৪২. ডুবো পাহাড়

চ্যাপ্টার

উপকূলের শক্ত পাথরটাতে মাথা রেখে অবসন্ন দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে মরার মত পড়ে থাকল আহমদ মুসা।
শরীরে তার একফোটা শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু মাথা তার সক্রিয়।
উপকূলের স্পর্শ পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
তার বোট ঘেরাও হয়ে পড়েছে, শেষ মুহূর্তে টের পায় আহমদ মুসা। শেষ রাতের নিরব সমুদ্র দিয়ে নিশ্চিন্তে বোট চালিয়ে আসছিল সে। তার চোখে নাইট ভিশন গগলস ছিল, কিন্তু তা ছিল খুবই স্বল্প পাল্লার। টের পেয়েই ওদের ঘেরাও থেকে বের হবার জন্যে আহমদ মুসা বোটের সবটুকু স্পীড ব্যবহার করেছিল। বোটটি লাফিয়ে উঠে তীরের মত চলতে শুরু করেছিল। ঠিক তখনি চারদিক থেকে গুলী এসে তাকে ঘিরে ধরে। পরিণতি বুঝতে পারে আহমদ মুসা। ‘টিউব মেরিন আর্মার’ সে পরেই ছিল।
‘টিউব মেরিন আর্মার’ সর্বাধুনিক একটি আবিষ্কার। এটা ওয়াটার প্রুফ, এয়ার প্রুফ একটা টিউব। এর সাথে একটা ইঞ্জিন যুক্ত আছে এবং আছে একটা মিনি অক্সিজেন ট্যাংক। ইঞ্জিন চালু করলে টর্পেডো টিউবের মতই টিউবটি প্রচ- গতিশীল হয়ে যায়। মিনি ট্যাংকের অক্সিজেনে একজনের পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে। অতএব এই টিউবে আশ্রয় নিয়ে একজন মানুষ সাগরের তলদেশ দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে।
গুলী বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে দুপা এগিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ে পানিতে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটা গুলী এসে তার বাহুকে বিদ্ধ করে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে গোটা শরীর আহমদ মুসার। এরপরও সে এদিকে তার মনোযোগ দেবার সময় পায় না। দ্রুত ভার্টিকাল ডাউন বোতাম টিপে পানির গভীরে নেমে যায়।
এ সময় আহমদ মুসা খেয়াল করে বুলেটের আঘাতে তৈরি ফুটো দিয়ে চিকন ধারায় হলেও তীর বেগে পানি প্রবেশ করছে টিউবে।
আঁৎকে ওঠে আহমদ মুসা। পানি যতই প্রবেশ করবে, অক্সিজেনের ক্ষেত্র ততই সংকুচিত হয়ে পড়বে। এক সময় পানি ভর্তি হয়ে যাবে টিউব, তার সাথে সাথেই টিউবটা অক্সিজেন শূন্য হয়ে পড়বে। তার মানে তখন আর পানির তলায় থাকতে পারবে না টিউবটা।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি প্যারালাল ফরোয়ার্ড বোতাম টিপে কম্পাসের নির্দেম মত সোজা পশ্চিমে সেট করে টিউব সাব-মেরিনের মাথা। তীর বেগে ছুটতে শুরু করে টিউবটি। অক্সিজেন শেষ হবার আগেই আহমদ মুসাকে অবরোধ জোন ও গুলীর রেঞ্জ থেকে দূরে সরে যেতে হবে।
টিউবটি পানিতে প্রায় পূর্ণ। আহমদ মুসা বোতাম টিপে টিউবের মাথা ৪০ ডিগ্রী আপওয়ার্ড ঘুরিয়ে নেয়, তারপর কয়েক মুহূর্ত। আহমদ মুসা উঠে আসে পানির সারফেসে।
টিউব থেকে বেরিয়ে আসে আহমদ মুসা। বাম হাতটা নড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে আহমদ মুসা।
গুলীটা বাহুর পেশি ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, না পেশির মধ্যে ঢুকে আছে তা বোঝার উপায় নেই। সাগরের লোনা পানির জন্যেই বোধ হয় যন্ত্রণাটা অনেক বেশি।
টিউব থেকে বেরিয়েই আহমদ মুসা পেছনের ঘটনাস্থলের দিকে তাকিয়েছিল। দেখল সবগুলো বোটে আলো জ্বলে উঠেছে। আলোগুলো ছুটোছুটি করছে এবং আলোর ফ্লাশ চষে ফিরছে ঐ এলাকার সাগরের বুক। তাকেই খুঁজছে বুঝল আহমদ মুসা।
দৃষ্টি ফেরায় আহমদ মুসা সামনের দিকে।
পশ্চিম দিগন্তে ক্ষীণ আলোর একটা রেখা দেখা যায়। কতদূরে হবে উপকূল? বিশ থেকে তিরিশ মাইলের মত দূরে হবে, ভাবে আহমদ মুসা।
লাইফ-জ্যাকেটে ভেসেছিল আহমদ মুসা। সাঁতরাতে শুরু করে বাঁ হাত তুলতে গিয়ে আবারও অন্তর্ভেদী খোঁচা খায় সে। যন্ত্রণায় ঝিমঝিম করে উঠল তার গোটা শরীর।
বাঁ হাত ব্যবহার করা গেল না।
চিৎ হয়ে দুপা ও ডান হাত দিয়ে সাঁতরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে আহমদ মুসা।
গুলীর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তখনও।
শরীরটাকে টেনে নিয়ে এগোনো কঠিন হয়ে পড়ছিল। ফাঁপা জ্যাকেট বাধার সৃষ্টি করছিল বেশি।
দু’পায়ে পানি ঠেলে এবং অবশিষ্ট এক হাত দিয়ে পানি টেনে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোয় আহমদ মুসা উপকূলের দিকে।
অব্যাহতভাবে এই চলা।
থামার কোন অবকাশ নেই। যে কোন মূল্যে রাতের অন্ধকার শেষ হবার আগেই তাকে উপকূলে পৌছাতে হবে।
দুর্বল হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। তবু সর্বশক্তি দিয়ে দু’পা ও এক হাতকে আরও সক্রিয় করতে হয় তাকে।
দুঃসাধ্য এই প্রচেষ্টা।
যখন উপকূলে পৌছে, তখন দূর্বলতা ও ক্লান্তিতে সংজ্ঞা হারাবার মত অবস্থা আহমদ মুসার। লাইফ-জ্যাকেট না থাকলে অনেক আগেই ডুবে যেত সে। দেহকে ভাসিয়ে রাখার শক্তি তার ছিল না।
পাথরে মাথা রেখে অনেকক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে থাকার পর শক্তি যেন কিছুটা ফিরে পেল আহমদ মুসা। মাথার চিন্তাও ফিরে আসে পেছন থেকে বর্তমানে। ভাবনা এল মাথায়, অন্ধকার আরও ফিকে হবার আগেই তাকে সরে পড়তে হবে। পুব আকাশ সাদা হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সুবহে সাদেকের স্বচ্ছতা নেমে আসছে।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে উঠে বসল। চারদিকে তাকাল।
দেখল, এখানকার উপকূলটা পাথর বাঁধানো। কিছুটা উপর থেকে সাজানো বাগানের মত। আর আহমদ মুসা বসে আছে একটা পাথুরে সিঁড়ির ধাপে। মাথা রাখার যে স্থানটাকে সে পাথর ভেবেছিল, সেটা পাথর বটে, কিন্তু সিঁড়ির একটা ধাপ।
সিঁড়ি বরাবর উপরে তাকাল আহমদ মুসা। সিঁড়ির শেষটা সে দেখতে পেল না। সিঁড়িটা খাড়া উঠে গিয়ে কিছুটা বেঁকে গেছে। সিঁড়ির শেষটা দেখা না গেলেও একটা মন্দিরের বিশাল চুড়া দেখতে পেল আহমদ মুসা। বুঝল, এটা একটা মন্দির এলাকা। সিঁড়িটা মন্দিরে উঠে গেছে। আহমদ মুসা চেষ্টা করেও ঠিক করতে পারলো না এটা পোর্ট ব্লেয়ারের কোন এলাকা। উত্তর অংশ অবশ্যই নয়, দক্ষিণ দিকের কোন স্থানে এটা হতে পারে। আবার ভাবল, সে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের বিপরীত দিকে ‘ব্লেয়ার চ্যানেল’ এর উত্তর দিকের কোন জায়গায় এসে উঠেনিতো? ব্লেয়ার চ্যানেলের দক্ষিণ তীরে পোর্ট ব্লেয়ার। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চিন্তা হলো, ব্লেয়ার চ্যানেলের উত্তর তীর খুবই খাড়া। সাগরের দিকটাও একই রকম খাড়া। সেখানে এমন সুন্দর জায়গা থাকতে পারে না। এটা যে পোর্ট ব্লেয়ার নিশ্চিত হল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
বিপর্যস্ত শরীরে কোমরের ভারী বেল্ট এবং পিঠের ট্যুরিষ্ট ব্যাগটাকে আরো ভারী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ও দুটি ফেলা যাবে না। ওয়াটার প্রুফ বেল্ট ও ব্যাগে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আছে। পদে পদেই দরকার হবে। শোল্ডার হোলষ্টারে তার প্রিয় রিভলবারটার স্পর্শও অনুভব করতে পারছে।
বাম হাত চেপে ধরে সে হাঁটতে শুরু করল।
গুলীতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্ত এখন বেরুচ্ছে না। কিন্তু ভিজা ক্ষত স্থানের জমাট রক্ত গলছে।
পানিতে ধুয়ে গেলেও বাম বাহু ও বাঁদিকের কাপড়-চোপড় অনেকটা রক্তাক্তই দেখাচ্ছে।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ উঠেছে।
হঠাৎ সিঁড়ির বাঁকের ওপার থেকে দুটি মেয়ের মাথা সে দেখতে পেল। ধীরে ধীরে তাদের গোটা দেহ তার নজরে এল।
দুটি মেয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। একজন তিরোশার্ধ, অন্যজন তরুণী।
দু’জনেরই কপালে ফোঁটা, কিন্তু একজনের সিঁথিতে সিঁদুর। তরুণীটির সিঁথিতে সিঁদুর নেই। তার হাতে পিতল রংয়ের একটা গোলাকার ট্রে মনে হচ্ছে।
নিশ্চয় ট্রেটিতে ফুল ও পুজার উপকরণ আছে, অনুমান করল আহমদ মুসা। সেই সাথে বাবল, মেয়ে দুটি নামছে সাগরে পূজার অর্ঘ দিতে।
মেয়ে দুটিও তাকে দেখে ফেলেছে।
আহমদ মুসা ক্ষণিকের জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
কিন্তু মেয়ে দুটি দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রথমে তাদের চোখে ছিল সাধারণ কৌতুহল দৃষ্টি। এই রকম চিন্তা যে, এই সাত সকালে সিঁড়ি দিয়ে কে উঠে আসছে! এ কৌতুহল শীঘ্রই বিস্ময়ে পরিণত হল, যখন দেখল লোকটি পানি থেকে উঠে আসছে।
আরও কাছে এসে পড়েছে আহমদ মুসা।
এবার পরিপূর্ণভাবে ওদের নজরে পড়েছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসার বাম বাহু আহত, রক্তাক্ত, তা দেখতে পেয়েছে ওরা। আহমদ মুসার পিঠের ব্যাগ দেখতে পেয়েছে তারা। আহমদ মুসার চেহারার বিদেশী ভাবও তাদের নজর এড়ায়নি।
তাদের বিস্ময় এবার উদ্বেগে রূপ নিয়েছে।
আহমদ মুসা খুবই স্বাভাবিকভাবে উপরে উঠেছিল। মেয়েরা কিছু না বললে আহমদ মুসা ওদের এড়িয়ে উঠে যাবে, এটাই ভেবে রেখেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আরও এগিয়ে এলে তরুণীটি বড় মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপা লোকটি আহত, মনে হয় কোন ট্যুরিষ্ট। কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কিংবা দুর্ঘটনায় পড়েছিল বোধ হয়।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু রেডিও ঘোষণা শুনেছিস? একজন বিদেশী সন্ত্রাসীকে সরকার খুঁজছে। সে এমনি……।’
পেছনে খড়মের দ্রুত ঠক ঠক শব্দ শুনে বড় মেয়েটি কথা বন্ধ করে পেছনে তাকাল। দেখল প্রধান পুরোহিত দ্রুত নামছে সিঁড়ি বেয়ে।
পুরোহিত যোগানন্দ যোগী কোন কারণে মন্দিরের এ দিকটায় এসে দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। একটু ভালো করে দেখেই ছুটে আসছে।
যোগানন্দ যোগী ‘মহাসংঘ’ এর সদস্য।
আন্দামান সাগরে বোট সমেত আহমদ মুসা ধ্বংস হবার খবর সে শুনেছে। খুশিতে আপ্লুত হয়ে ইতিমধ্যেই সে এক প্রস্থ পূজা দিয়েছে। শক্তিরূপিনী, অশুর নাশিনী মা দূর্গাকে। কিন্তু এখন ভিজা, আহত আহমদ মুসাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখেই তার কোন সন্দেহ রইল না যে, এই লোক সাগর থেকে উঠে আসছে। সেই সাথে তার দ্বিতীয় যে কথা মনে হল, তা হল সোজাসুজিই সাগরে বোট ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে, সুতরাং সাগর থেকে উঠে আসা লোক আহমদ মুসা হওয়াই স্বাভাবিক। সে সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে যতই আহমদ মুসার নিকটবর্তী হল, এই বিশ্বাস তার আরও দৃঢ় হল। মেয়ে দুটির পেছনে এসে আহমদ মুসার গুলীবিদ্ধ বাম বাহু দেখে তার আর কোন সন্দেহই রইল না।
সঙ্গে সঙ্গেই দুপায়ের খড়ম ফেলে দিয়ে সে হুংকার দিয়ে সামনে এগোল। কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার তার উঠে এসেছে হাতে।
আঁৎকে উঠে মেয়ে দুটি সিঁড়ির দু’পাশে সরে গেল।
যোগানন্দ যোগীর মনে পড়ছে তার উপর হুকুমের কথা, ‘দেখামাত্র আহমদ মুসাকে হত্যা করতে হবে।’
রিভলবার তুলে নিয়েই যোগানন্দ যোগী চিৎকার করে উঠেছে, ‘বিভেন বার্গম্যান ওরফে আহমদ মুসা তোমার আর রক্ষা নেই। সাগরে থেকে তুমি বেঁচে উঠেছ, কারণ ডাঙ্গায় তোমার মরণ লিখা ছিল।’
বলেই যোগানন্দ যোগী আহমদ মুসার দিকে তাক করা রিভলবারের ট্রিগার টিপে দিয়েছে।
যোগানন্দ যোগীকে হাতে রিভলবার তুলে নিতে দেখেই আহমদ মুসার হাত শোল্ডার হোলষ্টারে চলে গিয়েছিল। আহমদ মুসাকে দেখামাত্র গুলী করার ‘মহাসংঘের’ সিদ্ধান্ত সে জানে। যোগানন্দ যোগীর বেপরোয়া চেহারা দেখে এবং কথার ধরনে এ কথাই তার আবার মনে পড়ল। শোল্ডার হোলষ্টার থেকে রিভলবার বের করলেও গুলী করার সময় ছিল না। আত্মরক্ষার জন্যে আহমদ মুসাকে বাঁ দিকে ছিটকে পড়তে হল। গুলী করার জন্যে ডান হাত উন্মুক্ত রাখার জন্যেই আহত বাম পাশটার উপরই আবার জুলুম করতে হল। গুলীটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল যোগানন্দ যোগীর। আহমদ মুসা তার দেহ সরিয়ে নিতে চার পাঁচ সেকেন্ড দেরী করলেই যোগানন্দ যোগীর বুলেট তার কপাল ফুটো করে দিত।
বাঁ দিকে মাটিতে ছিটকে পড়েই আহমদ মুসা তার রিভলবারের ট্রিগার টিপেছিল যোগানন্দ যোগীকে লক্ষ্য করে।
পাল্টা এই আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না যোগানন্দ যোগী। কিছু বুঝে উঠার আগেই কপালের ঠিক মাঝখানটায় গুলী খেয়ে আছড়ে পড়ল সে সিঁড়ির উপর। তারপর গড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নেমে গেল তার দেহটা।
গুলী করেই আহমদ মুসা তার বাম বাহুর যন্ত্রণায় নেতিয়ে পড়ল মাটির উপর। বামদিকে দেহকে ছিটকে দেয়ায় আহত বাম বাহুটা গিয়ে পড়েছিল একটা পাথরের উপর। দেহের গোটা চাপটাও গিয়ে পড়েছিল সেই আহত বাহুটার উপরই।
যন্ত্রণায় বাহুটা প্রায় অবশ হয়ে পড়েছিল। সেই সাথে দেহটাও তার ব্যথায় জরজর হয়ে পড়েছে।
ভয়-আতংকে পাথর হয়ে যাওয়া মেয়ে দুটি তাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিরবে দেখছিল।
প্রথমে সাধু যোগানন্দ যোগী গুরুজীর ঐভাবে তেড়ে আসা ও রিভলবার বের করা দেখে তারা অবাক হয়েছিল। যে গুরুজী একটা মাছি মারাকেও ¯্রষ্টার অনভিপ্রেত বলেন, সেই গুরুজীর হাতে রিভলবার! তারপর গুরুজী সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা লোককে ‘আহমদ মুসা’ বলে সম্বোধন করা দেখে ভীষণ চমকে উঠেছিল বড় মেয়েটি। ভেতর থেকে শতকণ্ঠে তার জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হয়েছিল এই লোকটি তাহলে সেই আহমদ মুসা!
আতংকের ঘোর কাটলে আহমদ মুসা নামটা ধাক্কা দিল বড় মেয়েটিকে। গুরুজীর কপালে যে গুলী লেগেছে, এটা তো দেখাই গেল। এতক্ষণে গুরুজী বোধ হয় শেষ হয়ে গেছেন। কিন্তু আহমদ মুসা যাকে বলা হল, তিনিও কি গুলী খেয়েছেন। ওভাবে নির্জীব পড়ে আছেন কেন? গুরুজীর মতই কি তার অবস্থা? বুকের কোন গভীরে যেন একটা প্রবল অস্বস্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে তরুণীটির হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘এস।’
বড় মেয়েটি দ্রুত এগোল আহমদ মুসার দিকে। গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসাও মাটি থেকে মাথা উঠিয়ে চাইল মেয়েটির দিকে।
‘আপনি ভালো আছেন? আপনার গুলী লাগেনি?’ উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল মেয়েটি।
বিস্মিত হল আহমদ মুসা। এই অচেনা হিন্দু মেয়েটির কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর কেন? চোখে তার দরদ ভরা দৃষ্টি কেন?
জবাব দিতে আহমদ মুসার একটু দেরী হয়েছিল। মেয়েটিই আবার বলে উঠল, ‘আপনি কি সত্যিই আহমদ মুসা? ভয় নেই। আমি সুস্মিতা বালাজীর বোন। আমি পোর্ট ব্লেয়ারে থাকি, সুস্মিতা আপা আপনার কথা আমাকে বলেছেন।’
আহমদ মুসা তার ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরে উঠে বসল। বলল, ‘আল্লাহর অশেষ প্রশংসা। আমার চরম দুঃসময়ে আল্লাহ আপনাকে মিলিয়ে দিলেন। আপনার বোন সুস্মিতা বালাজীকেও এক কঠিন বিপদে আমি আল্লাহর সাহায্য হিসেবে পেয়েছিলাম।’
একটু থেমে একটা দম নিয়ে আবার আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ আমি আহমদ মুসা।’
শুনে খুশি হল বড় মেয়েটি। কিন্তু পরক্ষণেই এক রাশ উদ্বেগের অন্ধকার নামল তার চোখে-মুখে। বলল সে দ্রুতকণ্ঠে, ‘সরকার ও গোটা প্রশাসন পাগল হয়ে উঠেছে আপনাকে শেষ করার জন্যে। পোর্ট ব্লেয়ারের কোন রাস্তা, হোটেল, বাড়ি আপনার জন্যে নিরাপদ নয়। আপনি উঠুন, এখনি এখান থেকে সরে পড়তে হবে।’
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল মেয়েটি, ‘আপনি হাঁটতে পারবেন?’
আহমদ মুসা উঠতে উঠতে বলল, ‘পারব। কিন্তু কোন জায়গাই নিরাপদ না হলে আমি কোথায় যাব, কোথায় নেবেন আপনারা আমাকে?’
‘সুস্মিতা বালাজীর বোনের বাড়িকে আপনি নিরাপদ ভাবতে পারেন।’ বলল বড় মেয়েটি।
আহমদ মুসা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘আমরা মন্দিরের দিক দিয়ে বেরুতে পারবো না। বাইরের রাস্তাও আমাদের জন্যে নিরাপদ নয়। সাগর তীর দিয়েই আমাদের যেতে হবে। মন্দির এলাকা পেরোবার পরও সাগর তীর হয়েই যাওয়া যাবে। একটু এগোলেই আমাদের বাড়ি।’
বলেই হাঁটতে শুরু করল বড় মেয়েটি। তার সাথে আহমদ মুসা ও তরুণীটিও।
পাশাপাশি তিনজন হাঁটছে। প্রথমে কিছুক্ষণ নিরবতা।
নিরবতা ভেঙে বড় মেয়েটিই প্রথমে কথা বলল, ‘আমার নাম সুরূপা সিংহাল। সুস্মিতা আপার ছোট খালার বড় মেয়ে আমি। আর এই মেয়েটি আমার চাচাতো বোন এবং সুষমা রাওয়ের খালাতো বোন। আন্দামান এলে আমাদের বাসাতেই থাকে, গভর্নর ভবনে সে যায় না। ওর নাম সাজনা সিংহাল।’
যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটছিল তারা।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে বাম হাতটা চেপে ধরে হাঁটছিল।
‘স্যার, আপনার কষ্ট হচ্ছে আপনার পিঠের ব্যাগটা আমাকে দিন।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘ভাই, ও ঠিকই বলেছে। ওটা আমাদের দিন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘না বোনরা, আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। বরং পিঠের চাপ আহত বাহুর যন্ত্রণাকে কিছুটা লাঘব করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কষ্ট বেশি হবার কথা, লাঘব হচ্ছে কিভাবে স্যার?’ বলল বিস্মিত কণ্ঠে সাজনা সিংহাল।
‘পিঠে ভারের বোধ থাকায় কষ্টের অনুভূতিটা দু’ভাবে ভাগ হচ্ছে। এ ভার না থাকলে কষ্ট বোধটা আহত বাহুতে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
সুরূপা ও সাজনা দু’জনেই এক সাথে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দুজনের চোখেই বিস্ময়।
সুরূপা চোখ ফিরিয়ে স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘কোন বিষয়কে এমন নিখুঁতভাবে দেখা ঈশ্বরের দেয়া বিশেষ গুণ।’
সাজনা কিছু বলতে যাচ্ছিল। সুরূপা বাধা দিয়ে বলল, ‘আমরা এসে গেছি সাজনা। সামনেই কাঁটাতারের বেড়া। এস আমরা নিচে নেমে যাই, নিচু করিডোরটা দিয়ে আমরা ওপারে চলে যাব, কাঁটাতারের বেড়া ডিঙাতে যাওয়া ঠিক হবে না।
ওরা তিনজন নিচে সাগরের কূলে নেমে গের। বড় বড় পাথর-টিলার কিছু চড়াই-উৎরাই ওদের পার হতে হল। ওপারে পৌছে গেল ওরা। এখন অনেকটা নিরাপদ। একটা বড়, মসৃণ পাথর দেখে সুরূপা আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাই, আপনি বসুন। আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে।’
বসল তিনজনই।
সুরূপা আহমদ মুসার বাহুর ক্ষতটা দেখছিল। বলল, ‘আমার মনে হয় গুলীটা বেরিয়ে গেছে।’
‘আমারও তাই মনে হয়। তা না হলে ক্ষতের দুটি মুখ থাকতো না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আপনি কোথায় গুলীবিদ্ধ হলেন? সাগরে পড়লেন কি করে? লঞ্চ ডুবি হয়েছিল? ‘সাগর থেকে বেঁচেছ, ডাঙ্গায় তোমার মরণ লিখা হয়েছে’ -গুরুজী এই কথা বলল কেন? গুরুজী আপনাকে মারতে চেয়েছিল কেন?’ -এক নিশ্বাসে প্রশ্নগুলো করল সাজনা সিংহাল।
‘গুরুজী কেন মারতে চায়, সে কথা তুমি সুরূপার কাছে শুনে নিও। সে নিশ্চয় সব কথা শুনেছে সুস্মিতা আপার কাছ থেকে। সাগরে কি করে পড়লাম, সেই কথা বলছি শোন। আমি………।’
‘এখন কোন কথা নয় ভাই। বাসায় চলুন, আপনি সুস্থ হোন তারপর সব কথা।’ বলে সুরূপা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কোথাও মোবাইলে কথা বলল। কোন এক ডাক্তার সোহনীকে বলল, ‘প্লিজ আপনি সার্জারী, ব্যান্ডেজ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে আমার বাসায় চলে আসুন। এখনি প্লিজ।’
মোবাইল রেখে সুরূপা বলল, ‘ডাক্তার সোহনী পোর্ট ব্লেয়ার হাসপাতালের একজন সার্জন এবং সুস্মিতা আপার ক্লাসমেট ও বন্ধু। আমাদের সমস্যায় তিনি আসেন। আপনার ক্ষেত্রে যেমনটা প্রয়োজন, তিনি ততটাই বিশ্বস্ত।’
‘সোহনী নাম, তিনি কি মুসলিম?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি হ্যাঁ মুসলিম, কেরালার মেয়ে। পুরো নাম সোহনী শবনম। খুব ধর্মভীরু। নিয়মিত নামায পড়ে, মাথায় রুমাল বাঁধে। আপনাকে নিশ্চয় চিনবে।’ সুরূপা বলল।
কেরালার নাম শুনতেই আহমদ মুসার মনে পড়ল শাহ বানুর মায়ের কথা, হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহর কথা। মোপলা বিদ্রোহের নায়ক তাদের পূর্ব পুরুষের কথা। বলল আহমদ মুসা, ‘ডাক্তার সোহনী শবনম কি কেরালা থেকে আসা, না আন্দামানের কেরালিয়ান?’
‘কেরালা থেকে আসা। কেরালার সরকারি হাসপাতাল থেকে ট্রান্সফার হয়ে আন্দামানে এসেছেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
কথা শেষ করেই সুরূপা আবার বলে উঠল, ‘চলুন উঠি। সোহনীদি আবার এসে পড়বেন।’
সবাই উঠল। চলতে শুরু করল সাগর তীরের পাথুরে চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে।

ডাক্তার সোহনী ব্যান্ডেজ খুলেই বলে উঠল, ‘তাই বলে আপনার দেহ এত আঘাতের ধকল মোকাবিলার পরেও কেমন করে এত স্বাভাবিক! আপনার দেহে নিশ্চয় মেডিসিনের ষ্টোর আছে, অথবা আপনার দেহে আল্লাহ এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন, যা আঘাতের ক্ষতিকে দ্রুত পূরণ করে আপনাকে স্বাভাবিক করে দেয়। তা না হলে মেশিন গানের বুলেট পেশির গভীরে প্রবেশ করে বিপরীত দিক দিয়ে বের হয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, তা ঠিক হতে কমপক্ষে ১৫ দিন লাগার কথা, কিন্তু তার সিকি সময়ও তো আপনার লাগেনি!’
‘তাড়াতাড়ি আমার সুস্থ হওয়া প্রয়োজন। সে কারণেই আল্লাহর এই সাহায্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ক্ষেত্রে এটা খুব বেশি ঠিক।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?’
‘নিশ্চয় করবেন? তবে ‘আপনি’ সম্বোধন না করলে খুশি হতাম। সুস্মিতা আপাও শেষে ছোট ভাই হিসেবে ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শুধু বয়স মর্যাদার প্রতীক নয়। আপনাকে ছোট ভাই বলে আপন করার চাইতে আপনি যে মর্যাদার অধিকারী, সেটাকে বড় করে দেখাই বেশি প্রয়োজনীয়।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘আপনার প্রশ্ন বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
একটুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, ‘মনে রাখবেন প্রশ্নটা আমার মত একজন দুর্বল নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। আপনার এই অস্থির জীবনের শেষ কোথায়? আমি যতটুকু জেনেছি, ততটুকুতেই আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি। জোসেফাইন ভাবী কি ভাবেন আমি জানি না।’
‘এটা ‘অস্থির জীবন’ নয় ডাক্তার সোহনী, এরই নাম জীবন। জীবন মানেই কাজ, কাজ মানেই অস্থিরতা। কাজের এই অস্থিরতা গৃহাঙ্গন থেকে বিশ্ব পর্যায়ে হতে পারে। এরই একপর্যায়ে আমার জীবন। সুতরাং এই অস্থিরতা শেষ হওয়ার কথা নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘আপনাদের মত লোকদের সাধারণ কথাও দর্শন হয়ে যায়। সহজ কথার একটা কঠিন দর্শন আপনি তুলে ধরেছেন। আমিও একমত আপনার সাথে। কিন্তু এই অস্থিরতার মাঝেও স্থিরতা থাকে। আমি সেটার কথাই বলেছি।’
‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু সব জীবন একরকম নয়। আপনাদের মোপলা বিদ্রোহের কথাই স্মরণ করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
গম্ভীর হয়ে ওঠল ডাক্তার সোহনীর মুখ। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়নি। একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’
ডাক্তার সোহনী তার ডাক্তারী ব্যাগ গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ব্যাগটি গুছিয়ে নিয়ে পাশের সোফায় বসল।
হাতের টিস্যুটা দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে একটু হাসল। বলল, ‘ওসব ভারী কথা থাক। এখন, বলুন গত রাতে চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে প্রচ- গোলা-গুলীর মধ্যে বোট থেকে সাগরে নামলেন, গুলীবিদ্ধ হলেন, সাবমেরিন টিউবও যখন গুলীতে ফুটো দেখলেন, তখন আপনার কি মনে হয়েছিল?’
‘প্রত্যেক বিপদের মধ্যে বাঁচার একটা পথ থাকেই, সেই বাঁচার পথ ব্যবহার করার জন্যে তখনকার অবস্থা মোকাবিলা করা ছাড়া আর কিছুই আমি ভাবিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাবীর কথা? বাচ্চার কথা?’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘ওদের ছবি, সব সময় আমার চোখের সামনে থাকে। তবে ঐ মুহূর্তে ওদেরকে নিয়ে দূর্বল করার মত ভাবনা আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়নি।’
‘সে জন্যেই তো আপনি আহমদ মুসা। ধন্যবাদ। কিন্তু বলুন তো অতীতের এমন কোন ঘটনা বা স্মৃতি যা আপনাকে দূর্বল করে, দুঃখিত করে, ব্যথিত করে?’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘এমন কোন মানুষ দুনিয়ায় নেই যার জীবনে এই ধরনের কোন ঘটনা বা স্মৃতি নেই। আমার জীবনেও এমন অনেক ঘটনা আছে। এতই বেশি…..।’
এই সময় ছুটে ঘরে প্রবেশ করল সুরূপা সিংহাল। তার পেছনে পেছনে সাজনা সিংহালও।
আহমদ মুসার কথা আগেই থেমে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসল।
‘ভাই, একটা দুঃসংবাদ।’ সুষমা রাও নিখোঁজ।’
‘সুষমা রাও নিখোঁজ?’ অনেকটা স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
ধীরে ধীরে মাথাটা নিচু হল। চোখটাও তার বন্ধ হয়ে গেল। ভাবছে সে। কথা বলল না।
কথা বলল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘কবে থেকে নিখোঁজ?’
‘গতকাল বিকেল থেকে।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘কই পত্রিকায় তো আসেনি? গভর্নরের মেয়ে নিখোঁজ, ছোট ঘটনা নয়।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘সম্ভবত মর্যাদার ব্যাপারকে তারা বড় করে দেখছে।’ সুরূপা বলল।
‘কোত্থেকে নিখোঁজ হয়েছে?’ প্রশ্ন ডাক্তার সোহনীর।
‘গভর্নর হাউজের সামনে কালী মন্দিরে মায়ের সাথে পূজো দিতে গিয়েছিল। ফেরার পথে নিখোঁজ হয়েছে।’ বলল সুরূপা।
‘তাহলে তো এটা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নয়। নিখোঁজ এভাবে হয় না। বলতে হবে অপহৃত হয়েছে।’ ডাক্তার সোহনী বলল।
‘খালাম্মার সাথে কথা হল। তিনি নিখোঁজ শব্দই বললেন। অবশ্যই তার অবস্থা খুবই খারাপ। কান্নায় কথা বলতে পারছেন না। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘মন্দির পর্যন্ত এরিয়া গভর্নর হাউজের সিক্যুরিটি এলাকার মধ্যে। ওখান থেকে গভর্নরের মেয়ে অপহৃত হলে সাংঘাতিক দুঃসাহসিক কাজ!’ ডাক্তার সোহনী বলল।
‘পুলিশের থেকে তারা যদি বড় হয়, তাহলে দুঃসাহসের দরকার হয় না।’ সুষমা রাওয়ের অপহরণের ব্যাপারে প্রথম মুখ খুলল আহমদ মুসা।
‘পুলিশের থেকে তারা বড় হবে কেন? সন্ত্রাসী যত বড়ই হোক, পুলিশকে তারা ভয় করে।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘ব্যাপারটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। তবে আমার মনে হয় সন্ত্রাসীরা সুষমা রাওকে অপহরণ করেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কে অপহরণ করেছে?’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আমার কথা ঠিক নাও হতে পারে। তবে আমি সুষমা রাওয়ের অপহরণের যতগুলো বিকল্পের কথা ভাবলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনার কথা হল, একটা জঘন্য উদ্দেশ্যে অপহরণের নাটক সাজানো হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলেন কি ভাই? এ নাটক সাজাবে কে? তার বাবা?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আমি তাই অনুমান করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি কারণে, সেই জঘন্য উদ্দেশ্যটি কি?’ প্রশ্ন সুরূপারই।
‘অনেকগুলো কারণের কথা চিন্তা করা যায়। সুষমা রাওয়ের সাথে সুস্মিতা বালাজী আপার যোগাযোগ হয়েছে, এটা তার পিতা জানতে পেরে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্যে এই কাজ করেছেন। কিন্তু এই কারণ আমার কাছে খুব যৌক্তিক নয়। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, সুষমা রাওকে অপহরণের নাটক সাজিয়ে তাকে সরিয়ে রেখে এর দায় আহমদ শাহ আলমগীর তথা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোন দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে চান। এ কারণকেও আমার কাছে খুব শক্তিশালী মনে হয় না। তৃতীয় কারণ হতে পারে এই যে, বন্দী আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য একটা গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সুষমা রাওকে।’
‘গিনিপিগ কিভাবে? কি তথ্য আদায়?’ বলল সুরূপা সিংহাল বিস্মিত কণ্ঠে।
আহমদ শাহ আলমগীর ও সুষমা পরষ্পরকে ভালোবাসে। সুষমাকে বন্দী আহমদ শাহ আলমগীরের কাছে হাজির করে আহমদ শাহ আলমগীরকে এ কথা বলা হবে যে, তথ্য যদি সে প্রকাশ না করে, তাহলে তার সামনেই সব রকম নির্যাতন, এমনকি শ্লীলতাহানীর কাজ করা হবে। সুষমা রাওকে রক্ষার জন্যেই তখন আহমদ শাহ আলমগীর মুখ খুলবে। আর……’।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ডাক্তার সোহনী বলে উঠল, ‘আপনি এটাও কি নিছক অনুমান করেছেন?’
‘না। এভাবে গিনিপিগ বানাবার জন্যে বিবি মাধবের লোকরা আহমদ শাহ আলমগীরের মা ও বোনকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু তারা তাদের হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় তাদের গিনিপিগ বানানো সম্ভব হয়নি এবং আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে তথ্যও তারা আদায় করতে পারেনি। শেষ ব্যবস্থা হিসেবেই আমি মনে করি সুষমা রাওকে তারা অপহরণ করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার কথায় শক্তিশালী যুক্তি আছে। কিন্তু একজন পিতা কি তার মেয়ে নিয়ে এমন কিছু করতে পারেন?’
‘এটা হতে পারে যদি গরজটা মেয়ের চেয়েও বড় হয়। আর পিতা মনে করতে পারেন, আসলেই তার মেয়ের কোন ক্ষতি হবে না। মাঝখান থেকে আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে তথ্য আদায় হয়ে যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু মেয়ের কাছে তো পিতা চিরদিনের মত ছোট হয়ে যাবেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সুষমা রাও পিতাকে সন্দেহ করেছে, কিন্তু পিতা মেয়েকে জানতে দেয়নি তারাই যে আহমদ শাহ আলমগীরকে অপহরণ করেছে। তাঁর নিজের লোকরা ছদ্মবেশে সুষমাকে অপহরণ করেছে এবং জানতেও দেবে না তার পিতা এর সাথে জড়িত। সে বুঝবে আহমদ শাহ আলমগীরকে যারা আটক করেছে, তারাই আহমদ শাহ আলমগীরকে কথা বলাবার জন্যে সুষমাকে অপহরণ করেছে। সুষমা আরও বুঝবে, তার পিতা তাহলে আহমদ শাহ আলমগীরের অপহরণের সাথে জড়িত নয়। এতে গভর্নর মাধব মেয়ের সন্দেহের দায় থেকেও মুক্ত হবেন এবং কার্যোদ্ধারও হয়ে যাবে।’
ডাক্তার সোহনী, সুরূপা ও সাজনা সিংহাল সকলের মুখেই আনন্দ ও স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছে। তাদেরও এখন স্থির বিশ্বাস সুষমার অপহরনের কাজ তার পিতাই করেছে এবং সুষমার আসলেই কোন ক্ষতি হবে না।
আনন্দ ও স্বস্তির মধ্যেও প্রশ্নের এক প্রবল স্ফুরণ ঘটেছে সাজনা সিংহালের চোখে মুখে। বলল সে, ‘খালুজান মানে সুষমা আপার আব্বা এতবড় একটা কাজ করেছেন কোন তথ্যের জন্যে? সে তথ্যের সাথে তার সম্পর্ক কি?’
‘এটাই আসল বিষয়। এই তথ্যের জন্যেই আহমদ শাহ আলমগীরকে অপহরণ করা হয়েছে এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো এই তথ্যকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। কিন্তু এই ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানি না। আমি এ পর্যন্ত যেটা জানতে পেরেছি তা হল, শিবাজীর কি দলিল ও মোগল সম্রাটদের কি একটা নক্সা আহমদ শাহ আলমগীরের কাছে আছে। এই জিনিসগুলো তারা চায়। এটা পেলে নাকি তাদের পথ ও পাথেও দুই-ই পাওয়া হয়ে যাবে। আবার ভারতে প্রতিষ্ঠিত হবে শিবাজীর স্বপ্নের ধর্মরাজ্য। কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় একত্রিত হবে আবার, ‘এক ধর্মরাজ্য পাশে খ- ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘রবীন্দ্রনাথের এ কবিতাংশ জানলেন কি করে? আপনি তো বাংলা জানেন না, ভারতীয়ও নন।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘তোমার আপা সুস্মিতা বালাজীই আমাকে শিখিয়েছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
ডাক্তার সোহনী ও সুরূপার মুখ গম্ভীর। তারা ভাবছিল। সাজনার এবং আহমদ মুসার উত্তর তাদের কানে বোধ হয় পৌছায়নি।
আহমদ মুসার কথার শেষ শব্দ বাতাসে মেলাবার আগেই সুরূপা প্রশ্ন করল, ‘যারা ঐসব অপহরণের সাথে জড়িত, যারা ভারতে শিবাজীর ধর্মরাজ্য চায় তাদের সাথে গভর্নর বিবি মাধবের সম্পর্ক কি? তিনি তো ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের গভর্নর।’
গম্ভীর হল আহমদ মুসা। ভাবনার একটা ছায়া নামল তার চোখে-মুখে। বলল সে ধীরে ধীরে, ‘এটা তাঁর উপরি কাঠামো। ভেতরের রূপ ভিন্ন। ভারতের ‘শিবাজী সন্তান সেনা’, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’, প্রভৃতি অত্যন্ত পরিচিত ও নির্দোষ জাতীয়তাবাদী সংগঠন। কিন্তু এগুলো আসলে পানির উপরে মাথা তোলা শৈল চূড়া। পানির নিচে লুকানো রয়েছে ‘ডুবো পাহাড়’-এর মত ‘মহাসংঘ’। মহাসাম্প্রদায়িক এই ‘মহাসংঘে’রই একজন নেতা বিবি মাধব। তিনি আন্দামান ‘মহাসংঘ’কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেই আমার বিশ্বাস।’ থামল আহমদ মুসা।
সুরূপা সিংহালরা কোন কথা বলল না। তাদের সকলের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। বিস্ময়ে তাদের যেন বাকরোধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসাই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘ডুবো পাহাড় এই মহাসংঘই ভারতের সকল সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিত-া এবং দাঙ্গার জন্য দায়ী। ধর্মের কারণে ভারত ভাগও হলেও ভাগ হওয়া অন্য দুই অংশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-ফাসাদ নেই। সেখানেও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের আন্দোলন আছে। কিন্তু সেটা গোপন নয়, গণতান্ত্রিক। সেখানে অবশ্য সন্ত্রাস আশ্রয়ী অগণতান্ত্রিক একটা ধর্ম আন্দোলন মাথা তুলেছিল, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও সেখানকার সরকারের কঠোর অবস্থান ও জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করায় ঐ আন্দোলন পানার মত ভেসে গেছে। কিন্তু ভারতে তা হতে পারছে না।’
‘কেন? ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার নিশ্চয় মহাসংঘটির কর্মকা-কে সমর্থন করে না। সেজন্যেই ওটা প্রকাশ্য পাহাড় নয়, গোপন ডুবো পাহাড়।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘প্রকাশ্যে সমর্থন করে না এটা ঠিক। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের মত কঠোর অবস্থানও নেয় না। বরং গোপন সায় আছে এটাই প্রমাণ হয়। যেমন, বাবরী মসজিদ ধ্বংস করল ‘শিবাজী সন্তান সেনা’রা নানা নামের ব্যানারে। তদানিন্তন নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস এতে প্রকাশ্যে অংশ নেয়নি বটে, কিন্তু বাধা দেয়নি, প্রতিরোধ করেনি। বাবরী মসজিদ রক্ষায় এগিয়ে যায়নি সরকারের পুলিশ ও সৈন্যরা। নিরবে দাঁড়িয়ে সবকিছু যেন উপভোগ করেছে।’ থামল আহমদ মুসা।
সুরূপা সিংহালদের মুখ ম্লান হয়ে গেছে। কথা বলল না সঙ্গে সঙ্গেই। একটু সময় নিয়ে ডাক্তার সোহনী বলল, ‘হতাশার কথা আপনি শোনালেন।’
‘হতাশ হবার কিছু নেই। ভারতে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। ডুবো পাহাড় রূপী মহাসংঘের বিরুদ্ধে এই গণতন্ত্রই ভারতবাসীদের জন্যে রক্ষাকবচ, যদি গণতন্ত্রকে সত্যিকার গণতন্ত্র হিসেবে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাই, আপনার কথা সত্য হোক। কিন্তু আন্দামান মহাসংঘের তৈরি সংকট থেকে উদ্ধার হবে কিভাবে, যেখানে গভর্নর নিজে জড়িত হয়ে পড়েছেন?’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘এই সংকট উত্তরণের চেষ্টাই আমরা করছি। দোয়া করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে উঠে দাঁড়াল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘আপনার শরীরের দূর্বলতা কাটতে কিন্তু আরও একটু সময় লাগবে। এখনও আপনার বাইরে বেরোনো নিষেধ।’
‘ও, আপনাকে বলা হয়নি, আজ সকালেই তো উনি বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হয়েছিলেন। একটা টেলিফোনের অপেক্ষা করতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত তিনি বেরুতে পারেননি।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
সুরূপার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আমার এক পুরানো বন্ধু আটক আছেন। তার খোঁজেই একটু বেরোনো দরকার। সম্ভবত তার বাসার টেলিফোন খারাপ। খবর দিয়েও কোন সাড়া পাইনি।’
‘কিন্তু আপনি জানেন, আপনার চলাচল নিরাপদ নয়।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আমি জানি বোন। ওদের চেষ্টা হল, কারফিউ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমার চলাফেরা অসম্ভব করে তুলে ওদের লক্ষ্য অর্জন করা। অন্যদিকে আমার কাজ হল ওদের সতর্কতার সব আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়ে আমার লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। আমার চুপ করে বসে থাকার অর্থ হল, লক্ষ্য অর্জনে তাদের সাহায্য করা। আমার কি করা উচিত বলুন আপনারা।’
‘আমরা জানি আহমদ মুসা বসে থাকবার পাত্র নন। বিপদের ঘনঘটা তার খুব পরিচিত সাথী। কিন্তু আমার কৌতুহল আপনি এই মুহূর্তে বাইরে গিয়ে কি করবেন?’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘কিছুই করার না থাকলে, কোন পথই খুঁজে না পেলে কাজ হবে ওদের হাতে ধরা দেয়া। ধরা দিয়ে ওদের কাছে পৌছে পথ বের করে নেয়া। কিন্তু …..।
আহমদ মুসার কথা সামনে এগোতে পারলো না। বাধা দিয়ে কথা বলে উঠল সুরূপা সিংহাল। বলল, ‘এমন আত্মঘাতী কাজ করার চিন্তাও করেন?’ বিস্ময় ও উদ্বেগ তার কণ্ঠে। সাজনা ও ডাক্তার সোহনীরও মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘নিরুপায় অবস্থায় এমন কাজ করতে হয়েছে। তবে এখন এমন কিছু করার প্রয়োজন নেই। চলার জন্যে আমার সামনে পথ খোলা। আপনারা কেউ সাহায্য করলে, বিশেষ করে তিনি যদি একজন ডাক্তার হন, তাহলে একটা অভিযান এখনি শুরু হতে পারে।’
ডাক্তার সোহনীসহ ওদের তিনজনের চোখেই বিস্ময় ও কৌতুহল। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সুরূপা সিংহাল বলে উঠল, ‘আমাদের মধ্যে ডাক্তার তো একজনই আছে। কি বলবেন সোহনী আপা?’
‘হ্যাঁ, প্রস্তাবটা বিস্ময়ের এবং রোমাঞ্চকর। আমি বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা, একজন ডাক্তার আপনাকে কি বিশেষ সহায়তা করতে পারেন?’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘কথা আমি সিরিয়াসলি বলেছি ডাক্তার সোহনী। হাজী আবদুল আলী আব্দুল্লাহ জেলে, তার স্ত্রীর সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার। কিছু বিষয় তার কাছ থেকে জানা দরকার। কিন্তু তার বাড়ি ও টেলিফোন দুয়ের উপরই নজরদারী চলছে। তাঁর মোবাইলও মনিটর করা হচ্ছে। গোয়েন্দা ও পুলিশের নজর এড়িয়ে তাঁর বাড়িতে কারও যাওয়া সম্ভব নয়, এমনকি আত্মীয়-স্বজনদেরও যেতে দেয়া হচ্ছে না খবর পাচার হতে পারে এই আশংকায়। এই অবস্থায় একজন ডাক্তারই তাঁর বাড়িতে যেতে পারেন। তার সাথে থাকবে শিখ ড্রাইভার………।’
কথা বলতে বলতেই আহমদ মুসা সামনের ‘টি’ টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিল এবং ‘স্যরি’ বলে খেতে শুরু করল।
গ্লাস টেবিলে রাখতেই সাজনা সিংহাল বলল, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম ডাক্তার সোহনী না হয় হলেন ডাক্তার, আপনি কি তাহলে ড্রাইভার? ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন কোথায়? তারপর পোশাক?’
আহমদ মুসা সাথে করে আনা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে সবার সামনে রাখল। শিখ সাজার মত পাগড়ী, পোশাক, দাড়ী, এমনকি গোঁফও বেরিয়ে এল তার ব্যাগ থেকে।
সাজনা সিংহাল ছোঁ মেরে ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে নিল। একটু নজর বুলিয়েই বলল, ‘তাহলে স্যার, আপনি ড্রাইভার শরন সিং।’
‘তাহলে দেখছি, আপনি পরিকল্পনা তৈরি করেই এসেছেন। কিন্তু ডাক্তার এভাবে পেয়ে যাবেন, এটা ঠিক করেছিলেন কিভাবে?’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আমার পরিকল্পনায় ডাক্তার ছিল না। এই মাত্র এ বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে ডাক্তার সোহনীকে দেখে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডাক্তার সোহনীকে না পেলে পোর্ট ব্লেয়ারে এসে ট্যাক্সির ব্যবস্থা কিভাবে করতেন?’
‘একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে আটকে রেখে তার ট্যাক্সি ব্যবহার করতাম। নিরাপত্তার জন্যে ট্যাক্সির নাম্বার পাল্টে অকেজো, পরিত্যক্ত একটা ট্যাক্সির নাম্বার ব্যবহার করতাম। সে নাম্বারও আগে থেকেই জোগাড় করা আছে।’ আহমদ মুসা থামল।
কিন্তু ওদের কারও মুখে কোন কথা নেই।
সবার বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। এতদিনের শোনা আহমদ মুসাকে তারা চোখের সামনে দেখছে। তার কাজ করার ধরন, তার কৌশল সব তারা নিজের চোখে দেখছে, খোদ আহমদ মুসার কাছেই শুনছে। এই বাস্তবতা স্বপ্নের চেয়েও বড় স্বপ্ন মনে হচ্ছে তাদের কাছে।
নিরবতা ভাঙল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘আমি রাজি জনাব। আমি আপনার কোন কাজে লাগলে, নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করব।’
‘ওয়েলকাম ডাক্তার সোহনী। আমার কাজ দ্রুত ও সহজ করে দিলেন। আমি মনে করি চিন্তার কিছু নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি তো বিনা কলেই যাচ্ছি। এটা যদি পুলিশ-গোয়েন্দারা জানে এবং বলে যে কল নেই যাচ্ছি কেন?’ ডাক্তার সোহনী বলল।
‘বলবেন, রুটিন চেকিং, প্রতিমাসেই হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চমৎকার জবাব। রুটিন চেকিং বলাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। ধন্যবাদ আপনাকে।’ ডাক্তার সোহনী বলল।

আরও তিন ঘণ্টা পর। পড়ন্ত বেলা।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top