৫
গোল্ডেন হর্নের দক্ষিণ তীরে এর দ্বিতীয় ব্রীজের একটু পশ্চিমে বিশাল জায়গা জুড়ে তুর্কি জনগণের অতি প্রিয় ‘আইউপ’ (আইয়ুব) সুলতান কমপ্লেক্স। বিশাল মসজিদ, প্রশস্ত-সুন্দর কবরগাহ, মুসাফিরদের জন্যে সরাইখানা এবং বৃহৎ একটি মার্কেট নিয়ে এই কমপ্লেক্স।
কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে ‘আইউপ সুলতান মসজিদ’-এর সুউচ্চ মিনার এবং আইউপ সুলতান কবরগাহের গম্বুজ নজরে পড়তেই একটা আবেগ এসে আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল। তুর্কিদের অতি প্রিয় ‘আইউপ সুলতান’ আসলে ইতিহাসের হযরত আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর এক অতি প্রিয় সাহাবা ছিলেন তিনি। তিনি সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি যার বাড়িতে আল্লাহর নবী মদীনায় প্রথম প্রবেশের পর বসবাস করেছেন। এই সৌভাগ্য লাভের জন্যে মদীনার সবাই লালায়িত ছিল। কিন্তু উটে সওয়ার আল্লাহর রাসূল(সাঃ) বলেছিলেন, তার উট নিজ ইচ্ছায় যার বাড়িতে গিয়ে বসে পড়বে, তিনি সে বাড়িরই আতিথ্য গ্রহণ করবেন। আল্লাহর রাসূলের উট স্বেচ্ছায় তার বাড়িতে বসাতে আবু আইয়ুব আনসারী এবং তার পরিবার তাদের হৃদয়ের সব আবেগ উজাড় করে পরম অতিথিকে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল(সাঃ)-এর সাহাবী পরম সৌভাগ্যবান মদীনার সেই আবু আইয়ুব আনসারী আইউব সুলতান নাম নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন ইস্তাম্বুল নগরীর এখানে। তুর্কিরা বলে, যারা দুনিয়ার সুলতান(বাদশাহ), তাদের নামের আগে সুলতান বসে। কিন্তু আবু আইয়ুব আনসারী তাদের হৃদয়ের সুলতান বলে তার নামের পরে তারা ‘সুলতান’ বসিয়েছে।
আহমদ মুসা আহমদ আবদুল্লাহকে কোলে নিয়ে স্ত্রী জোসেফাইনের হাত ধরে এগোচ্ছিল আইউপ সুলতান মসজিদের দিকে।
জোসেফাইনের হাতে একটা চাপ দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হাজারো মসজিদের মিনার শোভিত ইস্তাম্বুলের দৃশ্য চোখে পড়লে, ইস্তাম্বুলে এলে কোন কথা তোমার প্রথম মনে পড়ে বল তো?’
‘এই সেই ইস্তাম্বুল যা একদিন রোমানদের রাজধানী ছিল, যেখানে বসে তারা এশিয়া শাসন করেছে, এই সেই ইস্তাম্বুল যেখানে বসে মুসলমানরা ইউরোপ শাসন করেছে এবং তিন হাজার বছরের এই সেই ইস্তাম্বুল যা এখন মুসলমানদের সাথে আছে, যদিও মুসলমানরা তাদের বহু গৌরবের বহু কিছু হারিয়েছে।’ বলল জোসেফাইন। আবেগজড়িত তার কণ্ঠ।
‘তোমার কি মনে পড়ে, এই কথাই না?’ কথা শেষ করেই আবার প্রশ্ন করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর। আবেগে তা ভারি হয়ে উঠেছে। বলল, ‘না জোসেফাইন, আমি অন্য কথা ভাবি। আমি ভাবি আবু আইয়ুব আনসারীর কথা। ইস্তাম্বুলের সবকিছু ছাপিয়ে তার নামটাই আমি সবার ওপরে জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখি। মুসলিম-ইস্তাম্বুল নগরীর জনক বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ রানা। কিন্তু এ নগরীর প্রকৃত জনক আবু আইয়ুব আনসারীই। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৪৫৪ খৃস্টাব্দে ইস্তাম্বুল জয় করেন। কিন্তু সাড়ে সাতশ’ বছর আগে বিজয়ের বীজ বপন করে যান আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। ইস্তাম্বুল বিজয়ের সাড়ে সাতশ’ বছর আগে তার শেষ ইচ্ছায় এ নগরীতে প্রবেশের প্রধান সড়কের ওপর অন্ধকারে তাকে দাফন করা হয়। তিনি বলেছিলেন, তার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে মুসলিম বাহিনী ইস্তাম্বুল জয় করবে। তার এই ইচ্ছার সাড়ে সাতশ’ বছর পর এটাই হয়েছিল।’
আহমদ মুসার কথা শেষ না হতেই দাঁড়িয়ে গেল ডোনা জোসেফাইন। আহমদ মুসার হাত টেনে ধরল। ডোনা জোসেফাইনের চোখে-মুখে রাজ্যের কৌতুহল। দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসাও।
জোসেফাইন বলল, ‘তুমি যে বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলছ, তাতো আমি জানি না। কোথাও পড়িনি। আমি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)-এর জীবনী পড়েছি। তাতে তিনি যুদ্ধে গিয়ে ইস্তাম্বুলে ইন্তেকাল করেন, এর বেশি কিছু লেখা নেই। বল তুমি। মহান সাহাবীর কাহিনীটা আমি শুনতে চাই, তার পবিত্র কবরগাহের সামনে দাঁড়িয়েই শুনতে চাই।’ থামল জোসেফাইন। তার কণ্ঠ আবেগাপ্লুত।
‘বলছি। বড় কোন কাহিনী নয় জোসেফাইন। সপ্তম শতাব্দীর তখন শেষ। খলিফা মুয়াবিয়া(রাঃ)-এর শাসনকাল। তার ছেলে ইয়াজিদ সেনাপতি। রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল তখন ‘কনস্ট্যান্টিনোপল’। বিজয়ের জন্যে ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী পাঠানো হয়। সে বাহিনীতে শামিল ছিলেন ছিয়াশি বছর বয়স্ক আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। দীর্ঘ এক বছর অবরোধ করে রেখেও ইস্তাম্বুল জয়ে ব্যর্থ হয় মুসলিম বাহিনী। এ সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বৃদ্ধ আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। মৃত্যু আসন্ন হয়ে উঠে তার। শুনে বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ্ ইয়াজিদ ছুটে গেলেন বুজুর্গ সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারীর শয্যাপাশে। পরম শ্রদ্ধাভরে তার কাছে তার শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন। বললেন, বলুন চাচাজান, আপনি কি চান? খলিফার সাথে আলাপ করে ইনশাআল্লাহ তার ব্যবস্থা করব। আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ) বললেন, বলে লাভ কি, যা চাই তা দিতে পারবে না। ইয়াজিদ বুজুর্গ সাহাবীর শেষ ইচ্ছা জানার জন্যে নাছোড়বান্দা। বললেন, বলুন মেহেরবানী করে, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। মুমূর্ষু মুজাহিদ বুজুর্গ সাহাবী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি চাই আমার মৃত্যুর পর আগামীকাল কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রবেশ পথের ওপর আমাকে কবর দিয়ে আসবে। শেষ ইচ্ছা শুনে হতবাক ইয়াজিদ জানতে চাইলেন, তার এই শেষ ইচ্ছার কারণ কি! আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ) জানালেন, কনস্ট্যান্টিনোপলের বিজয় একদিন আসবেই। আমি চাই, সে বিজয়ের দিনে বিজয়ী মুসলিম সৈনিকরা যেন আমার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোমান রাজধানীতে প্রবেশ করে। তার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ রোমক সেনাপতিকে অনুরোধ করে রোমক সৈন্যের ব্যুহের ওপারে ইস্তাম্বুলে প্রবেশকারী সড়কের ওপর তাকে দাফন করেন। এই ঘটনার সাড়ে সাতশ’ বছর পর এই সড়কের ওপর দিয়েই ওসমানীয় খলিফা দ্বিতীয় মুহাম্মদের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল।’ থামল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন আবেগ-উচ্ছ্বসিত চোখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা থামলে জোসেফাইনের চোখ ধীরে ধীরে সরে গেল আইউপ সুলতান মসজিদের ওপর, সেখান থেকে ঘুরে গিয়ে নিবদ্ধ হলো আইউপ সুলতান কবরগাহের ওপর। তারপর দু’চোখ তার আবার ফিরে এসে নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার ওপর। বলল, ‘অপরূপ কাহিনী মহান বুজুর্গ মুজাহিদ সাহাবীকে জীবন্ত করে তুলেছে। যেন দেখতে পাচ্ছি দু’পক্ষের সারি সারি সৈন্য, সেই সড়ক, সেই কবরে মহান মুজাহিদ সাহাবীকেও। তুমি সত্যিই বলেছ, ইস্তাম্বুলের সব দৃশ্য ছাপিয়ে এই দৃশ্যই বড় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, ১৪৫৪ খৃস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করছে সে মহান মুজাহিদের ডাকে, পরিচালনায়। তুর্কিরা ঠিক নাম দিয়েছে তাকে, ‘আইউপ সুলতান’। ইস্তাম্বুলের চিরন্তন সুলতান তিনি!’
আবেগে কাঁপছে জোসেফাইনের কণ্ঠ। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার দু’চোখের দু’কোণ থেকে।
আহমদ মুসা একটা রুমাল জোসেফাইনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক, তিনি ইস্তাম্বুলের চিরন্তন সুলতান। হৃদয়ের সুলতান তো মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। আলহামদুলিল্লাহ্।’
জোসেফাইন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘চল।’
পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল আবার।
‘আইউপ সুলতান’ মসজিদে তারা দু’রাকাত করে নফল নামায পড়ল। কিছু সময় কাটাল তাসবীহ পাঠ ও ধ্যানমগ্নতায়।
জোসেফাইন নামায পড়ছিল মেয়েদের পাশে, আর আহমদ মুসা পুরুষদের এলাকায়।
আহমদ মুসা মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, জোসেফাইন আগেই বেরিয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে।
আহমদ মুসা ওদের কাছে গেল।
আহমদ আবদুল্লাহর হাতে ছোট্ট দামি একটা ইলেক্ট্রনিক খেলনা এবং চাইল্ড গ্রেড দামি একটা চকোলেটের প্যাকেট।
দেখেই আহমদ মুসা বলল, ‘এ সময় এসব এর হাতে কোত্থেকে এল জোসেফাইন?’
জোসেফাইন হাসল। বলল, ‘আমার এক আমেরিকান বান্ধবী এগুলো দিল একে। এই তো এইমাত্র চলে গেল। আমরা একসাথে নামায পড়লাম।’
‘তুমি আসবে জানত সে? কি করে সে উপহারগুলো নিয়ে এল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রায়ই সে এখানে আসে। এই সময়। আমিও এ সময়েই আসি। দেখা হয়। একসাথে নামায পড়ি, মহান বুজুর্গের কবর জিয়ারত করি। জান, আহমদ আবদুল্লাহর জন্যে সে পাগল। সাংঘাতিক ভালোবাসে। আহমদ আবদুল্লাহও তাকে পেলে আমাকে ভুলে যায়।’
‘তোমার বান্ধবী শ্বেতাংগ আমেরিকান, না কোন মাইগ্রেটেড আমেরিকান?’
‘একেবারেই খাস শ্বেতাংগ। কিন্তু শ্বেতাংগ কোন কালচার তার মধ্যে নেই। ইসলাম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান, গভীর আগ্রহ আমার খুব ভালো লাগে। তোমার সাথে আজ তাকে পরিচয় করাতে চাইলাম। তিনি বললেন কি জান? বললেন, ‘অপ্রয়োজনে অন্য কারো স্বামীর সাথে পরিচয় করা ইসলামী কালচার নয়।’ বলেই হেসে আবার বলেছেন, ‘মসজিদে ঢোকার সময় তাকে আমি দেখেছি। আপনারা তখন দাঁড়িয়ে কোন গল্পে ডুবে গিয়েছিলেন।’ আজ তাকে খুব চঞ্চল দেখলাম। আহমদ আবদুল্লাহকে লম্বা একটা চুমু খেয়ে ছুটে চলে গেল।’
‘তোমার বান্ধবী কি করেন? কোথায় থাকেন? কোথায় তার সাথে তোমার পরিচয় হলো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখানে বুজুর্গের এই কমপ্লেক্সেই তার সাথে আমার প্রথম দেখা। থাকেন, বলেছেন, তোপকাপিরই কোন এক সরকারি গেস্ট হাউসে। তোপকাপিতে নাকি অনেক এবং অনেক রকম গেস্ট হাউস আছে। এক মজার ঘটনার মাধ্যমে আমাদের বুজুর্গের মাজারে তার সাথে পরিচয় হয়। আমার সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান গেছে অজু করতে, আমি মোনাজাত করছিলাম। এই সুযোগে আহমদ আবদুল্লাহ মাজারের ওপাশে চলে গেছে। সেখানে বসে মেয়েটি কুরআন শরীফ পড়ছিল। আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে তার কোলে উঠে বসেছে। মেয়েটি একটা আয়াত পর্যন্ত পড়া শেষ করে কুরআন বন্ধ করে রেখে আহমদ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে আমাদের খোঁজে এসেছে। ততক্ষণে আমার মোনাজাত হয়ে গিয়েছিল। লতিফা আরবাকানও এসে গিয়েছিল। আমরা আহমদ আবদুল্লাহকে খুঁজছিলাম। তাকে দেখে আমরাও তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে হাসতে হাসতে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় এর মা? বাচ্চার চেহারায় আপনার এক্সপ্রেশন আছে। নাম কি বাচ্চার?’
‘আহমদ আবদুল্লাহ।’
আমি নাম বলতেই তিনি বললেন, ‘চমৎকার নাম। একটা ছন্দ আছে। কিন্তু আপনার ছেলে তো আমাকে কিছুটা পটিয়ে ফেলেছে। আমি কুরআন শরীফ পড়ছিলাম। সে সোজা গিয়ে আমার কোলে উঠে বসেছে। যেন কত দাবি, কত বছরের চেনা। ‘
আমি হেসে বললাম, ‘মায়ের চেহারার সাথে আপনার চেহারার খুব একটা অমিল নেই। হয়তো মা-ই মনে করে বসেছে।’
‘সে বলল, ‘আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে। বাচ্চারা আমার খুব প্রিয়। দেখুন, সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। উশখুশ করছে আপনার কোলে যাবার জন্যে। কিন্তু ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। আমি আর একটু নিয়ে থাকি।’ বলে বাচ্চার দু’গালে দু’বার চুমু খেল। আবদুল্লাহরও দেখলাম আমার কাছে আসার চেষ্টা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির দিকে সে একবার চেয়ে তার বুকে মুখ গুঁজল। মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেল। তারপর থেকে আহমদ আবদুল্লাহর সাথে তার মহাখাতির হয়ে গেল। সেও প্রায়ই এখানে আসে। খুব ভক্ত মহান বুজুর্গের। তোমার আজকের কাহিনী শুনলে তো সে আরও পাগল হয়ে যাবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘নাম কি তোমার বান্ধবীর? আমেরিকার কোথায় থাকেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
জিভ কেটে মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল ডোনা জোসেফাইন। তারপর হেসে উঠল। বলল, ‘কি উত্তর দেব! সত্যি, নাম জিজ্ঞেস করার কথা মনেই হয়নি। দোষ আমার একার নয়। উনিও আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি। উনি জিজ্ঞেস করলে আমারও মনে হতো। স্যরি।’
হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘অবাক হওয়ার মতো কথা শোনালে! দু’জনের ক্ষেত্রেই একই কাণ্ড ঘটল কি করে?’
‘এর কারণ আমি মনে করি, আমরা এত দ্রুত অন্তরংগ হয়ে উঠি যে, নাম জিজ্ঞেস করার পর্যায় কখন যেন পেছেনে পড়ে যায়। আমাদের যখন দেখা হতো, যতক্ষণ আমরা একসঙ্গে থাকতাম, সবটা সময় আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকতাম। নিরিবিলি অন্তরংগ কোন আলোচনা হয়নি।’ বলল জোসেফাইন।
‘এমনটাই ঘটেছে জোসেফাইন। কিন্তু এটা মনে থাকার মতো ঘটনা। আজ নাম জানার একটা সুযোগ চলে গেল। আমার সাথে দেখা হলে, নামের প্রশ্ন হয়তো উঠতো। যাক, চল আমরা সামনে এগোই।’
‘চল। একদিন দেখা হলে নিশ্চয় আমি প্রথমেই তার নাম জেনে নেব।’ বলল জোসেফাইন।
তারা হাঁটতে লাগল আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)-এর কবরগাহের দিকে।
বেলা বারটা।
আহমদ মুসা অফিস থেকে বেরুল। উদ্দেশ্য, আল-আলা পাহাড়ের সিনাগগ দিনের বেলায় একটু ভালো করে দেখা।
অফিস থেকে বেরুতেই দেখল, ডঃ শেখ বাজ অফিসে আসছে। দেখা হতেই বলল, ‘স্যার, এ সময়ে যে বেরুলেন?’
আহমদ মুসা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, আশে-পাশে কেউ নেই। সিকিউরিটির লোকটি বেশ একটু দূরে। বলল আহমদ মুসা, ‘আমি আল-আলা পাহাড়ের দিকে একটু যাচ্ছি। ডাঃ ইয়াসারদের সাথেও দেখা করতে পারি। আচ্ছা ডঃ শেখ বাজ, আপনি আল-আলা পাহাড়ের সিনাগগ সম্পর্কে কিছু জানেন? ওদের কেউ এখানে আসে কি? কিংবা ওদের কারো সাথে আমাদের কারো জানাশোনা আছে কিনা?’
‘আমি কিছু জানি না, তবে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানী যিনি মারা গেলেন, তার কাছ থেকে শুনেছি, তিনি এবং ঐ সিনাগগের যিনি প্রধান রাব্বি, ডেভিড ইয়াহুদ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পিএইচডি করেছেন। পিএইচডি’র পর ডেভিড ইয়াহুদ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি পেয়েছিলেন। আর তিনি দেশে ফেরার পর চাকরি নিয়ে চলে আসেন ইস্তাম্বুলে আমাদের এই ইনস্টিটিউটে। সম্প্রতি ডেভিড ইয়াহুদ ঐ সিনাগগে প্রধান রাব্বির দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
শুনে চোখ কপালে তুলল আহমদ মুসা। ‘বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ অধ্যাপক সিনাগগের রাব্বি হয়েছেন?’ অনেকটা স্বগতঃ কণ্ঠে আহমদ মুসা উচ্চারণ করল কথাটি। এই সাথে তার মনে জাগল অনেক কথা। ডেভিড ইয়াহুদ কি আমাদের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তার একটা সফল সৃষ্টি উড়ন্ত সকল ধরনের অস্ত্র-বিনাশী ‘সোর্ড’-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মিশন নিয়েই এখানে এসেছেন? তিনিই কি মূল ব্যক্তি? মনে হয় না। বরং তাকে ব্যবহারের জন্যে আনা হয়েছে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীর সহপাঠী বলেই ডেভিড ইয়াহুদকে এখানে আনা হয়ে থাকতে পারে যাতে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ও গবেষণাগারে প্রবেশ করার সুযোগ তাদের হয়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীও তাদের হাতের পুতুল হতে চায়নি বলেই কি তাকে মরতে হয়েছে! এখন তাদের পরিকল্পনা কি? কোন পথে এগোচ্ছে তারা? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন, নানা কথা আহমদ মুসাকে অস্থির করে তুলেছিল। সে আনমনা হয়ে পড়েছিল কিছুটা।
ডঃ শেখ বাজই আবার কথা বলল, ‘স্যার কিছু ভাবছেন?’
আহমদ মুসা সম্বিত ফিরে পেল। বলল, ‘না ডঃ বাজ, তেমন কিছু না। আপনাকে ধন্যবাদ ডঃ বাজ একটা ভালো খবর দেয়ার জন্যে। এই তথ্যটা কি জেনারেল তাহির তারিককে জানিয়েছিলেন?’
‘না স্যার। আমার মনে পড়েনি। আপনি প্রশ্ন করার পর মনে পড়েছে আমার। আর একে আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে মনে করিনি।’ বলল ডঃ বাজ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখুন, আমাকে স্যার স্যার বলবেন না। আমরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে বোধহয় সহপাঠী হতাম। ভাই বলতে পারেন।’
‘না স্যার, অফিসে এটা হয় না। বাইরে অবশ্যই ভাই বলব। কিন্তু অফিস চলবে অফিসের নিয়মে।’ বলল ডঃ বাজ।
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিক আছে। ‘ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট’-এর উপযুক্ত কথাই আপনি বলেছেন। ধন্যবাদ। আপনি অফিসে যান, আমি আসছি।’
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল।
‘জেনারেল তাহির তারিক স্যার আসবেন বলেছেন। উনি যোগাযোগ করলে কি বলব?’ জিজ্ঞাসা ডঃ বাজের।
‘বলবেন, আমি ডাঃ ইয়াসারদের ওদিকে গেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইয়েস স্যার’ বলে ডঃ বাজও যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
ডঃ ডেভিড ইয়াহুদ সম্পর্কে জেনে খুব খুশি হলো আহমদ মুসা। ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীসহ সব মৃত্যু, সব নিখোঁজের কেন্দ্র এই সিনাগগ এবং হতে পারে ঐ ডঃ ডেভিড ইয়াহুদ, এই বিশ্বাস দৃঢ় হলো আহমদ মুসার। দিনের বেলা সিনাগগকে একটু ভালো করে দেখা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে ডাঃ ইয়াসারদের কাছ থেকে আরও কিছু জানাও যেতে পারে।
গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা। গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা আল-আলা পাহাড়ে পৌঁছে গাড়ি ড্রাইভ করে সিনাগগের রাস্তার সামনে পৌঁছল।
সিনাগগটি চারদিক দিয়ে দেয়াল ঘেরা। প্রাচীরের পাশ দিয়ে পাথর বিছানো প্রাইভেট রাস্তা। এগুলো আশপাশের বাড়িতে যাবার পথ। আহমদ মুসা গাড়িতে করে পাথর বিছানো পথে বাড়ির চারদিকটা ঘুরে আসতে চাইল। কিন্তু পারল না। সিনাগগের পেছনটায় খাড়া একটা খাদ। কতটা গভীর বোঝা গেল না। ছোট-বড় নানা রকম গাছ-গাছড়ায় ভর্তি। আহমদ মুসা ফিরে এল বাড়ির সামনের বড় রাস্তায়। মোটামুটি বাড়ির বাইরেটা দেখা হয়ে গেছে তার।
গাড়িতে উঠল। গাড়ি স্টার্ট দিল। কয়েক গজ সামনেই রাস্তার ডান পাশে ডাঃ ইয়াসারদের বাড়ি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা মনে করল, আজ ডাক্তারদের বাড়ি না-ই বা গেলাম।
বিপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি আসছিল এদিকে। ডাঃ ইয়াসারের বাড়ির সামনে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে গেল দুই গাড়ি।
পাশ কাটাবার জন্যে আহমদ মুসা গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু সামনের গাড়িটা থেমে গেল। গাড়িটা থামতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ডাঃ ইয়াসার এবং ডাঃ রাসাত।
ওদের দেখে আহমদ মুসাও গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।
‘কি ব্যাপার মিঃ খালেদ, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন! গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। আগে আপনি ঢুকুন আমাদের গেট দিয়ে, পেছনে আমরা। পালাবার পথ নেই।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে চাইল।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে ডাঃ ইয়াসার বলে উঠল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। যেতে আপনি পারছেন না। অতএব, সময়ক্ষেপণে কোন লাভ নেই জনাব। আসুন।’
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
সাবাতিনিও বাড়িতে। সে বেরিয়ে এসেছে।
গাড়ি বারান্দায় নেমে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আহমদ মুসার গাড়ি থামলে তার গাড়ির দরজা খুলে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আসুন স্যার।’ আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।
‘আমাদের গেটেই এভাবে ধরা পড়ে যাবেন, এমনটা ভাবতেই পারেননি স্যার, তাই না মাম্মি, ড্যাডি?’ হাসতে হাসতে বলল সাবাতিনি।
‘ঠিক আছে, স্যারকে কি খাওয়াবে দেখ। আমরা সকলেই তোমার গেস্ট আজ।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘থ্যাঙ্কস ড্যাডি। মাম্মির রান্না করা খাবার দিয়ে হোস্ট হওয়া কঠিন নয়। ওয়েলকাম সকলকে। আসুন।’ বলল সাবাতিনি হাসতে হাসতে। সবাই বসল গিয়ে ড্রইংরুমে।
সাবাতিনি ভেতরে গিয়েছিল। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘ড্যাডি, মিঃ ইরগুন ইবান আসছেন। স্যারের সাথে নাকি তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন!’ সাবাতিনির অস্বস্তি ও অসন্তুষ্টির ভাব।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল ডাঃ ইয়াসারের দিকে। সাবাতিনির কথা শোনার সাথে সাথে ডাঃ ইয়াসারের মুখের আলো যেন হঠাৎ দপ করে নিভে গিয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিল। তবে সাবাতিনির কথার উত্তরে কথা বলতে তার দেরি হলো। একটু সময় নিয়ে সে বলল, ‘তুমি তাকে কি বলেছিলে যে মিঃ খালেদ খাকান এসেছেন, না তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন?’ ডাঃ ইয়াসারের কণ্ঠে কতকটা বিব্রত হওয়ার আমেজ।
‘না ড্যাডি, আমি কিছু বলিনি। উনিও জিজ্ঞেস করেননি। মনে হলো উনি জানতেন। কারণ সোজাসুজি তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি আসছেন।’ বলল সাবাতিনি।
পরিস্থিতি একটু বেসুরো হয়ে উঠেছিল। এটা কাটিয়ে উঠতেই এগিয়ে এলো ডাঃ রাসাত। বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, মিঃ ইরগুন ইবান আমাদের প্রতিবেশী। এখানকার সিনাগগের একজন সদস্য। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মুষ্টিযোদ্ধা। আমার মনে হয়, তার সাথে পরিচিত হয়ে আপনিও খুশি হবেন।’
‘আমারও তাই মনে হয় রাসাত। একজন মেহমান পেয়েছিলাম, দু’জন হয়ে গেল। এটা আমাদের সৌভাগ্যই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আকস্মিকতা ভাগ্যের কাজ। মানুষের হাত এর ওপর নেই। আমার আসার কথা ছিল না এখানে। কিন্তু এসে গেছি। ইরগুনও সেভাবেই আসছেন। তাকে ওয়েলকাম।’
ইরগুন ইবানকে মুখে ওয়েলকাম জানালেও আহমদ মুসার মনে নানা চিন্তার ভিড়। তার বুঝতে বাকি নেই ইরগুন ইবান কে। সে শত্রুপক্ষের একজন, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ডেভিড ইয়াহুদের তরফ থেকেই সে আসছে, যারা সেদিন তাকে আক্রমণ করেছিল ইরগুন ইবান তাদের গ্রুপেরই একজন, এ ব্যাপারেও সে নিশ্চিত। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছে না সে আসছে কেন? তাকে নিছক দেখার জন্যে সে অবশ্যই আসছে না। তাহলে কি জন্যে আসছে? এই শত্রুপক্ষ সম্পর্কে আহমদ মুসারা জেনেছে, তাতে পরিষ্কার এরা আক্রমণের নানা পন্থা ব্যবহার করে। তারা এখানে লোক পাঠাচ্ছে কোন কৌশল সাথে নিয়ে!
বৈঠকখানার দরজায় নক হলো। আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ নামল। সাবাতিনি ভেতরে চলে গিয়েছিল। সে ছুটে এসে দরজা খুলে দিল।
দরজায় একজন লোক দাঁড়িয়ে।
খোলা দরজায় সাবাতিনির মুখোমুখি হতেই লোকটি বলল, ‘আমি ইরগুন ইবান, টেলিফোন করেছিলাম।’
স্বাগত জানানোর মতো কোন কথা না বলে সাবাতিনি দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন ভেতরে, সবাই আছে।’
ইরগুন ইবান ভেতরে প্রবেশ করল।
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাল। ডাঃ রাসাত বলল, ‘আমরা খুশি হয়েছি মিঃ ইবান আপনি আসায়।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ডাঃ রাসাতের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা ইরগুন ইবানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি খালেদ খাকান।’
ইরগুন ইবান হ্যান্ডশেকের জন্যে আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘খুশি হলাম খালেদ খাকান, আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে।’
বলে মুখ ঘুরিয়ে ডাঃ রাসাতের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি অবশ্য না ডাকতেই এসে পড়েছি।’
‘আপনি প্রতিবেশী। আপনি যে কোন সময় আসতে পারেন। দাওয়াত বা অনুমতির প্রশ্ন এখানে নেই।’ বলল ডাঃ রাসাত।
ইরগুন ইবান হাত টেনে নিয়েছে আহমদ মুসার হাত থেকে। কিন্তু তার আগেই ইরগুন ইবানের ডান হাতের তর্জনীর একটা অস্বাভাবিক সাইজের আংটি আহমদ মুসার নজরে পড়েছে। আংটির পাথরটা পিরামিড আকৃতির। তবে পিরামিডের ওপরের শীর্ষটা সরু নয়, ফ্ল্যাট। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, পাথরের নিচের মেটালিক বেজটা। যেটার ওপর-নিচের প্রশস্ততা কিছুটা অস্বাভাবিক। কিছুটা অস্বাভাবিক এই আংটিটা চোখে পড়তেই তার মনে হলো, এই ধরনের আংটি এর আগে কোথায় যেন সে দেখেছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, ফিলিপাইনে এক মেয়ের পাল্লায় সে পড়েছিল। মেয়েটা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গোয়েন্দা কর্মী ছিল। সে এই ধরনের আংটির পয়জন ও পিন দিয়ে আহমদ মুসাকে হত্যা করতে গিয়েছিল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। এই আংটি যদি সেই আংটির মতো কিছু হয়ে থাকে, তাহলে ইরগুন ইবান তাকে হত্যার জন্যেই এখানে এসেছে।
‘আমি মিঃ খালেদ খাকানের পাশেই বসি। গল্প বেশি জমবে।’ বলে মিঃ ইরগুন ইবান আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসার দু’পাশের দু’টি সোফা ফাঁকা ছিল। সে এসে আহমদ মুসার বাম পাশের সোফাটায় বসল।
আহমদ মুসার বাঁ হাত ও দেহের বাম পাশটা ইরগুন ইবানের ডান হাতের আওতায় চলে এল। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা।
গল্প জমে উঠল। ইরগুন ইবান হাত নেড়ে কথা বলছে।
আহমদ মুসার বাম হাত সোফার হাতলে।
মাঝে মাঝে কথা বলার সময় ইরগুন ইবানের চলন্ত হাত আহমদ মুসার বাম হাতের আশপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আহমদ মুসা গল্পের মধ্যে থাকলেও ইরগুন ইবানের হাতটাকে সে ফলো করছে।
কথার মাঝখানে ইরগুন ইবান অকাল্ট সায়েন্স বা হস্তরেখা বিজ্ঞান নিয়ে কথা তুলল এবং সে বলল, জার্মানিতে এই সাবজেক্টের ওপর লেখাপড়া করেছে।
খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।
ডাঃ ইয়াসার প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। তারপর ডাঃ রাসাতের হাত দেখল সে।
হস্তরেখা বিজ্ঞান সম্পর্কে সে কতটা জানে সেটা ভিন্ন কথা, তবে হস্তরেখা সম্পর্কে তার জ্ঞান কিছুটা যে আছে তা বোঝা গেল। বিজ্ঞ হস্তরেখাবিদের মতো কথা বলে ডাঃ ইয়াসার এবং ডাঃ রাসাত দু’জনকেই চমৎকৃত করে ফেলেছে।
চমৎকৃত ডাঃ ইয়াসার বলল, ‘আপনি মুষ্টিযুদ্ধ চর্চা করেছেন, কিন্তু এ চর্চা করতে গেলেন কেন?’
‘মুষ্টিযুদ্ধ শক্তি ও কৌশল নির্ভর হলেও ভাগ্যেরও একটা দিক আছে। প্রতিপক্ষের হস্তরেখা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তার শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানা যেতে পারে। বিজয়ের জন্যে এর গুরুত্ব আছে।’
বলে ইরগুন ইবান ফিরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘এবার মিঃ খালেদ খাকান, আপনার পালা। দেখি আপনার হাত।’
আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কারও ভবিষ্যৎ বাণীর ওপর আমি বিশ্বাস করি না। অকাল্ট সায়েন্সও এক ধরনের ভবিষ্যৎ বাণী। তবে হাতটা আপনাকে দেখতে দিচ্ছি এ কারণে যে, আপনাকে আমার হাত দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।’
ইরগুন ইবান একবার মুখে হাসি টেনে ঠাণ্ডা চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসার হাত দেখার প্রতি মনোযোগ দিল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, ইরগুন ইবানের তর্জনীর সেই আংটিটি উল্টে গেছে। এ পর্যন্ত আংটির পাথর দিকটা ছিল আঙুলের পিঠে, সেটা এখন চলে গেছে আঙুলের বিপরীত পাশে।
সাবাতিনি ড্রইংয়ের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খাবার টেবিলে সব রেডি ড্যাডি, মাম্মি।’
বলার পরেই হাত দেখার প্রতি তার নজর পড়ল। বলল, ‘বাহ, এখনো হাত দেখ চলছে নাকি!’
বলে সে এগিয়ে এসে মায়ের পাশে সোফায় বসল।
হঠাৎ আহমদ মুসার হাত থেকে মুখ তুলল ইরগুন ইবান। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল উদ্বেগ ও আতংকের সুরে, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনার হাত বলছে আপনি মারা যাচ্ছেন, সেটা এখনি।’
বলেই ইরগুন ইবান আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা উঠে ডান হাত দিয়ে আহমদ মুসার বাম বাহু চেপে ধরল এবং বাম হাত দিয়ে আহমদ মুসার ডান হাত ধরতে গেল, যেন সে আহমদ মুসাকে সাহায্য করতে যাচ্ছে, তাকে বাঁচাতে চাচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে।
কিন্তু ইরগুন ইবানের বাম হাত আহমদ মুসার ডান হাত পর্যন্ত পৌঁছার আগেই আহমদ মুসার ডান হাতের একটা প্রচন্ড ঘুষি আধা-আধি উঠে দাঁড়ানো ইরগুন ইবানের বাম কানের পেছনটায় আঘাত হানল।
ইরগুন ইবানের ডান হাত খসে গেছে আহমদ মুসার বাম বাহু থেকে। তার দেহটা টলে উঠে পড়ে গেল মেঝেতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মেঝেতে পড়ে গিয়েই ইরগুন ইবান কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে সেন্সটাকে সক্রিয় করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে পকেট থেকে রিভলভার বের করেছে। রিভলভার ইরগুন ইবানের দিকে তাক করে বলল, ‘একটু নড়া-চড়া করলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। বলেছিলেন না যে, আমি মারা যাচ্ছি। উল্টো হয়ে গেল ব্যাপারটা।’
বলে আহমদ মুসা ডাঃ ইয়াসারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ডাক্তার ইয়াসার, আপনি ইরগুন ইবানের ডান হাতের তর্জনী থেকে আংটি খুলে নিন।’
ডাঃ ইয়াসার, ডাঃ রাসাত ও সাবাতিনি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে গেছে। পাথরের মতো বসে আছে তারা।
আহমদ মুসা ডাঃ ইয়াসারকে আহবান জানালে নড়ে উঠল সে। তাকাল সে একবার ডাঃ রাসাতের দিকে, আর একবার আহমদ মুসার দিকে। কি করবে, কি করবে না বুঝতে পারছে না সে।
ওদিকে প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠার পর ইরগুন ইবানের চেহারায় একটা মরিয়াভাব ফুটে উঠল। কঠোর কণ্ঠে বলল সে, ‘তোমাকে তোমার আচরণের জন্যে চরম মূল্য দিতে হবে খালেদ খাকান।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমরা কি করতে বাকি রেখেছ? সেদিন আল-আলা পার্কে তোমরা আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিলে, আজ তোমার আংটির বিষাক্ত পিন আমার শরীরে ঢুকিয়ে আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিলে। কি আর মূল্য দিতে হবে আমাকে! দু’বার আমাকে মারার চেষ্টা, আবারও চেষ্টা করবে, এই তো? আমি তার জন্যে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তোমাকে এখন আমাকে হত্যা চেষ্টার অপরাধে ধরে থানায় দেব।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা না তাকিয়েই ডাঃ ইয়াসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ডাক্তার ইয়াসার, আপনি দয়া করে এর ডান হাতের তর্জনী থেকে আংটিটা পাথরে চাপ না পড়ে এমন সাবধানে খুলে নিন। আর ডাঃ রাসাত, আপনি আপনার বাগান থেকে কোন গাছের একটা বড় পাতা নিয়ে আসুন।’
এমনিতেই বিস্ময়-বিমূঢ় ডাক্তার পরিবার, ইরগুন ইবান তারপর খালেদ খাকানের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল। একটা বিষয় তারা পরিষ্কার বুঝল, ইরগুন ইবানরাই সেদিন খালেদ খাকানকে মারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আজ কিভাবে ইরগুন ইবান আহমদ মুসাকে মারার চেষ্টা করেছিল, সেটা তারা বুঝল না। আংটির বিষাক্ত পিনের রহস্য তাদের কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি।
তবু খালেদ খাকানের আহবানে ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই উঠে দাঁড়াল। ডাঃ ইয়াসার উদ্বেগ ও বিব্রতকর চেহারায় এগোলো ইরগুন ইবানের দিকে। আর ডাঃ রাসাত গাড়ি বারান্দার ওপাশের টব থেকে একটা বড় পাতা আনার জন্যে বেরিয়ে গেল।
আংটি খুলে নেয়ার জন্যে ডাঃ ইয়াসার কাছাকাছি হতেই ইরগুন ইবান তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তর্জনীর আংটির পাথরের উপর চাপ দিতে গেল।
ব্যাপারটা চোখ এড়াল না আহমদ মুসার। সংগে সংগেই আহমদ মুসার পিস্তল গর্জন করে উঠল। বুলেট গিয়ে বিদ্ধ হলো হাতের কব্জির কিছু ওপরে।
চিৎকার করে উঠল ইরগুন ইবান। তার তর্জনী আংটির পাথর স্পর্শ করেই সরে এল আকস্মিক আঘাতে।
গুলি করেই আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি যেভাবে আছ সেভাবে থাক, যে হাত যেখানে আছে, সেভাবেই থাকবে। তুমি মরতে চেষ্টা করেছিলে, মরতে তোমাকে দেয়া হবে না।’
গুলির শব্দে চমকে উঠে ডাঃ ইয়াসার পিছিয়ে গিয়েছিল। সাবাতিনিও চমকে উঠে কাঁপতে শুরু করেছে। ডাঃ রাসাত ছুটে এসে ঘরে ঢুকেছে। তার হাতে একটা বড় পাতা এবং চোখে আতংক। ঘরে ঢুকে ইরগুনের রক্তাক্ত হাতের দিকে চোখ পড়তেই ভীষণভাবে আঁৎকে উঠল সে।
‘স্যরি আমি, এসব ঘটনার জন্যে’, বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘আসলে তার হাতে ঐ সময় গুলি করা ছাড়া তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাবার আর কোন পথ ছিল না। আমি সব বলছি ডাঃ ইয়াসার, আপনি আগে তার হাতের আংটি খুলে নিন।’
এবার ডাঃ ইয়াসার এগিয়ে গিয়ে ইরগুন ইবানের আহত হাতের তর্জনী থেকে সাবধানে আংটি খুলে নিল।
‘এবার ডাক্তার ইয়াসার, আপনি ডাঃ রাসাতের হাতের পাতাটার বোঁটার মূল শিরায় আংটির পাথরের শীর্ষ অংশ চেপে ধরুন মাত্র সেকেন্ডের জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আচ্ছা’ বলে ডাঃ ইয়াসার এগোলো ডাঃ রাসাতের হাতের পাতার দিকে। ডাক্তার পরিবারের সবাই চোখ ভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে পাতার দিকে। ডাক্তার দম্পতি এখন বুঝতে পারছে, পাতায় বিষক্রিয়া দেখতে চায় খালেদ খাকান।
তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল, মাত্র তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যে বিরাট তরতাজা পাতাটি কালো রং ধারণ করে একদম চুপসে গেল। এ যে অত্যন্ত তীব্র ও ভয়ংকর বিষের ফল!
তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের দৃষ্টিতে ভয়, উদ্বেগ ও বিমূঢ় ভাব।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমার হাত দেখার নাম করে আগাম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে ডান হাত দিয়ে সে আমার বাহু চেপে ধরেছিল ঐ বিষ আমার দেহে ঢুকিয়ে আমাকে হত্যার জন্যে। আমি মরে গেলে আপনার ধরে নিতেন আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং তাকে বাহবা দিতেন মৃত্যুর আগাম খবর নিখুঁতভাবে বলার জন্যে।’
মৃত্যুর পাণ্ডুরতা ডাক্তার দম্পতির চেহারায়।
আর অপার বিস্ময় নেমেছে সাবাতিনির চোখে-মুখে। সে কম্পিত গলায় বলল, ‘আপনি কি করে বুঝলেন যে, আংটির পাথরে ঐভাবে বিষাক্ত পিন লুকানো আছে এবং পাথরটি দেহে চেপে ধরলে বিষাক্ত পিনটি দেহে আঘাত করবে?’
‘আমরা এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি, এমন বিস্ময়কর সব দৃশ্য চোখে দেখব কোনদিন ভাবিনি। কিন্তু সাবাতিনির প্রশ্ন আমাদেরও।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘ওর সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় তার তর্জনীর আংটির আকার দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। দেখুন, আংটির মেটালিক বেজটা অন্যান্য আংটির চেয়ে দ্বিগুণ প্রশস্ত। আরেকটা বিষয় দেখুন, মেটালিক বেজটা আংটির পাথরকে চেপে ধরে নেই বরং দৃশ্যমানভাবেই আলগা। এ দু’টি কারণে আমি সন্দেহ করি যে, আংটিটি একটা মারণাস্ত্র। আংটির পাথর স্প্রিং-এর ওপর বসানো আছে, আর স্প্রিং থেকে একটা বিষাক্ত পিন সেট করা পাথরের ভেতর দিয়ে। চাপে পাথরটি বসে গেলেই পাথর থেকে পিনটি বেরিয়ে আসবে এবং চাপ দেয়া বস্তুকে আঘাত করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
অপার বিস্ময় ডাক্তার পরিবারের সকলের চোখে-মুখে। ডাঃ রাসাতই আবার বলে উঠল, ‘আমরাও আংটিটি দেখেছি, কিন্তু সন্দেহ হয়নি। আংটির কোন অস্বাভাবিকতা আমাদের নজরে পড়েনি। এর অর্থ আমরা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ওটা দেখিনি। কিন্তু আপনি দেখেছেন। কেন?’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। অন্যসব চেপে গিয়ে সাদামাটা ব্যাখ্যা হিসেবে বলল, ‘গায়ে পড়ে দাওয়াত নেয়া, বিনা কারণে আমার সাথে পরিচিত হবার তার আগ্রহে তার প্রতি আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাছাড়া সেদিন আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর আমি সতর্ক ছিলাম যে, সেদিন ব্যর্থ হলেও তারা অন্য কোন কৌশলে আমার ওপর আবার আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করবে। এই কারণে লোকটার ওপরে সন্দেহ হওয়ায় আমি তার সবকিছুই অনুসন্ধিৎসার দৃষ্টিতে দেখেছি….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই চিৎকার করে উঠল সাবাতিনি, ‘স্যার, মিঃ ইবান তার গলার ক্রস কামড়ে ধরে দেখুন পড়ে যাচ্ছে।’
আহমদ মুসা কয়েক মুহূর্তের জন্যে ইরগুন ইবানের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়েছিল ডাক্তার দম্পতির দিকে। এরই সুযোগ ইরগুন ইবান গ্রহণ করেছে।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে দ্রুত ইরগুন ইবানের দিকে এগোলো। মুখ থেকে চেন ধরে টেনে বের করল যিশুর মূর্তি সম্বলিত ক্রসটি।
কিন্তু ইরগুন ইবানের দেহ ততক্ষণে নেতিয়ে পড়ে গেছে মেঝের ওপর। নাড়ি, চোখ পরীক্ষা করে দেখল, সে আর ইহজগতে নেই।
হতাশভাবে আহমদ মুসা ফিরল ডাক্তার দম্পতির দিকে। বলল, ‘ধরা পড়ার চেয়ে সে মৃত্যুকেই পছন্দ করেছে। আমি জীবিত রাখতে চেয়েছিলাম, পারলাম না।’
বলে আহমদ মুসা পাশের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। ভেতর থেকে মন তার চিৎকার করে উঠল, অদৃশ্য শত্রুদের খুব ভেতরের একজনকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতে রাখা গেল না। ওদের পরিচয় জানার জন্যে খুব দরকার ছিল একে।
ভেতরের এই অস্বস্তিকে চাপা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।’
‘এতো অস্বাভাবিক মৃত্যু, এখন কি করা যাবে? পুলিশ তো ঝামেলা করবে।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আমার সত্যি এখন ভয় করছে।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘আমি এসে সত্যি আপনাদের মহা ঝামেলায় ফেললাম। কিন্তু পুলিশের ভয় আপনাদের করতে হবে না।’
‘স্যরি, ঝামেলার কথা বলছি না। তাছাড়া আমরাই তো আপনাকে ডেকেছিলাম। আমরা বলছি, এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর না দিয়ে মোবাইল বের করে কোথাও টেলিফোন করল।
ওপারের সংযোগ পেয়ে গেলে সে সালাম দিয়ে বলে উঠল, ‘মিঃ তাহির তারিক, আমি আল-আলা পাহাড়ে ডাঃ ইয়াসার দম্পতির বাসায়। দাওয়াত ছিল। বাইরের একজন লোক এসেছিল। সব পরে বলব। আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। লোকটি ধরা পড়ার পর আত্মহত্যা করেছে। এখন একে সরিয়ে ফেলা দরকার, তার ব্যাপারে অনুসন্ধানও হওয়া উচিত।’
ওপারের কথা শুনে মোবাইল অফ করে ডাঃ ইয়াসারদের লক্ষ্য করে বলল, ‘এখনি পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যাবে। আমি বাদী হয়ে কেস করবো। আপনাদের কোন ঝামেলা হবে না। কালকে পত্রিকায় একটা নিউজ প্রকাশ হবে যে, আপনার বাড়িতে দাওয়াতে আমি এসেছিলাম, সেও উপস্থিত দাওয়াতে হাজির হয়েছিল। সে আমাকে হত্যার জন্যে আক্রমণ করে। এখন ইরগুন ইবানের ব্যাপারে পুলিশী তদন্ত চলছে।’
‘ধন্যবাদ। ইরগুন ইবানের লোকরা ঝামেলা করে কিনা, সেটা একটা ভাবনার বিষয়।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘তারা আপনাদের ঝামেলায় ফেলবে না, বরং তারা চেষ্টা করবে ইরগুন ইবানের কোন পরিচয় পুলিশকে যেন না বলেন। আপনারা ওদের জানিয়ে দেবেন, পুলিশকে ইরগুন ইবানের পরিচয় আপনারা দেননি। পুলিশকে বলবেন, সে আপনাদের একজন প্যাশেন্ট। কিন্তু যে ঠিকানায় সে প্যাশেন্ট হয়েছে, পুলিশ অনুসন্ধান করে সেটাকে ভুয়া পাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই। বলল, ‘ধন্যবাদ, মনে হচ্ছে সমাধান আমরা পেয়ে গেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশের একটা গাড়ি এসে পৌঁছল। গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাকধারী চার-পাঁচ জন পুলিশ।
গাড়ির শব্দ শুনেই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত।
গাড়ি থেকেই পুলিশদের একজন জিজ্ঞেস করল ডাঃ ইয়াসারকে লক্ষ্য করেই, ‘আপনি নিশ্চয় ডাঃ ইয়াসার। আমাদের ঘরটায় নিয়ে চলুন।’
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত পুলিশদের নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।
দু’জন পুলিশ পেছনে পেছনে একটা স্ট্রেচার নিয়ে প্রবেশ করেছিল।
পুলিশদের একজন একটা সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করল। অবস্থার কয়েকটা ফটোও তুলল পুলিশরা। তারপর একজন নির্দেশ দিল লাশটা গাড়িতে নিতে।
দু’জন পুলিশ স্ট্রেচারে করে লাশ নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের সাথে বেরিয়ে গেল আরও দু’জন। অবশিষ্ট একজন বেরিয়ে যাবার আগে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি বাসায় ফিরলে কাউকে আমাদের রিং দিতে বলবেন। আমরা স্টেটমেন্টটায় স্বাক্ষর করিয়ে আনব।’
বলে বেরিয়ে গেল পুলিশ অফিসারটি।
পুলিশ অফিসারটি বেরিয়ে যেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ডাঃ ইয়াসার, ডাঃ রাসাত, যা ঘটেছিল এখন আপনারা সব ভুলে যান। কোন পক্ষ কোন অসুবিধা করলে আমাকে জানাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘স্যার, কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলতে চাই।’ বলল সাবাতিনি।
‘কিছু মনে করার প্রশ্ন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাংঘাতিক যা ঘটে গেল, অবস্থার ওলট-পালট যেভাবে হলো, আমি বলতে সাহস পাচ্ছি না বিষয়টাকে আপনি কিভাবে নেবেন এই ভেবে।’ বলল সাবাতিনি।
‘আমি তো বলেছি, যা কিছু ঘটেছে তা এখন একেবারেই ভুলে যেতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। তাহলে আমি যে ‘হোস্ট’ ছিলাম, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানাচ্ছি, খাবার টেবিল তৈরি হয়ে আছে।’ বলল সাবাতিনি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক সাবাতিনি, ঠিক এই সময় এই ধরনের প্রস্তাব বেসুরো হবারই কথা। কিন্তু তুমি খাবার এই আমন্ত্রণ এখন না জানালেও নিজ থেকেই আমি খেতে চাইতাম। কারণ, আমি চলে গেলে আগামী অন্তত কয়েক ঘন্টা খাবার টেবিলের দিকে কেউ যাবে না। আমি তোমাদের সকলের সাথে খেয়ে বাড়িটাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে বাসায় ফিরতে চাই।’
‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনি সাইকোলজিস্টও। ঠিক বলেছেন, অন্তত আজ আমরা কেউ খাবার টেবিলে যেতে পারতাম না।’ আবেগজড়িত ভারি কণ্ঠে বলল ডাঃ রাসাত।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চলুন, আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে যাই। এর মধ্যে কাজের লোকরা ড্রইংরুমটা পরিষ্কার করে ফেলবে।’
কথা শেষ করেই সাবাতিনিকে ডাঃ রাসাত বলল, ‘সাবাতিনি, তোমার বাথটা মিঃ খালেদকে দেখিয়ে দাও। আর তুমি বেসিনে মুখ ধুয়ে নিয়ে খাবার টেবিল ঠিক-ঠাক করে নাও।’
সবাই গিয়ে বসল খাবার টেবিলে।
সাবাতিনি হোস্টের মতো খাবার গোটা সময় তত্ত্বাবধান কাজটা করল এবং খেলোও। তার মা ডাঃ রাসাত খাবার সময় আলোচনা শুরু করেছিল ঘটনা সম্পর্কে, কিন্তু সাবাতিনি বাঁধা দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘কথা শুরু হলে কথাই চলবে, খাওয়া হবে না। আমি খাওয়া নষ্ট করতে দেব না। খাওয়া শেষ হলে আমি নিজে কথা শুরু করে দেব।’
সত্যি খাওয়া শেষ হলে সকলকে চা পরিবেশন করে নিজে তার চায়ে চুমুক দিয়ে সাবাতিনি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আপনার পুরো পরিচয় আপনি দেননি। আপনার যে পরিচয়, একটি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আকস্মিক পরিচালক, তার সাথে প্রকৃত অবস্থার মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার টেলিফোনের পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে যায়, তারা এসে কোন জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া লাশ নিয়ে যায়, আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করে, পুলিশরা স্টেটমেন্ট স্বাক্ষর করার জন্যে আপনার বাসায় যেতে চায়, এসবের কোনটাই আপনার কথিত পরিচয়ের সাথে মিলে না। বরং এসব থেকে মনে হয়, আপনি পুলিশ কিংবা সরকারের কোন বড় কর্তা, না তার চেয়ে আরও বড় কিছু।’
আহমদ মুসা শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা পিরিচে রেখে হেসে বলল, ‘সাবাতিনি খুব বুদ্ধিমতী, বয়সের তুলনায়।’
বলে থামল আহমদ মুসা। তার মুখ থেকে হাসির রেশ কেটে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল জমাট এক গাম্ভীর্য। বলল, ‘তুমি ঠিকই ধরেছ সাবাতিনি। তবে আমি পুলিশ কিংবা সরকারের কেউ নই। এর বেশি আমার সম্পর্কে আর কিছু বলব না। প্রসঙ্গটা না বলা অবস্থায় থাক কোন এক ভবিষ্যতের জন্যে।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ এবং যা কিছু অপ্রীতিকর ঘটেছে, তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
‘চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’ বলল সাবাতিনি।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা সাবাতিনিকে বলল, ‘কষ্ট করার দরকার কি? এখন তো একটু রেস্ট নেবে।’
‘আসল কথা হলো আমাদের রাস্তার মাথার মার্কেটটায় আমি যাব।’ বলল সাবাতিনি।
সবাইকে গুড ইভনিং জানিয়ে সাবাতিনিকে আসতে বলে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
সাবাতিনিও বেরিয়ে এল আহমদ মুসার পিছু পিছু।
আহমদ মুসা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
সাবাতিনি তার পাশের সিটে উঠে বসেছে।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখ। আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আমার মার্কেটে যাবার কথা মিথ্যা স্যার। দুঃখিত, আমি মিথ্যা কথা বলেছি।’
বলে থামল সাবাতিনি।
আহমদ মুসা বিস্মিত হয়ে সাবাতিনির দিকে চাইল। তার মুখ দেখে বুঝল, তার কথা শেষ হয়নি। বলল আহমদ মুসা, ‘থামলে কেন, বল।’
‘স্যার, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমার মনে হচ্ছে, আমার ড্যাডি, মাম্মি বিপদে পড়েছে। আপনি যতটা সহজভাবে বলছেন ঘটনাটা মিটে যাবে, তা বোধহয় হবে না।’
থামল সাবাতিনি। তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন।
‘কেন হবে না? বল।’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা সাবাতিনিকে।
‘স্যার, ইরগুন ইবান আসার মধ্যে কাহিনী আছে। ড্যাডি, মাম্মি সম্ভবত ভয়ে সেটা প্রকাশ করেননি।’ বলল সাবাতিনি।
আহমদ মুসার ঔৎসুক্য বেড়ে গেল। প্রশ্ন করল সাবাতিনিকে, ‘কাহিনীটা কি?’
‘ড্যাডি মাম্মিকে একদিন একান্তে কাহিনীটা বলছিলেন। সেটা হলো, সিনাগগের প্রধান ডেভিড ইয়াহুদ আমার আব্বাকে বলেছেন আপনাকে একদিন দাওয়াত দিয়ে আনার জন্যে। সে সময় ইরগুন ইবানকে সিনাগগ থেকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ড্যাডির কাছে এমন প্রস্তাব কোন কারণে ভালো লাগেনি। তিনি বিষয়টা এড়াবার জন্যে বলেছিলেন যে, আপনি তেমন পরিচিত নন। এটা তিনি ভালো মনে করেছেন। তখন ডেভিড ইয়াহুদ হুমকি দিয়ে বলেছে যে, ড্যাডিকে এটা করতে হবে, দ্বিতীয়বার যেন ‘না’ শব্দ না বলা হয়। আরো বলে, ‘স্মার্থা’ নামে একটি মেয়ে আপনার ব্যাপারে ড্যাডির সাথে যোগাযোগ করবে। তিনি আরও হুমকি দেন যে, এ বিষয়টা যদি খালেদ খাকানকে আগে জানানো হয়, যদি প্ল্যানটা ব্যর্থ হয়, তাহলে এর যে ফল ড্যাডিকে ভোগ করতে হবে তা ড্যাডি কল্পনাও করতে পারবে না।’
থামল সাবাতিনি মুহূর্ত কালের জন্যে। তারপর আবার বলে উঠল, ‘আমি মনে করি, আপনার বিরুদ্ধে এটা গভীর ষড়যন্ত্র এবং আমার ড্যাডি, মাম্মিও এখন খুব বিপদে। কারণ, তাদের প্ল্যান ব্যর্থ হয়েছে। এতসব কথা মাম্মি, ড্যাডি আপনাকে বলেনি। আমি এটা বলার জন্যেই এসেছি।’
‘ধন্যবাদ সাবাতিনি। বিষয়টা উদ্বেগের, ওরা না করতে পারে এমন কিছু নেই। কিন্তু কাল পত্রিকায় দেখা যাবে, যা ঘটেছে, তাতে তোমার মাম্মি-ড্যাডির কোন হাত ছিল না এবং তারা ইরগুন ইবানের প্রকৃত পরিচয় পুলিশের কাছে গোপন করেছেন, এজন্যে আশু টার্গেট হওয়া থেকে তারা বেঁচে যাবেন। প্রধান টার্গেট এখন আমি। সুতরাং, তাদের আশু নজর আমার ওপরই পড়বে। ভয় নেই তোমাদের। একটা কথা তোমাকে আরও বলি, সিনাগগের ওপর এখন পুলিশের সার্বক্ষণিক নজর থাকবে। তোমাদের ক্ষতি করার সুযোগ তারা পাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমার একটা কৌতুহল আছে।’ সাবাতিনি বলল।
‘বল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার ওপর এই আক্রমণ কেন? আপনাকে তারা হত্যা করতে চাচ্ছে কেন?’ সাবাতিনি বলল।
‘ওদের দুরভিসন্ধি কার্যকরী করার পথে ওরা আমাকে বাঁধা মনে করছে, এমন কিছু হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুরভিসন্ধিটা কি?’ জিজ্ঞাসা সাবাতিনির।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি এখনও ছোট। সব প্রশ্ন করতে নেই, সব কিছু জানতে নেই।’
‘সব প্রশ্ন করতে নেই, সব কিছু জানতে নেই, এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি ছোট- একথা ঠিক নয়। আমার বয়স ঊনিশ, পূর্ণ একজন নাগরিক এখন আমি। আর প্রচুর গোয়েন্দা বই আমি পড়েছি। আমি এসব বিষয় অনেক বুঝি। জানেন, সেদিন আমাদের এক প্রফেসর আমাকে বলেছে আমি গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করবো কিনা। আমি কি কাজ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, খুবই একটা সহজ কাজ। তোমার বাড়ি তো রোমেলী দুর্গের পাশেই। রোমেলী দুর্গের পশ্চিম পাশে একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে। ঐ ইনস্টিটিউটে পাঁচজন বিজ্ঞানী আছেন, তাদের বাসা ইস্তাম্বুলের কোথায় কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে। এক একটি বাড়ি খুঁজে দেয়ার জন্যে এক হাজার ডলার করে পাবে। দেখুন কত বড় অফার!’ থামল সাবাতিনি।
খুব হালকা স্বরে কথা বলছিল সাবাতিনি। কিন্তু সাবাতিনির দেয়া তথ্য শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার জন্যে। তার গোটা দেহে খেলে গেল গরম চাঞ্চল্যের এক শিহরণ। ষড়যন্ত্রকারী সন্ত্রাসীরা বিজ্ঞানীদের বাড়ি সন্ধান করছে, এটা খুব বড় একটা ঘটনা, উদ্বেগজনক খবর। প্রফেসরের দেয়া অফার নিয়ে সাবাতিনি কি করল, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোন দিকে গড়িয়েছে- তা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায় সাবাতিনি।
‘অফারের কি হল সাবাতিনি? তুমি গ্রহণ করেছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘টাকার অফারটা ভালো স্যার, কিন্তু কাজটা আমার পছন্দ হয়নি। কারও বাড়ি খুঁজে বের করার মধ্যে কোন থ্রিল বা কোন গোয়েন্দা যোগ্যতার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়নি। গবেষণাগারে গেলেই তো তাদের বায়োডাটা, তাদের ঠিকানা উদ্ধার করা যায়। কিংবা তাদের অনুসরণ করলেও তা জানা যেতে পারে। এসব কথা তুলে আমি বলেছিলাম, কাজটা আমার পছন্দ নয়।’ থামল সাবাতিনি।
‘তারপর?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘তারপর স্যার বললেন, পছন্দ হবে। থ্রিল আছে। ঐ গবেষণা ইনস্টিটিউটে কারও পক্ষেই ঢোকা সম্ভব নয়। তাছাড়া ওদের কোন বায়োডাটা অফিসে পাওয়া যাবে না, এটাও নিশ্চিত। আর তারা বাড়িতে যাতায়াত করেন সামরিক হেলিকপ্টারে। সপ্তাহে তারা একদিন বাড়িতে যান। কিন্তু যাওয়ার কোন দিন, ক্ষণ ঠিক নেই। অতএব, তাদের বাড়ি খুঁজে বের করার মধ্যে বিরাট থ্রিল আছে। আমি বললাম, থ্রিল আছে বুঝা গেল। তবে গবেষণা কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানীদের ঠিকানা প্রয়োজনেই আড়াল করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনারা ঠিকানা কেন চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। স্যার বললেন, এসব নিয়ে তোমার কাজ নেই। তোমাকে একটা দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, সেটা তুমি করবে। আমি বললাম, মন না চাইলে সে কাজ করা যায় না স্যার। এ জন্যেই উদ্দেশ্যটা জানতে চাচ্ছিলাম। স্যার বললেন, দেখ, তোমাকে এখন সেটা বলা যাবে না। কিন্তু কাজটা মহৎ। মনে রেখ, বিজ্ঞানীরা মহাক্ষতিকর কাজেও জড়িত থাকে। সে কাজ থেকে তাদের বিরত রাখাও মানবজাতির জন্যে প্রয়োজন। স্যারের কথা আমার ভালো লাগল। বললাম, আমাকে কি করতে হবে জানালে আমি কাজটা করতেও পারি। তিনি বললেন, রোমেলী দুর্গে তোমার নিয়মিত যাওয়ার অভ্যেস করতে হবে, যেমন উইকএন্ডে অনেকেই সেখানে যায়। এভাবে ওখানকার দায়িত্বরত কিছু সেনা অফিসারের সাথে তোমার পরিচিত হতে হবে। তুমি মুসলিম নাম ‘সায়েমা সাবাতিনি’ হিসেবে তাদের কাছে পরিচিত হবে। রোমেলী দুর্গের সর্ব পশ্চিমের সর্ববৃহৎ টাওয়ারের গোড়ায় হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং করার মতো একটা জায়গায় সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঁচটা হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে। তোমার টার্গেট হবে হেলিকপ্টারের দশ গজের মধ্যে পৌঁছা। তোমাকে একটা পিস্তল দেয়া হবে। তাতে থাকবে রাবার বুলেট। অলক্ষ্যে তোমাকে পিস্তল থেকে রাবার বুলেট ছুঁড়তে হবে হেলিকপ্টারের গায়ে। এক সপ্তাহে সব হেলিকপ্টারে বুলেট ছুঁড়তে পারবে না। ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানীকে বহনকারী পাঁচটা হেলিকপ্টারের জন্যে তোমাকে পাঁচ সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হতে পারে। ব্যস, এটুকুই তোমার দায়িত্ব। আমি বললাম, পিস্তলের শব্দে তো বিষয়টা সবার চোখে পড়ে যাবে। স্যার বললেন, পিস্তলের একটুকুও শব্দ হবে না। কাজটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। আমি কাজটা গ্রহণ করেছি এই জন্যে যে, কোন খারাপ কাজ হয়তো এর দ্বারা বন্ধ হবে।’ থামল সাবাতিনি।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘তোমার দায়িত্ব ছিল বিজ্ঞানীদের বাড়ি খুঁজে দেয়া, হেলিকপ্টারে রাবার বুলেট ছুঁড়েই সে দায়িত্ব পালন হয় কি করে?’
হাসল সাবাতিনি। বলল, ‘আমি স্যারকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, রাবার বুলেট গিয়ে হেলিকপ্টারের গায়ে একটা জিনিস পেস্ট করে দেবে, ওটাই আমাদের বিজ্ঞানীদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে।’
আহমদ মুসার চিন্তায় চলছে তোলপাড়। ওদের ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য সবকিছুই আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার। ওরা এবার বিজ্ঞানীদেরই সরিয়ে দিতে চায়। সাবাতিনিকে এ কাজের জন্যে কেন বাছাই করেছে, সেটাও বুঝতে পারছে সে। কিন্তু সাবাতিনি কি সেটা জানে?
‘সাবাতিনি, এ কঠিন কাজের জন্যে ওরা তোমার মতো একজন নতুনকে বাছাই করল কেন?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
হাসল সাবাতিনি। বলল, ‘স্যার, এ প্রশ্নও তাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে প্রফেসর স্যার বলেছিলেন, তুমি ঐ এলাকার মেয়ে। তোমার চেহারা তুর্কিদের মতো, কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী তাদের মধ্যে খুব বেশি নেই। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ছাত্র-ছাত্রীদের অবাধ গতিকে সবাই একটু মেনে নেয় এবং সর্বশেষ বিষয় হলো, তুমি আমার ইহুদি কমিউনিটির মেয়ে, সেজন্যে তোমার ওপর আস্থা রাখা যায়।’
‘উনি ঠিকই বলেছেন। তুমি কি কাজ শুরু করে দিয়েছ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘একদিন দুর্গের ভেতরটা ঘুরে এসেছি। শুনলাম যে, দুর্গের আশে-পাশেই আপনার অফিস। আপনার সাহায্য চাইব ভাবছি। যতটা আপনাকে বুঝেছি, এটা আপনার বাঁ হাতেরও কাজ নয়।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বলো, কোন দরকার হলে, আমি অবশ্যই সাহায্য করব। আচ্ছা, তোমার সেই প্রফেসর স্যার কোন বিভাগের, কি নাম? ভদ্রলোক বোধহয় অন্যায় কাজ, ক্ষতিকর গবেষণাও দেখতে পারেন না?’
‘তাই স্যার। তার নাম আলী আহসান বেগভিচ। তিনি বসনিয়া থেকে এসে এখানে সেটেল করেছেন।’
‘মুসলিম নাম দেখছি। তিনি তো ইহুদি।’
‘কেন, অনেক ইহুদির এমন মুসলিম নাম আছে। আমি তাকে তো মুসলমানই মনে করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দূরে একটা সিনাগগ আছে। সিনাগগের একটা বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে তার সাথে আমার নতুন করে পরিচয় হলো। দেখলাম যে, তিনি ইহুদি।’
‘ধন্যবাদ সায়েমা সাবাতিনি, অনেক কথা হলো।’ বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল সাবাতিনি। বলল, ‘স্যার, ও নামতো আমার ঐ দুর্গের জন্যে।’
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল সাবাতিনি, ‘স্যার, আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। এসেছি যখন, মার্কেটটা ঘুরেই যাই।’
আহমদ মুসা গাড়ি থামাল।
গাড়ি থেকে নামার আগে সাবাতিনি একটা নেমকার্ড আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার নেমকার্ডটা। আমার টেলিফোন নাম্বার এতে আছে। আপনার একটা মোবাইল নাম্বার তো সেদিন আমাকে দিয়েছিলেন। আমি বিরক্ত করলে কিছু মনে করবেন না স্যার। স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সাথের মুহূর্তগুলো অবিস্মরণীয়, ঠিক আপনার মতোই।’ বলে হাসতে হাসতে নেমে পড়ল সাবাতিনি।
‘গুড ইভনিং সাবাতিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
সাবাতিনি নেমে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল বিদায় জানাতে।
আহমদ মুসাও তার দিকে হাত নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।