৪২. ডুবো পাহাড়

চ্যাপ্টার

সাগরের তীর ঘেষে দাঁড়ানো অভিজাত ‘সী ভিউ’ রেষ্টুরেন্ট। আহমদ মুসা সাগরের প্রান্তের একটা টেবিলে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল।
আহমদ মুসা প্রায় নিয়মিতই এই সাগর তীরে আসে এবং এক সময় এই টেবিলে এসে বসে।
যথারীতিই একজন নিষ্ঠাবান শিখের পোশাক আহমদ মুসার দেহে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আহমদ মুসা তাকিয়েছিল আন্দামান সাগরের স্থির কাল পানির দিকে।
তার টেবিলে তার মুখোমুখি আর একজন এসে বসল।
আহমদ মুসা সাগর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তার সামনে এসে বসা লোকটির দিকে তাকাল। তাকিয়েই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সেদিন রিকশায় চড়ে যাওয়া এই লোকটিকেই অনুসরণ করে আহমদ মুসা হাজী আবদুল্লাহকে রাখা বন্দীখানায় পৌছেছিল। রিকশা চড়ে যাওয়ার সময় ওদের কথোপকথন থেকে এই লোকটির নাম শুনেছিল ‘হরিকিষাণ’। পরে ওখানে গিয়ে দেখেছিল হরিকিষাণ ঐ বন্দীখানার প্রহরা-ব্যবস্থার প্রধান। সম্ভবত সে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে থাকা ছাড়াও সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ‘মহাসংঘ’-এর প্রভাবশালী সদস্যও।
আহমদ মুসা তাকে চিনতে পেরেই সিদ্ধান্ত নিল লোকটিকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে। কিছু পাওয়া যেতেও পারে।
পরিচিত লোককে নতুন করে দেখছে এমন একটা ভাব নিয়ে আহমদ মুসা লোকটির উদ্দেশ্যে হিন্দী ভাষায় বলল, ‘হরিকিষাণজী, আপনি কেমন আছেন?’
হরিকিষাণ লোকটি ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে তার অপেক্ষা করছিল। আহমদ মুসার সম্বোধন শুনে সে ফিরে তাকাল। কিন্তু আহমদ মুসাকে চিনতে না পারায় একটা বিব্রত ভাব তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনি আমাকে চিনেন? কিন্তু আমি তো……….।’
‘চিনতে পারছেন না, এই তো?’ আহমদ মুসা হরিকিষাণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল।
কথাটা শেষ করে আহমদ মুসা একটু থামল। পরক্ষণেই মুখে হাসি টেনে বলল, ‘কেন মনে পড়ছে না? ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর’-এর বাড়িতে আমি আপনাকে দেখেছিলাম। আমি সাবেক জেনারেল জগজিত জয়রাম মহাগুরুর পক্ষ থেকে সেখানে গিয়েছিলাম হাজী আবদুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে।’
আসলে আহমদ মুসা জেনারেল জগজিত জয়রাম মহাগুরুকে চিনেই না। হরিকিষাণকে অনুসরণ করে সেদিন ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোরের ঘাঁটিতে গিয়ে আড়াল থেকে হরিকিষাণদের মুখেই ঐ জেনারেলের নাম এবং তার লোকদের আসার কথা শুনেছিল।
হরিকিষাণের মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠেছিল। সে বলল, ‘স্যরি, সেদিন ছিল রাত, আর আপনি হ্যাট পরেছিলেন। তাই চিনতে পারছিলাম না।’
তার অন্ধকারে ঢি ছোড়ার কৌশলটা কাজে লেগেছে দেখে আনন্দিত হল আহমদ মুসা।
‘তাই হবে। যাক, আপনারা কেমন আছেন? হাজী আবদুল্লাহর খবর কী?’
‘কেন, আপনি কিছু জানেন না?’
হরিকিষাণের কথায় মনে মনে উদ্বিগ্ন হল আহমদ মুসা। হাজী সাহেবের কিছু হয়নি তো! কিছু না জানার কথা বলছে কেন? ঘটেছে কি কিছু?
আহমদ মুসা হরিকিষাণের দিকে চোখ তুলে বলল, ‘আমি সেদিন ওখান থেকে ফিরেই কলকাতা গিয়েছিলাম, গত রাতে ফিরেছি। বিশেষ কিছু কি ঘটেছে?’
‘বড় কিছু ঘটেছে। বিপদ দেখা যাচ্ছে সামনে।’ বলে থামল হরিকিষাণ।
আরও উদ্বিগ্ন হল আহমদ মুসা। বলল, ‘কি ঘটেছে?’
‘সিবিআই তদন্তে আসছে। সম্ভবত হাজী সাহেবের পরিবার থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিযোগ গেছে যে, পুলিশ তাকে নিয়মমাফিক গ্রেফতার না করে বেআইনিভাবে লুকিয়ে রেখেছে। আমি সবকিছু জানি না। তবে আজই সিবিআই-এর শক্তিশালী টিম আসছে। আর সিবিআই গোয়েন্দারা নাকি ইতিমধ্যেই এসে গেছে।’
আহমদ মুসা মনে মনে খুশি হল। বুঝল যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাহলে এ্যাকশনে গেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা সরকারের চাপেই তাহলে এই ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আহমদ মুসা কণ্ঠে কৃত্রিম ভয় নিয়ে বলল, ‘তাহলে এখন কি করা?’
‘সে চিন্তা উপর ওয়ালারা করছে। আজ হাজী আবদুল্লাহকে সরিয়ে ফেলা হবে। বন্দীখানা থেকে বের করে নিয়ে হাত-পা বেঁধে নৌকায় তুলে মাঝ সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হবে।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, ‘সিবিআই-এর হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচার এটাই উপায়। আপনার তো তাহলে অনেক দায়িত্ব মি. হরিকিষাণ। হাজী আবদুল্লাহকে সরাবার দায়িত্ব তো আপনাকেই নিতে হবে।’
আহমদ মুসা চাইল তাদের পরিকল্পনার বিস্তারিতটা জানতে।
আহমদ মুসার কথার জবাবে হরিকিষাণ বলল, ‘আমার দায়িত্ব ঐ বাড়ি পাহারা দেয়া। ঐ অপারেশনের জন্যে লোক পাঠানো হবে পোর্ট ব্লেয়ার হেড অফিস থেকে। রাত ৩টার দিকে পানি সাপ্লাই সংস্থার ওয়াটার ক্যারিয়ার নিয়ে তারা আসবে।’
‘সিবিআই-এর গোয়েন্দা আগেই এসেছে বললেন, ওরা কিছু টের পাবে না তো?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে কৃত্রিম উদ্বেগ।
‘হ্যাঁ, ওরা ইতিমধ্যেই এসেছে শুনেছি। কিন্তু ওরা আমাদের গোপন বন্দীখানার সন্ধান পাবে কি করে? অতএব ভয়ের কিছু নেই।’
‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। আপনি কখন যাচ্ছেন ডিউটিতে?’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আহমদ মুসা।
‘সারদিন যাচ্ছি না। রাত ৮টার দিকে যাব।’
‘ওকে, হরিকিষাণ। আসি। বাই।’ বলল আহমদ মুসা।
বেরিয়ে এল আহমদ মুসা রেষ্টুরেন্ট থেকে।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। ঠিক সময়েই সে সবকিছু জানতে পেরেছে। অবশ্যই হাজী সাহেবকে বাঁচাতে হবে। ওদের হাত থেকে হাজী সাহেবকে ছিনিয়ে নেয়ার চেয়ে ওরা রাত ৩টায় বন্দীখানায় পৌছার আগেই তাকে সরিয়ে নেয়া অনেক সহজ হবে।
কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবল হাজী সাহেবকে সে উদ্ধার করলে তাকে যে আন্দামান সরকার ‘মহাসংঘে’র সাথে মিলে আটক করেছিল, তা প্রমাণ করার পথ থাকবে না এবং মহাসংঘে’র সাথে আন্দামান সরকারের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি প্রমাণ করার একটা সুযোগ হাতছাড়া হবে। আহমদ মুসা চিন্তা করে দেখেছে, হাজী আবদুল্লাহ ও আহমদ শাহ আলমগীরকে উদ্ধার করা এবং মহাসংঘে’র কিছু লোক ক্ষয় হওয়া সমস্যার সমাধান নয়। সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী সংগঠন ‘মহাসংঘ’ যদি টিকে থাকে, তাদের কাজ করার সুযোগ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ভারতের প্রশাসনযন্ত্রে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও বাড়বে এবং বর্তমানের মত সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এক হাজী আবদুল্লাহ ও আহমদ আলমগীরকে উদ্ধার করলেও আরও শত শত হাজী আবদুল্লাহ ও আহমদ শাহ আলমগীরকে তারা কব্জা করবে। সুতরাং প্রয়োজন এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সমূলে উচ্ছেদ। আর এই কাজ শুধু করতে পারে ভারত সরকারই। এজন্যে প্রয়োজন মহাসংঘকে ভারত সরকারের কাছে হাতে-নাতে ধরিয়ে দেয়া। এর একটা সুযোগ তার হাতে এসেছে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার অবশ্যই তাকে করতে হবে।
হাজী আবদুল্লাহকে উদ্ধার করে নিজেদের গোপন আশ্রয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টাল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই যে চিন্তাটা এসে আহমদ মুসার মাথায় ভর করল সেটা হল, কিভাবে হাজী আবদুল্লাহ ওদের হাতে থাকা অবস্থায় ওদেরকে সিবিআই-এর হাতে ধরিয়ে দেবে? সিবিআই-এর গোয়েন্দারা যারা এসেছে তাদেরকে হাজী আবদুল্লাহর বন্দী থাকার অবস্থানটা জানিয়ে দিতে পারলেই কাজ হয়ে যেত। কিন্তু সেটা কিভাবে? ওদের কোন কিছুই তো তার জানা নেই।
আহমদ মুসা বাসার দিকে হাঁটছিল। তার মাথার মধ্যে তখন তোলপাড় করছিল এসব চিন্তা। হঠাৎ তার মনে পড়লো দিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।
আহমদ মুসা পকেটে হাত দিল সঙ্গে সঙ্গেই। না পকেটে মোবাইল নেই। মর্নিং ওয়াকের সময় সাধারনত সে মোবাইল পকেটে নেয় না। সেই সিলসিলায় আজও মোবাইল তার সাথে নেই।
আহমদ মুসা হাঁটার গতি দ্রুত করল।
ঊাসার গেটে এসে পৌছাতেই দেখল, দু’তলার ব্যালকনি থেকে সাজনা সিংহাল তাকে ব্যস্ত হয়ে ডাকছে। আহমদ মুসা দৌড় দিল।
এক তলার ড্রইংরুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেল হাতে মোবাইল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে সুরূপা সিংহাল।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা তার হাত থেকে মোবাইল নিল।
‘এক্সেলেন্সী মি. রবার্ট পাওয়েল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’ মোবাইলটি আহমদ মুসার হাতে দিতে দিতে ফিসফিসে কণ্ঠে বলল সুরূপা সিংহাল।
আহমদ মুসা মোবাইলটি কানে তুলে নিয়েই শুনল, ‘গুড মর্নিং বিভেন বার্গম্যান। কেমন আছ? তোমার কাজ হয়ে গেছে। সিবিআই ও অন্যান্য গোয়েন্দারা মুভ করেছে।’ বলল ওপার থেকে রাষ্ট্রদূত।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি কিছুটা জানতে পেরেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে?’ বলল ওপার থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘আকস্মিক এক সুযোগ পেয়ে গোপন ‘মহাসংঘেষ্ফর একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সিবিআই অপারেশন ইফনিট আসছে, গোয়েন্দা ইউনিট অলরেডি এসে গেছে।’
‘কিন্তু ওরা জানল কি করে? এই উদ্যোগ তো খুবই গোপনে চলছে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এ বিষয়টার তত্ত্বাবধান করছেন।’
‘তাহলে সিবিআই-এর শীর্ষ পর্যায়ে কোথায় ওদের লোক আছে নিশ্চয়?’
‘সাংঘাতিক ব্যাপার। বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীকে তাহলে জানাতে হয়।’
বলে একটা দম নিয়েই মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট পাওয়েল বলল, ‘শোন তোমাকে যে জন্যে টেলিফোন করেছি। তোমাকে একটা বিশেষ মোবাইল নাম্বার দিচ্ছি। সেটা আন্দামানে যাওয়া সিবিআই অপারেশন চীফের। তার সাথে যোগাযোগ রাখবে। তোমার ‘বিভেন বার্গম্যান’ নাম সে জানে। তোমার সাহায্য তাদের প্রয়োজন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমার মাধ্যমে তোমাকে এ অনুরোধ করেছেন।’
কথা শেষ করেই বিশেষ মোবাইল নাম্বারটি বলল মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
আহমদ মুসা নাম্বারটি লিখে নিয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ মি. এ্যামবেসেডর। এই নাম্বারের চেয়ে বেশি মূল্যবান এই মূহুর্তে আমার কাছে আর কিছু নেই। এই সুযোগ হাতে পাওয়ার জন্যে আমি আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম। আপনি টেলিফোন না করলে এতক্ষণে আমার টেলিফোন পেয়ে যেতেন।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করুন।’ বলল মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
‘একটা বিষয়, সিবিআই অপারেশন টীম কখন আন্দামানে পৌছেছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘ধাজ সন্ধ্যা নাগাদ পৌছেছে বলে আমি জানি।’
‘এই সময়-সূচী ঠিক থাকা খুব জরুরি স্যার। এর চেয়ে যেন দেরি না হয়।’
‘কেন? কোন সমস্যা আছে?’
‘ইয়েস মি. এ্যামবেসেডর। আজ মধ্যরাতের দিকে সিবিআই এ্যাকশনে আসার আগেই হাজী সাহেবকে হত্যা করে তারা তাকে বেআইনিভাবে বন্দী করে রাখার দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চায়।’
‘সর্বনাশ। তাহলে এখন প্রধানমন্ত্রীকে আমি বলছি যে, তাদের অবশ্যই সন্ধ্যার মধ্যে আন্দামানে পৌছাতে হবে। কিন্তু পৌছে অল্প সময়ের মধ্যে কি তারা কিছু করতে পারবে?’ বলল রবার্ট পাওয়েল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন মি. এ্যামবেসেডর।’
‘স্যরি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি আহমদ মুসা। ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করুন। বাই।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করে মোবাইলটা পাশের সোফায় ছুড়ে দিয়ে নিজেও ধপ করে বসে পড়ল সোফার উপর। তারপর দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিল। তার মুখে স্বস্তির একটা আনন্দ।
উপরে দু’তলার ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে সুষমা রাও ও সাজনা সিংহাল এবং সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে সুরূপা সিংহাল আহমদ মুসার কথা শুনছিল। তারা বুঝল আজ রাতে ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হাজী সাহেবের জীবনও বিপন্ন। তবে আহমদ মুসার মুখে স্বস্তি দেখে তারা আবার আশান্বিত হল। সুষমা রাও, সাজনা সিংহাল সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল নিচে। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া আপনার কথা শুনে আমরা আতংকিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি আশংকা-আতংকের মত কিছুই যেন বলেননি।’
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘সুষমা, বলা যায় আমি আন্দামানে এতদিন একাই লড়াই করেছি। মনে হয় এবার এই লড়াইয়ে সিবিআই তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে শামিল করতে পারছি। এ কারণেই আশংকার মধ্যে আমার এই আনন্দ।’
সুষমাসহ ওদের মুখেও স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। সুষমাই বলল, ‘হাজী আংকল নিরাপদ হবেন তো?’
গম্ভীর হল আহমদ মুসা। বলল, ‘নিরাপত্তা দেয়ার এষতিয়ার শুধুই আল্লাহর হাতে। কোন মানুষ ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না বোন।’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই, গোসল সেরে নাস্তা খেয়ে লম্বা আরেকটা ঘুম দেব।’
সিঁড়িতে কয়েক ধাপ উঠে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা সাজনাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি একটু দেখবে সাজনা মোটর সাইকেলটা ঠিক-ঠাক আছে কিনা, পুরো ট্যাংক তেল ভরেছে কিনা এবং সাইলেন্সার ঠিকমত লাগিয়েছে কিনা।’ বলেই আবার ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে গেল দুতলায়।
সুরূপা সিংহাল, সাজনা সিংহাল ও সুষমা রাও তিন জন এসে বসল সোফায়। তিনজনই গা এলিয়ে দিল সোফায়।
চোখ বন্ধ করেছিল সাজনা। চোখ বন্ধ করেই বলল, ‘মনে হচ্ছে দীর্ঘ এক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলছি আমি।’
সুষমাও ঐভাবে চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিল। বলল, ‘স্বপ্নও এত সুন্দর, এত দীর্ঘ, এত থ্রিলিং হয় না সাজনা।’
‘তুমি খুব ভাগ্যবান সুষমা। এই সুন্দর, এই দীর্ঘ এবং থ্রিলিং স্বপ্নের তুমি একটা বড় অংশ। নায়ক আহমদ শাহ আলমগীর শত্রুর কবলে, তোমার এখন বুক ভরা দুঃখ। কিন্তু আমি নিশ্চিত, নায়ক নায়িকার বুকে ফিরে আসবেই। স্বপ্নের থ্রিল তো তোমাকে ঘিরেই।’
‘থ্রিল দেখলে, থ্রিলের মূল্যটা দেখেছে? আহমদ শাহ আলমগীর কি অবস্থায় কে জানে! নিজের পিতা হয়ে গেল আমার জন্য বিপজ্জনক। মা ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।’ বলল সুষমা রাও। তার কণ্ঠ ভারী। চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠেছে।
তার পাশেই বসেছিল সুরূপা সিংহাল। সে সুষমা রাওয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধৈর্য ধরতে হবে বোন। দেখ না সুস্মিতা বালাজীকে। সে প্রায় ২০ বছর ধরে বনবাসে। আমাদের হাসি-কান্না সবই আমাদের জীবনের এক একটি দাবী হিসেবে আসে। জীবন-নাট্যের এক মহানায়ক আহমদ মুসার কথাই একবার ভেবে দেখ না। আহমদ শাহ আলমগীর তার কে? আন্দামানের যে লোকগুলোকে সে বাঁচাতে এসেছে, তারা তার কে? কেউ না। দেখ এদের জন্যেই তিনি বাড়ি-ঘর, স্ত্রী-পুত্র থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়েছেন শুধু নয়, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কয়েকবার। এই যে মৃত্যুর মুখে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তিনি কি জানেন যে তিনি ফিরে আসবেন। ফিরে আসা, না আসা দুটোকে মেনে নিয়েই তিনি সামনে অগ্রসর হন। এটা আকাশস্পর্শী ভারী সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত কোরবানী এটা। জীবনেরই এক দাবী হিসেবে একে তিনি নিজের জীবনের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন।’ থামল সুরূপা সিংহাল।
সুষমা রাও ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ আপা। জীবনের জন্যে সুখের মত দুঃখও একটি বাস্তবতা। কিন্তু আপা তুমি একজন দেবতার উদাহরণ এনেছ। দেবতার এবং মানুষের শক্তি তো এক নয় আপা। আহমদ মুসা দেবতার মতই স্বপ্নের নায়ক, কল্পনার নায়ক, আমরা মাটির মানুষ তাঁকে শুধু নমষ্কারই করতে পারি, সমকক্ষ হতে পারি না। দেখলে তো মাত্র ক’ঘণ্টা পরে রাতে এক জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামার আগে উনি দীর্ঘ ঘুম দিতে গেলেন। বাড়ির কথা, স্ত্রীর কথা, সন্তানের কথা, নিজের জীবনের কথা মনে পড়লে এমন নিশ্চিন্ত থাকা কি কারও পক্ষে সম্ভব!’ থামল সুষমা রাও।
সুরূপা সিংহাল বলল, ‘উনি দেবতা নন সুষমা। উনি মাটির মানুষ। আর সত্যিকার মানুষ দেবতার চেয়ে বড় হন। মুসলমান ধর্মের ইতিহাসে পড়েছ যে, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টির পর তার ফিরিশতা অর্থাৎ এ্যাঞ্জেলদের মানুষকে সিজদা করতে বলেছিলেন। ঈশ্বরের পর মানুষের চেয়ে বড় কেউ নেই। একজন কবি বলেছেন, ‘আপনার লয়ে বিব্রত থাকিতে আসেনি কেহ অবনি পরে।’ সকলে যখন সবার তরে হয়, তখন সমাজ হয় সোনার সমাজ। আহমদ মুসারা সোনার সমাজের সোনার টুকরো।’
‘একটা কথা আপা, তোমার এ সোনার টুকরো’র পরিচয় কিন্তু তোমাদের দেখা ‘ভালো মানুষ’দের সাথে মিলে না। আমাদের ইতিহাসের ‘ভালো মানুষরা’ ‘অহিংসা পরমধর্ম’, সর্বজীবে দয়া’র অনুসারী, তারা সমাজের সংঘাত থেকে দূরে থেকে নিরিবিলি নিরুপদ্রব জীবন যাপন করতে চান এবং নিজেরা ভালো থেকে মানুষকে ভালো থাকার উপদেশ দেন। কিন্তু আহমদ মুসা মানুষকে শুধু ভালো থাকা নয়, ভালো হতে বলা নয়, মন্দের প্রতিরোধ এবং মজলুমের পক্ষে লড়াইয়েও নামেন। আপা, এই দুই ভালোর মধ্যে আসলে ভালো কোনটা?’
‘আহমদ মুসাই আসল ভালো’র প্রতীক । আমাদের কবি বলেছেন না যে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করা অন্যায়-অত্যাচার করার মতই পাপ। শুধু ভালো করা নয়, মন্দের আক্রমণ থেকেও মানুষকে বাঁচাতে হবে। আহমদ মুসা দুই কাজই করেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
সঙ্গে সঙ্গেই সাজনা বলে উঠল, ‘জুলুমের প্রতিকার, জালেমের বিচার করা আইনের কাজ, রাষ্ট্রের কাজ। কেউ নিজে এর প্রতিকার বা বিচারের নামে যা করবে সেটা কি অবৈধ এবং আইনের প্রতি হস্তক্ষেপ হবে না?’
‘জুলুম, জালেমের বিচার করা রাষ্ট্রের কাজ, আইনের কাজ। কিন্তু জালেমের হাত থেকে, জালেমের হাত থেকে মজলুমকে রক্ষা করা যে কোন ব্যক্তির কাজ। যেমন কেউ কাউকে নির্যাতন করছে, যাকে নির্যাতন করা হচ্ছে আর যারা এই দৃশ্য দেখছে তাদের প্রত্যেকের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে মজলুমকে রক্ষা করা তারপর জালেমকে আইনের হাতে তুলে দেয়া।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘কিন্তু মজলুমকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি জালেমকে আঘাত করতে হয়, সেটা কি তাহলে আইন হাতে তুলে নেয়া হবে না?’ জিজ্ঞেস করল সাজনা।
‘মজলুমকে তাৎক্ষণিক রক্ষার জন্যে যতটুকু করার প্রয়োজন পড়ে, সেটা অবশ্যই আইন হাতে তুলে নেয়ার মধ্যে পড়বে না। কিন্তু মজলুমকে রক্ষা করার পর ক্রুব্ধ হয়ে বা প্রতিশোধ বশত জালেমের উপর বাড়তি যা কিছুই করা হোক- তা আইন হাতে তুলে নেয়ার বা নিজে বিচারক সাজার মত অপরাধমূলক কাজ হবে।’ সুরূপা সিংহাল বলল।
সুরূপা সিংহালের কথা শেষ হতেই সুষমা রাও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ সুরূপা আপা। আপনি আহমদ মুসাকে যতটা ডিফাইন করেছেন, আহমদ মুসা নিজেও বোধ হয় এভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করেন না। ধন্যবাদ আপনাকে। এবার চলুন, নিশ্চয় ভাইয়া গোসল সেরে বেরিয়েছেন।’
উঠে দাঁড়াল সুরূপা সিংহাল ও সাজনা সিংহাল দুজনেই।
উঠতে উঠতে সাজনা সিংহাল বলল, ‘চল আহমদ মুসা ভাইয়ার কাছ থেকে সুরূপা আপার ওকালতির ফি আদায় করব।’
হেসে উঠল সাজনা সিংহাল ও সুষমা রাও দুজনেই।
সুরূপা সিংহালও হাসল। বলল, ‘অন্তত তোমরা যে এটুকু মনে করেছ আমি আহমদ মুসার উকিল হতে পারি, এটাও আমার জন্যে সৌভাগ্যের।’
বলেই দু’হাতে দুজনের গলা জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত দোতলায় উঠতে লাগল।

ঠিক রাত ২টা ৪৫ মিনিটে আট সিটের একটা ল্যান্ড ক্রুজার জীপ ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর থেকে প্রায় তিনশ গজ দূরে মিডল পোর্ট রোডের পাশে এক ঝোপের অন্ধকারে এসে দাঁড়াল। জলপাই রঙের জীপটি অন্ধকারে একদম মিশে গেল। জীপে আটজন আরোহী। পেছনে তিন তিন করে ছয় জন। আর সামনে দুজন। ড্রাইভিং সিটে একজন তার পাশের সিটে একজন। জীপটি সিবিআই-এর।
ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া। সিবিআই অফিসার।
জীপটি দাঁড়াতেই মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া গলায় ঝুলানো নাইট ভিশন দুরবিন দ্রুত চোখে লাগাল।
দূরবিনের দুচোখ ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোরের দিকে। সামনের গোটা রাস্তাসহ মেডিকেল ষ্টোরের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া। দেখল গাড়ি বারান্দা এলাকায় দুটি ওয়াটার ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। খুশি হল মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া। বিভেন বার্গম্যানের দেয়া তথ্য অনুসারে ওয়াটার ক্যারিয়ারে করে হাজী আবদুল্লাহকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে।
মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লেফটেন্যান্ট শিকার আমাদের ঠিক জায়গায় রয়েছে। ঠিক সময়েই আমরা এসেছি।’
মেজর সুরজিতের জীপটি দাঁড়াবার তিন মিনিটের মধ্যে অনুরূপ আরেকটা জীপ এসে পঞ্চাশ গজ পেছনে দাঁড়াল।
এ জীপেও আটজন আরোহী।
এ জীপের পাশের সিটে রয়েছে কর্নেল সুরেন্দ্র সিং।
জীপ থামতেই সে অয়্যারলেস তুলে নিয়ে বলল, ‘সুরজিত সব ঠিক ঠাক আছে?’
‘জি স্যার। আমরা ঠিক সময়ে এসেছি। ওল্ড মেডিকেল ষ্টোর বাড়িটির গাড়ি বারান্দা এলাকায় দুটি ওয়াটার ক্যারিয়ার দেখতে পাচ্ছি।’ বলল মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া।
‘ওকে। বিভেন বার্গম্যানও তো বলেছে ওয়াটার ক্যারিয়ারে করেই হাজী আবদুল্লাহকে পাচার করা হবে।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র সিং।
‘ইয়েস স্যার।’
‘ওদিকে চোখ রেখ। ওদের গাড়ি মুভ করলেই আমরা অগ্রসর হবো। সামনে চৌমাথার মুখেই ওদের আটকাতে হবে।’
‘ইয়েস স্যার।’
‘ধন্যবাদ। বাই।’
বলেই অয়্যারলেসের লাইনটা কাট করে আরেকটা লাইনের নব পুশ করল কর্নেল সুরেন্দ্র সিং।
অয়্যারলেসে সঙ্গে সঙ্গেই একটা কণ্ঠ ভেসে উঠল, ‘ইয়েস স্যার, আমি শংকর।’
‘তোমরা বাড়ির পেছনে ঠিকভাবে পজিশন নিতে পেরেছ?’
‘জি স্যার। পেছন দিয়ে কেউ পালাতে পারবে না।’
‘ওকে, সব দিকে ঠিকভাবে নজর রাখ। বাই।’
বলে কর্নেল সুরেন্দ্র সিং লাইনটা অফ করে দিল।
রাত ২ টা ৫৫ মিনিট। কর্নেল সুরেন্দ্র সিং এর অয়্যারলেস টেলিফোন আবার বেজে উঠল।
‘হ্যালো, কর্নেল সুরেন্দ্র বলছি।’ টকিং লাইন অন করেই বলল কর্নেল সুরেন্দ্র সিং।
ওপার থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ইয়েস, আমি বিভেন বার্গম্যান। আপনাদের উপস্থিতি ওদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। ওরা মুভ করেছে। আপনাদের প্রতিরোধ ও হাজী আবদুল্লাহকে নিয়ে পালানোর কাজ একই সাথে করবে ওরা। ওকে। বাই।’
ওপার থেকে অয়্যারলেস টেলিফোন লাইন কেটে গেল। কর্নেল সুরেন্দ্র সিং ধন্যবাদও দিতে পারল না।
সঙ্গে সঙ্গেই কর্নেল সুরেন্দ্র সিং পুশ করল সুরজিতের লাইন।
‘হ্যালো, সুরজিত!’ ওপার থেকে সাড়া দিল।
‘ইয়েস, কর্নেল সুরেন্দ্র বলছি। ওরা টের পেয়েছে। মুভ! বেরুবার রাস্তা ওদের ব্লক করো।’ নির্দেশ দিল কর্নেল সুরেন্দ্র।
কর্নেল সুরেন্দ্রের কথা শেষ হবার পরবর্তী দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যেই একটা বোমা বিস্ফোরিত হল মেজর সুরজিতের গাড়ির উপর।
কর্নেল সুরেন্দ্রর ‘মুভ’ শব্দ উচ্চারিত হবার সাথে মেজর সুরজিত ড্রাইভার লেফটেন্যান্ট বরুনকে ‘মুভ’ করার ইঙ্গিত দিয়েছিল। বোমা যখন পড়ল তখন কয়েক গজ ‘মুভ’ করেছে মেজর সুরজিতের জীপ। সুতরাং বোমাটা গিয়ে সরাসরি আঘাত করল জীপের গজ চারেক পেছনের মাটিকে। আঘাতের ধ্বংসাত্মক একটা ঢেউ এসে আঘাত করল জীপের পেছনে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল জীপ। শেষ পর্যন্ত উল্টে গেল না। কিন্তু আহত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে পেছনের তিন জন সাথী।
পেছনে না তাকিয়েই মেজর সুরজিত পেছনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘যারা ভালো আছ তারা সাথীদের দেখ।’ আর ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মুভ অন লেফটেন্যান্ট। চৌমাথার মুখে পৌছাতে হবে।’
ওদিকে বোমা বিস্ফোরিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এদিকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হল। এক পশলা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটু পরে আরেক পশলা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হল এবং তার প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা বোমা বিস্ফোরণের শব্দ হল কর্নেল সুরেন্দ্রের জীপের আট দশ গজ দূরে।
কর্নেল সুরেন্দ্রের জীপ তখন এগিয়েছিল মুভ করার জন্যে। প্রথম বোমা বিস্ফোরণের পরে মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল কর্নেল সুরেন্দ্রের জীপের ষ্টার্ট।
কর্নেল সুরেন্দ্রের মুখের সামনে অয়্যারলেস। সে চিৎকার করছিল, ‘মেজর সুরজিত হ্যালো, হ্যালো, মেজর সুরজিত।’
অয়্যারলেস হাতে থাকলেও বোমার ধাক্কা সামলানো, করণীয় সম্পর্কে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া ইত্যাদি চিন্তা করতে গিয়ে কর্নেল সুরেন্দ্রের কল এ্যাটেন্ড করতে পারেনি মেজর সুরজিত। প্রথম সুযোগেই অয়্যারলেস মুখের কাছে নিয়ে মেজর সুরজিত বলল, ‘ইয়েস মেজর। কয়েকজন লোকসহ আমাদের গাড়ির পেছনটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা এগোচ্ছি স্যার। আপনারা ওকে স্যার? দ্বিতীয় বোমার কি অবস্থা?’
‘বেভ বয়, মুভ। দ্বিতীয় বোমা আমাদের পর্যন্ত পৌছার আগেই বিস্ফোরিত হয়েছে। ব্রাশ ফায়ার তো নিশ্চয় তোমরা করনি। বেশ একটু দূরত্বে মানে বোমারুদের অবস্থান যেখানে ছিল, সেখান থেকে ব্রাশ ফায়ার হয়েছে।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘ঠিক তাই স্যার। তাহলে স্যার ব্রাশ ফায়ার আপনাদের গাড়ি থেকেও হয়নি?’ বলল মেজর সুরজিত।
‘অবশ্যই না।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘তাহলে?’ প্রশ্ন ফের সুরজিতের। ভাবছিল, হিসেব মেলাচ্ছিল কর্নেল সুরেন্দ্র। বলল, ‘ব্রাশ ফায়ার বিভেন বার্গম্যানের। প্রতিরোধ তত্ত্ব অনুযায়ী একটি করে নয়- বোমা আরও আসা উচিত ছিল। বিভেন বার্গম্যানের ব্রাশ ফায়ার আক্রমণকারীদের হত্যা করেছে।’
কর্নেল সুরেন্দ্রের কথা শেষ হতেই মেজর সুরজিত বলল, ‘স্যার দুটি ওয়াটার ক্যারিয়ারই ছুটে আসছে।’
‘চৌমাথা পর্যন্ত আসেনি নিশ্চয়।’
‘না স্যার।’
‘চৌমাথা দখল কর। তারপর আরও সামনে এগোও।’
মেজর সুরজিতের গাড়ি তখনও চৌমাথা থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে। কিন্তু চৌমাথা থেকে ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোরের দূরত্ব মোট ৫০ গজের বেশি নয়। ওয়াটার ক্যারিয়ার দুটো ইতিমধ্যেই ২৫ গজ পার হয়ে এসেছে। সুতরাং চৌমাথা থেকে তারা মাত্র পঁচিশ গজ দূরে। আর তারা আসছে মরণপণ গতিতে।
মেজর সুরজিতের গাড়ি যখন ১০ গজের মাথায় পৌছেছে, তখন প্রচ- বেগে একটা ওয়াটার ক্যারিয়ার এসে তার রাস্তার মুখে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে গেল এবং পরক্ষণেই তাতে জ্বলে উঠল আগুন। আর তার সাথে দ্বিতীয় ওয়াটার ক্যারিয়ারটি চৌমাথায় এসে বাঁক নিয়েই দক্ষিণের রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল।
চৌমাথা থেকে উত্তর-দক্ষিণে যে রাস্তা বেরিয়ে গেছে তার নাম ‘সী এন্ড লেক রোড’। মানুষ সংক্ষেপে একে ‘সী লেক রোড’ বলে ডাকে। রাস্তার উত্তর প্রান্ত পোর্ট ব্লেয়ার লেক পর্যন্ত গেছে, আর দক্ষিণ মাথা এঁকে-বেঁকে সাগর তীরে গিয়ে শেষ হয়েছে। মেজর সুরজিতের জীপ দাঁড়িয়ে গেল।
রাস্তার দুধারেই সেখানে গভীর খাদ। বিশাল ওয়াটার ক্যারিয়ার পাশ কাটিয়ে সামনে এগোবার কোন উপায় নেই। তার উপর গোটা ক্যারিয়ারটিই এখন জ্বলন্ত। তেল ঢেলে দেয়ায় মাটিতেও আগুন জ্বলছে।
কর্নেল সুরেন্দ্রর জীপও এসে দাঁড়াল মেজর সুরজিতের জীপের পেছনে।
মেজর সুরজিতরা গাড়ি থেকে নেমেছে কর্নেল সুরেন্দ্রও নামল গাড়ি থেকে। বলল, ‘মেজর, ঐ ওয়াটার ক্যারিয়ারে করে হাজী আবদুল্লাহকে নিয়ে ওরা পালাচ্ছে।’
‘স্যার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এ রাস্তা থেকে নেমে দক্ষিণের রাস্তায় উঠা যাবে। মাটি এবড়ো-থেবড়ো, কিন্তু বড় কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।’ বলল মেজর সুরজিত সিন্ধিয়া।
‘হ্যাঁ, এটাই বিকল্প। চল কুইক।’ নিজের গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
ঠিক এ সময় একটানা ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ এল দক্ষিণের রাস্তার দিক থেকে অর্থাৎ দূরে ছুটে চলা ওয়াটার ক্যারিয়ারের দিক থেকে। তার সাথে সাথেই দুতিনটি টায়ার বাষ্ট হবার বিকট শব্দ।
কর্নেল সুরেন্দ্র এবং মেজর সুরজিত দুজনই চোখে নাইট ভিশন দূরবিন লাগিয়ে দেখল, ওয়াটার ক্যারিয়ারটি রাস্তার এ পাশে কাত হয়ে গেছে এবং একজন আপাদ মস্তক কালো কাপড়ে আবৃত লোক ওয়াটার ক্যারিয়ারটির সামনের দিকে ষ্টেনগান তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল সুরেন্দ্র বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, কেউ পালাতে পারেনি। বিভেন বার্গম্যান ওদেরকে গাড়ির মধ্যেই আটকে রেখেছে।’
কথাগুলো বলেই সে পা বাড়াল রাস্তা থেকে নামার জন্যে এবং বলল, ‘একটি গাড়ি এখানে থাক। আরেকটি ওখানে আসবে। মেজর সুরজিত, মেজর পুরন্দর এবং আরও কয়েকজন এস। ছুটতে হবে ওদিকে।’
কর্নেল সুরেন্দ্র সিং, মেজর সুরজিত ও মেজর পুরন্দরসহ আরও তিন জন ছুটল ওয়াটার ক্যারিয়ারের দিকে।
ওরা গিয়ে পৌছল। ওরা দেখল, পাঁচজন লোক গাড়ির মাথার পাশে হাত তুলে বসে আছে। কাল জুতা, কাল প্যান্ট, কালো জ্যাকেট আর কালো হ্যাট পরা বিভেন বার্গম্যান ওদের দিকে ষ্টেনগান তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
ওখানে পৌছার পরই মেজর সুরজিত ও মেজর পুরন্দরের ষ্টেনগান তাক হল ওদের লক্ষ্যে। আর তার সাথেই বিভেন বার্গম্যঅন তার ষ্টেনগানের মাথা সরিয়ে নিয়ে ষ্টেনগান ঝুলালো কাঁধে।
কর্নেল সুরেন্দ্র এগিয়ে গেল বিভেন বার্গম্যান ওরফে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং বিভেন বার্গম্যান। আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।’
‘ধন্যবাদ কর্নেল।’ বলেই আহমদ মুসা ঐ পাঁচ জনের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাঝের একজন সুঠামদেহীকে দেখিয়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় চিনবেন, ইনি জেনারেল জগজিত জয়রাম। ইনি আন্দামান মহাসংঘের দ্বিতীয় ব্যক্তি। পুরো নাম এখন তাঁর জেনারেল জগজিত জয়রাম মহাগুরু। ডাকা হয় জেনারেল স্বামীজী বলে। ওর সামনে পড়ে থাকা তাঁর ঐ মোবাইলে উনি গাড়ি কাত হয়ে পড়ার পর টেলিফোন করেছিলেন সম্ভবত মহাসংঘের এক নম্বর ব্যক্তি কিংবা সংঘের অন্য কাউকে। আমি কলটা সমাপ্ত করতে দেইনি। এ কল থেকে এবং মোবাইল থেকে আরও প্রমাণ পেতে পারেন।’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ বিভেন বার্গম্যান। নয়া দিল্লীতে শুধু আপনার নাম শুনেছি। আজকের সফল অভিযানের সব কৃতিত্ব আপনার। আমাদের জীবনও আপনি বাঁচিয়েছেন। আপনি যদি ভারতীয় না হন, তাহলে আপনার প্রতি গোটা ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘ধন্যবাদ কর্নেল। একটু বেশি বলেছেন আপনি। আমি যা করেছি সেটা সামান্য সহযোগিতা মাত্র। কৃতজ্ঞতা আমাদের ঈশ্বরকে জানানো উচিত। আমি এখন চলি। আপনাদের এখন অনেক কাজ। ঘণ্টা দেড়েক পর আমি আপনার সাথে কথা বলব।’
বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘হাজী আবদুল্লাহকে ওরা সংজ্ঞাহীন করে চাদরে জড়িয়ে সিটের সেকেন্ড সারির ছাদের সাথে টাঙিয়ে রেখেছে।’
থামল আহমদ মুসা। তাকাল সবার দিকে। বলল, ‘আসি কর্নেল সুরেন্দ্র, মেজর সুরজিত, মেজর পুরন্দর। সকলকে আবার ধন্যবাদ।’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তার ঢাল থেকে নিচে নেমে গেল। ওখানে কাত হয়ে পড়েছিল একটা মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলটি তুলে নিয়ে আহমদ মুসা ওখানেই চড়ে বসল। মোটর সাইকেলটি নিঃশব্দে উঠে গেল রাস্তার উপর। দ্রুত হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
কর্নেল সুরেন্দ্র তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘মি. বার্গম্যানের কাছ থেকে একটা শিক্ষা পেলাম। এ ধরনের অপারেশনে সাইলেন্সার যুক্ত মোটর সাইকেল খুবই কার্যকরী। সুতরাং গাড়ি থাকলেও, তার সাথে মোটর সাইকেল অবশ্যই থাকা দরকার।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র তাকাল মেজর সুরজিতের দিকে। বলল, ‘মেজর তোমরা এদের হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোল।’
ইতিমধ্যে গাড়িও এসে গেছে।
কথা বলার সময়ই কর্নেল সুরেন্দ্র রুমাল দিয়ে ধরে তুলে নিয়ে রুমালে জড়িয়ে জেনারেল জগজিত জয়রামের মোবাইল পকেটে রাখল।
মেজর সুরজিত ও মেজর পুরন্দর সকলের পকেটে এবং গাড়ি সার্চ করে যা কিছু পেল সব ভিন্ন কাপড়ে বেঁধে গাড়ির একটা ব্যাগে রেখে দিল।
জেনারেল জগজিত জয়রামসহ গ্রেফতারকৃত সকলকে গাড়ির মেঝেয় তুলল এবং হাজী আবদুল্লাহকে বাঁধন খুলে দিয়ে যতেœর সাথে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিল।
কর্নেল সুরেন্দ্র মেজর পুরন্দরকে বলল গাড়িতে উঠে বসতে এবং গাড়ি সামনের ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর বাড়িটাতে নিয়ে যেতে। অন্যদিকে প্রথম গাড়ির ড্রাইভিং অফিসার লেফটেন্যান্ট বরুনকে বলল গাড়ির তিনজন প্রহরীকে ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোরের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে হেডকোয়ার্টারে চলে যেতে এবং আরেকটি গাড়ি নিয়ে এখনি চলে আসতে।
মেজর পুরন্দর গাড়ি নিয়ে উঠে গেল রাস্তায় এবং চলল গোপন বন্দীখানা হিসেবে ব্যবহৃত বাড়িটার দিকে।
কর্নেল সুরেন্দ্র ও মেজর সুরজিত ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেল রাস্তায়।
দুজনে হেঁটে চলল বাড়িটার দিকে।
‘মেজর, বিভেন বার্গম্যানকে কেমন মনে হল তোমার?’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘অদ্ভুত স্যার। কিন্তু এমন দক্ষ, অন্যের প্রয়োজনের প্রতি এত সচেতন এবং এমন বিনীত স্বভাবের মানুষ স্যার সিআইএ’র হতে পারে না। দেখলেন তো, কৃতিত্ব তিনি নিলেন না, বললেন কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরের প্রাপ্য।
‘ঠিক বলেছ মেজর সুরজিত। সিআইএ’র প্রতি পদক্ষেপে বড় হওয়ার একটা অহমিকা আছে, অন্যের ত্রুটি ধরার প্রবণতা আছে। বিভেন বার্গম্যানের মধ্যে এটা নেই।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘তাহলে কে তিনি স্যার? নাকি মার্কিন মনের রূপান্তর ঘটছে? নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিন্তু ‘প্রেসিডেন্ট জেফরসন’ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ‘বিশ্বটা আমার তরে’ না বলে তিনি ‘সকলে আমরা সকলের তরে’ বলছেন।’ বলল মেজর সুরজিত।
‘হতে পারে মেজর। দিন কারও সমান যায় না। কলিংগ যুদ্ধের ভয়ংকর যোদ্ধা স¤্রাট অশোক কলিংগ যুদ্ধের পর ‘স্মৃতি অশোক’ এ পরিণত হয়েছিলেন। যাক, বার্গম্যানের আরও পরিচয় আমরা পাব। আমাদের গোটা অপারেশনে তিনি আমাদের সাথে আছেন।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠল। ওল্ড মেডিকেল ষ্টোর বাড়িটার দিকে থেকে কিছুটা হৈ চৈ এর মত শোনা যাচ্ছে। দ্রুতকণ্ঠে সে বলল, ‘কিছু ঘটল নাকি ওখানে?’
বলেই কর্নেল সুরেন্দ্র অয়্যারলেস তুলে নিল মুখের কাছে। কল করল মেজর পুরন্দরকে।
মেজর সুরজিত সিন্ধিয়াও উদগ্রীব হয়ে উঠল কি ঘটেছে তা শোনার জন্যে।

Top