থাকায় পরিষ্কার দেখা গেলনা, কিন্তু কাপড়-চোপড়ের যে অংশ বিশেষভাবে দেখা গেল তাতে একাধিক মহিলাকে গাড়িতে উঠানো হচ্ছে তা নিশ্চিত।
আহমদ মুসা ছুটে এসে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসল। তারিক এসে বসল পাশে। মাইক্রো তখন স্টার্ট নিয়ে ফেলেছে।
এদিকেই মাইক্রোটি গড়াতে শুরু করেছে। তার মানে মাইক্রোটি দক্ষিণে কোথাও যাবে।
খুশি হলো আহমদ মুসা মাইক্রোটিকে এদিকে আসতে দেখে। সিদ্ধান্ত সে নিয়ে নিয়েছে, এখানেই সে আটকাবে মাইক্রোটিকে।
মাইক্রোটি আসছে।
রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত।
আহমদ মুসা রাস্তার পশ্চিম পাশে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আর মাইক্রোটি আসছে রাস্তার পূর্ব পাশ দিয়ে। মাইক্রোটি আহমদ মুসার গাড়ির সমান্তরালে এলে দু’গাড়ির মধ্যকার দূরত্ব দাঁড়াবে বিশ গজের মত।
পরিকল্পনা করে ফেলল আহমদ মুসা।
দু’হাতে দুটি রিভলবার তুলে নিল আহমদ মুসা। দু’তর্জনি দু’ট্রিগারে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
মাইক্রোটি এসে পড়েছে। মাইক্রোর ভেতরের অবয়বগুলো এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশের জানালায় কাঁচ নামানো। সামনের সীটে আছে দু’জন, মাঝের সিটে তিনজন এবং পেছনের সিটে শাহ বানু ও সাহারা বানুকে নিয়ে ৪ জন।
মাইক্রোর দু’টি দরজাই পূব দিকে।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। রিভলবার ধরা দু’হাত তার পেছনে।
মাইক্রোটি আহমদ মুসার গাড়ির সমান্তরালে এসে যাচ্ছে।
‘তারিক তুমি গাড়িটা রাস্তার ওপাশে মাইক্রোর পেছনে নিয়ে আসবে।’
মুখের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই রিভলবার ধরা তার দু’হাত উপরে উঠেছে। দু’রিভলবারের গুলি তার একসাথেই বেরিয়ে গেল। তার ডান হাতের রিভলবার গুলি করেছে মাইক্রোর সামনের ডান দিকের চাকায় আর বাম হাতের রিভলবারের গুলী গিয়ে বিদ্ধ করেছে ড্রাইভারকে।
গুলীর রেজাল্ট না দেখেই আহমদ মুসা বাঘের মত দীর্ঘ এক লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে চরকির মত নিজের দেহটা মাটির উপর গড়িয়ে রাস্তার ওপাশে চলে গেল।
মাইক্রোতে ফুল স্পীড ছিলনা। গুলী খাওয়ার পর মাইক্রোটি প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে কাত হয়ে গিয়ে আবার এঁকে-বেঁকে একটু সামনে এগিয়ে ফুটপাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে থেমে গেল।
মাইক্রো থামলেও মাইক্রোর ভেতরের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল না। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ধাক্বায় নাকাল হওয়া, আকস্মিক আক্রমণে বিমুঢ় হয়ে পড়া এবং শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি এসব কারণে তাদের বের হতে বিলম্ব হলো। অন্যদিকে আহমদ মুসা মাইক্রো দাঁড়াবার সাথে সাথেই গড়িয়ে গিয়ে মাইক্রোর পেছনে অবস্থান নিল।
মাইক্রো থেকে বের হতে ওরা দেরি করলেও হুড়মুড় করে ওরা অবার একসাথেই ৬ জন বেরিয়ে এল।
ওরা বেরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ির পেছনে বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যাতে ওদের সবাইকে চোখের সামনে আনা যায়।
আহমদ মুসাকেও ওরা দেখতে পেল।
আহমদ মুসার দু’হাতের রিভলবার তাক করা ছিল ওদের দিকে।
কিন্তু বেপরোয়া ওরা ওদের হাতের রিভলবার তুলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। দু’রিভলবার দিয়ে ছয়জনকে তাক করা যায়না, এ ধারণাই কাজ করেছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু হাতের রিভলবার টার্গেট পর্যন্ত তোলা ও গুলী করার জন্যে যে সময়ের প্রয়োজন তাতে দু’রিভলবার কেউ কেউ ছয়জন কেন তারও বেশি লক্ষ্যভেদ যে করতে পারে, সেটা তাদের বিবেচনায় আসেনি।
এর ফল তাদের ভোগ করতে হলো। আহমদ মুসার দু’রিভলবার পাখির মসতো শিকার করল ওদের ছয়জনকে।
ছয় গুলী শেষ করেই আ্হমদ মুসা তাকাল গাড়ির ভেতরে শাহ বানুদের অবস্থা দেখার জন্যে। দেখতে পেল শাহ বানু ও তার মা দু’ জনেই আহমদ মুসার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। সাহারা বানুকে আহত দেখল আহমদ মুসা। তার কপাল সম্ভবত থেঁতলে গেছে। সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর পরেও দু’জনেরই মুখ ভরা আনন্দ এবং চোখ উপচানো খুশির ঔজ্জ্বল্য।
আহমদ মুসা দ্রুত খোলা দরজার সামনে গিয়ে একটু নিচু হয়ে বলল, ‘খালাম্মা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন, শাহ বানু এস।’
আহমদ মুসা ধরে ওদের নামিয়ে আনল।
এ সময় তারিকও গাড়ি এনে মাইক্রোর পেছনে দাঁড় করাল।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই গাঁড়ি থেকে নামল তারিক। খুলে দিল পেছনের দরজা।
আহমদ মুসা শা বানু ও সাহারা বানুকে ধরে গাড়ির দিকে আনছিল।
শাহ বানু ও সাহারা বানুর চোখে-মুখে আনন্দের ঔজ্জ্বল্য ফিরে এলও তাদের শরীরের আতংকজনিত ভেঙে পড়া অবস্থা যায়নি। তারা দাঁড়াতে গিয়েও কাঁপছিল।
আহমদ মুসা ওদেরকে গাড়িতে বসিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তারিক তুমি রিভলবারগুলো কুড়িয়ে আন, কুইক।’
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
তারিকও রিভলবার কুড়িয়ে এনে আহমদ মুসার পাশের সিটে বসল।
এলাকাটি অফিস এলাকা হলেও এবং অফিসের সময়ের দেড় ঘণ্টা বাকি থাকলেও বেশ দূরত্বে দু’চারজন জমা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তাকাল পুরাতত্ব অফিসের দিকে। ওরা জানতে পেরেছে কিনা, দেখতে পেয়েছে কিনা- এটা একটা বড় বিষয়।
আহমদ মুসা দেখতে পেল অফিসের সামনে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আরও দু’জন ভেতর থেকে ছুটে এল। তারপর চারজনেই ছুটল অফিসের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ানো জীপরে দিকে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। ওরা চারজন তাহলে জীপ নিয়ে তাকে ফলো করবে। ওদের মধ্যে শংকরাচার্য নেই। এখানে মৃত ছয়জনের মধ্যেও শংকরাচার্য নেই। সে তাহলে গেল কোথায়?
আহমদ মুসা আপাতত এ ভাবনা রেখে পায়ের পাশ থেকে একটা ব্যাগ তুলে পেছন দিকে এগিয়ে ধরে শাহ বানুদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘শাহ বানু ব্যাগে দেখ ফাস্ট এইডের জিনিস রয়েছে। খালাম্মার আহত জায়গাটায় ফাস্ট এইড লাগাও।’
‘আমরা ভাল আছি বেটা। আমাদের কথা ভেবনা। নতুন জীবন পেয়েছি। কোন কষ্টই কষ্ট নয়।’ বলল সাহারা বানু।
আহমদ মুসার গাড়ি লর্ড মেয়ো রোর্ড থেকে কালিকট রোডে পড়ল। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে দক্ষিণে কালিকটের দিকে যাবার এটাই সবচেয়ে সোজা পথ। পোর্ট ব্লেয়ার ও কালিকটের মধ্যবর্তী সেই উপকূলই আহমদ মুসার টার্গেট।
কালিকট রোডে পড়ার পর আহমদ মুসা রিয়ারভিউতে দেখল, জীপটি ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা গাড়ির গতি বাড়াল না।
শহর ছেড়ে পাহাড় এলাকায় প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়িকে ফলো করে আসার জীপটাকে শাহ বানুরাও দেখতে পেয়েছে। তারা ঘন ঘন তাকাচ্ছে পেছন দিকে। তাদের মুখে-চোখে আবার ফুটে উঠেছে সেই আতংকের ভাব।
আহমদ মুসার গাড়ির স্পীড কমমে কমতে এক সময় ‘ডেড স্টপ’ হয়ে থেমে গেল।
আহমদ মুসা দু’টি রিভলবার হাতে নিয়ে বলল, ‘শাহ বানু গোলাগুলী শুরু হয়ে গেলে তুমি খালা আম্মাকে নিয়ে সীটে শুয়ে পড়বে। তারিক তুমিও।’
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনে চলে গেল। খুলল ইন্জিনের ঢাকনা।
‘গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে?’ আর্তকণ্ঠে বলল সাহারা বানু।
কে উত্তর দেবে এই প্রশ্নের। শাহ বানুর চোখে-মুখেও নেমেছে মৃত্যুর পাণ্ডুরতা। তারিকও উদ্বেগ-আতংকে মুষড়ে পড়েছে। এই ভয়ানক সময়ে তাদের গাড়ি খারাপ হল, এই চিন্তা তার মনকে দারুণ পীড়া দিচ্ছে।
পেছনের জীপ দেখতে পেয়েছে সামনের গাড়ির এই দুর্দশার চিত্র। জীপের ড্রাইভিং সীটের লোকটি অন্যদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি ঐ গাড়ির পেছনে জীপ দাঁড় করাচ্ছি। আসল লোক গেছে সামনে গাড়ি ঠিক করতে। গাড়িতে মেয়ে দু’টি আর একটি ছেলে। আমরা চারজন একসাথে নামব দু’জন দু’পাশ থেকে পাহারা দেব গাড়ি ঠিককরারত লোকটাকে। সে যেন আক্রমণে আসতে না পারে। আর দু’জন গিয়ে ছেলেটিকে কাবু করে বা হত্যা করে মেয়ে দু’জনকে বের করে আনবে।
ওদিকে আহমদ মুসা গাড়ির সামনের ঢাকনাটা তেুলে রেখে গাড়ির নিচে ঢুকে গেল। মাটি আঁকড়ে শুয়ে সাপের মতো গড়িয়ে গাড়ির পেছন দিকে এগুচ্ছিল।
গাড়িটা আহমদ মুসা এমন মজার জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখানে গাড়ির তলার জায়গাটা নিচু, দু’ধার আবার উঁচু। কিছুটা নালা গোছের। গাড়ির দু’ধারের চাকা পড়েছে নালার দু’ধারের উঁচু প্রান্তে। গাড়ির তলার নালা দিয়ে এগুতে আহমদ মুসার তাই কোন কষ্ট হলোনা। তবে নালা মত জায়গাটায় কাদা-পানি থাকায় মুখসহ সামনের দিকটা কাদার প্লাস্টারে ঢেকে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা যখন গাড়ির পেছনে পৌঁছে গেছে, তখনই জীপটি এসে দাঁড়াল আহমসদ মুসাদের গাড়ির চার পাঁচ গজ পেছনে। আহমদ মুসা জীপের উপরের অংশ ছাড়া দু’পাশ ও নিচের অংশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। আহমদ মুসা তার মুখ লম্বাভাবে মাটির উপর রেখে দু’হাতের দু’রিভলবার দিয়ে জীপের দু’পাশটাকে টার্গেট করল।
জীফ থামার সঙ্গে সঙ্গেই জীপের পাশ দিয়ে প্রায় একই সঙ্গে ৮টি পা নেমে এল। আহমদ মুসা ওদের নিচের অংশ দেখতে পাচ্ছিল, দেহের উপরের অংশ নয়।
আটটি পা দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওরা জীপ পার হয়ে মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় সহজ টার্গেটে আসার পর আহমদ মুসা স্থির লক্ষ্যে গুলী করা শুরু করল। দু’রিভলবার হতে চারটি ফায়ার হতেই চারজন মাটিতে পড়ে গেল।
এবার ওদের চারজনকেই আহমদ মুসা দেখতে পেল। চারজনই পায়ে গুলী খেয়েছে। ওরা বসে পড়ে উদভ্রান্তের মত চারদিকে খুঁজতে লাগল গুলী কোন দিক থেকে এল। ওদের হাতে তখনও রিভলবার, চোখে হিংসার আগুণ।
আহমদ মুসা তার রিভলবারের নল দিয়ে গাড়ির গার্ডারে দুটি আঘাত করল। একটা ধাতব শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ওদের চারজনের চোখই ছুটে এল এদিকে।
ওরা দেখতে পেল আহমদ মুসার মুখ এবং দু’হাতের রিভলবার।
প্রথমটায় ওরা ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল। তার পরক্ষণেই ওদের চারজনেরই রিভলবার উঠতে লাগল আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
কিন্তু আহমদ মুসার তর্জনি রিভলবারের ট্রিগার স্পর্শ করে তৈরি হয়েছিল। আহমদ মুসার দু’তর্জনি আবার দু’বার করে চাপল রিভলবারের ট্রিগার। বেরিয়ে গেল চারটি গুলী। নিঁখুতভাবে তা লক্ষ্যভেদ করল। চারটি দেহই এবার গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
গাড়ির পেছনে নালার মাথাটা ছিল তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ। বের হতে কষ্ট হলো। কর্দমাক্ত ‍ও ধুলি ধুসরিত দেহ নিয়ে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল।
শাহ বানু, সাহারা বানু ও তারিক সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওদের চারজনকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখে এবং আহমদ মুসাকে আশে-পাশে না দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছে তারা। আহমদ মুসাতে দু’হাতে রিভলবার নিয়ে গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওরা যেন প্রাণ ফিরে পেল। সাহারা বানু আহমদ মুসাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘বেটা তোমাকে না দেখে মনে হচ্ছিল গোটা জগৎ যেন মুছে গেল চোখের সামনে থেকে। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবি করুন, শত মায়ের শত বোনের অশ্রু মোছাতে তোমাকে সামর্থ দান করুন। তোমার এত কষ্টের শতগুণ জাযা আল্লাহ তোমাকে দান করুন।’
‘ধন্যবাদ খালাম্মা।’ বলল আহমদ মুসা
তারপর দ্রুতকন্ঠে বলল, ‘আসুন এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়তে হবে। আল্লাহর বিশেষ দয়া যে এতক্ষণ কোন গাড়ি এদিকে আসেনি।’
ইতোমধ্যে তারিক মৃত চারজনের রিভলবার ও মোবাইল সংগ্রহ করেছে।
আহমদ মুসা তারিকের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘এই তো যুদ্ধের ট্রেনিং শুরু করে দিয়েছে। সাবাস!’
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভাইয়া, সামনের দিকের কাপড় শুধু ভিজা নয় একদম কাদায় লেপটে গেছে। আপনার ব্যোগে বাড়তি কাপড় দেখেছি….।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল শাহ বানু। কথা শেষ না করেই থেমে গেছে শাহ বানু।
‘কিছু ভেব না শাহ বানু, আমার এ সবে অভ্যেস আছে।’ হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা।
সবাই গাড়িতে উঠল
আবার গাড়ি ছুটে চলল।
‘স্যার, মাফ করবেন। একটা কথা। আপনি গাড়ির নিচে ঢুকবেন তো গাড়ির ঢাকনা তুললেন কেন? আমি তো ভয় পেয়েছিলাম, গাড়ি বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে।’
‘ঢাকনা না তুললে তো ওরা গাড়ির সামনেটাও দেখতে পেতো। যদি দেখতে পেতো আমি নেই তাহলে ওরা সাবধান হয়ে যেত এবং আমাকে খোঁজার কাজটাই তারা প্রথমে করত। আমাকে গাড়ির তলায় ওরা খুঁজে পেতেও পারতো।’
‘ঠিক স্যার।’ বলল তারিক।
‘তারিক তুমি আহমদ মুসাকে ‘স্যার’ বল? ভাই বল না?’
চমকে উঠল তারিক ‘আহমদ মুসা’র নাম শুনে। দ্রুত পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘খালাম্মা ইনি আহমদ মুসা?’ কন্ঠে তার রাজ্যের বিস্ময়।
‘কেন তুমি ‘আহমদ মুসা’কে চেননা? তোমার ‘স্যার’ আহমদ মুসা জাননা?’ বলল সাহারা বানু।
তারিক ভূত দেখার মত শ্বাসরুদ্ধকর এক অনুভূতি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
নির্বাক বিস্ময়ে সে তাকিয়েই রইল। মনের ভেতরে তোলপাড়। এই আহমদ মুসা! সকাল থেকেই আহমদ মুসার পাশেই সে আছে! আহমদ মুসা হুকুম দিচ্ছে, ঐ হুকুম তামিল করার সৌভাগ্য সে লাভ করেছে! সেই বিরাট আহমদ মুসা এত সহজ, এত সরল, এত আপন! গর্বে বুক ভরে উঠল তারিকের। আহমদ মুসার জীবন-মৃত্যুর অপরূপ খেলার সে চাক্ষুস সাক্ষী হতে পেরেছে, তার সাথী হতে পেরছে।
আনন্দ বিস্ময় আবেগ অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এল তার চোখ দিয়ে।
আহমদ মুসা ড্যাশবোর্ড থেকে একটা টিস্যু পেপার তুলে নিয়ে তারিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চোখের পানি মুছে ফেল তারিক। বলেছিনা যে, অশ্রু মানুষকে দুর্বল করে।’
‘এটা ভয়ের নয়, আনন্দের অশ্রু স্যার। বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বজনের আকস্মিক সাক্ষাতে যে অশ্রু ঝরে, তা মানুষকে দুর্বল নয় প্রাণবন্ত করে।’ তারিক বলল।
‘ধন্যবাদ তারিক। স্বজন পাওয়ার প্রতি আমার খুব লোভ।’
‘কিন্তু আমাদের মত আপনার কোটি কোটি স্বজন প্রতিটি সকাল সন্ধ্যায় আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্যে অপেক্ষা করছে স্যার।’
তারিকের কথা শেষ হতেই সাহারা বানু বলল, ‘বৃটেন থেকে ‘স্যার’ সম্বোধনে দেখছি একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে গেছ তারিক।’
‘খালাম্মা, তারিক আমার ছাত্র হতে চায়। এটা ভাল। আমি ওর ট্রেনিং শুরু করেছি। একজন বিরাট যোদ্ধা ওকে বানিয়ে ছাড়ব।’
‘ভাইয়া, যোদ্ধা কাউকে বানানো যায়? যোদ্ধা হওয়া তো মননের ব্যাপার।’ বলল শাহ বানু গম্ভীর কন্ঠে।
‘তোমার কথা ঠিক শাহ বানু। এক শক্তিশালী মনন ওর মধ্যে আছে বলেই আমি ওকে ট্রেনিং দিচ্ছি।’
একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল তারিকের চোখে-মুখে। সেই সাথে লজ্জাও। লজ্জাকর একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরেছে। শাহ বানুর প্রতি তার দুর্বলতার কথা, শাহ বানুর নেতিবাচক মনোভাবের কথা, ইত্যাদি বিষয় আহমদ মুসাকে বলা তার ঠিক হয়নি। এখন সে কি করবে! আহমদ মুসা ও শাহ বানুর উপস্হিতিতে পরিস্থিতি তার জন্যে যে মহাবিব্রতকর হয়ে উঠেছে।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল তারিকের দিকে। তার বিব্রত অবস্থা দেখতে পেল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল।
‘আমরা গন্তব্যে প্রায় এসে গেছি খালাম্মা। সামনেই উপকূল।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। সেই সাথে তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘খালাম্মা, পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বেশ দূরে ভিন্ন একটা জায়গায় আপনাদের নিয়ে যেতে চাই।’
‘কোথায় বেটা।’ বলল সাহারা বানু, শাহ বানুর মা।
‘মায়া বন্দর ও পাহলগাঁও-এর মাঝখানে গভীর জংগলে সবুজ উপত্যকার এক আদিবাসীদের জনপদে।’
‘ওখানে কে আছে?’
‘আমার বড়বোন এবং আমার দুলাভাই।’
‘তোমার ভাই-বোন কেউ নেই, বড় বোন কোথেকে এল?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পাতানো বড় বোন, তাঁকে বড় বোন ডেকেছি।’
‘হঠাৎ কোথায় কিভাবে তাঁদের পেলে? মাত্র কয়েক দিন তো তুমি পোর্ট ব্লেয়ারের বাইরে ছিলে?’
‘এই কয়েকদিনে অনেক ঘটনা ঘটেছে খালাম্মা।’
আহমদ মুসা কথা শেষ হবার সাথে সাথে গাড়ি- একটা ঝোপের পাশে দাঁড় করাল। বলল, খালাম্মা, এ ঝোপটা পার হলেই আমরা উপকূলের সামনে পড়ে যাব। এই উপকূলের ধারে তারিককে মেরে ফেলতে নিয়ে আসা লোকটি এখনও পড়ে থাকার কথা। সে আপনাদের দেখতে পাক, সেটা ঠিক হবেনা। আমি দেখে আসি। আপনার ঝোপের আড়ালে একটু দাঁড়ান।’
আহমদ মুসা গাড়ি নিতে গিয়েও নিলনা। ভাবল সে, আগে দেখা দরকার আহত লোকটি আছে। তারপর গাড়ি নেয়া যাবে।
এই ভাবনাকে আহমদ মুসা খুবই গুরুত্ব দিল। সরাসরি বাইরে না বেরিয়ে জংগলের আড়াল নিয়ে সে এগুলো সামনে।
এক সময় গোটা উপকূলইটাই তার নজরে এল। দেখল, ‘সেই আহত লোকটি নেই।’ বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল সকাল ৮টা চল্লিশ মিনিট বাজে।
নানা চিন্তা, নানা আশংকার বিষয় ঘুরপাক খেতে লাগল আহমদ মুসার মাথায়। যে গাড়িতে সকাল ৮টায় আমার কথা আত্মসমর্পণ করার জন্য, আমি না পৌঁছানোয় কি সে গাড়িটি উপকূলে এসেছিল খোঁজ নিতে? যদি তারা এসে থাকে, তারা পেয়ে গেছে আহত লোকটিকে। তার কাছে সব কথাই তারা শুনেছে এবং শুনেছে যে আমি সাড়ে ৮টায় ফিরে আসব।
এই চিন্তা তার যদি সত্য হয়, তাহলে এই উপকূলে কোথাও তারা ওঁৎপেতে অপক্ষো করছে আহমদ মুসার জন্যে। কোথায় তারা লুকাতে পারে? দু’পাশের কোন জংগলে নিশ্চয়।
যে কোন জংগলে তারা অপেক্ষা করতে পারে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। উত্তরেরও সন্ধান করতে লাগল।
আহমদ মুসা দক্ষিণ পাশের জংগল ধরে এগুচ্ছিল। পেছনে এই জংগলেরই একপাশে শাহ বানুদের সে লুকিয়ে রেখে এসেছে এবং এপাশের জংগলেই উপকূলে এক প্রান্তে এক ঝোপের ভেতরে বোটও লুকানো রয়েছে। আহমদ মুসা বোট থেকে নেমেছিল এ পাশের জংগলেরই কাছাকাছি জায়গায়। আবার তারিককে ডুবিয়ে মারার জন্যে তাকে পানিতে ফেলার জায়গাটাও দক্ষিণ পাশের জংগলেরই নিকটে। আর আহত লোকটিকে আহমদ মুসা যেখানে রেখে গিয়েছিল, সেটাও এই জংগলেরই কাছে। সুতরাং শত্রুরা যদি তার জন্যে ওঁৎপেতে থাকে, সেটাও তাহলে এ দক্ষিণ পাশের জংগলেই হবে।
এই চিন্তা করার সাথে আহমদ মুসা ক্রলিং করে সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগুতে লাগল।
কিছুটা এগুবার পর আহমদ মুসা নাকে সিগারেটের গন্ধ পেল।
থেমে গেলে আহমদ মুসা।
সে উপরে গা্ছের দিকে তাকিয়ে পাতার নড়া-চড়া থেকে বুঝল বাতাস সামনে থেকে মানে পূর্ব দিক থেকে বইছে তাহলে ঠিকই যাচ্ছে আহমদ মুসা। সামনেই শত্রুদের সে পেয়ে যাবে।
ক্রলিং করে আরও মিনিট দুই এগুবার পর আহমদ মুসা চাপা কথার আওয়াজ পেল।
আরও এগুলো আহমদ মুসা।
চোখে পড়ে গেল ওরা আহমদ মুসার। জংগলের মধ্যে একটা গোলমত জায়গায় একটা তোয়ালে বিছিয়ে ৪ জন তাস খেলছে। আর দু’জন একটা গাছের আট দশ ফিট উঁচু ডালে উত্তরমুখী হয়ে বসে ফাঁকা উপকূলের দিকে নজর রেখেছে। গাছে বসা দু’জনেই সিগারেট খাচ্ছে।
হঠাৎ একটা কুকুরের আকাশ-ফাটা চিৎকারে চমকে উঠল আহমদ মুসা। দেখল সে, ওদের পাশে কুকুরটা শুয়ে ছিল, লাফ দিয়ে উঠল। উঠার আগেই সে চিৎকার দিতে শুরু করেছে। বোধ হয় কুকুরটি ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। উঠেই সে পরিচিত গন্ধ পেয়েছে, যদি আহমদ মুসার কোন জিনিস কুকুরটিকে শুকিয়ে রাখা হয়ে থাকে। অথবা অপরিচিত গন্ধ পেয়েও কুকুরটি ক্ষেপে উঠতে পারে। এসব ভাল আহমদ মুসা।
কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠার সাথে সাথে চারজনের তাস খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। জংগলের আড়ালে থাকার কারণে তারা আহমদ মুসাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু ডালে বসা দু’জন লোক ঠিকই দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। তাদের হাতেও উঠে এসেছে রিভলবার।
আহমদ মুসার দু’হাতে দু’রিভলবারের দুটি গুলি সে একই সাথে করেছে ডালে বসা দু’জনকে লক্ষ্য করে।
বুকে গুলি খেয়ে দু’জনেই ডাল থেকে খসে পড়ল মাটিতে।
ওদিকে ওরা কুকুরের চেন খুলে দিয়েছে।
ছুটতে শুরু করেছে কুকুর। ওরা চারজন কুকুরের পেছনে। তাদের হাতের রিভলবার বাগিয়ে ধরা। হিংস্র দৃষ্টি তাদের চোখে।
আহমদ মুসার রিভলবার ডালের দু’জনকে গুলি করেই লক্ষ্য নামিয়ে নিয়ে এসেছিল নিচে কুকুর এবং সেই চারজনের দিকে।
আহমদ মুসার বাম হাতের রিভলবার টার্গেট করেছে ছুটে আসা কুকুরটিকে। গোলাকৃতি সেই ফাঁকা জায়গা থেকে জংগলে ঢোকার বেশ আগেই মাথায় গুলী খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল কুকুরটি। আর ডান হাতের রিভলবার টার্গেট করল চারজন লোককে। অধীকতর ক্ষীপ্র আহমদ মুসার ডান হাত তার সাথে বাম হাত যোগ দেবার আগেই অব্যর্থ গুলীতে তিনজনকে শিকার করা সমাপ্ত করল। বাম হাত এসে চতুর্থ জনকে গুলী করে ওদের আক্রমণে আসার চেষ্টার ইতি ঘটাল।
ঘটনার এ জায়গা থেকে উপকূলের ফাঁকা এলাকা দশ গজের বেশি দূরে নয়।
আহমদ মুসা জংগল থেকে বেরিয়ে এল। সে তাকাল শাহ বানুরা যে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে ঝোপের দিকে। দেখল, ঝোপের আড়াল থেকে তারিক উঁকি দিচ্ছে। আহমদ মুসাকে দেখে সে ঝোপের আড়াল থেকে বাইরে এল। আহমদ মুসা তাকে গাড়িসহ সবাইকে নিয়ে আসার জন্য ইঙ্গিত করল।
দু’মিনিটের মধ্যেই তারিক সবাইকে নিয়ে হাজির হলো।
গাড়ি থামতেই শাহ বানু প্রথম নামল। বলল, ভাইয়া, আপনি ভাল আছেন তো। গুলীর আওয়াজ শুনলাম, কুকুরের আওয়াজ শুনলাম। ওদের…….।’
‘ভাল আছি। গুলীর আওয়াজ ছিল আমার, কুকুরের আওয়াজ ছিল ওদের।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা কারা?’ বলল সাহারা বানু।
অন্যেরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল।
‘আসুন’ বলে আহমদ মুসা সবাইকে জংগলের ভেতরে নিয়ে গেল। দেখাল ৬ জনের লাশ। বলল, ‘এরা এখানে ওঁৎ পেতে বসে ছিল আমাদের অপেক্ষায়।’
‘কিন্তু আমরা এখানে আসব তা ভাবল কি করে? প্রশ্ন করল শাহ বানু।
‘যে আহত লোকটিকে রেখে গিয়েছিলাম, তাকে আমি বলে গিয়েছিলাম সাড়ে ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্যে। আমি ঠিক করেছিলাম, আমি ফিরে এলে সেই গাড়িতে সে যেতে পারবে। কারণ আমার গাড়ির আর দরকার হবে না।’
‘তাকে যখন বাঁচাতে চাও, তখন যাবার সময় লিফট দিলে পারতে। গাড়ি পাওয়া যায় এমন কোথাও নামিয়ে দিতে।’ বলল সাহারা বানু।
‘কিন্তু তাকে উদ্ধারের জন্যে আপনাদের ওখানে পৌঁছার আগেই সেখানে আমাদের খবর পৌঁছে দিত।
‘বুঝেছি। ধন্যবাদ বেটা।’
‘আহত লোকটি এই ছয়জনের মধ্যে আছে?’ বলল তারিক।
‘নেই। আমরা এখানে পৌঁছার আগেই শংকরাচার্যের কোন গ্রুপ মনে হয় এখানে এসেছিল। হতে পারে এখান থেকে দু’মাইল পশ্চিমে গিয়ে যাদের কাছে আমার আত্মসমপর্ণের কথা ছিল, তারাই এখানে এসেছিল। আহত লোকের কাছে সব শুনে গাড়িতে করে আহতকে পাঠিয়ে দিয়ে অন্যেরা আমাদের ধরার জন্যে এখানে অপেক্ষা করছিল এবং আমার মনে হয়, এরাই শংকরাচার্যকে জানিয়েছিল যে, আত্মসমপর্ণের বদলে আমি শাহ বানুদের উদ্ধার করতে গেছি। এই খবর পেয়েই শংকরাচার্য শাহ বানুদেরকে লর্ড মেয়ো রোডের ঐ বাড়ি থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিল।
‘তাই হবে ভাইয়া, আমাদের ঘরের বাইরে একজন আরেকজনকে বলছিল, ‘শয়তান ধরা দেয়নি। আর এ কুকুরকেও উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। এখানে আর বন্দীদের রাখা যাবে না। মহগুরুচী বলেছেন, ‘ওখানে গিয়েই বাঘের শিকার ধরার মহোৎসব হবে। মহাগুরু গাড়ি ঘুরিয়ে ওখানেই যাচ্ছেন।’
‘তোমরা কি জান বাঘের শিকার ধরার মহোৎসবটা কি?’
মুখটা ম্লান হয়ে উঠল শাহ বানুর। আতংক দেখা দিল তা চোখে-মুখে। মাথা নিচু করল সে। বলল, ‘জানি ভাইয়া, গত রাতেই শংকরাচার্য স্বয়ং এই হুমকি দিয়ে গেছে। আমার সারারাত আল্লাহকে ডেকেছি। আমাদের ছিল উভয় সংকট। আমাদের পরিণতির বিষয়টা যেমন ছিল অকল্পনীয়, আপনি আত্মসমর্পণ করলে আমরা, আপনি একসাথে বিপদগ্রস্থ হতাম।’
‘আমিও এটা জানতাম শাহ বানু।’
‘তাহলে আত্মসমপর্ণে রাজি হলেন কেন?’ জিজ্ঞাসা শাহ বানুর।
‘দু’কারণে রাজি হয়েছি। এক, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতিকে বিলম্বিত করা, দুই, তোমাদের উদ্ধারের একটা সুযোগ তৈরি করা। আল্লাহ সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।’
‘আল হামদুলিল্লাহ।’ একসাথে বলে উঠল শাহ বানু, সাহারা বানু দু’জনেই।
একটা নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল তারিক। বলল, ‘আমার একটা কৌতুহল স্যার, জংগলে এদের আপনি পেলেন কি করে? আমাদের পাহারায় থেকেও এরা গুলী ছুড়তে পারলোনা কেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি যখন আমার ছাত্র, তখন তো শেখাতেই হবে। শোন, যখন দেখলাম আহত লোকটি উপকূলে নেই, তখন বুঝলাম কেউ বা কারা এসেছিল। যখন শত্রুপক্ষের লোক এসেছিল, তখণ তারা অবশ্যই জেনেছে আমি এখানে ফিরে আসব। যখন তারা জেনেছে আমি ফিরে আসব, তখন অবশ্যই আমার জন্যে তারা ফাঁদ পাতবে। তারপর চিন্তা করেছি, দু’পাশের জংগলের কোন পাশে তারা অপেক্ষা করবে। সকল বিচারে আমি দেখলাম, দক্ষিণ পাশের জংগলে তাদের লুকিয়ে থাকা স্বাভাবিক। আমি দক্ষিণের জংগল ধরে অগ্রসর হলাম। এক জায়গায় পৌঁছে সিগারেটের গন্ধ পেলাম। বাতাসের গতি দেখে বুঝলাম, পূর্ব দিক থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। আমি ওদের সন্ধানে অগ্রসর হলাম এবং ওদের পেয়েও গেলাম। ওদের কুকুর আমাকে টের পেয়ে গিয়েছিল। ওদের দু’জন গাছের ডালে বসেছিল পাহারার জন্যে। তারা আমাকে দেখতে পেল এবং গুলী করতে যাচ্ছিল। তার আগেই আমি গুলী করলাম। এভাবেই ঘটনার ইতি হলো।’
‘ধন্যবাদ স্যার, এই কয়েক ঘন্টায় স্যার আমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছি।’ বলল তারিক।
‘এই তো উপযুক্ত ছাত্রের কাজ। এবার তুমি ছয়জনের মোবাইল ও রিভলবারগুলো এবং শা বানুদের নিয়ে বাইরে যাও। সামনের এক ঝোপে স্পীড বোট লুকিয়ে রেখেছি। ওটা নিয়ে আমি আসছি।’
বলে আহমদ মুসা দ্রুত হাঁটা শুরু করল পূর্বদিকে। ঝোপের আড়াল থেকে স্পীড বোট চালিয়ে পানিতে নেমে গেল।
শাহ বানুরাও তীরে এসে পড়েছে। বোটে উঠল সবাই।
‘স্যার, আমি বোট ভাল ড্রাইভ করতে পারি।’ বলল তারিক মুসা মোপলা।
‘কিন্তু রুট তো নতুন তোমার জন্যে।’ আহমদ মুসা বল।
‘অসুবিধা হবে না স্যার, আপনি তো পাশে থাকছেন।’
‘বেশ এস। তোমার উপর শিক্ষকতা করার আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল।’
বলে আহমদ মুসা সরে এল ড্রাইভিং সিট থেকে।
‘ধন্যবাদ স্যার’ বলে তারিক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। বসে বলল, ‘স্যার আপনার কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তেই শেখার আছে। আমার একটা গর্ব ছিল আমি গাড়ি ভাল ড্রাইভ করি, কিন্তু স্যার আপনার গাড়ি ড্রাইভ দেখে আমার মনে হয়েছে আমার বহু কিছু শেখার আছে।’
‘ধন্যবাদ তারিক। কি শিখতে হবে জানাটা কিন্তু একটা বড় শিক্ষা।’ বলে আহমদ মুসা বোটের ড্যাশবোর্ড থেকে একটা মানচিত্র বের করে আনল। সেটা তারিকের সামনে মেলে ধরে বলল, ‘দেখ রুটটাকে রেড মার্ক করে রেখেছি। এখন তুমি আন্দামানের পূর্ব উপকূল ধরে উত্তরে ১২ ডিগ্রী পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছার পর ডানে থাকবে হ্যাভলক আইল্যান্ড আর বামে দেখবে মেইণল্যান্ডের সাথে কীড দ্বীপপুন্জ। এ দ্বীপপুণ্জের উত্তর মাথা দিয়ে একটা চ্যানেল ঢুকে গেছে মেইন্যোন্ড। এ চ্যানেলটি পশ্চিম উপকূলে স্পাইক বে’তে গিয়ে পড়েছে। স্পাইক বে’ থেকে বের হয়ে তোমাকে আন্দামানের পশ্চিম উপকূল ধরে এগোতে হবে। উত্তরে অ্যান্ডারসন দ্বীপ পর্যন্ত গিয়ে অ্যান্ডারসন চ্যানেল দিয়ে এর মাথা পর্যন্ত পৌঁছে পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে কয়েক মাইল গেলেই গ্রীণ ভ্যালির উপকূল পাওয়া যাবে।’
থামল আহমদ মুসা।
তারিক মানচিত্রটি হাতে নিয়ে তার সামনে ড্যাশবোর্ডের উপর আবার রাখল।
চলতে শুরু করল বোট।
সাত সীটের বোটটি খুব সুন্দর।
ড্রাইভিং সীটের পেছনে ৬টি সীট বৃত্তাকারে সাজানো। মাঝখানে একটা নীচু গোলাকার টেবিল। চেয়ার ও টেবিল সবই ক্লোজ করে মেঝেতে ফেলে রাখা যায়। তখন বোটটি কার্গো বোট হয়ে দাঁড়ায়। আবার চেয়ার-টেবিল আনফোল্ড করলেই সুন্দর ট্যুরিস্ট বোট হয়ে দাঁড়ায়।
বোটের ইঞ্জিনে ডবল সাইলেন্সার লাগানো। কোন শব্দই হয়না। নিঃশব্দে তীরের মত এগিয়ে চলে বোটটি।
আহমদ মুসার কথা শেষ করার পর একটা নিরবতা নেমেছিল।
নিরবতা ভাঙল সাহারা বানু, শাহ বানুর মা। বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, ‘বেটা আমাদের দূর্ভাগ্যের খবর তুমি কিভাবে পেয়েছিলে? কখন পেয়েছিলে?’
‘গতকাল বিকেলে আমি সুষমা রাও- এর কাছে টেলিফোন করেছিলাম। আমার টেলিফোন পেয়েই সে কাঁদতে শুরু করে এবং বলে আপনারা কিডন্যাপড হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পারি যে কারা এই কাজ করেছে। গতকাল বিকেলেই আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে গ্রীনভ্যালিতে। আপনাদের যারা কিডন্যাপ করেছিল, তাদেরই বার জন লোক পর্যটকের ছদ্মবেশে গিয়েছিল গ্রীনভালিতে আমার খোঁজে আমাকে ধরে আনার জন্যে। তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়। তারা সবাই মারা যায়। তাদেরই একজনের মোবাইল থেকে শংকরাচার্যের টেলিফোন নাম্বার পাই। সন্ধ্যার পরে এই তাকে টেলিফোন করে আপনাদের বিষয়ে জানার জন্যে। সেই কথা বলার সময় হুমকি দেয় আজ সকাল ৮টার মধ্যে আমি তাদের হাতে আত্মসমর্পল না করলে সে আপনাদের ক্ষতি করবে। তাই রাতেই চলে এলাম, যাতে সকাল আটটার মধ্যে তাদের কাছে পৌঁছা সম্ভব হয়।’
‘কিভাবে এলে? এই বোট নিয়ে?’ বলল সাহারা বানু।
‘ওঁরা খুব ভালো লোক। আমি শংকরাচার্যের হাতে আটকা পড়লে বোট ওরা কোনদিনই আর ফিরে পাবেনা জেনেও অত্যন্ত মূল্যবান বোটটি আমাকে দিয়েছে যাতে ঠিক সময়ে আমি পৌঁছতে পারি এখানে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওঁদের কথা কিছুই শোনা হয়নি। কিন্তু তার আগে বল আমাদের রেখে চলে যাবার পর হঠাৎ তুমি নিরব হয়ে গেলে কেন? না এলে, না টেলিফোনেও কোন যোগাযোগ করলে। মাত্র গতকাল সুষমার সাথে তোমার যোগেোযগ হলো কেন?’ বলল সাহারা বানু।
‘মাঝখানে শংকরাচার্যদের হাতে বন্দী হয়েছিলাম, তারপর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যখন……..।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই শাহ বানু বলে উঠল, ‘বন্দী হয়েছিলেন? শংকরাচার্যদের হাতে?’ শাহ বানুর কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার উত্তর দেয়ার আগেই কথা বলল সাহারা বানু। বলল, ‘কি অসুখ হয়েছিল তোমার? নিশ্চয়ই কিছু অঘটন ঘটেছিল!’ সাহারা বানুর কণ্ঠেও উদ্বেগ।
‘হ্যাঁ, খালাম্মা আ্হত হয়েছিলাম। আমি যাচ্ছিলাম ‘রস’ দ্বীপে আহমদ শাহ আলমগীরের খোঁজে। সাগর থেকেই ওরা আমাকে বন্দী করে হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে। ওদের বন্দীশালা থেকে পালাতে গিয়ে কাঁধে গুলী খেয়েছিলাম। ওরা আমার পিছু লেগেছিল গাড়ি ও হেলিকপ্টার নিয়ে। অনেকদূর পাহাড়ী এলাকায় যাবার পর ওরা আমাকে আগে ও পেছনে গাড়ি ও উপর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে ঘিরে ফেলে। এই অবস্থায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে জংগলে নামা ছাড়া উপায়ই ছিলনা। ঘন জংগলে অবিরাম খোঁজার কষ্ট এড়াবার জন্যে ওরা সংজ্ঞালোপকারী গ্যান বোমা ছোড়ে জংগলে। তখন আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ আহমদ মুসা থামল একটু।
কিন্তু থামতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল শা বানু, ‘আপনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন? আবার ধরা পড়লেন আপনি?’
‘না। আমাকে ওরা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ধরে এনেছিল বটে, কিন্তু ধরে নিয়ে যেতে পারেনি। তোমাদের তার নাম বলেছি। আমি যাকে বড় বোন বলেছি সেই ডাক্তার সুস্মিতা বালাজীর স্বামী ড্যানিশ দেবানন্দ রাও আমাকে সেখান থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন। পরে আমি তাদের কাছে শুনেছিলাম, ড্যানিশ দেবানন্দ কোন কাজে ঐ এলাকার পাহাড়ে গিয়েছিলেন। তিনি এক জায়গায় বসে- ওদের আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা, আমার জংগলে পালানো, ওদের সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসবোমা ছোড়া, আমার সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া, ওদের আমাকে গিয়ে ধরে নিয়ে আসা সবই চোখে দুরবীন লাগিয়ে দেখেছিলেন। তারপর তিনি পাহাড় থেকে নেমে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। আমার সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ডাক্তার সুস্মিতা বালাজী আমার গুলীবিদ্ধ স্থানে অপারেশন করেন। আমাকে কয়েকদিন ওরা নড়া-চড়া করতে দেননি। সুষমা রাওয়ের মোবাইলে তার কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না। শেষে দ্বিতীয় আরেকটি মোবাইলের নাম্বার মনে পড়ে যায়। সেটায় গতকাল বিকেলে তাকে ফোন করে পেয়ে যাই। তার পরের ঘটনা সবকিছু বলেছি।’
‘তোমার এত বিপদ গেছে? আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তোমাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলেছেন। তোমার বোন মেয়েটা সত্যিই ডাক্তার?’ বলল শাহ বানুর মা সাহারা বানু।
‘জি, তিনি এমবিবিএস ডাক্তার।’
‘গ্রীন ভ্যালি কি আসলেই জংগল?’ শাহ বানু বলল।
‘হ্যাঁ, একেবারে পুরোপুরি জংগল।’
‘কিন্তু জংগলে থাকেন কেন ওরা?’ শাহ বানুই প্রশ্ন করল।
‘সে অনেক কাহিনী। দু’জনেই খুব বড় ঘরের ছেলে মেয়ে। বোন সুস্মিতা বালাজী ডাক্তার এবং তার স্বামী ড্যানিশ দেবানন্দ একজন ইণ্জিনিয়ার। তিনি একজন বিপুল বিত্তশালী ইণ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের মালিকের ছেলে। নিজেও চাকরি করতেন পোর্ট ব্লেয়ার সরকারের অধীনে। সৎ অফিসার ছিলেন। তার সততাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। ঐ শংকরাচার্যরা তার চরম বৈরী হয়ে দাঁড়ায়। একদিন একসাথে তারা ড্যানিশ দেবানন্দের পিতা-মাতাকে খুন করে। কৌশলে খুনের দায় চাপিয়ে দেয় ড্যানিশ দেবানন্দ ও সুস্মিতা বালাজীর উপর। প্রাণ বাঁচাবার জন্যে দেবানন্দ তার পিতার সহায়-সম্পদ শংকরাচার্যদের হাতে তুলে দিয়ে জংগলে আশ্রয় নেয়। সেই থেকে আজ বিশ বছর ওঁরা জংগলে। আরেকটা বড় সুখবর তোমাদের জন্যে সেটা হলো সুস্মিতা বালাজী, মানে আমার পাতানো বড় বোন, তোমাদের সুষমা রাওয়ের ফুফাতো বোন। তারা মহারাষ্ট্রের একই গোষ্ঠীর মেয়ে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি বলছেন ভাইয়া, এটা সত্যি?’ বলল শাহ বানু। তার চোখে আনন্দ ও বিস্ময়।
‘সত্যি, তবে সুস্মিতা বালাজীর কথা সুষমা রাওয়ের মনে আছে কিনা জানি না। কিন্তু তার মা সুস্মিতা বালাজীকে খুব ভালবাসতেন, এখনও ভালবাসেন নিশ্চয়ই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝতে পারলাম না। মামাতো-ফুফাতো অচেনা হবে কিভাবে?’ বলল সাহারা বানু।
‘এর পেছনে কাহিনী আছে। সুস্মিতা বালাজী সুষমা রাওদের বোম্বের বাসায় থেকে মেডিকেল কলেজে পড়তো। সুষমা রাও বয়স যখন এক বছর, তখন সুস্মিতা বালাজী মেডিকেল কলেঝে শেষ বর্ষে পড়াকালে ইন্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষের ছাত্র ড্যানিশ দেবানন্দকে পরিবারের বাধা সত্বেও বিয়ে করে। বনিয়াদী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ভিন্ন জাতের ছেলেকে বিয়ে করায় পরিবার তা সাথে সম্পর্ক ছেদ করে। আজ বিশ বছর হলো তার পরিবারের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা সম্পর্ক নেই সুস্মিতা বালাজীর। সুষমা রাও তাকে চিনবে কি করে!’
‘ড্যানিশ দেবানন্দ কেমন ভিন্ন জাতের ছেলে? তারও তো হিন্দু নাম দেখছি!’ বলল শাহ বানুর মা সাহারা বানু।
‘সুস্মিতা বালাজীকে বিয়ে করার সময় ড্যানিশ দেবানন্দ হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু পিতার দিক থেকে সে পার্সি এবং মায়ের দিক থেকে থাই বৌদ্ধ। দেবানন্দের মা থাইল্যান্ডের প্রথম রাজবংশের মেয়ে এবং তারা মূলত চীনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার কাছ থেকে এই কাহিনীটা না শুনলেই ভাল ছিল। এখন খুব খারাপ লাগছে। তারা পরিবার হারিয়ে, স্বাধীন জীবন হারিয়ে জংগলে বাস করছে। কি দূর্ভাগ্য!’ বলল শাহ বানুর মা।
‘না খালাম্মা। ভাববেনা না। ওরা খুব ভাল আছে। আদিবাসীদের নিয়ে তারা এক নতুন জীবন শুধু নয়, এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এই সাম্রাজ্যে তারা সম্রাট। পরিবার-পরিজনদের হারিয়ে পরিবারের চেয়ে অনেক বড় আদিবাসী এক সমাজকে তারা পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠেছে। কথা শেষ করেই আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল তুলে নিল।
সুষমা রাওয়ের টেলিফোন।
‘হ্যালো। ওয়ালাইকুম ছালাম। বল সুষমা।’ বলল আহমদ মুসা।
ওপারের কথা শুনে আবার বলল, ‘না সুখবর আছে সুষমা। ওদের উদ্ধার করেছি। আমি এখন ওদের নিয়ে যাচ্ছি গ্রীণভ্যালিতে, যেখানে আমি, গত কয়েকদিন ছিলাম।’
‘না সুষমা। ওরা ওখানে ভাল ও নিরাপদ থাকবে।’
না, ওরা অজানা-অচেনা কেউ নয়। তোমার খুব আপনজন ওরা।’
‘না সত্যি বলছি।’
‘ঠিক আছে বলছি। আগে তুমি খালাম্মা ও শাহ বানুর সাথে কথা বলে নাও।’
আহমদ মুসা মোবাইল দিল সাহারা বানুকে। সাহারা বানু কথা বলল। তার কাছ থেকে মোবাইল গেল শাহ বানুর কাছে। ওদের কথা আর শেষ হয়না।
শাহ বানুই অবশেষে বলে ফেলল সুস্মিতা বালাজীর পরিচয়। বোধ হয় শাহ বানুর কাছে শুনে সুষমার যেন সব শোনা হলো না। আহমদ মুসার সাথে কথা বলতে চাইল সুষমা রাও।
শাহ বানু আহমদ মুসাকে মোবাইল দিয়ে বলল, ভাইয়া, ওদের ব্যাপারে সুষমা আপনার সাথে কথা বলতে চায়।
আহমদ মুসা মোবাইল নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে সুষমা রাও বলল, ‘কি ভাইয়া, শাহ বানু যা বলল তা সত্যি? সে সত্যিই আমার হারানো বোন?’ গম্ভীর ও আবেগ জড়িত কন্ঠ সুষমার।
‘তার কথা তোমার মনে আছে?’
‘তাকে আমার মনে নেই। কিন্তু আম্মার কাছ থেকে তার কথা এত বেশি শুনি যে, তিনি আমার কাছে শত বছরের চেনার চেয়েও বেশি। আমার জন্মের পর তিনি এক বছর আমাদের বাড়িতে ছিলেন। আম্মা বলেন, তিনি এই এক বছরে আমাকে শত বছরের আদর দিয়ে গেছেন। এক বছর আমি ওর কোলেই মানুষ হয়েছি। আমার অসুখ-বিসুখ কিংবা কোন অসুবিধা হলে তিনি মেডিকেল কলেজেরে ক্লাসে যেতেন না।’ বল্ল সুষমা রাও। কান্নাজড়িত কন্ঠ সুষমার।
‘হ্যাঁ, সুস্মিতা। তিনি তোমাদের কথা খুব ফিল করেন। সেদিন তোমাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক কেঁদেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার কথা আমার আম্মা শুনলে পাগল হয়ে যাবেন ভাইয়া। আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে, বিভিন্ন মাধ্যমে কত যে সন্ধান করেন তিনি আপার। ভাইয়া, শাহ বানুদের নিয়ে যাচ্ছেন, আমাকেও আপার কাছে নিয়ে চলুন।’ বলল সুষমা রাও।
‘তোমার আব্বার চোখ এড়িয়ে তোমার যাওয়া কঠিন। আমি কথা দিচ্ছি সুষমা, আপাকেই তোমাদের কাছে আনব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়। আমি, আমার মা সীমাহীন খুশী হবো। আপনি আপার টেলিফোন নাম্বার দিন। এখনি টেলিফোন করব।’
আহমদ মুসা সুস্মিতা বালাজীর টেলিফোন নাম্বার দিল সুষমা রাওকে।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমার সব ধন্যবাদ, সব কৃতজ্ঞতা আপনার জন্যে ভাইয়া। আবেগ রুদ্ধ কন্ঠে বলল সুষমা রাও।
‘কথা ফেরত নাও সুষমা। মানুষের সব ধন্যবাদ, সব কৃতজ্ঞতা একমাত্র আল্লাহর জন্যে।’
‘স্যরি। একজন নব্য মুসলমানের ভুল হতেই পারে। আমি আমার উক্তিটি প্রত্যাহার করলাম। কিন্তু ভাইয়া, আল্লাহ তো আল্লাহই। তিনি সর্বোপরি এবং সর্বশক্তিমান। সবকিছুর নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক তিনি। আমি যে কথাটা বললাম তা বললে কি তার এই অধিকারে হস্তক্ষেপ হয়, না আরও কিছু কারণ আছে?’
‘হস্তক্ষেপ অবশ্যই হয়। সব প্রশংসা, সব ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য মানুষ নয়, কারণ সব ক্ষমতা মানুষের নেই। যে কাজগুলোর জন্যে তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিলে বা কৃতজ্ঞতা জানালে, সে কাজগুলো আমি করেছি বটে, কিন্তু এর কৃতজ্ঞতা কি আমার? একটা পুতুল ভাল নাচে, একটা কলম ভাল লিখে, এই ‘ভাল নাচ’ ও ‘ভাল লেখা’র কুতিত্ব কি পুতুল ও কলমের? তা নয়। সবাই চোখ বন্ধ করে এই কৃতিত্ব দেবে পুতুল কলমের নির্মাতাকে। কারণ নির্মাতাই পুতুল ও কলমকে এই ভাল কাজের জন্যে তৈরি করেছে। সুতরাং আমি যে ভাল কাজগুলো করেছি, তার যোগ্যতা, তার মানসিকতা, তার সুযোগ, সামর্থ্য সবই আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছি বিধায় প্রশংসা, ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্যে।
‘আপনি ঠিক বলেছেন ভাইয়া। কিন্তু একটা সমস্যা। মানুষের ভাল কাজের প্রশংসা আল্লাহকে দিতে হয়, তাহলে মানুষের মন্দ কাজের দায় আল্লাহর উপরই বর্তায়।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পুতুল ও কলমের সাথে মানুষের পার্থক্য আছে। পুতুল ও কলমের স্রষ্টা পুতুল ও কলমকে নির্দিষ্ট একটা কাজের জন্যে সৃষ্টি করেছে, অন্য কোন কাজ করার ক্ষমতা, স্বাধীনতা পুতুল ও কলমকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ চিন্তা ও কাজ করার স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। এই সাথে মানুষের মঙ্গলের জন্যে, মানুষের এই বিশ্বের শান্তি ও স্বস্তির জন্যে ভাল ও ভাল পথকে আল্লাহ চিহ্নিত করে দিয়েছেন যুগে যুগে পাঠানো তাঁর নবী-রাসুলদের মাধ্যমে এবং বিধান দিয়েছেন মানুষকে ভাল কাজ হরতে হবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এই বিধান মানুষ মান্যও করতে পারে, লংঘনও করতে পারে। ভাল কাজ করতে পারলে আল্লাহর প্রশংসা এই জন্যেই করতে হয় যে, ভাল কাজ করার শক্তি-সামর্থ্য যেমন আল্লাহ দিয়েছেন, তেমনি ভাল পথ ও কাজ চেনার সুযোগও আল্লাহই করে দিয়েছেন। অন্যদিকে মানুষ মন্দ কাজ করে, মন্দ পথে চলে তখন আল্লাহর বিধান সে লংঘন করেই করে এবং কাজ করার যে শক্তি-সামর্থ্য আল্লাহ দিয়েছেন তার অপব্যবহার করে। সুতরাং কেউ মন্দ কাজ করলে ও মন্দ পথে চললে তার দায় দাকেই বহন করতে হবে, আল্লাহকে নয়।’
আহমদ মুসা থামল। থেমেই আবার বলল সুষমাকে কিছু বলার ‍সুযোগ না দিয়ে, ‘এসব ভারী কথা এখন থাক, সাক্ষাতে হবে। এখন বল, তেমন কোন খবর আছে কিনা। তোমার আব্বা কি ভাবছেন শাহ বানুদের ও আহমদ শাহ আলমগীরের উদ্ধারের ব্যাপার নিয়ে?’
‘কিছুই ভাবছেন না ভাইয়া, এসব ব্যাপারে নিজের থেকে কিছুই বলেননি তিনি। মিনিট পাঁচেক আগে তার রুমের পাশ দিয়ে আসার সময় টেলিফোনে খুব উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুনলাম। তিনি কাউকে গালিগালাজ করে বলছেন, ‘সব অপদার্থের দল। একা একজন সব ওলট-পালট করে দিল। আর সকলে মিলে তোমরা ঘোড়ার ঘাস কাটলে।’ তারপর তিনি কাউকে নির্দেশ দিলেন, ‘ওদের নিয়ে অবশ্যই কোথাও তাকে উঠতে হবে, পোর্ট ব্লেয়ার বা অন্য কোথাও। বোটে তারা অন্য কোন দ্বীপেও যেতে পারে। সন্দেহজনক সকল স্থানে তোমরা অভিযান চালাও। আমি বলে দিয়েছি পুলিশ তোমাদের সাহায্য করবে।’
থামল সুষমা রাও।
‘খু্ব মূল্যবান খবর দিলে তুমি সুষমা। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে, আমাদের ব্যাপারেই ঐ নির্দেশ তিনি কাউকে দিয়েছেন।
‘আমার মনও এরকম কিছু বলছে ভাইয়া। তার মানে আব্বা কি………।’
কথা শেষ না করেই থেমে গলে সুষমা রাও।
‘সুষমা প্রমাণহীন কোন সন্দেহ নিয়ে অযথা মন খারাপ করোনা।’
‘কিন্তু ভাইয়া, আমার মনে সন্দেহ ক্রমে দৃঢ় হচ্ছে যে, আমার কাছ থেকে আহমদ শাহ আলমগীরকে আলাদা করার জন্যেই তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’ শেষের কথাগুলো তার কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
‘ধৈর্য্য ধর সুষমা। আহমদ শাহ আলমগীর সম্পর্কে সুখবর আমি শীঘ্রই তোমাকে দিতে পারব।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে সাহয্য করুন। আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হলে অবস্থা আমাকে পাগল করে ফেলতো। আল্লাহর পরেই আপনার উপর আমার ভরসা।’
‘ধন্যবাদ বোন। এখন কথা শেষ করি।’
‘আব্বার ঐ নির্দেশ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন? আপনাদের অনেক সাবধান হতে হবে। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আপনি সময় না পেলে শাহ বানু যেন আমার সাথে যোগাযোগ রাখে।’
‘আমি ঐ বিষয়ে সিরিয়াসলি ভাবা শুরু করে দিয়েছি। তুমি চিন্তা করোনা। তোমার কথা আমি শাহ বানুকে বলব। রাখছি। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়াআলাইকুম আস সালাম।’ ওপার থেকে বলল সুষমা রাও।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল সাহারা বানু, ‘সুষমা রাও কি খবর দিল বেটা?’
‘আমাকে কি বলার জন্যে বলল সুষমা?’ মা সাহারা বানু থামতেই বলল শাহ বানু।
‘সুষমা তোমাকে ঘন ঘন টেলিফোন করতে বলেছে। আর খালাম্মা, সুষমার খবরটা হলো, ওরা আমাদের খোঁজার জন্যে চারদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের দূর্ভাগ্য। কিন্তু সুষমা এ বিষয়টা এত তাড়াতাড়ি জানল কি করে?’ বলল সাহারা বানু।
‘ক’মিনিট আগে তার আব্বা কারও সাথে টেলিফোনে যে কথাগুলো বলেছিল, তার থেকেই সুষমা এটা বলেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এত তাড়াতাড়ি বিষয়টা তার আব্বাই বা জানল কি করে? এমন কথা তিনি বলবেনই বা কেন? বলল সাহারা বানু। তার কপাল কুঞ্চিত।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘খালাম্মা আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা খুব বড় খালাম্মা।’
‘আমার ধারণা সত্য না হোক। কিন্তু মনে হচ্ছে কি জান, আহমদ শাহ আলমগীরের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সুষমার আব্বার হাত থাকতে পারে। যে অন্যবর্ণে বিয়ে করায় ভাগ্নীকে ত্যাগ করতে পারে, সে লোক নিজের মেয়েকে ভিন্ন ধর্মের ছেলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে ভিন্ন ধর্মের ছেলের ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যদি এই ঘটনা সত্যিই হয়, তাহলে আমাদের কিডন্যাপের সাথে তিনি জড়িত থাকতে পারেন।’ বলল সাহারা বানু।
‘খালাম্মা, আপনি যেটা বলেছেন সেটা ঘটতে পারা যুক্তির মধ্যেও আসে। কিন্তু আমি ভাবছি, তিনি আরও বড় কিছুর সাথে জড়িত।’
‘সেটা কি?’ সাহারা বানুর প্রশ্ন।
‘একটা হিংস্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাথে তিনি জড়িত। এই গোষ্ঠীর হাতেই এই পর্যন্ত আন্দামানের কয়েক ডজন মুসলিম যুবক প্রাণ দিয়েছে।’
আহমদ মুসার মুখের কথা শেষ না হতেই তার মোবাইল আবার বেজে উঠল।
মোবাইল আবার তুলে নিল আহমদ মুসা। সুস্মিতা বালাজীর টেলিফোন।
খুশী হলো আহমদ মুসা। তাকে টেলিফোন করা দরকার মনে করেছিল আহমদ মুসা।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম আপা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়ালাইকুম সালাম, ছোট ভাই। আপনাদের ওয়েলকাম। শাহ বানুরা আসছে জেনে খুব খুব খুশী হয়েছি আমরা।’
‘আমি আপনাকে টেলিফোন করব মনে করছি। আপনি জানলেন কি করে যে আমরা আসছি?’
‘সুষমা টেলিফোন করেছিল। এটা ছিল আমার জন্যে এক ঐতিহাসিক আনন্দের ঘটনা। সেই এক বছরের দেখেছিলাম তাকে। দেখলাম সে সব জানে, সব শুনেছে। আপনার কাছ থেকে টেলিফোন নাম্বার পেয়েও আমি আমি তাকে টেলিফোন করিনি সে আমাকে চিনতে পারে কিনা এই চিন্তায়। কিন্তু তার সাথে কথা বলে মনে হলো আমরা যেন একদিনের জন্যেও আলাদা হইনি। আপনাকে ধন্যবাদ, আপনার জন্যে এই আনন্দ, এই মিলন সম্ভব হলো।’
‘ওয়েলকাম আপা। আপনারা কেমন আছেন?’
‘ভালো’
‘গতকালের ঘটনার আর কোন প্রতিক্রিয়া আছে?’
‘খারাপ নেই। ভাল প্রতিক্রিয়া হলো, আপনাকে আদিবাসীরা দেবতা ভাবতে শুরু করেছে।’
‘ভাই সাহেব কি আশে-পাশে আছেন?’
‘আছেন। দিচ্ছি।’ সুস্মিতা বালাজী বলল।
‘হ্যালো ভাই সাহেব, কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনাকে কনগ্রাচুলেশন সাকসেসফুল মিশনের জন্যে। সত্যি আল্লাহ আপনাকে খাসভাবে সাহায্য করেন।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে একটা অনুরোধ করব।’
‘অনুরোধের প্রশ্ন কেন? বলুন কি’
‘হাইওয়ে থেকে ভ্যালিতে ঢোকার পথে, ভ্যালি মাঠটায় এবং ভ্যালি উপকূলে ল্যান্ডিং ডকটায় আপনি পাহারা বসান। তাদের বলুন অপরিচিত লোকদের দেখলে যেন আপনাদের খবর দেয়।’
‘কেন আপনি কি কোন আশংকা করছেন?’
‘সে রকম কিছু নয়, তবে আমার মন বলছে, আমাদের সাবধান হওয়া দরকার।’
‘যদি সে রকম হয়, তাহলে আমরা কি করব?’
‘লোকতেদর একত্রিত করবেন। যারা আসবে, তাদেরকে সার্চ করতে দেবেন। আমাদের না পেলেই তারা চলে যাবে। আরেকটা বিকল্প হলো, লোকদের একত্রিত করবেন সশস্রভাবে এবং যারা আসবে তাদের প্রতিহত করবেন।’
‘আপনার বিকল্পটাই গ্রহনযোগ্য। শংকরাচার্যের লোকেরা যদি ভ্যালিতে আসেই, তাহলে গতকালের ঘটনার তারা প্রতিশোধ নেবে। তাছাড়া আমাদের যদি চিনতে পারে, তাহতে তো অবস্থা আরও খারাপ হবে। সুতরাং বাধা দেওয়াই ভাল।’
‘ঠিক আছে। আমিও আপনার সাথে একমত। তবে ভাই সাহেব, ভ্যালিতে যদি কেউ যায়ই, তাহলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘটনাকে ডিলে করার চেষ্টা করবেন। অথবা যারা যাবে তার আপনার প্রস্তুতির বিষয় জানার আগেই তাদের শেষ করতে পারলে সেটাই ভাল হবে।’
‘এখানেও আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাব বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে অবস্থা অনুসারেই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’
‘ভাই সাহেব, এখন সাড়ে ৯টা। আমার খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব ইনশাআল্লাহ।’
‘ইনশাআল্লাহ। ছোট ভাই, দোয়া করুন, আমার শান্তির ভ্যালিটাকে আল্লাহ যেন রক্ষা করেন।’
‘আমিন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে রাখি। আপনারা আসুন। খোদা হাফেজ।’
আহমদ মুসা মোবাইল রাখল।
শাহ বানু, সাহারা বানু ও তারিক সবারই মুখ উদ্বেগাকুল। আহমদ মুসার কথায় তারা বুঝেছে যে ভ্যালিতে তারা যাচ্ছে, সেখানেও বিপদ।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই সাহারা বানু বলে উঠল, ‘বেটা সেখানে কিছু হয়েছে, কোন বিপদ ঘটেছে?’
‘খালাম্মা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা বিপদের মধ্যেই আছি।যে কোন জায়গায় যে কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আবার কিছু নাও ঘটতে পারে। আমি ওদের একটা আশংকার কথা বলেছি। যাতে ওরা সতর্ক থাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ সহায় হোন, কিছু না ঘটুক বেটা।’ বলল সাহারা বানু।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘খালাম্মা কিছু ঘটা দরকার, ওদের আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ানো দরকার। তাহলেই না বুঝব আমরা ঠিক পথে চলছি এবং আরও সামনে এগুনো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। যদি তারা আমাকে ওদের হাতে আত্মসমর্পণের জন্যে এখানে আসতে বাধ্য না করতো, তাহলে এত সহজে ও এত তাড়াতাড়ি আপনাদের উদ্ধার করা সম্ভব হতো না।’
‘তাই বলে বিপদেকে ওয়েলকাম করছেন স্যার?’
আলোচনায় শরিক হলো তারিকও।
‘বিপদকে নয় তারিক। শত্রুপক্ষ অন্ধকার থেকে সামনে এসে দাঁড়াক, সেটাই কামনা করছি। তাতে নতুন কিছু জানাও যেতে পারে। আহমদ শাহ আলমগীর এখনো উদ্ধার হয়নি। আমি অনুমান করি কোথায় তাকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটা নিশ্চিত নয়। আরও নিশ্চিত হওয়া যায় কিনা এবং ঐ জায়গা সম্পর্কে আরও খবর জানা যায় কিনা দেখতে হবে। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হতে পারে। আমি বুছতে পারছিনা, আহমদ শাহ আলমগীরের ব্যাপারে তারা এত সিরিয়াস কেন? শুধু সুষমা রাও এর কারণ হতে পারেনা। রহস্যের কেন্দ্রে পৌঁছতে……….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে কথা বলে উঠল সাহারা বানু। বলল সে, ‘স্যরি বেটা, একটা সাংঘাতিক কথা মনে পড়ে গেছে। আগে এটা শোন। তোমার জিজ্ঞাসার জবাব এতে পেতে পার।’
মুহূর্তখানেক থেমেই সাহারা বানু বলা শুরু করল, ‘শংকরাচার্যের লোকেরা আমাদের অনেক জিজ্ঞসাবাদ করেছে। এর মধ্যে একটা বাক্সের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সবচেয়ে বেশি। বলেছে, এই বাক্স না পেলে আহমদ শাহ আলমগীর কিংবা তোমাদের কাউকে আমরা ছাড়ব না। তোমাদের ধরাই হয়েছে এই বাক্স আদায়ের জন্যে। আহমদ শাহ আলমগীর তার চোখের সামনে তার মা ও বোনের মর্মান্তিক পরিণতি দেখবে, যাতে মুখ খুলতে বাধ্য হবে। আবার তোমরা তোমাদের চোখের সামনে আহমদ শাহ আলমগীরের মর্মান্তিক পরিণতি দেখবে এবং তোমাদেরও মুখ খুলতে হবে। এসবের আগেই তোমরা যদি বাক্সের সন্ধান দাও, তাহলে তোমরা সকলেই বেঁচে যাবে। বাক্সের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কোন বাক্সের কথা বলছে, আমরা বুঝতেই পারিনি। আমি বললাম, কোন বাক্সের কথা বলছেন আপনার? কি আছে তাতে? জবাবে ওদের সর্দার লোকটি ইংরেজিতে বলল, চন্দন কাঠের একটি বাক্স। ওতে আছে আমাদের ঋষি রাজা শিবাজীর তৈরি মহামূল্যবান একটি দলিল, মোগল ধনভান্ডারের একটা নক্সা এবং আরও কিছু। আমে বলেছিলাম, এ বাক্স আমি দেখিনি। বাক্সটি আমাদের কাছে আসবে কেন? তিনি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেছিলেন, ভনিতা রাখুন, বাক্সটি আপনাদের কাছেই আছে। আন্দামানে আপনাদের প্রথম পুরুষ মোগল শাহজাদা ফিরোজশাহ যখন কয়েদী হিসাবে আন্দামানে আসেন, তখন তার সাখে চন্দন কাঠের এই বাক্সটি ছিল। শত বিপদে সবকিছু ছাড়তে হলেও তিনি বাক্সটি ছাড়েন নি, তিনি কি বাক্সটিকে পারিবারিকভাবে হেফাজত না করে পারেন? পারেন না। অতএব বাক্সটি আপনাদের কাছে আছে, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই। আমি তখন বলি, কিন্তু আমরা কেউ জানি না। সে বলে, জানেন কিনা দেখা যাবে। কাল সকালে এক ভয়ংকর শয়তান আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। তারপর সবাইকে প্যাক করে আহমদ শাহ আলমগীরের কাছে নিয়ে যাব। তারপর দেখব আহমদ শাহ আলমগীর মা-বোনের অপমান কতটা সহ্য করতে পারে, আর তোমার চোখের সামনে সন্তানের আকাশ-ফাটানো আর্তচিৎকার কতটা সহ্য করতে পার দেখব। সে যেতে উদ্যত হয়েও আবার বলে, হ্যাঁ আরেকটা সুখবর শোন। এ হারামজাদা যদি কালকে আত্মসমর্পণ না করে তাহলে এক মহাঘটনার জন্যে তৈরি থেকো? তারপর চলে যায় সে।’
আহমদ মুসা চোখ নিচু করে গভীর মনেোযোগ দিয়ে শুনছিল সাহারা বানুর কথা। বাক্সের কথা ও বাক্সের ভিতরের জিনিসের কথা ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার। তাহলে শংকরাচার্যের এই রকাক্ত মিশনের সাথে শুধু আন্দামানের ব্যাপার নয় ইতিহাসের একটি বিষয় এবং অর্থযোগও রয়েছে। তার বিস্ময় জাগল, মোগল অর্থভান্ডার কি এখনো গোপনই রয়ে গেছে, তার মনে পড়ল রাশিয়ার জারদের গুপ্তধনের কথা। তাহলে সব রাজবংশই কি তাদের জন্য গোপন অর্থভান্ডার গড়ে তোলে? হতে পারে, এটাই সে সময়ের চলমান বাস্তবতা। তার মনে আরও প্রশ্ন জাগল, শিবাজীর মহামূল্যবান দলিল মোগলদের বাক্সে কেন? কি আছে ওতে? আর ফিরোজ শাহ এত বিপদের মধ্যেও বাক্সটি ছাড়লেন না কেন? সাথে করে তা নিয়ে এলেন আন্দামানে?
এসব চিন্তায় নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা। সাহারা বানু থামলেও তাই কথা বলতে দেরি হলো আহমদ মুসার।
চিন্তায় ছেদ টেনে কথা বলল আহমদ মুসা। বলল, ‘খালাম্মা, আমার মনে হচ্ছে বাক্সের কথাটা ওরা ঠিকই বলেছে। আহমদ শাহ আলমগীরকে বন্দী করে রাখার একটা বড় কারণ এটাই।’
‘কিন্তু বেটা, কোন চন্দন কাঠের বাক্সতো আমরা দেখিনি।’ সাহারা বানু বলল।
‘কিছু মনে করবেন না খালাম্মা, এটা একটা বংশীয় গোপনীয়তার ব্যাপার, এমন কি হতে পারে যে, আপনি জানেন না কিন্তু আহমদ শাহ আলমগীর জানে?’ বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না সাহারা বানু। ভাবছিল সে। একটু পর বলল, ‘তুমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছ। রাজা-বাদশাদের এটা শুধু ট্রেডিশন নয় আইনও। উত্তারধিকার সূত্রে আহমদ শাহ আলমগীর এমন কিছু পেতেও পারে। কিন্তু একটা বিষয়, আহমদ শাহ আলমগীরের পিতার এমন কোন বিশেষ বা গোপন স্থান ছিল না যেখানে সে একটা জলজ্যান্ত বাক্স সংরক্ষণ করবে, অথচ আমি জানেত পারবো না।’
এমনও তো হতে পারে, বাক্সটি দৃশ্যমান কোন স্থানে নেই। বাড়ির ভেতরে বা বাইরে কোন অদৃশ্য জায়গায় ওটা রেখেছিলেন ফিরোজ শাহ। ফিরোজ শাহ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বিষয়টা সবাই জেনে আসছে এবং এই নিয়মেই আহমদ শাহ আলমগীর জেনেছে তার পিতার কাছ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছ বেটা। বাক্সের বিষয়টা যদি সত্য হয়, তাহলে এটাই ঘটেছে।’
বলে একটু থামল সাহারা বানু। একটা ঢোক গিলে আবার বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর তারা আমাদের বন্দী করে আহমদ শাহ’র কাছে নিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের ক্ষতি দেখলে সে ওদেরকে বাক্সের কথা বলেও দিতে পারতো।’
‘ঠিক খালাম্মা, এটা একটা বড় বাঁচা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা বাঁচলাম, কিন্তু ভাইয়ার কি হবে, তার উপর তারা প্রতিশোধ নিতে পারে। কিছু ঘটে যায় যদি।’ কম্পিত কন্ঠে বলল শাহ বানু।
‘কোন ভয় নেই শাহ বানু। আমি নিশ্চত, ঐ বাক্স পাওয়া পর্যন্ত আহমদ শাহ আলমগীরকে তারা অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাক্সের ব্যাপারটা কি সত্যি ভাইয়া?’ শাহ বানু বলল।
‘বিশ্বাস করা, বিশ্বাস না করা কোন দিকেই সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ আমার কাছে নেই। তবে এরকম কিছু থাকা আমি অস্বাভাবিক মনে করি না।’
‘কোথায় খোঁজা যেতে পারে সে বাক্স’ বলল শাহ বানু।
বাক্স খোঁজা তাদের কাজ, আমাদের কাজ হলো আহমদ শাহ আলমগীরকে পাওয়া। তবে এই বাক্সটার সন্ধান করতে চাই। বাক্সটার সাথে দু’টি ইতিহাস জড়িত। এক, মোগলদের, দুই শিবাজীর। আমার মতে বাক্সের মোগল ধনভান্ডারের চাবি ও নক্সার চেয়ে শিবাজীর দলিলটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শোনার পর থেকে ঐ দলিলটার প্রতি আমার লোভ বাড়ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ভেতের কি কোন প্রকার লোভ আছে ভাইয়া?’ শাহ বানুর প্রশ্ন। তার ঠোঁটে ম্লান হাসি।
‘কেন আমি মানুষ নই? মানুষ বলেই অন্য মানুষের যা আছে, আমারও তা থাকবে।’
‘কিন্তু মানুষ বলেই সবকিছু সবার মধ্যে সবার মধ্যে থাকবে, তা কি স্বাভাবিক ভাইয়া?’
মৌলিক মানবীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই এটা স্বাভাবিক। কিন্তু পার্থক্য যেটা দেখা যায় সেটা মেধা ও অনুশীলণগত কারণের ফল। অনুশীলন এমনকি মেধার ঘাটতি পূরণ করে। সুতরাং শিক্ষা বা চর্চা মানুষে মানুষে বিরাট পার্থক্য তৈরি করে, আবার তেমনি পার্থক্য দূরও করে।
‘আপনার ছাত্র অনুশীলন শুরু করেছে, দেখা যাক পার্থক্য কতটা দূর করে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখা তো শেষ হয়ে গেছে শাহ বানু। তার বন্দী হওয়া থেকে উদ্ধার পর্যন্ত সে সাহসের পরিচয় দিয়েছে। পুনরায় তোমাকে উদ্ধার করার সময় এক কঠিন মুহূর্তে ঠিক সময়ে সে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল। তারপর এই বোট চালানোর দায়িত্ব সে নেয়া পর্যন্ত সংঘাতকালীন সব পর্যায়ে সে তার দায়িত্বের অংশ ঠিকঠাক পালন করেছে। আমি তার হাতে রিভলবার তুলে দেইনি। সবার হাতে রিভলবার উঠুক আমি চাই না, তোমাদেরও চাওয়া উচিত নয়।’
‘কিন্তু ভাইয়া, রিভলবারের ব্যবহারই কিন্তু আমাদের উদ্ধার করতে এবং এ পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছতে সাহায্য করেছে।’ বলল শাহ বানু।
‘ঠিক। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে রিভলবারের যেটুকু ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল, তার ব্যবস্থা আল্লাহ করেছিলেন।’
‘প্রয়োজনকালে সময়ের জন্যে প্রস্তুতি তো তাহলে অপরিহার্য।’ শাহ বানু বলল।
‘তার মানে তুমি তারিকের হাতে রিভলবার তুলে দেবেই। এটাই স্বাভাবিক। মোগল রক্তের সাথে তাদের সামরিক বৈশিষ্ট্য অবিচ্ছেদ্য।
‘কিন্তু ভাইয়া, রিভলবার হাতে দেওয়ার চেয়ে তুলে নেওয়াই বেশি স্বাভাবিক।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল তারিকেকে উদ্দেশ্য করে, ‘এবার তুমি জবাব দাও তারিক। নিজের বোঝা নিজেই বহন করা উচিত। আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বলে একটু থামল। শুরু করল পরক্ষণেই, ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া মোগল ট্রেডিশনে আছে। মোগল সম্রাজ্ঞীরা মোগল সম্রাটের হাতে তলোয়ার তুলে দিতেন যুদ্ধ যাত্রার সময়।’
বিব্রতকার একটা ভাব দেখা দিল শাহ বানুর চোখে-মুখে। লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। বলল, ওটা একটা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। যুদ্ধ যাত্রার সময়ে ওটা একটা বাড়তি উৎসাহের বিষয়। সম্রাটরা কিন্তু যোদ্ধা হিসাবেই সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে অস্ত্র পেয়েছেন।’
‘অস্ত্র হাতে পাওয়া যোদ্ধা হওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোন বাধার সৃষ্টি করে না।’ বোটের সামনের দিকেই চোখ নিবদ্ধ রেখেই বলল তারিক।
‘যোদ্ধা হওয়া যায়না কিংবা বাধা সৃষ্টি হওয়ার কথা আমি বলিনি। আমার বলার বিষয় হলো মানসিকতা। যুদ্ধ বা সংগ্রামের জন্যে নিজেই প্রস্তুত হওয়া এবং অন্যের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়ার মধ্যে মানসিকতার বিরাট পার্থক্য রয়েছে’ বলল শাহ বানু।
‘যুদ্ধ বা সংগ্রামের যে মুখোমুখি হয়নি, যুদ্ধ-সংগ্রামের যে সুযোগই পায়নি, তার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির প্রশ্ন ওঠে না।’ বলল তারিক।
শাহ বানু হাসল একটু। বলল, ‘স্যরি আমার কথা টার্গেটেড নয়, আমি নীতি কথা বলেছি। আমি সব সময় মনে করি, আজ মুসলমানদের তো বটেই, প্রতিটি নাগরিকেরই তিনটি দায়িত্ব পালন করা দরকার। এক. সে যোদ্ধা হবে, দেশ ও জাতির জন্যে ডাক পড়লে যেন যুদ্ধে যেতে পারে। দুই. সে পুলিশ হবে যেন সে সমাজে আইন-শৃংখলা রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে এবং তিন. সে সংসার-ধর্ম পালনকারী একজন পরিপূর্ণ গৃহস্থ হবে। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবার প্রস্তুতি তাকে সব সময় সম্পূর্ণ করে রাখতে হবে।’
‘ধন্যবাদ শাহ বানু।’ বলল আহমদ মুসা উচ্ছসিত কন্ঠে। আহমদ মুসার সাথে ধন্যবাদ দিল তারিকও।
‘তুমি চমৎকার একটা তত্ব সামনে এনেছ শাহ বানু।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আপনার কথা। আমি নতুন করে বললাম মাত্র। কোন এক ঘটনায় আপনিই একথা বলেছিলেন। ইন্টারনেট থেকেই আমি ও ভাইয়া এটা মুখস্থ করেছিলাম।’ বলল শাহ বানু।
‘ইন্টারনেঠে এটা আমি পড়িনি। কেউ বলেওনি। আমি জানতামও না। জানলে যোদ্ধা হওয়ার প্রস্তুতি অবশ্যই নিতাম।’ তারিক বলল।
‘আমাদেরকে কেউ বলেনি। আমরা ব্রাউজিং করে বের করেছি।’ বলল শাহ বানু।
‘তোমাদের ধন্যবাদ শাহ বানু। আমার নিজের জন্য স্যরি।’ তারিক বলল।
তারিকের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘স্যরি নয় তারিক। জানার জন্যে ওটা কোন অপরিহার্য বিষয় নয় যে দুঃখ করতে হবে। যা হোক, তোমাদের সংক্ষিপ্ত বিতর্ক ভালো হয়েছে। তোমরা দু’প্রান্তে থাকলে কোন বিতর্ক জমবে ভালো। তবে কথা পরোক্ষ হয়েছে, সরাসরি হলে আরও ভাল হতো।’
‘তুমি নতুন শুনছ তো বেটা! ওরা ওভাবেই কথা বলে। তারিক খুব শান্ত ছেলে, ভালো ছেলে। শুধু আত্মরক্ষা করে চলাই ওর অভ্যাস।’ সাহারা বানু বলল।
‘তার মানে আমি ভালো নই বলছ আম্মা?’
সাহারা বানু কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল।
আহমদ মুসা তার আগেই বলে উঠল, ‘আমার বোন এমন হতেই পারে না। মা যখন নিজের সন্তানের সামনে অন্য ছেলে-মেয়ের প্রশংসা করেন, তখন স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায় যে, সেই মা নিজের ছেলের গুণগুলোকেই অন্যের মধ্যে দেখতে চান।’
‘সবাইকে যিনি ভালবাসেন, তাকে এভাবেই ভাবতে হয় ভাইয়া।’
বলল শাহ বানু। তার কন্ঠ গম্বীর।
শাহ বানু থামতেই তারিক বলল, ‘দুর্লভ এই গুণ শাহ বানু।’
শাহ বানু তাকাল তারিকের দিকে। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘এসব কথা এখন থাক। এস অন্যদিকে মনোযোগ দেই।’
বলে তারিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারিক বোটের মাথার উপরের কভারটা আনফোল্ড করে দাও। উপর এবং আশ-পাশ কোথাও থেকে আমাদের কেউ দেখতে পাক তা চাই না।
‘আমরা তো সাগর দিয়ে চলেছি স্যার। আমাদের দেখবে কে?’ বলল তারিক।
‘টেলিস্কোপিক বাইনোকুলারের শক্তির কথা তোমার জানার কথা। পোর্ট ব্লেয়ারের উপকূলে বসে তোমার জামার রং পর্যন্ত কেউ বলে দিতে পারে।’
‘স্যরি স্যার।’ বলে তারিক বোটের কভার আনফোল্ড করার বোতাম টিপে দিল।
ঢেকে গেল বোটের উপরটা। তার সাথে চারদিক থেকে ঝালর নেমে এসে পাশের অনেকটা ঢেকে দিল।
আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
‘বেটা, বাক্সের ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। তুমি কি এ নিয়ে আর কিছু ভেবেছ?’
‘আমার কিছু ভাবার দেখছি না। আপনি এ ব্যাপারে কিছু ভাবতে পারেন। আমি নিশ্চত বাক্সটি আপনাদের বাড়িতেই আছে। হতে পারে সেটা বাইরের কোন লকারে অথবা ভেতরের কোন লকারে।’
‘ভেতরের লকার কি?’ সাহারা বানু বলল।
‘ভেতরের লকার অর্থ বাড়ির দেয়াল অথবা ফ্লোরে কোন লকার রয়েছে। হতে পারে বাড়ি নির্মাণের সময় সেটা তৈরি করা হয়। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি দয়া করে উত্তর দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বল বেটা।’ সাহারা বানু বলল।
আহমদ মুসা প্রশ্ন শুরু কলল। শুরু হলো আলোচনা।
নিঃশব্দে এগিয়ে চলল মটর বোট।

Top