৪৬. রোমেলি দুর্গে

চ্যাপ্টার

গোল্ডেন হর্নের একদম পশ্চিম প্রান্ত এলাকার ফ্লাইওভার-৩ জংশন দিয়ে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস রোডে প্রবেশ করেছিল।
বাইপাস রোড ধরে তীরের গতিতে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ড্যাশ বোর্ডে রাখা মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল কলটা জেনারেল মোস্তফার কাছ থেকে এসেছে। আহমদ মুসা দ্রুত মোবাইলটা কানের কাছে তুলে নিল। এ সময় জেনারেল মোস্তফার ফোন নিশ্চয় কোন ছোট কারণে নয়। তারাও এই বাইপাস রোডের বিপরীত রোড ধরে আসছে। জেনারেল মোস্তফার ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কে প্রবেশ করেছে গোল্ডেন হর্ন এলাকার জংশন নং ৫ দিয়ে। তাদের গাড়ি ছুটে আসছে পশ্চিম দিকে। তাদের গাড়ি বাইপাস রোড ধরে ৯৯ নাম্বার বাড়ির দিকে আসছে। আসছে আহমদ মুসারাও।
মোবাইল তুলে নিয়ে সালাম দিতেই ওপ্রান্ত থেকে জেনারেল মোস্তফার দ্রুত কণ্ঠ শুনতে পেল আহমদ মুসা। বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, এই মাত্র ৯৯ নাম্বার বাড়ির এলাকা থেকে আমাদের জানাল, বাড়িটা থেকে কয়েকটি গাড়ি বেরিয়ে এসেছে। তারা পালাচ্ছে।’ জেনারেল মোস্তফার উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত কণ্ঠ।
‘ওরা কোন দিকে পালাচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জানা যায়নি। ও কথা শেষ করতে পারেনি, তার আগেই সে গোলা-গুলীর মধ্যে পড়ে যায়। সম্ভবত তার মোবাইল পড়ে যায়, কিন্তু মোবাইল বন্ধ হয়নি। আমি তার মোবাইলেও কিছুক্ষণ গোলা-গুলীর শব্দ পেয়েছি।’
‘ওদের পালাবার সম্ভাব্য রুট কি হতে পারে জেনারেল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরানব্বই নাম্বার বাড়ির সামনে একটা টার্ন নেবার পাস-পয়েন্ট আছে। সুতরাং বাইপাস রোডের পূর্ব- পশ্চিম যে কোন দিকে তারা যেতে পারে।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ঠিক আছে, আমার মনে হয় মোতায়েনরত পুলিশ ওদের গাড়িগুলোর গতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল এবং পুলিশ পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশের ক্ষতিও হয়েছে বলে মনে হয়। এই কারণেই ওদিক থেকে ইনফরমেশন আসা বন্ধ হয়েছে।’
আহমদ মুসা কথা বলছিল এবং ইস্তাম্বুলের সিটি ম্যাপের উপরও চোখ বুলাচ্ছিল। বাইপাস রোডের ৯৯ নাম্বার বাড়ির অবস্থানটা দেখে নিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আমার মনে হয় যদি ওরা পূর্ব দিকে গিয়ে থাকে, তাহলে এখনি ওদের সাক্ষাত আপনারা পেয়ে যাবেন।’
‘ইউ আর রাইট খালেদ খাকান। আমি দেখতে পাচ্ছি ডানের ফেরার রাস্তা দিয়ে ৪টা গাড়ি জোটবদ্ধ হয়ে ছুটে আসছে। তাদের মধ্যে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সামনেই ‍ওদিকের রাস্তায় যাবার টার্ন-পয়েন্ট। আমরা ওদের গতিরোধ করব। ওকে খালেদ খাকান।’
জেনারেল মোস্তফার মোবাইল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মোবাইলটা ড্যাশ বোর্ডে রেখে দুরবিনটা তুলে নিয়ে সামনের রাস্তার উপর চোখ বুলান। আহমদ মুসার এখান থেকে ৯৯ নাম্বার বাড়িটা জেনারেল মোস্তফাদের অবস্থানের তুলনায় দ্বিগুণ দূরে। আর বাইপাসের এই দিকটা গোল্ডেন হর্নের এলাকা অতিক্রম করে শহরের পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য উপকণ্ঠ ঘুরে উত্তরের পার্বত্য ভূমির দিকে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল না পলাতকরা অপেক্ষাকৃত এই নিরাপদ রুট বাদ দিয়ে পূর্ব দিকে জংশন ৫-এর দিকে গেল কেন! ওদিকটার তো দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ন ও পূর্বে বসফরাস দ্বারা ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা এই সময়ে গোল্ডেন হর্ন কিংবা বসফরাসের ব্রীজে উঠার ঝুঁকি নেবে, এটায় সায় দিচ্ছে না তার মন কিছুতেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ওরা ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়নি তো। পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্যে তারা ‍দু’ভাগ হয়ে দু’রুটকেই ব্যবহার করতে পারে। এতে পুলিশের প্রতিরোধ শক্তি দু’ভাগ হয়ে যাবে এবং দু’ভাগের কোনভাগে বিজ্ঞানীরা আছেন, এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়বে পুলিশরা। আরেকটা কৌশলও তারা করতে পারে। সেটা হলো, দু’রুটে যাওয়া দু’ভাগের যেভাগে বিজ্ঞানীরা থাকবেন না, সেভাগে গাড়ির সংখ্যা বেশি রেখে নিরাপত্তার বেশি ব্যবস্থা করে পুলিশের দৃষ্টি সেদিকে বেশি আকৃষ্ট রেখে অন্য ভাগে বিজ্ঞানীদের নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এটা ভাবতে গিয়ে জেনারেল মোস্তফাদের দিকে যাওয়া ৪টি গাড়ির জোটবদ্ধ যাত্রাকে কিছুটা প্রদর্শনী বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসার এই ভাবনা ঠিক হওয়ার অর্থ এই বাইপাসের পশ্চিমমুখী রুট ধরে ওদের কোন গাড়ি কি এগিয়ে আসছে!
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ডান পাশে ফেরার রোডটিতে যাওয়ার জন্য সামনে এসে পড়া পাস-পয়েন্টে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
রং সাইড দিয়েই মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
বাইপাস খুব ব্যস্ত নয়, কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে খুব কমও নয়। এই গাড়ি চলাচলের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে দ্বিধাহীন গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনে থেকে আসা গাড়িগুলোই বরং আহমদ মুসার গাড়ির বেপরোয়া গতি দেখে তাদের গতি ঠিক করে নিচ্ছে।
এভাবে চলার তিরিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। বাইপাস সড়কের ডানদিকের একটা সংযোগ রাস্তার থেকে একটা মোটর সাইকেল দ্রুত বেরিয়ে এল।
মোটর সাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার। মাথায় হ্যাট, শোল্ডার ব্যান্ডে লাল রংয়ের ডবল ক্রিসেন্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে ফাস্ট গ্রেডের একজন পুলিশ অফিসার সে।
পুলিশ অফিসারের মোটর সাইকেলটি বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ির রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল।
তার মোটর সাইকেলের সামনে পর্যন্ত গিয়ে হার্ড ব্রেক কষল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়েছে।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আহমদ মুসা ঝামেলায় পড়তে চায় না। আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার খুব বেশি দেরি নেই।
গাড়ি থেকে দু’তিন ধাপ এগিয়ে পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি হলো।
আহমদ মুসা দেখল, পুলিশ অফিসারটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক তরুণী।
‘ম্যাডাম, আমি দুঃখিত। ইচ্ছা করেই এবং বাধ্য হয়েই আমাকে এই বেআইনি কাজটি করতে হয়েছে। আমার মনে হয় আমি বড় ধরনের একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি মাথা থেকে হ্যাট খুলল। বলল, ‘আপনি অনেকগুলো কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কথাই আপনার আইন ভাঙার পক্ষে যুক্তি নয়। আপনি দয়া করে রাস্তায় ফিরে যান।’ পুলিশ অফিসার মেয়েটির কণ্ঠ শক্ত।
‘আপনি আইনের কথা বলেছেন ম্যাডাম, ধন্যবাদ! কিন্তু শুরুতেই ইচ্ছে করে এবং বাধ্য হয়েই আমাকে আইন ভাঙতে হয়েছে। এখনও আমি আপনার কথা মানতে পারবো না। অনেক ইমারজেন্সি আছে, যখন আইন ব্রেক করা অপরিহার্য হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি তীক্ষ্ণ, গভীর দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার মুখটি সহজ হয়ে উঠল। বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনার সব কথাই সত্য, কিন্তু আইন ভাঙা কেন অপরিহার্য তা আমি বুঝিনি। প্রতিদিন রাস্তার মানুষ ও যাত্রীদের অনেকে হাজারো অপরিহার্য সিচুয়েশনে পড়ে, কিন্তু ট্রাফিক আইন ভাঙার অনুমতি কেউ পায় না।’
‘ঠিক বলেছেন ম্যাডাম, কিন্তু আমার বিষয়টা ন্যাশনাল ইমারজেন্সির সাথে জড়িত।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে পুলিশ অফিসার মেয়েটির সামনে তুলে ধরল।
কার্ডের দিকে তাকিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। দেখল, তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফার দস্তখতসহ প্রধানমন্ত্রীর কাউন্টার সাইন করা স্পেশাল গ্রেডের সিকিউরিটি কার্ড। এই কার্ড যার হাতে থাকে সে যা প্রয়োজন তা করার স্বাধীনতা পায় এবং সব দায় থেকে মুক্ত থাকে।
কার্ডের উপর চোখ বুলিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যরি স্যার। আপনি এখন স্বাধীন।’
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম। নরম মনের মেয়েরাও যে কত কঠোর হতে পারে নিছক আইন রক্ষায়, তার একটা দৃষ্টান্ত আজ দেখলাম।’
আহমদ মুসা কথাটা বলে মেয়েটির দিকে মুখ তুলতেই তার চোখ মেয়েটির পেছনে সামনের রাস্তার উপরে পড়ে গেল। দেখতে পেল, তিনটি গাড়ি একই সমান্তরালে এগিয়ে আসছে। মাঝের গাড়িটি যে বুলেটপ্রুফ তা দেখেই বুঝল আহমদ মুসা। সংগে সংগে মনে পড়ল, জেনারেল মোস্তফা যে চারটি গাড়ির কথা বললেন তারও একটি বুলেটপ্রুফ ছিল। এর অর্থ এরা নিশ্চিতই কিডন্যাপারদের একটা অংশ। হতে পারে এদের সাথেই আছেন বিজ্ঞানীরা।
ওরা এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
আহমদ মুসা দ্রুত নিজের কোট খুলে পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি পুলিশের টুপিটা খুলে ফেলুন। ইউনিফরমের উপর কোটটা পরে নিন। প্লিজ কারণ জিজ্ঞেস করবেন না।’
বলেই আহমদ মুসা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মেশিন রিভলবারটার স্পর্শ একবার নিয়ে দ্রুত একটু সরে গেল সড়কের উত্তর পাশের দিকে।
আহমদ মুসার কার ও পুলিশ অফিসার মেয়েটির মোটর সাইকেল সড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ তিনটি গাড়িও পাশাপাশি সড়কের মাঝখান দিয়ে আসছিল। অনেকটা দূরে থাকতেই তারা এটা লক্ষ্য করেই সম্ভবত গাড়ি তিনটি সমান্তরালে সারিবদ্ধভাবেই মাঝপথ এড়িয়ে সড়কের ডানপাশে মানে উত্তর পাশের দিকে সরে গেছে।
আহমদ মুসা সড়কের উত্তর পাশের দিকে একটু সরে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে গাড়ি তিনটি থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। আহমদ মুসার ভাবখানা এই রকম যে, তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, এজন্যে গাড়িগুলোর সে সাহায্য চাইছে। গাড়িগুলো সাধারণ হলে এই অবস্থায় তারা অবশ্যই দাঁড়াবে। আর যদি গাড়িগুলো ডেভিড ইয়াহুদের ‘থ্রি জিরো’র হয় এবং বিজ্ঞানীকে যদি সাথে নিয়ে থাকে, তাহলে আহমদ মুসাকে পিষে ফেলে হলেও তারা সামনে এগোবে।
গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে আসছে। হাত তোলার পর ওদের গাড়ির গতি আরও বেড়েছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে।
তখন গাড়ি ৫০ গজ দূরেও নয়।
আহমদ মুসা ভাবল, বুলেটপ্রুফ গাড়িটাকে বড় কোন ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে তার গতি ব্লক করে বিজ্ঞানীকে অক্ষত উদ্ধার করতে হবে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে বিদ্যুৎ বেগে মেশিন রিভলবার বের করে আনল।
ট্রিগারে আঙুল চেপেই আহমদ মুসা রিভলবার বের করে এনেছিল। বের করেই ট্রিগার চেপে রিভলবার ঘুরিয়ে আনল ডান পাশের গাড়ির বাম চাকা এবং বাম পাশের গাড়ির ডান চাকার উপর।
গুলী করেই আহমদ মুসা নিজের দেহটাকে ছুঁড়ে দিয়ে দক্ষ এক্রব্যাটের মত নিজের দেহকে হাতের উপর কয়েকবার ঘুরিয়ে নিল। কয়েকগজ ডানে গিয়ে তার দেহ মাটির উপর পড়ে স্থির হলো।
আহমদ মুসার হাতে রিভলবার উঠতে দেখে তিন গাড়ি থেকেই তাকে উদ্দেশ্য করে গুলী করা হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষনে আহমদ মুসার দেহ তিন গাড়ির মধ্য অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল এবং দু’পাশের ব্রাশ ফায়ারের প্রবল শব্দে গতি পরিবর্তন করেছিল। তার ফলে তাদের গুলীও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে টায়ার বিস্ফোরণের পর দু’গাড়িই একটি বাম দিকে, অন্যটি ডান দিকে টার্ন নিয়ে একটা আরেকটার উপর আছড়ে পড়ে। মাঝের বুলেটপ্রুফ গাড়িও তাদের সাথে সামান্য ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। সম্ভবত ড্রাইভার পাশের দু’গাড়ির গতি দেখে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষতে পেরেছিল।
আহমদ মুসার দেহ মাটিতে পড়বার সংগে সংগেই সে আবার উঠে দাঁড়াল। জাম্প করার সময় সে মেশিন রিভলবারটা ছুঁড়ে দিয়েছিল এদিকে। সেটাও পাশে পড়েছিল। উঠে দাঁড়াবার সময় রিভলবারটাও কুঁড়িয়ে নিয়েছে সে।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি এই গাড়ির আরোহীদের একটু দেখুন, এরা যাতে আক্রমণে আসতে না পারে।’
বলেই আহমদ মুসা ছুটল বুলেটপ্রুফ গাড়িটার দিকে।
বুলেটপ্রুফ গাড়িটার ওপাশ দিয়ে দু’টি মাথা উপরে উঠতে দেখা গেল। কার মাথা স্পষ্ট হলো না আহমদ মুসার কাছে, কারণ ঐ গাড়িতে বিজ্ঞানী ডঃ আন্দালুসি এবং সাইমি ইসমাইলেরও থাকার কথা। সুতরাং রিভলবার তুলেও গুলী করতে পারলো না।
কিন্তু পরমুহূর্তেই গাড়ির উপর দিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল দেখা গেল এবং সেই সাথে ছুটে এল গুলীবৃষ্টি।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই বসে পড়েছিল মাটিতে এবং দু’হাঁটু বুকের সাথে গুটিয়ে নিয়ে দ্রুত ফুটবলের মত গড়িয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে চলে এল। যেহেতু ওরা গাড়ির ভিতর দিয়ে গুলী করছিল, তাই সবগুলো গুলী আহমদ মুসার মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। আর ওরা মাথা লুকিয়ে গুলী শুরু করার কারণে আহমদ মুসার ফুটবলের মত গড়িয়ে আসাটা দেখতে পায়নি।
বুলেটপ্রুফ গাড়ির আড়াল থেকে গুলী শুরু হলে পুলিশ অফিসার মেয়েটি ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির আড়াল নিয়ে গুলী করা শুরু করেছে। এই গাড়িটাই ওদের গুলী বর্ষণের টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে আশ্রয় নেয়ার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে গাড়ির পেছন ঘুরে এসে গাড়ির ওপাশটাকে সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এগোচ্ছিল।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির পেছন দিকে টার্ন নিচ্ছিল। টার্ন নেবার সময় পেছন দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল এমনিতেই। তাকিয়েই দেখতে পেল, দু’জন আহত লোক টায়ার ফেটে যাওয়ায় এক্সিডেন্টের মুখে পড়া এ পাশের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাথা থেকে নেমে আসা রক্তে তাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে রিভলবার। রিভলবার তুলছে তারা আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার দেহটা গাড়ির পেছনে আড়াল করেই বাম হাতে মেশিন রিভলবার থেকে গুলীবৃষ্টি করল।
ওরাও গুলী করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার দেহ ততক্ষনে বুলেটপ্রুফ গাড়ির পেছনে আশ্রয় নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওদের কাছে তখন আড়াল নেয়ার কিছু ছিল না। ফলে ওরা আহমদ মুসার গুলী বর্ষণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
গুলী বন্ধ করেই আহমদ মুসা পেছন দিক একবার দেখে নিশ্চিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং বিড়ালের মত চলতে শুরু করল।
গাড়ির উপর দিয়ে এদের যে গুলীবর্ষণ চলছে, তাতে কিছু পরিবর্তন বুঝতে পারলো আহমদ মুসা। এখন দু’টি নয়, একটি স্টেনগান থেকে গুলী বর্ষণ চলছে। একজনের স্টেনগান থামল কেন?
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মন বলে উঠল, আহমদ মুসার পাল্টা গুলী বর্ষণের শব্দ থেকে ওরা ধরে নিয়েছে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে নিশ্চয় শত্রু এসে গেছে। তাই একজনকে গুলী বর্ষণে রেখে আরেকজন নিশ্চয় এদিকে আসছে।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবারটা ডান হাতে নিয়ে অদৃশ্য টার্গেটের দিকে স্থির করে বিড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত গাড়ির পেছনটা ঘুরে গাড়ির ওপাশে টার্ন নেবার আগে গাড়ির কোণাটায় মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ট্রিগারের উপরে তর্জনীটাকে শক্ত করে এক ঝটকায় গাড়ির ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল।
ওপাশে ঘুরতেই চোখ পড়ল একজন শ্বেতাংগ চেহারার লোকের উপর। একেবারে মুখোমুখি তারা শ্বেতাংগ লোকটির হাতে উদ্ধত রিভলবার। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এরই সুযোগ গ্রহণ করল আহমদ মুসার রিভলবার। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসেছে। এক পশলা গুলি গিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল শ্বেতাংগ লোকটির বুক।
গুলী করেই আহমদ মুসা তাক করল দ্বিতীয় লোকটিকে। সে গাড়ির উপর দিয়ে অদৃশ্য শত্রু লক্ষ্যে গুলী করছিল। এদিকে গুলীর শব্দ শুনে সে গুলী বন্ধ করে তার স্টেনগানটা মূহুর্তে ঘুরিযে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসার রিভলবার তখন তার দিকে হাঁ করে আছে।
আহমদ মুসা দেখল, স্টেনগানধারী লোকটি একজন তরুন। আহমদ মুসার হঠাত মনে পড়ল, কিডন্যাপারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রকে জেফি জিনা দেখেছিল এবং ডেলিগেটদের সাথে যে ছেলেটি জেফি জিনাকে একটি ফোল্ডার দিয়েছিল যার মধ্যে ৯৯নং বাসার ঠিকানা ছিল, এই কি সেই ছাত্র।
এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তরুণকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি শত্রুতামূলক আচরণ না করলে আমি তোমাকে গুলী করব না। তুমি তোমার স্টেনগান ফেলে দাও। আত্নসমর্পন না কররে তোমার বাঁচার কোন সম্ভাবনা …।‘
পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এদিক থেকে তার লক্ষ্যে গুলী বন্ধ হওয়ায় এবং এদিকে গুলীর শব্দ শুনেই সে ছুটে এসেছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই তরুণটির স্টেনগানের ব্যারেল বেপরোয়াভাবে উঠে এল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসার মুখের কথা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তার তর্জনি। চেপে ধরেছিল মেশিন রিভলবারের ট্রিগারকে। এক পশলা গুলী গিয়ে আছড়ে পড়ল তরুণটির বুকে। স্টেনগানটি হাতে ধরেই সে টলে উঠে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
‘ধন্যবাদ মি…..’ বলল পুলিশ মেয়েটি।
‘খালেদ খাকান।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
‘ধন্যবাদ নয়, আমি তরুণটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি, টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তরূণটি।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘না, আমি এজন্যে ধন্যবাদ দেইনি। ধন্যবাদ দিয়েছি অবিশ্বাস্য ধরনের এই সফল অপারেশন দেখে।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
আহমদ মুসা পুলিশ মেয়েটির এই সব কথা যেন শুনতেই পায়নি।
বলল, ‘ম্যাডাম অফিসার …।‘
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই পুলিশ অফিসার মেয়েটি বলে উঠল, ‘আমার নাম আয়েশা আরবাকার।‘
নাম শুনে একটু চমকে উঠে তাকাল পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে আহমদ মুসা। মেয়েটির নাম শুনে জোসেফাইনের পিএস লতিফা আরবাকানের কথা মনে পড়েছে। তার সাথে এ মেয়েটির চেহারারও মিল আছে। বলল আহমদ মুসা, ‘আপনার কি লতিফা আরবাকান নামে কোন বোন আছে?’
পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ আছে। আপনি কি তাকে চেনেন?’
বলে এক মুহূর্ত থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তাহলে কি আপনি ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইনের স্বামী সেই খালেদ খাকান?’ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। সে ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইন ও তাঁর স্বামী খালেদ খাকান সম্পর্কে লতিফা আরবাকানের কাছে অনেক কথা শুনেছে এবং প্রতিদিনই শুনছে। সেই খালেদ খাকান ইনি!
তার চিন্তা বেশি দূর এগোতে পারলনা। তার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ মিস, মিসেস আয়েশা আরবাকান..।‘
এবারও পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘ মিস আয়েশা আরবাকান।‘ তার মুখে হাসি।
‘হ্যাঁ মিস আযেশা আরবাকান। চলুন গাড়ির ভেতরটা দেখি। সেখানে দু’জন বন্দী থাকার কথা।‘
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি আয়েশা আরবাকানও হাঁটতে শুরু করেছে। বলল, ‘বন্দীর কথা বললেন, কারা এই বন্দী? এই বন্দী উদ্ধারের জন্যেই কি আপনার এই অভিযান?’
‘বন্দীর একজন বিজ্ঞানী এবং আরেকজন আপনাদের লোক সাইমি ইসমাইল।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘বিজ্ঞানী মানে, ড. আন্দালুসি?’ জিজ্ঞাসা আয়েশা আরবাকানের।
‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘আমি লতিফার কাছে শুনেছি উনি কিডন্যাপ হয়েছেন। সরকার অবশ্যই ঘটনা গোপন রাখায় কেউ জানতে পারেনি। গোয়েন্দা অফিসার সাইমি মিসিং হবার কথাটা বিভাগীয় সূত্রেই জানি।‘ আয়শা আরবাকান বলল।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
প্রবেশ করল দু’জনই।
গাড়ির পেছনের সিটে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসী এবং সাইমি ইসমাইলকে। দু’জনের মুখই চওড়া টেপ পেস্ট করে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ড. আন্দলুসির চেহারা বিধ্বস্ত।
দু’জনেই দেখতে পেল তাদেরকে।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সামনের সিটের উপরে উঠে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসির মুখের টেপ খুলে দিল ও হাত-পায়ের বাঁধন কেটে ফেলল। আয়েশা আরবাকানও মুক্ত করল গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে।
মুক্ত হয়েই সাইমি ইসমাইল বলল দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আমার ভুল না হয়ে থাকলে আপনি মি. খালেদ খাকান। আপনি তাড়াতাড়ি আন্দালুসির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। উনি অসুস্থ।‘
আহমদ মুসা বলল, ‘মিস আয়েশা আরবাকান, মিস সাইমি ইসমাইল আপনারা ড. আন্দালুসিকে সিটে শুইয়ে দিন। প্রচুর ঠান্ডা পানি খাওয়ান তাকেঁ, তাঁকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে বুঝতে পারছি। গাড়ির দরজা বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনকে ফ্রিজিং পয়েন্টে নিয়ে যান। আমি জেনারেল মোস্তফা এবং নাজিম এরকেনকে ডাকছি। ওরা কাছেই আছেন।‘
বলে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসিকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসার সময় ড. আন্দালুসি বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে মি. খালেদ খাকান। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না্ ওরা আমার দেহকে কষ্ট দিলেও, মন আমার আগের চেয়ে হাজার গুন বেশি তাজা ও শক্তিশালী হয়েছে।‘
আহমদ মুসার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠেছিল। ড. আন্দালুসিকে আবার ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিল, ‘একজন মুমিনের চরিত্র এরকমই হয়ে থাকে স্যার।‘
আহমদ মুসা বেরিয়ে যেতেই সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান দু’জনে আহমদ মুসার নির্দেশ পালনে কাজে লেগে গেল।
ড. আন্দালুসিকে শুইয়ে দিয়ে গাড়ির রেফ্রিজারেটর বক্স থেকে পানির প্লাস্টিক বতলের ৫০০ মিলিমিটারের পানি সবটুকু খাইয়ে দিল।
তাঁর বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
পানি খাওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলল, ‘মনে হচ্ছিল এক সাগর পানিতেও আমার তৃষ্ণা মিটবেনা। কিন্তু তোমাদের এক বোতল ঠান্ডা পানিতেই আমার তৃষ্ণা মিটে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।‘
গাড়ির এয়ারকন্ডিশন আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে এল।
কাজ শেষ করে সাইমি ইসমাইল সিটে বসতে বসতে বলল, ‘মিস আয়শা আরবাকান ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি এই রকম একটি অপারেশনে খালেদ খাকানের সহযোগী হতে পেরেছেন।‘
হাসল আযেশা আরবাকান। বলল, ‘খালেদ খাকান সাহেব রং সাইডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাকেঁ পাকড়াও করার জন্যে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় প্রবেশ করেছিলাম।‘
তারপর কি কি ঘটেছিল তার সব বিবরণ দিযে বলল, ‘এই অপারেশনে একটাই কাজ করেছি, সেটা হোল আপনার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে আপনাকে মুক্ত করেছি। তবে আমি সৌভাগ্যবান। তিনটি বেপরোয়া গাড়ির বিরুদ্ধে একজন মানুষের অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য এক অপারেশনের দৃশ্য দেখলাম। তীর বেগে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির মাত্র ৫০ গজ সামনে দাঁড়িয়ে গুলী করে দু’পাশের দু’গাড়ির মধ্যে সংঘাত ঘটিয়ে রাস্তা ব্লক করা একটা শিল্পকর্মের মত নিখুঁত ও সুন্দর কারুকাজ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমি না দেখলে এমন ঘটতে পারে তা বিশ্বাস করতামনা।‘
‘আমিও তার সম্পর্কে এমন সব কথাই শুনেছি। তবে তোমার মত কোন সৌভাগ্যের মুখোমুখি হইনি।
‘এখন বারবার আমার একটা কথাই মনে জাগছে, সেটা হলো, আসল পরিচয় তাঁর কি? আমার বোন মিসেস খালেদ খাকানের পার্সোনাল সেক্রেটারী। আমার বোন বলেছে, মিসেস খালেদ খাকান ফরাসি এবং ফ্রান্সের রাজবংশের একজন রাজকুমারী। ফ্রান্সের রাজকুমারীকে যে বিয়ে করে সে ফ্রান্সের রাজকুমার না হলেও সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তার চেয়ে বড় কেউ নিশ্চয় হবেন। তার সিকিউরিটি কার্ডে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর এবং তার স্ত্রী প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর রাস্ট্রীয় মেহমান হিসেবে তোপকাপিতে রয়েছেন। ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট তার নিজের পিএসকে মিসেস খালেদ খাকানের পিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং খালেদ খাকানের অতুলনীয় কাজের মতই তার অতুলনীয় কোন পরিচয় আছে।‘
চোখ বুজে শুয়েছিলেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন তিনি। বললেন, ‘তোমাদের কথা সত্য বলেই হয়তো মি. খালেদ খাকান ভিন্ন ধরনের মানুষ। উনি প্রশংসা পছন্দ করেন না। যাক, এখান থেকে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। তোমরা দেখ, মি. খালেদ খাকান একা বাইরে গিয়ে কি করছেন।‘
‘ঠিক আছে স্যার। আমরা দেখছি ওদিকে।
বলেই দু’জন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়েই টেলিফোন করেছিল জেনারেল মোস্তফাকে। তাকে খবরটা মানে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির উদ্ধারের খবর দিলে জেনারেল মোস্তফা কয়েক মুহূর্ত বিস্ময় ও আনন্দে কথা বলতে পারেনি। তারা আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘এখানে বড় ঘটনা ঘটেছে। এসে বলব। আমরা আসছি। আপনারা সাবধান থাকবেন।‘
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার সাথে কথা বলার পর প্রথমেই এল আইজ্যাক বেগিনের লাশের কাছে। আহমদ মুসা তাকে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান হিসেবে চেনেন না। নামও জানে না। কিন্তু ইউরোপীয় চেহারা ও বিজ্ঞানীর বহনকারী গাড়ির প্রধান হিসেবে দেখে নিশ্চিত হয়েছে একজন খুব বড় নেতা হবেন।
আহমদ মুসা তাকে সার্চ করল। পকেট থেকে পেল মোবাইল ও একটি মানিব্যাগ। মানিব্যাগে কিছু ডলার ও টার্কিশ লিরা পেল। তার সাথে মানিব্যাগের কয়েন কেবিনে একটি সীম এবং মাইক্রো চিপ পেল আহমদ মুসা। সীম ও চিট পকেটে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল। মেনু বাটনে চাপ দেবার জন্যে আঙুল তুলেছিল আহমদ মুসা। আঙুল মেনু বাটন স্পর্শ করার আগেই মোবাইল নতুন মেসেজের সংকেত দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসার আঙুল থেমে গেল।
মেসেজের সংকেত শেষ হবার পর আহমদ মুসা মেসেজটা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। এই সময় আসা মেসেজ নিশ্চয় জরুরি ও গুরুত্বপূণ হবে। যিনি মেসেজ পাঠিয়েছেন, তিনি জানেন না এখানে কি ঘটেছে।
মেসেজটি ওপেন করল আহমদ মুসা। মাত্র কয়েকটি শব্দের একটি মেসেজ: Change Direction to 101 Barbaros Boulevard ম্যাসেসের শেষে প্রেরকের নাম Dy লেখা। চট করেই আহমদ মুসার মনে পড়ল Dy বর্ন দুটির অর্থ David, Yahood, এই ডেভিড ইয়াহুদ তুরস্কে ‘থ্রি জিরো’র প্রধান। তিনি একে মেসেজ পাঠিয়েছেন যে, গতি পরিবর্তন করে ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যাও। মানে বন্দী বিজ্ঞানীকে অন্য কোন ঠিকানায় যাবার কথা ছিল, শেষ মুহুর্তে কোন কারণে গন্তব্য চেঞ্জ করে নতুন ঠিকানা ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যেতে বলা হয়েছে।
গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। মোবাইলটা অফ করে পকেটে রেখে দিল। ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল কয়েকটি পুলিশের গাড়িসহ দু’টি কার এসে দাঁড়িয়েছে। দু’টি কারের একটি থেকে নামছে জেনারেল মোস্তফা, অন্যটি থেকে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা এক ধাপ, দু’ধাপ করে তাদের দিকে এগোলো। আর তারা দু’জন ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে। তারা দু’জন এক সাথেই জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘খালেদ খাকান, আপনি আমাদের সকলের গর্ব। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।‘ আর পুলিশ প্রধান বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন, কারন আপনি সব বান্দাকে ভালোবাসেন। এজন্য বিজয় সব সময় আপনার হাতেই ধরা দেয়।‘ পুলিশ প্রধানের কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে।
‘চলুন দেখবেন বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসিকে।‘ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। তাদের উপর চোখ পড়তেই পুলিশ প্রধান সাইমি ইসমাইলকে স্বাগত জানিয়ে আয়েশা আরবাকানকে বলল, ‘তুমি এখানে কি করে?’
আয়েশা কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘উনি এই অপারেশনে আমার সাথী।‘
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল পুলিশ প্রধান।
আয়েশা প্রতিবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘চলুন বিজ্ঞানী একা আছেন।‘
‘চলুন।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক ধাপ সামনে এগোতেই দেখতে পেল আইজ্যাক বেগিনকে। তাকে দেখেই চমকে উঠল তারা। বলল, ‘ইনি তো আইজ্যাক বেগিন। ইনি ইহুদীবাদী একটি গোপন আন্দোলনের ইউরোপীয় নেতা। কি আশ্চর্য! ইনি এস্তাম্বুলে এসেছেন এবং কিডন্যাপের সাথে ইনিও জড়িত!’
‘যে গাড়িতে বিজ্ঞানী ও সাইমি ইসমাইলকে পাওয়া গেছে, সেই গাড়িতে ইনি এবং ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজির একজন ছাত্র ছিল। এ দেখুন তার লাশ।‘ সামনের একটা লাশের দিকে ইংগিত করে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন সামনে এগিয়ে ছাত্রটিকেও দেখল। পুলিশ প্রধান বলল, ‘চিনতে পেরেছি। এর ছবি আমাদের ছাত্র অপরাধী ফাইলে রয়েছে। এর বিরুদ্ধে রহস্যজনক গতিবিধির অভিযোগ রয়েছে।‘
‘এখানে কতজন মারা গেছে মি. খালেদ খাকান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘গুলীতে চারজন। অন্য ছয় জন গাড়ির একসিডেন্টএ?।‘
বিজ্ঞান ড. আন্দলুসি যে গাড়িতে আছেন, সে গাড়ির পাশে সবাই এসে পৌছেছে।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, কথা আদায়ের জন্যেই নিশ্চয় বিজ্ঞানীকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছিল। তিনি অসুস্থ। তাকে একটু ঠান্ডায় রাখা হয়েছে। আসুন তাঁর সাথে কথা বলুন।‘
বলে গাড়ির দরজা খুলল আহমদ মুসা।
দরজা খুলতেই বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসি উঠে বসছিলেন।
‘স্যার, আপনি শুয়ে থাকুন তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফা এবং পুলিশ প্রধান জনাব নাজিম এরকেন এসেছেন। তারা একটু দেখা করবেন আপনার সাথে।‘
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন গাড়ির ভেতর দিকে এগোলো। আহমদ মুসা সরে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য বসার জায়গা করে দিয়ে বলল, ‘আপনারা তার সাথে বসুন। আমি আসছি।‘
বলে আহমদ মুসা সরে এল।
একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। আহমদ মুসা ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘পুলিশ এখনি লাশগুলোকে নিয়ে যাবে। আপনার আইজ্যাক বেগিন বাদে অন্য নিহতদের পকেটগুলো সার্চ করে দেখুন। পকেটের কাগজপত্র ও মোবাইলগুলো কাজে লাগতে পারে।‘
‘ঠিক স্যার। ধন্যবাদ, আমরা দেখছি।‘
বলে ওরা দু’জন কাজে লেগে গেল।
আহমদ মুসা দাঁড়াল গাড়ি ঠেস দিয়ে। তার মাথায় একটা চিন্তা অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, তাদের অপারেশনের একটা মধ্যবর্তী সময় তারা গন্তব্য পরিবর্তন করল কেন? হঠাত তার মনে হলো, ডেভিড ইয়াহুদের ওখানে কি ঘটেছে তার মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত থাকতে পারে, কারণ ডেভিড ইয়াহুদই গন্তব্য চেঞ্জ করেছেন।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এল এ সময়। আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আপনি টেলিফোনে বলছিলেন যে, ওখানে কি একটা নাকি ঘটেছে?’
‘হ্যাঁ, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে খালেদ খাকান। এখনি ছুটতে হবে প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিং-এ। আমাদের অসুস্থ প্রধান বিচারপতি মিলিটারি এ্যাম্বুলেন্সে সামরিক হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, ওরা পালানোর পথে এই এ্যাম্বুলেন্স কিডন্যাপ করেছে। দু’তিন মিনিট পরেই ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাশ সড়কের ওপ্রান্তের জংশন এলাকা থেকে খবর এল, সেখানে রাস্তার পাশে মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ‘ওরা মানে এই আইজ্যাক বেগিনের কিডন্যাপাররা?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘হ্যাঁ ওদের চারটি গাড়ির তিনটিই আমাদের পুলিশের হাতে পড়ে। ধরা পড়া নিশ্চিত যেনে ওরাই ওদের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং সবাই মারা পড়ে। কিন্তু বুলেটপ্রূফ গাড়িটা আমাদের তিনজন পুলিশের লাশের উপর দিযে পালাতে সক্ষম হয়। ওরাই কিডন্যাপ করে এ্যাম্বুলেন্সটিকে।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ্যাম্বুলেন্সকে কিডন্যাপ করল কেন? ওরা কি জানত যে, এ্যাম্বুলেন্সে প্রধান বিচারপতি আছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, ওরা বুলেটপ্রুফ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স নিয়েছিল। জংশন-৬ এলাকা নিরাপদে পার হবার জন্যেই তারা এ্যাম্বুলেন্সের কভার নিয়েছিল।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘বুঝলাম, প্রধান বিচারপতির পরিচয় পাবার পর তারা তাকেঁ কিডন্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তাঁকে দিয়ে কি করবে ওরা? ড. আন্দালুসীকে কিডন্যাপ করার সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রে তো এরকম কোন কারণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘তাদের পরিত্যাক্ত মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা অবিলম্বে পরিত্যাগ করতে হবে। তার প্রমাণ হিসেবে অবিলম্বে খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে বহিস্কার করতে হবে। এ দু’টি নির্দেশ মানা না হলে প্রধান বিচারপতিকে হত্যা করা হবে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন তাহলে কি? বিজ্ঞানী তো উদ্ধার হয়ে গেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখন ভয় হলো, ক্রুদ্ধ হয়ে তারা যেন প্রধান বিচারপতিকে হত্যা না করে বসে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। চোখে-মুখে তার উদ্বেগ।
আহমদ মুসা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময়েই বেজে উঠল জেনারেল মোস্তফার টেলিফোন।
‘এক্সকিউজ মি!’ বলে জেনোরেল মোস্তফা মোবাইল তুলে নিল। মোবাইল স্ক্রীনে প্রধানমন্ত্রীর নাম্বার দেকে চমকে উঠে মুখের কাছে মোবাইল এনে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার, আমি মোস্তফা কামাল। কিছু আদেশ স্যার?’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী কথা বলল। ওপারের কথা শুনে বলল, ‘স্যার, ড. আন্দালুসি এখন ভালো আছেন।’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী আবার কথা বলল। তার কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘স্যার, এখনি তাঁকে বলছি। জি স্যার, ব্রিফিং-এ আমি তাঁকেও নিয়ে আসব। তিনি আমার পাশেই আছেন স্যার।’
‘জি স্যার, তাকে মোবাইল দিচ্ছি।’ বলল ওপারের কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা মোবাইলটি আহমদ মুসার দিকে তুরে ধরে বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী।’
আহমদ মুসা মোবাইলটি হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন স্যার?’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি যা করেছি, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সেও নিশ্চয় তা পারতো।’ বলল আহমদ মুসা ওপারের কথা শুনে।
‘এক্সকউজ মি স্যার, আমি মনে করি ওদের ফলো করাই এখন প্রথম কাজ। আমি একটা পরিকল্পনা অলরেডি করে ফেলেছি।’ ওপারের কথা শুনে বলল আহমদ মুসা আবার।
‘ধন্যবাদ স্যার, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে আমার সালাম দেবেন। নিশ্চয় দু’একদিনের মধ্যেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করব।’ বলল আহমদ মুসা আবার।
‘দোয়া করুন স্যার, আমি যা ধারণা করেছি তা যেন ঠিক হয়। আমি জনাব জেনারেল মোস্তফাকে টেলিফোন দিচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা মোবাইলটা আবার জেনারেল মোস্তফাকে দিল।
জেনারেল মোস্তফা টেলিফোন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে ‘জি’ ‘জি’ করে অবশেষে বলল, ‘স্যার, মি. খালেদ খাকান অবশ্যই সব ব্যাপারে স্বাধীন স্যার। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। তাঁর সাথে পরামর্শ করেই আমরা আসছি স্যার।’
সালাম দিয়ে মোবাইল রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা। মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘প্রধান বিচারপতির কিডন্যাপের বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন, সে বিষয়ে সহযোগিতা করাকেই আমাদের প্রধান কাজ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলুন মি. আহমদ মুসা আমরা কি করতে পারি?’
‘ঘটনার পর আইজ্যাক বেগিনের মোবাইল নিয়ে আমি যখন ‘মেনু’ উইনডো ওপেন করতে যাচ্ছিলাম, তখন একটা মেসেজ আসে তার মোবাইলে। মেসেজে একটা নতুন ঠিকানা দেয়া হয়েছে। সব কার্যকারণ বিচার করে আমার মনে বলছে, এই ঠিকানায় আমরা প্রধান বিচারপতিকে পাব। এই ঠিকানাকেই আমি এখন টার্গেট করতে চাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল পুলিশ প্রধান,‘ঠিকানাটা কি?’
‘১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মুখে ঠিকানাটা উচ্চারিত হতেই সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে,‘স্যার এ সম্পর্কে আমিও একটা তথ্য দিতে পারি।’
সবাই তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে।
‘ওয়েলকাম মিস সাইমি ইসমাইল, বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমাদেরকে আজ যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তখন আইজ্যাক বেগিনের মোবাইলে একটা কল আসে। তিনি কলটি রিসিভ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন, ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড রেডি? ধন্যবাদ। আমাদের লক্ষ্য এখন পিয়েল পাশা বুলেভার্ড। এটা কাছে।’ সাইমি ইসমাইল বলল।
‘ধন্যবাদ সাইমি ইসমাইল। আপনার এই তথ্য ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে কনফার্ম করল। আসলে শুরুতে গন্তব্য পিয়েল পাশা বুলেভার্ড ছিল। কিন্তু সম্ভবত তাদের গাড়ি বহর আক্রান্ত হওয়া এবং প্রধানবিচারপতিকে কিডন্যাপ করায় পিয়েল পাশা বুলেভার্ড কাছে বলেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, অথবা সেখানে অন্য কোন অসুবিধা দেখা দেয়, তার ফলেই তারা গন্তব্যস্থান হিসেবে ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে ঠিক করে।’ থামল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই পুলিশ প্রধান প্রধান নাজিম এরকেন বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকানা সম্পর্কে আপনার কথা ঠিক। এখন আমাদের কি করণীয় স্যার?’
‘দয়া করে ১০১ বার্বারোস ঠিকানাটার চারপাশে আপনাদের লোকদের সাদা পোশাকে এমনভাবে অবস্থান নিতে বলুন, যাতে কারও মনে সামান্য সন্দেহের উদ্রেকও না হয়। এ ঠিকানায় ঢুকতে কাউকে তারা বাধা দেব না। কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে ফলো করবে এবং নিরাপদ জায়গায় তাকে আটক করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অল রাইট’ বলে পুলিশ প্রধান একটু সরে দাঁড়িয়ে তার পকেট থেকে মিনি অয়্যারলেস বের করে নির্দেশ দিতে শুরু করল।
‘এরপর করণীয় কি মি. খালেদ খাকান?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমাদের লক্ষ্য হলো, প্রধান বিচারপতিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ওদের হাত ছাড়া হওয়া এবং আইজ্যাক বেগিনের পরিণতির কথা জানতে পারলে ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হবে। রাগের মাথায় ওরা প্রধান বিচারপতির ক্ষতি করতে পারে। এই সম্ভাবনা রোধের জন্যে অবিলম্বে তাকে উদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের।
‘উদ্ধার অভিযান এমন হবে যা শেষ মুহূর্তের আগে ওরা টের পাবে না। টের পেলে ওরা মরিয়া হয়ে প্রধান বিচারপতিকে হত্যাও করে ফেলতে পারে। উদ্ধার অভিযানের বিষয় যখন তারা টের পাবে, তখন তাদের করার কিছুই থাকবে না, এই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা আহমদ মুসা বলল।
‘সে ব্যবস্থার কথাই ভাবুন মি. খালেদ খাকান।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
চোখ বন্ধ করেছিল আহমদ মুসা। ভাবছিল সে।
জেনারেল মোস্তফা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, দু’একজনকে ঐ বাড়িতে ওদের অলক্ষ্যে প্রবেশ করতে হবে। তাদের কাজ হবে প্রধান বিচারপতিকে সাহায্য করা, নিরাপদ করা। তারা সংকেত দিলে, তারপর ঐ ঠিকানায় সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
সবাই নিরব।
ভাবছে সবাই।
সব শেষে সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকেই। জেনারেল মোস্তফা বলল,‘এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চয় কিছু ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
‘আমাকে ওরা তুরস্ক ছাড়া করতে চাচ্ছে, আমিই আগে দেখা করতে চাই ওদের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখভরা হাসি।
কিন্তু হাসতে পারল না আর কউ। বলল জেনারেল মোস্তফা,‘আপনি একা?’
‘ওদের নজর এড়াবার জন্যে একাই সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া এই মুহূর্তে দ্বিতীয় জনের সিলেকশন মুস্কিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল তাহির তারিক আংকারা থেকে ফিরেছেন, তাঁর সাথে কি একটু কথা বলবেন?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সময় কম। এই সময়ে তার উদ্বেগ বাড়িয়ে লাভ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি খুব সামান্য একজন কমান্ডো। আমি ও আমার সাথীরা সেদিন বিজ্ঞানী স্যারের কিডন্যাপ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। এরপরও আমি কি আমার সহযোগিতা অফার করতে পারি?’ বলল সাইমি ইসমাইল।
‘বোন ভাইকে এমন সহযোগিতা অফার করাটাই স্বাভাবিক। সেদিন তোমরা ব্যর্থ হওনি বোন। তুমি ছাড়া সবাই তো সেদিন জীবন দিয়েছে। বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে না করলে তোমাকেও ওরা মেরে ফেলত। সেদিন দিনটা ওদের ছিল, পরিকল্পনাও ছিল ওদের। তাই বিজয়ও ওদের হয়েছে। কিন্তু তোমরা সেদিন ব্যর্থ হওনি।’আহমদ মুসা বলল।
আবেগে মুখ ভারি হয়ে উঠেছিল সাইমি ইসমাইলের। তার দুধে-আলতা রংয়ের গালে স্ফটিকের মত দু’ফোটা অশ্রুও নেমে এসেছিল।
বলল, ‘তাহলে কি ভাইয়ের সাথী হতে পারব আমি?’ আবেগরূদ্ধ কণ্ঠ সাইমি ইসমাইলের।
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আমাদের ঐতিহ্য হলো, এ ধরনের লড়াই-এ বোনরা শুরুতেই শামিল হয় না। বিবি খাওলাদের ডাক পড়ে যুদ্ধের পরিনতি পর্বে। জেনারেল মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের সাথে আজকে তুমিও থাকবে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার অভিযানে।’
‘ধন্যবাদ। কষ্ট হলেও ভাইদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া বোনদেরও ঐতিহ্য।’ বলল সাইমি ইসমাইল চোখ মুছতে মুছতে।
‘আরেক বোনের তো কথা বলা হচ্ছে না! বোনরা সবসময় আবদার করেই কি অধিকার আদায় করবে?’ বলল আয়েশা আরবাকান।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি তো আমার সাথেই আছ। তোমার দুই রিভলবারের সবগুলো গুলিই তুমি খরচ করেছ এই অভিযানে। আমি মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের কাছে তোমার নামও রিকমেন্ড করব এই অভিযানে শামিল করার জন্য।’
‘জনাব খালেদ খাকান, আয়েশা আরবাকানও আমাদের মহিলা কমান্ডো ইউনিটের একজন চৌকশ সদস্য। তাকে আমরা ওয়েলকাম করব এই অভিযানে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘ধন্যবাদ মি. নাজিম এরকেন।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘আমার গাড়ি ওরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। আমি এখনি বের হতে চাই।’
‘চলুন, আমরা ড. আন্দালুসিকে নিয়ে মিলিটারী হাসপাতাল পর্যন্ত একসাথে যাই। ওখানেই একটা ভাল গাড়ি আপনার জন্য থাকবে। প্রয়োজনীয় কমব্যাট ব্যাগও পাবেন তাতে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই জেনারেল মোস্তফা আবার বলল, ‘আমি ভাবছি, আপনি ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড ঠিকানায় পৌঁছে আমাদেরকে একটা সঙ্কেত দেবেন। আপনার সঙ্কেত পাওয়ার পর আমরা ওদিকে মুভ করব। যাতে আপনি বাড়িতে প্রবেশের বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারি।’
‘ধন্যবাদ, ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলুন আমরা মুভ করি হাসপাতালের দিকে।’
‘চলুন। মি. খালেদ খাকান আপনি সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকানকে নিয়ে ড. আন্দালুসির সাথে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বসুন। সাইমি ইসমাইলই গাড়িটা ড্রাইভ করবে।’
বলে জেনারেল মোস্তফা তার গাড়ির দিকে এগোলো। অন্যেরাও এগোলো তাদের গাড়ি লক্ষ্যে।
স্টার্ট নিল সবগুলো গাড়ি।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের গাড়ি সবার আগে। তারপরে বিজ্ঞানীকে নিয়ে আহমদ মুসাদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সবার পেছনে পুলিশের দুটি গাড়ি।
গাড়ির ছোট্ট বহরটি এগিয়ে চলল মিলিটারী হাসপাতালের দিকে।