৪৭. বসফরাসে বিস্ফোরণ

চ্যাপ্টার

নানা চিন্তা কিলবিল করছে আহমদ মুসার মাথায়। আইআরটির ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি’র ওপর ওদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু ওদের আক্রমণের শক্তি যে কত ভয়ানক তা প্রমাণিত হয়েছে নৌবাহিনীর অস্ত্র ‘ডিপো’র ওপর ওদের আক্রমণের প্রকৃতি দেখে। এ এক ধরনের ভৌতিক ধ্বংসলীলা। আক্রমণকে কেউ দেখবে না, বুঝবে না, কিন্তু চোখের পলকে আস্ত্রাগার, কলকারখানা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আমাদের ‘সোর্ড’-এর প্রটেকশন আমব্রেলা ছাড়া এই নিরব ধ্বংসলীলা রোধ করার আর কোন উপায় নেই। কিন্তু ‘সোর্ড’-এর এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা দেয়া যাবে, কত কত জায়গায় দেয়া যাবে? ধ্বংসের এই দৈত্য আগে বাড়তে দিলে গোটা দুনিয়ার কি হবে! সকলের নিরাপত্তার একমাত্র উপায় ড. আরিয়েহ এবং তার অস্ত্র ও গবেষণাকে ধ্বংস করা। এই কাজ দ্রুতই হতে হবে। কিন্তু আরিয়েহকে পাওয়া যাবে কোথায়? সে কি ইস্তাম্বুলেই আছে, না বাইরে কোথাও পালিয়েছে? বিশাল তার লটবহরকে এত তাড়াতাড়ি বাইরে নেয়া সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত যে, তারা ইস্তাম্বুলেই আছে। তাছাড়া ‘সোর্ড’-এর ব্যাপারটার কোন হেস্তনেস্ত না করে তারা দূরে সরবে না। ‘সোর্ড’কেই এখন তাদের একমাত্র ভয়। রোমেলী দুর্গে ‘আইআরটি’র ওপর আক্রমণ করে তারা বুঝেছে ‘সোর্ড’-এর কাছে তাদের অস্ত্র অচল। সুতরাং ‘সোর্ড’ এখন তাদের পথের একমাত্র বাধা, একমাত্র শত্রু। এ শত্রুকে রেখে তারা কোথাও যাবে না। আমরা যেমন এখন ড. আরিয়েহ-ডেভিডদের অস্ত্র ধ্বংস করাকেই প্রধান কাজ ভাবছি, তেমনি ওরাও ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা হাত করা এবং আমাদের আইআরটি ধ্বংস করে ‘সোর্ড’কে শেষ করে দেয়াকেই নিশ্চয় সবচেয়ে বড় বিষয় ভাবছে। সামনে একটা ভয়ংকর লড়াই। লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ তাদের মতো আমরাও গ্রহণ করেছি। কিন্তু সমস্যা হলো, ওরা আমাদের সব জানে, কিন্তু ওদের আমরা কয়েকটা নাম ছাড়া কিছুই জানি না। ওদের ঘাঁটির সন্ধান করতে না পারলে আমরা ওদের ওপর আঘাত করতে পারছি না। ড. আরিয়েহর নাম পেলাম। এখন সবচেয়ে বড় দরকার ওদের ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া।
আহমদ মুসার হাত দু’টি গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে ঠিকভাবে থাকলেও এবং তার দুই চোখের দৃষ্টি ঠিকভাবে কাজ করলেও এই সব চিন্তায় কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু জেনারেল মোস্তফার অফিস ক্রস করে যেতেই সে সম্বিত ফিরে পেল সম্ভবত গেটের সেন্ট্রির লম্বা স্যালুট দেখেই।
গাড়ি পেছনে নিয়ে গেট দিয়ে জেনারেল মোস্তফার অফিসে প্রবেশ করল।
গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল জেনারেল মোস্তফা। আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতেই বলল, ‘কি ব্যাপার মি. খালেদ খাকান, আপনিও এমন আপনভোলা হয়ে পড়েন? বেমালুম অফিস পার হয়ে যাবার মতো এতটা?’
হাসল আহমদ মুসা। ডান হাতের ব্যাগটা বাম হাতে নিয়ে জেনারেল মোস্তফার সাথে হান্ডশেক করে বলল, ‘মাথায় এখন একটাই চিন্তা ড. ডেভিডদের নতুন ঠিকানা কোথায়?’
গম্ভীর হলো জেনারেল মোস্তফার মুখ। বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই তো এখনকার সবচেয়ে বড় চিন্তা। কিন্তু কিছু সুরাহা হলো মি. খালেদ?’
দু’জনেই গাড়ি বারান্দা থেকে বারান্দার ধাপ ভেঙে অফিসের দিকে উঠছিল। আলো কোন দিকেই দেখা যাচ্ছে না। এলাম একটা বিষয় আলোচনার জন্যে।’
অফিসে ঢুকে আহমদ মুসাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসল। বলল, ‘বলুন মি. খালেদ খাকান। আমরা কি করব?’
আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল কথা বলার জন্যে। তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল-স্ক্রীনে নামটা দেখেই আহমদ মুসা মোবাইল মুখের কাছে তুলে নিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, জোসেফাইন, সব ঠিক-ঠাক তো! ভালো আছ তো!’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমরা ভালো আছি। একটা জরুরি ব্যাপারে টেলিফোন করেছি। জেনি জিফা এইমাত্র টেলিফোন করেছিল। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে সে জানিয়েছে।’ ওপার থেকে বলল জোসেফাইন।
‘কি ঘটতে যাচ্ছে? কেন তিনি বললেন? কি জানতে পেরেছেন তিনি? এ সম্পর্কে তিনি কিছু বলেছেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘একজন শিক্ষিকা তার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স করেন। তার কথাবার্তায় তিনি বিষয়টা আঁচ করেছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি একটা অনুষ্ঠান হবে! প্রেসিডেন্টকে সেখানে নেয়া হবে। সেই সূত্রে শিক্ষক প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্ট ভবনে কয়েকবার গেছেন। কোর্স করতে আসা শিক্ষিকা শিক্ষক প্রতিনিধি দলের সাথে যেসব কথা বলেছেন এবং যে চিঠিটা তিনি দিয়েছেন তা থেকেই তার সন্দেহ হয়েছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘তেমন দু’একটা কথা কি তিনি জানিয়েছেন, চিঠিটা কি ছিল?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, চিঠিটা জেফি জিনাকেই দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বেন গালিব গিদন নামের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দেয়ার জন্যে। তাকে বলা হয়েছিল, কার পার্কিং-এ তাদের স্বাগত জানাতে আসা প্রোটোকল অফিসারের পাশেই লোকটি থাকবে। তার শার্টের নেম-ব্যান্ড–এ ‘বেন গালিব’ লেখা থাকবে। হ্যান্ডশেক করার সময় তাকেই চিঠিটা দিয়ে দিতে হবে। জেফি জিনা বলল, সে জানত যে, প্রেসিডেন্ট হাউজের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একজন ‘থ্রি জিরো’র বলে একটা সন্দেহ রয়েছে। বেন গালিব গিদন নামের ‘গিদন’ শব্দ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। এ নামটি হিব্রু। তাওরাতের একজন বীর যোদ্ধার নাম এটা। এই সন্দেহ থেকেই চিঠিটা সে পড়ে। চিঠির বক্তব্যকে তার রহস্যপূর্ণ মনে হয়। চিঠিতে লেখা ছিল:
‘বেন গালিব গিদন,
তোমার ডেভিরা, পিতা, দু’চার দিনের মধ্যে চলে যাচ্ছেন তুমি জান। যাওয়ার আগে একটা বুঝাপড়া হওয়া দরকার। ঘুম হলে সে ভালো থাকে। ডেব্রা, তোমার বোন, আসছে। ইলিরাজ ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
তোমার অ্যান্টি-
এসএম সিমশন।’
কথা শেষ করল জোসেফাইন।
‘চিঠিটা কি উনি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বেন গালিবকে দিয়েছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘দিয়েছে। না দিলে তো তিনি সন্দেহ করেছে, এটা ধরা পড়ে যেত। চিঠিটি কপি করে নিয়েছিল সে।’
‘চিঠি থেকে কি সন্দেহ করেছিলেন তিনি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তিনি বলেছেন, ‘ডেভিরা’ বলতে প্রেসিডেন্টকে বুঝানো হয়েছে। ‘পিতা’ শব্দ ‘ডেভিরা’র পরে বসায় ওর কোন অর্থ নেই। প্রেসিডেন্টকে নিয়েই কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। ‘ডেভিরা’ শব্দের মতো ‘ডেব্রা’ শব্দেরও ভিন্ন অর্থ আছে।’ জোসেফাইন বলল।
মুহূর্তের জন্যে ভাবল আহমদ মুসা। মনের পাতায় গেঁথে যাওয়া চিঠির কথাগুলোর ওপর একবার নজর বুলাল সে। বলল, ‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। আমার মনে হয় ‘ইলিরাজ’ শব্দেরও বিশেষ অর্থ আছে। তোমার বান্ধবী ‘জেফি জিনা’কেও ধন্যবাদ। তাঁর বলা আর কোন কথা আছে জোসেফাইন?’
‘আমার বুঝি কোন কথা নেই? জেফির কথাই শুধু শুনতে চাচ্ছ যে!’
হাসি চাপতে চাপতে কথাটা বলল জোসেফাইন, বুঝল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আমি জোসেফাইনের কথা শুনেছি, জেফির নয়।’
‘কিন্তু আমি তো জেফি’র কথা বলছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘কিন্তু মধুর কণ্ঠটা জোসেফাইনের, ভাষাও জোসেফাইনের, বিষয়ের কথা বাদ দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাক, প্রশংসার দরকার নেই। তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। কিন্তু তুমি এখন কোথায়?’ বলল জোসেফাইন।
‘জেনারেল মোস্তফার অফিসে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কয়টা বাজে এখন?’ জোসেফাইনের জিজ্ঞাসা।
ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আজকে কিন্তু ঠিকই লাঞ্চে আসব। শর্ত হলো তোমার দেয়া ইনফরমেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এ সম্পর্কিত জরুরি কিছুতে জড়িয়ে না পড়লে ঠিকই আমাকে লাঞ্চের টেবিলে পাবে।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
ওপার থেকে উত্তর আসতে একটু দেরি হলো। মূহূর্ত পরেই শোনা গেল জোসেফাইনের কণ্ঠস্বর। বলল, ‘লাঞ্চের কথা বলো না, আসতে পারবে না। অনুরোধ, লাঞ্চটা ঠিক সময়ে খেয়ে নিও। আর ডিনার থেকে কিন্তু ছুটি নেই, মনে রেখ।’
‘নিয়ন্ত্রণের রশিটা তো এমন করে টানা দেখে? নতুন মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
‘কেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বার্থ বুদ্ধ্বি বাড়বে না?’ বলল জোসেফাইন। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
‘তোমার স্বার্থ চিন্তা কত আছে আমি তা জানি। বল তো ব্যাপার কি?’
‘বলব না, তুমি ডিনারে এসো।’ জোসেফাইন বলল ওপার থেকে।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘জোসেফাইন, এতটা সময় আমাকে অশান্তিতে রাখতে পারবে তুমি?’
জোসেফাইনের উত্তর এলো একটু দেরিতে। বলল, ‘তুমি এখন যুদ্ধ্বক্ষেত্রে। আবেগকে এতটা প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমি…।’
জোসেফাইনের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলল, ‘একে আবেগ বলো না জোসেফাইন। এ আত্মা ও অস্তিত্বের আকুতি।’
‘স্যরি! আমার এ কথার অর্থ- প্রতি পদক্ষেপে তোমাকে স্বাভাবিক, সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে। তুমি এমন একটা পথে, যেখানে জীবন ও মৃত্যু এক সাথে…।’
আবেগে রুদ্ব হয়ে গেল জোসেফাইনের গলা। কথা আটকে গেল তার।
কিন্তু সংগে সংগেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে গলাটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, ‘আজকের দিনটা কোন্‌ দিন বলত?’
‘আজ…?’ হঠাৎ সচেতন হয়ে স্মৃতির সন্ধানে লাগল আহমদ মুসা। কিছুটা বিব্রত হয়ে উঠল সে।
জোসেফাইনই আহমদ মুসাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো। বলল, ‘কয়েক বছর আগের এক সুন্দর অপরাহ্ন, প্যারিসের এক মসজিদ…।’
‘স্যরি, আর বলো না জোসেফাইন। এদিন তো ভোলার নয়। ভুলিনি তো এর আগে। আজ ভুললাম কি করে এই প্রিয় দিনটাকে! তোমার টেবিলে মেহেদীর রংটা দেখেও আমার মনে পড়া উচিত ছিল। ধন্যবাদ তোমাকে। আমি আসছি।’
‘আবার তুমি আবেগকে বড় করছ। না, তুমি আসবে না এখন। তোমার সামনে যে কাজ তা আমাদের ব্যাক্তিগত স্বার্থের চেয়ে অনেক বড়। সকালে তোমাকে বলিনি তার কারণও এটাই। আমি ডিনারে তোমার অপেক্ষা করবো।’ বলল জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। সত্যিই সাংঘাতিক গোলকধাঁধায় পড়েছি। সমাধানটা দেখা যাচ্ছে খুব কাছে, কিন্তু কোন পথ আমরা পাচ্ছি না। তাহলে এখনকার মত এটুকুই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসময়ে তোমার অনেকটা সময় নিয়েছি। দুঃখিত। খোদা হাফেজ! আসসালামু আলাইকুম।’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু আমি আনন্দিত হয়েছি। ওয়া আলাইকুম সালাম।’
আহমদ মুসা কল অফ করতেই উৎকণ্ঠিত জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘স্যরি মি. খালেদ খাকান, ম্যাডামকে কষ্ট দিবেন না। আমাদের অপরাধী করবেন না।’
একটু থামল। বলল আবার সংগে সংগেই, ‘মি. খালেদ খাকান, ম্যাডাম কি তথ্য দিলেন। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, চিঠি, সন্দেহ ইত্যাদি সব কথা শুনলাম। কিছুই বুঝলাম না।’ জেনারেল মোস্তফার চোখে-মুখে এবার স্পষ্ট উদ্বেগ।
‘গুরুতর কিছু তথ্য দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট হাউজের একজন কর্মকর্তার কাছে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিটা রহস্যপূর্ণ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চিঠিতে কি ছিল সেটা কি জানা গেছে?’ দ্রুত কন্ঠে বলল, জেনারেল মোস্তফা।
‘চিঠিটা ছোট। আমাকে বলেছে। লিখুন, আমি বলছি।’
‘ধন্যবাদ’ বলে জেনারেল মোস্তফা একটা নোট প্যাড টেনে নিল। আহমদ মুসা বললে লিখে ফেলল জেনারেল মোস্তফা।
লেখার পর বলল, ‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান, বেন গালিব গিদনকে আমিও চিনতে পারছি। সে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের প্রশাসন বিভাগের কর্মচারী ব্যবস্থাপনা শাখার একজন কর্মকর্তা।’
‘সে কি ইহুদি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
প্রশ্ন শুনে বিস্মিত চোখে তাকাল জেনারেল মোস্তফা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘না তো, সে ইহুদি নয় তো!’
‘কিন্তু তার নামের ‘গিদন’ শব্দটা হিব্রু, ইহুদিরাই শুধু ব্যবহার করে থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোন অর্থ আছে এ শব্দের?’
‘তাওরাতে উল্লিখিত একজন যোদ্ধার নাম এটা।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় বিমূঢ় চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল জেনারেল মোস্তফা। একটু পর বলল, ‘অথচ সে বলেছিল সিরিয়ার এক গ্রামের নাম গিদন। ওটা ছিল তার পূর্বপুরুষের বাসস্থান। পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবেই তারা নামের সাথে এই নাম ব্যবহার করে থাকে।’
মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলে উঠল, ‘দুনিয়াটা বড় অসরল। ধীরে ধীরে আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে মি. খালেদ খাকান যে, আমরা মুসলমানরা ছাড়া দুনিয়ার সবাইকেই দেখছি ধর্মকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহারের ক্ষেত্রে দারুন মৌলবাদী। ওসমানীয় খিলাফত আমলে আমাদের তুরস্কে মুসলমানদের চেয়ে খৃষ্টান প্রজাদেরকেই বেশি সু্যোগ-সুবিধা দেয়া হতো। আর আমাদের আজকের নব্য তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে ইসলাম নির্বাসিতই হয়েছিল। কিন্তু আমরা ধর্ম ছাড়লেও ওরা কিন্তু দেখছি ওদের ধর্ম ছাড়েনি। যাক, আসুন, চিঠির দিকে মনোযোগ দিই।’
চিঠির ওপর নজর বুলাল জেনারেল মোস্তফা। বলল, ‘সত্যিই চিঠিটা রহস্যপূর্ণ। এই রহস্য থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, এই চিঠির পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে অবশ্যই। চিঠির কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হলে রহস্যটা বুঝা যাবে। বেন গালিব গিদনের ‘পিতা’ কে বা কি, ‘বুঝাপাড়া’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে, ‘ইলিরাজ’ কি ইত্যাদি। আপনি কিছু বুঝছেন, মি. খালেদ খাকান?’
‘আমিও চিন্তা করছি। যার কাছে তথ্য এসেছে তিনি কিছু ক্লু দিয়েছেন। বলেছেন; ‘পিতা’ শব্দের কোন অর্থ নেই। তেমনি আমার বোন শব্দেরও কোন অর্থ নেই। কারণ ‘বোন’ শব্দ ‘পিতা’র মতো ‘ডেব্রা’ শব্দের পরে বসেছে। ‘পিতা’ ও ‘বোন’ যদি অনর্থক শব্দ হয়, তাহলে ‘ডেভিরা’, ‘ ডেব্রা’ শব্দের নিশ্চয় কোন অর্থ আছে। ‘গিদন’ ও ‘ইলিরাজ’ শব্দ হিব্রু। ‘ডেভিরা’ ও ‘ডেব্রা’ নিশ্চয় হিব্রু শব্দ। এ দুটি শব্দের অর্থ জানা দরকার। হিব্রু ডিকশনারী নিশ্চয় আপনার অফিসে আছে।’
সংগে সংগে জেনারেল মোস্তফা উঠে গিয়ে হিব্রু ডিকশনারি নিয়ে এলো।
বসে ডিকশনারি থেকে শব্দ দু’টি খুঁজে বের করল। বলল, ‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান, ‘ডেভিরা’ শব্দের অর্থ আশ্রম, আশ্রয় এবং ‘ডেব্রা’ শব্দের অর্থ মৌমাছির ঝাঁক। আর ‘গিদন’ শব্দের অর্থ আপনি তো বলেছেনই। ‘ইলিরাজ’ শব্দ আপনার জানা। ওটার অর্থ কি?’
‘ইলিরাজ’ অর্থ ‘গোপন’।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিদঘুটে’ সব অর্থ! চিঠিটার অর্থ তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে মি. খালেদ খাকান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। বলল, ‘তোমার আশ্রয় দু’চার দিনের মধ্যে চলে যাচ্ছে তুমি জান। যাওয়ার আগে একটা বুঝাপাড়া হওয়া দরকার। ঘুম হলে সে ভালো থাকে। মৌমাছির ঝাঁক আসছে। গোপন ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।’ তিনটি হিব্রু শব্দের অর্থ পাওয়ার পর এই দাঁড়াচ্ছে চিঠির বক্তব্য। যিনি এই তথ্যটা দিয়েছেন, তার বক্তব্য হলো চিঠির ‘ডেভিরা’ বা ‘আশ্রয়’ শব্দের অর্থ ‘প্রেসিডেন্ট’। এদিক থেকে ‘বুঝাপড়া’ ও ‘ঘুম’ বিষয়টি প্রেসিডেন্টের সাথে সম্পর্কিত। এখন প্রশ্ন হলো: ‘বুঝাপড়া’, ‘ঘুম’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে? আর পরবর্তী দুই বাক্যের ‘মৌমাছির ঝাঁক’ ও ‘গোপন ব্যাপার’ বিষয় দুটিও রহস্যপূর্ণ।’
‘প্রেসিডেন্টের সাথে বেন গালিব গিদনের কি বুঝাপড়া হতে পারে! নিশ্চয় এটা কোন ষড়যন্ত্র। আর শেষের ‘গোপন ব্যাপার’টাও সেই ষড়যন্ত্র। কিন্তু ‘ঘুম’ আর ‘মৌমাছির ঝাঁক’ বলতে কি বুঝাচ্ছে?’
থামল জেনারেল মোস্তফা।
‘আসল বিষয় সম্ভবত এই শব্দ দু’টির অর্থের মধ্যে নিহিত রয়েছে।’
বলে থামল আহমদ মুসা।
সোফায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। অর্ধবোজা তার চোখ। গভীর ভাবনার ছাপ তার চোখে- মুখে।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘মি. জেনারেল, ‘বুঝাপড়া’ ব্যাপারটা যদি তার ক্ষতি করার কোন ষড়যন্ত্র হয়, তাহলে ‘ঘুম’ ও ‘মৌমাছির ঝাঁক’ সেই ক্ষতি করার অস্ত্র হতে পারে। যে ধরনের ‘ক্ষতি’ করা হবে, সেই ধরনের অস্ত্র হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কি ধরনের ক্ষতি করতে চায়? আমার মনে হচ্ছে, তাঁকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হবে। আর…।’
‘কিডন্যাপ? প্রেসিডেন্টকে!’ আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে বলল জেনারেল মোস্তফা। তার দু’চোখ ছানাবড়ার মতো বিস্ফোরিত!
একটু সামলে উঠেই জেনারেল মোস্তফা আবার দ্রুত কন্ঠে বলে উঠল, ‘এমন সাংঘাতিক চিন্তাটা আপনার কেন এলো?’
‘দেখুন, ইতিমধ্যে ওরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে দু’টি কিডন্যাপের আশ্রয় নিয়েছে। তৃতীয় প্রচেষ্টাও কিডন্যাপেরই হতে পারে। বড় কোন ভিভিআইপিকে কিডন্যাপ তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সহজ। আর প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তাদের সবচেয়ে মূল্যবান শিকার, লক্ষ্য অর্জনে যা হবে অব্যর্থ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথায় যুক্তি আছে।’ শুকনো কন্ঠে বলল জেনারেল মোস্তফা। তার চোখ- মুখ থেকে রক্ত যেন সরে গেছে। তাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।
কথাটা শেষ করে মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলল, ‘তাহলে, ‘ঘুম’ ও ‘মৌমাছির ঝাঁক’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে?’
‘তাদের অতীতের দু’টি কিডন্যাপেই তারা ক্লোরোফরম জাতীয় সংজ্ঞালোপকারী বস্তু ব্যবহার করেছে। প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটতে পারে। ‘ঘুম’ শব্দটি আমি মনে করি, এরই ইংগিত দিচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে কোনওভাবে সংজ্ঞাহীন করে তাকে কিডন্যাপ করা হবে? ‘মৌমাছির ঝাঁক’ কথাটার কি অর্থ দাঁড়াচ্ছে?’ বলল অস্থির কন্ঠে জেনারেল মোস্তফা।
‘চিঠির ‘ঘুম’ শব্দের ইংগিত এ রকমই বলছে। আমার মতে ‘মৌমাছির ঝাঁক’ হতে পারে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রশাসন বিভাগে কর্মরত সেই বেন গালিব গিদনকে তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সাহায্য দিতে আসবে তারা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে এটা একটা পরিপূর্ণ ষড়যন্ত্র! ওরা আঁট-ঘাট বেঁধে লেগেছে। আমাদের মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে গিদনের মতো, সেই প্রটোকল অফিসারের মতো তাদের আরও লোক অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। এত বড় ষড়যন্ত্র একার পক্ষে সম্ভব নয়।’
থামলো জেনারেল মোস্তফা। তার শুষ্ক কন্ঠ কাঁপছিল।
থেমেই আবার বলে উঠল, ‘এখনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের অফিসকে জানাতে হবে। মি খালেদ খাকান, এখনই আমাদের কিছু করা দরকার। কিন্তু কি করা দরকার? ষড়যন্ত্র কত দূর এগিয়েছে কে জানে! যদি কিছু…।’
কন্ঠ আপনাতেই থেমে গেল জেনারেল মোস্তফার।
‘চিঠির যা বক্তব্য তাতে প্রেসিডেন্ট আংকারা যাওয়ার আগেই তারা ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে যে কোন সময় ঘটনা ঘটতে পারে। তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু এ সপ্তাহেই তিনি আংকারা যাবেন। তার মানে আর চার দিন বাকি। খুব বেশি ভাবার সময় নেই। এখন বলুন, কি করব আমরা? আমাকে এখনি একবার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যেতে হবে।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘দুটি কাজ এখনি করুন। এক. মৌমাছির ঝাঁক মানে বাইরের লোক যাতে কোন পরিচয়েই কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করুন। দুই. প্রেসিডেন্ট প্রাসেদের চীফ অব স্টাফকে বলুন, তিনি যেন বেন গালিব গিদনকে চোখে চোখে রাখেন অথবা তাকে গ্রেফতারও করতে পারেন। আপনি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে যান, কিন্তু আমাকে এখনই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। প্রধানমন্ত্রীর ওখান থেকে আপনিও সেখানে আসুন।’ আহমদ মুসা বলল।
কোন কথা না বলে জেনারেল মোস্তফা অয়ারলেস তুলে নিল। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের চীফ অব স্টাফ ইসমত ইউসুফ ইনুনুর সাথে সংযোগ নিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘আমি জেনারেল মোমস্তফা কামাল। বেন গালিব গিদন কোথায়?’
সালাম নিয়ে ওপার থেকে ইসমত ইউসুফ ইনুনু বলল, ‘স্যার, আজ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ইন্টারনাল স্টাফদের বার্ষিক গেট টুগেদার। বেন গালিব গিদন ওখানেই গেছে। আমিও যাব। তাকে দরকার স্যার?’
‘না। শোন, তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখ। আর প্রেসিডেন্টের সার্বক্ষণিক পার্সোনাল সিকিউরিটি বাড়িয়ে দাও। আর উনি এখানে থাকা পর্যন্ত আগামী কয়েকদিন দর্শনার্থীসহ সব রকম প্রোগ্রাম বাতিল করে দাও। মি. খালেদ খাকান প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে যাচ্ছেন। তার প্রয়োজন অনূসারে তাকে সহযোগিতা করো। একটু পরে আমিও আসব।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘আপনার নির্দেশ পালিত হবে স্যার। আজ সকালে প্রেসিডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজিতে একটা প্রোগ্রাম করেছেন। কয়েকটা সাক্ষাৎকার ছাড়া সামনের কয়েকদিন বড় কোন প্রোগ্রাম নেই।’ বলল ইসমত ইউসুফ ইনুনু।
‘মাননীয় প্রেসিডেন্টের আজকের প্রোগ্রামটা ভালো হয়েছে। তিনি এখন কোথায়?’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘উনি রেস্টে আছেন। একবার হয়তো অনুষ্ঠানেও আসবেন।’ বলল ইসমত ইউসুফ ইনুনু।
‘ঠিক আছে সাবধান থেক। মি. খালেদ খাকান যাচ্ছেন?’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘স্যার, কিছু কি ঘটেছে? কোন কিছুর আশংকা আছে?’ বলল ইসমত ইউসুফ ইনুনু।
‘যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটতে পারে। আবার নাও ঘটতে পারে। কিন্তু ঘটবে এটা সামনে নিয়েই এ্যালার্ট থাকি আমরা।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘অবশ্যই স্যার।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে সালাম দিয়ে কল অফ করে দিয়েই জেনারেল মোস্তফা আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে মি. খালেদ খাকান, আমি উঠছি।’
‘আমিও উঠব। কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের একটা লে-আউট আমি চাই, জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই এটা আপনার দেখা উচিত।’
বলেই জেনারেল মোস্তফা কম্পিউটার থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের একটা লে-আউটের প্রিন্ট বের করে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘খেলাফত আমলের দোলমাবাসি প্যালেসই এখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। প্রেসিডেন্ট যখন ইস্তাম্বুলে থাকেন, তখন এই প্রাসাদেই তিনি উঠেন। আগের লে-আউটের বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হয়নি। আপনি দেখুন, কোন কিছু প্রশ্ন থাকলে ইসমত ইউসুফ ইনুনু উত্তর দিতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফাও।
দু’জনে এক সাথেই বেরিয়ে এলো।
গাড়ি বারান্দায় নেমে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে নিজের গাড়ীর দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, সত্যিই আমি উদ্বিগ্ন বোধ করছি। ওদের হাত প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ভেতরেও প্রবেশ করেছে।’
‘আল্লাহ হাফেজ, জেনারেল মোস্তফা।’
বলে আহমদ মুসা নিজের গাড়ির দিকে এগোলো।

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের গেটে আহমদ মুসার গাড়ি ব্রেক করতেই একজন লোক, গোয়েন্দা অফিসারই হবে, ছুটে এলো আহমদ মুসার গাড়ীর জানালায়। আহমদ মুসা নিজের আইডি কার্ড তাকে দেখাতেই সে স্যালুট দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে ইংগিতে গেট খুলে দিতে বলল।
আহমদ মুসার গাড়ি কার পার্কে দাঁড়াতেই একজন প্রোটোকল অফিসার ছুটে এলো। আহমদ মুসার গাড়ির দরজা খুলে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘ইনুনু স্যার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আমি প্রোটোকল অফিসার আহমদ তুঘরিল।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
হাঁটতে লাগল প্রোটোকল অফিসার আহমদ তুঘরিলের সাথে।
কার পার্কের পরে প্রেসিডেন্ট ভবনের মূল ফটক। ফটকে বডি স্ক্যানিং এর ব্যবস্থা আছে। স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়েই সকলকে যেতে হয়।
কিন্তু প্রোটোকল অফিসার আহমদ মুসাকে পাশের গ্রীল গেট দিয়ে নিয়ে গেল যে গেট শুধু প্রেসিডেন্টই ব্যবহার করেন।
প্রাসাদে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা প্রাসাদের আশেপাশে যাদেরই দেখল, তাদের মধ্যে একটা ত্রস্ত ভাব।
‘আপনাদের যে বার্ষিক গেট টুগেদার হচ্ছিল, সেটা কি চলছে? মি. ইসমত ইউসুফ ইনুনু কি ঐখানেই ব্যস্ত?’ প্রোটোকল অফিসারকে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, মহামান্য প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি গেট টুগেদার অনুষ্ঠনে আসছিলেন। আসার পথে হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যেতে দেখে তার পিএস ও চারজন সিকিউরিটি অফিসারও সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ইনুনু স্যার খবর পেয়ে ছুটে যান। তিনি বেন গালিব গিদনকে ডাক্তার ডাকার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে ধরাধরি করে প্রেসিডেন্টকে তার কক্ষে নিচ্ছিলেন। আমি তখন এসেছি আপনাকে রিসিভ…।’
প্রোটোকল অফিসারের কথা শুনে আহমদ মুসা একবারে বজ্রাহতের মতো হয়ে গেল। প্রবল উদ্বেগ-আতংকের ছায়া নেমেছে তার চোখে। রহস্যময় সেই চিঠির ‘ঘুম’-এর কথা তার মনে পড়েছে। মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে।
পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রায় চিৎকার করার মতো কন্ঠে বলল, ‘আমাকে প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে চল। সেখানে মি. ইনুনুও নিশ্চয় আছেন। চলো, দৌড় দাও।’
প্রোটোকল অফিসার একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে দৌড় দিল। আহমদ মুসাও তার পিছনে দৌড়াচ্ছে।
দৌড়াবার পথেই আহমদ মুসা এক জায়গায় দেখতে পেল পাঁচ ব্যক্তি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। চারজন অস্ত্রধারী, একজন নিরস্ত্র।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়ালো। বলল প্রোটোকল অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘এঁরাই কি প্রেসিডেন্টের পিএস ও পাঁচ জন সিকিউরিটি?’
প্রোটোকল অফিসারও থমকে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার।’
আহমদ মুসা বসে পড়ে একজনের নাকের কাছে মুখ নিয়ে গন্ধ শুঁকার চেষ্টা করল।
গন্ধ শুঁকেই চমকে উঠল সে। যা সন্দেহ করেছিল। তাদের সংজ্ঞাহীন করে রাখা হয়েছে। যে গন্ধটা পেল তা এক ধরনের ক্লোরোফরম জাতীয় গ্যাস। এর বৈশিষ্ট্য হলো দূর থেকে ফায়ার করে গ্যাসটা বাতাসে ছড়িয়ে দিলে এক থেকে তিন মিনিটের মধ্যে কেউ এর সংস্পর্শে এলে সে ধীরে ধীরে তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা মানুষের কাছে অসুস্থ হয়ে পড়ার মতো দেখায়। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এটা বেন গালিব গিদনদেরই কাজ। তাহলে প্রেসিডেন্টের কি অবস্থা? ওরা ক্লোরোফরম বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে চুপ করে অবশ্যই বসে নেই। তাহলে কি করেছে ওরা?
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উদ্বেগে আচ্ছন্ন তার মুখ। প্রোটোকল অফিসারকে বলল, ‘চল। প্রেসিডেন্টকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে?’
আবার ছুটতে লাগল প্রোটোকল অফিসার আহমদ তুঘরীল।
তারা প্রবেশ করেছে প্রেসিডেন্টের রেসিডেন্সিয়াল উইং-এ।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে মুখ ঘুরিয়ে দেখল, পোশাক পরা কয়েকজন সিকিউরিটির লোক ছুটে আসছে।
আরও কিছুটা এগিয়ে সুন্দর সাজানো একটা লাউঞ্জ পার হয়ে কয়েকটা ঘরের একটা সুন্দর ব্লক দেখতে পেল।
ফ্লোরটা তিন তলায় হতে পারে।
প্রোটোকল অফিসার বলল, ‘ঘরগুলোর সবই প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শয়নকক্ষে তিনি থাকেন।’
ঘরের সামনে তিনজন লোককে দাঁড়ানো এবং চারটি দেহ পড়ে থাকতে দেখল।
আরও কাছে এগিয়ে তারা দেখে বুঝল চারটি দেহই সংজ্ঞাহীন।
প্রোটোকল অফিসার বলল, ‘স্যার, প্রেসিডেন্টকে যারা ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল, সেই চীফ অব স্টাফ ইসমত ইউসুফ ইনুনু ও আরও চারজন সিকিউরিটির লোকও সংজ্ঞাহীন পড়ে আছে।
আহমদ মুসারা পৌছে গেল সেখানে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েই দাঁড়ানো তিনজনের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘প্রেসিডেন্ট কোথায়? দ্রুত ও শক্ত কন্ঠ আহমদ মুসার।
পেছন থেকে দৌড়ে আসা সিকিউরিটির লোক এসে দাঁড়িয়েছে। তারাও শুনতে পেল আহমদ মুসার প্রশ্ন।
তিনজনের একজনের হাতে ডাক্তারী ব্যাগ। সেই বলল, ‘মি. গিদন আমাকে ডাকতে গিয়েছিল অসুস্থ প্রেসিডেন্টকে এসে দেখার জন্যে। আমরা এসে প্রেসিডেন্টকে পাইনি। এঁদের পাঁচজনকে সংজ্ঞাহীনভাবে পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল স্টাফ এসে বলল, মুখে গ্যাস মাস্ক লাগানো ডাক্তারের মতো এ্যাপ্রোন পরা চারজন লোক প্রেসিডেন্টকে তুলে নিয়ে গেছে।’
থামল ডাক্তার, সে ইংগিত করে প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল স্টাফকে দেখিয়ে দিয়েছিল।
‘কোথায় তুমি তাদেরকে দেখছ?’ আহমদ মুসার প্রশ্ন সেই পার্সোনাল স্টাফকে উদ্দেশ্য করে।
‘লিফটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।’ বলল লোকটি।
‘তুমি চেন তাদের?’
‘না।’
‘তুমি তাদের ফলো করনি, অন্তত গেট পর্যন্ত?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার, আমাকে ওরা বলল, আমরা প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আন। তিনি অবশিষ্টদের ব্যবস্থা করবেন। আমি সংগে সংগেই ডাক্তারের খোঁজে চলে যাই। ডাক্তারকে না পেয়ে দ্রুত এখানে ফিরে এসে দেখি ডাক্তার সাহেব এখানে।’
আহমদ মুসা পাশে এসে সিকিউরটির লোকদের একজনকে বলল, ‘আপনারা নিশ্চয় নিচের সিকিউরটি ক্যাম্প থেকে এসেছেন। সংজ্ঞাহীন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে নিশ্চয় কেউ নিচে নামেনি? আমরা নিচ থেকে আসলাম। আমরা এটা দেখিনি।’
‘গেটের দিকে যাবার পথেই আমাদের ক্যাম্প। কেউ নিচে যায়নি।’
‘আর কোন গেট নেই?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আছে, কিন্তু সেগুলো পার্মানেন্টলি বন্ধ। বন্ধ থাকলেও সে গেটগুলোতেও পাহারা আছে।’ বলল সিকুউরিটিদের একজন।
‘কিন্তু গেটগুলো তো কেউ খুলতেও পারে!’ বলল আহমদ মুসা।
আমাদের সিকিউরিটি অফিস থেকে গেটগুলোকে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হয়। আমরা এখানে আসার আগ পর্যন্ত গেটগুলো আমাদের পর্যবেক্ষণে ছিল। কিন্তু সেদিকে কেউ যায়নি।’
আহমদ মুসা এবার তাকাল ডাক্তার ও পার্সোনাল স্টাফ লোকটার মাঝখানে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। আহমদ মুসা নিশ্চিত এই লোকটাই বেন গালিব গিদন। তবু আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনিই কি বেন গালিব গিদন?’
লোকটি ভীত ও বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘জি স্যার।’
‘ওরা কোন্‌ দিকে যেতে পারে মি. গিদন?’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা স্যার। ডাক্তার আনতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি এই অবস্থা।’ বলল গিদন।
‘গেটগুলো ছাড়া বাড়ি থেকে বেরুনোর আর কোন পথ আছে?’
‘আমি জানি না স্যার। আমার মনে হয় সে রকম কোন ব্যবস্থা নেই।’ বলল গিদন মুখটা নিচু রেখেই।
‘তাহলে ওরা গেল কোন্‌ দিক দিয়ে?’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা এখানে আসার আগে গাড়ীতে বসে যতটা সম্ভব প্রাসাদের লে-আউটের ওপর নজর বুলিয়েছে। গ্রাউন্ড মানে ফার্স্ট ফেজ লে-আউটের দক্ষিন-পূর্ব কোণের দিকে এক জায়গায় নিম্নমুখী একটা এ্যারো আঁকা আছে। এ ধরনের এ্যারো লে-আউটের অন্য আর কোথাও নেই। আর প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষের যে ব্লক, তা প্রাসাদের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকাতেই। এখান থেকে বসফরাসের পানি ও তীর খুব বেশি দূরে নয়। লে-আউটের তীরটা এই দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় সুনির্দিষ্টভাবে কোন এলাকাকে মিন করছে তা বলা মুস্কিল।’
‘এটাই এখন সবচেয়ে বড় রহস্যের স্যার।’ বলল লোকটি।
‘আপনার কাছেও এটা রহস্য?’
লোকটি চোখ তুলে চাইল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময় ও ভয় দুইই! বলল, ‘শুধু রহস্য নয় স্যার, সাংঘাতিক একটা রহস্য।’
‘এ সময়টা মিথ্যা বলার সময় নয় মি. গিদন। কিছু জানলে সেটা বলুন।’ বলল আহমদ মুসা নরম কন্ঠে।
লোকটির চোখ দু’টি চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার আমি যা জানি তাই বলেছি।’
চারজন সিকিউরিটির লোকসহ সবার দৃষ্টি বেন গালিব গিদনের দিকে। সবার মনেই বিস্ময় কেন তাকে এভাবে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে! তাকে কি সন্দেহ করা হচ্ছে? কেন?
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবার বের করল। তাক করল তার দিকে। বলল, ‘আমি কিন্তু এক কথা দু’বার বলি না। বল, প্রেসিডেন্টকে কিডন্যাপ করে কোন্‌ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?’ শক্ত কন্ঠ আহমদ মুসার।
বেন গালিব গিদন ভয়ার্ত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসা তার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝল, এ থ্রি জিরোর কোন পাকা ক্যাডার নয়। ‘থ্রি জিরো’র অনেককেই সে মুখোমুখি দেখেছে। তাদের চোখে ভয় থাকে না, থাকে হিংসার আগুন, ক্রোধের বহ্নি শিখা। ওদের কথা বলানো যায় না, একে কথা বলানো যাবে।
আহমদ মুসা আবার কথা বলল।
‘আমি তিন গোণা পর্যন্ত সময় দিলাম।’
বলেই আহমদ মুসা গুণতে লাগল, এক দুই…।
বেন গালিব গিদন চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘আমি কিছুই জানিনা। আমাকে…।’
আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসল। একটি গুলি বেরিয়ে গিয়ে বেন গিদনের কব্জির নিচে হাতের তালুর ওপরের একটা অংশ খাবলা দিয়ে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সে চিৎকার করে কব্জি চেপে ধরল।
চমকে উঠল উপস্থিত সবাই। ভীত-বিব্রত সবাই। কিন্তু আহমদ মুসাকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। তারা মনে করছে সে এ ব্যাপারে নিশ্চয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ।
আহমদ মুসার রিভলবারের নল একটুও নড়েনি। বলল কঠোর কন্ঠে, ‘গুলিটা তোমার কব্জি টেস্ট করেছে। যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর না দিলে এবার মাথা গুঁড়ো করে দেব।’
আহমদ মুসার রিভলবারের নল উঠতে লাগল তার মাথা লক্ষ্যে।
‘আমি বলছি, আমি বলছি স্যার।’
চিৎকার করে বলল বেন গালিব গিদন।
কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। বলতে লাগল, ‘ওরা সুড়ঙ্গ পথে এসেছিল। প্রেসিডেন্টের পারসোনাল সিকিউরিটি অফিসার এক লাখ ডলারের বিনিময়ে সুড়ঙ্গের মুখ ভেতর থেকে খুলে দিয়েছিল। আমিই তাকে টাকাটা দিয়েছিলাম। ঐ সিকিউরিটি অফিসারই তাকে দেয়া গ্যাসটিউব স্প্রেয়ার থেকে ক্লোফরম স্প্রে করেছিল।’
‘সুড়ঙ্গের মুখ কোথায়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘প্রেসিডেন্টের বেড রুম ব্লকের ঠিক কেন্দ্রে বিশাল স্টিল লকারের মধ্যে।’ বলল বেন গালিব গিদন।
‘প্রেসিডেন্টের সে সিকিউরিটি অফিসারের নাম কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সোলেমান আফেন্দী।’
বলে সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা চারজন সিকিউরিটি অফিসারের একজনকে দেখিয়ে দিল সে।
মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল পকেট থেকে বের করে স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়ে মুখের কাছে তুলে নিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, সব শুনেছেন। আমি আসার পূর্বক্ষণে ঘটনা ঘটেছে। প্রেসিডেন্টকে সংজ্ঞাহীন করে কিডন্যাপ করা হয়েছে। তার সাথে আটজন সিকিউরিটি অফিসারও সংজ্ঞাহীন। সিকিউরিটি অফিসার সোলেমান আফেন্দী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই সুড়ঙ্গ পথ খুলে দিয়েছে।’
‘প্রেসিডেন্টকে সুড়ঙ্গ পথে নিয়ে গেছে? তাহলে তো গোটা বসফরাস ও তীরবর্তী সব রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। এখন আপনি কি করছেন? আমরা আর কি করব? প্রেসিডেন্ট কিডন্যাপ হয়েছেন এই সংবাদটাকে গোপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ ভীত, উদ্বেগ-ভরা কন্ঠে বলল জেনারেল মোস্তফা।
সুড়ঙ্গ দিয়ে কিডন্যাপের কথাটা বেন গালিব গিদনের কাছ থেকে বের করেছি। সোলেমান আফেন্দীর নামও সেই বলেছে। শুনুন…।’
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। তাকে যে আপনি এত তাড়াতাড়ি কথা বলাতে পেরেছেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘কথা বলাবার জন্যে তাকে গুলী করে আহত করতে হয়েছে। যাক। শুনুন, আমি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করছি। আপনারা সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিন। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে মিনিট সাতেক সময় গেছে। ওরা নিশ্চয় সুড়ঙ্গ থেকে বের হতে পারেনি।’
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান, সিকিউরিটি অফিসারদের কাউকে নিয়ে আপনি সুড়ঙ্গে নামুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘সুড়ঙ্গ দিয়ে এগোতে হবে ওদের অলক্ষ্যে। ওদের টের পেতে দেয়া যাবে না। ওরা নিশ্চয় সুড়ঙ্গ পথকে বিপজ্জনক করে গেছে। সুড়ঙ্গে ওদের সাথে লড়াই করা যাবে না। কারণ ওদের হাতে প্রেসিডেন্ট আছেন। ওখানে নিরব লড়াইয়ের প্রয়োজন হবে। সুতরাং লোক বেশি নিয়ে লাভ নেই। ওদের অস্ত্রে ওদের ঘায়েল করব, এটাই হবে আমাদের চেষ্টা।’
‘ধন্যবাদ, মি. খালেদ খাকান। আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আরেকটা বিষয়, সুড়ঙ্গ কি একমুখী, না এর শাখা-প্রশাখা আছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি সুড়ঙ্গে কোনদিন প্রবেশ করিনি। তবে জানি, সুড়ঙ্গটা একমুখী। কিন্তু ধাঁধা সৃষ্টির জন্যেই এর ব্লাইন্ড শাখা-প্রশাখা রয়েছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ধন্যবাদ, জেনারেল মোস্তফা। আর কিছু?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আর কি বলব! প্রধানমন্ত্রী শুনে কেঁদে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন উপরে আল্লাহ এবং তাঁর বান্দা খালেদ খাকানই আমাদের ভরসা। আল্লাহ আপনাকে সব সময় সাহায্য করেছেন। এই কঠিন বিপদেও তিনি আপনাকে, আমাদেরকে সাহায্য করুন। পুলিশপ্রধান ও অন্যরা দুই-এক মিনিটের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পৌছে যাবেন। আমি এদিকটা দেখব।’
‘আল্লাহ সহায়। আসসালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
তাকাল আহমদ মুসা সিকিউরিটি অফিসারদের দিকে। বলল, ‘তোমরা একজন এখনই এই বেন গালিব গিদন ও সোলেমান আফেন্দীকে গ্রেফতার কর। আর দু’জন যাও সুড়ঙ্গের মুখ ঠিক আছে কিনা দেখ। অন্যজন আমাকে ওখানে নিয়ে চল।’
সিকিউরিটি অফিসারদের চারজনেই পা ঠুকে আহমদ মুসাকে স্যালুট দিল।
আহমদ মুসা ব্যাগ খুলে একবার চেক করল তার গ্যাস মাস্ক, অত্যাধুনিক গ্যাস গান মাল্টি ডিটেক্টর, নাইট ভিউ গগলস, হিউম্যান বডি ওয়েভ, সেঞ্জিং মনিটর ইত্যাদি সব ঠিক আছে কিনা।

Top