৪২. ডুবো পাহাড়

চ্যাপ্টার

পোর্ট ব্লেয়র জুড়ে নিñিদ্র নজরদারী চলছে, নগরে যারা প্রবেশ করছে এবং যারা বের হচ্ছে তাদের প্রত্যেককেই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া নগরীর প্রতিটি বাড়ির বাসিন্দাদের পরিচয় যাচাই করা হচ্ছে। নগরীর উপকূল, সবগুলোর সব এন্ট্রি পয়েন্ট, বিমান বন্দরকে সার্বক্ষণিক নজরদারীর আওতায় আনা হয়েছে।
এই ব্যবস্থা প্রশাসনিক নির্দেশে করা হয়েছে। জনগণের অবগতির জন্যে বলা হয়েছে, এটা রুটিন সতর্কতা ও চেকআপের মহড়া। জনগণের উদ্বেগের কোন কারণ নেই। তারা সব সময়ের স্বাভাবিক চলাফেরা, কাজ-কর্ম করে যাবেন।
নজরদারী ও চেকআপের কাজে পুলিশের পাশাপাশি রয়েছে ব্যাজ পরা রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক। আসলে এরা স্বেচ্ছাসেবক নয়, এরা সকলে ‘মহাসংঘ’ ও শিবাজী সন্তান সেনা (সেসশি) এর সদস্য। নজরদারী ও চেকআপে এরাই আসল, পুলিশ সাইনবোর্ড মাত্র।
মহাসংঘ ও ‘সেসশি’ আহমদ মুসা আন্দামানে এসেছে এটা জেনে ফেরার পর মহাআলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে পর্দার অন্তরালে। মূল ভূখ-ের মুম্বাই ও উত্তর প্রদেশে যথাক্রমে ‘সেসশি’ ও মহাসংঘ-এর হেডকোয়ার্টার এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে আন্দামানে আহমদ মুসার আসার কথা শুনে। ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙা, আসামের নেলী, বোম্বাই; গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধনের মত সংখ্যালঘু নির্মূলের রাজনীতি যারা করে, তারা ক্রোধে ফেটে পড়েছে। সেই সাথে মজলুম উদ্ধারে, অন্যায়ের প্রতিকারে আহমদ মুসার অনন্য রেকর্ডের কথা তারা জানে বলে তারা আতংকও বোধ করছে। মনে করছে, আইসবার্গের নিচে জাতিগত হিংসা, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার যে ডুবো পাহাড় তারা লুকিয়ে রেখেছে, সেটাকে আহমদ মুসা দিনের আলোতে এনে ফেলতে পারে। এই ভয়, আতংক, ক্রোধ থেকে এবং মহাগুরু শংকরাচার্য ও স্বামী স্বরূপানন্দের মত লোকদের মহাজ্বালা সামনে রেখে তারা আন্দামানের গোপন সাম্প্রদায়িক আন্দোলনের নেতা মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্রের উদ্দেশ্যে নির্দেশ জারি করেছে, আহমদ মুসা আর একদিনও যাতে জীবিত থাকতে না পারে। আন্দামানে এটাই তাদের এখন একমাত্র কাজ।
পোর্ট ব্লেয়ার ছাড়াও উত্তরে ‘নর্থ প্যাসেজ আইল্যান্ড’ থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের দক্ষিণে ডান কান প্যাসেজ পর্যন্ত মধ্য ও দক্ষিণ আন্দামানের দুই উপকূলকেও সার্বক্ষণিক সতর্ক পাহারার মধ্যে রাখা হয়েছে।

ভাইপার দ্বীপের সামরিক অবজারভেটরি।
একটা নাইট ভিশন দূরবিনে চোখ রেখে বসেছিল জয়রাম রাঠোর। তার দুরবিনের চোখ ঘুরছে নর্থ প্যাসেজ দ্বীপের দক্ষিণে ‘কী’ আইল্যান্ড ও রিসেজ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যবর্তী গোটা উপকূল রেখায়।
জয়রাম রাঠোর ‘মহাসংঘ’-এর একজন অপারেশন প্রধান। গভর্নরের বিশেষ নির্দেশে বিশেষ জুরী অবস্থায় সামরিক অবজারভেটরিতে সামরিক লোকদের সাথে সেও কাজ করছে। সামরিক লোকরা ধরে নিয়েছে জয়রাম রাঠোর কেন্দ্রীয় বিভাগের কেউ হবেন।
তার সহযোগী হিসেবে তার পাশেই বসেছিল এখানকার সেনা ইউনিটের একজন ক্যাপ্টেন। সে এক সময় জয়রাম রাঠোরকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আমরা যান সন্ধান করছি, সে অনুপ্রবেশকারী লোকটি কে?’
‘একজন ইন্টারন্যাশনাল টেররিষ্ট।’ বলল জয়রাম রাঠোর।
‘নাম জানা গেছে?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না জয়রাম রাঠোর। দ্বিধাগ্রস্ত ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে। অবশেষে নাম সে বলল না। বলল, ‘টেররিষ্টদের নামের ঠিক নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা তেমন নাম নেয়। যেই হোক, সে একজন মুসলিম টেররিষ্ট।’
‘একটা কথা স্যার, মুসলমানরা হঠাৎ এমন টেররিষ্ট হয়ে উঠল কেন?’
‘তার মানে মুসলমানরা আগে টেররিষ্ট ছিল না বলতে চাও?’
‘আমি বলতে চাই না স্যার। ইতিহাস বলে। সে কথাই আমি বলছি।’
‘ইতিহাস কি বলে, শুনি।’
‘স্যার গত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পর দু’টি আন্দোলনকে আমরা খুব বেগবান হতে দেখি। একটা হল কম্যুনিজমের বিস্তার, অন্যটি মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের পর মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে, তেমনি কম্যুনিজমের বিস্তারও এ সময় সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৭০ সালের মধ্যে প্রায় সবগুলো মুসলিম দেশ স্বাধীন হয়ে পড়ে। এই দুই সমান্তরাল আন্দোলনের মধ্যে কম্যুনিজমের রাজ্য গঠন ও রাজ্য বিস্তার ছিল হিংসা, সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র নির্ভর। আর মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল জনগণের শক্তি, সুবিচার ও যুক্তিনির্ভর। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানরা সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কিন্তু এরপরও তারা কম্যুনিষ্টদের মত ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়নি। ভারতের কথাই ধরুন স্যার। এখানে মুসলমানদের আযাদী আন্দোলনের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এতটাই নিয়মতান্ত্রিক ছিলেন যে, জীবনে একবারও তাঁকে জেলে যেতে হয়নি। তারপর দেখুন স্যার, বঙ্গভঙ্গ রহিত করার জন্য আমরা হিন্দুরা বিক্ষুব্ধ হয়ে আবেগের বশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন করেছি, বোমা মেরেছি, কিন্তু মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে এবং বঙ্গভঙ্গ রহিত করার বিপক্ষে কোন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন করেনি, বোমাও হাতে তুলে নেয়নি।’
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ক্যাপ্টেন শশাংক সিংঘাল।
জয়রাম রাঠোরের মুখে-চোখে একটা বিরক্তি ভাব ফুটে উঠেছিল। ক্যাপ্টেন শশাংক সিংঘাল থামতেই জয়রাম রাঠোর বলল, ‘তুমি বোধ হয় ইতিহাসের ছাত্র ছিলে?’
‘জি স্যার।’
‘কোথায় তুমি লেখাপড়া করেছ, আলীগড়ে?’
‘না স্যার। অনার্স, মাষ্টার্স দু’টোই আমি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছি।’
‘ভালো করেছ। তবে তুমি সামরিক বাহিনীতে না এসে বিনোদাভাবে কিংবা রামমোহনের মত কোন সর্বোদয় নেতা হওয়া উচিত ছিল তোমার। থাক, তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর চাও?’
‘জি স্যার।’
‘তত্ব কথা শুনতে নাকি নগ্ন সত্যটা জানতে চাও?’
‘সত্য জানতে চাই স্যার।’
‘মুসলমানরা সীমাহীন সম্পদের মালিক এক বদ্ধ বোকার মত। ওদের কাছে এমন এক পরশ পাথর আছে যা গোটা দুনিয়াকে ওদের জন্যে সোনায় পরিণত করে দিতে পারে। কিন্তু এ কথাটা ঐ বোকারা জানে না। ওরা এটা জানা এবং ব্যবহার করার আগেই ওদের হাত-পা ভেঙে ওদের চলৎশক্তি রহিত করা প্রয়োজন। এই কাজই এখন চলছে।’ বলল জয়রাম রাঠোর।
‘বুঝলাম না স্যার। মুসলমানদের টেররিষ্ট হওয়া এবং তাদের হাত-পা ভেঙে চলৎশক্তিহীন করা- এ দুয়ের মধ্যে কি সম্পর্ক?’
‘কল্পনা করো ভোটের কোন এক প্রার্থীর কথা। ভীষণ জনপ্রিয়। মানুষ তাকে দারুণ ভালোবাসে। সে সকলের ভোট পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সময় যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে, সে কোটি টাকা আত্মসাতকারী, কোটি টাকার কালোবাজারী। তখন তার অবস্থা কি দাঁড়ায়? হাত-পা ভাঙ্গা চলৎশক্তিহীন মানুষের মত হয়ে যায় না? প্রকৃত অর্থে মানুষের কাছে তার মৃত্যু ঘটে যায় কি না? মুসলমানরা টেররিষ্ট বলে চিহ্নিত হবার পর তাদের এই অবস্থাই হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল, মুসলমানরা হঠাৎ এভাবে টেররিষ্ট হল কি করে?’
‘কারণটা তো বলেছি। উদাহরণও দিয়েছি। এ থেকেই বুঝে নেয়া উচিত ছিল। আরও খোলাসা শুনতে চাও?’
‘জি স্যার।’
‘মুসলমানদের টেররিষ্ট বানানো হয়েছে। পুঁজি করা হয়েছে তাদের অসন্তোষকে। এ লক্ষ্যেই তাদের অসন্তোষকে বাড়ানো হয়েছে, কমানোর বা তাদের সমস্যা সমাধানের কোন চেষ্টা করা হয়নি। মুসলমানদের দু’টি সমস্যা ছিল খুব বড়। একটা ফিলিস্তিন, অন্যটা কাশ্মীর। জাতিসংঘের মাধ্যমে বহু আগেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তা করতে দেয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও রাশিয়া দুই পরাশক্তি দুই পক্ষ নিয়ে সমস্যা দুটিকে ঝুলিয়ে রাখে প্রায় ৪০ বছর। ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ইসরাইল ও আরবদের মধ্যে এবং কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তিনটি করে বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। জীবন ও সম্পদের সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এই অবস্থায় জাতিসংঘের ব্যর্থতার পটভুমিতেই নব্বই দশকের আগে ও এর শুরু থেকে ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা স্বাধীনতার জন্যে গেরিলা লড়াই শুরু করে। গোটা নব্বই এর দশক ধরে এ লড়াই চলে। পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার পতন ঘটার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমী শক্তির একক নেতৃত্বে এই সমস্যার সমাধান হলো না। এই অব্যাহত অবিচার, মুসলিম দেশসমূহে নিজেদের আদর্শ ও অধিকারের চেতনা অবলম্বন করে মুসলিম যুব শক্তির উত্থান, ইসলামের নামে ইরানে বিপ্লব এবং আফগানিস্তানে মুসলিম সমর শক্তির বিজয় শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, গোটা দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে নতুন জাগরণের জোয়ার সৃষ্টি করে। এই জাগরণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও তার মিত্ররা এক নতুন শক্তির উত্থান প্রত্যক্ষ করল। নতুন শক্তির এই উত্থানকে অংকুরেই শেষ করে দেবার জন্যে একটা বড় অজুহাত বা উপলক্ষের প্রয়োজন ছিল। ‘সন্ত্রাস’কে তারা এই উপলক্ষ হিসেবে বাছাই করল। আফগানিস্তানে গেরিলা যুদ্ধে বিজয়ী, কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনে গেরিলাযুদ্ধরত এবং যুগ-যুগান্তের অবিচার পীড়িত মারমুখী হয়ে ওঠা মুসলমানদের উপর ‘সন্ত্রাসী’ হওয়ার দোষ চাপানো খুব সহজ ছিল। মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসের দায় চাপানোর জন্যেই নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সন্ত্রাসী কর্মকা- অভিনীত হল। যেহেতু তাকফিরুল হিজরা, আল-জিহাদ ও হিজবুল্লাহর মত ক্ষুদ্র কয়েকটা গোষ্ঠী ছাড়া মুসলিম বিশ্বের সব ইসলামী দলই গণতান্ত্রিক। তারা সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্র পছন্দ করে না। তাই আল-কায়েদা নামে একটা ইসলামী দল ও লাদেন নামে একটা ইসলামী ব্যক্তিত্বকে খাড়া করা হয় এবং টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায় এদের ঘাড়ে চাপানো হল। তাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে আফগানিস্তান ধ্বংস করা হল। শুরু হয়ে গেল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মুসলমানদের বানানো হল এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ, অন্য কথায় সন্ত্রাসী।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল জয়রাম রাঠোর।
‘ধন্যবাদ স্যার। বুঝতে পেরেছি সব। কিন্তু স্যার আমরা যার সন্ধান করছি, সে কি সত্যিই টেররিষ্ট, না বানিয়ে বলা হচ্ছে?’ বলল ক্যাপ্টেন শশাংক সিংঘাল।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না জয়রাম রাঠোর। তার মুখে একটা অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি সত্য জানতে চাও, না যা বলা উচিত তা জানতে চাও?’
‘সত্য জানতে চাই স্যার।’
‘সত্য জানতে চাইলে এখন উত্তর পাবে না। এখন আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। যাকে আমরা বধ করব, তার সম্পর্কে ভালো চিন্তা বা ভালো কথার এখন সময় নয়।’
‘তাহলে অর্থ দাঁড়ায় স্যার, সে ভালো কেউ?’
জয়রাম রাঠোর চোখ পাকিয়ে ক্যাপ্টেন শশাংকের কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিল, সে সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে চেয়েই এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে সোজা হয়ে চেয়ারে বসল। বলল, ‘স্যার, স্যার……..।’
ওপারের কথা শুনল। শুনে শশব্যস্তে বলল, ‘স্যার, নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। আমাদের চোখ এড়িয়ে সে পোর্ট ব্লেয়ারে প্রবেশ করতে পারবে না। পশ্চিম উপকূলের স্পাইক আইল্যান্ড থেকে আমাদের লোক চোখ রেখেছে নর্থ প্যাসেজ সাউথ প্যাসেজসহ পশ্চিম উপকূলের দিকে। স্যার, পশ্চিম উপকূলে বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে আছে হারতাবাদের পশ্চিম উপকূলে আমাদের আরেকজন লোক। নেইল আইল্যান্ডে আমরা আরেকজনকে রেখেছি পূর্ব উপকূলে বাড়তি সতর্কতার জন্য। সাউথ আন্দামানের দু’পাশের গোটা উপকূলই আমাদের নজরে স্যার।’
থামল জয়রাম রাঠোর। ওপারের কথা শুনল। উত্তরে বলল, ‘না স্যার ভুল হবে না। তার চেহারা আমাদের মুখস্থ। চিনতে পারলেই গুলী, কোন কথা নয় স্যার।’
কথা শেষ করে ওপারের কথা শুনে ধন্যবাদ দিয়ে মোবাইল রেখে দিল জয়রাম রাঠোর।
‘কার টেলিফোন ছিল স্যার?’ উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন শশাংক সিংঘাল।
‘কার আবার…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল জয়রাম রাঠোর। নিজেকে সামলে নিয়েই বলে উঠল, ‘উনি ছিলেন গভর্নর বিবি মাধব।’
বলেই দূরবিনের দিকে আবার মনোযোগ দিল। বলল ক্যাপ্টেন শশাংককে লক্ষ্য করে, ‘দেখ দুরবিনে ভালোভাবে চোখ রাখ।’
তার কথা শেষ হবার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিয়ে তাকাল স্ক্রীনের দিকে। দেখল স্ক্রীনে বিপিন বাজওয়ার নাম ভেসে উঠেছে।
বিপিন বাজওয়া নেইল আইল্যান্ডের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে নজর রাখছে উপকূলসহ পোর্ট ব্লেয়ারের সামনের আন্দামান সাগরের উপর।
জয়রাম খুশি হল মোবাইল স্ক্রীনে বাজওয়ার নাম দেখে। বলল, ‘কি খবর বাজওয়া?’
‘বড় ঘটনা ঘটে গেছে।’ বলল বাজওয়া। উত্তেজিত তার কণ্ঠস্বর।
‘কি ঘটনা?’
‘এক বিস্ফোরণে আহমদ মুসার বোট ধ্বংস হয়েছে। আহমদ মুসাও।’
‘কোথায়? কি ঘটনা?’
‘আমাদের নেইল আইল্যান্ড থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে। বলা যায় ৯৩ ডিগ্রী অক্ষাংশের উপর আমাদের বোট দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় আহমদ মুসার বোটে বিস্ফোরণ ঘটেছে।’
‘ঘটনাটা কি?’
‘আহমদ মুসার বোটটি যখন পশ্চিম উপকূলের স্পাইক আইল্যান্ডের উত্তর দিয়ে ‘নর্থ প্যাসেজে’ প্রবেশ করেছিল পূর্ব উপকূলে আসার জন্যে তখন স্পাইক আইল্যান্ডের আমাদের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র তা দেখতে পায। বোটের আলো নিভানো ছিল, ইঞ্জিন ছিল সাইলেন্সার যুক্ত। বোটের চালক ছিল একমাত্র আরোহী। একটা কৌণিক অবস্থানের কারণে ‘নাইট ভিশন’ দুরবিনেও তাকে চেনা সম্ভব হয়নি। সন্দেহ হওয়ায় স্পাকি দ্বীপ থেকে একটা বোট তার পিছু নেয়। সন্দেহযুক্ত বোটটি ‘নর্থ প্যাসেজ’ পার হয়ে রিসেজ দ্বীপপুঞ্জ ঘুরে বারেন দ্বীপকে বাঁয়ে রেখে দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করে। দক্ষিণগামী কোন বোট পাগলের মত এতটা পথ কখনও ঘোরে না। এতে সন্দেহ আরও বাড়ে। রিসেজ দ্বীপপুঞ্জের ‘আউট রাম’ দ্বীপের পর্যবেক্ষণ নৌকেন্দ্র থেকে আরও দুটি বোট তার পিছু নেয়। পোর্ট ব্লেয়ার বরাবর এসে রহস্যজনক বোটটি তার গতি পরিবর্তন করে সোজা পশ্চিম দিকে চলতে শুরু করে। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। নিশ্চিত বোঝা যায় বোটটির লক্ষ্য পোর্ট ব্লেয়ার। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ওরা আমাদেরও জানায়। আমরা ‘নেইল আইল্যান্ড’ থেকে আরও তিনটি বোট নিয়ে সামনে থেকে এগোলাম। আমাদের তিনটি এবং পেছন থেকে তিনটি মোট ৬টি বোট রহস্যজনক বোটটিকে ঘেরাও করে ফেললাম। তখনও বোটের চালক লোকটিকে সরাসরি দেখা যায়নি। আমাদের লক্ষ্য ছিল রহস্যজনক বোটটিকে আটকানো। আমরা বোটের আলো নিভিয়ে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের নাইট ভিশন দূরবিনেই সে প্রথম ধরা পড়ল। আমরা চিনতে পারলাম সে আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বোট থেকে সব বোটকে এলার্ট করা হল। ঘিরে ফেলা হল বোটটিকে। সেও আমাদের দেখে ফেলেছে। তার বোটের স্পীড সাংঘাতিক বেড়ে গেল। তীর বেগে সে এগোল পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে। একদম বেপরোয়া। মনে হল সামনে অন্য বোট পড়ে গেলে তার উপর দিয়েই সে সামনে এগোবে। উপায় না দেখে তাকে থামাবার জন্য চারদিক থেকে মেশিনগানের গোলা বর্ষণ শুরু করলাম। আমাদের ব্যারিকেড ভাঙতে পারলেও শেষ রক্ষা করতে সে পারল না। সম্ভবত ফুয়েল ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ঘটে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বোটটি। তার সাথে সাথে ছাই হয়ে গেছে আহমদ মুসাও।’
বিপিন বাজওয়ার দীর্ঘ বিবৃতি শেষ হল।
আনন্দ-বিস্ময়ে জয়রাম কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর বলল চিৎকার করে, ‘ধন্যবাদ বাজওয়া তোমাদের সকলকে। আমাদের মহামুনি মানে স্যার কি জেনেছেন?’
‘এইমাত্র তো ঘটনা ঘটেছে। তাঁর সবগুলো ফোন ব্যস্ত পেয়ে আপনাকেই প্রথম টেলিফোন করলাম।’
‘ঠিক আছে, আমি জানিয়ে দিচ্ছি। তোমরা এখন কোথায়?’
‘আমরা এখন বিস্ফোরণ ক্ষেত্রেই। আপনাদের হুকুমের অপেক্ষা করছি।’
‘ঠিক আছে। আমি তাহলে মহামুনি স্যারের সাথে কথা বলে নেই। তারপর জানাচ্ছি।’
কথা শেষ করেই ‘বাই’ বলে দ্রুত লাইনটা কেটে দিল।
জয়রাম রাঠোর দ্রুত টেলিফোন করল মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র ওরফে গভর্নর বিবি মাধবকে।
গভর্নর বিবি মাধব টেলিফোন ধরেই বলল, ‘তোমাদের ধন্যবাদ জয়রাম। খবর আমরা পেয়েছি। খবর শুধু এটা নয় জয়রাম, এটা মহাখবর। পৃথিবীর অধিশ্বররা যা পারেনি, তোমরা তাই করে দেখালে। সুতরাং আমরাই পৃথিবীর অধিশ্বর হব, এটা প্রমাণ হল।’
‘অবশ্যই মহামুনি গুরুদেব। আমাদের ‘মহাসংঘ’ অবশ্যই দুনিয়াতে মহাকীর্তি রেখে যাবে।’
‘আগে বিশ্বের কথা নয় জয়রাম। নর-দেবতা শিবাজী মহাপ্রভুর আমৃত্যু সংগ্রামের যে স্বপ্ন, যা মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তার ‘এক ধর্মরাজ্য পাশে খ- ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’ কবিতাংশে অপরূপভাবে প্রকাশ করেছেন, তার আশু বাস্তবায়ন আমাদের কাজ।
‘তথাস্তু মহামুনি মহাগুরু। আমার জন্যে আর কিছু নির্দেশ?’
‘কাল সকালে পুলিশ যাওয়া পর্যন্ত ওদের সেখানে অপেক্ষা করতে বল। কিছু আলামত পেলে তা ওরা সংগ্রহ করতে পারবে।’
‘তথাস্তু মহামুনি মহাগুরু!’
ওপার থেকে লাইন কেটে দেয়া হয়েছে।
জয়রাম রাঠোর মোবাইল রেখে দিল।
ক্যাপ্টেন শশাংক বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল জয়রাম রাঠোরের দিকে।
জয়রাম টেলিফোন রাখতেই ক্যাপ্টেন শশাংক বলল, ‘কার সাথে কথা বললেন স্যার? আমরা যার সন্ধান করছি, বোটসহ তার ধ্বংস হওয়ার খবর দেয়ার কথা বলে টেলিফোন করলেন। কিন্তু খবর তো দিলেন না।’
হাসল জয়রাম রাঠোর। বলল, ‘উনি আগেই খবর পেয়েছেন। তার খবর পাওয়ার লাইন বহু।’
‘কে তিনি স্যার? ‘মহাসংঘ’, ‘মহাকীর্তি’, ‘মহামুনি’, ‘মহাগুরু’ এসব কথার কিছুই বুঝলাম না স্যার।
‘এসব শব্দ থেকেই বুঝেছ, যার সাথে আমি কথা বলেছি, তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি। সাধারণ্যে তার কথা বলা যায় না।’
‘স্যার দেশ আমাদের গণতন্ত্রের। এখানে আইনের দৃষ্টিতে সাধারণ-অসাধারণ নেই, এখানে অস্বচ্ছতার কোন দেয়াল নেই।’
‘কেতাবের কথা রাখ। কেতাবের কথা দিয়ে শাসন চলে, দেশ চলে, কিন্তু জাতি বাঁচে না।’
‘দেশ ও জাতিকে আপনি আলাদা করে দেখছেন?’
‘দেশের নাম, সীমার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু জাতির জীবন পথ অপরিবর্তনশীল। সুতরাং একটু পার্থক্য তো হতেই পারে।’
‘একটি গনতান্ত্রিক দেশে ‘জাতীয় জীবন পথ’ বা ‘জাতীয় স্বার্থ’, যদি মেজরিটির স্বার্থ হয়, তাহলে সেটাও গণতন্ত্রের অধীন। গণতন্ত্রের অধীন হলে সেটা আইনানুগ হবে এবং তাতে স্বচ্ছতা থাকবে। সুতরাং ‘জাতীয় জীবন পথ’ বা ‘জাতীয় স্বার্থ’ তো আলাদা হচ্ছে না।’
‘আলাদা হলেই তা আইনানুগ হবে না, তাতে স্বচ্ছতা থাকবে না সেটা নয়। কিন্তু জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তবর্তীকালীন একটা সময়ে প্রতিষ্ঠিত আইন ভাঙতে হয়, স্বচ্ছতাও রাখা যায় না। যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম। জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজও জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম চলছে। সে সংগ্রামে নেই বলে তুমি অনেক কিছু বুঝতে পারছো না।’
‘কিন্তু দেশ তো আমাদের স্বাধীন। আইন ও সংবিধানের বাইরে তো কোন সংগ্রাম চলতে পারে না। এ সংগ্রাম আসলে কি চায় স্যার।’ ক্যাপ্টেন শশাংকের চোখে সন্দেহ ও গভীর অনুসন্ধিৎসা।
‘ঐ তো বললাম শিবাজী যে জন্যে সংগ্রাম করেছেন, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায় প্রকাশ করেছেন খ- ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক সাথে বেঁধে ‘এক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা’।
‘কিন্তু এই ধরনের সংগ্রাম তো ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা চেতনা ও সংবিধান দু’য়েরই বিরোধী। তাছাড়া আমাদের হিন্দু ধর্ম তো কিছু পুরা কাহিনীর সমষ্টি মাত্র। এ দিয়ে আজ কোন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। হলে সেটা হবে ধর্মের নামে স্বৈরতন্ত্র, ঠিক যেমন ছিল মধ্যযুগে ইউরোপের যাজক-রাষ্ট্র-তন্ত্র।’
চরম বিরক্তিভাব ফুটে উঠেছিল জয়রাম রাঠোরের চোখে-মুখে। বলল, ‘এই কিছুক্ষণ আগে তুমি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছ, তাহলে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হবে না কেন?’
‘আমি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলিনি। মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছি। তবে যদি ধরে নেই মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুসলিম রাষ্ট্রের জন্যে, যেমন ভারত ভাগ হয়েছে পৃথক ‘মুসলিম রাষ্ট্রের’ দাবীতে। তবু এখানে কথা আছে, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে তাদের রাষ্ট্রনীতি আছে যা সাংঘাতিকভাবে আধুনিক। সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্র হতে পারে। কিন্তু আমাদের সে সুযোগ নেই। মাফ করবেন রাজা দশরথ (রামচন্দ্রের পিতা) ও রামচন্দ্র যে রাজ্য পরিচালনা করেছেন তা নিজস্ব ধর্মচিন্তার ভিত্তিতে, ধর্মগ্রন্থের সুনির্দিষ্ট বিধানবলীর ভিত্তিতে নয়। সুতরাং মানব রচিত নয় এমন ‘সোর্স অব ল’ আমাদের নেই, যা মুসলমানদের আছে বলে তারা দাবী করে।’
‘তোমার এসব তত্ত্ব কথা রাখ ক্যাপ্টেন। তত্ত্বের চেয়ে বাস্তবতা বড়। বাস্তবতা বহুদূর এগিয়ে গেছে। তোমার চোখ নেই তাই দেখতে পাচ্ছ না। ডুবো পাহাড় দেখেছ? নিশ্চয় দেখার কথা। ‘মহাসংঘ’ আজ ডুবো পাহাড়ের রুপ নিয়েছে। কিছুই দেখছো না তুমি। কিন্তু দেশ নামক সমুদ্রের সবটা জুড়ে রয়েছে ডুবো পাহাড়।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। যা বলছেন তা কি ঠিক?’
‘অবশ্যই।’
‘কিন্তু স্যার আমার মনে হচ্ছে আমাদের পুরা কাহিনীর মতই এ এক কল্প কথা।’
‘অল্প বুদ্ধি ভয়ংকর ক্যাপ্টেন। জেনারেল হও তারপর বুঝবে আমি যা বলছি তার অর্থ।’ বলল জয়রাম রাঠোর অনেকটা বিদ্রুপের কণ্ঠে।
কথা শেষ করেই মুহূর্তকাল থেমে আবার বলা শুরু করল, ‘থাক এসব কথা। এস এখনকার করণীয় বিষয়ে আলাপ করি।’
‘করণীয় আর কি স্যার। মিশন আমাদের সফল। এখন ব্যারাক এবাউট টার্ন।’
‘না। কাল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছা পর্যন্ত যার যে জায়গা সেখানে থাকতে হবে।’
‘তথাস্তু স্যার।’
‘শব্দটি শেখার জন্যে ধন্যবাদ।’

গভর্নর হাউজের খাস বৈঠকখানা।
গভর্নর বিবি মাধব একটা সোফায় বসে। তার সামনে আরেক সোফায় আরও দু’জন লোক বসে।
কথা বলছিল বিবি মাধব, ‘হ্যাঁ, আমাদের সামনে থেকে প্রধান বাধা, প্রধান শত্রু আহমদ মুসা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমাদের আসল কাজ একটুকুও এগোয়নি। আহমদ শাহ আলমগীর মুখ খোলেনি। সে মুখ না খুললে বাক্স পাওয়া যাবে না। বাক্স না পাওয়া গেলে আমাদের জন্য শিবাজী মহাপ্রভুর রেখে যাওয়া মহাভারত গঠনের নীলনকশা আমরা পাব না এবং মোগলদের গোপন ধনভা-ারও আমরা হাত করতে পারবো না। দুটোই আমরা চাই, একটা জাতির জীবন হিসেবে, আরেকটা জাতির সমৃদ্ধির জন্যে।’ থামল বিবি মাধব।
তার সামনের সোফায় বসে থাকা দুজনের একজনের চেহারা ভারতীয়, অন্যজন বিদেশী, সেমেটিক চেহারা।
বিবি মাধব থামতেই ভারতীয় চেহারার লোকটি বলে উঠল, ‘এটা খুবই আশ্চর্যের যে, এতদিনে সবকিছু করেও একজন লোকের কাছ থেকে কথা আদায় করা গেল না। অবিশ্বাস্য ঘটনা।’
‘অবিশ্বাসের কিছু নয় জেনারেল স্বামীজী। যে মৃত্যু চায়, কোন নির্যাতন, কোন ভয় তাকে বাধ্য করতে পারে না।’
জেনারেল স্বামীজীর পুরোনাম জেনারেল জগজিৎ জয়রাম। দু’বছর আগে তিনি ভারতীয় সেনা প্রধানের দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেয়ার পরেই তিনি ‘শিবাজী সন্তান সেনার সদস্য হয়েছেন। আজ তিনি ‘মহাসংঘ’ এর একজন মহাগুরুত্বপূর্ণ নেতা। তার নাম আজ জেনারেল স্বামী জগজিৎ জয়রাম মহাগুরু। মহাগুরু স্বামী শংকরাচার্য শিরোমনি গ্রীনভ্যালি অপারেশনে নিহত হলে তার দায়িত্ব নিতে মহারাষ্ট্র থেকে এসেছেন। তিনি আন্দামানে ‘মহাসংঘ’ এর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কাজ করছেন।
বিবি মাধব থামলে জেনারেল স্বামীজি বলে উঠল, ‘তাহলে উপায় কি?’
‘উপায় তার মানসিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়া। এ ধরনের আদর্শবাদীদের দৈহিক কষ্ট দিয়ে তাদের মানসিক প্রতিরোধ ভাঙ্গা যায় না। আহমদ শাহ আলমগীরের মা-বোনের ইজ্জত আহমদ শাহ আলমগীরের মত লোকদের কাছে নিজ জীবনের চেয়ে লক্ষগুণ বেশি মূল্যবান।’ জেনারেল স্বামীজির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল বিদেশী চেহারার লোকটি।
বিদেশী চেহারার লোকটির নাম দানিয়েল ডেভিড। ইসরাইলী গোয়েন্দা কর্মকর্তা সে। ইসরাইলের সেরা চৌকষ গোয়েন্দা কোলম্যান কোহেন আহমদ মুসার হাতে নিহত হবার পর তার স্থানে কাজকরতে এসেছে দানিয়েল ডেভিড।
দানিয়েল ডেভিড থামতেই বিবি মাধব বলল, ‘ওদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আহমদ মুসা ওদের উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল উত্তর আন্দামানের গ্রীনভ্যালিতে। আহমদ মুসা সেখান থেকে চলে আসার পর এবং বিস্ফোরণে বোটসহ আহমদ মুসা ধ্বংস হবার পর কয়েকবার আমরা গ্রীনভ্যালিতে গোপনে খবর নিয়েছি সেখানে আহমদ শাহ আলমগীরের মা-বোনরা নেই। আহমদ মুসাই তাদেরকে সরায় অথবা পরে তারা সরে যায়। তাদেরকে চারদিকে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু তারা কোথায় এ সম্পর্কে কোন ক্লু আমরা এখনও পাইনি।’
থামল বিবি মাধব।
‘তাহলে উপায় কি? তাদের খোঁজ পাওয়ার উপরই নির্ভর করছে আমাদের লক্ষ অর্জন।’ বলল জেনারেল স্বামীজি।
সোফায় হেলান দিয়ে ছিল বিবি মাধব।
জেনারেল স্বামীজি থামলেও বিবি মাধব সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। তার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।
দানিয়েল ডেভিডের মুখেও কোন কথা ছিল না।
এক সময় বিবি মাধব সোজা হয়ে সোফায় বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, আর কোন উপায় না দেখে আমি একটা উপায় বের করেছি। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মত।’
‘সেটা কি?’ উদগ্রীব জেনারেল স্বামিজী জিজ্ঞাসা করল।
‘সেটা বলার জন্যে আমি আজ আপনাদের ডেকেছি।’
এটুকু বলে মুহূর্তের জন্যে থামল বিবি মাধব। পরক্ষণেই শুরু করল আবার, ‘আজ সকালে আমার মেয়ে আমার স্ত্রীর সাথে মন্দির থেকে আসার পথে কিডন্যাপ হয়েছে। কিডন্যাপ হয়েছে মানে আমি কিডন্যাপ করিয়েছি।’ থামল বিবি মাধব।
জেনারেল স্বামিজী ও দানিয়েল ডেভিড দু’জনেরই মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে। তাদের মুখে কোন কথা নেই। তাদের বিস্ফোরিত চোখ গভর্নর বিবি মাধবের উপর নিবদ্ধ।
শুরু করল বিবি মাধব আবার, ‘আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায়ের শেষ, নিরাপদ ও অব্যর্থ ব্যবস্থা হিসেবে আমরা এটা করেছি।’
গলাটা পরিষ্কার করার জন্যে একটু থেমেছিল। সেই সুযোগে দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল, ‘আপনার মেয়ের কিডন্যাপ হওয়ার সাথে আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায়ের কি সম্পর্ক রয়েছে! আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘আছে। আপনারা একটা বিষয় জানেন যে, আমার মেয়ে ও আহমদ শাহ আলমগীর এক সাথে পড়তো। আহমদ শাহ আলমগীর ভালোবাসে আমার মেয়ে সুষমাকে। আমরা সুষমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই, আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্যে।’
‘কিভাবে?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘আহমদ শাহ আলমগীরের সামনে একটা নাটক করা হবে। তার কাছ থেকে যা জানতে চাওয়া হচ্ছে তা না বললে তার প্রেমিকা ধর্ষিতা হচ্ছে, এই হবে সে নাটক। আমার বিশ্বাস আহমদ শাহ আলমগীরের মা-বোনকে ব্যবহার করে যে ফল পাওয়া যেত, এক্ষেত্রেও সে ফল পাওয়া যাবে।’ বিবি মাধব বলল।
‘কিন্তু আপনার মেয়ে এবং আহমদ শাহ আলমগীর দুজনেই এটা ধরে ফেলতে পারবে। তাদের এত দিনে জেনে ফেলা স্বাভাবিক যে, আপনি বা আপনার সরকার আহমদ শাহ আলমগীরের আটক করার পেছনে রয়েছে।’ বলল জেনারেল স্বামিজী।
‘আহমদ শাহ আলমগীর এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আমার মেয়েও নয়। সে কোনওভাবে সন্দেহ করলেও কিডন্যাপ হওয়ার পর নিশ্চিত হবে যে, তার পিতা কিংবা পিতার সরকার আহমদ শাহের কিডন্যাপের সাথে নেই।’
‘কিন্তু কিডন্যাপ, মানে কিডন্যাপ নাটকের যে কোন পর্যায়ে তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে যে, তার পিতা বা পিতার সরকার তাকে একটা রক্তাক্ত নাটকের উপকরণে পরিণত করেছে। তখন সব পরিকল্পনা প- হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া আপনার মেয়ে সব কথা প্রকাশ করে সমস্যা বাড়াতে পারে, আমি ভয় করছি।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘সেটা আমি চিন্তা করেছি মি. ডেভিড। চারজন চৌকশ মহিলা গোয়েন্দা সুষমাকে পাহারা দিয়ে রাখবে। অধিকাংশ সময় তাকে রাখবে ঘুম পাড়িয়ে। প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথার বাইরে কেউ একটা কথাও তার সাথে বলবে না। মহাসংঘের সুরক্ষিত অফিসগুলোতেই তাকে রাখা হবে। সুতরাং আপনি যে আশঙ্কা করছেন তার কোনই সম্ভাবনা নেই।’ বিবি মাধব বলল।
‘কিন্তু মহামুনি স্যার, আহমদ শাহ আলমগীর যদি মুখ না খোলে। মুখ খোলার জন্যে ধর্ষনের নাটকও শুরু করতে হতে পারে। তারপরও যদি মুখ না খোলে। নাটককে যদি শেষ পর্যায় পর্যন্ত নিতে হয়?’ বলল জেনারেল স্বামীজি।
হঠাৎ মলিন হয়ে উঠল বিবি মাধবের মুখ। কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। শক্ত হয়ে উঠল তার মুখ। তার মুখের পেশীগুলো যেন শক্ত পাথরের রূপ নিল। বলল, ‘আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে বাঞ্জিত তথ্য আদায়ের জন্যে যে কোন পর্যায় পর্যন্ত আমি যাব। মেয়েকেও আমি কুরবানী দেব।’
একটু থামল বিবি মাধব। তার মুখটি সহজ হয়ে এল। বলল, ‘তবে আমি মনে করি, সে পর্যন্ত যেতে হবে না। তার আগেই কথা তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে।’
‘ধন্যবাদ ‘মহামুনি স্যার’ আপনাকে। আপনার এই ত্যাগের মনোভাব জাতির জন্যে একটা মহান দৃষ্টান্ত এবং আমাদের জন্য একটি অফুরন্ত প্রেরণা। কিন্তু স্যার, আহমদ শাহ আলমগীর যদি বিষয়টা আসলেই না জানে, তাহলে বলবে কি করে? সে ক্ষেত্রে আমাদের তো দু’কুলই যাবে।’ বলল জেনারেল স্বামীজী।
‘এমন ভাবার কোন অবকাশ নেই। আহমদ শাহ আলমগীরের বাপ বেঁচে নেই। সুতরাং তাকে এটা জানতেই হবে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তার কাছে তথ্যটা থাকবেই। সেসব কথা বললেই আমরা সেটা বুঝতে পারব।’
‘ধন্যবাদ। ঠিক বলেছেন, মহামুনি স্যার।’ জেনারেল স্বামীজী বলল।
‘বাই দি বাই। দি গ্রেট শিবাজীর সেই দলিলে কি আছে, আপনারা সেটা কি জানেন?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘মহাপ্রভু শিবাজী দলিলটি প্রনয়ের পর দ্বিতীয় যে ব্যক্তি এটা দেখেছেন, তিনি তার পুত্র শম্ভুজী। শিবাজী মহাপ্রভু ও শম্ভুজীর ডাইরি থেকে দলিল সম্পর্কে কিছু জানা গেছে। শিবাজী মহাপ্রভু তার ডাইরীর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বাইশ বছর বয়সকালে ১৫৭১ সালের বৈশাখ শুক্লা নবমী বৃহস্পতিবার মহারাষ্ট্রের এক পাহাড়ে স্বর্গীয় পুরুষ গুরু রামদাস স্বামীর কাছে পরমার্থতত্ত্ব সম্পর্কে দীক্ষা লাভের পর দিব্যজ্ঞান লাভ হল। তাতে দেখলাম, আমি যে রাজ্য ফেলে পাহাড়ে এসেছিলাম, সে রাজ্য আসমুদ্র হিমাচল এবং সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াব্যাপী বিস্তৃত হয়ে মায়ের পবিত্র রূপ নিয়ে শুধু আমাকে নয় আমার পেছনে দাঁড়ানো আর্য সন্তানদের ডাকছে। সে দিব্যজ্ঞানের নির্দেশেই সেই পাহাড়ে বসে মা-রূপী সে সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনের জন্যে একটা দলিল রচনা করলাম। তারপর রাজ্যে ফিরে এসে রাজপাটে বসে ‘মহাভারত’ এর সংগ্রাম শুরু করলাম।’ তাঁর ডাইরীর সর্বশেষ বাক্য হিসেবে লিখেছেন, ‘মহাপবিত্র’ দলিলটির মহাগুরুভার আমি পুত্র শম্ভুজীকে অর্পণ করে গেলাম।’ আর শম্ভুজী তার ডাইরীর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বাপুজীর মহাপবিত্র দলিলটি আমি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখেও রক্ষা করতে পারলাম না। মোগল স¤্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেব আমার মত দলিলটিকেও বন্দী করে দিল্লী নিয়ে যাচ্ছে।’ দলিলটি সম্বন্ধে শম্ভুজীর ডাইরীতে আর কিছু পাওয়া যায়নি। আর শিবাজী মহাপ্রভু দলিলের বিষয় সম্পর্কে যেটুকু বলেছেন, তার চেয়ে বেশি জানা যায়নি।’ থামল বিবি মাধব।
আবেগে ভারী হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল দানিয়েল ডেভিডের মুখও বলল, ‘বুঝলাম, দলিলটা আমাদের ‘টেন কমান্ডমেন্ট’ এর মতই আপনাদের কাছে মূল্যবান। অবশ্য আমাদের ‘টেন কমান্ডমেন্টটা ডিভাইন।’
একটু থামল দানিয়েল ডেভিড। একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার বলে উঠল, ‘একটা সা¤্রাজ্যের সীমা সেন্ট শিবাজী এঁকেছেন তার ডাইরীর ঐ বক্তব্যে। তাঁর দলিলেও নিশ্চয় এটা আরও তিনি সুনির্দিষ্ট করেছেন। ষোড়শ শতকের এই চিন্তাকে আপনারা এখন বাস্তব মনে করেন?’
‘শুধু বাস্তব নয়, আমরা একে ‘ধ্রুব’ মনে করি। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এর জন্যেই কাজ করছি। আমাদের মহাসংঘের এই একটাই লক্ষ্য। এর জন্যে যা করা দরকার, তা আমরা করব। আমার জীবন তুল্য সন্তান আমার মেয়েকে এই লক্ষ্যেই বলি দিতে রাজি হয়েছি।’ বলল বিবি মাধব। আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
‘স্যার, আপনাদের উদ্দেশ্যের প্রতি আমার আন্তরিক সম্মান। কিন্তু এতবড় উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন আপনাদের সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থার সহায়তা ছাড়া কিভাবে হতে পারে, আমি বুঝতে পারছি না। আপনাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ এবং আপনাদের সরকারকে সে সংবিধানকেই মান্য করতে হবে। আপনারা তাহলে কিভাবে শিবাজীর মানে আর্য সন্তানদের ‘মহাভারত’ গঠন করবেন?’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘সংবিধান, সরকার সবই জনতার জন্যে এবং জনতার দ্বারা। সুতরাং জনতা সবকিছু পরিবর্তন করে যা চায়।’ বলল বিবি মাধব।
‘কিন্তু আপনাদের সমর্থিত দল তো জনতার সমর্থনে ক্ষমতায় গিয়েছিল, তারা তো কোন পরিবর্তনই আনতে পারেনি।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যেতে হবে। সে সুযোগ আমাদের এখনও হয়নি। তাছাড়া প্রস্তুত হওয়ার কাজ আমাদের শেষ হয়নি।’ বলল বিবি মাধব।
‘কি প্রস্তুতি?’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘মহাসংঘের কাজ এখনও সব জায়গায় পৌছেনি। শিবাজী মহাপ্রভুর ‘দলিল’ এখনও আমাদের হাতে আসেনি। ওটাই তো আমাদের মূল পাথেয় এবং ওটা আমাদের বাস্তবায়নের বিষয়ও।’ বলল বিবি মাধব।
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে আপনারা যা চান, যা করবেন, তা এখনও নির্দিষ্ট নয় আপনাদের কাছে।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘এ কথা ঠিক নয়। রামচন্দ্রের মহাভারত আমাদের সামনে আছে। আমরা যা করব, আমরা তা জানি। শিবাজী মহাপ্রভুর নির্দেশনা সেটাকে আরও সুনির্দিষ্ট ও পূর্নাঙ্গ করবে মাত্র।’ বলল বিবি মাধব।
‘বুঝেছি। ধন্যবাদ।’
‘ওয়েল কাম মি. দানিয়েল ডেভিড।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল বিবি মাধব। বলল, ‘আপনারা বসুন। আরও কিছু কথা আছে। আমি ছোট্ট একটা কাজ সেরে আসছি।’
ড্রইংরুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে বিবি মাধব তার রেসিডেন্ট অফিসের দিকে ছুটল।

জ্ঞান ফিরে আসার সাথে সাথে সুষমা রাও চোখ খুলেই এক ঝটকায় উঠে বসল। দেখতে পেল একটু দূরে ঘরের ঠিক মাঝখানে চারজন মুখোশধারী মহিলা মেঝেতে বসে চাদর পেতে তাস খেলছে। তাদের প্রত্যেকের পাশে একটি করে রিভলবার।
মনে পড়ল সুষমা রাওয়ের, সে মন্দির থেকে মায়ের সাথে তাদের বাড়ির দিকে আসছিল। মন্দিরটা তাদের বাড়ির পাশেই এবং তা তাদের গভর্নর হাউজের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই। বাড়ি ও মন্দিরের মাঝামাঝি জায়গায় তারা আসতেই একটা মাইক্রো তীর বেগে এসে তাদের পাশে দাঁড়ায়। মাইক্রো থেকে মুখোশধারী কয়েকজন নেমে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন তার মুখে একটি রুমাল চেপে ধরে, অন্যেরা তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নেয় মাইক্রোতে। রুমাল থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আতংকের এক প্রবল চাপ নামে তার মনের উপর। শাহ বানুরা যেভাবে কিডন্যাপ হয়েছিল, তাহলে সেও ঐভাবে কিডন্যাপ হয়েছে। শরীল ও মন তার থর থর করে কেঁপে ওঠে। চারজন মুখোশধারী মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কে আপনারা? আমাকে কেন ধরে এনেছেন?’
তারপর হাত-পায়ের বাঁধনের দিকে চেয়ে কান্না জড়িতকণ্ঠে বলল, ‘আমি কি অপরাধ করেছি?’
চারজন মুখোশধারীর কেউ কোন কথা বলল না। ফিরেও তাকাল না তার দিকে।
‘কেন কি করেছি আমি, ছেড়ে দাও আমাকে?’ কান্নার সাথে বলল সে।
এবার মুখোশধারীদের একজন পাশে রাখা রিভলবার তুলে নিয়ে তার দিকে ঘুরল। হাত উঠাল উপরে। তর্জনি তার রিভলবারের ট্রিগারে। চাপল সে ট্রিগার। একটা গুলী বেরিয়ে সুষমা রাওয়ের চুল ছুঁয়ে গিয়ে বিদ্ধ করল পেছনের দেয়ালকে।
বুক ফাটা আতংকে সুষমা রাওয়ের চোখ দু’টি বিস্ফোরিত হয়েছিল। মাথার উপর দিয়ে গুলী চলে গেলেও বেঁচে যাওয়ার কোন স্বস্তি তার চোখে মুখে ফুটে উঠল না। বুঝল সে, এরা পাখির মত মানুষও মারতে পারে। এবার গুলী তার চুল ছুঁয়ে গেছে পরের গুলী হয়তো মাথা ভেদ করে যাবে। কারা এই নিষ্ঠুররা? যারা শাহ বানুদের কিডন্যাপ করেছিল, যারা আহমদ শাহ আলমগীরকে কিডন্যাপ করেছে, যারা ডজন ডজন মানুষকে আন্দামানে খুন করেছে, তারাই কি এরা? কিন্তু তারা আমার জন্যে মেয়ে প্রহরী দিয়েছে কেন? মেয়ের জন্যে মেয়ে প্রহরী এমন নীতিবোধ তো তাদের থাকার কথা নয়? আসলে এরা কারা?
এই সময় ঘরের একটা মাত্র দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করল বিশাল বপু একজন মহিলা। তার পেছনে সৈনিকের পোশাকধারী একজন পুরুষ। দুজনেরই মুখে মুখোশ। মহিলার হাতে রিভলবার, আর সৈনিকের হাতে ষ্টেনগান।
সুষমা বুঝল সৈনিক লোকটি পদস্থ মহিলাটির গার্ড।
‘কি ঘটনা, গুলী কেন?’ ঘরে ঢুকেই বলল মহিলাটি।
ভেতরের চারজন মহিলা বিশাল বপু মহিলাটি ঘরে ঢুকতেই তাকে দু’হাত তুলে নমষ্কার করেছিল। তার প্রশ্নের উত্তরে একজন বলল, ‘মহা মাতাজী, মেয়েটি কান্না জুড়ে দিয়েছিল। থামিয়ে দেবার জন্যে ওই ব্যবস্থা করেছি আমরা।’
‘গুড।’ বলল বিশাল বপু মহিলাটিই।
‘ধন্যবাদ, মহামাতাজী।’ সেই মেয়েটিই বলল।
‘তবে দেখ, এখনই গুলীটা যেন মাথায় ঢুকে না যায়। তার ডার্লিং এর কাছ থেকে যদি কথা আদায় করে দিতে পারে, তাহলে দুজনেরই মুক্তি। আর কথা আদায় করে দিতে না পারলে তাকে মরার আগেই মরতে হবে। তারপর এক সময় আসল মরণ।’ বলল বিশাল বপু মহিলাটি।
বিশাল বপু মেয়েটির কথা শুনে কৌতুহল ও আশা জাগল সুষমা রাওয়ের মনে। বলল, ‘আমার ডার্লিং, কে সে ম্যাডাম?’ বিশাল বপু মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল সুষমা রাও।
‘কেন আহমদ শাহ আলমগীর? সে তোমার প্রেমিক নয়?’
সুষমা রাও মহিলাটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘তার কাছ থেকে কি কথা আদায় করতে হবে?’
‘একটি বাক্সের কথা। বাক্সটি তার বাসায় কোথাও লুকানো আছে। আমরা বাক্সটি চাই।’ বলল বিশাল বপু লোকটি।
‘বাক্সের জন্যেই কি তাকে ধরেছেন?’ সুষমা রাও বলল।
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘ওঁদের বাড়িতে তো এখন কেউ নেই। বাক্সটি আপনারা খুঁজে নিতে পারেন।’
‘আমরা আগেই খুঁজেছি। না পেয়েই তো তাকে ধরা হয়েছে।’
‘বাক্সের কথা উনি তোমাদের বলছেন না?’
‘বলছে না। সে মানুষ নয়, একটা পাথর। এত আঘাতে পাথরও ভেঙে যেত, কিন্তু তাকে মুখ খোলানো যায়নি।’
মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল সুষমা রাওয়ের। বেদনার এক প্লাবন নামল তার চোখে-মুখে। ছল ছলিয়ে উঠল তার দুচোখ। এক অসহনীয় যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল বুক থেকে সর্বত্র।
একটু সময় নিয়ে বলল, ‘বাক্সটি কি এমন গুরুত্বপূর্ণ যে এজন্যে তাকে কিডন্যাপ করেছেন, নির্যাতন করছেন?’
‘ওর মধ্যে আমাদের প্রাণ আছে। ও বাক্সটা আমাদের।’
‘বাক্সটা আপনাদের হলে উনি দেবেন না কেন?’
‘সেটাই তো আমাদের কথা। দেবে না কেন?’ সে মরতে রাজি, কিন্তু বাক্সের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নয়।’
মুখ মলিন হয়ে গেল সুষমা রাওয়ের। মরতে রাজি, কিন্তু বাক্স দিতে রাজি নয়। তাহলে কি বাক্সটি তাদের জন্যেও মূল্যবান? বাক্সটি কি………।’
সুষমা রাওয়ের ভাবনায় ছেদ পড়ল মহিলাটির কথায়। সে বলছে, ‘বাক্সটি তুমি আমাদের আদায় করে দাও। এজন্যে আমরা তোমাকে এনেছি।’
‘যদি এমনই হয় যে, তিনি মরতে রাজি বাক্স দিতে রাজি নয়, তাহলে আমার কথায় তা তিনি অবশ্যই দেবেন না।’
‘সে তোমাকে ভালোবাসে।’
‘যদি তাই হয়, তিনি যা চান না, আমি সেটার জন্যে চাপ দেব কেন? আর অন্যায় কথা তিনি শুনবেন কেন? আর ভালোবাসলেই যে সব কথা শুনতে হবে, মানতে হবে, তা স্বাভাবিক নয়।’
‘হ্যাঁ, ওটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা অস্বাভাবিকটা চাচ্ছি। তুমি অবশ্যই তাকে বলবে, তাকে শুনতেও হবে এবং সে শুনবেই।’
বিস্ময় নামল সুষমা রাওয়ের চোখে-মুখে। বলল, ‘শুনবেই, এ কথা কেমন করে বলছেন ম্যাডাম?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না মহিলাটি। সে হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু সেটা যেন হাসি নয়, একটা বিকৃত চিৎকার। তার চোখে-মুখে লালসার বন্যা।
তার চিৎকার ও চেহারা দেখে আঁৎকে উঠল সুষমা রাও।
বিশাল বপু মহিলাটি একটু সময় নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘সে চোখের সামনে তার সুন্দরী প্রেমিকা ধর্ষিতা হচ্ছে এটা দেখতে চাইবে না। সুতরাং কোন অসুর পুরুষ তোমার দেহের কাপড় টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নেকড়ে যেমন শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভাবে তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন তার মুখ থেকে বাক্সের কথা সুড় সুড় করে বেরিয়ে আসবে।’
মহিলাটির কথা শেষ না হতেই থর থর করে কেঁপে উঠেছে সুষমা রাওয়ের দেহ। সে বুঝতে পারল ওরা কি ষড়যন্ত্র করেছে! ভয় ও আতংকে কুঁকড়ে গেল সুষমা রাওয়ের দেহ।
আবার হেসে উঠল মহিলাটি। কুৎসিত হাসি। বলল, ‘এখনই কুঁকড়ে অর্ধেক হয়ে গেছ! তখন কেমন হবে অবস্থা! আর তোমার সে অবস্থা দেখে কি অবস্থা হবে তোমার প্রেমিকের!’
কোন কথা বলল না সুষমা রাও। চোখ বন্ধ করেছে সে। তার মনে হচ্ছে সে এক গহীন জঙ্গলে। চারদিক থেকে তাকে ছিঁড়ে খাবার জন্যে নেকড়েরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মনে পড়ল তার আহমদ মুসার কথা। তিনি কি জানতে পারবেন তার কিডন্যাপ হওয়ার কথা! আর…….।
সুষমা রাওয়ের ভাবনা ছিড়ে গেল আবার বিশাল বপু মহিলাটির অট্টহাসিতে।
হাসতে হাসতে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সুষমার দেহটা লুটিয়ে পড়ল খাটিয়ার উপর।

Top