৪৫. বসফরাসের আহ্বান

চ্যাপ্টার

কথা বলছিল জেনারেল তাহির তারিক, ‘…আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন খালেদ খাকান, ইতোমধ্যেই খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আপনার জীবনের ওপর দু’টি ভয়াবহ ধরনের হামলা হলো। আমি ভাবছি, আমরা যথেষ্ট সাবধান কিনা। আপনাকে উপযুক্ত সহযোগিতা আমরা দিচ্ছি কিনা। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী দু’জনেই উদ্বিগ্ন। তারা গোটা পরিস্থিতি রিভিউ করতে বলেছেন।’
কথা হচ্ছিল ইনস্টিটিউটের অফিসে বসে।
আহমদ মুসা ছাড়াও এখানে আরও হাজির আছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
জেনারেল তাহিরের কথা শেষ হতেই হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘জেনারেল তাহির ঠিক বলেছেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই উদ্বিগ্ন। অহেতুক যেন তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা না হয়, তারা বলেছেন।’
‘আমারও সেই কথা। আমাদের সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। খালেদ খাকানের প্রতি আমাদের বিরাট দায়িত্ব আছে। তার নিরাপত্তার বিষয়টা আমাদের প্রথম বিবেচ্য।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘আমি দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম এখন আমাদের কি করতে হবে এ নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু আলোচনা হচ্ছে অতীত নিয়ে, কোন ব্যক্তির নিরাপত্তা নিয়ে। আমি মনে করি, এমন সব আলোচনা করার সময় এটা নয়। সাবধান হওয়া কিংবা ঝুঁকি নেয়ার কোন মাত্রা নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। অতি সাবধান হওয়ার পরেও অঘটন ঘটে যায়। আর ঝুঁকি না নিয়ে কোন লড়াইয়ে নামা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, আমাদের যতটা সাবধান হওয়া সম্ভব, ততটা সাবধান আমরা আছি।’ বিনীত কণ্ঠে, কিন্তু দৃঢ় উচ্চারণে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন জনাব খালেদ খাকান। কিন্তু বড় দু’টি ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে, যার একটিতে আপনি মারাত্মক আহত হয়েছেন, অন্যটিতে বলা যায় মৃত্যু আপনাকে ছুঁয়ে গেছে। এ জন্যেই সবাই ভাবছেন, আরও সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে।’ হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘আমি মনে করি, অফিসের জন্যে যে সাবধানী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট। আর আমি যেভাবে চলাফেরা করছি, সেভাবেই চলাফেরা করতে চাই। সাবধানতার নামে আমার পেছনে যদি প্রহরী দেয়া হয়, তাহলে যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই, তা পারবো না…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে কথা বলে উঠল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘অজ্ঞাতে, অলক্ষ্যে প্রহরীরা যদি আপনাকে অনুসরণ করে আর ওদের নজরে যদি না পড়ে তাহলে ক্ষতি কি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘প্রথমবার হয়তো ওরা বুঝতে পারবে না। কিন্তু যখন তারা দেখবে, আমার বিপদকালে পেছন থেকে, পাশ থেকে লোকজনরা যেয়ে হাজির হয়েছে, তাহলে ওদের জানা হয়ে যাবে যে, আমার আশে-পাশে, পেছনে লোক থাকে।’
‘তাহলে আপনার নিরাপত্তার দিকটা দেখার উপায় কি, যা সবাই চাচ্ছেন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘দেখুন, ওরা যে বিষয়ের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সেটা আসলে আনন্দের। আমার ওপর ওদের দু’বারের আক্রমণ প্রমাণ করেছে, আমরা সঠিক পথে চলছি। ঐ হামলা আরও প্রমাণ করেছে, তাদের পরিচয় আমাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে বলে তারা ভীত হয়ে পড়েছে। তাদের ভয় যত বাড়বে, তাদের মরিয়াভাব তত বাড়বে। আমি চাই, তারা আক্রমণে আসুক। তাদের পরিচয় বেশি বেশি সামনে আসুক, তারপর সুযোগ হবে আমাদের আক্রমণের। সুতরাং উদ্বেগ নয়, এ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তার জন্যে আমাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান। আপনি ঠিক বলেছেন। এটাই সাফল্যের পথ। এটাও আমি মনে করি। কিন্তু এই সাথে স্বীকার করতে হবে, এটা সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। এটা নিয়েই আমরা ভাবছি।’ হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘এই ঝুঁকি নেয়ার বিকল্প নেই জনাব। দু’টি বড় ঘটনা ঘটার পর, ওদের পরিচয়-পরিকল্পনার একটা দরজা আমার সামনে খুলে গেছে। এটা আল্লাহর সাহায্য। এ সাহায্য তাদেরকেই করা হয় যারা অগ্রসর হয়, ঝুঁকি নিতে রাজি হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি শুধু সাফল্যের কথা ভাবছেন, নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন না।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওটা ভাবার দায়িত্ব আল্লাহর। আমার ঈমান হলো, আল্লাহ যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তখন তার আগে মৃত্যু হবে না। অতএব, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কারণ, চিন্তা করে, সাবধান হয়ে মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আল্লাহ আপনাকে এমন সাহস ও বিশ্বাসের তৌফিক দিয়েছেন। এমন কথা বলার লোক আমাদের মধ্যে প্রচুর আছে। কিন্তু এমন কথার ওপর আপনার মতো আমল করার লোক খুব কম আছে।’ বলল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। আবেগরুদ্ধ তার কণ্ঠ।
‘মুহতারাম ডঃ ওমর সাহেব যা বলেছেন, তারপর আর কিছু বলার থাকে না। অনেক ধন্যবাদ খালেদ খাকান আপনাকে। একটা কথা, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জেনেছি?’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওদের কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে কিন্তু ওদের কোন সাংগঠনিক পরিচয় এখনও জানা যায়নি। ওদের ঘাঁটির সন্ধান মিলেছে। জানা গেছে, ঐ ঘাঁটিতে পাঁচ গোয়েন্দার গাড়ি ঢোকার পরই তারা নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা হলো, গোপনে এ ঘাঁটিতে প্রবেশ করা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। এ অগ্রগতি অনেক, আমরা তো একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। আপনাকে বোধহয় আরেকটা তথ্য এখনও জানানো হয়নি। আমরা ইরগুন ইবানের জামার ব্র্যান্ড ট্যাগে লেখা ‘One Orld O’bit’ এবং এই লেখার নিচে তিন শূন্য ‘কোডেড’ করা পেয়েছি। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ‘ব্র্যান্ড-নেম’ দুনিয়াতে কোন জামার নেই। আমরা এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল। কথা শেষ করেই হাজী জেনারেল একটা কাগজখণ্ড আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ট্যাগের লেখা এখানে হুবহু লেখা আছে।’
শুনেই আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কাগজখণ্ডের লেখার ওপর চোখ বুলাল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা কামাল। একটা রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। ইরগুন ইবানের জামার ব্র্যান্ড-ট্যাগে লিখিত ‘One Orld O’bit’ আসলে হবে ‘One World Orbit’ ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’। হিব্রু ভাষার লোকাল উচ্চারণে ‘World’-এর ‘ডব্লিউ’ এবং ‘Orbit’-এর ‘আর’ থাকে না। ‘One Orld O’bit’-এর তিন শব্দের প্রথম তিন ‘O’ নিয়ে হয়েছে তিন শূন্য বা ‘থ্রী জিরো’। বোঝা গেল, ইরগুন ইবানদের সংগঠনের নাম ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ বা ‘থ্রী জিরো’।’
‘চমৎকার। ধন্যবাদ খালেদ খাকান। তোমার এই সিদ্ধান্ত একদম ঠিক। আমার মনে পড়েছে, ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ নামে একটি গোপন যুদীয়-খৃস্টান গ্রুপ গোটা দুনিয়ায় কাজ করছে। কিন্তু ওটা তো কালচারাল সংগঠন।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘কালচারাল নামের আড়ালে রাজনৈতিক কাজ করা সুবিধাজনক জনাব। আসলে জনাব, এটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত একটা আমব্রেলা সংগঠন। পশ্চিমের বেশ কিছু শক্তিমান দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এর সাথে কাজ করে। ‘এক বিশ্ব গঠন’ এদের বাহ্যিক শ্লোগান। কিন্তু আসল লক্ষ্য হলো, অন্যসব জাতি, রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও শক্তি ধ্বংস করে সবাইকে পশ্চিমের একটি একক আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসা। সেটাই হবে ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’। ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ এই লক্ষ্যেই কাজ করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সর্বনাশ! এদেরই টার্গেট আমাদের গবেষণা ইনস্টিটিউট! ভয়ানক ব্যাপার তাহলে! ওদের তো অনেক ক্ষমতা!’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওদের অনেক ক্ষমতা, তবে আল্লাহর চেয়ে বেশি নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, বিষয়টা যে কঠিন, জটিল এই অর্থে বলেছিলাম। ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান, আপনার মতো আত্মবিশ্বাসই প্রয়োজন। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আমি বাইরে বেরুবো একটু। আমার জন্যে আপনাদের আর কিছু পরামর্শ?’ বলে আহমদ মুসা সবার দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, মিঃ খালেদ খাকান। আমরা আপনাকে যে জন্যে চেয়েছিলাম, সেটা হয়ে গেছে। আপনার সময় আমরা নষ্ট করব না।’ ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর বলল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহির তারিকও। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি মিঃ খালেদ খাকানকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।’
সবাইকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
সাথে জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসা বেরিয়েই একটা চিরকুট জেনারেল তারিকের হাতে দিল। বলল, ‘মেয়েটার নাম সাবাতিনি ইয়াসার। ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতের মেয়ে। এদের বাড়িতেই আমার চিকিৎসা হয়েছিল, আপনি জানেন। আবার এদের বাড়িতেই ইরগুন ইবানের সাথে ঘটনা ঘটেছে, এটাও আপনি জানেন। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে বুদ্ধিমতী ও অনুসন্ধিৎসু মেয়ে। জাতিতে ইহুদি, কিন্তু আমার ভক্ত। সে ‘থ্রী জিরো’দের ট্র্যাপে পড়েছে। ওদের পক্ষে কাজ করার জন্যে তাকে রোমেলী দুর্গে আসতে হবে। যেসব হেলিকপ্টার বিজ্ঞানীদের বাড়িতে চলাচল করে, তার কাছাকাছি পর্যন্ত তাকে আসতে হবে এবং একটি রাবার বুলেট ছোঁড়ার মাধ্যমে তাকে হেলিকপ্টারে ট্রান্সমিটার চিপস সেট করতে হবে। কিন্তু তার ওপর আমাদের চোখ রাখতে হবে। আর যেদিন পিস্তল দিয়ে রাবার বুলেট ছুঁড়ে ট্রান্সমিটার চিপস সেট করার চেষ্টা করবে, সেদিনই তাকে গ্রেফতার করতে হবে। কিন্তু তার সাথে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার যেন না করা হয়। সে আমার মেহমান। তাকে গ্রেফতার করা প্রয়োজন ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের বাঁচা এবং তাকে বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু এটা জানানোর প্রয়োজন নেই। যা বলার আমি যথাসময়ে বলব।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আমি বুঝেছি। কিন্তু যারা তাকে ব্যবহার করছে, তাদের সম্পর্কে কি ব্যবস্থা?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘মেয়েটি ‘থ্রী জিরো’ গ্রুপের মাত্র একজনকে চেনে, যে তাকে কাজে লাগিয়েছে। লোকটি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার ব্যাপারটাও আমি দেখছি। সে আমার নজরে আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি এখন কোথায় কোথায় বেরুবেন?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডঃ শেখ বাজ।
‘আমি আল-আলা পাহাড়ের আল-আলা সিনাগগটিতে যাব।’
বলেই আহমদ মুসা ফিরল ডঃ বাজের দিকে। বলল, ‘আজ ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। আপনি কি থাকছেন ইনস্টিটিউটে?’
‘থাকব স্যার। কোন পরামর্শ স্যার?’ বলল ডঃ বাজ।
আহমদ মুসা একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘আমি মধ্যরাতের মধ্যে না ফিরলে আপনি জেনারেল তাহিরকে সেটা জানিয়ে দেবেন।’
‘অবশ্যই স্যার।’ বলেই চমকে উঠে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কেন স্যার, আপনি ফিরবেন না?’
তার কথার উত্তর দেবার আগেই জেনারেল তাহির তারিক এসে আহমদ মুসার দু’হাত ধরল। বলল, ‘আপনি কি সে রকম অভিযানে…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘না, মাত্র একটা অনুসন্ধানে। ভাবনার কিছু নেই।’
‘প্লিজ টেক কেয়ার অব ইউ, আমার অনুরোধ।’ বলল স্নেহের স্বরে জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠে উদ্বেগ তখনও।
‘অবশ্যই।’ বলে সালাম দিয়ে ডঃ শেখ বাজের পিঠ চাপড়ে আহমদ মুসা পা বাড়াল তার অফিস রুমের দিকে।

আল-আলা সিনাগগের পেছনটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।
সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
এটা সিনাগগের পশ্চিম পাশ।
পূর্বের মূল গেট কিংবা উত্তর ও দক্ষিণের অংশ দিয়ে সিনাগগে ঢোকার চেষ্টা করা যেত। হয়তো সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ হতো। কিন্তু সহজ বলেই সিনাগগ প্রহরীদের দৃষ্টি সেদিকে কেন্দ্রীভূত থাকবে, এটা ধরে নিয়েছে আহমদ মুসা। তাই পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশকেই নিরাপদ ভেবেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা শুরুতেই সংঘাতে যেতে চায় না। এই যাত্রায় সিনাগগটা দেখতে চায় সে। ওখানে পাঁচ গোয়েন্দা ঢোকার পর নিখোঁজ হওয়ার কোন ক্লু সেখানে পাওয়া যায় কিনা, এটা খোঁজ করা তার একটি লক্ষ্য। তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো, সদ্যোজাত ‘থ্রী জিরো’ সংগঠনের কোন পরিচয়-পরিকল্পনা সিনাগগ থেকে উদ্ধার করা যায় কিনা তা দেখা।
সিনাগগের পশ্চিম দেয়াল থেকেই খাদের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। খাদের দেয়াল ও সিনাগগের দেয়ালের মাঝখানে আধা-ঢালু ফুটখানেকের মতো জায়গা আছে। সেটাও আগাছায় ভরা।
আহমদ মুসা ফুটখানেক প্রশস্ত কাঁথির উপর দিয়ে এগিয়ে সিনাগগের দেয়ালের মাঝ বরাবর এসে পৌঁছল। এখান থেকে একটা মোটা পাইপ উঠে গেছে উপর দিকে। মনে হয়, স্যুয়ারেজ এবং বর্জ্য ওয়াটারের যৌথ পাইপ এটা। এই পাইপ দিয়েই উপরে উঠার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
পাইপটা চেক করতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসা দেখল, পাইপের গোড়ায় একটা মোটা দড়ি বাঁধা। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
পাইপের গোড়ায় বাঁধা দড়িটা খাদে নেমে গেছে।
আহমদ মুসা আস্তে দড়িটা টানল। উঠে আসতে লাগল দড়িটা। গজ তিনেক উঠে আসতেই দেখল, দড়িটা আসলে একটা দড়ির মই।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে এবার বিস্ময় নামল। খাদের চারদিকে তাকাল। দিনের বেলা যা দেখেছিল, তারই একটা অন্ধকার ইমেজ তার সামনে এল। খাদটা সিনাগগের বাউন্ডারি ওয়ালের। খাদের তিন দিকের উঁচু দেয়ালের কালো দেহটা স্পষ্ট তার চোখে পড়ছে। আর খাদের ভেতরটা তার চারপাশের দেয়ালের গাছ-গাছড়ায় ঢাকা বলে অপেক্ষাকৃত বেশি অন্ধকার।
আহমদ মুসা ভাবল, দড়ির মই এখানে কেন?
মই থাকার অর্থ খাদে কেউ বা কারা উঠা-নামা করে।
জংগলাকীর্ণ খাদে নামার ব্যবস্থাটা কেন? প্রশ্নটি আহমদ মুসার কাছে খুব বড় হয়ে উঠল। ভাবল সে, সিনাগগের সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এই খাদের। শুধুই পরিত্যক্ত জংগলাকীর্ণ খাদ এটা নয়। কোন রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে এখানে।
আহমদ মুসা দড়ির মই বেয়ে খাদে নামার সিদ্ধান্ত নিল।
দড়ির মইয়ে ঝুলে পড়ে কয়েক গজ নামার পর আহমদ মুসা হাতের মেশিন রিভলভারটি কাঁধে রেখে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ হাতে নিল। খাদের দেয়াল ঘেঁষে নিচের দিকে আলো ফেলল। দেখল, নিচের দিকটা পরিষ্কার। খাদের মেঝেরও কিছুটা অংশ নজরে এল। যতটা বোঝা গেল, মেঝেটা পরিষ্কার ও সমতল।
যতই নিচে নামতে লাগল আহমদ মুসা, গাছ-গাছড়া ততই কমতে লাগল। এক জায়গায় এসে দেখল, গাছ-গাছড়া একেবারেই নেই এবং খাদের গা মসৃণ পাথরের তৈরি। বুঝল আহমদ মুসা, এটা পরিত্যক্ত কোন খাদ নয়। এটা রহস্যের কোন কেন্দ্র বা রহস্যের কোন দরজা হতে পারে।
খুশি হলো আহমদ মুসা।
মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে নিচটা দেখে নিচ্ছে আহমদ মুসা।
মেঝের চার-পাঁচ ফিট উপরে এসে থেমে গেল আহমদ মুসা।
টর্চের আলো ফেলে খাদের মেঝে ভালোভাবে দেখল এবং মেঝে সংলগ্ন খাদের চারদিকের দেয়ালটাও দেখে নিল। মেঝেটা পাথরের। মেঝের চারদিক দিয়ে খাদের দেয়ালের গোড়া বরাবর বেশ গভীর নালা। নালাটা খাদের পানি নিষ্কাশনের জন্যে, এটা মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। সংগে সংগে তার মনে এল, তাহলে তো খাদের তলা থেকে একটা স্যুয়ারেজ আউটলেট আছে! বের হবার কোন পথও কি আছে কিংবা সিনাগগে ঢোকার কোন পথ? কি কাজে ব্যবহার হয় সুন্দর করে রাখা এই খাদটা?
এসব প্রশ্ন নিয়ে আহমদ মুসা খাদের মেঝেতে নামল।
মেঝেতে নামার পর মেঝেটা কি কাজে ব্যবহার হয় সেটা তালাশের দিকে প্রথমে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
খাদের পানি নিষ্কাশনের একটা জায়গা খুঁজে পেল সে। সেখানে নালার প্রান্তে দেয়ালের গায়ে ছয় ইঞ্চি আয়তনের একটা সুড়ঙ্গ মুখ। সুড়ঙ্গ মুখে জালি লাগানো।
খাদের মেঝে ও দেয়াল সতর্কভাবে পরীক্ষা করল কিন্তু কিছুই পেল না আহমদ মুসা। খাদের মেঝে ও দেয়াল আয়তাকার, চতুষ্কোণ ইত্যাদি বিভিন্ন সাইজের পাথরে তৈরি। তবে একটা অসঙ্গতি লক্ষ্য করল আহমদ মুসা। বড়, গোলাকার এবড়ো-থেবড়ো দু’টি পাথর রয়েছে। একটি দেয়ালে, অন্যটি মেঝেতে। দু’টি পাথর গোটা মেঝে ও দেয়ালকে বেখাপ্পা করে তুলেছে। আহমদ মুসার মনে পড়ল একটা মহাজনী উক্তি, ‘সুরের মধ্যে বেসুরো কিছু ঘটলে তার পেছনে একটা কারণ কাজ করবে।’ আহমদ মুসা এই কারণ সন্ধানের জন্যে পূর্ব দেয়ালের বেঢপ আকৃতির পাথরের দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা আবার খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করল দেয়ালের পাথরটিকে। কিন্তু পাথরের গা থেকে কোন ক্লু পেল না। শুধু দেখল, পাথরের চারদিকের গোলাকার প্রান্ত খুব মসৃণভাবে সেট হওয়া, অন্য পাথরগুলোর মতো এবড়ো-থেবড়ো জোড়া নয়।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সরে গিয়ে মেঝের গোলাকার পাথরটিকেও দেখল আহমদ মুসা। বিস্ময়ের সাথে দেখল, জোড়া লাগানোটা মসৃণ।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এ পাথর দুটোই শুধু যান্ত্রিকভাবে সেট করা। অন্যগুলো হাতে করা। এর কারণ কি হতে পারে চিন্তা করতে গিয়েই সে বড় আশার আলো দেখতে পেল।
আহমদ মুসা দ্রুত এগোলো দেয়ালের গোলাকার পাথরটির দিকে।
পাথরটির মাঝখানে পা দিয়ে জোরে একটি হ্যাঁচকা চাপ দিল।
পাথরটি নড়ে উঠে কয়েক ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর তা দ্রুত সরে গেল এক পাশে।
উন্মুক্ত হলো একটা সুড়ঙ্গ পথ। আবছা আলো তাতে।
আহমদ মুসা বুঝল, সিনাগগে প্রবেশের এটা গোপন পথ।
আহমদ মুসা ঢুকতে যাবে সুড়ঙ্গ পথে, এমন সময় তার পকেটের মোবাইলে ভাইব্রেশন অনুভব করল।
মোবাইলটি হাতে নিয়ে অন করে দেখল, জোসেফাইনের কল।
‘আসসালামু আলাইকুম জোসেফাইন, আমি বাইরে। কিছু খবর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। একটা খবর। তুমি সিনাগগে, এ খবর তারা পেয়ে গেছে।’ জোসেফাইন বলল।
শুনেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। আমি সিনাগগে। আর কিছু?’
‘না, আর কিছু নয়। ফি আমানিল্লাহ।’ বলল জোসেফাইন।
‘আসসালামু আলাইকুম।’ বলে মোবাইল বন্ধ করল আহমদ মুসা।
জোসেফাইনের দেয়া খবর নিয়ে মুহূর্ত কাল ভাবল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা সিনাগগে আসছে- এ খবর এরা পাওয়ার অর্থ সকলেই সতর্ক, প্রবেশের সবগুলো পথের উপর তাদের চোখ থাকবে। এই খাদ এবং এই সুড়ঙ্গ পথের উপরও কি? এ পর্যন্তকার অবস্থায় তা মনে হয়নি। তাদের এই গোপন পথ এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যাবে, এতটা দুর্বল আত্মবিশ্বাস ওদের নয় নিশ্চয়। যাই হোক, তাকে সামনে এগোতে হবে।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল সুড়ঙ্গ পথে। সুড়ঙ্গ পথের মুখ বন্ধ করার জন্যে আহমদ মুসা পেছন ফিরল।
সুড়ঙ্গ মুখ থেকে সরে যাওয়া পাথরটিকেও প্রথম দেখল আহমদ মুসা। পাথরটিকে মুভ করার কৌশল পাথরটিতেই আছে, কারণ, পাথরটির মাঝখানে চাপ দেবার ফলেই তা মুভ করে, খুলে যায়।
আহমদ মুসা পাথরের এ দিকটি ভালো করে পরীক্ষা করল। সুইচ জাতীয় কিছু পেল না। দেখল, পাথরের গোড়ার বরাবরটাই কতকগুলো চাকার উপরে এবং চাকাগুলো ইস্পাতের মজবুত রেলের উপর। রেলটা পাশের দিকে মুভেবল, বুঝল আহমদ মুসা। এ কারণেই পাথরে শক্ত চাপ পড়লে তা আগে-পেছনে মুভ করে। রেলটি ইস্পাতের পিচ্ছিল বেদীর উপর থাকায় মুভ করতে কোন অসুবিধা হয় না।
আহমদ মুসা আগের মতোই পাথরটির মাঝখানে প্রচণ্ড চাপ দিল। আগে যা ঘটেছিল, সেভাবেই পাথরটি সামনের দিকে সরে গেল এবং সংগে সংগে পাথরটি দ্রুত সরে গিয়ে সুড়ঙ্গের দরজা বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, পাথরটি দরজায় সেট হওয়ার সাথে সাথেই পাথরের দুই প্রান্তে দু’টি হাতল ছিটকে বেরিয়ে এল। বুঝল আহমদ মুসা, ভেতর থেকে দরজার পাথরটি পেছন দিকে টানার জন্যে এই দুই হাতল ব্যবহার করতে হবে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল।
ওদিক থেকে আসা আলোতে সুড়ঙ্গে আলো-অন্ধকার।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গ পথে দশ-বারো ফিট এগোনোর পর একটা আলোকোজ্জ্বল ফ্লোরে এসে দাঁড়াল।
সিনাগগের ভূ-গর্ভস্থ একটা ফ্লোর এটা।
আহমদ মুসা অনুমান করল, উপরে আরেকটা ভূ-গর্ভস্থ ফ্লোর রয়েছে। তারপরেই গ্রাউন্ড ফ্লোর।
আহমদ মুসা ভাবল, সিনাগগের গোপন ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে ‘থ্রী জিরো’ সংগঠনের পরিচয়-পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে।
আহমদ মুসা নজর বুলাল ফ্লোরটির চারদিকে। ফ্লোরের পশ্চিম ও উত্তর অংশ মোটামুটি ফাঁকা। এ অংশে কিছু বাক্স-পেটরা ছাড়া তেমন কিছু নেই। কিন্তু দক্ষিণ ও পূর্ব অংশে বেশ কিছু সারিবদ্ধ সুন্দর কক্ষ দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল, ফ্লোরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে মোটা রড দিয়ে তৈরি খোঁয়াড়ের মতো একটা জায়গা।
প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে, এটা ওদের কোন বন্দীখানা নয়তো?
আহমদ মুসা এগোলো খোঁয়াড় মতো জায়গাটার দিকে।
খোঁয়াড়ের ফ্লোর ফুটখানেক উঁচু। বেশ বড় খোঁয়াড়টি। আয়তনটা আট বর্গফুটের কম হবে না। খোঁয়াড়ের একদিকে দেয়াল, তিনদিকে মোটা রডের বেড়া, ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু। খোঁয়াড়ের দেয়ালের দিকে নজর পড়ল আহমদ মুসার। দেখতে পেল, পরিষ্কার দেয়ালে সাদা পাথরের ওপর ফিংগার প্রিন্টের মতো কালো দাগ ইংরেজি ‘5’ অংকের আকারে সাজানো বেমানান লাগছে বলেই বিষয়টা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আরেকটা মজার বিষয় আহমদ মুসা দেখল যে, একই সাইজের ফিংগার প্রিন্টের মতো দাগগুলোর সংখ্যাও পাঁচ। এই সংখ্যা আহমদ মুসাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করল। নিকট থেকে দেখতে চাইল দাগগুলো আসলে কি।
আহমদ মুসা খোঁয়াড়ের গ্রীল ডোরটি খোলার জন্যে ডান হাতের মেশিন রিভলভারটি বাম হাতে নিয়ে ডান হাত খালি করতে যাচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে ‘হা হা’ শব্দের অট্টহাসি তার কানে এল। একই সাথে আরেকটা উচ্চকণ্ঠ, ‘হ্যাঁ খালেদ খাকান, ঠিক জায়গায় পৌঁছেছ। ঢুকে যাও খোঁয়াড়ে। তোমার আগে ওখানে পাঁচ গোয়েন্দাও….।’
কথা শেষ করতে পারল না পেছনের কণ্ঠ।
ওদিকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ার মতোই আহমদ মুসার দেহ আছড়ে পড়েছিল সামনের দিকে। তার চোখের সামনে এসে গিয়েছিল পেছনটা। ট্রিগারে লাগসইভাবে সেঁটে ছিল তার তর্জনী। তার দেহ মাটি ছোঁয়ার আগেই শব্দ লক্ষ্যে তার মেশিন রিভলভার গুলি বৃষ্টি শুরু করেছিল। তার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ‘হা হা’ অট্টহাসি এবং দ্বিতীয় কণ্ঠের বিকট উচ্চারণ।
দেহটি মাটি ছোঁবার পর পেছনটা সম্পূর্ণ নজরে এল আহমদ মুসার, দেখল, লিফটের সামনে পড়ে থাকা লাশগুলোর মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়াচ্ছে তার স্টেনগানটা হাতে নিয়ে।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলভার তাকে টার্গেট করল। লোকটি তার স্টেনগান এদিকে ফেরানোর আগেই সে লাশ হয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েই ছুটল লিফটের দিকে।
লিফট অটোমেটিকভাবে বন্ধ হবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু একটা লাশ লিফটের দরজার উপরে পড়ে থাকায় তা বন্ধ হতে পারছিল না।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে লিফটের ভেতরে ঢুকল। ‘ওপেন’ বোতাম টিপে দরজা সরিয়ে নিল। তারপর লাশের পাটা সরিয়ে দিল লিফটের দরজা থেকে।
মোট পাঁচটি লাশ লিফটের বাইরে পড়েছিল। সবার হাতেই স্টেনগান।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। ক্ষিপ্রতার প্রতিযোগিতায় সে জিতেছে।
লিফটের কী-বোর্ডের মনিটরে দেখল আহমদ মুসা, ‘গ্রাউন্ড জিরো’ ফ্লোর থেকে অস্থিরভাবে লিফট কল করা হচ্ছে।
লিফটের ‘জিরো’ সুইচ অন করল আহমদ মুসা। তারপর তার মেশিন রিভলভার দু’হাতে বাগিয়ে ধরে দরজার পাশে লিফটের গা সেঁটে দাঁড়াল, যাতে কারও সরাসরি দৃষ্টি তার উপরে না পড়ে।
উঠতে শুরু করল লিফট।
একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট দাঁড়াল ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর’ মানে ‘জিরো’তে। লিফট কী-বোর্ড দেখে বুঝেছে আহমদ মুসা, ‘গ্রাউন্ড টু’ হলো ভূ-গর্ভস্থ সবচেয়ে নিচের ফ্লোর। তার উপরের ফ্লোর হলো ‘গ্রাউন্ড ওয়ান’ এবং ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর’টাই হলো ‘গ্রাউন্ড জিরো’। এটাই হলো সিনাগগের মূল ফ্লোর। এর উপরে আরও তিনটি ফ্লোর আছে, সেগুলোতে সিনাগগ সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিস এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ফাঁকা। সিনাগগের সাম্প্রতিক ব্যবস্থায় দু’একজন কর্মকর্তা ছাড়া কাউকেই সিনাগগে থাকতে দেয়া হয় না। সবাই বাইরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।
লিফট ‘জিরো’তে দাঁড়াবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লিফটের দরজা ওপেন হয়ে গেল।
লিফটের দরজা খুলতে শুরু করার সময় ওদের কথা কানে এল আহমদ মুসার। একজন বলছে, ‘না, আর গুলি-গোলার শব্দ কিন্তু নেই। তাহলে কি শয়তান খালেদ খাকান মারা পড়েছে? কিন্তু ওরা কিছু জানাচ্ছে না কেন?’
‘ওসব ভেবে লাভ নেই। চল সবাই নিচে যাই। বাইরে যারা পাহারায় আছে, তাদের আমি খাদের চারধারে পাহারায় থাকতে বলেছি।’ বলল আর একজন।
অন্য একজন বলল, ‘আমাদের রাব্বি প্রধান ডেভিড ইয়াহুদকে জানানো দরকার ছিল না কি?’
‘আমরা খবর পাওয়ার পর তাকেও খবরটা জানিয়েছি। আবার এইমাত্র টেলিফোন করেছি। তিনি বলেছেন, খালেদ খাকান যেন জীবন্ত বের হতে না পারে। হত্যাই তার একমাত্র শাস্তি। দেখামাত্রই তাকে হত্যা করতে হবে।’ বলল দ্বিতীয়জন।
লিফটের দরজা তখন পুরোপুরি খুলে গিয়েছিল।
ওরা একসাথে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদেরও হাতে স্টেনগান।
আর ফুট দুই-তিন এগোলেই আহমদ মুসা ওদের নজরে পড়ে যাবে পুরোপুরি।
ওরা এ সুযোগ পাওয়ার আগেই আহমদ মুসা মেশিন রিভলভারের ট্রিগার চেপে রেখে বেরিয়ে এল লিফটের দরজার আড়াল থেকে।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলভার গুলি বৃষ্টি শুরু করেছিল দরজার ওপাশের প্রান্ত থেকে। মুহূর্তেই আহমদ মুসা দরজার মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াবার সাথে সাথেই অর্ধ বৃত্তাকারে ঘুরে দরজার এ প্রান্তে এসে থামল।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পাল্টা আক্রমণের কোন চেষ্টা না করেই ওরা ছয়জন গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে লাশ হয়ে পড়ে গেল।
এ গুলির শব্দ বাইরে গেলে কি প্রতিক্রিয়া হয়, দেখার জন্যে আহমদ মুসা লিফট লক করে দিয়ে বেরিয়ে অল্প দূরে লিফটমুখী একটা ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটি অন্ধকার।
ঘিরে কেউ নেই নিশ্চয়। ঘরে কেউ থাকলে গুলির শব্দে নিশ্চয় সে বের হতো।
আহমদ মুসা দরজার একপাশে অন্ধকারে দাঁড়াল। ভাবল, এখানে দাঁড়িয়েই কয়েক মিনিট সে প্রতীক্ষা করবে গুলির শব্দে ভেতর বা বাইরে থেকে কেউ এদিকে এগোয় কিনা।
আহমদ মুসার অপেক্ষার পালা শুরু। তার ডান হাতের রিভলভারটা উদ্যত।
হঠাৎ মাথার পেছনে একটা ভারি স্পর্শ অনুভব করল আহমদ মুসা। সেই সাথে একটা কর্কশ কণ্ঠ বলে উঠল, ‘তোমার হাতের রিভলভার ফেলে…..।’
লোকটির বাক্য শেষ হলো না। তার বদলে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা আর্তনাদ।
লোকটির কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসার মেশিন রিভলভারের কয়েকটি গুলি তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে।
মাথার পেছনে ভারি কিছুর স্পর্শ এবং তার সাথে কর্কশ কণ্ঠ শ্রুত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার আত্মরক্ষার চিন্তা মুহূর্তও দেরি না করে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছিল।
তখন আহমদ মুসার দেহ বোঁটা থেকে খসে পড়া ফলের মতোই টুপ করে দ্রুত নিচে নেমে গিয়েছিল এবং তার চেয়েও দ্রুত উপরে উঠে এসেছিল তার রিভলভার ধরা ডান হাত।
আহমদ মুসার মাথা যখন লোকটির পেট পর্যন্ত নেমে এসেছিল, তখন আহমদ মুসার ডান হাত পৌঁছে গিয়েছিল তার মাথার উপরে। তর্জনী চেপেছিল আহমদ মুসা মেশিন রিভলভারের ট্রিগারে। গুলির বৃষ্টি ছুটছিল পেছনের লোকটির বুক লক্ষ্যে।
লোকটির মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল তার কথার দিকে, তার রিভলভারের ট্রিগারে থাকা তর্জনীর দিকে নয়। যখন সে টের পেল তার রিভলভার থেকে টার্গেটের মাথা খসে গেছে, তখন কথা বন্ধ করে রিভলভারের নল রি-অ্যাডজাস্ট করার জন্যে যেটুকু সময় তার প্রয়োজন ছিল, সেটা সে পায়নি। তার আগেই গুলি বৃষ্টি আছড়ে পড়েছিল তার বুকে। এই অসতর্কতাই তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
লোকটির লাশ পেছনে ছিটকে পড়ে গেছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে আগের মতো পজিশন নিল সেই দরজার পাশেই। আর বেশি দেরি করতে হলো না।
দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে শিকারী বেড়ালের মতো ছুটে এল স্টেনগানধারী তিনজন লোক।
চারদিকে নজর রেখে তারা ছুটে এল লাশের দিকে। লাশের দিকে একবার তাকিয়েই তারা চোখ ভরা আতংক নিয়ে স্টেনগান বাগিয়ে কি যেন পরামর্শ করল তিনজনে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে এল প্রশস্ত করিডোরে।
আহমদ মুসা ওদের মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুঁড়ল। বলল, ‘তোমাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত তুলে……।’
কথা শেষ না করেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে বাম দিকে মেঝের উপর ছুঁড়ে দিল। এক ঝাঁক গুলি এসে সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান দিয়ে ছুটে গেল। আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে থাকলে তার বুক, মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা বাঁ দিকে ঝাঁপ দিলেও তার তর্জনী রিভলভারের ট্রিগার থেকে সরেনি এবং তার দু’চোখও নিবদ্ধ ছিল ওদের ওপর। ঝাঁপ দেবার পরেই সে ট্রিগার টিপে ধরেছিল মেশিন রিভলভারের। আহমদ মুসা শূন্যে থাকতেই এক ঝাঁক গুলি ওদের দিকে ছুটে গিয়েছিল। আহমদ মুসার দেহ যখন মাটিতে পড়ল, তখন মেশিন রিভলভারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ওদের দেহও পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মনে মনে প্রশংসা করল ওদের তিনজনের। মৃত্যুকে ওরা ভয় করেনি। প্রথম সুযোগেই ওরা শত্রুকে আঘাত হেনেছে। আহমদ মুসা ওদের মুভমেন্ট বুঝতে পেরে যদি যথাসময়ে ঝাঁপ না দিত, তাহলে ওদের আক্রমণ সফল হতো।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই ছুটল সিনাগগের গেটের দিকে।
সিনাগগের গেটের সামনে বিশাল একটা হল ঘর। এটাই প্রধান প্রার্থনা কক্ষ। প্রার্থনা কক্ষের পূর্ব প্রান্তে একটা প্রশস্ত করিডোর প্রধান গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। করিডোরের দু’পাশে কক্ষের সারি।
আহমদ মুসা যখন হল পেরিয়ে করিডোর মুখের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তখন দেখল তিনজন স্টেনগানধারী করিডোরে প্রবেশ করেছে। ওরা দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে, আহমদ মুসাও দেখেছে ওদের।
ওদের করিডোরে দেখেই একটা পিলারের আড়ালে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে দেখেই ওরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই ওরা এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা পিলারের পেছনে লুকিয়েছে, দেখেছে তা ওরা। ওরা গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেলো পিলার লক্ষ্যে। আহমদ মুসা যেন পাল্টা গুলিবর্ষণের সুযোগ না পায়, এটাই ওরা চাচ্ছে।
সত্যিই আহমদ মুসা বেকায়দায়। গুলি এসে পিলারকে এমনভাবে ছেঁকে ধরেছে যে, উঁকি মারা কিংবা গুলি করার জন্যে রিভলভার ধরা হাত বাইরে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। গুলিগুলো আসছে মাথা সমান উঁচু রেঞ্জ দিয়ে। তার উপরে গুলির লেভেল উঠছে না।
ওরা করিডোর পার হয়ে সামনে এগোতে চাচ্ছে।
আহমদ মুসা পিলারের ওপর দিকে তাকাল। দেখল, পিলারের প্রায় আট ফিটের মাথায় পিলারের ভেতর থেকে ইস্পাতের একটা বার এক ফিটের মতো বেরিয়ে এসেছে। ইস্পাত বারের প্রান্তটা উপর দিকে বাঁকানো। সম্ভবত ডেকোরেশন পিস অথবা ঝুলন্ত ফুলের বাস্কেট টাঙানোর জন্যেই সবগুলো বা কোন কোন পিলারে এ ধরনের ইস্পাত বার রাখা হয়েছে।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। এটা তার জন্যে এক অমূল্য সাহায্য।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলভারের বাঁট কামড়ে ধরে দু’হাত উপরে তুলে ইস্পাত বারটি ধরার জন্যে বিসমিল্লাহ বলে লাফ দিল।
হাতে পেয়ে গেল ইস্পাত বারটি।
ইস্পাত বারটি দু’হাতে ধরার পর বাম হাতের উপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে ডান হাত মুক্ত করে মুখে কামড়ে ধরে রাখা রিভলভারটি হাতে নিল। গুলি তখনও একই লেভেলে হচ্ছে। তার মানে, আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উপরে উঠেছে এটা তারা টের পায়নি। খুশি হলো আহমদ মুসা। উঁকি মেরে দেখল, ওরা করিডোর থেকে হলে নেমে এসেছে। আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না। ওরা টের পেয়ে গেলে আবার সংকটে পড়বে সে।
ওদের একজন আহমদ মুসার পিলারের উপর দিকে ইংগিত করে কি যেন বলে উঠল। সংগে সংগেই ওদের তিনজনের চোখ এদিকে নিবদ্ধ হলো, আর নড়ে উঠল ওদের স্টেনগান।
সবকিছু বুঝে গেল আহমদ মুসা। প্রস্তুত ছিল সে। তার মেশিন রিভলভারও তৈরি। তার তর্জনী চেপে বসল রিভলভারের ট্রিগারে।
লক্ষ্য একেবারে নাকের ডগায়।
ওরাও দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসার রিভলভার। ওদের বিস্ফারিত চোখে মরিয়াভাব। উঠে আসছিল ওদের তিনটি স্টেনগান।
কিন্তু স্টেনগানগুলো টার্গেট পয়েন্টে উঠে আসার আগেই ওরা আহমদ মুসার মেশিন রিভলভারের গুলি বৃষ্টির শিকার হয়ে গেল। পড়ে গেল হলের মেঝেতে তিনটি লাশ।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল পিলারের ইস্পাত বার থেকে।
নেমেই করিডোরের দিকে ছুটে গিয়ে দেখল, সিনাগগের প্রধান দরজাটি বন্ধ। ওরা দরজা বন্ধ করে দিয়েই ঢুকেছিল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে ছুটল লিফটের দিকে। লিফট দিয়ে নামল ‘গ্রাউন্ড টু’তে। ছুটল সেই খোঁয়াড়ের দিকে। খোঁয়াড়ের দেয়ালে ‘5’ আকৃতিতে সাজানো ফিংগার প্রিন্টের মতো পাঁচটি কালো দাগ তখনই পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। আক্রান্ত হবার ফলে পারেনি। সেটাই এখন দেখতে চায় সে।
আহমদ মুসা খোঁয়াড়ে ঢুকে সেই দেয়ালে ফিংগার প্রিন্টের মতো চিহ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াল।
চিহ্নগুলোর উপর নজর পড়তেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার চোখ। পাঁচটি কালো চিহ্নের সবগুলোই সুস্পষ্ট ফিংগার প্রিন্ট।
আহমদ মুসার কোন সন্দেহ নেই যে, ঐ ফিংগার প্রিন্ট নিহত পাঁচ গোয়েন্দার। তারা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই মৃত্যুর পূর্বে শত্রুকে চিহ্নিত করার জন্যে এই ফিংগার চিহ্ন রেখে গেছে একটা দর্শনীয় পদ্ধতিতে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করল জেনারেল তাহির তারিককে। জেনারেল তাহির তারিক আহমদ মুসার কণ্ঠ শুনতে পেয়েই বলে উঠল, ‘কি খবর খালেদ খাকান! আপনি ভালো আছেন? এইমাত্র গোয়েন্দা সূত্র জানাল, সিনাগগে গোলাগুলি চলছে। ওখানে পুলিশ গেছে। আমিও আসছি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান হাজী জেনারেল মোস্তফা কামালও যাচ্ছেন।’ উদ্বেগ জেনারেল তাহিরের কণ্ঠে।
‘পাঁচ গোয়েন্দা সম্ভবত নিহত হয়েছেন। তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন রেখে গেছেন। আসুন দেখবেন। গোটা সিনাগগ তদন্তও হওয়া প্রয়োজন। আপনারা এলেই আমি বেরুব। আমাকে একটু বেরুতে হবে জরুরি কাজে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই জেনারেল তাহির তারিক বলে উঠল, ‘কিন্তু সিনাগগের কি অবস্থা, কি ঘটেছে, তা তো বললেন না। এত গুলি-গোলা…..।’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখানে আসছি, এ খবর এরা আগেই পেয়ে যায়। তার ফলে আমার গোপন অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ওদের পনের জন মারা গেছে। এই মুহূর্তে সিনাগগে ওদের কোন লোক নেই।’
‘আপনি ওখানে যাচ্ছেন, এ খবর ওরা আগেই পেয়ে যায়?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘হ্যাঁ, পেয়ে যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি তো সুস্থ আছেন?’ প্রশ্ন জেনারেল তারিকের।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। ভালো আছি।’ আহমদ মুসা বলল।

আহমদ মুসা সিনাগগ থেকে বেরিয়ে গেল তার গাড়ির কাছে। গাড়িটা সে পার্ক করে এসেছিল সিনাগগের বাইরে রাস্তার পাশে।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে যেতেই রাস্তার ওপ্রান্তের দিক থেকে একটা গাড়ি এসে আহমদ মুসার কাছে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মিস লতিফা আরবাকান। বলল আহমদ মুসাকে, ‘স্যার, ও গাড়ির কোথাও ওরা বোমা বা কোন বিস্ফোরক রেখে গেছে। ও গাড়িতে এখন উঠবেন না। চলুন ঐ গাড়িতে। ম্যাডাম আছেন।’
বোমা ও বিস্ফোরকের কথা শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চমকে উঠল ম্যাডাম মানে জোসেফাইন এখানে আসার সংবাদে।
‘আপনারা এখানে, এ সময়ে?’ দু’চোখ কপালে তুলে বলল আহমদ মুসা।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই আহমদ মুসা এগোলো গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে পৌঁছতেই গাড়ির পেছন সিটের দরজার কাঁচ নেমে গেল। জানালা দিয়ে শোনা গেল জোসেফাইনের কণ্ঠ, ‘আসসালামু আলাইকুম, আসুন।’
গাড়ির দরজাও খুলে গেল সেই সাথে।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসতেই জোসেফাইন আবার বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, তিনি সুস্থ রেখেছেন তোমাকে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। তোমরা এখানে জোসেফাইন! আমার কাছে তো স্বপ্নের মতো লাগছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমিও ভাবিনি আসব, কিন্তু এসে গেছি। পরে কথা হবে, এবার চলি আমরা।’
বলে জোসেফাইন হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকল তার পারসোনাল সেক্রেটারি মিস লতিফা আরবাকানকে।
লতিফা আরবাকান এসে ড্রাইভিং সিটে উঠছিল।
‘আমিই ড্রাইভ করব। এই রাতে মিস লতিফার ড্রাইভ না করাই ভালো।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার হাত ধরে আটকে ফেলে বলল, ‘মিস লতিফা খুবই এক্সপার্ট ড্রাইভার। উইম্যান কার রেসিং-এ মিস লতিফা ইস্তাম্বুলের চ্যাম্পিয়ন। ওকে, গাড়ি ছাড়ুন মিস লতিফা।’
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা আবারও বলল, ‘জোসেফাইন, তোমরা এই রাতে এই বিপদের মধ্যে এখানে এসেছ! আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘পরে সব বলব। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমার কাছে তোমার দেয়া মেশিন রিভলভার আছে, জেফি জিনার কাছেও রিভলভার ছিল, লতিফা আরবাকানের কাছেও রিভলভার আছে। তুমি জান না, আমাদের মিস লতিফা আরবাকান বয়সে কম হলেও সেনাবাহিনী থেকে জেদ করে রিটায়ারমেন্ট নেয়া একজন ব্রিলিয়ান্ট সেনা অফিসার অর্থাৎ ক্যাপ্টেন। আর টুয়েন্টি ফাইভ এজ গ্রুপে মিস লতিফা সেনাবাহিনীতে পরপর তিনবার র‍্যানডম পিস্তল শুটিং-এ চ্যাম্পিয়ন ছিল। সে দক্ষতা তার আরও বেড়েছে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিস লতিফা আরবাকানকে ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি যে, তুমি তাকে পিএস হিসেবে পেয়েছ। কিন্তু একটা বিষয় তুমি জান না জোসেফাইন, মিস লতিফা আরবাকান সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ারমেন্ট নিলেও তুর্কি সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী মহিলা গোয়েন্দা ইউনিটের একজন বড় অফিসার এখন সে।’
বিস্ময় নামল জোসেফাইনের চোখে-মুখে, তার সাথে আনন্দও।
আর মিস লতিফা আরবাকান চমকে উঠে মুহূর্তের জন্যে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু আমি যতদূর জানি, এই বিষয়টাতো স্যার, আপনার জানার কথা নয়।’
‘আমার জানার কথা নয়, এ কথা ঠিক। আমাকে কেউ জানায়নি। কিন্তু আপনাকে প্রথম দিন দেখেই জেনে ফেলেছি যে, আপনি তুর্কি সেনাবাহিনীর ‘ভি ডব্লিউ সি এস’ ইউনিটের (Voluntary Women Counter-spionage Unit) সদস্য।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু কিভাবে সেটা জানলেন?’ মিস লতিফা আরবাকানের চোখে-মুখে বিস্ময়।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার বাঁ হাতের অনামিকায় একটা গোল্ড রিং আছে। যে গোল্ড রিং-এ ‘VWCS’ অক্ষরগুলো উৎকীর্ণ আছে। আমি জানি, ‘VWCS’-এর সকল সদস্যের বাঁ হাতের অনামিকায় এই রিং থাকে। এটা তাদের প্রাথমিক আইডেন্টিফিকেশন।’
মিস লতিফা আরবাকানের চোখে-মুখে নামল এবার অপার বিস্ময়। বলল, ‘এই ছোট বিষয়টাও আপনার নজর এড়ায়নি স্যার! আপনি অসাধারণ, অনন্য অসাধারণ স্যার আপনি।’
‘আপনিও কম অসাধারণ নন মিস লতিফা। আমি খুব খুশি আপনাকে সাথী পেয়ে।’
বলেই জোসেফাইন প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘সিনাগগে কি ঘটল, এটা কিন্তু আমাদের জানা হয়নি।’
‘সেটা বলব, কিন্তু তার আগে বল, জেফি জিনা কে যার নাম তুমি বললে।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসি ফুটে উঠল জোসেফাইনের মুখে। বলল, ‘ও হো, তোমাকে তো বলা হয়নি। ওটা আমার সেই বান্ধবীর নাম, হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর মাজারে যার সাথে আমার দেখা। তুমি এটা জান।’
‘তাহলে ‘জেফি জিনা’ তার নাম। কিন্তু তিনি তোমার সাথে এই সময়ে এলেন কি করে? এবং তিনি এখন কোথায়?’
‘সে অনেক কথা। এতক্ষণ ছিলেন। পুলিশ সিনাগগে ঢোকার পর উনি চলে গেছেন। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছিলেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘ছাড়লে কেন? এত রাতে উনি কিভাবে গেলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসুবিধা হবে না। উনি নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। তার সাথে তার পিএ মহিলাও রয়েছেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু তিনি তোমার সাথে এলেন, তাকে এই রাতে পেলে কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটাই তো আসল কথা। তার কাছ থেকেই জানতে পারি, তুমি সিনাগগে যাচ্ছ এবং শত্রুরা তোমার যাওয়ার খবর আগাম পেয়ে গেছে। আমি….।’
জোসেফাইনের কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তিনি তোমাকে জানান?’ আহমদ মুসার চোখ ভরা বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, তিনি আমাকে জানান।’
‘উনি কিভাবে জানলেন? ক’টায় তিনি জানান?’
‘উনি রাত দশটা থেকে আমাকে টেলিফোন করছিলেন। আমার মোবাইল বন্ধ ছিল, আমি গিয়েছিলাম তোপকাপি প্রাসাদের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। রাত এগারটা পর্যন্ত আমি ছিলাম সেখানে। উনি আমাকে টেলিফোনে না পেয়ে সোজা আমার বাসায় চলে এসে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি ফিরে এসে তার কাছ থেকে সবকিছু শুনি এবং সংগে সংগেই তোমাকে টেলিফোন করি।’
‘এই খবর দেবার জন্যে তিনি ঐ রাতে তোমার ওখানে এসেছিলেন!’ বলল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়।
‘খুব ভালো বন্ধু তিনি আমার। খবরটা তাকে খুবই উদ্বিগ্ন করেছিল। আমি তার সাথে যখন কথা বলেছি, তখন তাকে দারুণ উদ্বিগ্ন দেখেছি।’ জোসেফাইন বলল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখনও দারুণ বিস্ময়। বলল, ‘কিন্তু তিনি এই গুরুতর খবরটা জানলেন কি করে?’
‘এ বিষয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, সেদিন রাত নয়টায় ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে গিয়েছিলেন তার একজন আমেরিকান অধ্যাপিকা বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। বান্ধবীর কক্ষে যাবার সময় একটা কক্ষের পাশ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। রুমটার একটা দরজা খোলা ছিল। ভেতরে কেউ একজন টেলিফোনে কথা বলছিলেন। কথার মধ্যে তোমার নাম ‘খালেদ খাকান’ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ভেতরের লোকটি টেলিফোনে বলছিল, বুঝলাম। কিন্তু খালেদ খাকান লোকটা আল-আলা সিনাগগে আজ রাতে যাচ্ছে, এটা নিশ্চিত হওয়া গেল কি করে? তার কথা শেষ হওয়ার কিছু পর আবার কণ্ঠ শোনা যায়। তিনি বলেন, কখন যাচ্ছে, কতজন যাচ্ছে- এটা কি জানা গেছে? তার কথা শেষ হওয়ার পর আবার নীরবতা। কিছুপর তার কণ্ঠ শোনা যায় আবার, খবরের জন্যে ধন্যবাদ। দু’বার খালেদ খাকান আমাদের হাত থেকে বেঁচে গেছে, সেদিন খালেদ খাকান আমাদের একজন লোককে হত্যা করেছে, তার আজ শেষ দিন। সিনাগগ থেকে সে জীবন্ত বের হতে পারবে না। তার মৃত্যুদণ্ড আগেই ঘোষিত হয়েছে, আজ তা বাস্তবায়নের রাত। তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। আর কোন কথা হয়নি। এই টেলিফোনের কথা শুনে সে সংগে সংগেই আমাকে টেলিফোন করে। বার বার আমাকে পাওয়ার চেষ্টা করে টেলিফোনে। না পেয়ে সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। বান্ধবীর সাথে কথা বলার প্রোগ্রাম বাতিল করে সে ছুটে আসে আমার বাসায়। প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা অপেক্ষা করে আমাকে পায়। আমি এজন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম। উত্তরে সে কি বলেছিল জান? বলেছিল, আরও দু’ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলেও করতাম।’
থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী আসলেই তোমার সত্যিকার একজন বান্ধবী। তাকে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা দিও। আচ্ছা বল, তুমি তো আমাকে খবর জানালেই, আবার এলে কেন? তিনিই বা এলেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখানেই জেফি জিনার ভূমিকা আছে। সে আমাকে বলে, এই খবর দেয়াই যথেষ্ট নয়, বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত। তার কথার উত্তরে সত্য গোপন করে বললাম, তার কোন ব্যাপারে পুলিশকে জানানোর অনুমতি নেই। তখন সে বলে, এ রকম হতে পারে, তাহলে কিছু একটা করা দরকার। এত বড় খবর পাওয়ার পর ঘরে বসে থাকা সম্ভব কি করে? আমি বলি, আমারও মন এটাই বলছিল। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? সে বলে, আমাদের একটা কাজই করার আছে, সেটা হলো সংকটের জায়গায় আমরা উপস্থিত হতে পারি। আমরা কোন সাহায্যে আসতে পারবো কিনা সেটা আল্লাহই বলতে পারেন। কিন্তু না গেলে আল্লাহ যে কিছু করবেন, তারও সুযোগ থাকে না। তার এ কথার পর আমরা সিনাগগে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’ থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী তো আমার বিস্ময় বাড়িয়েই তুলছে। আশ্চর্য, এমন বান্ধবী এখনো দুনিয়াতে মিলে?’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘তোমার বান্ধবী জেফি জিনা কি ঐ অধ্যাপকের নাম বলেছিলেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করিনি, তিনিও বলেছেন বলে মনে পড়ছে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘নামটা জানতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জানা যাবে। সকালেই জেনে নেব।’ বলল জোসেফাইন।
‘নামটা না জানালেও চলবে জোসেফাইন। রুমটার নাম্বার কিংবা আইডেন্টিফিকেশন পেলেও চলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওটা তো পাওয়া যাবেই।’ বলল জোসেফাইন।
গাড়ি তখন গোল্ডেন হর্নের দ্বিতীয় ব্রীজ অতিক্রম করছিল।
বাইরে দৃষ্টি ছিল জোসেফাইনের। বলল, ‘রাতের গোল্ডেন হর্ন, মর্মর সাগর, বসফরাসের পটভূমিতে ইস্তাম্বুলকে অপরূপ লাগে। সত্যিই ইস্তাম্বুল ভূমধ্যসাগরের তীরে সবুজ জনপদের গলায় বিমুগ্ধকরী সৌন্দর্যের এক মুক্তা।’
আহমদ মুসাও দৃষ্টি ফিরিয়েছিল বাইরে। বলল, ‘আমার মনে কি হয় জানো জোসেফাইন? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবির সর্বশ্রেষ্ঠ এক কবিতা হচ্ছে ইস্তাম্বুল।’
‘ধন্যবাদ। আমিও কি কিছু বলতে পারি?’ বলল মিস লতিফা আরবাকান।
‘বলুন, মিস লতিফা।’ জোসেফাইন বলল।
‘ইস্তাম্বুলের মানুষগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।’
‘বুঝেছি মিস লতিফা, আপনি কি বলতে চান। ইস্তাম্বুলের মতোই ইস্তাম্বুলের ইতিহাসও ইতিহাসের পাতায় বিশেষ করে, মুসলিম ইতিহাসের পাতায় প্রোজ্জ্বল এক মুক্তার মতো। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ এবং সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টরা ইস্তাম্বুলের মুক্তার মতোই মানুষ। ওরা ইস্তাম্বুলের শুধু নয়, শুধু তুরস্কের নয়, গোটা ইসলামী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তান।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা এসে গেছি।’ বলল মিস লতিফা আরবাকান।
মর্মর সাগরের তীরে তোপকাপি প্রাসাদের দ্বিতীয় গেট দিয়ে প্রবেশ করল গাড়ি।

Top