৪৩. পাত্তানীর সবুজ অরণ্যে

চ্যাপ্টার

অদ্ভুত একটা জায়গা।
দু’পাহাড়ের মাঝখানে উঁচু পাথুরে-উপত্যকা।
উপত্যকাটা খুব বড় নয়।
পঞ্চাশ বর্গগজের বেশি হবে না।
এর উত্তর ও দক্ষিণে পাহাড়ের দেয়াল। পশ্চিমে ছোট্ট একটা গভীর হ্রদ। আর পূর্বে বিরাট জলাভূমি। এ জলাভূমি দক্ষিণে এগিয়ে গেছে পাত্তানী নদী পর্যন্ত। এখান থেকে পাত্তানী নদীর দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মত….. যেখানে পাত্তানী নদী একটা হ্রদে গিয়ে পড়েছে। পাত্তানীর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর ‘ইয়ালা’ এখান থেকে ৫০ কিলোমিটারের মত দূরে।
দু’পাহাড়ের কোলের এই ছোট্ট পাথুরে উপত্যকার আকাশটা আরও অদ্ভুত। দু’দিক থেকে পাহাড়ের মাথাটা কার্নিসের মত এগিয়ে এসে উপত্যকার আকাশকে ঢেকে দিয়েছে।
এই উপত্যকায় গড়ে উঠেছে একটা পাথুরে বাড়ি। বাড়িটা কতকটা দুর্গের ষ্টাইলে তৈরি।
বাড়িটার একটা কাহিনী আছে। পাত্তানী অঞ্চলের মুসলিম সালতানাতগুলো যখন থাই রাজার অধীনে চলে যায়, তখন রাজ্যচ্যুত সুলতান আবদুল কাদির কামালুদ্দিন জংগলে পালিয়ে এসে বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু করেন। তিনিই সে সময় মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছাকাছি দীগন্ত প্রসারী ঘন জংগলের মধ্যে দু’পাহাড়ের মাঝখানের এই দুর্গম স্থানে তাঁর বিদ্রোহের রাজধানী গড়ে তোলেন। পরবর্তী কালে তার সশস্ত্র আন্দোলন যখন অস্ত্র পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ফিরে আসে, তখন বিদ্রোহের রাজধানী পরিত্যাগ করে তারা চলে যায় এবং বাড়িটা চোর-ডাকাত ও বেআইনি কাজের আড্ডা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে আসা-যাওয়ার মাধ্যম হলো নৌকা বা অন্য কোন জলযান।
একটা সুন্দর বোট এসে উপত্যকার পূর্ব তীরে নোঙর করল।
পানির লেভেল থেকে উপত্যকার সারফেস প্রায় বিশ ফিট উপরে। স্থানান্তরযোগ্য একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠা-নামা করা যায়।
নিচে বোট থেকে কিংবা দূর থেকে উপত্যকটার বাড়িটা দেখা যায় না। গোটা পাহাড় এবং পাহাড়ের গা ঘন বনে আচ্ছাদিত।
বোটটা উপত্যকায় ভীড়তেই বোটের কেবিন থেকে বেরিয়ে এল প্রায় ৬ ফুট লম্বা তীরের মত ঋজু দেহের একজন মানুষ।
সে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই মাঝারী শব্দে তিনবার তিন নিয়মে বোটটার হর্ন বেজে উঠল।
সংগে সংগেই ক্রেন জাতীয় কিছুর মাথা উপত্যকার ফ্লোরের বাইরে বেরিয়ে এল। ক্রেনের মাথায় প্রায় গার্ড বক্সের মত বড় ষ্টিল বক্স। সেই বক্স থেকে নেমে এল লিফট, একেবারে বোটের ওপর। বোটের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসা লোকটি লিফটে উঠে বসল।
লিফট উঠে এল উপরে।
ক্রেনটি গুটিয়ে গিয়ে লিফটিকে বাড়িতে প্রবেশের গেটে নামিয়ে দিল।
গেট থেকে লাল পাথরের একটা রাস্তা সোজা এগিয়ে একটা উঁচু বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে পৌছেছে। এই রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ ঘর। ঘরগুলোর দরজা ও জানালা জাতীয় গবাক্ষগুলো দেখলে মনে হয় এগুলো দুর্গমুখের প্রতিরক্ষা আয়োজনের অংশ। গবাক্ষগুলো দিয়ে বন্দুক ব্যবহার করা যায়, কামানও ব্যবহার করা যায়।
গেটের ভেতরে দু’পাশে দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে ছিল।
বোট থেকে উঠে আসা লোকটি ডিজিটাল লক ব্যবহার করে গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই সামরিক কায়দায় স্যালুট দিল।
লোকটি এগোলো লাল রাস্তা ধরে উঁচু বারান্দার দিকে। গেটের চারজন প্রহরীর দু’জন চলল তার পিছু পিছু।
পাঁচ ধাপের সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে লোকটি ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দা পেরিয়ৈ বন্ধ দরজার সামনে।
সংগে সংগে দরজা খুলে গেল।
সোফায় সাজানো ঘরটি।
একটি সোফায় বসেছিল তিনজন লোক। ভদ্র পোশাক, কিন্তু খুনি চেহারা।
লোকটি ঘরে ঢুকতেই তিনজনই উঠে দাঁড়াল।
‘মি. আশের, লেভিকে দেখছি না। সে কোথায়?’
তিন জনের একজনকে লক্ষ্য করে বলল লোকটি।
তিনজনের যে লোকটি সামনে ছিল, সে হাতের গগলসটা পকেটে রেখে বলল, ‘মি. হাবিব হাসাবাহ স্যার, আপনার নির্দেশক্রমে লেভিকে পাত্তানীতে আসা আগন্তুককে অনুসরণ করার জন্যে পাঠানো হয়েছিল। সে ফেরেনি, কোন খবরও দেয়নি। আমরা এখানে আসার পূর্ব পর্যন্ত তাকে পাত্তানী শহর, ও সুলতান গড়সহ আশে-পাশের সব এলাকায় খুঁজেছি। পাওয়া যায়নি তাকে।’
কথার ওপর কোন মন্তব্য না করে হাবিব হাসাবাহ সামনের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘এসো তোমরা।’
হাবিব হাসাবাহ প্রবেশ করল যে ঘরে, সেটা একটা বড় অফিস কক্ষ।
ঘরের মাঝখানে বড় একটি টেবিল। টেবিলের সামনে চারটে চেয়ার। টেবিলের ওপাশে একটি বড় রিভলভিং চেয়ার রয়েছে। তার বাম পাশে সাইড টেবিলে একটা কম্পিউটার। কম্পিউটারের ওপাশে সাইড টেবিলে একা সুইচ বোর্ড রাখা। তাতে নানা রঙের ও আকারের অনেকগুলো সুইচ।
হাবিব হাসাবাহ গিয়ে রিভলভিং চেয়ারে বসল। বসতে বলল ওদের তিনজনকে সামনের চেয়ারে।
হাবিব হাসাবহ থাইল্যান্ডের ‘ব্ল্যাক ঈগল’-এর প্রধান। সে লেবাননের ইহুদী বংশোদ্ভুত। আমেরিকায় সে বড় হলেও অনর্গল আরবী বলতে পারে। আরবী পোশাক পরলে তাকে একজন জবরদস্ত আলেম বলে মনে হয়। মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় আলেমের পোশাকই সে পরিধান করে।
‘পাওয়া যায়নি তাকে, এর অর্থ কি তোমরা মনে করছ?’ বসেই প্রশ্ন করল হাবিব হাসাবাহ।
আশের নামের লোকটি বলল, ‘অন্তত সে স্বাধীন অবস্থায় নেই স্যার।’
‘না সে বন্দী নেই। তোমরা ভুলে যাচ্ছ কেন, সে বন্দী থাকলে সিগন্যাল পাঠাবার মত ব্যবস্থা তার কাছে আছে।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
‘স্যরি স্যার, বিষয়টা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনার কথাই ঠিক স্যার, সে বন্দী নেই।’ বলল বসে থাকা তিনজনের মাঝের জন।
‘কিন্তু ড্যান, এটা ঠিক না হলেই ভাল হতো।’ হাবিব হাসাবাহ বলল।
‘স্যরি স্যার।’ বলল ড্যান।
আশের, ড্যান এবং অন্যজন লাদিনো-এই তিনজনই হাবিব হাসাবাহর দক্ষিণ হস্ত। এই তিনজনই মিসরীয় ইহুদী। কিন্তু তারা লেখাপড়া করেছে আমেরিকায়। এরা আঞ্চলিক আরবীও অনর্গল বলতে পারে, এই নামগুলো তাদের প্রকৃত নামের অংশ। কিন্তু প্রকাশ্যে এই নাম ব্যবহার হয় না। বাইরের জন্যে তাদের চমৎকার মুসলিম নাম রয়েছে। ‘আশের’-এর মুসলিম নাম শেখ আবু দাউদ, ড্যান-এর নাম শেখ আমর ঈসা এবং লাদিনোর নাম শেখ আলী ইলিয়াস। হাবিব হাসাবহারও বাইরের পরিচয় শেখ হাবিব হাসাবাহ।
‘ঠিক আছে। আগন্তুক সম্পর্কে কি জান তোমরা?’
‘তার ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি স্যার। তাকে আমরা প্রথম দেখি চাস্ফুতে। নিয়ম অনুযায়ী আমাদের লোকরা ‘চাস্ফু’ জংশনে রেল ও সড়কপথে আসা নতুন লোকদের ওপর নজর রাখছিল। নাখো সান্তান থেকে আসা বাস পরিবর্তনের জন্যে নামা একজন শিখ যাত্রী আমাদের লোকদের বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একজন শিখ যুবক সে। মাথায় বাদামী পাগড়ী মুখ ভরা দাড়ি। গায়ে ইংলিশ পোশাক একদম আধুনিক শিখ। কিন্তু এলাকার কিছুই চেনে না। এমনকি ট্রেন থেকে নেমে কোন দিকে যাবে কি করবে এটা নিয়েও দ্বিধায় পড়েছিল। পদে পদে জিজ্ঞাসা করে সামনে এগুচ্ছিল। সুযোগ বুঝে আমাদের লোকরা তার কাছে যায় এবং তাকে সাহায্য করার সুযোগ নেয়। যাত্রী পরিচয়ে তার সাথেই বাসে ওঠে লেভি। সর্বশেষ যোগাযাগ হয় তার সাথে মোবাইলে। ফটথালং বাস ষ্টেশনের গাড়ি থেকে সে আমাকে মোবাইলে জানায়, লোকটির নাম বাজাজ সিং। পাত্তানী শহরের জন্যে টিকিট করলেও তার আগেই সুলতান গড়ে সে নামবে। আমি আমার মুসলমান নাম ‘জহীর উদ্দিন’ বলেছি। তাতে তার কোন প্রতিক্রিয়া বুঝিনি। এ পর্যন্ত তার সাথে কথা বলে কিছুই আদায় করতে পারিনি। তবে সন্দেহের বিষয় হলো, সুলতান গড়ে কোথায় যাবে এই প্রশ্ন সে এড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, সে-ই আমাকে প্রশ্ন করেছে বেশি। তার প্রশ্নের মূল বিষয় হলো, এদিকের আইন-শৃঙ্খলা কেমন, কিছু সংঘর্ষের ঘটনা মানুষকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে ইত্যাদি। লেভি’র এই কথাগুলো স্যার আমাকেও সন্দিগ্ধ করে তোলে। আমি তাকে বাজাজ সিংকে অনুসরণ করা অব্যাহত রাখতে বলি। এখানেই তার সাথে আমার কথা শেষ হয়। তারপর ঘণ্টা দুয়েক পর্যন্ত তার কোন টেলিফোন না পেয়ে আমিই তাকে টেলিফোন করি। কিন্তু তার কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। সুলতান গড়ে আমরা যাই। কিন্তু তার সন্ধান মেলেনি।’
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ড্যান।
‘তুমি ঠিকই বলেছ ড্যান, কথাগুলো সন্দেহের। সংঘর্ষগুলো কেন এবং কোন ঘটনা বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এসব তো পত্র-পত্রিকা থেকেই জানা গেছে। সে প্রশ্ন করে তা জানার চেষ্টা করল কেন? তার মানে সে অন্য কিছু জানতে চায়। এমনও হতে পারে যে, পরে আরও আলোচনা হয়েছে এবং আরও কিছু জানাজানি হয়েছে। তার ফলে কিছু ঘটে থাকতে পারে। এখন প্রয়োজন বাজাজ সিংকে খুঁজে বের করা।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
‘স্যার, বিভেন বার্গম্যান কি সত্যি চলে গেছেন?’ প্রশ্ন করল লাদিনো।
‘বৃটিশ এয়ারওয়েজের হিথ্রোগামী একটি ফ্লাইটে বোর্ডিং কার্ড সে নেয়। যাত্রী তালিকায় তার নাম আছে, এ খবর আমি পেয়েছি। সুতরাং ঐ ব্যাপারে সন্দেহ করার এখনও কিছু ঘটেনি।’ হাবিব হাসাবাহ বলল।
কথা বলার জন্য মুখ খুলেছিল ড্যান। হাবিব হাসাবাহ তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এ প্রসঙ্গ আপাতত থাক।’ এরপর বলল, ‘বিবৃতিটি জাবের জহীর উদ্দিনকে দিয়ে সই করিয়েছ?’
মুখ বিমর্ষ হয়ে উঠল ড্যানের। বলল, ‘সই’ করানো যায়নি স্যার। তার এক কথা তোমাদের কোন সহযোগিতা আমরা করব না। তাকে বাধ্য করার জন্য যা করা প্রয়োজন, তা আমরা করেছি। সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে, কিন্তু সে রাজি হয়নি।’
‘তাকে নিয়ে এসো।’ নির্দেশ দিল হাবিব হাসাবাহ।
সংগে সংগেই আশের ও ড্যান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পরেই জাবের জহীর উদ্দিনকে নিয়ে তারা ঘরে প্রবেশ করল।
বাইশ-তেইশ বছরের যুবক জাবের জহীর উদ্দিন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। সোনালী গায়ের রং। তার মধ্যে চাইনিজ চেহারাই বেশি স্পষ্ট। পরতে গ্যাবাডিন জাতীয় কাপড়ের প্যান্ট। গায়ে সার্ট নেই, একটা জ্যাকেট মাত্র। বোতাম খোলা। মাথার চুল ছোট। আঁচড়ানো নয়।
জাবের জহীর উদ্দিনকে নিয়ে ওরা ঘরে ঢুকতেই হাবিব হাসাবাহ তার বাম পাশের সাইড টেবিলে রাখা সুইচ বোর্ডের একটা সুইচ টিপে দিল। সংগে সংগেই তার টেবিলের ডান দিকে একটু দূরে মেঝের একটা অংশ সরে গেল এবং সেই সুড়ঙ্গ পথে বড় আকারের হাতল ওয়ালা চেয়ার উঠে এল। চেয়ারের সাথে নানা রকম তারের সংযোগ। হাবিব হাসাবহ আরেকটা সুইচ টিপতেই চেয়ারটির ওপর চোখ ধাঁধানো বাল্ব নেমে এল ছাদের দিক থেকে।
‘জাবেরকে চেয়ারে বসিয়ে দাও আশের।’ হাসাবাহ বলল ভারী গলায় আদেশের সুরে।
আশের ও ড্যান জাবেরের দু’হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বসাল সেই চেয়ারে।
জাবের একটুও আপত্তি না করে বসল চেয়ারে। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কিন্তু চোখ দু’টি বড় উজ্জ্বল।
হাবিব হাসাবাহ তার চেয়ার একটু ঘুরিয়ে নিয়ে মুখোমুখি হলো জাবের জহীর উদ্দিনের। বলল, ‘জাবের তুমি ষ্টেটমেন্ট সই করোনি কেন?’
‘আমি তোমাদের জঘন্য ষড়যন্ত্রের সহযোগী হবো, তা তোমরা ভাবলে কি করে?’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন দৃঢ়কণ্ঠে।
‘তুমি তো আমাদের সহযোগিতা করছ। খুবই মূল্যবান সহযোগিতা। সেদিন তোমার আঙুল কেটে তার রক্তে তোমার জামা রাঙিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা আমাদের খুব কাজ দিয়েছে।’
‘কি কাজ দিয়েছে?’ বিস্ময়ের সুরে বলল জাবের জহীর উদ্দিন।
‘সেটা শুনে তোমার কাজ নেই। শোন ষ্টেটমেন্টে স্বাক্ষর করা এবং ভিডিও ক্যামেরার সামনে কিছু বলে আমাদের সহযোগিতা তোমাকে করতে হবে।’ শক্ত কণ্ঠ হাবিব হাসাবাহর।
‘আমি আমার কথা বলে দিয়েছি, জ্ঞানত এবং প্রত্যক্ষভাবে কোন সহযোগিতাই আমি তোমাদের করব না। তোমরা মুসলমানদের শত্রু, ইসলামের শত্রু, আমাদের মাতৃভূমি থাইল্যান্ডের শত্রু।
হো হো করে হাসল হাসাবাহ। বলল, ‘শত্রু আমরা নই। সরকারের খাতায় শত্রু তুমি। তুমি শত্রু হিসাবেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলে। তারপর তুমি তোমার সন্ত্রাসী সংগীদের সহায়তায় পালিয়ে এসেছ। এখন পুলিশ হন্যে হয়ে গোটা দেশে তোমাকে খুঁজছে, আমাদের নয়। আগের জীবনে ফিরে যাবার আর কোন পথ তোমার নেই। সুতরাং আমাদের সাহায্য তোমাকে করতেই হবে।’
‘পুলিশ এবং সরকার আমাদের ভুল বুঝেছে। এ ভুল তাদের একদিন ভাঙবে।’
‘হয়তো ভাঙবে। কিন্তু তা শোনার জন্যে তোমরা কেউ বেঁচে থাকবে না, এমনকি ‘পাত্তানী’ নামটাও তখন বেঁচে নাও থাকতে পারে।’ বলল হাবিব হাসাবাহ। তার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি।
‘হ্যাঁ তোমরা এটাই চাচ্ছ। কিন্তু জেনে রেখ, তোমরা ষড়যন্ত্রকারীরা সর্বশক্তিমান নও। আল্লাহই সর্বশক্তিমান।’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন।
আল্লাহর নাম শুনেই ক্রোধে ফুঁসে উঠল হাবিব হাসাবাহ। বলল, ‘জান, তোমার ঐ চেয়ার ও চেয়ারের তারগুলোই সর্বশক্তিমান। একটা সুইচ টিপলেই তারগুলো তোমার দেহে যন্ত্রণার জাহান্নাম সৃষ্টি করবে আর চেয়ার তোমাকে একবিন্দু নড়তে দেবে না, মুখও খুলতে পারবে না চিৎকারের জন্যে। যন্ত্রণার আগুন তাতে আরও দাউ দাউ করে বাড়বে।’
‘হ্যাঁ এ শক্তিটুকু তোমাদের আছে। কিন্তু আমাকে পক্ষে নেবার শক্তি তোমাদের নেই।’ বলল দ্বীধাহীন কণ্ঠে জাবের জহীর উদ্দিন।
সংগে সংগে কোন উত্তর এল না হাবিব হাসাবাহর তরফ থেকে। তার দৃষ্টি জাবের জহীর উদ্দিনের ওপর নিবদ্ধ। দৃষ্টিতে একটা শূন্যতা। ভাবছে সে।
হঠাৎ তার ঠোটে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তোমার বোনের নাম যয়নব যোবায়দা না? খুব সুন্দর নাম।’
জাবের জহীর উদ্দিন কোন উত্তর দিল না। কিন্তু তার চোখ দুটি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শয়তান তার বোনের কথা জিজ্ঞাসা করছে কেন?’
‘তোমার বোন খুব সুন্দরী না? ঠিক খলিফা হারুন অর রশীদের মহিয়সী যোবায়দার মত?’
এবারও কোন কথা বলল না জাবের জহীর উদ্দিন। কিন্তু কেঁপে উঠেছে তার অন্তরটা। তার প্রিয় বোন, একমাত্র বোন যয়নব যোবায়দার সম্মান ও মর্যাদার চেয়ে বড় কিছু নেই তার এই দুনিয়ায়।
আবার কথা বলে উঠল হাবিব হাসাবাহই। বলল, ‘কথা বলছ না কেন? শক্তি, দৃঢ়তার বাহাদুরী এতটুকুই! বোনের নাম শুনেই কথা বন্ধ হয়ে গেছে, মর্যাদায় আঘাত লেগেছে। কিন্তু জান কি, তোমার সুন্দরী বোন এখন আমাদের কব্জায়?’
‘কি বলছ তোমরা, এ হতে পারে না?’ প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল জাবের জহীর উদ্দিনের কণ্ঠ।
‘এ হতে পারে, হয়েছে। তুমি যদি চাও তাকে এখানে নিয়ে আসছি। তোমার সামনেই তার সর্বস্ব লুণ্ঠনের ব্যবস্থা করছি।’
‘না আমার বোনের গায়ে তোমরা হাত দিতে পারবে না। আমার সাথে তোমাদের বাগড়া। আমার বোনকে এর মধ্যে তোমরা টেনে এন না।’ ব্যাকুল, বিনীত জাবের জহীর উদ্দিনের কণ্ঠ।
মুখে হাসি ফুটে উঠল হাবিব হাসাবাহর। বলল, ‘তুমি যদি এটা চাও, সেটা হতে পারে এক শর্তে।’
‘সেটা কি?’
‘আমরা যেভাবে চাইব, তুমি আমাদের সাহায্য করবে?’
সংগে সংগে উত্তর দিতে পারল না জাবের জহীর উদ্দিন। তাদের শর্ত তার কাছে হিমালয়ের মত দুর্বিষহ। কিন্তু তার বোনের নিষ্পাপ চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এই বোনকে হায়েনার গ্রাসে কি করে সে ঠেলে দেবে। মনটা তার হু হু করে কেঁদে উঠল। তার মন বলে উঠল, বোনকে রক্ষা করাই আশু দায়িত্ব। অন্য দায়িত্বের কথা পরেও সে চিন্তা করতে পারবে।
জাবের জহীর উদ্দিনকে নিরব থাকতে দেখে হাবিব হাসাবাহ বলল, ‘তাহলে তোমার সিদ্ধান্তে তুমি অটল। তাহলে…………..।’
হাবিব হাসাবাহর কথা শেষ করতে না দিয়ে জাবের জহীর উদ্দিন বলল, ‘আমি তোমাদের শর্তে রাজি। তবে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তোমরা তার কোন অসম্মান করোনি এবং তাকে ছেড়ে দিতে হবে।’
জাবের জহীর উদ্দিনের কথা শুনেই হাবিব হাসাবাহ বলে উঠল, ‘তোমার শর্ত মঞ্জুর জাবের। আমি এখনি বেরুব। কাল সকালে আমি আসব। তখন তোমার বোনের সাথে কথা হওয়ার পর বিষয়টা চুড়ান্ত হবে।’
‘এখন কেন নয়?’ জাবের জহীর উদ্দিন বলল।
‘তোমার বোনকে ভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। এখন আমার অসুবিধা আছে। কাল সকালে তাকে নিয়ে আসব।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
তাকাল জাবের জহীর উদ্দিন হাবিব হাসাবাহর দিকে। তার চোখে সন্দেহ।
বুঝতে পেরে হাবিব হাসাবাহ বলল, ‘আমি বলেছি জাবের তোমার বোনের কোন ক্ষতি হবে না।’
বলেই হাবিব হাসাবাহ আশেরকে বলল, ‘যাও জাবেরকে নিয়ে যাও। রেখে তাড়াতাড়ি এসো।’
জাবেরকে রেখে আশের ফিরে এল দু’মিনিটের মধ্যেই।
আশের ঘরে ঢুকতেই হাবিব হাসাবাহ বলল, ‘কি ঘটল ড্যানরা কিছু বুঝতে পারছ না। বল দেখি তুমি কি বুঝেছ?’
‘স্যার ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া হয়েছে।’ বলল আশের।
‘না ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া নয়, ঘোড়া ছাড়াই গাড়ি দৌড়ানো হলো বলা যায়। এখন যয়নব যোবায়দাকে হাজির করতে পারলেই কেল্লা ফতে।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
‘এটাই তো আসল বিষয় স্যার। সকালে তাকে যদি হাজির করা না যায়?’ ড্যান বলল।
‘যদিও এর কোন স্কোপ নেই। কাল সকালের মধ্যে যয়নব যোবায়দাকে এখানে হাজির করতে হবে যেভাবেই হোক। আজ এই সময় পর্যন্ত যয়নব যোবায়দা সুলতান গড়ের বাইরে যায়নি। সুলতান গড়ের ওপর যারা চোখ রাখছে, তাদের বলে দাও গোপনে যয়নব যোবায়দার অবস্থান যেন ঘেরাও করে রাখে এবং গতিবিধিকে ঘনিষ্ঠভাবে ফলো করে। অবিলম্বে তোমরা যাও। সবাই মিলে তাকে তুলে নিয়ে এসো। দেখ, তার যেন কোন অসম্মান না হয়। তার মর্যাদাহানিকর কোন কিছু হয়েছে তা যেন বলতে না পারে। তোমরা যাও।’
বলে উঠে দাঁড়াল হাবিব হাসাবাহ।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
হাবিব হাসাবাহকে অনুসরণ করে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সুলতান গড়ে নেমে আহমদ মুসা প্রথমেই যে কাজটা করেছিল, সেটা শিখের পোশাক পরিবর্তন। ট্রেনে তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু চাস্ফু জংশনে নামার পর তার মনে সন্দেহ হয়েছে। তার পোশাক দেখে ও কথা শুনে অনেকেরই চোখে-মুখে সন্দেহের ভাঁজ পড়তে দেখেছে। এই সন্দেহ নিয়েই তাকে তারা সহযোগিতা করেছে, হয়ত পিছুও নিয়েছে। মুসলমানরা সন্দেহ করছে এই শিখ তাদের এলাকায় কেন? সরকারি কিংবা বিদেশী গোয়েন্দা নয় তো? এমন সন্দেহ মুসলমানদের চোখে-মুখে দেখেছে। আবার অমুসলমানরাও অনুরূপ চিন্তা করেছে। তারা ভেবেছে ছদ্মবেশে আমি তাদের কোন প্রতিপক্ষ এলাম কিনা। এ রকম একজন জহীর উদ্দিনের কথা তার মনে পড়ল। সে তাকে ফলো করেছে চাস্ফু ষ্টেশন থেকে। প্রথমে আহমদ মুসা তাকে মুসলমান মনে করেছিল। কিন্তু কিছু কথা ও ঘটনায় তাকে সন্দেহ হয় যে সে প্রতিপক্ষ বা পুলিশের চর। হঠাৎ সে উধাও হয়ে যায় সুলতান গড়ের কাছাকাছি একটা বাস ষ্টেশনে নামার পর। ব্যাপারটি বিস্ময়কর মনে হয়েছে আহমদ মুসার কাছে। একটা বিষয় সে নিশ্চিত যে গোটা পাত্তানীকেই সংশয়, সন্দেহ ও সংঘাতের এক উর্বর ভূমি করে তোলা হয়েছে। আহমদ মুসা যেদিন ব্যাংকক থেকে পাত্তানী আসার জন্যে যাত্রা করেছে, সেই দিনই পাত্তানী শহরের উপকণ্ঠের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি এক দুঃসাহসিক হামলার শিকার হয়। ডজন খানেকেরও বেশি সৈনিক মারা যায়, লুট হয় অস্ত্র ভান্ডার। এই ঘটনার উত্তাপ উত্তেজনা এখনও এলাকার মানুষকে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে নতুন লোকদের খুব বিপদ। তারা সব পক্ষেরই সন্দেহের শিকার হয়।
ষ্টেশনের পাশের একটা ঝোপের আড়ালে পোশাক পাল্টে ব্যাংকক থেকে কেনা প্যান্ট, সার্ট ট্যুরিষ্ট জ্যাকেট ও ট্যুরিষ্ট ক্যাপ পরে বের হয়ে এসেছিল।
ব্যাংককে ভূমিবলের কাছে আহমদ মুসা শুনেছিল সুলতান গড় ষ্টেশন থেকে পূর্বে সাগরের তীরে সুলতান শহরের মূল এলাকা। এখানে একটা ভাল ট্যুরিষ্ট হোটেল আছে।
আহমদ মুসা সেখানে এসেছে। কিন্তু কোথায় খুঁজবে হোটেল জিজ্ঞাসা করে কারো সন্দেহের শিকার হতে চায়নি। কিন্তু কত ঘুরবে হোটেলের জন্যে!
শহরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত। কিন্তু গাড়ি-ঘোড়া দেখা যায় না বললেই চলে।
আহমদ মুসা রাস্তার বাম পাশের ফুটপাথ দিয়ে পূর্ব দিকে হাঁটছিল। শহরের পূর্ব প্রান্তের দিকে হোটেল পাওয়া যাবে বলে আহমদ মুসার বিশ্বাস।
আহমদ মুসার সমান্তরালে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল একজন গোয়ালা। একটা ঠেলা গাড়িতে করে দুধের ছোট ছোট জার নিয়ে সে হাঁটছিল। আহমদ মুসা ডাকে দুধওয়ালাকে। দাঁড়ায় দুধওয়ালা। সে সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটা প্রাইভেট কারও দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কারণে।
আহমদ মুসা ইংরেজি ও দুই একটি থাই শব্দ মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করে দুধওয়ালাকে যে এখানে ভাল হোটেল কোন দিকে। বুঝল না দুধওয়ালা আহমদ মুসার কথা কিছুই। কয়েকবার বুঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আহমদ মুসা।
রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো প্রাইভেটকার থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে। আঠার-বিশ বছর বয়সের তরুণী। বোরখা পরিহিত। মাথায় রুমাল বাঁধা। তার উপর একটা ওড়না মাথা ও গলায় জড়ানো। মুখ খোলা।
মেয়েটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে, ‘শহরের পূর্ব প্রান্তে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামলে সাগরের ধারে উপত্যকায় পর্যটক হোটেল পাবেন। এই রাস্তা ধরেই যেতে পারবেন।’
‘অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম।’ বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটির কথা মতই আহমদ মুসা পেয়ে যায় হোটেল।
হোটেল কক্ষে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে অজু করে ফ্রেস হয়ে বসতেই তার মোবাইল বেজে ওঠে। ব্যাংকক থেকে পুরসাত প্রজাদীপকের টেলিফোন। কুশল বিনিময়ের পর পুরসাত প্রজাদীপক বলে, ‘বিভেন তোমার যাওয়া বোধ হয় ধরা পড়ে গেছে ওদের কাছে। ওদের একজন বাসে তোমাকে ফলো করছিল, তাকে চিনতে পারে আমাদের একজন গোয়েন্দা। সুলতান গড়ের আগের বাসষ্টেশনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জাবের জহীর উদ্দিনকে যারা কোর্ট থেকে কিডন্যাপ করেছিল, তাদেরই একজন সে। কিন্তু তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যায়নি। আজ কোর্ট থেকে রিমান্ডে নিয়ে বের হয়ে আসার সময় তাকে কারা যেন গুলী করে মেরে ফেলেছে। কোন কথা আদায় করার আগেই এ ঘটনা ঘটে গেল।’
‘সে যে ‘ব্ল্যাক ঈগল’ গ্রুপের এবং ঐ কিডন্যাপের সময় সে উপস্থিত ছিল, তা আপনারা জানলেন কি করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমাদের কোর্টের ভিডিও ক্যামেরায় সবার ফটো ওঠে। এর মধ্যে যারা জীবিত আছে তাদের ফটো আমরা আলাদা করেছিলাম। এদের মধ্যে সেও আছে। অন্যদের সাথে তার ফটোও আমরা প্রত্যেক থানায় ও গোয়েন্দাদের কাছে সরবরাহ করেছিলাম।’
বলে একটু থামে পুরসাত প্রজাদীপক। পরক্ষণেই আবার বলে সে, ‘তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে বিভেন।’
‘কি দুঃসংবাদ?’ দ্রুতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তোমার চলে যাবার দু’দিন পর পাত্তানী শহরের উপকণ্ঠে যে সেনাফাঁড়ি আক্রমণ হয়েছিল, সেখানে জাবের জহীর উদ্দিনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’ বলেছিল পুরসাত প্রজাদীপক।
‘কি প্রমাণ?’
‘সংঘর্ষে সম্ভবত সে আহত হয়েছিল। রক্তরঞ্জিত একটা সার্ট ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে। রক্ত ও সার্টের পরীক্ষায় পাওয়া গেছে রক্ত ও সার্ট দুই-ই জাবের জহীর উদ্দিনের। এটা প্রমাণ হওয়ার পর আমার ও তোমার কিছু করার থাকল না বিভেন।’
‘রক্ত ও সার্ট জাবের জহীর উদ্দিনের এটা প্রমাণ হওয়ায় নিশ্চিত প্রমাণ হয় না যে সে ঐ সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিল। জাবের জহীর উদ্দিন এখন তাদের হাতে। তাদের ষড়যন্ত্রে সফল করার জন্যে তারা সবকিছুই করতে পারে। জাবের জহীর উদ্দিনের সার্ট এবং তার রক্ত সংগ্রহ কঠিন কাজ নয়।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘তোমার কথা ঠিক। কিন্তু এ কথা শুনবে কে বল। আর কে বিশ্বাস করবে। সরকারের হাতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে।’ বলেছিল পুরসাত প্রজাদীপক।
‘আমার মন বলছে, সব প্রমাণ খতিয়ে দেখা হয়নি। আপনি কি কষ্ট করে এটা নিশ্চিত করতে পারেন যে, ঘটনার সময়টা আর জহীর উদ্দিনের গায়ের জামায় যে রক্ত তার ক্ষরণের সময়টা একই ছিল?’ আহমদ মুসা বলে।
‘তোমার পয়েন্টটা বুঝেছি বিভেন। তোমাকে ধন্যবাদ। আমি এখনি এ পরীক্ষার ব্যবস্থা করছি। গুড লাক।’ বলে ওপার থেকে ফোন রেখে দিল পুরসাত প্রজাদীপক।

সুলতান গড় আসার পর ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। রাতে ঘুমানো ছাড়া সবটা সময় সে চষে বেড়িয়েছে গোটা সুলতান গড়। জাবের জহীর উদ্দিন ও যয়নব যোবায়দাদের বাড়ি বের করতে পারেনি সে। কাউকে জিজ্ঞাসা করেনি সন্দেহ এড়ানোর জন্যে। শ্রমিক-মজুর শ্রেণীর সাধারণ লোকরা নিরাপদ। কিন্তু সহজে তাদের কথা বুঝানো মুশকিল, আবার ওদের কথা বুঝাও মুশকিল। থাই-মালয়ী মিশিয়ে তারা এমন ভাষা বলে কিছুই বুঝা যায় না। হোটেল বয়-বেয়ারাদের সাথেও এই কারণে আহমদ মুসা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেনি।
তখন বেলা ৪টা। বাইরে থেকে এসে আহমদ মুসা খেয়ে নামায পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে গত ৪৮ ঘণ্টার ব্যর্থতা নিয়ে ভাবছিল।
দরজায় নক হলো।
ভ্রু’কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। এ সময় কারও আসার কথা নয়।
উঠে আহমদ মুসা দরজা খুলল।
দরজার সামনে হোটেলের একজন বেয়ারা দাঁড়িয়ে।
‘মাফ করবেন স্যার। অবসর মত আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। তাই এলাম স্যার।’ বলল বেয়ারা ছেলেটি।
‘ও ঠিক, ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। এসো, ভেতরে এসো।’ বলল আহমদ মুসা।
দুপুরে খাবার সময় আহমদ মুসাই তাকে আসতে বলেছিল।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল। বেয়ারা ছেলেটি ঘরে ঢুকে একটা সোফায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।
‘বস, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’
বেয়ারাটির নাম বাছির থানম।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।
ছেলেটি শান্ত, ভদ্র স্বভাবের, হোটেলে আসার পর থেকেই দেখছে আহমদ মুসা। অন্যের মত বকশিস নেবার প্রবণতা তার নেই। কোন জিনিস কিনতে দিলে হিসাব করে প্রতিটি পাই ফেরত দেয়।
‘না স্যার ঠিক আছে। বলুন।’ আহমদ মুসা বসতে বলার জবাবে বলল বেয়ারা বাছির থানম।
‘তুমি এই সুলতান গড়ের লোক না?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি স্যার। আমাদের বাড়ি এখানেই।’
‘আমি দু’দিন হলো এসেছি। একা একা কিছু এলাকা ঘুরেছি। বলত, সুলতান গড়ে দেখার মত কি কি আছে?’
হাসল বাছির থানম। বলল, ‘পাহাড়, জংগল, এই হোটেলের নিচের সুন্দর সী-চি, হ্রদ ছাড়া এখানে দেখার তেমন কিছুই নেই স্যার। আর পুরনোর মধ্যে আছে সুলতান পাহাড়ের ‘শাহ বাড়ি।’
‘শাহ বাড়ি কি?’ সংগে সংগেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। মনে মনে সে খুশি হলো এই ভেবে যে, এটা যয়নব যোবায়দাদের বাড়ি হতে পারে।
‘স্যার এটা পাত্তানীর শাহ সুলতানের বাড়ি।’
‘শাহ সুলতান কে?’
‘তিনি গোটা থাইল্যান্ডের রাজকুমার চাউশির বাংগসা। তিনি পাত্তানীতে প্রথম স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। তার পুরো নাম ‘সুলতান আহমদ শাহ’।’
‘তাহলে থাই রাজকুমার চাউশির বাংগসা মুসলমান হয়েছিলেন?’
‘জ্বি স্যার। তাঁর মুসলমান নামই হলো সুলতান আহমদ শাহ। এটা কয়েকশ’ বছরের আগের কথা স্যার।’
‘এখনও বাড়িটি আছে?’
‘পুরাতন অংশ ভাংচুর অবস্থায় আছে। পাশে নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে।’
‘নতুন বাড়ি? কে থাকে সেখানে?’ যেন কিছুই জানে না এমন একটা ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে জবাব দিল না বাছির থানম। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বারান্দাটা দেখে এল। তারপর গলাটা নামিয়ে বলল, ‘ওখানে থাকেন জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এখন নাকি তিনি জেল থেকে পালিয়ে সরকারের সাথে যুদ্ধ করছেন।’
‘জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন কে?’ না জানার ভান করে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। সে ছেলেটিকে বাজিয়ে নিতে চায়।
সে একই ফিস ফিসে গলায় বলল,‘শাহজাদা সুলতান বংশের লোক।’
‘কেন পুলিশ তাকে ধরেছিল? কেনই বা সে যুদ্ধ করছে?’
চোখে-মুখে ভয় ফুটে উঠল বাছির থানমের। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘সেসব আমি বুঝি না স্যার। বলতে পারব না।’
‘এখন ঐ বাড়িতে কে থাকেন?’
‘শাহজাদী যয়নব যোবায়দা। জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিনের বোন স্যার। শুনেছি সেও বাড়িতে সব সময় থাকে না। কখন আসে কখন যায়, কোথায় থাকে কেউ জানে না।’ বলল বাছির থানম। তার চোখে-মুখে বেদনার ছায়া।
‘জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন ও যয়নব যোবায়দা সম্পর্কে এখানকার লোকরা কি মনে করে?’
‘তারা ভাল স্যার। সবাই তাদের ভালবাসে। কিন্তু বলতে পারে না।’
‘কেন?’
হঠাৎ বাছির থানম চমকে উঠে ভয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি কি কাউকে বলে দেবেন, আমি এ কথা বললাম? আমাকে মাফ করবেন স্যার। আমি হঠাৎ বলে ফেলেছি।’
ভয়ার্ত বাছির থানমের কাকুতি-মিনতি দেখে মনটা কেঁদে উঠল আহমদ মুসার। এলাকার নিরীহ মানুষ এভাবেই চরম ভীতির মধ্যে বাস করছে। তারা জাবের জহীর উদ্দিন, যয়নব যোবায়দার মত তাদের সম্মানিত লোকদের নামটা পর্যন্ত নির্ভয়ে উচ্চারণ করতে পারে না।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। বলল নরম কণ্ঠে, ‘বাছির থানম তোমার কি মনে হয় আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে পারি?’
‘আপনি একটু ভিন্ন রকমের স্যার। আপনি মদ খান না, হোটেলের নাইট ক্লাবে যান না, খারাপ লোকদের সাথে আড্ডাবাজি করেন না, বাথরুমে গোসল করেন, সুইমিং পুলে নামেন না। সেই জন্যে কিছু বলতে সাহস করেছি। তবু ভয় থাকেই স্যার।’
‘ভয় নেই। আমাকে তোমার ভাই মনে কর।’
‘সত্যিই আপনি খুব ভাল স্যার।’ ছেলেটির গলা কাঁপল, চোখ দু’টি তার ছলছলিয়ে উঠেছে।
মনে মনে খুশি হলো আহমদ মুসা। খাঁটি একটা ছেলেকে পেয়েছে। সুলতান গড়ের জনজীবনের ভেতরে মাথা গলাবার একটা পথ হলো।
‘তোমার নাম বাছির থানম কেন? বাছির তো আরবী শব্দ, কিন্তু থানম তো থাই শব্দ।
‘আমার মা মুসলমান হওয়ার আগে থাই-বৌদ্ধ ছিলেন। থানম আমার মায়ের দিক থেকে এসেছে।’
‘শাহ বাড়ি দেখা যায় না?’
‘যায়। কিন্তু ……।’ আমতা আমতা করে বলল বাছির থানম।
‘কিন্তু কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার শুনেছি, পুলিশ এবং অন্য কারা যেন বাড়ির প্রতি সব সময় নজর রাখে।’
বলে সে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘তাছাড়া স্যার আপনি বিদেশী। সন্দেহ কেউ করতেই পারে। ইতিমধ্যে স্যার আপনার সম্পর্কে একজন এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছে।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘কি খোঁজ নিয়ে গেছে?’
‘হোটেলে রেজিষ্টার থেকে নিয়েছে নাম ঠিকানা, দস্তখতও দেখেছে এবং ছবিও নিয়েছে। তাকে বয়-বেয়ারাদের কাছ থেকেও খোঁজ খবর নিতে দেখেছি। কিন্তু কি বলেছে, কি জেনেছে সেটা আমি জানি না।’
‘ওরা কি পুলিশের লোক?’
‘না স্যার। পুলিশ তো সবার ক্ষেত্রে যা করে- তাই করেছে, আপনার নাম, ঠিকানা, ছবি প্রথম দিনই নিয়ে গেছে। এরা গতকাল এসেছিল, পুলিশের লোক এরা নয়।’
‘কারা হতে পারে বলে তোমার ধারণা?’
‘জানি না স্যার। তবে তাদের ব্যবহার ভাল নয়। প্রথমেই তারা এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোন শিখ হোটেলে এসেছে কিনা। গত ৪৮ ঘণ্টায় একমাত্র আপনিই হোটেলে এসেছেন। সুতরাং আপনি তাদের টার্গেট হতে পারেন।’
বুঝল আহমদ মুসা ওরা হোটেল পর্যন্ত এসেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় একমাত্র আহমদ মুসাই যখন হোটেলে এসেছে, তখন তার ওপর ওরা নজর রাখবে। ব্যাংককে তার ফটো যদি তারা তুলে থাকে, কিংবা কোনভাবে তারা সেখানকার কোনও ফটো পেয়ে থাকে, তাহলে তারা তাকে চিনতেও পারবে নিশ্চয়।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা ওদের কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করি। তুমি ‘শাহ বাড়ি’ আমাকে দেখাতে পারবে?’
‘আপনি যদি যেতে চান, দেখাতে পারব। তবে কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।’
কথা শেষ করেই কি মনে হওয়ায় আবার দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘আজ খুব ভাল দিন স্যার। ‘শাহ বাড়ি’ যে পাহাড়ে, তার নিচে বিশাল, প্রশস্ত সমতল উপত্যকায় প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব হয়। আজ সেই ক্রীড়া উৎসবের দিন। সেখানে যেতে অসুবিধা নেই। সেখান থেকে শাহ বাড়ি ভালভাবে দেখতে পাবেন।’
‘কি ধরনের ক্রীড়ানুষ্ঠান হয়?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘ঘোড় দৌড়, তীরন্দাজী, কুস্তি, পাহাড়ে ওঠা ইত্যাদি। আপনি কি খেলায় অংশ নেবেন? মেলায় উপস্থিত যে কেউ যে কোন খেলায় অংশ নিতে পারে, কোন পরিচয়ের দরকার হয় না।’ বলল বাছির থানম।
‘খেলা লক্ষ্য নয়, আমি যেতে চাই ওখানে। তুমি কখন যেতে পারবে?’
‘স্যার আমার ডিউটি শেষ। আমি এখনি যেতে পারি।’
‘ধন্যবাদ বাছির থানম। আমিও এখন বেরুতে পারি।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘বাছির, ৫ মিনিট লাগবে আমার তৈরি হতে।’
‘ঠিক আছে স্যার, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’
বলে বাছির থানম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা তৈরি হয়ে ঘরের দরজা লক করে বেরিয়ে এল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিল আহমদ মুসা। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে-বেঁকে এগোতে লাগল ট্যাক্সি পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে পৌছার জন্যে।
শহরের একদম দক্ষিণ প্রান্তে সাগরের গা ঘেঁষে শাহ বাড়ির পাহাড়।
হোটেল থেকে অনেকটা পথ।
বাছির থানম যাবার পথে দু’পাশের স্থানগুলোর নাম পরিচয় বলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল জাবের জহীর উদ্দিনকে আটকে রাখা ‘কাতান টেপাংগো’র কথা। জিজ্ঞাসা করল ফিসফিসে কণ্ঠে, ‘বাছির থানম, ‘কাতান টেপাংগো’ কোথায় জান?’
‘টেপাংগো মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটা পাহাড়ের নাম। কাতান টেপাংগো চিনি না স্যার।’
‘ধন্যবাদ বাছির থানম।’ আহমদ মুসা বলল।

এই মাত্র বাড়ি এসেছে যয়নব যোবায়দা। মাথার চাদর ও রুমাল এবং গা থেকে বোরখা খুলে পরিচারিকার হাতে দিয়ে ইজি চেয়ারে ধপ করে বসে গা এলিয়ে দিল চেয়ারে।
বাইরে থেকে আসার ক্লান্তি শুধু নয়, একটা বিমর্ষভাবও তার সুন্দর মুখকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বিশ বছর বয়স যয়নব যোবায়দার। পাঁচ ফিট কয়েক ইঞ্চি লম্বা হবে। সোনা রং গায়ের। চুলও সোনালী। চোখ নীল। গায়ে গাঢ় বাদামী রংয়ের থ্রি পীস।
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেছে যয়নব যোবায়দা।
চোখ বোজার পর তার অতীত ও বর্তমান এক হয়ে গেছে। ভবিষ্যতও কালো মেঘের রূপ নিয়ে সামনে হাজির। জাবের জহীর উদ্দিন কোর্ট থেকে পালানো এবং তার নিজের সৈন্য ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলার খবর সংবাদপত্রে পড়ে যয়নব যোবায়দা সাংঘাতিকভাবে মুষড়ে পড়েছে। তার ভাই জাবের জহীর উদ্দিন সন্ত্রাসে নামবে, সন্ত্রাসী হবে, এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য। এর চেয়েও অবিশ্বাস্য হলো তার ভাই জেল থেকে বেরুবার পর একবারও তার কাছে টেলিফোন করেনি। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। না বুঝতে পেরে আরও আতংকিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে দাদীর পর, তার সবচেয়ে প্রিয়জন ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন প্রাণে বাঁচার জন্যে পলাতক জিন্দেগী যাপন করছে। সে মেয়ে মানুষ তার কি করার ক্ষমতা আছে! দাদীর পরামর্শে আল্লাহর নাম নিয়ে বহু আশা করে চিঠি দিয়ে পাতার নৌকা ছেড়েছিল। সে কোন ঠিকানায় পৌছেছে, না সমুদ্রে সলিল সমাধি হয়েছে তা জানারও কোন উপায় নেই। আল্লাহ তাকে কোন সাহায্য করবেন না? চোখের দু’কোণ ভিজে উঠল তার।
খোলা দরজা পথে ঘরে প্রবেশ করল যয়নব যোবায়দার দাদী।
ধীরে ধীরে এসে সে যয়নব যোবায়দার মুখের সামনে দাঁড়াল। একটা হাত রাখল যয়নব যোবায়দার কপালে। স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল ‘খুব খারাপ লাগছে বোন?’ যয়নব যোবায়দা চট করে চোখ খুলে উঠে দাঁড়াল ইজি চেয়ার থেকে। দু’হাত ধরে দাদীকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘না দাদীমা আমার শরীর খারাপ করেনি।’
বলে যয়নব যোবায়দা দাদীর পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসে পড়ল।
‘শরীর খারাপের কথা বলিনি বোন। মন খুব খারাপ করছে কিনা সেটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মন খারাপ এটা তোর জন্যে কোন খবর নয়, খুব খারাপ কিনা এটাই খবর।’
‘শুধু আমার কথা বলছ কেন দাদী। তোমার দুঃখের কথা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?’
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল দাদী। কিন্তু বুজে যাওয়া চোখের পাতা ভেদ করে দু’চোখ থেকে বেরিয়ে এল অশ্রুর দুটি ধারা। বলল, ‘তোরা তাই মনে করিস। তোরা কিছু না বললেই আমি কিছু দেখি না, শুনি না, বুঝি না। জহীর কোথায় হারিয়ে গেল বলিসনি, পাত্তানীর এত লোক খুন হচ্ছে, সৈনিকরা মরছে কেন, তা তোরা বলিসনি। জহীরের মত তুইও হারিয়ে গেছিস কোন এক সকালে উঠে শুনব। সেদিনও জানব না কি হচ্ছে, এসব কেন হচ্ছে? কিন্তু আমার চোখ বন্ধ নয়, কারও বন্ধ নয়।’
‘কিন্তু তুমিই বল দাদী, এসব কথা শুনতে যতখানি কষ্ট, বলতে কষ্ট তার চেয়ে অনেক বেশি কি-না? তাই চেয়েছি দাদী তোমার ঘাড়েও বেদনার দুঃসহ বোঝা চাপিয়ে নিজের দুঃখ আরও না বাড়াতে।’ বলল যয়নব যোবায়দা। তার কণ্ঠ ভারী।
দাদী যয়নব যোবায়দার মাথাটা কোলে টেনে নিল। বলল, ‘বোকা বোন, দুঃখ ভাগ করে নিতে হয়। তাতে দুঃখের ভার কমে।’
বলে একটু থামল। বোধ হয় একটু ভাবল। তারপর সরাসরি তাকাল যয়নব যোবায়দার দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘সত্যি করে বলতো যোবায়দা, জহীর কি সত্যই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে?’
‘না দাদীমা, এটা সত্য নয়।’ দ্বিধাহীন দৃঢ় কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
‘তাহলে কি সত্য?’
‘পাত্তানীর নেতৃস্থানীয় আমাদের এই পরিবারকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে পাত্তানীর মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসের অভিযোগে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’
‘তাহলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জহীরকে পুলিশের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার ব্যখ্যা কি এবং সেদিন সশস্ত্র হামলায় জহীর নিজে অংশ নেয়া এবং তার রক্তমাখা জামা পাওয়ারই বা ব্যাখ্যা কি?’
সংগে সংগে উত্তর দিল না যয়নব যোবায়দা। তাকে খুবই বিব্রত দেখাল। মুহূর্ত কয়েক পর ধীর কণ্ঠে বলল, ‘এই ব্যাখ্যা আমিও তালাশ করছি দাদীমা। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি দাদীমা, ভাইয়ার নামে যা বলা হচ্ছে সব মিথ্যা, সব ষড়যন্ত্র।’
‘তোর নিশ্চিত হওয়ার কারণ?’
‘কারণ আমি ভাইয়াকে জানি, ভাইয়ার চিন্তাধারা আমি জানি। ইসলাম প্রচারে আল্লাহর রাসুল স. যে পথ অনুসরণ করেছেন, তার বাইরে আর কোন পথ ইসলামী নয়। ইসলাম প্রচারের পথে বাধা এলে তার মোকাবিলা শক্তি বা সন্ত্রাস দিয়ে নয়, যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে করতে হবে। ইসলাম প্রতিটি মানুষকে সংশোধন করতে চায়, কাউকে সংহার নয়। আদর্শিক, সামাজিক ও সামষ্টিক প্রয়েঅজনে অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার শুধু রাষ্ট্রের, এমন অনুমতি কেবল রাষ্ট্রের মত অথরিটিই দিতে পারে। এই বিশ্বাস ভাইয়ার মজ্জাগত বলা যা। সুতরাং তিনি সন্ত্রাসী কাজে রত হবেন এটা অবিশ্বাস্য।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘মানুষের মত তো পরিবর্তন হতে পারে।’ বলল দাদী।
‘দাদী, ভাইয়ার ওটা মত নয়, ওটা তার বিশ্বাস, ঈমান। ঈমান পরিবর্তন করে মুসলমান থাকার প্রশ্ন ওঠে না।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে দাদীর মুখ। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ যোবায়দা। কিন্তু ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা তাহলে কি? ষড়যন্ত্র যদি হয়, তাহলে ষড়যন্ত্র কার, কেন? জহীর সে ষড়যন্ত্রের হাতে পুতুল হয়ে গেল কি করে?’
‘পুতুল হয়েছে আমি মনে করি না দাদী। ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যাও আমি জানি না। ভয়াবহ এক সংকট আমাদের গ্রাস করছে, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু জানি না সে সংকটটা কি? জানাও আমার সাধ্যের অতীত। কি করব তার কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না।’
‘তুই যে আল্লাহর ‘কেয়ার অব’-এ একটা খোলা চিঠি পাঠিয়েছিলি তার কি হলো?’
বেদনায় ভারী হয়ে গেল যয়নব যোবায়দার মুখ। বলল, ‘আল্লাহই সেটা জানেন দাদী।’
দাদী কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। তখন ঘরে প্রবেশ করল পরিচারিকা নূরী। দাদী ও যয়নব যোবায়দাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দাদী আম্মা, বেগম শাহজাদী আপা, মেলার প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। চলুন।’
যয়নব যোবায়দা উঠে দাঁড়াল।
‘তোরা যা যোবায়দা, আমার ভাল লাগছে না।’ বলল দাদী।
‘আমারও ভাল লাগছে না। মেলা দেখার মত মনের অবস্থা নেই। তবু দাদী, শাহ দাদুর শুরু করা এই মেলায় অন্তত দেখার মাধ্যমে অংশ নেয়া এই বাড়ির রীতি। আমরা এই রীতির খেলাফ করতে পারি না দাদী।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
বলে যয়নব যোবায়দা দাদীকে টেনে ইজি চেয়ার থেকে তুলল। একটা চাদর এনে দাদীর গায়ে জড়িয়ে দিল।
আলমারি থেকে বের করে আনল দু’টি দূরবীন। বলল, ‘চলো দাদী।’
‘বাড়ির সবাই তো চলে যাচ্ছে, এই রীতি কি আর থাকবে?’ বলে হাঁটতে লাগল দাদী।
দাদীর নাম বেগম শরীফুন নেসা। যয়নবের পিতা তাঁর একমাত্র সন্তান। দাদা মারা গেছেন তিরিশ বছর আগে, তখন দাদীর বয়স ৫০ বছর। দাদার মৃত্যুর পর বিশ বছর পর মারা যান যয়নবদের পিতা। যয়নবরা তখন কৈশোরেও পৌছেনি। আর যয়নবদের মা মারা গেছেন পিতার মৃত্যুর এক বছর পরেই। কার্যত তারা শিশুকাল, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পৌছেছে দাদীর হাতেই।
‘রীতি ঠিক আছে, আমরাই ঠিক থাকতে পারছি না দাদী। এটা আমাদের ব্যর্থতা।’ বলল যয়নব যোবায়দা। ভারী কণ্ঠ তার।
দাদী একটা হাত রাখল যয়নব যোবায়দার পিঠে। সান্তনার সুরে বলল, ‘সময় সমান যায় না, কারণ সব মানুষ সমান হয় না।’
‘তাহলে সময় আবার আমাদের পক্ষে আসবে দাদী?’
‘তার জন্যে একজন মানুষ প্রয়োজন যিনি সময়ের গতি ঘুরিয়ে দেবেন।’
‘ভাইয়া নিজেই বিপদে, কোথায় সে মানুষ?’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘এমন মানুষের ব্যবস্থা আল্লাহই করে থাকেন যোবায়দা।’ তিন তলার প্রশস্ত বারান্দায় পা রাখতে রাখতে বলল দাদী।
তিন তলার এ বারান্দা বাড়ির পশ্চিম দিকে। বারান্দাটি অন্য সব বারান্দার চেয়ে আলাদা। রেলিং থেকে তিনটি প্রশস্ত ষ্টেপ একটির চেয়ে অন্যটি উঁচু হয়ে উপরে উঠে গেছে। তিন সারিতে বসে অনেকগুলো মানুষ এখান থেকে নিচের দৃশ্যাবলি উপভোগ করতে পারে।
নিচেই পাহাড়ের গোড়ায় মেলার মাঠ। এই বারান্দা থেকে শুধু মেলার মাঠটি নয়, মাঠের চারদিকটাও ভালোভাবে দেখা যায়।
মেলায় বিচিত্র পোশাকের প্রচুর লোক। কিন্তু মাঠ বড় বলে কোথাও মানুষের বড় ভীড় সৃষ্টি হয়নি।
মেলার মূল খেলার মাঠের চারদিক ঘিরে প্রশস্ত জায়গা। এই প্রশস্ত জায়গায় প্রচুর দোকান বসে। মাঠের চারদিকে বসে মানুষ খেলাও দেখে। সারাদিনব্যাপী মেলার প্রথম অংশেই নানা রকম খেলা-ধুলার আসর বসে।
বিভিন্ন আইটেমে একের পর এক প্রতিযোগিতা হয়।
তীরন্দাজী দিয়ে খেলা শুরু হয় এবং শেষ হয় ঘোড় দৌড় দিয়ে। তীর নিক্ষেপ মেলার সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতিযোগিতা।
টার্গেটে তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে।
যয়নব যোবায়দা ও দাদী বসেছে পাশাপাশি সোফায়। পরিচারিকা ‘নূরী’ বসেছে এক ষ্টেপ পেছনে একটি চেয়ারে।
তিন জনের হাতেই দূরবীন।
যয়নব যোবায়দা ও দাদীর হাতের দূরবীণ দুটি বেশ বড় আকারের। এ দূরবীন দিয়ে তারা মেলার মাঠের ছোট এক খন্ড কাগজের লেখাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। দূরবীন দুটি বিশেষ ধরণের। এ দিয়ে দূরের জিনিস নিখুঁতভাবে দেখা যায় এবং দেখাও যায় স্বাভাবিক আকারে।
যয়নব যোবায়দা ও দাদী দু’জনের চোখেই দূরবীন।
যয়নব যোবায়দার দূরবীনের চোখ একজনের ওপর পড়ে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।
দেখল আহমদ মুসাকে। তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে পাশের এক ছেলের সাথে। আহমদ মুসাকে দেখে চিনতে পারল। তাকেই সে সেদিন রাস্তায় ট্যুরিষ্ট হোটেলের পথ বাতলে দিয়েছিল। আর ছেলেটি ঐ হোটেলেরই বেয়ারার ইউনিফরম পরা।
বিস্মিত হলো যয়নব যোবায়দা, লোকটি কেন তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে! কি আলাপ করছে ছেলেটির সাথে?
আহমদ মুসা সরে গেল ক্যামেরার লেন্স থেকে।
যয়নব যোবায়দার দূরবীনের চোখ ফিরে এল তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার দৃশ্যে।
তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
প্রতিযোগীর প্রত্যেকেই টার্গেটে তিনটি তীর নিক্ষেপ করবে। নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি রাবার বোর্ডে একটি সাদা বৃত্ত আঁকা আছে। বৃত্তের কেন্দ্রে আরেকটা লাল বৃত্ত। লাল বৃত্তের মাঝখানে একটি চোখ আঁকা। চোখের ভেতর চোখের কাল মণিও আঁকা। তীর যদি চোখের মণি বিদ্ধ করে তাহলে তিন পয়েন্ট, চোখের মণির বাইরে লাল বৃত্তের মধ্যে কোথাও আঘাত করলে ২ পয়েন্ট আর লাল বৃত্তের বাইরে সাদা বৃত্তের কোথাও আঘাত করলে ১ পয়েন্ট এবং সর্বোচ্চ নাম্বারের তিনজনকে ফাষ্ট, সেকেন্ড, থার্ড করা হবে। কেউ যদি সর্বোচ্চ নয় পয়েন্ট অর্থাৎ তিন তীরই যদি টার্গেটের চোখের মণিতে লাগাতে পারে তাহলে সে মেলার চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হয়। আর যে সর্বোচ্চ সংখ্যক খেলায় জেতে, তাকে গেমস চ্যাম্পিয়ন খেতাব দেয়া হয়।
যয়নব যোবায়দারা তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা দেখছিল। কেউ ভাল করছে না। ঘোষক মাইকে জানাল মাত্র একজন প্রতিযোগী আর বাকি। তখন পর্যন্ত একজনই সর্বোচ্চ ৫ পয়েন্ট পেয়েছে। শেষ প্রতিযোগী এল। সে আহমদ মুসা। যয়নব যোবায়দা বিস্ময়ের সাথে দেখল আহমদ মুসার তিনটি তীরই চোখের মণিকে বিদ্ধ করল।
এই সময় একজন পরিচারিকা বারান্দায় প্রবেশ করল। যয়নব যোবায়দাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘শাহজাদী আপা, ম্যাডাম আয়েশা শহর থেকে এসেছেন।’
‘হ্যাঁ, ওঁকে আসতে বলেছি। আজই এসে গেলেন! ঠিক আছে, যাও তুমি ওঁকে বসিয়ে চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর। আমি আসছি।’
পরিচারিকা চলে গেল।
‘দাদী, ম্যাডাম আয়েশা কয়েকদিন হলো ব্যাংকক থেকে এসেছে। উনি জেদ্দাভিত্তিক একটা মানবাধিকার সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। ওআইসির একটা অংগ সংগঠন এটা। আমি এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওঁকে কিছু জানিয়েছি। আর কিছু কথা বলতে চাই।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘চেষ্টা কর বোন। কোন চেষ্টা কখন কাজে লেগে যায়, কে বলতে পারে!’ বলল দাদী।
‘তাহলে তুমি বস দাদী। ওঁর সাথে কথা বলে আসি আমি।’
‘ঠিক আছে বোন।’ বলল দাদী।
যয়নব যোবায়দা চলে গেল ভেতরে।
যয়নব যোবায়দা ড্রইংরুমে ঢুকতেই ম্যাডাম আয়েশা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মিস যোবায়দা, আজ রাতেই চলে যাব, তাই বিনা নোটিশে হঠাৎ করে চলে এলাম। অসুবিধা করলাম না তো!’
মিষ্টি হেসে যয়নব যোবায়দা বলল, ‘না ম্যাডাম। আমিই তো আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। প্লিজ বসুন।’
দু’জনে বসল।
‘মিস যোবায়দা, আপনার সব কথা নিয়ে অনেক ভেবেছি। যতই ভেবেছি, ততই বিষয়টা জটিল হয়ে উঠেছে। এমন জটিলতার ওপর কাজ করা মানবাধিকার সংস্থার স্কোপের মধ্যে পড়ে না।’ বলল ম্যাডাম আয়েশা।
‘কেমন জটিলতা দেখছেন ম্যাডাম?’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘থাই সরকার দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, আপনার ভাই জাবের জহীর উদ্দিন পাত্তানী অঞ্চলের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের মধ্যমণি। কিন্তু আপনারা বলছেন থাই সরকার ভুল করছে। তৃতীয় একটি পক্ষের এটা ষড়যন্ত্র পাত্তানীর মানুষকে শিকার বানাবার জন্যে। এই তৃতীয় পক্ষের কিন্তু আপনারা নাম বলতে পারছেন না এবং চিনেনও না। আর থাই সরকার এমন কিছু বিশ্বাস করে না। এটাই হলো জটিলতা। সন্ত্রাস অব্যাহত থাকা এই জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের মানবাধিকার সংস্থার জন্যে কিছু করার কোন সুযোগ আমি দেখছি না।’ ম্যাডাম আয়েশা বলল।
হতাশায় ভরে গেল যয়নব যোবায়দার মুখ। বলল, ‘ম্যাডাম আপনি কি বিশ্বাস করেন জাবের জহীর উদ্দিন বা আমরা এই সন্ত্রাস করছি?’
‘না, আমি বিশ্বাস করি না। ব্যাংকক ও পাত্তানীতে এসে আমার অনুসন্ধান থেকেও আমি এটা জেনেছি। কিন্তু এই মতের পক্ষে থাই সরকারকে আমি কোন প্রমাণ দিতে পারছি না!’
‘এটা আমাদেরও সমস্যা। এখন আমরা কি করব?’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
বেদনায় ভরে গেল ম্যাডাম আয়েশার মুখও। ম্যাডাম উঠে এসে যয়নব যোবায়দার পাশে বসল। একটা হাত তার কাঁধে রেখে সান্তনার সুরে বলল, ‘ধৈর্য ধরুন মিস যোবায়দা, আল্লাহই সাহায্য করবেন।’
‘আল্লাহর সাহায্যেরই অপেক্ষা করছি। কিন্তু সব তো শেষ হয়ে গেল। ষড়যন্ত্রকেই আরও পাকাপোক্ত হতে দেখছি।’ ওড়নার প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল যয়নব যোবায়দা।
‘এই বিপদে আমার একজনের কথাই শুধু মনে পড়ছে। তিনি আহমদ মুসা। মুসলমানদের এমন বহু বিপদে তিনি এগিয়ে এসেছেন। আল্লাহ ছাড়া এমন সংকট উত্তরণে তার বিকল্প আর কেউ নেই। তিনি আল্লাহর মূর্তিমান এক সাহায্য।’
প্রবল আগ্রহ ফুটে উঠল যয়নব যোবায়দার চোখে-মুখে। মনে হলো তার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া নতুন রক্তে প্রবাহ এলো। বলল, ‘আমি তাঁর নাম শুনেছি। অনেক পড়েছি তাঁর সম্পর্কে। কিন্তু তিনি তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক ফেরেশতা-মানুষ। তাঁকে কোথায় পাব আমরা!’
‘তাঁকে কেউ খুঁজে পায় না মিস যয়নব। তিনিই খোঁজ নিয়ে জাতির সংকট কবলিত মানুষদের কাছে হাজির হন। সর্বশেষ তিনি আন্দামানে এসেছিলেন। আন্দামানের মুসলমানদের মহাসংকট কেটে গেছে।’ বলল ম্যাডাম আয়েশা।
‘আন্দামানে? এই তো কাছেই। কোনোভাবে তাঁকে কিছু জানাবার পথ নেই?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে ব্যাকুলভাবে বলল যয়নব যোবায়দা।
‘তিনি আন্দামান আছেন, না চলে গেছেন জানি না। এখানে আসার আগে জেদ্দায় ওআইসির মুসলিম সংখ্যালঘু সংক্রান্ত এক গোপন রিপোর্টে আমি আন্দামানে তাঁর মিশন এবং মিশন সফল হওয়া সম্পর্কে জেনেছি।’ ম্যাডাম আয়েশা বলল।
‘ওআইসি’কে অনুরোধ করলে তারা আহমদ মুসার সাথে কোন যোগাযোগ করে দিতে পারে না?’
গম্ভীর হলো ম্যাডাম আয়েশার মুখ। বলল, ‘আহমদ মুসা আল্লাহর অনন্য এক বান্দাহ। এক আল্লাহ ছাড়া কারও অধীনে তিনি নন। তার নিজস্ব কোন চাওয়া, অভিলাষ নেই। নিজেকে নিয়ে তিনি কোন স্বপ্ন দেখেন না, তাই তিনি জগতের কারো মুখাপেক্ষেও নন। ওআইসি সব সময় তার খোঁজও জানতে পারে না। সুতরাং নির্দেশ দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।’
‘তাঁর কোন ঠিকানা, বাড়ি নেই?’ আশায় উচ্চকিত যয়নব যোবায়দার কণ্ঠ।
‘ঠিকানা, বাড়ি বলতে যা বুঝায় তা তাঁর নেই। সব মুসলিম দেশের তিনি নাগরিক। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্সও তাঁকে নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছে। তবে তাঁর স্ত্রী একটি বাচ্চা নিয়ে থাকেন মদিনায়।’
‘তাদের সাহায্য নেয়া যায় না।’
‘তাঁকে আমি দেখিনি। তার স্ত্রী ও ছেলেকে দেখা আমার এক আবেগময় স্বপ্ন। কিন্তু পারিনি। সৌদি আরবের রাষ্ট্র প্রধানকে ঘিরে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সে রকমই নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকেন তারা। সৌদি আরবের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমতি ছাড়া বাইরের কেউ তাদের সাথে দেখা করতে পারে না। অন্য কোন যোগাযোগের মাধ্যম কাউকে জানানো হয় না।’
‘তাহলে?’ বলল যয়নব যোবায়দা। তার কণ্ঠে চরম হতাশার সুর।
‘একটু ধৈর্য ধরুন মিস যোবায়দা। আমি জেদ্দায় ফিরে এখানকার রিপোর্ট ওআইসির মানবাধিকার কমিশনকে দেব। তার সাথে অনুরোধ করব এখানকার ভয়াবহ অবস্থার কথা আহমদ মুসাকে জানানো যায় কিনা। তাছাড়াও মদিনায় যোগাযাগের একটা উদ্যোগ নেব। আমি কথা দিলাম।’
যয়নব যোবায়দা ম্যাডাম আয়েশার দু’টি হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল, ‘আপনার এই কথা মনে যে আশা জাগাচ্ছে, তা কল্পনাও করিনি। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের সাহায্য করুন।’
ম্যাডাম আয়েশা তাকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘বোন এমন ভেঙে পড়ো না। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে বলো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
নাস্তা করার পর বিদায় নিল ম্যাডাম আয়েশা।
গাড়ি পর্যন্ত বিদায় দিয়ে যয়নব যোবায়দা ফিরে এসে নিজের দেহটাকে সোফায় ছেড়ে দিল। ম্যাডাম আয়েশাকে সব কথা বলতে পেরে ও তার কথা শুনে ভাল লাগছে। সবচেয়ে ভাল লাগছে আহমদ মুসার বিষয়টি। আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক কিছু জানে সে, কিন্তু তাকে এমনভাবে জানত না। তাহলে এমন মানুষও দুনিয়ায় আছে। কেমন হবেন তিনি দেখতে! কেমন হবে চেহারা! কেমনভাবে তিনি কথা বলেন! এমন ফেরেশতাতুল্য মানুষ তো তার দু’চোখ কখনও দেখেনি। মনটা ছুটে গেল আল্লাহর দিকে। একমাত্র তিনিই পারেন সাহায্য করতে। আহমদ মুসা তো তাঁরই বান্দাহ, তাঁরই মুখাপেক্ষী। অতএব তিনি পারেন আহমদ মুসাকে যে কোন সময় এখানে আনতে। একমুখী এই চিন্তায় ডুবে গিয়ে কখন যেন চোখ ধরে এসেছিল ঘুমে।
যয়নব যোবায়দার ব্যক্তিগত পরিচারিকা নূরীর উচ্চকণ্ঠে ঘুম ভেঙে গেল যয়নব যোবায়দার। চোখ খুলেই বলল, ‘কি নূরী, হৈ চৈ করছিস কেন? কি হয়েছে?’
‘কি হয়নি শাহজাদী আপা? আপনি দেখলেন না। এমন ঘটনা এখানকার মেলায় কোন সময় ঘটেনি। তীরন্দাজীতে যাঁকে আপনি প্রথম হতে দেখেছেন, তিনিই ‘মেলায় চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছেন, আবার গেমসেরও চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।’ বলল নূরী উৎসাহের সাথে।
‘কি বলছিস? আর কয়টি খেলায় উনি জিতেছেন?’ বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে যয়নব যোবায়দার।
‘ঘোড় দৌড়ে জিতেছেন, কুস্তিতে জিতেছেন এবং লাঠি-বাজিতেও জিতেছেন। তিনি চারটি খেলায় অংশ নিয়ে চারটি খেলাতেই প্রথম হয়েছেন।’ বলল নূরী।
‘কে তিনি? জানা গেল? তিনি তো পাত্তানী নন।’ জিজ্ঞাসা যয়নব যোবায়দার।
‘তাকে ‘ট্যুরিষ্ট’ বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে।’ বলল পরিচারিকা নূরী।
হঠাৎ নিচে মাঠের দিক থেকে গুলীর শব্দ ভেসে এল। অনেকগুলো গুলীর শব্দ।
যয়নব যোবায়দা এবং নূরী দৌড় দিল পশ্চিমের সেই বারান্দার দিকে।
দাদী বারান্দাতেই বসে আছে। তার চোখে দূরবীন।
‘কি হয়েছে দাদী?’ জিজ্ঞেস করল যয়নব যোবায়দা। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। আবার কোন সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটল নাকি!
‘দেখ মাঠের দিকে।’ বলল দাদী। তার চোখ দূরবীনে। মনোযোগ দিল মাঠের ঘটনার দিকে।
দূরবীনসহ চোখ তুলে দ্রুত যয়নব যোবায়দা মাঠের দিকে তাকাল। দেখল বিক্ষেপ্তভাবে চারটি গুলীবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। আর দেখতে পেল আহমদ মুসার হাতে রিভলবার। সে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে পুলিশ এগিয়ে আসছে। মাঠের সব লোক চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে সবার চোখে ভীতি।
যয়নব যোবায়দা দেখল আহমদ মুসার শান্ত, সরল মুখ। একটা ঠিকরে পড়া জ্যোতি সে মুখে। এতবড় হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার কোন প্রতিচ্ছবি তার চোখে-মুখে নেই। যয়নব যোবায়দা বুঝতে পারছে আহমদ মুসার রিভলবারের গুলীতেই ওরা চারজন মরেছে। কিন্তু কোন ভীতি, দুশ্চিন্তা আহমদ মুসার মধ্যে নেই।
পুলিশ এলে আহমদ মুসার সাথে কথা শুরু হলো। যয়নব যোবায়দা দেখল, আহমদ মুসা একটা আইডেনটিটি কার্ড, একটা লাইসেন্স জাতীয় কাগজ ও পাসপোর্ট পুলিশকে দেখাল। পুলিশরা আহমদ মুসাকে একটা স্যালুট দিয়ে পিছনে সরে গেল এবং পরে লাশ নিয়ে তারা চলে গেল।
পুলিশ চলে গেলে মেলার লোকজন সবাই ছুটে এসে আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল ও আনন্দ করতে লাগল।
‘পুলিশ লোকটিকে স্যালুট করল কেনরে বোন? সেও কি পুলিশের লোক? না কি বড় কোন কেউ?’ দাদী জিজ্ঞেস করল যয়নব যোবায়দার দিকে মুখ ফিরিয়ে।
‘না দাদী, সে পুলিশের লোক নয়, এদেশেরও বড় কেউ নয়। এদেশের হলে সে পাসপোর্ট দেখাতো না। যখন সে আইডেনটিটি কার্ড দেখাল, তখন তার নিশ্চয় বড় পরিচয় আছে। হতে পারে আইডেনটিটি এদেশ থেকেই তাকে সাময়িকভাবে দেয়া হয়েছে। পুলিশ চিনেছে বলেই তাকে স্যালুট দিয়েছে। আর লাইসেন্সের মত যে কাগজ দেখাল, সেটা নিশ্চয় রিভলবারের লাইসেন্স। রিভলবারের বৈধ না হলে লোকটিকে পুলিশ নিশ্চয় ছাড়তো না।’
‘তাই হবে বোন। যা হোক, লোকটি কিন্তু বাজের মত ক্ষীপ্র এবং অত্যন্ত কুশলী। না হলে তাকেই মরতে হতো। সে তো নিজেকে বাঁচাবার জন্যে গুলী করেছে।’ বলল দাদী।
‘দাদী তুমি এভাবে বলো না, পুরো ঘটনা বলো।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘ঐ যে লোকটি দুই পর্বেই চ্যাম্পিয়ন হলো, সে পুরষ্কারের মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা মেলা কমিটির হাতে ফেরত দিয়ে অনুরোধ করেছে, আগামী বছর থেকে এই মেলায় শিশু-কিশোরদের দেশ সম্পর্কিত জ্ঞানের, বিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞানের এবং স্রষ্টা সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘোষণা আসার পর লোকটি এবং একটি ছেলে মেলা থেকে বের হয়ে আসতে যাচ্ছিল, এই সময় রিভলবারধারী চারজন লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলে। অবাক কান্ড, লোকটি চোখের পলকে একজনকে আঘাত করে তাকে পেছন থেকে বুকের সাথে সেঁটে ধরে। বাকি তিনজন লোকটিকে লক্ষ্য করে গুলী করেছিল, কিন্তু তিনটি গুলীই গিয়ে লোকটির সামনে ঢাল হিসেবে ধরে রাখা তাদের লোককেই বিদ্ধ করল। এই সুযোগে লোকটি তার পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিয়েছে এবং বিদ্যুত গতিতে তার রিভলবার ঘুরে গেল ঐ তিনজনের ওপর দিয়ে। তিনজনই গুলী খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এই হলো ঘটনা। তার পরের ঘটনা তোদের দেখা।’ থামল দাদী।
‘লোকটি অদ্ভুত দাদী। খেলাতেও চ্যাম্পিয়ন। সংঘাতেও চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু মেলা কমিটিকে যে পরার্ম তিনি দিলেন তা এসবের বিপরীত। তিনি শিশু-কিশোরদেরকে দেশ, বিশ্ব ও ধর্মজ্ঞানে গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ সংঘাতে তিনিই চ্যাম্পিয়ন হলেন।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘না বোন, সংঘাতের চ্যাম্পিয়নের অর্থ ভিন্ন। সে তো সংঘাতের চ্যাম্পিয়ন নয়। সে আত্মরক্ষা করেছে মাত্র। নিজেকে রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের অধিকার এবং দায়িত্ব। নিজের প্রতি এই দায়িত্বই সে পালন করেছে। তার মত যদি আমরা সবাই আমাদের রক্ষা করতে পারতাম, তাহলে আমাদের এই বিপর্যয় ঘটত না, অপরাধীদের দৌরাত্ম সর্বগ্রাসী হয়ে উঠত না। খেলা-ধুলা, তীরন্দাজী ইত্যাদির সাথে শিশু-কিশোরদের দেশ, বিশ্ব ও ধর্মজ্ঞান চর্চার কথা বলে সে শুধু জীবনকে ভারসাম্য করা নয়, বিনোদন ও অস্ত্রবাজীকে মানব জ্ঞান ও নৈতিকতার অধীনে আনতে বলেছে। আজকের জন্য এর চেয়ে ভাল কথা আর কি আছে?’
‘ধন্যবাদ দাদী, তুমি যে অপরূপ ব্যাখ্যা দিলে, সে ব্যাখ্যঅ তারও নিশ্চয় জানা নেই। তবে যাই হোক দাদী, লোকটির প্রতিভা ও যোগ্যতা অসাধারণ মাপের। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, তিনি এদেশের নন, কিন্তু পুলিশ তার কি পরিচয়পত্র দেখে তাকে স্যালুট করতে বাধ্য হলো।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘এই প্রশ্নের জবাব তোর কাছে যেমন নেই, আমার কাছেও নেই। এর উত্তর পাওয়া ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রেখে চলো এখন যাই। খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। মেলাও আবার দেখতে হবে।’ বলল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে।
সবাই উঠে দাঁড়াল এবং বারান্দা থেকে পা বাড়াল ভেতরে যাওয়ার জন্যে।