বোট তীরে ভিড়তেই কর্নেল সুরেন্দ্র বোটে উঠল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার মি. বিভেন, আমি ওদের বিশেষ করে গভর্নর স্যারের একটা ফটো নিতে চাই তিনি যে অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন, সে অবস্থায়।’
‘হ্যাঁ সেটা তো আপনার একটা আইনি প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইয়েস মি. বিভেন স্যার।’ বলেই কর্নেল সুরেন্দ্র তীরে দাড়ানো ক্যামেরাধারী একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমার ওদিকের ফটো নেয়া শেষ তো! এখন বোটে এসো, এদের ফটো নিতে হবে।’
নির্দেশ পেয়েই লোকটি বোটে উঠে এল।
গভর্নর বিবি মাধব এবং জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘একসিলেন্সি মি. গভর্নর এবং জেনারেল স্যার আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি আপনাদের ফটো নেব।’
ফটোগ্রাফার ক্যামেরা তাক করল গভর্নরের দিকে।
‘দাঁড়াও কর্নেল সুরেন্দ্র, তো…….।’ চিৎকার করে কথা বলতে যাচ্ছিল বিবি মাধব।
কর্নেল সুরেন্দ্র তাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘একসিলেন্সি, দয়া করে আমাকে সরকারি কাজে বাধা দেবেন না। আপনি কথা বলুন, তাতে আমার আপত্তি নেই।
কর্নেল সুরেন্দ্র যখন কথা বলছিল, তখন সিবিআই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা একের পর এক ক্লিক করে চলছিল।
‘আমি আন্দামানের গভর্নর। আমাকে এভাবে গ্রেফতার করতে পার না প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার অনুমতি ছাড়া।’ বলল বিবি মাধব ক্রুব্ধ কণ্ঠে।
‘প্রমাণ পেলে আন্দামানের যে কাউকে আমি গ্রেফতার করতে পারব, এ অথরিটি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে আন্দামানে পাঠিয়েছেন। তার উপর এই দশ মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রীকে আমি সব কথা জানিয়েছি। তিনি প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে তার অনুমতি নিয়ে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যে। তিনি আমাকে আরও জানিয়েছেন, ‘আন্দামান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে তাৎক্ষণিকভাবে আন্দামানের গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
এ কথা শোনার সংগে সংগে গভর্নর বিবি মাধবের মুখ মলিন হয়ে গেল। তার চোখে-মুখে নামল উদ্বেগের গভীর ছায়া। বলল, ‘কর্নেল সুরেন্দ্র তোমার মোবাইলটা আমাকে দাও। আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলব। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এই বিভেন বার্গম্যান আমেরিকান পরিচয় দিয়ে সব কলকাঠি নেড়েছে। কিন্তু বিভেন বার্গম্যানকে তো প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং তোমরাও জান না।’
‘আমি জানতাম না একথা ঠিক একসিলেন্সি। কিন্তু এক মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, বিভেন বার্গম্যান আসলে আহমদ মুসা।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘জানার পরেও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা শুনেছেন? তোমরাও তাকে সহযোগিতা করছ?’ উচ্চকণ্ঠে বলল বিবি মাধব। তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
‘একসিলেন্সি, আমরা তাকে সহযোগিতা করছি না, তিনিই দয়া করে আমাদের সহযোগিতা করছেন। আর প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা শুনবেন কেন? আন্দামানের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে তারা সঠিক পদক্ষিপ নিয়েছেন। তিনি যদি এ ব্যাপারেও কোন সহযোগিতা করে থাকনে, সেটা তার শুভেচ্ছা।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘তুমি ঠিক বলছ না। সে তার সম্প্রদায় মুসলমানদের স্বার্থে সব কিছু করেছে। আর……।’ বিবি মাধব কথা শেষ করতে পারল না। মাঝপথেই থেমে যেতে হলো।
কর্নেল সুরেন্দ্র বিবি মাধবের কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘ব্যাপারটাকে ঐভাবে না দেখে বলুন যে, একদল মজলুম মানুষের স্বার্থে তিনি কাজ করছেন।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, আমরা জালেম?’ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল বিবি মাধব।
‘আমি কিছুই বলছি না একসিলেন্সি। সে কথা আইন বলবে, বিচার বলবে।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘বিচার কি বলবে? আমরা জাতির স্বার্থে কাজ করেছি। ব্যক্তি স্বার্থে কিছু করিনি আমরা।’
কর্নেল সুরেন্দ্রের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘একসিলেন্সি আপনারা আমাদের অগ্রজ। একটা কথা বলি, একজনের সর্বনাশ করে আরেকজনের ‘পৌষ মাস’ আনা ভাল কাজ নয়, সব আইনেই এটা অপরাধ।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন স্যার, আহমদ শাহ আলমগীরকে বাক্স থেকে উদ্ধার করতে হবে।’
আহমদ মুসা মনে মনে আহমদ শাহ আলমগীরের কথা ভেবে অধীর হয়ে উঠেছিল। কর্নেল সুরেন্দ্র নিজের থেকেই একথা মনে করায় খুশি হলো আহমদ মুসা। দুজনে বোট থেকে নেমে চলল বাক্সটার দিকে।
বাক্সের পাশে দাঁড়াতেই বুকটা দুরু দুরু করে উঠল আহমদ মুসার। কি অবস্থায় দেখবে সে আহমদ শাহ আলমগীরকে!
বাক্সের উপরের ঢাকনায় অনেকগুলো বড় বড় ফুটো। বাক্সের দুপাশে দেয়াল এবং পা ও মাথার দিকেও কয়েকটা করে বড় ফুটো। বুঝল আহমদ মুসা, আহমদ শাহ আলমগীরের বাঁচার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা না হয় এজন্যে বাক্সে ভালো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাক্সটির দুপ্রান্ত প্লাষ্টিক দড়ি দিয়ে বাঁধা।
আহমদ শাহ আলমগীর সংজ্ঞাহীন, না সজ্ঞানে রয়েছে? ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল বাক্সটির উপর।
ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে প্রথমে জোরে একটি টোকা দিল। মুহূর্তকাল থেমে একই সাথে জোরে আরো একটি টোকা দিল।
এই টোকার ধরন আহমদ শাহ আলমগীরের কাছে পরিচিত। তাদের পরিবারে আঙুল বা কলিংবেল যাই হোক নক করার ক্ষেত্রে এই সংকেত ব্যবহার করা হয়। টোকার এই সংকেতের মাধ্যমে আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে এই মেসেজ দিতে চাইল যে, সে এখন আপন পরিবেশে, শত্রুদের হাতে নয়।
আহমদ মুসা নক করার কয়েক মুহূর্ত পরেই ভেতর থেকে বাক্সের ঢাকনায় ঠিক আহমদ মুসার নিয়মেই তিনবার নক হলো।
অপার খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কর্নেল সুরেন্দ্রও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল। সে খুশি হয়ে আহমদ মুসাকে বলল,‘গুড নিউজ স্যার। আহমদ শাহ আলমগীর সজ্ঞানে এবং সচল অবস্থায় আছে। আপনার সংকেতের জবাব দিয়েছে সে। কিন্তু আপনার সাথে এ সহযোগিতা করল কেন সে? শত্রুর সংকেতে সে তো রেসপন্স করার কথা নয়।’
‘আমি তার ফ্যামেলী কোডে সংকেত দিয়েছি কর্নেল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি।’ প্রসন্ন মুখে কথাটা বলেই কর্নেল সুরেন্দ্র কোমরের বেল্টে ঝুলানো খাপ থেকে ছুরি বের করে দু’প্রান্তের বাঁধন কেটে দিল।
আহমদ মুসা দুহাত দিয়ে বাক্সের উপরের ঢাকনা তুলে বন্ধনের এক প্রতীক অর্গলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আহমদ মুসার চোখ দুটি গিয়ে স্থির হলো অপার প্রত্যাশিত আহমদ শাহ আলমগীরের মুখের উপর। অনিয়ন্ত্রিত, অগোছালো লম্বা দাড়ি-গোফ এবং মাথা থেকে নেমে আসা বিশৃঙ্খল লম্বা চুলে মুখ প্রায় ঢেকে গেছে। কালোর মধ্যে মুখের সাদা দীপ্তি এবং উজ্জ্বল চোখ দেখতে পেল আহমদ মুসা। শবাসনে থাকার মত চিৎ হয়ে সে শুয়ে ছিল। তার প্রলম্বিত হাত দুটি লম্বাভাবে দেহের উপর রাখা ছিল।
আহমদ শাহ আলমগীরের চোখ চার দিকে ঘুরে এসে আহমদ মুসার মুখের উপর স্থির হলো। ধীরে ধীরে তার চোখে ফুটে উঠল সাত রাজারধন কুড়িয়ে পাওয়ার এক আনন্দ।
আর আহমদ মুসার চোখে অবশেষে আহমদ শাহ আলমগীরকে ঘিরে পাওয়ার অশ্রুঘন এক আবেগ।
শোয়া থেকে তাকে তুলে আনার জন্যে আহমদ মুসা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ শাহ আলমগীরের ডান হাত উঠে এল। কাঁপছিল তার হাত। অপুষ্টিতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার হাতের চামড়া। হাতের আঙুলগুলো অনেকটাই শিথিল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে ফেলল। আহমদ শাহ আলমগীরের বাম হাত উঠে এল এবং আঁকড়ে ধরল আহমদ মুসার হাত।
আহমদ মুসা তাকে টেনে তুলল এবং জড়িয়ে ধরল। আহমদ শাহ আলমগীরও আহমদ মুসাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
‘তুমি ঠিক আছ আহমদ শাহ আলমগীর?’ নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমার সব দুঃখ, সব বেদনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। আমি আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি। তিনি আমাকে উদ্ধার করতে এসেছেন, উদ্ধার করেছেন।’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল আহমদ শাহ আলমগীর। তার শেষ কথাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আহমদ মুসা নরমভাবে আহমদ শাহ আলমগীরকে পিঠ চাপড়ে সান্তনা দিল। বলল, ‘আমি আহমদ মুসা তুমি কি করে জানলে?’
‘আপনি বিভেন বার্গম্যান, ওরফে আহমদ মুসা। আপনার সব কথাই ওরা গল্প করতো এবং বলতো, ‘আহমদ মুসা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে সত্য, তবে আহমদ মুসা কেন তার বাবাও পারবে না তোকে উদ্ধার করতে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম।’
আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে একটু উঁচু করে বাক্সের বাইরে নিয়ে এল। বলল, ‘তোমার কাছ থেকে অনেক কথা শোনার আছে। চলো আগে বোটে, হাঁটতে পারবে?’
আহমদ শাহ আলমগীর কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সিবিআই কর্নেল বলল আহমদ মুসাকে, ‘স্যার শাহ সাহেবের বাক্সে শোয়া অবস্থায় একটা ফটো নেয়া হয়েছে, বাক্সের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় একটা ছবি নিতে চাই স্যার।’
‘অবশ্যই, আপনার আইনের জন্যে যা যা প্রয়োজন, তা অবশ্যই করবেন।’
বলে আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে বাক্সের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সরে এল।
কিন্তু আহমদ শাহ আলমগীর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। টলে উঠল তার দেহ।
সিবিআই-এর ক্যামেরা ক্লিক করে উঠল।
বাক্সের পাশে টলায়মান আহমদ শাহ আলমগীরের দেহটাই ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেল।
আহমদ মুসা এবং কর্নেল সুরেন্দ্র দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল আহমদ শাহ আলমগীরকে। পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল সে।
‘স্যার এঁর দেহের কাঠামোটা শুধু ঠিক আছে, দীর্ঘ নির্যাতন তাঁর দেহের আর কিছু বাকি রাখেনি। দেখুন দুই হাতের কব্জিই ক্ষত-বিক্ষত। মনে হয় ভেতরে ঘা এখনও কাঁচা আছে। বাহুতেও দেখুন অনেক কালচে দাগ। কাপড়ের নিচে দেহের অবস্থা যে কি ঈশ্বর জানেন।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘আল্লাহর অশেষ প্রশংসা কর্নেল। তাদের এতসব নির্যাতন ব্যর্থ হয়েছে। নির্যাতনের ভয়াবহ শক্তিকে পরাজিত করতে পেরেছে আহমদ শাহ আলমগীর। ওরা যা চেয়েছিল তার কাছ থেকে তা পায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ সম্ভবত এই যে, তার দেহের শক্তি যত কমেছে, মনের শক্তি তত বেড়েছে।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র বলল, ‘স্যার চলুন একে তাড়াতাড়ি বোটে নিয়ে যাই। কিছু খাওয়াতে হবে। আমাদের কাছে চা, জুস ও শুকনো খাবার আছে।’
‘হ্যাঁ চলুন। সত্যই ওকে খাওয়ানো প্রয়োজন। কখন খেয়েছে কে জানে? আর তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার তাকে দেয়া হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
দু’জনে দুদিক থেকে ধরে আহমদ শহা আলমগীরকে বোটে তুলল।
বোটের কেবিনে বিছানা পাতাই ছিল।
আহমদ শাহ আলমগীরকে অজু করিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল আহমদ মুসা।
একজন সৈনিককে নিয়ে প্রবেশ করল কর্নেল সুরেন্দ্র। কর্নেল সুরেন্দ্রের হাতে পানির একটি বোতল, জুসের ক্যান এবং সৈনিকের হাতে পেপার প্লেটে শুকনো খাবার ও চা।
আহমদ শাহ আলমগীরকে খাবার দিয়ে কর্নেল সুরেন্দ্র আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার ওদিকের একটা ব্যবস্থা করতে হয়। কে কিভাবে আমরা যাব ঠিক করে ফেলতে হয়।’
‘দিল্লী কি বলছে?’
‘দিল্লী থেকে সিবিআই এর একটা টীম পোর্ট ব্লেয়ারে আসছে, তারা গভর্নর বিবি মাধবকে দিল্লী নিয়ে যাবে। আর অন্য সব বন্দীরা এখানে থাকবে। তাদের জিজ্ঞাসাবাবদ করে মহাসংঘের সব তথ্য জানতে হবে। ‘মহাসংঘে’র সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
‘নাইস। বন্দীদের নিয়ে সবাই এক সাথে যেতে পারলে ভাল হয়। আমাদের দুটি বোট আছে। তৃতীয় একটি বোট ডোবানো আছে, এ বোটেই আমি এসেছিলাম। তিনটি হলেও এক সাথে আমরা যেতে পারছি না। এই……….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই কর্নেল সুরেন্দ্র বলে উঠল, ‘স্যরি স্যার মাঝখানে কথা বলার জন্যে। এক সাথে আমরা যাচ্ছি না। আমার সহকারী মেজর বীরবল সৈনিকদের নিয়ে এখানে থাকছে। আমরা মাত্র জনাছয়েক সৈনিক ও বন্দীদের নিয়ে এখন পোর্ট ব্লেয়ারে যাব। মেজর বীরবলরা মহাসংঘের রস দ্বীপের ঘাঁটি সার্চ করে তথ্য প্রমাণাদি যা পায় তা নিয়ে পরে পোর্ট ব্লেয়ারে যাবে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পুলিশ আসার জন্যেও তাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। ঘাঁটির দায়িত্ব পুলিশের হাতে ন্যাস্ত করার আগে তারা যেতে পারবে না।’
‘ওকে কর্নেল, সঠিক সিদ্ধান্ত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। তাহলে ওদিকটা দেখি। সব ব্যবস্থা করে ফেলি।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘ওকে কর্নেল।’
কর্নেল সুরেন্দ্র উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
খাওয়া শেষ করেছে আহমদ শাহ আলমগীর।
খাবারের অবশিষ্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল সৈনিকটি।
সৈনিকটি বেরিয়ে যেতেই আহমদ শাহ আলমগীর পশ্চিম দিকে ঘুরে সিজদায় পড়ে গেল। দীর্ঘক্ষণ সিজদায় থাকল।
সিজদা থেকে উঠে সালাম ফিরিয়ে ঘুরে বসল আহমদ মুসার দিকে।
তার চোখে অশ্রু। বলল সে, ‘আপনার আন্দামানে আগমন অকল্পনীয় এক ব্যাপার। আল্লাহর অসীম দয়া। আমার এবং আমাদের সাহায্যের জন্যেই আপনাকে তিনি এখানে এনেছেন। যাদের কেউ থাকে না, আল্লাহ বোধ হয় এভাবেই তাদের সাহায্য করেন।’ কান্না জড়ানো কণ্ঠ আহমদ শাহ আলমগীরের।
‘অবশ্যই।’ বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। বলল, ‘তোমার আম্মা, শাহবানু, সুষমার সাথে কথা বলো। ওঁরা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আছে।’
‘আমার মা-বোন এবং পরে সুষমাকে কিডন্যাপ করেছে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করার অস্ত্র হিসাবে এটা আমি ওদের কাছেই শুনেছি। আবার ওঁরা তাদের হাতছাড়া হয়েছে, সে কথা বলেও তারা আমাকে নির্যাতন করেছে। আমি তখনই বুঝেছি, আপনিই তাদের উদ্ধার করেছেন।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা মোবাইল কল করতে করতে বলল, ‘ধর তাদের যদি তোমার সামনে নিত আর তাদের নির্যাতন করতো, তাহলে কি ওদের প্রার্থীত তথ্য দিয়ে দিতে ওদেরকে?’
‘আমার বলার কিছু ছিল না। ওরা যা জানতে চায় আমিতা জানি না।’ আহমদ শাহ আলমগীর বলল।
‘শোন আহমদ শাহ আলমগীর, ঐ বিষয়টা কি? তা জানার খুব ইচ্ছা আমারও। কোন তথ্য বা কি তোমার কাছে ওরা জানতে চাচ্ছিল?’ বলল আহমদ মুসা দ্রুতকণ্ঠে এবং আগ্রহের সাথে।
‘জি, সেটা এক বাক্সের কথা।’ বলতে শুরু করল আহমদ শাহ আলমগীর, ‘বাক্সটিতে না কি আছে…………।’
আহমদ মুসা হাত তুলে ইশারা করে থামতে বলায় থেমে গেল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা মোবাইলে কল পেয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে শুরু করেছিল।
…………..আমি ভাল আছি, আহমদ শাহ আলমগীর ভাল আছে। খালাম্মাকে ডাক। আহমদ শাহ আলমগীরের সাথে কথা বল।’
আহমদ মুসা মুখ থেকে মোবাইল সরিয়ে আহমদ শাহ আলমগীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শাহবানুর সাথে কথা বল। খালাম্মা আসছে। এঁদের সাথে কথা শেষ কর, তারপর সুসমার সাথেও লাগিয়ে দেব।’
আহমদ শাহ আলমগীরের চোখ-মুখ মুহূর্তেই আনন্দ-আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে দ্রুত হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিল।
আহমদ মুসা তার হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে বলল, ‘তুমি কথা বল, আমি এখুনি আসছি।’
বলে আহমদ মুসা বোটের কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। আহমদ মুসা চাইল, আহমদ শাহ আলমগীর সংকোচহীন পরিবেশে প্রাণখুলে কথা বলুক। সুষমার সাথে আহমদ শাহ আলমগীরের কথা বলার অবস্থা কেমন হবে, সেটাও ভাবনায় এল আহমদ মুসার। কান্না ও বাঁধভাঙ্গা আবেগের বন্যা নিশ্চয় দুজনের কণ্ঠই রুদ্ধ করে দেবে। এই না বলার মধ্যেই তাদের সব বলা হয়ে যাবে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
৪৩. পাত্তানীর সবুজ অরণ্যে

Tags