১
শাহবাড়ির পাহাড়ের গোড়ায় পৌছে আহমদ মুসা ভাবল, মসৃণ রাস্তা ধরে সে গাড়ি নিয়ে শাহবাড়িতে উঠে যেতে পারে। কিন্তু উঠতে গিয়ে মনের তরফ থেকে বাধা পেল আহমদ মুসা।
সুতরাং ওঠা বাদ দিয়ে আহমদ মুসা পাহাড় ঘুরে শাহবাড়ির পেছনে চলে এল এবং প্রথমবারের মত এবারও পাহাড় বেয়ে ক্রলিং করে শাহবাড়ির পেছনের সংকীর্ণ একটা চত্বরে উঠে এল।
একটা ছোট গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল আহমদ মুসা। তারপর বাড়ির দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে লাগল। ইতিমধ্যেই কেউ এসেছে কিনা, তার অনেক খানি বোঝা যাবে সামনের দিকটা দেখলে।
বাড়ির সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। আহমদ মুসা দেয়ালের যে বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা পার হলেই গাড়ি বারান্দা দেখা যাবে।
আহমদ মুসা সোজাসুজি বাঁকটা পার না হয়ে গাড়ি বারান্দা দেখার জন্যে উঁকি দিল। দেখতে পেল গাড়ি বারান্দা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি গাড়ি। দুটি মাইক্রো এবং একটি জীপ।
বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে। এতগুলো গাড়ি নিয়ে কারা এল? ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা কি? তাদের আসাই স্বাভাবিক। ভোর পর্যন্ত তাদের লোকরা যয়নব যোবায়দাকে ধরে নিয়ে না ফেরায় এবং সম্ভবত যোগাযোগেও ব্যর্থ হওয়ায় খারাপ কোন কিছু ঘটার আশংকায় তারা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে বুঝল গাড়িতে কোন লোক নেই। যারা এসেছে নিশ্চয় সবাই ভেতরে ঢুকেছে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
বাহিরটা আরেকবার দেখে ভেতরে ওদের উপর চোখ রাখার সিদ্ধান্ত নিল।
ভেতরে ঢোকার দরজা খোলা পাবে ভেবেছিল। খোলাই পেল।
ধীরে ধীরে ঘরের দরজা খুলল। দিন হলেও ভেতরটা অন্ধকার দেখল। ভেতরটা সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করতে চাইল আহমদ মুসা।
কিন্তু দরজা খুলে স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই ছুটে আসা একটা কিছু তার উপর পড়ল। এর নরম স্পর্শ পাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার অভিজ্ঞ অনুভূতি নিশ্চিত হলো কি ঘটতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল বর্তমান সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভয়ংকর নরম ধাতব ফাঁস তাকে এসে ঘিরে ধরেছে।
ফাঁস আহমদ মুসাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই চোখের পলকে আহমদ মুসা বসে পড়ল। ঠিক যেমন মায়ের পেটে শিশু দুই হাঁটু, দুই হাত এবং মাথা এক সন্ধিস্থলে নিয়ে অবস্থান করে। এর ফলে নরম ধাতব ফাঁস প্রত্যেক অংগকে আলাদা করে আটকে ফেলে মানুষকে একেবারে নিস্ক্রিয় করে ফেলার যে কাজ করে তা করতে পারল না।
ফাঁদ তার বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিক্ষিপ্ত হবার পর গুটিয়ে গিয়ে আহমদ মুসাকে রাগবি বলের মত রূপ দিল।
ফাঁদ যে ছুঁড়েছিল সম্ভবত সেই লোকটিই চিৎকার করে উঠল, ‘শিকার ধরে পড়েছে।’
সংগে সংগেই ছুটে এল কয়েকজন লোক। তারা ফাঁদ ধরে টেনে-হিঁচড়ে আহমদ মুসাকে ভেতরে এক তলার দরবার কক্ষে নিয়ে গেল।
আহমদ মুসা ফাঁদের মধ্যে তার দেহকে যেভাবে গুটিয়ে নিয়েছিল, তাতে তার দেহ হয় ডান ও বাম দিকে কাত হয়ে, নয়তো চিৎ হয়ে থাকছে।
দরবার কক্ষে যখন তাকে আছড়ে ফেলল তখন তার দেহটা কাত হয়ে পড়ল। একজন তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘লাদিনো বস, হোটেল থেকে এরই ফটো পাওয়া গেছে। তার মানে এই সেদিন মেলার মাঠে আমাদের চারজন লোককে হত্যা করেছে।’ বলেই আহমদ মুসাকে কষে কয়েকটা লাথি লাগাল।
লাদিনো ব্ল্যাক ঈগলের এই দলের প্রধান। এরাই সকালে পাত্তানী সিটি থেকে শাহবাড়ি এসেছে তাদের লাপাত্তা হওয়া সাথীদের খোঁজে।
লাদিনো ছুটে এল তার সাথীর কথা শুনে। আহমদ মুসার কাছে এসে আহমদ মুসার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল। দেখে সেও চিৎকার করে উঠল, ‘ঠিক, কোন সন্দেহ নেই এই শয়তানই সেই শয়তান।’
বলে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম দিল, ‘একে ঝাড় বাতির হুকের সাথে টাঙাও। তারপর পেটাও। আজ আমাদের ৮ জন লোক গায়েব হওয়ার খবরও এই শয়তান দিতে পারবে। আমি নিশ্চিত, ঐ শয়তান আর এই শয়তান দু’জনেই আজ রাতে এখানে ছিল। যয়নবরা কোথায় এ কথাও এরাই বলতে পারবে।’
আহমদ মুসাকে টাক্সিয়ে দেয়া হয়েছে ছাদের ঝাড়বাতির হুকের সাথে। ফাঁসের গোড়াটাকে বাঁধা হয়েছে হুকের সাথে। ফাঁসের পেটে ঝুলছে আহমদ মুসা মাটি থেকে দুই ফিট উপরে।
আহমদ মুসার গুটানো দেহটা এবার ফাঁদে উপুড় হয়ে আছে। মেঝের বড় অংশই সে এখন দেখতে পাচ্ছে।
মেঝের উপর পড়ে থাকা একটা রক্তাক্ত যুবকের দেহ তার নজরে পড়ল। তেইশ চবিবশের মত বয়স হবে যুবকটির। বুঝাই যাচ্ছে তাকে নির্মমভাবে মেরেছে। আহত স্থানগুলো থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সম্ভবত ছেলেটিকেও সকালে এখানে ধরা হয়েছে। কিন্তু ছেলেটি কে? এখানে এসেছিল কেন?
লাদিনো নামের লোকটি এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। তার হাতে কালো রঙের একটি ব্যাটন। বুঝাই যাচ্ছে, শাল কাঠের ব্যাটনটি লোহার মত ভারী হবে। ব্যাটনের উপর পেরেক বসানো। পেরেকগুলো সিকি ইঞ্চির মত লম্বা। পেরেকের মাথাগুলো তীক্ষ্ণ নয়, ভোঁতা ধরনের। এ ধরনের কাঁটাওয়ালা ব্যাটন বেয়াড়া মানুষকে কথা বলাবার জন্যে নাকি খুবই উপকারী।
লাদিনো ব্যাটনটি দিয়ে ফাঁসে আবদ্ধ ঝুলন্ত আহমদ মুসাকে একটা প্রচন্ড আঘাত করে বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা, ঐ দিকে দেখ কথা বলায় কি হাল হয়েছে। আমরা জানতে চাই গত রাতে তুই এ বাড়িতে এসেছিলি কি-না, আমাদের ৮ জন লোক কোথায় গেল এবং কোথায় গেল এ বাড়ির লোকরা?’
‘একথা তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমরা তো এ বাড়িতে আমার আগে এসেছ। সব প্রশ্নের জবাব তোমাদের জানার কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
লাদিনো তার হাতের ব্যাটন দিয়ে আহমদ মুসার দুই পাঁজরে পাগলের মত পেটাল। আহমদ মুসা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল অকথ্য যন্ত্রণা। সহ্যের সীমা ডিক্সিয়ে দুই চোখ ফেটেই যেন অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার।
কিছুক্ষণ পিটিয়ে পেটানোতে ক্ষান্ত দিয়ে বলল, ‘আমার সাথে চালাকি করছিস। তুই মাঠে আমাদের ৪ জনকে মেরেছিলি, আজ রাতেই তুই-ই আমাদের ৮ জন লোককে গুম করেছিস। সরিয়েছিস যয়নবদেরকেও। তোকে মুখ খুলতেই হবে। না হলে পিটিয়েই মেরে ফেলব।’
‘যদি তোমরা নিশ্চিত হও, আমিই এজন্যে দায়ী, তাহলে ঐ ছেলেটিকে মেরেছ কেন? তার মানে আমি করেছি বলে যে কথা বলছ, সেটা তোমাদের অনুমান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঐ শয়তানও জড়িত আছে। না হলে বাড়িটা পাহাড়া দেবার জন্যে সে এসেছিল কেন? সেও জানে যয়নবরা কোথায় আছে।’ বলেই লাদিনো আবার ব্যটর তুলল এবং পেটাতে শুরু করল আহমদ মুসাকে।
অন্যদিকে আরেকজন পেটাতে শুরু করল ঐ ছেলেটিকে।
সে কানফাটা চিৎকার করতে লাগল।
আহমদ মুসার পাঁজর ঝাঝরা হয়ে গেল। রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচের মেঝেতে। আহমদ মুসার মুখ থেকে শব্দ বেরুচ্ছে না। কিন্তু একদিকে অসহ্য যন্ত্রণা, অন্যদিকে ছেলেটির কানফাটা চিৎকার আহমদ মুসাকে অতিষ্ঠ করে তুলল।
আহমদ মুসা মুক্ত হওয়ার কাজ আগেই শুরু করে দিয়েছিল। দু’হাত দিয়ে জামার কলার থেকে চাকু বের করে হাতে নিয়েছে এবং বের করে নিয়েছে শোল্ডার হোলষ্টার থেকে রিভলবার। যেহেতু তাকে নিয়ে ফাঁসটা মাটি থেকে দুই ফিট উপরে ছিল এবং আহমদ মুসাও যেহেতু উপুড় হয়ে ছিল। তাই তার হাতের কাজ লাদিনোরা কেউ দেখতে পেল না। এই সুযোগ গ্রহণ করেই আহমদ মুসা ফাঁস দেড়ফুট পরিমাণ কেটে ফেলল। তারপর যতটা সম্ভব ঘরটাকে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল, তাকে এবং ছেলেটিকে নির্যাতন চালানো দু’জন ছাড়া অন্য সবাই মেঝের মাঝখানে বসে আছে। শূন্য বাড়ি থেকে হাতে বহন করার মত মূল্যবান যেসব জিনিস ওরা লুট করেছে, সেগুলো তারা দেখাদেখি করছে।
আহমদ মুসা যথাসম্ভব গুটিয়ে নিয়ে দেহটাকে ছেড়ে দিল ফাঁসের কাটা অংশ দিয়ে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই চিৎ হলো। হাতে তার রিভলবার,ট্রিগারে আঙুল।
আহমদ মুসা পড়তেই টের পেয়ে গেল তার পাশে দাঁড়ানো লাদিনো। সে পকেটে হাত দিল রিভলবার বের করার জন্যে।
সে সুযোগ আহমদ মুসা তাকে দিল না। গুলী করল লাদিনোকে। দ্বিতীয় গুলী ছুঁড়ল ছেলেটিকে নির্যাতনকারী লোকটির উদ্দেশে। দ্বিতীয় গুলী করেই আহমদ মুসা শুয়ে থেকে তার পাশে পড়ে যাওয়া লাদিনোর কোমরের বেল্ট থেকে পকেট মেশিনগান বের করে নিয়ে তাক করল বসে থাকা লোকদের। ঐ লোকরা প্রথমে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও কেউ কেউ তাদের ষ্টেনগান তুলে বসে থেকেই গুলী চালানো শুরু করেছে। একটি গুলী এসে আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধির পেশী উড়িয়ে দিয়ে গেল।
গোটা দেহ কেঁপে উঠল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার দেহ লাদিনোর লাশের আড়ালে না থাকলে এতক্ষণে ঝাঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা নিজেকে সামলে নিয়ে লাদিনোর দেহকে কাত করে নিজের দেহের সাথে হেলান দিয়ে পকেট মেশিনগানটি লাদিনোর ঘাড়ের পাশ দিয়ে গলার উপর সেট করে ওদের দিকে গুলী বৃষ্টি শুরু করল। ওদের সামনে কোন কভার ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওদিক থেকে আসা ষ্টেনগানের গুলী বন্ধ হয়ে গেল। আরও কয়েক সেকেন্ড গুলীবৃষ্টি অব্যাহত রাখার পর গুরী বন্ধ করল আহমদ মুসা। এরপরও কিছুক্ষণ নিস্ক্রিয় পড়ে থেকে অপেক্ষা করল সে।
ওদিকের ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে।
ছেলেটি আহমদ মুসাকে বন্দী করে আনা দেখেছে। তাদের আনন্দ দেখে সে বুঝেছে যে নতুন বন্দী নিশ্চয় বড় কেউ। তার উপর নির্যাতনও সে লক্ষ্য করেছে। জীবনের আশা সে ছেড়ে দিয়েছিল। চোখ বুজে অকথ্য নির্যাতনও সহ্য করছিল। কিন্তু গুলীর শব্দে সে চোখ খুলেছিল। আঁৎকে উঠেছিল নতুন বন্দীকে মেরে ফেলল এই চিন্তা করে। চোখ খুলেই সে দেখল তার পাশে দাঁড়ানো শত্রু লোকটি গুলী খেয়ে ঢলে পড়ছে। নতুন বন্দীর ওখানেও একজন লোককে গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখল। পরক্ষণেই ওপাশে বসে থাকা লোকদের নতুন বন্দীর দিকে গুলীবৃষ্টি করতে লাগল। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে নতুন বন্দীর দিক থেকে গুলীবৃষ্টি শুরু হলে খুশি হয় সে। গুলী বন্ধ হলে নতুন বন্দীর কোন সাড়া না পেয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছে তার দিকে।
আহমদ মুসার কাছে এসেই সে বলল, ‘স্যার আপনি ভালো তো? এ কি, আপনার বাহুতে গুলী লেগেছে স্যার!’
আহমদ মুসা উঠে বসল। গোটা দেহ তার রক্তাক্ত।
একদিকে পেরেকওয়ালা ব্যাটনের প্রহার ও বাহুতে গুলী লাগা, অন্যদিকে লাদিনোর গায়ের রক্ত তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসা ছেলেটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে বসেই বলল, ’তোমার নাম কি?’
‘ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।’
‘তুমি ব্যাংকক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
‘জি, হ্যাঁ।’
‘তুমি জাবের জহীর উদ্দিন ও যয়নব যোবায়দার বন্ধু এবং যয়নব যোবায়দার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তাই না?’
ছেলেটির চাইনিজ-থাই ফর্সা চেহারায় বিস্ময়, সেই সাথে লজ্জায় লাল রং দেখা গেল। বলল, ‘স্যার এতকিছু জানলেন কি করে? আপনি কে?’ সংকুচিত ভাব ছেলেটার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা অব্যাহত রাখল। বলল, ‘গত তিন মাস ধরে পালিয়ে আছ। এক মাস হলো যয়নবদের সাথেও কোন যোগাযোগ করনি।’
‘জি স্যার। ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি কোন যোগাযোগ করিনি।’
‘নিরুদ্দেশের এক মাস তুমি কোথায় ছিলে?’
‘পাত্তানীর গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি।’
‘শুধু ঘুরে বেড়ানো?’
‘আমি তাদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি স্যার।’
‘পরিস্থিতিটা কি বলত? মানুষকে কি বুঝিয়েছ?’
‘পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কনফিউজড স্যার। আমি সকলকে এই কথায় একমত করার চেষ্টা করেছি যে, পুলিশ ও সেনাসদস্যদের সাথে এবং নিজেদের মধ্যে সংঘাত থেকে দূরে থাকতে হবে। সেই সাথে সন্ত্রাসের কাজ কারা করছে এ সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করতে হবে এবং এসব তথ্য পুলিশের কাছে পৌছে দিতে হবে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। এই লোকগুলো তোমার সাথে কথা বলেছে। আচ্ছা বলত এরা দেশী না বিদেশী, এদের কাউকে চেন কি-না, এরা পাত্তানী কি-না কিংবা এ অঞ্চলের কি-না?’
একটু অপেক্ষা করল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তারপর বলল, ‘এখানে এই দশ জনের মধ্যে পাত্তানী কেউ নয়। আপনার পাশের যে লাশটি, এটিই শুধু বিদেশী, অন্যরা সবাই থাইল্যান্ডের অন্যান্য অঞ্চলের। এদের এতক্ষণের বিভিন্ন আলোচনা ও চেহারা ছুরত দেখে মনে হয়েছে এরা সবাই ক্রিমিনাল।’
আহমদ মুসা রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কল করল ব্যাংককে পুরসাত প্রজাদিপককে। আহমদ মুসার কণ্ঠ পেয়েই ওপার থেকে পুরসাত প্রজাদিপক বলল, ‘বল বিভেন বার্গম্যান। নিশ্চয় কোন সুখবর দেবে?’
আহমদ মুসা মোবাইলের স্পীকার অন রেখেছিল। মোবাইলের কথা শুনতে পাচ্ছে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনও। আহমদ মুসাকে ওপার থেকে ‘বিভেন বার্গম্যান’ নামে সম্বোধন করায় অস্বস্তির একটা চিহ্ন ফুটে উঠল তার মুখে।
পুরসাত প্রজাদিপকের কথার জবাবে আহমদ মুসা বলল, ‘স্যার আমার পক্ষ থেকে একটা খবর। সুখবর হবে কিনা সেটা আপনাদের উপর নির্ভর করে।’
‘আচ্ছা, খবরটা বল।’
‘ভোর রাতে আপনাকে জানিয়েছিলাম ওরা যয়নব যোবায়দাকে কিডন্যাপ করতে এসেছিল। কিডন্যাপ করতে আসা নিহত আটজনের মধ্যে একজন বিদেশীও ছিল। শাহবাড়ির পেছনের বন্ধ কূপে এদের লাশ আছে, পরীক্ষা করলেই এদের পরিচয় মিলবে। সকালেও আবার শাহবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। এবার তিন গাড়ি বোঝাই করে এসেছিল দশজন। আপনি জাবেরের বন্ধু ফরহাদকে জানেন। সে ওদের বন্দী হয়েছিল। আমিও বাড়িতে প্রবেশ করতে গিয়ে বন্দী হয়েছিলাম। শেষে যা হোক ওরা দশজনই মারা গেছে। এদের মধ্যেও একজন বিদেশী। অবশিষ্ট নয় জনের কেউ পাত্তানী অঞ্চলের নয় এবং তারা সবাই পেশাদার ক্রিমিনাল। আপনারা তদন্ত করলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে স্যার।’
‘বুঝেছি, এই ঘটনাকে দ্বিতীয় প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করতে চাচ্ছ। গত রাতে এবং সকালের দু’টি অভিযানেই নেতৃত্ব দিয়েছে দুই বিদেশী। যারা তাদের সাথে ছিল, তারা পাত্তানীর লোক নয়, অ-পাত্তানী ক্রিমিনাল ওরা। এর অর্থ তৃতীয় যে পক্ষ জাবেরকে ছিনতাই করে নিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহার করছে, তারা আজ জাবেরের বোন যয়নবকে কিডন্যাপ করার জন্যে বার বার চেষ্টা করেছে।’
‘ঠিক স্যার।’
‘ধন্যবাদ। তোমার ‘বিদেশী’ ও ‘ক্রিমিনাল’ তথ্য দুটি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে এটা অবশ্যই একটা বড় প্রমাণ হবে। তুমি যয়নবকে বলে দাও থানায় একটা ডাইরী করতে। আমি পাত্তানী পুলিশকে বলে দিচ্ছি, ওরা সব লাশ উদ্ধার এবং তাদের ব্যবহৃত সব গাড়ি সীজ করে তদন্ত শুরু করবে। কিন্তু বিভেন বার্গম্যান তোমাকে আরও অনেক এগুতে হবে। এ পর্যন্ত সন্ত্রাসের যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেসব যারা ঘটাল তাদের সব প্রমাণ দিনের আলোতে আনতে হবে এবং ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যকে পরিষ্কারভাবে সামনে আনতে হবে। মনে রেখ, ওদের একজন লোককেও এখন পর্যন্ত ধরা যায়নি এবং কোন দলিলও হাত করা যায়নি।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। অনেক এগুতে হবে আমাদের।’
‘ধন্যবাদ বিভেন বার্গম্যান।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
আহমদ মুসা মোবাইল অফ করতেই ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘আলোচনায় যা শুনলাম, তা স্বপ্ন অবশ্যই নয়। তাহলে আপনিই তো আমাদের সব কাজ করছেন? কিন্তু নাম বিভেন বার্গম্যান, কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। আপনি কে স্যার?’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের কথায় কান না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এমন রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরে বেরুনো যাবে না। এখন কি করা যায় বল।’
‘স্যার উপরে গেষ্টরুমে আমি কখনও কখনও থাকি। সেখানে আমার কাপড়-চোপড় থাকার কথা। চলুন দেখি।’
উপরে দোতলায় উঠে গেল তারা।
উঠতে উঠতে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার এই বাড়িটা এক কালে পাত্তানী এলাকার ‘রাজ ভবন’ ছিল। এর নিচ তলা ছিল জনগণের দরবার এলাকা। মানে সুলতানের শাসন অফিস। দ্বিতীয় তলা অতিথীশালা ও পরিবারের ষ্টাফদের আবাসিক এলাকা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। আর উপরের তলা ছিল শাহ পরিবারের নিজস্ব আবাসিক এলাকা। বিশাল এই বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরের কোনটাতেই ৫০টির কম কক্ষ নেই। এই বাড়িতে ঢুকলেই শরীল রোমাঞ্চিত হয় স্যার। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন থাই রাজপুত্র বাংগসা ওরফে সুলতান আহমদ শাহ। কত পার্থক্য সেদিনের এই বাড়ি ও আজকের এই বাড়ির মধ্যে!’
থামর ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল।
তার আবেগটা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বলল, ‘ফরহাদ, এই বংশের সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক আছে?’
‘এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন স্যার?’
‘এই বংশের প্রতি তোমার আবেগ এবং এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তোমার স্থায়ী গেষ্ট হওয়া দেখে।’
‘ঠিকই ধরেছেন স্যার। এই বংশেরই এক সন্তান আমি। প্রায় শত বছর আগে পাত্তানী অঞ্চল দুটি সালতানাতে বিভক্ত ছিল। যয়নব যোবায়দার দাদার বাপরা ছয় ভাই ছিলেন। ছয় ভাই ছয়টি সালতানাতে রাজত্ব করতেন। রাজ্যগুলো থাই কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে চলে গেলে যয়নব যোবায়দার দাদার বাবা সুলতান আব্দুল কাদের কামাল উদ্দিন ছাড়া অন্য পাঁচ ভাই হিজরত করে মালয়েশিয়া চলে যান। সেই পাঁচ ভাইয়েরই এক ভাইয়ের বংশধর আমি। জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন ‘তাফসিরুল কুরআন’ শিক্ষার জন্য ছোটবেলা মালয়েশিয়া যায়। পাঁচ বছর সে মালয়েশিয়ায় ছিল। কোর্স শেষ করে সে থাইল্যান্ডে ফিরে আসে। তার সাথে আমার এত বন্ধুত্ব হয় যে, আমিও তা সাথে থাইল্যান্ডে চলে আসি। ব্যাংককের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এই বাড়ির গেষ্ট রুম আমার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাবেরের সাথে এখানে এলে বা সুলতান গড়ে থাকলে এই গেষ্ট রুমেই আমি থাকি। কিন্তু তাই বলে ‘গেষ্ট’ নয়, পরিবারের একজন সন্তান হিসাবেই দাদী এবং অন্যরা আমাকে দেখেন।’
থামল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
আহমদ মুসার ঠোঁটে মিষ্টি এক টুকরো হাসি। বলল, ‘জামাই হিসেবে দেখেন না?’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। লজ্জাজড়িত ধীর কণ্ঠে বলল, ‘বিশ্বাস করুন স্যার, যয়নবের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, এ কথা আপনার কাছে আমি প্রথম শুনলাম। না দাদী, না অন্য কেউ এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেছেন।’
‘যয়নব যোবায়দার দিক থেকে?’
‘না স্যার। যয়নব খুব ভালো মেয়ে। খুব নীতি-নিষ্ঠ সে। তিন তলায় তার এলাকায় কোন দিন আমি ঢুকিনি, ঢোকার অনুমতিও নেই। দাদী ও জাবেরের ঘর পর্যন্ত আমার যাতায়াত।’
‘কথা বল না তোমরা?’
‘তার ফরমাল অবস্থায় প্রয়োজনীয় যেটুকু সেটুকু কথাই হয়।’
‘তার ‘ফরমাল অবস্থা’ বুঝলাম না ফরিদ।
‘ফরমাল পোশাক পরে যখন সে বাইরে আসে।’
‘ফরমাল পোশাক কি?’
‘যখন সে বাইরে আসে, গা মাথা ঢেকে জাবের সাথে বাইরে আসে। এটাই তার ফরমাল অবস্থা।
‘বুঝেছি।’ বলে আহমদ মুসা একটু মিষ্টি হাসল। বলল, ‘হতাশ হয়ো না ফরহাদ। তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে থাকার কথা দাদী আমাকে বলেছেন এবং সেটা তিনি বলেছেন যয়নব যোবায়দার সামনে। তুমি খুশি?’
একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। লাজ রাঙা মুখ নিচু করে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। দাদী আর জাবের আমাকে খুব ভালবাসেন।’
‘আর যয়নব? তার প্রতি অবিচার করছ কেন?’
সলজ্জ হেসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, ‘ওটা ভাবার সাহস আমার এত দিন হয়নি। সে আমার কাছে দুর্লভ এক ‘মনি’।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল। লজ্জা লুকাতে নতমুখী ফরহাদের কাঁধে হাত রেখে আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাদের দু’জনকে। ভিন্ন ধরনের এক শিরী-ফরহাদ তোমরা এবং এটাই আদর্শ।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ফরহাদের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘দেখি তোমার কি আছে দেখাও।’
প্রসঙ্গান্তরে যাবার সুযোগ পেয়েই যেন ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন হঠাৎ এ্যাকটিভ হয়ে উঠল। ছুটে গেল ড্রেস-ক্যাবিনেটের কাছে। খুলে ফেলল ড্রেস-ক্যাবিনেট। বলল, ‘দেখুন স্যার আপনি কি পছন্দ করবেন।’
‘আর দেখাদেখি নয়। তুমি আমার জন্যে শার্ট, প্যান্ট দাও। আর জ্যাকেট থাকলে জ্যাকেট নিয়ে এস। আমার অনেক পকেট দরকার।’ বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল সোফায়। সামনে একটি আলমারির উপর একটা ফার্ষ্ট এইড বক্স দেখতে পেল। উঠে গিয়ে সেটা নামিয়ে আনল। বাক্সে দুই প্যাকেট এন্টিসেপটিক ও এন্টিপেষ্ট ফাইবার ব্যান্ডেজও পেল। একটা প্যাকেট ফরহাদের জন্যে, অন্যটি নিজের জন্যে নিয়ে নিল। বাহু সন্ধির বুলেটাহত স্থানের রক্ত বন্ধ করা প্রয়োজন।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন কয়েকটা প্যান্ট, অনেকগুলো শার্ট এবং কয়েকটা জ্যাকেট এনে আহমদ মুসার কাছে রেখে বলল, ‘কোনটা কোনটা আপনার পছন্দ হয় দেখুন।’
‘ধন্যবাদ ফরহাদ।’ বলে আহমদ মুসা একটা গাবাডিন প্যান্ট, একটা সুতি শার্ট এবং বেশি পকেটের একটা জ্যাকেট বেছে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে বলল, ‘নির্জন ঘরে তুমিও পোশাক পাল্টে নাও। সোফার উপর ব্যান্ডেজ প্যাকেট আছে। ব্যবহার করতে পার।’
পোশাক পাল্টে নিল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
আহমদ মুসাও বেরিয়ে এল।
‘স্যার আপনি বুলেটাহত স্থান কি ব্যান্ডেজ করেছেন?’
‘ব্যান্ডেজ করিনি, বেঁধেছি।’
‘আমরা এখন কোথায় যাব স্যার?’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘তোমার এখানে কোন ঠিকানা নেই?’
‘শাহবাড়ি ছাড়া এখানে কোন ঠিকানা নেই। আমি আজ এখানে এসেছিলাম পঞ্চাশ মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে।’
‘চিন্তা নেই তুমি যে ঠিকানায় এসেছিলে, সে ঠিকানায় তুমি যাবে।’
‘বুঝলাম না স্যার।’
‘দাদীমারা যেখানে আছেন, সেখানেই তুমি যাবে। তোমাকে কমপক্ষে ৭ দিন শুয়ে থাকতে হবে।’
‘কেন?
‘পেরেকওয়ালা ব্যাটনের প্রহারের প্রতিক্রিয়া কত তীব্র তা বুঝতে পারবে কয়েক ঘণ্টা পর থেকে।’
বলেই হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
পেছনে পেছনে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
গাড়ি বারান্দায় ব্ল্যাক ঈগলের তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠতে যাচ্ছিল। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার আপনার একটা হাত আহত। আমি ড্রাইভ করতে পারি।’
আহমদ মুসা সরে গিয়ে পাশের সিটে বসল। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন উঠল ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
‘ফরহাদ, মেইন রোডে উঠেই এ গাড়ি দাঁড় করাতে হবে। একটা গাড়ি ঠিক করবে পাত্তানী সিটির ওল্ড এলাকার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার এ গাড়ি নিয়েও তো আমরা পাত্তানী সিটিতে যেতে পারি।’ ফরহাদ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এর অর্থ হবে আমাদের ঠিকানা শত্রু ব্ল্যাক ঈগলকে জানিয়ে দেয়া।’
‘কিভাবে?’ ফরহাদ বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘এ গাড়ির কোথাও ট্রান্সমিটার চীপ লাগানো আছে। গাড়ি যেখানেই থাকুক, এই ট্রান্সমিটার তার অবস্থান জানিয়ে দেবে।’
ফরহাদের চোখ থেকে বিস্ময় তখনও কাটেনি। বলল, ‘কিভাবে জানলেন স্যার আপনি?’
‘বলব।’
বিস্ময় কাটেনি ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের চোখ থেকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আজকের শুরু থেকে সব দৃশ্য। সব শক্তি, সব জ্ঞান দিয়ে যেন আল্লাহ এক ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছেন। কে এই ফেরেস্তা? ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন আহমদ মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন কি আবার জিজ্ঞেস করতে পারি স্যার?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বললেই তো জানা শেষ হয়ে যাবে জানার আগ্রহটা থাক না।’
মেইন রাস্তায় গাড়ি পৌছে গিয়েছিল।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন রাস্তার বাইরে একটা গাছের আড়াল নিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘স্যার, আপনি একটু বসুন, আমি গাড়ি দেখছি।’ বলে ফরহাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে বলেছিল, পেরেকওয়ালা ব্যাটন চার্জের প্রতিক্রিয়া তুমি বুঝতে পারবে কয়েক ঘণ্টা পর থেকে। ৭ দিন তোমাকে শুয়ে থাকতে হবে। কথাটা আহমদ মুসার ক্ষেত্রে বেশি ফলেছে। সাত দিন তাকে বিছানা থেকে উঠতে হয়নি। অবশ্য ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সাত দিনেও সেরে উঠতে পারেনি। তার অবস্থা ছিল আরও কাহিল।
আহমদ মুসা মনে করেছিল, সে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে যয়নব যোবায়দাদের ওখানে পৌছে দিয়েই সুলতান গড়ে ফিরে যাবে তার সদ্য ভাড়া করা বাড়িতে। কিন্তু দাদী ও যয়নব তাকে ছাড়েনি। কোন কথা না শুনে আহমদ মুসা চলে আসতে গেলে আড়াল থেকে যয়নব যোবায়দা বেরিয়ে এসেছিল। কেঁদে উঠে বলেছিল, ‘আপনি সবার জন্যে হবেন, কেউ আপনার জন্যে নয়, এটা শুধু সবার প্রতি আপনার জুলুম নয়, এটা আপনার অন্যায় আত্মপীড়ন। এই মনোভাব ইসলামের সামাজিক সম্পর্কের লংঘন।’ বলে একটু থেমে আবেগকে সম্বরণ করে নিয়ে আবার বলে উঠেছিল, ‘ভাই বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে, বোনেরও দায়িত্ব আছে ভাইয়ের প্রতি। দারুণ আহত অবস্থায় আপনি যেখানে যাবেন, সেই সদ্য ভাড়া করা বাড়িতে আপনার কেউ নেই। হাসপাতালে যাওয়া যেমন নিরাপদ হবে না, তেমনি যে কোন ডাক্তার ডাকাও নিরাপদ নয়। এই অবস্থার কথা জেনে আপনাকে আমরা ছাড়ব কি করে?’ অশ্রু সম্বরণের চেষ্টা সত্ত্বেও যয়নবের শেষের কথাগুলো কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কোন কথা না বলে আহমদ মুসা ঘরের দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে এসে সোফায় বসেছিল। বলেছিল, ‘স্যরি বোন। আমি বোনদের দায়িত্বশীল প্রমাণ করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, আমাদের সবার অবস্থান এক জায়গায় না হোক।’
‘আপনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই হবে স্যার। পাশের বাড়িই একজন মহিলা সার্জনের। তিনি আমার মায়ের বন্ধু, তার ওপর বর্তমান সংকটে তিনি আমাদের একজন মুরুব্বিও। তিনি আপনাদের দেখবেন। তারপর যা ভালো মনে হয় করা যাবে স্যার।’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা।
আহমদ মুসার চোখ দু’টো নিচু। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছিল। বলেছিল, ‘বোন কি ভাইকে ‘স্যার’ বলে?’
বিব্রত ভাব ফুটে উঠেছিল যয়নব যোবায়দার মুখে। কয়েক মুহূর্ত কথা বলেনি সে। তারপর বলেছিল, ‘স্যরি, অভ্যাসবশত বলেছি ভাইয়া।’
‘স্যার, আপনি ভাই হয়ে গেলেন। কিন্তু আপনার পরিচয় জিজ্ঞেস করেও জানতে পারছি না।’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
‘তোমার ধারণা বলত তিনি কে হতে পারেন?’ বলেছিল দাদী।
‘না দাদীজী বলতে পারব না। অনেক ভেবেছি আমি। কাউকে আমি খুঁজে পাইনি। কাজ ও যোগ্যতার দিক দিয়ে রূপকথার রাজপুত্রের সাথে তার তুলনা হয়। কিন্তু রূপকথার রাজপুত্র তো এভাবে বাস্তবে আসে না!’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
‘রূপকথার রাজপুত্র বাস্তব হয়ে আসে না, কিন্তু বাস্তবে রূপকথার রাজপুত্রের চেয়েও বড় রাজপুত্র থাকতে পারে।’ বলেছিল দাদী।
‘আমি মানলাম দাদী, ইনি সেরকম কেউ, কিন্তু কে?’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
ফরহাদ থামতেই আহমদ মুসা বলেছিল, ‘দাদীমা, প্লিজ এই আলোচনা রাখুন। প্রতিদিন পৃথিবীতে রূপকথার চেয়ে বড় হাজারো রূপকথা তৈরি হচ্ছে। এই রূপকথা যারা সৃষ্টি করছে, তারা সবাই সাধারণ মানুষ, রাজপুত্র নয় দাদীমা।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল দাদীমা। কিন্তু বলা হয়নি। পরিচারিকা ডাক্তারী ব্যাগ হাতে এ্যাপ্রন পরা একজন পঁয়তালিস্নশ-পঞ্চাশ বছরের মহিলাকে নিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করেছিল।
যয়নব যোবায়দা এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে সালাম দিয়ে বলে, ‘আসুন ডাক্তার খালাম্মা।’
যয়নব যোবায়দা ডাক্তার খালাম্মাকে আহমদ মুসাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সালাম বিনিময় ও প্রাথমিক কথা শেষ হলে যয়নব যোবায়দার নির্দেশে পরিচারিকা আহমদ মুসাকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য তাকেই প্রথম দেখা হয়, পরে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যান্ডেজ শেষে দু’জনকে তাদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার খালাম্মা ফিরে আসেন ড্রইং রুমে।
শোফায় বসতে বসতে বলেছিলেন, ‘তোমাদের পরিচারিকারা খুব দক্ষ। আমার নার্সের চেয়েও ভালো কাজ করেছে তারা।’
‘এ মেয়েরা খুবই আন্তরিক ডাক্তার খালাম্মা।’ বলে যয়নব যোবায়দা।
‘ওদের কেমন দেখলে ডাক্তার মা?’ দাদী বলেছিল উদগ্রীব কণ্ঠে।
মুখটা মলিন হয়ে যায় ডাক্তারের। বলেছিল, ‘আমার ডাক্তারী জীবনে এমন বীভৎস দৃশ্য আমি দেখিনি আম্মাজী। শুনলাম পেরেকওয়ালা ব্যাটন দিয়ে ওদের পেটানো হয়েছে, বিশেষ করে বিভেন বার্গম্যান নামের ছেলেটার দু’পাজরে অক্ষত চামড়া নেই বললেই চলে। আর ওর বাম বাহু-সন্ধির মাসলটা বুলেট একেবারে তুলে নিয়ে গেছে। এদিকে ফরহাদ ছেলেটা মোটামুটি আছে। প্রায় সারা গায়েই পেরেকের আঘাত আছে, কিন্তু মেজর কিছু নয়।’
‘বিভেন বার্গম্যানের কেমন রেষ্ট দরকার হবে, ডাক্তার খালাম্মা?’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা।
‘বেটি তার দু’পাজরে ও বাহু সন্ধিতে নতুন চামড়া গজাতে হবে। আট-দশদিন তাকে বিছানা থেকেও উঠতে দেয়া যাবে না। তারপরেও সপ্তাহখানেক রেষ্ট দরকার হবে। তবে এই ছেলেটার ক্ষেত্রে এত সময় লাগবে বলে মনে হয় না। মানসিক শক্তি তার অবিশ্বাস্য। এ ধরনের লোকদের যে কো ব্যধিই দ্রুত সেরে যায়।’
‘ব্যাপারটা কি করে বুঝলেন খালাম্মা?’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা আগ্রহের সাথে।
‘তার বুলেট-বিদ্ধ ও ব্যাটনের পেরেক বিদ্ধ বিরাট আহত স্থান আমাকে পরিষ্কার করতে হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে রোগীরা চিৎকার করে, উঃ আঃ তো করেই। যেমন ফরহাদ করেছে, সে খুব কষ্টও পেয়েছে। কান্না আটকাতে পারেনি বেচারা। কিন্তু বিভেন বার্গম্যানের মুখে কষ্টের একটি ভাঁজও পড়তে দেখিনি। গোটা সময় সে চোখ বন্ধ করে ছিল। যেন শান্তিতে ঘুমুচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। সব সময় কণ্ঠ স্বাভাবিক ছিল। চা খেতে খেতে গল্প করেছে। এমন নার্ভের মানুষ আমি আগে দেখিনি। তাকে মনে হয়েছে একটা অনুভূতিহীন পাথর। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কষ্ট লাগছে না? উত্তরে সে বলেছিল, কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক। আমি বলেছিলাম, কিন্তু তোমাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না? সে বলেছিল, কষ্ট হজম করতে পারলে বাইরে তা আর প্রকাশ পায় না। ঠিক বলেছে সে। কিন্তু এমন নার্ভ কম মানুষেরই থাকে। কে এই লোক বেটি?’
যয়নব যোবায়দা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে, ডাক্তার খালাম্মাকে কতটুকু বলা যায়। কিছু না বললে তিনি মাইন্ড করতে পারেন। সেটা ভালো হবে না। এসব চিন্তা করে যয়নব যোবায়দা বলে, ‘উনি আমাদের মেহমান। একজন বিদেশী।’
‘কিন্তু সে তো খৃষ্টান। নাম শুনে তো তাই মনে হচ্ছে! এমন মারাত্মকভাবে আহত ও গুলীবিদ্ধ হলো কোথায়?’ ডাক্তার খালাম্মা বলেছিল। তাঁর চোখে বেদনা ও বিস্ময়।
যয়নব যোবায়দা একবার দাদীর দিকে তাকায়। একটু ভাবে। তারপর বলে, ‘আপনি আমাদের বিপদের কথা জানেন। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকেও আপনি চেনেন। সে সুলতান গড়ে আক্রান্ত ও কিডন্যাপড হলে এই বিদেশী তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও বন্দী হয়। উভয়েই নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু তারা অবশেষে নিজেদের মুক্ত করতে সমর্থ হয়।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। দেখ মানুষ মানুষের জন্য কত করতে পারে! বিদেশী বিভেন বার্গম্যানই বেশি নির্যাতিত হয়েছে।’ বলেছিল ডাক্তার খালাম্মা।
যয়নব যোবায়দার এই বলা এবং ডাক্তার খালাম্মার এই শোনা যে সংকট ডেকে আনবে কেউ তখন এটা বুঝেনি।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »