৪৬. রোমেলি দুর্গে

চ্যাপ্টার

‘স্যরি ম্যাডাম। আপনাকে মুখ খুলতেই হবে, আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। দরকার হলে আপনাকে আমরা থানায় নেব। আপনার পেছনে যে মহিলারা দাড়িয়ে আছেন, তারা পোশাকে সিভিলিয়ান বটে, কিন্তু তারা দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। বাড়িটাও চারিদিক থেকে পুলিশে ঘেরা।’ বলল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার মুখে কিন্তু ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠের কঠোর কথাগুলো আয়েশা আজীমার চেহারায় সামান্য চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করল না।
আহমদ মুসার ডান পাশের সোফায় বসেছিল তাহির তারিক, বাম পাশের আরেক সোফায় বসেছিল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
আয়েশা আজীমা বসে ছিল সামনে একটু দূরের একটা সোফায়। মাঝখানে লাল কার্পেটে মোড়া বর্গাকৃতির ছোট্ট একটা চত্বর। তাতে শুধু একটা ‘টী’ টেবিল।
তার পরনে পাজামা ও ফুলহাতা কামিজ। কামিজের উপর একটা কুকিং অ্যাপ্রন।
আয়েশা আজীমা রান্নাঘরে ছিল। সেখানে সে যেভাবে ছিল মহিলা পুলিশ অফিসারেরা তাকে সেভাবেই ধরে নিয়ে এসেছে।
তার মাথায় একটা রুমাল বাঁধা।
বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিছাত্রী ও সেরা সুন্দরী ছিল আয়েশা আজীমা। সৌদি ছাত্র শেখ বাজের মেধা ও বিত্তই সম্ভবত শেখ আয়েশা আজীমাকে আকৃষ্ট করে। আকর্ষণ শেষে প্রেম ও বিবাহে পরিণতি লাভ করে।
আয়েশা আজীমা আহমদ মুসার কথার কোন জবাব না দেয়াতে আহমদ মুসা জেনারেল তারিক ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে একবার তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে আয়েশা আজীমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দেখুন, চুপ থেকে লাভ নেই। ড. শেখ বাজ হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন। তার কাছ থেকে কোটপিনের আকারে এই শক্তিশালী ট্রান্সমিটার পাওয়া গেছে। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছেন, তার কোটপিনে যে ট্রান্সমিটার তা তিনি জানেন না। কিন্তু আইন তার এ কথা মানবে না। ধরা পড়ার পর সব অপরাধীই এমন কথা বলে। এখন আমরা জানতে চাই আপনার এ ব্যাপারে বক্তব্য কি? কারণ তিনি বলেছেন, কোটপিন আপনার সংগ্রহ করা।’
থামল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা একবার মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে চাইল। কোন কথা নেই তার মুখে। তবে প্রথমবারের মত তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা মুখ একটু নিচু করে ভাবল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক সূক্ষ্ণ হাসি। বলল সে, ‘তাহলে বুঝা গেল মিসেস বাজ, আপনি কিছুই জানেন না। ড. শেখ বাজই মিথ্যা কথা বলেছেন। সত্য তাহলে তার কাছেই পাওয়া যাবে। তার কাছ থেকেই সত্য এবার বের করতে হবে। সত্য বের করার কৌশল পুলিশের জানা আছে। বাবা ডেকে সব সত্য কথা বলে দেবেন তিনি। আমরা উঠছি। যতদিন না বিষয়টির সুরাহা হয় ততদিন আপনি পুলিশের কাস্টডিতে…।’
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। চিৎকার করা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল আয়েশা আজীমা, ‘না, আমি সব বলব। ওর কোন দোষ নেই। ওঁর মত ভাল মানুষ কোন অপরাধ করতে পারেন না। তার কোন ক্ষতি করবেন না, তাকে আপনারা ছেড়ে দিন।’
কথাগুলো বলে থামল আয়েশা আজীমা। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
‘ওঁর কোন দোষ নেই দোষটা তাহলে কার, এটাই তো আমরা জানতে চাচ্ছি। সব বলুন আপনি আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমি একটা স্টেটমেন্ট করব, আপনি লিখুন।’
আহমদ মুসা তাকাল তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে।
বুঝতে পেরে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল ইশারা করে আয়েশা আজীমার পেছনে দাঁড়ানো তিন মহিলা পুলিশ অফিসারের একজনকে ডেকে বলল, ‘মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, আপনি ওঁর স্টেটমেন্টটা লিখুন।’
মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু এই এলাকার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত অফিসার।
মিসেস ডেডেগ্লু পকেট থেকে নোটশিট ও কলম বের করে আয়েশা আজীমার পাশের সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম, বলুন।’
আয়েশা আজীমা মিসেস ডেডেগ্লুর কাছ থেকে নোটশীট ও কলম নিয়ে নিল এবং কয়েকটি নোটশীটের শেষ প্রান্তে নিজের নাম দস্তখত করে ওগুলো মিসেস ডেডেগ্লুর হাতে ফেরত দিল।
স্টেটমেন্ট করার আগেই স্টেটমেন্টশীটে সত্যয়নকারী দস্তখত করায় অবাকই হল আহমদ মুসা। বেরিল ডেডেগ্লুও। তার চোখেও বিস্ময়।
‘লিখুন’, বলতে শুরু করল আয়েশা আজীমা, ‘আমি আয়েশা আজীমা ওরফে আলিশা দানিয়েল স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছি যে, ‘আমি ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট (থ্রি জিরো) নামক সংস্থার দেয়া অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তাদের সরবরাহ করা ‘কোটপিন’ আকারের শক্তিশালী ট্রান্সমিটার আমার স্বামীর কোটে নিয়মিত লাগিয়ে রাখার মাধ্যমে রিসার্চ সেন্টারের যাবতীয় কথোপকথন পাচার করেছি। আমার স্বামীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা ব্যবহার করা তাঁর অজ্ঞাতে তাঁদেরই বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র করতে আমি বাধ্য হয়েছি। কেন এভাবে আমি বাধ্য হলাম, কেন আমার প্রিয়তম স্বামী ও তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র করতে বাধ্য হলাম, তার পেছনে আছে আমার এক অসহায়ত্ব। সে অসহায়ত্ব হলো আমার স্বামীকে রক্ষার এক নিরুপায় ব্যবস্থা। আমি ওদের ষড়যন্ত্রের সাথী না হলে ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করত। আমি জানি আমার স্বামীকে কেউ-ই ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। শুধু ‘থ্রি জিরো’ই তখন আমার শত্রু হতো না, তুরস্কের পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে আমার মত ছদ্মবেশী অনেকে আছে যারা ‘থ্রি জিরো’ অর্থাৎ ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট-এর পক্ষে কাজ করছে তারাও আমার স্বামীর হন্তায় পরিণত হতো। আমার অন্যায় হয়েছে, আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কে আমার স্বামীকে না বলা, এমন ছদ্মবেশ নিয়ে তার মত একজন ভালো ও জাতিপ্রেমিক মানুষকে বিয়ে করাও আমার অন্যায় হয়েছিল। কিন্তু তার প্রতি আমার প্রেম আমাকে অন্ধ করেছিল। তাঁকে বিয়ে না করেও পারিনি, তাঁকে হারাবার ভয়ে আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কেও তাঁকে বলতে আমি সাহস পাইনি।
আমি স্বীকার করছি। আমার ছদ্মবেশ ছিল পরিকল্পিত। হাজারো ইহুদী তরুণী যেভাবে তাদের নাম পরিচয় পাল্টে মুসলিম ও খ্রিস্টান সমাজে ঢুকে পড়েছে, আমি তাদেরই একজন। লেবাননের বেকা অঞ্চলের এক ইহুদী পরিবারে আমার জন্ম। স্কুল সার্টিফিকেট পর্যায় পর্যন্ত আমি ইসরাইলের তেলআবিবে পড়ি। তারপর বেকায় ফিরে আসি। বেকায়ই আমার পরিবারের পরিচিত আয়েশা আজীমার নাম পরিচয় আমাকে গ্রহণ করতে বলা হয়। তার সমস্ত শিক্ষা ডকুমেন্টও আমাকে দেওয়া হয়। এই সব ডকুমেন্টের জোরে আমি আয়েশা আজীমা রূপে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। আমি পুরোপুরি আয়েশা আজীমা হয়ে যাই। পরে শুনেছি, স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশের পর আয়েশা আজীমা নিহত হয়। কেউ আমাকে বলেনি, তবে এখনও আমি বিশ্বাস করি আমাকে আয়েশা আজীমা বানাবার জন্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে হঠাৎই কৃতি ছাত্র শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার পরিচয় হয়। ভালো লেগে যায়। শুধু কৃতি ছাত্র বলে নয়, তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মেয়েদের প্রতি নির্মোহ ভাব আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। তার মত ঠাণ্ডা ছেলেকে উত্তপ্ত করতে আমার অনেক সময় লেগেছে। জার্মানিতে পিএইচডি করার সময় তার কাছ থেকে বিয়ের ইতিবাচক সাড়া আমি পাই। ইতিমধ্যে ‘থ্রি জিরো’-এর সাথে আমার পরিচয় হয়ে গেছে। পরে জেনেছি তারাই জার্মানিতে পড়ার জন্য আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে। বৈরুতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও আমার বাবা-মায়ের মাধ্যমে তারাই দেয় বলে জানতে পারি। শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার সম্পর্কে ‘থ্রি জিরো’ আমাকে দারুণভাবে কনগ্রাচুলেট করে এবং বলে যে, সৌদি আরবের এমন পরিবারের ছেলে সে সৌদি আরবের বড় কোন এক দায়িত্বে যাবেই। শেখ বাজের উপর তাদের চোখ রাখাকে আমি ভাল চোখে দেখিনি, কারণ এটা আমার একান্তই প্রাইভেট ব্যাপার। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। কেউ আমাকে না বলে দিলেও আমি জানতাম, আমাদের জাতীয় এই সংগঠনের কথা আমাকে মানতে হবে। পিএইচডি করার পর জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি হয়ে গেল। ‘থ্রি জিরো’র লোকরা এসে আমার সাথে দেখা করল। সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তির একটা কাটিং আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি করা যাবে না। যে কোনভাবে এই বিজ্ঞপ্তির চাকরিই যোগাড় করতে বলো। আমি বিজ্ঞপ্তি পড়ে দেখলাম, সেটা ইস্তাম্বুলের ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি সংস্থায় ‘ডাইরেক্টর অব ম্যানেজমেন্ট’ পদে নিয়োগের একটা বিজ্ঞপ্তি। আমি ওদের বললাম, এটা একটা ম্যানেজারিয়াল পদ, কিন্তু শেখ বাজের পছন্দ একাডেমিক কাজ। তারা চাপ দিয়ে বলল, না এই চাকরিই তাঁকে যোগাড় করতে হবে। তারা যুক্তি হিসেবে বলল, ওআইসির গোপন অর্থ ও তত্ত্বাবধানে এই ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে। এটাকে ঘিরে নিশ্চয়ই ওআইসির এক বড় পরিকল্পনা আছে। সেখানে কি হয় এটা আমাদের জানা দরকার। সুতরাং শেখ বাজকে সেখানে ঢুকাতেই হবে। আমি পছন্দ করি বা না করি, এটা আমাকে মেনে নিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি ইস্তাম্বুলে এবং রিসার্চ ও টেকনোলজির সাথে জড়িত বলে এই চাকরি নেওয়ার জন্য শেখ বাজ আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যায়। বরং আমি তার কাছ থেকে ধন্যবাদই পাই যে এমন একটা বিজ্ঞাপনের দিকে আমার নজর গেছে। ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি (আইআরটি)-তে তার চাকরি হয়ে যায়। এই পদের জন্য তার মত যোগ্য লোকই তারা খুঁজছিল। তার চাকরি হওয়ার পরই নতুন সঙ্কট আমার সামনে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়। ‘থ্রি জিরো’ অনেকগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দ অঙ্কিত অন্ধকারেও জ্বলে এমন দামি পাথরের তৈরি দেওয়াল ‘শো পিচ’ আমাকে দিয়ে বলে আইআরটির তিন ফ্লোরেই দেওয়ালের দর্শনীয় স্থানে শেখ আব্দুল্লাহর দ্বারা এগুলো লাগিয়ে দিতে। তাদের প্রস্তাবে আমি চমকে যাই। বুঝতে পারি ‘শো পিচ’ এর কভারে এগুলো নিশ্চয়ই গোয়েন্দা যন্ত্র, গোপন ক্যামেরা বা গোপন ট্রান্সমিটার হতে পারে। আমি ওদের বললাম, এটা সেট করাকে শেখ বাজ নিজেও সন্দেহের চোখে দেখতে পারে অথবা কারও সন্দেহের শিকার হতে পারে। সেসহ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। আমার যাই হোক, আমার স্বামীর কোন ক্ষতি আমি করতে পারবো না। তাদের প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপরই তারা আনে ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব। এটাও ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমি এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করি। এরপরই তারা আবির্ভূত হয় স্বমূর্তিতে। বলে যে, ‘আমি যদি প্রতিদিন স্বামীর কোটে তাদের দেওয়া কোটপিন রাখার ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করি, তাহলে যে স্বামীকে রক্ষার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না, সেই স্বামীকেই আমাকে হারাতে হবে। আমি অস্বীকার করার পর একদিনও তাঁকে বাচতে দেয়া হবে না। আর আমি যদি তাদের এসব কথা আমার স্বামী, পুলিশ বা কাউকে বলি, তাহলে স্বামীর সাথে আমার মেয়েকেও শেষ করে ফেলবে ওরা। আমি নিরুপায় হয়ে যাই। আমি স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই না, কিন্তু তার চেয়েও বড় হল, আমি কিছুতেই তাঁকে হারাতে চাই না, এই পর্যায়ে এসেই আমার জন্য কম ক্ষতিকর হিসেবে তাদের ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রাণপ্রিয় স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রতিপল, প্রতিক্ষণ আমি দগ্ধ হয়ে এসেছি। একটা সান্ত্বনা আমার ছিল, সেটা হল স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করে আমি আমার স্বামীকে রক্ষা করেছি। আমার স্বামীকে দয়া করে আপনারা রক্ষা করবেন। আমিই আমার স্বামীর জন্য মুসিবত। আমি চাই এই মুসিবত থেকেও উনি মুক্তি পান। আর আমিও চাই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইলের হাত থেকে মুক্তি।’
কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে থামল আয়েশা আজীমা।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার প্রশ্ন, ‘ম্যাডাম, এই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইল যারা করতো, যারা এখানে আপনার সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের পরিচয় সম্পর্কে দয়া করে বলুন।’
‘আমার স্টেটমেন্ট শেষ জনাব। আমার স্বামীকে দয়া করে দেখবেন।’
বলেই আয়েশা আজীমা তার বাম হাতের অনামিকার আংটির নিল পাথরটাকে কামরে ধরল।
আয়েশা আজীমাকে তার হাতের আংটি মুখে নিতে দেখেই আহমদ মুসা উঠে দাড়িয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাতটাকে ধরে ফেলার জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরে ফেলার আগেই হাতের আংটি কামড়ে ধরেছিল আয়েশা আজীমা।
আহমদ মুসা দ্রুত হাতটা টেনে নিল আয়েশা আজীমার মুখ থেকে।
আয়েশা আজীমার মুখে এক টুকরো নির্দোষ হাসি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই তা কোথায় মিলিয়ে গেল। সোফার উপর এলিয়ে পড়ল আয়েশা আজীমার দেহ।
পেছনে নির্বাক দাঁড়ানো দুই পুলিশ অফিসার ও আয়েশার স্টেটমেন্ট লেখা পুলিশ অফিসারগণ। এই তিন পুলিশ অফিসার গিয়ে ধরল আয়েশা আজীমাকে। তাদের একজন বলল, ‘আমরা বুঝতেই পারিনি ইনি কি করতে যাচ্ছেন। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।’
হতাশ আহমদ মুসা ধপ করে সোফায় বসে বলল, ‘কোন লাভ নেই পুলিশ অফিসারগণ। পটাসিয়াম সাইনাইড কাউকে এন্টিডোজ নেয়ার সুযোগ দেয় না।’
উঠে দাঁড়িয়েছিল জেনারেল তাহির এবং জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালও। তারাও বসল।
আয়েশা আজীমাকে সোফায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, ‘স্যার, সংগে সংগেই কি করে নিশ্চিত হলেন, উনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন?’ প্রশ্নের লক্ষ্য আহমদ মুসা।
‘সেদিন ‘থ্রি জিরো’র ইরগুন ইবানও আমার হাত ফসকে এভাবেই মরেছে পটাসিয়াম সাইনাইড খেয়ে। সেদিন তাকে বাঁচানো যেমন জরুরি ছিল, একে বাঁচানোও তেমন জরুরি ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবুও এর কাছ থেকে কিছু জানা গেল।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘শুধু নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একজনের নাম প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলেননি। আমরা জানি ডঃ বাজ নির্দোষ। আয়েশা আজীমা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করায় আমাদের কোন লাভ হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তবে ডঃ বাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আপনি এই চাল না চাললে আমার মনে হয় আয়েশা আজীমা এটুকুও বলতেন না। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তারিক।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না তার। স্বামীকে বাঁচানোর জন্যেই এই স্টেটমেন্ট তিনি দিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইস্তাম্বুলের ষড়যন্ত্রের যারা হোতা, যারা তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তাদের সম্বন্ধে না বলায় কি প্রমাণ হয় যে তিনি ‘থ্রি জিরো’র প্রতিও বিশ্বস্ত ছিলেন।’ পুলিশ অফিসার বেরিল ডেডেগ্লু বলল।
‘হ্যাঁ, বলা হয় দ্বৈত আনুগত্য আয়েশা আজীমার মধ্যে ছিল। একদিকে তিনি স্বামীকে ভালোবাসতেন বলে স্বামীর সমাজ ও জাতির প্রতিও তার একটা ভালোবাসা ছিল। আবার যারা পেছন থেকে সহযোগিতা দিয়ে তাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাদের প্রতিও একটা আনুগত্য তার ছিল। তবে আয়েশা আজীমার স্টেটমেন্টের শেষ কথা প্রমাণ করে তিনি তাদের জাতির ওই লোকদের ভয় করতেন, ভালোবাসতেন না। তাদের হাত থেকে স্বামীকে মুক্ত করা ও নিজে মুক্ত হবার জন্যেই তার এই মৃত্যু।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অনেক ইহুদিই কিন্তু ওদের ষড়যন্ত্রের সাথে নেই।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল।
‘অনেক’ বলছেন কেন, আমার জানা মতে নব্বই ভাগ ইহুদিই ওদের সাথে নেই। তারা ধার্মিক, শান্তি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। মাত্র জায়নিস্ট বা ইহুদীবাদী বলে পরিচিত মুষ্টিমেয়রাই পৃথিবীব্যাপী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাদের চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধমকিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ইহুদীরা অতিষ্ঠ ও অসহায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন জনাব খালেদ খাকান। এই সাধারণ শান্তিবাদী ইহুদীরা ঐক্যবদ্ধ না থাকা এবং অসংগঠিত হওয়ার কারণেই এদের কণ্ঠ শ্রুত হয় না, এদের কণ্ঠ কোন শক্তি নয়।’
বলেই একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘করনীয় কাজের কথায় আমরা ফিরে আসতে পারি। প্রথমে ডঃ শেখ বাজকে ডাকা দরকার। তিনি এলেই আমরা লাশ নেবার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজ করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আমি ডাকছি ড. শেখ বাজকে। আপনি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবুন প্লিজ।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তাহির।
‘ঠিক আছে, আপনারা এসব করুন। আমাকে এখনি উঠতে হবে। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ হবার আগেই আমি আরেক ঘাঁটিতে হানা দিতে চাই। সেখানে থাকেন আয়েশা আজীমা বা সেদিনের ইরগুন ইবানের চেয়ে বড় কেউ। তাকে আমাদের হাতে পেতেই হবে। ‘থ্রি জিরো’র ভেতরে ঢোকার প্রত্যক্ষ এই একটা দরজাই আমাদের সামনে খোলা আছে।’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘আল্লাহ আপনাকে সফল করুন খালেদ খাকান। কিন্তু একা যাবেন না। অগ্রবাহিনী কিংবা পশ্চাৎবাহিনী যেভাবেই হোক আপনার পছন্দনীয় একদল পুলিশ আপনি নিন।’ বলল জেনারেল তাহির আহমদ মুসাকে।
জেনারেল তাহির থামতেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আমি পুলিশ প্রধানকে বলে দিচ্ছি এবং মোবাইল নাম্বারও দিচ্ছি। তিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কোথায় যাচ্ছেন, কি কাজ- এ সম্পর্কে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আপনিও তাকে কিছু বলবেন না।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের। আমি আসি। আমি যাচ্ছি গোল্ডেন হর্নের ওপারে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহদ মুসা বেরুবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়াল।
ডঃ শেখ বাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে ছুটল বসফরাস ব্রীজ অর্থাৎ কামাল আতাতুর্ক ব্রীজের দিকে। ওই ব্রীজ দিয়ে বসফরাস উপকুলের হাইওয়ে ধরে গোল্ডেন হর্নের গালাটা ব্রীজ পার হয়ে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব তাড়াতাড়ি পৌছা যাবে।
আহমদ মুসার গাড়ি বসফরাস ব্রিজে ওঠার পরই গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল ৪টা গাড়ি সারি বেঁধে একই গতিতে তার পেছনে ছুটে আসছে।
ব্রীজের মাঝামাঝি এসে দেখল ব্রীজের ওপাশ থেকে আরও চারটা গাড়ি হঠাৎ রং সাইড এ এসে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে দাঁড়াল। গোটা রাস্তা জুড়ে তারা দাড়িয়ে। কোনভাবেই তাদের পাশ কাটানো সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা ডান দিকে ব্রীজে ওপাশে রিটার্ন লেনের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কতকগুলো গাড়ি দাড়িয়ে ডানদিকটাও ব্লক করে ফেলেছে।
আশ্চর্যের বিষয়, সবগুলো গাড়িই, ওয়াগন মিনিট্রাক। আর আহমদ মুসার গাড়ি ১৩০০ সিসির আমেরিকান কার। ওদের তুলনায় বাচ্চা।
তিন দিক থেকেই অবরুদ্ধ আহমদ মুসা। হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাড় করায় আহমদ মুসা। বাঁ দিকে দেখেছে আহমদ মুসা ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের সমান্তরাল প্যানেলবার গাড়ির সমান্তরালে।
আহমদ মুসার গাড়ি দাড়িয়ে পড়তেই তিন পাশের গাড়িগুলোও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
তিন দিকে উঁচু গাড়ির দেয়ালের মাঝখানে আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়িগুলো থামতেই নেমে এল একদল মানুষ। প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান।
আহমদ মুসা বুঝে গেছে সব। নিশ্চয় ‘থ্রি জিরো’র লোকরাই আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে সব দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। ঘেরাও করে ফেলা এতগুলো স্টেনগানের বিরুদ্ধে তার এক রিভলবার কোন কাজেই আসবে না। বরং তাদের গুলী এড়াতে হলে তাকে রিভলবার বের করা চলবে না। মাত্র খোলা থাকা বসফরাসের দিকসহ চারিদিকে একবার চেয়ে মুহূর্তের জন্য করনীয়টা ঠিক করে নিয়ে আহমদ মুসা বসফরাসের দিকে মানে বাম দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির ছাদে উঠে দু’হাত তুলে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই ডান পাশ থেকে একজন চিৎকার করে বলল, ‘কেউ গুলী করবে না। ওকে মৃত পেলেও আমাদের চলবে, কিন্তু জীবন্তই বেশি দরকার। একটা গুলিতে তার আরামের মৃত্যু হলে তার কাছে আমাদের পাওনা শোধ হবে না। তোমরা কয়েকজন গিয়ে তাকে বেঁধে গাড়িতে তোল।’ নির্দেশের সাথে সাথেই তিন দিক থেকে চার পাঁচজন ছুটল আহমদ মুসার দিকে।
‘তোমরা কারা? আমার দোষটা কি? তোমরা এসব কথা বলছ কেন?’
চিৎকার করে এসব কথা বলতে বলতে আহমদ মুসা ইঞ্চি ইঞ্চি করে পেছনে হটে গাড়ির বাম প্রান্তের দিকে এগোচ্ছিল। সে জানে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবার থেকে দু’শ ফুটেরও বেশি নিচে বসফরাসের পানি। ওদিকেও মৃত্যুর হাতছানি তবু তার রক্তের জন্যে হন্যে হয়ে থাকা ‘থ্রি জিরো’র কশাইদের হাতে পড়ার চেয়ে বসফরাসের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া অনেক ভালো।
আহমদ মুসার গাড়ির ছাদ থেকে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবারের ব্যবধান দেড় ফুটের বেশি নয়।
আহমদ মুসার দিকে ছুটে আসা লোকগুলো তার গাড়ির পাশে এসে গেছে। ওরা উঠে আসছে গাড়ির ছাদে।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির ছাদের বাম পাশের শেষ প্রান্তে।
লোকগুলো উঠে এসেছে গাড়ির ছাদে। তাদের চোখে-মুখে ক্রুর হাসি। যেন কাঁটা-ছেঁড়ার জন্যে একটা অসহায় গিনিপিগ তারা পেয়ে গেছে।
লোকগুলো এগুচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের কয়েকজনের দেহ আহমদ মুসা ও স্টেনগানধারীদের মাঝখানে একটা দেয়াল সৃষ্টি করেছে।
লোকগুলো আরও ক্লোজ হয়েছে আহমদ মুসার।
হঠাৎ আহমদ মুসা এবাউট টার্ন করে লাফ দিয়ে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালবারে উঠে দেহে একটা ঝাঁকি দিয়ে দক্ষ সাঁতারুর মত শূন্যে সামনে দু’হাত বাড়িয়ে ড্রাইভ দিয়ে বাতাস কেটে ছুটল বসফরাসের নিল জলরাশির দিকে। পেছনের লোকগুলো তখন চিৎকার করে উঠে সবাই কাঁধের স্টেনগান হাতে নিয়ে গুলী করতে শুরু করেছে উড়ন্ত দেহ লক্ষ্যে।

মেজর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের বাম পাশ থেকে টেলিফোন বেজে উঠল।
বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।
তার সামনে একটা ফাইল খোলা। ছড়িয়ে আছে অনেক কাগজপত্র। সে ও জেনারেল তাহির তারিক দু’জনে কাগজগুলো পরীক্ষা করছিল। এ কাগজগুলো এনেছে তারা আয়েশা আজীমার ব্যক্তিগত ফাইল থেকে। নোটবুকগুলোও তার আনা হয়েছে। ডঃ শেখ বাজ তাদেরকে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সহযোগিতা করেছে। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু মৃতা স্ত্রীর কোন কিছুই সে তাদের কাছে গোপন রাখেনি। সে চেয়েছে তার স্ত্রীকে যারা ব্ল্যাকমেইল করেছে, ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যবহার করেছে, তাদের স্বরূপটি উদঘাটিত হোক। তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পাক তাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানবতার আশার প্রদীপ ‘আইআরটি’ (ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি)। তার স্ত্রীর শেষ পরিচয়টা তাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। ডঃ বাজ জেনারেল তাহির তারিকদের কাছ থেকে শুনেছে, তার স্ত্রী তাকে সব সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্যেই নিজের সব কথা সে বলেছে এবং সব অপরাধের স্বীকৃতি দিয়েছে। তার স্ত্রী নিজের দায়ভার নিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, কিন্তু চেয়েছে স্বামীর গায়ে যেন কোন কালো দাগ না লাগে। ইহুদী কন্যা হিসেবে ষড়যন্ত্রে শামিল থাকলেও স্বামীকে সে ভালবেসেছে প্রাণ দিয়ে। স্ত্রী আয়েশা আজীমা তাকে ঠকিয়েছে তার পরিচয় গোপন করে, জঘন্য অপরাধ করেছে তাকেও ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু সে সমগ্র অন্তর দিয়ে অনুভব করছে তার ভালোবাসায় সামান্য কোন খাদ ছিল না। ডঃ শেখ বাজের চোখে অবিরল অশ্রু শুধু এ কারণেই।
একরাশ বিরক্তি নিয়েই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল তাকাল টেলিফোনের সাইড টেবিলের দিকে। লাল, নীল, সাদা ও কালো অনেকগুলো টেলিফোন সেখানে। পিএবিএক্স ও প্রাইভেট কালো ও সাদা টেলিফোন দুটোই তাকে বিরক্ত করে বেশি।
কিন্তু নীল টেলিফোনটা বাজতে দেখে মুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের। এ টেলিফোনটা গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের।
টেলিফোন তুলে নিয়ে নিস্পৃহভাবে ওপারের কথা শুনল, দু’একটা নির্দেশও দিল।
টেলিফোন রেখে ঘুরে বসে কাগজ-পত্রে মনোযোগ দেবার আগে বলল, ‘জেনারেল তাহির, বসফরাস ব্রীজে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রচুর গোলা-গুলি হয়েছে। কিন্তু প্রাণহানির ঘটনা নেই। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ভয়ানক যানজট ছিল। বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট এখনও পুরো পাওয়া যায়নি।’
বসফরাস ব্রীজ, আর গোলা-গুলির কথা শুনে আগ্রহের সাথে মুখ তুলল জেনারেল তাহির তারিক। বলল, ‘ঘটনা ঘটেছে ক’টায়?’
‘পৌনে একটায়।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান ড. বাজের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল বারটা তিরিশ মিনিটে। গোল্ডেন হর্নে যাবার জন্যে তিনি যদি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে কতকটা এই সময়েই তো তার ব্রীজ অতিক্রম করার কথা।’
‘আপনি মিঃ খালেদ খাকানের বিষয়টা এর মধ্যে আনছেন কেন? আপনি কিছু ভাবছেন?’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক তেমন নয়, তবে এই সময় মিঃ খালেদ খাকান ঐ এলাকায় থাকার কথা, যদি তিনি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, এটাই বলছি।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
সংগে সংগে কথা বলল না জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। ভাবান্তর ঘটেছে তার চোখে-মুখে। ছোট হয়ে এসেছে তার দুই চোখ। সিরিয়াসলিই ভাবছে সে।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তার পর ঘুরল টেলিফোনের দিকে। তুলে নিল নীল টেলিফোন। একটা কল করল।
ওপার থেকে সাড়া পেতেই বলল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। হ্যাঁ, বসফরাস ইষ্ট পুলিশ স্টেশন! তোমরাই তো দেখেছ বসফরাসের ঘটনাটা?’
ওপারের উত্তর শুনে নিয়ে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘হ্যাঁ, বল, ওখানে কি ঘটেছে? হত্যা, কিডন্যাপের চেষ্টা? ব্রীজ থেকে একজন বসফরাসে লাফিয়ে পড়েছে? জানা গেছে সে কে? গ্রেফতার হয়েছে কেউ?’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের চোখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুইয়ের মিশ্রণ।
ওপ্রান্তের উত্তর শোনার পর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আক্রান্ত বলে যে কারটিকে তোমরা সন্দেহ করছ, তার নাম্বার কত?’
ওপার থেকে উত্তর পেল। উত্তর পাওয়ার সাথে সাথেই তার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশ ঘটল। দ্রুত কণ্ঠে সে বলল, ‘স্পটে কে আছে?’
উত্তর শুনে নিয়ে বলল, ‘আমরা যাচ্ছি সেখানে, জানিয়ে দাও ওদের।’
বলেই টেলিফোন রেখে ঘুরল জেনারেল তাহির তারিকের দিকে।
জেনারেল তাহিরের চোখে-মুখে প্রশ্ন, তার সাথে আশঙ্কার কালো ছায়া।
ঘুরে বসেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে, আক্রান্ত গাড়িটা খালেদ খাকানের। তার মানে তিনি ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন।’ শুষ্ক, উদ্বেগাকুল গলা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
মুখের আলো যেন দপ করে নিভে গেল জেনারেল তাহিরের। চোখে –মুখে তার এক বোবা আতঙ্ক। কয়েক মুহূর্ত তার বাক স্ফূরণ হলো না। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘তার পরের খবর কি, মানে খালেদ খাকানের খবর কি?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল তাহির তারিকের।
‘বসফরাসে অনুসন্ধান চলছে। পুলিশ, গোয়েন্দা ও নৌবাহিনীর কয়েকটা ইউনিট কাজে নেমেছে। চলুন আমরা যাই। যেতে যেতেই প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা জানাব।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহিরও।
উঠেই আবার বসে পড়ল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। বলল, ‘জেনারেল মিঃ তাহির, আপনি গাড়ির দিকে যান। জরুরি আরও কয়েকটা কল সেরে আমি আসছি।’
‘আসুন’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিক।
ঘর থেকে বেরিয়ে লিফট হয়ে নেমে এল আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের একদম গাড়ি বারান্দায়। এ বিশেষ গাড়ি বারান্দায় লিফটের সামনেই তার ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। একটু দুরেই এটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল দু’জন কমান্ডো। তারা গাড়ির সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছিল।
তারা জেনারেল তাহিরকে দেখে স্যালুট দিয়ে আবার স্থির দাঁড়িয়ে গেল।
নানা আশংকা জেনারেল তাহিরকে ঘিরে ধরেছে। আহমদ মুসা দু’শ দশ ফিট উঁচু বসফরাস ব্রীজ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে, এ কথা মনে হতেই বুক কেপে উঠছে জেনারেল তাহিরের। কোন মানুষ কি এমন সাহস করতে পারে। আহমদ মুসাই হয়ত পারে। কিন্তু তারপর কি ঘটেছে? আর ভাবতে পারছে না জেনারেল তাহির। গোটা সত্ত্বা তার একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠছে, আহমদ মুসার মহান জীবনের পরিসমাপ্তি আল্লাহ এভাবে করবেন না। চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠল জেনারেল তাহির তারিকের। সমগ্র অন্তর থেকে একটা প্রার্থনা তার উচ্চারিত হলো, ‘আল্লাহ তোমার সৈনিককে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার।’
লিফট থেকে বেরিয়ে এল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
দু’চোখের কোণ মুছে ফেলল জেনারেল তাহির তারিক।
লিফট থেকে বেরিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘জেনারেল তাহির, প্রধানমন্ত্রীকেও খবরটা দিলাম। সামরিক গোয়েন্দা সূত্রে তিনি ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে গেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টকেও এ খবর জানিয়েছেন। তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বসফরাস জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় ঘণ্টার জন্যে বিদেশি এবং যেকোন নৌযানের বসফরাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যেসব নৌযান বসফরাস ও মর্মর সাগরে আছে, সেগুলোর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাপক সন্ধান শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওখানে যাচ্ছেন। চলুন, আমরা চলি।’
বলেই নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। জেনারেল তাহির তারিক কোন কথা বলল না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জেনারেল মোস্তফার পেছন পেছন চলল।
ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছেই জেনারেল মোস্তফা কামালরা ব্রীজের ঠিক গোড়ার আইল্যান্ডে পুলিশের একটা জটলা দেখল। জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ঠিক এখানকার মত ব্রীজের ওপ্রান্তেও পুলিশ অস্থায়ী অফিস বসিয়েছেন। চলুন আমরা স্পটটা দেখে আসি।’
স্পটে দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার পরিত্যক্ত কারটিও ব্রীজের দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।
জেনারেল তাহিররা গাড়ি থেকে নামল।
দু’জন পুলিশ অফিসার স্যালুট করে এগিয়ে এসে বলল জেনারেল মোস্তফাকে, ‘স্যার, গাড়িটা এখানেই পাওয়া গেছে, একটুকুও সরানো হয়নি।’
‘থ্যাংকস অফিসার।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘চলুন গাড়িটাকে আগে দেখা যাক।’ বলে জেনারেল তাহির তারিক গাড়ির দিকে এগোলো।
গাড়ির ভেতর-বাহির পরীক্ষা করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল জেনারেল তাহির তারিক, ‘এটা খালেদ খাকানেরই গাড়ি, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গাড়িতে কোন কিছুই রেখে যাননি। তার মোবাইল, রিভলবার ও আইডি কার্ড তার পকেটেই ছিল।’
উদ্বেগ-আতঙ্কে ভরা জেনারেল মোস্তফা কামালের চেহারা। বলল, ‘ড্যাশবোর্ডের ভয়েস রেকর্ডার শূন্য। কিছুই বলে যাননি। বলবেন বা কি। আমি বুঝতে পারছি না, ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়ার অসম্ভব সিদ্ধান্তটা কেন নিলেন!’
‘সঙ্কটের চরম মুহূর্তে তার মনে যে কাজকে অগ্রাধিকার দেন সেটাকেই তিনি গ্রহণ করেন। যে কোন সঙ্কটে তার মনটা স্থির থাকে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠ শুষ্ক।
দু’জনেই গিয়ে দাঁড়াল ব্রীজের ফেন্স ওয়ালের সম্ভাব্য যে স্থান থেকে তিনি লাফিয়ে পড়েছেন সেখানে। নিচে বসফরাসের পানির দিকে তাকিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘তিনি বসফরাসের নিচে ঠিক লম্বভাবে গিয়ে পড়েছেন। এখানে দাড়িয়েই যদি ওরা ব্রাশ ফায়ার করে থাকে, তাহলে গুলির মুখে পড়ার তার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি না ততক্ষণে রেঞ্জের বাইরে গিয়ে থাকেন। যতই তার দেহটা নিচের দিকে নেমেছে, ততই তা ব্রীজের ইনওয়ার্ডের দিকে বাক নিয়েছে, আর ওদের ব্রাশ ফায়ারের গুলির গতি ব্রীজ থেকে আউটওয়ার্ড হওয়াই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু গুলী থেকে বাঁচলেও এত বড় দূরত্ব থেকে আছড়ে পড়ার আঘাত থেকে তিনি বাচবেন কি করে?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
বেদনায় মুখটা আরও চুপসে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘কিন্তু তার জীবনের ইতি এভাবে ঘটতে পারে না, অবশ্যই পারে না। আসুন আমরা আর কিছু না ভাবি।’
‘ভাবনাকে দেয়াল দিয়ে আটকানো যায় না। সুতরাং এ প্রসঙ্গ থাক। চলুন আমরা নিচের পুলিশের অপারেশন অফিসে যাই। অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছে চলুন দেখি।’
বলে গাড়ির দিকে এগোলো জেনারেল মোস্তফা কামাল।
জেনারেল তাহিরও গিয়ে গাড়িতে উঠল।
নীচে পৌছতেই পুলিশ অফিসাররা স্বাগত জানিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামালদের নিয়ে গেল তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী অফিসে।
‘নতুন কোন খবর আছে? প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেছে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘স্যার, অনুসন্ধান চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধানও চলছে। এ এলাকায় অনেককেই পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেসময় এখানে হাজির ছিল। আকস্মিক ঘটনা তাই অনেকেরই নজরে পড়েনি। অনেকের নজর গেছে ব্রীজ থেকে আসা ব্রাশ ফায়ারের দিকে। পানিতে পড়ার দৃশ্য দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া যাইনি এখনও।’ ঘটনার মনিটররত পুলিশ অফিসার বলল।
‘সিসিটিভি’র মনিটর থেকে তো এ দৃশ্য পাবার কথা। সেখানে কি দেখা গেছে?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘স্যার, এই মাত্র প্রিন্টগুলো এসেছে। দেখুন ছবিতে একব্যক্তিকে ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বসফরাসের পানি থেকে পঞ্চাশ ফিট লেবেলের পর তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। দু’দিক থেকে আসা দুই সারি জাহাজের আড়ালে চলে যান তিনি। সে সময় একটা জাহাজ বহরের দুই কলাম বসফরাস ব্রীজ অতিক্রম করছিল। জাহাজের দুই কলাম CCTV-র ফোকাসকে আংশিকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।’ বলল দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার।
জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির পুলিশ অফিসারের কথা শুনছিল, সেই ছবিগুলোও দেখছিল। তারা দেখল, পুলিশ অফিসার যা বলল ঘটনা তাই। আহমদ মুসার ডাইভ দেয়া দু’হাত সামনে ছড়িয়ে রেখে নিপুণ ডাইভারের মত ছুটে আসা দেহ বসফরাসের পানির কিছু উপরে এসে বিশাল জাহাজের আড়ালে চলে গেছে।
ছবিগুলোর দিকে নজর রেখেই জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘জাহাজের দুই কলামের মাঝ বরাবর ফাঁকা থাকার কথা, না কোন নৌযান চলছিল?’
‘চলার কথা না, ধরে নেয়া যায় চলছিল।’ বলল পুলিশ অফিসার।
তাহলে জাহাজের দুই কলাম ছাড়াও আরও ছোট-খাট নৌযানকে প্রত্যক্ষদর্শীর তালিকায় রাখতে হবে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘স্যার, সেটাকেও আমরা হিসেবে রেখেছি। সেসব নৌযানকে লোকেট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশ অফিসার বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘জাহাজ বহরটা কোন দেশের ছিল? ওদের বক্তব্য কি?’ জেনারেল তাহির বলল।
‘ওটা ছিল সোভিয়েত যুদ্ধ জাহাজের একটা বহর। যাচ্ছিল ওরা ভূমধ্যসাগরের এক মহড়ায় অংশ নিতে। প্রাথমিক যোগাযোগ ওদের সাথে হয়ে গেছে। তাৎক্ষনিক তারা বলেছে, ব্রীজ থেকে বসফরাসে পড়তে কাউকে তারা দেখেছে কিংবা এরকম কেউ তাদের জাহাজে পড়েছে অথবা উদ্ধার করেছে তারা কাউকে, এমন কোন খবর তাদের কাছে নেই। তবে তারা আরও চেক করে দেখবে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘ধন্যবাদ অফিসার!’ বলে জেনারেল তাহির তাকাল জেনারেল মোস্তফা কামালের দিকে। বলল, ‘আমার মনে হয় আমরা ঘুরে-ফিরে একটু দেখতে পারি। আপনি কি আসবেন?’
‘অবশ্যই, চলুন।’ বলে উঠে দাঁড়াল মোস্তফা কামাল।
পুলিশ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘আসুন আমরা গাড়ি না নিয়ে বসফরাসের তীর ধরে হাটি। করনীয় তো আমাদের কিছু নেই।’
‘চলুন। তবে আমি আশাবাদী কিছু একটা সংবাদ খুব তাড়া তাড়াতাড়িই আমরা পাব। নৌবাহিনীর ওয়াটার স্ক্যানিং কাজ শুরু করে দিয়েছে দেখছি। পানির যে কোন গভীরে হিউম্যান বডিকে ওয়াটার স্ক্যানার লকেট করতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া আরও গভীর হলো। বলল, ‘আমরা তাঁর বডি নয়, তাঁকে চাই আমরা। এই বসফরাসে এসে তিনি শেষ হয়ে যাবেন, তা হয় না, হতে পারে না।’ শুষ্ক কণ্ঠ জেনারেল তাহিরের।
‘এটা আমাদের সবারই চাওয়া। আল্লাহ আমাদের এই চাওয়াকে মঞ্জুর করুন।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
বসফরাসের প্রায় পানি ঘেঁষে প্রান্ত বরাবর আপ-ডাউন হাইওয়ে। তার পাশ দিয়ে সুদৃশ্য ফুটপাত। এই রাস্তাগুলো নীল বসফরাসের গলায় যেন হীরকের হার। বসফরাসের তীরে মাঝে মাঝে রয়েছে ফেরী ঘাট। ঘাটগুলো বোট, ফেরি ও মানুষের ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট বোটগুলো ঘাটে ছাড়াও তীরে ভিড়ে থাকে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম।
ব্রীজের নিচে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেছে সকলেই।
ব্রীজের নিচে বিরাট এক ফেরি ঘাট।
ঘাটে বেশ কিছু ফেরি ও বোট দাড়িয়ে আছে। এসব ঘাটে ফেরি ও বড় বড় বোট ছাড়াও ছোট ছোট বোটও ভাড়ায় পাওয়া যায়।
ফুটপাত দিয়ে হেঁটে ফেরিঘাট অতিক্রম করছিল জেনারেল তাহিররা।
‘ঘিয়ে ভাজা কোন কিছুর গন্ধ পাচ্ছি জেনারেল তারিক।’
বলে ডান দিকের পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকাল।
বসফরাসের তীর এখানে হাইওয়ে ও ফুটপাতের পর ঢালু হয়ে ক্রমশ উপরে পাহাড়ে উঠে গেছে। এই ঢালে গড়ে উঠেছে মনোরম সব রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও ঘর-বাড়ি।
জেনারেল তাহিরও তাকাল পাহাড়ের ঢালের দিকে।
‘জেনারেল তাহির, আমরা কিন্তু খেয়াল করিনি, লাঞ্চের সময় অনেক আগে পার হয়ে গেছে। বেশি উপরে নয়, এই ঢালেই সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা কি যেতে পারি?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
খেয়ে সময় নষ্ট করতে মন চাইছিল না জেনারেল তাহিরের। তার কাছে এখন আহমদ মুসার সন্ধান করার চেয়ে বড় কিছু নেই। তবে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, এ কথাও ঠিক। হয়ত জেনারেল মোস্তফা কামাল বোধ হয় বেশি কষ্ট পাচ্ছে ক্ষুধায়। জেনারেল তাহির সায় দিল জেনারেল মোস্তফা কামালের কথায়। বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি জেনারেল মোস্তফা।’
লাঞ্চের পিক আওয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবে মাঝে মাঝে টেবিল এ দু’চারজন লোক আছে। কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ বসে গাল-গল্প করছে। গল্পের প্রধান সাবজেক্ট হলো বসফরাস ব্রীজের ঘটনা।
গল্পের সাবজেক্ট শুনে খুশি জেনারেল তাহির তারিক। রেস্টুরেন্টের ঠিক নিচেই দুর্ঘটনার বাঁ ঘটনার স্থান।
মাঝখানের এক ফাঁকা টেবিল দেখে বসেছে জেনারেল তাহিররা।
খেতে শুরু করেছে তারা।
নানারকম কথা তাদের কানে আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। ব্রীজে গোলা-গুলি কারা করল, কেন করল-তা নিয়ে নানা রকম ধারনার কথা। ব্রীজ থেকে যে লাফ দিয়ে পড়েছে, সে পাগল না হয়ে যায় না। কেউ বলছে জীবন বাঁচাবার জন্যেই ওটা করেছে। আবার কেউ বলছে, জীবন বাঁচাবার জন্যে কেউ মৃত্যুমুখে ঝাপ দেয় না। বেঘোরে মারা গেল লোকটা।
জেনারেল তাহিরদের পেছনের টেবিলে তিনজন লোক এসেছে সব শেষে। এই মাত্র তাঁর খাওয়া শুরু করেছে। তাদেরই একজন বলল, ‘কিছু না জেনেই বলা হচ্ছে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে লোকটা। আসলে লোকটা মরেনি বলেই মনে হয়। একটা মোটর বোট তাঁকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে গেছে।’
তাঁর কথা শেষ হতেই তাঁর টেবিলের একজন বলল, ‘দেখেছ তুমি? তখন কোথায় ছিলে?’
‘আমিও একটা বোটে এই ঘাটের দিকে আসছিলাম। গোলা-গুলির মুখে সামনের ঐ বোটটি সামনের দিকে ছুটে পালায়, আমি পিছনের দিকে সরে যাই।’ বলল দ্বিতীয় লোকটি।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই।
শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে তারা। তাদের সমস্ত মনোযোগ এখন ওদের কথার দিকে।
ঐ টেবিলের তৃতীয় লোকটি বলল, ‘সোয়া দু’শ ফিট উপর থেকে পড়লে কারও কিন্তু বাচার কথা নয়।’
‘কিন্তু লোকটা যখন পানিতে ডুবে যাবার পর ভেসে উঠতে পেরেছে, তখন বলতে পার নিজ চেষ্টায় সে ভেসে উঠেছে। তার অর্থ সে মরেনি।’ বলল প্রথম লোকটি।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল চট করে পেছন ফিরে লোকটাকে একবার দেখে নিল। তারপর সে জেনারেল তাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘লোকটার কাছে আরও কিছু জানার আছে।’
‘ওদের খাওয়া শেষ হলেই ভাল হয়।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘না, এক মিনিট নষ্ট করা যায় না জেনারেল তাহির।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘তা ঠিক।’ বলল জেনারেল তাহির।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
গেল পেছনের টেবিলে।
‘এক্সকিউজ মিঃ জনাব’ বলে পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে লোকটার সামনে ধরে বলল, ‘আমি টার্কিশ ইন্টারনাল সিকিউরিটি সার্ভিস (TISS)-এর ডিজি জেনারেল মোস্তফা কামাল। আমি আপনাদের কথা সামনের টেবিল থেকে শুনেছি। যে লোকটা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে বসফরাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তুরস্কের সম্মানিত মেহমান তিনি। ঘটনার সাথে তুরস্কের মর্যাদা জড়িত হয়ে পড়েছে। যে বোটটি তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে তাঁর কোন হদিস কি দয়া করে দিতে পারেন?’
জেনারেল মোস্তফার পরিচয় জানার পর খাওয়া বন্ধ করে তিনজনই উঠে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের বহুল পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থা TISS-এর স্বয়ং ডিজিকে তাদের সামনে দেখে তারা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রথম লোকটি বলল, ‘সিওর স্যার, আমি বলছি।’
বলে একটু থামল লোকটি। স্মরণ করছে সে।
‘আপনারা বসুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওকে স্যার। ঠিক আছে। বলছি আমি।’
একটু থেমেই বলা শুরু করল, ‘বোটটির পেছনের দু’পাশেই নাম্বার সাইনের উপরে কনকর্ডের ছবি আঁকা ছিল। বোটে ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম ব্যবহার করা একটা আনকমন ব্যাপার। এ কারণেই ‘কনকর্ড’ সাইনটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাঁর সাথে নাম্বার সাইনটিও। নাম্বার সাইনটিও ছিল মজার। মনে পড়ছে নাম্বার সাইনটি ছিল- ‘এমভি’ ড্যাশ ‘বি’ ড্যাশ টি নাইনটি ট্রিপল নাইন (T90999)।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল পকেট থেকে কলম ও নোটপ্যাড বের করে দ্রুত নাম্বার লিখে নিল। তারপর সেখানে দাড়িয়েই পকেট থেকে অয়ারলেস বের করে একটা জরুরি মেসেজ ট্রান্সমিট করলঃ ‘রেড এলার্ট ফর অল সিকিউরিটি সার্ভিস অ্যান্ড পুলিশ। ‘এমভি ড্যাশ বি ড্যাশ টি নাইনটি থাওজ্যান্ড নাইন হান্ড্রেড নাইনটি নাইন’ নাম্বারের মোটর বোট যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে আটকান এবং আমাকে খবর দিন। বোটের বাড়তি চিহ্ন ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম। ওভার।’
মেসেজ শেষ করে জেনারেল মোস্তফা কামাল দাঁড়ানো লোকটিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি তুরস্কের সীমাহীন উপকার করেছেন। এমন একটা ক্লুর জন্যে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এবং পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন।’ বলল লোকটি। তাঁর কণ্ঠও আবেগঘন।
‘আমিন। আমরা সবাই এটা চাই।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল আবারো তাদের ধন্যবাদ দিয়ে তার খাবার টেবিলে ফিরে এল।
টেবিলে বসতে বসতে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কি করার আছে জেনারেল তাহির?’
‘চলুন, আমরা বোট নিয়ে আমরা বসফরাসের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাই। ও বোটটাতো ওদিকেই গেছে। বোট ডিটেক্ট হবার পর ও দিক থেকেই খবর আসবে। আমরা যতটা সামনে যাব ততটাই আমরা এগিয়ে থাকব।’
‘ঠিক বলেছেন, চলুন, উঠি।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুবার জেনারেল মোস্তফা কামাল একটা পুলিশ বোট কল করল।
রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে ঘাটে নেমে এসে দেখল, একটা পুলিশ বোট অপেক্ষা করছে।
একজন পুলিশ অফিসার তীরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
জেনারেল মোস্তফা কামালরা ওয়াক ওভার ব্রীজ দিয়ে পৌছতেই অফিসার দ্রুত এসে স্যালুট করে বলল, ‘স্যার, বোট রেডি।’
‘এস।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল বোটে উঠল। তার পেছনে জেনারেল তাহির। সবশেষে পুলিশ অফিসার।
বোটটা ছোট। দুই রোতে চারটি সিট।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল সামনের দুই সিটে বসল। পেছনের দুই সিটের একটিতে পুলিশ অফিসার।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আরেকটি পুলিশ অফিসার।
‘বোটটি ধীরে ধীরে হর্ন ও মর্মরের সংযোগস্থলের দিকে এগিয়ে নাও। ওখানে গিয়ে আবার ভাবব।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
ধীর গতিতে চলেছে বোটটি।
বসফরাসের কামাল আতাতুর্ক থেকে বসফরাস-হর্ন-মর্মর সাগরের সন্ধিস্থল খুব বেশি দূরে নয়। প্রায় এসে পড়েছে বোট সেখানে।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তাহির তারিকের অপেক্ষারও অবসান হলো।
ওয়ারলেস বিপ করতে শুরু করল।
শসব্যস্তে কল ওপেন করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
কথা বলে উঠল ওয়ারলেস।
‘আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আইদিন গোল্ডেন হর্নের আয়ুব সুলতান ব্রীজ থেকে। ব্রীজের ঘাটে টি ৯০৯৯৯ বোটটি পাওয়া গেছে। বোট ও বোটের লোকজনদের আটকানো হয়েছে। কোন নির্দেশ, স্যার। ওভার।’ ওপ্রান্ত থেকে বলল পুলিশ ইন্সপেক্টর আইদিন।
‘বোটে কোন যাত্রী আছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘নেই স্যার, তিনজন ক্রু ও মালিক ছাড়া আর কেউ নেই।’ পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল।
‘তুমি ওদেরকে আটকে রাখ, আমরা আসছি কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমরা এখন হর্নের মুখে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওয়ারলেস কল অফ করতেই উদগ্রীব কণ্ঠে জেনারেল তারিক বলল, ‘জিজ্ঞেস করলেন না বসফরাস থেকে উদ্ধার করা লোকটি কোথায়?’
‘বিষয়টা ওদের অজানাই থাক। বোটটা শত্রু পক্ষের কিনা কে জানে! আগে জানলে ওরা সাবধান হতে পারে, কিংবা কিছু ঘটেও যেতে পারে ওখানে। আমরা ক’মিনিটের মধ্যেই ওখানে পৌছাচ্ছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক আছে।’ জেনারেল তাহির বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল কোন কথা বলল না। তার দৃষ্টি সামনে হর্নের দিকে।
বোট ইতোমধ্যেই টার্ন নিয়ে দ্রুত গতিতে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করেছে।