৪৪. ব্লাক ঈগলের সন্ত্রাস

চ্যাপ্টার

লেদার পেপার থেকে পড়ছিল আহমদ মুসা:
‘আমি আবদুল আজিজ মালাকি। মালয় রাজ্যের হতভাগ্য সুলতান। পরাজিত ও রাজ্যহারা হয়ে পালিয়ে এসেছি এই কোহেতান পাহাড়ে আশ্রয় নেবার জন্রে এবং আমার এই অর্থ-কড়ির একটা কিনারা করার জন্যে। যুগ, বহু যুগ, শতবর্ষ বা বহু শতবর্ষ পরে যিনি বা যারা এই গনিমত পাবেন, তারা নিশ্চয়ই এই সম্পদের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবেন। তাদের জন্যেই আমার ও আমাদের সম্পর্কে কয়েকটি কথা।
এই ধনভান্ডার ‘মালাকি আল-ফালাহ’ সালতানাতের। মালাকি আল-ফালাহ সালতানাত গঠিত হয় প্রায় ৪০০ বছর আগে মালয়ের পশ্চিম উপকূলের ‘মালাকা’ বন্দর শহরে। আমার পিতামহের পিতামহ শাইখ ওয়াকিল বিন ওয়ালিদ একজন ব্যবসায়ী ও ইসলাম ধর্মের প্রচারক ছিলেন। এই উপলক্ষেই মালয় অঞ্চলে এসেছিলেন এবং ইসলাম প্রচারের নেশাতেই তিনি এক সময় মালাকা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সময়টা খৃষ্টীয় ১৩৯৬ সাল। এক সময় মালাকা অঞ্চলে স্থানীয়-অস্থানীয় মিলে মুসলমানদের সংখ্যা প্রচুর হয়ে দাঁড়ায়। তরুণ ওয়াকিল ইবনে ওয়ালিদ তাদের সামনে দাঁড়ান। অবস্থার কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয় মালাকা আল-ফালাহ সালতানাত। সুলতান আমার পিতামহের পিতামহ শেখ ওয়াকিল বিন ওয়ালীদ। পরবর্তী একুশ বছরের মধ্যে মালয়ের এ অঞ্চল শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়। আর বন্দর নগরী মালাকা হয়ে দাঁড়ায় গোটা অঞ্চলের ট্রেডিং ক্যাপিটাল।
তবে শান্তির ঘরে আগুন লাগে শীঘ্রই। ১৫১১ সালের এক কুলগ্নে পর্তুগীজরা এসে নোঙর করে মালাকাতে। সমুদ্রে যেমন তারা ছিল জলদস্যু, তেমনি স্থলেও তারা সুযোগমত লুটতরাজ শুরু করল। সমৃদ্ধ মালাকাকে তারা ভালোভাবেই টার্গেট করেছিল। শীঘ্রই তাদের সৈন্য ও যুদ্ধ জাহাজে ছেয়ে যায় মালাকা। মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতের সমৃদ্ধি ছিল, কিন্তু সেই অনুযায়ী শক্তি ছিল না। তাদের আন্তরিকতা ছিল, দেশপ্রেম ছিল, কিন্তু কূটনীতিতে অনকে পেছনে ছিল।
পর্তুগীজরা দখল করে নিল মালাকাসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চল। মালাকা আল ফালাহ সালতানাত মধ্যাঞ্চলীয় পাহাড়ের এ পাশের কেলানতান অঞ্চলে চলে আসে। মালাকা বিপর্যয়েও আমাদের কোন শিক্ষা হয় না। কেলানতানে আশ্রয় পাওয়ার পর আল-ফালাহ সালতানাত আয়েশের কোলে গা ভাসিয়ে দিল এবং সম্পদ ও শান্তির খোঁজে আবার পাগল হয়ে উঠল। সম্পদকে শক্তি বাড়াবার কাজে ব্যবহার না করে, সম্পদ দিয়ে শুধু সম্পদ বাড়াবার কাজই চলল। ওদিকে মালাকারের মালাকা ও উপকূলীয় অঞ্চল ১৬৪১ সালের দিকে পর্তুগীজদের হাত থেকে ডাচদের হাতে চলে গেল। যা করা উচিত ছিল মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতের তা করল ডাচরা। পরবর্তী ৫০ বছরে কিছু পরিবর্তন ঘটল জনশক্তির ক্ষেত্রে। ডাচদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও সেলেবিস দ্বীপাঞ্চল ছেড়ে হাজার হাজার মালাকা মালয় অঞ্চলে চলে আসল। তখন একটা জাগরণও হলো এবং ১৭০০ শতকের দিকে সকলের সমন্বয়ে মালয় রাষ্ট্র গঠিত হলো। মালাকা আল-ফালাহ সালতানাতও এ রাষ্ট্রের একটা অংগ হিসাবে যোগদান করল। কিন্তু দেখা গেল আসল শিক্ষা তাদের হয়নি। শক্তির চেয়ে সম্পদ আহরণের দিকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকল। চারদিকের পরিস্থিতি কি, সময়ের দাবি কি, সে দিক থেকে তারা চোখ বন্ধই রাখল। পরবর্তী একশ বছরে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। এর ফলেই মালয় রাষ্ট্র পারল না, কিন্তু বৃটিশরা ১৮২০ সালের দিকে মালাকা অঞ্চল, পেনাংগ; সিংগাপুর দখল করে নিল। আরও একশ বছর পার হলো। বৃটিশদের ষড়যন্ত্র আরও সামনে অগ্রসর হলো, তাদের শক্তি আরও বাড়ল। কিন্তু মালয় রাষ্ট্র, মালাকা আল-ফালাহ সালতানাত, প্রভৃতির দেশীয় শক্তির অনৈক্য ও দুর্বলতা আরও বেড়ে গেলো। আর এই সময়েই বৃটিশরা গোটা মালয় উপদ্বীপ দখল করে নিল। যে সময় বৃটিশ সৈন্যরা কেলানতান দখল করে, সে সময় কেলানতানের মালকা আল-ফালাহ সালতানাতের দুর্ভগা সুলতান আমিই ছিলাম। যেদিন রাজধানী ‘মালাকা ছানি’র ৫০ মাইল দূরের শেষ দূর্গের পতন ঘটল বৃটিশদের হাতে, তখনই আমাদের পরাজয় সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। আমি রাজধানী ত্যাগ করলাম পরিবার ও সম্পদ সাথে করে নিয়ে।
কিন্তু এই সম্পদের এক কপর্দকও আমি রাখলাম না আমার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য। যতদিন বাঁচব পরিশ্রমলব্ধ আয় দ্বারা জীবন নির্বাহ করে অতীতের কৃত পাপের কিছু প্রায়শ্চিত্ত হলে তা করব। রাজভান্ডার থেকে আনা সব অর্থই এই গুহায় জমা রাখলাম এই আশায় যে, এই সম্পদ দিয়ে আমরা যা করিনি, করতে পারিনি, তার কিছুটা হলেও এই সম্পদ দিয়ে কেউ হয়ত শক্তি অর্জন করবেন আর আমার মন বলছে, এমন লোকই এই অর্থের সন্ধান পাবেন। আমার মন থেকে আসা এই কথা মহান আল্লাহরই কথা, এই প্রার্থনা মহান আল্লাহর কাছে আমি করি।’
পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার।
পড়তে পড়তে আহমদ মুসার মন বেদনায় ভারী হয়ে উঠেছিল। ছোট্ট তিন খন্ড কাগজের কথায় মালয় অঞ্চলের চারশ বছরের ইতিহাস যেন তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে ইতিহাস বেদনার, ব্যর্থতার এবং সব হারানোর এক অসহনীয় যন্ত্রণার।
সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বিষণ্ণ, গম্ভীর। তাদের চোখও সজল।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। কাগজের টুকরোগুলো সোনার বাক্সে পুরে তা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘বলুন জনাব।’
সরদার জামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে কথাটি বলেছিল আহমদ মুসা।
‘যে উপলব্ধি হয়েছে এই বক্তব্যে, সে উপলব্ধি যদি তখন সব মুসলিম শাসকের হতো! তাহলে এই এলাকার ইতিহাস ভিন্ন হতো।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘শুধু এ এলাকার নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাস ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এ উপলব্ধি সেদিন কোন মুসলিম শাসকের ছিল না। মুসলমানরা তাজমহল, আল-হামরা গড়েছে, কিন্তু ক্লাইভ-ফার্ডিন্যান্ডদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার শক্তি অর্জন করেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজও কি এই উপলব্ধি হয়েছে স্যার?’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠ ভারী।
‘হয়নি আবদুল কাদের। হলে, আল্লাহর দেয়া অঢেল পেট্রডলার আকাশস্পর্শী ইমারত, মসৃণ হাইওয়ে নির্মাণ হবার আগে অন্তত আত্মরক্ষার জন্য স্বনির্ভর একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠতো।’ আহমদ মুসা বলল। তারও কণ্ঠ ভারী।
কথা শেষ করেই সোনার বাক্সটি আবার স্বর্ণ মুদ্রার স্তুপের উপর রেখে বলল, ‘আমাদের এখানকার কাজ শেষ। আসুন গুহামুখ আমরা বন্ধ করি।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনও।
‘ভাই আহমদ মুসা, এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো শুধু টাকাই নয়, আমাদের পূর্ব পুরুষদের অমিতাচার, ব্যর্থতার শিক্ষা ও সাক্ষ্য হয়ে এসেছে আমাদের জন্যে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার কণ্ঠও ভারী।
‘ঠিক বলেছেন জনাব।’
বলে আহমদ মুসা গুহামুখ বন্ধের কাজে মন দিল।
কাজে লাগল সকলেই।
গুহামুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল পাহাড়ের সেই গলি থেকে, পাহাড় থেকে।
উঠে এল তারা কিং রোডে আবার।
তাদের মিশনের সেই যাত্রা শুরু হলো নতুন করে।
লক্ষ্য কাতান টেপাংগো।
আগের মতই আগে আগে চলছে আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন, মাঝখানে আহমদ মুসা এবং পেছনে সরদার জামাল উদ্দিন।

পরবর্তী বই
বসফরাসে আহবান

Top