আহমদ মুসা শিখ ড্রাইভারের পোশাক পরে ড্রইংরুমে বসে ডাক্তার সোহনীর অপেক্ষা করছে, আর গল্প করছে সুরূপাদের সাথে।
ঠিক সময়েই গাড়ি বারান্দায় প্রবেশ করল ডাক্তার সোহনীর গাড়ি।
ডাক্তার সোহনী গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল। তার হাতে ষ্টেথিসকোপ, গায়ে ডাক্তারের এপ্রন। এপ্রনে একটা বড় আকারের রেডক্রস ছাড়াও তার নিচে সবুজ কালিতে জ্বল জ্বল করছে আন্দামান সরকারি হাসপাতালের মনোগ্রাম। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে রাখা একটা বড় ডাক্তারী ব্যাগও দেখ যাচ্ছে। গাড়ির সামনের ও পেছনের স্ক্রিণেও লাল রেডক্রসের মনোগ্রাম।
গাড়ির শব্দে শিখ ড্রাইভারবেশী আহমদ মুসাসহ সুরূপা ও সাজনা বেরিয়ে এসেছিল।
আহমদ মুসাকে দেখে ডাক্তার সোহনী সানন্দে বলে উঠল, ‘চমৎকার, একদম নিখুঁত ছদ্মবেশ। আগে না জানলে আমি চিনতেই পারতাম না আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা এগিয়ে গিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে পাঞ্জাবী মেশানো হিন্দীতে ডাক্তার সোহনীকে গাড়িতে বসার জন্যে আহ্বান জানাল।
‘ধন্যবাদ’ বলে ডাক্তার সোহনী গাড়িতে গিয়ে বসল।
গাড়ির দরজা বন্ধ করে আহমদ মুসা গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুরূপা ও সাজনা। সাজনা বলল ডাক্তার সোহনীকে লক্ষ্য করে, ‘আমার হিংসা হচ্ছে আপনাকে একটা ইতিহাসের অংশ হতে দেখে।’
‘কিন্তু ইতিহাসের শুরু তোমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের সহযোগিতায়। সুতরাং তোমরাও ইতিহাসের অংশ। আসি, আসসালাম।’ বলে আহমদ মুসা গাড়িতে ষ্টার্ট দিল।
সুরূপা দুই হাত জোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়াল। বোধ হয় মা দূর্গা’র কাছে কোন প্রার্থনা করল। গাড়ি তখন বাড়ি থেকে রাস্তায় গিয়ে উঠেছে।
হঠাৎ আহমদ মুসা ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিল। তারপর গাড়ি ব্যাক করে গেটের ভেতর চলে এল। গেট থেকে একটু আড়ালে গাড়ি নিয়ে আবার ব্রেক কশল।
ডাক্তার সোহনী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার জনাব?’
‘একটা ভুল হয়েছে। দু’মিনিট দেরি হবে।’ বলে আহমদ মুসা তার ব্যাগ থেকে গাড়ির দুটি নাম্বার নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। ডাক্তার সোহনীর গাড়ির দুদিকে নাম্বার প্লেট খুলে গাড়ির ভেতরে ছুড়ে দিয়ে তার জায়গায় নতুন নাম্বার প্লেট লাগিয়ে দিল।
কাজ শেষ করে ড্রাইভিং সিটে ফিরে এল। সিটে বসে গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘ডাক্তার সোহনী সম্প্রতি কোন ডাক্তার কি বিদেশে বা ছুটি নিয়ে মূল ভুখ-ে গেছে?’
‘গেছে। কেন?’
‘বলছি। তাদের কারও একজনের নাম বলুন।’
‘ডাক্তার আশা স্যাম্যাল আমেরিকা গেছেন এবং ডাক্তার নন্দিতা পাঞ্জাবে তার বাড়ি ছুটিতে গেছেন।’
‘তাহলে ডাক্তার সোহী এখন থেকে আমাদের ফিরে আসা পর্যন্ত আপনার নাম ডাক্তার নন্দিতা। আপনি এই অভিযানে ছিলেন এ কথা যাতে কোনভাবে প্রমাণ না হয় এজন্যে।’
‘কিন্তু এতে আমি বাঁচব, কিন্তু ডাক্তার নন্দিতার তো বিপদ হবে।’
‘ডাক্তার নন্দিতার বিপদ হবে কেন? তিনি তো ছুটিতে আছেন। প্রমাণ হবে যে, ‘কেউ নকল নন্দিতা সেজেছিলেন।’
হাসল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘গাড়ির নাম্বার প্লেট বদলাবার কারণ কি?’
‘গাড়িটা যে আপনার এটা যাতে কেউ খুঁজে বের করতে না পারে, এজন্যেই এই ব্যবস্থা।’
‘আল্লাহকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তিনি নিশ্চয় আপনাকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন। আপনি এতটা আগাম চিন্তা করেন?’
‘এটা আমার কৃতিত্ব নয় মোটেই।’ গাড়ি ষ্টার্ট দিতে দিতে বলল আহমদ মুসা। গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে ছুটে চলল।
এক সময় ডাক্তার সোহনী পেছন থেকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা জনাব, সংস্কারক ও যোদ্ধা এ দুজনের মধ্যে কে বড়?’
‘দুজনেই বড়। সংস্কার জাতির পুনর্গঠনের কাজ করেন এবং যোদ্ধা জাতিকে রক্ষার জন্যে লড়াই করে। দুকাজই তাদের স্ব স্ব জায়গায় এক নাম্বার।’
‘আপনি একজন যোদ্ধা হিসেবে বলুন…………।’
আহমদ মুসা ডাক্তার সোহনীর কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘না আমি যোদ্ধা নই, যোদ্ধার দায়িত্ব অনেক বড়। আমি ছোট একজন সেবক, জাতির বিপদকালে সাহায্য করার চেষ্টা করি।’
‘এটা আপনার বিনয়। মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, বলকান, স্পেন, প্রভৃতি জায়গায় যা করেছেন, সেটা যুদ্ধের চেয়েও বড়।’
‘না, ওগুলো যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের জন্যে আনুষ্ঠানিক একটা সেন্ট্রাল অথরিটি থাকতে হয়, জনগণের কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক সমর্থন ও গ্রহণ থেকে এই অথরিটির সৃষ্টি হয়। এসব কিছুই সেখানে ছিল না, এসবের প্রয়োজনও হযনি। কারণ আমি যেটা করেছি, সেটা অন্যায় ও অন্তর্ঘাতের মোকাবিলা এবং জাতিতে তার বিপদ উত্তরণে সহযোগিতা করা। বিপদ মুক্ত হয়ে জাতি অনেক জায়গায়ই স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছে। আর দেখুন, আমি আমার এ তৎপরতায় কোন আইন ভঙ্গ করিনি, আইনের পক্ষে কাজ করেছি এবং আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকেই সামনে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি ডাক্তার সোহনী, আজ বিশ্বে মুসলমানরা যদি তাদের স্ব স্ব স্থানে আইনের শাসন রক্ষা ও গণতন্ত্র চর্চার উপর অটল থাকে এবং আল্লাহ যেমন চান তেমন ‘ভালো’ মানুষ হতে পারে, তাহলে তাদের সেই সোনালী দিনের পুনরাগমন নিশ্চিত হতে পারে।’
‘চমৎকার বলেছেন। ধন্যবাদ। কিন্তু বলুন আমাদের এই যাত্রা, আমরা যা করতে চাচ্ছি তা কি এই দেশের আইনের বিরুদ্ধে হচ্ছে না?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘না তা হচ্ছে না। এই দেশে একটা খুনি সন্ত্রাসী চক্র সরকারের অভ্যন্তরে একটা সরকার সৃষ্টি করে বেআইনিভাবে আইনকে হাতে নিয়ে নির্দোষদের উপরে যে নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছে, তারই বিরুদ্ধে আমাদের এই অভিযান। আমরা কেন, চক্রটির ষড়যন্ত্রের কথা যদি এদেশের দেশপ্রেমিক পুলিশ, গোয়েন্দারা জানত, তাহলে তাদেরও দায়িত্ব হতো এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া। আমরা বলতে গেলে তাদেরই কাজ….।’
কথা শেষ না করেই আহমদ মুসা গাড়ির ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
সামনেই একজন পুলিশ হাত তুলে আছে, আহমদ মুসার গাড়িকে দাঁড়াবার নির্দেশ দিচ্ছে।
হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহর বাড়ি এসে গেছে। সামনের মোড়টা ঘুরেই রাস্তাটা সোজা হাজী আবদুল আলী আবদুল্লার বাড়ি গিয়ে উঠেছে। এখানে এই একটিই রাস্তা। এদিক-সেদিক যাবার কোন রাস্তা নেই এবং এই রাস্তাটা হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহর বাড়ি গিয়েই শেষ হয়েছে।
পুলিশ অফিসারটি কয়েক ধাপ হেঁটে আহমদ মুসা রূপী ড্রাইভার শরন সিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। তার সাথে ছিল আরও দুজন পুলিশ। তারাও এসে দাঁড়াল পুলিশ অফিসারের পেছনে।
পুলিশ অফিসারটি কয়েক ধাপ হেঁটে আহমদ মুসারূপী ড্রাইভার শরন সিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। তার সাথে ছিল আরও দুজন পুলিশ। তারাও এসে দাঁড়াল পুলিশ অফিসারের পেছনে।
পুলিশ অফিসারটি গাড়ির জানালার দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘সিংজী আপনারা কোথায় যাচ্ছেন।’
‘হাজী আবদুল্লাহজীর বাড়িতে।’
পুলিশ অফিসার আহমদ মুসার কাছ থেকে সরে ডাক্তার সোহনীর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তার সোহনী একটা খবরের কাগজ পড়ছিল।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলার সময় ডাক্তার সোহনী মুখের সামনে থেকে কাগজটা একটু সরিয়ে নিয়েছিল। বাম দিকের চুলের কিছু অংশ ও বাম চোখের উপর দিয়ে গালের উপর পড়েছিল। মুখের ঠোঁট বরাবর ছিল খবরের কাগজের উপরের প্রান্ত। ফলে মুখের পুরোটা দেখা যাচ্ছিল না।
পুলিশ অফিসারকে তার জানালার দিকে আসতে দেখে ডাক্তার সোহনী নিজেই বলে উঠল, ‘কিছু ঘটেছে অফিসার?’
‘না, ম্যাডাম। ইমারজেন্সী চলছে তো। তাই রুটিন চেকিং হচ্ছে। হাজী সাহেবের বাড়িতে সাধারণের যাওয়াটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাজী সাহেবের বাড়ি থেকে আপনাকে ‘কল’ করা হয়েছে বুঝি?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘প্রতি মাসের রুটিন চেকিং বেগম সাহেবার।’
‘বুঝেছি।’ বলে একটু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে নোট বুক ও কলম বের করে বলল, ‘মাফ করবেন, শুধু নিয়ম রক্ষার জন্যে। ম্যাডামের নাম কি?’
‘ডাক্তার নন্দিতা। পোর্ট ব্লেয়ার গভর্নমেন্ট হাসপাতাল।’
‘ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাও সিংজী।’
আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিল। সে রিয়ার ভিউতে দেখল, গাড়ির নাম্বারও টুকে নিচ্ছে পুলিশ অফিসারটি।
‘অফিসার গাড়ির নাম্বারও লিখে নিচ্ছে ডাক্তার সোহনী।’ আহমদ মুসা বলল।
ডাক্তার সোহনী এক পলক পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ সিংজী। এখন বুঝতে পারছি গাড়ির নাম্বার ও আমার নাম বদলানো কত গুরুত্বপূর্ণ। যাক ফাঁড়াটা কেটে গেছে।’
‘কাটলেই ভালো’। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু কাটলো না।
হাজী সাহেবের বাড়ির বাউন্ডারি প্রাচীরের গেটে গাড়ি পৌছাতেই সাদা পোশাকের একজন লোক ভূতের মত উদয় হয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
গেটের সামনে এসে গাড়ি আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
লোকটি সোজা গিয়ে ডাক্তার সোহনীর জানালায় গিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তার সোহনী আগের মতই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। খবরের কাগজে তার মুখ ঢাকা।
সাদা পোশাকধারী লোকটি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মুখের সামনে থেকে কাগজটা একটু সরিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল লোকটির দিকে।
আগের মতই ডাক্তার সোহনী বাম পাশের বাম দিকের চোখ ও গাল প্রায় ঢেকে দিয়েছে।
ডাক্তার সোহনীকে তার দিকে চাইতে দেখেই সাদা পোশাকের লোকটি পকেট থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে ডাক্তার সোহনীর সামনে তুলে ধরে বলল, ‘আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোক। আমার উপর নির্দেশ আছে যে বা যারাই ভেতরে হাজী পরিবারের সাথে দেখা করতে বা কোন কাজ নিয়ে যান, তাদের সাথে থাকতে। আশা করি, আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন।’
তার কথার উত্তর না দিয়ে ডাক্তার সোহনী ডাকল আহমদ মুসাকে, ‘সিংজী।’
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা বলল, ‘ইয়েস ম্যাডাম।’
তারপর পেছন দিকে না ফিরেই আহমদ মুসা গোয়েন্দার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওয়েলকাম। আসুন স্যার। সামনে এসে বসুন।’
কথাগুলো বলছিল আহমদ মুসা আর পকেট থেকে ছোট একটা সেন্টের শিশি বের করে তার পাশের সিটের সামনে ড্যাশ বোর্ডের উপর রাখছিল।
আহমদ মুসা গোয়েন্দাকে তার পাশে এসে বসার আমন্ত্রণ জানালে ডাক্তার সোহনীর মুখ ম্লান হয়ে গেল। আহমদ মুসা যে জন্যে যাচ্ছে, সেই কাজ সে গোয়েন্দার সামনে কিভাবে করবে? তাদের মিশনটাই ব্যর্থ হয়ে গেল বোধ হয়। মনটা খারাপ হয়ে গেল ডাক্তার সোহনীর।
আহমদ মুসার আহ্বান পেয়ে গোয়েন্দা এসে গাড়ির দরজা খুলে আহমদ মুসার পাশের সিটে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ সিংজী।’
‘ওয়েলকাম স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রবেশের গেটটা বন্ধ ছিল। কিন্তু গেটম্যান গেট বক্সে বসে জানালা দিয়ে সব ব্যাপারই দেখছিল ও শুনছিল।
গোয়েন্দা লোকটি গাড়িতে উঠে বসলে গেটম্যান আর কোন কথা না বলে ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দিল।
গেটের পরেই একটা পাথুরে মসৃণ রাস্তা সোজা এগিয়ে গাড়ি বারান্দায় গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার দু’পাশ বরাবর ফুল গাছের সারি। আর রাস্তার দুদিক থেকে শুরু হয়ে বাড়িটার চারদিকের বিশাল এলাকা জুড়ে বিশাল ফলের বাগান। চারদিকের সবুজ সমুদ্রের মাথায় টিলার সাদা বাড়িটাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।
গেট থেকে গাড়ি বারান্দার দূরত্ব ২০০ গজের কম হবে না।
গাড়ি চলছে গাড়ি বারান্দার দিকে।
পথের মাঝখানে এসে আহমদ মুসা গোয়েন্দাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, ড্যাশ বোর্ডের উপরের সেন্টের শিশিটি কি আমাকে দেবেন?’
কোন কথা না বলে গোয়েন্দা লোকটি তার সামনের ড্যাশ বোর্ড থেকে সেন্টের শিশি তুলে নিল। চোখের সামনে ধরে বলল, ‘প্রিন্সেস।’ তারপর নিচের টাইটেল লাইনে দেখল, ‘অ্যা প্রডাক্ট অব প্যারিস’। পড়েই হাঁ করে বলে উঠল, ‘প্রিন্সেস ব্রান্ড। তাও আবার প্যারিসের। একবার না শুঁকে দিচ্ছি না সিংজী।’
বলেই গোয়েন্দা লোকটি শিশির ছিপি খুলে মহানন্দে নাকে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথাটি সিটের উপর ঢলে পড়ল। তার হাত থেকে শিশিটি পড়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে শিশিটা ধরে ফেলল এবং চাপ দিয়ে ছিপি লাগিয়ে দিল।
গোয়েন্দাটির দেহ গাড়ির সিটে ঢলে পড়ল।
‘কি হল? গোয়েন্দা লোকটির কি হল জনাব?’ পেছনের সটি থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ডাক্তার সোহনীর।
‘সে জ্ঞান হারিয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন? কিভাবে? শিশিতে তাহলে কি কোন হার্ড ক্লোরোফরম ছিল?’
‘জি, হ্যাঁ। ফাঁদ পেতেছিলাম। সে ফাঁদে ধরা পড়েছে সে।’
‘ও গড! এমন ঘটনার জন্যেও আপনি প্রস্তুত ছিলেন? কি করে জানলেন এই ঘটনা ঘটবে?’
‘কিছুই জানতাম না। আমার কাছে যেমন রিভলবার আছে, তেমনি এই ক্লোরোফরমও রয়েছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি মাত্র।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ক্ষেত্রে ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু গোয়েন্দা লোকটিকে এখন কি করবেন?’
‘যাবার সময় কোথাও রেখে যাবো। এখন সিটেই বসে থাকবে।’
গাড়ি বারান্দায় পৌছে আহমদ মুসা ও ডাক্তার সোহনী গাড়ি থেকে নামল। গাড়ি লক করে আহমদ মুসা দৌড় দিয়ে বারান্দায় উঠল। পেছনে পেছনে ডাক্তার সোহনী।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশের দরজাটার সামনে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘বলে তো আসা হয়নি। বেগম হাজী সাহেব দরজা খুলবেন তো?’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘বেগম সাহেবার জন্যে সংকেত আছে। তিনি বুঝবেন, অসুবিধা হবে না।’
বলে আহমদ মুসা কলিং বেলে তিন বারে এক, দুই ও তিন সংখ্যায় মোট ৬ বার চাপ দিল।
তারপর পাঁচ সেকেন্ডের মত অপেক্ষা।
কলিংবেল কথা বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম। ওয়েলকাম, বাছা। এস।’
সঙ্গে সঙ্গেই দরজার অটোলক শব্দ করে খুলে গেল।
প্রবেশ করল আহমদ মুসা এবং ডাক্তার সোহনী।
সবই চেনা আহমদ মুসার।
ভেতরে ঢুকে গেল আহমদ মুসা।
ভেতরের ফ্যামিলী ড্রইংরুমে বসেছিল বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসাদের দেখেই উঠে দাঁড়াল হাজী হাসনা বেগম আবদুল্লাহ এবং এগিয়ে এল।
আহমদ মুসাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আল্লাহর পর তোমাকেই আমি স্মরণ করছিলাম। আল্লাহর শোকর যে তোমাকে পেয়ে গেছি। তুমি এলে কেমন করে। বুঝতে পারছি তোমাকে আটকাবার জন্যেই ওরা পোর্ট ব্লেয়ারে কারফিউ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।’
একটা দম নিয়ে বেগম হাজী হাসনা ডাক্তার সোহনীকে দেখিয়ে বলল, ‘কে এ বাছা?’
‘ইনি ডাক্তার সোহনী। এর ড্রাইভার সেজে সহজেই আসা সম্ভব হয়েছে। উনি আপনাকে চেকও করবেন। তাহলে ওর আসাটাও সার্থক হবে।’
‘ধন্যবাদ মা। অবশ্যই মা আমাকে দেখবে।’
বলে বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ দুজনকে টেনে নিয়ে সোফায় বসল।
বসেই আহমদ মুসা বলল, ‘প্রথমে কাজের কথা সেরে নেই আম্মা। আপনার কোন নির্দেশ-উপদেশ আছে কিনা আগে বলুন।’
‘তোমাকে বলার সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল, হাজী সাহেবকে আটকে রাখার কথা সরকার অস্বীকার করছে। প্রথম দিকে নিচের অফিসাররা স্বীকার করলেও তারা এখন বলছে, খবরটা ভুল বুঝাবুঝির ফল ছিল। এই অস্বীকার করার কারণ খারাপ কিছু ঘটে থাকতে পারে বলে আমার ভয় হচ্ছে।’
থেমে গেল বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেছে তার কণ্ঠ।
‘ধৈর্য ধরুন আম্মা। খারাপ কিছু ঘটার পেছনে যুক্তি নেই। এমন কিছু ঘটতে পারে না।’ নরম কণ্ঠে সান্তনার সুরে বলল আহমদ মুসা।
চোখ মুছে বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ বলল, ‘তাহলে আটক রাখার কথা অস্বীকার করছে কেন?’
‘অন্য কোন কারণ থাকতে পারে। আমি এ ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না। বলুন, আর কি কথা আছে।’
‘আমি তাঁর ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের গোয়েন্দা আটক কেন্দ্রগুলোর একটা তালিকা পেয়েছি। ওটা তোমার কাজে লাগবে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার তৃতীয় কথা হল, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দেয়া তার অয়্যারলেস মোবাইল নাম্বারটা হারিয়ে গিয়েছিল। ওটা পেয়েছি। উনি তোমার সাথে কথা বলার জন্যে উদগ্রীব।’
থামল বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ এবং হাতের ছোট্ট ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কার্ড বের করে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নাম্বার এতে রয়েছে।’
‘পোর্ট ব্লেয়ারে গোয়েন্দাদের আটক কেন্দ্রগুলোর তালিকা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার হাতের কার্ড দেখনি। দেখ। ওটা আমাদের হোটেলের একটা অ্যাড্রেস কার্ড। কার্ডটা একটু পুরু। একটু চেষ্টা করলেই কার্ডের দুটি লেয়ার আলাদা হয়ে যাবে। বেরিয়ে পড়বে সুপার ফাইল ফোল্ড করা একখ- কাগজ। ঐ কাগজে টেলিফোন নাম্বারটাও পাবে এবং ঐ তালিকাও পাবে।’ বলল বেগম হাজী হাসনা আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসা কার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আম্মা।’
‘এখন বল তোমার কথা।’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
‘আমার জানার বিষয়ও আপনার কথায় পেয়ে গেছি। আমি ভেবেছিলাম হাজী সাহেব কোথায় কোন জেলে আপনি জানেন। এখন দেখছি, সরকার তাকে আটক রাখার কথাই অস্বীকার করছে। আরেকটা বিষয় ছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অয়্যারলেস টেলিফোন নাম্বার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা। সেটা তো পেয়েই গেলাম। এখন আপনার স্বাস্থ্য চেক করা বাকি।’ আহমদ মুসা বলল।
পরিচারিকা এ সময় ট্রলি ঠেলে নাস্তা নিয়ে প্রবেশ করল।
বেগম হাজী আবদুল্লাহ ট্রলিটি টেনে নিয়ে বলল, ‘এস বাছা, এস মা। আমি দশ মিনিট আগে নাস্তা করেছি। এখন তোমাদের একাই নাস্তা করতে হবে।’
নাস্তা সেরে ডাক্তার সোহনী বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহকে, ‘সত্যি মা আমি আপনার ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস এবং হার্ট পরীক্ষা করব। ব্লাডপ্রেসার ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা এখানেই করছি। হার্টের ইসিজি করব আপনাকে আপনার বেডে নিয়ে।’
পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষ হলে আহমদ মুসা বলল, বেগম হাজী আবদুল্লাহকে, ‘আম্মা এবার আমাদের উঠতে হবে। বেশি সময় থাকলে পুলিশের সন্দেহ হতে পারে।’
‘অবশ্যই যাবে বাছা। মাকে তুমি কি সান্তনা দিয়ে যাবে বল।’
‘আমার বিশ্বাস আম্মা, হাজী সাহেবকে ওরা কোন জেলে রাখেনি। গোয়েন্দাদের আটক কেন্দ্রেই তিনি বন্দী আছেন। আমি সব জায়গাতেই খুঁজবো। সুষমা রাও-ও কিডন্যাপড হয়েছে। আমার অনুমান তাকেও হাজী সাহেবের মত কোন গোয়েন্দা আটক কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে। লিষ্টটা পাওয়ায় তাকে খোঁজাও সহজ হয়ে গেল। অপেক্ষা করুন। আল্লাহর সাহায্য আমাদের বিজয়ী করবে।’
‘আমিন। আল্লাহ তোমার কথাকে সত্য করুন।’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
‘আম্মা, এখন বাড়িতে আপনার পরিচারিকা ছাড়া আর কেউ আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘নেই।’ বেগম হাজী আবদুল্লাহ বলল।
‘এখন আমাকে একটা নাটক করতে হবে মা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নাটক? কেন? কিসের নাটক?’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
‘আপনাকে ও পরিচারিকাকে ক্লোরোফরমে সংজ্ঞাহীন করে এই ড্রইং রুমে ফেলে রাখতে চাই। আর আপনার সিন্দুকের কাগজ-পত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখতে চাই এবং টাকা পয়সা গায়েব করতে চাই। সিন্দুকের……….।’
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে বেগম হাজী আবদুল্লাহ বলে উঠল, ‘কি কারণে, কেন এসব করবে?’ তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আপনাকে সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্যে। আমরা আসার সময় একজন গোয়েন্দাকে সংজ্ঞাহীন করে এখানে এসেছি। তা না হলে সেও আমাদের সাথে আসত এবং তার সামনেই আমাদের কথা-বার্তা বলতে হতো।’ থামল একটু আহমদ মুসা।
সেই ফাঁকেই বেগম হাজী আবদুল্লাহ বলল, ‘বুঝলাম। কিন্তু আমাদের উপর সন্দেহ করবে কেন?’
‘শুধু সন্দেহ প্রথম সুযোগেই তারা আপনাকে গ্রেফতার করবে।’
‘কেন? কি কারণে?’ উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
‘যখন একজন গোয়েন্দাকে সংজ্ঞাহীন করে আমরা এখানে এসেছি, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওরা বুঝবে আমরা ডাক্তার হওয়ার যে পরিচয় দিয়েছি এবং আপনাকে চেক করতে আসার যে কথ বলেছি তা ঠিক নয় এবং আপনার সাথে দেখা করার জন্যেই এই কৌশল নিয়েছিলাম। তারা সন্দেহ করবে এই যোগসাজশে আপনিও জড়িত আছেন। সুতরাং আপনার কাছ থেকে তারা জানার চেষ্টা করবে, আমরা করা। এমনকি তারা আপনাকে এই অজুহাতে গ্রেফতারও করতে পারে। এখন আমরা যদি আপনাকে বেঁধে ও সংজ্ঞাহীন করে যাই এবঙ আপনার সিন্দুক লুট করি, তাহলে আপনাকে সন্দেহ করার তাদের কোন অবকাশ থাকবে না।’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বেগম হাজী আবদুল্লাহর। বলল, ‘ঠিক বলেছ বাছা। তোমার এত বুদ্ধি! আল্লাহ তোমাকে আরও উন্নতি দিন।’
একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তোমরা বস আমি একটু আসি। শরিফাকে সব বুঝিয়ে বলি। পুলিশকে কি বলতে হবে সেটা তার ভালোভাবে বুঝা দরকার। নাস্তার এসব আয়োজনও তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে।’
বলে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
কয়েক মিনিট পরে ফিরে এল। বলল, ‘হ্যাঁ আমরা রেডি। ভল্ট মানে সিন্দুক চল খুলে দেই।’
‘না আম্মা, সিন্দুক আপনি খুলবেন না। আমি লেসার কাটার দিয়ে সিন্দুক খুলে সিন্দুক লুট করব।’
‘ঠিক আছে। লকটা নষ্ট হবে অবশ্য। সিন্দুকে কিছুই নেই। আছে মাত্র কিছু চেক বই, ব্যাংক সার্টিফিকেট, শেয়ার সার্টিফিকেট এবং জমি ও ব্যবসায়ের কিছু দলিল দস্তাবেজ। ওগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে বা নষ্ট হলে কোন ক্ষতি নেই।’
‘ঠিক আছে।’ বলে আহমদ মুসা এ্যাকশন শুরু করল। বেগম হাজী আবদুল্লাহকে তার বেডরুমে চেয়ারের সাথে বাঁধল। পরিচারিকা শরিফাকে সংজ্ঞাহীন করে বাইরের প্রবেশ দরজার কাছে ফেলে রাখল। বেগম হাজী আবদুল্লাহকে সংজ্ঞাহীন না করে বড় স্কচ টেপ তার মুখে সেঁটে মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর তার চোখের সামনে লেসার কাটার দিয়ে সিন্দুকের লক কেটে ভেতরের সব কাগজপত্র টেনে বের করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলল। তারপর ‘আম্মাজী আমরা চললাম, দোয়া করবেন’ বলে ডাক্তার সোহনীকে ডেকে নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। যেন সত্যিই সে এক দস্যুতার কাজ সম্পন্ন করল।
বাইরে বেরিয়ে এসে বাড়িতে প্রবেশের দরজাটিরও লক লেসার কাটার দিয়ে ওপেন করে রাখল।
আহমদ মুসা ও ডাক্তার সোহনী নেমে এল গাড়ি বারান্দায়। একটু দূরে বাইরের গেটের দিকে নজর পড়তেই বিস্মিত হল আহমদ মুসা। গেটটি একেবারে খোলা। তাড়াতাড়ি গাড়ির ভেতরে তাকাল আহমদ মুসা। সংজ্ঞাহীন গোয়েন্দা তার সিটে নেই। গাড়ির দরজা টান দিয়েই আহমদ মুসা বুঝল কি ঘটেছে।
ভ্রুকুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। বলল, ‘ডাক্তার সোহনী আমরা ধরা পড়ে গেছি।’
ডাক্তার সোহনী আহমদ মুসার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। সেও খারাপ কিছু আশংকা করছিল। আহমদ মুসার কথা শুনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাক্তার সোহনী বলল, ‘সংজ্ঞাহারা গোয়েন্দাটি গাড়িতে নেই দেখছি। ধরা পড়ে গেছি মানে ওরা কি আমাদের চিনে ফেলেছে?’
‘চিনে ফেলেনি। তবে জেনে ফেলেছে যে আমাদের পরিচয় ভুয়া।’
‘তাহলে?’
‘আমার মনে হয় সংজ্ঞাহীন গোয়েন্দাকে ওরা চিকিৎসার জন্যে নিয়ে গেছে। সম্ভবত সংখ্যায় দুই একজনের মত ছিল বলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেনি। কিন্তু হয় তারা এখন বাইরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, নয়তো ওরা প্রস্তুত হয়ে আসার পথে।’
উদ্বেগ-আতংকে মুখ পাংশু হয়ে গেল ডাক্তার সোহনীর। কথা বলতে পারল না।
‘স্যরি ডাক্তার সোহনী, আপনাকে আমি বিপদে ফেলেছি। কিন্তু আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে তার ব্যাগটি বের করে নিল। বলল ডাক্তার সোহনীকে লক্ষ্য করে, ‘আপনি গাড়িতে উঠে বসুন। ভয় করবেন না, ওদের চোখে ধুলা নয় ধুঁয়া নিক্ষেপ করে ঠিকই আমরা চলে যেতে পারব।’
‘আল্লাহ সাহায্য করুন।’ বলে ডাক্তার সোহনী গাড়িতে উঠে বসল।
আহমদ মুসা ছোট মার্বেলাকৃতির ছয়টি স্মোক বোম ভরল মোটা নলের পেট মোটা এক রিভলবারে।
এটা পাওয়ারফুল উৎক্ষেপক যন্ত্র। রিভলবারের মতই একাধিক্রমে ছয়বার ট্রিগার টেপা যায়। ছয় বারে ছয়টি স্মোক বোম ৫০ গজ পর্যন্ত দূরে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই দশ বর্গগজ এলাকা জুড়ে ধুঁয়ার দেয়াল সৃষ্টি করতে পারে।
স্মোক বোম রিভলবার নিজের সিটের উপর রেখে আহমদ মুসা গাড়ির খুলে রাখা নাম্বার প্লেট বের করে নিল এবং গাড়িতে লাগানো নাম্বার প্লেট খুলে সামনে পিছনে দু’দিকেই আগের নাম্বার প্লেট লাগিয়ে নিল।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে এসে বসল।
‘এখনই যে আগের নাম্বার লাগিয়ে ফেললেন? ওরা তো দেখে ফেলবে।’ ডাক্তার সোহনী বলল।
‘এখন আর ওরা গাড়ির নাম্বার দেখবে না। গাড়ি সমেত আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। আগের নাম্বারটা এখন লাগালাম, কারণ ওরা ইতিপূর্বে গাড়িতে যে নাম্বার লাগানো ছিল তা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, অথবা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিতে পারে। সুতরাং পুলিশের চোখ থাকবে গাড়ির পূর্বের নাম্বারের দিকে, এই নাম্বার লাগানোর ফলে আমরা নিরাপদে চলে যেতে পারব।’
‘সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি আপনাকে এমন দুরদৃষ্টি দিয়েছেন।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা মাথার পাগড়ি ও দাড়ি খুলে ফেলল। শুধু গোঁফটাই থেকে গেল।
পাশের জানালা পুরোটাই খুলে ফেলল।
বাম হাত ষ্টিয়ারিং-এ রেখে ডান হাতে তুলে নিল স্মোক বোমের রিভলবারটি।
ষ্টার্টার অন করার আগে আহমদ মুসা বলল, ‘ডাক্তার সোহনী আপনি সিটে শুয়ে পড়–ন এবং সিটের প্রান্ত ভালোভাবে ধরে রাখুন।’
আহমদ মুসা সামনে তাকিয়ে হিসেব করে নিল। বাগানের মাঝ বরাবর গিয়ে গেটের ওপাশে প্রথম স্মোক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবে। তারপর রাস্তার প্রথম বাঁকে আরও দুটি। পরে দরকার মনে করলে সিদ্ধান্ত নেবে।
গাড়ি ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা। যতটা সম্ভব গতি বাড়াতে লাগল।
গাড়ি ষ্টার্টের শব্দ গেটের ওপাশে পৌছে গেছে। গাড়ি বাগানের মাঝ বরাবর আসতেই চার জন পুলিশ তাদের সাবমেশিনগান বাগিয়ে গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সেই পুলিশ অফিসার যার সাথে, আহমদ মুসারা কথা বলেছিল।
দেখার পর পলকমাত্র দেরি করেনি আহমদ মুসা। ট্রিগার টিপেছে স্মোক বোম রিভলবারের। ওরাও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসার ট্রিগার টেপা। ওরাও তাদের হাতের সাবমেশিনগান তুলছিল। কিন্তু সেই সময়েই তাদের মাঝখানে গিয়ে বিস্ফোরিত হল স্মোক বোম।
স্মোক বোমা বিস্ফোরণের পর পরই আহমদ মুসার গাড়ি তীব্র বেগে এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
গেটে পৌছেই আহমদ মুসা তিরিশ চল্লিশ গজের ব্যবধানে আরও একটি স্মোক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাল।
আহমদ মুসার গাড়ি গেট থেকে তিরিশ চল্লিশ গজ দূরে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের জায়গায় পৌছাতেই পেছন থেকে বৃষ্টির মত গুলী ছুটে এল তার গাড়ির দিকে।
প্রথম স্মোক বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ চারজন নিশ্চয় আতংকিত হয়ে পড়েছিল। বোমাটি যে নির্দোষ স্মোক বোমা এটা বুঝতে তাদের একটু সময় লেগেছিল। তারা বুঝে উঠে আক্রমণের জন্যে তৈরি হওয়া পর্যন্ত আহমদ মুসা গেট থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে চলে এসেছিল।
ধুয়ার মধ্যে থেকে লক্ষ্যহীনভাবে ছোড়া পুলিশের গুলীর দু’একটি পেছনের গার্ডারে আঘাত করলেও গাড়ির কোন ক্ষতি হয়নি।
সামনে আর কোন পুলিশ দেখতে পেল না আহমদ মুসা। তাই স্মোক বোমার ব্যবহার আর করল না।
‘আলহামদুলিল্লাহ। মাত্র চারজন পুলিশ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ডাক্তার সোহনী। মনে হয় আরও দু’একজন পুলিশ ছিল তারা সংজ্ঞাহীন গোয়েন্দাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এখনো নতুন পুলিশ এসে পৌছায়নি। মনে হয় সংজ্ঞাহীন গোয়েন্দাকে তারা বেশি আগে খুঁজে পায়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সামনে আরও পুলিশ থাকতে পারে।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘থাকলে ক্ষতি নেই। সেই নাম্বারের গাড়ি, সেই শিখ ড্রাইভার এবং সেই ডাক্তার কাউকেই তারা পাবে না। আপনি এখনও ডাক্তারের এপ্রন খোলেননি। খুলে ফেলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
সত্যিই কোথাও আর পুলিশ তাদের আটকালো না।
ডাক্তার সোহনীর মুখে স্বস্তি ও হাসি ফিরে এসেছে। সহজ হয়ে বসে বলল, ‘আমি কৌতুহল বশতই আপনার অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা লাভ আজ আমার হল। আপনার সম্পর্কে শত কথা শুনেছিলাম। কিন্তু আজ আপনার সঙ্গী হয়ে দেখলাম, কোন বর্ণনাই আপনাকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।’
প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওল্ড সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর’, ‘ওল্ড পুলিশ হেডকোয়ার্টার’, ‘শয়তানের সীমান্ত’, ‘পূর্বানী’, ‘আসু আশ্রম’ এবং ‘কালী বাড়ি’-এসব কি কোথায় আপনি জানেন?’
নামগুলো শুনেই হাসতে লাগল ডাক্তার সোহনী। বলল, ‘নামগুলো আপনি কোথায় পেলেন? এক জায়গায় কিভাবে নামগুলোকে একত্র করলেন?’
‘জায়গাগুলো আমার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে সাহায্য করুন প্লিজ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্থানগুলোর সবই একদিক দিয়ে ঐতিহাসিক। স্থানগুলোর স্থাপনাসমূহ পরিত্যক্ত ঘোষিত। সরকারের পূর্ত বিভাগ এ স্থানগুলোর দায়িত্বে রয়েছে।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘স্থানগুলো সম্পর্কে আমি আরও বিস্তারিত জানতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারব। বেশি সাহায্য পাবেন পোর্ট ব্লেয়ার মিউজিয়াম থেকে।’ বলল ডাক্তার সোহনী।
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি ব্যাপার, আপনি চিনতে পারেননি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তো!’ বলল দ্রুত কণ্ঠে ডাক্তার সোহনী।
‘স্যরি। মনটা অন্যদিকে ছিল। আশে পাশে তাকানো হয়নি।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে এল। গেট দিয়ে প্রবেশ করল ভেতরে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
৪২. ডুবো পাহাড়

Tags