৪৬. রোমেলি দুর্গে

চ্যাপ্টার

ষ্টার্টারের চাবিতে হাত দিয়েছে আহমদ মুসা। চাবিটা ঘুরাবার আগেই বেজে উঠল আহমদ মুসার মোবাইল।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাল। দেখল জোসেফাইনের নাম্বার। মনে হঠাৎ যেন আনন্দের বন্যা নামল আহমদ মুসার। তার সমগ্র অন্তর যেন জোসেফাইনের টেলিফোনেরই অপেক্ষা করছিল।
টেলিফোনটা মুখের কাছে নিয়ে সালাম দিয়েই বলল, ‘জোসেফাইন, তোমার টেলিফোন সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে টেলিফোনের জন্যে।’
‘যার বেশি দরকার সেই কিন্তু টেলিফোন করে, তুমি কিন্তু টেলিফোন করনি।’
‘এই মুহূর্তে তোমার টেলিফোন যে আমি সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম, সেটা বুঝলাম তোমার টেলিফোন পাওয়ার পর।’
‘এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বল?’ হাসতে হাসতে বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে বিশ্বাস করতে বলব কি, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। অবচেতন মনের চাওয়া চেতন মন সব সময় জানতে পারে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘রাখ দর্শনের কথা, বল তুমি কি বলবে, না ওটাও অবচেতন মনে আছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘জোসেফাইন, তোমার বান্ধবী ঠিকই সন্দেহ করেছিল, খবর ঠিক দিয়েছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে রক্ষা করতে পারিনি। যথাসময়ে আমরা পৌছতে পারিনি, বিজ্ঞানীকে ওরা কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইন্নালিল্লাহ! ভয়ানক দুঃসংবাদ। তুমি এখন কোথায়?’ বলল জোসেফাইন।
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে গাড়িতে উঠে বসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি কোথাও যাচ্ছ? তোমার সাথে কথা বলে ঠিক এটাই ভেবেছি। তোমার জন্যে আমার কাছেও জরুরি তথ্য আছে। কয়েক মিনিট আগে জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় সেও নিশ্চয় জেনেছেন।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। ওঁকেই আমার এখন খুব বেশি দরকার। বলতো কি ইনফরমেশন দিয়েছেন। নিশ্চয় আগের মতই জরুরি কিছু হবে।’
‘একটা ঠিকানা দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা প্রতিনিধিদল তাদের রিসার্চ ফোরামের পক্ষ থেকে তার সাথে দেখা করে ড. আন্দালুসির সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেছিল। সে সময় ছাত্রদের একজন জেমস জোসেফ তাকে ষ্টুডেন্ট রিসার্চ ফোরামের একটা ফোল্ডার দিয়েছিল। ফোল্ডারে রিসার্চ ফোরামের কাগজ-পত্রের মধ্যে একটা চিরকুট ছিল। তাতে জনৈক ডিওয়াই লিখেছিল, জেমস জোসেফ, তুমি প্রতিনিধি দলে অবশ্যই থাকবে। যে কোন মূল্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেই হবে। আর নতুন ঠিকানা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িটা ভালো করে দেখে আসবে। ঠিকানাটা তোমার চিনে নেয়ার দরকার হবে। এই চিরকুটটা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, এখন এটা তোমার কাছে অমূল্য হতে পারে, জেফি জিনা বলেছেন।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তার মনে দারুণ এক বিস্ময়ও। কে এই জেফি জিনা? ছাত্র প্রতিনিধি দল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্যে তারা জেফি জিনার কাছে কেন গিয়েছিল? আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালূসিই বা কোন কারণে জেফি জিনাকে দাওয়াত করেছিল ছাত্রদের সাথে? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গুণী অধ্যাপক হলে একটা অর্থ পাওয়া যেত। কিন্তু ঐখানে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কোন অধ্যাপক নেই। তাহলে কে তিনি?
ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা। জোসেফাইনের কথা শেষ হলেও উত্তরে আহমদ মুসা কিছু বলেনি।
জোসেফাইন আবার কথা বলে উঠল, ‘কি ভাবছ? কি হলো তোমার? কথা বলছ না যে?’
‘হ্যাঁ, জোসেফাইন তোমার বান্ধবী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটা সত্যিই অমূল্য। যে ছেলেটা জেফি জিনাকে ফোল্ডারটা দিয়েছিল, তারই নাম জেমস জোসেফ এবং অনুমান সত্য হলে বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলাকারী গ্রুপের সাথে তিনি তাকে দেখেছিলেন। সুতরাং এই ঠিকানা বিজ্ঞানীর উদ্ধার অভিযানের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমি ভাবছিল জোসেফাইন, তোমার এই বান্ধবীটি কে? ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অত্যন্ত পরিচিত কেউ অথবা প্রভাবশালী ও গুণী একজন অধ্যাপক হবেন। কিন্তু জেফি জিনা নামে কোন অধ্যাপক ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাহলে জেফি জিনা নামটা কি নকল? আমরা কিছু বুঝতে পারছি না জোসেফাইন।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আমার কাছে তার নাম বদলাবার দরকার কি? নামটা নকল বলে আমার মনে হচ্ছে না। কিন্তু তোমার কথা ঠিক যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কেউ না হলে এসব ঘটনার সাথে তাকে জড়িত দেখা যাচ্ছে কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু ঐ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই, এটাও তো সত্য! আমার আরেকটা বিষয় বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে, এই খবরটা তিনি পুলিশকে না দিয়ে তোমাকে দিলেন কেন! আবার এখন এই যে, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও ঠিকানার খবর কেন তোমাকে দিলেন! পুলিশকে সরাসরি দিতে পারতেন। কিন্তু ভায়া-মিডিয়া দেয়ার মত সময় খরচ অযথা করলেন কেন? সত্যি আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কি কিছু মনে করবেন উনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জিজ্ঞেস করব?’ জোসেফাইন বলল।
‘যেমন তিনি এখন কোথায়? তার সাথে আমি কথা বলতে পারি কিনা? তাঁর আরও সহযোগিতা আমাদের দরকার। তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন, তাহলে আমি তো কাছেই আছি। আমি গিয়েও তার সাথে দেখা করতে পারি। ইত্যাদি বিষয় তাঁর কাছে তুলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এসব প্রশ্ন করে, এসব বিষয় তুলে তার নাম ও পেশার পরিচয় পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘একবার তার ঠিকানা জানলে তার সব পরিচয়ই আমরা বের করতে পারব। তার নাম, পেশা নিয়ে আজ এ সময় হঠাৎ প্রশ্ন তুলতে গেলে আমরা তাকে সন্দেহ করছি ভাবতে পারেন।’
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। কোনোভাবে তাঁকে হিট করা ঠিক হবে না। শুরু থেকেই তিনি আমাদের যে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন, তা অমূল্য। হতে পারে আমাদের সন্দেহ ঠিক নয়। নাম হয়তো তার ঠিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়েও তার অবস্থান এমন গুরুত্বপূর্ণ যে সব জায়গায় তিনি আছেন। অথবা তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ হতে পারেন। ঠিক আছে, আসলে যা আমরা চাই, সে তথ্য তিনি তো দিয়েছেনই। আবার টেলিফোন করলে বাই দি বাই কিছু আলোচনা করতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে, যতটা পারি করব। তোমার এখন কি প্রোগ্রাম?’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী জেফি জিনা যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটাই এখন আমাদের টার্গেট। সে বিষয়টা জেনারেল মোস্তফাদের সাথে আলোচনা করছি।’
‘ঠিক আছে, সময় আর নষ্ট করব না। আমি রাখছি। ফি আমানিল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’
মোবাইল পকেটে রেখে তাকাল আহমদ মুসা বাইরের গাড়ি ও হেলিকপ্টারের দিকে। দেখল বাড়ির সামনে জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা বুঝল, আমি কেন দেরি করছি, কেন আমি দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলেই তারা এদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সংগে সংগে জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার কাছাকাছি এসেই জেনারেল মোস্তফা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার মি. খালেদ খাকান। নতুন কোন খবর অথবা কিছু ঘটেছে?’
জেনারেল মোস্তফারা আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ বাইপাস রোডের ৯৯ নম্বর বাড়িটার চারদিকে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে পাহারা বসাতে হবে এখনই। লক্ষ্য রাখতে হবে ঐ বাড়ির অথবা সেখানকার অন্য কেউ যাতে সন্দেহ না করে যে, চারদিক থেকে বাড়িটার উপর চোখ রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা হলো, বাড়িটাতে কেউ যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ বেরুলে সবার অলক্ষ্যে তাকে আটকাতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চোখে বিস্ময় এবং অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আহমদ মুসা কাউকে কোন প্রশ্ন না করতে দিয়ে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে বলল, ‘মি. এরকেন, এখনি আপনার পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দিন।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি নির্দেশ দিচ্ছি।’ বলে মোবাইল তুলে নিল হাতে। একটু সময় নিয়ে বিষদ নির্দেশ দিল।
কথা শেষ করে মোবাইল অফ করে দিয়ে নাজিম এরকেন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কিন্তু কাকে রক্ষার জন্যে কিংবা কাকে ধরার জন্যে আমরা বাড়িটার উপর চোখ রাখব স্যার?’
‘সন্দেহ করা হচ্ছে, কিডন্যাপাররা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ও আনন্দে পাল্টে গেল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চেহারা। মুহূর্ত কয়েক যেন তারা কথা বলতে পারল না।
প্রথম মুখ খুলল জেনারেল মোস্তফা। বলল সে, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনার কথা আমার কাছে মহাআনন্দের আর স্বপ্নের মত লাগছে। আপনি ঠিক বলছেন তো! সত্যিই আপনি এত তাড়াতাড়ি এতদূর পর্যন্ত এগোতে পেরেছেন?’
‘আমার স্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। আমাদের অত্যন্ত সচেতন একজন শুভাকাংক্ষী এই তথ্য আমাদের দিয়েছেন। তাঁর দেয়া তথ্য আগেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কোন প্রশ্ন তুলছি না মি. খালেদ খাকান। আমাদের বিস্ময় লাগছে, সোনার হরিণটা এত তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় আসবে। এখন বলুন, আপনার পরিকল্পনা কি?’
‘এখন সেখানে রওয়ানা হতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও! যদি আপনি ঠিক মনে করেন।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ অভিযান তো আপনাদের। আমি সহযোগিতা করছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই বলল, ‘এ অভিযানটা আমাদের হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা বিপদ বুঝলে বিজ্ঞানীকে হত্যাও করতে পারে। আমাদের এ ধরনের অবস্থার শিকার হওয়া চলবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! প্ল্যানটা কি হবে একটু ভাবা প্রয়োজন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘বলুন, কি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল পুলিশ প্রধানই আবার। বলল, ‘দিনের বেলায় বাড়িটা গোপনে ঘিরেই রাখতে হবে, যেভাবে আপনি বলেছেন। গভীর রাতে গোপনে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে, যাতে ওদের এড়ানো এবং বিজ্ঞানীকে নিরাপদে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা যায়।’
‘রাতে হলেও প্রথমে দল বেঁধে বা একাধিক লোক বাড়িতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। বাড়িতে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নিশ্চয় তারা রেখেছে। ওরা টের পেয়ে গেলে দু’টি ঘটনা ঘটবে। এক. বিজ্ঞানীর জীবনের তারা ক্ষতি করবে অথবা দুই. বিজ্ঞানীকে নিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ তারা নেবে। এ বাড়িতেও সুড়ঙ্গ পথের ব্যবস্থা নেই তা বলা যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! এ ধরনের কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আপনার পরামর্শ কি? আমরা তাহলে কিভাবে এগোবো?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘চলুন ওখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তবে আমি মনে করছি, দিনে কিংবা রাতে, যখনই সম্ভব হয় আমি গোপনে বাড়িটাতে প্রথম প্রবেশ করব। আমি মোবাইলে মিসকল দেব, তখন অবস্থা বুঝে আপনারা প্রবেশ করবেন।’
‘কিন্তু মি. খালেদ খাকান, ওরা খুব বিপজ্জনক লোক। ওরা কত লোক ভেতরে আছে, তাও জানা নেই। আপনি যদি বিপদে পড়েন?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘নিরাপদে বাড়িটিতে প্রবেশ করে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিরাপদ করা এখনকার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ এবং এটা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই মি. খালেদ খাকান। ঠিক আছে, আমরা যাত্রা করতে পারি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমার মনে হয়, আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে যাচ্ছি। সাদা পোশাকে আরও কিছু পুলিশ। তারাও এক গাড়িতে দু’জনের বেশি যাবে না। বাড়িটার উত্তর পাশেই একটা হোটেল আছে। আর বাড়ির পেছনে, মানে পশ্চিম দিকে একটা বড় মসিজদ রয়েছে। আর দক্ষিণ পাশে একটা কম্যুনিটি হাসপাতাল। আমাদের লোকরা রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়া ছাড়াও এই তিনটি স্থানকে কেন্দ্র করা হোক। আমরাও সেখানে অবস্থান নিতে পারি।
‘আশ্রয়ের একটা জায়গা থাকা দরকার। সেই হিসেবেও কেন্দ্রগুলো ঠিকই হয়েছে। কিন্তু আপনার লোকদের বলে দিন যেন সব রাস্তার উপর নিচ্ছিদ্র অবরোধ থাকে। আর কেউ যেন পালাতে না পারে।’ কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আসুন, আমরা যাত্রা করি।’
বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগোলো।
‘ঠিক আছে মি. খালেদ খাকান, আমি বিষয়টা আবার আমাদের লোকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’ নাজিম এরকেন বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল সালাম নিয়ে ‘গুডলাক মি. খালেদ খাকান’ বলে তার গাড়ির দিকে এগোলো।
এগোলো পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও।

‘না, থামবেন না ড. আন্দালুসি। আরও একটু বিস্তারিত বলুন, সোর্ড নামে যে অস্ত্র তৈরি করেছেন, সেটা কিভাবে ফাংশন করে?’
কথাগুলো বলছিল ডেভিড ইয়াহুদ।
সে একটা চেয়ারে বসে। তার পাশের চেয়ারেই বসেছিল আইজ্যাক বেগিন।
তাদের সামনে আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ড. আন্দালুসির পাশেই আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় আছে বিজ্ঞানীর সাথে ধরে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার।
আর তাদের সকলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ছয়জন ষ্টেনগানধারী অস্ত্র বাগিয়ে এ্যাটেনশন অবস্থায়।
ঘরটা আন্ডার গ্রাউন্ড একটা কক্ষ। বেশ বড়।
এটা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ রোডের ৯৯নং বাড়িটির একটা কক্ষ।
বাড়িটা চারদিক থেকে প্রাচীর ঘেরা।
প্রাচীর ঘেরা জায়গার মাঝখানে বাড়িটা।
বাড়ির সম্মুখ ভাগের প্রাচীর রাস্তা থেকে কয়েক গজ ভেতরে। রাস্তা থেকে প্রাচীর গেট পর্যন্ত রাস্তা পাথর বিছানো। গেটে গ্রীলের দরজা। গেট থেকে একটা পাথর বিছানো পথ গাড়ি বারান্দায় গেছে। গাড়ি বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি পেরোলে বারান্দা। বারান্দায় সোজা এগোলেই বাড়িতে প্রবেশের মূল দরজা। ভেতরে প্রবেশ করলেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের চারদিকে বিভিন্ন করিডোর। লাউঞ্জের ডান দিকের দু’প্রান্ত দিয়ে দুটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়িগুলো দেয়ালের সাথে যুক্ত হয়ে উপরে উঠে গেছে। ওপাশের সিঁড়ির গোড়ার পাশে দেয়ালে রয়েছে একটা দরজা। দরজা থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
আন্ডার গ্রাউন্ডে অনেকগুলো কক্ষ।
কক্ষগুলো ষ্টোর এবং শেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে তুরষ্ক সব যুদ্ধ অথবা যুদ্ধ-ঝুঁকির মধ্যে ছিল। একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া ঠান্ডাযুদ্ধ পর্যন্ত সকল যুদ্ধের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ এক পক্ষ ছিল তুরষ্ক। এজন্যে তুরষ্কে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের বাড়িতে আন্ডার গ্রাউন্ড শেল্টার রয়েছে।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটির একটা বড় ও বিশেষ কক্ষে ড. আন্দালুসিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডেভিড ইয়াহুদের প্রশ্নের জবাবে ড. আন্দালুসি বলল, ‘আমি বলেছি, ‘সোর্ড’ কোন অস্ত্র নয়, এটা আত্মরক্ষার একটা মেকানিজম। এটা কারো বিরুদ্ধে নয়, অন্যের হিংসার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার একটা মাধ্যম মাত্র।’
‘তবু এটা অস্ত্র। অস্ত্রকে যা ব্যর্থ, নিষ্ক্রিয় করে, কিংবা ধ্বংস করে, সেটা অস্ত্রের চেয়েও বড় অস্ত্র। ‘সোর্ড’ এ ধরনেরই একটা ভয়াবহ অস্ত্র। যাই হোক, বলুন কিভাবে এটা ফাংশন করে? এর বেসিক কনসেপ্ট কি?’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘নিয়ন্ত্রিত আলোক কণার একটা দেয়াল উড়ন্ত ও অগ্রসরমান যে কোন কিছুর গতিরোধ করে এবং একে পৃথিবীর আবহাওয়ার বাইরে নিয়ে ধ্বংস করে। এটাই এর কনসেপ্ট যে, ইন্টিগ্রেটেড আলোক কণার শক্তিকৃত চৌম্বকত্ব ও সর্বভেদী ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে উড়ন্ত অগ্রসরমান সকল মেটালিক, নন-মেটালিক বস্তুকে আকাশেই অবরুদ্ধ এবং তার বিলয় ঘটাতে পারে।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি।
‘তার মানে আকাশপথের আক্রমণকারী সব অস্ত্রকেই সোর্ড ধ্বংস করতে পারবে। এর অর্থ সোর্ড মানব কল্যাণের বড় অস্ত্র। তাই নয় কি?’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘অবশ্যই। আমি তো বলেছি এটা আক্রমণ করার কোন অস্ত্র নয়, আত্মরক্ষার মাধ্যম।’ বলল ড. আন্দালুসি।
‘তাহলে বলুন, কল্যাণের মাধ্যম যে জিনিসটা, তার উপর সকলের অধিকার আছে কিনা?’ ড. ডেভিড বলল।
ড. আন্দালুসি তাকাল পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। তার দু’চোখে অন্ধকার। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, ডেভিড ইয়াহুদের কথা কোন দিকে যাচ্ছে।
ভাবতে গিয়ে ডেভিড ইয়াহুদের কথার জবাব দিতে পারল না ড. আন্দালুসি।
ডেভিড ইয়াহুদই কথা বলে উঠল আবার। বলল, ‘মঙ্গলজনক আবিষ্কার কারও একার নয়। সকলেরই অধিকার আছে তা থেকে উপকার নেয়ার। সুতরাং ড. আন্দালুসি, ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আমরা চাই।’
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং মুখের ভাব শক্ত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আমাকে কি এজন্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে?’
‘ধন্যবাদ ড. আন্দালুসি, আমাদের মনের কথা আপনিই বলে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ড. আন্দালুসি, আপনার ঐ মহামঙ্গলের আবিষ্কারের প্রতিই আমাদের লোভ। ফর্মূলা আদায়ের জন্যেই আমরা আপনাকে তুলে নিয়ে এসেছি।’
‘বৃথাই কষ্ট করেছেন। এই ফর্মূলা আপনারা কেন, দুনিয়ার অন্য আর কাউকেই দেয়া হবে না।’ বলল ড. আন্দালুসি। শক্ত কণ্ঠ তার।
‘সাধারণভাবে সকলের জন্যে কল্যাণকর কোন কিছু যদি কেউ কুক্ষিগত করে রাখতে চায়, সেটা অন্যায়। আমরা এ অন্যায় বরদাশত করব না। আমরা কল্যাণের মহৎ লক্ষ্যেই তা ছিনিয়ে নেব। এজন্যেই আপনাকে এখানে আনা হয়েছে।’
হাসল বিজ্ঞানী আন্দালুসি। বলল, ‘আপনারা কল্যাণের লক্ষ্যে নয়, মানুষের অকল্যাণের লক্ষ্যেই এই আবিষ্কারকে হাত করতে চান। আমরা এটা হতে দেব না।’
‘দেবেন আপনারা, তা জানি বলেই তো আমরা সোর্ড-এর পিতাকে নিয়ে এসেছি। দেবেন না কেন? কল্যাণের আবিষ্কার, যেমন ধরুন কোন ওষুধ, গোটা মানব জাতির সম্পদ। এ ধরনের কল্যাণের আবিষ্কার ‘সোর্ড’ কুক্ষিগত করে রাখা দুরভিসন্ধিমূলক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ কঠোর কণ্ঠে।
‘উল্টো কথা বলছেন। ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আপনাদের হাত করতে চাওয়াই দুরভিসন্ধিমূলক। একটা জঘন্য উদ্দেশ্য নিয়েই আপনারা ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলাকে হাত করতে চাচ্ছেন।’
আইজ্যাক বেগিন এতক্ষণ কথা বলেনি। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বাজের মত হিংস্র শিকারীর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ড. আন্দালুসির দিকে। বলল, ‘দুরভিসন্ধিটা কি ড. আন্দালুসি?’
‘সোর্ড-এর যে ফর্মূলা, তা দিয়ে শুধু সোর্ডের মত আত্মরক্ষার অস্ত্র নয়, আক্রমণের অস্ত্রও তৈরি হতে পারে। এই আক্রমণাত্মক অস্ত্র হবে আত্মরক্ষার অস্ত্র ‘সোর্ড’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভয়াবহ। সমন্বিত ও শক্তিকৃত ফোটনের স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বউৎক্ষিপ্ত ফোটন-এ্যারো পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে যে কোন স্থানের বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র মাইলো এবং অস্ত্র গুদাম নিজেই খুঁজে নিয়ে চোখের পলকে সেগুলোকে নিস্ক্রিয় ও নিরস্থিত করে দিতে পারে। আপনাদের দুরভিসন্ধি হলো সোর্ডের ফর্মূলা হাত করে এই অস্ত্র তৈরি করে গোটা পৃথিবী দখল করে নেয়া।’
আইজ্যাক বেগিন এবং ডেভিড ইয়াহুদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যেন আকাশের চাঁদ তারা হাতে পেয়ে গেছে।
তারা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তৎক্ষণাত কোন কথা তারা বলতে পারেনি।
নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর, আমরা যা জেনেছি, আপনি তা নিশ্চিত করলেন। এখন আসুন, আমরা একটা ডিল করি। আমরা সোর্ডের ফর্মূলা চাই, বিনিময়ে যা চাইবেন দিতে রাজি আছি। টাকার যে অংক বলবেন, সেই অংকই আমরা দেব। বলুন ডক্টর।’
হাসল ডক্টর আন্দালুসি। বলল, ‘আমি একজন বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী নই। তাছাড়া আমার গবেষণা মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়। ঐ হিমালয় পরিমাণ অর্থ দিলেও আমি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব না, ফর্মূলাটি আমরা দেব না।’
গম্ভীর হয়ে উঠল আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। তাদের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। দু’জন দু’জনের দিকে একবার তাকাল। তারপর আইজ্যাক বেগিন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। মুহূর্তের জন্যে একবার চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘ডক্টর, নিশ্চয় এটা আপনার শেষ কথা নয়। শেষ কথার আগে আরও অনেক কিছুই বাকি আছে। হ্যাঁ বলুন ডক্টর, আমাদের কথায় রাজি হয়ে যান, রাজি না হয়ে আপনার অন্য কোন উপায়ও নেই।’
‘না, আমার শেষ কথাই বলে দিয়েছি।’ বলল ডক্টর আন্দালুসি।
চোখ দু’টি জ্বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের। তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আপনার মিশন শুরু করুন মি. ডেভিড। নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।’
ডেভিড ইয়াহুদ তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। কাঠের চেয়ারটিতে হাত, পাসহ গোটা দেহ শক্ত করে বাঁধা ড. আন্দালুসির। একমাত্র মাথা ছাড়া দেহের কোন অংশ একটু নড়াবার উপায় নেই। চেয়ারের তলা থেকে একটা বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
পাশের চেয়ারে ড. আন্দালুসির সাথে কিডন্যাপ করে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে চেয়ারের সাথে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার চেয়ারের তলা থেকেও একটা বৈদ্যুতিক তার কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীকে বুঝান। এটা তার গবেষণাগার কিংবা ড্রইংরুম নয়। এখানে ওঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্যে আনা হয়নি। আনা হয়েছে ফর্মূলা আদায়ের জন্যে! এ লক্ষে যা করা দরকার আমরা তাই করব। আপনি তাঁকে বুঝান।’
গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বলল, ‘আপনাদের ভুল হচ্ছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী নই, আমি তাঁর একজন কর্মচারী, সিকিউরিটির দিকটা আমি দেখি।’
‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আমাদের বোকা সাজাতে চাইছেন। বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর স্ত্রীকে ধরে এনেছি, সেটা বুঝেই পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। মিথ্যা কথা বলে লাভ হবে না।’
বলেই ডেভিড ইয়াহুদ চেয়ারের একটা হুক থেকে রিমোটটা টেনে নিয়ে বলল, ‘ড. আন্দালুসি, কেউ কথা না শুনলে তাকে কথা শোনাবার ফর্মূলা আমাদের আছে। সে রকম একটা ফর্মূলাই আমরা এখন প্রয়োগ করছি। রেডি স্যার।’
ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি রিমোর্ট কন্ট্রোলের একটা লাল বোতামে চেপে বসল।
সংগে সংগে ঝাঁকি দিয়ে উঠল ড. আন্দালুসির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণাকাতর একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল ডক্টর আন্দালুসির কণ্ঠ থেকে। ড. আন্দালুসির হাত, পা যেন সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করছিল। শক্ত করে বাঁধা সিল্কের কর্ড দেহে কামড়ে বসেছিল। সেই কামড়ে পাতলা চামড়ার ওপরের অংশ কেটে দু’ভাগ হয়ে গেল। দু’হাত ও দু’পায়ের বাঁধনের স্থান থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। তার দু’চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। যতক্ষণ ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি লাল বোতাম চেপেছিল, ততক্ষণ ড. আন্দালুসির আর্ত চিৎকার থামেনি।
বোতাম থেকে তর্জনি উঠল।
চিৎকার ধীরে ধীরে থেমে গেল।
তার মাথাটা চেয়ারের আশ্রয়ে ঢলে পড়ল। চোখ দু’টি তার বুজে গেছে।
আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখে প্রশান্তি। সাইমি ইসমাইলের চোখে মুখে আতংক। সে ভাবছে, ফর্মূলা না পেলে তারা বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলতে পারে। অন্যদিকে ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা সম্পর্কে সে যা জেনেছে, তাতে এই ফর্মূলা কিছুতেই এদের হাতে দেবেন না বিজ্ঞানী। তাহলে? প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গিয়ে কেঁপে উঠল সাইমি ইসমাইল।
‘ড. আন্দালুসি কথা বলুন। কি ভাবছেন আমাদের প্রস্তাব সম্পর্কে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
ড. আন্দালুসি স্থির, নিরব। কথা বলল না, চোখও খুলল না।
আইজ্যাক বেগিনের চোখে আবার আগুন দেখা গেল। তাকাল সে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে।
ড. ইয়াহুদের হাতের রিমোর্ট কনট্রোল আবার নড়ে উঠল। তার তর্জনি আবার সক্রিয় হলো। চেপে বসল সেই লাল বোতামে।
শক্ত বাঁধনের মধ্যেও বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দেহ লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। আর মুখ থেকে বেরিয়ে এল বুক ফাটা চিৎকার।
হাত পায়ের বাঁধন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। যন্ত্রণার অসহনীয় তীব্রতায় বড় হয়ে বের হয়ে আসা চোখ দু’টি তার যেন ফেটে যাচ্ছে।
সুইচ থেকে ডেভিড ইয়াহুদ তার তর্জনি না তোলা পর্যন্ত ড. আন্দালুসির বুকফাটা চিৎকার থামল না।
পাশের চেয়ারে বাধা সাইমি ইসমাইল চিৎকার করে উঠল, ‘আপনারা এটা কি করছেন! উনি একজন বিজ্ঞানী। দয়া করে এই অমানুষিক কাজ বন্ধ করুন।’
সুইচ থেকে তর্জনি উঠল ইয়াহুদের।
চিৎকার থামলো ডক্টর আন্দালুসির। তার মাথাটা নেতিয়ে পড়ল চেয়ারে। চোখ বুজে গেছে তার। চেয়ারের হাতলে বাধা দু’হাত তার কাঁপছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চেয়ারের হাতা দিয়ে।
‘ম্যাডাম, আমরা তো এই খারাপ পথে যেতে চাইনি। উনি বাধ্য করেছেন। আপনি তাকে বলুন, ফর্মূলা উনি আমাদের দিয়ে দিতে রাজি হোন।’ সাইমি ইসমাইলের দিকে চেয়ে বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
সাইমি ইসমাইল কিছু বলার আগেই ক্লান্ত, কাঁপা স্বরে ডক্টর আন্দালুসি বলল, ‘ম্যাডাম সাইমি ইসমাইল, আপনি ওদের বলে দিন, কোন নির্যাতন করেই তারা যা চায় তা পাবে না। আর আমাকে ওরা মেরে ফেলতে পারবে না। কারণ তাতে তাদের সোনার ডিম তারা চিরতরে হারাবে।’
হো হো করে হেসে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘আপনি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী। আমাদের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝেছেন। কিন্তু এটা বুঝেননি যে, আমরা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি। যারা দৈনিক শত নির্যাতন হজম করতে পারে, তারা কিন্তু মানসিক চাপে মোমের মত গলে যায়।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
পাশের টিপয়ের গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি খেল। তারপর একটা হাসল। বলল, ‘ড. আন্দালুসি, আপনার উপর আঘাত আপনি সহ্য করেছেন, কিন্তু সাইমি ইসমাইলের উপর এ ধরনের আঘাত আপনি কতক্ষণ সহ্য করবেন? এখানেই শেষ নয়। অস্ত্র আমাদের আরও আছে। আপনার চোখের সামনে বিবস্ত্র সাইমি ইসমাইল মানুষ-হায়েনার দ্বারা লুণ্ঠিত হবে, তারপরও আপনি কতক্ষণ চুপ করে থাকবেন।’
কথা শেষ করে আইজ্যাক বেগিন তাকাল আবার ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘এবার সাইমিকে কিছুটা নাচান মি. ইয়াহুদ। তারও কিছু গান আমরা শুনি।’
চমকে উঠে চোখ খুলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, যে উদ্বেগ তার চোখে-মুখে কঠিন নির্যাতনেও ফুটে উঠতে দেখা যায়নি। চেয়ারে এলিয়ে পড়া মাথা তুলে সে বলল, ‘সাইমি ইসমাইল আমার স্ত্রী নন। তিনি একজন নির্দোষ মহিলা। তাঁকে আপনারা ছেড়ে দিন। দাবি আপনাদের আমার কাছে। আমাকে নিয়ে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করুন।’
আইজ্যাক বেগিনের আবার সেই অট্টহাসি। বলল, ‘আমরা ঠিক সিলেকশন করেছি। এ ওষুধেই কাজ দেবে। আগাও ডেভিড ইয়াহুদ।’
ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্টটা হাতে তুলে নিল আবার।
ঠিক এই সময় দরজায় নক হলো। দ্রুত নক হলো পরপর তিনবার। এর অর্থ কেউ জরুরি সাক্ষাৎ চায়।
আইজ্যাক বেগিন তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। ডেভিড ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে ঘুর দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভেতরে এস।’
ভেতরে প্রবেশ করল জেমস জোসেফ। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘কি ব্যাপার জেমস, তোমাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে! কোন খবর?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড ইয়াহুদের।
‘স্যার, বাড়িটার চারদিকে নতুন কিছু লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আমাদের ইনফরমাররা বলছে, লোকগুলো সাদা পোশাকে পুলিশ হতে পারে।’
ডেভিড ইয়াহুদের চেহারায় কেউ যেন এক রাশ কালি ঢেলে দিল। বলল, ‘খবরটা কি ঠিক? এটা কি করে সম্ভব? বাড়িটাতো আমরা নিয়েছি মাত্র সাত দিন হলো। আমাদের লোকরাও জানে না। আমাদের লোকরা যারা আজ এখানে এসেছে, তারাও এই বাড়িটা প্রথম দেখল। কিভাবে এটা বাইরের কেউ জানতে পারে? লোকজন যে পুলিশের তা কি করে জানা গেল?’
আমাদের লোকরা তাদের সাথে মেলা-মেশার ফলে তাদের কথাবার্তা শুনে এবং বাড়িটার উপর চোখ রাখা দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছে। সবশেষ এইমাত্র খবর পেলাম ঐ লোকদের একজন মোবাইলে কাউকে বলছেন, একজন বিখ্যাত লোককে কিডন্যাপ করার ঘটনা ঘটেছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের থাকতে হবে। এই কথার পর এখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।’ বলল জেমস জোসেফ।
উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিনও।
সেও এসে দাঁড়াল ডেভিড ইয়াহুদের পাশে জেমস জোসেফের কাছে। তাদের সকলের মুখ পাণ্ডুর, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বলল আইজ্যাক বেগিন, ‘ধন্যবাদ জেমস, খবরটা পেতে যে আরও দেরি হয়নি এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওরা কমব্যাট ষ্টেজে এখনও আসেনি। নিশ্চয় ওরা কোন কিছুর অপেক্ষা করছে। এরই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
চোখ তুলল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘মি. ডেভিড ইয়াহুদ, আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে কয়টি গাড়ি আছে?’
‘দু’টি বুলেটপ্রুফ গাড়িসহ সাতটি গাড়ি আছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘লোকদের ডাক। এদের দু’জনকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোল। এ গাড়িতে আমি উঠব এবং জেমসসহ উঠবে আরও তিনজন। অন্য বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুমি উঠবে কয়জনকে নিয়ে বাকি ৫ টি গাড়িতে অবশিষ্ট জনশক্তি উঠবে। সাতটি গাড়ি দু’গ্রুপে ভাগ হবে। একটা গ্রুপ আপনার নেতৃত্বে যাবে দক্ষিণের পথ ধরে। আর অন্য গ্রুপ নিয়ে আমি যাব উত্তর দিকে। এতে ওরা বিভ্রান্তিতে পড়বে এবং ওদের জনশক্তি ভাগ হয়ে যাবে। এর জন্যে তাদের গাড়িও লাগবে। তাদের এই অপ্রস্তুতি হবে আমাদের জন্যে বড় সুযোগ।’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেভিড ইয়াহুদের। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. বেগিন। এ সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর হয় না। কিন্তু বেরুবার মুখেই যদি আমরা আক্রমণের মুখে পড়ি!’
‘সে ধরনের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেবার জন্যেই সাতটি গাড়ি এক সাথে বের হতে হবে। তাদের তাৎক্ষণিক ঐ আক্রমণ সাতটি গাড়িকে মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট হবে না। তারা বাড়তি প্রস্তুতি নেবার আগেই আমরা তাদের আওতার বাইরে চলে যাব।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘রাস্তার দু’ধারেও ওদের লোক মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে।’ জেমস জোসেফ বলল।
‘ওসব বাধা ধর্তব্য নয় জেমস। কোন গাড়ির দৃঢ় সংকল্প গতিকে আকস্মিক চেষ্টায় মোকাবিলা সহজ নয়। ও বিষয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।’
কথা শেষ করেই তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে উপরে যাচ্ছি মি. ডেভিড ইয়াহুদ। এদের এখনি গাড়িতে নিন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সবগুলো গাড়ি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আমি এটাই চাই।’
বলেই আইজ্যাক বেগিন উপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চলল। অন্যদিকে ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্ট কনট্রোলের ‘কল’ বোতামে চাপ দিয়ে রিমোর্ট কনট্রোলকে মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘সাতটি গাড়িই রেডি কর। তিন চার মিনিটের মধ্যেই আমরা বেরুবো। ইট ইজ অ্যান ইমারজেন্সি। ওভার।’
রিমোর্টটা মুখ থেকে সরিয়েই চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেনগানধারীদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাদের দু’জন এস। এদের বাঁধন খুলে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেল। মুখে ভালো করে টেপ পেস্ট করে দাও। তারপর নিয়ে চল গ্যারেজে। আর জেমস জোসেফ, ওদিকে দেখ গাড়ি ঠিক ঠাক রেডি হচ্ছে কিনা।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ হবার সংগে সংগে ‘ইয়েস স্যার’ বলে জেমস জোসেফ ছুটল গ্যারেজের দিকে।
দু’জন স্টেনগানধারী ড. আন্দালুসি ও সাইমি ইসমাইলের বাঁধন খোলা শুরু করেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ পকেট থেকে তার মোবাইল তুলে নিল। তার তর্জনি অস্থির হলো মোবাইলের ‘কী’গুলোর উপর একটা কল করার জন্যে।

Top