৪৭. বসফরাসে বিস্ফোরণ

চ্যাপ্টার

গাড়ি বারান্দায় গিয়ে গাড়ি থামতেই ডেভিড ইয়াহুদ লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল।
দ্রুত বারান্দার তিনটি ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় উঠে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ।
আবু আবদুর রহমান আরিয়েহের চোখে-মুখে উত্তেজনা। সে দাঁড়িয়েছিল যেন ডেভিড ইয়াহুদের অপেক্ষায়!
ডেভিড ইয়াহুদ বারান্দায় উঠে আসতেই তার সাথে হ্যান্ডশেক করে আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ তাকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
পাশাপাশি সোফায় বসেই আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ বলল, ‘আপনারা এ কি করলেন? এ বিপজ্জনক বন্দীকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?’
‘করার কিছুই ছিল না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বন্দীকে আমরা তুলেছিলাম ডেভিড হারজেলের ওখানে। আমাদের একটা ভুলের জন্যে ঐ ঠিকানাটা প্রতিপক্ষের হাতে চলে যেতে পারে সন্দেহ করেই দ্রুত ওখান থেকে সরে আসতে হয়েছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ঐভাবে এ ঠিকানাও শত্রুপক্ষের জানা হয়ে যেতে পারে। এ সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি।’ আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ বলল।
‘ঠিক হয়নি এটা আমি জানি। এই সেনসেটিভ ঠিকানার ওপর কারও কোন প্রকার সন্দেহের দৃষ্টি না পড়ে এই সার্বিক প্রচেষ্টা আমাদের রয়েছে। এখন কি করা যায় বলুন।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আমরা যে গবেষণার কাজ এখানে করছি, তার অগ্রাধিকার সবার ওপরে। যে কোন মূল্যে এর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। আমি মনে করি, বন্দীকে অবিলম্বে অন্য কোথাও শিফ্‌ট করুন।’ বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান বলল।
‘কিন্তু ইস্তাম্বুলে নিরাপদ কোন আশ্রয় আমাদের আর নেই। এখানে বন্দীকে রাখা ঠিক হবে না, এ বিষয়ে আমিও একমত। তাহলে কি করা যায় বলুন?’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আপনারা প্রধান বিচারপতিকে কেন বন্দী করেছেন, বলুন তো?’ জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমানের।
‘বিজ্ঞানী হাতছাড়া হয়ে যাবার পর সুযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তাকে পণবন্দী করা হয়েছে চাপ সৃষ্টি করে বিজ্ঞানেীকে ফেরত পাওয়া বা অন্য কোন সুবিধা লাভের ক্ষীণ আশায়।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আপনাদের সিদ্ধান্ত ঠিকই তাৎক্ষণিক, সুচিন্তিত নয়। কারণ প্রধান বিচারপতির বিনিময়ে তারা বিজ্ঞানীকে আমাদের হাতে তুলে দেবে না। প্রধান বিচারপতিকেই উদ্ধারের জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। প্রধান বিচারপতিকে বন্দী করে রাখার মধ্যে কোন লাভ নেই, ষোল আনাই ক্ষতির আশংকা।’ বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান বলল।
‘আপনার পরামর্শ কি তাহলে?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড ইয়াহুদের।
চোখ বন্ধ করে এক মুহুর্ত ভেবে বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান বলল, ‘তাকে ছেড়ে দিয়ে আসাই সব দিক থেকে মঙ্গল। প্রধান বিচারপতিকে পেলে ওদের অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি রক্ষা পেয়ে যাবে এবং নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা নতুন উদ্যোগে কিছু করার সুযোগ পাব।’
ডেভিড ইয়াহুদ একটু ভেবে বলল, ‘আপনার যুক্তিই ঠিক মি. আরিয়েহ। তাহলে ওদের আমি বলে দিই ওরা তাকে রাস্তার পাশে কোন এক জায়গায় ফেলে রেখে আসবে।’
‘উনি কি অবস্থায় আছেন?’ জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমানের।
‘উনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছেন। আগে চোখ বাঁধা ছিল, এখন বাঁধা নেই।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ঠিক আছে, যেভাবে বলেছেন সেটাই করুন। আপদ বিদায় হোক!’ বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান বলল।
‘আসছি আমি, বলে আসি ওদের।’
বলে ডেভিড ইয়াহুদ দ্রুত উঠে গেল।
দু’মিনিট পরে ফিরে এলো ডেভিড ইয়াহুদ। বলল, ‘ওদের পাঠিয়ে দিয়েছি। সাবধানে কাজটা সারতে বলেছি।’
ডেভিড ইয়াহুদ বসল বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান আরিয়েহর পাশে।
‘এটাই ভালো হলো, ড. ডেভিড ইয়াহুদ! আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। নিশ্চিত লাভ ছাড়া ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ানোর কোন দরকার নেই।’ বিজ্ঞানী ড. আরিয়েহ বলল।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল ডেভিড ইয়াহুদ। সোজা হয়ে বসল। তার সারা মুখ জুড়ে হতাশার ছাপ। বলল ধীরে ধীরে, ‘অনেক দিনের পরিকল্পনার জাল পেতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে ধরলাম। লাভ হলো না। জাল কেটে বেরিয়ে গেল। এই আহমদ মুসাই অতীতে আমাদের বার বার সর্বনাশ করেছে। এবারের সর্বনাশটাও সে-ই করল। সে দৃশ্যপটে উদিত না হলে সোর্ডের ফর্মুলা, সোর্ডের মডেল সবই এতদিন আমাদের হাতে এসে যেত। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো এই শয়তানটা!’
‘হঠাৎ কেন আসবে? ওআইসি ও তুরস্ক সরকার পরিকল্পনা করেই তাকে নিয়ে এসেছে। আহমদ মুসা এখন ইসলামী বিশ্বের শেষ তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যেখানেই তাদের অনতিক্রম্য ক্রাইসিস, সেখানেই আহমদ মুসাকে হাজির করা হচ্ছে।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আরিয়েহ।
‘বুঝতে পারছি না আমি, আমরা এখন কোন্ পথে এগোবো? আমি নতুন করে তেলআবিব ও ই্উরোপ-আমেরিকার আমাদের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেছিলাম, আহমদ মুসাকে মোকাবিলা করতে পারে এমন কাউকে পাঠানোর জন্যে। তারা কোন আশ্বাস দিতে পারেনি। তারা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে হাতে আনাকেই গুরুত্ব দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাকে হাতে এনেও রাখতে পারলাম না। আমি ভাবছি, তাকে কিডন্যাপ করার নতুন উদ্যোগ শুরু করার কোন বিকল্প নেই। একজন ব্যক্তিকে তারা তো বাক্সবন্দী করে রাখতে পারবে না। প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে তাকে হাতে পাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যাবেই।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। দূর্বল ও বেদনার্ত কণ্ঠ তার।
সোফায় গা হেলান দিয়ে ভাবছিল বিজ্ঞানী ড. আরিয়েহ। তার চোখ দু’টি বোজা ছিল। সে সোজা হয়ে বসল। মাথা নিচু হলো তার। বলল, ‘ফোটন পারটিকেলস’-এর ঝাঁককে একটা স্বয়ংক্রিয় ডিফেনসিভ শিল্ডে পরিণত করা এবং তাকে স্বয়ংক্রিয় ক্যারিয়ারে পরিণত করে বন্দী মারণাস্ত্রকে গভীর মহাশূণ্যে নিয়ে ধ্বংস করার বিজ্ঞান ও টেকনোলজি আমার কাছে এখনও আকাশ কুসুম বলেই মনে হয়। বুঝতেই পারছি না এই অসাধ্য ও কল্পনার একটা বিষয়কে ড. আন্দালুসিরা কিভাবে বাস্তবে পরিণত করল। এতো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিফেন্স টেকনোলজি! একে হাত করতে না পারলে তো আমাদের সব আশা-ভরসাই শেষ হয়ে যাবে!’ হতাশ কণ্ঠস্বর বিজ্ঞানী ড. আরিয়েহর।
‘আমাদের সাফল্য আর কত দূরে ড. আরিয়েহ?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড ইয়াহুদের।
‘ল্যাবরেটরি টেস্ট তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। মডেল টেস্টও সফল হয়েছে। অপারেশন শুরুর জন্যে প্রস্তুত হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।’ বলল ড. আরিয়েহ।
ড. ইয়াহুদের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘রোমেলী দুর্গের ওদের ‘ইনস্টিটউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি’, ওদের সোর্ড, ওদের বিজ্ঞানীরা আমাদের প্রথম টার্গেট হতে পারে না? সবার অলক্ষ্যে ওদের সব চিহ্ন আমরা দুনিয়ার বুক থেকে মুছে ফেলতে পারি না?’
‘একটা বিকল্প পথ হিসেবে এটা আমাদের সামনে আছে। কিন্তু এর পথে আছে অদৃশ্য দেয়ালের বাধা। ওদের সোর্ডের ডিফেনসিভ শিল্ডের মনিটর যদি সুপার সেনসেটিভ হয় এবং যদি সোর্ডের শিল্ড হাইয়েস্ট পাওয়ার পারটিকেলের হয়, তাহলে আমাদের ফোটন সাইলেন্ট ডেস্ট্রাকশন ডেমন (Foton Silent Destruction Deomon-FSDD) ধ্বংস করার বদলে সোর্ডের হাতে বন্দী হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের ফোটন সাইলেন্ট ডেস্ট্রাকশন ডেমন (FSDD) বা ‘ডাবল ডি’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে।’ বলল বিজ্ঞানী আরিয়েহ গম্ভীর কণ্ঠে।
‘কিন্তু তারা যদি অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে এবং সে সম্ভাবনাই বেশি।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘সেটাও সম্ভাবনার ব্যাপার।’ নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, তারা সব সময় প্রস্তুত থাকে না। থাকারই কথা।’ বলল ড. আরিয়েহ।
‘আর কি বিকল্প আছে?’ বলল হতাশ কণ্ঠে ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘বিকল্প আর কিছু নেই। ওদের বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে কিডন্যাপ করা অথবা মেরে ফেলা অথবা ওদের ধ্বংস করা-এই দুই পথেই আমাদের এগোতে হবে।’ ড. আরিয়েহ বলল।
‘কিন্তু ওদের ধ্বংস করার পথই তো অনিশ্চিত।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আমি তত্ত্বগত অসুবিধার কথা বলেছি। বাস্তবে সুবিধাও থাকতে পারে, আশংকা সত্য নাও হতে পারে। বিষয়টা আরও বিবেচনা সাপেক্ষ, যা ভাবছি সে রকম অসম্ভব নাও হতে পারে।’ ড. আরিয়েহ বলল।
ড. আরিয়েহর কথা শেষ হবার আগেই ড. ডেভিড ইয়াহুদের টেলিফোন বেজে উঠেছিল।
ড. ইয়াহুদ তার মোবাইল বের করে নিয়েছিল তার পকেট থেকে। ড. আরিয়েহর কথাও তখন শেষ হয়ে যায়।
ড. ইয়াহুদ মোবাইলে ও প্রান্তের সাড়া পেতেই বলে উঠল, ‘কি খবর জোনাহ, কাজ শেষ?’
‘হ্যাঁ, শেষ। তাকে এই মাত্র ওরা তুলে নিয়ে গেছে।’ বলল ওপার থেকে।
‘এত তাড়াতাড়ি? তোমরা ওখানেই?’ এপার থেকে প্রশ্ন ড. ইয়াহুদের।
‘বলছি। আমরা তাকে হাইওয়ের বাঁদিকেই চৌরাস্তার টপ ফ্লাইওভারে ফেলে রেখে চলে এসে আবার রাস্তা ঘুরে ওদিকে গিয়েছিলাম। মানুষের জটলা দেখে আমরা যাচ্ছিলাম ওখানে। পৌঁছতেই দেখলাম একজন তার সংজ্ঞাহীন দেহ গাড়িতে তুলল। গাড়িতে তুলে দরজা বন্ধ করে মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দিকে যাচ্ছিল। স্পষ্ট শুনলাম উনি বলছিলেন, ‘জেনারেল, তাকে পাওয়া গেছে মাঝপথেই। প্রয়োজন নেই আর আপনাদের আসার। হাসপাতালে ফিরুন। আমি ওঁকে নিয়ে হাসপাতালে আসছি।’ কথা শেষ করেই গাড়ি নিয়ে উনি ছোটেন সিজলীর দিকে। আমার মনে হয় লোকটি কোন সরকারি লোক হবেন।’
‘লোকটি কেমন? ইউনিফর্মে ছিল?’ জিজ্ঞাসা ড. ইয়াহুদের।
‘না, সিভিল ড্রেসে। একহারা সাধারণ ফিগার। এশীয় চেহারা।’ বলল ওপার থেকে জোনাহ।
‘ঠিক আছে তোমরা চলে এসো। ওকে।’
বলে মোবাইল মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে অফ করে দিল।
মোবাইলের লাউড স্পীকার অন ছিল। মোবাইলের সব কথা ড. আরিয়েহও শুনছিল।
মোবাইল বন্ধ করে ড. ইয়াহুদ কিছু বলার আগেই ড. আরিয়েহ বলে উঠল, ‘মি. ইয়াহুদ, বুঝা যাচ্ছে, যে লোকটি প্রধান বিচারপতিকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে সে তাকে উদ্ধার করতেই এদিকে আসছিল এবং জেনারেল মোস্তফারাও আসছিল উদ্ধার অভিযানেই। কিন্তু এদিকে কেন?’
থামল ড. আরিয়েহ। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া। বলল সে, ‘টেলিফোনে জোনাহ যা বলল তাতে তো বুঝা যাচ্ছে ওরা এদিকেই আসছিল। কিন্তু কেন এদিকে বলা মুস্কিল। এ পথ দিয়ে তো অনেক দিকেই যাওয়া যায়।’
‘তা যাওয়া যায়। এখানেও তো আসা যায়।’ বলল ড. আরিয়েহ।
‘তা আসা যায়। কিন্তু তারা এখানে আসবে কেন?’ বলল ড. ইয়াহুদ।
‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু যে উত্তর আমাদের জানা নেই, তা কারও জানা নেই, তা ঠিক নাও হতে পারে। ডেভিড হারজেলের বাড়ির সন্ধান তারা পেয়েছিল, এ কথা আমরা জানি। সুতরাং আমাদের এ ঠিকানার নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা আমরা করতেই পারি।’ বলল ড. আরিয়েহ।
ড. ইয়াহুদ কোন উত্তর দিল না। তাকিয়ে ছিল সে ড. আরিয়েহর দিকে। একটু সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে সে বলল, ‘ড. আরিয়েহ, আপনি ঠিক বলেছেন। আহমদ মুসা যেন বাতাস থেকে সব কিছুর গন্ধ পায়! এখন আমাদের করণীয় কি ভাবছেন?’
‘আমি আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছি। এ ঠিকানাও ছেড়ে দিতে হয় কিনা তা আমাদের ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।’ ড. আরিয়েহ বলল।
‘আপনার ভাবনা ঠিক। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে উদ্ধারের পর আমাদের এই ঠিকানা ওদের সন্দেহের তালিকায় আর নেই। কারণ প্রধান বিচারপতিকে তারা পেয়েছে অন্য এক জায়গায়। এর অর্থ এখানে তাকে আনা হয়নি। অতএব, এ ঠিকানার সন্ধান তারা পেলেও এটা এখন তাদের ভুলে যাবার কথা।’ বলল ড. ইয়াহুদ।
‘আপনার যুক্তি ঠিক। প্রধান বিচারপতিকে উদ্ধারের পর আমাদের এ ঠিকানা নিয়ে তাদের ভাববার কথা নয়। এ যুক্তির সাথে আমিও একমত। কিন্তু আশংকা থেকে মুক্ত হতে পারছি না।’ ড. আরিয়েহ বলল।
‘আশংকা থাকা ভালো। আমরা সাবধান হতে পারব। কিন্তু সাবধান থাকার জন্য বেশি কিছু করার দরকার নেই।’ বলল ড. ইয়াহুদ।
‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু আমাদের ‘ডাবল ডি’ মানে ‘ফোটন সাইলেন্স ডেসস্ট্রাকশন ডেমন’ (FSDD) গবেষণার অংশ বিশেষ অন্যত্র আমি সরিয়ে ফেলতে চাই, বিশেষ করে ‘মডেল’ ও ‘টেস্ট’ অংশ অন্যত্র সরিয়ে রাখাই ভালো। শুধু ‘রিসার্চ অংশ এখানে থাকবে।’ ড. আরিয়েহ বলল।
‘কিন্তু এত বড় জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে?’ জিজ্ঞাসা ড. ইয়াহুদের।
‘চিন্তা করুন। আমিও চিন্তা করছি। জায়গা অবশ্যই পাওয়া যাবে। ইউরোপ-আমেরিকার দূতাবাস কর্তৃপক্ষ যারা ইস্তাম্বুলে আছেন তারাও আনন্দের সাথে আমাদের সাহায্য করবেন।
‘ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন! আমরা আরও একটু ভাবনা-চিন্তা করি। আপনি যেটা বলেছেন সে রকমই সিদ্ধান্ত হতে পারে, যদি জায়গা পাওয়া যায়। ধন্যবাদ ড. আরিয়েহ আমি উঠি। আমাদের কোথায় কি অবস্থা একটু খোঁজ নিতে হবে।’
উঠে দাঁড়াল ড. ইয়াহুদ।
ড. আরিয়েহও উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে দিল ড. ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘ভাববেন না, ড. ইয়াহুদ, আমরা দুর্বল হইনি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মারণাস্ত্র এখন আমাদের হাতে এবং এই খবর কেউ জানে না, ইউরোপ-আমেরিকাও নয়। ওরা জানলে পাগল হয়ে যাবে। আমাদের কোন শর্তই ওরা অপূর্ণ রাখবে না। সোর্ড ইউরোপ-আমেরিকার আতংকের কারণ বটে, কিন্তু ‘ডাবল ডি’র খবর জানলে ওদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। অতএব, আমাদের চিন্তার কিছু নেই।’
‘ধন্যবাদ ড. আরিয়েহ। ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা হাত করা এবং সোর্ড ও তার গবেষণা ধ্বংস করার জন্যে ওরা আমাদের সাহায্য করছে। এই সাহায্য আমাদের ও আমাদের ‘ডাবল ডি’র শত্রু ‘সোর্ড’কে ধ্বংস করতে যেমন আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনি আমাদের ‘ডাবল ডি’র গবেষণা তৈরিতেও সাহায্য করছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তিনি তাঁর আশীর্বাদ আমাদের ওপর ঢেলে দিয়েছেন।’
কথা শেষ করে ড. আরিয়েহর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আসি, বাই!’
‘ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন! আসুন।’ বলল ড. আরিয়েহ।

ইস্তাম্বুল সামরিক হাসপাতালের ভিভিআইটি স্যুট।
ইজি চেয়ারে শুয়ে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তার বাম ও ডান পাশের সোফাগুলোর বাম পাশের একটি সোফায় বসে আছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সিকউরিটি চীফ জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং ডান পাশের পাশাপাশি দু’সোফায় বসে আছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আহমদ আরদোগাল বাবাগলু ও প্রধানমন্ত্রী হোসেইন ইসমাইল সেলিক।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দেখতে এসেছেন বিজ্ঞানী ড. আব্দুল্লাহ আন্দালুসিকে। জেনারেল মোস্তফা কামাল হাসপাতালেই ছিলেন। ভিভিআইপি অতিথিদের তিনিই সাথে করে কক্ষে নিয়ে এসেছেন।
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তার সুস্থ হেয়ে উঠতে সময় লাগছে। ইলেক্ট্রিক শক তার দেহের কোষগুলোর বিরাট ক্ষতি করেছে। আস্তে আস্তে সেরে উঠছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কুশল বিনিময় ও টুকটাক কথা চলছিল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি এবং প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন যে, আল্লাহ শুধু বিজ্ঞানীকে নন, একটা শ্রেষ্ঠ গবেষণাকে তিনি রক্ষা করেছেন।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার, মানবতার পক্ষের একটা গবেষণাকে তিনি সব দিক দিয়েই সাহায্য করেছেন। খালেদ খাকান কে আমি জানি না। তবে তাকে সাক্ষাত ফেরেশতা বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তিনি আসার পর যা ঘটছে, তিনি যা করছেন এবং আমাদের উদ্ধারের ঘটনা আমি দেখলাম, তাতে তিনি আল্লাহর তরফ থেকে এক জীবন্ত সাহায্য। আপনাদের মোবারকবাদ যে, এমন একজন ব্যক্তিকে আপনারা বাছাই করেছেন।’
‘ড. আন্দালুসি, আপনি যেমন আল্লাহর এক বিশেষ সাহায্য মুসলিম উম্মার জন্যে, তেমনি তিনিও এক সাহায্য। আল্লাহর অসীম দয়ার জন্যে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
এভাবেই তাদের অনির্দিষ্ট আলোচনা এগিয়ে চলছিল।
প্রেসিডেন্টের পি.এস. এসে প্রবেশ করল।
প্রেসিডেন্টকে কানে কানে কিছু বলে সরে দাঁড়ালো পেছন দিকে।
প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহমদ মুসা এসেছে। তাকে আসতে বলি?’
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার যদি আপত্তি না থাকে।’ প্রধানমন্ত্রী বললেন।
‘আমার আপত্তি থাকার কোন প্রশ্নই নেই।’
বলে তাকালেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দিকে। বললেন, ‘মি. খালেদ খাকান আসছেন, ড. আন্দালুসি!’
‘ওয়েলকাম। তার আসার জন্যে কোন অনুমতির দরকার নেই।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দুলুসি।
প্রেসিডেন্টের পি.এস. বেরিয়ে গেল।
মিনিট খানেকের মধ্যে আহমদ মুসাকে নিয়ে প্রবেশ করল ভিভিআইপি রুমটির সিকিউরিটি অফিসার তুর্কি সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যরি, আমি নিশ্চয় অসময়ে এসে পড়েছি।’
কক্ষের সবাই সালাম দিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘না, মি. খালেদ খাকান, আপনি নিশ্চয় সুসময়ে এসেছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনারেল মোস্তফাসহ বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে কিছু শোনা হয়নি। ওদের পর পর কয়েকটা সেট ব্যাক হবার পর এবং প্রধান বিচারপতিকে তারা ছেড়ে দেয়ার পর কি মনে হয় যে, তারা অফেনসিভে আসবে? কিন্তু তার আগে বলুন, আপনি কেমন আছেন? কবে আপনি হাসপাতলে থেকে বেরুলেন? আপনার আঘাতের অবস্থা কি? আঘাতটার ব্যাপারে কিন্তু আপনি নিজের প্রতি যথেষ্ট অবহেলা দেখিয়েছেন, ডাক্তারের কাছে আমি শুনেছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। গতকাল হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি। জেনারেল মোস্তফা তখন ছিলেন সেখানে।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘আপনি প্রধান বিচারপতিকে ছেড়ে দেয়ার কথা তুলেছেন। প্রধান বিচারপতিকে পণবন্দী রেখে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না ভেবেই তারা তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তাদের উদ্দেশ্য সফল না হওয়া কিংবা তাদের ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অফেনসিভের আশংকা বাদ দেয়া যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক, মি. খালেদ খাকান। ওদের অফেনসিভ যে কোন দিক থেকে যে কোন সময় আসবে এটাই ধরে নিতে হবে। ওরা যথেষ্ট দূর্বল হয়েছে, তবে ওদের মূলোচ্ছেদ ঘটেনি।’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘ঠিক, মি. প্রেসিডেন্ট।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা।
তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, ‘কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যে আমি এসেছিলাম। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, ড. আন্দালুসি যদি অনুমতি দেন, তাহলে কথা বলতে পারি।’
‘আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? আমাদের উপস্থিতিতে কথা বলায় আপত্তি নেই তো?’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হতেই বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি বলে উঠল, ‘আমার অনুমতির প্রয়োজন এ কথা মেনে হলো কেমন করে আপনার? আপনাকে যে কোন সহযোগিতা করতে পারলে খুশি হবো।’
‘ধন্যবাদ সকলকে। যে কথাটা আমি বলতে চাই, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। মি. প্রেসিডেন্ট ও মি. প্রধানমন্ত্রী তা শোনার মতো সময় দিলে আমি খুব খুশি হবো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। তাহলে শুরু করুন আপনার কথা।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল। মুহুর্তের জন্যে একটু ভাবল। তাকাল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দিকে। বলল, ‘ড. আন্দালুসি, আমাদের সোর্ড (Saviour of World Rational Domain-SOWRD) তো ডিফেনসিভ অস্ত্র, ফোটন পারটিকেলস দিয়ে কি অফেনসিভ অস্ত্র তৈরী সম্ভব?’
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, এ প্রশ্ন কেন করছেন?’
‘কারণ পরে বলব। আপনি বলুন এটা সম্ভব কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. খালেদ খাকান, যে শক্তি বা বস্তু ব্যবহারে ডিফেনসিভ অস্ত্র বানানো যায়, তা দিয়ে অফেনসিভ অস্ত্র বানানোও সম্ভব।’ বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি বলল।
‘ধন্যবাদ ড. আন্দালুসি। ফোটন পারটিকেলস দিয়ে যে অফেনসিভ অস্ত্র তৈরী হবে, তার চরিত্র কেমন হতে পারে, তার ধ্বংসকারী ক্ষমতা কি ধরণের হবে?’ বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘অস্ত্রের চরিত্র ও ধ্বংসকারিতা নির্ভর করবে কি ধরণের ফোটন পারটিকেলস কি মাত্রায় ব্যবহার করা হবে তার ওপর।’
‘প্রচলিত পরমাণু অস্ত্র ও ফোটন অস্ত্রের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য কি হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হাসল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, আপনি এসব সাংঘাতিক বিষয় নিয়ে কেন আলোচনা করছেন।’
বলে থামল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। শোয়া অবস্থা থেকে মাথাটা ওপরে তুলে বসার চেষ্টা করল ইজি চেয়ারে। তারপর বলল, ‘ফোটন বুলেট বা ফোটন এক্সপ্লোশনের সাধারন যে চরিত্র তাতে সহজ ভাষায় যা বলা যায় তা হল, পরমানু অস্ত্র ধ্বংস করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, আর ফোটন ধ্বংস করবে নিরব-নিস্তব্ধ আঘাতে এবং এ ক্ষেত্রে ধ্বংসও হবে টোটাল, কোন ধ্বংসাবশেষও থাকবে না। এ এমন এক ভয়ংকর দৃশ্য যার কল্পনাও মানুষের বিবেক ও সত্তাকে অবশ করে দেয়ার মতো’। বলল বিজ্ঞানী ডঃ আন্দালুসি। তাঁর গোটা মুখমণ্ডল বেদনাক্লিস্ট হয়ে উঠেছে।
উপস্থিত সকলের চোখে-মুখেও বিস্ময় ও বেদনার চিহ্ন!
‘ড. আন্দালুসি, এ ধরনের অস্ত্র তৈরির গবেষণা চলছে এবং গবেষণার চূড়ান্ত সাফল্য গজ খানেকের বেশি দুরে নয়, এমন তথ্য তথ্য বা এমন দাবি কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে?’
আহমদ মুসার কথা শুনেই তড়াক করে উঠে সোজা ইজি চেয়ারে বসল ড. আন্দালুসি। তাঁর চোখে-মুখে বিস্ময় ও আতংকের চিহ্ন! তীব্র দৃষ্টিতে সে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। বলল দ্রুত ও শুকনো কণ্ঠে, ‘নিশ্চয় মি. খালেদ খাকান, আপনি কোন ভয়ংকর রসিকতা করছেন না!’
‘না জনাব। যদি বিষয়টা ভয়ংকর হয়, তাহলে আমি ভয়ংকর বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছি। তথ্যটা আমি যেখান থেকে যেভাবে পেয়েছি, তাতে এটা বিশ্বাস করেছি।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘কে বা কারা এই অস্ত্র তৈরি করেছে বা করছে?’ জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির। তাঁর কণ্ঠে কম্পন স্পষ্ট।
‘ওয়াল ওয়ার্ল্ড অরবিট বা থ্রি জিরো’ এই অস্ত্র তৈরি করেছে বা করছে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘থ্রি জিরো’ মানে যারা আমাদের গবেষণা হাত করার চেষ্টা করছে, যারা আমাকে কিডন্যাপ করেছিল, তারা?’
‘ইয়েস ড. আন্দালুসি, আমি এই তথ্যই পেয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
জবাবে কোন কথা বলল না বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তাঁর গোটা চেহারা উদ্বেগ ও আতংকের কালো চাদরে ঢেকে গেছে। সেই সাথে গভীর ভাবনার রেখা তাঁর চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্ট আহমদ আরদোগাল বাবাগলু, প্রধানমন্ত্রী হোসেইন ইসমাইল সেলিক ও তুরস্কের নিরাপত্তাপ্রধান জেনারেল মোস্তফার চোখে-মুখেও বিস্ময়, উদ্বেগ, আতংক! প্রেসিডেন্ট বললেন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘মি. খালেদ, ভয়ংকর এক তথ্য আপনি দিলেন। আপনি সত্য বলেছেন এবং বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বক্তব্যে বুঝেছি, এ ধরনের অস্ত্র তৈরি থিয়োরিটিক্যালি সম্ভব। কিন্তু যিনি আপনাকে খবরটি দিয়েছেন বা যে সুত্রে আপনি খবরটি পেয়েছেন, সেই সুত্র কতটা সত্য ইনফরমেশন দিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?’
‘মি. প্রেসিডেন্ট, সুত্রের সত্যতা সম্পর্কে আমি একশ’ ভাগ নিশ্চিত।’ কোন প্রকার সন্দেহ থাকলে বিষয়টা আমি এখানে তুলতাম না’। বলল আহমদ মুসা ধীর ও দৃঢ় কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কথাটা বললাম এই কারনে যে, খবরটা শ্বাসরুদ্ধ হবার মতো ভয়ংকর, বিশেষ করে ‘থ্রি জিরো’র মতো সন্ত্রাসী সংস্থার হাতে এই অস্ত্র গেলে গোটা পৃথিবীতে তো বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে!’ প্রেসিডেন্ট বললেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।
‘ওদের সংঘটনের নাম ‘One World Orbit’। তারা গোটা দুনিয়া দখল করে একক একটি রাষ্ট্র বানাতে চায় যার নিয়ন্ত্রক হবে তারা। এজন্যই এমন অস্ত্র তাঁদের চাই, যা দিয়ে কয়েক মুহূর্তে দুনিয়ার সব শক্তিকে ধ্বংস করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ওঁরা তো পশ্চিমাদেরও বিরোধী?’ প্রেসিডেন্ট বললেন।
‘অবশ্যই। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাদের বন্ধু নয়, ওদের ব্যবহার করছে মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘থ্রি জিরো’-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পূর্ব-পশ্চিম সবাই আমরা এক হতে পারি, একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারি। অন্তত ভয়ংকর এই অস্ত্রের ব্যাপারে এক সাথে কাজ করতে পারি।’ বললেন প্রধানমন্ত্রী।
‘পশ্চিমীদের জানালে হিতে বিপরীত হতে পারে। পশ্চিমীরা সন্ত্রাসী এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে অস্ত্রটা নিয়ে সেটা আমাদের উপর প্রয়োগ করতে পারে। ‘থ্রি জিরো’ বিপদে পড়লে ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আমাদের ধ্বংস করার সুযোগ নিতে পারে। সুতরাং কল্যাণ হলো, বিষয়টা কাউকে না জানিয়ে এই ভয়ংকর অস্ত্রের হাত থেকে দুনিয়ার মানুষকে রক্ষার জন্যে আমাদেরই উদ্যোগ গ্রহন করা।’ আহমদ মুসা বলল।
স্বস্তিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও নিরাপত্তাপ্রধান জেনারেল মোস্তফার। পরক্ষনেই আবার উদ্বেগ নেমে এলো প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে। বললেন, ‘কিন্তু আমরা যদি যথাসময়ে ওদের সব পরিকল্পনা নস্যাত করতে সমর্থ না হই, অস্ত্র যদি তৈরি হয়ে যায় বা এর ব্যবহার হয়, তাহলে?’
‘এ ঝুঁকি আছে, মি. প্রেসিডেন্ট। তবে আমি মনে করি অস্ত্র তারা এতো তাড়াতাড়ি ব্যবহার করবে না। তাঁদের অস্ত্র তৈরি যদি সম্পূর্ণও হয়ে যায়, তাহলেও তারা অস্ত্রের উৎপাদন, ব্যবহারের পরিকল্পনা, প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে। চিন্তা করবে তারা অস্ত্র ব্যবহারের পরবর্তী অবস্থা নিয়েও। তারা অস্ত্রাগার ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষকে তো ধ্বংস করতে পারবে না। ধ্বংস করতে পারবে না দুনিয়ার কোটি কোটি সংখ্যক প্রচলিত অস্ত্র। অতএব, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে তাঁদের অনেক ভাবতে হবে, অনেক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন আছে। সুতরাং সময় আমরা পাবো’। আহমদ মুসা বলল।
আবার মুখে ঔজ্জ্বল্য ফিরে এল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর। বললেন প্রেসিডেন্ট, ‘এখন তাহলে কি করনীয়? ‘থ্রি জিরো’ কোথায় তাঁদের গবেষণা চালাচ্ছে? সেটা কি তুরস্কে? ইস্তাম্বুলে?’
‘নিশ্চিত করে বলা যাবে না। গবেষণার বিভিন্ন পার্ট থাকতে পারে। সব এক যায়গায় থাকতে পারে, আবার অনেক যায়গায় বিভক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তবে এটা আমি নিশ্চিত মনে করি যে, মূল গবেষক ইস্তাম্বুলে আছেন’। আহমদ মুসা বলল।
‘তিনি ইস্তাম্বুলে আছেন? তিনি তুরস্কের বাসিন্দা, নাগরিক? না তিনি আছেন, এখানে এখন?’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তাঁর কণ্ঠে বিস্ময়-পীড়িত কম্পন।
‘আমি যতটা জেনেছি তিনি তুরস্কের বাসিন্দা।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও কেউ কথা বলল না। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল মোস্তফা, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি সবার চোখে-মুখেই বিস্ময়।
নিরবতা ভাঙল বিজ্ঞানী ডঃ আন্দালুসি। বলল, ‘শুধু ইস্তাম্বুল নয়, গোটা তুরস্কে অ্যাডভান্সড ফিজিক্স ও পারটিকেল বিজ্ঞান নিয়ে যারা কাজ করে, প্রত্যেককেই আমি চিনি। তাঁদের গবেষণা সম্পর্কেও মোটামুটি জানি। এদের কেউ হবেন নিশ্চয়।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি।
‘এই অনুসন্ধানের ব্যাপারে কিছুটা এগিয়েছি, নিশ্চিত হবার জন্যে আরও কিছুটা সময় লাগবে। আমি আশাবাদী খুব সত্বরই এ ব্যাপারে একটা সুখবর আমি দিতে পারব’। আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান।’ কথাটা প্রায় এক সাথেই বলে উঠলেন প্রেসিডেন্ট ও বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি।
আহমদ মুসা তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে ড. আন্দালুসির দিকে চেয়ে বলল, ‘ড., একটা বিষয় আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ফোটন পারটিকেলস থেকে তৈরি ওদের ধ্বংসাত্মক অস্ত্র প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমাদের সোর্ড-এর কি ভুমিকা হতে পারে?’
আহমদ মুসার প্রশ্নে খুশির প্রকাশ ঘটল প্রধানমন্ত্রীর চোখে। বললেন, ‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান, এ প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছে। বিষয়টা আমাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ভ্রু কুঞ্চিত হল ড. আন্দালুসির। ভাবল সে। একটু পর ধীর কণ্ঠে বলল, ‘এর সুস্পষ্ট জবাব দেয়া কঠিন। ফোটন পারটিকেলস থেকে মারনাস্ত্র কোন্‌ শ্রেণীর ফোটনের এবং কত মাত্রার তা জানলে নির্দিষ্ট জবাব দেয়া যেত। তবে একটা কথা বলতে পারি, ফোটন পারটিকেলসের মারনাস্ত্র কোন না কোন মেটালে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রবাহিত হয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে। আমাদের সোর্ড মেটালিক সে ক্ষেপণাস্ত্রকে বন্দী করে ধ্বংস করতে পারবে। আর ফোটন পারটিকেলস মারনাস্ত্র যদি শ্রেণী ও মাত্রার বিচারে আমাদের সোর্ড এর চেয়ে কম পাওয়ারফুল হয়, তাহলে সে ফোটন মারনাস্ত্রকেও নিউট্রাল করে ফেলতে পারবে আমাদের সোর্ড। আর ফোটন মারণাস্ত্রটি শ্রেণী ও মাত্রায় বেশি পাওয়ারফুল হলে সোর্ডের শিল্ড কেটে তা বেরিয়ে যাবে, কিন্তু লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। কারন গাইডেড হবার মতো মেটালিক যান বা ক্ষেপণাস্ত্র তাঁর থাকবে না। তবে সমস্যা এই যে, প্রচলিত কোন রাডারে ফোটন মারনাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র ধরা পড়বে না অতি ক্ষুদ্র অবয়ব হওয়ার কারণে। তবে ফোটন মারনাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে যদি সোর্ড মোতায়েন থাকে এবং সোর্ড যদি অ্যাকটিভেটেড (চালু) অবস্থায় থাকে, তাহলে ফোটন মারনাস্ত্র একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে পৌছার পর সোর্ডের চোখে ধরা পড়ে যাবে এবং তারপর যা ঘটবে তা আগেই বলেছি।’
‘তাঁর মানে আমাদের সোর্ড যদি অ্যাকটিভেটেড অবস্থায় মোতায়েন থাকে, তাহলে লক্ষ্যবস্তু ফোটন মারনাস্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘তাত্ত্বিকভাবে আমি তাই মনে করি। ফোটন মারনাস্ত্রের কম্পোজিশন ও শক্তির ডিটেইলটা পেলে সুনির্দিষ্ট একটা অপিনিওন দাঁড় করানো যেতে পারে’। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি বলল।
‘তাহলে এখন ফোটন মারণাস্ত্রের কম্পোজিশন ও শক্তিকে বিস্তারিত জানা প্রথম বিষয় হিসাবে দাঁড়াচ্ছে। পরের বিষয় হলো, এই সর্বনাশা মারনাস্ত্র ও তাঁর গবেষণাকে দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত করা। আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন, মিঃ খালেদ খাকান?’ বললেন প্রধানমন্ত্রী।
‘মি. প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেটা বলছেন সেটা আমারও কথা। এই দুই লক্ষ্যে আমরা কাজ করব, ফল আল্লাহ্‌র হাতে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বুঝতে পারছি না, এই ভয়ংকর অস্ত্র তৈরি যখন সম্পূর্ণ করেছে, তখন কেন তারা আমাদের সোর্ড-এর ফর্মুলা ও গবেষণা হাত করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে? ড. আন্দালুসি এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন দয়া করে?’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্যই মি. প্রেসিডেন্ট। তিনটি কারনে তারা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। এক. ফোটন পার্টিকেলস থেকে এ্যান্টি-এটাকিং ডিফেন্সিভ শিল্ড তারা আবিষ্কার করতে পারেনি। দুই. তারা পশ্চিমের ননকনভেনশনাল অস্ত্র ভাণ্ডারকে অচল হয়ে পড়ার ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষার কোন দায়িত্ব পেয়েছে পশ্চিমের কাছ থেকে এবং তিন. আত্মরক্ষার এই সুযোগ তারা আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে চায়। মিঃ খালেদ খাকান, কি ভাবছেন এ ব্যাপারে?’ বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি বলল।
‘আমার নতুন কিছু কথা নেই। ডঃ আন্দালুসি যা বলেছেন, সেটা আমারও কথা। প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে একটা কথা বলতে চাই, ওদের গবেষণার কথা আমরা জানতে পেরেছি, এটা ‘থ্রি জিরো’র কোনভাবেই জানা ঠিক হবে না। জেনে ফেললে অনেক কিছু ঘটাতে পারে। ওদের অপ্রস্তুত রেখে আমাদের ওদের ওপর গিয়ে পড়তে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তথাস্তু, আহমদ মুসা। সরকারের কোন ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানাবো না। কিন্তু আমরা সাংঘাতিকভাবে উদ্বিগ্ন, খালেদ খাকান। আমাদের যে কোন সাহায্য আপনার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। জেনারেল মোস্তফা সব ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহ্‌ আপনাকে সাহায্য করুন! আপনার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আপনি জীবন বাজি রেখে যা করছেন কোন মূল্যে তাঁকে পরিমাপ করা যাবে না। আল্লাহ্‌ আপনাকে এর জাযাহ দান করুন!’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমি আল্লাহ্‌র বান্দাদের জন্যে কাজ করছি। আল্লাহ্‌ যদি সন্তুষ্ট হন, এটাই আমার পরম পাওয়া।’ বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে।
‘এটাই ঠিক, মি. খালেদ খাকান। মানুষ জাগতিক কোন লাভের জন্যে এভাবে জীবন পণ করে কাজ করতে পারেনা। একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যে যে কাজ সে কাজেই মানুষ এতটা নিবেদিত, এতটা বেপরোয়া হতে পারে।’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
ঘরে প্রবেশ করল প্রেসিডেন্টের পি.এস.। বলল সে প্রেসিডেন্টকে, ‘স্যার, ডাক্তার ও নার্স এসেছেন।’
‘স্যরি। আমরা অনেক সময় নিয়েছি। ওঁদের আসতে বল। আমরা উঠছি।’
বলেই উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট।
উঠে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল মোস্তফা, আহমদ মুসা সকলেই।
প্রেসিডেন্ট কয়েক ধাপ এগিয়ে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘ইয়াংম্যান, আপনি আমাদের গর্ব। আল্লাহ্‌ আপনার বুদ্ধি, শক্তি সব বাড়িয়ে দিন। আজ আসি, আবার দেখা হবে। আসসালামু আলাইকুম।’
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিল। সব শেষে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসা ও জেনারেল মোস্তফা।
হাসপাতালের লাউঞ্জে বেরিয়ে জেনারেল মোস্তফা আহমদ মুসাকে ডেকে নিয়ে এক প্রান্তের নিরিবিলি সোফায় গিয়ে বসল। বলল, ‘অবস্থা সত্যিই ভয়ংকর। কোন্‌ পথে কিভাবে এগোবেন বলে ভাবছেন?’
‘পথ এখনও বের হয়নি। পথ বের করার জন্যে কিছু কাজ করতে হবে। সেদিন আপনি যে পাম গার্ডেনের ঠিকানা দিয়েছিলেন, গোপনে সেখানে একটা হানা দেব। দেখি সেখানে কোন ক্লু মিলে কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের কিছু করনীয় আছে?’ জিজ্ঞেস করল জেনারেল মোস্তফা।
‘আপনাকে জানাবো। আমি সেখানে যাবার আগে আপনার সাথে তো আলোচনা হবেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। তাহলে আমি উঠছি। আপনি না হয় আমাদের অফিসে চলুন। এক সাথে যাওয়া হবে।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘গেলে বাড়তি কি লাভ হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
হাসল জেনারেল মোস্তফাও। বলল, ‘আপনি যে ধরনের লাভের কথা বলছেন, তেমন কিছু আমার হাতে নেই। তবে আপনাকে একটা সাইন্স ফিকশন দেখাতে পারি। সদ্য রিলিজড্‌ হয়েছে। বিজ্ঞানের যে দিকটা আলোচনা হলো, সে ধরনের বিষয়েরই একটা ছবি।’
‘আপনি যখন দেখেছেন, তখন অবশ্যই ভালো হবে। আমারও লোভ জাগছে। চলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
দু’জন উঠে দাঁড়াল।
লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এগোলো গাড়ির দিকে।

জেনারেল মোস্তফার প্রতিশ্রুত সিনেমাটি দেখল আহমদ মুসা। প্রথমে হালকা মুডে, রসিকতার মধ্যে দেখা শুরু করলেও শীঘ্রই সে সিরিয়াস হয়ে উঠল।
দেখল আহমদ মুসা, দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী বিজ্ঞানীর কাহিনী সিনেমাটি। দু’জন বিজ্ঞানীর একজন হলেন প্ল্যানেট আর্থ-এর বিজ্ঞানী ড. লেভী, অন্য বিজ্ঞানী পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহ ‘নেবুলা’র ড. ক্রিস্টি ক্রায়েস্ট। দু’জন বিজ্ঞানী একে অপরকে টপকে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় পাগল। একজনকে আরেকজন মিথ্যা প্রমাণিত করতে পারলে খুব খুশি। একজন একটা আবিষ্কার করলে, তার বেটার ভারশন তৈরি করতে না পারলে অন্যজন স্থির থাকতে পারে না। দু’জনের প্রতিযোগিতা শেষে বিধ্বংসী প্রতিযোগিতায় রূপ নিল। ড. লেভী হয়ে দাঁড়ালেন পৃথিবীর রক্ষক, আর ড. ক্রিস্টি ক্রায়েস্ট তাঁর গ্রহ-রাজ্য নেবুলার পাহারাদার। তাঁদের এই বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দিল প্ল্যানেট আর্থ ও প্ল্যানেট নেবুলা উভয়কেই। নেবুলার বিজ্ঞানী ড. ক্রিস্টি ক্রায়েস্ট পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কানেকটিভিটির সুত্র আবিষ্কার করে তাঁকে কাজে লাগিয়ে এ্যান্টি –রিঅ্যাকটিভ ‘ডিঅ্যাকটিভ ভিটিং এন্ড ডিফিউজিং ওয়েভগান’ নামের অস্ত্র তৈরি করছে। ভয়াবহ এই অস্ত্র প্ল্যানেট আর্থের একটি প্রাণীরও কোন ক্ষতি না করে পৃথিবীর সব অস্ত্র মুহূর্তে অচল করে দিতে পারে। অন্য দিকে এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে প্ল্যানেট আর্থের বিজ্ঞানী ড. লেভী আলোর ফোটন পারটিকেলস-এর গ্রেড এইড থেকে ‘হর্ন অব গড’ ওরফে ‘সাইলেন্ট ডেথ ওয়ারিওর’ নামের অস্ত্র আবিষ্কার করেছে। এই মারণাস্ত্র শুধু প্ল্যানেট নেবুলার সব অস্ত্র ভাণ্ডার নয়, সেখানকার সব ধরনের মেটালকে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া করে দিবে। ফলে প্ল্যানেট নেবুলার সব কল-কারখানা বন্ধ করা সহ অফিস-আদালত ও বাড়ি-ঘরের কাজও অচল করে দেবে। এই আবিষ্কারের কথা ঘোষিত হবার পর প্ল্যানেট নেবুলার অনুরোধে প্ল্যানেট আর্থ ও প্ল্যানেট নেবুলা’র মধ্যে বৈঠক বসল। আলোচনার পর নিঃশর্তভাবে সারেন্ডার করল নেবুলার বিজ্ঞানী ড. ক্রিস্টি ক্রায়েস্ট।
এই হলো সিনেমাটির কাহিনী।
সিনেমাটি শেষ হবার পর ক্রেডিট লাইনের এক জায়গায় কাহিনীর আইডিয়ার জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে জনৈক বিজ্ঞানী ডঃ আরিয়েল আরিয়েহ-এর।
প্রথমে দু’চারটি কথা বললেও আহমদ মুসা নির্বাকভাবে সিনেমাটি দেখা শেষ করল।
সিনেমাটি তাঁকে দারুণভাবে বিস্মিত করল। তাঁর মনে হলো, তাঁদের আইআরটির প্রতিরক্ষা অস্ত্র ‘সোর্ড’ ও ‘থ্রি জিরো’র ফোটন পারটিকেলসের বিধ্বংসী অস্ত্রের কথা পরোক্ষভাবে সিনেমায় বলা হয়েছে। সিনেমাটি আমেরিকায় তৈরি। নাম দেখা গেল, নির্মাতা সংস্থাটি একটি লিমিটেড ফার্ম। তারা এ ধরনের একটা সিনেমা কিভাবে তৈরি করতে পারল? ব্যাপারটা কাকতালীয়? একটা সাইন্স ফিকশন লেখকের চিন্তা ও একটি বাস্তবতা কি কাকতলীয়ভাবেই মিলে গেছে? কাহিনীর আইডিয়া এসেছে ড. আরিয়েল আরিয়েহর কাছ থেকে। এই বিজ্ঞানী ড. আরিয়েল আরিয়েহ কে? হঠাৎ মনে পড়ল ‘থ্রি জিরো’ র বিজ্ঞানী ড. আবু আবদুর রহমানের নামের শেষেও আরিয়েহ আছে। তাহলে ড. আরিয়েল আরিয়েহও কি ইহুদি বিজ্ঞানী? তাই হবে। আরিয়েল আরিয়েহ পুরোটাই হিব্রু নাম যার অর্থ ঈশ্বরের সিংহ আরিয়েহ। আর ‘আরিয়েহ’ হলো ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত-এর একজন সেনাধ্যক্ষ। সিনেমার আরেকটি জিনিস আহমদ মুসার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। সেটা হলো, ড. লেভী নিরব ধ্বংসের যে অস্ত্র তৈরি করেছে, সেটা ফোটন পারটিকেলস-এর এইটথ গ্রেড থেকে তৈরি। ‘থ্রি জিরো’ র বিজ্ঞানী ড. আরিয়েহ নিরব ধ্বংসের অস্ত্র তৈরি করেছে, সেটা তাহলে কত গ্রেড থেকে তৈরি? ফোটন পারটিকেলস-এর অষ্টম গ্রেড? কিন্তু আলোর পারটিকেলস-এর তো কোন অষ্টম গ্রেড নেই? নাম হর্ন অব গড, ড. লেভীর মারণাস্ত্রগুলো খুব মজার মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। ‘হর্ন অব গড’ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র শিং-ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হল।
আহমদ মুসা চিন্তায় একেবারে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। কখন কথা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সম্বিত ফিরে আসেনি আহমদ মুসার। জেনারেল মোস্তফা হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। এক সময় বলে উঠল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনাকে নিয়ে এসে বৃথা যায় নি। সিনেমাটি আপনাকে দারুণভাবে ভাবাতে পেরেছে দেখছি।’
ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো আহমদ মুসা। তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, ফিল্মটি তো আপনি আগে অবশ্যই দেখেছেন। আমরা সামরিক হাসপাতালে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটার পর এ ফিল্মটি আবার দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে?’
গম্ভীর হল জেনারেল মোস্তফা।
‘কিছু যে মনে হবে, এজন্যেই ফিল্মটি দেখার জন্যে আপনাকে নিয়ে এসেছি। সত্যিই আমি ভেবে অবাক হয়েছি, ফিল্মটি যেন আমাদের আইআরটির সোর্ড ও থ্রি জিরোর ফোটন মারনাস্ত্রেরই কাহিনী! পার্থক্য শুধু এটুকু যে, ফিল্মের বিজ্ঞানী ক্রিস্টি ক্রায়েস্টের ‘ডিএ্যাকটিভেটিং অ্যান্ড ডিফিউজিং’ অস্ত্র গিয়ে সব অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আর সোর্ড মাত্র এটাকিং অস্ত্রকে আটকে ফেলে দূর আকাশে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ধ্বংস করে দেয়।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘বিষয়টাকে আপনি কি কাকতালীয় বলবেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘বলতে কষ্ট হবে, কিন্তু আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে বলুন তো?’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘থ্রি জিরো ইহুদিবাদীদের সংস্থা, আর ফিল্মটিও নিশ্চয় কোন ইহুদিবাদীর পরিকল্পিত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাদের মধ্যে কোন যোগসূত্র থাকার কথা বলছেন?’
‘অনুমান করে বলার মধ্যে কোন লাভ নেই। এটা অনুসন্ধানের বিষয়, বিশেষ করে বিজ্ঞানী ড. আরিয়েল আরিয়েহ কে, তা জানতে পারলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোন বেজে উঠল জেনারেল মোস্তফার।
মোবাইল তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে পুলিশপ্রধান নাজিম এরকেন বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আমি এখন রোমেলী দুর্গে। এখানে বিস্ময়কর ভূতুড়ে একটা ঘটনা ঘটেছে। রোমেলী দুর্গের উত্তর পাশে নৌবাহিনীর জরুরী অস্ত্র ডিপোর সব অস্ত্র হাওয়া হয়ে গেছে। ধাতব ডাস্টের একটি স্তর ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই, এমনকি সেই ডিপোর জানালার গরাদসহ কোন প্রকার মেটাল অবশিষ্ট নেই। আর…।’
‘বলুন রোমেলী দুর্গের কি অবস্থা?’ পুলিশপ্রধান নাজিম এরকেনকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল জেনারেল মোস্তফা। তাঁর চোখে-মুখে উদ্বেগ ও ভীতি নেমে এসেছে।
‘রোমেলী দুর্গের সব ঠিক আছে।’ বলল পুলিশপ্রধান নাজিম এরকেন।
‘একটু ধরুন মি. নাজিম এরকেন।’
বলেই জেনারেল মোস্তফা উৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, বোধ হয় ভয়ানক এক দুঃসংবাদ। আমাদের রোমেলী দুর্গের উত্তর পাশের নৌবাহিনীর অস্ত্র ডিপোর সব অস্ত্র ও ডিপোর সব ধরনের জিনিস ডাস্ট হয়ে গেছে, কিন্তু রোমেলী দুর্গের সব ঠিক আছে।’
বিদ্যুস্পৃষ্ট হওয়ার মতো চমকে উঠল আহমদ মুসা। নেমে এলো তাঁর চোখে- মুখে উদ্বেগ। মুহূর্ত ভাবল আহমদ মুসা। মুহূর্তের জন্যে তাঁর চোখ দু’টিও বুজে গিয়েছিল। চোখ খুলেই আহমদ মুসা বলল, ‘ওকে বলুন, বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। তথ্যটা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। আর চলুন, ওখানে যেতে হবে আমাদের।’
জেনারেল মোস্তফা বিষয়টি পুলিশপ্রধানকে জানালে পুলিশপ্রধান বলল, ‘সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর্মস ডিপোর স্টাফদের পর্যন্ত ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয় নি। সেনাবাহিনীর কয়েকজন টপ অফিসার ও পুলিশের মধ্যে আমিই শুধু বিষয়টা জেনেছি।’
‘মিঃ নাজিম এরকেন, আমি খালেদ খাকানকে নিয়ে আসছি।’
বলে সালাম দিয়ে মোবাইল অফ করে দিল জেনারেল মোস্তফা।
মোবাইলটা পকেটে রেখে জেনারেল মোস্তফা আহমদ মুসাকে বলল, ‘কিছু আন্দাজ করেছেন, মিঃ খালেদ খাকান?’
‘চলুন, গিয়ে দেখা যাক। তবে আমি ভাবছি, ‘থ্রি জিরো’ কি রোমেলী দুর্গে আইআরটি’র ওপর আক্রমন করল, না ডিপোটির ওপর টেস্ট আক্রমন? সিদ্ধান্তের আরও কিছু বিষয় জানা দরকার।’ বলল খালেদ খাকান।
‘চলুন, তাহলে বেরুনো যাক।’ বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।

Top