৪৫. বসফরাসের আহ্বান

চ্যাপ্টার

মোবাইলে রিং শুনে আহমদ মুসা চোখ খুলল। ডান হাত দিয়ে বালিশের পাশের মোবাইলটি অন করল আহমদ মুসা। অভ্যাসমতো ডান পাশ ঘুরে বাম হাত দিয়ে মোবাইল নিয়ে কানে তুলতে চাইল।
অন্যদিনের মতোই ডান পাশ ঘুরতে গেল আহমদ মুসা। তখন মাথা ও ডান কাঁধের ব্যথায় প্রচন্ড ঘা লাগল। মুখ থেকে ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে এল আপনাতেই। পাশ ফিরতে পারল না আহমদ মুসা।
বাঁ হাত ঘুরিয়ে মোবাইল নিয়ে চোখের সামনে ধরল। মোবাইল স্ক্রীনে ‘DJ’ শব্দ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডোনা জোসেফাইনের টেলিফোন! নিশ্চয় সে তার বেদনাজড়িত আর্তকণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। আহমদ মুসা তার আহত হওয়ার খবর গত রাতে ডোনা জোসেফাইনকে জানায়নি। ভেবেছিল, তেমন বড় আঘাত নয়, তাকে অহেতুক চিন্তায় ফেলার দরকার নেই। এখন জানতে পারলে তো সে কেন গোপন করেছি তা নিয়ে মন খারাপ করবে। একই শহরে কয়েক মাইলের ব্যবধানে দু’জন থাকছি, সন্ধ্যার এত বড় খবর সকাল নয়টা পর্যন্ত জানানো হয়নি, এই দায়িত্বহীনতা আড়াল করার মতো নয়। যাক, যা হবার হয়েছে। বেশি রাতের ব্যাপার, সুযোগ পায়নি টেলিফোন করতে, এটাই বলার মতো একটা কথা।
পরিকল্পনা অনুসারে একই প্লেনে একই দিনে আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন ইস্তাম্বুল এসেছে। থাকার জায়গাও দু’জনের দু’জায়গায়। দু’জনেই ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে থাকছে। কিন্তু ডোনা জোসেফেইনের থাকার জায়গা করা হয়েছে গোল্ডেন হর্নের দক্ষিণে আদি ইস্তাম্বুল অংশে।
ডোনা জোসেফাইনের থাকার এলাকা সিলেকশন তার নিজের। ওসমানীয় খলিফারা যেখানে বসে পাঁচশ’ বছর ধরে ইউরোপ ও এশিয়া শাসন করেছিল, গোল্ডেন হর্নের উত্তরের সেই ইস্তাম্বুলে থাকার জন্যে পছন্দ করেছিল ডোনা জোসেফাইন। কিন্তু যে স্থানে থাকতে চেয়েছিল, সেই স্থান সে পায়নি। তার পছন্দ ছিল আইয়ুব সুলতান মসজিদের আশে-পাশে কোথাও থাকা, যাতে মসজিদটিতে ইচ্ছেমতো নামায পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে সেখানে রাখার ব্যবস্থা তুর্কি সরকার করতে পারেনি। ঐ এলাকায় প্রেসিডেন্সিয়াল কোন অতিথি ভবন নেই। পরিবর্তে ডোনা জোসেফাইনকে যেখানে রাখা হয়েছে, সেটা ধর্মীয় আবেগের দিক দিয়ে না হলেও ঐতিহ্য-আবেগের দিক দিয়ে অতুলনীয়। মর্মর সাগর, বসফরাস প্রণালী এবং গোল্ডেন হর্ন একসাথে আছড়ে পড়ছে ঈগলের ঠোঁটের মতো যে ভূ-খণ্ডের ওপর, সেখানেই ওসমানীয় খলিফাদের পাঁচশ’ বছর শাসন পরিচালনার গৌরব-দীপ্ত কেন্দ্র ‘তোপকাপি’ প্রাসাদ। এই প্রাসাদ এলাকা সংরক্ষিত এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীন। এই প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে মর্মর সাগর, বসফরাস, গোল্ডেন হর্নের আছড়ে পড়া পানির আরও নিকটে প্রাসাদ এরিয়ার মধ্যেই রয়েছে হাই সিকিউরিটি ব্যবস্থার অধীন একটা প্রেসিডেন্সিয়াল ভবন। তোপকাপি প্রাসাদে এলে প্রেসিডেন্ট এখানে বিশ্রাম নেন। এই ভবনে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট ছাড়াও ভিভিআইপি প্রেসিডেন্সিয়াল অতিথিদের জন্যে আছে আরও কিছু স্যুইট। এই স্যুইটের একটা দেয়া হয়েছে ডোনা জোসেফাইনকে। তার স্যুইটের বারান্দায় বসে মর্মর সাগর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আইয়ুব সুলতান মসজিদের আশেপাশে থাকার ইচ্ছে পূরণ না হলেও তোপকাপি প্রাসাদের সান্নিধ্যে কল্পনার মর্মর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নকে হাতের মুঠোয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছে ডোনা জোসেফাইন। স্যুইটে উঠেই ডোনা জোসেফাইন টেলিফোন করে তার আবেগের কথা আহমদ মুসাকে জানিয়েছে।
কোন জরুরি প্রয়োজন না হলে ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসাকে দিনে-রাতে দু’বারের বেশি টেলিফোন করে না। দু’বার টেলিফোনের একটা রাত দশটায় আর দ্বিতীয়টা হলো সকাল নয়টায়।
মোবাইল কানের পাশে নিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ জোসেফাইন?’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। তুমি অসুস্থ! তোমার কি হয়েছে? তুমি তো এমন কঁকিয়ে ওঠ না সাধারণ কোন বেদনাতেই?’
‘মোবাইলটা নেয়ার জন্যে হঠাৎ পাশ ফিরেছিলাম। অজান্তেই ব্যথা পেয়েছি, অজান্তেই শব্দটা বেরিয়ে এসেছে। তোমাকে বলা হয়নি, একটা সুখবর হলো, গতকাল নতুন শত্রুদের সাক্ষাৎ মিলেছে। কিন্তু খারাপ খবর হলো, ওদের ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’-এর মতো আক্রমণে মাথার ডান পাশ ও কাঁধ আহত হয়েছে। ঐ ব্যথাতেই ডান পাশ ফিরতে পারছিলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, তুমি বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে দেখছ। এমনটা যদি হয়, তাহলে কিন্তু আমি মর্মর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্ন-তীরের আরাম-আয়েশের এই অবকাশ কেন্দ্র ছেড়ে উঠব তোমার আলালা পাহাড়ের সরাইতে।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘স্যরি জোসেফাইন, আমি সাড়ে দশটায় রোমেলী দুর্গে ফিরেছি। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়ার কথা। তোমাকে ঘুম থেকে তুলে এই দুঃসংবাদটা দেয়া আমি ঠিক মনে করিনি। আর ভোরে নামায পড়েই আবার আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
জোসেফাইনের জবাব সংগে সংগে এলো না। একটু সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ। মাথার ডান পাশের আঘাতটা তোমার কেমন? তুমি এখানে এস, না হলে কিন্তু আমি ওখানে যাব।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘না জোসেফাইন, তেমন বড় আঘাত নয়। যেখানে আহত হই, সেখান থেকেই দু’জন ডাক্তার দম্পতি আমাকে তাদের বাসায় নিয়েছিলেন। ওরাই চিকিৎসা করেন। আমি ওখানে দু’ঘন্টার মতো বিশ্রাম নেয়ার পর বাসায় ফিরেছি। আমিই তোমার ওখানে আসব। প্লিজ, তুমি আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে ‘সরাই’তে কিংবা ‘রোমেলী’তে এস না। এ দু’জায়গা এখন ওদের নজরে।’
‘বল, তুমি আরও সাবধান হবে। তোমার এবারের শত্রু ষড়যন্ত্রকারী এবং ওরাই অফেন্সিভে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুমি শত্রুকে দেখছ না, এমনকি জানই না তারা কারা! অথচ তুমি সর্বক্ষণ ওদের নজরে রয়েছ। এমন লড়াই বিপজ্জনক।’ বলল ডোনা জোসেফাইন। তার কণ্ঠ ভারি।
‘অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে জোসেফাইন। ডাক্তার-দম্পতির বাড়ি থেকে একটা বড় ক্লু আমি পেয়ে গেছি। আর…….।’
‘না, এসব কথা টেলিফোনে নয়। আমি জানি, অবস্থার পরিবর্তন আল্লাহ করবেন।’ আহমদ মুসার কথায় বাঁধা দিয়ে বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। এখন বল, তুমি এদিক-সেদিক ঘুরছ, না শুধু ঘরে থাকছ? ঠিক-ঠাক সহযোগিতা পাচ্ছ তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রয়োজনের বেশি বলতে পার। আমার সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান খুব বুদ্ধিমতী, খুব স্মার্ট, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্না। তার ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি নেই। প্রতিদিনই বের হচ্ছি। আগে-পেছনে দুই গাড়িতে দশ জন সিকিউরিটির লোক থাকে। আমার গাড়ি সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান নিজে চালায়। তার পাশে বসে আমার পরিচারিকা। দু’একদিন পরপরই যাচ্ছি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (আইয়ুব সুলতান)(রাঃ)-এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে। মসজিদে নামায পড়ি ও দোয়া করি। ওখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসি। জান, সুলতানের মাজারের সামনে যখন দাঁড়াই, তখন চোখ ফেটে পানি আসে। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি আল্লাহর পথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে শত শত মাইল পথ পেরিয়ে এই সুদূর ইউরোপের রণক্ষেত্রে এসেছিলেন! নিজেকে তখন ছোট মনে হয় এবং হৃদয় থেকে তার জন্যে দোয়া বেরিয়ে আসে। এবার তুমি সময় নিয়ে এখানে এস। তোমাকে নিয়ে আমি তার মসজিদ ও মাজার জিয়ারতে যাব। তাঁদের সাথে তোমার মিল আছে। তোমাকে পাশে নিয়ে দোয়া করলে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অনেক বেশি পাব।’
‘তাঁদের সাথে আমাদের তুলনা করতে পার এই অর্থে যে, তাঁরা সূর্য আর আমরা পৃথিবী। আমাদের কোন আলো নেই, আমরা তাঁদের আলোতে আলোকিত হই। ঠিক জোসেফাইন, তোমাদের নিয়ে তাঁর কবর জিয়ারতে যাব। আমি ইস্তাম্বুল এসে সেদিনই তাঁর কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। মন ভরে থাকতে পারিনি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাঁদের সাথে তোমার তুলনা করেছিলাম এই অর্থে যে, দেশ, বাড়ি-ঘর ছেড়ে তাঁরা যেমন আল্লাহর জন্যে মানুষের কল্যাণে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা দিকে, নানা দেশে, তুমিও তো তেমনি করছ।’
বলে একটু থেমেই জোসেফাইন আবার বলে উঠল, ‘আজ নয়, তুমি দু’একদিন পরে এস। রেস্ট নিলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। আহমদ আবদুল্লাহ কেমন মেজাজে আছে ওখানে? জ্বালায় না তো তোমাকে বেশি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মহাখুশি সে! আমি তাকে পাই-ই না বেশি। সেক্রেটারির সাথে মহা থাতির হয়েছে। তার সাথে আর পরিচারিকার সাথে সে ঘুরে বেড়ায়। আর যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, সামনের ব্যালকনি বারান্দা তার প্রিয়। সে অবাক-বিস্ময়ে সারাক্ষণ চেয়ে থাকে বসফরাস, মর্মর সাগরের আদিগন্ত পানির দিকে। এ তার নতুন অভিজ্ঞতা।’ বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। দরজায় নক হলো এ সময়। সংগে সংগে আহমদ মুসা প্রসংগ পাল্টিয়ে বলল, ‘জোসেফাইন, সম্ভবত কোন মেহমান দরজায় নক করছে। তোমার সাথে….।’
আহমদ মুসার কথায় বাঁধা দিয়ে ডোনা জোসেফাইন বলল, ‘আমি টেলিফোন রাখছি। পরে কথা বলব তোমার সাথে। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ধন্যবাদ। ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
বলে আহমদ মুসা মোবাইল অফ করে দিল। দরজার মাথার ওপরে সেট করা সিসিটিভি স্ক্রীনে আগেই দেখতে পেয়েছে দরজার বাইরে জেনারেল তাহির তারিক এসে দাঁড়িয়েছেন।
মোবাইল রেখে দিয়ে আহমদ মুসা রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে দরজা আনলক করে দিল। সংগে সংগে দরজা পাশের দিকে সরে গিয়ে দেয়ালে ঢুকে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, ‘আসুন জেনারেল তাহির তারিক।’
আহমদ মুসা উঠে বসেছে।
জেনারেল ঘরে ঢুকে ‘কেমন আছেন মিঃ আহমদ মুসা’ বলে সোজা আহমদ মুসার কাছে এল। মাথার ব্যান্ডেজের এরিয়া দেখে তার বাহু ও কাঁধে হাত দিয়ে ব্যান্ডেজের পজিশনটা দেখে নিয়ে বলল, ‘আল্লাহ রক্ষা করেছেন। আঘাত মাথার খুলিতে না লেগে চামড়া কেটে পিছলে নেমে গেছে। কাঁধে তো যন্ত্রণা নেই, তাই না?’
‘না জেনারেল তাহির তারিক, কাঁধে কোন যন্ত্রণা নেই, কাঁধে কোন ফ্র্যাকচার হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহর হাজার শোকর। আপনি ঠিক সময়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
খাটের পাশেই সোফায় বসল জেনারেল তাহির তারিক।
বসেই বলে উঠল, ‘রাতেই আমি আসতে চেয়েছিলাম। আপনি নিষেধ করলেন। কিন্তু সারারাত আমি উদ্বেগে ঘুমাতে পারিনি। আঘাত কেমন, আপনি এত তাড়াতাড়ি টার্গেট হয়ে গেলেন, শত্রু সরাসরি আক্রমণ করতেও সাহস পেল ইত্যাদি চিন্তা সারারাত আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’
‘কিন্তু কালকের ঘটনা আমাকে আনন্দিত করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আনন্দ পেয়েছেন? কিভাবে?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ইস্তাম্বুলে আসার পর বলা যায় অন্ধকারেই ঘুরছিলাম। কিন্তু কার্যকারণ সামনে রেখে সামনে এগোতে চেষ্টা করছিলাম। কালকে প্রথমবারের মতো শত্রুদের আমি সামনে পেলাম। এছাড়া আমাদের পাঁচ গোয়েন্দা যে বাড়িতে ঢোকার পর নিখোঁজ হয়ে গেছেন, সেটাও আমি গতকালের অভিযানে জানতে পেরেছি। সম্ভবত এ জানার ব্যাপারটা ঠেকানোর জন্যেই ওরা আমাকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে তাৎক্ষণিকভাবেই। শত্রুদের পরিচয়ের একাংশও আমি জানতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল তাহির তারিকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সত্যি আল্লাহর বিশেষ সাহায্য আপনার সাথে রয়েছে।’
‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, কালকে আমি পুলিশ আর্কাইভসে গিয়েছিলাম এবং কি জন্যে গিয়েছিলাম তা শত্রুর কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। তারা আর্কাইভসের বাইরে আমার বের হওয়ার জন্যে ওঁৎপেতে ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল জেনারেল তাহির তারিক। কয়েক মুহূর্ত আহমদ মুসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি পুলিশ আর্কাইভসে যাচ্ছেন, এটা আমদের এখানকার কেউ জানত?’
‘হ্যাঁ, আমি এ ব্যাপারে আলাপ করেছিলাম ডঃ শেখ বাজের সাথে। তিনিই শুধু জানতেন।’
মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। একটুক্ষণ ভেবে একটা ঢোক গিলে বলল, ‘কিন্তু ডঃ শেখ বাজ তো খুবই পরীক্ষিত মানুষ। তার বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কিছুই আমরা পাইনি অতীতে। তাহলে সে কি কাউকে বাই দি বাই বলে ফেলেছিল?’ অনেকটা স্বগত কণ্ঠের মতো বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘আমি তার সাথে রাত্রেই কথা বলেছি জেনারেল। ডঃ শেখ বাজ বিষয়টি আর কাউকেই জানাননি। তিনি বলেছেন এবং আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ও অফিস রেকর্ডেও পেয়েছি, ডঃ শেখ বাজ গতকাল বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিসে ছিলেন। সন্ধ্যা ছয়টার পর তিনি হাঁটাহাঁটি করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন। বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকাকালে তিনি বাইরে কোন টেলিফোনও করেননি। অফিসের মোবাইল মনিটরিং রেকর্ড থেকে এ বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমি মনে করি, কালকের ঘটনায় তিনি সন্দেহের ঊর্ধ্বে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কিভাবে শত্রুর কাছে কথাটা পৌঁছতে পারে?’
‘সেটাই ভাবনার বিষয়। শত্রুর কাছে আমাদের গতিবিধি পৌঁছার ঘটনা ও আমার সন্দেহ যদি সত্য হয়, তাহলে অতীতে আমাদের দুই তদন্ত টিম কিভাবে ব্যর্থ ও শেষ হয়ে যায় তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘এখন আমাদের কি করণীয় বলুন।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘আপাতত কিছুই করার নেই। আমাদের নিরাপত্তা-ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও ছিদ্র আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। আমি ডঃ শেখ বাজকেও বলেছি, বিষয়টা যে আমাদের নজরে এসেছে, কোন দ্বিতীয় জন যেন আর জানতে না পারে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি শুনেছি, এখানে যারা থাকেন তাদের স্ত্রীরা মাঝে মাঝে এখানে আসেন। হয়তো এসে স্বামীকে বাড়িতে বা প্রোগ্রামে নিয়ে যান কিংবা তারা এদিকে বেড়াতে এসে স্বামীর সাথে দেখা করে যান। শুনেই আমার মনে হয়েছে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটা একটা লিকেজ হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল তাহির তারিকের চোখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। বলল, ‘জ্বি, এটা ঘটে। দু’দশ মিনিটের জন্যে ওরা আসেন, আমরা এটাকে খুব ক্ষতিকর মনে করিনি। ব্যাপারটা স্পর্শকাতর। শুরু থেকেই এটা না হলে ভালো হতো। কিন্তু রেওয়াজ চালু হবার পর বিনা কারণে এটা বন্ধ করাও কষ্টকর ছিল। আপনার পরামর্শ বলুন, প্লীজ। কোন সৌজন্যবোধ নয়, নিরাপত্তাই আমাদের কাছে বড়।’
‘আপাতত কোন পরিবর্তন দরকার নেই। সব কিছু যেমন চলছিল, তেমন চলুক। শুধু একটা অনুরোধ করব আপনার কাছে। আপনি দয়া করে এই ইনস্টিটিউটে যারা থাকেন, তাদের স্ত্রীদের ফটো ও তাদের জন্ম পরিচয় থেকে তাদের কমপ্লিট বায়োডাটা আমাকে দেবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমি তার ব্যবস্থা করছি। ফটো ও বায়োডাটা সবার আছে। আমরা নিয়োগ দেয়ার সময়ই সবার স্ত্রীদের বায়োডাটাও নিয়েছি। কিন্তু আপনি যেমনটা চাচ্ছেন, তেমনটা কমপ্লিট নাও হতে পারে। যদি না হয়, তাহলে কমপ্লিট করেই আপনাকে দেব।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। আপনার চিন্তা ও কাজ সঠিক পথেই এগোচ্ছে মিঃ খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল। তার কণ্ঠে আবেগ।
ডোরবেল থেকে সংকেত এল কেউ বাইরে এসেছে। দরজার ওপরের সিসিটিভির স্ক্রীনে দেখা গেল, ডঃ শেখ বাজ দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আহমদ মুসা রিমোটের সুইচ টিপে ডোরলক খুলে দিল।
আল-আলা সিনাগগের বিশাল প্রেয়ার হল। সাড়ে তিনশ’-চারশ’ লোক বসতে পারার মতো বিশাল হল ঘরটি।
অন্ধকার হল ঘরটি। শুধু প্রেয়ার পরিচালনার মঞ্চে অনেক উঁচু ছাদে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। অনুরূপ আর একটি বাল্ব জ্বলছে হলের মাঝ বরাবর ছাদে। এই দুই আলো ঘরের অন্ধকারকে ভৌতিক করে তুলেছে।
হলের চেয়ারের প্রথম রো’তে বসে আছে সাতজন মানুষ। আর প্রেয়ার হলের নিচে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চারজন লোক আসামীর এজলাসে দাঁড়ানো মানুষের মতো অ্যাটেনশন অবস্থায়।
চেয়ারের প্রথম রো থেকে পাঁচ-ছয় গজ সামনে থেকে শুরু হয়েছে প্রেয়ার মঞ্চ। হলের ফ্লোর থেকে প্রেয়ার মঞ্চটি এক ফুটের মতো উঁচু।
প্রেয়ার মঞ্চটি নাটকের মঞ্চের মতোই বেশ বড়। প্রেয়ার মঞ্চের পাথরের ফ্লোরটি শূন্য। কার্পেট বিছানো নেই কিংবা চেয়ারও নেই।
চেয়ারে বসা সারিবদ্ধ সাতজনের মাঝের ব্যক্তি তার হাতের রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকাল। তারপর পাশের ব্যক্তির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘গ্র্যান্ড রাব্বি স্যার তো কোনদিন এক মিনিটও লেট করেন না! এখন তো বারটা চার মিনিট!’
তার কথা শেষ না হতেই মঞ্চের ঠিক মাঝখানের একটা বর্গাকৃতি অংশ কয়েক ইঞ্চি নেমে গিয়ে পাশে সরে গেল। সংগে সংগেই ফ্লোরে উঠে এল একটি চেয়ার। চেয়ারটা আলোকিত। চেয়ারে বসে গ্র্যান্ড রাব্বি আইজ্যাক বেগিন। মাথায় তার কালার টুপি, গায়ে কালো পোশাক। মুখটি খোলা।
ফ্লোরে চেয়ারটি স্থির হয়ে দাঁড়াতেই ঢোলের গমগমে ধ্বনির মতো আইজ্যাক বেগিনের কণ্ঠ বলল, ‘ঠিক বলেছেন সিনাগগ প্রধান ও আমাদের ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ (থ্রি জিরো) ইস্তাম্বুল শাখার প্রধান ডেভিড ইয়াহুদ। আমার চার মিনিট লেট হয়েছে। চারজন অপদার্থ লোক আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। এই চার মিনিট তারই সিম্বল। আর হলের অন্ধকারটা ঐ চারজনের প্রতি ঘৃণার প্রতীক, যারা মিশন পরিত্যাগ করে জান বাঁচানোর জন্যে ফিরে এসেছে।’
বলে একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
আইজ্যাক বেগিন ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ বা ‘থ্রি জিরো’ সংগঠনের ইউরোপ চ্যাপ্টারের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
কয়েক মুহূর্ত পর আইজ্যাক বেগিনের কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো প্রেয়ার মঞ্চের পাশে দাঁড়ানো চারজনের উদ্দেশ্যে, ‘তোমরা জান, ডেভিড ইয়াহুদ তোমাদের কি জন্যে এনেছেন এখানে?’
চারজন হাতজোড় করে বলল, ‘বিচারের জন্যে।’
‘ধন্যবাদ। বল, তোমাদের পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে কি বলার আছে।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
চারজনের একজন বলল, ‘আমাদের টার্গেট খালেদ খাকান একা ছিলেন, অপ্রস্তুত ছিলেন। আমাদের মিশন সফল হওয়া সম্পর্কে ওভার সিওর ছিলাম। আমরা আক্রমণ করি। তাকে কাবু করেও ফেলা হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য এক দ্রুততার সাথে সে পাল্টা আক্রমণে আসে এবং আমরাই তার শিকারে পরিণত হই। এই আকস্মিকতায় এবং পাল্টা আক্রমণের কোনই পথ না দেখে এক উপায়হীন বিমূঢ অবস্থায় আমরা পালিয়ে আসি।’
‘আমাদের অভিধানে ‘পালানো’ নামক কোন শব্দ নেই। পালানো মানে খরচ হয়ে যাওয়া।’
আইজ্যাক বেগিনের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই তার হাতের রিভলভার চারবার গর্জন করে উঠল।
প্রেয়ার মঞ্চের পাশে দাঁড়ানো চারটি দেহ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে মেঝের ওপর পড়ে গেল।
সংগে সংগে হলে আলো জ্বলে উঠল। সেই সাথে প্রেয়ার মঞ্চে আইজ্যাক বেগিনের সামনে একটি টেবিল এবং টেবিলের তিন দিক ঘিরে সাতটি চেয়ার মেঝের নিচ থেকে উঠে এল।
ফ্লোরের চেয়ারে বসা সাতজন নিঃশব্দে উঠে এসে আইজ্যাক বেগিনের সামনের সাতটি চেয়ারে বসল।
শিরদাঁড়া খাঁড়া করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসেছিল আইজ্যাক বেগিন।
ওরা সাতজনও সেভাবেই অ্যাটেনশন হয়ে বসল।
‘মিঃ ডেভিড ইয়াহুদ, টেলিফোনে আপনার কিছু কথা শুনেছি। আপনিই শুরু করুন, ঘটনা সম্পর্কে আপনার কথা বলুন।’ প্রথমেই কথা বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘আমরা নিশ্চিত জেনেশুনেই আমাদের অপেক্ষাকৃত চৌকশ চারজনকে খালেদ খাকানকে হত্যা করার জন্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে এত বড় ফাইটার তা আমরা বুঝতে পারিনি।’
‘আপনি ডঃ শেখ বাজের সাথে তার কথাবার্তার মনিটরিংটা কি ভালো করে শুনেছেন? মনে হয় শোনেননি। শুনলে বুঝতেন, এর আগে যাদের আমরা ‘ডিল’ করেছি, তাদের থেকে খালেদ খাকান কত আলাদা! উকিলদের মতো প্রশ্ন, গোয়েন্দাদের মতো বিশ্লেষণ, ডাক্তারদের মতো তার ডায়াগনোসিস থেকে আপনার বোঝার কথা ছিল, সে সাধারণ কেউ নয়।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘ঠিক স্যার, আমরা এতটা গভীরে যাইনি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, আমাদের বাছাই করা চারজন যে কোন একজন মানুষকে কাবু করার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের হিসেবে ভুল ছিল। আমাদের আন্দাজের বাইরেও শক্তিমান ও কুশলী মানুষ আছে।’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কে এই লোক? কোত্থেকে একে আমদানি করল? এসেছে রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর হিসেবে, কিন্তু কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দার মতো। একে কিন্তু সময় দেয়া যাবে না। আমাদের গ্রাসে পড়লে তার বাঁচার আর অধিকার নেই। কৌশল এবং শক্তি দু’টিরই ব্যবস্থা কর। আগের মতো কৌশলে যদি কাজ হয়, তাহলে শক্তি ব্যবহারে না যাওয়াই ভালো।’
‘যথা আজ্ঞা এক্সিলেন্সি। সে আর বেঁচে নেই ধরে নিন। জীবনের খাবারটা দু’একদিন খেয়ে নিক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘তাই হোক ডেভিড। এখন আসল কথায় আসা যাক। আমাদের মূল কাজটা কতদূর এগোলো? বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার সহযোগিতা করেনি, বরং বাঁধার সৃষ্টি করেছিল। তাকে সরানো হয়েছে। পরে আমাদের দু’টি অপশন ছিল। এক. প্রধান বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ এবং তা সফল না হলে বিজ্ঞানীকেই কিডন্যাপ করা, দুই. এই অপশন কাজে না এলে গোটা এই পাহাড়কেই ধূলায় পরিণত করা, যার সাথে ধূলা হয়ে যাবে সকল বিজ্ঞানী, সমাধি হয়ে যাবে তাদের ভয়ংকর আবিষ্কার ‘সোর্ড’-এর। প্রথম অপশনটা কতদূর এগোলো?’
ডেভিড ইয়াহুদ তাকালো ‘থ্রি জিরো’-এর ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের অপারেশন চীফ ইরগুন ইবানের দিকে। বলল, ‘অবস্থার বিবরণটা তুমিই দাও।’
‘ধন্যবাদ, স্যার’, বলে শুরু করল ইরগুন ইবান, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ও ‘সোর্ড’-এর জনক বিজ্ঞানী ডঃ আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসীর সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এখনও সফল হয়নি। যোগাযোগের জন্যে ইনস্টিটিউটে প্রবেশ সম্ভব নয়। নিশ্ছিদ্র একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে। এরপরও গোপনে অথবা গায়ের জোরে গবেষণাগারে ঢোকা যায়, কিন্তু আমরা যে যোগাযোগ চাই, তা এর দ্বারা হবে না। এজন্যে আমরা বিজ্ঞানীর ইস্তাম্বুলস্থ বাড়ির সন্ধান করছি। তিনি সপ্তাহের কোন এক সময় দুর্গ প্রাঙ্গণ থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে তার বাড়ি যান। বাড়িতে একদিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন। আমরা তার বাড়ির ঠিকানা জানার অন্যান্য চেষ্টার সাথে হেলিকপ্টারের ফ্লাইটটাকে লোকেট করার চেষ্টা করছি। তার বাড়ির সন্ধান পেলে আমরা সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পাব। তিনি লোভ এবং ভয়েও রাজি না হলে আমরা তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে কিডন্যাপ করে তার ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবো। সেটাও কাজ না করলে খোদ তাকে কিডন্যাপ করা হবে। এই গোটা অপারেশনের জন্যে আমাদের সময় প্রয়োজন। সময় বেশি লাগলেও এটাই নিশ্চিত পথ। এসব কিছুতে কাজ না হলে গবেষণাগার ধ্বংস করার অপশন তো আমাদের রয়েছেই।’
থামল ইরগুন ইবান।
সংগে সংগেই আইজ্যাক বেগিন বলে উঠল, ‘বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে খুব লাভ হবার সম্ভাবনা নেই। গবেষণা ধ্বংস করে আমরা তাদের ক্ষতি করতে পারবো, আমরাও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাব, কিন্তু ‘সোর্ড’কে হাত করে যে লাভ করতে চাই তা হবে না। আমরা চাই ক্ষতি থেকে বাঁচতে, তার সাথে চাই ষোল আনা লাভ। সুতরাং যে কোন মূল্যে, যে কোনভাবে বিজ্ঞানী আন্দালুসীর সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
‘এর জন্যে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হবে। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ব্যাপারেও একই প্রচেষ্টা আমাদের আছে। এসব থেকেও কোন রেজাল্ট আমাদের আসতে পারে। সব চেষ্টার পরই গবেষণাগার ধ্বংস।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আর এই প্রচেষ্টা সফল করার জন্যে প্রয়োজন খালেদ খাকানকে এই মুহূর্তে সীন থেকে সরানো। এটা এই মুহূর্তের টপ প্রায়োরিটি।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
বেগিন কথা শেষ করতেই ডেভিড ইয়াহুদের টেলিফোন বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি’ বলে টেলিফোন ধরল ডেভিড ইয়াহুদ।
ওপারের কণ্ঠস্বর শুনেই বলল, ‘বল স্মার্থা, কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু?’
স্মার্থা ‘থ্রি জিরো’ সংগঠনের ইস্তাম্বুল শাখার একজন গোয়েন্দা কর্মী। পেশায় সে একজন শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী।
‘জ্বি স্যার। খালেদ খাকান ঘটনার পর কোথায় প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়, তার সন্ধান পেয়েছি। আমাদের সিনাগগের ঠিক বিপরীত দিকে রাস্তার ওপাশে ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতের বাড়ি। তারা দু’জনেই পার্ক থেকে খালেদ খাকানকে বাড়িতে এনে চিকিৎসা করেন। খালেদ খাকান দুই ঘন্টা তাদের বাসায় থাকেন।’ বলল স্মার্থা।
‘ওয়ান্ডারফুল স্মার্থা। ওরা যদিও আমাদের সিনাগগের সদস্য নয়, কিন্তু একটা ধার্মিক ইহুদি পরিবার ওটা। ওরা আমাদের সাহায্য করবে। খালেদ খাকানের সাথে তাদের পরিচয়ের সুযোগ আমাদের ব্যবহার করতে হবে।’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘এটা সম্ভব স্যার। আমি ওদের সাথে আলোচনা করে বুঝেছি, খালেদ খাকানের সাথে ওদের একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখবে বলে কথা হয়েছে। খালেদ খাকান পরে টেলিফোনে তাদের সাথে যোগাযোগও করেছে।’ বলল স্মার্থা।
‘গুড। ধন্যবাদ স্মার্থা। আর কিছু কথা?’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘না স্যার, ধন্যবাদ।’ বলল স্মার্থা।
‘ওকে বাই।’ বলে টেলিফোন রেখে দিল ডেভিড ইয়াহুদ।
আইজ্যাক বেগিনসহ সবাই ডেভিড ইয়াহুদের কথা শুনছিল।
ডেভিড ইয়াহুদ টেলিফোন রাখতেই আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘কার সাথে কথা বললেন? খুব খুশি মনে হল!’
‘খবর কিছুটা খুশিরই বটে। আমাদের এক গোয়েন্দা কর্মী জানাল, সেদিন ঘটনার পর মারাত্মক আহত খালেদ খাকান যেখানে যাদের কাছে চিকিৎসা নিয়েছে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের এই সিনাগগের অপজিটে আমাদের কমিউনিটিরই একজন ডাক্তার দম্পতি থাকেন। তারাই আহত খালেদ খাকানকে পার্ক থেকে বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা করেন।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আইজ্যাক বেগিনের। বলল, ‘অবশ্যই খুশির খবর। নিশ্চয়ই ডাক্তার দম্পতির সাথে খালেদ খাকানের অন্তত কৃতজ্ঞতার একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হবার কথা।’
‘অবশ্যই তা হয়েছে। আমাদের কর্মী স্মার্থা বলল, তাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। খালেদ খাকান তাদের সাথে যোগাযোগও রাখছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘জিহোভা আমাদের প্রতি সদয় আছেন। কাজ এখন অনেক সহজ হয়ে গেল। ডাক্তার দম্পতির বন্ধু সেজে খালেদ খাকানের কাছে যাবার সুযোগ নেবে অথবা ডাক্তার দম্পতিকে দিয়ে দাওয়াত করিয়ে খালেদ খাকানকে তাদের বাসায় নিয়ে এস। তারপর স্বাভাবিক পথে তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে আমাদের বহু অস্ত্রের যে কোনটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করো।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘আমি ভাবছি ডাক্তার দম্পতি সরাসরি আমাদের এ ধরনের সহযোগিতা করবেন কিনা। তারা আমাদের সিনাগগের সদদ্য নয়। তারা সহায়তা করলে কাজ সহজ হবে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধরে নাও, তারা সহযোগিতা করবেন না, কিন্তু সহযোগিতা আদায় করতে হবে। অনুরোধ, লোভ, ভয় সব অস্ত্রই ব্যবহার করবে। অতি শীঘ্র কাজটা হোক, আমি চাই মিঃ ডেভিড ইয়াহুদ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল। তার কণ্ঠ শক্ত।
‘তাই হবে জনাব।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ। বিনীত তার কণ্ঠ।
উপস্থিত অন্য সকলের দিকে তাকিয়ে আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘ইস্তাম্বুলের দায়িত্বশীল তোমাদের সকলকে এখানে ডেকেছি এই কারণে যে, তোমরাও দায়িত্ব অবহেলাকারীদের দেখ এবং সবকিছু নিজ কানে শোন। এখন সবাইকে তোমাদের জানাতে হবে, কোন কারণেই কোন ব্যর্থতা আমরা সহ্য করবো না। আমাদের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে আমাদের সমমনা বহু রাষ্ট্রের যুদ্ধ-শক্তির ভবিষ্যৎ। আমরা ব্যর্থ হলে তাদের আক্রমণ-শক্তি জিরো হয়ে যাবে। এই কারণে তারা আমাদের ডলারের পাহাড় দিয়েছে। আমাদের ব্যর্থ হওয়া যাবে না।’ বলল আইজ্যাক বেগিন। তার কথাগুলো ছুরির মতো ধারাল। কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিন। তার সংগে সংগেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেল।
পর মুহূর্তেই চেয়ার-টেবিল অদৃশ্য হয়ে গেল মঞ্চ থেকে।
পাথুরে মেঝের শূন্য রূপ আবার ফিরে এল।

Top