৪২. ডুবো পাহাড়

চ্যাপ্টার

বিবি মাধবের খাটের পাশে ‘কিট ক্যাবিনেটে’র উপরে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল।
বালিশে আধা-শোয়া বিবি মাধবের চোখটা সবে ধরে এসেছিল।
মোবাইলের রিংটোন তার সে ঘুমের জাল ছিড়ে ফেলল। লাফ দিয়ে উঠে বসল। মোবাইলটি হাতে নিয়ে বলল, ‘হোল্ড অন।’
বলে সে দ্রুত খাট থেকে নামল এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
গভর্নর বিবি মাধবের স্ত্রী পাশেই শুয়ে ছিল। তার চোখ দুটি ছিল বোজা। বিবি মাধব যখন মোবাইল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সে চোখ খুলল। দ্রুত উঠে বসে খাট থেকে নেমে এল সেও। বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে সে স্বামীর পিছু নিল।
বিবি মাধবের স্ত্রীর চোখে-মুখে, কৌতুহল দুই-ই। তার স্বামী বিবি মাধব সারারাত ঘুমায়নি। আধা ঘণ্টা আগে বেড রুমে এসেছে, কিন্তু বেডে আসেনি। ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে এবং ঘড়ি দেখছে বার বার। মিনিট পাঁচেক আগে বেডে এসে সে আধা-শোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। মিসেস বিবি মাধবও ঘুমাতে পারেনি।
সে চোখ বুজে শুয়ে থেকে উদ্বেগের সাথে স্বামীর অস্থির অবস্থা অবলোকন করছে। তার মনে নানা প্রশ্ন, নানা চিন্তা। বড় কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়। কি সেটা? তাদের মেয়ে সুষমা রাওয়ের কিছু ঘটেছে কি? সুষমা রাওয়ের কথা মনে হতেই উদ্বেগ বেড়ে যায় মিসেস বিবি মাধবের। এই তো কয়েকদিন আগেও তার স্বামী নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তার সাথে বলতো, ‘তাদের মেয়ে শীঘ্রই মুক্ত হবে। তার কোন ক্ষতি হয়নি।’ কিন্তু গত কয়েখ দিন থেকে এই নিশ্চয়তার কথা তার স্বামী বলছে না। সুষমা রাওয়ের কথা উঠলেই, নানাভাবে সে তার কথা এড়িয়ে যায়। তার খারাপ কিছু ঘটেনি তো? অবশ্য কয়দিন থেকে তাদের মেয়ে সুরূপা সিংহাল টেলিফোনে তাকে সান্ত¦না দিচ্ছে যে, সুষমা রাওয়ের মত নিষ্পাপ-নির্দোষ মেয়ের কোন ক্ষতি ঈশ্বর করবেন না। সে যেমন গিয়েছিল, তেমনি আপনার কোলে ফিরে আসবে। কিন্তু মন মানছে কই?’
মিসেস বিবি মাধব স্বামীর পিছু নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
গভর্নল বিবি মাধব ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রবেশ করল ষ্টাডিতে।
এক হাতে মোবাইল ছিল। অন্য হাতটা দিয়ে নব ঘুরিয়ে ঠেলে দরজার পুরোটাই খুলে দিল। শেষ প্রান্তে খোলা দরজা ধরে রাখার জন্যে ছিল একটা চুম্বক। সেই চুম্বকে দরজা খট করে আটকে গেল।
দরজা পুরো খোলা রইল। গভর্নর বিবি মাধব দ্রুত গিয়ে বসল ষ্টাডিরুমের একটা চেয়ারে।
বিবি মাধব মনোযোগ দিল মোবাইলের দিকে। কথা বলা শুরু করল সে।
মিসেস বিবি মাধব খোলা দরজার ওপাশে দরজার চৌকাঠ ঘেঁষে দাঁড়াল। উৎকর্ণ হল মোবাইলের কথা শোনার জন্য।
তার স্বামী বিবি মাধবই তখন কথা বলছিল।
‘কি বলছ জেনারেল স্বামীজী নিহত? কখন কিভাবে ঘটনা ঘটল? তোমরা হাজী আবদুল্লাহকে নিয়ে বন্দীখানা থেকে বেরুচ্ছ, এটা তো জেনারেল স্বামীজী আমাকে জানালেন।’ থামল বিবি মাধব। কণ্ঠ তার উত্তেজিত।
ওপার থেকে কি যেন বলল তা শোনার পর গভর্নর বিবি মাধব আবার বলল, ‘এটা কি করে সম্ভব? আজ সন্ধ্যায় সিবিআই আন্দামানে এসে পৌছেছে। কিভাবে তাদের পক্ষে এমন অভিযান চালানো সম্ভব? তারা এই বন্দীখানার খোঁজ নিল কখন, খোঁজ পেল কখন?’ থামল গভর্নর বিবি মাধব।
অল্প কিছু শোনার পর বলল, ‘থাম, শোন, সুষমা রাওকে সিবিআই উদ্ধার করেনি। করলে তারা সুষমাকে আমার বাড়িতেই নিয়ে আসত। সুষমা রাওকে যে আমরাই কিডন্যাপের নাট করে আটক করেছি শাহ আলমগীরকে কথা বলতে বাধ্য করার জন্য, এটা আহমদ মুসা জানতেও পারে, আন্দাজও করতে পারে। আমি নিশ্চিত, আহমদ মুসাই সুষমা রাওকে আমাদের বন্দীখানা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে, সিবিআই নয়।’
থামল গভর্নর বিবি মাধব। ওপারের কথা শুনছে সে।
খোলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মিসেস বিবি মাধবও শুনছে গভর্নর বিবি মাধবের সব কথা। সুষমা রাওয়ের কথা শুনে তার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে গেল। গলা ফেটে একটা চিৎকার তার বেরিয়ে আসছিল। মুখে হাত চেপে ধরে অনেক কষ্টে সে ভেতর থেকে ঝড়ের মত বেরিয়ে আসা কষ্ট-যন্ত্রণার বিস্ফোরণ আটকে দেয়। শেষ পর্যন্ত সে শুনতে চায় সুষমা রাও সম্পর্কে।
ওপারের কথা শোনার পর গভর্নর বিবি মাধব আবার কথা বলা শুরু করল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় বড় কিছু ঘটে গেছে। আমি শুটু এটুকু জানতে পেরেছি, সিবিআই সর্বভারতীয় একটা তদন্তে গোপনে আন্দামানে আসছে। গোপনেই তারা তাদের মত করে তদন্তে গোপনে আন্দামানে আসছে। গোপনেই তারা তাদের মত করে তদন্ত করবে। এখন এই ঘটনা প্রমান করছে, সিবিআই হাজী আবদুল্লাহ, আহমদ শাহ আলমগীরদের ব্যাপারে তদন্তের জন্যেই আন্দামানে এসেছে। খুব ক্ষতি হল হাজী আবদুল্লাহ ওদের হাতে চলে যাওয়ায়। সে আমাদের অনেক কিছুই জানতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে। সুরক্ষা ও সতর্কতামূলক এত আয়োজনের পরও সুষমা ও হাজী আবদুল্লাহকে আটকে রাখা গেল না!’
কথা থেমে গেল গভর্নর বিবি মাধবের। সে সোজা হয়ে বসেছে। তার মুখম-ল শক্ত। দুচোখে হিং¯্রতা ঠিকরে পড়ছে।
মোবাইলে আবার কথা বলা শুরু করল সে। বলল, ‘শোন আহমদ শাহ আলমগীরকে আর সময় দেয়া যাবে না। যা ইচ্ছা তাই কর, কিন্তু তার কাছ থেকে কথা আদায় করতেই হবে। আমিও যাচ্ছি সেখানে। তাকে হাতছাড়া করা যাবে না। সে রকম পরিস্থিতি হলে তাকে হত্যা করতে হবে।’
বলে একটু থামল বিবি মাধব। চেয়ারে একটু হেলান দিল। বলল আবার, ‘এ দিকের কাজ সব বন্ধ। এখন রাস-ঘাঁটিকে রক্ষার ব্যবস্থা কর সবাই। পুলিশ, আর্মি ছাড়া যেই, ওদিকে যাবার চেষ্টা করুক,তাকে হত্যা করতে হবে। উইক এন্ডের গোটা দুদিন আমি ওখানে থাক। ওকে, বাই।’
কথা শেষ করেই সে স্থির বসে থাকল চেয়ারে। সে তাকিয়ে আছে সামনের টেবিলটার দিকে। কিন্তু চোখে কোন দৃষ্টি নেই। আত্মস্থ সে। ভাবছে সে। আহমদ মুসা এক বিরাট ‘শনি’ তাদের জন্যে। সে আন্দামানে পা দেবার পর থেকেই তাদের দুর্ভাগ্যের শুরু। তাদের ‘মহাসংঘে’র ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে কে ব্রিফ করল? এর পিছনেও কি আহমদ মুসার হাত আছে? কিন্তু কিভাবে? কেন্দ্রীয় সরকারে তার তো কোন পরিচিতি থাকার কথা নয়! তাহলে কথা লাগানোর কাজ কে করল? হঠাৎ কেন্দ্রীয় সরকারই বা এত কঠোর হয়ে উঠল কেন? কেন্দ্রীয় সরকারের সিবিআই-এ, পুলিশে, সেনাবাহিনীতে ‘মহাসংঘে’র শক্তিশালী লবী আছে। কিন্তু সব লবিকেই নিস্ক্রিয় দেখা যাচ্ছে। শুধু সিবিআই-এর লবী থেকে এটুকু জানানো হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী এই অপারেশনের তত্ত্বাবধান করছেন। তার বাছাই করা সিবিআই সদস্য তিনি নিজে ব্রিফ করে আন্দামানে পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে কারো কিছু করার নেই। মহাসংঘের জন্য এটা ভয়াবহ এক বিপর্যয়।
গভর্নর বিবি মাধবের কথা শেষ হলে মিসেস বিবি মাধব ফিরে চলল তার বেড রুমের দিকে। কিন্তু আসার সময় তার পায়ে যতটুকু শক্তি ছিল, সেই শক্তি এখন আর নেই। পিতা হয়ে নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করিয়েছে আহমদ শাহ আলমগীরকে কথা বলতে বাধ্য করার জন্যে! এখন তো দেখা যাচ্ছে, আহমদ শাহ আলমগীরকে তারাই কিডন্যাপ করেছে। কেন কিডন্যাপ করেছে? সুষমাকে সে ভালোবাসে এ অপরাধে নিশ্চয় নয়। কারণ, সুষমাকে গিনিপিগ বানিয়ে যে কথা আদায় করতে চেয়েছিল আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে, সেটাই আসল। সেই আসল ব্যাপারটি কি, যার জন্যে নিজের মেয়েকে গিনিপিগে পরিণত করেছিল? ক্ষোভ, দুঃখ ও লজ্জায় মিসেস বিবি মাধবের বুক দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তার মনের কোণে একটাই আশার আলো, আহমদ মুসা সুষমাকে উদ্ধার করেছে। আর যাই হোক, আহমদ মুসা একজন ভালো মানুষ এবং আহমদ শাহ আলমগীরের পক্ষের মানুষ। তার কাছে সুষমা সম্মান ও মর্যাদার সাথে থাকবে। হঠাৎ মিসেস বিবি মাধবের মনে পড়ল সুরূপা সিংহালের কথা। ‘সুষমা যে অবস্থায় আপনার কাছ থেকে গিয়েছিল, সে অবস্থায় আপনার কাছে ফিরে আসবে’- সুরূপা এই আশ্বাস তাকে দিয়েছিল কেন? তাহলে সে কি কিছু জানে? আহমদ মুসা সুস্মিতা বালাজীর কাছে ছিল কিছুদিন, এ কথা সুষমাই তাকে বলেছিল। আর সুস্মিতা বালাজীর সাথে গোটা পরিবারের মধ্যে একমাত্র সুরূপা সিংহালেরই নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তাহলে সেই সূত্রেই কিছু কি জানতে পেরেছে সে? তার মনের কোণের আশার প্রদীপটা আরও উজ্জ¦লতর হল। সে বেডে এসে শুয়ে পড়ল। চাদর টেনে নিয়ে মুড়ি দিল।
মনে আশার দিকটা শক্তিশালী হবার সাথে সাথে সাহস হল মেয়ের মুখ সামনে নিয়ে আসার। সদানন্দ মেয়ের নিষ্পাপ মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই দুচোখ বেয়ে নামল অশ্রুর ঢল। কোথায় আছে? কিভাবে আছে তার মেয়ে? এখন নিশ্চয় ঘুমুচ্ছে। চোখ মুছে উঠে বসল মিসেস বিবি মাধব। তার পাশের টিপয় থেকে মোবাইল নিয়ে তার ষ্টাডিতে চলে গেল সে।
মোবাইল করল সুরূপা সিংহালকে।
সুরূপা সিংহাল শুয়েছিল, কিন্তু ঘুমায়নি। তার স্বামীও ঘুমায়নি। আহমদ মুসা রাত ১২টার দিকে বেরিয়ে গেছে। তারপর তারা শুয়েছে বটে, কিন্তু তাদের ঘুম আসেনি। একজন মানুষ অন্যের স্বার্থে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে বেরিয়ে গেল, সে লড়াইয়ের পরিণতি না জেনে তারা ঘুমাবে কি করে। প্রতিমুহূর্তে তারা আহমদ মুসার টেলিফোনের অপেক্ষা করছে।
মোবাইল বেজে উঠতেই সুরূপা সিংহাল পাশ থেকে মোবাইল তুলে নিয়ে উঠে বসল।
‘হ্যালো।’ লাইন ওপেন করে বলল সুরূপা সিংহাল।
‘মা সুরূপা, আমি তোমার খালা, সুষমার মা। কেমন আছ মা? ঘুম ভাঙালাম মা? স্যরি।’
‘খবর ভালো তো খালাম্মা? আমরা জেগেই ছিলাম।’
‘খবর ভালো নয় মা। বুকটা হালকা করার জন্যে তোমাকে টেলিফোন করেছি। আমার মেয়ের যদি আরও কিছু খোঁজ পাই সে জন্যেই।’
‘বলুন, খালাম্মা। আরও খারাপ কিছু ঘটেনি তো?’
‘আরও খারাপ কি ঘটবে মা? জানো, আমার সুষমাকে তার পিতাই কিডন্যাপ করিয়েছিল তাকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্যে।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মিসেস বিবি মাধব।
উদ্বেগ ফুটে উঠল সুরূপা সিংহালের চোখে-মুখে। এ গোপন খবরটা খালাম্মা জানলে পরিবারে আরও কিছু ঘটেও যেতে পারে। সে বিষয়টাকে হালকা করার জন্যে বলল, ‘আপনি শান্ত হোন খালাম্মা। কথাটা সত্য কিনা? কার কাছ থেকে শুনেছেন?’
‘তোমার খালু সাহেবের মুখ থেকে শুনেছি। এই অল্পক্ষণ আগে একজনের সাথে টেলিফোনে কথা বলার সময় এই কথাগুলো বলেছেন?’
‘এই এত রাতে কার সাথে তিনি এ নিয়ে আলাপ করবেন খালাম্মা।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘হ্যাঁ তাই তো। কি যেন এক বড় ঘটনা ঘটেছে সুরূপা। কোন এক জেনারেল স্বামীজী নাকি আজ রাতে নিহত হয়েছেন। হাজী আবদুল্লাহকে কারা যেন উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। আমার সুষমাকে এই হাজী আবদুল্লাহর মত করেই তোমার খালু সাহেবরা আটকে রেখেছিল জানলাম। আরও…..।’
মিসেস বিবি মাধবের কথার মাঝখানেই সুরূপা সিংহাল বলে উঠল, ‘হাজী আবদুল্লাহ উদ্ধার হয়েছেন?’ সুরূপার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আনন্দে। তার আনন্দের কারণ, হাজী আবদুল্লাহ উদ্ধার হওয়া আহমদ মুসার অভিযান সফল হওয়ার প্রমাণ।
‘হাজী আবদুল্লাহকে চেন?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস বিবি মাধব।
‘চিনি না। শুনেছি যে, আহমদ শাহ আলমগীরের আত্মীয় তিনি।’
‘তাই হবে। সে কারণেই হয়তো তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। টেলিফোনে তোমার খালু সাহেব আহমদ শাহ আলমগীরের ব্যাপারেও অনেক কথা বলেছে।’
‘কি কথা বলেছে খালাম্মা?’ জিজ্ঞেস করল সুরূপা সিংহাল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘বলেছেন, আহমদ শাহ আলমগীরকে আর সময় দেয়া যাবে না। এই মুহূর্তে তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে। কথা আদায় করতে না পারলেও তাকে হত্যা করতে হবে। যেন হাজী আবদুল্লাহর মত কিছু না ঘটে, সে জন্যেই বোধ হয় এই চিন্তা তাদের। আরও একটা কথা, তোমার খালু সাহেব আজই সেখানে যাচ্ছেন।’ বলল মিসেস বিবি মাধব।
‘খুব খারাপ খবর খালাম্মা। সুষমা খুবই দুঃখ পাবে। ঈশ্বর এটা সত্য না করুন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘এটা তুমি বুঝেছ মা, কিন্তু মেয়ের বাপ হয়েও তোমার খালু সাহেব এ কথা বোঝার অবস্থায় নেই। থাকলে শুধু আহমদ শাহ আলমগীরের জীবন ধ্বংস করা নয়, নিজের মেয়ের জীবন নিজের হাতে বিপন্ন করার উদ্যোগ নিতে পারতেন না। আহমদ মুসাকে পেলে অনেক ধন্যবাদ দিতাম। তিনি আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন।’
মুহূর্তের জন্যে থামল। থেমেই আবার বলল, ‘মা, আমার সুষমার আর কোন খবর জানাতে পার?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না সুরূপা সিংহাল। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘সে ভালো আছে খালাম্মা। আমি একটু দেখি খালাম্মা, কালকে আপনাকে আরও খবর দিতে পারি কিনা।’
‘ধন্যবাদ মা, ঈশ্বর তোমার ভালো করুন। এখন রাখলাম টেলিফোন।’
ওপার থেকে লাইন কেটে গেল।
মোবাইলের কল লাইন অফ করে দিল সুরূপা সিংহালও।
মোবাইল রাখতেই দরজায় নক করার শব্দ হল।
সুরূপার স্বামীও উঠে বসেছিল। সে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজায় নক করেছে সাজনা সিংহাল। তার পাশে দাঁড়ানো সুষমা রাও।
দরজা খুলে যেতেই সাজনা সিংহাল বলল, ‘নিশ্চয় স্যার এসেছেন।’
সুরূপা সিংহাল ও তার স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
সবাই যখন দোতলার ড্রইং হয়ে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে আসছিল, তখন আহমদ মুসা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করেছে।
সিঁড়ির মুখে সবাই স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।
সবার সন্ধানী দৃষ্টি আহমদ মুসার দেহের দিকে। আহমদ মুসা ঠিক আছে কিনা, এটাই তাদের দেখার বিষয়। কিন্তু তার এলোমেলো চুল ও ধুলি ধুসরিত পোশাক ছাড়া দেহে আর কোন অস্বাভাবিকতা নেই।
‘ভাই সাহেব, আসুন বসুন।’ বলে সোফার দিকে এগোল সুরুপা সিংহাল।
আহমদ মুসা বসল। বসল সবাই।
‘আমি দুঃখিত, আপনারা সকলেই এভাবে জেগে আছেন। সত্যি, আমি আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি।’ বসেই বলল আহমদ মুসা।
‘ভাই সাহেব, আপনি মানুষের জন্যে অশেষ কষ্ট করছেন, মানুষের জন্যে জীবন দিতেও এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরাও কিছু কষ্ট করতে শিখি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মধ্যেও কিছু সৃষ্টি হোক, তা কি আপনি চাইবেন না?’ শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলল সুরূপা সিংহাল।
চোখ বুজল আহমদ মুসা। তার মুখম-লে আবেগের একটা স্ফুরণ। সঙ্গে সঙ্গেই আবার চোখ খুলল। বলল, ‘আপনি খুব বড় একটা কথা বলেছেন বোন। আমিসহ সব মানুষের কাছে আমি এটাই চাই, আপনাদের ক্ষেত্রে চাইব না কেন! বোন, আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, আপনাদের মত ভালো মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছিল।’
‘না ভাই সাহেব, কথাটা উল্টো। সৌভাগ্য আমাদের। একটি অতি ভালো মানুষকে সামনে দেখে আমরা ভালো হবার চেষ্টা করছি। সুরূপা এই যে মানুষের জন্যে কষ্ট করার কথা বলল, মানুষকে ভালোবাসার কথা বলল, এমন কথা সে কোন দিন বলেনি।’ আহমদ মুসা থামতেই বলল সুরূপা সিংহালের স্বামী।
‘ভাইয়া, দুলাভাই যে কথা বলেছেন, সেটা আমাদের সকলের কথা। কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক ভাইয়া, আমরা উদগ্রীব আপনার অভিযানের খবর এবং হাজী আবদুল্লাহ চাচার অবস্থা জানার জন্যে।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল সুষমা রাও।
‘আলহামদুলিল্লাহ। হাজী সাহেব মুক্ত হয়েছেন, অভিযান সফল হয়েছে বোন’। আহমদ মুসা বলল।
‘আর জেনারেল স্বামীজী নিহত হয়েছেন।’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বলে উঠল সুরূপা সিংহাল।
আহমদ মুসা চমকে উঠল। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। বলল, ‘কি জেনারেল স্বামীজী মারা গেছেন? কিন্তু আমি তো তাকে বন্দী করে সিবিআই-এর কর্নেল সুরেন্দ্রের গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম। আপনি এই খবর কি করে জানলেন বোন?’
‘আমার খালাম্মা সুষমার মা আমাকে এই তো কয়েক মিনিট আগে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি এ খবর আমাকে দিয়েছেন। হাজী আবদুল্লাহ উদ্ধার হয়েছেন, সে কথাও তিনি বলেছেন। তিনি খালু সাহেবের টেলিফোনের আলাপ আড়ি পেতে শুনতে গিয়ে এসব খবর জেনেছেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আম্মা টেলিফোন করেছিলেন? এই সময়ে? এই খবর জানাতে নিশ্চয় নয়। কোন খারাপ খবর আছে আপা?’ সুষমা রাও বলল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘ঠিক সুষমা, এ খবর দেবার জন্যে নয়। কিছু খারাপ খবর আছে। তোমার পিতা যে তোমাকে কিডন্যাপ করিয়েছিলেন এবং তোমাকে যে গিনিপিগ সাজাতে চেয়েছিলেন আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্যে, এটা তিনি জানতে পেরেছেন। খুবই আপসেট হয়ে পড়েছেন তিনি। টেলিফোনেই তিনি অনেক কেঁদেছেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘কি করে জানতে পারলেন? আব্বার ঐ টেলিফোন আলোচনা থেকে?’ কম্পিত কণ্ঠ সুষমা রাওয়ের। মুষড়ে পড়া চেহারা। চোখ দুটি তার ছলছল করছে।
‘হ্যাঁ সুষমা। তোমার আব্বার ঐ টেলিফোন কথোপকথন থেকে আরও খারাপ খবর তিনি দিয়েছেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘আরও খারাপ খবর? কি সেটা?’ অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠ সুষমা রাওয়ের।
‘আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায় করা যাক বা না যাক অবিলম্বে তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তোমার আব্বা। তিনি নিজে আজ ভোরে যাচ্ছেন সেখানে। হাজী আবদুল্লাহর মত আহমদ শাহ আলমগীর হাতছাড়া হয়ে সব তথ্য ফাঁস হয়ে যাক, তারা হাতে-নাতে ধরা পড়–ক, এ তারা চাচ্ছেন না।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
সুষমা রাও কোন কথা বলতে পারলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সুরূপা সিংহালের শেষ কথা শুনে সোজা হয়ে বসেছে আহমদ মুসা। তার চোখ দুটি চঞ্চল। একটা প্রবল উত্তেজনা তার মুখে এসে আছড়ে পড়েছে। বলল আহমদ মুসা সুরূপা সিংহালকে লক্ষ্য করে, ‘সুষমার মা কি এই কিছুক্ষণ আগে জেনারেল স্বামীজীর মৃত্যু এবং হাজী আবদুল্লাহর উদ্ধারের খবর দেয়ার সময় এ খবর দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, ভাই সাহেব।’
আহমদ মুসা কিছু বলল না। মুখ নিচু করে মুহূর্ত কাল ভাবল। তারপর পকেট থেকে বের করল মোবাইল। হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে মোবাইলের বোতাম টিপতে শুরু করল কল করার জন্য।
মোবাইল সে মুখের সামনে তুলে নিল।
ওপার থেকে সাড়া পেয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘গুড মর্নিং, কর্নেল সুরেন্দ্র বলছেন? আমি বিভেন বার্গম্যান।’
‘ইয়েস মিঃ বার্গম্যান। আপনি বাড়ি থেকে কথা বলছেন?’
‘ইয়েস কর্নেল, আমি বাসা থেকে বলছি। আপনারা সবাই ঠিক-ঠাক পৌছেছেন?’
‘হ্যাঁ। আমাদের বন্দীখানা অভিযানও ভালো হয়েছে। মূল্যবান কিছু দলিল প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। কিন্তু একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে।’
কর্নেল সুরেন্দ্র একটু থামতেই সেই ফাঁকে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমি সে কথাই বলতে চাচ্ছি। আমি তো জেনারেল স্বামীজীকে অক্ষত অবস্থায় আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে মারা গেল কি করে?’
‘মেজর পুরন্দরের সাথে গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমি ও মেজর সুরজিত হেঁটে যাচ্ছিলাম বন্দীখানার দিকে। মাঝ বরাবর যাওয়ার পর বন্দীখানার গাড়ি বারান্দায় হৈ চৈ শুনতে পাই। আমরা দৌড় দেই। গিয়ে দেখি, জেনারেল স্বামীজী পটাসিয়াম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পটাসিয়াম সায়নাইড তার জামার বোতামের সাথে ছিল।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘হ্যাঁ কর্নেল সুরেন্দ্র, জেনারেল স্বামীজীর পূর্বসুরী মহাগুরু শংকরাচার্য শিরোমনিও ধরা পড়ার মুখে পটাসিয়াম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যাক, আপনাদের বিরাট ক্ষতি হল। ‘মহাসংঘে’র সবকিছু তার কাছ থেকে জানা যেত।’ আহমদ মুসা বলল। থাক মি. বার্গম্যান এখন বলুন, কি চিন্তা করছেন আপনি?’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘ঘটনা দ্রুত সামনে গড়াচ্ছে মি. কর্নেল। হাজী আবদুল্লাহ আপনাদের হাতে পড়ার মত এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্যে তারা রাস দ্বীপে বন্দী করে রাখা আহমদ শাহ আলমগীরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্ভবত মোগল বংশীয় কোন গুরুতর তথ্য তার কাছ থেকে তারা আদায় করতে চায়। আজ তারা যে তথ্যের জন্যে শেষ চেষ্টা করবে। তারপর পেল বা না পেল উভয় অবস্থাতেই তাকে হত্যা করবে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ইতিমধ্যেই মহাসংঘের নেতারা রাস দ্বীপে যাত্রা করেছে বা যাত্রা করছে বলে জানতে পেরেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গুরুতর ইনফরমেশন মি. বার্গম্যান। কি করার কথা ভাবছেন? সময় তো হাতে নেই।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘এখনি আমাদের রাস দ্বীপে মুভ করা দরকার। আপনাদের কি চিন্তা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু কোথায় যাব, কি করব, এ নিয়ে তো আমাদের ভাবার কোন সময় নেই। আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘অবশ্যই মি. কর্নেল। আমি মনে করছি, আপনারা আপনাদের ওয়েতে রাস দ্বীপে যাত্রা করুন। আমি আমার নিজস্ব ব্যবস্থায় রাস দ্বীপে যাত্রা করছি। আপনারা ১নং ন্যাঙাল জেটিতে গিয়ে নামুন। এই ঘাঁটিটি রাস দ্বীপের ধ্বংসপ্রাপ্ত ফার্ষ্ট সার্কেলের পাশে। আমাদের টার্গেট ফার্ষ্ট সার্কেল। বিস্তারিত আমি রাস দ্বীপে পৌছে বলব। ১নং ন্যাঙাল ডকইয়ার্ডে নামার পর সিবিআই-এর পোশাক আপনাদের পরিত্যাগ করতে হবে এবং আপনাদের সবাইকে পুরাতত্ব কর্মীর পোশাক পরতে হবে। আপনারা রাস দ্বীপে ঐ ন্যাঙাল ডকইয়ার্ডেই অপেক্ষা করবেন। আমি রাস দ্বীপে পৌছেই আপনার সাথে যোগাযোগ করব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মিঃ বার্গম্যান। একটা পথ আমাদের সামনে তৈরি হল। আপনি বললেন, ফার্ষ্ট সার্কেল আমাদের টার্গেট। কিন্তু সার্কেলটা তো বিরাট এবং গোটাটাই তো বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত।’ থামলো কর্নেল সুরেন্দ্র।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘মি. কর্নেল সুরেন্দ্র! অন্ধকারের জীবরা বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত স্থানের অলি-গলিই বেশি পছন্দ করে। আর ফার্ষ্ট সার্কেল একেবারে পরিত্যক্তও নয়। ওখানে একটা পুরাতত্ব অফিস আছে।’
‘ধন্যবাদ মি. বার্গম্যান, বুঝেছি। দ্বীপে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আছে, আপনি আমাদের সাথে গেলেই পারতেন।’
‘তা হতো। কিন্তু পরিকল্পনাটা একটু ভিন্ন। আপনারা টার্গেটে প্রবেশ করবেন উত্তর দিক থেকে, আর আমি প্রবেশ করব দক্ষিণ দিক থেকে। সে কারণে আলাদা পথে যাওয়াই ভালো। তবে কিছু যদি করতে চান, তাহলে সিবিআই-এর আইডেনটিটি কার্ড আমাকে দিতে পারেন। কিন্তু দিতে চাইলেও এই সময়ে দিতে পারবেন না।’
কর্নেল সুরেন্দ্র হেসে উঠল। বলল, ‘মনে করুন আপনার কার্ড হয়ে গেছে। এখন বলুন কার্ড আপনি কোথায় ডেলিভারি নেবেন। এখন বাজে সাড়ে ৪টা, আমরা রাস দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব ঠিক ভোর সাড়ে ৫টায়।’
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘তাহলে আপনাদের ভিডিও ক্যামেরা কার সাথে ছিল- বন্দুকের নলের সাথে, মাথার ক্যাপের সাথে, না গাড়ির হেডলাইটের সাথে?’
হাসল কর্নেল সুরেন্দ্রও। বলল, ‘সত্যি মি. বিভেন বার্গম্যান, আপনার অসাধারন মেধা। আমাদের ষ্টেনগান, রিভলবার এবং গাড়ির হেডলাইট সবকিছুর সাথেই ভিডিও ক্যামেরা আছে। মাথার ক্যাপেও ভিডিও ক্যামেরা থাকে। কিন্তু সেটা আমরা রাখি অপারেশনের সময় নয়, সাধারণ চলাফেরার সময়। ভিডিও থেকে আপনার সুন্দর ছবি করে নেব। আমাদের এখানকার হেডকোয়ার্টারে আইডেনটিটি কার্ড তৈরির অটো সিস্টেম রয়েছে।’
‘কিন্তু একজন কর্নেল হয়ে ‘সিবিআই কর্নেলে’র এ ধরনের আইডেনটিটি কার্ড আপনি দিতে পারেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আবারও হাসল কর্নেল। বলল, ‘আপনার নাম ছাড়া অন্য কোন পরিচয় আমাকে জানানো হয়নি। কিন্তু এটুকু বলে দেয়া হয়েছে, আপনার নির্দেশ বা ইচ্ছা পূরণের জন্যে যে কোন আইন আমি ভাঙতে পারি।’
‘ধন্যবাদ কর্নেল। আপনার হেডকোয়র্টারের সামনে যে পোষ্টাল বক্স রয়েছে, তাতে আইডেনটিটি কার্ডটা ফেলে রাখবেন। সকাল ৭টার আগে পোষ্টাল বক্স ক্লিয়ার হয় না। তার আগেই কোন এক সময় আমি ওটা সংগ্রহ করে নেব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. বার্গম্যান। খুব নিরাপদ প্রস্তাব। আমি সেটাই করব।’
‘অল রাইট। তাহলে কথা শেষ।’
‘ইয়েস, বাই।’
‘বাই।’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
মোবাইলটা পাশে সোফার উপর রেখে আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাক একটা সমস্যার বোধ হয় সহজ সমাধান হয়ে গেল। সিবিআই আইডেনটিটি কার্ড পেলে কারও বোট আর হাইজ্যাক করতে হবে না। কার্ড দেখিয়ে যে কোন বোট দখলে নিতে পারব। আর রাস দ্বীপে ঢুকতেও কোন সমস্যা হবে না।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করল। কিন্তু কারও মুখে কোন কথা নেই। সুষমা রাওয়ের কান্না থেমে গেছে। তার মুখে আশা-নিরাশার ছাপ। তার অসহায় চোখের নির্ভরতার এক দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। আর সুরূপা সিংহাল, তার স্বামী এবং সাজনা সিংহালের বিস্ময়-বেদনার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। এইমাত্র সারা রাতের এক অভিযান থেকে ফিরল, আবার এখনি যাত্রা করবে রাস দ্বীপে এক মহাঅভিযানে। তারা কি বলবে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। টেলিফোনে আহমদ মুসার কথায় সব তারা জেনেছে। এখনি যাত্রা করা দরকার, সেটা তারা বুঝেছে। কিন্তু একজন লোক এই অবস্থায় কি করে যাত্রা করতে পারে, এ প্রশ্নও তাদের মনে জাগছে। আহমদ মুসার এই গমনকে স্বাগত জানানো কষ্টকর, আবার ‘না’ বলাও অসম্ভব।
অবশেষে নিরবতা ভাঙল সুরূপা সিংহাল, ‘ভাই সাহেব, এটাই তো আপনার জীবন!’ কাঁপল সুরূপা সিংহালের কণ্ঠ। আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল তার গলার স্বর।
গম্ভীর হল আহমদ মুসা। বলল, ‘শুধু আমার নয়, মানুষের জীবনই এটা। কে কখন কি করবে, কোথায় যাবে ইত্যাদি সবই একজন ঠিক করেন, যিনি সবার মালিক, সবকিছুর মালিক। আমরা শুধু বাছাই করি ভালো কাজে আমি সন্তুষ্ট, না খারাপ কাজে সন্তুষ্ট। মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্ররা রাস দ্বীপে যাচ্ছেন আহমদ শাহ আলমগীরকে হত্যার জন্যে, আর আমি এবং কর্নেল সুরেন্দ্ররা যাচ্ছি তাকে বাঁচাবার জন্য। ঘটনা ঘটবে, সে ঘটনায় আমরা হাজির থাকব, কিন্তু কে কি রোল প্লে করব সেটা বাছাইয়ের ব্যাপারটাই হল আসল।’
‘এই বাছাইয়ের কাজটা সেই একজনের অমোঘ বিধানের অধীন নয় কি?’ প্রশ্ন করল সুরূপা সিংহালের স্বামী।
‘না এই বাছাইয়ের এখতিয়ার মানুষের নিজস্ব। এই বাছাইটাই হল পরীক্ষা। এই পরীক্ষা দেয়ার জন্যে দুনিয়ায় মানুষের আগমন। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছি এটা দেখার জন্যে যে, কারা সুন্দর ও মহৎ জীবনচর্চা বেছে নেয়।’
সুরূপা সিংহাল দুহাত জোড় করে অবনত মাথায় ¯্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রনাম করে বলল, ‘মহান জগৎ প্রভুর কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তার পরীক্ষার এই জীবন নাটক মাঝে মাঝে এমন মর্মান্তিক হয়ে ওঠে কেন? এই সময় এই মুহূর্তে আপনার রাস দ্বীপে অভিযানকে মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে, নিষেধ করতেও ভয় পাচ্ছি।’ ভারী কান্নাভেজা কণ্ঠ সুরূপা সিংহালের।
‘সন্তানকে মানুষ শাস্তি দিতে অবশ্যই কষ্ট পায়, কিন্তু এই কষ্ট স্বীকার করে নেয়া হয় বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যে। এখানেও সেই বাছাইয়ের প্রশ্ন। কষ্টের চেয়ে সব সময় মঙ্গলকে বড় করে দেখতে হয় বোন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মানুষের কষ্ট, মানুষের অশ্রুর কি কোন মূল্য নেই। তাহলে জগৎ প্রভু এটা দিলেন কেন?’ সুরূপা সিংহাল বলল।
‘কষ্ট ও অশ্রু আসে মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি ভালোবাসা থেকে। এই ভালোবাসা আল্লাহর একটি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, সৃষ্টি প্রকৃতির একটি প্রাণসত্তা। মানুষের জীবনকে মহত্ত করছে এই ভালোবাসা। পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব মানবকে একটা গ্রন্থিতে আবদ্ধ রেখেছে এই ভালোবাসাই। এই ভালোবাসা না থাকলে আমি আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় পেতাম না, আমার মত একজন অজানা, অচেনা মানুষের কল্যাণ চিন্তা তাহলে আপনাদের কষ্ট দিত না, অশ্রুসিক্ত করতো না।’ আহমদ মুসা থামল।
কথা বলল না। সুরূপা সিংহাল। কারও মুখেই কোন কথা নেই। সকলের মুগ্ধ, সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার প্রতি নিবদ্ধ। কথা বলতে যাচ্ছিল সাজনা সিংহাল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকাল। বলল, ‘পৌনে পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নেই। পাঁচটার মধ্যেই বের হবো।’ বলে আহমদ মুসা এগোল তার কক্ষের দিকে।

Top