৪৭. বসফরাসে বিস্ফোরণ

চ্যাপ্টার

‘থ্রি জিরো’র শয়তানি দেখছি আমাদের অতিষ্ট করে তুলল। এর অবসান না ঘটালে চলছে না।’ বলছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আহমদ আরদোগাল বাবাগলু।
বৈঠকটা প্রেসিডেন্টের মিনি ক্যাবিনেটের যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টা বিশেষভাবে দেখে থাকে।
আজকের মিনি ক্যাবিনেটে হাজির আছেন প্রধানমন্ত্রী, দেশরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং গোয়েন্দা বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধান।
প্রেসিডেন্ট যা বললেন, তার মধ্যে অস্থিরতার একটা প্রকাশ আছে। এর কারনও আছে। থ্রি জিরোর কবল থেকে প্রেসিডেন্টের উদ্ধার এবং থ্রি জিরোর ৭ জন লোক ধরা পড়ার পর তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিশোধের জন্যে ইতিমধ্যেই তারা ৩টি ট্রেন ও দু’টি বাসস্ট্যান্ডের প্রায় তিরিশটির মতো বাস হাওয়া করে দিয়েছে। ওদের এই ভয়ানক অদৃশ্য অস্ত্র মানুষের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করেছে। থ্রি জিরো হুমকি দিয়েছে, তাদের দাবি মেনে না নিলে তারা ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করবে। শিল্প-কারখানা, ট্রেন, বাস, লঞ্চ, স্টিমার, অস্ত্রগুদাম সব তারা ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে দেবে। তারা তাদের সর্বশেষ দাবিতে আজ বলেছে, আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাদের ৭জন লোককে ছেড়ে দেয়াসহ মি. খালেদ খাকান ও বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে তাদের হাতে তুলে না দিলে তারা আক্রমন শুরু করবে।
বিষয়টি নিয়ে সকালে ক্যাবিনেট আলোচনা হয়েছে। আহমদ মুসার সাথেও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। এখন আবার মিনি ক্যাবিনেট আলোচনায় বসেছে ক্যাবিনেটে আলোচিত বিষয় নিয়ে আরও আলোচনার জন্যে।
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করলে নড়েচড়ে বসলেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ওদের মোকাবিলায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে আছি। ওদের অনেক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ওদের। প্রায় ফাইনাল স্টেজে আমরা এসেছি পৌঁছেছি। আমরা ওদের উৎখাত করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
‘কিন্তু আমাদের হাতে সময় তো বেশি নেই। অবশ্যই মি. খালেদ খাকান কি ভাবছেন, কি করছেন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাথে আর কিছু আলোচনা হয়েছে জেনারেল মোস্তফার?’ জেনারেল মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘সকালের বৈঠকের পর তার সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। স্যার, তার কাজের একটা স্টাইল হলো, কোন ভাবনা, কোন পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হলে তিনি বলেন না। আর কোন কাজে হাত দিলে সেটা শেষ না করে ছাড়েন না। আমরা দেখেছি, যখন নিরব থাকেন তিনি, তখনই তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ঠিক বলেছেন, জেনারেল মোস্তফা। তবে পরশু দিন সকাল পর্যন্ত সময়। সেই হিসাবে সময় বেশি নেই। তার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আমাদের থাকতে হবে।’ বললেন প্রধানমন্ত্রী।
‘অবশ্যই স্যার। আমি এ মিটিং…।’
জেনারেল মোস্তফার কথার মাঝখানেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
জেনারেল মোস্তফা থেমে গিয়ে ‘মাফ করুন আপনারা’ বলে মোবাইল ধরল জেনারেল মোস্তফা।
ওপারের কথা শুনতেই মুখে অন্ধকার নামল জেনারেল মোস্তফার।
ওপারের কথা শুধু শুনলই। বলল না কিছু।
এক সময় কল অফ করে দিয়ে তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে।
জেনারেল মোস্তফার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে সবাই বুঝতে পারল কোন দুঃসংবাদ নিশ্চয়।
জেনারেল মোস্তফা মুখ থেকে টেলিফোন সরাতেই সবাই প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘কোন খারাপ সংবাদ জেনারেল মোস্তফা?’
‘থ্রি জিরো’র টেলিফোন। ওরা তাদের দাবির সাথে আরেকটা বিষয় যোগ করেছে। সেটা হলো, তাদের দেয়া দাবি মানার সময় পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু করা যাবে না। যদি এরকম আক্রমণাত্মক কিছু দেখতে পায়, তাহলে আলটিমেটাম বাতিল হয়ে যাবে এবং তারা এ্যাকশন শুরু করবে। দেশকে তারা লন্ড ভন্ড করে দেবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা কথা শেষ করলো, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। কারও কাছ থেকে কোন কথা এলো না। হঠাৎ করেই বিষাদের একটা কালো ছায়া সবার চোখে-মুখে নেমে এসেছে।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল মোস্তফাই। বলল, ‘আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে বিষয়টা মি. খালেদ খাকানকে জানানো দরকার।
‘ঠিক বলেছ, জেনারেল মোস্তফা। তুমিই টেলিফোন কর তাকে এখনি।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।
‘ইয়েস স্যার’ বলে জেনারেল মোস্তফা কল করল আহমদ মুসাকে।
বিষয়টা তাকে জানিয়ে তার মতামত জানতে চাইল।
আহমদ মুসার কথা সে শুনল।
শেষে সালাম দিয়ে কল অফ করে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল জেনারেল মোস্তফা। বলল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আহমদ মুসা বলেছেন, দেশকে লন্ডভন্ড করে দেবার সাধ্য তাদের নেই। সকল সামরিক, শিল্প ও গভর্নমেন্ট স্থাপনা সোর্ডের ডিফেন্স শিল্ডের আওতায় আনা হয়েছে। এরপর বাকি বেসরকারি ও অন্য ধরনের হাজারো টার্গেট। এসব টার্গেটকে আক্রমণের আওতায় আনা অকল্পনীয়, অবশ্যই তাদের অসাধ্য। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওদের শেষ দাবি মেনে নেয়ার জন্যে। মেনে নেয়ায় আমাদের কাজের কোনই ক্ষতি হবে না। আমরা যা করব, তা ওদের চোখের সামনে করব না, জানিয়েও করব না।
থামল জেনারেল মোস্তফা।
‘আলহামদুলিল্লাহ! আহমদ মুসা ঠিক কৌশল নিয়েছেন। আমরা তার কৌশল গ্রহন করলাম। আর আমাদের দেশকে লন্ডভন্ড করার থ্রি জিরোর দাবি প্রত্যাখান করে মি. খালেদ খাকান যা বলেছেন, সেটাও ঠিক। তবে ক্ষতি যেটুকুই করতে পারুক, সেটাও আমাদের ক্ষতি। সে ক্ষতিও আমাদের এড়াতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ! আহমদ মুসার ওপর আমাদের আস্থা আছে। তিনি পারবেন অগ্রসর হতে, যেভাবে চাইছেন। তাকে সর্বাত্মক সাহায্য তোমরা কর।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।
‘ইয়েস স্যার।’ বললেন প্রধানমন্ত্রী।
‘সবাইকে ধন্যবাদ’ বলে উঠে দাড়ালেন প্রেসিডেন্ট।

প্রচন্ড চাপ আহমদ মুসার মনের ওপর।
ওদের আলটিমেটামের ৪৮ ঘন্টার অনেকটা সময় কেটে গেছে। কিন্তু সামনে এক ইঞ্চি এগোনো যায়নি। এবার প্রয়োজন ওদের আসল ঘাঁটির সন্ধান, যেখানে চলছে তাদের গবেষণা, আছে ভয়ংকর অস্ত্রের কারখানা। ওদের পরিত্যক্ত পাম ট্রি গার্ডেনের ঘাঁটির কাগজপত্র ঘেঁটে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। ওদের অস্ত্রের নাম ও প্রকৃতি সম্পর্কে আরও কিছু। অদ্ভুত ওদের অস্ত্রটির নাম; ‘ফোটন সাইলেন্ট ডেস্ট্রাকশন ডেমন’ মানে ‘নিরব ধ্বংসের দৈত্য ফোটন।’ সংক্ষেপে ‘ডাবল ডি’। অস্ত্রের নামটা কিন্তু সার্থক। সত্যি ওটা নিরব ধ্বংসের দৈত্য। নিরবে, নিঃশব্দে ধ্বংস করে দেয় মেটালের তৈরি সব কিছু। অস্ত্রটি মানুষ হত্যা করে না, কিন্তু মানুষের, সমাজের, সভ্যতার, শক্তির সব অবলম্বনকে ধ্বংস করে দেয়। এ অস্ত্র ভালো হাতে থাকলে ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এ শয়তানদের হাতে থাকার অর্থ অন্য সবারই মহাসংকটে পড়া। অন্য সবাইকে গোলাম বানাবার অস্ত্র হতে পারে এটা। শয়তান তার অস্ত্র অক্ষত রাখবে, ধ্বংস করবে অন্য সকলের অস্ত্র। এমন ধ্বংসের দুনিয়ার মানুষের শত্রু, মানবতার শত্রু। তার হাতে নিরব ধ্বংসের দৈত্য নামের ফোটন অস্ত্র থাকা দুনিয়ার জন্যে, দুনিয়ার মানুষের জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়। তাদের এই অস্ত্র, এই গবেষণা সহ তাদের ধ্বংস করতে হবে। তাহলে আমাদের অস্ত্র সোর্ড হয়ে দাঁড়াবে মানবতাকে রক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্র। সব দেশ যদি ডিফেন্সের সোর্ড পেয়ে যায়, তাহলে আক্রমণকারী সব অস্ত্র অচল হয়ে পড়বে। ফলে এধরনের অস্ত্র তৈরিতে সব দেশই নিরুৎসাহিত হবে। ফলে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থে অস্ত্র তৈরি হবে না এবং সেই অর্থ সাশ্রয় হবে। মানুষের, মানবতার কল্যাণে লাগবে সেই অর্থ এবং এভাবেই আমাদের অস্ত্র, সেভিয়ার অব ওয়ার্ল্ড র‍্যাশনাল ডোমেইন (দুনিয়ার মানুষ্যত্ব- আদর্শের রক্ষক) নাম সার্থক হবে।
ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
‘সোর্ড’ এর কথা ভাবতে গিয়ে একটা আবেগ এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। পারল না। আহমদ মুসার চোখ ঠিকই আছে তার দিকে, কিন্তু তাতে কোন দৃষ্টি নেই।
জোসেফাইন সামনের সোফা থেকে উঠে এসে আহমদ মুসার পাশে বসল। ধীরে ধীরে হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে।
আহমদ মুসা একটু চমকে উঠে ফিরে তাকাল জোসেফাইনের দিকে।
আহমদ মুসার চোখে তখনও শূন্য দৃষ্টি।
জোসেফাইন আহমদ মুসার কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, ‘কি ভাবছ এমন করে?’
আহমদ মুসা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘ভাবছি ওদের আলটিমেটামের কথা। সময় যাচ্ছে, কিন্তু সামনে এগোবার পথ দেখা যাচ্ছে না। ওদের ঘাঁটি, হেড কোয়ার্টার ওরা কোথায় শিফ্‌ট করল, সেটাই আমরা লোকেট করতে পারছি না। সবচেয়ে বেদনার বিষয় হয়েছে, ওদের যে ৭ জন লোক ধরা পড়েছিল, পুলিশের অসতর্কতার কারণে তাদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। জ্ঞান ফেরার সংগে সংগেই ওরা পটাসিয়াম সাইনাড খেয়ে…।’
মোবাইল বেজে উঠল জোসেফাইনের।
জোসেফাইন আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘এক্সকিউজ মি, টেলিফোনটা ধরছি।’
বলে জোসেফাইন সোফার একপাশে কাত হয়ে কলটা অন করল।
ওপারে জেফি জিনার কণ্ঠ শুনেই জোসেফাইন বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি কেমন আছেন? ব্যাস্ত নন তো আপনি?’ বলল জেফি জিনা।
‘ব্যস্ত থাকব কেন, আমার তো কোন কাজ নেই। আহমদের আব্বার সাথে একটু কথা বলছিলাম খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন এখন তিনি।’ বলল জোসেফাইন।
‘কি নিয়ে ওঁর দুশ্চিন্তা?’ জিজ্ঞাসা জেফি জিনার।
‘ওরা ৪৮ ঘন্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। এই আলটিমেটামের মোকাবিলা করতে হলে ওদের হদিস প্রয়োজন। সে হদিস এদের কাছে নেই।’ বলল জোসেফাইন।
সংগে সংগে উত্তর দিল না জেফি জিনা।
মূহুর্ত কয়েক পরে তার কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স করছেন সেই শিক্ষক স্মার্থা দু’দিন আগে টেলিফোনে কারও সাথে কথা বলার সময় বলছিল, বসফরাসের পূর্বে উত্তর ইস্তাম্বুলের একটা বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স তাদের নতুন ঠিকানা। আমি জানিনা এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন কি না?’
‘ধন্যবাদ মিস জেফি, প্লিজ আপনি ওর সাথে একটু কথা বলুন। তার আরও কিছু জিজ্ঞাসাও থাকতে পারে।’ জোসেফাইন বলল।
‘প্লিজ, না। হঠাৎ কথা বলতে খারাপ লাগবে। পরিচয় নেই, উনিই বা কি ভাববেন? আমার যা জানা আপনাকে তো বললাম। প্লিজ।’
‘ঠিক আছে। সে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কি নাম বলছিল?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
‘নাম বলেনি, বলেছিল ঐটুকুই। গত দু’দিন থেকে সে হঠাৎ করেই উধাও। আচ্ছা থাক, আহমদ আব্দুল্লাহ কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
‘অনেক দিন ওর সাথে দেখা হয়নি, না?’ বলল জেফি জিনা।
‘আসুন না আমাদের বাসায়। এলেন না কোন দিন।’ জোসেফাইন বলল। তার কন্ঠে অনুযোগের সুর।
‘যাবো একদিন।’ বলল জেফি জিনা।
‘সে দিন কবে আসবে? আসার কথা বললেই কোন না কোন অসুবিধা দাঁড় করাবেনই?’ জোসেফাইন বলল।
‘হযরত আইয়ুব সুলতান রা.-এর ওখানে এর মধ্যে কবে আসবেন?’ জিজ্ঞাসা জেফি জিনার।
‘যাওয়ার আগে আপনাকে জানাব। আপনাকে না পেলে তো মজা হবে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ। আর কথা নয়। আপনি অবশ্যই ব্যস্ত। রাখি।’ জেফি জিনা বলল।
‘আবার ব্যস্ততার কথা!’ বলল জোসেফাইন।
‘স্যরি। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ধন্যবাদ। ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলে মোবাইলের কল অফ করে দিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা উদ্‌গ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘তোমার বান্ধবী কি বলছিল? কি এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কথা বললে?’
‘স্মার্থা মানে সেই শিক্ষিত মেয়েটা। সে নাকি দু’দিন আগে কারও সাথে টেলিফোনে কথা বলার সময় বসফরাসের পশ্চিমে উত্তর ইস্তাম্বুলে একটা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে তাদের নতুন ঠিকানার কথা বলেছে।’
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো তার। বলল আহমদ মুসা দ্রুত কন্ঠে, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের নাম বলেছে?’
‘নাম নয়, শুধু ঐ টুকুই বলেছিল।’ বলল জোসেফাইন।
‘বসফরাসের পশ্চিমে উত্তর ইস্তাম্বুলে একটা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ কথাটা কয়েকবার মনের মধ্যে আওড়াল আহমদ মুসা। শুনেছে এমন কথা সে এর আগে। কোথায়? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, প্রেসিডেন্ট কিছু দিন আগে তাকে বলেছিলেন, বিজ্ঞানি আবদুর রহমান আরিয়েহকে বসফরাসের পূর্ব পাড়ে পার্বত্য এলাকায় একটা ইন্ডাস্ট্রিয়েল কমপ্লেক্স স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন।
সংগে সংগেই লাফ দিয়ে উঠল আহমদ মুসা সোফা থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে যাবার আনন্দে। বলল, ‘বোধ হয় পেয়ে গেছি জোসেফাইন!’
বলেই আবার বসে পড়ল। বলল, ‘জোসেফাইন, আমার মোবাইলটা দাও তো!’
আহমদ মুসার আনন্দে জোসেফাইনেরও মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দ্রুত উঠে গিয়ে মোবাইল এনে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘কি পেয়ে গেছ? ওদের নতুন ঠিকানা?’
‘বলছি জোসেফাইন, প্রেসিডেন্টকে টেলিফোনটা করে নিই।’
বলে কল করল প্রেসিডেন্টকে।
ওপারে প্রেসিডেন্টের কন্ঠ পেয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্ট! স্যার, এভাবে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত। জরুরি…।’
‘মি. খালেদ খাকান, এধরনের কথার আশ্রয় নেবেন আপনি, এটা আমার জন্যে খুবই দুঃখের। আমার ২৪ ঘণ্টা সময় আপনার জন্যে ওপেন। প্লিজ বলুন।’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন প্রেসিডেন্ট।
‘ধন্যবাদ, স্যার। একটা জরুরি বিষয়ের জন্যে আপনাকে টেলিফোন করেছি। একদিন আপনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানি আবদুর রহমান আরিয়েহকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের জন্যে একটা বিশাল এলাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন বসফরাসের পূর্ব পাড়ে উত্তর ইস্তাম্বুলে। সে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের নামও আপনি বলেছিলেন। আমি মনে করতে পারছি না। আপনি কি একটু সাহায্য করতে পারবেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান, ঘটনাটা আমার মনে আছে। নাম হলো, ‘আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড’।’
‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ দিন, কিন্তু বিদায় নেবেন না। যেজন্যে এত বড় ধন্যবাদ, সেই আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়ে আপনার আগ্রহ কেন বলুন।’ প্রেসিডেন্ট বললেন।
‘স্যার, আমার ইনফরমেশন যদি ঠিক হয়, তাহলে এটাই আমাদের খুঁজে বেড়ানো সোনার হরিণ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ! আপনার জিজ্ঞেস করা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। থ্রি জিরোর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু হবে এটা। একদম সোনার হরিণ হবে তা বুঝিনি। আলহামদুলিল্লাহ! পরবর্তী প্রোগ্রাম আপনার কি? জেনারেল মোস্তফারা জানতে পেরেছেন এ বিষয়টা?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।
‘না, এখনো জানাইনি। তথ্যটা পাওয়ার পর প্রথম টেলিফোনটা আপনাকে করেছি বিষয়টা নিশ্চিত হবার জন্যে। আমার প্রোগ্রাম আমি পরে জানাব। তার আগে আরও কিছু বিষয় জানা দরকার। ইতিমধ্যে আমার একটা অনুরোধ। আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে বাইরে বেরুবার যত পথ আছে, অলিগলি আছে, সবখানে সাদা পোশাকে পুলিশ ও গোয়েন্দা মোতায়েন করা দরকার। যারা শিল্প-কারখানাটি থেকে বের হবে, তারা কোথায় কোথায় যায়, কোথায় থাকে তা শেষ পর্যন্ত মনিটর করতে হবে। আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর স্যাটেলাইট ক্লোজ ফটো দরকার। পরে সব আলোচনা করবো স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ, মি. খালেদ খাকান। আপনি যা বলেছেন, তা এখন থেকেই কার্যকর হবে। স্যাটেলাইট ফটো আপনি অল্পক্ষণের মধ্যে পেয়ে যাবেন।’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওকে, মি. খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আসসালামু আলাইকুম।’ বললেন প্রেসিডেন্ট।
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে মোবাইলের কল অফ করে দিল।
মোবাইল অফ করে দিয়ে মূহুর্তকাল চোখ বন্ধ করে থাকল আহমদ মুসা।
তারপর চোখ খুলেই সে জড়িয়ে ধরল জোসেফাইনকে। বলল, ‘তোমার বান্ধবীকে ধন্যবাদ। প্রায় সব ক্রিটিক্যাল ব্যাপারে তার সহযোগিতা তোমার মাধ্যেমে এসেছে। কিন্তু আমার বিস্ময় লাগছে, এতো সাহায্য যিনি করছেন, তিনি কিন্তু একদিনও কথা বলেননি, সরাসরি কোন তথ্য তিনি আমাকে দেননি। এটা সত্যি বিস্ময়কর! এর কোন অর্থ তুমি পেয়েছ, আমি কিন্তু পাইনি।’
দু’জনই পাশাপাশি বসল। ভাবনার ছাপ জোসেফাইনের চোখে-মুখে। বলল, ‘অনেক সময় আমারও বিস্ময় ঠেকেছে! খুব জরুরি বিষয় যা তোমাকে সরাসরি জানানো দরকার, সেটাও আমার মাধ্যমে বলেছেন। তার ফলে সময় নষ্ট হয়েছে। সময় নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বুঝেও তিনি সরাসরি টেলিফোন করেননি। সত্যি এ রহস্যের কোন জবাব নেই আমার কাছে। আজও আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম নতুন ঠিকানার বিষয়টি তোমাকে বুঝিয়ে বলার জন্যে। কিন্তু পাল্টা তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন সরাসরি কথা বলা থেকে রেহাই পাবার জন্যে।’
থামল জোসেফাইন।
‘অথচ দেখ, সাহায্য করার আগ্রহ তারই বেশি। কিন্তু কথা বলার আগ্রহ নেই। বিষয়টা মেলে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শুধু আগ্রহ নয়, উদ্বেগও তার মধ্যে আমি দেখেছি। সেই যে আলালা পাহাড়ের সিনাগনে, তুমি যেখানে বিপদে পড়েছিলে, সেদিন আমাকে নিয়ে সেখানে যাওয়ার সময় তার মধ্যে যে উদ্বেগ দেখেছি, আবেগ দেখেছি তা বিস্ময়কর! বসফরাসের ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়ার ঘটনায় তোমাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় শত্রুর হাত থেকে কৌশলে তিনি উদ্ধার করে আনলেন, সে দিন তার মধ্যে যে উদ্বেগ, আবেগ ও আন্তরিকতা দেখেছি তার কোন তুলনা হয় না। একেবারে একদম কাছের মানুষ না হলে এমন মনোভাব কারও মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। এভাবে প্রতিটি ইনফরমেশন দেয়ার সময় তার মধ্যে আমি এই আবেগ-আন্তরিকতা দেখেছি। সত্যি আমি বিষয়টা ভাবতে…।’
জোসেফাইনের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘দেখ, একটা বিষয় এখনও আমার কাছে রহস্য! তিনি শত্রুর কবল থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করলেন। বুঝলাম একজন বান্ধবীর স্বামীকে তিনি উদ্ধার করেছেন, কিন্তু বান্ধবীর স্বামীটিকে তিনি চিনলেন কি করে? এক ঝলক কোথাও যদি দেখেও থাকেন, ফটোও যদি দেখে থাকেন, তবু ঐ রকম বিপর্যস্ত অবস্থায় চিনতে পারার কথা নয়। আরেকটা কথা ঐ অবস্থায় চিনতে পারার জন্যে যে গভীরভাবে দেখা প্রয়োজন, সেভাবে দেখার জন্যে উনি সেদিন সেখানে গেলেন কেন?’
থামল আহমদ মুসা।
‘প্রশ্নগুলো আমার কাছেও বিস্ময়ের! তবে আমার বান্ধবীর নিয়ে অন্য কিছু ভেব না। সে অত্যন্ত আন্তরিক। প্রতিবার, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি কথায় এর প্রকাশ আমি দেখেছি। তার মুখটা তার মনের আয়না। অদ্ভূত এক সরলতা, পবিত্রতা তার চোখে-মুখে! তার সান্নিধ্যে গেলে মন ভরে যায়, অপার এক আনন্দ পাওয়া যায়। বাচ্চারাই মানুষের অন্তর ভালো বুঝতে পারে। কারও কাছে তারা যায়, কারও কাছে যায় না। আমাদের আহমদ আব্দুল্লাহ তার জন্যে পাগল। দেখা পেলেই তার কোলে গিয়ে মুখ গুঁজবে। সেও…।’
‘যাক, আর বলো না জোসেফাইন। বুঝতে পারছি, তুমি তার প্রেমে পড়ে গেছ। তবে এটাও মনে রেখ, যে কোন সৌন্দের্যের প্রশংসা করে কিংবা যে সবার মধ্যে সৌন্দর্য, সরলতা, পবিত্রতা দেখে, সে কিন্তু সবার চেয়ে সুন্দর হয়। অতএব, জোসেফাইন…।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করার আগেই জোসেফাইন আহমদ মুসার পিঠে একটা কিল দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি কথাটাকে এখন অন্যদিকে ঘোরাচ্ছ, আমি চললাম।’
আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল জোসেফাইনকে। ছুটে পালাল জোসেফাইন।
হাসল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, ‘তুমি অন্যের প্রশংসা যতটা কর, তার একাংশও নিজের প্রশংসা শুনতে পার না।’
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলটা টেনে নিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন করল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির রেজিস্ট্রার তাইয়ের ইসমাইলকে।
তাইয়ের ইসমাইলের সাথে আহমদ মুসার কয়েক বার দেখা হয়েছে।
টেলিফোনে তাইয়ের ইসমাইলকে পেল আহমদ মুসা। সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বলল, ‘আমি একটা ফেভার চাই আপনার।’
‘অবশ্যই, স্যার। বলুন।’ বলল রেজিস্ট্রার।
‘আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জেফি জিনা’ নামে একজন বিদেশী অধ্যাপিকা আছেন। তার কিছু তথ্য আমাকে দিতে হবে। তিনি কোন্‌ দেশের, কোন্‌ ঠিকানার, কতদিন আছেন, থাকেন কোথায় ইত্যাদি।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা যখন কথা বলছিল, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসার অনুরোধের উত্তরে ওপার থেকে রেজিস্ট্রার বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, জানাব আপনাকে খোঁজ নিয়ে।’
ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে কল অফ করে দিল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ, ঠিক করেছ। এবার ওঁকে ধরা যাবে।’ বলল জোসেফাইন।
আবার আহমদ মুসা হাত বাড়াল। জোসেফাইনকে ধরার জন্যে।
এবার আর পালালো না জোসেফাইন।
হাত ধরলেও বাধা দিল না।
টানল জোসেফাইনকে আহমদ মুসা নিজের দিকে।
বোঁটা ছেঁড়া ফলের মতো জোসেফাইন এসে পড়ল আহমদ মুসার কোলে।
‘ঝামেলা করো না, আহমদ আবদুল্লাহ নড়ছে, এখনি উঠবে ঘুম থেকে।’ বলল জোসেফাইন। তার মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে।

আহমদ মুসার পরনে শিখ ড্রাইভারের পোশাক। মাথায় শিখের পাগড়ি। মুখভরা কালো দাড়ি। গায়ে ড্রাইভারের ইউনিফরম।
পেছনের সিটে ইস্তাম্বুল হার্ডওয়্যার লিমিটেড-এর জিএম ইসমাত ওসমানেগলু। জরুরি ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির কিছু স্পেয়ার পার্টস দরকার। পার্টসগুলোর স্পেসিফিকেশন আছে। তার অনুকরণেই স্পেয়ার পার্টসগুলো তৈরি হবে। এই অর্ডার নিয়েই যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের জিএম ইসমাত ওসমানেগলু আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানীর কাছে।
আহমদ মুসা আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ওয়েব সাইটে দেখেছে, কোম্পানিটি জার্মানি ও জাপানের মিল-মেশিনারিজ এবং অফিস ইকুপমেন্ট তৈরিকারি দু’টি সোল এজেন্ট হওয়া ছাড়াও অর্ডারের ভিত্তিতে স্পেয়ার পার্টস তৈরি ও সরবরাহ করে থাকে।
আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজের ভেতরে ঢোকা এবং ভেতরের একটা অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্যে এর চেয়ে সস্তা ব্যবস্থা করার কোন পথ আর আহমদ মুসারা পায়নি।
আহমদ মুসা নকল ড্রাইভার। কিন্তু ইস্তাম্বুল হার্ডওয়্যারের জিএম ইসমাত ওসমানেগলু নকল নন। তিনি সত্যিই প্রতিষ্ঠানটির জিএম। একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা হয়েছে। তবে স্পেয়ার পার্টস তাদের দরকার, এটা ঠিক।
বসফরাসের পূর্ব তীর ধরে একটা দামি মার্সিডিস এগিয়ে চলছে উত্তর দিকে।
গাড়িটা হাইওয়ের কেলি ইবরাহিম অংশে পৌঁছার পর সতর্ক হয়ে উঠল আহমদ মুসা। সামনেই ‘মারকাজ বেকিজ’-এর মোড়।
গাড়ি পৌঁছল মারকাজ বেকিজ-এর বিখ্যাত ব্যস্ত স্থানটিতে। এখান থেকে রাহিকায়া রোড পূর্ব দিকে গেছে। এই রোড ধরে তাদের পূর্বে পার্বত্য এলাকার দিকে এগোতে হবে।
রাহিকায়া রোড সাত-আট মাইল চলার পর গাড়ি গিয়ে পড়ল আকবাবা রোডে।
ঠিক যে স্থানটায় আহমদ মুসাদের গাড়ি আকবাবা রোডে উঠল, সেখানে সামনে বিরাট একটা বনজ উপত্যকা। তারপরেই একটা পার্বত্য ভূমি ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেছে।
এই বনজ উপত্যকাতেই গড়ে উঠেছে আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
রাহিকায়া রোড থেকেই একটা পাথুরে প্রাইভেট রোড গাছের সারির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে আরও ভেতরে।
আহমদ মুসার গাড়ি একটি প্রাইভেট রোডে গিয়ে পড়ল।
পেছন থেকে ইসমত ওসমানেগলু আহমদ মুসাকে বলল, ‘ওদের সাথে যোগাযোগ করে আসিনি। ওরা কি ঢুকতে দেবে, সাক্ষাৎ দিতে রাজি হবে?’
‘সেটাও টেস্ট করা আমাদের আজকের একটা লক্ষ্য।’
আড়াইশ’ তিনশ’ গজ এগোবার পর বাধা পেয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থামিয়ে দিল।
দু’জন লোক রাস্তার দু’পাশ থেকে লাল পতাকা তুলে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসা গাড়ি রাস্তার একপাশে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল।
লাল পতাকাধারী দু’জন লোক ছুটে এলো গাড়ির কাছে। একজন লোক খোলা জানালার দিকে ইসমাত ওসমানেগলুর সাথে কথা বলার জন্যে এগোলো, আরেকজন দাঁড়াল আহমদ মুসার পাশে এসে।
‘স্যার, কোথায় যাবেন?’ ইসমত ওসমানেগলুর দিকে এগিয়ে যাওয়া লোকটি জিজ্ঞেস করল ইসমাত ওসমানেগলুকে।’
‘আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজে।’ বলল ইসমত ওসমানেগলু।
‘কার কাছে?’ আবার জিজ্ঞাসা লোকটির।
‘জরুরি প্রয়োজন। সেল্‌স বা প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বশীল যাকেই পাই তার সাথে আলোচনা করব।’ বলল ইসমাত ওসমানেগলু।
লোকটি একটু চিন্তা করল। বলল, ‘আপনি কি এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন?’
‘বললাম তো খুব জরুরি ব্যাপার। মার্কেটে অনেক ঘুরেছি, তারপর সোজা এখানে আসছি শেষ ভরসা হিসেবে। যোগাযোগের সময় পাইনি।’ বলল ইসমত ওসমানেগলু।
‘ঠিক আছে, এসব গেটে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে বলবেন। কিন্তু আপনাদেরকে গাড়ি রেখে যেতে হবে। প্লিজ আপনারা নামুন। গাড়ি এখানেই পার্ক করা থাকবে।’
আহমদ মুসা নেমেছে। ইসমাত ওসমানেগলুও নামল।
‘গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না কেন?’ গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল তার সামনের লোকটিকে।
‘এখানকার এটাই নিয়ম। সবাইকেই এখানে গাড়ি রেখে যেতে হয়। শুধু তো গাড়ি নয়, আপনাদের ব্যাগে, পকেটে মেটালিক কিছু থাকলে সেগুলোও রেখে যেতে হবে।’ জবাবে লোকটি বলল।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
তার মনের কোণে একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মনে মনে চমকে উঠল। কিন্তু বিষয়টা মনেই রেখে মুখে বিস্ময় টেনে বলল, ‘আমরা যে স্পেয়ার পার্টস কিনতে যাচ্ছি, তার অনেক রকমের স্যাম্পল আমাদের ব্যাগে আছে ! সেগুলো না নিলে আমাদের চলবে কি করে?’
‘আমরা সেটা জানি না। সেটা ওখানে গিয়েই বলবেন। তারা সেটা দেখবেন, এমনকি পকেটের চাবি, হাতের আংটি সবই আপনাদেরকে গাড়ির ভেতর রেখে যেতে হবে।’ একেবারে নিরস কন্ঠে বলল লোকটি।
‘আচ্ছা একটা কথা, আপনাদের ইন্ডাস্ট্রিজের লোকরাও কি এভাবে মেটালিক সব কিছু রেখে ভেতরে যায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার মনে এ রকমের অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে।
‘তারা এ পথে যান না।’ বলল লোকদের একজন।
‘কোন্‌ পথে যান? আমরাও সে পথে যেতে পারি? কোন্‌ দিকে পথটা?’ জিজ্ঞেস করল আবার আহমদ মুসা।
লোক দু’জন বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সেটা আকাশ দিয়ে কি পাতাল দিয়ে তা আমরা জানি না। কথা রাখলে, আমরা যেভাবে বলেছি, সেভাবে যেতে পারেন। না হলে ফিরে যান।’
‘দুঃখিত, মাফ করবেন। আমরা তো সাংঘাতিক ঝামেলায় পড়েছি! জিনিসগুলো খুব জরুরি। সেজন্যেই বলছিলাম। আমরা যদি মালিকদের অনুরোধ করি টেলিফোনে, তাহলে কি তারা পথটা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারেন?’ খুব নরম গলায় বিনয়ের সাথে বলল আহমদ মুসা।
লোকটি পূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। ওষুধে ধরেছে বলে মনে হলো। তার চোখে নরম ভাব নেমে এসেছে। বলল, ‘স্বয়ং ঈশ্বর নেমে এলেও সে পথের সন্ধান পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। আরে মিয়া, যাবেনই বা কি করে? পাহাড়ে কি গাড়ি চলে?’
‘পাহাড়ে যাবো কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পথ তো ওখানেই।’ বলল একজন।
‘পাহাড়-টাহাড় থাক, এখন বলুন, কোনওভাবে গাড়ি নিয়ে গেটে যেতে পারবো কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখুন, আপনারা ফিরে যান। এভাবে স্পেয়ার পার্টস কেনার জন্যে এখানে কখনও কেউ আসেনি। আপনারা ফিরে গিয়ে বসদের সাথে যোগাযোগ করুন।’ বলল ওদের দু’জনের একজন।
‘সেটাই ভালো!’ বলে আহমদ মুসা ইসমাত ওসমানেগলুকে বলল, ‘ঠিক আছে। গাড়িতে উঠুন।’
আহমদ মুসা ও ওসমানেগলু দু’জনেই গাড়িতে উঠল।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করল।
‘গেলেই কি ভালো হতো না গাড়ি রেখে!’ ইসমাত ওসমানেগলু বলল।
‘দরকার নেই, ইসমাত ওসমানেগলু, যেজন্যে আসা তা হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, ইসমত ওসমানেগলু।’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ বলল ব্যবসায়ী ইসমাত ওসমানেগলু। কথা সে বাড়াল না। সে জানে, গোয়েন্দা বিভাগের অনেক জরুরি কাজ। জরুরি প্রয়োজন থাকে। সব জানা তাদের ঠিক নয়।

আরিয়েহ ইন্ড্রাস্ট্রিজের পূর্ব প্রান্তের পাহাড়ে উঠেছে আহমদ মুসা।
স্যাটেলাইট ফটোতে পাহাড়ের এই এলাকা নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করেছে আহমদ মুসা। আরিয়েহ ইন্ড্রাস্ট্রিজে ঢোকার পথে দু’জন লাল পতাকাধারীর কাছ থেকে জেনেছিল এই পাহাড়ী এলাকা থেকে আরিয়েহ ইন্ন্ড্রাস্ট্রিজে ঢোকার গোপন পথ রয়েছে।
গাড়ি ও কোন প্রকার মেটাল দ্রব্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ নেই, লাল পতাকাধারীরা বাধা দেয়া থেকে এ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আরিয়েহ ইন্ড্রাস্ট্রিজের চারদিক ঘিরে একটা নিষিদ্ধ এলাকা তারা সৃষ্টি করেছে যে এলাকায় তাদের নিরব ধ্বংসের দৈত্য সক্রিয় থাকে। শত্রুরা যাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে এজন্যেই এই ব্যবস্থা। কেউ প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে তাদের অস্ত্র হাওয়া হয়ে যাবে, এমনকি বিস্ফোরকের সাথে যদি মেটালিক কিছু থাকে, তাহলে তাও বিস্ফোরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
আহমদ মুসারা পাহাড়ের গোপন পথেই আরিয়েহ ইন্ডাসস্ট্রিজে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লাল পতাকাধারীদের কথা থেকে যা বুঝা গেছে তাতে এই পথে মেটালিক অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু আহমদ মুসারা মেটালিক অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাণহানি এড়িয়ে যুদ্ধ ছাড়াই আরিয়েহ ইন্ড্রাস্ট্রিজের গবেষণাগার ও অস্ত্রশস্ত্র দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা গ্যাস অস্ত্র ব্যবহারের।
আহমদ মুসা ক্রলিং করে এগোচ্ছে।
এলাকাটা ফ্লাট, কিন্তু এবড়ো-থেবড়ো।
টার্গেটটা এখনও বেশ দূরে।
টার্গেট হলো ছোট আকারের ডিশ প্লাস কম্যুনিকেশন এ্যান্টেনা। এ্যান্টেনা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় চার ফুট উচু পাথুরে পিলারের ওপর। পিলারটা হবে চার বর্গফুটের মতো প্রশস্ত। আহমদ মুসারা সন্দেহ করেছে গোপন সুড়ঙ্গ পথ এখানেই থাকতে পারে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে ঐ এ্যান্টেনার দিকেই এগোচ্ছে।
আহমদ মুসার গায়ে পাথুরে রঙের একটা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে বুলেট প্রুফ জ্যাকেটটি। গলায় ঝুলছে হিউম্যান বডি সেঞ্জিং মনিটর ও একটি গ্যাস মুখোশ। হাতের কাছে জ্যাকেটের বুক পকেটে রয়েছে আল্ট্রা ক্লোরোফরম গান। এই গ্যাস ক্যাপসুল বুলেট মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ার সংগে সংগেই মানুষের সংজ্ঞা লোপ পায়।
সামনে বড় পাথর পথ রোধ করে উঁচু হয়ে আছে।
পাথরটা ডিঙাবার জন্যে মাথা তুলেছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ সামান্য যান্ত্রিক একটা শব্দে সামনে তাকিয়ে হালকা অন্ধকারে দেখতে পেল, এ্যান্টেনাটি একদিকে কাত হয়ে গেছে।
কৃষ্ণপক্ষের রাত হলেও তারার আলো উন্মুক্ত জায়গায় অন্ধকার অনেকখানি ফিকে করে দিয়েছে।
আহমদ মুসা মাথাটা পাথরের আড়ালে এনে চোখ রাখল টার্গেট স্থানটার দিকে।
পার হলো কয়েক মূহুর্ত।
প্রশস্ত পিলারের ভেতর থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে দেখল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার চোখ এবার আঠার মতো লেগে গেল দৃশ্যটির ওপর।
এক এক করে পাঁচজন লোক বেরিয়ে এলো।
পঞ্চম ব্যক্তি বেরিয়ে এলে একজন গিয়ে কাত হয়ে পড়া এ্যান্টেনার গোড়ায় কি যেন করলো। এ্যান্টেনা আবার সোজা হয়ে প্রশস্ত পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল পিলারটি আসলে সিঁড়ির মুখ বা সুড়ঙ্গ মুখ। এ্যান্টেনা হচ্ছে সুড়ঙ্গ মুখের ক্যামোফ্লেজ। আর এ্যান্টেনার গোড়ায় রয়েছে সুড়ঙ্গ মুখ খোলার চাবিকাঠি।
পাঁচজন একত্র হয়ে উদ্যোগ নিল সামনে মানে পাহাড়ের ওপর দিকে এগোবার।
আহমদ মুসা আর সময় নষ্ট করল না।
তারা এ সিদ্ধান্তই নিয়েছে প্রথম সুযোগেই তারা আক্রমণে যাবে, লোকটিকে অচল করে দেবে। সেই ফর্মুলাই এখন বাস্তবায়ন শুরু করার পালা।
আহমদ মুসাও বুক পকেট থেকে আল্ট্রা ক্লোরোফরম গ্যাস ক্যাপসুল বের করল। গানটা ওদের দিকে তাক করে ট্রিগারে চাপ দিল। মানব দেহের সান্নিধ্যে গিয়ে অটো-বিস্ফোরণযোগ্য ক্যাপসুল বুলেট ছুটল সামনের পাঁচজনের দিকে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড!
ওরা পাঁচজনই সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল পাথুরে চত্বরে।
একটু সময় অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। তার পর এগোলো ক্রলিং করেই ওদের দিকে।
ওদের কাছে পৌঁছে আহমদ মুসা পেন্সিল টর্চ জ্বেলে ওদের একবার করে দেখে নিতে লাগল।
একটি মুখে টর্চের আলো স্থির হয়ে গেল। স্তম্ভিত হয়ে গেল বিজ্ঞানী আবদুর রহমান আরিয়েহকে দেখে! আজই তার ফটো দেখেছে আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার ফাইলে।
আনন্দে ভরে গেল আহমদ মুসার মন। শুরুতেই পেয়ে গেছে আসল লোককে। সাথের এ লোকগুলোও নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কেউ হবে।
আহমদ মুসা দ্রুত মেসেজ পাঠালো পাথুরে এই এলাকার পাশে অপেক্ষমান তার টিমের লোকজনদের কাছে। তাদের তাড়াতাড়ি আসতে বলল এই পাঁচজনকে নিয়ে যাবার জন্যে।
আহমদ মুসা সেই পাথরের আড়ালে বসে অপেক্ষা করতে লাগল ওদের আসার জন্যে।
এই সময় আহমদ মুসা একটা চাপা হিস হিস শব্দ শুনে ওপরের দিকে তাকাল।
দেখল, মাথার ওপর একটা হেলিকপ্টার নেমে আসছে।
হেলিকপ্টারের আলো নেভানো ও অনেকটা নিঃশব্দে। নিয়ন্ত্রিত শব্দের এ হেলিকপ্টারগুলো অত্যন্ত দামি।
হেলিকপ্টারটি ল্যান্ড করল যেখানে পাঁচজন লোক সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে, তা থেকে কিছুটা পূর্বে, পাহাড়ের আরও উঁচুতে। ওখানে পাহাড়ের মাথাটা যথেষ্ট সমতল।
ওদের সংজ্ঞাহীন হওয়ার ঘটনার পর পরই হেলিকপ্টার আসায় আহমদ মুসা বুঝল, হয় এই হেলিকপ্টারে আবদুর রহমান আরিয়েহদের কোথাও যাবার কথা ছিল অথবা এই হেলিকপ্টারে বড় কেউ আসছেন, যাদের স্বাগত জানানোর জন্যই তারা যাচ্ছিলেন ওদিকে।
হেলিকপ্টার থেকে এক এক করে নামল চারজন মানুষ। ওরা এগিয়ে আসতে লাগল এ্যান্টেনার দিকে।
এ্যান্টেনার সামনেই পড়ে আছে পাঁচজনের সংজ্ঞাহীন দেহ।
কথা বলছিল হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকগুলো।
বেশ বড় গলাতেই কথা বলছিল তারা।
কে একজন বলছিল, ‘মি. ডেভিড ইয়াহুদ, বিজ্ঞানি আরিয়েহ ও তার সহযোগি চারজন বিজ্ঞানী ঠিক রাত ৯টায় এখানে রেডি থাকবেন এবং তাদেরকে এখান থেকে নিয়ে তৃতীয় জায়গাটায় মিটিং-এ বসব, এটাই তো সিদ্ধান্ত ছিল। ওরা আসেননি, আর্শ্চয!’
‘আমি স্তম্ভিত হচ্ছি, মি. বেন জায়ন বেন ইয়ামিন! মিটিং-এর স্থান শেষ মূহুর্তে পাল্টে আমরা আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজেই মিটিংটা করব ঠিক করা হয়েছে, এটা তো বিজ্ঞানী আরিয়েহদেরকে জানানো হয়নি! তাহলে সিদ্ধান্ত অনুসারে ওরা এখানে থাকবেন না কেন, বিশেষ করে ‘থ্রি জিরো’র সুপ্রিম কমান্ডার বেন জায়ন বেন ইয়ামিন হেলিকপ্টারে থাকবেন, তার উপস্থিতিতে সিদ্ধান্তের অন্যথা তিনি করবেন, তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
একথাগুলো ‘থ্রি জিরো’র ইস্তাম্বুল প্রধান ডেভিড ইয়াহুদের। তা প্রথম জনের কথা থেকেই আহমদ মুসা বুঝল। আর যাকে লক্ষ্য করে ডেভিড ইয়াহুদ কথাগুলো বললেন অর্থাৎ যিনি প্রথম কথা বলেছিলেন, তিনি বেন জায়ন বেন ইয়ামিন ও ‘থ্রি জিরো’র সুপ্রিম কমান্ডার মানে সুপ্রিমপ্রধান।
একই সাথে বিস্ময় ও আনন্দে আহমদ মুসার মন নেচে উঠল। ‘থ্রি জিরো’র সব হিরোকে আল্লাহতায়ালা এক সাথে করে তাদের কাছে এনে দিয়েছেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
ওরা এসে পৌঁছে গেছে সংজ্ঞাহীন পাঁচজনের কাছে।
কাছাকাছি হতেই ওরা চারজন ছুটে এলো মাটিতে পড়ে থাকা পাঁচজনের দিকে।
ওরা চারজনই ঝুঁকে পড়েছে ওদের সংজ্ঞাহীন দেহের ওপর।
এটাই সময়, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
বুক পকেট থেকে আরেকবার উঠে এলো ক্লোরোফরম গান আহমদ মুসার হাতে।
ক্লোরোফরম গানটা ওদের দিকে টার্গেট করে ট্রিগারে তর্জনি চেপে ধরল আহমদ মুসা।
ছুটল ক্যাপসুল বুলেট ওদের চারজনের দিকে।
মাত্র আট-দশ সেকেন্ড। এর মধ্যেই ওদের চারজনের সংজ্ঞাহীন দেহ ঝরে পড়ল ওদের পাঁচজনের ওপর। ওরা সেই যে ঝুঁকে পড়েছিল, উঠে দাঁড়ানোরও আর সু্যোগ পেল না।
পেছনে পায়ের পরিচিত শব্দ পেল আহমদ মুসা। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, তার দশ জনের টিমটি এসে গেছে।
আহমদ মুসা কমান্ডো টিমের নেতা মুরাদ আনোয়ারকে নির্দেশ দিল, ‘এ্যান্টেনার কাছে ৯ জন লোক সংজ্ঞাহীন পড়ে আছে। প্রথমে এদের সবাইকে পিছমোড়া করে বাঁধ। তারপর এদের নিয়ে নিচে গিয়ে পুলিশে কাছে হস্তান্তর কর। তারা যেন জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশপ্রধানের নির্দেশ আনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মনে রেখ, এরা সবাই ভিভিআইপি বন্দী। একটুও অসাবধান হওয়া যাবে না।’
ওরা নির্দেশ নিয়ে স্যালুট করে চলে গেল।
আহমদ মুসা এবার কল করল জেনারেল মোস্তফাকে।
ওপারে জেনারেল মোস্তফার কন্ঠ পেতেই আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর অসীম করুণা, যুদ্ধ শুরুর আগেই যুদ্ধের বড় বিজয়টাই হয়ে গেছে! ধ্বংসের নিরব দৈত্যের প্রধান বিজ্ঞানী আবদুর রহমান আরিয়েহসহ চারজন বিজ্ঞানী, ‘থ্রি জিরো’র সুপ্রিমপ্রধান বেন জায়ন ও ড. ডেভিড ইয়াহুদসহ আরও নেতা, সব মিলিয়ে ৯ জন এখন আমাদের হাতে। কমান্ডোরা ওদের পাহাড়ের নিচের ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘ধন্যবাদ, মি. খালেদ খাকান। আপনি শুধুই বড় বিজয় বলছেন কেন? এটাই সবচেয়ে বড় বিজয়। প্রধান বিজ্ঞানীসহ পাঁচজন বিজ্ঞানী মাইনাস হলে নিশ্চয় ওদের ধ্বংসের নিরব দৈত্য অচল হয়ে পড়বে। আর বেন জায়ন ও ডেভিড ইয়াহুদ আমাদের হাতে আসা মানে ওদের সংগঠনকে এখন আমরা হাতের মুঠোয় আনতে পারব। এই অসাধ্য সাধন কি করে হলো মি. খালেদ খাকান?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘এটা একেবারেই আল্লাহর বিশেষ রহমত। এ্যান্টেনার স্থানটা পরীক্ষা করার জন্য পাহাড়ে উঠেছিলাম।’
বলে আহমদ মুসা ওদের ৯ জন সংজ্ঞাহীন করার ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘কমান্ডোরা ওদের রেখে ফিরে এলেই আমি এ্যান্টেনার সিঁড়ি পথে ভেতরে ঢুকবো।’
‘পাহাড়ের নিচের ক্যাম্পে আমি যাচ্ছি, মি. খালেদ খাকান। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে?’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘চারদিকের বেষ্টনিকে আরও ক্লোজ করুন এবং আপনি ও নাজিম এরিকেন আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজের গেটের দিকে চলে আসবেন। আমি ভেতরে ঢোকার পর পরবর্তী প্দক্ষেপ নিয়ে আপনার সাথে মোবাইলে আলাপ করবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, মি. খালেদ খাকান। আমি আপনার কলের অপেক্ষা করব। আর বেন জায়ন ও ডেভিড ইয়াহুদদের আমি গোয়েন্দা হেড কোয়ার্টারে সরিয়ে নিচ্ছি। ওকে মি. খালেদ খাকান। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা অপেক্ষা করতে লাগল কমান্ডোদের।
ওরা এলেই একটা পরিকল্পনা করে আহমদ মুসা প্রবেশ করবে থ্রি জিরোর গবেষণাগার, অস্ত্রাগার আরিয়েহ ইন্ডাস্ট্রিজের অভ্যন্তরে, যেখানে আছে নিরব ধ্বংসের দৈত্য, ‘Fotan silent destruction demon’ যার বলে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, দাস বানাতে চাচ্ছে আর সব মানুষকে।
আহমদ মুসার অপেক্ষার ইতি হলো।
তারার আবছা আলোতেই আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে, কমান্ডোরা সার বেঁধে উঠে আসছে পাহাড়ের ওপরে।

পরবর্তী বই
‘মাউন্ট আরারাতের আড়ালে’