৪৪. ব্লাক ঈগলের সন্ত্রাস

চ্যাপ্টার

মাগরিবের নামাযে ইমামতি করল আহমদ মুসা।
নামায শেষ করেই সরদার জামাল উদ্দিন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মুয়াজ্জাজ ভাই আহমদ মুসা, তোমার সাথে জরুরি আলাপ আছে। কিন্তু একটু বাজারে যেতে হবে আমাকে। আমি এখনি আসছি।’
উঠে দাঁড়াল সরদার জামাল উদ্দিন। বলল আয়েশা আলিয়াকে, ‘আয়েশা বোন, তুমি এর মধ্যে চা-টা নিয়ে এস।’
চলে গেল সরদার জামাল উদ্দিন।
আহমদ মুসারা সবাই জায়নামায থেকে সোফায় ফিরে এল।
আহমদ মুসার সামনের সোফায় বসল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। পাশে একটু দূরের সোফায় বসল আয়েশা আলিয়া।
বসেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল আহমদ মুসকে, ‘স্যার কুরআন শরীফে ইহুদী-নাসারাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তার মানে তাদেরকে সব সময় শত্রু হিসাবে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা জানার জন্যে প্রশ্ন করেছি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বন্ধু ও শত্রুতার নীতি নির্ণয় করতে হবে আল-কুরআন সামগ্রিকভাবে যে নীতি নির্ধারন করেছে, তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন সুরা মায়েদার ৫১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘হে মুমিনগণ, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরষ্পর বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধরূপে গ্রহণ করলো সে তাদেরই একজন হবে। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’ আল্লাহর এই নির্দেশ এমন সময়ে নাজিল হয়েছিল, তখন ছদ্মবেশী মুনাফিকরা ইহুদী-নাসারাদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কোন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে যোগদানের ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কোন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে যোগদানের ষড়যন্ত্র করেছিল। মুসলমানদের যুদ্ধরত প্রতিপক্ষের সাথে সম্পর্কের নীতি হিসেবেই আল্লাহ এই আদেশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে এই নীতি অবশ্যই পালনীয়। এই নীতি সব সময় সব ক্ষেত্রে পালনীয় হবে না তা আল্লাহ রাববুল আলামিনই বলে দিয়েছেন। আল-কুরআনের সূরা ‘মুমতাহানা’র ৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেছেন, ‘‘আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দীনের (বিশ্বাস ও ধর্মের) ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কার সাহায্য করেছে। তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারা তো জালিম।’’ আল্লাহর এই আদেশে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্ম ও বিশ্বাসের সাথে যারা যুদ্ধ করেনি, বৈরিতা করেনি এবং যুদ্ধ ও বৈরিতায় সাহায্য করেনি, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়নি। আর কারো সাথে এবং কোন জাতির সাথে বন্ধুত্ব ও শত্রুতাকে আল্লাহ স্থায়ী বিষয়ও করেননি। আল্লাহ তায়ারঅ সূরা ‘মুমতাহানা’র ৭ আয়াতে বলেছেন, ‘যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে সম্ভবত আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
কথা শেষ করল আহমদ মুসা। তারপর আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘বিষয়টা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে কামাল?’
‘স্যার জটিল বিষয়টাকে আপনি খুব সহজ করে বললেন।’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহ তার দীনকে তার বান্দাদের জন্যে সহজ করেছেন, কঠিন করেননি। আর আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন ইহুদী নাসারাসহ সব মানুষের জন্যে। কারও সাথে যুদ্ধমান পরিস্থিতি না থাকলে তার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। সুতরাং এ ধরনের সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যা স্বাভাবিক সম্পর্ক অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।’
‘কিন্তু স্যার, সত্য ও অসত্য তো দ্বন্দ্বমান। সত্যের শত্রু অসত্য এবং অসত্যের শত্রু সত্য। এ দুয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব সহযোগিতা তো হতে পারে না।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, সত্য ও অসত্য চির দ্বন্দ্বমান। কিন্তু সত্যপন্থী ও মিথ্যা-পন্থীর দ্বন্দ্ব চিরন্তন নয়, শত্রুতাও তাদের চিরস্থায়ী নয়। মিথ্যাপন্থী যে কোন সময় সত্যপন্থী হয়ে যেতে পারে। এ লক্ষে চেষ্টা করাও সত্য-পন্থীর দায়িত্ব এবং এজন্যে মিথ্যাপন্থীর সাথে একটা প্রয়োজনীয় সম্পর্ক তার রাখা প্রয়োজন। এ সম্পর্ক রক্ষার দাবি হলো, মিথ্যাপন্থী শত্রু হলেও সর্বাবস্থায় তার প্রতি সুবিচার করতে হবে। এই আদেশ আল্লাহ কুরআন শরীফে সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। সূরা মায়িদার ৮ আয়াতে তিনি বলছেন, ‘কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সদা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর।’ ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে এই সুবিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ ইসলামে অবশ্য পালনীয় বিষয়।
‘আপনার কথা বুঝেছি স্যার। আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের সহাবস্থান ও সহযোগিতা খুব কঠিন এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অসত্যপন্থীদের সংস্পর্শ-সাহচার্যে সত্যপন্থীদের কাজ ও বিশ্বাসেও বিচ্যুতি আসতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এর সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তোমার আশঙ্কা ঠিক। সত্যপন্থীরা জ্ঞান, বুদ্ধি, উদ্যোগ, আয়োজনে দূর্বল হয়, তাহলে তোমার আশঙ্কা সত্য হতে হবে, ইতিহাসও এর সাক্ষী। আর সত্যপন্থীরা যদি সর্বক্ষেত্রে সফল হয়, তাহলে তোমার আশঙ্কার উল্টোটা ঘটবে। তোমাদের খুব কাছের একটা দেশের দৃষ্টান্ত দেখ। বাংলাদেশ ভারত উপমহাদেশের একটা অংশ। ভারতে আটশ বছর মুসলিম শাসন ছিল এবং এই মুসলিম শাসনের কেন্দ্র ছিল দিলস্নী। শাসনের শক্তি, প্রভাব, প্রতিপত্তি সবকিছুর চুড়ান্ত প্রদর্শনি ছিল সেখানে। মুসলিম শাসনকেন্দ্রের আটশ’ বছরের প্রভাব-প্রতিপত্তি সত্ত্বেও দিলস্নী ও তার আশ-পাশের অঞ্চলে মুসলমানরা সাংঘাতিকভাবে সংখ্যালঘিষ্ট। মুসলিম শাসনকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে ছিল বাংলাদেশ প্রদেশটি। অথচ এই বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর কারণ বাংলাদেশে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল না, ফলে উন্নততর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বেশি কাজ করেছে। প্রতিটি মানুষই শান্তি, সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবন চায়। শাসকের তলোয়ারের ছায়া থেকে অনেক দূরে মুসলিম শাসনের একটি প্রদেশ বাংলাদেশে ইসলামের মহান অনুসারীরা তাদের কাজ, কথা ও চরিত্রের মাধ্যমে আপামর মানুষদের শান্তি, সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবনের সন্ধান দিয়েছিল। তার ফলেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। সুতরাং উন্নততর ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারী মানুষদের সহাবস্থানে ভয় করার কিছু নেই।’
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা শুনছিল আহমদ মুসার। তাদের ধর্ম ইসলামের এক নতুন রূপ তাদের সামনে আসছে জীবন্ত হয়ে, যে সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান ছিল না।
এবার মুখ খুলল আয়েশা আলিয়া। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে স্যার। প্রথম দিন থেকেই আপনার কাছে নতুন কথা শুনছি এবং সত্য হিসাবে তা শিরোধার্য হয়ে উঠেছে।’
আয়েশা আলিয়া থামতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘হতেই হবে। তার পরিচয় সামনে রাখলে এ প্রশ্নও তোমার মনে উঠতো না। যাক। কিন্তু………..।’
বলেই কথা শেষ না করে থেমে গেল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। একটা ঢোক গিলল। কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘কিন্তু আমীর হাবিব হাসাবহ এতটাই উল্টো ব্যাখ্যা করেন তাহলে?’
‘কি নাম বললে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হাবিব হাসাবাহ।’ বলল আবদুল কাদের।
‘কে তিনি? কিসের আমীর তিনি?’ আহমদ মুসার প্রশ্ন।
‘কেন তিনি আমাদের পাত্তানী মুজাহেদীনদের আমীর!’
‘হাবিব হাসাবাহ। কতদিন থেকে তাকে তোমরা জান?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দু’ বছর।’ আবদুল কাদের বলল।
‘দুবছর আগে তিনি কোথায় ছিলেন, কি করতেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তা আমরা জানি না। তার আরও ঘনিষ্ঠজনরা তাকে জানতে পারেন। তবে শুনেছি, তিনি জার্মানীতে বসবাসকারী একটি থাই মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি আল আজহারে লেখা-পড়া করেছেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই মিশনারী চরিত্রের। শেকড় সন্ধানে তিনি থাইল্যান্ডে আসেন এবং জাতির দুঃসময় দেখে তাদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।’ থামল আবদুল কাদের।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জার্মানীতে তো নয়ই, কোন দেশেই কোন মুসলিমের নাম এমন হয় না। ‘হাসাবাহ’ শব্দটি হিব্রু, আরবী নয়। ‘হাবিব’ শব্দটি আরবী বটে, কিন্তু আরবী ইহুদীরা এই নাম ব্যবহার করে থাকে। এখন বল, লোকটি ‘থাই’ চেহারার?’
‘জি না। তার চেহারা আরবীদের মতো। শুনেছি, তার আববা থাই হলেও , মা আরবী। এ কারণেই তার আরবী চেহারা।’ বলল আবদুল কাদের।
‘আবদুল কাদের, লোকটি ইহুদী। তোমার মানতে কষ্ট হবে, কিন্তু তিনি ইহুদী হলে তবেই আজ থাইল্যান্ডে যা ঘটছে, তার সাথে তোমার আমীর হাবিব হাসাবাহর সম্পর্ক দাঁড় করানো যায়। হাবিব হাসাবাহ কোথায়………..।’
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা থামল।
‘দাদাজান এসেছেন।’ বলে আবদুল কাদের উঠে গেল দরজা খুলে দেবার জন্যে।
দরজা খুলে দিল আবদুল কাদের।
দাদাকে সালাম দিয়ে স্বাগত জানাল।
তার দাদা সরদার জামাল উদ্দিন ভেতরে প্রবেশ করলো। আবদুল কাদের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সামনে চোখ পড়তেই দেখল নিচে উপত্যকার দিক থেকে একজন লোক তার বাড়ির রাস্তা ধরে উপরে উঠে আসছে।
‘কে আসছে’ এই কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আবদুল কাদের।
লোকটি আরও সামনে এগিয়ে এল।
চেহারায় চোখ পড়তেই চমকে উঠল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। লোকটি ‘সাবাত সোলায়মান’। একজন থাই মুসলিম। সে বেতাং এলাকায় ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ ওরফে ‘ব্ল্যাক ঈগল’-এর নেতা হাবিব হাসাবাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রত্যেক এলাকায় এমন বিশেষ লোক রয়েছে। মনে করা হয়, এরা গোপন গেরিলা ইউনিটের সদস্য। এরা খুবই পাওয়ার ফুল। তাদের বাড়িতে সে কয়েকবার এসেছে।
আবদুল কাদের ভেতরে ছুটে গিয়ে তার দাদাকে বলল, ‘দাদা, সাবাত সোলায়মান আসছেন।’
‘সাবাত সোলায়মান? ভালো। খুব ভালো করিতকর্মা লোক। নিয়ে এস।’ বলেই হঠাৎ সরদার জামাল উদ্দিন বিমর্ষ হয়ে পড়ল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই তো?’
সাবাত সোলায়মান নামটা শুনেই চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। নামটা শুনেই বুঝেছিল ওটা ইহুদী নাম। নামটা শুনে ভ্রুটাও কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার। সে কি জেনে-শুনে আসছে? কিন্তু তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। আহমদ মুসা তার উদ্দেশ্যের কথা কারও কাছে বলেনি। বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই।’
‘আমি নিয়ে আসছি গিয়ে’ বলে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ছুটে গেল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সাবাত সোলায়মান এল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন তাকে সালাম দিল। সাবাত সোলায়মান সালাম নিয়ে বলল, ‘তোমাদের বাসায় যে মেহমান এসেছিলেন, তিনি আছেন?’
‘আছেন।’ বলল আবদুল কাদের।
‘চল।’ বলে দ্রুত উঠে এল বারান্দায়।
লোকটি বারান্দায় উঠে আসতেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন দেখল সাবাত সোলায়মান লোকটি তার পেছনেই। ডান হাতটি তার পকেটে।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল তারা।
আহমদ মুসাসহ অন্য সবাই উঠে দাঁড়াল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন মেহমান সাবাত সোলায়মানকে বসতে বলার জন্যে তার দিকে তাকিয়েছিল। তাকিয়েই চমকে উঠল সাবাত সোলায়মানের হাতে রিভলবার দেখে।
সাবাত সোলায়মান আহমদ মুসাকে একনজর দেখেই পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাত বের করে এনেছিল এবং রিভলবার তুলেছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
সাবাত সোলায়মানের হাতের রিভলবার সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া দুজনেই দেখতে পেয়েছিল। তাদের চোখে আতংক।
বিমূঢ়ভাব আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনেরও।
আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তুলেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘সেদিন মসজিদেই তোমাকে চিনতে পেরেছি তুমি আহমদ মুসা। দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ তোমাকে। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্যে একটু অপেক্ষা করেছি। আজ তোমার ফটো পেয়েছি। কয়েকদিন জীবন বেশি পেলে। আজ তোমার দিন শেষ।’
কথা শেষ হবার আগেই তার রিভলবার থেকে গুলী বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসার দুচোখ স্থিরভাবে নিবদ্ধ ছিল সাবাত সোলায়মান লোকটির তর্জনির দিকে। আর তার ডান হাত সেঁটে ছিল পকেটের সাথে।
সাবাত সোলায়মানের তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসার সংগে সংগেই নিজের মাথা পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ছিটকে পড়েছিল সোফার উপর এবং এই ফাঁকে পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল রিভলবার। পিঠ দিয়ে সোফা স্পর্শ করতেই হাতে তুলে নেয়া রিভলবার থেকে পর পর দুটি গুলী করেছিল আহমদ মুসা।
সাবাত সোলায়মান তার প্রথম গুলীকে ব্যর্থ হতে দেখে নতুন টার্গেটে রিভলবার নামিয়ে নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সময়েই আহমদ মুসার প্রথম গুলী এসে বিদ্ধ হলো তার হাতে। হাতের রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল। আহত হাতের প্রতি কোন ভ্রুক্ষক্ষপ না করে সাবাত সোলায়মান তার বাম হাত বাম পকেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার দ্বিতীয় গুলী এসে বিদ্ধ করল সাবাত সোলায়মানের বাম বুক।
মেঝের উপর ঢলে পড়ে গেল সাবাত সোলায়মানের দেহ। ঢলে পড়ে বুক চেপে ধরে সে চিৎকার করে বলল, ‘আমাকে মারলেও তুমি পালাতে পারবে না এখান থেকে আহমদ মুসা। আমি একা আসিনি। জিহোভা অবশ্যই তোমাকে শাস্তি দেবেন।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। শেষ বাক্যটা সাবাত সোলায়মান হিব্রু ভাষায় বলল।
সাবাত সোলায়মানের পকেটের মোবাইল বেজে উঠল এই সময়।
আহমদ মুসা উঠে দ্রুত ছুটে গিয়ে তার পকেট থেকে মোবাইল বের করল। নিশ্চয়ই সাবাত সোলায়মানের কোন সাথীর টেলিফোন হবে। তার শেষ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আশে-পাশে কোথাও থেকে ওরা টেলিফোন করেছে। হয়তো গুলীর শব্দও ওরা শুনতে পেয়েছে।
আহমদ মুসা মোবাইল তুলে নিয়ে যতটা পারা যায় সাবাত সোলায়মানের কণ্ঠ নকল করে বলল, ‘হ্যালো।’
ওপার থেকে কে একজন বলল, ‘সাবা, গুলী-গোলার শব্দ পেলাম। তুমি ঠিক আছ?’ ওপারের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি আহত। শয়তানটা আমাকে দুটি গুলী করেছে। তোমরা এস। জিহোভা আমাদের সাহায্য করুন।’
বেদনাকাতর আর্তকণ্ঠে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ অনেকটাই সাবাত সোলায়মানের মতো শোনাল। শেষ বাক্যটা আহমদ মুসাও হিব্রু ভাষায় বলল। কণ্ঠটা সাবাত সোলায়মানেরই এ বিশ্বাস নিশ্চিত করার জন্য হিব্রু ভাষা ব্যবহার করল।
আহমদ মুসা সাবাত সোলায়মানের সাথীদের সবাইকে সামনে আনতে চায়। এ জন্যেই সে সাবাত সোলায়মানের আহত হওয়ার খবরটা ওদের জানাল, যাতে তাকে উদ্ধার করতে ওরা সবাই ছুটে আসে।
‘তুমি কোথায়?’ ওপার থেকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি বারান্দার সিঁড়ির আড়ালে।’
‘তুমি অপেক্ষা কর। আমরা আসছি।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওপার থেকে মোবাইল বন্ধ হওয়ার শব্দ এল।
আহমদ মুসা মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখে দিতে দিতে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এর লাশটা বারান্দার সিঁড়ির আড়ালে ঠেস দিয়ে রেখে আসি।’
বলেই আহমদ মুসা সাবাত সোলায়মানের লাশটি পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
সরদার জামাল উদ্দিন, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া সবাই রাজ্যেল আতংক-উদ্বেগ নিয়ে পাথরের মূর্তির মত নিশ্চয় দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে যে আহমদ মুসার মৃত্যু তাদের কাছে অবধারিত মনে হয়েছিল, সেই আহমদ মুসা দৃশ্যপট পাল্টে দিল। এ সিনেমার কোন দৃশ্য নয়। নিদারুণ এক বাস্তবতা।
আহমদ মুসার কথায় সম্বিত ফিরে পেল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘স্যার লাশটা ওখানে আমি নিতে চাই।’
‘বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই এসব করে না।’ বলল হাসি মুখে আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম, সাবাত সোলায়মানের সাথীরা আসছে। নিশ্চয় ওরা শুধু লাশ নিয়ে চলে যাবে না!’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘অবশ্যই জনাব। ওরা সামনা সামনি লড়াইয়ে আসুক। এজন্যেই ওদের এভাবে ডেকেছি। এতে আমাদের সুবিধা হবে। আমরা ওদের জানব, কিন্তু ওরা আমাদের জানবে না। তা না হলে ওরা আমাদে রজানত, ওদের শিকার হতাম আমরা। ওদের আমরা জানতে পারতাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
বিমুগ্ধ ভাব ফুটে উঠল সরদার জামাল উদ্দিনের গোটা চেহারায়। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আল্লাহর হাজার শোকর। আগুনের মত গরম পরিবেশেও তোমার মাথা এত ঠান্ডা থাকে। মুহূর্তের মধ্যে এমনভাবে নিখুঁত চিন্তা তুমি করতে পার!’
আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনের দু’একটা কথা শুনেই লাশ নিয়ে চলতে শুরু করেছিল।
আহমদ মুসার পিছু নিয়ে আবদুল কাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আয়েশা আলিয়া ছুটে এসে তার দাদার হাত ধরে বলল, ‘সাবাত সোলায়মানের সাথীরা কি অনেক?’
‘হতে পারে। আমি জানি না। কিন্তু ভেব না। আল্লাহর কাছে সংখ্যা বড় নয়। আর আহমদ মুসা আল্লাহর কি ধরনের সৈনিক, তাতো ইতিমধ্যেই বুঝে গেছ নিশ্চয়।’
বলেই সরদার জামাল উদ্দিন হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘এস, বাইরে গিয়ে দেখি। শয়তানরা কিন্তু এখনি এসে যেতে পারে।’
আয়েশা আলিয়াও দাদার পিছনে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা বারান্দায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
সাবাত সোলায়মানের লাশকে সে ইতিমধ্যেই নিচে সিঁড়ির পাশে রেখে এসেছে।
আহমদ মুসার একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আয়েশা আলিয়া গিয়ে দাঁড়াল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের পেছনে। তাদের সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা তার হাতের মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েছিল। এই মোবাইলটাই পেয়েছিল সে সাবাত সোলায়মানের পকেট থেকে। আহমদ মুসার চোখে-মুখে নিশ্চিন্ত ভাব।
কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছে সরদার জামাল উদ্দিন ও অন্য সবাই।
সরদার জামাল উদ্দিন বলেই ফেলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, এই মুক্ত জায়গায় আমাদের দাঁড়ানো ঠিক হচ্ছে না। ওদের চোখ এ দিকেই। ওদের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। ওরা ধীরে ধীরে এদিকে এগুচ্ছে।’
‘এদিকে চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু ওরা এদিক দিয়ে আক্রমণ করবে না। চোখের সামনে এভাবে আসাই তার প্রমাণ।’
‘তার মানে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘তার মানে ওরা আমাদের পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি। তাহলে চল ওদিকে দেখি।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘পেছনে কি দরজা আছে?’
‘আছে। ভেতর থেকে তালাবন্ধ।’
‘তালা আজ কোন বাধা নয়।’ বলেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনারা এখানে দাঁড়ান। আমি ওদিকে দেখি।’
আহমদ মুসা ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। সরদার জামাল উদ্দিন জিজ্ঞেস করল, ‘শত্রু যদি পেছন থেকে আসে, তাহলে আমাদের এখানে থাকা কেন?’
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ওরা যাতে বুঝতে পারে পেছনে আমাদের কোন সতর্কতা নেই, চোখ নেই। তাহলে ওরা নিশ্চিন্তে পেছন দিক থেকে আসতে পারে।’
‘আমরা বুঝেছি ধন্যবাদ স্যার।’ হাসি মুখে এক সাথে বলে উঠল, আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন এবং আয়েশা আলিয়া।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

সাবাত সোলায়মানের সাথে কথা শেষ করেই দানিয়েল দানেশ মোবাইল পকেটে ফেলে বলল, ‘সাবাত সোলায়মান আহত। এখনি আমাদের মুভ করা দরকার।’
‘তাহলে তো সাবাত সোলায়মানের সন্দেহ ঠিক। লোকটি আহমদ মুসাই।’ বলল দানিয়েল দানেশের পাশে দাঁড়ানো মিকাইল মৈনাক।
দানিয়েল দানেশ এবং তার সহকারী মিকাইল মৈনাক আরও কয়েকজন আজই বেতাংগে এসে পৌছেছে। সাবাত সোলায়মানের পাঠানো ছবি দেখে লোকটি যে আহমদ মুসা তা নিশ্চিত করার পরই কাতান টেপাংগো থেকে এদের পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে আহমদ মুসাকে বন্দী করার জন্যে নয়, দেখা মাত্র হত্যা করার জন্যে।
সাবাত সোলায়মান আহমদ মুসাকে সব সময় চোখে চোখেই রেখেছিল। আহমদ মুসা যখন সরদার জামাল উদ্দিনের বাড়িতে প্রবেশ করে, তখন নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল সাবাত সোলায়মান। এ সময়ই এসে পৌছে দানিয়েল দানেশরা। মোবাইলে যোগাযোগ হলে সাবাত সোলায়মান তাদেরকে লোকেশান জানিয়ে এখানেই ডেকে পাঠায়। দানিয়েল দানেশ ও মিকাইল মৈনাক আরও পাঁচজন সাথীসহ সেখানে এসে পৌছায়।
এসেই দানিয়েল দানেশ সাবাত সোলায়মানকে প্রশ্ন করে, ‘সরদার জামাল উদ্দিনরা তো আমাদের লোক। আহমদ মুসা সেখানে কেন?’
‘আমি দেখেছি বৃষ্টির তাড়া খেয়ে সে প্রথমে তাদের বাড়ি সামনে পেয়ে সেখানে উঠেছে। সরদার জামাল উদ্দিনের সাথে গত জুমার নামাযে তার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু এ কয়দিন সে আসেনি এ বাড়িতে।’ বলেছিল সাবাত সোলায়মান।
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন বলুন, আপনি কিছু করণীয় চিন্তা করছেন কিনা।’ বলে দানিয়েল দানেশ।
‘হ্যাঁ, আমাদের এখনই ওখানে যাওয়া উচিত। কিন্তু এক সাথে যাওয়া যাবে না। আহমদ মুসা সন্দেহ করতে পারে। আমি……….।’
সাবাত সোলায়মানের কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠে দানিয়েল দানেশ। থেমে যায় সাবাত সোলায়মান।
দানিয়েল দানেশ বলে, ‘ঠিক বলেছেন মি. সাবাত সোলায়মান। আহমদ মুসাকে সন্দেহ করতে দেয়া যাবে না। সে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আগাম সন্দেহ করলে তাকে বাগে আনা যাবে না।’
‘হ্যাঁ, তাই আমি ভাবছি, আগে বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলতে হবে, যাতে তার পালাবার পথ বন্ধ হয়। তারপর প্রথমে আমি একাই যাব মনে করছি। আমি ওদের সবার পরিচিত এবং এখানেই থাকি বলে কেউ কিছু ভাববে না। এই অবস্থায় অতর্কিতে গুলী করে হত্যা করা আমার পক্ষে সহজ হবে। প্রথম দর্শনে আমি এই চেষ্টাই করব। আমার চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তোমাদের মোবাইল করব, তাও না পারলে ওয়াম বাটন প্রেস সিষ্টেমে আমি মিসকল দেব।’ বলেছিল সাবাত সোলায়মান।
এসব কথা সামনে এসে গিয়েছিল দানিয়েল দানেশের। মিকাইল মৈনাকের কথার জবাবে সে বলল, ‘হ্যাঁ, আহমদ মুসা না হলে গুলী করার দরকার নেই।’
কথা শেষ করেই দানিয়েল দানেশ মোবাইল তুলে একটা কল করল। বলল, ‘তোমরা তিন জন বাড়ির সামনে থাক। অস্ত্র বাগিয়ে খুব ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে আগাও। যাতে তাদের সব মনোযোগ তোমাদের দিকে নিবদ্ধ থাকে। যে তরফেরই হোক গুলীর শব্দ শোনার পর তোমরা বাড়িতে প্রবেশ করবে।’
মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখেই বলল দানিয়েল দানেশ, ‘চল আমরা পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকব।’
সরদার জামাল উদ্দিনের বাড়িটার পেছনের দিকটায় ফলের বাগান। ছোট-বড় অনেক গাছ। বড় গাছের বিভিন্ন ধরনের আগাছা।
গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে তারা বাড়ির পেছনের পাশে গিয়ে পৌছল। বাড়ির কোন পাশে বা পেছনে কোথাও চাকর-বাকরদের যাতায়াত ও মাল-পত্র আনা-নেয়ার জন্য একটা দরজা থাকবেই, এটা তারা ধরেই নিয়েছিল।
তারা পেয়ে গেল দরজা। পুরু ষ্টিলশীটের বড় দরজা।
ডিজিটাল লক। ভেতর থেকে বন্ধ করা।
দানিয়েল দানেশ পকেট থেকে ল্যাসার বীম কাটার বের করে দরজার লক এরিয়া গোটাটাই কেটে ফেলল। খসে পড়ল কাটা অংশটা। তৈরি হলো টেনিস বল আয়তনের একটা ছিদ্র। দরজাও একটু নড়ে উঠে কিঞ্চিত পেছনে সরে গেল।
হঠাৎ একটা অব্যাহত যান্ত্রিক শব্দ কানে এল দানিয়েল দানেশের। দরজায় সৃষ্ট ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল দানিয়েল দানেশ। শুনতে পেল অব্যাহত অ্যালার্ম বাজার শব্দ। দেখল ভেতরের ঘরটা আলোকিত। ঘরে কেউ নেই।
বুঝে নিয়েছিল দানিয়েল যে ডিজিটাল লকের সাথে এলার্ম সংযোগ ছিল। ডিজিটাল লকটা আনলক হলেও এলার্মের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।
দানিয়েল দানেশ তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। দেখল কেটে ফেলা ডিজিটাল লকটি দরজার পাশের দেয়ালে একটা তারে ঝুলছে। তারটি ছিড়ে ফেলল সে।
থেমে গেল এলার্ম।
দানিয়েল দানেশের সংগে সংগে অন্য সবাই প্রবেশ করল ভেতরে।
ভেতরটা কোন ঘর নয়, আয়তাকার একটা প্যাসেজ।
এলার্ম থামলেও আতংক কাটেনি দানিয়েল দানেশের। এলার্ম বেজেছে তার অর্থই হলো প্রতিপক্ষের কাছে তাদের আগমনের কথা ঘোষণা হয়ে গেছে। অতএব শত্রুদের অলক্ষে পেছন দিক থেকে নিরাপদ আক্রমণের যে চিন্তা তারা করেছিল, তা ভন্ডুল হয়ে গেল।
প্যাসেজটির সামনে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় একটা বড় খোলা দরজা। দরজার ওপারটাও আলোকিত।
কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকার পর দানিয়েল দানেশ আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে এগুতে শুরু করল। হঠাৎ সামনে থেকে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েই দানিয়েল দানেশ ছুটে গিয়ে সিঁড়ির পাশে দু’ফুট উঁচু দেয়াল সেঁটে হামাগুড়ি দেয়ার মত করে বসল। তার সাথের অন্যরাও এভাবে গিয়ে দেয়ালের আশ্রয় নিল।
এছাড়া তাদের লুকানোর কোন জায়গা ছিল না। লুকানোর জন্যে এটা মোটেও ভাল জায়গা না হলেও যে বা যারা আসছে প্রথমেই তাদের দৃষ্টিতে পড়া থেকে বেঁচে যাবে। তার উপর দেখার জন্যে তারা নিশ্চয় সিঁড়ি পর্যন্ত আসবে। আসলেই সে বা তারা তাদের হ্যান্ড মেশিনগানের আওতায় এসে যাবে।
পায়ের শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ভাবনা দানিয়েল দানেশের থেমে গেল।
সে সতর্ক হয়ে উঠল। তাহলে ওরা নিশ্চয় খোলা দরজা দেখতে পেয়েছে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করেছি, এটাও নিশ্চয় তারা সন্দেহ করেছে।
এই চিন্তা শেষ হবার আগেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ ভেসে এল দানিয়েল দানেশের কানে। পায়ের শব্দগুলো দরজার কাছাকাছি আসতেই একটা শক্ত চাপা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘সামনে এক পাও নয়, দাঁড়ান আপনারা।’
ঘটনাটা বুঝতে দানিয়েল দানেশের মুহূর্তও দেরি হলো না। আগে যার পায়ের শব্দ শুনেছিল, সে নিশ্চয়ই তাদের আগমন টের পেয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। এই সময় বাড়ির অন্যরা এসে পৌছেছে। প্রথম লোকটি আহমদ মুসা হবার সম্ভাবনাই বেশি।
এসব কথা দানিয়েল দানেশের মাথায় বিদ্যুতের মত মুহূর্তেই খেলে গেল। এখন তার কি করা দরকার তাও মাথায় এসে গিয়েছিল। তাদের কথা বলা ও দাঁড়ানোর সুযোগটাকে গ্রহণ করতে হবে। দানিয়েল দানেশ রিভলবার বাগিয়ে আড়াল থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়েই রিভলবারের টার্গেট ঠিক করতে গেল।
কিন্তু দেখল আহমদ মুসার বাম হাত যখন দু’জনকে ঠেলে মেঝেয় ফেলে দিচ্ছে, তখন তার ডান হাতের মেশিন রিভলবার তার লক্ষে আগেই উঠে এসেছে।
দানিয়েল দানেশের টার্গেটে স্থির হবার আগেই আহমদ মুসার রিভলবারের পর পর দু’টি গুলী এসে তার মাথা ও বুককে বিদ্ধ করল।
দানিয়েল দানেশের পেছনে অন্যরাও তার সাথেই বেরিয়ে এসেছিল। তারাও আহমদ মুসার গুলী বৃষ্টির মুখে গিয়ে পড়ল। ডান দিকে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ানো একজনই শুধু গুলী করার সুযোগ পেল। কিন্তু তার ডান হাতের মেশিন রিভলবারের গুলী দরজার সাথে তার কৌণিক অবস্থানের কারণে অধিকাংশই দরজায় গিয়ে বিদ্ধ হলো। দরজাকে পাশ কাটিয়ে কয়েকটি গুলীই শুধু আহমদ মুসার দিকে ছুটে যেতে পারল। তার একটি গিয়ে আহমদ মুসার বাম বাহু বিদ্ধ করল। কিন্তু লোকটি টার্গেট এডজাষ্ট করার দ্বিতীয় সুযোগ পেল না। তার আগেই আহমদ মুসার বৃষ্টির মত ছুটে আসা গুলীর শিকার হলো।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে দরজার দু’পাশে তাকিয়ে দেখল আর কেউ নেই।
মেঝের উপর পড়ে যাওয়া সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন উঠে বসেছে। আয়েশা আলিয়াও ছুটে ঘরে প্রবেশ করেছিল। আহমদ মুসার বাহু থেকে রক্ত ঝরতে দেখে সে আতংকিত হয়ে ছুটে এসে বাহু ধরে বলল, ‘স্যার আপনি আহত। আর কোথাও গুলী লাগেনি তো?’
আহমদ মুসার নজর তখন বাইরের দিকে। তিনজন ছুটে আসছে ঘরের দিকে। আহমদ মুসা আয়েশা আলিয়াকে জোরে পাশের দিকে ঠেলে দিয়ে লাফ দিয়ে ঘরের পূর্ব প্রান্তে মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েই গুলী শুরু করল ঐ তিনজনকে লক্ষ্য কলে।
ওরা তিনজন প্রথমে আহমদ মুসাকে দেখতে পায়নি। যখন দেখতে পেয়েছে, তখন আহমদ মুসার গুলী বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। আক্রমণ কিংবা আত্মরক্ষার জন্যে ওরা কোন কিছুর আড়াল নেবার সুযোগ পেল না।
ওরা তিনজনই অসহায়ভাবে মৃত্যুকে আলিংগণ করল।
আর কাউকে না দেখে আহমদ মুসা পেছন ফিরল। আয়েশা আলিয়া ও সরদার জামাল উদ্দিনদের লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যরি আপনাদের ধাক্কা দিতে হয়েছে। আঘাত পাননি তো!’
‘আপনি নিজে গুলীবিদ্ধ হয়ে এই কথা বলছেন, আপনি ঐ ধাক্কাটুকু না দিলে তো ওরা না মরে আমরাই তাদের আগে মরতাম।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদেরও আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘আল্লাহর শোকর আহমদ মুসা, ঠিক সময়ে তুমি এসে পড়ে সাক্ষাত মৃত্যু থেকে আমাদের বাঁচিয়েছ।’
‘আপনাদের ওখানে রেখে এসেছিলাম। আপনারা এভাবে এসে ঠিক করেননি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিপদ এলার্ম শুনে আমরা সব ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি বিপদে পড়েছ কিনা এ ভয়ও আমাদের পেয়ে বসে। কিন্তু তুমি দরজার আড়ালে কি করছিলে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘এলার্ম শুনেই আমি দ্রুত এদিকে আসি। তার আগেই ওরা ভেতরে প্রবেশ করেছে। আমি বাইরের দরজা খোলা দেখি। আমি দরজার আড়ালে যাই লুকানো স্থান থেকে ওদের আরও ভেতরে এগিয়ে আনার জন্যে যাতে ওরা আমাকে দেখতে পাওয়ার আগেই আমার গুলীর আওতায় আসে।’
‘আমরা দুঃখিত আহমদ মুসা। এভাবে আসাটা আমাদেরকে বিপদে ফেলেছিল। তোমাকেও বিপদে ফেলেছিল।’ বলল জামাল উদ্দিন।
‘এখন কোন কথা নয় দাদা। উনি আহত। চলুন ভেতরে। ওকে হাসপাতালেও নিতে হতে পারে। আসুন, আমি ডাক্তারকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
বলেই ছুট দিয়েছিল আয়েশা আলিয়া।
‘থাম আয়েশা। আগেই ডাক্তার নয়। দেখি আহত স্থানটা। গুলী ভেতরে নাও থাকতে পারে। ছোট-খাট আঘাতের ব্যবস্থা আমিই করতে পারব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমারও নার্সিং ট্রেনিং আছে স্যার।’ বলল আয়েশা আলিয়া।
‘আমিও ভাল ফাষ্ট এইড জানি।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘আমিও জানি।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার হাসি ও রসিকতাপূর্ণ কথায় সবাই বিস্মিত হয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল আয়েশা আলিয়া, ‘স্যার মনে হচ্ছে আপনার কিছুই হয়নি। হাসি-রসিকতা দূরে থাক, আমরা হলে আতংক-আর্তনাদেই ডুবে থাকতাম।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। কিছুই বলল না।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে সরদার জামাল উদ্দিন বলল, আর কোন কথা নয়, চল।
সবাই চলতে শুরু করল।