৪৪. ব্লাক ঈগলের সন্ত্রাস

চ্যাপ্টার

মাগরিবের নামায শেষ করে বেডের পাশের সোফায় বসেছে আহমদ মুসা। একজন পরিচারিকা চা দিয়ে গেল।
পিরিচ সমেত চায়ের কাপ তোলার জন্যে বাম হাত এগিয়ে নিতে গিয়ে পারল না আহমদ মুসা। বেদনার চেয়ে ঘাড়ের ব্যান্ডেজটিই অসুবিধা করছে বেশি। ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় ডাক্তার খালাম্মা তাকে বলেছে, ‘হাতকে যাতে কাজে লাগাতে না পার এমন ব্যান্ডেজই বাঁধব। হাত না নাড়লে কাঁধ রেষ্টে থাকবে। দু’দিন এমন রেষ্টে থাকলে দু’দিন পরেই তুমি এ হাত দিয়ে কাজ করতে পারবে।’
ডান হাত দিয়ে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগল আহমদ মুসা।
দাদী এসে পাশে বসল আহমদ মুসার। বলল, ‘কেমন আছ ভাই? জ্বর আসে নি তো?’
‘না দাদীমা, আমি ভালো আছি।’
‘কেমন করে যে ভালো থাক ভাই, তোমাকে দেখেই আমার জ্বর এসেছে।’
‘একটা ওষুধ বলি দাদীমা?’
‘জ্বরের? বল।’
‘নামায পড়ার সময় যেমনটা হয়, সেভাবে মনোযোগ কালবের দিকে স্থির রেখে একশ বার বলুন, আমার জ্বর নেই। দেখবেন জ্বর আপনার থাকবে না।’
হাসল দাদী। বলল, ‘তুমি দেখছি পীর-ফকিরের পথ ধরলে। তোমার এ কথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি?’
‘ভিত্তি দু’টি দাদীমা। একটি হলো, একটা অনুভূমি থেকে আপনার জ্বর এসেছে, বিপরীত এক অনুভূতি দিয়ে আগের অনুভূতি মুছে ফেললেই জ্বর সেরে যাবে। দ্বিতীয়ত, রোগ নিরাময়ে ইতিবাচক মানসিক শক্তির ভূমিকা খুব বড়। আমি সুস্থ আছি, এই ইতিবাচক চিন্তা বাড়িয়ে নিতে পারলে তা রোগ নিরাময়ে সহায়ক হয়।’
যয়নব যোবায়দা দাদীর খোঁজে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসাকে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে।
আহমদ মুসা থামলেই সে বলে উঠল, ‘আপনি দেখছি স্যার মনো-চিকিৎসকও। কি নন স্যার আপনি?’
আহমদ মুসা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠল। থেমে গেল আহমদ মুসা।
মোবাইলটা বাম পাশে বেডের উপর ছিল। অভ্যাসবশত বাম হাতটা সেদিকে বাড়াতে গেল। ধাক্কা খেয়ে হাতটা থেমে গেল আহমদ মুসার।
যয়নব যোবায়দা ছুটে গেল। তার মাথার নাইলনের রুমাল কপালের উপর সরে গিয়েছিল। রুমালটি তাড়াতাড়ি কপালের উপর টেনে নিয়ে মোবাইল বিছানা থেকে তুলে আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা মোবাইল মুখের কাছে তুলে নিল।
আহমদ মুসা ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী প্রধান পুরসাত প্রজাদীপকের কণ্ঠ শুনতে পেল।
আহমদ মুসা মোবাইলের ভয়েস স্পীকার অন করে বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার।’
‘গুড ইভনিং বিভেন বার্গম্যান। তোমাকে অভিনন্দন।’
‘কেন স্যার?’
‘তোমার ওখান থেকে মানে যয়নব যোবায়দার ওখান থেকে যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই ব্ল্যাক ঈগলের বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রমাণিত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন বিদেশী যার নাম বেঞ্জামিন বেকার। সে ইসরাইলেরই কোন এক স্থানের বাসিন্দা।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এই সুখবরের জন্যে ধন্যবাদ স্যার।’
‘আরও সুখবর আছে বিভেন বার্গম্যান। বিদেশী বেঞ্জামিন বেকারকে ওখানে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর কালকেই তাকে ব্যাংকক আনা হচ্ছে। এছাড়া সুলতান গড়েড় শাহবাড়িতে সেদিন দুই ঘটনায় বিদেশীদের যে লাশ পাওয়া গেছে এবং ব্যাংককে প্রথম কিডন্যাপিংয়ের ঘটনায় যারা মরেছিল, তাদের মধ্যেকার বিদেশীদের লাশ সংরক্ষিত আছে, এসব লাশ ব্যাংককে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এবং বেঞ্জামিন বেকারকেও এসব লাশ দেখানো হবে। ওদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এসব পরীক্ষা থেকে তোমার ‘তৃতীয় পক্ষ’ তত্বের বড় প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনার শুভেচ্ছায় এটা সম্ভব হচ্ছে। স্যার, আমি শুধু দেখতে চাই জাবের জহীর উদ্দিন নির্দোষ, পাত্তানী মুসলমানরা নির্দোষ এবং এটা প্রমাণ হোক যে, তৃতীয় একটি পক্ষ মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসের অভিযোগ চাপানোর পুরাতন প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু করেছে।’
‘আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন বিভেন বার্গম্যান? আমরাই তো তোমাকে ধন্যবাদ দেব। আমরাই আমাদের দেশের এক গ্রুপ নাগরিককে ভুল বুঝেছিলাম, তাদের সন্ত্রাসী ধরে নিয়েছিলাম, তাদের জেল-জুলুমের শিকারে পরিণত করেছিলাম। তুমি এসে আমাদের সাহায্য করেছ। জান, আজ প্রধানমন্ত্রী এই ফাইল কল করেছিলেন। তিনি দেখেছেন ফাইল। তোমাকে নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ধন্যবাদ বিভেন বার্গম্যান।’
মোবাইলের কল অফ করে পাশে রেখে দিল আহমদ মুসা।
দাদী এবং যয়নব যোবায়দা দু’জনেই টেলিফোনের আলোচনা শুনছিল। তাদের দু’জনেরই চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই দাদী এগিয়ে গেল আহমদ মুসার দিকে। হাত রাখল দাদী আহমদ মুসার মাথায়। বলল, ‘তোমাকে দোয়া করার কোন ভাষা আমার নেই। আর আমার মত সামান্য কেউ তোমার জন্য কিইবা দোয়া করতে পারে! আমরা কৃতজ্ঞ ভাই। তুমি আমাদের জাতিকে, কম্যুনিটিকে বাঁচিয়েছ।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দাদীর কণ্ঠ।
ভারী হয়ে উঠেছিল যয়নব যোবায়দার কণ্ঠ। ভিজে উঠেছিল তার দু’চোখের কোণও। বলল, ‘স্যার, জাবের ভাইয়ার উদ্ধারের জন্যে সরকার কি এবার চেষ্টা করবেন?’ কান্না ভেজা কণ্ঠ যয়নব যোবায়দার।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই বাহির থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল।
শব্দ শুনেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল, ‘দাদী আমার মনে হচ্ছে পুলিশবক্স আক্রান্ত হয়েছে। এটা প্রতিশোধ আক্রমণ অথবা আমাদের ধরার লক্ষে দ্বিতীয় আক্রমণ হতে পারে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বালিশের তলা থেকে হ্যান্ডমেশিনগান তুলে নিয়ে তাতে ম্যাগাজিন লাগাতে লাগাতে বলল, ‘দাদী প্লিজ আপনারা উঠে যান।’
ডান হাতে বালিশ সরিয়ে বাম হাত দিয়ে হ্যান্ডমেশিনগান তুলে ধরেই তাতে ম্যাগাজিন পরিয়েছিল আহমদ মুসা। যেন বাম হাত খুবই স্বাভাবিক, একটু আহত নয়।
সবই দেখল দাদী ও যয়নব যোবায়দা। কিন্তু তাদের মুখে কোন কথা জোগাল না। বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলী শুনে এবং বন্দুক নিয়ে অসুস্থ আহমদ মুসার বাইরে যাওয়া দেখে তারা পাথর হয়ে গিয়েছিল। তাই দোতলায় চলে যাবার জন্যে আহমদ মুসার যে আদেশ তা তারা ভুলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজার ডোর ভিউতে চোখ রাখল।
বাইরে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির বারান্দার নিচে কয়েকজন মানুষ তাদের দরজার দিকে হ্যান্ডমেশিনগান টার্গেট করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন পুলিশবক্সকে টার্গেট করে গুলী ছুঁড়ছে। একজন পুলিশের লাশ পুলিশবক্সের সিঁড়ির উপর পড়ে আছে।
আহমদ মুসা বুঝল অবশিষ্ট দু’জন পুলিশ আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা পুলিশকে পেছনে রেখে বাড়িতে ঢুকতে চাচ্ছে না হয়তো দুই কারণে। একটি হলো, পেছন থেকে আক্রান্ত হবার ভয়, দ্বিতীয়ত, তারা এখানকার খবর দিয়ে পুলিশ ডাকতে পারে।
কিন্তু পুলিশবক্সের নিচের অংশ বুলেটপ্রুফ বলে তারা চাচ্ছে উপরের অংশ ভেঙে পুলিশ দু’জনকে মারতে।
আহমদ মুসা দেখল পুলিশবক্সের উপরের অংশ ঝাঝরা হয়ে গেছে। এখন একটি ধাক্কা দিলেই উপরের অংশ ভেঙে পড়তে পারে। পুলিশকে কাবু করার পরই এদিকে আসবে।
ভাবল আহমদ মুসা, পুলিশকে ওরা কাবু করার আগেই তাকে যা করার করতে হবে। এ সময় তার ঘরের সামনের লোকরাও আক্রমণের জন্য টপমুডে নেই। এটাই তার জন্যে বড় সুযোগ।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল। হ্যান্ডমেশিনগানের লোড একবার পরীক্ষা করল।
তারপর হ্যান্ডমেশিনগান ডান হাত দিয়ে ধরে বাঁ হাতে দরজা আনলক করল।
দরজার তালা খোলা হয়ে গেলে আহমদ মুসা ডান হাতে হ্যান্ডমেশিনগান বাগিয়ে ধরে তর্জনিটা ট্রিগারে রেখে বাম হাত দিয়ে নব ঘুরিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল। ডান হাতের তর্জনি হ্যান্ডমেশিনগানের ট্রিগারে চেপে ব্যারেল ঘুরিয়ে নিল ঘরের সামনে বারান্দার নিচে দাঁড়ানো পাঁচজন ব্ল্যাক ঈগলের উপর দিয়ে।
ঘটনা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ব্রাশ ফায়ারের শিকার হলো।
এদিকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনে পুলিশবক্স আক্রমণে যে চারজন নিয়োজিত ছিল, তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলী বর্ষণ শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এসেছিল।
দরজায় এসে বিদ্ধ হতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী।
ঘরের এদিকে কোন জানালা নেই।
চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। ভেতরের দরজার পেছনে দেখতে পেল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, যয়নব যোবায়দা এবং দাদীকে। উদ্বেগ-আতংকে মুষড়ে পড়েছে তারা সকলেই।
‘ভয় নেই দাদীমা, জয় আমাদের হবে ইনশাআল্লাহ।’
আহমদ মুসার চোখ পড়ল ষ্টিলবডির টিপয়ের উপর। দেখল টিপয়ের টপটা ষ্টিল শীটের।
আহমদ মুসা টিপয়টি বাঁ হাতে তুলে নিয়ে দরজার এ পাশে শুয়ে পড়ল। টিপয়টিকে মাথার সামনে নিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল এবং টিপয়ের প্রান্ত দিয়ে আগে বাড়ানো হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল দিয়ে ছুটল গুলীর বৃষ্টি।
ওরা এগিয়ে আসছিল আহমদ মুসার ব্রাশফায়ারে আহত অথবা নিহত তাদের সাথীদের দিকে। আহমদ মুসার গুলীর মুখে তারাও গুলী বর্ষণ শুরু করল। কিন্তু ওদের অসুবিধা ছিল ওদের সামনে আড়াল ছিল না। ওরা শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল।
সুযোগ পেয়ে পুলিশ দু’জনও বেরিয়ে এসেছে তাদের বক্স থেকে। তাদের দু’জনের রিভলবারের গুলী ছুটল ওদের উদ্দেশ্যে। আহমদ মুসার গুলী ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেলেও দু’জন পুলিশের টার্গেটেড গুলী ব্যর্থ হলো না।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ছুটে এল দু’জন পুলিশ। বলল, ‘স্যার আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমাদের একজনকে ওরা মেরে ফেলেছে। আর একটু হলেই আমাদেরও মেরে ফেলত।’
আহমদ মুসা ওদের হাতে সাধারণ রিভলবার দেখে বলল, ‘তোমাদের হাতে সাধারণ রিভলবার কেন? তোমরা তো বাইরের অপারেশনে বা দায়িত্ব পালনে গেলে আধুনিক ষ্টেনগান ব্যবহার কর?’
‘একটা ভুল হয়েছে স্যার। এ্যামুনিশনসহ ষ্টেনগানের একটা ফোল্ডার আগেই গাড়িতে উঠেছিল এটা আমাদের বলা হয়। কিন্তু পুলিশবক্সে আসার পর গাড়িতে আমরা বাক্সটি পাইনি। কোন ভুলের ফলেই এটা হয়েছে। বিষয়টি আমরা তখনি এসপি সাহেবকে না পেয়ে ডিএসপিকে জানাই। এর ফলেই আমরা রিভলবার দিয়ে সন্ত্রাসীদের মেশিন রিভলবারের মোকাবিলা করতে পারিনি।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
পুলিশের একজন আবার বলে উঠল, ‘স্যার, এসপি সাহেব ডিএসপি মহিদলকে পাঠাচ্ছেন একদল পুলিশসহ। আমরা টেলিফোন করেছি।’
আহমদ মুসা কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই পেছন থেকে কথা বলে উঠল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, ‘স্যার দাদীমা ডাকছেন। আপনার আহত স্থান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। জামা ভিজে গেছে। আপনি আসুন।’
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আসছি।’
তারপর সামনে তাকিয়ে পুলিশ দু’জনকে বলল, ‘আমি ভেতর থেকে আসি। এর মধ্যে ডিএসপি সাহেব এসে পড়লে আমাকে ডেকো।’
আহমদ মুসা দরজা লক করে ভেতরে চলে গেল। ড্রইং রুমের পরের রুমে দাদী, যয়নব যোবায়দা এবং পরিচারিকারা অপেক্ষা করছিল।
আহমদ মুসার রক্তভেজা জামার দিকে তাকিয়ে দাদী বলল, ‘তুমি আমাদের জন্যে আর কত কষ্ট করবে ভাই! যে হাত দিয়ে তুমি চায়ের কাপ তুলতে পরো না, সেই হাত দিয়ে লড়াই করে আসলে।’
যয়নব যোবায়দারও চোখ ভরা অশ্রু। বলল, ‘আপনি বসুন স্যার। ডাক্তার খালাম্মা আসছেন।’
‘না ম্যাডাম যোবায়দা, আমি বসতে পারব না। ডিএসপি সাহেব আসছেন। এ সময় আমার ওখানে থাকা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু স্যার, আপনি ভালো না থাকলে তো আমরাও ভালো থাকবো না।’ কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ যয়নব যোবায়দার।
‘ভালো রাখার মালিক আল্লাহ বোন। মনে করুন, আমাদের ওহুদ যুদ্ধের কঠিন সময়ের কথা। রাসুল স. এর দাঁত ভেঙে গেছে, কপালে গভীর হয়ে বসে গেছে একটা লৌহ খন্ড। রক্তাক্ত মহানবী। তবু তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং পলায়নপর শত্রু একত্রিত হয়ে আবার যাতে আক্রমণ করতে না পারে এজন্যে রক্তাক্ত, আহত, অবসন্ন সাথীদের নিয়ে শত্রুদের তাড়া করেছেন। আমরা তো তারই অনুসারী বোন।’
যয়নব যোবায়দার দু’গ- বেয়ে নামছে অশ্রুর দু’টি মোটা ধারা। দৃঢ় সংবদ্ধ দু’টি ঠোঁট তার কাঁপছে। একটা উচ্ছাস রোধ করছে সে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল বাইরে যাবার জন্যে।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল, ‘স্যার আমি আসি আপনার সাথে?’ তার কণ্ঠ ভারী। তারও চোখে অশ্রু।
‘এস।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ওকে আপনার মত লড়াই শেখান।’ পেছন থেকে কান্না জড়িত ভাঙা গলায় বলল যয়নব যোবায়দা।
না দাঁড়িয়ে, পেছনে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘সেও লড়াই শিখেছে, শিখবে। কিন্তু সেটা অস্ত্রের লড়াই নয়, বুদ্ধির লড়াই। বুদ্ধির লড়াই অস্ত্রকে অচল করে দিতে পারে।’
আহমদ মুসা বাইরে এসে দেখল, পুলিশরা এসেছে। উর্ধ্বতন একজন পুলিশ অফিসারকেও দেখতে পেল সে। আহমদ মুসাকে দেখেই সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেল।
পুলিশ অফিসারটি তার সামনে এসেই বলল, ‘স্যার আপনি নিশ্চয় বিভেন বার্গম্যান?’
আহমদ মুসার সাথে কথা বলার সময় পুলিশ অফিসারটির চেহারায় অসন্তুষ্টির ছায়া দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটি পুলিশবক্স আমরা নিয়ে এসেছি। এবার ছয়জন পুলিশ পাহারায় থাকবে।’
‘ধন্যবাদ মি. মহিদল।’
পুলিশ অফিসারটির চোখ পড়েছিল আহমদ মুসার হ্যান্ডমেশিনগানের দিকে। বলল, ‘স্যার হ্যান্ডমেশিনগানটি কি সন্ত্রাসীদের?’
‘না।’
‘তাহলে এটা আপনার লাইসেন্সকৃত?’
‘না। এটা ছিল আগের সন্ত্রাসীদের। এসপি উদয় থানি এটা আমার কাছে রেখেছেন প্রয়োজন হতে পারে বলে।’
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, পুলিশ অফিসারটির এ জিজ্ঞাসাবাদে সদিচ্ছার কোন সুর নেই।
আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলল, ‘মি. মহিদল অস্ত্রটা কি আপনি নিয়ে যেতে চান?’
‘না, স্যার আমি তা পারি না। এসব অস্ত্র তো পাবলিকের কাছে থাকে না। তাই কৌতূহল বশতই প্রশ্ন করেছিলাম।’ দ্রুত নিজেকে সহজ করে নিয়ে মহিদল বলল।
কথা শেষ করেই আবার সে বলে উঠল, ‘চলি স্যার। আমার এ দিকের কাজ শেষ।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, লোকটি তাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না।
মনে তার নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। সে ড্রইংরুম লক করে ধীরে ধীরে চলে এল ভেতরে। এসে বসল তার ঘরের সোফায়।
এর কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার খালাম্মাকে নিয়ে যয়নব যোবায়দা, দাদী এবং ফরহাদ এল।
‘ওয়েলকাম ডাক্তার খালাম্মা। আসুন। আমি বসে আছি। যা করার করুন প্লিজ।’ বলল আহমদ মুসা হেসেই। কিন্তু হাসিটা হাসির মত ছিল না।
‘ধন্যবাদ বেটা। আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব টায়ারড। তোমার শরীরের উপর খুবই অবিচার হচ্ছে বেটা।’
ডাক্তার খালাম্মা বলছিল আর আহমদ মুসার গায়ের রক্তমাখা জামা কাটছিল। ব্যান্ডেজ কেটে আহত স্থানের অবস্থা দেখে বলল, ‘ইস, কি হয়েছে আহত জায়গাটার হাল! সেলাইগুলো কেটে গেছে। আবার সেলাই করতে হবে। তোমার কিন্তু খুব কষ্ট হবে বেটা।’
আহমদ মুসা তখন অন্য এক ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত। ডাক্তার খালাম্মার কোন কথাই তার কানে যায়নি।
ডাক্তার খালাম্মা তাকাল যয়নব যোবায়দা, দাদীদের দিকে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। এ ঘরে আসা থেকেই তারা আহমদ মুসাকে গম্ভীর ও চিন্তান্বিত দেখছে। আহমদ মুসার এমন চেহারা তাদের কাছে অপরিচিত।
ডাক্তার খালাম্মা তার কাজে মনোযোগ দিল। কাঁচি দিয়ে কেটে ছেঁড়া সেলাই-এর কডগুলো তুলে ফেলতে লাগল।
‘প্লিজ খালাম্মা’ বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সোফার ওপাশে পড়ে থাকা মোবাইল তুলে নিতেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
কল অন করে মোবাইল স্ক্রীনে এসপি উদয় থানি’র নাম্বার দেখে ভীষণ খুশি হলো। শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, ‘মি. উদয় থানি আপনার কাছেই আমি টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।’
‘জরুরী কিছু স্যার? আপনার কণ্ঠে আমি উত্তেজনা দেখছি। নিশ্চয় বড় কিছু হবে?’ বলল উদয় থানি।
‘মি. উদয় থানি, আমি মনে করছি ব্ল্যাক ঈগল তার লোকদের আজ রাতেই ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করবে।’
‘তার মানে ওরা আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করবে।’
‘ব্ল্যাক ঈগলের চরিত্র আমি জানি। এই প্রথম ওদের কিছু লোক ধরা পড়েছে। তাদের উদ্ধার করতে দরকার হলে গোটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার ওরা ধ্বংস করতে পারে। এমনকি যদি দেখে তাদের লোকদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের লোকদেরসহ গোটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার তারা উড়িয়ে দেবে।’
‘এত বড় অনুমানের হেতু কি স্যার?’
‘আমাদের এখানে ওদের সর্বাত্মক আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত। অথচ নিজেদের রক্ষার জন্যে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির আগে ওদের উদ্ধারটাই বেশি প্রয়োজন। সুতরাং আমি মনে করছি আমাদের এখানে ওদের সর্বাত্মক আক্রমণই ওখানে আক্রমণ হওয়ার প্রমাণ।’
‘আপনাদের অনুমান যুক্তিসংগত স্যার। আমি গ্রহণ করছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা কৃতজ্ঞ স্যার। আপনার ওখানে সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে দু’জন পুলিশ রক্ষা পেয়েছে এবং ওদের হামলা ব্যর্থ হয়েছে আপনার জন্যেই। আপনার ওখানে সন্ত্রাসীরা যে জবাব পেয়েছে, এখানে সে জবাবই তারা পাবে।’ বলল উদয় থানি।
‘আরেকটা বিষয় মি. উদয় থানি। এটা ভুল অনুমান হতে পারে। তবে আজকের ঘটনায় বিভিন্ন কার্যকরণ থেকে আমি মনে করছি, সন্ত্রাসীদের সাথে আপনাদের পাত্তানী পুলিশের কেউ বা কোন গ্রুপের যোগসাজশ আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগেই জবাব এল না ওপার থেকে। একটুক্ষণ পরেই এসপি উদয় থানির বিস্মিত কণ্ঠ ভেসে এল, ‘মি. বিভেন বার্গম্যান আপনি এ কথা বলছেন?’
‘বলছি এ কারণেই যে এই যোগসাজশ আছে বলেই আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সন্ত্রাসীদের হামলার আরও বেশি আশংকা করছি মি. উদয় থানি। আমাদের এখানকার ঘটনায় এই যোগসাজশের কিছু আলামত পাওয়া গেছে বলে আমি মনে করি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাদের কথা স্যার আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু আলামতগুলো জানতে চাই স্যার।’ বলল পাত্তানী শহরের এসপি উদয় থানি।
‘আজ এখানে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মুখে একজন পুলিশ হত্যা ও পুলিশের বিপর্যয়ের বড় কারণ হলো এখানে ডিউটিরত তিনজন পুলিশের হাতে তাদের জন্যে নির্ধারিত সাবমেশিনগান ছিল না। হ্যান্ডমেশিনগানের আক্রমণের মুখে তাদের রিভলবার কোনই কাজ করেনি। দ্বিতীয়ত………।’
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে উদয় থানি বলল, ‘স্যরি স্যার। অবাক করার মত কথা আপনি বললেন। বিষয়টা কি পুলিশ আপনাকে বলেছে? কি বলেছে?’
‘তাদের বলা হয় তিনটি ষ্টেনগান ও এ্যামুনিশনস একটা ফোল্ডারে বা বাক্সে আগেই গাড়িতে উঠেছে। কিন্তু আমাদের এখানে এসে পুলিশ ফোল্ডার পেয়েছে, অথচ তার মধ্যে কিছুই ছিল না। তারা বিষয়টা আপনাকে না পেয়ে ডিএসপিকে জানায়।’
‘ষ্ট্রেঞ্জ, এমনটা কিভাবে ঘটতে পারে! ডিএসপি সাহেব আমাকে কিছু বলেননি। কোন ত্বরিত ব্যবস্থাও নেননি। এটাও আমার বিশ্বাস করতে পারছি না। স্যার, এ ব্যাপারে আপনি বোধ হয় আরও কিছু বলতে চান! দয়া করে বলুন স্যার।’
‘কিছু মনে করবেন না মি. উদয় থানি। আমি এখন যা বলব সেটা আমার একটা ইমপ্রেশন। আমার মনে হয়েছে ডিএসপি মি. মহিদল সন্ত্রাসীদের ব্যর্থতায় খুশি হননি এবং সন্ত্রাসীদের হত্যায় আমার ভূমিকা ভালো চোখে দেখেননি। তিনি সামান্য একটি ধন্যবাদও আমাকে দেননি। বরং হ্যান্ডমেশিনগানটা আমার হাতে কেন, এর লাইসেন্স আছে কিনা, এসব প্রশ্নও তিনি তুলেছেন।’
‘আপনি ইমপ্রেশনটা ঠিকই নিয়েছেন। আমি শুধু বিস্মিত নই, উদ্বেগও বোধ করছি। সাবমেশিনগান কেন গেল না, আমি এখনি দেখছি।’
‘মি. উদয় থানি। আমার একটা অনুরোধ- দয়া করে মি. মহিদল যে ছয়জন পুলিশকে রেখে গিয়েছে তাদের পরিবর্তন করে অন্য ৬ জন দিন।’
‘বুঝেছি স্যার। আপনি ঠিক বলেছেন? এখনি ছয় জন পুলিশ যাচ্ছে, আর ওরা ফেরত আসবে। স্যার আমাকে কোন পরামর্শ দেবেন।’
‘মি. উদয় থানি। আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। আপনি সব জানেন কি করতে হবে আপনাকে।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনি অনেক পুলিশের জীবন বাঁচাবার, অনেক ক্ষতি এড়ানোর এবং ব্ল্যাক ঈগলের লোকদের ধরে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষার দায়িত্ব আমি তো মহিদলকেই দিতে যাচ্ছিলাম। রক্ষা করলেন আপনি। আমি এখনি ওকে ডিউটি থেকে অফ করে দিচ্ছি। আর…….।’
হঠাৎ এই সময় টেলিফোনে একটা গুলীর শব্দ ভেসে এল। একটা ‘আঃ’ আর্তনাদ ভেসে এল। গলাটি উদয় থানির বুঝল আহমদ মুসা। তারপরই একটি শব্দ। মোবাইল পড়ে যাবার শব্দ। তার সঙ্গে সঙ্গেই আবার গুলীর শব্দ ভেসে এল। এর পরেই আবার দু’টি গুলীর শব্দ পেল টেলিফোনে।
তারপর সব চুপচাপ। কথা ও চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কিন্তু কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।
‘মি. উদয় থানি’, ‘মি. উদয় থানি’ বলে ডাকতে লাগল আহমদ মুসা, কিন্তু কোন উত্তর পেল না।
উদ্বেগ দেখা দিল আহমদ মুসার মনে। সন্ত্রাসীরা কি পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করেছে? কিন্তু সবগুলোই তো রিভলবারের গুলীর শব্দ। ওদের মরিয়া আক্রমণ হেভি অস্ত্র দিয়ে হবার কথা, রিভলবার দিয়ে নয়।
মোবাইল বন্ধ করল আহমদ মুসা।
‘কি ঘটনা স্যার?’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
যয়নব যোবায়দা, ডাক্তার খালাম্মা এবং দাদী সবারই চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘কি ঘটেছে আমি জানি না, কিন্তু বড় কিছু ঘটেছে। এসপি উদয় থানি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ।
‘একজন পুলিশ অফিসারের যে ষড়যন্ত্র এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সন্ত্রাসীদের হামলার যে কথা আপনি টেলিফোনে বললেন, সেটাই ঘটল কিনা?’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘ঘটতে পারে, কিন্তু কি ঘটেছে বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে হচ্ছে গুলী বিনিময়টা পুলিশের মধ্যে হয়েছে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি বাইরে পুলিশদের কাছে বসে থাক। তাদের কাছে কোন খবর আসে কিনা দেখ।’
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে এ নির্দেশ দেয়ার পর ডাক্তার খালাম্মার দিকে চেয়ে বলল, ‘খালাম্মা আপনার কাজটা দয়া করে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন। এসপি উদয় থানি যদি নিহত হয়ে থাকেন, তাহলে কোন বিপদ আমাদের উপর আসতে পারে।’
‘আমরা তো বিপদের মধ্যেই আছি। নিশ্চয় কোন বড় বিপদের কথা বলছেন?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
ডাক্তার খালাম্মা পুরানো আহত স্থানটা ড্রেসিং-এর কাজ শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা তখন ড্রেসিং এর জন্যে স্থির হয়ে বসেছে। ঐ অবস্থায় বলল যয়নব যোবায়দার কথার উত্তরে, ‘আমি একটা আশংকা করছি, কিন্তু তার আগে যদি বিপদ আসে?’
‘বেটা এ সময় কথা না বললে আমার কাজটা সুন্দর হবে।’ বলল ডাক্তার খালাম্মা।
‘তুমি কাজ কর ডাক্তার মা। আর কেউ কথা বলবে না।’ বলল দাদী।
‘আমি দুঃখিত’ বলে যয়নব যোবায়দা দাদীর পাশে গিয়ে বসল।
ড্রেসিং শেষ করে ডাক্তার হাত পরিষ্কার করে এসে সোফায় বসে বলল, ‘বেটা বিভেন বার্গম্যান। তোমার নাম খৃষ্টান হলেও তুমি খৃষ্টান নও। যারা হারাম খায়, তাদের গা একটা বিজাতীয় গন্ধ ছড়ায়। অমুসলিম কলিগদের সাথে আমি কাজ করি বলে আমি এটা জানি। তুমি খৃষ্টান নও অবশ্যই। তোমার কথা-বার্তার ষ্টাইলেও এটা বুঝা গেছে। তুমি তাহলে কি? কে তুমি। আমার পুরানো প্রশ্ন এটা।’
ডাক্তার খালাম্মার কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তার মুখে কিছুটা উত্তেজনা। আহমদ মুসার দৃষ্টি ফিরে গেছে তার দিকে। বলল, ‘ফরহাদ, মনে হচ্ছে কিছু খবর আছে?’
‘স্যার আগের ছয়জন পুলিশ চলে গেছে। নতুন ছয়জন পুলিশ এসেছে।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘আলহামদুলিল্লাহ, এসপি উদয় থানি তাহলে বেঁচে আছেন।’
একটু থেমেই ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘পুলিশরা কিছু বলেনি? বলাবলি করেনি?’
‘নতুনরা নেমেই আগের পুলিশদের বলেছে, অফিসে একটু গোলমাল আছে, তোমরা তাড়াতাড়ি যাও। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি গোলমাল? প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে গেছে।’ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বলল।
আহমদ মুসা যয়নব যোবায়দাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি যে বিপদের কথা বলেছিলাম, সে বিপদ কেটে গেছে। যে ছয়জন পুলিশ এতক্ষণ পর্যন্ত এখানে ছিল, তাদের প্রতি আমার আস্থা ছিল না। তাই এদের তুলে নিয়ে নতুন পুলিশ দিতে বলেছিলাম উদয় থানিকে। তিনি সেটা করেছেন।’
‘কেন তুমি সন্দেহ করেছিলে এই পুলিশ ছয়জনকে?’ বলল দাদীমা।
আহমদ মুসা পাত্তানী শহরের ডিএসপি মহিদলের সাথে সন্ত্রাসীদের সম্পর্কের বিষয় সামনে এনে বলল, ‘আগের ছয়জনকে মহিদল নিয়ে এসেছিল। সুতরাং তাদেরকে আমি বিশ্বস্ত মনে করিনি দাদীমা।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি মি. উদয় থানিকে আর একবার দেখি। ওখানে কি ঘটল জানতে পারলাম না।’
আহমদ মুসা আবার টেলিফোন করল এসপি উদয় থানিকে। মোবাইলে রিং হলো কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
আহমদ মুসা ভাবল ঘটনা এই হতে পারে যে, তাঁর হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাবার পর সেটা আর তোলা হয়নি এবং উদয় থানি সেই ঘরে এখন নেই।
আহমদ মুসা স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ ভরসা।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘পুলিশ থাকলেও আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ওদের সম্ভাব্য আক্রমণ সফল হলে,ওরা এখানেও হামলা চালাতে পারে। এখন রাত ৮টা। রাত ২টা পর্যন্ত তুমি পাহারা দেবে। রাত ২টায় আমাকে জাগিয়ে দেবে। পরের দায়িত্ব আমার।’
‘অবশ্যই পারব স্যার।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘কিন্তু উনি গুলী চালাতে জানেন না। পাহারা দেবেন কিভাবে?’ টিপ্পনি কাটার সুরে বলল যয়নব যোবায়দা।
মুখ লাল হয়ে উঠেছে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের। বিব্রত কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বন্দুক চালনা ভালো জিনিস নয়। ফেৎনা-ফাসাদের আগ্রাসন মোকাবিলার অপরিহার্য কাজেই শুধু এই খারাপ কাজকে বৈধ করা হয়েছে। সবাইকে সব সময় এ কাজের জন্যে প্রয়োজন হয় না, হলে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন কারো পেছনে থাকবে না। আপাতত তার দায়িত্ব আমাকে প্রয়োজন অনুসারে ও ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেয়া।’
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে যয়নব যোবায়দার ঠোঁটে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই দাদী বলল, ‘খাবার দেয়া হয়েছে। এখন উঠ, সবাইকে খেতে হবে।’
‘বিকেলে আমার নাস্তা একটু বড় হয়েছে। আমি এখন খাব না। দু’টায় উঠে কিছু খেয়ে নেব। চল ফরহাদ এশার নামায পড়ে নিই। তারপর আমি ঘুমাব, তুমি জাগবে।’
বলে উঠতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
ডাক্তার খালাম্মা বলে উঠল, ‘উঠ না, বিভেন বার্গম্যান। তোমার পরিচয় আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। তুমি এর মধ্যে একবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’, আরেকবার ‘আল্লাহ ভরসা’ বলেছ। তার মানে তুমি খৃষ্টান নও। তাহলে তোমার নাম বিভেন বার্গম্যান কেন? বলতে হবে কে তুমি? তোমার এই ছদ্মবেশ কেন?’ ডাক্তার খালাম্মার নাছোড়বান্দা কণ্ঠ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘খালাম্মা, আমার যে পরিচয় পেয়েছেন সেটা সত্য। আমার বাকি পরিচয় আপনি ম্যাডাম যয়নব যোবায়দার কাছ থেকে জানতে পারবেন। আমার ছদ্মবেশ বিপক্ষকে বিভ্রান্ত এবং কাজের সুবিধার জন্যে খালাম্মা।’ গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার গম্ভীর, প্রশান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তার খালাম্মা বলল, ‘ঠিক আছে বেটা।’
যয়নব যোবায়দা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল ডাক্তার খালাম্মাকে, ‘আসুন খালাম্মা। খেতে খেতে সব বলা যাবে।’
পরে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বোনকে ‘ম্যাডাম’ বলা কি ভালো দেখায়?’
‘আপনিও আমাকে ‘স্যার’ বলেন।’ বলল আহমদ মুসা।
যয়নব যোবায়দার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আর বলব না ভাই সাহেব।’
যয়নব যোবায়দা পা বাড়াল ডাইনিং রুমের দিকে যাবার জন্যে।
আহমদ মুসারা এগুলো জায়নামাযের দিকে।

রাত তখন সাড়ে তিনটা। ব্ল্যাক ঈগলের পাত্তানী সিটির আইজ্যাক জ্যাকব এবং ব্ল্যাক ঈগলের থাই অপারেশন প্রধান শিমন আশের একটা ছোট ঝাউ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নাইটভিশন দূরবীন চোখে লাগিয়ে পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং তার আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে।
পাত্তানী পুলিশ হেডকোয়ার্টার একটা উচ্চভূমির উপর। উচ্চভূমি গোটাটাই ফলজ গাছের বাগান। উচ্চভূমির মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে লাল ইটের তৈরি পুলিশ হেডকোয়ার্টারটি। হেডকোয়ার্টারের চারদিক ঘিরে বাগান। এই বাগানেরই এখানে-সেখানে পুলিশদের রেসিডেন্সিয়াল বস্নক।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার তিন তলা। কিন্তু মাটির নিচে রয়েছে আরও দু’টি আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর। এই ফ্লোরগুলোতে রাখা হয় ভয়ংকর সব ক্রিমিনালদের।
বাগানের ভেতর ছোট একটা ঝাউয়ের আড়াল থেকে আইজ্যাক জ্যাকব ও শিমন আশেরের নাইটভিশন দূরবীন এই পুলিশ হেডকোয়ার্টারকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। তাদের উদ্দেশ্য পাহারায় থাকা পুলিশদের দেখা। তাদের নাইটভিশন দূরবীনের দৃষ্টিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ফ্রন্ট ভিউ নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু একজন পুলিশকেও কোথাও পাহারায় দেখছে না।
স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব এবং শিমন আশের দু’জনের মুখেই। আইজ্যাক জ্যাকব বলল, ‘মি. আশের স্যার, মনে হচ্ছে আমাদের ডিএসপি মহিদল পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পেরেছে।’
‘তাহলে তো কাজ শুরু করা দরকার। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিউটিরত ও পাহারায় থাকা পুলিশদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য যে বিশেষ ক্লোরোফরম গ্যাস তাকে দেয়া হয়েছে, তার মেয়াদ দু’ঘণ্টা। এক ঘণ্টা পর সবাই সংজ্ঞা ফিরে পাবে। আমাদের কিন্তু ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করে ফিরতে হবে।’ বলল শিমন আশের।
‘ঠিক। তা না হলে বাধা পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কেউ এলে কিংবা টেলিফোন করে অব্যাহতভাবে নো রিপ্লাই পেলে বিষয়টা ধরা পড়ে যেতে পারে।’ বলে আইজ্যাক জ্যাকব হাতঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকাল। সময় ৩টা বেজে ৩২ মিনিট। ঠিক তিনটা ৩০ মিনিটে সে ক্লোরোফরম গ্যাস ছেড়েছে। সুতরাং দুই মিনিট চলে গেছে অপারেশন শুরু হবার পর।
‘চলুন তাহলে অগ্রসর হওয়া যাক। আমি সংকেত দিচ্ছি সবাই আমাদের ফলো করবে।’ বলল শিমন আশের।
‘না স্যার, সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে এভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আমি দেখে আসি।’ বলে ছুটল আইজ্যাক জ্যাকব পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে।
গেটে পৌছেই সে দেখল গেটের দু’পাশের দুই গেট বক্সে চারজন পুলিশের দেহ সংজ্ঞাহীনভাবে কোনটা টেবিলে, কোনটা মেঝেতে পড়ে আছে। ভেতরে ঢুকে ডিউটি রুম পর্যন্ত একই দৃশ্য দেখল আইজ্যাক জ্যাকব। বিভিন্ন স্থান মিলে প্রায় তিরিশজন পুলিশকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সে দেখতে পেল। ডিউটি রুমে ডিএসপি মহিদলকেও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। এটাই পরিকল্পনা ছিল যে, ডিএসপি মহিদল নিজেও সংজ্ঞাহীন হবে, যাতে সে সকল সন্দেহের উর্ধে থাকে।
ডিউটি রুম থেকে বেরুবার সময় আইজ্যাক জ্যাকব টেবিলের উপর ঢলে পড়ে থাকা পুলিশের দেহ তুলে ধরে একটা ঝাকুনি দিল ক্লোরোফরমের এ্যাকশন দেখার জন্যে।
ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিতেই গড়িয়ে দেহটি মেঝেয় পড়ে গেল।
হাসি মুখে ছুটে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এল আইজ্যাক জ্যাকব।
পৌছে খবর দিল আশেরকে, ‘স্যার মাঠ একদম পরিষ্কার। ৩০ জন পুলিশকে সংজ্ঞাহীন পড়ে থাকতে দেখে এলাম। ডিএসপি মহিদলকেও। চলুন যাওয়া যাক।’
‘যাব। শোন আইজ্যাক জ্যাকব, তুমি তো জান, মহিদল যা বলেছে। তিন তলার রেড সিকিউরিটি রুমে লিফট আছে ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামার। ভূগর্ভের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আমাদের লোকদের রাখা হয়েছে। তুমি দশ বারো জনকে নিয়ে যাবে তাদের উদ্ধারের জন্য। আমি অবশিষ্টদের নিয়ে নিচে পাহারায় থাকব। যাওয়া ও আসার মধ্যে দশ মিনিটের বেশি সময় তুমি পাবে না মনে রেখ।’ বলল শিমন আশের।
‘দশ মিনিট যথেষ্ট স্যার। চলুন।’ আইজ্যাক জ্যাকব বলল।
সবাই পৌছল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।
পরিকল্পনা মোতাবেক আইজ্যাক জ্যাকব ১২ জনকে নিয়ে তিন তলার রেড সিকিউরিটি রুমের দিকে ছুটল সিঁড়ি দিয়ে। দুই তলা শূন্য দেখল। চার তলাও তাই। তবে রেড সিকিউরিটি রুমে ঢুকে দেখল চারজন পুলিশ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। খুশি হলো আইজ্যাক জ্যাকব। একজনের পাঁজরে লাথি মেরে বলল, ‘হারামজাদারা, আমাদের লোকদের আটকে রেখেছিল?’ লিফটের সুইচ অন করল আইজ্যাক জ্যাকব। লিফটের দরজা খুলে গেল।
লিফটে উঠল ওরা বার জন।
লিফট গিয়ে পৌছল ভূগর্ভস্থ দুই ফ্লোরের গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
লিফটের দরজা খুলে গেল। সামনেই বিরাট হল ঘর।
হল ঘরে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে তাদের ১২ জন লোক।
আইজ্যাক জ্যাকবদের দেখে ওরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
দ্রুত ওদের বাঁধন খুলে দেয়া হলো।
আনন্দে একে অপরকে ওরা জড়িয়ে ধরল। কুশল বিনিময় শুরু হয়ে গেল।
আইজ্যাক জ্যাকব চিৎকার করে বলল, ‘এখন এসব রাখ। আগে বের হও পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে।’
বলেই আইজ্যাক লিফটের বন্ধ দরজার দিকে চলল।
চাপল লিফটের উপরে উঠার সুইচ।
সবাই ছুটে আসতে লাগল লিফটের দিকে।
লিফটের দরজা খুলল না ।
সুইচের দিকে তাকাল আইজ্যাক জ্যাকব। দেখল সুইচে আলো জ্বলছে না। চমকে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব। আবার সুইচ টিপল। না সুইচে আলো জ্বলছে না। চমকে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব। আবার সুইচ টিপল। না সুইচে আলো জ্বলছে না।
‘তাহলে কি বিদ্যুৎ চলে গেছে?’ স্বগত কণ্ঠেই যেন বলে উঠল আইজ্যাক জ্যাকব।
আইজ্যাক জ্যাকবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আগে বন্দী হয়ে আসা ১২ জনের একজন অ্যারন আজিজ।
অ্যারন আজিজ লেবানন বংশোদ্ভুত একজন ইহুদী। তার বর্তমান বসবাস থাইল্যান্ডে।
অ্যারন আজিজ বলল, ‘স্যার বিদ্যুৎ যায়নি। দেখুন এই ঘরে তো বিদ্যুৎ আছে।’
‘ঠিক তো বিদ্যুৎ যায়নি! তাহলে সুইচে বিদ্যুৎ নেই কেন?’ তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল, ‘শুধু লিফটের বিদ্যুৎ তো এভাবে যায় না! কেউ কি লিফটের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিল?’ আর্তনাদের মত শোনার আইজ্যাক জ্যাকবের কথা।
সে পাগলের মত লিফটের সুইচ টিপতে লাগল। লাথি লাগাল লিফটের দরজায়।
আইজ্যাক জ্যাকবের লাথিতে লিফটের দরজায় সামান্য শব্দও হলো না।
অ্যারন আজিজ বলল, ‘স্যার লিফট এবং সিঁড়ি মুখের দরজা কয়েক ইঞ্চি পুরু ষ্টিলের। আমরা অনেক লাথি-টাথি মেরে দেখেছি। মনে হয় বোমাতেও দরজার কিছু হবে না।
আইজ্যাক জ্যাকব মোবাইল বের করল শিমন আশেরকে টেলিফোন করার জন্যে। কিন্তু দেখল মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই।
‘আমাদেরকে ওরা ট্রাপে ফেলেছে’ বলে চিৎকার করে উঠে আইজ্যাক জ্যাকব তার মেশিনগানের সব গুলী উজাড় করল লিফটের দরজার উপর।
লিফটের দরজায় লাগা সবগুলো গুলী ঝরে পড়ল মেঝেতে। দরজায় সামান্য দাগও পড়ল না। তার মানে দরজাগুলো বুলেট প্রুফ।
ক্রোধে, ক্ষোভে, উদ্বেগে পাগলের মত হয়ে ওঠে আইজ্যাক জ্যাকব। উন্মত্তের মত লাথি দিতে লাগল লিফটের দরজার উপর।
ওদিকে শিমন আশের আইজ্যাক জ্যাকবকে তাদের লোকদের উদ্ধারের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েই পুলিশ হেডকোয়ার্টার ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়। পজিশন নিয়েই নির্দেশ দেয় সংজ্ঞাহীনদের পাশে পড়ে থাকা ষ্টেনগান ও রিভলবার নিয়ে তার সামনে এক জায়গা জমা করতে।
সে নিজে পজিশন নিয়েছিল দুই গেট বক্সের মাঝখানে।
অস্ত্রগুলো এক জায়গায় স্তুপ করার পর সবাই রিলাঙ মুডে গল্প-গুজব শুরু করল।
ঠিক এই সময় তিন তলায় গুলীর একটি শব্দ হলো।
শিমন আশের চমকে উঠে দাঁড়াল।
সাথে সাথে ব্ল্যাক ঈগলের যে যেখানে ছিল অস্ত্র নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের সবার দৃষ্টি তিন তলার দিকে।
অন্যদিকে গুলীর শব্দের সংগে সংগে সংজ্ঞাহীন পুলিশের সবাই গড়িয়ে গড়িয়ে বিভিন্ন দিকে সরে গেল এবং লুকানো অস্ত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারা প্রত্যেকেই যার যার নিকটবর্তী ব্ল্যাক ঈগলের লোককে টার্গেট করল।
দুই গেট বক্সের চার সংজ্ঞাহীন পুলিশ বেরিয়ে এসেছে নিঃশব্দে। তাদের হাতেও গোপন স্থান থেকে বের করে নিয়ে আসা চার ষ্টেনগান।
গুলীর শব্দের পর থেকে তাদের বেরিয়ে আসার মধ্যে ১৫ সেকেন্ড সময়ও লাগেনি।
তারা দু’দিক থেকে যখন শিমন আশেরের পেছনে এসে দাঁড়াল, তখনও তার উদগ্রীব দৃষ্টি তিন তলার দিকে। তার হ্যান্ডমেশিনগান বেল্টে ঝুলছে এবং তার রিভলবার হাতে ঝুলছে।
চারজনের একজন গিয়ে তার ষ্টেনগানের বাঁট দিয়ে শিমন আশেরের রিভলবার ধরা হাতে আঘাত করল।
রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
চমকে উঠে চরকির মত ঘুরে দাড়াল শিমন আশের। তার একটা হাত চলে গিয়েছিল তার হ্যান্ডমেশিনগানের বাঁটে।
ষ্টেনগান দিয়ে যে পুলিশ শিমন আশেরের হাতে আঘাত করেছিল, তার ষ্টেনগান উঠে গিয়েছিল শিমন আশেরের বুক বরাবর। সে উঠে দাঁড়াবার সংগে সংগেই বলল, ‘লাভ হবে না অস্ত্রে হাত দিয়ে তোমার সামনে চারটা ষ্টেনগান। একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে তুমি।’
শিমন আশেরের হাত সরে এল হ্যান্ডমেশিনগানের বাঁট থেকে।
চার পুলিশের একজন দ্রুত গিয়ে শিমন আশেরের দুই হাত পেছনে টেনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
শিমন আশের ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা চারজন। কিন্তু আমার তিন ডজন লোক তোমাদের হেডকোয়ার্টার দখল করে আছে। এখনি এসে পড়বে তারা।’
একজন পুলিশ শিমন আশেরকে ঘুরিয়ে দিল যাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ভেতরটা দেখতে পায়।
ভেতরে চোখ পড়তেই আঁৎকে উঠল শিমন আশের। দেখল, ব্ল্যাক ঈগলের প্রত্যেকের পেছনে একজন করে পুলিশ। সবারহ হাতেই হ্যান্ডকাফ।
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা শিমন আশেরের। তাহলে পুলিশের সংজ্ঞাহীন হওয়ার ব্যাপারটা কি ভুয়া?’
এক পুলিশ বলল, ‘আশা করবেন না যে, আপনাদের যারা বন্দী ব্ল্যাক ঈগলদের উদ্ধার করতে গেছে, তারা আপনাদের উদ্ধার করতে আসছে। উদ্ধার করতে গিয়ে ওরা নিজেরাই এখন সাথীদের সাথে খাঁচা-বন্দী হয়েছে।’
বিস্ময়-উদ্বেগে মুখ চুপসে গেল শিমন আশেরের। বলল, ‘ডিএসপি মহিদলের সংজ্ঞা হারানোও কি নাটক?’
‘না তারটাই আসল। তার সাথে আপনাদের যোগসাজশের শুধু ঐটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে। তাকে সংজ্ঞালোপ করে ফেলে রাখা হয়েছিল আপনাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যে।’ বলল একজন পুলিশ।
এ সময় দোতলা থেকে এসপি উদয় থানির কণ্ঠ শোনা গেল। নির্দেশ দিল সে, ‘বন্দী সবাইকে ব্ল্যাক চেম্বারে নিয়ে এস।’
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ‘ব্ল্যাক চেম্বার’ হলো একটা ট্রানজিট কক্ষ। মাত্র এক দরজার জানালাহীন এক বিশাল ঘর এটা। বাতাস যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ক্ষুদ্রাকারের ভেন্টিলেশন রয়েছে ঘরটিতে। গ্রেফতারের পর ক্রিমিনালদের জেলে বা পুলিশ হাজতে কিংবা স্থানান্তরে পাঠানোর আগে এই ঘরে রাখা হয়।
হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় প্রত্যেককে সেই ঘরে নিয়ে তোলা হলো।
ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে আরও ২৪ জনকে হ্যান্ড কাফ পরা ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এনে ‘ব্ল্যাক চেম্বারে’ তোলা হলো। এদের মধ্যে আইজ্যাক জ্যাকবও সংজ্ঞাহীন ছিল।
ব্ল্যাক চেম্বারে ‘ব্ল্যাক ঈগল’ এর বন্দীর মোট সংখ্যা ৪৮ জন।
বাম হাতে ব্যান্ডেজ বাধা এসপি উদয় থানি শিমন আশেরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমিই সম্ভবত পালের গোদা। তোমরা ডিএসপি মহিদলকে বশ করে মনে করেছিলে বন্দীদের উদ্ধার করাসহ যা ইচ্ছা তাই করে যাবে। কিন্তু পারনি। সত্যি বলতে কি তোমাদের এতবড় বিপর্যয় এত সহজে হবে আমরাও কল্পনা করতে পারিনি। এর অর্থ তোমাদের খেলা খতম হওয়ার পথে।’
শিমন আশেরের বিধ্বস্ত চেহারায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলকে এত ছোট করে দেখ না। পস্তাতে হবে। মনে রেখ ব্ল্যাক ঈগলের ডানার নিচে গোটা দুনিয়া। আর থাইল্যান্ডেও ব্ল্যাক ঈগল দুর্বল নয়। শাহবাড়ি, যয়নব যোবায়দার বাসা এবং আজকের বিপর্যয় আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু এর মূল্য তোমাদেরকে দিতে হবে।’
‘মূল্য আমরা অনেক দিয়েছি। বহু থাই মানুষকে তোমরা মেরেছ। এবার আমাদের মূল্য আদায় করার পালা। কিন্তু বলত তোমরা এখানে মুসলমানদের ঘাড়ে চড়েছ কেন? তাদের ঘাড়ে সন্ত্রাসের বদনাম চাপিয়ে তোমাদের লাভ?’ বলল এসপি উদয় থানি।
‘ব্ল্যাক ঈগল কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।’ বলল শিমন আশের।
‘দেয় না। কিন্তু এবার দেবে।’ বলল উদয় থানি। তার কণ্ঠ কঠোর।
উদয় থানি থামতেই শিমন আশের বলে উঠল, ‘আমাদের এই চব্বিশ জন সংজ্ঞাহীন হলো কি করে?’
‘পুলিশদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য তোমরা যে ক্লোরোফরম গ্যাস মহিদলকে দিয়েছিলে, সেই গ্যাস দিয়ে বন্দীখানায় এদের আমরা সংজ্ঞাহীন করেছি। যাতে নিরুপদ্রবে সবাইকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এই ব্ল্যাক-চেম্বারে আনতে পারি।’
বলেই এসপি উদয় থানি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সংগে সংগে ষ্টিলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কপালের ঘাম মুছে এসপি উদয় থানি কম্যুনিকেশন রুমে ঢুকল ব্যাংককের সাথে কথা বলার জন্য। ডিএসপি মহিদলের ঘটনার ব্যাপারে পূর্বেও একবার সে কথা বলেছে ব্যাংককের সাথে।

Top