৪৬. রোমেলি দুর্গে

চ্যাপ্টার

তোপকাপি ভিআইপি গোল্ড রিসোর্টের ভিআইপি ক্লিনিক।
সংজ্ঞা ফেরেনি তখনও আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসে আছে ডোনা জোসেফাইন।
কয়েকজন নার্স কক্ষটিতে। যে কোন নির্দেশের অপেক্ষায়।
কক্ষে প্রবেশ করল কয়েকজন ডাক্তার।
প্রধান ডাক্তার মানে ক্লিনিকের চীফ ডাঃ মোস্তফা সাইদ দ্রুত এগিয়ে এল ডোনা জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম সমস্ত পরীক্ষা শেষ। সব কিছু ওকে আছে। বুকে প্রচন্ড চাপের কারণে ফুসফুসে চাপ পড়ে ফলে অক্সিজেন শূন্য হয়ে যায় ফুসফুস। তার ফলেই সংজ্ঞা হারান তিনি। হার্ট, ব্রেন সব ঠিকমত কাজ করছে এখন। স্বাভাবিক হয়ে আসছেন তিনি।’
বলেই ডাঃ মোস্তফা সাইদ এগিয়ে গিয়ে আহমদ মুসার পালস দেখল। বলল, ‘আমি মনে করি, আর ক’মিনিটের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
আহমদ মুসার হাতটা আস্তে আস্তে বেদে রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, আমরা অফিসে আছি। কোন দরকার হলে নার্সকে বলবেন।’
ডাক্তার বেরিয়ে গেল। নার্সরাও। শুধু দু’জন নার্স থাকল।
ডাক্তাররা সান্ত্বনা দিলেও উদ্বেগের কালো মেঘ জোসেফাইনের মুখ থেকে কাটেনি। তবে আগের সেই অস্থিরতা এখন নেই।
ডাক্তাররা বেরিয়ে যেতেই জোসেফাইনের পারসোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান নার্স দু’জনকে বলল, ‘সিস্টার, তোমরা বাইরে তোমাদের টেবিলে গিয়ে বস।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে নার্স দু’জন বেরিয়ে গেল।
কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে জেতেই লতিফা আরবাকান বলল, ‘ম্যাডাম, শয়তানদের কয়েকজন স্যারের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। গোল্ড রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে তারা আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেছিল যে, ‘আমরা মিস্টার খালেদ খাকানের কর্মস্থল আইআরটিতে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু। আমরা খালেদ খাকানকে দেখতে এসেছি।’ পুলিশ আমার সাথে যোগাযোগ করলে, আমি তাদের নাম জানতে চেয়েছিলাম। যে পাঁচটি নাম তারা বলল, তাদের চারজনের নাম আইআরটির স্টাফদের সাথে মিলে গেল। একটি নামই শুধু নতুন। ইনি নাকি অফিসের নতুন রিক্রুট। যাদের নাম মিলে যায়, তাদের মধ্যে ডঃ শেখ বাজের নাম ছিল। ডঃ শেখ বাজের সাথে বছরখানেক আগে আমার ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়েছিল। আমি তাঁর সাথে কথা বলতে চাইলাম। কথা বলে দেখলাম সে নকল লোক। আরবী ধাঁচে ইংরেজি বলার চেষ্টা করলেও আমার জানা কোনো তথ্যই সে ঠিক মত বলতে পারেনি। পুলিশ ওদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা গোলা-গুলি চালিয়ে কয়েকজন পুলিশকে আহত করে পালিয়েছে। আপনার মনের উপর নতুন করে প্রেসার সৃষ্টি না হোক, এজন্যেই খবরটা আগে আপনাকে দেইনি।’
‘ধন্যবাদ লতিফা। তুমি একটা বড় বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়েছ। তুমি এতোটা সতর্ক না হলে বড় একটা কিছু ঘটতে পারতো। কিন্তু ওরা তো শক্তি বৃদ্ধি করে আবার ফিরে আসতে পারে।’ বলল জোসেফাইন।
‘সে সম্ভাবনা নেই। তোপকাপি প্রাসাদ ও সংলগ্ন গোটা এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। গোল্ড রিসোর্টকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল জোসেফাইন।
এ সময় আহমদ মুসার দুই হাত নড়ে উঠল আর নড়তে লাগল তাঁর চোখের দুই পাতা।
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোসেফাইনের। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ওর সংজ্ঞা ফিরে আসছে। যাও লতিফা তুমি আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে এস।’
লতিফা আরবাকান দ্রুত দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেও ফিরে দাঁড়াল। বলল, ‘ছোট সাহেবের ঘুম যদি না ভেঙ্গে থাকে?’
‘আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিও। তার আব্বার কথা শুনলে দেখবে ঘুমের সব জড়তা তার চলে যাবে।’ জোসেফাইন বলল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লতিফা আরবাকান।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
প্রথমেই তার দু’হাত নরম বেডের উপর বুলাল। তার খোলা চোখ কক্ষের ও জোসেফাইনের মুখে এসে নিবদ্ধ হতে রাজ্যের বিস্ময় নামল আহমদ মুসার চোখে। বলল, ‘জোসেফাইন তুমি! আমি কোথায়?’
জোসেফাইন ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে বসে তার চুলে হাত ধুঁকিয়ে বলল, ‘তুমি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে।’
‘আমি ছিলাম বসফরাসের পানিতে। এখানে এলাম কিভাবে? আর কাউকে দেখছি না, তুমি জানলে কিভাবে?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘বলছি। আল্লাহর হাজার শোকর। সোয়া দু’শ ফুট উঁচু থেকে কেউ লাফিয়ে পড়ার কথা ভাবতে পারে! আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম, এত দূরে, একেবারে তোমার এখানে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব পরে জানাব। বসফরাস থেকে একটা বোট তোমাকে তুলে নিয়ে আয়ুব সুলতান ব্রীজের ঘাটে পৌঁছে। জটলা দেখে সেখানে হাজির হওয়া আমার বান্ধবী জেফি জিনা তোমাকে দেখে চিনতে পেরে তোমাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে।’
‘মিস জেফি জিনা ওখানে? আমাকে উদ্ধার করার অর্থ কি? আমাকে কেউ কি বন্দী করেছিল?’ বল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘সব আমি শুনিনি। তোমাকে নিয়ে সবাই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে এটা লতিফা আমাকে বলেছে, তোমাকে এখানে আনার কিছুক্ষণ পরই চার পাঁচজন তোমার অফিস সহকর্মীর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। লতিফা ওদের নাম শোনার পর ওদের ভুয়া পরিচয়ের কথা জেনে গোল্ড রিসোর্টে ঢুকতে দিতে নিষেধ করে। তখন পুলিশকে ওরা আক্রমণ করে। তিনজন পুলিশ আহত হলেও সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’
একটু থামল জোসেফাইন। পরে বলল, ‘থাক এসব কথা। এসব নিয়ে তুমি এই মুহূর্তে ভেব না।’
‘ভাবছি না, অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি, নদীতেও ওদের পাহারা ছিল। ওরাই……।’
জোসেফাইন আহমদ মুসার ঠোঁটের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘প্লিজ, এসব বিষয় এখন থাক। আমাকে একটু সময় দাও। তোমাকে সংজ্ঞাহীন দেখে আমাদের দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।’ ভারী কণ্ঠ জোসেফাইনের। তার দুই চোখের কোনে অশ্রু চিক চিক করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। গভীর, অন্তরঙ্গ দৃষ্টি।
জোসেফাইনের একটা হাত ছিল আহমদ মুসার মাথায়, অন্য হাতটা ছিল বেডের উপর।
আহমদ মুসা বেডের উপর থেকে জোসেফাইনের হাত তুলে নিয়ে টানল জোসেফাইনকে নিজের দিকে।
জোসেফাইন বেডের উপর অনেকটা আলতোভাবে বসে ছিল। সে খসে পড়ল আহমদ মুসার বুকের উপর।
আহমদ মুসার দু’হাত তাঁকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার বুক থেকে তার মুখ তুলে তার হাতের বাঁধন থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, ‘দরজায় নার্সরা বসে আছে, আহমদ আব্দুল্লাহও এখনি এসে পড়বে।’
জোসেফাইন উঠে বসেছে এই সময় দরজায় নক হলো।
জোসেফাইন উঠে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’
প্রবেশ করল একজন নার্স। তার হাতে কর্ডলেস টেলিফোন। বলল, ‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, আপনার একটা কল এসেছে, জরুরি।’
‘কার কল’ জিজ্ঞেস করল জোসেফাইন।
‘জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তারিক।’ বলল নার্স।
জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে নার্সকে বলল, ‘নিয়ে এস টেলিফোন।’
জোসেফাইন টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি জোসেফাইন মানে মিসেস খালেদ খাকান।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমি জেনারেল মোস্তফা কামাল। মিঃ খালেদ খাকান কোথায়? আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘উনি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে। জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছেন জনাব। টেলিফোন তাঁকে দিচ্ছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘থাক, আমরা এখনি আসছি। আল্লাহ তাঁকে দ্রুত সুস্থ করে তুলুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন জনাব।’
‘ওকে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলল ওপার থেকে।
জোসেফাইনও টেলিফোন রেখে দিল।
ডাক্তাররা ভেতরে ঢুকল।
ডাক্তাররা আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে কিছু জরুরি জিজ্ঞাসাবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করল।
জোসেফাইন ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বিস্মিত হয়েছে। ডাক্তারদের কাউকে চিনতে পারছে না সে।
হঠাৎ জোরে দরজা ঠেলে একজন ঘরে প্রবেশ করল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সব ক্লিয়ার, তাড়াতাড়ি।’
তার কথা শেষ হতেই একজন ডাক্তারের হাতে রিভলবার উঠে এল। তাক করল আহমদ মুসাকে এবং চিৎকার করে বলল, ‘হারাজাদাকে ক্লোরোফরম করে বাঁধ।’
ডাক্তারবেশী তিনজন এগুলো আহমদ মুসার দিকে। তাদের একজনের হাতে ক্লোরোফরমের শিশি।
ঘটনার আকস্মিকতায় জোসেফাইন প্রথমে বিমূড় হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক হতে দেখেই জোসেফাইন সম্বিত ফিরে পেল। দ্রুত ওড়নার আড়ালে হাত দিয়ে কাঁধে ঝুলন্ত ছোট ব্যাগের পকেট থেকে ছোট্ট একটা রিভলবার বের করে আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক করে থাকা ডাক্তারকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলী ছুঁড়ল সে। প্রথমেই আহমদ মুসাকে বেকায়দা অবস্থা থেকে মুক্ত করা তার লক্ষ্য।
ডাক্তারটির মাথা গুড়িয়ে দিল জোসেফাইনের গুলী।
গুলীর শব্দে অবশিষ্ট তিনজন ফিরে তাকিয়েছে জোসেফাইনের দিকে।
যে লোকটি পরে ঘরে ঢুকেছিল, তারই চোখ প্রথম পড়েছিল জোসেফাইনের উপর। সংগে সংগে রিভলবার তুলে নিয়েছিল সে। জোসেফাইনও তার দিকে তাকিয়েছিল। সে নিশ্চিত ছিল আহমদ মুসাকে বাঁধতে ও ক্লোরোফরম করতে এগিয়ে যাওয়া তিনজনকে আহত মুসাই ম্যানেজ করতে পারবে।
জোসেফাইনের রিভলবারই প্রথমে টার্গেট করেছিল লোকটিকে। সুতরাং জোসেফাইনের রিভলবারের বুলেটই প্রথমে আঘাত করল লোকটিকে। বুলেটটি বিদ্ধ হয়েছিল তার বুকে। তার রিভলবারেরও ট্রিগার টেপা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বুলেটটি বিদ্ধ হবার পর মর্মান্তিক ঝাঁকুনি তার হাতকে কাপিয়ে দিয়েছিল। গুলীটি লক্ষভ্রষ্ট হয়ে জোসেফাইনের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ওদিকে আহমদ মুসা ওরা তিনজন একশন এ যাবার আগেই দু’পায়ের স্নেক নক ব্যবহার করে ওদের তিনজনকেই মাটিতে ধরাশায়ী করেছে এবং সংগে সংগেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার সংগে সংগেই জোসেফাইন তার দিকে রিভলবার ছুড়ে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা ওদের দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘যে যেভাবে আছ, সেভাবে থাক। নড়বার চেষ্টা করো না। তিনজনকে মারতে আমার তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না।’
এই সময় বাইরে অনেকগুলো পায়ের ছুটে আসার ভারী শব্দ পাওয়া গেল।
পরক্ষনেই দরজা ঠেলে ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল, জেনারেল তারিকসহ কয়েকজন পুলিশ।
ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। পুলিশকে বলুন এ তিনজনকে এরেস্ট করতে, মিঃ জেনারেল মোস্তফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, এরেস্ট কর তিনজনকে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওরা তিনজন তাকাল আহমদ মুসা, জেনারেল মোস্তফা, জেনারেল তাহির ও চারজন পুলিশসহ সবার দিকে। সবার হাতের রিভলবার, স্টেনগান তাদের দিকে তাক করা।
তিনজন পুলিশ ওদের দিকে এগোচ্ছিল।
চতুর্থজন পুলিশ অফিসার। সে বলল ঐ তিনজনকে লক্ষ্য করে, তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।
পুলিশ অফিসারটির কর্কশ নির্দেশের সাথে সাথেই ওরা শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে এবং তার সাথে সাথেই দেখা গেল তাদের অনামিকা আঙ্গুল তাদের মুখে চলে গেছে।
চমকে উঠে আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ওদের সামনে গিয়ে পড়ল। একজনের আঙ্গুল টেনে বের করল তার মুখ থেকে। কিন্তু দেখল সব শেষ হয়ে গেছে। নীল হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘দুর্ভাগ্য, হাতে পেয়েও এদের জীবিত ধরা যাচ্ছে না।’ স্বগত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘ওদের হাতের রিং এ পটাসিয়াম সায়ানাইডের মত কিছু ছিল নিশ্চয়!’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘হ্যাঁ, মিঃ জেনারেল। আগের ঘটনাগুলোতে এধরনের বিষয়ই ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রথম দু’জন দেখছি গুলীতে মরেছে। ওরা দু’জন নিশ্চয় আক্রমণে এসেছিল। এরা তিনজন আক্রমণে আসেনি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘আসলে ওরা সকলেই এসেছিল ডাক্তারের ছদ্মবেশে আমার কাছে আসার সুযোগ নিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করতে। এরা তিনজন এসেছিল আমাকে বাঁধতে এবং ওরা দু’জন রিভলবার নিয়ে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমি নিরস্ত তখন। আমি বাঁধাই পড়ে যেতাম যদি জোসেফাইন ওদের দুজনকে গুলী করে না মারতো। ওরা দু’জন মারা পড়ার পর আমি আক্রমণে যেতে সুযোগ পাই। আর তার রিভলবারও আমার দিকে ছুড়ে দেয়। সেটা দিয়েই ওদের নিষ্ক্রিয় করেছিলাম। তখনই আপনারা এসেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
ঘরের একপাশে দাঁড়ান জোসেফাইনের দিকে না তাকিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘তাঁকে মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞ আমরা তার প্রতি। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যা পারেনি, সেটা তিনিই করেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই জেনারেল তারিক বলে উঠল, ‘শুধু তাই নয়, বেগম খালেদ খাকান যে বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ়তার সাথে সংজ্ঞাহীন জনাব খালেদ খাকানকে হর্নের আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট থেকে উদ্ধার করে এনেছেন, সেটা বিস্ময়কর। যারা বসফরাস থেকে উদ্ধার করে খালেদ খাকানকে আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট এ নিয়ে এসেছিল, তাদের হাত থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা মিঃ খালেদ খাকানকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বেগম খালেদ খাকান সেখানে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হন এবং নিজেকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আপনাকে উদ্ধার করে আনতে সমর্থ হন।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা কারা? মানে আমার আইআরটির শত্রুরা। ওরাই যদি হয়, তাহলে একা জোসেফাইন আমাকে ছাড়িয়ে আনল কি করে? কি ঘটনা বলুন তো? আমি কিছু শুনেছি! পুরোটা বলুন।’
‘যারা আপনাকে বসফরাস থেকে তুলে নিয়েছিল, তাদের খোজ পাওয়ার পরই আমরা হর্নের আইয়ুব ফেরিঘাটে চলে আসি। ওদেরকে আমরা পেয়ে যাই। জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা সব কিছু জেনে নেই আপনাকে যাতে দ্রুত খুঁজে পেতে পারি। তারা বলেছে, আপনাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ওখানে ওরা পৌছার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’জন লোক এসে হাজির হয়। ওরা মনে হয় জেনেই এসেছিল। এসেই আপনাকে দাবি করল যে, আপনি ওদের লোক বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তারা যখন ওদের সাথে কথা বলছিল এই সময় আপনার স্ত্রী জোসেফাইন ম্যাডাম পাশ দিয়ে ঘাট এ নেমে যাবার পথে ওখানে দাড়িয়ে যান। তিনি আপনাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসেন। তখন উদ্ধারকারীদের সাথে আলাপ চলছিল ওদের। ম্যাডাম জোসেফাইন দ্রুত এগিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘এঁর এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে ওঁর?’ উদ্ধারকারীদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করেন এঁকে আপনি চেনেন?
ম্যাডাম জোসেফাইন কথা বলায় আগের যারা মিঃ খালেদকে আগে থেকেই দাবি করছিল, তারা তেড়ে উঠে। একজন বলে, মিথ্যা বলছে এই বিদেশী মহিলা। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। ইতিমধ্যেই দু’জন পুলিশ এসে দাড়িয়েছিল। তারাও শুনছিল কথা। লোকটার কথা শেষ হতেই ম্যাডাম জোসেফাইন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমার নাম মারিয়া জোসেফাইন। ইনি আমার স্বামী। নাম মিঃ খালেদ খাকান।’
সংগে সংগেই ওরা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওঁর নাম খালেদ খাকান। ইনি ইনিস্টিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। উনি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। দেখুন ইনি ইউরোপীয় আর মিঃ খাকান এশিয়ান।’
পুলিশের একজন এগিয়ে এসে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার পকেট সার্চ করে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। বলেই পুলিশটি জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জোসেফাইনকে, ‘উনি সত্যিই স্বামী হলে বলুন, উনি যে প্রতিষ্ঠান এ চাকরি করেন তার পুরো নাম কি?’ ম্যাডাম সঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করে, ‘বল, উনি কোন পদে চাকরি করেন?’ ওরা উত্তর দিতে পারে না। পুলিশ ম্যাডামকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। ম্যাডাম সঠিক উত্তর দেন। এরপর আপনার উচ্চতা ও আইডি মার্ক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। ওরা উত্তর দিতে পারে না। ম্যাডাম ঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাকে ম্যাডামের গাড়িতে তুলে দেয়। ম্যাডাম নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে পুলিশকে অনুরোধ করে তাদের পৌঁছে দিতে। পুলিশ আপনাকে কাছের ক্লিনিকে ভর্তি করতে বললে, ম্যাডাম বলেন, তোপকাপি এলাকায় আমাদের গোল্ড রিসোর্টে নিজস্ব ক্লিনিক রয়েছে, তাঁকে ওখানেই নিতে চাই।’ পুলিশের গাড়ি ম্যাডামের গাড়ির পেছন পেছনে এসে এই গোল্ড রিসোর্টে পৌঁছে দিয়ে যায়।’
কথা শেষ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার চোখেমুখে অপার বিস্ময়। সে অবাক হয়, জোসেফাইনের একজন নতুন বান্ধবী জেফি জিনা তার জন্য এতটা করেছে! নিজেকে ভিন্ন একজনে মানুষের স্ত্রী বলেও পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু জেফি জিনা আমার নাম, আমার প্রতিষ্ঠানের নাম, আমার পদের নাম জানতে পারে, কিন্তু আমার উচ্চতা ও আইডি মার্ক জানল কি করে! এ জিজ্ঞাসার কোন উত্তর পেল না আহমদ মুসা। বরং বিস্ময় বাড়লই তার।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা।
এই বিস্ময় জোসেফাইনেরও চোখে-মুখে। জেফি জিনা সেখানে আমার নামে পরিচয় দিয়েছে! হ্যাঁ, সে পরিচয় না দিলে তো সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে পারতো না। জেফি জিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল জোসেফাইনের মন। অকল্পনীয় ও দুঃসাহসিক এক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে সে। ভাগ্যিস জেফি জিনার দেওয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়নি। ভুল প্রমাণ হলে সেও বিপদে পড়তো। কিন্তু জেফি জিনা আহমদ মুসার এসব তথ্য জানল কি করে। এসব ভাবনা তার বিস্ময় আরও বাড়িয়েই দিল।
জেনারেল মিঃ মোস্তফা কামাল বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, ক্লিনিকের ভিন্ন একঘরে আপনাকে নিতে হবে।’
জেনারেল মোস্তফার এ কথার দিকে কোন মনোযোগ নেই আহমদ মুসার। বলল, ‘কি ঘটল বলুন তো। শুরুতেই তো এরা একবার এ ক্লিনিকে হানা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে তো সতর্ক পাহারাই থাকার কথা ছিল।’
পুলিশ অফিসারের চোখে সঙ্কুচিত ভাব ফুটে উঠল। সে একটু এগিয়ে সামনে পড়ে থাকা একটি লাশের গা থেকে ডাক্তারের অ্যাপ্রন সরিয়ে বলল, ‘স্যার, এই দেখুন এরা সুপার সিকিউরিটি ফোর্স (SSF) এর ইউনিফরম এরা এসেছিল। এক গাড়িতে ওরা ১৫জন এসেছিল। ওরা এসে প্রথমেই গোল্ড রিসোর্ট চেকপোস্টের দখল নিয়েছিল। এজন্য পুলিশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। ওদের বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষে যেতে হয়, এ সাহস তারা পায়নি। ওদের কয়েকজন চেকপোস্ট দখল করে পুলিশদের নিরস্ত্র করে সেখানকার পুলিশদের হত্যা করে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার দিয়ে। ভুয়া SSF-এর অবশিষ্ট কয়েকজন অন্য পুলিশদের দিকে ছুটে যায়। বাকিরা ছুটে আসে ক্লিনিকের দিকে। ডাক্তাররা বলেছে, ‘সশস্ত্র লোকরা ভেতরের ডাক্তারদের পোশাক খুলে নেয়।’
থামল পুলিশ অফিসারটি।
সংগে সংগেই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘SSF-এর একটা ইউনিট আসছিল তোপকাপি প্রাসাদে। তাদের গাড়ি নির্জন এপ্রোচ গার্ডেনে প্রবেশের সংগে সংগেই একটা গ্যাস বোমা এসে পড়ে গাড়িতে। মুহূর্তে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে সবাই। ঐ SSF-দের ইউনিফরম ও গাড়ি নিয়ে সন্ত্রাসীরা গোল্ড রিসোর্টে হামলা চালায়। এক মাত্র ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে বাঁচবার চেষ্টা করেও আংশিক আক্রান্ত হয়। সে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়ে টেলিফোন করে SSF হেডকোয়ার্টারে। আমরা জানতে পারি তার পরেই। এসএসএফ উদ্ধার ইউনিট ছুটে আসে, আমরাও ছুটে আসি। পুলিশও খবর পেয়ে পৌঁছে যায়।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে।
তখন তিনজন ডাক্তার প্রবেশ করল ঘরে। তাদের কারও ডাক্তারের অ্যাপ্রন নেই। অন্যান্য স্টাফদের সাথে এ তিনজন ডাক্তারকেও আটকে রেখেছিল সন্ত্রাসী ‘থ্রী-জিরো’র লোকরা।
ঘরে প্রবেশ করল এ সময় জোসেফাইনের পার্সোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও আতঙ্ক।
সে ছুটে এল ঘরের একপাশে দাঁড়ানো জোসেফাইনের কাছে।
‘ডাক্তার, আপনারা মিঃ খালেদ খাকানকে ভিন্ন ঘরে নিয়ে যান। তাকে ভাল করে দেখুন। জ্ঞান ফেরার পরই তার উপর দিয়ে বিরাট ধকল গেছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল একজন ডাক্তারকে লক্ষ্য করে।
‘প্লিজ জেনারেল মোস্তফা, আপনারা আপত্তি না করলে ওকে এখন অন্য ঘরে নয়, আমি বাসায় নিয়ে যেতে চাই।’ বলল জোসেফাইন।
জেনারেল মোস্তফা কামাল জোসেফাইনের দিকে চকিতে একবার মুখ তুলল, মুখ নামিয়ে নিল সংগে সংগেই। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম। আমাদের আপত্তি নাই।’
তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্য করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘আপনারা জনাব খালেদ খাকানকে দেখুন। তারপর ওকে গোল্ড রিসোর্ট কটেজে রেখে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে আসুন।’
ডাক্তারদের দিক থেকে ফিরে জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘এখন থেকে গোল্ড রিসোর্টের নিরাপত্তায় পুলিশের সাথে সাথে এসএসএফও থাকবে।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল, তার সাথে সাথে জেনারেল তাহিরও।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা পরে কথা বলব। এখন চলি।’ আহমদ মুসার দিকে দিকে ফিরে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন। আয়েশা আজীমা মানে ডঃ বাজের ওখান থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তেমন কিছু নয়। তবে ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। এক সাথে সব পরীক্ষা করা যাবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আর একটা কথা। ওরা এখন মরিয়া হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তার দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দোয়া করুন মিঃ খালেদ খাকান। আর আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আল্লাহ আপনাকে যেভাবে বাঁচিয়েছেন, সেভাবেই আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
ওরা বেরিয়ে গেল।
‘স্যার, পাশের রুম এ চলুন। আমরা আপনার ব্লাডপ্রেসার ও হার্টবিটটা একটু দেখতে চাই।’ বলল একজন ডাক্তার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে গাঁট হয়ে বসেছিল আহমদ মুসার কোলে। তার চোখে-মুখে কিন্তু আনন্দের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি। সে বারবারই তাকাচ্ছে ছড়ানো রক্ত আর পরে থাকা লোকগুলোর দিকে।
জোসেফাইন এগিয়ে গিয়ে আহমদ আব্দুল্লাহকে আহমদ মুসার কোল থেকে নিয়ে বলল, ‘ও আমার কাছে থাক। এসো পাশের রুমে।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
লতিফা আরবাকান গিয়ে জোসেফাইনের কোল থেকে আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি স্যারকে পাশের রুম এ নিয়ে যান।’
আহমদ আবদুল্লাহ লতিফা আরবাকানের কোলে উঠেই তার মাথায় বাঁধা রুমাল নিয়া টানাটানি আরম্ভ করল।’
‘হ্যালো স্যার জুনিয়র, একি করছ তুমি। তোমার তো কাজ হবে মানুষের নেকাব রক্ষা করা, বেনেকাব করা নয়।’ বলল লতিফা আরবাকান। তার মুখে আনন্দের হাসি।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘বল বেটা আহমদ, এটা আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদ।’
আহমদ মুসার ঠোটে হাসি।
চোখ তার নিচু।
হাঁটতে শুরু করেছে সে দরজার দিকে।
জোসেফাইনও তার পাশে হাঁটছে।
লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহর বিদ্রোহের সাথে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে আর ওদের পেছনে পেছনে হাঁটছে।
সবশেষে বেরিয়ে এল ডাক্তাররা।
দরজার বাইরে পুলিশ, এসএসএফ-এর লোকরা ও দু’জন ক্লিনার দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতেই পুলিশ ও এসএসএফ-এর লোকরা তাকে স্যালুট করল।
একজন পুলিশ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে পাশের ঘরের দিকে নিয়ে চলল।

বিস্ময়কর এক স্থানে তোপকাপি প্রাসাদের গোল্ড রিসোর্ট অতিথিশালা।
অতিথিশালার ডুপ্লেক্স কটেজের দু’তলার পূর্ব দিকের একটা ইজি চেয়ারে আধ-শোয়া অবস্থায় আহমদ মুসা। তার স্থির দৃষ্টি সামনে, এক খণ্ড সাগরের বুকে। মর্মর সাগর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের মিলিত স্থান এটা। এই সাগর শুধু পানির নয়, স্মৃতিরও এক সমুদ্র, তোপকাপি প্রাসাদের মত গৌরবেরও সাগর এটা। ইউরোপ বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনীর কলতানে মুখরিত ছিল এই সাগর। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ, সুলতান সুলায়মান, সুলতান বায়েজিদের মত জগত বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা হর্ন-বসফরাস-মর্মরকে হয়তো এভাবেই দেখেছেন।
নিজেকে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা।
একটি ট্রেতে করে দুই গ্লাস ফলের রস ও একটি বাটিতে বাদাম নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করল জোসেফাইন।
আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ট্রেটা দুই ইজি চেয়ারের মাঝখানের টি-টেবিলে রেখে পাশের ইজি চেয়ার এ বসল জোসেফাইন।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ কোথায়?’
‘লতিফার সাথে পেছনের বাগানে।’ বলল জোসেফাইন।
‘লতিফার সাথে ভাব হয়েছে কেমন? কিছুক্ষণ আগে আমার কোলে উঠে তো বিদ্রোহ করল।’
‘ওটা বিদ্রোহ ছিল না, ছিল তোমার কোলে থাকার ওঁর আকাঙ্ক্ষা। তোমাকে সব সময় পায় না, পেলে আর ছাড়তে চায় না।’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি, এখন আবার বাচ্চাকেও কষ্ট……।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। জোসেফাইন আহমদ মুসার মুখে হাত চাপা দিল। বলল, ‘এ প্রসঙ্গ থাক। জেফি জিনার তখন শেষ হয়নি। কিছু ভাবলে?’
‘জেফি জিনা নিজেকে আহমদ মুসার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন, এটা সে সময়ের জন্যে খুব স্বাভাবিক ছিল। স্ত্রী পরিচয় না দিলে তিনি আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারতেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে সময়ের জন্যে ওটা খুব স্বাভাবিক ছিল অবশ্যই। কিন্তু একজন মেয়ে নিজেকে অন্য কারও হৃদয় অত্যন্ত বড় না হলে, অসম্ভব আন্তরিক না হলে বান্ধবীর স্বামীকে ঐ অবস্থায়ও নিজের স্বামী বলে পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। আর তার সাথে আমার পরিচয়ও তেমন নয়। আসলে তার মত এমন কাউকে আমি জীবনে দেখিনি, তিনি এসেই যে আমাকে জয় করে নিয়েছেন। আমি তাকে কতোটা ভালবেসেছি জানি না, কারণ তার পরীক্ষা কখনও হয়নি। কিন্তু তিনি আমাকে অসম্ভব রকম আপন করে নিয়েছেন।’ জোসেফাইন বলল।
‘তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। তিনি সত্যিই অসাধারণ একজন। কিন্তু আমার সাথে তার দেখা হলো না। তিনি কি বান্ধবীর স্বামীকে এড়িয়ে চলছেন? সংজ্ঞাহীন একজনকে নিয়ে এসে, তার সংজ্ঞা না ফিরে আসতেই চলে যাওয়ার অর্থ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইনকে একটু বিব্রত দেখালো। এই চলে যাওয়াটা তার কাছেও স্বাভাবিক মনে হয়নি। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘জেফি জিনা একজন শ্বেতাঙ্গীনি হলেও ইসলামের বিধি-বিধান আন্তরিকভাবে মেনে চলেন। হতে পারে বিনা প্রয়োজনে বান্ধবীর স্বামীর মুখোমুখি হওয়াকে ঠিক মনে করেন না।’
‘হতে পারে। কিন্তু বলত, আমার উচ্চতা, ওজন, আইডি মার্ক, ইত্যাদি তথ্য তিনি কিভাবে জানলেন? এতো সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি গণক এমন দাবি নিশ্চয়ই করবেন না।’
‘এ বিস্ময় তো আমারও। জেফি জিনা টেলিফোন করলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ কথা। সে হেসে বলেছল, ‘এটা আল্লাহরই একটা সাহায্য। এ সাহায্য এমনভাবে ওঁর জন্যে আসবে, এটা আল্লাহর তরফ থেকেই ব্যবস্থা হয়েছিল।’ বলল জোসেফাইন।
‘এটা জবাব বটে, কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন উত্তর দেবার আগেই টি-টেবিলে রাখা আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা। কল অন ও লাউডস্পিকার অন করে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো।’
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল কণ্ঠ, ‘আসসালামু আলাইকুম। থ্যাংকস গড, আপনাকে পেয়েছি স্যার। আমি খুব বিপদে।’
‘বলো সাবাতিনি। কি ঘটেছে, কি বিপদ?’ আহমদ মুসা বলল। হাতের চায়ের কাপটি টি-টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা।
ওপ্রান্ত থেকে সাবাতিনির কণ্ঠ, ‘আজকেই আমাকে রোমেলী দুর্গে যেতে হবে সেই কাজের জন্যে।’
‘হ্যাঁ, আজ প্রধান বিজ্ঞানী আন্দালুসির সাপ্তাহিক অবকাশে বাসায় যাবার কথা। কিন্তু তুমি বিপদ ভাবছো কেন?’
‘বিপদ নয় কেন? ধরা পড়ে গেলে হয় জেলে যেতে হবে, নয়তো গুলী খেয়ে মরতে হবে। আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ওরাও ছাড়বে না।’
‘ছাড়বে না বলছো কেন? ওরা কি তোমাকে কোন থ্রেট করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘থ্রেট ওইভাবে করেনি তবে বলেছে, সহজ কাজটা তোমাকে পারতেই হবে। মনে রেখ, আমাদের কোন প্রোগ্রামে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই কিন্তু। এই কথা থ্রেট ছাড়া আর কি!’
থামল সাবাতিনি মুহূর্তের জন্যে। বলে উঠল আবার, ‘স্যার, শখের বশে গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলাম। এমনটা হবে ভাবিনি। মনে হচ্ছে আমাকে তারা তাদের কর্মী মনে করছে। তাদের লোকদের মতই আমাকে ডিল করছে। কিন্তু আমি ওদের লোক নই, ওদের কোন পয়সা আমি নেই না। আমার খুব ভয় করছে স্যার।’ কান্নাভেজা কণ্ঠ সাবাতিনির।
‘কোন ভয় নেই। তুমি ঠিক সময়ে রোমেলী দুর্গে যাও, সাহসের সাথে কাজটা করবে। যাই ঘটুক আমি দেখব। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল সান্ত্বনার সুরে।
‘কিন্তু আপনি কোথায়? কিভাবে আমাকে দেখবেন। তাহলে আপনি রোমেলী দুর্গে আসুন।’ আকুল অনুরোধ ঝরে পড়ল সাবাতিনির কণ্ঠে।
‘আমার উপর আস্থা আছে?’
‘আছে স্যার। একশ ভাগের বেশি।’
‘তাহলে যাই ঘটুক, মনে করবে আমি তোমার পাশে আছি। শোন, তোমার প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচ এখন কোথায়?’
‘মানে এখন বর্তমানে?’
‘হ্যাঁ ’
‘তিনি ছুটিতে যাচ্ছেন। আজই ছুটি নিয়েছেন। টিচার্স কোয়ার্টার থেকেও বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন বসফরাসের ওপারে ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে।’
একটু চিন্তা করল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কাজের জন্যে সে রিভলবারটা তিনি তোমায় দিয়ে দিয়েছেন?’
‘না দেননি। আমি এখন সেখানে যাচ্ছি। ওটা দেবার জন্যে তিনি ডেকেছেন।’
‘কিভাবে যাবে, চিনবে কি করে?’
‘ঠিকানা দিয়েছেন স্যার এইমাত্র।’
‘কি ঠিকানা?’
‘ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিণ পাশ বরাবর রাস্তার ওধারে ২৯৫ নাম্বার বাড়ি। আমাকে বলা হয়েছে, বাড়িটির গেটের শীর্ষ ফলাগুলোর মধ্যে ডান থেকে নাম্বার শিষ ফলা স্পর্শ করে গেটবক্সের সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে, মিনিট খানেকের মাঝেই একজন বেরিয়ে এসে একটা গিফটবক্স দিয়ে যাবে।’
‘আর কোন পরামর্শ দিয়েছেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। যদি ধরা পড়ে যাই আমি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের কোন লোক ধরা পড়ে না। যদি বোঝ তুমি ধরা পড়ছ তাহলে তোমার রিভলবারের ট্রিগার-রিং এর মাথার উপরে একটা লাল বোতাম আছে, তাতে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দেবে। সংগে সংগে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। রোমেলী দুর্গ থেকে তোমাকে আমরা সংগে সংগেই উদ্ধার করে ফেলব।’ থামল সাবাতিনি।
লাল বোতামের কথা শুনতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সাবাতিনি থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘সাবাতিনি খবরদার, ভুলেও লাল বোতামে চাপ দেবে না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন সাবাতিনির। তার কণ্ঠে ভয়।
‘ওতে ‘পয়জন পিস’ আসে।চাপ দেবার সংগে সংগেই তোমার মৃত্যু হবে। ভয় করো না, লাল বোতামে চাপ না দিলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
সাবতিনি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। পরে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমাকে বাঁচালেন। স্যার, আমার বাসায় এমন মৃত্যু দেখেছি। মনে পড়ছে আমার। ওরা এতবড় বিশ্বাসঘাতক, এতবড় খুনি স্যার। আমি তার অনুরোধে শখের বসে কাজ করছি, কোন বিনিময় তো ওদের কাছে নেইনি।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়া সাবাতিনির কণ্ঠ।
আহমদ মুসা কিছু বলবার আগেই সাবাতিনির কণ্ঠ আবার শোনা গেল, ‘আমি যদি ওদের এই কাজ না করি, করবো না আমি।’
‘ওদের এই কাজ না করেও তুমি বাঁচতে পারবে না। তোমার আব্বা-আম্মার উপরও বিপদ নেমে আসবে। ওদের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই। তার চেয়ে শোন, ওরা যেভাবে বলছে কাজটা করে দাও, শুধু লাল বোতামে চাপ দেয়া ছাড়া। কাজটা ঠিকভাবে করেছ, সেটা ওদের খুবই দরকার আর এটা তোমার বাঁচার জন্যে দরকার। আমাদের জন্যেও খুব দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আগের দুটো বুঝলাম, আপনাদের কেন দরকার সেটা বুঝলাম না স্যার।’ সাবাতিনি বলল।
‘ওরা হেলিকপ্টার ফলো করবে এবং বিজ্ঞানীর বাড়ি যাবে। ওদেরকে এভাবে আমরা দিনের আলোতে আনতে চাই।’
‘বুঝেছি স্যার। ব্যাপারটা চোরের উপর বাটপারি।’ বলল সাবাতিনি। তার কণ্ঠ এবার হালকা।
থেমেই আবার বলে উঠল সাবাতিনি, ‘ওদের নয় স্যার, আপনার নির্দেশেই আমি এ কাজ করবো।’
‘ওয়েলকাম সাবাতিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। ওখানে তোমার ধরা পড়ার কোন ভয় নেই, ওদিক থেকে তোমার ক্ষতি হবে না। আমার উপর নির্ভর করতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমার পরিচিত দুনিয়ার মধ্যে আমি সবচেয়ে আপনার উপরই নির্ভর করি। আপনি বললে আমি বোধহয় আস্থার সংগে আগুনেও ঝাপ দিতে পারি।’
‘এমন অন্ধ নির্ভরতা ঠিক নয় সাবাতিনি। আল্লাহর পরে নিজের বিবেককেই মনে করতে হবে সবচেয়ে বড়। যাক, শোন, প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের কোন আইডি মার্ক আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তার মাথায় একটা চুলও নেই। তাই তিনি সবসময় লাল তুর্কি টুপি পড়ে থাকেন। চোখ দুটো তার তীরের মত তীক্ষ্ণ। খুব অস্বস্থিকর চোখের দৃষ্টি। বোধহয় এটা আড়াল করার জন্যে গোল্ডেন কালারের ডীপ সানগ্লাস পরেন। তার বাঁ কানের নিচে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। ফেস মেকআপ দিয়ে ওটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। আর……।’
সাবাতিনিকে আর এগুতে দিল না আহমদ মুসা। তার কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর দরকার নেই সাবাতিনি। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি ওখানে যাত্রা করছি স্যার। ওখান থেকেই রোমেলী দুর্গে আসবো। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওকে সাবাতিনি। ওয়া আলাইকুম সালাম। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।’
বলে আহমদ মুসা কল অফ করে মোবাইল রেখে দিল।
মোবাইল রাখতেই জোসেফাইন বলল, ‘তুমি তাকে আশ্বাস দিলে, কিন্তু মেয়েটি উভয় সঙ্কটে। একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে পুলিশে ধরা পড়ার ভয়। কেন তুমি তাকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলে?’
‘তুমি জান, মেয়েটি আগেই ওদের ট্রাপে পড়েছে। ওদের ইচ্ছে মত না চললে, তাকে ওরা বাঁচতে দেবে না।
আমি তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।’
‘কিভাবে?’
‘সাবাতিনি ওদের দেয়া দায়িত্ব পালন করবে, তাতে সে ও তার পরিবার বাঁচবে। মনে করেছিলাম, ওকে গ্রেফতার করাব। কিন্তু তা করলে শত্রুরা তাদের বর্তমান প্রোগ্রাম পাল্টে ফেলবে। আমরা ওদের ফাঁদে ফেলার সুযোগ হারাব। অন্যদিকে সাবাতিনিকে ওরা কোন সন্দেহ করতে পারবে না। তার ও তার পরিবারের কোন ক্ষতি হবে না। সে বাইরে থাকলে আরেকটা উপকার হবে, শত্রুদের সম্পর্কে জানার সে একটা মাধ্যম হবে।’
‘কিন্তু মেয়েটিকে এই বিপদজনক কাজে ব্যবহার করা তোমাদের ঠিক হবে না। তোমার উপর মেয়েটির সীমাহীন আস্থা।’
‘আমি জানি জোসেফাইন। আমার বা আমার মিশনের জন্যে তাকে ব্যবহার করিনি। আমি তা করি না। আমার ভার আমিই বহন করি। আজ তাকে আমি চাপ দিয়ে রোমেলী দুর্গে যে পাঠালাম, সেটা তার ও তার পরিবারের ভালোর জন্যেই। প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের ঠিকানা ও আইডি জানায় আমার উপকার হয়েছে, কিন্তু তাতে তার ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন একটু এগিয়ে এসে আহমদ মুসার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমার গর্ব যে, তোমার এই সুবিচারবোধ অন্য যে কারো চেয়ে বেশি।’
আহমদ মুসা কাঁধ থেকে জোসেফাইনের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আল্লাহর বান্দাদের তো উচিত নিজের সুবিধার চেয়ে অন্যের অসুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়া। সুন্দর ও শান্তির সমাজ, যা আল্লাহ চান, এভাবেই গড়ে উঠতে পারে।’
বলেই আহমদ মুসা এক হাত দিয়ে মোবাইলটা আবার তুলে নিল।
‘জেনারেল মোস্তফাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেই!’ বলে আহমদ মুসা একটা কল করল।
ওপারে জেনারেল মোস্তফার কণ্ঠ পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, সাবাতিনি রোমেলী দুর্গে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী মিঃ আন্দালুসির হেলিকপ্টারের টেকঅফ ক’টায়?’
‘এখন থেকে দুঘণ্টা পর ঠিক বেলা দশটায়। এই মাত্র আমি সব খোঁজ নিলাম সব ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘প্রোগ্রামের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে জেনারেল মোস্তফা। সাবাতিনিকে তার কাজ শেষ করে নীরবে চলে যেতে দিতে হবে। আচ্ছা বলুন তো, অভিজাত সিজলি বা বিয়েগ্ল এলাকায় কোন ভিআইপির বাড়ি কি খালি আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা একটু চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ, সুইচ কনসুলেটের একটা ভাড়া নেয়া বাড়ি খালি হয়েছে। সুইচ কনসাল আঙ্কারায় বদলী হয়ে গেছেন। নতুন কেউ সহসা আসছেন না সম্ভবত। ওরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িটির নাম ‘ওয়েসিস’।’
‘তাহলে ব্যবস্থা করুন, হেলিকপ্টার ঐ বাড়িতেই ল্যান্ড করবে। বাড়িতে জনাব আন্দালুসির একটা নেমপ্লেট লাগিয়ে দিন।’
‘বুঝেছি মিঃ খালেদ খাকান। বাড়িটাকে আন্দালুসির বাড়িতে পরিণত করতে হবে। চাকর-বাকর, কুক, ড্রাইভার সবাই হবেন গোয়েন্দা, এই তো। সাবাতিনিকে গ্রেফতার করতে নিষেধ করছেন কেন? ওদিক থেকে তার কোন ভয় নেই? কিংবা ওদিকের সাথে এই দরজা আরও খোলা রাখতে চান?’
‘দু’টোই। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর পর সাবাতিনি ছাড়া আর কোন মাধ্যম আমাদের হাতে নেই। আরেকটা কথা জেনারেল, আজ দুপুর বারটার দিকে আমি ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে যাব। পার্কের পূর্ব-দক্ষিন এলাকায় হবে বাড়িটা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যখন যাবেন, তখন সেটা নিশ্চয়ই ছোট ব্যাপার নয়?’
‘টার্গেটটা বড়। ধরতে পারলে ভালো। এ জন্যে বিষয়টা আপনাকে জানালাম। ঐ এলাকায় আপনার কিছু লোক থাকতে পারে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু অতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল আপনার উপর দিয়ে। আজকেই কি আপনার বের হওয়া উচিত?’
‘কিন্তু দেরি করা যাবেনা। সে ইতিমধ্যেই জায়গা চেঞ্জ করেছে। কর্মস্থল থেকে সে ছুটিও নিয়েছে। সে আবারও জায়গা বদলাতে পারে। আর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে। আমাদের লোকরা পার্কের ঐ এলাকায় থাকবে। যদি দরকার হয়, তাহলে আমাদের সিকিউরিটির প্রথম নাম্বারটায়, যা আপনার মোবাইলে আছে, টেলিফোন করে জিরো নাইন জিরোতে কল করবেন, তাহলে পার্ক এলাকার টিম লিডারকে পেয়ে যাবেন।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই জোসেফাইন বলে উঠল, ‘তোমাকে যেতে বাধা দেব না, কিন্তু বসফরাস ব্রীজ হয়ে ওপারে যাও আমার মন তা মেনে নিতে পারছে না। তুমি বোট নিয়ে ওপারে যাও।’
‘ওয়াটার ওয়েকে তুমি নিরাপদ মনে করছ কেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘ওরা জানে তুমি এখানে আছো। নিঃসন্দেহে বলা যায় ওরা সম্ভাব্য সকল সড়কপথের উপর চোখ রাখছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘এ ভয় যদি তুমি কর, তাহলে সব রুটেই ভয় আছে। কারণ আমি গোল্ড রিসোর্টের তোপকাপি প্রাসাদ এলাকা থেকে বের হলেই ওরা খবর জানতে পারবে। এর ফলে সড়ক পথ কিংবা পানি পথ যে পথেই যাই ওরা খবর পেয়ে যাবে। সেদিন যে আমি বসফরাস ব্রীজে আক্রান্ত হলাম, সেটা তারা আয়েশা আজীমার বাড়ি থেকে বের হবার পরই জানতে পারে। তবে সেদিন ওরা যে সুযোগ পেয়েছিল, আজ তা পাবে না। সেদিন আমি শুধু অসতর্ক নয়, সামনের দৃষ্টিটা থাকলেও আমি নিজেকে নিজের মাঝে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন তো তোমার হয় না। কি ভাবছিলে তুমি।’
‘আয়েশা আজীমার কাহিনী ও ডঃ বাজের জন্যে তার অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আয়েশা আজীমা শুধু নিজেকেই কুরবানী দেয়নি, তার স্বজাতির ষড়যন্ত্রকেও খানিকটা প্রকাশ করে দিয়েছে। এভাবে আচ্ছন্ন থাকার কারণেই আয়েশা আজীমার বাড়ির ড্রাইভার, দারোয়ান ও কাজের লোকদের কেউ যে বাড়ির ঘটনা বাইরে সংগে সংগেই পাচার করতে পারে, সে কথা তখন মনেই আসেনি আমার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসলে তোমার মনটা খুব সেনসিটিভ, খুব নরম। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর ‘রাহমান’, ‘রহিম’ পরিচয়টাই সৃষ্টি জগতের জন্যে সবচেয়ে বড়। মহান আল্লাহ নিজেই তার সম্পর্কে কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘দয়াকে তোমার প্রভু তার জন্যে কর্তব্য হিসেবে ঠিক করেছেন।’ মানুষের মধ্যেও দয়া দেখাতে আল্লাহ বেশ ভালোবাসেন। আর তোমার মধ্যে দয়ার প্রকাশ আমাকে বেশি গর্বিত করে। যাক, আরেক……।’
কথা শেষ করতে পারল না জোসেফাইন। তার কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলল, ‘তাহলে আমার কঠোরতা নিশ্চয়ই তোমাকে দুঃখিত করে?’
গম্ভীর হলো জোসেফাইন। বলল, ‘তোমার কঠোরতা আইনের পক্ষে, নীতির পক্ষে, একেই বলে সুবিচার। মজলুমের পক্ষে দাড়িয়ে, সুবিচারের পক্ষে দাড়িয়ে যে কঠোরতা, তা মানবতা ও দয়া থেকেই উৎসারিত। এটা দয়ার উন্নততর রূপ। ইসলামের শান্তি আইনের কঠোরতা মানুষ ও মানবতার প্রতি অপার ভালোবাসা থেকেই নির্ধারিত।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি কিন্তু দার্শনিক হয়ে যাচ্ছ। যাক, বল, তুমি কি যেন বলতে যাচ্ছিলে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও আচ্ছা, আমার একটা কৌতূহল, বসফরাসের অস্বাভাবিক ঐ উচ্চতা থেকে কিভাবে লাফিয়ে পড়েছিলে। আমি অবাক হচ্ছি, তোমার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলে কিভাবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘পানির কাছাকাছি পৌঁছেও আমি ডাইভিং-এর নিয়ম অনুযায়ী দুই হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দুই বড় জাহাজের মাঝ দিয়ে পড়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, সরাসরি পানি যেন আমি পেয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শেষ মুহূর্তে একটা কার্গো ফেরির প্রান্ত ঘেঁষে ছিটকে পড়ে আরেকটা বোটের পেটে বাড়ি খেয়ে পড়ি পানিতে। সৌভাগ্য হলো, কার্গোতে নরম কিছু বোঝাই ছিল এবং আরেকটা সৌভাগ্য হলো, অতবড় উচ্চতা থেকে নিচে পড়বার যে বেগ তা কার্গো বোট ও অন্য যে বোটের পেটে ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই বোট এবং বসফরাসের পানি এই তিনের মধ্যে বণ্টন হওয়ায় আমি বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে যাই। কার্গোর নরম লাগেজে ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ার আঘাত দু’হাত দিয়ে সামলে নেই, কিন্তু ছিটকে পড়া পাঁজরটা বোটের পেটে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে যায়। হয়তো এই আঘাতেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। তবে সংজ্ঞা হারাবার আগে সর্বশক্তি দিয়ে পানিতে ভেসে উঠতে সমর্থ হই। সম্ভবত পেছনের বোটের লোকেরা এই অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে।’
থামল আহমদ মুসা।
মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন। আহমদ মুসার মাথা বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘যা ঘটেছে সেটা মিরাকল। আল্লাহ তোমাকে নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।’ আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের কণ্ঠ।
‘অবশ্যই জোসেফাইন, আল্লাহই রক্ষা করেছেন। কি ঘটেছে আমি বর্ণনা দিয়েছি। কিন্তু কিভাবে ঘটেছে, তা আমি জানি না। আমার নিজের উপর কিংবা কোন কিছুর উপরই আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সব কিছুর নিয়ন্ত্রক যিনি তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’
থামল আহমদ মুসা। পরক্ষনেই আবার বলল, ‘তুমি ওয়াটারওয়ে ব্যবহার করতে বলেছ। ভালো পরামর্শ তোমার। ফাতিহ পাশা পার্কের এলাকাতেই রয়েছে একটা ফেরিঘাট। একটাই অসুবিধা হবে গাড়ি থাকবে না, গাড়ি ভাড়া করতে হবে।’
‘অসুবিধা নেই। ফেরিঘাটে একটা গাড়ি রাখতে বলতে পার।’ বলল জোসেফাইন।
‘তাহলে যে আবার ফিরতে হবে ব্রীজ হয়ে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘অসুবিধা হবে না। গাড়িটা আবার কোন ঘাটে রেখে আসবে।’ বলল জোসেফাইন। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘রিভলবার চালাবার মত বুদ্ধিতেও তুমি একদম গোয়েন্দা হয়ে পড়েছ। ধন্যবাদ জোসেফাইন।’
‘বেশি প্রশংসা কিন্তু বিপরীত অর্থও বুঝায়’ বলে আহমদ মুসার পিঠে একটা কিল দিয়ে জোসেফাইন চায়ের কাপ নিয়ে দ্রুত চলে গেল ঘরের দিকে।

Top