৪৪. ব্লাক ঈগলের সন্ত্রাস

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

শাহবাড়ির পাহাড়ের গোড়ায় পৌছে আহমদ মুসা ভাবল, মসৃণ রাস্তা ধরে সে গাড়ি নিয়ে শাহবাড়িতে উঠে যেতে পারে। কিন্তু উঠতে গিয়ে মনের তরফ থেকে বাধা পেল আহমদ মুসা।
সুতরাং ওঠা বাদ দিয়ে আহমদ মুসা পাহাড় ঘুরে শাহবাড়ির পেছনে চলে এল এবং প্রথমবারের মত এবারও পাহাড় বেয়ে ক্রলিং করে শাহবাড়ির পেছনের সংকীর্ণ একটা চত্বরে উঠে এল।
একটা ছোট গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল আহমদ মুসা। তারপর বাড়ির দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে লাগল। ইতিমধ্যেই কেউ এসেছে কিনা, তার অনেক খানি বোঝা যাবে সামনের দিকটা দেখলে।
বাড়ির সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। আহমদ মুসা দেয়ালের যে বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা পার হলেই গাড়ি বারান্দা দেখা যাবে।
আহমদ মুসা সোজাসুজি বাঁকটা পার না হয়ে গাড়ি বারান্দা দেখার জন্যে উঁকি দিল। দেখতে পেল গাড়ি বারান্দা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি গাড়ি। দুটি মাইক্রো এবং একটি জীপ।
বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে। এতগুলো গাড়ি নিয়ে কারা এল? ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা কি? তাদের আসাই স্বাভাবিক। ভোর পর্যন্ত তাদের লোকরা যয়নব যোবায়দাকে ধরে নিয়ে না ফেরায় এবং সম্ভবত যোগাযোগেও ব্যর্থ হওয়ায় খারাপ কোন কিছু ঘটার আশংকায় তারা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে বুঝল গাড়িতে কোন লোক নেই। যারা এসেছে নিশ্চয় সবাই ভেতরে ঢুকেছে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
বাহিরটা আরেকবার দেখে ভেতরে ওদের উপর চোখ রাখার সিদ্ধান্ত নিল।
ভেতরে ঢোকার দরজা খোলা পাবে ভেবেছিল। খোলাই পেল।
ধীরে ধীরে ঘরের দরজা খুলল। দিন হলেও ভেতরটা অন্ধকার দেখল। ভেতরটা সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করতে চাইল আহমদ মুসা।
কিন্তু দরজা খুলে স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই ছুটে আসা একটা কিছু তার উপর পড়ল। এর নরম স্পর্শ পাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার অভিজ্ঞ অনুভূতি নিশ্চিত হলো কি ঘটতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল বর্তমান সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভয়ংকর নরম ধাতব ফাঁস তাকে এসে ঘিরে ধরেছে।
ফাঁস আহমদ মুসাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই চোখের পলকে আহমদ মুসা বসে পড়ল। ঠিক যেমন মায়ের পেটে শিশু দুই হাঁটু, দুই হাত এবং মাথা এক সন্ধিস্থলে নিয়ে অবস্থান করে। এর ফলে নরম ধাতব ফাঁস প্রত্যেক অংগকে আলাদা করে আটকে ফেলে মানুষকে একেবারে নিস্ক্রিয় করে ফেলার যে কাজ করে তা করতে পারল না।
ফাঁদ তার বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিক্ষিপ্ত হবার পর গুটিয়ে গিয়ে আহমদ মুসাকে রাগবি বলের মত রূপ দিল।
ফাঁদ যে ছুঁড়েছিল সম্ভবত সেই লোকটিই চিৎকার করে উঠল, ‘শিকার ধরে পড়েছে।’
সংগে সংগেই ছুটে এল কয়েকজন লোক। তারা ফাঁদ ধরে টেনে-হিঁচড়ে আহমদ মুসাকে ভেতরে এক তলার দরবার কক্ষে নিয়ে গেল।
আহমদ মুসা ফাঁদের মধ্যে তার দেহকে যেভাবে গুটিয়ে নিয়েছিল, তাতে তার দেহ হয় ডান ও বাম দিকে কাত হয়ে, নয়তো চিৎ হয়ে থাকছে।
দরবার কক্ষে যখন তাকে আছড়ে ফেলল তখন তার দেহটা কাত হয়ে পড়ল। একজন তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘লাদিনো বস, হোটেল থেকে এরই ফটো পাওয়া গেছে। তার মানে এই সেদিন মেলার মাঠে আমাদের চারজন লোককে হত্যা করেছে।’ বলেই আহমদ মুসাকে কষে কয়েকটা লাথি লাগাল।
লাদিনো ব্ল্যাক ঈগলের এই দলের প্রধান। এরাই সকালে পাত্তানী সিটি থেকে শাহবাড়ি এসেছে তাদের লাপাত্তা হওয়া সাথীদের খোঁজে।
লাদিনো ছুটে এল তার সাথীর কথা শুনে। আহমদ মুসার কাছে এসে আহমদ মুসার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল। দেখে সেও চিৎকার করে উঠল, ‘ঠিক, কোন সন্দেহ নেই এই শয়তানই সেই শয়তান।’
বলে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম দিল, ‘একে ঝাড় বাতির হুকের সাথে টাঙাও। তারপর পেটাও। আজ আমাদের ৮ জন লোক গায়েব হওয়ার খবরও এই শয়তান দিতে পারবে। আমি নিশ্চিত, ঐ শয়তান আর এই শয়তান দু’জনেই আজ রাতে এখানে ছিল। যয়নবরা কোথায় এ কথাও এরাই বলতে পারবে।’
আহমদ মুসাকে টাক্সিয়ে দেয়া হয়েছে ছাদের ঝাড়বাতির হুকের সাথে। ফাঁসের গোড়াটাকে বাঁধা হয়েছে হুকের সাথে। ফাঁসের পেটে ঝুলছে আহমদ মুসা মাটি থেকে দুই ফিট উপরে।
আহমদ মুসার গুটানো দেহটা এবার ফাঁদে উপুড় হয়ে আছে। মেঝের বড় অংশই সে এখন দেখতে পাচ্ছে।
মেঝের উপর পড়ে থাকা একটা রক্তাক্ত যুবকের দেহ তার নজরে পড়ল। তেইশ চবিবশের মত বয়স হবে যুবকটির। বুঝাই যাচ্ছে তাকে নির্মমভাবে মেরেছে। আহত স্থানগুলো থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সম্ভবত ছেলেটিকেও সকালে এখানে ধরা হয়েছে। কিন্তু ছেলেটি কে? এখানে এসেছিল কেন?
লাদিনো নামের লোকটি এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। তার হাতে কালো রঙের একটি ব্যাটন। বুঝাই যাচ্ছে, শাল কাঠের ব্যাটনটি লোহার মত ভারী হবে। ব্যাটনের উপর পেরেক বসানো। পেরেকগুলো সিকি ইঞ্চির মত লম্বা। পেরেকের মাথাগুলো তীক্ষ্ণ নয়, ভোঁতা ধরনের। এ ধরনের কাঁটাওয়ালা ব্যাটন বেয়াড়া মানুষকে কথা বলাবার জন্যে নাকি খুবই উপকারী।
লাদিনো ব্যাটনটি দিয়ে ফাঁসে আবদ্ধ ঝুলন্ত আহমদ মুসাকে একটা প্রচন্ড আঘাত করে বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা, ঐ দিকে দেখ কথা বলায় কি হাল হয়েছে। আমরা জানতে চাই গত রাতে তুই এ বাড়িতে এসেছিলি কি-না, আমাদের ৮ জন লোক কোথায় গেল এবং কোথায় গেল এ বাড়ির লোকরা?’
‘একথা তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমরা তো এ বাড়িতে আমার আগে এসেছ। সব প্রশ্নের জবাব তোমাদের জানার কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
লাদিনো তার হাতের ব্যাটন দিয়ে আহমদ মুসার দুই পাঁজরে পাগলের মত পেটাল। আহমদ মুসা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল অকথ্য যন্ত্রণা। সহ্যের সীমা ডিক্সিয়ে দুই চোখ ফেটেই যেন অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার।
কিছুক্ষণ পিটিয়ে পেটানোতে ক্ষান্ত দিয়ে বলল, ‘আমার সাথে চালাকি করছিস। তুই মাঠে আমাদের ৪ জনকে মেরেছিলি, আজ রাতেই তুই-ই আমাদের ৮ জন লোককে গুম করেছিস। সরিয়েছিস যয়নবদেরকেও। তোকে মুখ খুলতেই হবে। না হলে পিটিয়েই মেরে ফেলব।’
‘যদি তোমরা নিশ্চিত হও, আমিই এজন্যে দায়ী, তাহলে ঐ ছেলেটিকে মেরেছ কেন? তার মানে আমি করেছি বলে যে কথা বলছ, সেটা তোমাদের অনুমান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঐ শয়তানও জড়িত আছে। না হলে বাড়িটা পাহাড়া দেবার জন্যে সে এসেছিল কেন? সেও জানে যয়নবরা কোথায় আছে।’ বলেই লাদিনো আবার ব্যটর তুলল এবং পেটাতে শুরু করল আহমদ মুসাকে।
অন্যদিকে আরেকজন পেটাতে শুরু করল ঐ ছেলেটিকে।
সে কানফাটা চিৎকার করতে লাগল।
আহমদ মুসার পাঁজর ঝাঝরা হয়ে গেল। রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচের মেঝেতে। আহমদ মুসার মুখ থেকে শব্দ বেরুচ্ছে না। কিন্তু একদিকে অসহ্য যন্ত্রণা, অন্যদিকে ছেলেটির কানফাটা চিৎকার আহমদ মুসাকে অতিষ্ঠ করে তুলল।
আহমদ মুসা মুক্ত হওয়ার কাজ আগেই শুরু করে দিয়েছিল। দু’হাত দিয়ে জামার কলার থেকে চাকু বের করে হাতে নিয়েছে এবং বের করে নিয়েছে শোল্ডার হোলষ্টার থেকে রিভলবার। যেহেতু তাকে নিয়ে ফাঁসটা মাটি থেকে দুই ফিট উপরে ছিল এবং আহমদ মুসাও যেহেতু উপুড় হয়ে ছিল। তাই তার হাতের কাজ লাদিনোরা কেউ দেখতে পেল না। এই সুযোগ গ্রহণ করেই আহমদ মুসা ফাঁস দেড়ফুট পরিমাণ কেটে ফেলল। তারপর যতটা সম্ভব ঘরটাকে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল, তাকে এবং ছেলেটিকে নির্যাতন চালানো দু’জন ছাড়া অন্য সবাই মেঝের মাঝখানে বসে আছে। শূন্য বাড়ি থেকে হাতে বহন করার মত মূল্যবান যেসব জিনিস ওরা লুট করেছে, সেগুলো তারা দেখাদেখি করছে।
আহমদ মুসা যথাসম্ভব গুটিয়ে নিয়ে দেহটাকে ছেড়ে দিল ফাঁসের কাটা অংশ দিয়ে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই চিৎ হলো। হাতে তার রিভলবার,ট্রিগারে আঙুল।
আহমদ মুসা পড়তেই টের পেয়ে গেল তার পাশে দাঁড়ানো লাদিনো। সে পকেটে হাত দিল রিভলবার বের করার জন্যে।
সে সুযোগ আহমদ মুসা তাকে দিল না। গুলী করল লাদিনোকে। দ্বিতীয় গুলী ছুঁড়ল ছেলেটিকে নির্যাতনকারী লোকটির উদ্দেশে। দ্বিতীয় গুলী করেই আহমদ মুসা শুয়ে থেকে তার পাশে পড়ে যাওয়া লাদিনোর কোমরের বেল্ট থেকে পকেট মেশিনগান বের করে নিয়ে তাক করল বসে থাকা লোকদের। ঐ লোকরা প্রথমে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও কেউ কেউ তাদের ষ্টেনগান তুলে বসে থেকেই গুলী চালানো শুরু করেছে। একটি গুলী এসে আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধির পেশী উড়িয়ে দিয়ে গেল।
গোটা দেহ কেঁপে উঠল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার দেহ লাদিনোর লাশের আড়ালে না থাকলে এতক্ষণে ঝাঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা নিজেকে সামলে নিয়ে লাদিনোর দেহকে কাত করে নিজের দেহের সাথে হেলান দিয়ে পকেট মেশিনগানটি লাদিনোর ঘাড়ের পাশ দিয়ে গলার উপর সেট করে ওদের দিকে গুলী বৃষ্টি শুরু করল। ওদের সামনে কোন কভার ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওদিক থেকে আসা ষ্টেনগানের গুলী বন্ধ হয়ে গেল। আরও কয়েক সেকেন্ড গুলীবৃষ্টি অব্যাহত রাখার পর গুরী বন্ধ করল আহমদ মুসা। এরপরও কিছুক্ষণ নিস্ক্রিয় পড়ে থেকে অপেক্ষা করল সে।
ওদিকের ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে।
ছেলেটি আহমদ মুসাকে বন্দী করে আনা দেখেছে। তাদের আনন্দ দেখে সে বুঝেছে যে নতুন বন্দী নিশ্চয় বড় কেউ। তার উপর নির্যাতনও সে লক্ষ্য করেছে। জীবনের আশা সে ছেড়ে দিয়েছিল। চোখ বুজে অকথ্য নির্যাতনও সহ্য করছিল। কিন্তু গুলীর শব্দে সে চোখ খুলেছিল। আঁৎকে উঠেছিল নতুন বন্দীকে মেরে ফেলল এই চিন্তা করে। চোখ খুলেই সে দেখল তার পাশে দাঁড়ানো শত্রু লোকটি গুলী খেয়ে ঢলে পড়ছে। নতুন বন্দীর ওখানেও একজন লোককে গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখল। পরক্ষণেই ওপাশে বসে থাকা লোকদের নতুন বন্দীর দিকে গুলীবৃষ্টি করতে লাগল। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে নতুন বন্দীর দিক থেকে গুলীবৃষ্টি শুরু হলে খুশি হয় সে। গুলী বন্ধ হলে নতুন বন্দীর কোন সাড়া না পেয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছে তার দিকে।
আহমদ মুসার কাছে এসেই সে বলল, ‘স্যার আপনি ভালো তো? এ কি, আপনার বাহুতে গুলী লেগেছে স্যার!’
আহমদ মুসা উঠে বসল। গোটা দেহ তার রক্তাক্ত।
একদিকে পেরেকওয়ালা ব্যাটনের প্রহার ও বাহুতে গুলী লাগা, অন্যদিকে লাদিনোর গায়ের রক্ত তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসা ছেলেটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে বসেই বলল, ’তোমার নাম কি?’
‘ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।’
‘তুমি ব্যাংকক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
‘জি, হ্যাঁ।’
‘তুমি জাবের জহীর উদ্দিন ও যয়নব যোবায়দার বন্ধু এবং যয়নব যোবায়দার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তাই না?’
ছেলেটির চাইনিজ-থাই ফর্সা চেহারায় বিস্ময়, সেই সাথে লজ্জায় লাল রং দেখা গেল। বলল, ‘স্যার এতকিছু জানলেন কি করে? আপনি কে?’ সংকুচিত ভাব ছেলেটার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা অব্যাহত রাখল। বলল, ‘গত তিন মাস ধরে পালিয়ে আছ। এক মাস হলো যয়নবদের সাথেও কোন যোগাযোগ করনি।’
‘জি স্যার। ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি কোন যোগাযোগ করিনি।’
‘নিরুদ্দেশের এক মাস তুমি কোথায় ছিলে?’
‘পাত্তানীর গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি।’
‘শুধু ঘুরে বেড়ানো?’
‘আমি তাদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি স্যার।’
‘পরিস্থিতিটা কি বলত? মানুষকে কি বুঝিয়েছ?’
‘পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কনফিউজড স্যার। আমি সকলকে এই কথায় একমত করার চেষ্টা করেছি যে, পুলিশ ও সেনাসদস্যদের সাথে এবং নিজেদের মধ্যে সংঘাত থেকে দূরে থাকতে হবে। সেই সাথে সন্ত্রাসের কাজ কারা করছে এ সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করতে হবে এবং এসব তথ্য পুলিশের কাছে পৌছে দিতে হবে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। এই লোকগুলো তোমার সাথে কথা বলেছে। আচ্ছা বলত এরা দেশী না বিদেশী, এদের কাউকে চেন কি-না, এরা পাত্তানী কি-না কিংবা এ অঞ্চলের কি-না?’
একটু অপেক্ষা করল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তারপর বলল, ‘এখানে এই দশ জনের মধ্যে পাত্তানী কেউ নয়। আপনার পাশের যে লাশটি, এটিই শুধু বিদেশী, অন্যরা সবাই থাইল্যান্ডের অন্যান্য অঞ্চলের। এদের এতক্ষণের বিভিন্ন আলোচনা ও চেহারা ছুরত দেখে মনে হয়েছে এরা সবাই ক্রিমিনাল।’
আহমদ মুসা রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কল করল ব্যাংককে পুরসাত প্রজাদিপককে। আহমদ মুসার কণ্ঠ পেয়েই ওপার থেকে পুরসাত প্রজাদিপক বলল, ‘বল বিভেন বার্গম্যান। নিশ্চয় কোন সুখবর দেবে?’
আহমদ মুসা মোবাইলের স্পীকার অন রেখেছিল। মোবাইলের কথা শুনতে পাচ্ছে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনও। আহমদ মুসাকে ওপার থেকে ‘বিভেন বার্গম্যান’ নামে সম্বোধন করায় অস্বস্তির একটা চিহ্ন ফুটে উঠল তার মুখে।
পুরসাত প্রজাদিপকের কথার জবাবে আহমদ মুসা বলল, ‘স্যার আমার পক্ষ থেকে একটা খবর। সুখবর হবে কিনা সেটা আপনাদের উপর নির্ভর করে।’
‘আচ্ছা, খবরটা বল।’
‘ভোর রাতে আপনাকে জানিয়েছিলাম ওরা যয়নব যোবায়দাকে কিডন্যাপ করতে এসেছিল। কিডন্যাপ করতে আসা নিহত আটজনের মধ্যে একজন বিদেশীও ছিল। শাহবাড়ির পেছনের বন্ধ কূপে এদের লাশ আছে, পরীক্ষা করলেই এদের পরিচয় মিলবে। সকালেও আবার শাহবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। এবার তিন গাড়ি বোঝাই করে এসেছিল দশজন। আপনি জাবেরের বন্ধু ফরহাদকে জানেন। সে ওদের বন্দী হয়েছিল। আমিও বাড়িতে প্রবেশ করতে গিয়ে বন্দী হয়েছিলাম। শেষে যা হোক ওরা দশজনই মারা গেছে। এদের মধ্যেও একজন বিদেশী। অবশিষ্ট নয় জনের কেউ পাত্তানী অঞ্চলের নয় এবং তারা সবাই পেশাদার ক্রিমিনাল। আপনারা তদন্ত করলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে স্যার।’
‘বুঝেছি, এই ঘটনাকে দ্বিতীয় প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করতে চাচ্ছ। গত রাতে এবং সকালের দু’টি অভিযানেই নেতৃত্ব দিয়েছে দুই বিদেশী। যারা তাদের সাথে ছিল, তারা পাত্তানীর লোক নয়, অ-পাত্তানী ক্রিমিনাল ওরা। এর অর্থ তৃতীয় যে পক্ষ জাবেরকে ছিনতাই করে নিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহার করছে, তারা আজ জাবেরের বোন যয়নবকে কিডন্যাপ করার জন্যে বার বার চেষ্টা করেছে।’
‘ঠিক স্যার।’
‘ধন্যবাদ। তোমার ‘বিদেশী’ ও ‘ক্রিমিনাল’ তথ্য দুটি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে এটা অবশ্যই একটা বড় প্রমাণ হবে। তুমি যয়নবকে বলে দাও থানায় একটা ডাইরী করতে। আমি পাত্তানী পুলিশকে বলে দিচ্ছি, ওরা সব লাশ উদ্ধার এবং তাদের ব্যবহৃত সব গাড়ি সীজ করে তদন্ত শুরু করবে। কিন্তু বিভেন বার্গম্যান তোমাকে আরও অনেক এগুতে হবে। এ পর্যন্ত সন্ত্রাসের যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেসব যারা ঘটাল তাদের সব প্রমাণ দিনের আলোতে আনতে হবে এবং ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যকে পরিষ্কারভাবে সামনে আনতে হবে। মনে রেখ, ওদের একজন লোককেও এখন পর্যন্ত ধরা যায়নি এবং কোন দলিলও হাত করা যায়নি।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। অনেক এগুতে হবে আমাদের।’
‘ধন্যবাদ বিভেন বার্গম্যান।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
আহমদ মুসা মোবাইল অফ করতেই ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘আলোচনায় যা শুনলাম, তা স্বপ্ন অবশ্যই নয়। তাহলে আপনিই তো আমাদের সব কাজ করছেন? কিন্তু নাম বিভেন বার্গম্যান, কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। আপনি কে স্যার?’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের কথায় কান না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এমন রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরে বেরুনো যাবে না। এখন কি করা যায় বল।’
‘স্যার উপরে গেষ্টরুমে আমি কখনও কখনও থাকি। সেখানে আমার কাপড়-চোপড় থাকার কথা। চলুন দেখি।’
উপরে দোতলায় উঠে গেল তারা।
উঠতে উঠতে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার এই বাড়িটা এক কালে পাত্তানী এলাকার ‘রাজ ভবন’ ছিল। এর নিচ তলা ছিল জনগণের দরবার এলাকা। মানে সুলতানের শাসন অফিস। দ্বিতীয় তলা অতিথীশালা ও পরিবারের ষ্টাফদের আবাসিক এলাকা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। আর উপরের তলা ছিল শাহ পরিবারের নিজস্ব আবাসিক এলাকা। বিশাল এই বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরের কোনটাতেই ৫০টির কম কক্ষ নেই। এই বাড়িতে ঢুকলেই শরীল রোমাঞ্চিত হয় স্যার। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন থাই রাজপুত্র বাংগসা ওরফে সুলতান আহমদ শাহ। কত পার্থক্য সেদিনের এই বাড়ি ও আজকের এই বাড়ির মধ্যে!’
থামর ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল।
তার আবেগটা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বলল, ‘ফরহাদ, এই বংশের সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক আছে?’
‘এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন স্যার?’
‘এই বংশের প্রতি তোমার আবেগ এবং এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তোমার স্থায়ী গেষ্ট হওয়া দেখে।’
‘ঠিকই ধরেছেন স্যার। এই বংশেরই এক সন্তান আমি। প্রায় শত বছর আগে পাত্তানী অঞ্চল দুটি সালতানাতে বিভক্ত ছিল। যয়নব যোবায়দার দাদার বাপরা ছয় ভাই ছিলেন। ছয় ভাই ছয়টি সালতানাতে রাজত্ব করতেন। রাজ্যগুলো থাই কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে চলে গেলে যয়নব যোবায়দার দাদার বাবা সুলতান আব্দুল কাদের কামাল উদ্দিন ছাড়া অন্য পাঁচ ভাই হিজরত করে মালয়েশিয়া চলে যান। সেই পাঁচ ভাইয়েরই এক ভাইয়ের বংশধর আমি। জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন ‘তাফসিরুল কুরআন’ শিক্ষার জন্য ছোটবেলা মালয়েশিয়া যায়। পাঁচ বছর সে মালয়েশিয়ায় ছিল। কোর্স শেষ করে সে থাইল্যান্ডে ফিরে আসে। তার সাথে আমার এত বন্ধুত্ব হয় যে, আমিও তা সাথে থাইল্যান্ডে চলে আসি। ব্যাংককের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এই বাড়ির গেষ্ট রুম আমার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাবেরের সাথে এখানে এলে বা সুলতান গড়ে থাকলে এই গেষ্ট রুমেই আমি থাকি। কিন্তু তাই বলে ‘গেষ্ট’ নয়, পরিবারের একজন সন্তান হিসাবেই দাদী এবং অন্যরা আমাকে দেখেন।’
থামল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
আহমদ মুসার ঠোঁটে মিষ্টি এক টুকরো হাসি। বলল, ‘জামাই হিসেবে দেখেন না?’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। লজ্জাজড়িত ধীর কণ্ঠে বলল, ‘বিশ্বাস করুন স্যার, যয়নবের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, এ কথা আপনার কাছে আমি প্রথম শুনলাম। না দাদী, না অন্য কেউ এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেছেন।’
‘যয়নব যোবায়দার দিক থেকে?’
‘না স্যার। যয়নব খুব ভালো মেয়ে। খুব নীতি-নিষ্ঠ সে। তিন তলায় তার এলাকায় কোন দিন আমি ঢুকিনি, ঢোকার অনুমতিও নেই। দাদী ও জাবেরের ঘর পর্যন্ত আমার যাতায়াত।’
‘কথা বল না তোমরা?’
‘তার ফরমাল অবস্থায় প্রয়োজনীয় যেটুকু সেটুকু কথাই হয়।’
‘তার ‘ফরমাল অবস্থা’ বুঝলাম না ফরিদ।
‘ফরমাল পোশাক পরে যখন সে বাইরে আসে।’
‘ফরমাল পোশাক কি?’
‘যখন সে বাইরে আসে, গা মাথা ঢেকে জাবের সাথে বাইরে আসে। এটাই তার ফরমাল অবস্থা।
‘বুঝেছি।’ বলে আহমদ মুসা একটু মিষ্টি হাসল। বলল, ‘হতাশ হয়ো না ফরহাদ। তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে থাকার কথা দাদী আমাকে বলেছেন এবং সেটা তিনি বলেছেন যয়নব যোবায়দার সামনে। তুমি খুশি?’
একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। লাজ রাঙা মুখ নিচু করে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। দাদী আর জাবের আমাকে খুব ভালবাসেন।’
‘আর যয়নব? তার প্রতি অবিচার করছ কেন?’
সলজ্জ হেসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, ‘ওটা ভাবার সাহস আমার এত দিন হয়নি। সে আমার কাছে দুর্লভ এক ‘মনি’।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল। লজ্জা লুকাতে নতমুখী ফরহাদের কাঁধে হাত রেখে আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাদের দু’জনকে। ভিন্ন ধরনের এক শিরী-ফরহাদ তোমরা এবং এটাই আদর্শ।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ফরহাদের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘দেখি তোমার কি আছে দেখাও।’
প্রসঙ্গান্তরে যাবার সুযোগ পেয়েই যেন ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন হঠাৎ এ্যাকটিভ হয়ে উঠল। ছুটে গেল ড্রেস-ক্যাবিনেটের কাছে। খুলে ফেলল ড্রেস-ক্যাবিনেট। বলল, ‘দেখুন স্যার আপনি কি পছন্দ করবেন।’
‘আর দেখাদেখি নয়। তুমি আমার জন্যে শার্ট, প্যান্ট দাও। আর জ্যাকেট থাকলে জ্যাকেট নিয়ে এস। আমার অনেক পকেট দরকার।’ বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল সোফায়। সামনে একটি আলমারির উপর একটা ফার্ষ্ট এইড বক্স দেখতে পেল। উঠে গিয়ে সেটা নামিয়ে আনল। বাক্সে দুই প্যাকেট এন্টিসেপটিক ও এন্টিপেষ্ট ফাইবার ব্যান্ডেজও পেল। একটা প্যাকেট ফরহাদের জন্যে, অন্যটি নিজের জন্যে নিয়ে নিল। বাহু সন্ধির বুলেটাহত স্থানের রক্ত বন্ধ করা প্রয়োজন।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন কয়েকটা প্যান্ট, অনেকগুলো শার্ট এবং কয়েকটা জ্যাকেট এনে আহমদ মুসার কাছে রেখে বলল, ‘কোনটা কোনটা আপনার পছন্দ হয় দেখুন।’
‘ধন্যবাদ ফরহাদ।’ বলে আহমদ মুসা একটা গাবাডিন প্যান্ট, একটা সুতি শার্ট এবং বেশি পকেটের একটা জ্যাকেট বেছে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে বলল, ‘নির্জন ঘরে তুমিও পোশাক পাল্টে নাও। সোফার উপর ব্যান্ডেজ প্যাকেট আছে। ব্যবহার করতে পার।’
পোশাক পাল্টে নিল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
আহমদ মুসাও বেরিয়ে এল।
‘স্যার আপনি বুলেটাহত স্থান কি ব্যান্ডেজ করেছেন?’
‘ব্যান্ডেজ করিনি, বেঁধেছি।’
‘আমরা এখন কোথায় যাব স্যার?’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘তোমার এখানে কোন ঠিকানা নেই?’
‘শাহবাড়ি ছাড়া এখানে কোন ঠিকানা নেই। আমি আজ এখানে এসেছিলাম পঞ্চাশ মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে।’
‘চিন্তা নেই তুমি যে ঠিকানায় এসেছিলে, সে ঠিকানায় তুমি যাবে।’
‘বুঝলাম না স্যার।’
‘দাদীমারা যেখানে আছেন, সেখানেই তুমি যাবে। তোমাকে কমপক্ষে ৭ দিন শুয়ে থাকতে হবে।’
‘কেন?
‘পেরেকওয়ালা ব্যাটনের প্রহারের প্রতিক্রিয়া কত তীব্র তা বুঝতে পারবে কয়েক ঘণ্টা পর থেকে।’
বলেই হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
পেছনে পেছনে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
গাড়ি বারান্দায় ব্ল্যাক ঈগলের তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠতে যাচ্ছিল। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার আপনার একটা হাত আহত। আমি ড্রাইভ করতে পারি।’
আহমদ মুসা সরে গিয়ে পাশের সিটে বসল। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন উঠল ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
‘ফরহাদ, মেইন রোডে উঠেই এ গাড়ি দাঁড় করাতে হবে। একটা গাড়ি ঠিক করবে পাত্তানী সিটির ওল্ড এলাকার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার এ গাড়ি নিয়েও তো আমরা পাত্তানী সিটিতে যেতে পারি।’ ফরহাদ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এর অর্থ হবে আমাদের ঠিকানা শত্রু ব্ল্যাক ঈগলকে জানিয়ে দেয়া।’
‘কিভাবে?’ ফরহাদ বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘এ গাড়ির কোথাও ট্রান্সমিটার চীপ লাগানো আছে। গাড়ি যেখানেই থাকুক, এই ট্রান্সমিটার তার অবস্থান জানিয়ে দেবে।’
ফরহাদের চোখ থেকে বিস্ময় তখনও কাটেনি। বলল, ‘কিভাবে জানলেন স্যার আপনি?’
‘বলব।’
বিস্ময় কাটেনি ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের চোখ থেকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আজকের শুরু থেকে সব দৃশ্য। সব শক্তি, সব জ্ঞান দিয়ে যেন আল্লাহ এক ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছেন। কে এই ফেরেস্তা? ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন আহমদ মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন কি আবার জিজ্ঞেস করতে পারি স্যার?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বললেই তো জানা শেষ হয়ে যাবে জানার আগ্রহটা থাক না।’
মেইন রাস্তায় গাড়ি পৌছে গিয়েছিল।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন রাস্তার বাইরে একটা গাছের আড়াল নিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘স্যার, আপনি একটু বসুন, আমি গাড়ি দেখছি।’ বলে ফরহাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

আহমদ মুসা ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে বলেছিল, পেরেকওয়ালা ব্যাটন চার্জের প্রতিক্রিয়া তুমি বুঝতে পারবে কয়েক ঘণ্টা পর থেকে। ৭ দিন তোমাকে শুয়ে থাকতে হবে। কথাটা আহমদ মুসার ক্ষেত্রে বেশি ফলেছে। সাত দিন তাকে বিছানা থেকে উঠতে হয়নি। অবশ্য ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সাত দিনেও সেরে উঠতে পারেনি। তার অবস্থা ছিল আরও কাহিল।
আহমদ মুসা মনে করেছিল, সে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে যয়নব যোবায়দাদের ওখানে পৌছে দিয়েই সুলতান গড়ে ফিরে যাবে তার সদ্য ভাড়া করা বাড়িতে। কিন্তু দাদী ও যয়নব তাকে ছাড়েনি। কোন কথা না শুনে আহমদ মুসা চলে আসতে গেলে আড়াল থেকে যয়নব যোবায়দা বেরিয়ে এসেছিল। কেঁদে উঠে বলেছিল, ‘আপনি সবার জন্যে হবেন, কেউ আপনার জন্যে নয়, এটা শুধু সবার প্রতি আপনার জুলুম নয়, এটা আপনার অন্যায় আত্মপীড়ন। এই মনোভাব ইসলামের সামাজিক সম্পর্কের লংঘন।’ বলে একটু থেমে আবেগকে সম্বরণ করে নিয়ে আবার বলে উঠেছিল, ‘ভাই বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে, বোনেরও দায়িত্ব আছে ভাইয়ের প্রতি। দারুণ আহত অবস্থায় আপনি যেখানে যাবেন, সেই সদ্য ভাড়া করা বাড়িতে আপনার কেউ নেই। হাসপাতালে যাওয়া যেমন নিরাপদ হবে না, তেমনি যে কোন ডাক্তার ডাকাও নিরাপদ নয়। এই অবস্থার কথা জেনে আপনাকে আমরা ছাড়ব কি করে?’ অশ্রু সম্বরণের চেষ্টা সত্ত্বেও যয়নবের শেষের কথাগুলো কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কোন কথা না বলে আহমদ মুসা ঘরের দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে এসে সোফায় বসেছিল। বলেছিল, ‘স্যরি বোন। আমি বোনদের দায়িত্বশীল প্রমাণ করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, আমাদের সবার অবস্থান এক জায়গায় না হোক।’
‘আপনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই হবে স্যার। পাশের বাড়িই একজন মহিলা সার্জনের। তিনি আমার মায়ের বন্ধু, তার ওপর বর্তমান সংকটে তিনি আমাদের একজন মুরুব্বিও। তিনি আপনাদের দেখবেন। তারপর যা ভালো মনে হয় করা যাবে স্যার।’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা।
আহমদ মুসার চোখ দু’টো নিচু। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছিল। বলেছিল, ‘বোন কি ভাইকে ‘স্যার’ বলে?’
বিব্রত ভাব ফুটে উঠেছিল যয়নব যোবায়দার মুখে। কয়েক মুহূর্ত কথা বলেনি সে। তারপর বলেছিল, ‘স্যরি, অভ্যাসবশত বলেছি ভাইয়া।’
‘স্যার, আপনি ভাই হয়ে গেলেন। কিন্তু আপনার পরিচয় জিজ্ঞেস করেও জানতে পারছি না।’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
‘তোমার ধারণা বলত তিনি কে হতে পারেন?’ বলেছিল দাদী।
‘না দাদীজী বলতে পারব না। অনেক ভেবেছি আমি। কাউকে আমি খুঁজে পাইনি। কাজ ও যোগ্যতার দিক দিয়ে রূপকথার রাজপুত্রের সাথে তার তুলনা হয়। কিন্তু রূপকথার রাজপুত্র তো এভাবে বাস্তবে আসে না!’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
‘রূপকথার রাজপুত্র বাস্তব হয়ে আসে না, কিন্তু বাস্তবে রূপকথার রাজপুত্রের চেয়েও বড় রাজপুত্র থাকতে পারে।’ বলেছিল দাদী।
‘আমি মানলাম দাদী, ইনি সেরকম কেউ, কিন্তু কে?’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলেছিল।
ফরহাদ থামতেই আহমদ মুসা বলেছিল, ‘দাদীমা, প্লিজ এই আলোচনা রাখুন। প্রতিদিন পৃথিবীতে রূপকথার চেয়ে বড় হাজারো রূপকথা তৈরি হচ্ছে। এই রূপকথা যারা সৃষ্টি করছে, তারা সবাই সাধারণ মানুষ, রাজপুত্র নয় দাদীমা।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল দাদীমা। কিন্তু বলা হয়নি। পরিচারিকা ডাক্তারী ব্যাগ হাতে এ্যাপ্রন পরা একজন পঁয়তালিস্নশ-পঞ্চাশ বছরের মহিলাকে নিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করেছিল।
যয়নব যোবায়দা এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে সালাম দিয়ে বলে, ‘আসুন ডাক্তার খালাম্মা।’
যয়নব যোবায়দা ডাক্তার খালাম্মাকে আহমদ মুসাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সালাম বিনিময় ও প্রাথমিক কথা শেষ হলে যয়নব যোবায়দার নির্দেশে পরিচারিকা আহমদ মুসাকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য তাকেই প্রথম দেখা হয়, পরে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যান্ডেজ শেষে দু’জনকে তাদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার খালাম্মা ফিরে আসেন ড্রইং রুমে।
শোফায় বসতে বসতে বলেছিলেন, ‘তোমাদের পরিচারিকারা খুব দক্ষ। আমার নার্সের চেয়েও ভালো কাজ করেছে তারা।’
‘এ মেয়েরা খুবই আন্তরিক ডাক্তার খালাম্মা।’ বলে যয়নব যোবায়দা।
‘ওদের কেমন দেখলে ডাক্তার মা?’ দাদী বলেছিল উদগ্রীব কণ্ঠে।
মুখটা মলিন হয়ে যায় ডাক্তারের। বলেছিল, ‘আমার ডাক্তারী জীবনে এমন বীভৎস দৃশ্য আমি দেখিনি আম্মাজী। শুনলাম পেরেকওয়ালা ব্যাটন দিয়ে ওদের পেটানো হয়েছে, বিশেষ করে বিভেন বার্গম্যান নামের ছেলেটার দু’পাজরে অক্ষত চামড়া নেই বললেই চলে। আর ওর বাম বাহু-সন্ধির মাসলটা বুলেট একেবারে তুলে নিয়ে গেছে। এদিকে ফরহাদ ছেলেটা মোটামুটি আছে। প্রায় সারা গায়েই পেরেকের আঘাত আছে, কিন্তু মেজর কিছু নয়।’
‘বিভেন বার্গম্যানের কেমন রেষ্ট দরকার হবে, ডাক্তার খালাম্মা?’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা।
‘বেটি তার দু’পাজরে ও বাহু সন্ধিতে নতুন চামড়া গজাতে হবে। আট-দশদিন তাকে বিছানা থেকেও উঠতে দেয়া যাবে না। তারপরেও সপ্তাহখানেক রেষ্ট দরকার হবে। তবে এই ছেলেটার ক্ষেত্রে এত সময় লাগবে বলে মনে হয় না। মানসিক শক্তি তার অবিশ্বাস্য। এ ধরনের লোকদের যে কো ব্যধিই দ্রুত সেরে যায়।’
‘ব্যাপারটা কি করে বুঝলেন খালাম্মা?’ বলেছিল যয়নব যোবায়দা আগ্রহের সাথে।
‘তার বুলেট-বিদ্ধ ও ব্যাটনের পেরেক বিদ্ধ বিরাট আহত স্থান আমাকে পরিষ্কার করতে হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে রোগীরা চিৎকার করে, উঃ আঃ তো করেই। যেমন ফরহাদ করেছে, সে খুব কষ্টও পেয়েছে। কান্না আটকাতে পারেনি বেচারা। কিন্তু বিভেন বার্গম্যানের মুখে কষ্টের একটি ভাঁজও পড়তে দেখিনি। গোটা সময় সে চোখ বন্ধ করে ছিল। যেন শান্তিতে ঘুমুচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। সব সময় কণ্ঠ স্বাভাবিক ছিল। চা খেতে খেতে গল্প করেছে। এমন নার্ভের মানুষ আমি আগে দেখিনি। তাকে মনে হয়েছে একটা অনুভূতিহীন পাথর। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কষ্ট লাগছে না? উত্তরে সে বলেছিল, কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক। আমি বলেছিলাম, কিন্তু তোমাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না? সে বলেছিল, কষ্ট হজম করতে পারলে বাইরে তা আর প্রকাশ পায় না। ঠিক বলেছে সে। কিন্তু এমন নার্ভ কম মানুষেরই থাকে। কে এই লোক বেটি?’
যয়নব যোবায়দা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে, ডাক্তার খালাম্মাকে কতটুকু বলা যায়। কিছু না বললে তিনি মাইন্ড করতে পারেন। সেটা ভালো হবে না। এসব চিন্তা করে যয়নব যোবায়দা বলে, ‘উনি আমাদের মেহমান। একজন বিদেশী।’
‘কিন্তু সে তো খৃষ্টান। নাম শুনে তো তাই মনে হচ্ছে! এমন মারাত্মকভাবে আহত ও গুলীবিদ্ধ হলো কোথায়?’ ডাক্তার খালাম্মা বলেছিল। তাঁর চোখে বেদনা ও বিস্ময়।
যয়নব যোবায়দা একবার দাদীর দিকে তাকায়। একটু ভাবে। তারপর বলে, ‘আপনি আমাদের বিপদের কথা জানেন। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকেও আপনি চেনেন। সে সুলতান গড়ে আক্রান্ত ও কিডন্যাপড হলে এই বিদেশী তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও বন্দী হয়। উভয়েই নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু তারা অবশেষে নিজেদের মুক্ত করতে সমর্থ হয়।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। দেখ মানুষ মানুষের জন্য কত করতে পারে! বিদেশী বিভেন বার্গম্যানই বেশি নির্যাতিত হয়েছে।’ বলেছিল ডাক্তার খালাম্মা।

যয়নব যোবায়দার এই বলা এবং ডাক্তার খালাম্মার এই শোনা যে সংকট ডেকে আনবে কেউ তখন এটা বুঝেনি।
সংকট এল তিন দিন পরেই।
আহমদ মুসা শুয়েছিল তার কক্ষে তার বেডে। ধীরে ধীরে এসে ফরহাদ আহমদ মুসার বিছানায় তার পাশে বসল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। তুমি কষ্ট করে এলে কেন? ডাকলে আমি যেতাম।
তিন দিনেই আহমদ মুসা প্রায় সেরে উঠেছে, কিন্তু ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের জ্বরই এখনও সারেনি।
ডাক্তার খালাম্মা ঘরে ঢুকে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে দেখে বলল, ফরহাদ তোমার বিছানা থেকে উঠা ঠিক হয়নি। দাঁড়ালেও আহত স্থানগুলোর উপর চাপ পড়বে, তাতে জ্বর বাড়বে এবং নিরাময় বিলম্বিত হবে। শুয়ে পড়, এখানেই তোমাকে দেখব।’
সুবোধ বালকের মত সংগে সংগেই শুয়ে পড়ল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘ফরহাদ আমাদের খুব ভালো ছেলে। বড়দের কথা মান্য করতে একটু দেরি করে না।’ বলল দাদী প্রসন্ন মুখে।
মুখ টিপে হাসল যয়নব যোবায়দা। বলল, ‘বুঝার আগে কাজ করলে তার ফল সব সময় ভালো হয় না।’
‘ভালো একটা নীতি কথা বলেছ বেটি’ বলে ডাক্তার খালাম্মা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি একটা মিরাকল বিভেন বার্গম্যান। তিন সপ্তাহের নিরাময় তোমার ক্ষেত্রে তিন দিনে হয়ে গেছে। আজ আমি আমাদের ডাক্তারদের বৈঠকে তোমার কথা বললে সবার চোখ ছানাবড়া হয়েছে। একজন তো সব শুনে এতটা অভিভূত হয়েছে যে তোমাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। আমি তাকে ওয়েলকাম করেছি। সে আসছে। সে একজন চর্ম বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও একজন প্লাষ্টিক সার্জন। তার কাছ থেকে ভালো পরামর্শও পাবে।’
থামল ডাক্তার খালাম্মা।
ডাক্তার খালাম্মার শেষের কয়েকটি বাক্য শুনে মুখের সব আলো দপ করে নিভে গেল আহমদ মুসার। তার মিরাকল নিরাময়ের কথা শুনেই একজন শীর্ষ স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংগে সংগে তাকে দেখতে চলে আসতে, এটা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ডাক্তার খালাম্মাকে, ‘তারা কি আমার নাম জেনেছে?’
‘হ্যাঁ তারা জিজ্ঞেস করেছে। আমি বলেছি তোমার নাম। বিদেশী তাও বলেছি।’ বলল ডাক্তার খালাম্মা।
‘কে জিজ্ঞেস করেছে?’
‘কেন, ঐ স্কিন স্পেশালিষ্ট ও প্লাষ্টিক সার্জন। তাঁরই তো উৎসাহ বেশি।’
‘কি নাম তার ডাক্তার খালাম্মা?’
‘ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো জুদাহ।’
নাম শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার নামের প্রথম অংশকে না ধরলেই শেষ অংশটা পরিষ্কার ইহুদী। বলে ‘ডাক্তার খালাম্মা, ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো আমাকে দেখার জন্য আসবেন এ কথা কখন আপনাকে বলেন? সংগে সংগেই?’
ডাক্তার খালাম্মা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভাবনার একটা ছায়া ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে সংগে সংগেই সে কিছু বলল না। একটু ভেবে বলল, ‘মনে পড়ছে সে মাঝখানে উঠে টয়লেটে গিয়েছিল। টয়লেট থেকে আসার পর সে আলোচনায় আবার যোগ দেয় এবং বলে ঐ কথা। কেন প্রশ্ন করছ এসব, অন্য কিছু ভাবছ?’
‘বলছি খালাম্মা। বললেন উনি আসছেন। উনারা কি আলাদাভাবে আসছেন? বাসা চিনবেন কি করে ওরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এক সাথেই আশার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে বলল, ওদিকে আমার এক বন্ধুরও যাওয়ার কথা। আমরা এক সাথেই যাবো। ক’মিনিট দেরী হবে। আপনার পেছনেই আমি আসছি। আমি বাসার ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে এসেছি।’ ডাক্তার খালাম্মা বলল।
আহমদ মুসা নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনারা এসেছেন সাত মিনিট। আর চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা এসে পড়বে নিশ্চয়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল দাদী ও যয়নব যোবায়দার দিকে। বলল, ‘ভবিষ্যত জানেন একমাত্র আল্লাহ। কিন্তু আমি আশংকা করছি চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের দিকে ছাড়া অন্য কোন পথ কি আছে যেখান দিয়ে আপনাদের বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে?’
সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। প্রবল উদ্বেগ ফুটে উঠেছে তাদের চোখে মুখে। বলল ডাক্তার খালাম্মা চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে, ‘তুমি কি আশঙ্কা করছ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো কোন বিপদের………।
ডাক্তার খালাম্মার কথা শেষ হলো না। কলিং বেল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ডাক্তার খালাম্মা ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর ডান তর্জনি কি ডিফেক্টিভ?’
বিস্ময় বিমূঢ় চোখে তাকাল খালাম্মা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে?’
‘পরে বলব, ওরা এসে গেছে। আপনারা সবাই দু’তলায় জান। ফরহাদ তুমিও যাও। দয়া করে আমি না ডাকা পর্যন্ত কেউ নিচে নামবেন না। যান আপনারা, আমি গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বালিশের নিচ থেকে রিভলবার বের করে মাথার পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
‘খারাপ কিছুর আশংকা আছে?’ দ্রুত কম্পিত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
‘প্রস্তুত থাকা ভালো।’ হাসি মুখে শান্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘প্লিজ আপনারা দোতলায় যান।’
কথা বলতে বলতেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটল বাইরের ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা চলে যাবার পর ডাক্তার খালাম্মা যোবায়দাকে বলল, ‘তোমরা যাও, আমি দেখি ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো সত্যি এলেন কিনা।’
‘প্লিজ খালাম্মা, উনি যা বলেছেন তার মধ্যেই কল্যাণ আছে। সব ঠিক ঠাক থাকলে তো উনি আমাদের ডাকবেনই।’ অনুরোধ করল যয়নব যোবায়দা ডাক্তার খালাম্মাকে।
ওরা সবাই দোতলায় উঠে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে এসে ড্রইংরুমের বাইরের দরজার ডোর ভিউতে চোখ রাখল। দেখতে পেল দরজার সামনেই আছেন দীর্ঘদেহী পঞ্জাশের মত বয়সের একজন ভদ্রলোক। তার গায়ে তখনও ডাক্তারের এ্যাপ্রোন। তার পেছনে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ।
পুলিশ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর সাথে তো আসার কথা ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা। পুলিশ কেন তার সাথে?
একটা সন্দেহ উঁকি দিল আহমদ মুসার মনে। পুলিশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলাল আহমদ মুসা। না পুলিশী ক্যাপ, ইউনিফরম, বুট সব ঠিক আছে। কোন খুত নেই। কিন্তু আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল পুলিশদের চুলের উপর। থাই পুলিশদের চুল মাথার ক্যাপ ছাপিয়ে এমন বেঢপ ভাবে বেরিয়ে আসে না। দ্বিতীয় আরেকটি জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটা হলো, এই পুলিশদের বুটের কালো ফিতার প্রান্তের মেটাল মোড়কের সবটাই সাদা। কিন্তু থাই পুলিশের তা নয়। তাদের ফিতার মোড়কের অগ্রভাগের এক তৃতীয়াংশ কালো।
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর চালাকি বুঝতে পারল আহমদ মুসা। ঝামেলা এড়াবার জন্যে ব্ল্যাক ঈগলের লোকদের সে পুলিশ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে।
হাসল আহমদ মুসা।
ডোর ভিউ থেকে সরে এসে দরজার পাশের ছোট ‘কী’ বোর্ড থেকে চাবি হাতে নিল।
দরজাটির তালায় ভেতর বাহির দু’দিক থেকেই চাবি দেবার ব্যবস্থা আছে। খুশি হলো আহমদ মুসা। সে যে পরিকল্পনার কথা ভাবছে, তাতে এর প্রয়োজন আছে।
এ সময় কলিংবেল আবার বেজে উঠল। এবার পর পর দু’বার। আহমদ মুসা বুঝতে পারল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন।
আহমদ মুসা দরজার লক আন-লক করে চাবিটা লকের ভেতরেই রেখে দিল।
দরজাটি দ্রুত খুলে বলল, ‘স্যরি স্যার দেরি হয়ে গেল। আমি ভেতরে রোগীর ঘরে ছিলাম। স্যার আপনি তো ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো, ম্যাডাম ডাক্তার খালাম্মা আপনার কথা বলেছেন।’
তারপর লোকটিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, ‘পুলিশ কেন স্যার, কি চায়?’
‘হ্যাঁ, আমি ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। এই পুলিশদের সাথে আমার রাস্তায় দেখা। ওরাও এখানে আসছে জেনে এক সাথেই এলাম। কি জন্যে ওরা এসেছে আমি জিজ্ঞেস করিনি।’
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে বারান্দার প্রান্ত পর্যন্ত পৌছে পুলিশদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা এ বাড়িতে এসেছেন? কেন এসেছেন?’
বাড়ির উঠানে সদ্য আসা তিনটি গাড়ি। একটা ছোট কার অন্য দু’টি অটো-টেম্পো। পুলিশের সংখ্যা মোট এগার জন। তাদের সবার হাতেই খাটো ব্যারেলের হ্যান্ড মেশিনগান। আহমদ মুসা থাই পুলিশের হাতে এ ধরনের সাব-মেশিনগান দেখেনি।
কাঁধে সাবমেশিনগান ঝুলানো ও হাতে ব্যাটনধারী একজন পুলিশ একটু সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি কে?’
‘আমি আলী আবদুল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিভেন বার্গম্যান কি ভেতরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা তার সাথে কথা বলব।’ পুলিশ লোকটি।
‘আপনারা কোন থানা থেকে এসেছেন।’
একটু থতমত খেয়ে পুলিশ অফিসারটি একটা ঢোক গিলে বলল, ‘না, আমরা পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছি।’
‘ওয়েলকাম আপনাদের। আপনারা সকলে আসুন।’
বলে আহমদ মুসা দরজার একপাশে দাঁড়াল।
ভেতরে ঢুকল প্রথমে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। বলল, ‘আমিও তাকে দেখতে এসেছি।’
পুলিশরা সবাই এক এক করে ভেতরে ঢুকল।
সবশেষে আহমদ মুসা ঢুকল। ঢুকেই দু’হাত পেছনে নিয়ে দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিল এবং একই সাথে লকে লাগানো চাবি ঘুরিয়ে লক বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে এসে বলল, ‘আপনারা একটু বসুন। আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।’ বলে আহমদ মুসা ড্রইংরুম থেকে ভেতরে যাওয়ার দরজায় এসে বলল, ‘৮ জনের সোফায় ১২জন বসতে একটু অসুবিধা হবে স্যার।’
একটা চেয়ার ঘরের এদিকের দেয়ালের সাথে আলগা করে রাখা ছিল। চেয়ারটি একটু টেনে আহমদ মুসা একজন পুলিশকে ডেকে বলল, ‘আপনার ওখানে অসুবিধা হচ্ছে। এখানে বসুন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ব্যাটনধারী পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘মি. আবদুল্লাহ, বসার দরকার নেই। দু’জন আপনার সাথে যাচ্ছে। তারা বিভেন বার্গম্যানকে আনতে আপনাকে সাহায্য করবে।’
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। তার প্ল্যানটা একটু পাল্টে গেল। তাতে বরং তার লাভই হবে। দু’জন কম হলো এ রুমের থেকে।
‘ঠিক আছে। আসুন, ওয়েলকাম।’
বলে আহমদ মুসা নব ঘুরিয়ে ভেতরে যাবার দরজা খুলে ফেলল। এবং দরজার এক পাশে দাঁড়াল। পুলিশ দু’জন এলে তাদেরকে ভেতরে যাবার জন্যে আহবান জানাল। দু’জন পুলিশেরই হ্যান্ডমেশিনগান কাঁধে ঝুলানো।
পুলিশ দু’জন ভেতরে ঢুকে গেল এক এক করে। তাদের পেছনে ঢুকল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে গেল এক এক করে। তাদের পেছনে ঢুকল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে দরজার পাল্লা আস্তে করে ঠেলে দিল এবং লকটাও টিপে দিয়েছে সাথে সাতে। অটো ক্লোজ হওয়ার মতই দরজাটা সামান্য শব্দ তুলে ক্লোজ হয়ে গেল।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে দু’জন পুলিশ এক সাথেই পেছন ফিরে তাকাল। তাদের চোখে সন্দেহযুক্ত প্রশ্ন। কিন্তু তারা প্রশ্ন করার আগেই আহমদ মুসা চোখের পলকে মাথার পেছনে জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাদের দিকে তাক করে বলল, ‘তোমরা কাঁধ থেকে মেশিনগান নামিয়ে নেবার সুযোগ পাবে না। তার আগেই আমার রিভলবারের দুই গুলী তোমাদের মাথা গুঁড়ো করে দেবে। আমার এই রিভলারে কোন শব্দ হয় না। নিঃশব্দে দুই গুলী তোমাদের মেরে ফেলবে। তোমাদের সঙ্গীরা কেউ জানতে পারবে না। যদি বাঁচার ইচ্ছা থাকে অস্ত্র ফেলে দাও।’
পুলিশ দু’জন একটু দ্বিধা করল, কিন্তু পরক্ষণেই কাঁধের হ্যান্ড মেশিনগান নিচে মেঝেয় ছেড়ে দিল।
দু’জনের দিকে রিভলবার নাচিয়ে বলল, ‘তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়। মনে রেখ, এক আদেশ কিন্তু দুবার করব না। দ্বিতীয় বার চলবে গুলী।’
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল দু’জনেই।
আহমদ মুসা ঘরের এদিক-ওদিক তাকাল বাঁধার কিছু একটার খোঁজে।
ঘরটি নিচ তলার ডাইনিং রুম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ঘরের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির নিচ দিয়ে ওপাশে কিচেনে যাবার দরজা। ঘরের অন্য দু’দিকে দু’টি কক্ষ। এ দু’টিই বাড়ির গেষ্ট রুম। এরই একটিতে আহমদ মুসা, অন্যটিতে থাকে ফরহাদ উদ্দিন।
খুঁজতে গিয়ে আহমদ মুসা অ্যাডহীসীভ টেপ পেয়ে গেল। এ টেপ তাদের ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজের জন্যেই আনা হয়েছিল।
এই টেপ দিয়ে দ্রুত দুই পুলিশের হাত-পা ছাড়াও মুখ আটকে দিল যাতে চিৎকার করতে না পারে।
এরপর আহমদ মুসা মোবাইলে একটা টেলিফোন করল পাত্তানী শহরের এসপিকে। থাই গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক পাত্তানী সিটির এসপিকে আহমদ মুসা সম্পর্কে আগেই বলে রেখেছে। আহমদ মুসাও তার সাথে কথা বলেছে বিভেন বার্গম্যান পরিচয়ে।
সিটি পুলিশ ধরলেই আহমদ মুসা এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা পুলিশের ছদ্মবেশ নিয়ে আমাদের ধরতে এসেছে। এখানে যয়নব যোবায়দাও আছে আপনি জানেন।’
‘এখন কি অবস্থা?’ সিটি পুলিশ সুপার জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ওদের আটকে রেখেছি। কতক্ষণ পারব জানি না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. বার্গম্যান মিনিট দশেক ওদের সামলান। ঐ এলাকায় পুলিশ ইন্সপেক্টর থাচিনের নেতৃত্বে একটা ভ্রাম্যমান টীম আছে। ওরা যাচ্ছে ওখানে। আমি একটি পুলিশ টীম নিয়ে নিজেই আসছি।’ বলল পাত্তানী সিটি পুলিশ সুপার।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়েলকাম মি. বার্গম্যান।’ বলে পুলিশ সুপার টেলিফোন রেখে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল পকেটে রেখে দু’জন পুলিশের হ্যান্ডমেশিনগান তুলে নিয়ে একটি কাঁধে ঝুলাল, অন্যটি হাতে রাখল।
ডান দিক থেকে পেছনে ঘুরতে গিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে নজর গেল আহমদ মুসার। দেখল, ‘সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে যয়নব যোবায়দা। তার দু’চোখে বিস্ময়, আতংক।
আহমদ মুসা দ্রুত কয়েক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘আপনারা কেউ এদিকে থাকবেন, কাউকে আমার দরকার হতে পারে।’
যয়নব যোবায়দার পেছনে এসে দাঁড়াল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন এবং ডাক্তার খালাম্মা। উদ্বেগ-আতংকে সবার মুখই শুকনো।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। যয়নব যোবায়দা শুকনো কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।’
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলল ড্রইং রুমের দরজার দিকে।
ড্রইংরুমের দরজায় গিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর হ্যান্ড মেশিনগানের ট্রিগারে আঙুল রেখে বাম হাতে দরজার নব ঘুরিয়ে আস্তে স্বাভাবিকভাবে খুলতে লাগল। প্রথমেই তার নজরে পড়ল, দরজা সোজা চেয়ারটা যেখানে একজন পুলিশকে বসতে বলেছিল, সেটা খালি। খুশি হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ডান হাতের হ্যান্ডমেশিনগানটা একটু আড়াল করে বাম হাত দিয়ে দরজাটা পরিপূর্ণ খুলে দেয়ালের সাথে সেঁটে দিল। ইলাষ্টিক হুকে আটকে গেল দরজা।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা হ্যান্ডমেশিনগানটা বাগিয়ে ধরে লাফ দিয়ে দরজা ডিক্সিয়ে ড্রইং রুমের মেঝেয় গিয়ে দাঁড়াল এবং নিচু গলায় কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘একজনও অস্ত্র তোলার চেষ্টা করলে সবাইকে এক সাথে গুলী করে মারব।’
আহমদ মুসাকে অস্ত্র হাতে লাফ দিয়ে পড়তে দেখেই কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আকস্মিকতা কাটিয়ে তারা অস্ত্র তোলার আগেই আহমদ মুসার মেশিনগান তাদের দিকে উদ্যত হলো এবং ধ্বনিত হলো তার কঠোর কণ্ঠ।
আহমদ মুসার হাতের হ্যান্ডমেশিনগানের হাঁ করা ব্যারেল দেখে এবং তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউই আর অস্ত্রে হাত দিতে সাহস করল না। বসে দাঁড়িয়ে যে যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকল।
সেই ব্যাটনধারী পুলিশ অফিসার লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতেও ছিল রিভলবার। সে বলল, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে তুমি বন্দুক উঁচিয়েছ। এর পরিণতি জান? আমাদের দু’জন পুলিশ কোথায়? কি করেছ তাদের?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমার পরিণতির কথা পরে। কারণ আমার হাতে এখন বন্দুক। তোমার পরিণতির কথা ভাব।’
আহমদ মুসা যখন কথা বলছিল, তখন একে সুযোগ হিসাবে নিয়ে পুলিশ অফিসারটি তার রিভলবার তুলেছিল আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু আহমদ মুসা মুখে কথা বললেও হ্যান্ডমেশিনগানে আটকানো তার তর্জনি একটুও অসতর্ক হয়নি। পুলিশ অফিসারবেশী লোকটির রিভলবার থেকে গুলী বেরুবার আগেই আহমদ মুসার হ্যান্ডমেশিনগানের কয়েকটি গুলী ছুটে গেল তার দিকে। একটি গুলী বিদ্ধ করল তার রিভলবার ধরা হাতকে। আরও দু’টি গুলী তার বাহু ও উরুতে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
সে আর্তনাদ করে বসে পড়ল সোফায়।
হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল সবার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘ওর বুকে গুলি করিনি প্রথম কেস বলে। কিন্তু এরপর কেউ অস্ত্রে হাত দিলে এবার গুলী যাবে সরাসরি তার বুকে। সবাই অস্ত্র মেঝের মাঝখানে ফেলে দাও।’
সংগে সংগেই সবার অস্ত্র মেঝের মাঝখানে এসে জমা হলো।
সোজা হয়ে বসল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। বলল ভীত কণ্ঠে, ‘আমি এসবের মধ্যে থাকতে চাই না। কিছু বুঝতে পারছি না আমি। আমি চলে যাই। বিভেন বার্গম্যানের সাথে আমি পরে দেখা করব।’
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো উঠে দাঁড়াল।
‘না, ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো আপনি বসুন। আমার আশঙ্কা, এই ভুয়া পুলিশদের পাঠিয়েছে যারা, তাদের আপনি খবর দেবেন এখান থেকে বেরিয়েই। সুতরাং পুলিশ আসা পর্যন্ত থাকুন। আপনাকে কি করবে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘আমাদের ভুয়া পুলিশ বলছ। তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে?’ বলল আহত পুলিশবেশী অফিসার লোকটি।
প্রতিবাদ করলেও পুলিশবেশী সকলের মুখে ভীতির পর এবার মুষড়ে পড়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে।
‘প্রমাণ করা আমার দায়িত্ব নয়। পুলিশ আসছে, খোদ এসপি সাহেবও আসছেন। তাঁরাই প্রমাণ করবেন।’
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোও মুষড়ে পড়েছে। সে বলল, ‘আমি পুলিশের অপেক্ষা করব কেন? এদের সাথে কিংবা তাদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি আপনাদের ডাক্তার খালাম্মার সাথে যোগাযোগ করে এসেছি। তাঁকে ডেকে দিন।’
পাশের ঘরে যয়নব যোবায়দা, ডাক্তার খালাম্মা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সবাই দাঁড়িয়েছিল। তাদের সাথে আহমদ মুসার কথোপকথন সবই তারা শুনেছে। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর শেষ কথাটা শুনে ডাক্তার খালাম্মা ড্রইং রুমে আসতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা দেখতে পেয়ে তাকে ইশারা করে ফিরিয়ে দিল। বলল সে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর কথার উত্তরে, ‘মি. ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো, এখন ডাক্তার খালাম্মাকে ডাকার সময় নয়। আপনি যা বলার পুলিশকে বলবেন।’
হঠাৎ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো তার এ্যাপ্রনের পকেটে থাকা দুই হাতের ডান হাত রিভলবারসহ বের করে গুলী করল আহমদ মুসাকে। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর চেহারায় পুটে উঠেছিল উৎকট বেপরোয়া ভাব।
একটু অসতর্ক ছিল আহমদ মুসা। আর ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর রিভলবারসহ হাতটা এত দ্রুত তার লক্ষে উঠে এসেছিল যে, পাল্টা আক্রমণের সময় তখন ছিল না। আত্মরক্ষার জন্যে দ্রুত বসে পড়েছিল আহমদ মুসা। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর গুলীটা তার গলদেশের বাম গোড়ায় কাঁধের পেশি উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। বসতে সে তিল পরিমাণ দেরি করলে গুলীটা তার হৃদপিন্ড ভেদ করে চলে যেত।
আহমদ মুসা বসে পড়ার জন্য যে সময় পেল সেই সময়ের মধ্যে তার হ্যান্ডমেশিনগানের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়ে ট্রিগার টেপে তার হ্যান্ডমেশিনগানের। হাত, পাঁজরসহ কয়েক জায়গায় গুলী খেয়ে ঢলে পড়ে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো সোফার উপর।
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোকে গুলী করেই আহমদ মুসা তার হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল অন্যদের উপর একবার ঘুরিয়ে নিল। বলল, ‘দেখ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর ডাক্তার পরিচয়কেই বড় করে দেখেছিলাম। তাই তিনি আমাকে ফাঁকি দিতে পেরেছেন। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে আমার কোন বিভ্রান্তি নেই। অতএব যে যেমন আছ, ঠিক সে ভাবেই থাক।’
আহমদ মুসাকে গুলী লাগতে দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিল যয়নব যোবায়দা এবং ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন দু’জনেই।
‘ও গড, বিভেন বার্গম্যান তো আগের আহত জায়গার পাশেই আবার গুলী খেয়েছে।’
ডাক্তার খালাম্মা কয়েক মুহূর্ত থেমে আবার আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো বার্গম্যানকে গুলী করে আহত করল, আবার বার্গম্যান ব্রাশ ফায়ার করল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোকে। উনি হয়তো মরেই গেলেন! এসব কি হচ্ছে?’
এ সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা পুলিশদের উপর থেকে চোখ না সরিয়েই বলে উঠল, ‘ফরহাদ তুমি এস।’
ফরহাদ তাকাল যয়নব যোবায়দার দিকে।
‘দেরি করো না। উনি আহত, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। যা বলছেন কর।’ উদ্বেগ-আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
অসুস্থ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সব ভুলে দৌড়ে পৌছল ড্রইং রুমে।
‘ফরহাদ, ডোর ভিউ দিয়ে দেখ বাইরে পুলিশ কিনা। পুলিশ হলে দরজা খুলে দাও।’ বলে আহমদ মুসা একটা চাবি তার হাতে দিল।
ইতিমধ্যে কলিংবেল আবারো বেজে উঠল।
ফরহাদ দ্রুত এগিয়ে ডোর ভিউতে একবার চোখ রেখেই দ্রুত দরজা খুলে দিল।
ঘরের বড় পুলিশ অফিসার তার পাশের পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘ইন্সপেক্টর থাচিন, অস্ত্রগুলো নিয়ে নাও আর ওদের গ্রেফতার করতে বল।’ বলে বড় পুলিশ অফিসারটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমি সিটি এসপি উদয় থানি। আপনি তো মিঃ বিভেন বার্গম্যান স্যার। আপনি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন দেখছি। তবু আপনি এদের আটকে রেখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ উদয় থানি। আমাকে গুলীবিদ্ধ করেছেন ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। এর আগে আমাকে গুলী করেছেন পুলিশ অফিসারবেশী ঐ আহত ভদ্রলোক। দু’জনকে নিরস্ত্র করার জন্যে আমাকে গুলী করতে হয়েছে। আমার হাতের হ্যান্ডমেশিনগানটিও ওদের।’ বলে আহমদ মুসা হ্যান্ডমেশিনগানটি উদয় থানিকে দিয়ে দিল।
পাত্তানী সিটি এসপি উদয় থানি হ্যান্ডমেশিনগানটি আহমদ মুসার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখুন স্যার, আপনার কাজে লাগবে।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘ইতিমধ্যে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদীপক স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি অসম্ভব বড় একটা কাজ করেছেন স্যার। কথিত ‘ব্ল্যাক ঈগল’ এর কাউকেই এখনও জীবন্ত হাতে পাওয়া যায়নি। এবার এক সঙ্গে দশজনকে অস্ত্রসহ এ্যাকশনকালে হাতে-নাতে ধরা গেছে। এটা….।’
সিটি এসপি উদয় থানির কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ওরা দশজন নয়, বার জন। আরও দু’জনকে পাশের ঘরে বেঁধে রেখেছি।’
‘স্যার চলুন দেখি।’ বলে সিটি এসপি উদয় থানি পাশের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। আহমদ মুসাও চলল।
সিটি এসপি উদয় থানি ঘরে ঢুকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দু’জন পুলিশবেশী লোককে দেখতে পেল। দেখতে পেল যয়নব যোবায়দা, দাদী এবং ডাক্তার খালাম্মাকেও।
দাদী ইতোমধ্যে নিচে এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা উদয় থানিকে ওদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘জাবের জহীর উদ্দিনের বোন যয়নব যোবায়দা ওদের টার্গেট। জাবেরের মত যয়নব যোবায়দাকেও ওরা হাতের মুঠোয় পেতে চায়।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এই চেষ্টা তারা করেছে বলেই তাদেরকে আজ এভাবে হাতে-নাতে ধরা গেল। অবশ্য সব কৃতিত্ব স্যার আপনার। তবে এর চেয়ে বড় কৃতিত্বের কাজ আপনি থাইল্যান্ডের জন্য করেছেন, যার জন্যে শুধু থাই পুলিশ নয়, থাই সরকারও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ স্যার।’
কথা শেষ করেই উদয় থানি তাকাল যয়নব যোবায়দার দিকে। বলল, ‘শাহজাদী ম্যাডাম যোবায়দা, আমরা দুঃখিত আপনাদের সম্মানিত পরিবার এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তবে ম্যাডাম মেঘ কেটে যাচ্ছে আশা করি। মি. বিভেন বার্গম্যান স্যার বলা যায় অসাধ্য সাধন করেছেন। এটা শুধু আপনার পরিবারের প্রতি নয়, থাইল্যান্ডের প্রতি ঈশ্বরের একটা বিশেষ সাহায্য।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমাদের পুলিশ বাহিনী ও সরকারের প্রতি সব সময়ই আমরা আস্থাশীল। আমাদের সংকট মোচনে তারা সফল হবেন। আমার অনুরোধ ভাইয়াকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করুন। আর ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের মত যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের দয়া করে আপনারা অভয় দিন।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘শাহজাদী ম্যাডাম, এ নিয়েও উর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আজকের পর তাদের আর হয়রানি করা হবে না।’ সিটি এসপি উদয় থানি বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ওয়েলকাম ম্যাডাম’ বলে উদয় থানি তাকাল ডাক্তার খালাম্মার দিকে। ‘ডাক্তার ফাতেমা জহুরা ম্যাডাম আপনি এখানে, আবার ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো ভুয়া পুলিশের সাথে দেখছি। কি ব্যাপার?’
ডাক্তার খালাম্মা সংক্ষেপে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর এখানে আসার ব্যাকগ্রাউন্ডটা বর্ণনা করে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসবেন, তিনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসবেন, তিনি মি. বার্গম্যানকে গুলী করবেন, এসব কি করে হয়?’
‘ডাক্তার খালাম্মা, উনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসেননি। তিনিই ভুয়া পুলিশকে নিয়ে এসেছে আমাকে, ফরহাদকে এবং ম্যাডাম যয়নবকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডাক্তার ফাতেমা জহুরা ম্যাডাম এ দুনিয়ায় কিছুই অসম্ভব নয়। এই গ্রুপের লোককে প্রথম আমরা হাতে পেয়েছি। বহু কিছুই এখন বেরিয়ে আসবে।’
একটু থামল সিটি এসপি উদয় থানি। কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠল যয়নব যোবায়দাকে লক্ষ্য করে, ‘শাহজাদী ম্যাডাম, ফরহাদ সাহেবকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, সে একটা এফআইআর লিখে দিয়ে আসবে।’
‘ওকে স্যার সে যাচ্ছে আপনাদের সাথে।’ বলে যয়নব যোবায়দা তাকাল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে।
‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘অসুস্থ তুমি, পারবে তো যেতে?’ আহমদ মুসা বলল দরদ ভরা কণ্ঠে।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে। বলল, ‘স্যার আপনি গুলীবিদ্ধ, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে প্রবলভাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার কিছুই হয়নি। এই শিক্ষা কেন আমরা নিতে পারবো না স্যার!’ আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের কথার সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে উঠল সিটি এসপি উদয় থানি। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আমরা তো ওদের নিয়ে যাচ্ছি। বিভেন বার্গম্যান স্যারকে এখনি হাসপাতাল বা কোন ক্লিনিকে নেয়া দরকার। অপারেশন দরকার হতে পারে। রক্তও অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।’
কথা শেষ করেই সিটি এসপি উদয় থানি, ‘সবাইকে ধন্যবাদ, আমরা চলি’ বলে ঘুরে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়াল উদয় থানি। আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘তিনজন পুলিশের একটা টীম বাড়ির সামনে পাহারায় থাকবে। একটি ভ্রাম্যমান পুলিশ বক্সসহ তারা আসছে। সেখানেই তারা থাকবে। এটা উপরের হুকুম। আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগল উদয় থানি।
ওদের সাথে আহমদ মুসাও ড্রইংরুমে গেল।
সবাই বেরিয়ে যেতেই যয়নব যোবায়দা তাকাল ডাক্তার খালাম্মার দিকে।
এ দৃষ্টির অর্থ বুঝল ডাক্তার খালাম্মা ফাতেমা জহুরা। বলল, ‘বেটি ওকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার নেই। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর এই ঘটনা দেখার পর আমি হাসপাতালকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অপারেশন লাগলে এখানেই সেটা হবে।’
‘ওকে ভালো করে দেখুন ডাক্তার খালাম্মা। উনি মানুষ নয় খালাম্মা, আল্লাহর ফেরেশতা উনি! অন্যের কথাই শুধু ভাবেন, নিজের দিকে তাকান না। আপনি তো দেখলেন খালাম্মা, যে গুলীটা তার কাঁধে লেগেছে, ত্বরিত বসে না পড়লে সে গুলীটা তার বক্ষ ভেদ করে যেত। তাহলে কি হতো ভাবতেও ভয় লাগে খালাম্মা। কিন্তু দেখুন, তাঁর মধ্যে এর সামান্য অনুভূতি, উদ্বেগও নেই।’ আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে তার আপনাতেই থেমে গেল। চোখ দু’টিও তার অশ্রু সজল হয়ে উঠেছে।
‘ঠিক বলেছ বেটি। তবে তিনি ফেরেশতা নন, ফেরেশতার চেয়ে বড়। ফেরেশতা যে মানুষকে সিজদা করেছে, তিনি সে ধরনের মানুষ। আমি ভাগ্যবান যে তাকে চিকিৎসা করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু তার পরিচয় কি বেটি? তার সাথে বিভেন বার্গম্যান নাম মানায় না। বলল ডাক্তার খালাম্মা।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমে থেকে এ ঘরে প্রবেশ করল।
‘আপনাকে বলব খালাম্মা পরে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
দাদী এগুলো আহমদ মুসার দিকে। রাজ্যের মমতা নিয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, ‘ভাই, আমাদের জন্যে তোমার যুদ্ধ তো এখনকার মত শেষ। এবার নিজের দিকে নজর দাও। আমার এই ডাক্তার বেটির হাতে নিজেকে ছেড়ে দাও ভাই।’ ডাক্তার ফাতেমা জহুরার দিকে ইংগিত করল দাদী।
‘হ্যাঁ বেটা, টেবিল তো রেডিই আছে। অন্য সবকিছুও প্রস্তুত আছে। চল টেবিলের দিকে।’ দাদীর কথা শেষ হতেই বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা।
‘হাসপাতালে নিতে চাননি এজন্যে ধন্যবাদ ডাক্তার খালাম্মা। আমি রেডি চলুন।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘বেটা তুমি কি পাথরের? বুলেট বিদ্ধ হয়েও স্বাভাবিক থাকতে পার, হাসতে পার?’ আহমদ মুসার ডান হাত ধরে টেবিলের দিকে টেনে নিতে নিতে বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা।
‘মানুষ পাথর নয় ডাক্তার খালাম্মা। কষ্ট ও যন্ত্রণাবোধ সব মানুষের প্রায় একই রকম। তবে বড় কষ্টের কথা ভাবলে ছোট কষ্ট ভুলে থাকা যায় খালাম্মা, বড় বিপদ প্রতিরোধের বিষয় বড় হয়ে দেখা দিলে উপস্থিত কষ্টের কথা মানুষের মনে থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা ডাক্তার খালাম্মা, ঈশ্বরের জন্যে সব ব্যাথা-বেদনা মানুষ হজম করতে পারে।’
‘ঠিক বলেছ বেটা, যুক্তি এবং বিজ্ঞানও এই কথা বলে। কিন্তু যে মানুষ একে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, সেই মানুষ কিন্তু দেখা যায় না। তোমাকে ব্যতিক্রম হিসাবে দেখছি। তুমি কে বেটা, আমি এখনও কিন্তু জানি না।’ বলল ডাক্তার ফাতিমা জহুরা।
টেবিলে পৌছে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
ডাইনিং টেবিলে একটা তোষক তার উপর রেক্সিন আর চাদর বিছানোই ছিল। একজন পরিচারিকা বিছানা ঝেড়ে-মুছে দিচ্ছিল। তারও কাজ হয়ে গেল।
বিছানায় শোবার সময় বলল, ‘পরিচয় যেটুকু বাকি আছে, সেটুকও হয়ে যাবে ডাক্তার খালাম্মা।’
ডাক্তার ফাতেমা জহুরা তার ব্যাগ খুলে ষ্টেরিলাইজড অপারেশন কীটস নিয়ে আহমদ মুসার মাথার কাছে গেল।
কীটসটা খুলে বিছানায় রেখে গস্নাভস পরতে পরতে বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা, ‘কারও একজনের সাহায্য প্রয়োজন।’
যয়নব যোবায়দা বলল, ‘আমি আপনার পাশে আছি ডাক্তার খালাম্মা।’ বলে ডাক্তার ফাতেমা জহুরার পাশে এসে দাঁড়াল সে।
পরিচারিকরা দু’জন ড্রইংরুম পরিষ্কার করছিল, সেখানেই আবার ফিরে গেল।
অপারেশন শুরু করে দিল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা।

মাগরিবের নামায শেষ করে বেডের পাশের সোফায় বসেছে আহমদ মুসা। একজন পরিচারিকা চা দিয়ে গেল।
পিরিচ সমেত চায়ের কাপ তোলার জন্যে বাম হাত এগিয়ে নিতে গিয়ে পারল না আহমদ মুসা। বেদনার চেয়ে ঘাড়ের ব্যান্ডেজটিই অসুবিধা করছে বেশি। ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় ডাক্তার খালাম্মা তাকে বলেছে, ‘হাতকে যাতে কাজে লাগাতে না পার এমন ব্যান্ডেজই বাঁধব। হাত না নাড়লে কাঁধ রেষ্টে থাকবে। দু’দিন এমন রেষ্টে থাকলে দু’দিন পরেই তুমি এ হাত দিয়ে কাজ করতে পারবে।’
ডান হাত দিয়ে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগল আহমদ মুসা।
দাদী এসে পাশে বসল আহমদ মুসার। বলল, ‘কেমন আছ ভাই? জ্বর আসে নি তো?’
‘না দাদীমা, আমি ভালো আছি।’
‘কেমন করে যে ভালো থাক ভাই, তোমাকে দেখেই আমার জ্বর এসেছে।’
‘একটা ওষুধ বলি দাদীমা?’
‘জ্বরের? বল।’
‘নামায পড়ার সময় যেমনটা হয়, সেভাবে মনোযোগ কালবের দিকে স্থির রেখে একশ বার বলুন, আমার জ্বর নেই। দেখবেন জ্বর আপনার থাকবে না।’
হাসল দাদী। বলল, ‘তুমি দেখছি পীর-ফকিরের পথ ধরলে। তোমার এ কথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি?’
‘ভিত্তি দু’টি দাদীমা। একটি হলো, একটা অনুভূমি থেকে আপনার জ্বর এসেছে, বিপরীত এক অনুভূতি দিয়ে আগের অনুভূতি মুছে ফেললেই জ্বর সেরে যাবে। দ্বিতীয়ত, রোগ নিরাময়ে ইতিবাচক মানসিক শক্তির ভূমিকা খুব বড়। আমি সুস্থ আছি, এই ইতিবাচক চিন্তা বাড়িয়ে নিতে পারলে তা রোগ নিরাময়ে সহায়ক হয়।’
যয়নব যোবায়দা দাদীর খোঁজে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসাকে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে।
আহমদ মুসা থামলেই সে বলে উঠল, ‘আপনি দেখছি স্যার মনো-চিকিৎসকও। কি নন স্যার আপনি?’
আহমদ মুসা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠল। থেমে গেল আহমদ মুসা।
মোবাইলটা বাম পাশে বেডের উপর ছিল। অভ্যাসবশত বাম হাতটা সেদিকে বাড়াতে গেল। ধাক্কা খেয়ে হাতটা থেমে গেল আহমদ মুসার।
যয়নব যোবায়দা ছুটে গেল। তার মাথার নাইলনের রুমাল কপালের উপর সরে গিয়েছিল। রুমালটি তাড়াতাড়ি কপালের উপর টেনে নিয়ে মোবাইল বিছানা থেকে তুলে আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা মোবাইল মুখের কাছে তুলে নিল।
আহমদ মুসা ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী প্রধান পুরসাত প্রজাদীপকের কণ্ঠ শুনতে পেল।
আহমদ মুসা মোবাইলের ভয়েস স্পীকার অন করে বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার।’
‘গুড ইভনিং বিভেন বার্গম্যান। তোমাকে অভিনন্দন।’
‘কেন স্যার?’
‘তোমার ওখান থেকে মানে যয়নব যোবায়দার ওখান থেকে যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই ব্ল্যাক ঈগলের বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রমাণিত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন বিদেশী যার নাম বেঞ্জামিন বেকার। সে ইসরাইলেরই কোন এক স্থানের বাসিন্দা।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এই সুখবরের জন্যে ধন্যবাদ স্যার।’
‘আরও সুখবর আছে বিভেন বার্গম্যান। বিদেশী বেঞ্জামিন বেকারকে ওখানে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর কালকেই তাকে ব্যাংকক আনা হচ্ছে। এছাড়া সুলতান গড়েড় শাহবাড়িতে সেদিন দুই ঘটনায় বিদেশীদের যে লাশ পাওয়া গেছে এবং ব্যাংককে প্রথম কিডন্যাপিংয়ের ঘটনায় যারা মরেছিল, তাদের মধ্যেকার বিদেশীদের লাশ সংরক্ষিত আছে, এসব লাশ ব্যাংককে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এবং বেঞ্জামিন বেকারকেও এসব লাশ দেখানো হবে। ওদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এসব পরীক্ষা থেকে তোমার ‘তৃতীয় পক্ষ’ তত্বের বড় প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনার শুভেচ্ছায় এটা সম্ভব হচ্ছে। স্যার, আমি শুধু দেখতে চাই জাবের জহীর উদ্দিন নির্দোষ, পাত্তানী মুসলমানরা নির্দোষ এবং এটা প্রমাণ হোক যে, তৃতীয় একটি পক্ষ মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসের অভিযোগ চাপানোর পুরাতন প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু করেছে।’
‘আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন বিভেন বার্গম্যান? আমরাই তো তোমাকে ধন্যবাদ দেব। আমরাই আমাদের দেশের এক গ্রুপ নাগরিককে ভুল বুঝেছিলাম, তাদের সন্ত্রাসী ধরে নিয়েছিলাম, তাদের জেল-জুলুমের শিকারে পরিণত করেছিলাম। তুমি এসে আমাদের সাহায্য করেছ। জান, আজ প্রধানমন্ত্রী এই ফাইল কল করেছিলেন। তিনি দেখেছেন ফাইল। তোমাকে নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ধন্যবাদ বিভেন বার্গম্যান।’
মোবাইলের কল অফ করে পাশে রেখে দিল আহমদ মুসা।
দাদী এবং যয়নব যোবায়দা দু’জনেই টেলিফোনের আলোচনা শুনছিল। তাদের দু’জনেরই চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই দাদী এগিয়ে গেল আহমদ মুসার দিকে। হাত রাখল দাদী আহমদ মুসার মাথায়। বলল, ‘তোমাকে দোয়া করার কোন ভাষা আমার নেই। আর আমার মত সামান্য কেউ তোমার জন্য কিইবা দোয়া করতে পারে! আমরা কৃতজ্ঞ ভাই। তুমি আমাদের জাতিকে, কম্যুনিটিকে বাঁচিয়েছ।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দাদীর কণ্ঠ।
ভারী হয়ে উঠেছিল যয়নব যোবায়দার কণ্ঠ। ভিজে উঠেছিল তার দু’চোখের কোণও। বলল, ‘স্যার, জাবের ভাইয়ার উদ্ধারের জন্যে সরকার কি এবার চেষ্টা করবেন?’ কান্না ভেজা কণ্ঠ যয়নব যোবায়দার।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই বাহির থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল।
শব্দ শুনেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল, ‘দাদী আমার মনে হচ্ছে পুলিশবক্স আক্রান্ত হয়েছে। এটা প্রতিশোধ আক্রমণ অথবা আমাদের ধরার লক্ষে দ্বিতীয় আক্রমণ হতে পারে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বালিশের তলা থেকে হ্যান্ডমেশিনগান তুলে নিয়ে তাতে ম্যাগাজিন লাগাতে লাগাতে বলল, ‘দাদী প্লিজ আপনারা উঠে যান।’
ডান হাতে বালিশ সরিয়ে বাম হাত দিয়ে হ্যান্ডমেশিনগান তুলে ধরেই তাতে ম্যাগাজিন পরিয়েছিল আহমদ মুসা। যেন বাম হাত খুবই স্বাভাবিক, একটু আহত নয়।
সবই দেখল দাদী ও যয়নব যোবায়দা। কিন্তু তাদের মুখে কোন কথা জোগাল না। বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলী শুনে এবং বন্দুক নিয়ে অসুস্থ আহমদ মুসার বাইরে যাওয়া দেখে তারা পাথর হয়ে গিয়েছিল। তাই দোতলায় চলে যাবার জন্যে আহমদ মুসার যে আদেশ তা তারা ভুলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজার ডোর ভিউতে চোখ রাখল।
বাইরে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির বারান্দার নিচে কয়েকজন মানুষ তাদের দরজার দিকে হ্যান্ডমেশিনগান টার্গেট করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন পুলিশবক্সকে টার্গেট করে গুলী ছুঁড়ছে। একজন পুলিশের লাশ পুলিশবক্সের সিঁড়ির উপর পড়ে আছে।
আহমদ মুসা বুঝল অবশিষ্ট দু’জন পুলিশ আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা পুলিশকে পেছনে রেখে বাড়িতে ঢুকতে চাচ্ছে না হয়তো দুই কারণে। একটি হলো, পেছন থেকে আক্রান্ত হবার ভয়, দ্বিতীয়ত, তারা এখানকার খবর দিয়ে পুলিশ ডাকতে পারে।
কিন্তু পুলিশবক্সের নিচের অংশ বুলেটপ্রুফ বলে তারা চাচ্ছে উপরের অংশ ভেঙে পুলিশ দু’জনকে মারতে।
আহমদ মুসা দেখল পুলিশবক্সের উপরের অংশ ঝাঝরা হয়ে গেছে। এখন একটি ধাক্কা দিলেই উপরের অংশ ভেঙে পড়তে পারে। পুলিশকে কাবু করার পরই এদিকে আসবে।
ভাবল আহমদ মুসা, পুলিশকে ওরা কাবু করার আগেই তাকে যা করার করতে হবে। এ সময় তার ঘরের সামনের লোকরাও আক্রমণের জন্য টপমুডে নেই। এটাই তার জন্যে বড় সুযোগ।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল। হ্যান্ডমেশিনগানের লোড একবার পরীক্ষা করল।
তারপর হ্যান্ডমেশিনগান ডান হাত দিয়ে ধরে বাঁ হাতে দরজা আনলক করল।
দরজার তালা খোলা হয়ে গেলে আহমদ মুসা ডান হাতে হ্যান্ডমেশিনগান বাগিয়ে ধরে তর্জনিটা ট্রিগারে রেখে বাম হাত দিয়ে নব ঘুরিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল। ডান হাতের তর্জনি হ্যান্ডমেশিনগানের ট্রিগারে চেপে ব্যারেল ঘুরিয়ে নিল ঘরের সামনে বারান্দার নিচে দাঁড়ানো পাঁচজন ব্ল্যাক ঈগলের উপর দিয়ে।
ঘটনা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ব্রাশ ফায়ারের শিকার হলো।
এদিকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনে পুলিশবক্স আক্রমণে যে চারজন নিয়োজিত ছিল, তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলী বর্ষণ শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এসেছিল।
দরজায় এসে বিদ্ধ হতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী।
ঘরের এদিকে কোন জানালা নেই।
চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। ভেতরের দরজার পেছনে দেখতে পেল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, যয়নব যোবায়দা এবং দাদীকে। উদ্বেগ-আতংকে মুষড়ে পড়েছে তারা সকলেই।
‘ভয় নেই দাদীমা, জয় আমাদের হবে ইনশাআল্লাহ।’
আহমদ মুসার চোখ পড়ল ষ্টিলবডির টিপয়ের উপর। দেখল টিপয়ের টপটা ষ্টিল শীটের।
আহমদ মুসা টিপয়টি বাঁ হাতে তুলে নিয়ে দরজার এ পাশে শুয়ে পড়ল। টিপয়টিকে মাথার সামনে নিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল এবং টিপয়ের প্রান্ত দিয়ে আগে বাড়ানো হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল দিয়ে ছুটল গুলীর বৃষ্টি।
ওরা এগিয়ে আসছিল আহমদ মুসার ব্রাশফায়ারে আহত অথবা নিহত তাদের সাথীদের দিকে। আহমদ মুসার গুলীর মুখে তারাও গুলী বর্ষণ শুরু করল। কিন্তু ওদের অসুবিধা ছিল ওদের সামনে আড়াল ছিল না। ওরা শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল।
সুযোগ পেয়ে পুলিশ দু’জনও বেরিয়ে এসেছে তাদের বক্স থেকে। তাদের দু’জনের রিভলবারের গুলী ছুটল ওদের উদ্দেশ্যে। আহমদ মুসার গুলী ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেলেও দু’জন পুলিশের টার্গেটেড গুলী ব্যর্থ হলো না।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ছুটে এল দু’জন পুলিশ। বলল, ‘স্যার আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমাদের একজনকে ওরা মেরে ফেলেছে। আর একটু হলেই আমাদেরও মেরে ফেলত।’
আহমদ মুসা ওদের হাতে সাধারণ রিভলবার দেখে বলল, ‘তোমাদের হাতে সাধারণ রিভলবার কেন? তোমরা তো বাইরের অপারেশনে বা দায়িত্ব পালনে গেলে আধুনিক ষ্টেনগান ব্যবহার কর?’
‘একটা ভুল হয়েছে স্যার। এ্যামুনিশনসহ ষ্টেনগানের একটা ফোল্ডার আগেই গাড়িতে উঠেছিল এটা আমাদের বলা হয়। কিন্তু পুলিশবক্সে আসার পর গাড়িতে আমরা বাক্সটি পাইনি। কোন ভুলের ফলেই এটা হয়েছে। বিষয়টি আমরা তখনি এসপি সাহেবকে না পেয়ে ডিএসপিকে জানাই। এর ফলেই আমরা রিভলবার দিয়ে সন্ত্রাসীদের মেশিন রিভলবারের মোকাবিলা করতে পারিনি।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
পুলিশের একজন আবার বলে উঠল, ‘স্যার, এসপি সাহেব ডিএসপি মহিদলকে পাঠাচ্ছেন একদল পুলিশসহ। আমরা টেলিফোন করেছি।’
আহমদ মুসা কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই পেছন থেকে কথা বলে উঠল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, ‘স্যার দাদীমা ডাকছেন। আপনার আহত স্থান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। জামা ভিজে গেছে। আপনি আসুন।’
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আসছি।’
তারপর সামনে তাকিয়ে পুলিশ দু’জনকে বলল, ‘আমি ভেতর থেকে আসি। এর মধ্যে ডিএসপি সাহেব এসে পড়লে আমাকে ডেকো।’
আহমদ মুসা দরজা লক করে ভেতরে চলে গেল। ড্রইং রুমের পরের রুমে দাদী, যয়নব যোবায়দা এবং পরিচারিকারা অপেক্ষা করছিল।
আহমদ মুসার রক্তভেজা জামার দিকে তাকিয়ে দাদী বলল, ‘তুমি আমাদের জন্যে আর কত কষ্ট করবে ভাই! যে হাত দিয়ে তুমি চায়ের কাপ তুলতে পরো না, সেই হাত দিয়ে লড়াই করে আসলে।’
যয়নব যোবায়দারও চোখ ভরা অশ্রু। বলল, ‘আপনি বসুন স্যার। ডাক্তার খালাম্মা আসছেন।’
‘না ম্যাডাম যোবায়দা, আমি বসতে পারব না। ডিএসপি সাহেব আসছেন। এ সময় আমার ওখানে থাকা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু স্যার, আপনি ভালো না থাকলে তো আমরাও ভালো থাকবো না।’ কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ যয়নব যোবায়দার।
‘ভালো রাখার মালিক আল্লাহ বোন। মনে করুন, আমাদের ওহুদ যুদ্ধের কঠিন সময়ের কথা। রাসুল স. এর দাঁত ভেঙে গেছে, কপালে গভীর হয়ে বসে গেছে একটা লৌহ খন্ড। রক্তাক্ত মহানবী। তবু তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং পলায়নপর শত্রু একত্রিত হয়ে আবার যাতে আক্রমণ করতে না পারে এজন্যে রক্তাক্ত, আহত, অবসন্ন সাথীদের নিয়ে শত্রুদের তাড়া করেছেন। আমরা তো তারই অনুসারী বোন।’
যয়নব যোবায়দার দু’গ- বেয়ে নামছে অশ্রুর দু’টি মোটা ধারা। দৃঢ় সংবদ্ধ দু’টি ঠোঁট তার কাঁপছে। একটা উচ্ছাস রোধ করছে সে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল বাইরে যাবার জন্যে।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার আমি আসি আপনার সাথে?’ তার কণ্ঠ ভারী। তারও চোখে অশ্রু।
‘এস।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ওকে আপনার মত লড়াই শেখান।’ পেছন থেকে কান্না জড়িত ভাঙা গলায় বলল যয়নব যোবায়দা।
না দাঁড়িয়ে, পেছনে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘সেও লড়াই শিখেছে, শিখবে। কিন্তু সেটা অস্ত্রের লড়াই নয়, বুদ্ধির লড়াই। বুদ্ধির লড়াই অস্ত্রকে অচল করে দিতে পারে।’
আহমদ মুসা বাইরে এসে দেখল, পুলিশরা এসেছে। উর্ধ্বতন একজন পুলিশ অফিসারকেও দেখতে পেল সে। আহমদ মুসাকে দেখেই সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেল।
পুলিশ অফিসারটি তার সামনে এসেই বলল, ‘স্যার আপনি নিশ্চয় বিভেন বার্গম্যান?’
আহমদ মুসার সাথে কথা বলার সময় পুলিশ অফিসারটির চেহারায় অসন্তুষ্টির ছায়া দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটি পুলিশবক্স আমরা নিয়ে এসেছি। এবার ছয়জন পুলিশ পাহারায় থাকবে।’
‘ধন্যবাদ মি. মহিদল।’
পুলিশ অফিসারটির চোখ পড়েছিল আহমদ মুসার হ্যান্ডমেশিনগানের দিকে। বলল, ‘স্যার হ্যান্ডমেশিনগানটি কি সন্ত্রাসীদের?’
‘না।’
‘তাহলে এটা আপনার লাইসেন্সকৃত?’
‘না। এটা ছিল আগের সন্ত্রাসীদের। এসপি উদয় থানি এটা আমার কাছে রেখেছেন প্রয়োজন হতে পারে বলে।’
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, পুলিশ অফিসারটির এ জিজ্ঞাসাবাদে সদিচ্ছার কোন সুর নেই।
আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলল, ‘মি. মহিদল অস্ত্রটা কি আপনি নিয়ে যেতে চান?’
‘না, স্যার আমি তা পারি না। এসব অস্ত্র তো পাবলিকের কাছে থাকে না। তাই কৌতূহল বশতই প্রশ্ন করেছিলাম।’ দ্রুত নিজেকে সহজ করে নিয়ে মহিদল বলল।
কথা শেষ করেই আবার সে বলে উঠল, ‘চলি স্যার। আমার এ দিকের কাজ শেষ।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, লোকটি তাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না।
মনে তার নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। সে ড্রইংরুম লক করে ধীরে ধীরে চলে এল ভেতরে। এসে বসল তার ঘরের সোফায়।
এর কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার খালাম্মাকে নিয়ে যয়নব যোবায়দা, দাদী এবং ফরহাদ এল।
‘ওয়েলকাম ডাক্তার খালাম্মা। আসুন। আমি বসে আছি। যা করার করুন প্লিজ।’ বলল আহমদ মুসা হেসেই। কিন্তু হাসিটা হাসির মত ছিল না।
‘ধন্যবাদ বেটা। আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব টায়ারড। তোমার শরীরের উপর খুবই অবিচার হচ্ছে বেটা।’
ডাক্তার খালাম্মা বলছিল আর আহমদ মুসার গায়ের রক্তমাখা জামা কাটছিল। ব্যান্ডেজ কেটে আহত স্থানের অবস্থা দেখে বলল, ‘ইস, কি হয়েছে আহত জায়গাটার হাল! সেলাইগুলো কেটে গেছে। আবার সেলাই করতে হবে। তোমার কিন্তু খুব কষ্ট হবে বেটা।’
আহমদ মুসা তখন অন্য এক ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত। ডাক্তার খালাম্মার কোন কথাই তার কানে যায়নি।
ডাক্তার খালাম্মা তাকাল যয়নব যোবায়দা, দাদীদের দিকে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। এ ঘরে আসা থেকেই তারা আহমদ মুসাকে গম্ভীর ও চিন্তান্বিত দেখছে। আহমদ মুসার এমন চেহারা তাদের কাছে অপরিচিত।
ডাক্তার খালাম্মা তার কাজে মনোযোগ দিল। কাঁচি দিয়ে কেটে ছেঁড়া সেলাই-এর কডগুলো তুলে ফেলতে লাগল।
‘প্লিজ খালাম্মা’ বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সোফার ওপাশে পড়ে থাকা মোবাইল তুলে নিতেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
কল অন করে মোবাইল স্ক্রীনে এসপি উদয় থানি’র নাম্বার দেখে ভীষণ খুশি হলো। শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, ‘মি. উদয় থানি আপনার কাছেই আমি টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।’
‘জরুরী কিছু স্যার? আপনার কণ্ঠে আমি উত্তেজনা দেখছি। নিশ্চয় বড় কিছু হবে?’ বলল উদয় থানি।
‘মি. উদয় থানি, আমি মনে করছি ব্ল্যাক ঈগল তার লোকদের আজ রাতেই ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করবে।’
‘তার মানে ওরা আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করবে।’
‘ব্ল্যাক ঈগলের চরিত্র আমি জানি। এই প্রথম ওদের কিছু লোক ধরা পড়েছে। তাদের উদ্ধার করতে দরকার হলে গোটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার ওরা ধ্বংস করতে পারে। এমনকি যদি দেখে তাদের লোকদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের লোকদেরসহ গোটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার তারা উড়িয়ে দেবে।’
‘এত বড় অনুমানের হেতু কি স্যার?’
‘আমাদের এখানে ওদের সর্বাত্মক আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত। অথচ নিজেদের রক্ষার জন্যে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির আগে ওদের উদ্ধারটাই বেশি প্রয়োজন। সুতরাং আমি মনে করছি আমাদের এখানে ওদের সর্বাত্মক আক্রমণই ওখানে আক্রমণ হওয়ার প্রমাণ।’
‘আপনাদের অনুমান যুক্তিসংগত স্যার। আমি গ্রহণ করছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা কৃতজ্ঞ স্যার। আপনার ওখানে সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে দু’জন পুলিশ রক্ষা পেয়েছে এবং ওদের হামলা ব্যর্থ হয়েছে আপনার জন্যেই। আপনার ওখানে সন্ত্রাসীরা যে জবাব পেয়েছে, এখানে সে জবাবই তারা পাবে।’ বলল উদয় থানি।
‘আরেকটা বিষয় মি. উদয় থানি। এটা ভুল অনুমান হতে পারে। তবে আজকের ঘটনায় বিভিন্ন কার্যকরণ থেকে আমি মনে করছি, সন্ত্রাসীদের সাথে আপনাদের পাত্তানী পুলিশের কেউ বা কোন গ্রুপের যোগসাজশ আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগেই জবাব এল না ওপার থেকে। একটুক্ষণ পরেই এসপি উদয় থানির বিস্মিত কণ্ঠ ভেসে এল, ‘মি. বিভেন বার্গম্যান আপনি এ কথা বলছেন?’
‘বলছি এ কারণেই যে এই যোগসাজশ আছে বলেই আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সন্ত্রাসীদের হামলার আরও বেশি আশংকা করছি মি. উদয় থানি। আমাদের এখানকার ঘটনায় এই যোগসাজশের কিছু আলামত পাওয়া গেছে বলে আমি মনে করি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাদের কথা স্যার আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু আলামতগুলো জানতে চাই স্যার।’ বলল পাত্তানী শহরের এসপি উদয় থানি।
‘আজ এখানে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মুখে একজন পুলিশ হত্যা ও পুলিশের বিপর্যয়ের বড় কারণ হলো এখানে ডিউটিরত তিনজন পুলিশের হাতে তাদের জন্যে নির্ধারিত সাবমেশিনগান ছিল না। হ্যান্ডমেশিনগানের আক্রমণের মুখে তাদের রিভলবার কোনই কাজ করেনি। দ্বিতীয়ত………।’
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে উদয় থানি বলল, ‘স্যরি স্যার। অবাক করার মত কথা আপনি বললেন। বিষয়টা কি পুলিশ আপনাকে বলেছে? কি বলেছে?’
‘তাদের বলা হয় তিনটি ষ্টেনগান ও এ্যামুনিশনস একটা ফোল্ডারে বা বাক্সে আগেই গাড়িতে উঠেছে। কিন্তু আমাদের এখানে এসে পুলিশ ফোল্ডার পেয়েছে, অথচ তার মধ্যে কিছুই ছিল না। তারা বিষয়টা আপনাকে না পেয়ে ডিএসপিকে জানায়।’
‘ষ্ট্রেঞ্জ, এমনটা কিভাবে ঘটতে পারে! ডিএসপি সাহেব আমাকে কিছু বলেননি। কোন ত্বরিত ব্যবস্থাও নেননি। এটাও আমার বিশ্বাস করতে পারছি না। স্যার, এ ব্যাপারে আপনি বোধ হয় আরও কিছু বলতে চান! দয়া করে বলুন স্যার।’
‘কিছু মনে করবেন না মি. উদয় থানি। আমি এখন যা বলব সেটা আমার একটা ইমপ্রেশন। আমার মনে হয়েছে ডিএসপি মি. মহিদল সন্ত্রাসীদের ব্যর্থতায় খুশি হননি এবং সন্ত্রাসীদের হত্যায় আমার ভূমিকা ভালো চোখে দেখেননি। তিনি সামান্য একটি ধন্যবাদও আমাকে দেননি। বরং হ্যান্ডমেশিনগানটা আমার হাতে কেন, এর লাইসেন্স আছে কিনা, এসব প্রশ্নও তিনি তুলেছেন।’
‘আপনি ইমপ্রেশনটা ঠিকই নিয়েছেন। আমি শুধু বিস্মিত নই, উদ্বেগও বোধ করছি। সাবমেশিনগান কেন গেল না, আমি এখনি দেখছি।’
‘মি. উদয় থানি। আমার একটা অনুরোধ- দয়া করে মি. মহিদল যে ছয়জন পুলিশকে রেখে গিয়েছে তাদের পরিবর্তন করে অন্য ৬ জন দিন।’
‘বুঝেছি স্যার। আপনি ঠিক বলেছেন? এখনি ছয় জন পুলিশ যাচ্ছে, আর ওরা ফেরত আসবে। স্যার আমাকে কোন পরামর্শ দেবেন।’
‘মি. উদয় থানি। আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। আপনি সব জানেন কি করতে হবে আপনাকে।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনি অনেক পুলিশের জীবন বাঁচাবার, অনেক ক্ষতি এড়ানোর এবং ব্ল্যাক ঈগলের লোকদের ধরে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষার দায়িত্ব আমি তো মহিদলকেই দিতে যাচ্ছিলাম। রক্ষা করলেন আপনি। আমি এখনি ওকে ডিউটি থেকে অফ করে দিচ্ছি। আর…….।’
হঠাৎ এই সময় টেলিফোনে একটা গুলীর শব্দ ভেসে এল। একটা ‘আঃ’ আর্তনাদ ভেসে এল। গলাটি উদয় থানির বুঝল আহমদ মুসা। তারপরই একটি শব্দ। মোবাইল পড়ে যাবার শব্দ। তার সঙ্গে সঙ্গেই আবার গুলীর শব্দ ভেসে এল। এর পরেই আবার দু’টি গুলীর শব্দ পেল টেলিফোনে।
তারপর সব চুপচাপ। কথা ও চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কিন্তু কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।
‘মি. উদয় থানি’, ‘মি. উদয় থানি’ বলে ডাকতে লাগল আহমদ মুসা, কিন্তু কোন উত্তর পেল না।
উদ্বেগ দেখা দিল আহমদ মুসার মনে। সন্ত্রাসীরা কি পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করেছে? কিন্তু সবগুলোই তো রিভলবারের গুলীর শব্দ। ওদের মরিয়া আক্রমণ হেভি অস্ত্র দিয়ে হবার কথা, রিভলবার দিয়ে নয়।
মোবাইল বন্ধ করল আহমদ মুসা।
‘কি ঘটনা স্যার?’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
যয়নব যোবায়দা, ডাক্তার খালাম্মা এবং দাদী সবারই চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘কি ঘটেছে আমি জানি না, কিন্তু বড় কিছু ঘটেছে। এসপি উদয় থানি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ।
‘একজন পুলিশ অফিসারের যে ষড়যন্ত্র এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সন্ত্রাসীদের হামলার যে কথা আপনি টেলিফোনে বললেন, সেটাই ঘটল কিনা?’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘ঘটতে পারে, কিন্তু কি ঘটেছে বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে হচ্ছে গুলী বিনিময়টা পুলিশের মধ্যে হয়েছে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি বাইরে পুলিশদের কাছে বসে থাক। তাদের কাছে কোন খবর আসে কিনা দেখ।’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে এ নির্দেশ দেয়ার পর ডাক্তার খালাম্মার দিকে চেয়ে বলল, ‘খালাম্মা আপনার কাজটা দয়া করে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন। এসপি উদয় থানি যদি নিহত হয়ে থাকেন, তাহলে কোন বিপদ আমাদের উপর আসতে পারে।’
‘আমরা তো বিপদের মধ্যেই আছি। নিশ্চয় কোন বড় বিপদের কথা বলছেন?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
ডাক্তার খালাম্মা পুরানো আহত স্থানটা ড্রেসিং-এর কাজ শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা তখন ড্রেসিং এর জন্যে স্থির হয়ে বসেছে। ঐ অবস্থায় বলল যয়নব যোবায়দার কথার উত্তরে, ‘আমি একটা আশংকা করছি, কিন্তু তার আগে যদি বিপদ আসে?’
‘বেটা এ সময় কথা না বললে আমার কাজটা সুন্দর হবে।’ বলল ডাক্তার খালাম্মা।
‘তুমি কাজ কর ডাক্তার মা। আর কেউ কথা বলবে না।’ বলল দাদী।
‘আমি দুঃখিত’ বলে যয়নব যোবায়দা দাদীর পাশে গিয়ে বসল।
ড্রেসিং শেষ করে ডাক্তার হাত পরিষ্কার করে এসে সোফায় বসে বলল, ‘বেটা বিভেন বার্গম্যান। তোমার নাম খৃষ্টান হলেও তুমি খৃষ্টান নও। যারা হারাম খায়, তাদের গা একটা বিজাতীয় গন্ধ ছড়ায়। অমুসলিম কলিগদের সাথে আমি কাজ করি বলে আমি এটা জানি। তুমি খৃষ্টান নও অবশ্যই। তোমার কথা-বার্তার ষ্টাইলেও এটা বুঝা গেছে। তুমি তাহলে কি? কে তুমি। আমার পুরানো প্রশ্ন এটা।’
ডাক্তার খালাম্মার কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার মুখে কিছুটা উত্তেজনা। আহমদ মুসার দৃষ্টি ফিরে গেছে তার দিকে। বলল, ‘ফরহাদ, মনে হচ্ছে কিছু খবর আছে?’
‘স্যার আগের ছয়জন পুলিশ চলে গেছে। নতুন ছয়জন পুলিশ এসেছে।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘আলহামদুলিল্লাহ, এসপি উদয় থানি তাহলে বেঁচে আছেন।’
একটু থেমেই ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘পুলিশরা কিছু বলেনি? বলাবলি করেনি?’
‘নতুনরা নেমেই আগের পুলিশদের বলেছে, অফিসে একটু গোলমাল আছে, তোমরা তাড়াতাড়ি যাও। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি গোলমাল? প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে গেছে।’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল।
আহমদ মুসা যয়নব যোবায়দাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি যে বিপদের কথা বলেছিলাম, সে বিপদ কেটে গেছে। যে ছয়জন পুলিশ এতক্ষণ পর্যন্ত এখানে ছিল, তাদের প্রতি আমার আস্থা ছিল না। তাই এদের তুলে নিয়ে নতুন পুলিশ দিতে বলেছিলাম উদয় থানিকে। তিনি সেটা করেছেন।’
‘কেন তুমি সন্দেহ করেছিলে এই পুলিশ ছয়জনকে?’ বলল দাদীমা।
আহমদ মুসা পাত্তানী শহরের ডিএসপি মহিদলের সাথে সন্ত্রাসীদের সম্পর্কের বিষয় সামনে এনে বলল, ‘আগের ছয়জনকে মহিদল নিয়ে এসেছিল। সুতরাং তাদেরকে আমি বিশ্বস্ত মনে করিনি দাদীমা।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি মি. উদয় থানিকে আর একবার দেখি। ওখানে কি ঘটল জানতে পারলাম না।’
আহমদ মুসা আবার টেলিফোন করল এসপি উদয় থানিকে। মোবাইলে রিং হলো কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
আহমদ মুসা ভাবল ঘটনা এই হতে পারে যে, তাঁর হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাবার পর সেটা আর তোলা হয়নি এবং উদয় থানি সেই ঘরে এখন নেই।
আহমদ মুসা স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ ভরসা।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘পুলিশ থাকলেও আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ওদের সম্ভাব্য আক্রমণ সফল হলে,ওরা এখানেও হামলা চালাতে পারে। এখন রাত ৮টা। রাত ২টা পর্যন্ত তুমি পাহারা দেবে। রাত ২টায় আমাকে জাগিয়ে দেবে। পরের দায়িত্ব আমার।’
‘অবশ্যই পারব স্যার।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘কিন্তু উনি গুলী চালাতে জানেন না। পাহারা দেবেন কিভাবে?’ টিপ্পনি কাটার সুরে বলল যয়নব যোবায়দা।
মুখ লাল হয়ে উঠেছে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের। বিব্রত কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বন্দুক চালনা ভালো জিনিস নয়। ফেৎনা-ফাসাদের আগ্রাসন মোকাবিলার অপরিহার্য কাজেই শুধু এই খারাপ কাজকে বৈধ করা হয়েছে। সবাইকে সব সময় এ কাজের জন্যে প্রয়োজন হয় না, হলে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন কারো পেছনে থাকবে না। আপাতত তার দায়িত্ব আমাকে প্রয়োজন অনুসারে ও ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেয়া।’
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে যয়নব যোবায়দার ঠোঁটে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই দাদী বলল, ‘খাবার দেয়া হয়েছে। এখন উঠ, সবাইকে খেতে হবে।’
‘বিকেলে আমার নাস্তা একটু বড় হয়েছে। আমি এখন খাব না। দু’টায় উঠে কিছু খেয়ে নেব। চল ফরহাদ এশার নামায পড়ে নিই। তারপর আমি ঘুমাব, তুমি জাগবে।’
বলে উঠতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
ডাক্তার খালাম্মা বলে উঠল, ‘উঠ না, বিভেন বার্গম্যান। তোমার পরিচয় আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। তুমি এর মধ্যে একবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’, আরেকবার ‘আল্লাহ ভরসা’ বলেছ। তার মানে তুমি খৃষ্টান নও। তাহলে তোমার নাম বিভেন বার্গম্যান কেন? বলতে হবে কে তুমি? তোমার এই ছদ্মবেশ কেন?’ ডাক্তার খালাম্মার নাছোড়বান্দা কণ্ঠ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘খালাম্মা, আমার যে পরিচয় পেয়েছেন সেটা সত্য। আমার বাকি পরিচয় আপনি ম্যাডাম যয়নব যোবায়দার কাছ থেকে জানতে পারবেন। আমার ছদ্মবেশ বিপক্ষকে বিভ্রান্ত এবং কাজের সুবিধার জন্যে খালাম্মা।’ গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার গম্ভীর, প্রশান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তার খালাম্মা বলল, ‘ঠিক আছে বেটা।’
যয়নব যোবায়দা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল ডাক্তার খালাম্মাকে, ‘আসুন খালাম্মা। খেতে খেতে সব বলা যাবে।’
পরে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বোনকে ‘ম্যাডাম’ বলা কি ভালো দেখায়?’
‘আপনিও আমাকে ‘স্যার’ বলেন।’ বলল আহমদ মুসা।
যয়নব যোবায়দার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আর বলব না ভাই সাহেব।’
যয়নব যোবায়দা পা বাড়াল ডাইনিং রুমের দিকে যাবার জন্যে।
আহমদ মুসারা এগুলো জায়নামাযের দিকে।

রাত তখন সাড়ে তিনটা। ব্ল্যাক ঈগলের পাত্তানী সিটির আইজ্যাক জ্যাকব এবং ব্ল্যাক ঈগলের থাই অপারেশন প্রধান শিমন আশের একটা ছোট ঝাউ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নাইটভিশন দূরবীন চোখে লাগিয়ে পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং তার আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে।
পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টার একটা উচ্চভূমির উপর। উচ্চভূমি গোটাটাই ফলজ গাছের বাগান। উচ্চভূমির মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে লাল ইটের তৈরি পুলিশ হেডকোয়ার্টারটি। হেডকোয়ার্টারের চারদিক ঘিরে বাগান। এই বাগানেরই এখানে-সেখানে পুলিশদের রেসিডেন্সিয়াল বস্নক।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার তিন তলা। কিন্তু মাটির নিচে রয়েছে আরও দু’টি আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর। এই ফ্লোরগুলোতে রাখা হয় ভয়ংকর সব ক্রিমিনালদের।
বাগানের ভেতর ছোট একটা ঝাউয়ের আড়াল থেকে আইজ্যাক জ্যাকব ও শিমন আশেরের নাইটভিশন দূরবীন এই পুলিশ হেডকোয়ার্টারকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। তাদের উদ্দেশ্য পাহারায় থাকা পুলিশদের দেখা। তাদের নাইটভিশন দূরবীনের দৃষ্টিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ফ্রন্ট ভিউ নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু একজন পুলিশকেও কোথাও পাহারায় দেখছে না।
স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব এবং শিমন আশের দু’জনের মুখেই। আইজ্যাক জ্যাকব বলল, ‘মি. আশের স্যার, মনে হচ্ছে আমাদের ডিএসপি মহিদল পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পেরেছে।’
‘তাহলে তো কাজ শুরু করা দরকার। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিউটিরত ও পাহারায় থাকা পুলিশদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য যে বিশেষ ক্লোরোফরম গ্যাস তাকে দেয়া হয়েছে, তার মেয়াদ দু’ঘণ্টা। এক ঘণ্টা পর সবাই সংজ্ঞা ফিরে পাবে। আমাদের কিন্তু ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করে ফিরতে হবে।’ বলল শিমন আশের।
‘ঠিক। তা না হলে বাধা পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কেউ এলে কিংবা টেলিফোন করে অব্যাহতভাবে নো রিপ্লাই পেলে বিষয়টা ধরা পড়ে যেতে পারে।’ বলে আইজ্যাক জ্যাকব হাতঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকাল। সময় ৩টা বেজে ৩২ মিনিট। ঠিক তিনটা ৩০ মিনিটে সে ক্লোরোফরম গ্যাস ছেড়েছে। সুতরাং দুই মিনিট চলে গেছে অপারেশন শুরু হবার পর।
‘চলুন তাহলে অগ্রসর হওয়া যাক। আমি সংকেত দিচ্ছি সবাই আমাদের ফলো করবে।’ বলল শিমন আশের।
‘না স্যার, সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে এভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আমি দেখে আসি।’ বলে ছুটল আইজ্যাক জ্যাকব পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে।
গেটে পৌছেই সে দেখল গেটের দু’পাশের দুই গেট বক্সে চারজন পুলিশের দেহ সংজ্ঞাহীনভাবে কোনটা টেবিলে, কোনটা মেঝেতে পড়ে আছে। ভেতরে ঢুকে ডিউটি রুম পর্যন্ত একই দৃশ্য দেখল আইজ্যাক জ্যাকব। বিভিন্ন স্থান মিলে প্রায় তিরিশজন পুলিশকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সে দেখতে পেল। ডিউটি রুমে ডিএসপি মহিদলকেও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। এটাই পরিকল্পনা ছিল যে, ডিএসপি মহিদল নিজেও সংজ্ঞাহীন হবে, যাতে সে সকল সন্দেহের উর্ধে থাকে।
ডিউটি রুম থেকে বেরুবার সময় আইজ্যাক জ্যাকব টেবিলের উপর ঢলে পড়ে থাকা পুলিশের দেহ তুলে ধরে একটা ঝাকুনি দিল ক্লোরোফরমের এ্যাকশন দেখার জন্যে।
ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিতেই গড়িয়ে দেহটি মেঝেয় পড়ে গেল।
হাসি মুখে ছুটে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এল আইজ্যাক জ্যাকব।
পৌছে খবর দিল আশেরকে, ‘স্যার মাঠ একদম পরিষ্কার। ৩০ জন পুলিশকে সংজ্ঞাহীন পড়ে থাকতে দেখে এলাম। ডিএসপি মহিদলকেও। চলুন যাওয়া যাক।’
‘যাব। শোন আইজ্যাক জ্যাকব, তুমি তো জান, মহিদল যা বলেছে। তিন তলার রেড সিকিউরিটি রুমে লিফট আছে ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামার। ভূগর্ভের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আমাদের লোকদের রাখা হয়েছে। তুমি দশ বারো জনকে নিয়ে যাবে তাদের উদ্ধারের জন্য। আমি অবশিষ্টদের নিয়ে নিচে পাহারায় থাকব। যাওয়া ও আসার মধ্যে দশ মিনিটের বেশি সময় তুমি পাবে না মনে রেখ।’ বলল শিমন আশের।
‘দশ মিনিট যথেষ্ট স্যার। চলুন।’ আইজ্যাক জ্যাকব বলল।
সবাই পৌছল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।
পরিকল্পনা মোতাবেক আইজ্যাক জ্যাকব ১২ জনকে নিয়ে তিন তলার রেড সিকিউরিটি রুমের দিকে ছুটল সিঁড়ি দিয়ে। দুই তলা শূন্য দেখল। চার তলাও তাই। তবে রেড সিকিউরিটি রুমে ঢুকে দেখল চারজন পুলিশ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। খুশি হলো আইজ্যাক জ্যাকব। একজনের পাঁজরে লাথি মেরে বলল, ‘হারামজাদারা, আমাদের লোকদের আটকে রেখেছিল?’ লিফটের সুইচ অন করল আইজ্যাক জ্যাকব। লিফটের দরজা খুলে গেল।
লিফটে উঠল ওরা বার জন।
লিফট গিয়ে পৌছল ভূগর্ভস্থ দুই ফ্লোরের গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
লিফটের দরজা খুলে গেল। সামনেই বিরাট হল ঘর।
হল ঘরে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে তাদের ১২ জন লোক।
আইজ্যাক জ্যাকবদের দেখে ওরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
দ্রুত ওদের বাঁধন খুলে দেয়া হলো।
আনন্দে একে অপরকে ওরা জড়িয়ে ধরল। কুশল বিনিময় শুরু হয়ে গেল।
আইজ্যাক জ্যাকব চিৎকার করে বলল, ‘এখন এসব রাখ। আগে বের হও পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে।’
বলেই আইজ্যাক লিফটের বন্ধ দরজার দিকে চলল।
চাপল লিফটের উপরে উঠার সুইচ।
সবাই ছুটে আসতে লাগল লিফটের দিকে।
লিফটের দরজা খুলল না ।
সুইচের দিকে তাকাল আইজ্যাক জ্যাকব। দেখল সুইচে আলো জ্বলছে না। চমকে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব। আবার সুইচ টিপল। না সুইচে আলো জ্বলছে না। চমকে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব। আবার সুইচ টিপল। না সুইচে আলো জ্বলছে না।
‘তাহলে কি বিদ্যুৎ চলে গেছে?’ স্বগত কণ্ঠেই যেন বলে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব।
আইজ্যাক জ্যাকবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আগে বন্দী হয়ে আসা ১২ জনের একজন অ্যারন আজিজ।
অ্যারন আজিজ লেবানন বংশোদ্ভুত একজন ইহুদী। তার বর্তমান বসবাস থাইল্যান্ডে।
অ্যারন আজিজ বলল, ‘স্যার বিদ্যুৎ যায়নি। দেখুন এই ঘরে তো বিদ্যুৎ আছে।’
‘ঠিক তো বিদ্যুৎ যায়নি! তাহলে সুইচে বিদ্যুৎ নেই কেন?’ তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল, ‘শুধু লিফটের বিদ্যুৎ তো এভাবে যায় না! কেউ কি লিফটের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিল?’ আর্তনাদের মত শোনার আইজ্যাক জ্যাকবের কথা।
সে পাগলের মত লিফটের সুইচ টিপতে লাগল। লাথি লাগাল লিফটের দরজায়।
আইজ্যাক জ্যাকবের লাথিতে লিফটের দরজায় সামান্য শব্দও হলো না।
অ্যারন আজিজ বলল, ‘স্যার লিফট এবং সিঁড়ি মুখের দরজা কয়েক ইঞ্চি পুরু ষ্টিলের। আমরা অনেক লাথি-টাথি মেরে দেখেছি। মনে হয় বোমাতেও দরজার কিছু হবে না।
আইজ্যাক জ্যাকব মোবাইল বের করল শিমন আশেরকে টেলিফোন করার জন্যে। কিন্তু দেখল মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই।
‘আমাদেরকে ওরা ট্রাপে ফেলেছে’ বলে চিৎকার করে উঠে আইজ্যাক জ্যাকব তার মেশিনগানের সব গুলী উজাড় করল লিফটের দরজার উপর।
লিফটের দরজায় লাগা সবগুলো গুলী ঝরে পড়ল মেঝেতে। দরজায় সামান্য দাগও পড়ল না। তার মানে দরজাগুলো বুলেট প্রুফ।
ক্রোধে, ক্ষোভে, উদ্বেগে পাগলের মত হয়ে ওঠে আইজ্যাক জ্যাকব। উন্মত্তের মত লাথি দিতে লাগল লিফটের দরজার উপর।
ওদিকে শিমন আশের আইজ্যাক জ্যাকবকে তাদের লোকদের উদ্ধারের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েই পুলিশ হেডকোয়ার্টার ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়। পজিশন নিয়েই নির্দেশ দেয় সংজ্ঞাহীনদের পাশে পড়ে থাকা ষ্টেনগান ও রিভলবার নিয়ে তার সামনে এক জায়গা জমা করতে।
সে নিজে পজিশন নিয়েছিল দুই গেট বক্সের মাঝখানে।
অস্ত্রগুলো এক জায়গায় স্তুপ করার পর সবাই রিলাঙ মুডে গল্প-গুজব শুরু করল।
ঠিক এই সময় তিন তলায় গুলীর একটি শব্দ হলো।
শিমন আশের চমকে উঠে দাঁড়াল।
সাথে সাথে ব্ল্যাক ঈগলের যে যেখানে ছিল অস্ত্র নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের সবার দৃষ্টি তিন তলার দিকে।
অন্যদিকে গুলীর শব্দের সংগে সংগে সংজ্ঞাহীন পুলিশের সবাই গড়িয়ে গড়িয়ে বিভিন্ন দিকে সরে গেল এবং লুকানো অস্ত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারা প্রত্যেকেই যার যার নিকটবর্তী ব্ল্যাক ঈগলের লোককে টার্গেট করল।
দুই গেট বক্সের চার সংজ্ঞাহীন পুলিশ বেরিয়ে এসেছে নিঃশব্দে। তাদের হাতেও গোপন স্থান থেকে বের করে নিয়ে আসা চার ষ্টেনগান।
গুলীর শব্দের পর থেকে তাদের বেরিয়ে আসার মধ্যে ১৫ সেকেন্ড সময়ও লাগেনি।
তারা দু’দিক থেকে যখন শিমন আশেরের পেছনে এসে দাঁড়াল, তখনও তার উদগ্রীব দৃষ্টি তিন তলার দিকে। তার হ্যান্ডমেশিনগান বেল্টে ঝুলছে এবং তার রিভলবার হাতে ঝুলছে।
চারজনের একজন গিয়ে তার ষ্টেনগানের বাঁট দিয়ে শিমন আশেরের রিভলবার ধরা হাতে আঘাত করল।
রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
চমকে উঠে চরকির মত ঘুরে দাড়াল শিমন আশের। তার একটা হাত চলে গিয়েছিল তার হ্যান্ডমেশিনগানের বাঁটে।
ষ্টেনগান দিয়ে যে পুলিশ শিমন আশেরের হাতে আঘাত করেছিল, তার ষ্টেনগান উঠে গিয়েছিল শিমন আশেরের বুক বরাবর। সে উঠে দাঁড়াবার সংগে সংগেই বলল, ‘লাভ হবে না অস্ত্রে হাত দিয়ে তোমার সামনে চারটা ষ্টেনগান। একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে তুমি।’
শিমন আশেরের হাত সরে এল হ্যান্ডমেশিনগানের বাঁট থেকে।
চার পুলিশের একজন দ্রুত গিয়ে শিমন আশেরের দুই হাত পেছনে টেনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
শিমন আশের ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা চারজন। কিন্তু আমার তিন ডজন লোক তোমাদের হেডকোয়ার্টার দখল করে আছে। এখনি এসে পড়বে তারা।’
একজন পুলিশ শিমন আশেরকে ঘুরিয়ে দিল যাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ভেতরটা দেখতে পায়।
ভেতরে চোখ পড়তেই আঁৎকে উঠল শিমন আশের। দেখল, ব্ল্যাক ঈগলের প্রত্যেকের পেছনে একজন করে পুলিশ। সবারহ হাতেই হ্যান্ডকাফ।
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা শিমন আশেরের। তাহলে পুলিশের সংজ্ঞাহীন হওয়ার ব্যাপারটা কি ভুয়া?’
এক পুলিশ বলল, ‘আশা করবেন না যে, আপনাদের যারা বন্দী ব্ল্যাক ঈগলদের উদ্ধার করতে গেছে, তারা আপনাদের উদ্ধার করতে আসছে। উদ্ধার করতে গিয়ে ওরা নিজেরাই এখন সাথীদের সাথে খাঁচা-বন্দী হয়েছে।’
বিস্ময়-উদ্বেগে মুখ চুপসে গেল শিমন আশেরের। বলল, ‘ডিএসপি মহিদলের সংজ্ঞা হারানোও কি নাটক?’
‘না তারটাই আসল। তার সাথে আপনাদের যোগসাজশের শুধু ঐটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে। তাকে সংজ্ঞালোপ করে ফেলে রাখা হয়েছিল আপনাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যে।’ বলল একজন পুলিশ।
এ সময় দোতলা থেকে এসপি উদয় থানির কণ্ঠ শোনা গেল। নির্দেশ দিল সে, ‘বন্দী সবাইকে ব্ল্যাক চেম্বারে নিয়ে এস।’
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ‘ব্ল্যাক চেম্বার’ হলো একটা ট্রানজিট কক্ষ। মাত্র এক দরজার জানালাহীন এক বিশাল ঘর এটা। বাতাস যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ক্ষুদ্রাকারের ভেন্টিলেশন রয়েছে ঘরটিতে। গ্রেফতারের পর ক্রিমিনালদের জেলে বা পুলিশ হাজতে কিংবা স্থানান্তরে পাঠানোর আগে এই ঘরে রাখা হয়।
হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় প্রত্যেককে সেই ঘরে নিয়ে তোলা হলো।
ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে আরও ২৪ জনকে হ্যান্ড কাফ পরা ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এনে ‘ব্ল্যাক চেম্বারে’ তোলা হলো। এদের মধ্যে আইজ্যাক জ্যাকবও সংজ্ঞাহীন ছিল।
ব্ল্যাক চেম্বারে ‘ব্ল্যাক ঈগল’ এর বন্দীর মোট সংখ্যা ৪৮ জন।
বাম হাতে ব্যান্ডেজ বাধা এসপি উদয় থানি শিমন আশেরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমিই সম্ভবত পালের গোদা। তোমরা ডিএসপি মহিদলকে বশ করে মনে করেছিলে বন্দীদের উদ্ধার করাসহ যা ইচ্ছা তাই করে যাবে। কিন্তু পারনি। সত্যি বলতে কি তোমাদের এতবড় বিপর্যয় এত সহজে হবে আমরাও কল্পনা করতে পারিনি। এর অর্থ তোমাদের খেলা খতম হওয়ার পথে।’
শিমন আশেরের বিধ্বস্ত চেহারায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলকে এত ছোট করে দেখ না। পস্তাতে হবে। মনে রেখ ব্ল্যাক ঈগলের ডানার নিচে গোটা দুনিয়া। আর থাইল্যান্ডেও ব্ল্যাক ঈগল দুর্বল নয়। শাহবাড়ি, যয়নব যোবায়দার বাসা এবং আজকের বিপর্যয় আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু এর মূল্য তোমাদেরকে দিতে হবে।’
‘মূল্য আমরা অনেক দিয়েছি। বহু থাই মানুষকে তোমরা মেরেছ। এবার আমাদের মূল্য আদায় করার পালা। কিন্তু বলত তোমরা এখানে মুসলমানদের ঘাড়ে চড়েছ কেন? তাদের ঘাড়ে সন্ত্রাসের বদনাম চাপিয়ে তোমাদের লাভ?’ বলল এসপি উদয় থানি।
‘ব্ল্যাক ঈগল কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।’ বলল শিমন আশের।
‘দেয় না। কিন্তু এবার দেবে।’ বলল উদয় থানি। তার কণ্ঠ কঠোর।
উদয় থানি থামতেই শিমন আশের বলে উঠল, ‘আমাদের এই চব্বিশ জন সংজ্ঞাহীন হলো কি করে?’
‘পুলিশদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য তোমরা যে ক্লোরোফরম গ্যাস মহিদলকে দিয়েছিলে, সেই গ্যাস দিয়ে বন্দীখানায় এদের আমরা সংজ্ঞাহীন করেছি। যাতে নিরুপদ্রবে সবাইকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এই ব্ল্যাক-চেম্বারে আনতে পারি।’
বলেই এসপি উদয় থানি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সংগে সংগে ষ্টিলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কপালের ঘাম মুছে এসপি উদয় থানি কম্যুনিকেশন রুমে ঢুকল ব্যাংককের সাথে কথা বলার জন্য। ডিএসপি মহিদলের ঘটনার ব্যাপারে পূর্বেও একবার সে কথা বলেছে ব্যাংককের সাথে।

ভোর ৫টা। সূর্য ওঠার অনেক বাকি।
কয়েক কপি ব্যাংকক টাইমস হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
ফজরের নামায পড়ার পর পত্রিকার জন্যে বাইরে গিয়েছিল।
দু’কপি নিজেদের জন্যে রেখে অবশিষ্ট ২ কপি কাগজ পরিচারিকার হাতে দু’তলায় পাঠিয়ে দিল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
নামায পড়ে শুয়ে ছিল আহমদ মুসা।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন ১ কপি কাগজ আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল।
আহমদ মুসা পত্রিকা হাতে না নিয়ে বলল, ‘তুমি পড় আমি শুনি ফরহাদ।’
বেডের পাশে সোফায় বসল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। বলল, ‘পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ঘটনাকে পত্রিকা লীড আইটেম করেছে স্যার। একদম আট কলাম ব্যানার।’
‘পড়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার হেডিংটা হলো: ‘অনেক সন্ত্রাসী কর্মকা–র সাথে জড়িত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের ৩৬ জনকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হামলার প্রাক্কালে পাকড়াও করা হয়েছে।’ হেডিং এর নিচে একটা শোল্ডার। তা হলো, ‘সন্ত্রাসীদের সাথে যোগসাজশকারী ডিএসপি মহিদলকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে।’
‘আমার অনুমান ঠিক হয়েছে। এখন পড় নিউজটা।’
পড়তে শুরু করল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, ‘গত রাতে পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হামলার চেষ্টা কালে ‘ব্ল্যাক ঈগল’ নামের এক সন্ত্রাসী গ্রুপের ৩৬ জন সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। এর আগে এই রাতেই সন্ত্রাসীদের সাথে যোগসাজশকারী ডিএসপি মহিদল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এক সন্ত্রাসী অপতৎপরতা চালানোর সময় আহত হয়ে গ্রেফতার হন।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত রাতে একজন শুভাকাঙক্ষী টেলিফোনে পাত্তানী এসপি উদয় থানিকে জানান যে, তার আশংকা আজ রাতে পাত্তানী পুলিশ হেডকোর্টার সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তিনি আরও জানান, পাত্তানী ডিএসপি মহিদলের সাথে সন্ত্রাসীদের যোগসাজশ রয়েছে। শুভাকাঙক্ষী ব্যক্তিটি তার সন্দেহের সমর্থনে বিভিন্ন তথ্য দেন। ডিএসপি আড়ি পেতে এই টেলিফোন শুনছিলেন অথবা চলার সময় তার কানে কথা আসে। ডিএসপি যখন বুঝতে পারে সন্ত্রাসীদের সাথে তার যোগসাজশের কথা এসপি উদয় থানি জেনে ফেলেছে, তখন সে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে হত্যার জন্যে গুলী করে এসপি উদয় থানিকে। শেষ মুহূর্তে টের পাওয়ায় উদয় থানি নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। তবে তার হাতে গুলী লাগে। এসপিকে ডিএসপি’র গুলী করাটা একজন পুলিশ অফিসারের কাছে ধরা পড়ে যায়। ডিএসপি দ্বিতীয় গুলী করার আগেই তিনি ডিএসপির হাতে গুলী করেন। মরিয়া ডিএসপি বাম হাতে রিভলবার তুলে নিয়ে পুলিশ অফিসারকেও গুলী করতে যাচ্ছিল, এই সময় পেছন দিক থেকে ছুটে আসা দু’জন পুলিশ ডিএসপির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নেয়। এভাবে ধরা পড়ে যায় ডিএসপি মহিদল।
ডিএসপি মহিদল গ্রেফতার হওয়ায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আক্রমণের গোটা প্ল্যান ধরা পড়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সবকিছু স্বীকার করেন। সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা ছিল, ডিএসপি মহিদল বিশেষ ক্লোরোফরম গ্যাস দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সবাইকে নির্দিষ্ট সময়ে আধা ঘণ্টার জন্য সংজ্ঞাহীন করে ফেলবে। ডিএসপি মহিদল নিজেও সংজ্ঞাহীন হবে সন্দেহের বাইরে থাকার জন্যে। এই আধা ঘণ্টা সময়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করে তাদের ১২ জন বন্দী সহযোগীকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে।
এসপি উদয় থানির কঠোর নির্দেশে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ঘটনা এবং ডিএসপি মহিদল ধরা পড়ার ঘটনা গোপন রাখা হয় এবং নাটকের দৃশ্য এমনভাবে সাজানো হয় যাতে সন্ত্রাসীরা মনে করে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হয়েছে। এই বিশ্বাস নিয়ে সন্ত্রাসীরা যখন হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করবে এবং আটক সাথীদের উদ্ধার করতে যাবে, তখন তাদের জালে আটকানো হবে।
এসপি উদয় থানির পরিকল্পনা শতভাগ কার্যকরী হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রবেশকারী ৩৬ জন সন্ত্রাসীর সকলকেই আটক করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ব্ল্যাক ঈগল এর দু’জন বিদেশী বড় নেতাসহ কয়েকজন বিদেশী রয়েছেন।
সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত একটা প্রশ্নের জবাবে পুলিশের একটি সূত্র বলে, ‘পাত্তানী অঞ্চলে সাম্প্রতিক সবগুলো ঘটনায় ব্ল্যাক ঈগল জড়িত। তারা সুপরিকল্পিতভাবে তাদের সন্ত্রাসের দায় চাপাত পাত্তানী মুসলমানদের ঘাড়ে। তাদের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জাবের জহীর উদ্দীনসহ বেশ কিছু পাত্তানী মুসলিম গ্রেফতার হয় বলে মনে করা হচ্ছে।’
অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে এসপি উদয় থানি পুলিশকে তথ্য প্রদানকারী শুভাকাঙক্ষী ব্যক্তির পরিচয় প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে বলেন, তিনি থাই জনগণের বন্ধু। তার একক সাহায্যেই সন্ত্রাসীদের ষড়যন্ত্রকে দিনের আলোতে আনা সম্ভব হয়েছে।
বিনা রক্তপাতে বিপুল সংখ্যক ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের ধরার পরিকল্পনা এবং তার সফল বাস্তবায়নে এসপি উদয় থানি সরকারসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছেন।
জানা গেছে গত রাতেই ৪৮ জন সন্ত্রাসীকে একটা বিশেষ বিমানে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এত বিপুল সন্ত্রাসী এভাবে হাতে-নাতে ধরা পড়ার ঘটনা থাইল্যান্ডের ইতিহাসে অনন্য। আজ থেকেই সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবার কথা।’
আহমদ মুসা শুয়ে থেকে খবর পড়া শুনছিল।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন খবর পড়া শেষ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আশার চেয়ে ফল আল্লাহ বেশি দিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ ভাই, আহমদ মুসাকে আল্লাহ অসীম ভালোবাসেন। আহমদ মুসা নিকষ অন্ধকারে রাখলেও তা সোনালী সোবহে সাদেক রূপ নেয়। তোমাকে ধন্যবাদ ভাই।’
আহমদ মুসা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন দু’জনেই চোখ ফেরাল। দেখল দাদী ও যয়নব যোবায়দা দাঁড়িয়ে। তাদের হাতেও কাগজ।
আহমদ মুসারা তাদের দিকে তাকাতেই দাদী বলল, ‘আমরা এ খবরটা আগেই শুনেছি থাই টিভি’র ওয়ার্ল্ড চ্যানেলে। নিউজের প্রায় সব কথাই দেখছি টিভিতে বলেছে। আমরা কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। খবরের কাগজ দেখে তবেই প্রাণ পেয়েছি। তাই কাগজ নিয়েই ছুটে এসেছি ভাই।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল দাদী।
‘আল্লাহর হাজার শোকর দাদীমা। সরকারের দিক থেকে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। পাত্তানী মুসলমানদের এখন সরকারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে না। জাবের জহীর উদ্দিনকে তো সরকারিভাবেই নির্দোষ করা হলো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়াকে উদ্ধারের জন্যে তো সরকারও উদ্যোগ নেবেন।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘অবশ্যই নেবে বোন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার আপনিও সরকারের উপর ভরসা করছেন? আপনি আসার আগ পর্যন্ত সরকার সত্য উদ্ধার করতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি। ব্ল্যাক ঈগলের কাঁউকে ধরার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সরকারের কোন কৃতিত্ব নেই। গত রাতে ৩৬ জন সন্ত্রাসী ধরার কৃতিত্বও আপনার। ওরা এটা স্বীকারও করেছে।’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল।
‘ভাইয়া আমি সরকারের উপর নির্ভর করিনি। সরকার উদ্যোগ নিতে পারে কিনা আমি সেই কথা বলেছি।’ বলল যয়নব যোবায়দা। তার কণ্ঠে অভিমানের সুর।
আহমদ মুসার ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠল। বলল যয়নব যোবায়দার কথার উত্তরে, ‘ফরহাদ আমার সরকার নির্ভরতার কথা বলেছে।’
‘ও ভালো বুদ্ধিজীবী ভাইয়া। সে ‘আপনি’ বলেনি বলেছে, ‘আপনিও’। এটা বলে সে বুঝাতে চেয়েছে আমি যয়নব তো সরকারের উপর নির্ভর করেছিই, আপনিও নির্ভর করলেন?’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘যয়নব যোবায়দা ঠিকই বলেছে ফরহাদ। তুমিও ‘তুমি ভালো বুদ্ধিজীবী’ প্রশংসা পেয়েছ। তুমি আর কথা বাড়িয়ো না।’
‘তুমি ঠান্ডা বিরোধটা মিটিয়ে দিয়ে ভালো করেছ। এই প্রথম ফরহাদকে যয়নবের বিপরীত একটা কথা বলতে দেখলাম।’ দাদী বলল।
‘এটা ভালো দাদী। ওরা একে অপরকে সমান ভাবে, এটা স্বাভাবিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহ বিপদ দূর করুন। আমার ভাই জহীর ফিরে আসুক। তারপর তোমার উপস্থিতিতে এদের দু’জনকে এক….।’
দাদীর কথার মাঝখানেই বেজে উঠল আহমদ মুসার মোবাইল।
থেমে গেল দাদী।
আহমদ মুসা মোবাইল অন করতেই দেখল স্ক্রীনে পুরসাত প্রজাদিপকের মোবাইল নাম্বার। আহমদ মুসা বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার।’
‘গুড মর্নিং বিভেন বার্গম্যান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তোমাকে এই টেলিফোন করছি। তিনি তোমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তুমি শুধু পাত্তানীর মুসলমানদের বাঁচাওনি, তুমি বাঁচিয়েছ থাই জনগণকে বিভেদের হাত থেকে।’ বলল থাই সরকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক।
‘তাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন স্যার। সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতা না পেলে আমার স্বাধীনভাবে এগুনো সম্ভব হতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যে ৪৮ জন সন্ত্রাসীকে পাত্তানী থেকে ব্যাংকক আনা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশী আছে। আমরা আশা করছি, ষড়যন্ত্রের শেকড়সহ গোটা ছক আমরা পেয়ে যাব। তুমি অসাধ্য সাধন করেছ বিভেন বার্গম্যান। আমরা বিরাট ঋণী হয়ে পড়লাম।’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘এসব থাক স্যার। আমরা এখনও লক্ষে পৌছিনি। আমার থাইল্যান্ডে আসার প্রধান লক্ষের অন্যতম হলো, জাবের জহীর উদ্দিনকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি।’
আহমদ মুসার মোবাইলের রীলে স্পীকার অন ছিল। মোবাইলের এ কথোপকথন দাদী, যয়নব যোবায়দা এবং ফরহাদসহ সবাই শুনছিল। আহমদ মুসা এটা তাদের শোনায় এ কারণে যে, সব বিষয়ের সাথে তারা জড়িত। সব কথা তাদের জানা দরকার।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও সংগে সংগে উত্তর এল না পুরসাত প্রজাদিপকের কাছ থেকে।
কয়েক মুহূর্ত পর ওপার থেকে শান্ত, ভারী কণ্ঠ ভেসে এল। বলল, ‘বিভেন বার্গম্যান, এদিকে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হলো।’
‘কি সমস্যা?’ এই মাত্র পাত্তানী ও ব্যাংকক পুলিশ হেডকোয়ার্টারকে একজন মোবাইল টেলিফোনে জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪৮ জন সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দেয়া না হলে তারা জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে এবং আরও কিছু করবে যা থাই সরকার কল্পনাও করতে পারে না।’
আহমদ মুসা টেলিফোন শুনতে শুনতেই তাকাল দাদীদের দিকে। দেখল তাদের চোখে-মুখে নেমে এসেছে আতংক।
সংগে সংগেই উত্তর দিল আহমদ মুসা। বলল, ‘হুমকিটা নিসন্দেহে বড় স্যার। কিন্তু এর দ্বারা তারা তাদের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার প্রমাণ দিয়েছে।’
‘কেমন করে?’
‘ওরা জাবের জহীর উদ্দিনকে ছিনতাই করে নিয়ে গিয়েছিল তাকে তাদের পক্ষের প্রমাণ করে মুসলমানদের সন্ত্রাসী বানানোর ষড়যন্ত্র সফল করার জন্যে। কিন্তু সেই জাবের জহীর উদ্দিনকেই তারা প্রধান বিপক্ষ দাঁড় করাচ্ছে। এর অর্থ থাইল্যান্ডে তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছ বিভেন বার্গম্যান। কিন্তু ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছু একটা করে ফেলতে পারে, এ আশংকা আছে। এখন তোমার চিন্তা বল। এখানে সবাই এটা জানতে চায়।’
‘প্রতিশোধমূলক সন্ত্রাসী কিছু ঘটনা তারা ঘটাতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে মনে করি, জাবের জহীর উদ্দিন ওদের দরকষাকষির শেষ অস্ত্র। এই অস্ত্রকে তারা শুরুতেই ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না।’
‘আমাদের চিন্তাও এই রকম। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। সরকার খুবই উদ্বিগ্ন। পত্র-পত্রিকার সব সমালোচনা সরকারকেই বিদ্ধ করবে। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে।’
‘স্যার পাত্তানীর ‘কাতান টেপাংগো’ স্থানটা কোথায়?’
‘ওটা পাত্তানী ও মালয়েশিয়া সীমান্ত এলাকার একটা পাহাড়। এ জায়গার কথা বলছ কেন? জাবের জহীর উদ্দিনকে তারা ওদিকে নিয়ে যেতে পারে?’
‘আমার সন্দেহের একটা স্থান ওটা।’
‘হ্যাঁ বিভেন বার্গম্যান। তোমার সন্দেহের পেছনে যুক্তি আছে। কাতান টেপাংগো’র একটা ইতিহাস আছে। এক সময় পাত্তানীদের ওটা একটি আশ্রয় ছিল। ওখানে কিছু অবকাঠামোও ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পে তা নষ্ট হয়ে গেছে বলে শুনেছি। ও এলাকায় কখনও আমি যাইনি।’
‘স্যার পাহাড়ের একটা ম্যাপ এবং ওখানে যাবার পথের বিবরণ দিয়ে আপনি সাহায্য করতে পারেন?’
‘অবশ্যই পারব। আজই তা পেয়ে যাবে। কিন্তু তুমি যেতে চাচ্ছ না কি? শুনলাম তুমি আহত। তুমি এ কাজ কর না। তুমি পরামর্শ দাও। আমরা সেখানে বাহিনী পাঠাব। দরকার হলে তুমি তাদের সাথে যাও।’
‘না স্যার। আপনাদের বাহিনী যাক। কিন্তু আমার পথ হবে ভিন্ন।’ ‘কাতান টেপাংগো’র ম্যাপ ও বিকল্প সব রাস্তার বিবরণ পাওয়ার পর আমি এ নিয়ে আলোচনা করব।’
‘বুঝেছি। ঠিক আছে আলোচনা হবে। বিভেন বার্গম্যান, তুমি একটু কথা বল সিরিত থানারতার সাথে। সে কান্নাকাটি করছে।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
ওপার থেকে সিরিত থানারতার কণ্ঠ শোনা গেল। বলছিল, ‘হ্যাঁলো, কেমন আছেন ভাইয়া আপনি?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠ সিরিত থানারতার।
‘আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমার চোখে পানি কেন?’
‘ভাইয়া আপনি ভালো করে জানেন, ওরা মানুষ নামের পশু। ওরা সব করতে পারে ভাইয়া।’
‘কিন্তু সিরিত থানারতা, সব সময় ‘যা ইচ্ছা তা করা’র ইচ্ছা পূরণ হয় না।’
‘আপনি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা। তিনি আপনার কথা সত্যে পরিণত করুন।’
‘জাবের জহীর উদ্দিনের বোন ও দাদী আমার পাশে রয়েছেন। তুমি তাদের সাথে কথা বল।’
‘ওরা কথা বলবেন? মন্দ বলবেন না আমাকে?’
‘ওরা সব জানেন। তোমাকে খুব ভালো জানেন ওরা।’
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’
আহমদ মুসা টেলিফোনটা দিল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে যয়নব যোবায়দাকে দেবার জন্যে এবং বলল, ‘যয়নব যোবায়দা আগে কথা বল, তারপর দাদীও কিছু বলবেন।’
যয়নব যোবায়দা মোবাইল হাতে নিল। যয়নব যোবায়দা কথা শুরু করার আগেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাইরেটা একটু দেখে আশ-পাশের দোকান ও পুলিশদের সাথে কথা বলে আহমদ মুসা ফিরে এল কয়েক মিনিট পর। দোকান থেকে টুকিটাকি কিছু জিনিসও কিনেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকতেই দাদী বলে উঠল, ‘এইমাত্র কথা শেষ করলাম সিরিত থানারতার সাথে। তুমি তাকে দেখছি মুসলমান বানিয়ে ফেলছ ভাই। সালাম, কালাম, আল্লাহ হাফেজ সবই যে একদম মুসলমানের মত। খুব ভালো মেয়ে তো থানারতা। কিন্তু জহীর সব কথাই গোপন রেখেছে আমাদের কাছ থেকে।’
‘মনে হয় দাদীমা, জহীর অতটা এগোয়নি যতটা এগুলে আপনাদের বলা দরকার। আমার মনে হয়েছে জহীরের চেয়ে মেয়েটাই বেশি এগিয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমারও তাই মনে হয় দাদীমা।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘দাদীমা, ডাক্তার খালাম্মার বাসাটা কোন জায়গায়?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল দাদীকে উদ্দেশ্য করে।
‘বাসাটা পাশেই। কিন্তু সোজা যাবার পথ নেই। উল্টো দিক থেকে পথ ঘুরে যেতে হয়। কেন জিজ্ঞেস করছ এ কথা?’ দাদী বলল।
‘আপনি, যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ এখনি ওখানে চলে যান।’ বলল আহমদ মুসা।
যয়নব যোবায়দা, দাদী, ফরহাদ সকলের চোখে-মুখে নতুন উদ্বেগ এসে ছায়া ফেলল। যয়নব যোবায়দা বলল, ‘আপনি কি কিছু আশংকা করছেন?’
আহমদ মুসা উত্তর দেবার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা যয়নব যোবায়দার উদ্দেশ্যে ‘স্যরি’ বলে টেলিফোন ধরল। মোবাইল কানে তুলেই গলা পেল পাত্তানী সিটি এসপি উদয় থানির।
আহমদ মুসা ‘গুড মর্নিং’ বলতেই উদয় থানি বলল, ‘গুড মর্নিং বলবেন না স্যার, ব্যাড মর্নিং বলুন। গত রাতে আপনার কথায় সেই যে ছেদ পড়ল, তারপর গোটা রাতই বলা যায় দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আপনার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। বিশেষ করে ঐ মোবাইল সেটটা হারিয়ে যাওয়ায় আপনার নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলি। এখন ব্যাংকক থেকে আপনার নাম্বার নিয়ে টেলিফোন করছি। আপনি আমাকে মাফ করবেন স্যার। আমরা আজ যে বিশাল বিজয় লাভ করেছি এবং একজন বিশ্বাসঘাতকও ধরা পড়েছে, সেটা এককভাবে আপনার সাহায্যেই। আপনাকে হাজারো অভিনন্দন স্যার।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে গড় গড় করে কথাগুলো বলে গেল উদয় থানি।
‘অতীত এখন অতীত। আসুন বর্তমানের কথা বলি। এখন কি ভাবছেন আপনি? ওরা বিরাট হুমকি দিয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, এজন্যই তো আমি আপনার কাছে টেলিফোন করেছি। তারা দুটো হুমকি দিয়েছে। একটা স্পষ্ট যে, তাদের লোকদের ছেড়ে না দিলে ২৪ ঘণ্টা পর তারা জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে। আর দ্বিতীয় হুমকি হলো যা আমরা কল্পনা করতে পারি না, এমন ধ্বংসাত্মক কাজও তারা করবে। আমার কাছে তাদের দ্বিতীয় হুমকিটাই উদ্বেগজনক মনে হচ্ছে।’ উদয় থানি বলল।
‘ঠিক বলেছেন অফিসার। চাপ সৃষ্টির জন্যে কিছু ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকারক কাজ আগে করবে এবং সর্বশেষে করবে আল্টিমেটাম দেয়া হত্যার কাজ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাদের মটিভ সম্পর্কে আপনি কিছু ভাবছেন স্যার?’ উদয় থানি বলল।
‘অপরাধী, সন্ত্রাসীদের মতি-গতি সম্পর্কে আপনারাই ভালো জানবেন। তবে এটা স্বাভাবিক যে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রাধিকারের স্থানগুলোয় আপনাদের চোখ রাখতে হবে।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। এটাই প্রথম কাজ।’ বলল উদয় থানি।
‘তবে এই প্রথম কাজের আগে আরেকটি কাজ আছে অফিসার, সেটা হলো, পুলিশকে যাতে তারা পণবন্দী করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাংঘাতিক কথা বলেছেন স্যার। এ দিকটা তো আমরা ভাবিইনি। ধন্যবাদ স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ। সরকার ও জাতির একটা দুর্বল স্থান এটা। এখানে ঘা পড়লে গোটা জাতিই লাফিয়ে পড়বে। অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। এ বিষয়টা আমি ব্যাংককে এখনি জানাচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার, বাই।’
আহমদ মুসা, মোবাইল অফ করতেই যয়নব যোবায়দা বলে উঠল, ‘বুঝেছি ভাইয়া, ওরা এখানে হামলা ও আমাদের কাউকে পণবন্দী করার ভয় করছেন?’
‘হ্যাঁ বোন। ওরা কি করতে পারবে আমি জানি না। কিন্তু আহত বাঘের মত ওদের দশা। ওদের সাধ্যে কুলোয়, এ রকম সব কিছুই ওরা করবে। এর মধ্যে তোমরা তাদের বড় টার্গেট। এর আগেও তোমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছে। আমি মনে করি, তোমরা গুছিয়ে নিয়ে এখনই এ বাড়ি ত্যাগ কর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমিও কি ওখানে যাবে ভাই? তুমি না থাকলে আমরা নিরাপদ বোধ করব না।’ দাদী বলল।
‘চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের সাথে আছি দাদী।’ বলল আহমদ মুসা।
যয়নব যোবায়দা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে গেল প্রস্তুত হবার জন্য।
আহমদ মুসা আবার বাইরে এল। একজন পুলিশকে বলল তিনটা অটো রিকশা ডাকার জন্যে। বলল, ‘বাড়ির মেম সাহেবরা একটু মার্কেটে যাবেন।’
একজন পুলিশ চলে গেল। চারদিকটা দেখে দোকানদারের সাথে কথা বলে ফিরে এল আহমদ মুসা। এখানে মোট পাঁচ জন লোককে নতুন পেল আহমদ মুসা। একজন পাশের বাড়ির এক লোকের সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। আর তিন জন এসেছে ভাড়া বাসার খোঁজে। দু’একটা বাড়ির খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু বাসাওয়ালাকে একটু পরে পাওয়া যাবে। তারা অপেক্ষা করছে। আর একজন লোক এই মাত্র এসে চা খেতে বসেছে রোড-সাইড টি-ষ্টলে। তাদের সকলের বয়স কাছাকাছি পর্যায়ের নয়, এটাই আহমদ মুসার অসংগত মনে হয়েছে। আহমদ মুসার সন্দেহ সত্য হলে তাদের সকলকে এক বয়সের হতে হবে। তাহলে ওরা কি ছদ্মবেশ নিয়েছে! এই চিন্তা মাথায় উদয় হতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। মন বলল, এটা হতে পারে। তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে এসে জমা হতে শুরু করেছে এখানে।

আহমদ মুসা ড্রইংরুমে বসেছিল। ফরহাদ এসে বলল, ‘আমরা প্রস্তুত ভাইয়া।’
ফরহাদের পেছনে যয়নব যোবায়দা ও দাদীও এসে দাঁড়িয়েছে।
ওদিকে দুটো অটো রিকশাও এসে গেছে।
আহমদ মুসা ভাবনায় ডুবেছিল।
ফরহাদের কথায় চমকে উঠে মুখ তুলল আহমদ মুসা।
ফরহাদও চমকে উঠল। আহমদ মুসাকে এমন অপ্রস্তুত সে কখনও দেখেনি। বলল, ‘স্যার, খারাপ কিছু ভাবছেন?’
হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ভাবছিলাম। তবে খুব খারাপ কিছু নয়।’
সবার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা রেডি? ঠিক আছে তোমরা একটু পরে বের হবে। আমি বেরিয়ে গিয়ে টি-স্টলে চা-খেতে বসতে পারি, এতটা সময় পরে বের হবে। তিনটা পায়নি, দুটো অটো রিকশা পেয়েছে। ফরহাদ তুমি একটিতে ড্রাইভারের পাশে বসবে।’
সবার মুখে-চোখে উদ্বেগ। যয়নব যোবায়দা বলল, ‘বাইরে কিছু কি ঘটার আশংকা করছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সব সময় সবকিছুর জন্যে প্রস্তুত থাকা ভালো।’
বলে আহম মুসা বাইরে বেরিয়ে এল। বেরুবার সময় পকেটের রিভলবার এবং শোল্ডার হোলষ্টারে হ্যান্ডমেশিনগানের অস্তিত্ব অনুভব করল।
আহম মুসা বেরিয়ে সোজা চলল টি-ষ্টলের দিকে। যাবার সময় দেখল আগন্তুকের সংখ্যা আরও একজন বেড়েছে।
ছয় জনের দু’জন বসে পুলিশের সাথে আলাপ করছে। অবশিষ্ট চারজন যে যেখানে ছিল সেখানেই বসে আছে।
আহমদ মুসা পুলিশদের কাছে চা পাঠাতে বলে এবং নিজের জন্য এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসল যয়নব যোবায়দাদের বাড়িকে সামনে রেখে। এখানে বসে ছয়জন আগন্তুকসহ পুলিশ বক্স, দুই অটোরিকশা সবই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
দৃষ্টি সামনে রেখে চায়ে চুমুক দিচ্ছে আহমদ মুসা।
ফরহাদরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। বারান্দা থেকে লনে নেমেই দ্রুত গাড়িতে উঠল।
তাদের বাড়ি থেকে বেরুতে দেখে ছয়জনই উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবস্থা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত। যেন শিকার এভাবে পালাবে তারা আশা করেনি।
অটো রিকশা তখন চলতে শুরু করেছে।
পুলিশের কাছে যে দু’জন ছিল, তাদের একজন হাত দিয়ে একটা সংকেত দিল। সংগে সংগেই ছয় জনের পোশাকের ভেতর থেকে ছয়টি হ্যান্ডমেশিনগান বেরিয়ে এল। দু’জন গুলী করল অটো রিকশার চাকা লক্ষে। পুলিশের কাছের দু’জন চোখের পলকে চা খাওয়ারত পুলিশদের নিরস্ত্র করে পুলিশ বক্সের ভেতর ঠেলে দিল। অন্যজন ফাঁকা আওয়াজ করে ত্রাসের সৃষ্টি করল।
এরা ছয় জনেই এই কান্ড করে বসবে, আহমদ মুসা এটা ভাবেনি। এই অবস্থায় এত বড় কিডন্যাপের ঘটনার জন্যে আরও লোক তাদের চাই এবং তাদেরই অপেক্ষা তারা করছে; খুব বেশি হলে তারা সাথীদের খবর দেয়া এবং যয়নব যোবায়দাদের ফলো করার মত কাজ করতে পারে—এটাই ভেবেছিল আহমদ মুসা। সে ক্ষেত্রে আহমদ মুসা পুলিশ দিয়ে তাদের আটকাবে মনে করেছিল। কিন্তু তারা এল একদম ডাইরেক্ট একশনে।
আহমদ মুসা চায়ের কাপ পিরিচ রেখে এক লাফে রাস্তায় নেমে এল। পকেট থেকে রিভলবার বের করে বাঁ হাতে নিল এবং হ্যান্ড মেশিনগান রাখল ডান হাতে।
আহমদ মুসা প্রথমে টার্গেট করল পুলিশের কাছের দু’জনকে, পরে যে দু’জন অটো রিকশার কাছে চলে গিয়েছিল সে দু’জনকে।
চারটি গুলী করতেই বাকি দু’জন ফিরে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে এবং গুলী করতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছে একটা বিদ্যুতের পিলারকে আড়াল করে।
ওরা গুলী করতে করতে আহমদ মুসার দিকে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা ডান হাতের হ্যান্ডমেশিনগানের নল বিদ্যুৎ পিলারের বাইরে একটু বাড়িয়ে পিলার বরাবর সামনে অন্ধভাবে গুলী বর্ষণ শুরু করল। লক্ষ্য প্রতিপক্ষের গুলীর টার্গেট সরিয়ে দেয়া।
ওরা ছুটে আসছিল। ওদের কোন আড়াল ছিল না।
আহমদ মুসা গুলী বর্ষণ করলে পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে ওরা রাস্তার এক পাশে সরে যেতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওদের গুলীর লক্ষ্য সরে গিয়েছিল।
এই সুযোগই চাচ্ছিল আহমদ মুসা এবং এই সুযোগের সে পুরো সদ্ব্যবহার করল।
বেরিয়ে এল পিলারের আড়াল থেকে। লক্ষ্য স্থির করে এবার গুলী করল। গুলীর বৃষ্টি গিয়ে ছেঁকে ধরল রাস্তার পাশে সরে যাওয়া দু’জনকে।
দু’জনেই মুখ থুবড়ে পড়ল। ওদের গুলী বন্ধ হয়ে গেল।
উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ছুটল যয়নব যোবায়দাদের দিকে। যাবার পথে পুলিশবক্সের ছিটকিনি খুলে বের করল পুলিশদের।
পুলিশরা আহমদ মুসাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘স্যার আমরা চা খাচ্ছিলাম। আকস্মিকভাবে ওরা আমাদের আক্রমণ করে। উপযুক্ত ফল পেয়েছে সন্ত্রাসীরা। দেখছি সবাই মারা গেছে স্যার। ধন্যবাদ স্যার। ওঁদের অবস্থা কি?’
‘ওঁরা ভালো আছেন। ওদিকে যাচ্ছি।’ বলে আহমদ মুসা চলল অটো রিকশার দিকে।
অটোরিকশার ড্রাইভার দু’জন গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসাকে দেখে আতংকে চুপসে গেছে। আহমদ মুসা ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘দেখছি একটা করে টায়ার নষ্ট হয়েছে, বাড়তি চাকা নেই?’
‘আছে স্যার।’ বলল ড্রাইভারদের একজন।
‘তাড়াতাড়ি চাকা লাগাও।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
আর ফরিদদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা ড্রইং রুমে গিয়ে একটু বস। আমি এদিকে পুলিশদের দেখি ওরা হেডকোয়ার্টারকে জানাল কিনা।’
যয়নব যোবায়দা, দাদী ও দুই পরিচারিকা নামল।
‘দাদী আপনারা একটু বসুন। চাকা ঠিক হলে আমি ডাকব।’ বলল আহমদ মুসা দাদীকে।
‘আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন ভাই’ বলে দাদী হাঁটতে লাগল। তার কণ্ঠ কান্না জড়ানো।
আহমদ মুসা পুলিশদের সাথে কথা বলল। তারা হেডকোয়ার্টারকে জানিয়েছে। এসপি উদয় থানি নিজে আসছে। আহমদ মুসাও উদয় থানি এবং ব্যাংককে থাই সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপকের সাথে কথা বলল। দু’জনেই বলল আমরা আশংকা করেছিলাম সরকারি স্থাপনা বা সেনা অথবা পুলিশের উপর হামলা হবে। কিন্তু হামলা হলো শাহ পরিবারের উপর। তারা শাহ পরিবারের আরও কাউকে পণবন্দী করতে চায়। তারা মনে করে সরকারের উপর এতে চাপ বেশি পড়বে এবং সন্ত্রাসীদের ছাড়তে বাধ্য হবে। এই অবস্থায় শাহ পরিবার সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব পরামর্শ দিয়ে তারা তাদের কথা শেষ করেছে। তারা দু’জনেই আহমদ মুসার আকাশস্পর্শী প্রশংসা শুরু করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে দেয়ার হুমকি দেয়ায় সে পথে তারা বেশি এগোতে পারেনি।
ততক্ষণে অটো রিকশার চাকা লাগানো হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা উঠে গেল ড্রইংরুমে।
যয়নব যোবায়দারা কথা বলেছিল।
সবারই চোখে অশ্রু।
আহমদ মুসা কথা শুরুর আগেই দাদী কেঁদে উঠল। বলল, ‘আমরা কোথায় যাব ভাই? শাহবাড়িতে আক্রমণ হলো, এলাম এখানে। এ গোপন বাড়িটির সন্ধানও তারা পেয়ে গেল। ডাক্তার ফাতেমার ওখানে যাব। ওটাও নিশ্চয় গোপন থাকবে না। মাঝখানে তাকেও বিপদে ফেলা হবে। আমাদের জন্যে তো কোন নিরাপদ স্থান দেখছি না ভাই’ কান্নারুদ্ধ কণ্ঠেই কথাগুলো বলল দাদী।
আহমদ মুসা সোফায় বসল। নরম কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমরা জঘন্য এক বেপরোয়া শত্রুর কবলে পড়েছি দাদী। তবে এই আক্রমণ ওদের শক্তির পরিচয় নয। এগুলো ওদের দুর্বলতা ও হতাশা থেকে বাঁচার সর্বশেষ অপচেষ্টা। আমরা জয়ী হবো দাদীমা, ইনশাআল্লাহ।’
একটু থামল আহমদ মুসা।
সোফায় একটু ঠেস দিল। বলতে শুরু করল আবার, ‘নিরাপদ জায়গা আছে দাদীমা। এইমাত্র থাই সহকারী গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কথা হলো। এসব ঘটনায় সরকার খুবই উদ্বিগ্ন জানালেন তিনি। সরকারি তরফ থেকে তাকে বলা হয়েছে আপনার পরিবারকে নিরাপদ সরকারি তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য। এসপি উদয় থানিও বলেছেন এ কথা। তিনি এখানে আসছেন। দাদীমা আপনারা চাইলে সরকার এই মুহূর্তেই এ ব্যবস্থা করবেন। আপনারা কি করবেন বলুন দাদীমা।’
‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না ভাই। যা করার তুমিই করবে।’ বলল দাদী ভাঙা গলায়।
দাদীর কথা শেষ হতেই যয়নব যোবায়দা বলল, ‘পাত্তানী অঞ্চলের শাসক এবং পরবর্তীকালে প্রধান পাত্তানী পরিবার হিসাবে এই পরিবার নান উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে, কিন্তু কখনই সরকারি নিরাপত্তা হেফাজত নেয়নি। সব সময় এই পরিবার জনপ্রিয়তাকে তাদের নিরাপত্তা মনে করেছে। এখনকার আমাদের অবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে খারাপ। এ জন্যই নিশ্চয় আমাদের সাহায্যে আল্লাহ আপনাকে নিয়ে এসেছেন। এ পর্যন্ত আল্লাহর এ ব্যবস্থা আমাদের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে। ভবিষ্যতেও যথেষ্ট হবে বলে আমি মনে করি।’
থামল যয়নব যোবায়দা। প্রথম দিকে তার কণ্ঠ ছিল কান্নারুদ্ধ। কিন্তু শেষ দিকে কান্না মুছে গিয়ে তার কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল দৃঢ় প্রত্যয়ী।
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘যয়নব যোবায়দা, তুমি ‘সাকোথাই’ রাজবংশের যুবকদের এবং পাত্তানী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘চাউসির বাংগসা’ ওরফে সুলতান আহমদ শাহের যোগ্য উত্তরসূরীর মত কথা বলেছ। তোমাকে ধন্যবাদ। তবে বোন যয়নব যোবায়দা আল্লাহ তাঁর ব্যবস্থা শুধু আহমদ মুসাকে দিয়ে নয়, সরকারকে দিয়েও চালাচ্ছেন। সেই হিসাবে সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আল্লাহর ব্যবস্থারই অংশ হতে পারে।’
‘ঠিক বলেছেন। আমাকে শুধরে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি বিষয়টা আপনার উপরই ছেড়ে দিচ্ছি ভাই সাহেব।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘ধন্যবাদ বোন যয়নব যোবায়দা। ওরা প্রস্তাব করেছে, ব্যাংককে সরকারি নিরাপত্তায় থাকতে। আমি……….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই যয়নব যোবায়দা বলে উঠল, ‘নিজ মানুষদের ফেলে আমরা অন্য কোথাও যেতে পারব না।’
‘আমি সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। এই যাওয়াকে মানুষ অন্য দৃষ্টিতে নিতে পারে। এজন্যে আমার প্রস্তাব হলো, তোমরা শাহ বাড়িতেই থাকবে। এই বাড়িকে সরকার ফুল সিকিউরিটির মধ্যে নিয়ে আসবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ভাই, এটাই ভালো হবে।’ দাদী বলল।
‘আমারও এটাই মত।’ যয়নব যোবায়দা বলল।
‘আমারও সুবিধা হলো দাদীমা। এই ব্যবস্থা হলে আমি একটু হাল্কা বোধ করব। আমি একদিন বা কয়েকদিন পাত্তানী শহরে থাকছি না।’ বলল আহমদ মুসা।
দাদী, যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ তিনজনেরই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে। কথা বলল যয়নব, ‘আপনি কি তাহলে কোথাও যাচ্ছেন ভাই সাহেব?’
‘হ্যাঁ। তোমাদেরকে শাহ বাড়িতে পৌছে দেবার পর সম্ভব হলে আজকেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোথায়?’ দাদী বলল।
‘জাবের জহীর উদ্দিনের খোঁজে।’
‘পুলিশের সাথে?’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘না। পুলিশের পথ আর আমার পথ ভিন্ন হবে।’
‘আপনি সুস্থ নন। ডাক্তার খালাম্মা কি আপনাকে অনুমতি দেবেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এই ‘না’ বলা ডাক্তারের দায়িত্ব, কিন্তু আমার কাজ আমার প্রয়োজনে। ডাক্তারের দায়িত্ব থেকে রোগীর প্রয়োজন সব সময় অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।’
একজন পুলিশ ড্রইং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘এসপি স্যার এখানে আসতে চান স্যার।’
‘হ্যাঁ, ওয়েলকাম, আসতে বল।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
যয়নব যোবায়দা গায়ের চাদরটা আরও ঠিক করে নিল এবং কপালে নেমে আসা মাথার রুমালটাকে চোখের উপর পর্যন্ত নামিয়ে নিল।

হাবিব হাসাবাহর সামনে টেবিলের উপর মোবাইল রাখা।
কল চলছে।
মোবাইলের ইনকামিং ও আউটগোয়িং ভয়েস অপশন অন করা।
মোবাইল টেবিলে রেখেই যেমন কথা বলা যাচ্ছে, তেমনি কথা শোনাও যাচ্ছে।
শূন্য অফিস ঘর।
মাত্র হাবিব হাসাবাহই তার চেয়ারে বসে।
মোবাইলে ওপার থেকে কথা ভেসে আসছে।
হাবিব হাসাবাহর বিব্রত মুখ। বিধ্বস্ত চেহারা।
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কথা বলছেন, ইহুদীবাদী বিশ্ব গোয়েন্দা সংস্থা ইরগুন জাই লিউমি’র (ইজালি) প্রধান আলেকজান্ডার জ্যাকব। সে কথা বলছে ইসরাইলী হাইফার গোপন হেডকোয়ার্টার থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ইরগুন জাই লিউমি’র (ইজালি) হেডকোয়ার্টার বন্ধ হওয়াতে হাইফাতেই তাদের গোপন হেডকোয়ার্টার খোলা হয়েছে। এখানে হেডকোয়ার্টার হওয়াতে ইজালি’র লাভ হয়েছে। ইহুদী রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে ব্যবহার করা কিংবা মোসাদের তাদেরকে ব্যবহার করা সহজ হয়েছে।
ওপার থেকে আলেকজান্ডার জ্যাকব বলছিল, ‘এই বিভেন বার্গম্যান কয়েকদিন আগে পর্যন্ত আন্দামানে ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র থেকে এই মাত্র শুনলাম, বিভেন বার্গম্যান আসলে আহমদ মুসা। এই আহমদ মুসা আমাদের মূর্তিমান যম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জায়নবাদীদের সে উৎখাত করেছে। তার হাতে আমাদের সর্বশেষ বিপর্যয় ঘটেছে আন্দামানে। আমরা সেখানে মহাসংঘকে সহযোগিতা করছিলাম। আমাদের শীর্ষ গোয়েন্দা কোহেনকে সে খুন করেছে এবং সেখানে আমাদের গোটা নেটওয়ার্ক তার হাতে ধ্বংস হয়েছে। থাইল্যান্ডে যা ঘটেছে, আহমদ মুসার জন্যে তা ঘটানো খুবই স্বাভাবিক। সে অদ্ভুত কুশলী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সে সব সময় সংশ্লিষ্ট দেশের আইনকে অর্থাৎ সরকারকে পক্ষে রাখতে সমর্থ হয়। এই অসাধ্য সাধন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। তারই কৌশল ও চেষ্টায় সেখানে আমরা জায়নবাদী মানে ইহুদীবাদীরা মার্কিনীদের কাছে বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হই। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে আমাদের মোকাবিলায় ইহুদীদের ব্যাপক সমর্থন অর্জন করে। ইহুদীবাদীরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী এবং ধার্মিক ইহুদীরা তা নয়- তার এই যুক্তি মার্কিন ইহুদীরাও গলধঃকরণ করে। এহেন ধূর্তের সাথে লড়াইয়ে থাইল্যান্ডে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা খুব বড় নয়। সবচেয়ে অসুবিধার ব্যাপার হয়েছে, থাই সরকারকে সে শুধু পাশে পাওয়া নয়, সেখানকার মুসলমানদের সে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছে। এই অবস্থায় থাইল্যান্ডে আমাদের প্রধান কাজ হলো আহমদ মুসাকে হত্যা করা। জাবের জহীর উদ্দিন এবং তার পরিবারের লোকরা হবে আহমদ মুসাকে বাগে পাওয়ার টোপ। সুতরাং জাবের জহীর উদ্দিনকে ধরে রাখা আমাদের জন্য অপরিহার্য। ৪৮ জন বন্দীকে ছাড়লেও তাকে ছাড়বে না। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আহমদ মুসাকে হাতে পেতে চাই। শাহ পরিবারের লোকদের পণবন্দী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখ। আলটিমেটাম ঘোষণার পরেই শাহ পরিবারের সদস্যদের কিডন্যাপ করার আরও একটা উদ্যোগ নিয়েছিলে, এজন্যে তোমাকে মোবারকবাদ। তুমি ব্যর্থ হয়েছ, আমাদের আরও ছয়জন লোকের জীবন গেছে, একে আমি বড় করে দেখছি না। এক…….।’
আলেকজান্ডার জ্যাকবের কথার মাঝখানেই হাবিব হাসাবাহ বলে উঠল, ‘মাফ করবেন এক্সিলেন্সী। একটা কথা। এবার যে প্ল্যান আমরা করেছিলাম, তা প্রায় অব্যর্থ ছিল। কিন্তু পরিকল্পনার মাঝপথেই শাহ পরিবারের সদস্যরা অন্য কোথাও যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত ওখানে আমাদের জমা হয়েছিল মাত্র ছয়জন লোক। এরাই মরিয়া হয়ে ওদের কিডন্যাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপরও আহমদ মুসা না থাকলে তারা সফল হতো, এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
বললাম তো সে আমাদের যম। ওকেই আগে সরাতে হবে। জাবের জহীর উদ্দিন ভালো টোপ। প্রভু জিহোবা আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল ওপার থেকে আলেকজান্ডার জ্যাকব।
‘এক্সিলেন্সি, মনে হচ্ছে ওরা আলটিমেটাম না মেনে জাবের জহীর উদ্দিনকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে।’ হাবিব হাসাবাহ বলল।
‘আমরা এটাই চাই।’
‘উদ্ধারের চেষ্টায় তো ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিশ। আহমদ মুসা যদি না আসে!’
‘তুমি আহমদ মুসাকে চেন না। পুলিশের উপর ভরসা করে বসে থাকার লোক আহমদ মুসা নয়। পুলিশ উদ্ধারে আসবে। কিন্তু উদ্ধারের জন্য মূল ভূমিকা সে পালন করবে, এটা দেখতেই পাবে।’ ওপার থেকে বলল আলেকজান্ডার জ্যাকব।
‘ঠিক এক্সিলেন্সী। এ পর্যন্ত সব ঘটনার মধ্যে সে আছে।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
‘এই মুহূর্ত থেকে আহমদ মুসার পেছনে লোক লাগিয়ে দাও। তারা প্রতি পদে তাকে অনুসরণ করবে। সে উদ্ধার অভিযানে এসে তোমাদের দেখতে পাওয়ার আগে তোমরা যেন তাকে দেখতে পাও। এমন হলে তবেই আশা করা যায় তোমরা আহমদ মুসাকে কাবু করার সুযোগ পাবে।’ আলেকজান্ডার জ্যাকব বলল।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সী।’ বলল হাবিব হাসাবাহ।
‘ওয়েলকাম। ওকে। বাই।’ ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল আলেকজান্ডার জ্যাকব।
মোবাইল অফ করল হাবিব হাসাবহও।
যে বিধ্বস্ত চেহারা ছিল হাবিব হাসাবাহর, সেটা অনেকটাই কেটে গেছে এখন। মহাশক্তিধর আলেকজান্ডার জ্যাকব সর্বশেষ কয়েকটি বিপর্যয় ও ব্যর্থতার জন্যে তাকে খেয়ে ফেলবে এই ভয় ছিল হাবিব হাসাবাহর। কিন্তু বিভেন বার্গম্যানই আহমদ মুসা এটা জানার পর তার বিপর্যয় ও ব্যর্থতার অপরাধ আলেকজান্ডার জ্যাকবরা ভুলেই গেছে। এখন তার বিপর্যয়-ব্যর্থতাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে। মনে মনে দারুণ খুশি হাবিব হাসাবাহ। সে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা অতটা যোগ্য ও ক্ষমতাধর না হলে হাবিব হাসাবাহর আজ অব্যাহত ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ের জন্যে কি যে গতি হতো, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
হাবিব হাসাবহ গুনগুনিয়ে একটা গানের কলি গাইতে গাইতে কলিং বেলে চাপ দিল নতুন অপারেশন প্রধানকে ডাকার জন্যে। বস আলেকজান্ডার জ্যাকবকে টেলিফোন করার আগে সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল নিজের নাজেহাল অবস্থাকে অন্যের কাছ থেকে আড়াল করার জন্যে।

শাহ বাড়ির ছাদে হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নিয়েছে। হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আহমদ মুসা প্রস্তুত।
হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দাদীমা এখন তাহলে যেতে হয়। হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নিয়েছে।’
দাদীমা, যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ সবাই উঠে দাঁড়াল। দাদী বলল, ‘কি বলব ভাই, অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক এক অভিযানে যাত্রা করছ। শুধু আল্লাহকে বলব, তিনি তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করুন, তোমাকে সফল করুন, তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। তোমার মতো হাজারো আহমদ মুসাকে সৃষ্টি করুন। তাহলে দুনিয়ায় আমাদের মতো মজলুমদের আর কোন সমস্যা থাকবে না।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল দাদী।
দু’চোখ ছলছলিয়ে উঠেছে যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের। যয়নব যোবায়দা বলল, ‘যদি জানতাম আপনাকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলব, তাহলে ঐভাবে চিঠি পাঠাতাম না, আপনাকে ডাকতাম না। কারও সুখের জন্যে, কারও মুক্তি বা নিরাপত্তার জন্য আরেকজনের এত কষ্ট হতে পারে না।’ যয়নব যোবায়দারও কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দুনিয়ায় সব দাদী, সব মা, সব বোনেরা এমনটি হয়। আমি ভাগ্যবান দাদী। এমন স্নেহ দেবার দাদী, বোন, ভাই আমার দুনিয়া জোড়া। আপনাদের এই অশ্রু আমার জন্যে আশীর্বাদ।’ বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা ছাদে ওঠার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
সবাই তার পেছনে হাঁটতে শুরু করল। যেতে যেতে যয়নব যোবায়দা বলল। ‘ভাই সাহেব, আমি কি ভাবী সাহেবার সাথে কথা বলতে পারি?’
‘অবশ্যই যয়নব যোবায়দা। আমি কিছুক্ষণ আগে জোসেফাইনের সাথে কথা বলেছি। তোমার কথা সে জানে।’
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাদী ও যয়নব যোবায়দা দাঁড়াল। আবার এক দফা সালাম বিনিময় হলো।
ফরহাদ ও আহমদ মুসা উঠে গেল ছাদে।
সর্বশেষে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ফরহাদের পিঠ চাপড়ে ‘সাবধানে থেকো, সতর্ক থেকো’ বলে হেলিকপ্টার উঠে গেল।
হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ছুটল পশ্চিম দিকে।
হেলিকপ্টার আহমদ মুসাকে নামিয়ে দেবে সোয়াশ’ কিলোমিটার পশ্চিমে ‘হাটাই’ শহরে।
আহমদ মুসার গতিবিধি যাতে শত্রুপক্ষের কাছে গোপন থাকে, এজন্যেই এই হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা।
হাটাই থেকে একটা প্রাইভেট জীপে অতপর আহমদ মুসাকে অগ্রসর হতে হবে পাত্তানী মালয় রোড ধরে দক্ষিণে। এই রোড পাত্তানীর শেষ শহর সিডাও পর্যন্ত গেছে। সিডাও থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মালয়েশিয়া সীমান্ত। মালয়েশিয়া পার হয়ে তাকে পৌছুতে হবে সীমান্ত থেকে ৪০ কি.মি. ভেতরে পাত্তানী-মালয় সড়কের শেষ প্রান্ত ‘সুংচাই পেতানী’ শহরে। এই শহর থেকে দুর্গম এলাকার মধ্যে একটা পথ-চিহ্ন ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে মালয়েশিয়া সীমান্তে আবার তাকে ফিরে আসতে হবে। মালয়েশিয়া অতিক্রম করে তাকে পাত্তানীর দুর্গম শহর বেতাংগে পৌছুতে হবে এখানে তাকে অনেকগুলো কাজ সেরে ১০০ কিঃ মিঃ উত্তরে গোপনে ‘কাতান টেপাংগো’ পৌছার চেষ্টা করতে হবে। এ যেন দরজায় প্রবেশ না করে দরজার সামনে থেকে গোটা ঘরের চারপাশ ঘুরে এসে দরজায় প্রবেশ করা। পাত্তানী শহর থেকে ‘কাতান টেপাংগো’ সত্তর আশি কিলোমিটারের বেশি নয়। এই ‘কাতান টেপাংগো’ আসতেই তাকে ৭০০ কিলোমিটার ঘুরতে হবে, তাও ভিন দেশের মধ্যে দিয়ে। চিন্তা ভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আহমদ মুসা। থাই গোয়েন্দা বিভাগও আহমদ মুসার সাথে একমত হয়েছে। পাত্তানী শহর থেকে কাতান টেপাংগো যাবার দুটি পথের বিবেচনা করে দেখা হয়েছে। জল পথে গেলে কাতান হ্রদ বা জলাভূমি পর্যন্ত পৌছার খবর পেয়ে যাবে ব্ল্যাক ঈগল। অন্যদিকে কাঁচা একটা পথ পাত্তানী থেকে কাতান টেপাংগো’র পাশ পর্যন্ত গেছে। কিন্তু এ পথ সম্পূর্ণটা বলতে গেলে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দখলে। এ পথে পা দিলেই সে খবর কাতান টেপাংগো পৌছে যাবে। কিন্তু ব্ল্যাক ঈগলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাতান টেপাংগো পৌছুতে হবে যাতে বড় ধরনের রক্তপাত এড়ানো যায় এবং বাঁচানো যায় জাবের জহীর উদ্দিনকে। এ অবস্থাতেই হাটাই সুংগাই রোড ধরে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে সুংগাই থেকে পাত্তানীর সীমান্ত শহর বেতাংগে গিয়ে সেখান থেকে পেছন দিক দিয়ে ‘কাতান টেপাংগো’ প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা ও রুট নির্বাচন আহমদ মুসার এবং আহমদ মুসাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বেতাংগ থেকে ‘কাতান টেপাংগো’র রাস্তা অজ্ঞাত, অনিশ্চিত ও দুর্গম। মালয়েশিয়ার সুংগাই থেকে আসা কাঁচা রাস্তা বেতাংগ হয়ে কাতান পর্বত শ্রেণীর অনেক নিচে জংগলের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে, পরে পূর্ব দিকে ফিরে পাত্তানী শহর পর্যন্ত গেছে। এ রাস্তা দিয়ে কাতান টেপাংগো যাওয়া যায় না। কাতান টেপাংগো যাওয়ার অজ্ঞাত পথ কাতান পাহাড়ের উপর দিয়ে। জনশ্রুতি অনুসারে কাতান পাহাড়ের এই পথ থেকে এক সুড়ংগ পথে কাতান টেপাংগো যাওয়া যায়। কাতান পাহাড়ের এক সময়ের এই রাস্তা অব্যাহত ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই রাস্তার সন্ধান দিতে পারে শুধু পাহাড়ের সন্তান বলে কথিত ‘কোহেতান (কাতান) কবির’ বংশের কোন লোক। এরা এখনও পাহাড়ের বাস করে, পাহাড়ে পাহাড়েই ঘুরে বেড়ায়। বেতাংগ শহরের উত্তরাংশের একটি পাহাড়ে ওদের একটা ষ্টেশন আছে। এখানে ওদের কেউ না কেউ থাকে। আহমদ মুসাকে এই ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। ‘কোহেতান কবির’দের কারও সাহায্য নিতে হবে সামনে এগুবার জন্যে। এদিকে আহমদ মুসার এই অভিযান একেবারেই অনিশ্চিত যাত্রা। বেতাংগ পর্যন্ত পৌছে তাকে একেবারেই ভাগ্য, মানে আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করতে হবে।
এই চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌছে গেল হাটাই শহরে।
ছোট্ট হেলিকপ্টারটি তাকে পুলিশ অফিসের একটি মাঠে নামিয়ে দিল।
এখান থেকেই একলা যাত্রা আহমদ মুসার। নির্দেশিকা অনুসারে এখান থেকে একটা বাহন যোগাড় করে তাকে হাটাই সেন্ট্রাল রোডের ৯ নম্বর সরকারি গাড়ির পুলে যেতে হবে।
আহমদ মুসা মাঠ থেকে বেরিয়ে অটোরিক্সা যোগাড় করে ছুটল সেন্ট্রাল রোডের দিকে।
সেন্ট্রাল পুলে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে নাম্বার ওয়ান পার্কিং লোকেশানে একটি ল্যান্ড ক্রুজার জীপ দাঁড়িয়ে আছে। চাবী ঝুলছে গাড়ির কী হোলে।
আহমদ মুসা দরজা খুলে গাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই পকেট থেকে লাইটার বের করে বটমের একটি ক্ষুদ্র সাদা সুইটে চাপ দিল। সংগে সংগেই টপে একটা নীল আলো জ্বলে উঠল। নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা যে অন্তত ২৫ বর্গফুট এলাকার মধ্যে কোন বিস্ফোরক নেই।
আহমদ মুসা লাইটারটি পকেটে রেখে দিল।
লাইটারটি অনেক কাজের। এটি একই সংগে লাইটার, ডিটেক্টর, ক্যামেরা, লেসারগান এবং রেডিও রিসিভার ট্রান্সমিটার।
লাইটারটা তাকে গিফট করেন থাই সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক।
চাবি ঘুরিয়ে ড্যাশ বোর্ডে কেবিন খুলল আহমদ মুসা। তার নতুন পাসপোর্ট এখানেই থাকার কথা। পাসপোর্ট পেয়ে গেল আহমদ মুসা।
থাইল্যান্ডের এই পাসপোর্টে আহমদ মুসার নাম আহমদ মুসাই লেখা হয়েছে। পাসপোর্টে মালয়েশিয়ার ভিসা লাগানো রয়েছে।
পাসপোর্ট পকেটে পুরে গাড়ি ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
গাড়ি নেমে এল রাস্তায়।
হাটাই-সুংগাই রোড ধরে মালয়েশিয়া বর্ডারের দিকে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার জীপ।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। সকাল ১০টা।
আহমদ মুসার লক্ষ্য এই হাইওয়ের শেষ প্রান্ত সুংগাই পেতানী। আহমদ মুসা তিনটার মধ্যে সেখানে পৌছুতে চায়। মাঝখানে থাই-মালয়েশিয়া বর্ডারে এবং যোহরের নামাযের জন্যে তাকে থামতে হবে।
হাটাই শহর থেকে বেরুনোর পর হাইওয়ে ধরে তার গাড়ি তীব্র গতিতে চলতে শুরু করল। শীঘ্রই গতির কাটা ১০০ কিলোমিটার অতিক্রম করল।

বেতাংগ শহরের উত্তরাংশের সোগা কাতান পাহাড় খুঁজে পেয়েছে আহমদ মুসা। কিন্তু ‘কোহেতান কবীর’ পরিবার নামের কোন পরিবার খুঁজে পায়নি।
পাহাড়টি খুব ছোট নয়। ঝোপ, জংগল, ফল বাগান, সবজি বাগান, বাজার, প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদির বাইরে কয়েকশত পরিবারের বাস এই পাহাড়ে।
আহমদ মুসা গোটা পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছে। একে ওকে কোহেতান কবির পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারেনি।
ভাষা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় লোকরা অপভ্রংশ মালয়ী ও অপভ্রংশ আরবী মেশানো ভাষায় কথা বলে। লিখিত ভাষা ও কথ্য ভাষার মধ্যে এত পার্থক্য যে কোন কোন ক্ষেত্রে কথ্য শব্দ একেবারে নতুন রূপ নিয়েছে।
বেতাংগে পৌছার পরদিন ছিল শুক্রবার।
আহমদ মুসা সোগা কাতান পাহাড়ে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা রোড সাইড রেষ্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে একজন যুবকের সাথে আলাপ করছিল। আহমদ মুসা কথার এক ফাঁকে তাকে ‘কোহেতান কবির’ পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করে। সে জানায় যে, এ ধরনের কোন পরিবারের নাম সে শুনেনি। সে আরও জানায়, এখানে আসল নাম অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। ডাক নামই আসল নাম হয়ে যায়। তারা যে পাহাড়ী পরিবার একথা আহমদ মুসাকে জানায়। সে বলে, এখানে সব পরিবারের শেকড় পাহাড়ে। কিন্তু পাহাড়কে তারা এখন ভুলেছে। অবশ্য দুএকটি পরিবার আছে, যাদের কাছে পাহাড়ই এখনও তাদের আবাস।
এ সময় আজানের শব্দ ভেসে আসে।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকায়। বেলা ১২টা।
‘মসজিদ এখান থেকে কত দূর?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করে যুবককে।
‘এই পাহাড়েরই অল্প কিছু উত্তরে। কেন মসজিদে যাবেন? আজ জুমআর দিন এজন্য?’ বলে যুবকটি।
‘আমি মুসলমান কেমন করে জানলে?’ জিজ্ঞেস করে আহমদ মুসা।
‘কপালে সিজদার দাগ ছাড়াও চেহারা দেখেই আমি বুঝেছি। মুসলমানদের চেহারায় একটা পবিত্র লাবণ্য থাকে। আপনার চেহারায় তা আরও বেশি। চিনব না কেন?’ যুবকটি বলে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমিও কি যাবে মসজিদে?’
‘অবশ্যই যাব। না গেলে আগামী শুক্রবারে জবাবদিহী করতে হবে।’ বলে যুবক।
‘জুমআয় না গেলে জবাবদিহী করতে হয়? কার কাছে?’ জিজ্ঞেস করে আহমদ মুসা।
‘কেন মসজিদে একজন করে সরদার থাকেন। তিনি বংশের সরদারের চেয়েও শক্তিশালী।’ বলে যুবক।
‘তার কাজ কি?’ বলে আহমদ মুসা।
‘এলাকার মানুষদের সাপ্তাহিক দানে গড়ে ওঠা তহবিলের তিনি পরিচালক। সামাজিক বিচার-ফায়সালা করেন। এবং মানুষকে ইসলামী অনুশাসনের উপর থাকার ব্যাপারে তাকিদ করেন।’ যুবকটি বলে।
‘তহবিল দিয়ে কি কাজ হয়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তহবিলের কাজ তিনটি। মসজিদের সাথে একটা মক্তব আছে, সেটা চালানো। এলাকার দরিদ্র লোকদের স্বাবলম্বী হওয়ার কাজে সাহায্য করা এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সাহায্য দেয়া।’ যুবকটি বলে।
‘বাঃ সুন্দর ব্যবস্থা।’ বলে আহমদ মুসা। একথা শুনে আনন্দে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
যুবকটি উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘চলুন বিদেশী ভাই, আজান শোনা গেলেও জায়গাটা খুব কাছে নয়, যেতে কিন্তু সময় লাগবে। পাহাড়ে ওঠা-নামা ও অনেক বাঁক ঘুরে যেতে হবে।
বেশ বড় মসজিদটি। আহমদ মুসা দেখল, মেয়েরাও মসজিদে উপস্থিত। মসজিদের ডান দিকে বসেছে ছেলেরা, বাম দিকে মেয়েরা। মাঝখানে ৪ ফুটের মতো উঁচু পার্টিশন, কাপড়ের। খুশি হলো আহমদ মুসা। বহু মুসলিম দেশেও যা দেখা যায় না, তা এই জংগলের জনপদে এসে দেখতে পেল সে।
মসজিদে ঢুকে সুন্নাত নামায শেষ করে বসেই একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। পাশেই বসেছিল সাথে আসা যুবকটি। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ‘বিদেশী ভাইয়া, ইমাম সাহেব অসুস্থ। তিনি হাসপাতালে। সহকারী মৌলভীসাহেব নামায পড়াবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন, আসার পথে দূর্ঘটনায় পড়ে তিনিও হাসপাতালে। এখন খুতবা পড়ার লোক নেই। এখন যোহর পড়বে কিনা, সেই আলোচনা চলছে।’
শুনেই আহমদ মুসা বলে, ‘যোহর পড়ার দরকার নেই। খোতবা পড়ার কেউ না থাকলে আমি পড়াতে পারি।’
শুনে যুবকটি দারুণ খুশি হয়ে ওঠে। সে দ্রুত উঠে সরদারের কাছে চলে যায় এবং তাকে বিষয়টা বলে।
সরদার স্বয়ং যুবকটির সাথে আহমদ মুসার কাছে আসে।
সরদার ৭০ উর্ধ্ব সম্পূর্ণ সফেদ কেশধারী হলেও তার স্বাস্থ্য অটুট। সে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলে, ‘আমরা খুব খুমি হবো বাবা তুমি জুমআ পড়িয়ে দিলে। এই মসজিদের একশ’ বছরের ইতিহাসে আজকের মতো ঘটনা ঘটেনি।’
আহমদ মুসা সবিনয়ে বলে, ‘আপনাদের অনুমতি হলে আমি পড়িয়ে দেব।’
খুশি হয়ে সরদার উঠে দাঁড়ায় এবং তার জায়গায় ফিরে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। একজন মেহমান এসেছেন। তিনি জুমআর নামায পড়াবেন। নামাযের সময় হয়ে গেছে। আমি তাঁকে মিম্বরে আসার অনুরোধ করছি।’
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে মিম্বরে বসে।
মুয়াজ্জিন খোতবার বই আহমদ মুসার হাতে দিয়ে আযান দিতে চলে যায়। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ায় খোতবা দেবার জন্যে।
হাতের খোতবার বই দেয়ালের তাকে রেখে খোতবা শুরু করে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার আরবী উচ্চারণ অত্যন্ত মিষ্টি এবং তেলাওয়াত মর্মস্পর্শী।
আহমদ মুসা হামদ, সানা ও তেলাওয়াতের পর মালয়, আরবী ও ইংরেজী মেশানো ভাষায় তার খোতবায় দুটি বিষয় তুলে ধরে। এক. জান্নাতের পথ কঠিন কেন এবং জাহান্নামের পথ সহজ কেন। দুই. দুনিয়াতে মুসলমানরা আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পদানত হওয়ার মূল কারণ কি। প্রথম বিষয়ের উপর আহমদ মুসা একটা হাদীস বর্ণনা করে বলে, অনন্ত সুখের জান্নাত দুঃখ, বেদনা, ত্যাগ, কোরবানীর সাগর দিয়ে ঘেরা, অন্যদিকে অনন্ত দুঃখ ভোগের জাহান্নাম ভোগ-লিপ্সার আকর্ষণ দিয়ে সাজানো। জান্নাতের চারদিকের দুঃখ, ত্যাগ-কোরবানীর সাগর পাড়ি দিতে ধৈর্য প্রয়োজন, লোভ সম্বরণ প্রয়োজন। অনেকেই এটা পারে না বলে তাদের জন্যে জান্নাতের পথ কঠিন হয়ে যায়। আর জাহান্নামের চারদিকে সাজানো ভোগ-লিপ্সার আকর্ষণ অধিকাংশ মানুষই উপেক্ষা করতে পারে না। এরাই গিয়ে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে যেমন পতঙ্গ প্রদীপের আগুনে গিয়ে আত্মগুতি দেয়। ইতিহাস থেকে নানা উপমা ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আহমদ মুসা তার আলোচনাকে প্রাণস্পর্শী করে তোলে। দ্বিতীয় বিষয়ের আলোচনায় আহমদ মুসা বলে, ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধের দায়িত্ব ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিত্যাগ করে মুসলমানরা যখন অন্যায়, অসত্য, জুলুম, নির্যাতনের সাথে গলাগলি করে দুনিয়ার সমৃদ্ধি সন্ধান করে, তখন নৈতিক বা আদর্শিক শক্তির বিলয় ঘটে। আদর্শিক শক্তির অনুপস্থিতি মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির পতন ত্বরান্বিত করে। এভাবেই ন্যায়েল শক্তি যখন আমরা হারালাম, তখন অন্যায়ের শক্তি এসে আমাদের গ্রাস করল।
আহমদ মুসার এই খোতবা এতই দরদ মাখা ছিল যে মুসলিস্নদের অধিকাংশই অশ্রুসিক্ত হয়।
নামায শেষ হলে প্রথমেই সরদার এসে আহমদ মুসার সাথে কোলাকুলি করে এবং দাওয়াত দেয় আহমদ মুসাকে তার বাসায়। উল্লেখযোগ্য সবাই এসে আহমদ মুসার সাথে সালাম বিনিময় করে। কেউ কেউ দূর থেকে তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চলে যায়। আহমদ মুসা চাইছিল কোহেতান কবির পরিবারের কথা সরদারকে কিংবা কাউকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সেরকম সুযোগ সে পায় না। অবশেষে সে ভাবে, ইতিমধ্যে কিছু না হলে দাওয়াত খেতে গিয়ে সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।

তৃতীয় দিনের বিকেল।
আহমদ মুসা হাঁটছিল প্রশস্ত একটা উপত্যকার পথ ধরে।
দু’পাশেই ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া উঁচু টিলা জাতীয় পাহাড়। খুব উঁচু নয় কিন্তু প্রশস্ত। এটাই সোগা কাতান পাহাড়। আহমদ মুসা ঘুরে ফিরে এখানেই ছুটে আসে।
আজও এসেছে সেভাবেই। আহমদ মুসা ধীরে ধীরে হাঁটছিল।
হঠাৎ সূর্যের আলো উবে গেল।
আহমদ মুসা তাকাল আকাশের দিকে।
দেখল টস টসে পানি ভরা মেঘ। এ মেঘ যে কতটা বিপজ্জনক, তিন দিনে টের পেয়েছে আহমদ মুসা। এ মেঘ মাথার উপর আসা মানে বালতি থেকে পানি ঢালার বেগে বৃষ্টি এসে ছেঁকে ধরা।
আহমদ মুসা পাহাড়ের আশ্রয়ে উঠার জন্যে দৌড় দিল।
অনেক খানি উঠে গেল পাহাড়ে।
পাহাড় শীর্ষের শুরুতেই বড় টিলার শীর্ষে একটা সুন্দর বাড়ি। পাহাড় শীর্ষের টিলাগুলোর মধ্যে এই টিলাই সবচেয়ে বড় এবং বাড়িটাও বড় সবার চেয়ে।
ঘুরাঘুরির সময় কয়েকবার দেখেছে সে এ বাড়িটা।
বড় বড় ফোটায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে এল।
আহমদ মুসা যখন দৌড়ে বাড়িটার বারান্দায় উঠল, তখন আধাভেজা হয়ে গেছে সে।
বারান্দাটা আসলে বাড়ির গেটের সামনের ষ্টান্ডিং স্পেস।
বারান্দায় উঠে মুখ তুলতেই বড় দরজার মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা।
দরজার পাশেই একটা কাঠের প্লেট দেয়ালের সাথে সেঁটে রাখা আছে। এটা একটা নেমপ্লেট। তাতে মালয়ী ভাষায় লেখা ‘কবিলা আল কাতান’।
নেমপ্লেটটি পড়ে আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে আনল দরজার উপর।
ঠিক এই সময়ই দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল।
খোলা দরজায় দাঁড়ানো এক তরুণী। পরনে পাজামা। গায়ে কামিজের উপর ওড়না। মাথায় মালয়েশীয় পরদার রুমাল। ফর্সা ও বুদ্ধিদীপ্ত মালয়ী চেহারা।
দরজা খুলেই সালাম দিয়েছে তরুণীটি।
তার চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা লজ্জা,কিছুটা আনন্দ।
সালাম দিয়েই তরুণীটি বলল,‘ভেতরে আসুন স্যার। ভিজে গেছেন। বৃষ্টির ঝাপটা বারান্দায়ও আসছে। আরও ভিজে যাবেন।’ পরিষ্কার ইংরেজি ভাষা মেয়েটির কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল।
মেয়েটি একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল।
ঘরটা প্রায় ফাঁকাই।
ঘরে ঢুকেই ডান দিকে দেয়ালের পাশে জুতো রাখার র‌্যাক। সামনের দেয়ালের পাশে একটা আলনা দেখতে পেল। চারদিকের দেয়ালে সাঁটা কয়েকটা হ্যাংগার। ঘরের মাঝখানে কাঠের টেবিল। তার চারপাশে চেয়ার। বার্নিস করা সুন্দর চেয়ার টেবিল।
ঘরটা যে ট্রানজিট বুঝল আহমদ মুসা। জুতো ও বাড়তি কাপড় এখানে ছাড়া হয়। ভেতরে প্রবেশের আগে অনেক সময় আগন্তুককে এখানে ওয়েটও করতে হয়।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল মেয়েটি দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘরের বাম পাশে একটা দরজার দিকে ইংগিত করে বলল, ‘স্যার ওদিকে ড্রইং, চলুন।’
মেয়েটির চোখে-মুখে একটা অন্তরঙ্গ ভাব। চেনা-জানার একটা ছাপ সেখানে।
বিস্মিত আহমদ মুসা বলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চেনেন। কিন্তু আমি আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।’
আহমদ মুসা জুতো খুলে র‌্যাকে রাখতে রাখতে বলল।
মেয়েটি কোন জবাব না দিয়ে বলল, ‘স্যার আপনি জ্যাকেটটাও খুলতে পারেন। ওটা বেশি ভিজে গেছে।’
সত্যি ভিজা জ্যাকেটে অস্বস্তি লাগছিল আহমদ মুসার। খুশি হয়ে আহমদ মুসা জ্যাকেট খুলে দেয়ালেল হ্যাংগারে ঝুলাল।
মেয়েটি ‘আসুন স্যার’ বলে তখন হাঁটতে শুরু করেছে।
মেয়েটির পেছনে পেছনে আহমদ মুসা ড্রইং রুমে প্রবেশ করল।
বিশাল ড্রইং রুম।
লাল কার্পেটের উপর লাল সোফাসেট সাজানো।
ড্রইং রুমের আরেক অংশে কার্পেটের উপর পুরু ফরাশ এবং সোফসেট পাতা।
‘স্যার আমাদের পাহাড়ি কায়দার ফরাশ এবং ইংরাজী কায়দার সোফাসেট দুই-ই আছে। স্যার সোফাসেট আমার পছন্দ, আপনারও নিশ্চয় তাই। বসুন স্যার।’ একটা সোফা দেখিয়ে বলল মেয়েটি।
মেয়েটির কথা বলায় কোন আড়ষ্টতা নেই। কণ্ঠ সংযত, ভদ্র। চেহারায় পাহাড়ি লজ্জার পুরু ছাপ, কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট, খোলামেলা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসল।
‘স্যার গতকাল আপনাকে আমি মসজিদে দেখেছি। জুমআর খোতবা দিয়েছিলেন, নামায পড়িয়েছিলেন। ইসলামকে আপনি উত্তর আধুনিক ভাষায় তুলে ধরেছেন স্যার। এমন খোতবা শুনিনি কখনও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘স্যার একটু বসুন। আমি দাদুকে ডাকি।’
বলে দৌড় দিল মেয়েটি।
আহমদ মুসা আরেকবার তাকাল ড্রইং রুমের চারদিকে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সাজানো ঘর। সামনের দেয়ালে একটা দীর্ঘ পাহাড় শ্রেণীর দৃশ্য। কাতান পাহাড়ই হবে এটা, ভাবল আহমদ মুসা। অন্যপাশের দেয়ালে একটি নগরীর সুন্দর দৃশ্য। নিশ্চয় এটা বেতাংগ নগরী।
ঘরে ঢুকল সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধ।
তার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এ যে মসজিদের সেই সরদার, যে তাকে দাওয়াত করেছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তার হা হয়েছিল সালাম দেয়ার জন্যে। কিন্তু সরদারের মুখে সালাম উচ্চারিত হয়েছে।
সরদার এসে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে। বলল, ‘খুব খুশি হয়েছি এভাবে তোমাকে আমার বাসায় পেয়ে।’
থামল মুহূর্তের জন্যে। আবার বলে উঠল,‘অনেক সম্মানী, অনেক জ্ঞানী, অনেক বড় কেউ তুমি, কিন্তু আমার নাতির মতো। তোমার মতোই আমার এক নাতি কি এক পাহাড়-বিদ্যায় পাশ করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। অতএব সেদিন তোমাকে ‘তুমি’ বলেছি, আজও বলছি।’
‘অবশ্যই জনাব। আমি খুশি হবো’। আহমদ মুসা বলল।
সরদার আহমদ মুসাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
বসেই বলল সরদার, ‘আমি জামাল উদ্দিন আল কাতানী। কবিলা আল-কাতানের আমি বর্তমান সরদার। পাহাড়েই আমাদের বাড়ি। শুক্রবারসহ সপ্তাহের দু’একদিন আমি এ বাড়িতে থাকি।’
থামল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘আমি আহমদ মুসা। গত পরশু পাত্তানী থেকে আমি এখানে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা। মনে মনে ভাবল গোপন করে আর লাভ নেই। ব্ল্যাক ঈগল তার পরিচয় জেনে গেছে। আর যারা আহমদ মুসাকে জানে না, তাদের কাছে আসল-নকলের কোন পার্থক্য নেই।
‘কিন্তু তুমি তো থাইল্যান্ডের নও। তোমার আরবী, ইংরেজি, মালয় উচ্চারণ থেকে বুঝেছি তুমি আশে-পাশের কোন দেশেরও নও। তাহলে তোমার বাড়ি কোথায়?’ জিজ্ঞাসা সরদারের।
সেই মেয়েটি চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কথা শেষ করেই সরদার বলল, ‘দাও বোন চা দাও।’
মেয়েটি পাশের একটি টি-টেবিলে চায়ের ট্রে রেখে দুই কাপে চা ভরে একটি সরদার, অন্যটি আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল।
সরদার মেয়েটির দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এ আমার নাতনী আলিয়া কাতানী। তোমার সাথে তো আগেই দেখা হয়েছে। ও কুয়ালামপুরের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ‘ভাষাতত্ব’ বিষয়ে পড়ে। মসজিদে তোমার বক্তৃতা শুনে ও দারুণ অভিভূত হয়েছে। ও বলছে, ইসলামের উপর বক্তৃতা সে কুয়ালামপুরে প্রায়ই শোনে। কিন্তু এমন বক্তৃতা নাকি সে……….।’
‘থাম দাদু। সাক্ষাতে এত প্রশংসা করতে মানা আছে।’ সরদারের কথার মাঝখানেই বলে উঠল আয়েশা আলিয়া কাতানী। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তৃতয়ি একটা কাপে চা ঢেলে নিয়ে দাদুর ওপাশের এক সোফায় গিয়ে সে বসল।
‘আয়েশা ঠিক বলেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি খুশি। ও বড় পন্ডিত হবে।’
বলেই সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী দৃষ্টি ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ভাই, আমি তোমাকে দাওয়াত করে রেখেছি মাত্র। কিন্তু বৃষ্টি তোমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। নিশ্চয় তুমি চিনে বাড়িতে ওঠনি!’
‘জ্বি না। তবে এই বাড়ি আগে দেখেছি। গত কয়েকদিন ধরে এই পাহাড়ে আমি ঘুরছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই পাহাড়ে? কেন?’ জিজ্ঞাসা জামাল উদ্দিন কাতানীর।
সংগে সংগে উত্তর দিল না আহমদ মুসা।
চোখ তুলে তাকাল একবার বৃদ্ধ জামাল উদ্দিন কাতানীর দিকে। তার মনে হলো, তার অনুসন্ধান সম্পর্কে বলার উপযুক্ত জায়গা এটা হতে পারে।
মুহূর্তকালের এই ভাবনার পর আহমদ মুসা বলল, ‘আমি একটা পরিবারকে খুঁজছি জনাব।’
‘একটা পরিবার? কোন পরিবার?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার চোখে-মুখে কৌতুহল।
আয়েশা আলিয়া কাতানীও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
‘কাতান পাহাড়ের একটা পরিবার। শহরের এই পাহাড়েও তাদের একটা ঠিকানা আছে। পরিবারের নাম কোহেতান কবীর।’
নাম শোনার সংগে সংগে চমকে উঠল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানি। ভ্রু কুচকালো আয়েশা আলিয়া কাতানীরও।
‘কেন খুঁজছো ঐ পরিবারকে? পরিচয় আছে ওদের সাথে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘না পরিচয় নেই। ওদের নাম জানি এবং কিছু জানি ওদের সম্পর্কে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি পাত্তানী শহর থেকে এসেছ বললে। কার কাছ থেকে শুনেছ ওদের সম্পর্কে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘কিছু শুনেছি পাত্তানীর শাহ পরিবারের কাছ থেকে, কিছু শুনেছি থাই গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শাহ পরিবারকে তুমি চেন? কাকে চেন?’ সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে সন্দেহের ছায়া। তার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ।
‘শাহজাদী যয়নব যোবায়দাকে চিনি। তার দাদীমাকেও জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওদের সম্পর্কে আর কি জান?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন দ্রুতকণ্ঠে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে অস্পষ্ট একটা হাসি ফুটে উঠেছে। সে নিশ্চিত যে, এই কাতানী পরিবার ‘শাহ পরিবার’কে চেনে। তাহলে এরা কি ‘কোহেতান কবির’ পরিবারকেও চিনতে পারে? বলল আহমদ মুসা, ‘শাহজাদী যয়নব যোবায়দার ভাই জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন থাই সরকারের হাতে বন্দী ছিল। ব্ল্যাক ঈগল তাকে ছিনিয়ে এনেছে থাই সরকারের কাছ থেকে। এখন সে ব্ল্যাক ঈগলের হাতে বন্দী। শুধু বন্দী নয়, তার জীবন বিপন্ন। ব্ল্যাক ঈগলের লোকজনকে যদি থাই সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছেড়ে না দেয় তাহলে জহীরকে ব্ল্যাক ঈগলরা হত্যা করবে।’
থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়, উত্তেজনা ও সন্দেহের ঝড় বইছে সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে-মুখে। আয়েশা আলিয়া কাতানীও যেন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ।
সরদার জামাল উদ্দিনের বিস্ময় হলো, আহমদ মুসা এসব কি বলছে! অবশ্য সরদার জামাল উদ্দিনরাও থাই টিভি ও পত্র-পত্রিকা থেকে জেনেছে ব্ল্যাক ঈগল ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে তাদের লোককে না ছাড়লে তারা জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে। এটা তো থাই প্রপাগান্ডা বলেই সরদার জামাল উদ্দিনরা জানে। কিন্তু আহমদ মুসাও ঠিক থাই সরকারের মতোই কথা বলছে। সে থাই গোয়েন্দা কিংবা থাই এজেন্ট? কিন্তু এত ভালো লোক এই পথে কিভাবে যায়!
সতর্ক হলো সরদার জামাল উদ্দিন। বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলকে তোমরা কোত্থেকে পেলে? জাবের জহীর উদ্দিনকে তো মুক্ত করেছে ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ (এমপিএম) এবং জাহের জহীর উদ্দিন এখন এমপিএম-এর সাথে থেকে থাই নীপিড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’
‘না জনাব। জাহের জহীর উদ্দিন ব্ল্যাক ঈগলের হাতে বন্দী আছে। আর এমপিএম এখন সশস্ত্র বা হিংসাত্মক আন্দোলনে নেই। তাদের নাম ভাক্সিয়ে ব্ল্যাক ঈগল ষড়যন্ত্রমূলখ কাজে রত আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ব্ল্যাক ঈগল কে?’ সরদার জামাল উদ্দিনের প্রশ্ন।
‘আন্তর্জাতিক একটি ষড়যন্ত্রকারী সংস্থা। থাইল্যান্ডে এদের কাজ হলো নিজেরা থাই পুলিশ, থাই আর্মির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে তার দায় মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া। সে কারণে থাই পুলিশরা মুসলমানদের উপর নীপিড়ন শুরু করে, আর মুসলমানরা থাই সরকারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। এভাবে থাই মুসলমানদের তারা ধ্বংস করতে চায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার কথা যে ঠিক এবং এরা ব্ল্যাক ঈগল তার প্রমাণ কি?’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল। তার গলায় অসন্তুষ্টির সুর।
আহমদ মুসা তাকাল সরদার জামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘আপনার কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা অসন্তুষ্টি দেখতে পাচ্ছি। আপনি যে প্রশ্ন করছেন তার জবাব দেব। কিন্তু আপনি যদি সত্য জানার জন্যে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে শুধু বলব।’
গম্ভীর হয়ে উঠল সরদার জামাল উদ্দিন। বলল, ‘তুমি আমার জানা ও বিশ্বাসের বিপরীত কথা বলছ। তবে মনে রেখ, আমার ধর্ম এবং সত্য আমার কাছে সব চেয়ে বড়।’
‘ধন্যবাদ জনাব’ বলে কথা শুরু করল আহমদ মুসা, ‘প্রমাণের কথা যেহেতু বলেছেন, আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। আমি থাইল্যান্ডে আসার গত কয়েক সপ্তাহে যা ঘটেছে সব কথাই এর মধ্যে আসবে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে আমি ওদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলব। এক. ওরা পকেট মেশিনগানসহ এ ধরনের যে অস্ত্র ব্যবহার করে, তাতে খোদাই করা সাংকেতিক অক্ষর ও নাম্বার হিব্রু ভাষায় লেখা। তার মানে এ অস্ত্রগুলো ইসরাইলে তৈরি, দুই. ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ (এমপিএম) নামের কভারে ‘ব্ল্যাক ঈগল’এর যারা বাইরে থেকে এসে থাইল্যান্ডে কাজ করছে, তাদের অধিকাংশই আরব বংশোদ্ভুত, আরবী ভাষায় ফ্লুয়েন্ট কথা বলতে পারে এবং নামও আরবীয় তাদের, কিন্তু তারা মুসলমান নয়, এবং তিন. তারা তাদের চিঠিপত্রে, বিভিন্ন ডকুমেন্টে এবং তাদের জামা ও জ্যাকেটের কলার ব্যান্ডের ভেতরের অংশে পরিচয়মূলক যে মনোগ্রাম ব্যবহার করে সে মনোগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্ল্যাক ঈগল। ব্ল্যাক ঈগল বসে আছে মুসলমানদের প্রতীক অর্ধচন্দ্রের বুকের উপর। আর ঈগলের মাথার উপর রয়েছে ইসরাইলের ৬ কোণা তারকা।’ থামল আহমদ মুসা।
সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে-মুখে প্রবল বিস্ময়। সে একবার চাইল আয়েশা আলিয়া কাতানীর দিকে। একটু চিন্তা করল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
ভেতরে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘আহমদ মুসা তুমি একটু বস। আর আয়েশা বোন তুমি একটু আমার সাথে এস।’
আয়েশা আলিয়া কাতানীও উঠে দাদুর সাথে ভেতরে গেল।
দু’জনের মুখই গম্ভীর।
সরদার জামাল উদ্দিন গিয়ে ঢুকল নাতি আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের কক্ষে।
‘দাদু তুমি ভাইয়াকে দেয়া তাদের মেশিনগান ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেটটা দেখবে নাকি?’ বলল আয়েশা আলিয়া কাতানী।
‘হ্যাঁ বোন। আহমদ মুসা হয় ইবলিস শয়তানের চেয়েও বড় কেউ, অথবা জিবরাইলের মতো সৌভাগ্যের কোন ফেরেশতা। তার কথার বিষয়টা পরখ করা যাবে আমাদের আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের মেশিনগান ও ঐ জ্যাকেট থেকে।’ সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী বলল।
ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে হ্যাংগার থেকে জ্যাকেট এবং ওয়াল ক্যাবিনেটের ভেতরের দেয়ালের গোপন কুঠরী থেকে হ্যান্ড মেশিনগান বের করে নিল।
দু’টি জিনিস টেবিলে রেখে দাদু ও নাতনি হুমড়ি খেয়ে পড়ল আহমদ মুসার কথার সত্যাসত্য পরখ করার জন্যে।
দেখল তারা হ্যান্ড মেশিনগান এবং জ্যাকেটের কলার ব্যান্ডের ভেতরের পাশ।
দু’জনেই মুখ তুলল।
বিস্ময়-বিস্ফোরিত দু’জনেরই চোখ।
আহমদ মুসা যা বলেছে হুবহু তারা তাই দেখতে পেল। হ্যান্ড মেশিনগানের গায়ে শুধু হিব্রু অক্ষর ও সংখ্যাই নয়, প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডেভিড বেনগুরিয়ান ষ্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং’ কোম্পানির নামও খোদাই করা হয়েছে। জ্যাকেটের কলার ব্যান্ডেও মনোগ্রাম তারা পেল ঠিক আহমদ মুসা যেমন বলেছে।
‘দাদু উনি যা বলেছেন, ঠিক তেমনটাই তো পাওয়া গেল।’ বলল আয়েশা আলিয়া কাতানী।
সরদার জামাল উদ্দিন আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তার কপাল কুঞ্চিত। ভাবছে সে। বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না বোন ঘটনা আসলে কি। মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট (এমপিএম) সম্পর্কে তার বক্তব্য মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু তার উলেস্নখিত প্রমাণগুলোকেও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। দুটি প্রমাণ তো আমরা এখানে দেখলাম। আর মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট (এমপিএম) এর শীর্ষ যাদেরকে আমি দেখেছি তাদের বেশির ভাগই তো বিদেশী! কিন্তু মুসলমান নয়- এটা আমি মানতে পারছি না। শীর্ষ নেতা হাবিব হাসাবাহ একজন খুবই পরহেজগার মানুষ। আহমদ মুসার এই অভিযোগ অবিশ্বাস্য।’
‘কিন্তু দাদু তার কথাগুলো যে সত্যি প্রমাণিত হলো, তার ব্যাখ্যা কি?’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘এখানে এসেই তো আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ছয় কোণা তারকা, ক্রিসেন্টের বুকের উপর ব্ল্যাক ঈগল এবং ইসরাইলের তৈরি অস্ত্র এসব ছোট বিষয় নয়।’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল।
কথা শেষ করেই চলতে শুরু করে বলল, ‘এস আয়েশা বোন। ও একা বসে আছে।’
দু’জনেই ড্রইংরুমে ফিরে গেল।
আহমদ মুসার মুখে হাসি। বলল, ‘আসুন জনাব। বসুন। আমার জন্যে কোন সুখবর আছে কি জনাব?’
গম্ভীর মুখ সরদার জামাল উদ্দিনের। আহমদ মুসার কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বল, তোমার কথা যদি ঠিক হয়, ওরা যদি ‘ব্ল্যাক ঈগল’ই হয়ে থাকে, তাহলে পাত্তানীদের নেতা জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন ওদের সাথে এক হয়ে সংগ্রাম করছে কেন? এই তো সেদিন পাত্তানী শহরের উপকণ্ঠে ওদের এক অভিযানে জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐ অভিযানে তিনি আহত হন। তার রক্তমাখা জামা থাই সৈন্যরা উদ্ধার করেছে। এর ছবি তারা সংবাদপত্রে প্রকাশও করেছে। এটা তুমি কি করে অস্বীকার করবে?’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ জনাব, আপনি যা বলেছেন, থাই সরকারও আমাকে এ কথাই বলেছিল। তারা আমাকে নতুনভাবে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, আমি ঘটনাকে যেভাবে দেখছি সেটা ঠিক নয়। জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিনকে তার দলের লোকরাই পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সে নিজে অংশগ্রহণ করছে। তার রক্তাক্ত জামা এর সর্বশেষ প্রমাণ। কিন্তু থাই সরকারের এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত হইনি। আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম………….।’
আহমদ মুসা আর সামনে এগুতে পারল না।
ড্রইং রুমের বাইরের দরজায় একটা শব্দ হয়েছে এবং তার সাথে একটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠেছে, ‘থাম মিথ্যাবাদী। থাই সরকারের কুত্তা, এজেন্ট থাম।’
সবারই মাথা এক সাথে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে শব্দ লক্ষে।
আহমদ মুসা দেখল একজন তরুণ যুবক। তার দুই হাতে দুই রিভলবার তাক করা আহমদ মুসার দিকে।
যুবকটি আহমদ মুসার ডান পাশ থেকে সোজা পূর্বে আট দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বসে আছে উত্তরমুখী হয়ে। তার সামনে সরদার জামাল উদ্দিন। তার পেছনে আয়েশা আলিয়া।
যুবকটিকে দেখে সরদার জামাল উদ্দিনের কণ্ঠ থেকে স্বগত একটা উক্তি বেরিয়ে এল, ভাই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন!
আয়েশা আলিয়ার মুখ ফুটেও একটা স্বগোতুক্তি বেরিয়ে এসেছে, ‘ভাইয়া।’
প্রথমটায় সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া দু’জনকেই বিস্ময় এসে ঘিরে ধরেছিল।
বিস্ময় থেকে মুক্ত হয়ে সরদার জামাল উদ্দিন তার নাতি আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘কি করছ তুমি রিভলবার নামও। ইনি আমাদের মেহমান।’
‘না দাদু ইনি মেহমান হতে পারেন না। এর ফটো আমি দেখেছি। এ খুনি বিভেন বার্গম্যান। এ পর্যন্ত এ আমাদের মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্টের প্রায় এক শতের মতো লোককে হত্যা করেছে। এর কারণেই গ্রেফতার হয়েছে আমাদের অর্ধশতের মতো লোক। একে দেখা মাত্র হত্যার নির্দেশ আছে।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দু’চোখ বারুদে আগুন লাগার মতো জ্বলছিল। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার দুই তর্জনি দুই রিভলবারের ট্রিগারে চাপ বাড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসার বাম পকেট থেকে তার বাম হাতে রিভলবার আগেই উঠে এসেছিল।
গুলী করার পূর্ব মুহূর্তে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দুই রিভলবারের নল শেষ বারের টার্গেট এডজাষ্ট করে নিচ্ছিল।
‘ভাইয়া গুলী করো না, শোন।’ বলে চিৎকার করে উঠল আয়েশা আলিয়া কাতানী।
ঠিক এ সময় আহমদ মুসার বাম হাত চোখের পলকে ছুটে যায় ডান পাশে। হাতে কালো রংয়ের ছোট রিভলবার। রিভলবার থেকে দুটি গুলীর শব্দ হলো।
বাম হাতটা ছুটে আসা ও গুলী করার সেকেন্ডের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেল।
আহমদ মুসার দুটি গুলী লেগেছিল যুবকটির দুই হাতের দুই রিভলবারে। দুটি রিভলবারই যুবকটির হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার রিভলবার যুবকটির দিকে উদ্যত রেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। ছিটকে পড়া রিভলবার দু’টি কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যুবকটির মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন এস, বস। তোমার সব অভিযোগ শুনব।’
কল্পনার চেয়ে দ্রুত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।
বিমুঢ় ভাব কাটলে তার চোখে সেই বারুদের আগুন আবার জ্বলে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
‘যা বলবে, সব বসে বল।’ বলে আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে তাকে টেনে এনে তার দাদুর পাশে বসাল। আহমদ মুসার বাম হাতে তখনও উদ্যত রিভলবার।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া দু’জনেই অবিশ্বাস্য এক ঘটনা দেখে বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। যখন তারা সম্বিত ফিরে পেল, খুশি হলো যে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের কোন ক্ষতি হয়নি, আহমদ মুসাও বেঁচে গেছে।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন পাশে এসে বসার পর সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ আহমদ মুসা তোমার গুলী নিখুঁত হওয়ার জন্যে। আমার অবাক লাগছে, এত দ্রুত করা গুলী এত নিখুঁত হলো কি করে!’
‘দাদু, এর নাম আহমদ মুসা নয় বিভেন বার্গম্যান।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তার কন্ঠ ক্রোধ ও ক্ষক্ষাভে ভরা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘দু’দিন আগ পর্যন্ত ওরা আমার নাম ‘বিভেন বার্গম্যান’ই জানত। কিন্তু দু’দিন হলো তারা জানতে পেরেছে, আমি আসলে আহমদ মুসা। এরপরই তারা দেখামাত্র আমাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।’
‘কিন্তু আজও ওদের কাছে আপনার নাম বিভেন বার্গম্যান শুনেছি।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘তুমি মুসলমান। তুমি কেন, কোন মুসলমানের কাছেই আমার নাম ‘আহমদ মুসা’ একথা তারা প্রকাশ করবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘নাম নিয়ে তোমার প্রশ্ন থাক কামাল। জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিনের রক্তমাখা জামা নিয়ে উনি কথা বলছিলেন। তুমিও শুনেছ। কথাটা তাঁকে শেষ করতে দাও।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসা তাকাল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ কামাল, আমার বিরুদ্ধে তোমার যে অভিযোগ, এ থেকেও তারও কিছু জবাব তুমি পেয়ে যাবে।’
আহমদ মুসা একটু থামল। পরক্ষণেই আবার বলা শুরু করল, ‘সরদার সাহেব, আমি বলেছিলাম জাবের জহীর উদ্দিনের কথিত রক্ত মাখা জামা সম্পর্কে আপনি যা বললেন, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন যা মনে করে, থাই সরকারও আমাকে এটাই বুঝাবার চেষ্টা করেছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, থাইল্যান্ডে সন্ত্রাস মুসলমানরা করছে না। করছে তৃতীয় একটি ষড়যন্ত্রকারী পক্ষ। এবং জাবের জহীর উদ্দিনকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে তার বন্ধুরা নয় শত্রুরা। তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তারা তাকে ব্যবহার করতে চায়। আমার এ মতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্যে থাই সরকার থেকে আমাকে বলা হয়, জাবের জহীর উদ্দিনের রক্তমাখা জামা সংঘর্ষের স্থলে পাওয়াই প্রমাণ করে জাবের প্রত্যক্ষভাবে সংঘর্ষে অর্থাৎ সন্ত্রাসে অংশগ্রহণ করেছিল। অতএব আমার কথাকে তারা অসত্য বলে অভিহিত করে। আমি তাদেরকে অনুরোধ করি, সংঘর্ষেল সময় এবং জাবেরের জামায় যে রক্ত পাওয়া গেছে তা ঝরার সময় এক কিনা পরীক্ষা করে দেখুন। সংঘর্ষ ও জামায় রক্ত লাগার সময় যদি এক হয়, তাহলে সংঘর্ষে জাবের জহীর উদ্দিন অংশগ্রহণ করেছিল বুঝা যাবে। আর যদি সময় এক না হয়, তাহলে প্রমাণ হবে জাবের জহীর উদ্দিন সংঘর্ষে অংশ নেয়নি। রক্ত পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে জামার রক্ত লাগার সময় ও সংঘর্ষের সময় কয়েক ঘণ্টা আগের। তার মানে জাবের জহীর উদ্দিন সংঘর্ষে অংশগ্রহণের কথা মিথ্যা।’
বিস্ময়ে হা হয়ে গিয়েছিল সরদার জামাল উদ্দিনের মুখ। আয়েশা আলিয়ার মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল।
বিস্ময়ের একটা ছায়া নেমেছে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের চোখে-মুখে। কিন্তু চোখে-মখের বিক্ষুব্ধ ভাব তখনও অটুট আছে। বলল, ‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন জাবের জহীর উদ্দিন মহোদয়ের রক্তমাখা জামা তারা সংঘর্ষের স্থানে নিয়ে গিয়েছিল এবং তা ওরা ফেলে রেখে এসেছিল জাবের জহীর উদ্দিন সংঘর্ষে অশং নিয়েছিল, এটা প্রমাণের জন্যে।’
‘আমি বলতে চাচ্ছি শুধু নয়, এটাই সত্যি আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু কেন আপনি বলতে চাচ্ছেন? আপনি কে? কেন আপনি আমাদের সংগ্রাম বিকৃত করছেন। কেন আপনি আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন?’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের মুখ থেকে বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে এল কথাগুলো।
আহমদ মুসা প্রথমে হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন আমি নাক গলাইনি, তোমাদের ঘটনা আমার নাককে তার মধ্যে টেনে এনেছে।’
বলে আহমদ মুসা থাইল্যান্ডে প্রথম যেদিন সে ল্যান্ড করে হোটেলে আসছিল, তখন সে কিভাবে জাবের জহীর উদ্দিনকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার মধ্যে পড়ে যায়, কিভাবে তার ট্যাক্সি পুলিশ দখল করে, কিভাবে পুলিশের হাতে সে বন্দী হয়, কিভাবে সে আহত হয়েও ডজন খানেক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে, পুলিশ ও সরকারের আস্থা অর্জনের পর কিভাবে সে জাবের জহীর উদ্দিন ও থাই মুসলমানদের সন্ত্রাস থেকে আলাদা করার এবং সন্ত্রাসের জন্যে দায়ী তৃতীয় পক্ষকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে, কিভাবে ব্যাংককে তার উপর বার বার আক্রমণ হয় সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে, কিভাবে সন্ত্রাসীরা তাকে থাইল্যান্ড ছাড়ার জন্য আলটিমেটাম দেয়, হোটেলে কিভাবে সন্ত্রাসীদের লোকরা তার হাতে ধরা পড়ে, কিভাবে তাদের কাছ থেকে জানতে পারে যে জাবেরকে পাত্তানীর এক জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে, কিভাবে আহমদ মুসা কৌশল করে পাত্তানী যাত্রা করে এবং পথে কি ঘটে, পাত্তানীতে আসার হোটেলে কিভাবে সে সন্ত্রাসীদের চোখে পড়ে যায়, কিভাবে সে হোটেল বয়ের মাধ্যমে শাহ পরিবারের সন্ধান পায়, তাদের বাড়ি দেখতে গিয়ে কিভাবে সে শাহবাড়ির নিচের মেলায় সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, কিভাবে সে সেই রাতে শাহবাড়িতে যায় এবং শাহ পরিবারের উপর সন্ত্রাসীদের আক্রমণ নস্যাৎ করে কিভাবে শাহ পরিবারকে এক বিপর্যয় থেকে বাঁচায় এবং এরপর কিভাবে শাহ পরিবারের সাথে জড়িয়ে পড়ে, কিভাবে তাদের উপর বার বার আক্রমণ হয়, কিভাবে তারা রক্ষা পায় ও অনেক সন্ত্রাসী বন্দী হয় এবং সব শেষে কিভাবে সে পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের বিষয় আঁচ করে এবং কিভাবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষা ও সন্ত্রাসীরা পাকড়াও হয়, কিভাবে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যার আলটিমেটাম দেয়া হয়, কিভাবে আহমদ মুসাকে হত্যার জন্যে সন্ত্রাসীরা সর্বাত্মক জাল পাতে, কিভাবে আহমদ মুসা শাহ বাড়ির ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে সন্ত্রাসীদের ফাঁকি দিয়ে ‘হাঁটাই’তে আসে এবং সেখান থেকে কিভাবে মালয়েশিয়ার সুংগাই পেতানীতে আসে এবং সেখান থেকে কিভাবে সে বেতাংগ এল তার সংক্ষিপ্ত ও ধারাবাহিক বিবরণ আহমদ মুসা তুলে ধরল।
আহমদ মুসা যখন কথা শেষ করল, তখন সরদার জামাল উদ্দিন, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া তিনজনই যেন স্বপ্নের জগতে। তাদের বিস্ময় বিস্ফোরিত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর আঠার মতো লেগে আছে। তাদের চোখের পাতাও যেন নড়ছে না। বাকরুদ্ধ তারা।
আহমদ মুসাও দীর্ঘ কথা শেষ করে সোফায় হেলান দিয়েছে।
পল পল করে বেশ কতকটা সময় বয়ে গেল। তারা কথা বলল না।
আহমদ মুসাই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘কি ব্যাপার আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন কথা বলছ না যে! আমার কথা বিশ্বাস করছ না? রূপ কথা মনে করছ আমার কথাকে?’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন মুখ নিচু করল।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়ার মুখ নিচু হয়ে গেছে।
কথা বলল না তাদের কেউ।
বাইরে বৃষ্টি তখন থেমে গেছে।
নিস্তব্ধ চারদিকে।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে আবার কিছু বলতে গিয়েছিল আহমদ মুসা। কিন্তু দেখল তার নত মুখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে উরুর উপর রাখা তার দুই হাতের উপর। আয়েশা আলিয়ারও দুই গন্ড অশ্রুসিক্ত দেখতে পেল সে। শুধু মুখ শুকনো সরদার জামাল উদ্দিনের।
আহমদ মুসার মনটাও আবেগ প্রবণ হয়ে উঠল। কিন্তু নরম সান্তনা নয়, শক্ত কথাই বলল আহমদ মুসা, ‘অশ্রু মুছে ফেল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন, তোমাদের মতো তরুণদের চোখে আগুন থাকবে, অশ্রু নয়।’ শক্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
মুখ তুলে তাকাল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন আহমদ মুসার দিকে।
তার মতো সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়াও তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তার মুখ গম্ভীর। বলল, ‘সত্যি জনাব, আপনার শক্ত কণ্ঠ আমার কাছে নেতার আদেশের মতো মনে হয়েছে।’ বলতে গিয়ে তার চোখে অশ্রুর একটা ঢেউ এল আবার।
আবার চোখ মুছল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘হয়তো শুনেছ নেতার কণ্ঠ। কিন্তু আমি নেতা নই কামাল। আমি কর্মি। কাজ করে বেড়াই আমি।’
‘সত্যিকার নেতারাই এমন কথা বলতে পারেন স্যার।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
সেও তার চোখের অশ্রু মুছে ফেলেছে।
‘কিন্তু প্রথমেই আপনি শাহ বাড়ির কথা কেন বলেননি? কেন বলেননি যে আপনি শাহ পরিবার থেকে এসেছেন? জানেন ঐ বাড়ি আমাদের কেন্দ্র। ঐ পরিবার আমাদের নেতা।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠে অশ্রুভেজা আবেগ।
‘শুরুত বললে এভাবে তোমরা বিশ্বাস করতে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার একটা ব্যাপার খুব বিস্ময় লাগছে। শাহ পরিবারের সাথে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আপনি একাত্ম হয়ে গেলেন? শাহ পরিবার খুবই ধার্মিক পরিবার। আমি শুনেছি, বাইরের মানুষের সাথে মেলামেশা তো দূরে থাক সাক্ষাতও ওদের হয় না। আপনি কি আগে থেকে ওঁদের পরিচিত ছিলেন?’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘আমি কোনভাবেই পরিচিত ছিলাম না। এমনকি শাহ পরিবার সম্পর্কে আমার বলতে গেলে কিছুই জানা ছিল না। তবে থাইল্যান্ডে আমার আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। সে কাহিনীর সাথে এই পরিবার জড়িত।
বিস্ময়-কৌতুহলের একটা ঢেউ খেলে গেল ওদের তিনজনের চোখে-মুখে। আয়েশা আলিয়াই দ্রুত বলে উঠল, ‘কাহিনীটা কি সত্যি ঘটনা?’
‘সত্যি ঘটনা। তবে রূপকথার চেয়ে মজার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি সে ঘটনা?’ দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসা সোফায় হেলান দিয়ে বসল। বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘রূপকথা সাধারণত বড় হয়। এ রূপকথা কিন্তু খুব বড় নয়। ঘটনার সূত্রপাত আন্দামানে। আমি সেদিন আন্দামানে ঠিক আন্দামান সাগরের উপর দাঁড়ানো এক ড্রইং রুমে অনেকের সাথে বসে। বসে আছি জানালার পাশে। দৃষ্টি ছিল আদিগন্ত সাগরের দিকে। হঠাৎ………….।’
‘স্যার’ বলে কথার মাঝখানে বাধ সাধল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
তার চোখে-মুখে যেন একটা প্রশ্ন ঠিকরে পড়ছিল।
থেমে গেল আহমদ মুসা।
‘স্যরি’ বলে কথা শুরু করল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন, ‘স্যার আন্দামান সরকারের সাথে কি আপনার সংঘাত বেঁধেছিল?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আগে জবাবটা দিন। কারণ বলছি।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘আন্দামান সরকারের সাথে আমার সংঘাত বাধেনি। আন্দামান সরকারের গভর্নর একটি গোপন সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা ছিলেন, সে সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে আমার সংঘাত বেধেছিল। আর সন্ত্রাস থেকে মানুষকে রক্ষা করা, বাঁচানো যদি সন্ত্রাস হয় তাহলে সে সন্ত্রাস আমি করেছি।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন তার সোফায় বলা যায় এ্যাটেনশন হয়ে বসেছে। তার চোখ দু’টিতে অপার বিস্ময়। সেই সাথে তার চোখ জুড়ে একটি ঔজ্জ্বল্য। আহমদ মুসা থামলেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল, ‘আপনি যাদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলছেন, তাদের সাথে দুনিয়ার আর কোথাও কি আপনার সংঘাত হয়েছে?’
‘আন্দামানে যাদের সাথে আমার সংঘাত হয়েছে, তারা ভারতের। কিন্তু তাদেরকে সাহায্য করেছে ইহুদীবাদী গোয়েন্দারা। এই ইহুদীবাদী সংগঠনের সাথে দুনিয়ার নানাস্থানে আমার সংঘাত হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সম্প্রতি কিছুদিন আগেও আমেরিকায় সংঘাত হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের। ওর কণ্ঠ ভারী ও ভেঙে পড়ার মতো।
‘হ্যাঁ, আমেরিকায়ও হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসল। তারপর আহমদ মুসার দুই হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে বলল, ‘আমাকে মাফ করুন স্যার। আমি কি অকথ্য ভাষায় আপনাকে গালি দিয়েছি। আপনাকে হত্যা করার জন্যে রিভলবার উঠিয়েছিলাম। এমনকি আপনার ‘আহমদ মুসা’ নাম শুনেও বুঝতে পারিনি যে, আপনি সেই মহান বিপ্লবী!’ অপরিসীম আবেগের বিস্ফোরণ ঘটার মতো তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল এবং তার চোখ ফেটে অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা হেসে তাকে তুলে পাশে বসাল। বলল, ‘তুমি যা করেছ তার মধ্যে দিয়ে জাতির প্রতি তোমার ভালোবাসারই প্রকাশ ঘটেছে। অন্যায় কিছু করনি।’
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল সরদার জামাল উদ্দিন এবং আয়েশা আলিয়া। আহমদ মুসা থামতেই সরদার জামাল উদ্দিন আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা। আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘কিছুই না জনাব, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন আমার পরিচয় উদ্ধার করে ফেলেছে।’
‘কি পরিচয় পেল? কিভাবে পেল?’ বলল আয়েশা আলিয়া।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন চোখ মুছে বলল, ‘দাদু, আয়েশা, ওনার পরিচয় দিতে গেলে একটা বিরাট বক্তৃতা দিতে হবে। এইটুকু শুনুন, দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান মেহমান আমাদের ঘরে এসেছেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।’
বিস্ময় বিস্ফোরিত হযে উঠেছে আয়েশা আলিয়ার চোখ। অভিভূতের মতো যেন অজান্তেই সে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘ভাইয়া, ইনি তাহলে কি সেই আহমদ মুসা?’
‘হ্যাঁ আয়েশা, এঁর কথাই আমরা পত্রিকা, ম্যগাজিন ও ইন্টারনেটে পড়েছি।’
ধপ করে সোফায় বসে পড়ল আয়েশা আলিয়া। মুখ ঢাকল দু’হাত দিয়ে। যেন নিজেকে সে আড়াল করতে চায় আহমদ মুসার কাছ থেকে।
বিস্ময় সরদার জামাল উদ্দিনের চোখেও। বলল, ‘আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা। কয়েক দিন আগে ইন্দোনেশিয়ার পাহাড়ি কবিলাদের এক সম্মেলনে দেখা হয়েছিল মিন্দানাওয়ের প্রেসিডেন্ট মুরহামসারের সাথে। তিনি এক আহমদ মুসার গল্প করেছিলেন। গল্পটা যেন জগৎ জোড়া এক রূপকথা। এই রূপকথার আহমদ মুসার কাছে কিংবদন্তীর রবিনহুড, শার্লক হোমস তো বাচ্চা শিশু। সেই আহমদ মুসা নাকি এখন আন্দামানে, বলেছিলেন মুরহামসার। সেই তিনি এখন আমার বৈঠক খানায়! আমার সামনে!’
কথা শেষ করেই সরদার জামাল উদ্দিন চোখের পলকে গিয়ে আহমদ মুসার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল এবং মাথা নুইয়ে আহমদ মুসার হাত চুম্বন করল।
আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনকে টেনে তুলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি দুঃখিত। আপনি আমাকে আপনার নাতির মতো বলেও আমার পায়ের কাছে এসে বসেছেন। এটা ঠিক হয়নি।’
‘দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আনুগত্য প্রকাশের, বুজুর্গের প্রতি শদ্ধা নিবেদনের এটাই আমাদের যুগ যুগান্তের পাহাড়ী রীতি।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘কিন্তু এটা ইসলামী রীতি নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
সরদার জামাল উদ্দিন আহমদ মুসাকে বসিয়ে নিজে তার সোফায় ফিরে গেল। বলল, ‘এটা একটা রীতি মাত্র। ইসলাম লোকাল অনেক রীতিকেই গ্রহণ করেছে। আমাদের শাহ পরিবারের শেখ আবদুল কাদেরের কাছে এটা শুনেছি। তিনি এ রীতিকে অনুমোদন দিয়েছেন।’
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘থাক এ প্রসংগ এখন। আমি উঠতে চাই।’
‘না উঠবে কোথায়। তোমার হোটেলে থাকা চলবে না। আমি হোটেলে টেলিফোন করে দিচ্ছি, তোমার ব্যাগ সব দিয়ে যাবে কিংবা কামালকে পাঠাচ্ছি। সে গিয়ে নিয়ে আসবে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘না জনাব, হোটেলে থাকাই আমার কাজের জন্যে সুবিধাজনক। আমি উঠি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখানে থেকে দেখ কোন অসুবিধা হয় কিনা। অসুবিধা হলে আমিই তোমাকে হোটেলে দিয়ে আসব। আর আমি যা বুঝেছি, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে গোটা বেতাংগ শুধু নয় সমগ্র কাতান পাহাড় অঞ্চলে আমার বাড়ির চেয়ে নিরাপদ জায়গা কোথাও নেই।’
আহমদ মুসা কৌতুহলি দৃষ্টি নিয়ে তাকাল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানীর দিকে।
হাসল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী। বলল, ‘তুমি কোহেতান কবীর’ পরিবারকে খুঁজছ না? আমাদের কবিলাই সেই পরিবার।’
‘কিন্তু বাড়ির নেমপ্লেটে তো তা লেখা নেই?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা বাড়ির একটা ছদ্মবেশ।’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল।
‘কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
সরদার জামাল উদ্দিন গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘কোহেতান কবীর’ পরিবার তুমি যাকে ‘ব্ল্যাক ঈগল’ বলছ, আমরা যাকে মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ বলি তার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। এর পরেই এই ছদ্মবেশ সতর্কতার জন্যে।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দ দুয়েরই প্রকাশ ঘটল। তার মনে হলো, সে তার মিশনের সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছে গেছে। এই পরিবার কাতান টেপাংগো যাওয়ার রাস্তাও চেনে, ‘ব্ল্যাক ঈগল’দেরও চেনে।
‘আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি যে তিনি এভাবে আমাকে আপনাদের মধ্যে এনে দিয়েছেন। এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিনগুলির একটি। আমি আপনাদের সাহায্য চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পরিস্থিতি তোমার কাছে যা শুনলাম তাতে আমরা তোমাকে সাহায্য করা নয় আমাদেরই তোমার সাহায্য ভিক্ষা করা উচিত যা শাহজাদী যয়নব যোবায়দা করেছে। কিন্তু এ প্রসংগ আপাতত মুলতবী থাক। এখন তুমি মুখ-হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেক ভিজে গেছ তুমি।’
বলেই সরদার জামাল উদ্দিন তাকাল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, কামাল তুমি এঁকে টয়লেট দেখিয়ে দাও এবং একপ্রস্ত পোশাক এনে দাও। আর বোন আয়েশা তুমি যাও উপরের গেষ্টরুমে বেড ও সবকিছু ঠিক-ঠাক করে দাও।
উঠল সরদার জামাল উদ্দিন।
উঠল সবাই।

মাগরিবের নামাযে ইমামতি করল আহমদ মুসা।
নামায শেষ করেই সরদার জামাল উদ্দিন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মুয়াজ্জাজ ভাই আহমদ মুসা, তোমার সাথে জরুরি আলাপ আছে। কিন্তু একটু বাজারে যেতে হবে আমাকে। আমি এখনি আসছি।’
উঠে দাঁড়াল সরদার জামাল উদ্দিন। বলল আয়েশা আলিয়াকে, ‘আয়েশা বোন, তুমি এর মধ্যে চা-টা নিয়ে এস।’
চলে গেল সরদার জামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসারা সবাই জায়নামায থেকে সোফায় ফিরে এল।
আহমদ মুসার সামনের সোফায় বসল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। পাশে একটু দূরের সোফায় বসল আয়েশা আলিয়া।
বসেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল আহমদ মুসকে, ‘স্যার কুরআন শরীফে ইহুদী-নাসারাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তার মানে তাদেরকে সব সময় শত্রু হিসাবে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা জানার জন্যে প্রশ্ন করেছি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বন্ধু ও শত্রুতার নীতি নির্ণয় করতে হবে আল-কুরআন সামগ্রিকভাবে যে নীতি নির্ধারন করেছে, তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন সুরা মায়েদার ৫১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘হে মুমিনগণ, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরষ্পর বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধরূপে গ্রহণ করলো সে তাদেরই একজন হবে। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’ আল্লাহর এই নির্দেশ এমন সময়ে নাজিল হয়েছিল, তখন ছদ্মবেশী মুনাফিকরা ইহুদী-নাসারাদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কোন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে যোগদানের ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কোন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে যোগদানের ষড়যন্ত্র করেছিল। মুসলমানদের যুদ্ধরত প্রতিপক্ষের সাথে সম্পর্কের নীতি হিসেবেই আল্লাহ এই আদেশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে এই নীতি অবশ্যই পালনীয়। এই নীতি সব সময় সব ক্ষেত্রে পালনীয় হবে না তা আল্লাহ রাববুল আলামিনই বলে দিয়েছেন। আল-কুরআনের সূরা ‘মুমতাহানা’র ৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেছেন, ‘‘আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দীনের (বিশ্বাস ও ধর্মের) ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কার সাহায্য করেছে। তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারা তো জালিম।’’ আল্লাহর এই আদেশে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্ম ও বিশ্বাসের সাথে যারা যুদ্ধ করেনি, বৈরিতা করেনি এবং যুদ্ধ ও বৈরিতায় সাহায্য করেনি, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়নি। আর কারো সাথে এবং কোন জাতির সাথে বন্ধুত্ব ও শত্রুতাকে আল্লাহ স্থায়ী বিষয়ও করেননি। আল্লাহ তায়ারঅ সূরা ‘মুমতাহানা’র ৭ আয়াতে বলেছেন, ‘যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে সম্ভবত আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
কথা শেষ করল আহমদ মুসা। তারপর আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘বিষয়টা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে কামাল?’
‘স্যার জটিল বিষয়টাকে আপনি খুব সহজ করে বললেন।’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহ তার দীনকে তার বান্দাদের জন্যে সহজ করেছেন, কঠিন করেননি। আর আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন ইহুদী নাসারাসহ সব মানুষের জন্যে। কারও সাথে যুদ্ধমান পরিস্থিতি না থাকলে তার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। সুতরাং এ ধরনের সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যা স্বাভাবিক সম্পর্ক অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।’
‘কিন্তু স্যার, সত্য ও অসত্য তো দ্বন্দ্বমান। সত্যের শত্রু অসত্য এবং অসত্যের শত্রু সত্য। এ দুয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব সহযোগিতা তো হতে পারে না।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, সত্য ও অসত্য চির দ্বন্দ্বমান। কিন্তু সত্যপন্থী ও মিথ্যা-পন্থীর দ্বন্দ্ব চিরন্তন নয়, শত্রুতাও তাদের চিরস্থায়ী নয়। মিথ্যাপন্থী যে কোন সময় সত্যপন্থী হয়ে যেতে পারে। এ লক্ষে চেষ্টা করাও সত্য-পন্থীর দায়িত্ব এবং এজন্যে মিথ্যাপন্থীর সাথে একটা প্রয়োজনীয় সম্পর্ক তার রাখা প্রয়োজন। এ সম্পর্ক রক্ষার দাবি হলো, মিথ্যাপন্থী শত্রু হলেও সর্বাবস্থায় তার প্রতি সুবিচার করতে হবে। এই আদেশ আল্লাহ কুরআন শরীফে সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। সূরা মায়িদার ৮ আয়াতে তিনি বলছেন, ‘কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সদা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর।’ ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে এই সুবিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ ইসলামে অবশ্য পালনীয় বিষয়।
‘আপনার কথা বুঝেছি স্যার। আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের সহাবস্থান ও সহযোগিতা খুব কঠিন এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অসত্যপন্থীদের সংস্পর্শ-সাহচার্যে সত্যপন্থীদের কাজ ও বিশ্বাসেও বিচ্যুতি আসতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এর সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তোমার আশঙ্কা ঠিক। সত্যপন্থীরা জ্ঞান, বুদ্ধি, উদ্যোগ, আয়োজনে দূর্বল হয়, তাহলে তোমার আশঙ্কা সত্য হতে হবে, ইতিহাসও এর সাক্ষী। আর সত্যপন্থীরা যদি সর্বক্ষেত্রে সফল হয়, তাহলে তোমার আশঙ্কার উল্টোটা ঘটবে। তোমাদের খুব কাছের একটা দেশের দৃষ্টান্ত দেখ। বাংলাদেশ ভারত উপমহাদেশের একটা অংশ। ভারতে আটশ বছর মুসলিম শাসন ছিল এবং এই মুসলিম শাসনের কেন্দ্র ছিল দিলস্নী। শাসনের শক্তি, প্রভাব, প্রতিপত্তি সবকিছুর চুড়ান্ত প্রদর্শনি ছিল সেখানে। মুসলিম শাসনকেন্দ্রের আটশ’ বছরের প্রভাব-প্রতিপত্তি সত্ত্বেও দিলস্নী ও তার আশ-পাশের অঞ্চলে মুসলমানরা সাংঘাতিকভাবে সংখ্যালঘিষ্ট। মুসলিম শাসনকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে ছিল বাংলাদেশ প্রদেশটি। অথচ এই বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর কারণ বাংলাদেশে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল না, ফলে উন্নততর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বেশি কাজ করেছে। প্রতিটি মানুষই শান্তি, সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবন চায়। শাসকের তলোয়ারের ছায়া থেকে অনেক দূরে মুসলিম শাসনের একটি প্রদেশ বাংলাদেশে ইসলামের মহান অনুসারীরা তাদের কাজ, কথা ও চরিত্রের মাধ্যমে আপামর মানুষদের শান্তি, সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবনের সন্ধান দিয়েছিল। তার ফলেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। সুতরাং উন্নততর ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারী মানুষদের সহাবস্থানে ভয় করার কিছু নেই।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা শুনছিল আহমদ মুসার। তাদের ধর্ম ইসলামের এক নতুন রূপ তাদের সামনে আসছে জীবন্ত হয়ে, যে সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান ছিল না।
এবার মুখ খুলল আয়েশা আলিয়া। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে স্যার। প্রথম দিন থেকেই আপনার কাছে নতুন কথা শুনছি এবং সত্য হিসাবে তা শিরোধার্য হয়ে উঠেছে।’
আয়েশা আলিয়া থামতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘হতেই হবে। তার পরিচয় সামনে রাখলে এ প্রশ্নও তোমার মনে উঠতো না। যাক। কিন্তু………..।’
বলেই কথা শেষ না করে থেমে গেল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। একটা ঢোক গিলল। কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘কিন্তু আমীর হাবিব হাসাবহ এতটাই উল্টো ব্যাখ্যা করেন তাহলে?’
‘কি নাম বললে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হাবিব হাসাবাহ।’ বলল আবদুল কাদের।
‘কে তিনি? কিসের আমীর তিনি?’ আহমদ মুসার প্রশ্ন।
‘কেন তিনি আমাদের পাত্তানী মুজাহেদীনদের আমীর!’
‘হাবিব হাসাবাহ। কতদিন থেকে তাকে তোমরা জান?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দু’ বছর।’ আবদুল কাদের বলল।
‘দুবছর আগে তিনি কোথায় ছিলেন, কি করতেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তা আমরা জানি না। তার আরও ঘনিষ্ঠজনরা তাকে জানতে পারেন। তবে শুনেছি, তিনি জার্মানীতে বসবাসকারী একটি থাই মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি আল আজহারে লেখা-পড়া করেছেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই মিশনারী চরিত্রের। শেকড় সন্ধানে তিনি থাইল্যান্ডে আসেন এবং জাতির দুঃসময় দেখে তাদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।’ থামল আবদুল কাদের।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জার্মানীতে তো নয়ই, কোন দেশেই কোন মুসলিমের নাম এমন হয় না। ‘হাসাবাহ’ শব্দটি হিব্রু, আরবী নয়। ‘হাবিব’ শব্দটি আরবী বটে, কিন্তু আরবী ইহুদীরা এই নাম ব্যবহার করে থাকে। এখন বল, লোকটি ‘থাই’ চেহারার?’
‘জি না। তার চেহারা আরবীদের মতো। শুনেছি, তার আববা থাই হলেও , মা আরবী। এ কারণেই তার আরবী চেহারা।’ বলল আবদুল কাদের।
‘আবদুল কাদের, লোকটি ইহুদী। তোমার মানতে কষ্ট হবে, কিন্তু তিনি ইহুদী হলে তবেই আজ থাইল্যান্ডে যা ঘটছে, তার সাথে তোমার আমীর হাবিব হাসাবাহর সম্পর্ক দাঁড় করানো যায়। হাবিব হাসাবাহ কোথায়………..।’
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা থামল।
‘দাদাজান এসেছেন।’ বলে আবদুল কাদের উঠে গেল দরজা খুলে দেবার জন্যে।
দরজা খুলে দিল আবদুল কাদের।
দাদাকে সালাম দিয়ে স্বাগত জানাল।
তার দাদা সরদার জামাল উদ্দিন ভেতরে প্রবেশ করলো। আবদুল কাদের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সামনে চোখ পড়তেই দেখল নিচে উপত্যকার দিক থেকে একজন লোক তার বাড়ির রাস্তা ধরে উপরে উঠে আসছে।
‘কে আসছে’ এই কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আবদুল কাদের।
লোকটি আরও সামনে এগিয়ে এল।
চেহারায় চোখ পড়তেই চমকে উঠল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। লোকটি ‘সাবাত সোলায়মান’। একজন থাই মুসলিম। সে বেতাং এলাকায় ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ ওরফে ‘ব্ল্যাক ঈগল’-এর নেতা হাবিব হাসাবাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রত্যেক এলাকায় এমন বিশেষ লোক রয়েছে। মনে করা হয়, এরা গোপন গেরিলা ইউনিটের সদস্য। এরা খুবই পাওয়ার ফুল। তাদের বাড়িতে সে কয়েকবার এসেছে।
আবদুল কাদের ভেতরে ছুটে গিয়ে তার দাদাকে বলল, ‘দাদা, সাবাত সোলায়মান আসছেন।’
‘সাবাত সোলায়মান? ভালো। খুব ভালো করিতকর্মা লোক। নিয়ে এস।’ বলেই হঠাৎ সরদার জামাল উদ্দিন বিমর্ষ হয়ে পড়ল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই তো?’
সাবাত সোলায়মান নামটা শুনেই চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। নামটা শুনেই বুঝেছিল ওটা ইহুদী নাম। নামটা শুনে ভ্রুটাও কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার। সে কি জেনে-শুনে আসছে? কিন্তু তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। আহমদ মুসা তার উদ্দেশ্যের কথা কারও কাছে বলেনি। বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই।’
‘আমি নিয়ে আসছি গিয়ে’ বলে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ছুটে গেল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সাবাত সোলায়মান এল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন তাকে সালাম দিল। সাবাত সোলায়মান সালাম নিয়ে বলল, ‘তোমাদের বাসায় যে মেহমান এসেছিলেন, তিনি আছেন?’
‘আছেন।’ বলল আবদুল কাদের।
‘চল।’ বলে দ্রুত উঠে এল বারান্দায়।
লোকটি বারান্দায় উঠে আসতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন দেখল সাবাত সোলায়মান লোকটি তার পেছনেই। ডান হাতটি তার পকেটে।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল তারা।
আহমদ মুসাসহ অন্য সবাই উঠে দাঁড়াল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন মেহমান সাবাত সোলায়মানকে বসতে বলার জন্যে তার দিকে তাকিয়েছিল। তাকিয়েই চমকে উঠল সাবাত সোলায়মানের হাতে রিভলবার দেখে।
সাবাত সোলায়মান আহমদ মুসাকে একনজর দেখেই পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাত বের করে এনেছিল এবং রিভলবার তুলেছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
সাবাত সোলায়মানের হাতের রিভলবার সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া দুজনেই দেখতে পেয়েছিল। তাদের চোখে আতংক।
বিমূঢ়ভাব আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনেরও।
আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তুলেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘সেদিন মসজিদেই তোমাকে চিনতে পেরেছি তুমি আহমদ মুসা। দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ তোমাকে। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্যে একটু অপেক্ষা করেছি। আজ তোমার ফটো পেয়েছি। কয়েকদিন জীবন বেশি পেলে। আজ তোমার দিন শেষ।’
কথা শেষ হবার আগেই তার রিভলবার থেকে গুলী বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসার দুচোখ স্থিরভাবে নিবদ্ধ ছিল সাবাত সোলায়মান লোকটির তর্জনির দিকে। আর তার ডান হাত সেঁটে ছিল পকেটের সাথে।
সাবাত সোলায়মানের তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসার সংগে সংগেই নিজের মাথা পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ছিটকে পড়েছিল সোফার উপর এবং এই ফাঁকে পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল রিভলবার। পিঠ দিয়ে সোফা স্পর্শ করতেই হাতে তুলে নেয়া রিভলবার থেকে পর পর দুটি গুলী করেছিল আহমদ মুসা।
সাবাত সোলায়মান তার প্রথম গুলীকে ব্যর্থ হতে দেখে নতুন টার্গেটে রিভলবার নামিয়ে নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সময়েই আহমদ মুসার প্রথম গুলী এসে বিদ্ধ হলো তার হাতে। হাতের রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল। আহত হাতের প্রতি কোন ভ্রুক্ষক্ষপ না করে সাবাত সোলায়মান তার বাম হাত বাম পকেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার দ্বিতীয় গুলী এসে বিদ্ধ করল সাবাত সোলায়মানের বাম বুক।
মেঝের উপর ঢলে পড়ে গেল সাবাত সোলায়মানের দেহ। ঢলে পড়ে বুক চেপে ধরে সে চিৎকার করে বলল, ‘আমাকে মারলেও তুমি পালাতে পারবে না এখান থেকে আহমদ মুসা। আমি একা আসিনি। জিহোভা অবশ্যই তোমাকে শাস্তি দেবেন।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। শেষ বাক্যটা সাবাত সোলায়মান হিব্রু ভাষায় বলল।
সাবাত সোলায়মানের পকেটের মোবাইল বেজে উঠল এই সময়।
আহমদ মুসা উঠে দ্রুত ছুটে গিয়ে তার পকেট থেকে মোবাইল বের করল। নিশ্চয়ই সাবাত সোলায়মানের কোন সাথীর টেলিফোন হবে। তার শেষ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আশে-পাশে কোথাও থেকে ওরা টেলিফোন করেছে। হয়তো গুলীর শব্দও ওরা শুনতে পেয়েছে।
আহমদ মুসা মোবাইল তুলে নিয়ে যতটা পারা যায় সাবাত সোলায়মানের কণ্ঠ নকল করে বলল, ‘হ্যালো।’
ওপার থেকে কে একজন বলল, ‘সাবা, গুলী-গোলার শব্দ পেলাম। তুমি ঠিক আছ?’ ওপারের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি আহত। শয়তানটা আমাকে দুটি গুলী করেছে। তোমরা এস। জিহোভা আমাদের সাহায্য করুন।’
বেদনাকাতর আর্তকণ্ঠে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ অনেকটাই সাবাত সোলায়মানের মতো শোনাল। শেষ বাক্যটা আহমদ মুসাও হিব্রু ভাষায় বলল। কণ্ঠটা সাবাত সোলায়মানেরই এ বিশ্বাস নিশ্চিত করার জন্য হিব্রু ভাষা ব্যবহার করল।
আহমদ মুসা সাবাত সোলায়মানের সাথীদের সবাইকে সামনে আনতে চায়। এ জন্যেই সে সাবাত সোলায়মানের আহত হওয়ার খবরটা ওদের জানাল, যাতে তাকে উদ্ধার করতে ওরা সবাই ছুটে আসে।
‘তুমি কোথায়?’ ওপার থেকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি বারান্দার সিঁড়ির আড়ালে।’
‘তুমি অপেক্ষা কর। আমরা আসছি।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওপার থেকে মোবাইল বন্ধ হওয়ার শব্দ এল।
আহমদ মুসা মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখে দিতে দিতে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এর লাশটা বারান্দার সিঁড়ির আড়ালে ঠেস দিয়ে রেখে আসি।’
বলেই আহমদ মুসা সাবাত সোলায়মানের লাশটি পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
সরদার জামাল উদ্দিন, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া সবাই রাজ্যেল আতংক-উদ্বেগ নিয়ে পাথরের মূর্তির মত নিশ্চয় দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে যে আহমদ মুসার মৃত্যু তাদের কাছে অবধারিত মনে হয়েছিল, সেই আহমদ মুসা দৃশ্যপট পাল্টে দিল। এ সিনেমার কোন দৃশ্য নয়। নিদারুণ এক বাস্তবতা।
আহমদ মুসার কথায় সম্বিত ফিরে পেল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘স্যার লাশটা ওখানে আমি নিতে চাই।’
‘বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই এসব করে না।’ বলল হাসি মুখে আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম, সাবাত সোলায়মানের সাথীরা আসছে। নিশ্চয় ওরা শুধু লাশ নিয়ে চলে যাবে না!’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘অবশ্যই জনাব। ওরা সামনা সামনি লড়াইয়ে আসুক। এজন্যেই ওদের এভাবে ডেকেছি। এতে আমাদের সুবিধা হবে। আমরা ওদের জানব, কিন্তু ওরা আমাদের জানবে না। তা না হলে ওরা আমাদে রজানত, ওদের শিকার হতাম আমরা। ওদের আমরা জানতে পারতাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
বিমুগ্ধ ভাব ফুটে উঠল সরদার জামাল উদ্দিনের গোটা চেহারায়। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আল্লাহর হাজার শোকর। আগুনের মত গরম পরিবেশেও তোমার মাথা এত ঠান্ডা থাকে। মুহূর্তের মধ্যে এমনভাবে নিখুঁত চিন্তা তুমি করতে পার!’
আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনের দু’একটা কথা শুনেই লাশ নিয়ে চলতে শুরু করেছিল।
আহমদ মুসার পিছু নিয়ে আবদুল কাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আয়েশা আলিয়া ছুটে এসে তার দাদার হাত ধরে বলল, ‘সাবাত সোলায়মানের সাথীরা কি অনেক?’
‘হতে পারে। আমি জানি না। কিন্তু ভেব না। আল্লাহর কাছে সংখ্যা বড় নয়। আর আহমদ মুসা আল্লাহর কি ধরনের সৈনিক, তাতো ইতিমধ্যেই বুঝে গেছ নিশ্চয়।’
বলেই সরদার জামাল উদ্দিন হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘এস, বাইরে গিয়ে দেখি। শয়তানরা কিন্তু এখনি এসে যেতে পারে।’
আয়েশা আলিয়াও দাদার পিছনে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা বারান্দায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
সাবাত সোলায়মানের লাশকে সে ইতিমধ্যেই নিচে সিঁড়ির পাশে রেখে এসেছে।
আহমদ মুসার একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া গিয়ে দাঁড়াল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের পেছনে। তাদের সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা তার হাতের মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েছিল। এই মোবাইলটাই পেয়েছিল সে সাবাত সোলায়মানের পকেট থেকে। আহমদ মুসার চোখে-মুখে নিশ্চিন্ত ভাব।
কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছে সরদার জামাল উদ্দিন ও অন্য সবাই।
সরদার জামাল উদ্দিন বলেই ফেলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, এই মুক্ত জায়গায় আমাদের দাঁড়ানো ঠিক হচ্ছে না। ওদের চোখ এ দিকেই। ওদের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। ওরা ধীরে ধীরে এদিকে এগুচ্ছে।’
‘এদিকে চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু ওরা এদিক দিয়ে আক্রমণ করবে না। চোখের সামনে এভাবে আসাই তার প্রমাণ।’
‘তার মানে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘তার মানে ওরা আমাদের পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি। তাহলে চল ওদিকে দেখি।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘পেছনে কি দরজা আছে?’
‘আছে। ভেতর থেকে তালাবন্ধ।’
‘তালা আজ কোন বাধা নয়।’ বলেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনারা এখানে দাঁড়ান। আমি ওদিকে দেখি।’
আহমদ মুসা ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। সরদার জামাল উদ্দিন জিজ্ঞেস করল, ‘শত্রু যদি পেছন থেকে আসে, তাহলে আমাদের এখানে থাকা কেন?’
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ওরা যাতে বুঝতে পারে পেছনে আমাদের কোন সতর্কতা নেই, চোখ নেই। তাহলে ওরা নিশ্চিন্তে পেছন দিক থেকে আসতে পারে।’
‘আমরা বুঝেছি ধন্যবাদ স্যার।’ হাসি মুখে এক সাথে বলে উঠল, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন এবং আয়েশা আলিয়া।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

সাবাত সোলায়মানের সাথে কথা শেষ করেই দানিয়েল দানেশ মোবাইল পকেটে ফেলে বলল, ‘সাবাত সোলায়মান আহত। এখনি আমাদের মুভ করা দরকার।’
‘তাহলে তো সাবাত সোলায়মানের সন্দেহ ঠিক। লোকটি আহমদ মুসাই।’ বলল দানিয়েল দানেশের পাশে দাঁড়ানো মিকাইল মৈনাক।
দানিয়েল দানেশ এবং তার সহকারী মিকাইল মৈনাক আরও কয়েকজন আজই বেতাংগে এসে পৌছেছে। সাবাত সোলায়মানের পাঠানো ছবি দেখে লোকটি যে আহমদ মুসা তা নিশ্চিত করার পরই কাতান টেপাংগো থেকে এদের পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে আহমদ মুসাকে বন্দী করার জন্যে নয়, দেখা মাত্র হত্যা করার জন্যে।
সাবাত সোলায়মান আহমদ মুসাকে সব সময় চোখে চোখেই রেখেছিল। আহমদ মুসা যখন সরদার জামাল উদ্দিনের বাড়িতে প্রবেশ করে, তখন নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল সাবাত সোলায়মান। এ সময়ই এসে পৌছে দানিয়েল দানেশরা। মোবাইলে যোগাযোগ হলে সাবাত সোলায়মান তাদেরকে লোকেশান জানিয়ে এখানেই ডেকে পাঠায়। দানিয়েল দানেশ ও মিকাইল মৈনাক আরও পাঁচজন সাথীসহ সেখানে এসে পৌছায়।
এসেই দানিয়েল দানেশ সাবাত সোলায়মানকে প্রশ্ন করে, ‘সরদার জামাল উদ্দিনরা তো আমাদের লোক। আহমদ মুসা সেখানে কেন?’
‘আমি দেখেছি বৃষ্টির তাড়া খেয়ে সে প্রথমে তাদের বাড়ি সামনে পেয়ে সেখানে উঠেছে। সরদার জামাল উদ্দিনের সাথে গত জুমার নামাযে তার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু এ কয়দিন সে আসেনি এ বাড়িতে।’ বলেছিল সাবাত সোলায়মান।
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন বলুন, আপনি কিছু করণীয় চিন্তা করছেন কিনা।’ বলে দানিয়েল দানেশ।
‘হ্যাঁ, আমাদের এখনই ওখানে যাওয়া উচিত। কিন্তু এক সাথে যাওয়া যাবে না। আহমদ মুসা সন্দেহ করতে পারে। আমি……….।’
সাবাত সোলায়মানের কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠে দানিয়েল দানেশ। থেমে যায় সাবাত সোলায়মান।
দানিয়েল দানেশ বলে, ‘ঠিক বলেছেন মি. সাবাত সোলায়মান। আহমদ মুসাকে সন্দেহ করতে দেয়া যাবে না। সে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আগাম সন্দেহ করলে তাকে বাগে আনা যাবে না।’
‘হ্যাঁ, তাই আমি ভাবছি, আগে বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলতে হবে, যাতে তার পালাবার পথ বন্ধ হয়। তারপর প্রথমে আমি একাই যাব মনে করছি। আমি ওদের সবার পরিচিত এবং এখানেই থাকি বলে কেউ কিছু ভাববে না। এই অবস্থায় অতর্কিতে গুলী করে হত্যা করা আমার পক্ষে সহজ হবে। প্রথম দর্শনে আমি এই চেষ্টাই করব। আমার চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তোমাদের মোবাইল করব, তাও না পারলে ওয়াম বাটন প্রেস সিষ্টেমে আমি মিসকল দেব।’ বলেছিল সাবাত সোলায়মান।
এসব কথা সামনে এসে গিয়েছিল দানিয়েল দানেশের। মিকাইল মৈনাকের কথার জবাবে সে বলল, ‘হ্যাঁ, আহমদ মুসা না হলে গুলী করার দরকার নেই।’
কথা শেষ করেই দানিয়েল দানেশ মোবাইল তুলে একটা কল করল। বলল, ‘তোমরা তিন জন বাড়ির সামনে থাক। অস্ত্র বাগিয়ে খুব ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে আগাও। যাতে তাদের সব মনোযোগ তোমাদের দিকে নিবদ্ধ থাকে। যে তরফেরই হোক গুলীর শব্দ শোনার পর তোমরা বাড়িতে প্রবেশ করবে।’
মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখেই বলল দানিয়েল দানেশ, ‘চল আমরা পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকব।’
সরদার জামাল উদ্দিনের বাড়িটার পেছনের দিকটায় ফলের বাগান। ছোট-বড় অনেক গাছ। বড় গাছের বিভিন্ন ধরনের আগাছা।
গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে তারা বাড়ির পেছনের পাশে গিয়ে পৌছল। বাড়ির কোন পাশে বা পেছনে কোথাও চাকর-বাকরদের যাতায়াত ও মাল-পত্র আনা-নেয়ার জন্য একটা দরজা থাকবেই, এটা তারা ধরেই নিয়েছিল।
তারা পেয়ে গেল দরজা। পুরু ষ্টিলশীটের বড় দরজা।
ডিজিটাল লক। ভেতর থেকে বন্ধ করা।
দানিয়েল দানেশ পকেট থেকে ল্যাসার বীম কাটার বের করে দরজার লক এরিয়া গোটাটাই কেটে ফেলল। খসে পড়ল কাটা অংশটা। তৈরি হলো টেনিস বল আয়তনের একটা ছিদ্র। দরজাও একটু নড়ে উঠে কিঞ্চিত পেছনে সরে গেল।
হঠাৎ একটা অব্যাহত যান্ত্রিক শব্দ কানে এল দানিয়েল দানেশের। দরজায় সৃষ্ট ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল দানিয়েল দানেশ। শুনতে পেল অব্যাহত অ্যালার্ম বাজার শব্দ। দেখল ভেতরের ঘরটা আলোকিত। ঘরে কেউ নেই।
বুঝে নিয়েছিল দানিয়েল যে ডিজিটাল লকের সাথে এলার্ম সংযোগ ছিল। ডিজিটাল লকটা আনলক হলেও এলার্মের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।
দানিয়েল দানেশ তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। দেখল কেটে ফেলা ডিজিটাল লকটি দরজার পাশের দেয়ালে একটা তারে ঝুলছে। তারটি ছিড়ে ফেলল সে।
থেমে গেল এলার্ম।
দানিয়েল দানেশের সংগে সংগে অন্য সবাই প্রবেশ করল ভেতরে।
ভেতরটা কোন ঘর নয়, আয়তাকার একটা প্যাসেজ।
এলার্ম থামলেও আতংক কাটেনি দানিয়েল দানেশের। এলার্ম বেজেছে তার অর্থই হলো প্রতিপক্ষের কাছে তাদের আগমনের কথা ঘোষণা হয়ে গেছে। অতএব শত্রুদের অলক্ষে পেছন দিক থেকে নিরাপদ আক্রমণের যে চিন্তা তারা করেছিল, তা ভন্ডুল হয়ে গেল।
প্যাসেজটির সামনে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় একটা বড় খোলা দরজা। দরজার ওপারটাও আলোকিত।
কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকার পর দানিয়েল দানেশ আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে এগুতে শুরু করল। হঠাৎ সামনে থেকে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েই দানিয়েল দানেশ ছুটে গিয়ে সিঁড়ির পাশে দু’ফুট উঁচু দেয়াল সেঁটে হামাগুড়ি দেয়ার মত করে বসল। তার সাথের অন্যরাও এভাবে গিয়ে দেয়ালের আশ্রয় নিল।
এছাড়া তাদের লুকানোর কোন জায়গা ছিল না। লুকানোর জন্যে এটা মোটেও ভাল জায়গা না হলেও যে বা যারা আসছে প্রথমেই তাদের দৃষ্টিতে পড়া থেকে বেঁচে যাবে। তার উপর দেখার জন্যে তারা নিশ্চয় সিঁড়ি পর্যন্ত আসবে। আসলেই সে বা তারা তাদের হ্যান্ড মেশিনগানের আওতায় এসে যাবে।
পায়ের শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ভাবনা দানিয়েল দানেশের থেমে গেল।
সে সতর্ক হয়ে উঠল। তাহলে ওরা নিশ্চয় খোলা দরজা দেখতে পেয়েছে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করেছি, এটাও নিশ্চয় তারা সন্দেহ করেছে।
এই চিন্তা শেষ হবার আগেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ ভেসে এল দানিয়েল দানেশের কানে। পায়ের শব্দগুলো দরজার কাছাকাছি আসতেই একটা শক্ত চাপা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘সামনে এক পাও নয়, দাঁড়ান আপনারা।’
ঘটনাটা বুঝতে দানিয়েল দানেশের মুহূর্তও দেরি হলো না। আগে যার পায়ের শব্দ শুনেছিল, সে নিশ্চয়ই তাদের আগমন টের পেয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। এই সময় বাড়ির অন্যরা এসে পৌছেছে। প্রথম লোকটি আহমদ মুসা হবার সম্ভাবনাই বেশি।
এসব কথা দানিয়েল দানেশের মাথায় বিদ্যুতের মত মুহূর্তেই খেলে গেল। এখন তার কি করা দরকার তাও মাথায় এসে গিয়েছিল। তাদের কথা বলা ও দাঁড়ানোর সুযোগটাকে গ্রহণ করতে হবে। দানিয়েল দানেশ রিভলবার বাগিয়ে আড়াল থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়েই রিভলবারের টার্গেট ঠিক করতে গেল।
কিন্তু দেখল আহমদ মুসার বাম হাত যখন দু’জনকে ঠেলে মেঝেয় ফেলে দিচ্ছে, তখন তার ডান হাতের মেশিন রিভলবার তার লক্ষে আগেই উঠে এসেছে।
দানিয়েল দানেশের টার্গেটে স্থির হবার আগেই আহমদ মুসার রিভলবারের পর পর দু’টি গুলী এসে তার মাথা ও বুককে বিদ্ধ করল।
দানিয়েল দানেশের পেছনে অন্যরাও তার সাথেই বেরিয়ে এসেছিল। তারাও আহমদ মুসার গুলী বৃষ্টির মুখে গিয়ে পড়ল। ডান দিকে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ানো একজনই শুধু গুলী করার সুযোগ পেল। কিন্তু তার ডান হাতের মেশিন রিভলবারের গুলী দরজার সাথে তার কৌণিক অবস্থানের কারণে অধিকাংশই দরজায় গিয়ে বিদ্ধ হলো। দরজাকে পাশ কাটিয়ে কয়েকটি গুলীই শুধু আহমদ মুসার দিকে ছুটে যেতে পারল। তার একটি গিয়ে আহমদ মুসার বাম বাহু বিদ্ধ করল। কিন্তু লোকটি টার্গেট এডজাষ্ট করার দ্বিতীয় সুযোগ পেল না। তার আগেই আহমদ মুসার বৃষ্টির মত ছুটে আসা গুলীর শিকার হলো।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে দরজার দু’পাশে তাকিয়ে দেখল আর কেউ নেই।
মেঝের উপর পড়ে যাওয়া সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন উঠে বসেছে। আয়েশা আলিয়াও ছুটে ঘরে প্রবেশ করেছিল। আহমদ মুসার বাহু থেকে রক্ত ঝরতে দেখে সে আতংকিত হয়ে ছুটে এসে বাহু ধরে বলল, ‘স্যার আপনি আহত। আর কোথাও গুলী লাগেনি তো?’
আহমদ মুসার নজর তখন বাইরের দিকে। তিনজন ছুটে আসছে ঘরের দিকে। আহমদ মুসা আয়েশা আলিয়াকে জোরে পাশের দিকে ঠেলে দিয়ে লাফ দিয়ে ঘরের পূর্ব প্রান্তে মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েই গুলী শুরু করল ঐ তিনজনকে লক্ষ্য কলে।
ওরা তিনজন প্রথমে আহমদ মুসাকে দেখতে পায়নি। যখন দেখতে পেয়েছে, তখন আহমদ মুসার গুলী বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। আক্রমণ কিংবা আত্মরক্ষার জন্যে ওরা কোন কিছুর আড়াল নেবার সুযোগ পেল না।
ওরা তিনজনই অসহায়ভাবে মৃত্যুকে আলিংগণ করল।
আর কাউকে না দেখে আহমদ মুসা পেছন ফিরল। আয়েশা আলিয়া ও সরদার জামাল উদ্দিনদের লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যরি আপনাদের ধাক্কা দিতে হয়েছে। আঘাত পাননি তো!’
‘আপনি নিজে গুলীবিদ্ধ হয়ে এই কথা বলছেন, আপনি ঐ ধাক্কাটুকু না দিলে তো ওরা না মরে আমরাই তাদের আগে মরতাম।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদেরও আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘আল্লাহর শোকর আহমদ মুসা, ঠিক সময়ে তুমি এসে পড়ে সাক্ষাত মৃত্যু থেকে আমাদের বাঁচিয়েছ।’
‘আপনাদের ওখানে রেখে এসেছিলাম। আপনারা এভাবে এসে ঠিক করেননি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিপদ এলার্ম শুনে আমরা সব ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি বিপদে পড়েছ কিনা এ ভয়ও আমাদের পেয়ে বসে। কিন্তু তুমি দরজার আড়ালে কি করছিলে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘এলার্ম শুনেই আমি দ্রুত এদিকে আসি। তার আগেই ওরা ভেতরে প্রবেশ করেছে। আমি বাইরের দরজা খোলা দেখি। আমি দরজার আড়ালে যাই লুকানো স্থান থেকে ওদের আরও ভেতরে এগিয়ে আনার জন্যে যাতে ওরা আমাকে দেখতে পাওয়ার আগেই আমার গুলীর আওতায় আসে।’
‘আমরা দুঃখিত আহমদ মুসা। এভাবে আসাটা আমাদেরকে বিপদে ফেলেছিল। তোমাকেও বিপদে ফেলেছিল।’ বলল জামাল উদ্দিন।
‘এখন কোন কথা নয় দাদা। উনি আহত। চলুন ভেতরে। ওকে হাসপাতালেও নিতে হতে পারে। আসুন, আমি ডাক্তারকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
বলেই ছুট দিয়েছিল আয়েশা আলিয়া।
‘থাম আয়েশা। আগেই ডাক্তার নয়। দেখি আহত স্থানটা। গুলী ভেতরে নাও থাকতে পারে। ছোট-খাট আঘাতের ব্যবস্থা আমিই করতে পারব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমারও নার্সিং ট্রেনিং আছে স্যার।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘আমিও ভাল ফাষ্ট এইড জানি।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘আমিও জানি।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার হাসি ও রসিকতাপূর্ণ কথায় সবাই বিস্মিত হয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল আয়েশা আলিয়া, ‘স্যার মনে হচ্ছে আপনার কিছুই হয়নি। হাসি-রসিকতা দূরে থাক, আমরা হলে আতংক-আর্তনাদেই ডুবে থাকতাম।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। কিছুই বলল না।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে সরদার জামাল উদ্দিন বলল, আর কোন কথা নয়, চল।
সবাই চলতে শুরু করল।

‘কিন্তু আহমদ মুসা, তুমি সবই বলেছ, তবে তুমি কেন বেতাংগে এসেছ সেটাই বলনি।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
ড্রইং রুমে সবাই গল্প করছিল।
আহমদ মুসা বসেছে বড় একক একটা সোফায়। তার সামনের একটা সোফায় পাশাপাশি বসেছে সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তাদের পেছনের অন্য একটা সোফায় বসেছে আয়েশা আলিয়া।
আহমদ মুসার ডান বাহুতে ব্যান্ডেজ। আঘাত বড় ক্ষতিকর ধরনের নয়। তবে গুলী বের করতে ছোট খাট অপারেশন দরকার হয়।
‘ঠিক, কথাটা এখনও বলা হয়নি। এটাই শেষ কথা। হয় তো সে কারণেই এ পর্যন্ত বলা হয়নি।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘আপনি কাতান টেপাংগোর রাস্তা চেনেন?’
‘হ্যাঁ, চিনি।’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল।
‘এই পথের সন্ধান নেবার জন্যেই আমি বেতাংগে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওখানেই কি আমাদের জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন বন্দী আছেন?’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল।
‘হ্যাঁ সরদার জী।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগে কোন কথা এল না সরদার জামাল উদ্দীনের কাছ থেকে। কিছুটা আত্মস্থ হয়ে পড়েছিল সে। একটুক্ষণ পরেই মুখ তুলে সে বলল, ‘বেতাংগ থেকে উপত্যকার পথে যে রাস্তাটা কাতান টেপাংগো থেকে পাত্তানী গেছে, সেটা তো তুমি জান। আবার যে রাস্তা পাত্তানীর দিকে থেকে কাতান টেপাংগো এসেছে, সেটাও তোমার জানার কথা। তার মানে………।
আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনের কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘দুই রাস্তাই চিনি। কাতান টেপাংগোর সঠিক লোকেশান জানি না। আর ঐ দুই পথের কোনটাই নিরাপদ নয়। শুরুতেই ওদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা আছে। ওদের নজর এড়িয়ে সেখানে পৌছুতে না পারলে ওরা জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে এটা নিশ্চিত।’
‘আমি সে কথাই বলছিলাম। ওদের চোখে ধুলা দেবার জন্যে তাহলে ঐ দুই পথ এড়িয়ে তৃতীয় একটি গোপন পথ রয়েছে, সেটারই সন্ধান চাও?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘ঠিক।’ আহমদ মুসা বলল।
সরদার জামাল উদ্দিন তাকাল নাতি আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘তুমি কি কাতান টেপাংগো ঢুকেছ?’
‘না ঢুকিনি।’ বলল আবদুল কাদের।
সরদার জামাল উদ্দিন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কাতান টেপাংগো পর্যন্ত রাস্তা আমরা জানি। কিন্তু গত তিন বছর আমরা কাতান টেপাংগো ঢুকিনি। অর্থাৎ কাতান পাহাড় পার হয়ে টেপাংগো ঢোকার গিরিপথ পর্যন্ত যেতে পারব। তার পরের এলাকাটা নিষিদ্ধ, কিছু লোক ছাড়া অন্য সকলের জন্যে।’
‘এই ‘অন্য সকলের’ মধ্যে আপনারাও পড়েছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তুমি যা বল সেই ‘ব্ল্যাক ঈগল’-এর প্রধান হাবিব হাসাবাহর পরামর্শ কমিটির সদস্য এবং তার ষ্টাফরাই মাত্র ওখানে প্রবেশ করতে পারে। এদিকের গিরিপথও তারা বন্ধ করে দিয়েছে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘ওরা কি উপত্যকার এই দুই পথে আসা-যাওয়া করে? এই পাহাড়ী পথ ওরা চেনে না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘না এই পথ ওরা চিনে না। আমরা এবং পাহাড়ের কিছু পরিবার ছাড়া এই পথের সন্ধান কেউ জানে না। ননপাহাড়ী কাউকে আমরা এই পথের সন্ধান জানাই না।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘পাহাড়ী, ননপাহাড়ীর এই পার্থক্য কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘একটা বিশেষ কারণ আছে।’ জবাব দিল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘বিশেষ কারণটা কি জানাবার মত?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তোমাকে বলা যাবে না এমন কথা আমাদের থাকতে পারে না। ঘটনা হলো, একটা জনশ্রুতি আছে, কাতান পাহাড়ের ‘শাহ রোড’ বা ‘কিং রোডের দু’ধারের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অঢেল গুপ্তধন লুকানো আছে। এই গুপ্তধনের সন্ধানে আসা মানুষের রক্তে পাহাড়ের গা অব্যাহতভাবে রঞ্জিত হয়েছে। তারপর আল্লাহর ইচ্ছায় একটা ভূমিকম্প পাহাড়ের মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। তারপর শাহ রোড কেন্দ্রিক গুপ্তধনের সব নকশা অচল হয়ে গেছে। এই শাহ রোডের সন্ধান এখন শুধু পাহাড়ি কয়েকটি পরিবারই জানে। গুপ্তধনের সেই হানাহানি পাহাড়কে যেন আর গ্রাস না করে, এ জন্যে এই পথের সন্ধান আর কাউকে জানানো হয় না।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘শাহ রোড বা কিং রোড নামটা কেন? গুপ্তধনের এই জনশ্রুতির রহস্য কি?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘নাম সম্পর্কেও একটা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। বলা হয়, থাইল্যান্ড ও মালয় অঞ্চলের রাজ্যচ্যুত বা বিদ্রোহী রাজা-রাজপুত্র, দস্যু-জলদস্যুদের আশ্রয় নেবার গোপন স্থান ছিল গল্পের কোহেতান বা কাতান এই পাহাড়। এই রাজা-রাজপুত্ররা কোহেতান বা কাতান পাহাড়ের যে গোপন পথ ব্যবহার করতো, তাকেই নাম দেয়া হয়েছে শাহ রোড বা কিং রোড। এই নামের সাথে গুপ্তধনের গল্পের সম্পর্ক আছে। মনে করা হয় এত রাজা-রাজপুত্র যখন এসেছে, তখন তাদের রাজকোষও এসেছে। এই রাজকোষেরই সন্ধান করা হতো কিং রোডের দু’পাশে। থামল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘আমার মনে হয় জনশ্রুতির সবটুকুই ভিত্তিহীন গাল গল্প নয়, এর মধ্যে ইতিহাসও আছে। রাজ্যচ্যুত বা বিদ্রোহী রাজা-রাজপুত্ররা এই পাহাড় অঞ্চলে পালিয়ে এসেছেন, এটা ইতিহাস। থাইল্যান্ডের সোকোথাই রাজবংশের রাজপুত্র আবদুল কাদের আহমদ শাহ ওরফে ‘চাওসির বাংগসা’ এ অঞ্চলে পালিয়ে আসা এই ইতিহাসের একটা প্রমাণ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো গুপ্তধনের কথার মধ্যেও সত্যতা আছে ধরে নিতে হয়।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘এটা ধরে নেয়া কেন, এটাই বাস্তবতা যে রাজার সাথে রাজকোষও থাকবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে স্যার আপনিও কিং রোডে গিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান করবেন নাতো?’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘রাজা কে না হতে চায়, রাজকোষ কে না পেতে চায়। তবে আমার কাছে এখন জাবের জহীর উদ্দিন যে কোন রাজকোষের চেয়ে মূল্যবান। তাকে বাঁচানো এবং তাকে আবার পাত্তানীদের মাঝে ফিরিয়ে আনার চেয়ে বড় লোভনীয় কাজ আমার কাছে আর কিছু নেই।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘আল্লাহর শোকর যে, তোমার মত সোনার মানুষ আল্লাহ এ যুগে সৃষ্টি করেছেন। তুমি আমাদের নেতা সম্পর্কে যা ভাবছ, আমরাও তেমন করে ভাবতে পারি না। তার চেয়েও ট্রাজেডি হলো, যারা আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে, যারা আমাদের নেতাকে বন্দী করে হত্যা করতে চাচ্ছে তাদেরই আমরা সাহায্য করছি। আমরা আমাদের শত্রুদের চেনার যোগ্যতার হারিয়ে ফেলেছি।’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল। ভারাক্রান্ত কণ্ঠ তার।
আহমদ মুসা প্রসংগ পাল্টিয়ে বলল, ‘কাতান-টেপাংগে যারা ঢুকতে পারে, তারা কারা? আমি বলতে চাচ্ছি তারা এ দেশীয় কিনা?’
সংগে সংগে উত্তর দিল না সরদার জামাল উদ্দিন কিংবা আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তারা পরষ্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ভাবছিল তারা।
একটু পর কথা বলে উঠল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। বলল, ‘আগে এ বিষয়টা আমাদের মাথায় আসেনি। এখন মনে হচ্ছে, ওদের কারও চেহারা মালয়ী বা পিওর থাই নয়। আর কারও নামই থাই মুসলমানদের মত নয়। কারও কারও চেহারা থাই বা চীনা চেহারার সাথে কিছুটা মিললেও, অধিকাংশের চেহারাই কিন্তু এদেশীয় নয়।’
‘এ এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। আহমদ মুসাকে আল্লাহ এখানে না নিয়ে এলে আমরা এ ষড়যন্ত্রের কিছুই জানতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের গুটি হিসাবে আমরা যে কাজ করতাম, তাকেই জাতির স্বার্থে পবিত্র দায়িত্ব পালন বলে মনে করতাম। বিস্ময় লাগছে আমার, এত বড় ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে নিশ্চয় অনেক দিন লেগেছে। অঢেল পয়সা ও অনেক শ্রম খরচ হয়েছে। কিন্তু এত সব করে কি লাভ হয়েছে তাদের? আমাদের লোকরা কষ্ট ভোগ করেছে, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে, কিন্তু তাদের কি লাভ হয়েছে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘যে লাভ তারা চায়, সে লাভ তারা ষোল আনা পেয়েছে। ইসলামকে তারা সন্ত্রাসের ধর্ম সাজাতে চায়, মুসলমানদের সন্ত্রাসী সাজাতে চায়। সে উদ্দেশ্য তাদের হাসিল হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর মত থাই মুসলমানদের বিরুদ্ধেও চরম পন্থা ও সন্ত্রাসের কাহিনী জগৎময় প্রচার হয়েছে। থাই মুসলমানদের যে ক্ষতি হবার হয়েই গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু স্যার, আপনি তো বলেছেন থাই সরকারের কাছে বিষয়টি এখন পরিষ্কার। তাহলে ক্ষতি ও বদনাম থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি।’ বলল আযেশা আলিয়া।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘খারাপ খবর পৃথিবীর সবাই জানতে পেরেছে, কিন্তু ভাল খবরটা তাদের কারো কানেই পৌছুবে না। কারণ গ্লোবাল মিডিয়া কমবেশি তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। অনেক দেশের প্রেসিডেন্টও তাদের প্রপাগান্ডার শিকারে পরিণত হয়েছেন। এ থেকেই আমাদের অসহায়ত্ব অনুমান করা যায়।’
‘তাহলে আমাদের উপায়?’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
‘উপায় খোঁজার অবস্থায় আমরা নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনায় আমরা পেছনে বলে আমরা যেমন একটা শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারিনি। এই কারণেই গ্লোবাল কোন মিডিয়াও আমাদের হাতে নেই। সুতরাং এ দিকটা না ভেবে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আত্মরক্ষাকেই বড় করে দেখতে হবে। থাই মুসলমানরা ষড়যন্ত্রের কবল মুক্ত হচ্ছে, এটাকেই আমাদের বড় করে দেখা দরকার।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সত্যি, ষড়যন্ত্র ও বদনাম মুক্তভাবে বাঁচাই এখন আমাদের কাছে বড়। আহমদ মুসা এখন বল করণীয় কি? তোমার সাথে কাতান টেপাংগো যেতে আমরা প্রস্তুত।’
‘ধন্যবাদ জনাব, আজই রওয়ানা হতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি কিন্তু যাচ্ছি।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘সাথী পেলে আমি খুশি হবো। বিশেষ করে তোমাদের মত সাথী। চল তৈরি হই।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘আমার কি কাজ?’ বলল আয়েশা আলিয়া।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
হাসল। একটু ভাবল। বলল, ‘তুমি তো একা পড়ে গেছ। মেয়েদের জন্যে একা কোন মিশনে যাওয়ার অনুমতি নেই। ওঁরা দু’জন আমার সাথে যাবার জন্যে তৈরি। তোমার সাথী নেই।’
‘আছে স্যার। ওর কোন মিশন আছে কিনা?’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘মিশন আছে। কিন্তু সাথী পাবে কোথায়? ভাই তুমি একাই, অন্য কোন সাথী চলবে না মেয়েদের জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আসল সাথী স্যার। যাকে বলতে পারেন জোড়া।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘ভাইয়া, এসব এখন কেন?’ বলে আয়েশা আলিয়া তার ভাই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। সুন্দর সুসংবাদ। কিন্তু সে কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে। আপনার কথা শুনেই ছুটে পালিয়েছে। এখনি এসে পৌছুবে। এ বছরই মালয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছে। ক’দিন হলো শিক্ষকের চাকরি পেয়েছে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়েই।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘সাথী বলছ, জোড়া বলছ, বিয়ে হয়েছে এ কথা বলছ না কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব ঠিক-ঠাক স্যার। শুধু বিয়ের আসনে বসাই বাকি। আপনি বললে……….।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে আয়েশা আলিয়া বলে উঠল, ‘এসব কথা থাক। ঠিক আছে, আমি কোথাও যাচ্ছি না।’ বিব্রত আয়েশা আলিয়ার মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে লজ্জায়।
‘না বোন আয়েশা, তোমার জন্যে মিশন ঠিক হয়ে গেছে। তুমি অবশ্যই তা থেকে পিছু হটবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠল আয়েশা আলিয়ার মুখ। বলল, ‘স্যার আপনার ইচ্ছা ও আদেশের চেয়ে বড় কিছু আমার কাছে নেই। আপনি আমাদের নেতা। আপনার নির্দেশে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারি।’ আয়েশা আলিয়ার শেষ কথাগুলো আবেগে কাঁপছিল।
‘সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তাহলে বিয়েটা তুমিই পড়িয়ে দাও আহমদ মুসা। তার পরেই আমরা মিশনে বেরুবো। কিন্তু আয়েশা আলিয়াদের মিশন কোথায়, সেটা কিন্তু বলনি আহমদ মুসা।’
‘বলছি, আয়েশা আলিয়ারা দু’জন উপত্যকার পথে কাতান টেপাংগের কিছু দূর নিচে লেক চ্যানেলের এপারের ফেরিঘাটে গিয়ে পৌছুবে। সেখানে বসে তারা পাহারা দেবে চ্যানেলের পথকে, যাতে এদিকে হাবিব হাসাবাহ এবং তার লোকরা পালাতে না পারে। ওরা এ পথে পালাবার চেষ্টা করতেও পারে। এটা খুব বড় একটা কাজ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু লেক চ্যানেল অনেক প্রশস্ত। এপারে বসে চ্যানেল পাহারা দেয়া বা এ পথে কাউকে আটকানো সম্ভব নয়। এটা নিশ্চয় তোমার বিবেচনায় আছে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘ওপারেও ব্যবস্থা আছে। ওপারে ঘাটওয়ালা কয়েকদিন থাকবে না। ঘাটে ও ঘাটওয়ালার বাড়িতে কয়েকজন পুলিশ ঘাটওয়ালা ও তার আত্মীয়ের ছদ্মবেশ নিয়ে থাকবে। আপনার মত করে আমিও এখন বুঝতে পারছি, ঘাটওয়ালারা ওখানে বসে গোটা চ্যানেলে ওদের আটক করতে পারবে না। এজন্যে আয়েশা আলিয়াদের ওখানে পাঠানে হচ্ছে। ওরা পথ-যাত্রীর ছদ্মবেশে ঠিক সময়ে ওখানে গিয়ে পৌছুবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক সময়টা আমরা কি করে ঠিক করব?’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘ঠিক সময়টা আমিই ঠিক করে মোবাইলে জানাব। তোমাদের গাড়িটা হবে উভচর। স্থলের গতিতে সে পানিতেও চলতে পারবে। এ রকম একটি গাড়ি বেতাংগোতে এসেছে। তোমরা তা পেয়ে যাবে। আমি তার ব্যবস্থা করে যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শহরে থাই সরকারের কমিশনারের সাথে দেখা হয়েছে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘কমিশনারকে আমি কি উদ্দেশ্যে এসেছি সেটা ছাড়া সব জানিয়েছি। কমিশনার সাহেব আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। কথা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এখানে থাকতে পারতে। তাদের কাছে অনেক সহযোগিতাও পেতে। তুমি তা নাওনি কেন?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘সরকারি লোকদের উপর অবশ্যই ব্ল্যাক ঈগলের চোখ থাকবে। আবার সরকারি লোকজনদের কেউ কেউ ব্ল্যাক ঈগলের পক্ষে কাজও করতে পারে। এজন্যেই আমি গোপনে থাকছি।’
আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনেরদিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘যা করার আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে জনাব।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বৈঠকখানাটা একটু গোছ-গাছ করছিল। জানালার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘স্যার আবদুল জববার আল যোবায়ের এসে গেছে।’ বলেই সে তাকাল আয়েশা আলিয়ার দিকে। বলল, ‘আয়েশা যাও তুমি তৈরি হও। খালাম্মার ওখানে টেলিফোন করে ওঁদের আসতে বল।’
লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাওয়া আয়েশা আলিয়া বলল, ‘তুমিই টেলিফোন কর ভাইয়া।’
এই আবদুল জববার আল-যোবায়েরের সাথেই আয়েশা আলিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
আয়েশা আলিয়া থামতেই তার দাদু সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘পাহাড়ে তো আর খবর দেয়া যাবে না। তোমাদের খালাদের আমি টেলিফোন করছি আসার জন্যে। তুমি ভেতরে যাও বোন। দেখ কি করার আছে। দেখি যোবায়ের আসছে, কথা বলি তার সাথে।’
আয়েশা আলিয়া ভেতরে চলে গেল। তার মধ্যে লজ্জা, আবেগ, উত্তেজনা ও নার্ভাস ভাব। সব মিলিয়ে তার মুখে অপরূপ এক লাবণ্য।
সরদার জামাল উদ্দিন আহমদ মুসাকে নিয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।

শাহ রোড বা কিং রোড কোন রোড নয়, উঁচু-নিচু, এবড়ো-থেবড়ো ও ছোট-বড় পাথরে ঢাকা একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর মত প্রলম্বিত চ্যানেল।
দিগন্ত প্রসারিত শাহ রোড বা কিং রোড নামক চ্যানেল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা। সাথে সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
আগে হাঁটছিল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। মাঝখানে আহমদ মুসা। আর পেছনে সরদার জামাল উদ্দিন।
চ্যানেলের দু’পাশে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, পাথরের স্তুপ এবং মাঝে মাঝেই এদিক-সেদিক গিরি গলিপথ। আবদুল কাদের এক জায়গায় চ্যানেলের পথ পরিত্যাগ করে পশ্চিম দিকের সংকীর্ণ এক গিরিপথে প্রবেশ করল।
‘আমরা কিং রোডের চ্যানেল ছাড়ছি, ভুল হচ্ছে না তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার সামনে গিয়ে কিং রোড একটা খাদে শেষ হয়েছে।’ পেছনে না তাকিয়েই বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘পূর্ব দিকেও তো গিরিপথ দেখছি। আমাদের তো যেতে হবে পূর্ব দিকেই, কাতান টেপাংগো তো ওদিকেই?’ আবার আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘স্যার পূর্ব দিকের রাস্তা ঘুরে-ফিরে আমাদের ফেলে আসা অনেক পেছনে কিং রোডে গিয়েই উঠেছে। পথভ্রষ্ট করার এক গোলক ধাঁধাঁ ওটা।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
আবদুল কাদেরের পেছন থেকে তার দাদা সরদার জামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘ভাই আহমদ মুসা পশ্চিম পাশে ও পেছনে আরও কিছু পশ্চিমমুখী পথ এই পথের মতই রয়েছে। ওগুলোর কোনটা দিয়েই লক্ষে পৌছা যাবে না। ওসবের সবগুলোই কোনটা পাহাড়ের দেয়ালে, কোনটা গিরিখাদের মুখে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। মাত্র এই একটি পথই নানা গোলক ধাঁধাঁ পেরিয়ে কাতান টেপাংগোর দেয়াল পর্যন্ত পৌছেছে।
পাহাড়ের এই পথ ধরে ঘণ্টা দুয়েক চলল। পথটির দু’পাশে অনেক গলিপথ তারা পেরিয়ে এল। কোন কোন গলিপথ তাদের পথ থেকেও প্রশস্ত। এসব ক্ষেত্রে কোন পথ বেছে নেবে তা নির্ণয় করতে ষোল আনা ভুল হবার সম্ভাবনা। এক জায়গায় তো চলে আসা পথটি ছেড়ে দিয়ে পাশের একটা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ গলিপথ ধরতে হয়েছে তাদের। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করে জেনেছে চলে আসা পথ ধরে তারা সামনে এগুলে ঘণ্টা তিনেক ঘোরার পর আবার পেছনে ফিরে গিয়ে কিং রোডেই উঠতে হতো।
ঘণ্টা তিনেক চলার পর একটা প্রশস্ত চ্যানেলে তারা ফিরে এল। আহমদ মুসা খুশি হয়ে বলল, ‘তিন ঘণ্টা পর কিং রোড আবার আমরা পেয়ে গেলাম।’
হাসল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। বলল, ‘স্যার এটা শেষ ধাঁধাঁ। এটা একদম কিং রোডের মত, কিন্তু কিং রোড নয়। এটা ধরে এগুলে পাহাড়ের ডান পাশে অর্থাৎ পশ্চিম প্রান্তের লেকে গিয়ে পড়তে হবে।’
কথা শেষ করেই ‘আসুন’ স্যার বলে চ্যানেলের কয়েক গজ এগিয়ে বাঁ দিকের সংকীর্ণ গিরিপথে প্রবেশ করল।
এক ঘণ্টা চলার পর সামনেই একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে আরেকটা প্রশস্ত চ্যানেল দেখতে পেলো। আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আবদুল কাদের, এবার ভুল হবে না। ওটা নিশ্চয় কিং রোড।’
হাসল আবদুল কাদের। বলল, ‘এবার ঠিক ধরেছেন। আমরা কিং রোডে ফিরে এসেছি। আমরা যতটা পথ এগিয়েছি, আর ততটুকু এগুলেই কাতান টেপাংগো পৌছে যাব স্যার। আমরা অর্ধেক পথ পার হয়েছি।’
আবদুল কাদের কিং রোডে উঠেছে। আহমদ মুসা কিং রোডে উঠতে গিয়ে শেষ পাহাড়টার পাশ দিয়ে গিরি পথ অতিক্রম করছে। হঠাৎ ক্ষয়ে যাওয়া বিছানো পাথরের মাঝামাঝি স্থানে একটা অমসৃণ বৃত্ত, বৃত্তের নিচের দিকে গভীর ও পুরানো কিছু সুশৃঙ্খল রেখা দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। থমকে দাঁড়াল। এগুলো পাথরটার দিকে।
দাঁড়াল পাথরটার পাশে।
পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে পাথরের উপরটা মুছল আহমদ মুসা।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। যা ভেবেছিল তাই, সুশৃংখল রেখাগুলো আরবী ক্যালিওগ্রাফি।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়।
ক্যালিওগ্রাফির লেখা পড়ল আহমদ মুসা। ক্যালিওগ্রাফিতে একটা শব্দই লেখা রয়েছে। সেটা ‘তাহতা’ অর্থাৎ ‘নিচে’।
আহমদ মুসা মুখ ফেরাল সরদার জামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘ক্যালিওগ্রাফিক ষ্টাইলে এখানে একটি আরবী শব্দ লেখা রয়েছে।’
‘আরবী শব্দ? কি শব্দ? কি লেখা?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠে উত্তেজনা।
আহমদ মুসা বলল, ‘নিচে।’
‘নিচে অর্থ কি?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘এটা একটা সংকেত হতে পারে। পাথরটার নিচটা দেখতে হবে।’
বলেই আহমদ মুসা হাত দিয়ে চাপ দিয়ে পাথরটা পরীক্ষা করল।
পাথরটা বড়, কিন্তু খুব বড় নয়। পাথরটা তেমন নড়ল না বটে, কিন্তু লুজ মনে হলো তার কাছে।
‘আসুন জনাব আমরা পাথরের তলাটা দেখি।’ বলল আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে।
তিনজনে পাথরটার একটা প্রান্ত ধরে উল্টে ফেলল। পাথরের তলদেশটির চার প্রান্ত এবড়ো-থেবড়ো হলেও মাঝখানটি বিস্ময়করভাবে মসৃণ। এই মসৃণ জায়গায় খোদাই করা গাছের ছবি।
গাছের ছবিটা দেখেই আহমদ মুসা তাকাল চারদিকে। না, কোথাও কোন গাছের চিহ্ন নেই।
‘স্যার, পাথরের তলায় ওটা তো গাছ মনে হচ্ছে।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘হ্যাঁ, আবদুল কাদের।’ বলে আহমদ মুসা টিস্যু পেপারটি কুড়িয়ে নিয়ে পাথরের গা ভালো করে পরিষ্কার করল। গাছটার শাখা-প্রশাখা পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ল।
আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, ক্যালিওগ্রাফির সংকেত অনুসরণে পাথরের তলায় গাছ যখন পাওয়া গেছে, তখন গাছও একটা সংকেত হবে অথবা এর কোন অর্থ অবশ্যই থাকবে।
আহমদ মুসার দুই চোখ গভীরভাবে দেখতে লাগল পাথরের মাঝে খোদাই করা গাছটিকে।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ দুটি তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে।
চোখ দুটি তার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। দেখল যেন আরও ভালোভাবে।
গাছের উপর চোখ রেখেই বলল, ‘মনে হচ্ছে জনাব সুখবর, রাজভান্ডার পেয়ে গেছি।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে হালকা হাসি।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনও ঝুঁকে পড়ল পাথরের উপর।
আহমদ মুসা বলল, ‘দেখুন গাছের মাঝ বরাবর ডান থেকে বামে, গাছের খোদাই করা ডালগুলোর সংযুক্ত অংশের উপর ভালো করে চোখ রাখুন, দেখবেন আরবী শব্দ তৈরি হয়ে যাচ্ছে।’
সরদার জামাল উদ্দিন বলল ধীরে ধীরে, ‘হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা সেরকমই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু পড়তে পারছি না। ‘আইন’, ‘মিম’ ছাড়া আর কোন অক্ষর স্পষ্ট হচ্ছে না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্পষ্ট হবে। আর একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন। দেখুন আইনের মাথায় একটা গোলাকার আপেল ঝুলছে। ওটাকে নোকতা ধরুন। তাহলে আইনটা ‘গায়েন’ হয়ে যাবে। গায়েনের পর দেখুন বাম দিকে বিলম্বিত হয়ে যাওয়া শাখা কাছাকাছি পাশাপাশি দু’জায়গায় পিরামিড হয়ে উঠেছে। প্রথম পিরামিডের সুঁচালু মাথার উপর দেখুন একটা পাতা গোলাকার অবস্থায় ঝুলে আছে। দ্বিতীয় পিরামিডের নিচে দেখুন দুটি ফুল একই বৃন্তে ফুটে আছে। প্রথম পিরামিডকে ‘নুন’ এবং দ্বিতীয় পিরামিডকে ‘ইয়া’ ধরতে হবে। এবার প্রথম আরবী বর্ণের সাথে পরের বর্ণের মিমকে যুক্ত করুন। তাহলে পাওয়া যাচ্ছে একটা শব্দাংশ ‘গানিমা’। ‘গানিমা’র মিম শব্দের পরে দেখুন তলোয়ারের মত একটা শাখা বাম পাশের শেষ পর্যন্ত গেছে এবং তলোয়ারের শেষ প্রান্তটা বাঁকা হয়ে একটু উপরে উঠে গেছে। আর তলোয়ারের বুকের উপর দেখুন ঝুলন্ত দুটি পাতা কুঁকড়ে বৃত্তাকার হয়ে আছে। ও দুটি বৃত্তকে দুই নোকতা ধরুন। তাহলে ওটা হয়ে যাচ্ছে আরবী অক্ষর ‘তা’। সব মিলে শব্দটা দাঁড়াচ্ছে ‘গানিমাত’।
আহমদ মুসার শব্দটা উচ্চারণ শেষ হতেই সরদার জামাল উদ্দিন বিস্ময় ও আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘মানে ‘মাল’, ধনসম্পদ’। তাহলে এখানেই কি কিংবদন্তীর সেই ধন-সম্পদের একটা ভান্ডার লুকানো আছে? তুমি কি সেই খবরের কথা বলছ?’
সরদার জামাল উদ্দিনের কথা শেষ হতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘গানিমাত মানে কি ধন-সম্পদ? ‘মালে গানিমাত’ যুদ্ধলদ্ধ ধন বুঝতাম।’
‘গানিমাত’ মানে সহজে যে ধন-সম্পদ লাভ হয়। যুদ্ধ জয় থেকে সহজেই সম্পদ লাভ করা যায় বলে ওকেও মালে গানিমাত বলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাই আহমদ মুসা, সত্যই তুমি মনে করছ এখানে ধন-ভান্ডার আছে? ‘গানিমাত’ শব্দ কি সেই ইংগিতই দিচ্ছে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসা কথা বললেও তার অনুসন্ধানী চোখ পাথরের গাছ ও আশে-পাশে ‘গানিমাত’ বা সহজলভ্য ধনভান্ডারটি এখানে কিংবা কোথায় তার ইংগিত খুঁজে ফিরছিল।
পাথরের দিক থেকে মুখ না তুলেই আহমদ মুসা বলল, ‘অবশ্যই জনাব একটা ধনভান্ডার আছে। কিন্তু কোন জায়গায় সেটা আছে, তারই সংকেত আমি খুঁজছি।’
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল গাছের গোড়ার ঠিক নিচে পাথরের গায়ে খোদাই করে চোখে পড়ার মত স্পষ্ট করে মিম লেখা। মিমের পরেই একটা তীর আঁকা। তীরের মাথায় একটা ‘এক’ লেখা। তারপর আবার ‘তীর’। তীর চিহ্নের পর দুই লেখা। এরপর তৃতীয় তীর এবং তারপর ‘তিন’ লেখা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, তৃতীয় তীরের মাথা নিমণমুখী এবং ‘তিন’ অংকের মাথাও নিচের দিকে।
আহমদ মুসা অংকের এই সংকেতটি দেখাল সরদার জামাল উদ্দিনকে এবং আমার অনুমান ভুল না হলে এটাই ধন-ভান্ডারে পৌছার সংকেত।
আগ্রহ ভরে দেখল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
ভাবছিল আহমদ মুসা। ভাবছিল ধনভান্ডার কোথায় লুকানো আছে, এ নিয়ে নয়। ভাবছিল ধনভান্ডার উদ্ধার আগে, না কাতান-টেপাংগো যাওয়া আগে।
‘ভাই আহমদ মুসা, আমরা কিছু বুঝতে পারছি না অংকের সংকেত থেকে। পাথরকে সামনে রেখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি পশ্চিমমুখী হয়ে। তাহলে তীরের সংকেত আমাদের যেতে বলছে দক্ষিণ দিকে। কিন্তু এক,দুই, তিন-এর সংকেতটা বুঝছি না।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘সংকেত দক্ষিণ দিকের নয়। দেখুন অংকগুলোর আগে ‘মিম’ হল ‘মাগরিব’ এর প্রথম বর্ণ। অথএব ইংগিতটা ‘মাগরিব’ বা পশ্চিম দিকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এক, দুই, তিন এর ব্যাখ্যা কি?’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘পশ্চিম দিকে পরপর তিনটি স্থান অথবা তিনটি পাহাড়কে নির্দেশ করা হয়েছে। তৃতীয় স্থান বা পাহাড়ের কোথাও লুকানো রয়েছে ধনভান্ডার।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই তাকাল পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে। সামনে পাহাড়ের বহু টিলা। তারা যে টিলায় দাঁড়িয়ে সেখান থেকে প্রথম টিলাটা ২০০ গজের মত দূরে হবে। দ্বিতীয় টিলার দূরত্ব হবে ৫০০ গজের মত। আর তৃতীয় টিলাটি কম পক্ষে আধা মাইল দূরে। তৃতীয় টিলাকে টার্গেট ধরলে আধা মাইল দূরের ঐ টিলাতেই তাদের যেতে হবে।
কিন্তু আহমদ মুসার মনের ভেতর থেকে এর পক্ষে কোন সাড়া পেল না।
আহমদ মুসার দুই চোখ ফিরে গেল আবার সেই অংকের সংকেতে আর কোন ইশারা পায় কিনা দেখার জন্যে।
অংক ও তীরের স্থানটাকে আরো ভালো করে মুছে পরিষ্কার করল। তীরের উপর এবার নজর পড়তেই তার চোখে পড়ল, তীরের কিছু উপরে কনুই পর্যন্ত একটা হাত আঁকা। তীরের উপর থেকে ধুলো-বালি সরে যাওয়ায় আহমদ মুসা দেখতে পেল তীরের দন্ডটা প্লেইন নয়, খাঁজ কেটে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা। আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গুণে দেখল প্রত্যেকটা তীরে ২০টি করে খাঁজ কাটা আছে। তার মানে তৃতীয় স্থানটা এখান থেকে ৬০ হাত দূরে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তিনটি তীর ও তিনটি অংকে তিনটি স্থানকে দেখানো হয়েছে। তিনটি স্থান একটি অপরটি থেকে ২০ হাত ব্যবধানে রয়েছে। আপনারা দেখুন তীরের পাশে হাত আঁকা আছে এবং প্রত্যেকটি তীরে ২০টি করে খাঁজ আছে।’
শুনেই সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ঝুঁকে পড়ে পাথরের উপর চোখ বুলাতে লাগল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসার মনে হলো সংকেতে তিনটা তীর, তিনটা অংক দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে কেন? পশ্চিমে ৬০ গজ বুঝলেই তো হয়ে যেত? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হল, তিনটি স্থানেও ধাঁধাঁ থাকতে পারে। আহমদ মুসা বলল, ‘আমাদেরকে ২০ হাত থেকে প্রথম স্থানে যেতে হবে। ওখানে নিশ্চয় কোন সংকেত পাওয়া যাবে, সেই অনুসারে আমাদের সামনে এগুতে হবে।
গাছওয়ালা পাথরটি উল্টিয়ে আগের অবস্থায় রেখে আহমদ মুসা ঠিক পশ্চিমমুখী হয়ে ২০ হাত এগুলো। ঠিক বিশতম হাতের জায়গায় এলো-মেলো, এবড়ো-থেবড়ো অবস্থায় তিনটি পাথর পাওয়া গেল। তিনটি আরবী ‘এক’ লেখাও পাওয়া গেল। প্রত্যেকটি ‘এক’ অংকের সাথে রয়েছে একটি দিক নির্দেশক তীর। তীরের ফলকের সামনে একটিতে ‘মিম’ অর্থাৎ মাগরিব, ‘দ্বিতীয়টি ‘জিম’ অর্থাৎ জুনব (দক্ষিণ) এবং তৃতীয়টির সামনে ‘শিন’ অর্থাৎ শেমাল (উত্তর)।
আলোচনা করে পশ্চিমে যাবারই সিদ্ধান্ত নিল তারা। কিন্তু হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, পশ্চিমে যেতে হবে আগে থেকেই জানা, তাহলে তিন দিকের এই ধাঁধাঁ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?
সন্দেহের কথা সবাইকে বলে আহমদ মুসা তিনটি পাথরের সংকেতের মধ্যে আর কোন সংকেত পাওয়া যায় কিন দেখার জন্য তিন পাথরের সংকেত ভালোভাবে পরীক্ষা করতে শুরু করল। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল উত্তর দিকে ইংগিতকারী পাথরের সংকেতে একটি ‘মিম’ বাড়তি আছে। সে ‘মিম’টি পাথরটির ‘এক’ অংকের নিচে ছোট্ট করে লেখা।
আহমদ মুসা স্মরণ করল সংকেতওয়ালা পাথরটির গাছের ‘মিম’টির কথা। ‘মিম’টি সেখানে কোন অংকের সাথে ছিল না। ছিল প্রথম ‘এক’ অংকের পেছনের তীরের পেছনে। অর্থাৎ ঐ মিমটি সেখানে শুধু দিক জ্ঞাপক ছিল না, ছিল মূল সংকেত। সুতরাং ‘মিম’কেই অনুসরণ করতে হবে।
‘আমাদেরকে উত্তর দিকে বিশ হাত চলতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের দু’জনেই বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তাদেরকে ‘মিমের’ রহস্য খুলে বলল।
বিস্ময় তাদের চোখ-মুখ থেকে গেল না। তারা অনুসরণ করতে লাগল আহমদ মুসাকে।
বিশতম হাতের স্থানে এবারও পেল তিনটি পাথর। তিনটি পাথরেই ডানাছাড়া পাখির ছবি আঁকা। একটি পাখি পশ্চিমমুখী, একটি উত্তরমুখী, তৃতীয়টি পূর্বমুখী। পশ্চিমমুখী পাখির চোখের নিচে ঠোটের উপর একটি ছোট ‘মিম’ আঁকা।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন দু’জনেই মিমটা দেখল।
এবার পশ্চিম দিকে ২০ হাত যাবার পালা। সবাই তাকাল পশ্চিম দিকে। বিশ হাত দূরে এই পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশ। এটাই মূল অংশ পাহাড়ের। ওখানে পৌছার একটাই সংকীর্ণ গিরিপথ। গিরিপথের দুই পাশে গভীর গিরি খাদ।
সেই সংকীর্ণ গিরিপথ ধরে তারা এগুলো। দশ বারো হাত দূরত্বের স্বল্প পথ পেরিয়ে পাহাড়ের গলিতে গিয়ে পৌছল। গলিটির দক্ষিণ দিকে মূল পাহাড়। আর পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব দিকে পাহাড়ের দেয়াল। পূর্ব দিকের দেয়ালে মাত্র একটা সংকীর্ণ পথ।
এই গলিপথে তারা এগুলো ২০ হাত পূর্ণ করে।
যেখানে গিয়ে দাঁড়াল তারা, তার সামনে দক্ষিণ পাশের পাহাড়ের দেয়ালে এবড়ো-থেবড়ো বড় একটা পাথর। পাথরটি যেন তিলকের মত পাহাড়ের বুকে ঢুকে গেছে। পাথরের এক স্থানে অমসৃণ গায়েই নিচের দিকে মাথা বাঁকানো তীর আঁকা। তীরের পেছনেও মিম আঁকা।
‘আলহামদুলিল্লাহ আমরা পৌছে গেছি। আমি নিশ্চিত এই পাথরটিই ধনভান্ডারের মুখের তিলক। এটা সরালেই সেই ধনভান্ডার উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন। আমরা একটা মিশনে এসেছি। হঠাৎই আমরা একটা রাজভান্ডারের মুখোমুখি হয়েছি, যদি সংকেতের বক্তব্য সত্য হয়। এখন আমাদের কি করণীয়?’
সংগে সংগেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘মিশনটাই আগে সমাপ্ত করা দরকার। ওটা বেশি জরুরি।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ আবদুল কাদের। তোমার কাছে এই উপযুক্ত জবাবই আশা করছিলাম।’
আহমদ মুসা থামতেই সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘আমিও তোমাদের সাথে একমত। তবে আমরা সংকেত ধরে এত দূর এলাম সেটা কি, তা আমরা এখনো জানি না। আমি মনে করি আমাদের এই জানার কাজটা কমপ্লিট হওয়া দরকার।’
‘আপনার কথাতেও যুক্তি আছে। জনাব। যে অনুসন্ধিৎসায় আমরা এ পর্যন্ত এসেছি, তা শেষ করা দরকার।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘পাথরের উপর ক্যালিগ্রাফী দেখতে পাওয়া এবং সংকেত অনুসরণে এগিয়ে যাবার জন্যে মনে অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হওয়াকে আমি আল্লাহর ইচ্ছা হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমি মনে করছি আল্লাহ আমাদেরকে কোন ধন-ভান্ডার বা অন্য কোন কিছুর কাছে পৌছাতে চান। এই চিন্তাতেই আমি কিছুটা সময় এর পেছনে ব্যয় করেছি। অতএব যা জানার জন্যে এসব করেছি তা জানা প্রয়োজন।’
‘ধন্যবাদ স্যার। এটাই ঠিক সিদ্ধান্ত।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘একার পক্ষে সম্ভব নয়, আসুন সবাই মিলে পাথরটাকে সরাতে চেষ্টা করি।’ বলে পাথরের দিকে এগিয়ে গেল আহমদ মুসা।
পাথরটিকে দেকেই আহমদ মুসা বুঝল, পাথরটি লম্বভাবে পাহাড়ের বুকে ঢুকে আছে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে মসৃণ সমতল একটি পাথর পাহাড়ের উপর বসে আছে। আরও একটু মনোযোগ দিলে দেখা যাবে পাথরটি ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে, যা পাহাড়ের স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলেই দেখা যাবে ভিন্ন চিত্র। যে পাথর ভেতর থেকে প্রাকৃতিকভাবে উঠে আসে, তার নিচের দিকটা সরু ও মাথাটা মাটি থেকে উঠেই মোটা হয়ে যায় না।
তিনজনে মিলে পাথরটা সরিয়ে পাশের একটা পাথরে ঠেস দিয়ে রাখল। পাথর সরাতেই তার নিচে দেখা গেল পাথর কুচি ও মাটিতে নিচটা ভর্তি। স্থানটা গোলাকার।
আগ্রহের সাথে সবাই স্থানটা দেখছিল।
জমাট বাঁধা পাথর কুটি ও মাটির মধ্যে দুটো চেইন সবারই এক সাথে নজরে পড়ল। তিনটি হাত এক সাথেই সেদিকে এগুলো।
আহমদ মুসা হাত টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় পাথর ও মাটি কোন কনটেইনারে আটকে আছে। দুই চেইন ধরে টানলেই ওটা বেরিয়ে আসবে।’
তাই হলো। আবদুল কাদের ও সরদার জামাল উদ্দিন, দুজন দুই চেইন ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করতেই টবের মত উপরে প্রসারিত ও পেছনটা সরু একটা কনটেইনার বেরিয়ে এল।
কনটেইনার ও চেইন দু’টিই পিতলের তৈরি। কিন্তু বিবর্ণ হয়ে গেছে, চেনার উপায় নেই।
কনটেইনারটি পাশে রেখে দিল তারা।
পাথর মাটির মধ্য থেকৈ কনটেইনারটি উঠিয়ে নেবার পর ভেতরে দেখা গেল গুহার গোলাকার মুখ জুড়ে কালো একটা ঢাকনা গুহা-মুখের ফুট দেড়েক নিচে।
আহমদ মুসা হাত ঢুকিয়ে ঢাকনাটা স্পর্শ করে বুঝল, ওটা ধাতব। ঢাকনার মাঝখানে হাত দিয়ে ধরার একটি রিং পেল আহমদ মুসা। রিং ধরে ঢাকনা উপরে তোলার চেষ্টা করতেই গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেল।
সংগে সংগেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল সকলের। গোটা গুহা জুড়ে সোনালী সূর্যের ঝিলিক। গুহাভর্তি অঢেল সোনার মোহর।
তিনজনই বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন এক সাথেই।
স্বর্ণ মুদ্রার উপরে আয়তাকার একটা বাক্স দেখতে পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ে বাক্সটি তুলে নিল। বাক্সটি সোনার।
বাক্সটি উল্টিয়ে আহমদ মুসার মনে হলো এয়ারটাইট লক। বাক্সের মূল অংশ ও ঢাকনা মুখে মুখে ভিড়ানো।
খোলার কৌশল খুঁজতে গিয়ে বাক্সের দুই পাশে মূল অংশের উপরে ঢাকনার প্রান্ত ঘেঁষে নিচে বুড়ো আঙুলের ছাপ আঁকা দেখল।
বুঝল এ দুই স্থানে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতে বলা হয়েছে।
দুই বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই উপরের ঢাকনাটা ছিটকে উপরে উঠে পড়ে গেল।
সকলের আগ্রহী চোখ গিয়ে আছড়ে পড়ল বাক্সের ভেতরে।
বাক্সে তিন খন্ড চামড়ার কাগজ। সুন্দর, মসৃণ। এক সময় সাদা ছিল, এখন বিবর্ণ। তাতে আরবী লেখা। কালো কালিতে।
সকলের চোখেই অপার অনুসন্ধিৎসা। কি লেখা আছে কাগজটিতে!
সবাই সাবধানে হাতে নিয়ে দেখল চামড়ার কাগজ।
সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘আমরা যাবার আগে কাগজে কি লিখা আছে জেনে যেতে চাই। ভাই আহমদ মুসা তোমার কি মত? তুমি পড়বে কাগজটা?’
হেসে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি সেটাই ভাবছি। না পড়ে, না জেনে সামনে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।’
‘তাহলে স্যার পড়ুন। নিশ্চয় এতে ধনভান্ডার যিনি রেখেছেন তার পরিচয় ও তাঁর কথা জানা যাবে।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা।

লেদার পেপার থেকে পড়ছিল আহমদ মুসা:
‘আমি আবদুল আজিজ মালাকি। মালয় রাজ্যের হতভাগ্য সুলতান। পরাজিত ও রাজ্যহারা হয়ে পালিয়ে এসেছি এই কোহেতান পাহাড়ে আশ্রয় নেবার জন্রে এবং আমার এই অর্থ-কড়ির একটা কিনারা করার জন্যে। যুগ, বহু যুগ, শতবর্ষ বা বহু শতবর্ষ পরে যিনি বা যারা এই গনিমত পাবেন, তারা নিশ্চয়ই এই সম্পদের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবেন। তাদের জন্যেই আমার ও আমাদের সম্পর্কে কয়েকটি কথা।
এই ধনভান্ডার ‘মালাকি আল-ফালাহ’ সালতানাতের। মালাকি আল-ফালাহ সালতানাত গঠিত হয় প্রায় ৪০০ বছর আগে মালয়ের পশ্চিম উপকূলের ‘মালাকা’ বন্দর শহরে। আমার পিতামহের পিতামহ শাইখ ওয়াকিল বিন ওয়ালিদ একজন ব্যবসায়ী ও ইসলাম ধর্মের প্রচারক ছিলেন। এই উপলক্ষেই মালয় অঞ্চলে এসেছিলেন এবং ইসলাম প্রচারের নেশাতেই তিনি এক সময় মালাকা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সময়টা খৃষ্টীয় ১৩৯৬ সাল। এক সময় মালাকা অঞ্চলে স্থানীয়-অস্থানীয় মিলে মুসলমানদের সংখ্যা প্রচুর হয়ে দাঁড়ায়। তরুণ ওয়াকিল ইবনে ওয়ালিদ তাদের সামনে দাঁড়ান। অবস্থার কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয় মালাকা আল-ফালাহ সালতানাত। সুলতান আমার পিতামহের পিতামহ শেখ ওয়াকিল বিন ওয়ালীদ। পরবর্তী একুশ বছরের মধ্যে মালয়ের এ অঞ্চল শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়। আর বন্দর নগরী মালাকা হয়ে দাঁড়ায় গোটা অঞ্চলের ট্রেডিং ক্যাপিটাল।
তবে শান্তির ঘরে আগুন লাগে শীঘ্রই। ১৫১১ সালের এক কুলগ্নে পর্তুগীজরা এসে নোঙর করে মালাকাতে। সমুদ্রে যেমন তারা ছিল জলদস্যু, তেমনি স্থলেও তারা সুযোগমত লুটতরাজ শুরু করল। সমৃদ্ধ মালাকাকে তারা ভালোভাবেই টার্গেট করেছিল। শীঘ্রই তাদের সৈন্য ও যুদ্ধ জাহাজে ছেয়ে যায় মালাকা। মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতের সমৃদ্ধি ছিল, কিন্তু সেই অনুযায়ী শক্তি ছিল না। তাদের আন্তরিকতা ছিল, দেশপ্রেম ছিল, কিন্তু কূটনীতিতে অনকে পেছনে ছিল।
পর্তুগীজরা দখল করে নিল মালাকাসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চল। মালাকা আল ফালাহ সালতানাত মধ্যাঞ্চলীয় পাহাড়ের এ পাশের কেলানতান অঞ্চলে চলে আসে। মালাকা বিপর্যয়েও আমাদের কোন শিক্ষা হয় না। কেলানতানে আশ্রয় পাওয়ার পর আল-ফালাহ সালতানাত আয়েশের কোলে গা ভাসিয়ে দিল এবং সম্পদ ও শান্তির খোঁজে আবার পাগল হয়ে উঠল। সম্পদকে শক্তি বাড়াবার কাজে ব্যবহার না করে, সম্পদ দিয়ে শুধু সম্পদ বাড়াবার কাজই চলল। ওদিকে মালাকারের মালাকা ও উপকূলীয় অঞ্চল ১৬৪১ সালের দিকে পর্তুগীজদের হাত থেকে ডাচদের হাতে চলে গেল। যা করা উচিত ছিল মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতের তা করল ডাচরা। পরবর্তী ৫০ বছরে কিছু পরিবর্তন ঘটল জনশক্তির ক্ষেত্রে। ডাচদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও সেলেবিস দ্বীপাঞ্চল ছেড়ে হাজার হাজার মালাকা মালয় অঞ্চলে চলে আসল। তখন একটা জাগরণও হলো এবং ১৭০০ শতকের দিকে সকলের সমন্বয়ে মালয় রাষ্ট্র গঠিত হলো। মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতও এ রাষ্ট্রের একটা অংগ হিসাবে যোগদান করল। কিন্তু দেখা গেল আসল শিক্ষা তাদের হয়নি। শক্তির চেয়ে সম্পদ আহরণের দিকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকল। চারদিকের পরিস্থিতি কি, সময়ের দাবি কি, সে দিক থেকে তারা চোখ বন্ধই রাখল। পরবর্তী একশ বছরে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। এর ফলেই মালয় রাষ্ট্র পারল না, কিন্তু বৃটিশরা ১৮২০ সালের দিকে মালাকা অঞ্চল, পেনাংগ; সিংগাপুর দখল করে নিল। আরও একশ বছর পার হলো। বৃটিশদের ষড়যন্ত্র আরও সামনে অগ্রসর হলো, তাদের শক্তি আরও বাড়ল। কিন্তু মালয় রাষ্ট্র, মালাকা আল-ফালাহ সালতানাত, প্রভৃতির দেশীয় শক্তির অনৈক্য ও দুর্বলতা আরও বেড়ে গেলো। আর এই সময়েই বৃটিশরা গোটা মালয় উপদ্বীপ দখল করে নিল। যে সময় বৃটিশ সৈন্যরা কেলানতান দখল করে, সে সময় কেলানতানের মালকা আল-ফালাহ সালতানাতের দুর্ভগা সুলতান আমিই ছিলাম। যেদিন রাজধানী ‘মালাকা ছানি’র ৫০ মাইল দূরের শেষ দূর্গের পতন ঘটল বৃটিশদের হাতে, তখনই আমাদের পরাজয় সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। আমি রাজধানী ত্যাগ করলাম পরিবার ও সম্পদ সাথে করে নিয়ে।
কিন্তু এই সম্পদের এক কপর্দকও আমি রাখলাম না আমার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য। যতদিন বাঁচব পরিশ্রমলব্ধ আয় দ্বারা জীবন নির্বাহ করে অতীতের কৃত পাপের কিছু প্রায়শ্চিত্ত হলে তা করব। রাজভান্ডার থেকে আনা সব অর্থই এই গুহায় জমা রাখলাম এই আশায় যে, এই সম্পদ দিয়ে আমরা যা করিনি, করতে পারিনি, তার কিছুটা হলেও এই সম্পদ দিয়ে কেউ হয়ত শক্তি অর্জন করবেন আর আমার মন বলছে, এমন লোকই এই অর্থের সন্ধান পাবেন। আমার মন থেকে আসা এই কথা মহান আল্লাহরই কথা, এই প্রার্থনা মহান আল্লাহর কাছে আমি করি।’
পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার।
পড়তে পড়তে আহমদ মুসার মন বেদনায় ভারী হয়ে উঠেছিল। ছোট্ট তিন খন্ড কাগজের কথায় মালয় অঞ্চলের চারশ বছরের ইতিহাস যেন তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে ইতিহাস বেদনার, ব্যর্থতার এবং সব হারানোর এক অসহনীয় যন্ত্রণার।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বিষণ্ণ, গম্ভীর। তাদের চোখও সজল।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। কাগজের টুকরোগুলো সোনার বাক্সে পুরে তা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘বলুন জনাব।’
সরদার জামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে কথাটি বলেছিল আহমদ মুসা।
‘যে উপলব্ধি হয়েছে এই বক্তব্যে, সে উপলব্ধি যদি তখন সব মুসলিম শাসকের হতো! তাহলে এই এলাকার ইতিহাস ভিন্ন হতো।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘শুধু এ এলাকার নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাস ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এ উপলব্ধি সেদিন কোন মুসলিম শাসকের ছিল না। মুসলমানরা তাজমহল, আল-হামরা গড়েছে, কিন্তু ক্লাইভ-ফার্ডিন্যান্ডদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার শক্তি অর্জন করেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজও কি এই উপলব্ধি হয়েছে স্যার?’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠ ভারী।
‘হয়নি আবদুল কাদের। হলে, আল্লাহর দেয়া অঢেল পেট্রডলার আকাশস্পর্শী ইমারত, মসৃণ হাইওয়ে নির্মাণ হবার আগে অন্তত আত্মরক্ষার জন্য স্বনির্ভর একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠতো।’ আহমদ মুসা বলল। তারও কণ্ঠ ভারী।
কথা শেষ করেই সোনার বাক্সটি আবার স্বর্ণ মুদ্রার স্তুপের উপর রেখে বলল, ‘আমাদের এখানকার কাজ শেষ। আসুন গুহামুখ আমরা বন্ধ করি।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনও।
‘ভাই আহমদ মুসা, এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো শুধু টাকাই নয়, আমাদের পূর্ব পুরুষদের অমিতাচার, ব্যর্থতার শিক্ষা ও সাক্ষ্য হয়ে এসেছে আমাদের জন্যে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠও ভারী।
‘ঠিক বলেছেন জনাব।’
বলে আহমদ মুসা গুহামুখ বন্ধের কাজে মন দিল।
কাজে লাগল সকলেই।
গুহামুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল পাহাড়ের সেই গলি থেকে, পাহাড় থেকে।
উঠে এল তারা কিং রোডে আবার।
তাদের মিশনের সেই যাত্রা শুরু হলো নতুন করে।
লক্ষ্য কাতান টেপাংগো।
আগের মতই আগে আগে চলছে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন, মাঝখানে আহমদ মুসা এবং পেছনে সরদার জামাল উদ্দিন।

পরবর্তী বই
বসফরাসে আহবান

Top