৪৫. বসফরাসের আহ্বান

চ্যাপ্টার

অফিসের টেবিলে বসে কয়েকদিনের হিসেব-নিকেশ করছিল আহমদ মুসা।
তার অফিসটা রোমেলী দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানে তিনটি গোপন ফ্লোর রয়েছে। টপ ফ্লোর, সেকেন্ড ফ্লোর এবং বটম ফ্লোর। এই তিনটি ফ্লোর নিয়েই ওআইসি’র ‘আইআরটি’ অর্থাৎ ‘ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি’র অফিস। ফ্লোরগুলো টপ থেকে বটমের দিকে ক্রমশ বড় হয়েছে। দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারটি দুর্গ-অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায়। টাওয়ার-ফ্লোরের দশ ফিট নিচে টপ ফ্লোর। এই ফ্লোরের আয়তন সাড়ে তিন হাজার ঘন ফিটের মতো। এর নিচের সেকেন্ড ফ্লোরটির আয়তন টপ ফ্লোরের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় আট হাজার ঘন ফিট। কিন্তু বটম ফ্লোরটি বলা যায় একটা মাঠের মতো। আয়তন বিশ হাজার ঘন ফুট। এই তিনটি ফ্লোরের টপ ও সেকেন্ড ফ্লোর নির্মিত হয়েছে ১৪৫২ খৃস্টাব্দে। দুর্গটি নির্মিত হয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের দ্বারা। আর বিশ হাজার ঘন ফিটের বটম ফ্লোরটি নির্মাণ করেছে ওআইসি’র ইঞ্জিনিয়াররা। তিন ফ্লোরের টপ ফ্লোরে বিজ্ঞানীদের পার্সোনাল ফ্ল্যাট। সেকেন্ড ফ্লোরটি রিসার্চ সেন্টার এবং লাইব্রেরী। আর বটম ফ্লোরটি ল্যাবরেটরী ও টেস্ট সেন্টার।
বিজ্ঞানীদের সাথে আহমদ মুসার অফিসও সেকেন্ড ফ্লোরে।
ফ্লোরটির ঠিক মাঝখানে লাইব্রেরী। বৃত্তাকার লাইব্রেরীর চারদিকের বহির্দেয়ালে রয়েছে ছয়টি দরজা। এই ছয়টি দরজা ছয়টি রিসার্চ কমপ্লেক্সে ঢোকার পথ। একেকটি কমপ্লেক্সে বিজ্ঞানীরা এককভাবে বা যৌথভাবে কাজ করেন। এই ফ্লোরে ছয়টি রিসার্চ কমপ্লেক্স ছাড়াও প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কক্ষ রয়েছে।
ওআইসি’র এই ‘আইআরটি’তে আহমদ মুসা রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর (আরডি)-এর চাকরি নিয়ে এসেছে। জেনারেল তাহির তারিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের যে সেল এই ইন্সটিটিউট পরিচালনা করে, তাদের কেউ এখানে থাকেন না। ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) একজন আছেন। তিনি প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখেন। আর প্রজেক্টের প্রধান বিজ্ঞানী ‘চ্যান্সেলর অব আইআরটি’ হিসেবে সমগ্র রিসার্চ উইং পরিচালনা করেন। আহমদ মুসার নতুন চাকরিতে তার নতুন নাম হয়েছে খালেদ খাকান। তার পরিচয়, মধ্য এশিয়া অঞ্চলের বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক।
আহমদ মুসা বিজ্ঞানীদের সাথে থাকার জন্যে টপ ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে। অবশ্য আহমদ মুসা রোমেলী দুর্গের উত্তর পাশে আরও উঁচু একটা পাহাড়ে বাসা ভাড়া নিয়েছে। ইচ্ছেমতো দু’জায়গাতেই সে থাকে।
কাজে যোগ দেয়ার পর বেশ কয়দিন পার হয়ে গেছে আহমদ মুসার।
এই কয়েকদিনের হিসেব একসাথে তার সামনে এসেছে মালার মতো সারিবদ্ধভাবে সাজানো পুঁথির আকারে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছে যে, বাইরের কেউ আইআরটি’র প্রশাসনিক বিভাগের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের একটা কম্পিউটারে ‘প্রজেক্ট রেকর্ড’ ফাইলের আইডি ও পাসওয়ার্ড খুঁজেছে। কম্পিউটারের প্রসিডিংস মনিটরে দেখা গেছে, অজ্ঞাত সেই লোকটি দশ জোড়া আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছে। কম্পিউটারের ইমেজ আইতে লোকটির ছবি আসার কথা, কিন্তু আসেনি। অতি চালাক লোকটি মুখোশ পরা ছিল। কিন্তু কম্পিউটারের ক্যারেক্টার মনিটর থেকে জানা গেছে, লোকটি তার কম্পিউটার ব্যবহারের গোটা সময়ের সত্তর ভাগ বাম হাত ব্যবহার করেছে। তার অর্থ, লোকটি বাঁ-হাতি। খুশি হয়েছে আহমদ মুসা। এসব তথ্য কম মূল্যবান নয়।
কার্যত সর্পদংশনে মারা যাওয়া লোকটির ব্যাপারেও আহমদ মুসা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। আহমদ মুসা লোকটির মেডিক্যাল রিপোর্ট পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে, তার দেহে যে বিষ পাওয়া গেছে, তা নিঃসন্দেহে সাপের বিষ। কিন্তু আহত স্থানটি সর্পদংশনের ক্ষত নয়। এটা সন্দেহ নয়, সত্য। তবে ঐ ক্ষত সৃষ্টি করেই তার মাধ্যমে রক্তে সাপের বিষ ঢুকানো হয়েছে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি আহমদ মুসাকে উদ্বিগ্ন করেছে, সেটা হলো তার দেহে এই ক্ষত সৃষ্টিটি কে করল? কোন অপরিচিত লোকের পক্ষে এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে ঐ ধরনের আঘাত করার সুযোগ নেয়া সম্ভব নয়। দুর্গের সেনা-নিরাপত্তা ডিঙানোর প্রশ্ন তো আছেই। এ থেকে এটাই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে যে, আঘাতকারী লোকটি নিহত নিরাপত্তা গোয়েন্দার খুবই পরিচিত বা আস্থাভাজন এবং সেনা-নিরাপ ত্তা কর্মীদেরও পরিচিত কেউ। তাহলে সে কি ভেতরের না বাইরের পরিচিত কেউ?
তারপর তদন্তের জন্যে নিযুক্ত একজন নিরাপত্তা গোয়েন্দার বসফরাসে ডুবে মরার ঘটনাটিও আহমদ মুসা অনুসন্ধান করেছে। তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছে আহমদ মুসা। ওতে সন্দেহের মতো কিছুই সে দেখেনি। একজন স্রেফ ডুবে মরেছে। ঐ দুই নিরাপত্তা গোয়েন্দা যে ফ্ল্যাট দু’টিতে এসে উঠেছিল, সেখানেও গেছে আহমদ মুসা। একসাথে থাকতো ওরা। আহমদ মুসা ওদের ব্যবহৃত বই-পুস্তক, কাগজপত্র, কম্পিউটার সবই পরীক্ষা করেছে। তাদের কম্পিউটারের গোপন ফাইলে আহমদ মুসা তাদের ডেইলি নোটস পেয়েছে। ডেইলি নোটসে শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করার মতো কিছু পাচ্ছে না বলে লিখেছে। তবে ডেইলি নোটসে দু’জনেই একটা কথা লিখেছে, ‘সিক্সথ সেন্স’ এর কথা বার বারই বলেছে, আমরা সব সময় কারো নজরের মধ্যে রয়েছি। সুতরাং, আমরা হাওয়ায় ঝাণ্ডা উড়াচ্ছি না। এখন কাজ হলো, চোখের আড়ালের এই শত্রুকে চোখের সামনে নিয়ে আসা। কিন্তু সে সময় তাদের দেয়া হয়নি। আহমদ মুসা গোয়েন্দাদ্বয়ের এভাবে মরার ঘটনা অনুসন্ধান করা থেকে একটা কথাই বুঝল যে, আহমদ মুসাও কারো না কারো নজরের মধ্যে রয়েছে। আহমদ মুসা ওআইসি ও টার্কি গোয়েন্দাদের গঠিত পাঁচ সদস্যের যৌথ তদন্ত টিমের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার ব্যাপারেও অনুসন্ধান করেছে। কিন্তু সামনে এগোবার মতো কোন ক্লু এখনো পায়নি। শেষ একটা ব্যবস্থা হিসেবে তারা তদন্ত কাজে নিযুক্ত হবার পর তাদের মোবাইল বা ল্যান্ড টেলিফোনে যে কলগুলো করেছে কিংবা যে কলগুলো তারা রিসিভ করেছে, তার একটা নির্ঘণ্ট এবং কথা-বার্তার রেকর্ড আহমদ মুসা টার্কিশ গভর্নমেন্টের কাছে চেয়েছিল। সেই রেকর্ডগুলোই এখন তার সামনে। বহুক্ষণ ধরে এই রেকর্ডগুলোই পরীক্ষা করছিল আহমদ মুসা। কিন্তু নতুন কোন ক্লু পায়নি। পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিমের নেতা মেজর ইমাম সেদিন টেলিফোন করে অন্য চার সদস্যকে ডেকে নিয়েছিল এবং একত্রিত হয়ে কোথাও বেরিয়েছিল। তারপরেই অন্তর্ধান। ডেকে নেয়ার সময়ের কথা-বার্তা থেকে কোথাও একসাথে বের হবার আহবান ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। কোথায় বেরিয়েছিল তারা, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজারও চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা। তাদের অফিসের গার্ডবয় একজন তুর্কি যুবক। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আহমদ মুসা জানতে পেরেছিল, তারা পাঁচজন একটা গাড়িতে উঠেছিল। ড্রাইভিং সিটে বসেছিল মেজর ইমাম। তিনি তুর্কি সেনা গোয়েন্দার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন তুখোড় অফিসার। পাঁচ সদস্যের টিমেরও তিনি প্রধান। তিনি গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে সাথীদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, রোমেলী দুর্গের ওপরে উত্তর পাশে ‘আলালা’ পাহাড়ের ‘সরাই’তেঁ আমরা যাব। আমাদের গোয়েন্দা সূত্র কিছু তথ্য দিয়েছে। এরপর তাদের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে যায়। এটাই তাদের শেষ যাওয়া। গার্ড যুবকের কাছে এই তথ্য জানার পর আহমদ মুসা আলালা পাহাড়ের ‘সরাই’তে গিয়েছিল। ‘সরাই’ আলালা পাহাড়ের একটি ট্যুরিস্ট ভিলা। এতে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটগুলো সব ভাড়ায় চলে। আহমদ মুসা দেখেছে, ট্যুরিস্ট, নন-ট্যুরিস্ট সব ধরনের লোকই ‘সরাই’তেঁ রয়েছে। ‘সরাই’-এর বৈশিষ্ট্য হলো, এর দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের কিছু ফ্ল্যাট থেকে রোমেলী দুর্গের প্রায় গোটাটাই দেখা যায়। আহমদ মুসা এই সরাইয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম সন্ধিস্থলের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। এই ফ্ল্যাট থেকে দূরবীনে রোমেলী দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারসহ দুর্গের অনেক অংশ বিশেষ করে পশ্চিম অংশ নিখুঁতভাবে দেখা যায়। আহমদ মুসা এই ফ্ল্যাটে প্রতিদিনের একটা অংশ কাটায়।
আহমদ মুসা রোমেলী দুর্গে গিয়ে পাঁচ সদস্যের গোয়েন্দা টিমের সেখানে তদন্তে যাওয়ার কোন হদিসই বের করতে পারেনি। ঐ পাঁচ সদস্যের গোয়েন্দা টিমের মেজর ইমাম কোন এক গোয়েন্দা সূত্র থেকে সরাইতে যাওয়ার ব্যাপারে একটা তথ্য পেয়েছিল। কি তথ্য পেয়েছিল, এটা জানার চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা তুরস্কের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ঐ দিন, ঐ সময় দূরে থাক, তদন্ত টিমে যোগ দেয়ার পরও কেউই সরাসরি মেজর ইমামের সাথে কথা বলেনি। কারণ, তদন্ত টিমটি তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অধীন নয়, এটা সরাসরি ওআইসি সিকিউরিটি চীফ জেনারেল তাহির তারিকের অধীন। এ ধরনের তদন্ত টিম যে গঠিত হয়েছে এবং তাতে মেজর ইমাম যোগ দিয়েছে, এ তথ্য তুর্কি সামরিক গোয়েন্দার শীর্ষ ব্যক্তি, তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর কেউ জানেই না। সুতরাং তদন্তের ব্যাপারে ঐ ধরনের টেলিফোন মেজর ইমাম পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আহমদ মুসা নিশ্চিত বুঝেছে, তদন্ত টিমকে ট্র্যাপে ফেলতে শত্রুপক্ষেরই টেলিফোন ছিল ওটা। এই চিন্তা থেকে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয় যে, তদন্ত টিম গঠনের কথা এবং কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে সে কথা শত্রুপক্ষ জানতে পেরেছিল এবং সেই সাথে তারা জানে তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের চলমান ‘আইডেন্টিফিকেশন কোড’। তার মানে, তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কোন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের কারো সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নটি আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়নি, তারা তদন্ত টিমকে সরাই’তে ডেকেছিল কেন? এই প্রশ্নের সন্ধানেই আহমদ মুসা সরাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার একটা ব্যবস্থা করেছে।
ভাবনায় ডুবেছিল আহমদ মুসা। তার সামনে খোলা টেলিফোন মনিটরিং ডকুমেন্টের ফাইলটা। ফাইলটা বন্ধ করল আহমদ মুসা। নতুন একটা হিসেব তার সামনে এসে গেল।
বাইরের কে বা কয়জন কিভাবে গবেষণাগারে প্রবেশ করেছিল, কিংবা সে যদি পরিচিত কেউ বা ভেতরের কেউ হয়, তাহলে সে কে? যতটা অনুসন্ধান করতে পেরেছে, তাতে জেনেছে বাইরের কোন লোক ভেতরে প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। পাঁচ জন বিজ্ঞানী, ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট এবং ভেতর ও বাইরের দু’জন সিকিউরিটি ছাড়া বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু বাইরের বা ভেতরের কেউ এটা করেছে। আচ্ছা, গোপন তদন্তে নিয়োজিত দু’টি গোয়েন্দা টিমের খবর ওরা পেয়েছিল কি করে? এটা তো কোন ঘোষিত তদন্ত ছিল না? এমনকি বিষয়টি এ প্রতিষ্ঠানেরও কাউকে জানানো হয়নি! তাহলে শত্রুপক্ষের বড় কোন সোর্স এ পক্ষের কোথাও আছে। আর দুই তদন্ত টিম টার্গেট হলো এটা ঠিক আছে, কিন্তু সিকিউরিটির লোকটি টার্গেট হলো কেন? অন্য কেউ নয় কেন? কোন কিছু জেনে ফেলার জন্যে তাকে মারা হয়েছে, না পথের বাঁধা দূর করার জন্যে তাকে মারা হয়েছে?
ফাইল বন্ধ করলেও এসব নতুন চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা। পায়ের শব্দে মুখ তুলল সে। দেখল, ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজ তার টেবিলের দিকে আসছে।
ডঃ শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এর অফিস মানে গোটা প্রশাসনিক অফিস এই টাওয়ারের বাইরে, পাশেই। দুর্গের ভেতরেই ওটা নতুন একটা বিল্ডিং। ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজসহ ছোট্ট প্রশাসনিক স্টাফ সেখানেই বসেন। প্রশাসনিক স্টাফদের ভেতর ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজই গবেষণাগারে প্রবেশ করতে পারেন।
ডঃ শেখ বাজ এগিয়ে এসেছে আহমদ মুসার টেবিলের পাশে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে স্বাগত জানাল তাকে। বলল, ‘ডঃ বাজ, আমি আপনাকে ডেকেছিলাম, কষ্ট দিয়েছি। প্লিজ বসুন।’
ডঃ বাজ বসতে বসতে বলল, ‘কোন কষ্ট নয় স্যার। এটা আপনার ডিউটি, আমারও ডিউটি।’
ডঃ বাজ ইংরেজিতে জবাব দিল আহমদ মুসার। সে আরবিভাষী, সৌদি। সৌদি আরবের বিখ্যাত বাজ পরিবারের ছেলে। এই বাজ পরিবার বাদশাহ ইবনে সৌদের গুরু শেখ আবদুল ওয়াহাব নজদী পরিবারেরই একটা শাখা। এই পরিবারকে সম্মান করে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা খুশি হয়েছে যে, এই পরিবারের ছেলে এই ধরনের একটি দায়িত্ব পাওয়ারই উপযুক্ত।
কিন্তু ডঃ শেখ বাজ জানে না এখানে আহমদ মুসার মিশন সম্পর্কে। রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর ছিল না, এখন নেয়া হয়েছে এটাই সে জানে।
‘ধন্যবাদ ডঃ শেখ বাজ। আপনাকে ডেকেছি কারণ আমি আসার পর আপনার সাথে কিছু অফিসিয়াল কথা ছাড়া আর কোন কথাই হয়নি। কেমন আছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো স্যার। আপনি কেমন বোধ করছেন? কেমন লাগছে ইন্সটিটিউট? কেমন দেখছেন ইস্তাম্বুলকে?’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি খুব ভালো বোধ করছি। ভালো লাগছে সবকিছু।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা একটা অস্বস্তিতে আছি। একজন প্রকৌশল বিজ্ঞানী ও একজন সিকিউরিটি অফিসারের পরপর মৃত্যু হলো। মৃত্যুকে সন্দেহজনক মনে করা হলেও তদন্ত এগোতে পারেনি, নিশ্চয় জানেন। এর মধ্যে বড় পদে আপনার আগমন আমাদের আশান্বিত করেছে। ইতোমধ্যেই আপনি একটা উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছেন। কি জানি, আমরা আগের চেয়ে অস্বস্তিও যেন কম অনুভব করছি।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু তদন্ত কেন এগোতে পারল না? আপনাদের অভিমত কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাধারণ দৃষ্টিতে সবটাই দুর্ভাগ্য বলে মনে হয়। সবগুলো মৃত্যুই দুর্ঘটনা বা স্বাভাবিক কারণে হয়েছে। শুধু শেষ পাঁচ জনের নিখোঁজ হওয়া ছাড়া।’
‘আচ্ছা বলুন তো ডঃ শেখ বাজ, বিজ্ঞানীরা, আপনারা কয়েকজন ও সিকিউরিটি দু’জন ছাড়া ভেতরে আর কেউ কি প্রবেশ করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
ডঃ শেখ বাজ একটু চিন্তা করে বলল, ‘না স্যার, বাইরের অন্য কেউ ভেতরে আসতে পারে না, আসা নিষিদ্ধ।’
‘আচ্ছা, টপ ফ্লোরে রেসিডেন্সিয়াল কোয়ার্টার রয়েছে। যারা ওখানে থাকেন, তাদের কেউ এখানে আসে না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আসার বিধান নেই। তবে বিভিন্নভাবে কেউ কেউ আসেন। যেমন, যে তারিখে আমার বাসায় ফেরার কথা, সেদিন হয়তো আমার স্ত্রী এসে আমাকে নিয়ে গেল। এ ধরনের ঘটনা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে। তবে বাইরের এমন কেউ এসে বাস করে না।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘এমন যারা আসেন, তারা সেকেন্ড ফ্লোর এবং বটম ফ্লোরে যান কিংবা যেতে পারেন?’
‘বটম ফ্লোরে এমন কেউ এবং অন্য কেউই যেতে পারে না। ইন্সটিটিউটের চ্যান্সেলর প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসীই শুধু জানেন বটম ফ্লোরে প্রবেশের একমাত্র দরজার ছয়টি ডিজিটাল লকের কোনটি দিয়ে কখন কোন কোড ব্যবহার করে প্রবেশ করা যাবে। তিনিই মাত্র দরজা খোলেন এবং বিজ্ঞানীদের ভেতরে নিয়ে যান। সুতরাং তার দৃষ্টির বাইরে কারও সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তবে সেকেন্ড ফ্লোরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন বিধি-নিষেধ নেই। যারা এ ফ্লোরে আসেন, তারা ইচ্ছে করলে সেকেন্ড ফ্লোরে যেতে পারেন।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল, সেকেন্ড ফ্লোরে তো মাস্টার কম্পিউটারটা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে ইন্সটিটিউটের রিসার্চ ব্লু-প্রিন্টের বিবরণসহ বিজ্ঞানীদের বায়োডাটা ও রিসার্চ স্পেসিফিকেশন রয়েছে। এই কম্পিউটারেই প্রবেশ করতে চেয়েছিল অদৃশ্য অজানা কেউ। এই অজানা কেউ কে হতে পারে? এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে গেল। আহমদ মুসা বলল ডঃ শেখ বাজ-এর কথা শেষ হবার পর, ‘এভাবে যারা আসেন বা এসেছেন, তাদের কোন হিসেব এন্ট্রিলগ রেজিস্টারে আছে?’
‘জ্বি স্যার। নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকেরই নাম, পরিচয়, দস্তখত এন্ট্রিলগে রয়েছে। এছাড়া ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা লগের ফটোও আমরা কম্পিউটারে পাব।’
‘ম্যামেরা লগে কি শুরু থেকেই সব ফটো বা দৃশ্য সংরক্ষিত আছে?’
‘অবশ্যই স্যার। শুধু ফাস্ট এন্ট্রি নয় স্যার, প্রত্যেক ফ্লোরেরই আলাদা আলাদা এন্ট্রি ক্যামেরা লগ রয়েছে কম্পিউটারে। এ লগগুলো প্রতি মাসে রুটিন চেক হয়। সম্প্রতি সন্দেহজনক একটা ঘটনা ঘটার পর সবগুলো লগ কমপ্লিট চেক করা হয়।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘সন্দেহজনক কি ঘটনা?’
‘মাস্টার কম্পিউটারে সন্দেহজনক সার্চের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
বিষয়টা আহমদ মুসা আগে থেকেই জানে। তার তদন্তের এটাও একটা ইস্যু।
বলল আহমদ মুসা, ‘লগ পরীক্ষা থেকে কিছু পাওয়া গিয়েছিল?’
‘কিছু পাওয়া যায়নি স্যার। অজানা-অপরিচিত কারও প্রবেশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদেরও গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাজের গোপনীয়তার স্বার্থে কক্ষ পর্যায়ে সিসিটিভি ক্যামেরা পাহারায় রাখা হয়নি। সেটা থাকলে গোপনে কে মাস্টার কম্পিউটারে বসেছিল, তা জানা যেত।’ ডঃ শেখ বাজ বলল।
‘ডঃ শেখ বাজ, আমাদের ইন্সটিটিউটের ভেতরে বাইরে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে কি আপনি সন্তুষ্ট?’
‘জ্বি স্যার। বাইরের নিরাপত্তা তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনী রক্ষা করে। দুর্গে প্রবেশ তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া ইন্সটিটিউট পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারে না। ইন্সটিটিউটে প্রবেশের গেট নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের একজন সিকিউরিটি অফিসার। পালাক্রমে একজন সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের প্রধান গেট রক্ষা করে। ভেতরের জন্যে একজন সিকিউরিটি অফিসার আছেন। কিন্তু সন্দেহজনক ঘটনা ঘটার পর তাকেও বাইরের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োগ করা হয়েছে সম্প্রতি। ইনস্টিটিউটের নিরাপত্তার দিকটা আমি মনে করি এই দিক দিয়ে নিশ্চিত।’
‘ঠিক আছে, ডঃ শেখ বাজ। এনট্রান্স লগ এবং সিসিটিভি ক্যামেরা লগ আমার টেবিলে দেবেন। আমিও একটু দেখব।’
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা তিনটা বাজতে যাচ্ছে।
তারপর আহমদ মুসা তাকাল ডঃ শেখ বাজের দিকে। বলল, ‘ডঃ শেখ বাজ, আমি উঠব।’
‘কোথায় যাবেন স্যার? বাসায়? আপনি তো এ সময় বের হন না।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘আমি পুলিশের জোনাল আর্কাইভসে যাব।’
‘আলালা পাহাড়ের আল-আলা পার্কের লাগোয়া যে বড় পুলিশ অফিস ওটায়?’ জিজ্ঞেস করল ডঃ শেখ বাজ।
‘হ্যাঁ’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর্কাইভসে কি কাজ?’
‘তেমন কিছু না। সুলতান মুহাম্মদ মটরওয়ে থেকে যে রাস্তা আলালা পাহাড়ের ‘সরাই’ পর্যন্ত এসেছে, সে রাস্তায় গত একমাস ধরে যে সব গাড়ি চলাচল করেছে তার একটা তালিকা দরকার।’
‘সে তো অনেক বড় ব্যাপার! আপনি গোয়েন্দার মতো কথা বলছেন দেখছি! এ দিয়ে কি করবেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা ইস্তাম্বুল শহরে গাড়ি চলাচলের একটা স্যাম্পলিং। এটা আমার একটা হবি।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

রোমেলী দুর্গ যে পাহাড়ে তার উত্তর-পশ্চিমে আলালা পাহাড়। অপেক্ষাকৃত অনেক উঁচু। এই পাহাড়েই ‘সরাই’ বিল্ডিং-এ আহমদ মুসা ভাড়া থাকে। এই পাহাড়ের ওপরেই সমতল বিরাট এলাকা জুড়ে একটি পার্ক। এটাই আল-আলা পার্ক। পার্কের পাশে বিরাট টিলা জুড়ে পুলিশ আর্কাইভস। পার্কের চারদিক ঘিরে রাস্তা। রাস্তার পাশ থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে টিলার ওপরে। এ সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হয় পুলিশ আর্কাইভসে।
আর্কাইভসে মাগরিবের নামায পড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আহমদ মুসা বেরিয়ে পড়ল আর্কাইভস থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে রাস্তা অতিক্রম করে আহমদ মুসা পার্কে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা তার গন্তব্য আড়াল করার জন্যে গাড়ি পার্কের বাইরে রেখে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে পুলিশ আর্কাইভসে গিয়েছিল।
পার্কে প্রবেশের গেটের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলেও পার্ক তখনও দিনের আলোর মতোই ঝলমলে।
প্রচুর লোক তখনও পার্কে। কেউ পায়চারি করছে, কেউ কেউ এখানে ওখানে বসে গল্প করছে।
ইস্তাম্বুল যেমন পাহাড়ের শহর, তেমনি গাছ-গাছালিরও শহর।
পার্কের ফ্লোরও উঁচু-নিচু। বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে পরিকল্পিতভাবে সজ্জিত পার্কটি।
একটু নিরিবিলি জায়গা দেখেই এগোচ্ছিল আহমদ মুসা। একটা গাছের ছায়া পার হচ্ছিল সে।
পেছন থেকে চার জন লোক আহমদ মুসার দিকে ছুটে গেল। তাদের দু’জন জামার তলা থেকে লোহার ব্যাটন বের করে নিয়েছে। অন্য দু’জনের হাতে রিভলভার। পেছনের ব্যাটনধারী বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে আঘাত করল।
শেষ মুহূর্তে পায়ের শব্দে টের পেয়েছিল আহমদ মুসা। দ্রুত মাথাটা বাম দিকে সরিয়ে নিয়েছিল সে। কিন্তু তবু আঘাতটা এড়াতে পারল না। হাতুড়ির মতো একটা আঘাত নেমে এল মাথার ডান পাশের ওপর এবং তা নেমে গেল কান মাড়িয়ে। আরেকটা আঘাত এসে তার কাঁধ যেন গুঁড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা পড়ে গিয়েছিল উপুড় হয়ে। কিন্তু পড়ে গিয়েই ফলোআপ আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে গড়িয়ে বাম দিকে সরে গেল।
দুই ব্যাটনধারী ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল নতুন করে আঘাত করার জন্যে।
আহমদ মুসা সরে গিয়েই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
দুই ব্যাটনধারী ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল তার দিকে।
আহমদ মুসা দেহ শূন্যে তুলে তার দু’পা ছুঁড়ে দিল ওদের দু’জনের ধাবমান পায়ের দিকে। অব্যর্থ আঘাত। ওরা গোড়াকাটা গাছের মতো আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
প্রস্তুত আহমদ মুসা। ওরা দু’জন নিজেদের সামলে নেবার আগেই দু’হাতে ওদের দু’জনের গলা সাঁড়াশির মতো প্রচণ্ডভাবে পেঁচিয়ে ধরল। তারপর ওদের গলা মুচড়ে দিয়ে ওদের হাতের ব্যাটন কেড়ে নিল।
অন্যদিকে রিভলভারধারী দু’জন ছুটে আসছিল রিভলভার বাগিয়ে।
আহমদ মুসা তখন ব্যাটন হাতে বসা অবস্থায় ছিল। উঠে দাঁড়াবার সময় নেই। নতুন ভাবনার অবকাশ নেই। তবে আহমদ মুসার এ চিন্তা ছিল যে, জানাজানি, শোরগোল এড়াবার জন্যে ওরা পারতপক্ষে গুলি চালাবে না। আহমদ মুসা দ্রুত চিন্তা করে এই মুহূর্তে তার হাতে থাকা শেষ সুযোগ হিসেবে ব্যাটন দু’টি সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারল ওদের রিভলভার ধরা হাতের দিকে।
প্রচণ্ড গতিতে লোহার সলিড ব্যাটন ছুটে গিয়ে ঠিক ঠিক আঘাত করল ওদের রিভলভার ধরা হাতে। ওদের হাতের রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। হাতও ওদের আহত হলো।
আহমদ মুসা ব্যাটন ছুঁড়েই উঠে দাঁড়াল। সেই সাথে গলার মোচড়ের আঘাত তখনও সামলে উঠতে না পারা একজনের কোমরের বেল্ট ধরে এক হ্যাঁচকা টানে মাথার উপর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল ব্যাটনে আঘাতপ্রাপ্ত দু’জনের উপর।
এদিকে আহমদ মুসার পাশে পড়ে থাকা দ্বিতীয় জন মরিয়া হয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে পেঁচিয়ে ধরল আহমদ মুসার গলা।
আহমদ মুসা দু’হাতের কনুই দিয়ে প্রচণ্ড কয়েকটা ঘা দিল লোকটির পাঁজরে। ব্যথায় কোঁৎ কোঁৎ শব্দ বেরুলো তার মুখ থেকে। কিন্তু আহমদ মুসার গলা সে ছাড়ল না। বরং গলায় তার হাতের চাপ আরও তীব্র হলো। শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো তার। লোকটি তার গায়ের সাথে লেপটে থাকায় কনুই এর আঘাত আর কার্যকরী হচ্ছিল না। লোকটিকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক কৌশল হিসেবে আহমদ মুসা পা দু’টিকে একটু ফাঁক করে, শক্ত করে সর্বশক্তিতে দেহের উপরের অংশে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি দিয়ে বাঁকিয়ে নিয়ে মাথাটা অনেকটা লম্বভাবে নিজের পায়ের দিকে ছুঁড়ে দিল।
লোকটির পেছন দিকটা উল্টে এসে ছিটকে আহমদ মুসার সামনের দিকে চলে এল। অন্যদিকে আহমদ মুসা তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবস্থানটা অনড় রাখার চেষ্টা করে তা নিচের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তার মাথাটা হাঁটুর লেভেলে পৌঁছার পর আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপর দিকে তোলার চেষ্টা করল। মাথাটা ওপর দিকে উঠল না বটে, কিন্তু নিচের দিকে যাওয়ার গতি থেকে থেমে যাওয়ায় একটা ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। এই ঝাঁকুনি ও লোকটির দেহ উল্টে গিয়ে পড়ার প্রবল চাপ- দুইয়ে মিলে আহমদ মুসার গলায় পেঁচানো লোকটির দু’হাত শিথিল হয়ে গেল।
আহমদ মুসা লোকটির হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েই বুক ভরে এক শ্বাস নিয়ে তার পায়ের কাছে পড়ে যাওয়া লোকটির কোমরের বেল্টের নিচে হাত চালিয়ে তার দেহটা শূন্যে মাথার ওপর তুলে নিল।
ওরা তিনজন সার বেঁধে ছুটে আসছিল।
আহমদ মুসা লোকটিকে ছুঁড়ে মারল তাদের ওপর।
তিনজনই পেছনের দিকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে গেল পড়ে থাকা দু’টি রিভলভারের দিকে। কুড়িয়ে নিল দু’টি রিভলভার দু’জায়গা থেকে।
রিভলভার দু’টি কুড়িয়ে নেবার পর মাথা তুলে দেখল, ওরা চারজন উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাচ্ছে।
গুলি করার জন্যে রিভলভার তুলেও থেমে গেল আহমদ মুসা। শুরুতেই খুনোখুনিতে যেতে চায় না সে। রিভলভার দু’টি ফেলে দিয়ে বসে পড়ল সে। একটা প্রবল ক্লান্তি ঘিরে ধরছে যেন তার দেহকে। মাথার ডান পাশ ও কাঁধে অসহ্য একটা যন্ত্রণা। একটু জিরিয়ে নিয়ে উঠবে, ভাবল আহমদ মুসা। অবসন্নতায় মাথা ঝুঁকে পড়েছিল নিচের দিকে।
পায়ের শব্দে চমকে উঠে মুখ তুলল আহমদ মুসা। দেখল, একজন পুরুষ, একজন মহিলা তার দিকে ছুটে আসছে।
ওরা এল আহমদ মুসার কাছে। পুরুষটি আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বলল, ‘আপনার ডান পাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আপনাকে এখনি হাসপাতালে নেয়া দরকার।’
‘আক্রমণের গোটা ঘটনা আমরা দাঁড়িয়ে দেখেছি, আমরা কিছু করতে পারিনি, দুঃখিত। লোকজন ডাকার কথাও মনে হয়নি। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল!’ মহিলাটি বলল।
পুরুষটির বয়স চল্লিশ প্লাস হবে। মহিলাটির বয়সও চল্লিশ হবে। দু’জনেরই পরনে বিকেলের ওয়াকিং ট্রাউজার। পুরুষটির গায়ে ফুল টি-শার্ট, আর মহিলাটির গায়ে হালকা ফুলহাতা জ্যাকেট। দু’জনের কথাবার্তায় শিষ্টাচার ও চোখে আন্তরিক সমবেদনা।
আহমদ মুসা মেয়েটির কথার উত্তরে বলল, ‘ধন্যবাদ। এ ধরনের আকস্মিক ঘটনায় বাইরে থেকে কিছু করার থাকে না।’
‘এখনি আপনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। মাথার ডান পাশ ও বাঁ কাঁধের আঘাত সাধারণ নয়।’ বলল পুরুষটি।
‘হাস্পাতাল-ক্লিনিকে আমি যাব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বাসায় ফিরব। পার্কের উত্তর গেটে আমার গাড়ি আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। একটু সামনেই আমাদের বাড়ি। আমরা দু’জনেই ডাক্তার। আপনাকে কিন্তু আমরা এ অবস্থায় কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারি না।’ বলল পুরুষটি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার ইথিকসকে আমি ভাঙতে বলতে পারি না। চলুন।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ডাক্তার পুরুষ ও মহিলা দু’জন হেঁটেই পার্কে এসেছিল। আহমদ মুসাকে নিয়ে তারা আহমদ মুসার গাড়িতেই উঠল।
ডাক্তার পুরুষটি ড্রাইভিং সিটে বসল। ডাক্তার মহিলাটি পেছনের সিটে আহমদ মুসার পাশে বসল।
‘আপনি ঠিক তুর্কি নন বলে মনে হয়। কোথায় থাকেন আপনি?’
‘রোমেলী দুর্গের এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।’ বলল আহমদ মুসা।
ডাক্তারদের বাড়ি দূরে নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল তারা।
মাথা, কান ও কাঁধের ড্রেসিং শেষ করতে এক ঘন্টা সময় লেগে গেল। মাথার ডান পাশটা থেঁতলে অনেকটা চামড়া উঠে গিয়েছিল। কান কয়েক জায়গায় ফেটে গিয়েছিল। কাঁধের বাহুর সন্ধিস্থলের জায়গাটাও দারুণ থেঁতলে গিয়েছিল। কোন ফ্র্যাকচার হয়েছে কিনা, এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না।
ডাক্তার দু’জনে মিলে ড্রেসিং-এর কাজটা করল।
ড্রেসিং শেষে সবকিছু সরিয়ে দু’হাত পরিষ্কার করে ওরা দু’জন ফিরে এলে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমাকে নিশ্চয় এখন ছুটি দেবেন?’
কথা শেষ করেই আবার দ্রুত বলে উঠল, ‘ওহো, আপনাদের নামটাও জানা হয়নি। ডাক্তারদের নাম জেনে রাখা ভালো।’
ডাক্তার পুরুষটি বলল, ‘আমার নাম ডাঃ ইয়াসার তইফুন, আর ওর নাম ডাঃ রাসাত কাসাভা।’
বলে ডাঃ ইয়াসার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনার নামও কিন্তু জানা হয়নি।’
‘আমার নাম খালেদ খাকান।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিকই ভেবেছি, আপনার তুর্কি অরিজিন আছে। নামটাও তুর্কি। খুশি হলাম। এবার আসুন পাশের ঘরে।’
‘কেন?’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
পাশের ঘরটা একটা বেডরুম। গেস্টরুমই হবে। একটা খাট। খাটের বিপরীত দিকে এক সেট সোফা সুন্দর করে সাজানো। আর ঘরে আছে একটা ওয়্যারড্রোব, একটা ছোট ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার।
ঘরে ঢুকে ডাক্তার ইয়াসার বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনাকে ঘন্টাখানেক রেস্ট নিতে হবে। আপনার শরীর থেকে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে। হাসপাতালে নিলে রক্ত দেয়ার কথা উঠতো।’
‘তথাস্তু’ বলে শুয়ে পড়তে পড়তে আহমদ মুসা বলল, ‘ডাক্তারের হিসেব ও আমার হিসেব ভিন্ন। যা রক্ত গেছে, আরও ততটা রক্ত গেলেও আমি রক্ত নিতাম না।’
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত একটু পিছিয়ে সোফায় বসল। বসতে বসতে ডাঃ ইয়াসার বলল, ‘আপনার কথা এক দিক দিয়ে ঠিক মিঃ খালেদ খাকান। আমি আপনার মতো বিস্ময়কর পেশেন্ট কোন দিন পাইনি। আপনাকে যে ধরনের ড্রেসিং করতে হয়েছে, তাতে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া অপরিহার্য ছিল। আপনি অ্যানেসথেসিয়া নিলেন না। আমি বিস্মিত হয়েছি, ড্রেসিং-এর সময় আপনার চোখে-মুখে বেদনার সামান্য ভাঁজও পড়েনি। এ ধরনের শক্ত নার্ভ কারও থাকতে পারে, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল।’
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে উঠল ডাঃ ইয়াসার, ‘আপনার সত্যিই কোন অনুভূতি নেই?’
‘অনুভূতি তো জীবনের লক্ষণ। ওটা তো থাকতেই হবে। আসলে অনুভূতির প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় ধৈর্য্যের দ্বারা। ধৈর্য্য নার্ভ বা অনুভূতিকে সীমাহীন শক্তি দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ধৈর্য্য নার্ভকে সীমাহীন শক্তি দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ধৈর্য্য একজন অসাধারণেরই শুধু থাকতে পারে, সাধারণের নয়। আমার মনে হচ্ছে, এই অসাধারণের মধ্যে একজন আপনি। আল-আলা পার্কে আপনার ওপর হামলার সময়ও কিন্তু এটা আপনি প্রমাণ করেছেন। প্রথমেই যে পরিমাণ আহত আপনি হন, তাতে দু’জন রিভলভারধারীসহ চার জনের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হওয়া সত্যি একজন অসাধারণের কাজ। আপনার বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা ও কৌশল আমাদের সত্যিই অভিভূত করেছে। আপনার প্রফেশন কি বলবেন দয়া করে?’ ডাঃ রাসাত কাসাভা বলল।
‘একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আমি একজন ব্যবস্থাপনা এক্সিকিউটিভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি গবেষণাগার?’ জিজ্ঞাসা ডাক্তার ইয়াসারের।
‘ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান।’
‘আপনি তো দেখছি একজন প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবী। এদিক থেকে আপনি একজন নির্বিরোধ ব্যক্তি। আপনাকে এভাবে ওরা আক্রমণ করল ক্বেন? কারা ওরা? ওদের আপনি চেনেন? কি উদ্দেশ্য ওদের?’ বলল ডাক্তার ইয়াসার।
‘আপনার কোন প্রশ্নেরই জবাব আমার কাছে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার মনে হয়, পুলিশে আপনার খবরটা দেয়া উচিত।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আইনের কথা তাই। কিন্তু আমি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’
‘কিন্তু ঝামেলা তাতে আরও বাড়বে। ওরা সাহস পেয়ে যাবে। আবারও আক্রমণ করতে পারে ওরা।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আমি অফিসে গিয়ে পরামর্শ করে দেখব। তবে আমি এসবে ভয় পাই না। যদি আল্লাহ না চান, কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর চাইলে পুলিশ কিংবা কেউ আমাকে বাঁচাতেও পারবে না।’
‘আপনি তো দেখছি একজন গোঁড়া অদৃষ্টবাদী!’ ডাঃ রাসাত কাসাভা বলল।
‘এটা বিজ্ঞান-মনস্কতাও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিজ্ঞান-মনস্কতা?’ বলল ডাঃ রাসাত কাসাভা। তার চোখে-মুখে কৌতুকের চিহ্ন।
‘কেন, বিজ্ঞান বলছে না মানুষের বংশ-গতি, জীবন-গতি সবকিছু মানবদেহের ‘জীন’ কণার মধ্যে ‘এনকোডেড’ রয়েছে!’
ডাঃ রাসাত ও ডাঃ ইয়াসার দু’জনেরই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বলল ডাঃ রাসাত, ‘আপনি সত্যিই বিস্ময়কর মানুষ। সুন্দর কথা বলেন। কিন্তু বলুন তো, আপনি যদি চার জনের সাথে ফাইট না করতেন, তাহলে ‘জীন’ কি আপনাকে রক্ষা করতো?’
‘চার জনের সাথে আমি ফাইট করবো এবং জয়ী হবো, সেটা আল্লাহতায়ালা ‘জীন’-এ এনকোডেড করে রেখেছেন।’
হো হো করে হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই। ডাঃ রাসাত বলল, ‘আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না। তবে আপনি খুব হালকা কথার মধ্যে খুব ভারি কথা বলেছেন। আপনার মতো বিশ্বাস যাদের থাকে, তারাই অজেয় হন।’
‘আপনারা কি বিশ্বাসী নন? আপনাদের মধ্যে কি বিশ্বাস নেই?’ বলল আহমদ মুসা।
উত্তর দেয়ার জন্যে মুখ খুলেছিল ডাঃ ইয়াসার।
ঘরের আর একটা দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল একজন তরুণী। অপরূপা সুন্দরী তরুণী, যেন ডানাকাটা পরী।
মেয়েটি বলতে বলতে প্রবেশ করছিল, ‘বিশ্বাস আছে জনাব, কিন্তু তার অ্যাকশন নেই। আছে বিশ্বাস, কিন্তু তার জীবন নেই। বিশ্বাস আছে অবশ্যই জনাব, কিন্তু সেটা অবাঞ্ছিত গরীব আত্মীয়ের অসহ্য উপস্থিতির মতো, যাকে ফেলাও যায় না, রাখাও যায় না।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা মেয়েটির বাচনভংগীতে। বলল, ‘আপনি অবস্থার একটা চমৎকার ডেফিনিশন দিয়েছেন।’
বলেই আহমদ মুসা ডাক্তার ইয়াসার ও ডাক্তার রাসাতের দিকে চেয়ে বলল, ‘এই ডেফিনিশন সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?’
আহমদ মুসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ডাঃ রাসাত মেয়েটিকে দেখিয়ে হাসিতে মুখ রাঙিয়ে বলল, ‘ও সাবাতিনি ইয়াসার। আমাদের মেয়ে। কয়েকদিন হলো ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। খুব পড়ুয়া, টকেটিভও। পাশের রুমে তার স্টাডিতে বসে পড়েছিল। কথা বলার সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।’
‘ঠিক বলেছেন আম্মা। আমি পড়ার টেবিলে বসে আপনাদের ইন্টারেস্টিং আলোচনা শুনছিলাম। শেষে মিঃ খালেদ খাকান এমন প্রশ্ন আপনাদের করেছেন, যে প্রশ্নের সঠিক জবাব আপনারা দেবেন না ভেবেই আমি বেরিয়ে এসেছি সত্য জবাবটা দেয়ার জন্যে। আপনাদের ঠোঁটে ঈশ্বর আছে, কিন্তু বুকে ঈশ্বর নেই।’ বলল সাবাতিনি ইয়াসার।
‘সুন্দর ডেফিনিশন এবং স্পষ্ট কথার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কি জানতে পারি, আপনার ঈশ্বর আপনার কোথায় মানে ঠোঁটে না বুকে রয়েছে?’ আহমদ মুসা বলল।
মেয়েটির দুই ঠোঁট হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘জবাব আছে। তার আগে বলব, আমি বয়সে আপনার ছোট। আপনি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলায় আমি অস্বস্তি বোধ করছি। এ অস্বস্তি নিয়ে আপনার সাথে আমার কোন কথা হবে না।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ঠিক আছে সাবাতিনি, বল তোমার উত্তরটা।’
‘জবাবটা আপনি দিয়ে রেখেছেন। ঐ যে বলেছেন মানবদেহের ‘জীন-কোষ-কণা’র বংশ-গতির কথা। সে বংশ-গতির আমিও শিকার। আমার বিশ্বাস আমার পূর্বসূরীদের মতোই তো হবে।’ বলল সাবাতিনি।
‘তোমার এই উত্তরটা কিন্তু সত্য বা সংগত হলো না সাবাতিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন নয়? আমি তো বিজ্ঞানের কথা বলেছি, যেটা আপনিও বলেছেন।’ বলল সাবাতিনি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সাবাতিনি, আল্লাহর দেয়া দৈহিক ব্যবস্থা ‘জীন’-এর বংশ-গতি কিন্তু মানব জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে না। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এই ইচ্ছাশক্তিই মানুষের বিশ্বাস ও কর্মকে রূপায়িত করে পরিচালনা করে। এই কারণেই দেখ এক বিশ্বের, এক দেশের, এমনকি এক বাড়ির মানুষ বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন বিশ্বাস ও বিভিন্ন কর্মধারা অনুসরণ করে। বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির প্রভাবেরই এটা ফল।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে সাবাতিনি ইয়াসারের মুখ। বলল, ‘বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তি, বিভিন্ন ‘জীন-কণা’ যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তির পরিচালক হয়ে দাঁড়ায়, ইচ্ছাশক্তি তাহলে স্বাধীন থাকছে না।’
‘তুমি বলতে চাচ্ছ, একই বংশে, একই বাড়িতে বিভিন্ন জীনই বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির উৎস এবং তা যদি হয়, তাহলে ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন নয়। এই মত ঠিক নয় এই কারণে যে, একজন মানুষ তার জীবনে তার বিশ্বাস ও কর্মধারা একাধিক বা বহুবার চেঞ্জ করতে পারে এবং আমাদের চোখের সামনেই তা করছে। কিন্তু একজন মানুষের দেহ-কোষের ‘জীন-কণা’ তো এভাবে চেঞ্জ হতে পারে না, চেঞ্জ হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ‘জীন’ চেঞ্জ হয় না, কিন্তু ইচ্ছা চেঞ্জ হয়। এর পরিষ্কার অর্থ ইচ্ছাশক্তি ‘জীন’ নির্ভর নয়, স্বাধীন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই ডাঃ রাসাত বলে উঠল, ‘ইচ্ছা যে কোন বিশ্বাস, যে কোন কর্মধারা চয়েস করতে পারে, যেহেতু সে স্বাধীন। কিন্তু এই চয়েস তো সত্য, মিথ্যা, ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দের বিচারে চূড়ান্ত নয়। কারণ চয়েস দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন হচ্ছে, কিন্তু সত্য, ন্যায়, ভালো তো একটাই, বিভিন্ন নয়।’
‘ঠিক ধরেছেন ডাঃ রাসাত। মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু অন্ধ। ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু এর নিজস্ব কোন রূপ নেই, রঙ নেই। ইচ্ছাশক্তি একটা সিদ্ধান্ত, যা ঠিক করতে, ভুলও করতে পারে বা ভালো করতে পারে, আবার মন্দও করতে পারে, যা সত্য পথে চলতে পারে, আবার ভুল পথেও চলতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যে ইচ্ছাশক্তি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মধারার চালিকাশক্তি, সে ইচ্ছাশক্তি এমন অন্ধ হওয়াটা তো মানুষের জন্যে বিপজ্জনক। শুধু বিপজ্জনক নয়, ধ্বংসকারীও।’ বলল ডাঃ রাসাত। গম্ভীর তার কণ্ঠ।
‘ঠিক ডাঃ রাসাত। সত্যিই সব মানুষ এক বিপজ্জনক ও ধ্বংসকরী অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে একটা ছোট্ট সূরা রয়েছে। তার নাম ‘আসর’ বা ‘কাল’। এই সূরা বা ভার্স-এ আল্লাহতায়ালা ‘কাল’-এর (যে কাল মানুষের ক্ষতি ও সফলতার সাক্ষী) শপথ করে বলেছেন, নিশ্চয় সব মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, শুধু তারা ছাড়া যারা বিশ্বাসী, যারা সৎকর্মশীল এবং যারা সত্য ও ধৈর্য্যের উপদেশ দেয়। এই ভার্স-এ একথা…….।’
‘স্যরি, আমি জানতে চাচ্ছি, ইচ্ছাশক্তি যদি অন্ধ হয় এবং তা যদি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মধারার পরিচালক হয়, তাহলে অন্ধ ইচ্ছাশক্তির হাত থেকে বেঁচে মানুষ নিশ্চিতভাবে অবিশ্বাসী না হয়ে সুবিশ্বাসী, অসৎকর্মশীল না হয়ে সৎকর্মশীল হবে কি করে?’ বলল দ্রুতকণ্ঠে সাবাতিনি ইয়াসার।
‘বলছি সাবাতিনি। বলেছি, মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ইচ্ছাশক্তির বিচারবোধ বা জ্ঞানচক্ষু নেই, এই অর্থেই সে অন্ধ। এই অন্ধ ইচ্ছাশক্তিকে পথ চেনাবার জন্যে আল্লাহ মানুষকে ‘অন্ধের যষ্টি’ও দিয়েছেন। এই ‘অন্ধের যষ্টি’ হলো মানুষের বিবেক ও জ্ঞান। ইচ্ছাশক্তির সাথে সাথে আল্লাহ মানুষকে এই দুই জিনিস দিয়েছেন, যাতে মানুষের ইচ্ছাশক্তি সঠিকভাবে চলার দিক নির্দেশনা পায়। ইচ্ছাশক্তির দিক নির্দেশনা স্বরূপ এই দুই জিনিসের মধ্যে ‘বিবেক’ খারাপ-ভালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে সমানভাবে আছে। আর দ্বিতীয় বিষয় ‘জ্ঞান’ মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। জ্ঞানের আবার দু’টি উৎস রয়েছে। একটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আসা ‘ওহী’র জ্ঞান, অন্যটি জাগতিক শিক্ষা থেকে অর্জিত জগৎ বিষয়ক জ্ঞান। ওহীর জ্ঞান মানুষকে ‘বিশ্বাস’ ও ‘কর্মপদ্ধতি বা কর্মধারা’ সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে মংগলের পথে, ন্যায়ের পথে, শান্তি-স্বস্তির পথে, পরকালীন ভালোর পথে পরিচালনার জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান অনুসরণ অপরিহার্য। ইচ্ছাশক্তির হাতে যদি ‘অন্ধের যষ্টি’ ‘বিবেক’ ও ‘ওহী’র জ্ঞান না থাকে, তাহলে ইচ্ছাশক্তির যাত্রা হয় বিপজ্জনক, ধ্বংসকরী।’
‘‘ওহী’র জ্ঞান থাকলে ‘বিবেক’-এর কি প্রয়োজন আছে? এ দুইয়ের পার্থক্য কি, সম্পর্ক কি?’ জিজ্ঞাসা সাবাতিনির।
আহমদ মুসা বলল, ‘বিবেক হলো মানব মনের ভালো-মন্দ বাছাইয়ের একটা সহজাত শক্তি। এটা সকল মানুষের ‘জীন’-এ এনকোডেড একটা কমন বিষয়। অন্যদিকে ‘ওহী’র জ্ঞান হলো আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তাঁর নবী-রাসূলদের মাধ্যমে পাঠানো মানুষকে মঙ্গল ও মুক্তির পথে পরিচালনার জন্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন-পদ্ধতি। ‘বিবেক-জ্ঞান’ ও ‘ওহী’র জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হলো, ‘বিবেক-জ্ঞান’ বলতে পারে কাজটি ভালো না মন্দ, গ্রহণীয় না বর্জনীয়। কিন্তু ‘বিবেক-জ্ঞান’ মানুষকে মঙ্গল ও মুক্তির পথে পরিচালনার জন্যে কোন করণীয় ও কর্মপ্রণালী তৈরি করে না। এমনকি ‘বিবেক-জ্ঞান’ একজন স্রষ্টা আছেন, এমন একটা অনির্দিষ্ট অনুভূতি দান করা ছাড়া স্রষ্টার পরিচয়, স্রষ্টার ইচ্ছা, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই বলতে পারে না। বিবেকের পক্ষে পারা সম্ভব নয়, এমন সব জ্ঞানের বিশ্বাস নিয়েই নবী-রাসূলরা দুনিয়ায় এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে। মানুষের জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান সুনির্দিষ্ট করার পর বিবেক-জ্ঞান কেন প্রয়োজন, এ প্রশ্নও উঠতে পারে। এক্ষেত্রে অনুধাবনের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ‘ওহী’র জ্ঞান মানব মনের সহজাত প্রবণতায় সাধারণভাবে এনকোডেড কোন বিষয় নয়, এটা আয়ত্ত সাপেক্ষ, যা প্রচারের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছার কথা। কিন্তু দুনিয়ার সব জায়গার সব মানুষের কাছে এই প্রচার নাও পৌঁছতে পারে। সেক্ষেত্রে বিবেক-জ্ঞান হবে তাদের অবলম্বন, যার কাছ থেকে তাদের ইচ্ছাশক্তি পাবে দিক-নির্দেশনা। ‘ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই সাবাতিনি বলে উঠল, ‘আপনার শেষের কথায় একথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, ‘ওহী’র জ্ঞান পৃথিবীর সব জায়গায় সব মানুষের কাছে পৌঁছা দরকার। না হলে তারা ঠকবে, একমাত্র এবং অনির্দিষ্ট বিবেক-জ্ঞান নিয়েই তাদের চলতে হবে এবং তার ফলে জীবন-পরিচালনার সঠিক নির্দেশনা থেকে তারা বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষের কাছে ‘ওহী’র জ্ঞানের কি প্রচার হচ্ছে? না হলে তার উপায় কি? দ্বিতীয় বিষয় হলো, ‘বিবেক-জ্ঞান’ যেভাবে মানব প্রবণতার একটা সহজাত বিষয় হিসেবে ‘এনকোডেড’ হয়েছে, সেভাবে ‘ওহী’র জ্ঞান মানব-প্রবণতার সহজাত বিষয় হিসেবে এনকোডেড হলে দুনিয়ার কেউই তাহলে এই জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকতো না। এ বিষয় সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সাবাতিনি, তোমার শেষ বিষয় থেকেই শুরু করি। ‘বিবেক-জ্ঞান’ অপরিবর্তনশীল। দুনিয়ার প্রথম মানুষের এই জ্ঞান যেমনি ছিল, দুনিয়ার শেষ মানুষেরও তেমনি থাকবে। এজন্যে বিবেক-জ্ঞান শুরুতেই সর্বকালের মানুষের জন্যে এনকোডেড করা গেছে। কিন্তু ওহীর জ্ঞান পরিবর্তনশীল। সময় ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ‘ওহী’র জ্ঞানভিত্তিক জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়ে আসছে। এই পরিবর্তনশীলতার জন্যে ‘বিবেক-জ্ঞান’-এর মতো একে ‘এনকোডেড’ করা হয়নি। আধুনিক কালে এসে পরিবর্তন প্রয়োজনের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে মানবজাতির জন্যে সর্বশেষ ও আগামী সর্বকালের জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান বা ওহীভিত্তিক জীবন-পদ্ধতি প্রেরণের মাধ্যমে। ‘ওহী’র জ্ঞান সহজাত প্রবণতার ন্যায় এনকোডেড (Encoded) না হবার আরেকটা কারণ হলো, এই জ্ঞান প্রকৃতিজাত বা সহজাত হলে একে মানুষের জন্যে পরীক্ষার বিষয় করা যেত না। অথচ কে ভালো হতে চায়, কে চায় না- এই পরীক্ষা মানব সৃষ্টির সবচেয়ে বড় বিষয়। এর মাধ্যমেই পরকালীন জীবনের জন্যে পুরষ্কার বা তিরস্কার নির্ধারিত হবে।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আপনি ধর্মবেত্তা বা বিজ্ঞান-বেত্তা অথবা দার্শনিক হলে ভালো হতো। আমার অনার্সের সাবসিডিয়ারী বিষয়ের একটি হলো ধর্ম। আমাদের স্যাররা কিন্তু আপনার মতো এত গভীর, সেই সাথে সর্বাধুনিক দৃষ্টিভংগীর ধারে-কাছে নেই। আপনি বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু এসব বিষয়ে আমার আপনাকে বিরক্ত করার সম্ভাবনা আছে। যাক, আপনি একটা সাংঘাতিক কথা বলেছেন। আপনি ইসলামকে সর্বশেষ এবং আগামী সর্বকালের ধর্ম বা জীবন-পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করে সব ধর্মকে বাতিল করে দিয়েছেন।’ বলল সাবাতিনি ইয়াসার।
‘আমি বাতিল করিনি। স্বাধীন নিয়মেই সব বাতিল হয়ে যাবার কথা। নতুন সংবিধান চালুর অর্থ আগের সংবিধান আর নেই। এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম এর বাইরে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
সাবাতিনি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাঁধা দিয়ে ডাঃ ইয়াসার বলে উঠল, ‘আর নয় সাবাতিনি। উনি সুস্থ নন। ওকে একটু রেস্ট নিতে দাও।’
‘স্যরি আব্বা, স্যরি জনাব। তবে আমি অপ্রয়োজনীয় কিছু বলিনি।’ বলল সাবাতিনি প্রথমে তার আব্বা, পরে আহমদ মুসার দিকে ঘুরে।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি যতক্ষণ ইচ্ছা রেস্ট নিন, তবে এক ঘন্টার কম নয়। আমরা পাশের ঘরেই আছি।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘ধন্যবাদ ডাক্তার।’ বলে একটু থেমেই আবার সাবাতিনিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন, আপনার বাড়ির অপজিটে রাস্তার পশ্চিম পাশে বাগান ঘেরা বড় বাড়িটা কার?’
‘কেন, বাড়িটা ভালো লেগেছে আপনার? ভালো লাগলেও লাভ নেই। ওটা ‘সিনাগগ’। শুধু সিনাগগও নয়, ওটা একটা জুইশ কমপ্লেক্স। ওকে শুধু ইস্তাম্বুল নয়, তুর্কি জুইশদের রাজধানীও বলতে পারেন।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা মুখে বেজার ভাব এনে বলল, ‘আমি হতাশ হলাম।’
কিন্তু বাড়িটার এই পরিচয় পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে আহমদ মুসা। আজ পুলিশ আর্কাইভসে পাঁচ গোয়েন্দা নিখোঁজ হওয়ার দিনের নির্দিষ্ট সময়ের সিসিটিভির এই রাস্তার মনিটরিং-এর ছবিগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে সে দেখেছে, পাঁচ গোয়েন্দাকে বহন করা গাড়িটি সর্বশেষ ঐ বাড়িতেই প্রবেশ করে। গাড়িটার বের হবার দৃশ্য পরবর্তী চার-পাঁচ ঘন্টার মনিটরিং-এর ছবি পরীক্ষা করেও আর সে পায়নি। এর অর্থ, এখান থেকেই পাঁচ গোয়েন্দা এবং তাদের গাড়িটা উধাও হয়েছে।
‘বাড়িটার কি কি সুন্দর লেগেছে আপনার কাছে?’ জিজ্ঞেস করল ডাঃ রাসাতই আবার।
‘সবই সুন্দর লেগেছে। যে টিলার ওপর বাড়িটা, তা আনকমন। এই আয়তনের কোন টিলার এত প্রশস্ত ফেস খুবই দুর্লভ। বাড়িটার বিশালত্ব এবং দুর্গ ধরনের বৈশিষ্ট্য দৃষ্টি আকর্ষণের মতো। বাড়িটা যেন চারদিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে তার নিরাপত্তা ও নিরিবিলি পরিবেশকে অখণ্ড করে তুলেছে। বাড়ির মিছিলে থেকেও সে যেন একা, ভিন্নতর, স্বতন্ত্র। চারিদিকে হৈ চৈ, কিন্তু সে মৌন।’ থামল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল ডাঃ রাসাত, ডাঃ ইয়াসার এবং সাবাতিনি একসাথে। বলল ডাঃ রাসাত, ‘বাড়িটা সব সময় আমাদের নজরে আসে কিন্তু কখনও বিশেষ বলে মনে হয়নি। অথচ আপনার বর্ণনা শুনে বাড়িটা আমার কাছে সবিশেষ হয়ে উঠেছে। আমরাও যেন ভালোবেসে ফেলছি বাড়িটাকে বর্ণনার মাধুর্যে। আপনি কি কবি না শিল্পী?’
‘দুই-ই আম্মা। কবির কথামালা, শিল্পীর তুলি যেমন সাধারণকে অসাধারণ এবং অরূপকেও অপরূপা করে, উনিও তাই করেছেন।’ বলল সাবাতিনি। তার চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত এক বিমুগ্ধতা। তার অতল নীল চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলার এক আনমনা দৃষ্টি।
‘চাঁদের কলঙ্কের মতো বাড়িটার কিছু দোষও আছে। বাড়িটাতে কোন প্রাণের স্পন্দন নেই। বাড়িটার বড়, ভারি সিংহদ্বারটি আমার কাছে কারাগারের নিষ্ঠুর দরজা বলে মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
আবারও হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত।
কিন্তু গম্ভীর সাবাতিনি বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনার অনুভূতি এত স্পর্শকাতর জনাব!’ সাবাতিনির কণ্ঠে কম্পিত এক আবেগ।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনার অনুভূতিটা ঠিক। বাড়িটার বিরাটত্ব, গেটে দারোয়ান না থাকা, গেট ঘন ঘন না খোলা ইত্যাদি কারণে আপনার এই অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাড়িটা প্রাণহীন নয়, বাড়িতে লোক আছে। গেট ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত। গেটের সামনে লোক গেলেই ভেতর থেকে টিভি স্ক্রীনে তাকে দেখা যায় আর তখন দরজা খুলে দেয়া হয়। বাড়িটা পারিবারিক নয় বলে মানুষের আনাগোনা, যাতায়াত কম। যারা ওখানে আসেন, নির্দিষ্ট সময়গুলোতে আসেন।’ সাবাতিনির কথা শেষ না হতেই বলল ডাঃ রাসাত।
‘তাই হবে। কিন্তু শনিবার সিনাগগে প্রচুর ভিড় হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতো। কিন্তু পাশেই সিজলি বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-এ সম্প্রতি আরেকটা সিনাগগ হয়েছে। ভিড়টা ওখানে চলে গেছে। এ সিনাগগে ইস্তাম্বুলের জুইশ দায়িত্বশীলরা আসেন। ইস্তাম্বুলের বাইরে থেকেও দায়িত্বশীলরা আসেন। এখন বলা যায়, এটা বিশেষ সিনাগগ। এখানে প্রার্থনার অনুষ্ঠান দীর্ঘ হয়। কারণ, প্রার্থনার সাথে মিটিং-সিটিংও থাকে।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা মনে মনে ধন্যবাদ দিল রাসাতকে। বাড়িটা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল। ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক এক রূপরেখাও অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্য কিছু না ঘটলে পাঁচ গোয়েন্দা এই ভবনে ঢুকেই নিখোঁজ হয়েছে। এটাই আজকের বড় পাওয়া। আনন্দিত কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘অনেক কথা হলো। মন ভালো লাগছে আমার। আঘাতের বেদনাও যেন কমে গেছে। আমাকে রিলিজ করলে খুশি হই।’
‘রিলিজ আপনি হয়েই আছেন। আপনি যেহেতু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করবেন, এজন্যেই বলছি, আপনি কিছু সময় রেস্ট নিন। আর এখনই যদি যেতে চান, তাহলে আপনার ড্রাইভ করা হবে না, আমরাই আপনাকে পৌঁছে দেব।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘না ডাক্তার, আপনাদের আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। রেস্ট নেয়া আমার জন্যে ভালো আর আপনাদেরও কষ্ট দেয়া থেকে বাঁচা যাবে। এই চোখ বুজলাম, ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা বালিশে মাথাটা রাখল।
‘ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান। আমরা ওপাশের ঘরটায় আছি।’
বলে ডাঃ ইয়াসার ঘর থেকে বের হবার জন্যে পা বাড়াল। তার সাথে ডাঃ রাসাতও।
‘আমিও আসছি জনাব। আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।’ বলল সাবাতিনি।
‘শেষ হবার কথা নয়। একজন ছাত্রীর জন্যে এটাই স্বাভাবিক। ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলে সাবাতিনি পাশের ঘরে ঢুকে গেল।

Top