৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা ও সাতজন কমান্ডো এক এক করে অ্যান্টেনার খোলা বেজ মুখ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
প্রথমেই পাথুরে সিঁড়ি।
সিঁড়ির সাত-আটটা ধাপ পেরুতেই একটা দরজার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে তারা পৌঁছল।
দেখেই বোঝা গেল, সিঁড়িটা লিফটের আরেকটা দরজা।
দরজাটা পাথরের।
দরজা খোলার চিন্তায় আহমদ মুসা দরজা ও দরজার চারপাশের চৌকাঠের মতো প্রান্তের ‍ওপর চোখ বোলাতে লাগল।
ডান ও বাম পাশের দুই চৌকাঠে ভার্টিক্যালি লম্বা দু’টি করে বাটন দেখতে পেল আহমদ মুসা।
দু’পাশের দু’বাটনেই হিব্রু ভাষায় ওপেন ক্লোজ লেখা। কিন্তু দু’পাশের বাটনের লেখা এক রকমের নয়।
বাঁ পাশের চৌকাঠের লেখা সোজা মানে ওপেন শব্দ ডান দিক থেকে লেখা এবং ক্লোজ শব্দ বাঁ দিক থেকে লেখা, কিন্তু ডান দিকের চৌকাঠে শব্দ দু’টি বাঁ দিক থেকে লেখা।
পেছনে দাঁড়ানো কমান্ডো নেতা মুরাদ আনোয়ারের দিকে ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মনে হচ্ছে মুরাদ আনোয়ার, একটা ধাঁধা না ভাঙতে পারলে আমরা দরজা খুলতে পারবো না।’
মুরাদ এগিয়ে এল।
দেখল দুই চৌকাঠের চারটি বাটনকে ও বাটনের লেখাগুলোকে।
ভাবনার ছায়া নামল মুরাদ আনোয়ারের মুখে। ভাবছিল আহমদ মুসাও।
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে কাটল।
‘কিছু ভেবে পেলে মুরাদ আনোয়ার?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ধাঁধায় ফেলার জন্যে ‘ওপেন’ শব্দ সোজা আর উল্টো করে দু’বার লিখেছে। আমার মনে হয়, দুই ‘ওপেন’ বাটনের একটা চাপলেই আমাদের চাওয়াটা পেয়ে যাব মানে দরজা খুলে যাবে।’
‘চাপ দাও, মুরাদ আনোয়ার।’ বলল আহমদ মুসা।
মুরাদ আনোয়ার দুই ওপেন বাটনই পরপর নানাভাবে চাপল, কিন্তু পাথরের দরজা যেমন ছিল, তেমনি থাকল।
মুরাদ আনোয়ারের চোখে-মুখে হতাশা ফুটে উঠল। বলল, ‘তার মানে ধাঁধার অর্থ এটা নয়। নিশ্চয় আরও জটিল কিছু আছে।’ বলেই হঠাৎ থেমে গেল মুরাদ আনোয়ার। তার চোখে-মুখে নতুন ভাবনার আলো। বলল, ‘দু’পাশের দুই ‘ওপেন’-এ চাপ দেয়ার পর গোপন আরও একটা কমান্ড নিশ্চয় আছে। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।’
আহমদ মুসা ভাবছিল।
হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দু’পাশের চৌকাঠের বাটন চারটির ওপর আরও একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল, ‘না, মুরাদ আনোয়ার, তার মনে হয় দরকার হবে না। খুব সহজ একটা গাণিতিক নিয়ম রয়েছে ধাঁধার পেছনে। দেখ, ‘ক্লোজ’ শব্দ দু’টিই মাইনাস পজিশনে রয়েছে। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। তার মানে, ক্লোজ শব্দের বাটন দু’টি একসাথে চাপলেই দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আর দেখ, ‘ওপেন’ বাটন দু’টির একটি প্লাস, অন্যটি মাইনাস পজিশনে। প্লাসে-মাইনাসে মাইনাস। অতএব, ‘ওপেন’ বাটন দু’টি একসাথে চাপলেই আমি মনে করি দরজা খুলে যাবে। চেষ্টা কর মুরাদ আনোয়ার।’
বলে আহমদ মুসা রিভলভার ধরা ডান হাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে পেছনে দাঁড়ানো কমান্ডোদের দিকে একবার তাকাল।
বাটন দু’টি পুশ করতে এগিয়ে গেছে মুরাদ আনোয়ার।
লম্বা একটা ‘হিস’ শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই সামনের দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। দেখল, দরজাটা হাওয়া। ওপার থেকে অর্ধডজন স্টেনগান হাঁ করে আছে তাদের দিকে। সবচেয়ে সংগীন অবস্থা মুরাদ আনোয়ারের। তার বুকে রিভলভার চেপে ধরে আছে একজন।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াতেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘সবাই হাত ওপরে তোল। না হলে সবাই একসাথে লাশ হয়ে…।’
মুরাদ আনোয়ার আহমদ মুসার বাম দিকে চল্লিশ ডিগ্রী কোণে দাঁড়িয়েছিল। ফলে মুরাদ আনোয়ারের বুকে যে রিভলভার তাক করেছিল, তার বাম পাশ গোটাই আহমদ মুসার সামনে অবারিত।
লোকটি যখন হাত ওপরে তোলার নির্দেশ দিচ্ছিল, তখন পকেটের ভেতরে থাকা আহমদ মুসার রিভলভার উঠে এসেছিল লোকটির মাথা লক্ষ্যে।
কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসার রিভলভারের গুলি লোকটির বাম কানের পাশ দিয়ে ঢুকে গেল তার মাথায়।
গুলিটা করেই আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠল, ‘কমান্ডোজ, গেট চেঞ্জড।’
আহমদ মুসাও কাত হয়ে আছড়ে পড়েছিল মেঝেতে।
আহমদ মুসার আশংকাই সত্য হলো। আহমদ মুসার গুলি লোকটিকে হিট করার সাথে সাথেই ওদের ছয়টি স্টেনগান গর্জন করে উঠেছে।
আহমদ মুসার কমান্ড ছাড়াও ওদের স্টেনগান তাদের টার্গেট করা টের পেয়েছিল আহমদ মুসার সাথী কমান্ডোরা। আত্মরক্ষার জন্যে তারাও শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। কমান্ডো নেতা মুরাদ আনোয়ারসহ কয়েকজনের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল। কাঁধে, পাঁজরে লেগে কয়েকজন আহত হলো।
মাটিতে শুয়ে পড়ার আগেই আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলভার বের করে নিয়েছিল এবং ওদের ছয়জনকে টার্গেট করে গুলি করাও শুরু করেছিল।
দু’জন কমান্ডো কাঁধে ও পাঁজরে গুলি খেলেও দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের দু’জন মোহাম্মদ পাশা ও সোলেমান পাল্টা আঘাত হানতে মুহূর্ত দেরি করেনি। তার ফলেই শেষ রক্ষা হয়েছিল।
ওদের চারজনকে গুলি করতে করতেই আহমদ মুসার গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ দু’জনকে হত্যা করেছিল মোহাম্মদ পাশা ও সোলেমান। তা না হলে নির্ঘাত ব্রাশফায়ারের মুখে পড়ে যেত আহমদ মুসা।
ওদের স্টেনগানধারী ছয়জনের রক্তের স্রোতের মধ্যে থেকে একজন মাথা তুলল। সে হাতের স্টেনগানটির ব্যারেল মরিয়া হয়ে একবার ওপরে তোলার চেষ্টা করল। পারল না। হাত থেকে খসে পড়ে গেল স্টেনগান। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে সে বলল, ‘শয়তান, তোরা আমাদের নেতা, আমাদের বিজ্ঞানীদের ধরেছিস। কিন্তু তোদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আমাদের ‘নীরব’ ধ্বংসের দৈত্য ‘ডাবল ডি’ এবং আমাদের গবেষণা তোরা হাত করতে পারবি না। দেখ, আমাদের সুইসাইড স্কোয়াডের নেতা মাথায় গুলি খেয়ে মরলেও তার হাত তার গলায় ঝোলানো রিমোটের রেড বাটনকে প্রাণপণে চেপে ধরেছিল। মরে গেলেও দেখ চেপে ধরেই আছে। এখনি ডাবল ডি’র সবকিছুসহ গোটা গবেষণাগার ও এই কমপ্লেক্স ধূলো হয়ে যাবে। তার সাথে তোদেরও কবর হবে।’
শেষ কথার সাথে সাথে লোকটির মাথাটি নেতিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘মোহাম্মদ, সোলেমান, কুইক, আমাদের এখনি বেরুতে হবে এখান থেকে। তবে আমাদের ভাইদের লাশ কি করে রেখে যাই! তোমরা দু’জন দু’জনকে টেনে নিতে পারবে কিনা? আমি দু’জনকে নিচ্ছি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দু’জনকে দুই কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
পেছনে মোহাম্মদ পাশা ও সোলেমান দুই সাথীর লাশ টেনে নিয়ে উঠতে লাগল।
সুড়ঙ্গ-সিঁড়ির মুখ কমিউনিকেশন অ্যান্টেনার পথে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা সাহায্য করল আহত দু’কমান্ডো ভাইকে তাদের সাথীদের লাশ নিয়ে বেরিয়ে আসতে।
আহত দু’সাথী দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
‘দম নেবার সময় নেই প্রিয় কমান্ডো ভাইরা। যতটা দ্রুত সম্ভব, আমাদেরকে পাহাড়ের ওপরে উঠে যেতে হবে। এস।’
বলেই আহমদ মুসা দু’সাথীর লাশ আবার কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের ওপরে এগোতে লাগল।
‘ভাববেন না ভাই, আমরা পারব আপনাকে ফলো করতে। চলুন।’ বলল মোহাম্মদ পাশা ও সোলেমান একসাথেই।
সুড়ঙ্গের সিঁড়ি মুখ থেকে বিশ গজের মতো এগিয়েছে আহমদ মুসারা।
সুড়ঙ্গের মুখ থেকে পনের গজ ওপরে একটা টিলার দেয়াল। সে দেয়াল পার হয়ে আহমদ মুসারা মাত্র পাঁচ গজ এগিয়েছিল। এই সময়ই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। ভূমিকম্পের প্রবল ধাক্কা খাওয়ার মতো পাহাড়টাও প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল।
বড় কিছুর আশংকায় আহমদ মুসাদের চোখ আপনাতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মুহূর্তে কয়েকবার চিৎকার করে মোহাম্মদ পাশা বলল, ‘আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন খালেদ খাকান ভাই। আল্লাহর হাজার শুকরিয়া।’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। ওদিকের অবস্থা দেখার জন্যে কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে টিলাটার ওপর দিয়ে ওদিকে নজর ফেলতেই চমকে উঠল। টিলাটার ওপারে পাহাড়ের অবশিষ্ট অংশসহ সবকিছু হারিয়ে গেছে। প্রশস্ত গভীর অন্ধকার খাদ শুধু সামনে।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মোহাম্মদ পাশা এবং সোলেমানও।
‘মনে হয়, রিমোটের এ্যাকশন ডাইরেক্ট ছিল না। রিমোটকে এক বা একাধিক ম্যাকানিজমের চেইন্ড রিএ্যাকশনকে অ্যাকটিভেট করতে হয়েছিল। তার জন্যে কমপক্ষে বেশ কয়েক মিনিট বরাদ্দ ছিল। সেই সময়টুকুতেই আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ এভাবে ওরা সবকিছু ধ্বংস করল কেন?’ বলল মোহাম্মদ পাশা।
‘নিশ্চয় ওদের কাছে নির্দেশ এসেছিল। ওদের নেতা ও বিজ্ঞানী যাদের আমরা ধরেছি, তাদের কাছ থেকে কিংবা অন্যদিক থেকে তারা চূড়ান্ত নির্দেশ পেয়েছিল। তার ফলেই আমরা ব্যর্থ হলাম ওদের ধ্বংসের দৈত্য ও গবেষণাগার হাত করতে।’
আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনারা কোথায়? ভালো আছেন আপনারা?’ আর্ত-চিৎকারের মতো শোনাল জেনারেল মোস্তফার কণ্ঠ।
‘ভয় নেই জেনারেল, আমরা নিরাপদ আছি। ঠিক সময়ে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ভেতরের ওরা বাইরে থেকে মেসেজ পেয়েছে। আমরা যাদের ধরেছি, তারা কি কোন মেসেজ পাঠিয়েছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘স্যরি মি. খালেদ খাকান। ওদের শীর্ষ বিজ্ঞানী আব্দুর রহমান আরিয়েহের গোপন দ্বিতীয় মোবাইলটা তার কাছে রয়েই গিয়েছিল। সেই মোবাইলেই উনি ওদের কাছে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। বিস্ফোরণের পর উনিই চিৎকার করে বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। হেসে বলেছেন, ‘অন্তত, আমাদের নীরব ধ্বংসের দৈত্য এবং আমাদের গবেষণা আমরা তোমাদের হাতে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলাম।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বললেন না ওকে যে, আপনাদের নীরব ধ্বংসের দৈত্যকে আপনারা ধ্বংস করে ভালো করেছেন। ওর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। আমরা মানবতাকে ধ্বংস নয়, রক্ষা করতে চাই। সেই রক্ষার অস্ত্রই হলো আমাদের ‘সেভিয়ার অব ওয়ার্ল্ড র‍্যাশনাল ডোমেইন (সোর্ড)’। আমরা আমাদের ‘সোর্ড’কে রক্ষা করতে পেরেছি। দানবের বিরুদ্ধে মানবতার জয় হয়েছে।’
‘বলব মি. খালেদ খাকান! আপনারা আসুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘স্যরি জেনারেল। আপনাকে বলা হয়নি। আমরা কমান্ডো নেতা মুরাদ আনোয়ারসহ চারজনকে হারিয়েছি। কমান্ডো মোহাম্মদ পাশা ও সোলেমান মারাত্মক আহত। আমি ওদের নিয়ে পাহাড়ের ওপরে আছি। চার ভাইয়ের লাশও আমাদের সাথে আছে। প্লিজ একটা হেলিকপ্টার পাঠান।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বড় দুঃসংবাদ মি. খালেদ খাকান। আল্লাহর অশেষ প্রশংসা, আরও ক্ষতির হাত থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন। আমি হেলিকপ্টার নিয়ে আসছি মি. খালেদ খাকান।’
কথা শেষ করেই জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘একটু ওয়েট প্লিজ মি. খালেদ খাকান, প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন এসেছে।’
দু’মিনিটেই জেনারেল মোস্তফা টেলিফোনে ফিরে এলেন। বললেন, ‘মি. খালেদ খাকান, প্রধানমন্ত্রী তার এবং প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা আপনার সাথে দেখা করতে চান। সব শুনতে চান আপনার মুখ থেকে।’
‘তাদের ধন্যবাদ। আমি তাদের সাথে দেখা করার জন্যে উদগ্রীব। তাহলে আসুন জেনারেল মোস্তফা।’
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে কল অফ করল।

আহমদ মুসা ডিনার শেষে গোল্ড রিজর্টের দক্ষিণ বারান্দায় এসে বসল।
গা এলিয়ে দিল ইজি চেয়ারে।
মর্মর সাগরের স্নিগ্ধ বাতাস সেখানে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি তোপকাপি প্রাসাদের প্রান্ত পেরিয়ে মর্মর সাগরের ওপর নিবদ্ধ। মর্মর সাগরের কালো বুকের ওপর দিয়ে বসফরাসের আলোকোজ্জ্বল ব্রীজের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছে।
এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে গিয়ে মুহূর্তে কয়েকশত বছর আগে ছুটে গেল তার মন। জীবন্ত রূপ নিয়ে এলো তুরস্কের বিশ্ব কাঁপানো সুলতানদের স্মৃতি। তুরস্কের মহান সুলতান বায়েজিদ, সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ, সুলতান সোলেমান দি ম্যাগনিফিসেন্টরাও মর্মর সাগর আর বসফরাসকে এভাবেই দেখতেন। সেই মর্মর সাগর আছে, বসফরাস আছে, তোপকাপি প্রাসাদ আছে, কিন্তু নেই তারা, নেই সেই সময়, নেই তুরস্কের সেই দিন। ইউরোপের অর্ধেক এবং ভূমধ্যসাগর জুড়েও ওড়ে না আর ইসলামের অর্ধচন্দ্র পতাকা।
ভাবতে গিয়ে একটা আবেগ আচ্ছন্ন করে ফেলল আহমদ ‍মুসাকে। দু’চোখের কোণ তার ভারী হয়ে উঠল অশ্রুতে।
জোসেফাইন এসে বসল তার পাশের ইজি চেয়ারে।
আহমদ মুসা চিন্তায় মগ্ন থাকায় তা টের পেল না।
জোসেফাইন ধীরে ধীরে হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে। বলল আস্তে আস্তে, ‘এত বড় কাজের পর কোন ভাবনায় আবার নিজেকে এমন হারিয়ে ফেলেছ?’
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা মুখ ঘোরাল জোসেফাইনের দিকে। কাঁধ থেকে জোসেফাইনের হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় ধরে ওপরে তুলে নিয়ে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, ‘ভাবনায় নয়, অতীতের এক সুখ-স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, তুরস্কের অমর বিজেতা সুলতান সোলেমান দি ম্যাগনিফিসেন্ট এবং বায়েজিদদের কথা। আলোর মেঘমালায় সাজানো মর্মর সাগর ও বসফরাসের কালো বুকের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন তাদের চোখেই মর্মর আর বসফরাসকে দেখছি। ভেসে উঠেছিল আমার চোখে মর্মর আর বসফরাসের সে স্বর্ণালী দৃশ্য।’
‘স্যরি, তোমাকে এক দরিদ্র বাস্তবতায় এভাবে ফিরিয়ে আনার জন্যে। তুমি যাকে সুখ-স্মৃতি বলছ, তা সুখ-স্মৃতি মাত্র নয়, আসলে এক টনিক, এক গাইড, এক পাওয়ার জেনারেটর। এ আমাদের সামনে এক ‘ভিশন’ তুলে ধরে, সামনে এগোবার ক্ষমতা দেয়।’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমার সব কথা ঠিক জোসেফাইন। কিন্তু সুখ-স্মৃতিকে সংগ দেবার সময় আমাদের খুব কম। তুমি আমার সময় বাঁচিয়েছ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সময় বাঁচানোর প্রশ্ন আসছে কেন? তোমাদের এখানের কাজ শেষ। আপাতত হাতে তো প্রচুর সময়।’ জোসেফাইন বলল।
‘হ্যাঁ, হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেল। ওরা সবাই এভাবে ধরা পড়বে, তা ভাবা যায়নি। এখানে তোমার বান্ধবীর কৃতিত্ব অনেক বেশি। এই ঠিকানার সন্ধান তার কাছ থেকেই তুমি দিয়েছিলে। আমি ভাবছি তাকে একটা বড় পুরস্কার দেয়া যায়। কি দেয়া যায় বলো তো। আমি তুরস্ক সরকারকে বলব।’
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, মুখ গম্ভীর হলো জোসেফাইনের। তাতে বেদনার ছাপ। বলল, ‘সে সুযোগ পাবে না, সে সুযোগ সে তোমাদের দিল না।’
আহমদ ‍মুসাও সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘বুঝলাম না জোসেফাইন। সে সুযোগ পাবো না কেন?’
‘তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। সে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাচ্ছে। সে আজ রাতের ফ্লাইট ধরছে।’ বলল জেসেফাইন।
‘হঠাৎ এভাবে চলে যাচ্ছেন? তুমি তো টেলিফোনে তখন কিছু বলোনি। জানতে কি আগে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি জানতাম না। সেও আমাকে তখন টেলিফোনে কিছু বলেনি। সন্ধ্যায় আমি আয়েশা আরবাকানকে নিয়ে বাগানের দিকে বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে গেটম্যানের কাছে একটা এনভেলাপ পেলাম। চিঠিটা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেসেঞ্জার এসে দিয়ে গেছে। ঘরে এসে এনভেলাপ খুলে দেখি জেফি জিনার চিঠি। ওতেই পড়লাম, সে আজ চলে যাচ্ছে মায়ের অসুখের খবর পেয়ে।’
কথা শেষ করেই জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এনভেলাপটা এখানেই ঐ শোপিসটার ওপরে রেখেছি।’
বলে জোসেফাইন গিয়ে দেয়ালের শোপিসের ওপর থেকে এনভেলাপ এনে তা থেকে চিঠি বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল। বলল, ‘পড়ে দেখ। দুঃখজনক যে, সে তার আমেরিকার ঠিকানা চিঠিতে দেয়নি। ভুলেও যেতে পারে তাড়াহুড়োয়।’
চিঠি হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা।
শুরুতেই চিঠিতে জোসেফাইনকে সম্বোধন করেছে ‘আপা’ বলে। তারপর লিখেছে, ‘বন্ধু নয়, ‘আপা’ বলেই সম্বোধন করলাম।’ এই এক বাক্য পড়তেই চিন্তার কোথায় যেন হোঁচট লাগল আহমদ মুসার। এরকম একটা বাক্য কোথায় যেন পড়েছে তার মনে হলো।
আবার পড়তে শুরু করল, ‘আপা, আম্মার অসুস্থতার খবর পেয়ে হঠাৎ আমাকে আমেরিকা ফিরতে হচ্ছে। তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম, না পেয়ে খবরটা জানানোর জন্যে চিঠির আশ্রয় নিতে হলো। তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে ছোটমণি আহমদ আবদুল্লাহকে আর দেখতে পাবো না বলে। কারও মায়ার বাঁধন আবারো আমাকে এভাবে বাঁধবে, এটা ভাবিনি। এটা আমার একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
বুঝেছি আপা, এটাই দুনিয়া। এই দুনিয়ায় হাসির চেয়ে কান্নাই সম্ভবত বেশি আছে। আবার ব্যাপারটা এমনও হতে পারে যে, মানুষ ‘জন্ম’র আনন্দের চেয়ে মৃত্যুর বেদনাকেই বড় করে দেখে। যেমন সুখ-স্মৃতির চেয়ে, দুঃখের স্মৃতিই মানুষের মনে থাকে বেশি। এরপরও বলব, দুনিয়ার সেরা মহাকাব্যগুলোর অধিকাংশই বিয়োগান্তক। এই বিশ্বচরাচরে হাসির বন্যার চেয়ে কান্নার প্লাবন আসলেই বড়।
স্যরি, বিদায়ের সময় এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আমার মনে হয়, তুরস্কে তোমাদের মিশন শেষ। এরপর তুমি ঘরে ফিরবে, না নতুন কোন মিশনে, নতুন কোথাও যাবে- আমি জানি না। তবে যেখানেই থাক, যেখানেই থাকি, এক পৃথিবীতেই আমরা থাকব, এটাই সান্ত্বনা।
কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে, সেটা অনিচ্ছাকৃত। মাফ করে দিও। আমার ছোটমণিটার জন্যে অনেক দোয়া, অনেক ভালোবাসা।’
চিঠি পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার। চিঠির কথাগুলো তার মনে অনেক জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তুলল। চিঠির কথায়, চিঠির ভাষায় একটা পরিচিত মনের ছোঁয়া যেন লাগছে।
চিঠির শেষে নাম স্বাক্ষরের ওপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। স্বাক্ষরে দু’টি শব্দ ‘জেফি জিনা’। নামের অক্ষর লেখার, বিশেষ করে ‘জে’, ‘এফ,’ ‘এন’ অক্ষরগুলোর স্টাইলের ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার স্মৃতির দুয়ার যেন এক ধাক্কায় খুলে গেল। বিস্ময়-দৃষ্টি নিয়ে চিঠির লেখার ওপর আবার নজর বোলাল দ্রুত। জেফি জিনা নয়, সব ছাপিয়ে আরেকটা নাম যেন কথা বলে উঠল।
বিস্ময়-দৃষ্টি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসা জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘জোসেফাইন, এ চিঠি কি জেফি জিনার? জেফি জিনা কে?’
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার সুরে জোসেফাইনের চোখেও বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, চিঠি তো জেফি জিনার। কেন, জেফি জিনা তো জেফি জিনাই!’ জোসেফাইন কৌতুহল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে।
‘কিন্তু জোসেফাইন, আমি নিশ্চিত, এই চিঠির লেখা ও ভাষা দুই-ই সারা জেফারসনের।’
‘সারা জেফারসনের!’ শব্দটা জোসেফাইনের কণ্ঠ ভেদ করে একটা প্রবল উচ্ছ্বাসের তোড়ে যেন বেরিয়ে এলো।
ছুটে এসে সে আহমদ মুসার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসল। চিঠিটা আহমদ মুসার হাত থেকে নিয়ে তাতে চোখ বোলাল। তারপর ছুটে ঘরের ভেতরে চলে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যে বেরিয়ে এলো। হাতে একখণ্ড কাগজ।
আবার গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল জোসেফাইন আহমদ মুসার পাশে। বলল, ‘তোমার কাছে পাঠানো সারা জেফারসনের চিঠি নিয়ে এলাম। এস তো দেখি, চিঠি দু’টি মিলিয়ে।’
চিঠি দু’টি পাশাপাশি রেখে দু’জনেই দেখল। জোসেফাইন প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘ঠিক, সারা জেফারসনের লেখা এটা। তার মানে, জেফি জিনাই সারা জেফারসন।’
বলেই জোসেফাইন আহমদ মুসার উরুতে মুখ গুঁজল।
কয়েক মুহূর্ত পরে মুখ তুলল।
অশ্রুতে ধুয়ে গেছে তার মুখ। বলল, ‘এত ঘনিষ্ঠ, এত আপন হয়েও সে পরিচয় গোপন করল? আমার যে কত আশা ছিল তার দেখা পাওয়ার, তার সাথে কথা বলার! আমাকে বড় বোন ডেকে আবার এতটা নিষ্ঠুর হলো সে!’
কথা বলার সাথে সাথে তার দু’চোখ থেকে দু’গণ্ড বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ধারা।
আহমদ মুসা তাকে কাছে টেনে নিল। বাম বাহুর মধ্যে তাকে জড়িয়ে রেখে বলল, ‘তোমার আবেগ, তোমার কথা ঠিক আছে। আমিও দারুণ বিস্মিত হয়েছি এভাবে তার পরিচয় গোপনে। আমার বিস্ময়ও ঠিক আছে। কিন্তু তার দিকটা ভাব। সে তার দিক থেকে ঠিকই করেছে। তার সেই চিঠিটা আবার পড়ে দেখ।’
জোসেফাইন মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে প্রতিবাদের চিহ্ন। বলল, ‘না, সে ঠিক করেনি, তার চিঠি আমার মুখস্থ। ভালোবাসা পাপ নয় যে সে অপরাধীর মত পালিয়ে বেড়াবে। কেন সে নিজেকে অপরাধী ভাববে? অপরাধী নয় সে।’
কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল জোসেফাইনের শেষ কথাগুলো।
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা নীতিগত দিক দিয়ে ঠিক জোসেফাইন। কিন্তু তুমি একবার তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখ, তুমি যা সহজ মনে করছ তা সহজ নয়। তার জন্যে বিষয়টি কষ্টকর আর আমাদের জন্যে বিব্রতকর। সে এটাই এড়াতে চেয়েছে।’
কোন উত্তর দিল না জোসেফাইন। চোখ মুছে মাথা নিচু করল।
একটু পর মাথা নিচু রেখেই স্বগতঃকণ্ঠে বলল জোসেফাইন, ‘সে পরিচয় দিয়েই দেখতো, আমাদের বিব্রতভাব ও তার কষ্ট দূর করতে পারতাম কিনা!’
বলে মুখ তুলল জোসেফাইন। বলল, ‘আমাকে একটা অনুমতি দেবে?’
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘অনুমতির প্রশ্ন কেন? তোমার ইচ্ছাই যথেষ্ট। বল?’
‘আমি আমেরিকা যাব।’ বলল জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে।
মুহূর্তের জন্যে একটা বিস্ময়ের ঝলক খেলে গেল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। একটু ভাবল। অস্পষ্ট এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘তুমি সারা জেফারসনকে জবাব দিতে চাও?’
জোসেফাইনের চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের সাথে একটা দৃঢ়তা ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, তাকে জবাব দিতে চাই। সে যেভাবে নির্বাক-বিস্ময়ে পীড়িত করেছে, আমিও তাকে ঠিক সে নির্বাক-বিস্ময়ে অভিভূত করব।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘শুধু এ জন্য তুমি আমেরিকা পর্যন্ত ছুটবে?’
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘হ্যাঁ, বলারও কিছু আছে। সে যে পরিস্থিতিতে যেভাবে ভালোবেসেছে, সেটা অন্যায় নয়, অপরাধ নয়। কেন সে তাহলে পালিয়ে বেড়াবে? কেন স্বাভাবিক বিষয়টা সহজভাবে বলতে পারবে না? কেন সে অসহনীয় এক কষ্টে দগ্ধ হবে?’
হাসি দিয়ে কথা শুরু করেছিল জোসেফাইন। কিন্তু শেষে তার কণ্ঠ আবেগের উচ্ছ্বাসে প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
জোসেফাইনের আবেগ-রুদ্ধ কথা আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করেছিল। তার মুখে নেমে এল বিষণ্নতার একটা ছায়া। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, ‘এসব বলে কতটা লাভ হবে জোসেফাইন? তোমার যুক্তি ঠিক। কিন্তু তার কাছে যেটা বাস্তবতা, সেটা কি সে ডিঙাতে পারবে? তাকে তার মত করে থাকতে দেয়াই ঠিক নয় কি জোসেফাইন?’ নরম কণ্ঠ আহমদ মুসার।
ম্লান হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘এসব কি আমাকে যেতে না দেয়ার যুক্তি তোমার?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার ইচ্ছাই আমার অনুমতি জোসেফাইন। আমি যা বললাম, সেটা তোমার কথার পাশে আমার কথা মাত্র।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল জোসেফাইন হাসিমুখে।
‘যাওয়া সম্পর্কে তোমার পরিকল্পনা কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পরিকল্পনাটা তুমিই করে দেবে। মদীনা শরীফে ফিরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
বলে জোসেফাইন উঠে ইজি চেয়ারটা টেনে আহমদ মুসার চেয়ার ঘেঁষে তা সেট করে গা এলিয়ে দিল ইজি চেয়ারে এবং বলল, ‘আমাদের তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। তার পরিচয় জানার পর এটা অপরিহার্য হয়ে গেছে।’
‘পরিচয় জানার আগেও এটা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সুযোগ পাইনি। তুমি যাচ্ছ, আমার পক্ষ থেকে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে।’
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘আমার কৃতজ্ঞতা আমি জানাব। দরকার বোধ করলে তোমার কৃতজ্ঞতা তুমি জানিও।’
‘তোমার কৃতজ্ঞতা কিসের? তুমি না ঝগড়া করতে যাচ্ছ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঝগড়া যে কারণে, সে কারণে ঝগড়া তো হবেই। কৃতজ্ঞতার কারণ ভিন্ন।’ বলল জোসেফাইন।
‘কৃতজ্ঞতার কি কারণ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার স্বামীকে সে সাহায্য করেছে, একাধিকবার বড় বড় বিপদ ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, বিশাল এক দায়িত্ব পালনে আমার স্বামীর যে সাফল্য, তা তার সাহায্যেরও ফল।’ বলল জোসেফাইন। কথার শেষ দিকে কান্নায় তার চোখ ভিজে উঠেছিল।
আহমদ মুসার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তারও চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার আলো। বলল, ‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। তার সাহায্যগুলো ছিল অমূল্য, অকল্পনীয়ভাবে তা পেয়েছি। তার প্রতিটি সাহায্যই ছিল আমাদের সাফল্যের এক একটা করে টার্নিং পয়েন্ট। তখন বিস্মিত হয়েছি। মাঝে মাঝেই ভেবেছি, সে তাদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যেকার কেউ ভালো একজন হবেন। কিন্তু সারা জেফারসনের পরিচয় পেয়ে আরও বিস্মিত হচ্ছি, সে তাদের ভেতরের খবরগুলো এত নিখুঁতভাবে কিভাবে পেত!’
‘আমার মনে হয় কি জান, ‘স্মার্থা’ মেয়েটা ‘থ্রি জিরো’র হার্ডকোরের একজন ছিল। স্মার্থা তাদের স্বার্থে গোয়েন্দাগিরি করত আর সারা জেফারসন তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করত। আমার মনে হয়, স্মার্থার গতিবিধি সে অনুসরণ করত।’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু এই কাজটা অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটাই সে তোমাদের স্বার্থে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে গোপন রেখে করেছে। পরিমাপ করতে পার এই ত্যাগের?’ বলল জোসেফাইন।
‘এর পরিমাপ আল্লাহ করবেন। তিনিই মাত্র তাকে এর উপযুক্ত জাযাহ দিতে পারেন। নিঃস্বার্থ যে কাজ তা আল্লাহর জন্যেই হয়। সে এটাই করেছে।’ ধীর ও শান্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও সংগে সংগে জবাব দিল না জোসেফাইন।
মুহূর্ত কয়েক পর ধীরে ধীরে বলল জোসেফাইন, ‘আল্লাহ তো জাযাহ অবশ্যই দেবেন। আল্লাহর বান্দার কাছেও তাঁর প্রাপ্য অবশ্যই আছে। যারা বিনিময় চায় না, তাদের প্রতি দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।’
‘তোমার কথা ঠিক জোসেফাইন। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা শুধু দেয়, নেয় না। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনকেও তারা সহজে গ্রহণ করে না। সারা জেফারসন হতে পারে সে ধরনেরই মানুষ। তুমি যাচ্ছ। ঘনিষ্ঠ হলে তুমিই ভালো বুঝবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি যে ধরনের মানুষের কথা বলেছ, সে ধরনের মানুষ দুনিয়াতে আছে। কিন্তু সারা জেফারসন সে ধরনের মানুষ নয়। তার জীবনের এখন সফলতার শুরু মাত্র। জীবনের সবটাই তার পাবার বাকি। অনেক স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, অনেক কিছুরই কাঙাল সে। আমি দেখেছি, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আহমদ আবদুল্লাহকে সে জড়িয়ে ধরতো, চুমো খেত পাগলের মত। এটা এক বুভুক্ষু হৃদয়ের পরিচয়। তার সাথে আমার যতবার দেখা হয়েছে, বুকে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। এটা সৌজন্যমূলক নয়। তার বুকে আমি বোনের ‍উত্তাপ পেয়েছি, যা অন্তরঙ্গ, একান্ত আপন। এর মধ্যেও রয়েছে হৃদয়ের শূন্যতা পূরণের প্রয়াস। তোমার এসব বোঝার কথা নয়, বুঝবে না। সুতরাং তার সম্পর্কে কোনও শেষ কথা তুমি বলো না। তার ব্যাপারটা ছেড়ে দাও আমার ওপর।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। সারা জেফারসন ভালো মেয়ে। অজ্ঞাতেই আমি তার ক্ষতি করেছি। তুমি যদি তাকে সহজ করতে পার, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পার, তখন সে অতীত ভুলে গিয়ে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরবে সানন্দে, তাহলে শুধু আনন্দিত হওয়া নয়, এক অপরাধবোধ থেকেও মুক্তি পাব জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কণ্ঠ কিছুটা ভারী হয়েছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘দোয়া কর আমি যেন সফল হই।’
আহমদ মুসার বুক থেকে মুখ তুলে বলল জোসেফাইন, ‘ও! ভুলে গেছি। চিঠির সাথে একটা ইন্টারনেট ডকুমেন্ট আছে। সে যখন পাঠিয়েছে, তখন নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু।’
বলেই জোসেফাইন তার ইজি চেয়ারের ওপর থেকে এনভেলাপটি নিয়ে ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করল। কাগজের ভাঁজ খুলে কাগজটার ওপর নজর বোলাল। তিন পৃষ্ঠার একটা লেখা। ওপরে শিরোনাম: ‘গন্তব্য না জানা একটা মেসেজ’। শিরোনামের ওপর হাতের লেখা দু’টি লাইন। হাতের লেখাটা সারা জেফারসনের।
কাগজটি আহমদ ‍মুসার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘একটা মজার শিরোনামের একটা মেসেজ, তুমি পড়।’
আহমদ মুসা তখন ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দু’টিও বন্ধ করেছে। বলল, ‘তুমিই পড় জোসেফাইন। আমি শুনছি। কার মেসেজ, সারা জেফারসনের?’
‘না। সে ফরওয়ার্ড করেছে মাত্র।’
বলেই জোসেফাইন মেসেজের শেষটা দেখে নিল। বলল, ‘মেসেজটি জনৈক ড. আজদা আয়েশার।’
চিঠিটি হাতে নিয়ে জোসেফাইনও ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বলল, ‘পড়ছি, শোন।’
‘প্রথমে সারা জেফারসনের ফরওয়ার্ডিংটা পড়ছি। ফরওয়ার্ডিংয়ে সে লিখেছে, ‘প্রিয় জোসেফাইন, ইন্টারনেটে জনৈক ড. আজদা আয়েশার এই মেসেজটি আমি পাই। আমার কাছে মেসেজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তোমার স্বামী সম্মানিত খালেদ খাকান বিষয়টা আরও ভালো বুঝবেন। তার জন্যেই মেসেজটা পাঠালাম।’
লাইন কয়টা পড়ে একটু থামল জোসেফাইন। বলল, ‘দেখেছ, এই লাইনকয়টাতেও সে নিজেকে কেমনভাবে গোপন করেছে! খালেদ খাকান ছাড়া তোমার আর কোন পরিচয়ই যেন সে জানে না। আর দেখ, ‘তোমার স্বামী’ শব্দ না লিখলেও সে পারত। তার মত ক্ষেত্রে অন্য সবাই ‘তোমার স্বামী’ শব্দ এড়িয়ে যেত, এমন কিছু লেখা তাদের জন্যে কষ্টকর। কিন্তু সারা জেফারসন লিখতে পেরেছে। কারণ, তোমাকে নিয়ে আমার সাথে হিংসা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার লেশমাত্র তার মনে নেই। আশ্চর্য, সে আমাকে হিংসার বদলে বোনের নিবিড় ভালোবাসা দিয়েছে। আর সর্বতোভাবে তোমার থেকে দূরে থেকেছে, সম্পূর্ণভাবে আড়ালে রেখেছে নিজেকে। কত বড় ত্যাগের আদর্শ থেকে এমন মন সৃষ্টি হতে পারে, তা অনেকের জন্যে কল্পনা করাও মুশকিল।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসার কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা না করে পড়তে শুরু করল মেসেজটা:
‘আমি ড. আজদা আয়েশা। একজন টার্কিশ কুর্দি আমি। আমি জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর পিএইচডি করেছি ইতিহাসে। তারপর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার চাকরি করছি। কয়েকমাস আগে আমাদের প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার একটা কাগজে বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, আমার ছোট ভাই আতা সালাহউদ্দিন মাদক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী হিসেবে বিচারের সম্মুখীন। আমার ভাইয়ের জন্যে এ এক অকল্পনীয় অভিযোগ। সঙ্গে সঙ্গেই দেশে চলে এলাম। আমার চোখের সামনেই আমার ছোট ভাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে কারাগারে ঢুকে গেল। দেখা করলাম কারাগারে তার সাথে। তার রুমে মাদকের প্যাকেট রেখে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার ভাইয়ের কথা আমি বিশ্বাস করি। আমার প্রতিবেশী এক যুবকের ক্ষেত্রে এই একই ঘটনা ঘটেছে। জানলাম, আমার এক ক্লাসমেট এভাবেই জেলে গেছে। আমিও আতংক বোধ করছি। এই তিনজন সম্পর্কেই আমি জানি, এরা মাদকসেবী বা মাদক ব্যবসায়ী হতে পারে না। কেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? কি আছে এর পেছনে? আমি খোঁজ নেয়া শুরু করি আমার এলাকাসহ মাউন্ট আরারাতের সমগ্র দক্ষিণ এলাকায়। মাউন্ট আরারাতের দক্ষিণে তুরস্কের যে এলাকা বকের ঠোঁটের মত আর্মেনিয়া, নক্সিভ্যাম ও আজারবাইজানের মধ্যে ঢুকে গেছে, সেটাই আরা আরিয়াস। আমার এলাকা। অনুসন্ধানে আমার আরা আরিয়াসসহ এই এলাকায় গত ছয় মাসে দু’হাজার যুবক ঐ একই ধরনের অপরাধে যাবজ্জীবনের জন্যে জেলে গেছে। আমার গোটা এলাকা প্রায় যুবকশূন্য হয়ে গেছে। আরা আরিয়াস সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পরিবার বিলীন হয়ে গেছে। ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে তারা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নতুন মুখে ভরে গেছে আমার এলাকা। বহু নতুন পরিবার এসে জেঁকে বসেছে এখানে। এরা তুর্কি পরিবার নয়। ভাষার উচ্চারণে এদের আমি আর্মেনীয় মনে করেছি। আতংকিত হয়ে আমি আরও গভীর অনুসন্ধানে নামি। তাতে আমার দু’টি জিনিস মনে হয়েছে, এক. আসল বিষয় মাদক ব্যবসা বা মাদক নয়, বিষয়টা মাউন্ট আরারাতকে কেন্দ্র করে কিছু। নতুন বসতির বাড়িগুলোর প্রত্যেকটা দরজায় মাউন্ট আরারাতের প্রতিকৃতি। ঐ লোকদের অনেকের বাহুতেই দেখেছি মাউন্ট আরারাতের উল্কি। দুই. মাউন্ট আরারাতের দক্ষিণসহ আরা আরিয়াস কুর্দি যারা স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক, তাদের বিরুদ্ধে নীরব ক্যাম্পেইন চলছে। বলা হচ্ছে, এই দালালদের থাকার অধিকার নেই। উল্লেখ্য, মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে যাদের জেলে পুরা হচ্ছে, তারাও এই শ্রেণীর। তার ওপর তাদের ক্রিমিনাল হওয়ার অভিযোগ তো আছেই। আমি বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ও পুলিশের সাথে কথা বলেছি। তারা চোখ বন্ধ করে কথা বলেছে, মাদকের হাত থেকে এলাকাকে মু্ক্ত করার জন্যে ক্রিমিনালদের নির্মূল করা হবে। আর নতুন বসতি স্থাপনকারীদের সম্পর্কে আমার কথা শুনে তো তারা আমাকে বোকা ঠাওরেছে। বলেছে, আমি নাকি জার্মানীতে থাকায় দেশের কোন খোঁজ রাখি না। তারা বলেছে, ওরা নতুন আগন্তুক নয়, ওরা তুরস্কের বৈধ আর্মেনীয় নাগরিক। তুরস্ক-আর্মেনিয়া টেনশন ও কুর্দি বিদ্রোহকালীন বিভিন্ন সময়ে তারা আর্মেনিয়ায় চলে যায়। কিছু দিন আগে আর্মেনীয় তথাকথিত গণহত্যা বিষয়কে ফরগিভ এন্ড ফরগেট করার তুরস্ক-আর্মেনিয়া-মার্কিনীদের মধ্যেকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে মৈত্রী চুক্তির শর্ত হিসেবে উদ্বাস্তু আর্মেনীয় তুর্কিদের ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সুবিধা অনুসারে ওরা ধীরে ধীরে আসছে। তাদের কথা খণ্ডন করার মত যুক্তি আমার নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, তাদের কথাটাই শেষ কথা নয়। কি করব এ নিয়ে যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন একটা ঘটনা ঘটল। সেদিন আমি বাগানে কাজ করছিলাম। বাগানের বাইরে ছেলেরা খেলছিল। মাঝে মাঝে দু’একজন ছেলে বাগানেও আসছিল বল কুড়ানোর জন্যে। বাগানের গাছঘেরা জায়গায় আমি কাজ করছিলাম। দরজাটা সেখান থেকে গাছের একটু আড়ালে পড়েছে। কাজের সময় নড়াচড়াকালে হঠাৎ আমার নজরে পড়ল নয়-দশ বছরের একটা ছেলে আমার বাড়িতে প্রবেশ করল। তার হাতে একটা থলে। কেন প্রবেশ করল? পানি খেতে? কৌতুহলবশত আমিও ছুটলাম। ড্রইং রুমের দরজা খোলা ছিল। এ দরজা দিয়েই সে প্রবেশ করেছে। আমি ভেতরে ঢুকেই দেখলাম, ছেলেটি সোফার কুশন উল্টিয়ে কি যেন রাখছে। আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম, কয়েকটা প্যাকেট কুশনের তলায় রাখা হয়েছে। আমি ধরে ফেললাম ছেলেটিকে। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, প্যাকেটগুলো হেরোইন জাতীয় কোন মাদকের হবে নিশ্চয়। আমি ছেলেটাকে প্যাকেটগুলো হাতে নিতে বলে তাকে পুলিশে দেবার জন্যে নিয়ে চললাম। আমার বাড়ির সামনে রাস্তার বিপরীত দিকেই পুলিশ স্টেশন। আমি বাড়ির সামনের মাঠ পেরিয়ে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম রাস্তা পার হয়ে থানায় যাবার জন্যে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে লোকজন জমে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। লাফ দিয়ে কয়েকজন লোক নামল গাড়ি থেকে। তাদের মুখে মুখোশ। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে ধাক্কা ‍দিয়ে ফেলে দিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে গাড়িতে তুলল। তারপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। যে লোকটি আমাকে ধাক্কা দেয়ার জন্যে আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়েছিল, তার বাহুতে মাউন্ট আরারাতের উল্কি দেখেছি। প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন নিয়ে আমি থানায় গেলাম। থানা আমাকে হতাশ করল। পুলিশ উল্টো অভিযোগ করল, ওরা আপনার ভাইয়ের দলেরই লোক। আপনার বাড়িতে রাখা অবশিষ্ট মাদকের প্যাকেটই তারা নিতে এসেছিল। আমরা দলটাকে খুঁজছি। বিষয়টির গভীরে যেতে চায়নি পুলিশ। ‍ওইদিনই সন্ধ্যায় আমার ড্রইংয়ে ঢোকা সেই ছেলেটির লাশ পাওয়া গেল একটা রাস্তার পাশে। সম্ভবত ধরা পড়ার শাস্তি পেয়েছে ছেলেটি। এই ঘটনা থেকে আমি বুঝতে পেরেছি, আমার বাড়িতে মাদক রেখে আমাকেও জেলে পুরতে চেয়েছিল। আরও বুঝেছি, এই মাদকের সয়লাব গভীর কোন ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। কিন্তু জানি না সেই ষড়যন্ত্র কি? ষড়যন্ত্রকারীদের বাহুতে মাউন্ট আরারাতের উল্কি কেন? এই উল্কি আবার নতুন বসতি স্থাপনকারীদের দরজায় কেন? জানার জন্যে আমি আর কিছু করতেও পারব না। একবার বিপদ থেকে বেঁচেছি। আরও কি বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে! এই দুর্দিনে সাহায্য করার কাউকে দেখছি না, আল্লাহ ছাড়া। তাঁর ওপর ভরসা করেই আমাদের জনগণের এই বিপদ বার্তাটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিচ্ছি। আল্লাহই একে তার ঠিকানায় পৌঁছাবেন, এই আশায়।’ –ড. আজদা আয়েশা, আরা আরিয়াস, টার্কি।
মেসেজটি পড়া শেষ হলো জোসেফাইনের।
চিঠিটা পাশে রেখে তাকাল জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসেছিল ইজি চেয়ারের ওপর।
জোসেফাইনের পড়া শেষ হলেও আহমদ মুসা কথা বলল না। ভাবছিল সে। কোথায় যেন মাউন্ট আরারাতের উল্কি সে দেখেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনের একটা আর্কাইভে একটা প্রাচীন বইয়ে শামিল তাকে আরারাতের উল্কিওয়ালা মানুষ দেখিয়েছিল। বলেছিল, এরা ছিল আর্মেনিয়ার একটা বিপজ্জনক গ্রুপ। বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হোয়াইট ওলফের চেয়ে শতগুণ বেশি হিংস্র ওরা। ওরা নিজেদের মনে করে বাইব্লিক্যাল আর্মেনিয়ার সৈনিক। আর মাউন্ট আরারাত ওদের বেথেলহেম।
এই স্মৃতির মধ্যে আহমদ মুসা গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিল।
জোসেফাইন কিছুটা অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে বলল, ‘অন্য কিছু ভাবছ তুমি?’
চোখ ফিরিয়ে আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘অন্য কিছু নয়। অনুরূপ একটা অতীতের স্মৃতি নিয়ে ভাবছিলাম।’
আহমদ মুসা ইয়েরেভেনের আর্কাইভে দেখা আরারাতের উল্কিওয়ালা সেই বিপজ্জনক লোকদের সম্পর্কে শামিলের কাছে যা শুনেছিল তা বলল।
জোসেফাইন বলল, ‘সেই উল্কিওয়ালারা আর এই উল্কিওয়ালারা কি এক?’ তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি জানি না। এক হলে সেটা বিপজ্জনকই হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা কি চায়?’ জোসেফাইন বলল।
‘এ সম্পর্কে এখনও কিছু শুনিনি। ড. আজদাও তার মেসেজে এ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু লেখেনি।’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন কিছু বলল না। সে ভাবছিল, আজদার চিঠিতে বিষয়টাকে ততটা ভয়াবহ মনে হয়নি, কিন্তু আহমদ মুসা উল্কিওয়ালাদের যে পরিচয়ের কথা বলল, তাতে বিষয়টা একটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলা যায়। এই সাথে একটা উদ্বেগ জোসেফাইনের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তার মানে আহমদ মুসা ড. আজদার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে! বুকের কোথায় যেন একটা প্রবল অস্বস্তি মুখ তুলল। জোসেফাইন আশা করেছিল, এ মিশন শেষ করে তারা একসাথে মদিনায় ফিরছে। আহমদ মুসার রেস্ট দরকার। তার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।
জোসেফাইনের চিন্তা শেষ হলো না।
আহমদ মুসার কথায় তার চিন্তায় ছেদ নামল।
‘তুমি কি ভাবছ জোসেফাইন ড. আজদা আয়েশার মেসেজ নিয়ে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
বুকের কোথায় যেন মুহূর্তের জন্যে সামান্য কাঁপুনি উঠল। কি উত্তর দেবে সে! যে কথা সে বলতে চায়, সে কথা সে বলতে পারে না। এতটা স্বার্থপর সে হবে কেমন করে! তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি তার সাথে আছি।’
‘এতে কিন্তু তোমার মতের প্রকাশ ঘটল না।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
মুখ গম্ভীর হলো জোসেফাইনের। বলল, ‘বিষয়টা গ্রহণ করার মত না হলে সারা জেফারসন মেসেজটা তোমাকে দিত না। মেসেজটা পড়ার পর গুরুত্ব সম্পর্কে আমার দ্বিধা ছিল, কিন্তু তোমার কাছে উল্কিওয়ালাদের পরিচয় জানার পর আমার মনে হচ্ছে, আমাদের জানা এই বিষয়গুলো কোন বিশাল ষড়যন্ত্র বা ঘটনার আইসবার্গ মাত্র এবং সেহেতু ড. আজদার আহ্বানে সাড়া দেয়া অপরিহার্যই মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
হাসল আহমদ মুসা। হাত বাড়িয়ে জোসেফাইনের একটা হাত তুলে নিল নিজের দু’হাতের মুঠোয়। বলল, ‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি যখন কোন কিছুর পক্ষে যুক্তি দাও, তখন সেটা গ্রহণ করা আমার জন্যে শুধু আনন্দের নয়, তা আমার জন্যে শক্তির উৎসও হয়ে দাঁড়ায়। ধন্যবাদ জোসেফাইন তোমাকে।’
বলে জোসেফাইনকে কাছে টেনে নিল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘তোমার বিশ্রাম দরকার ছিল, তা হলো না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।’
‘ভেব না জোসেফাইন। কাজে আমি আনন্দ পাই। আনন্দই বিশ্রাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আনন্দ সবটুকু নয়। রাতের নীরবতা ও ঘুম আল্লাহ দিয়েছেন বিশ্রামের জন্যেই।’ জোসেফাইন বলল।
‘আনন্দ ও রাত দুটোই আমার সাথে থাকছে জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘থাকছে না কিন্তু জোসেফাইন।’ বলে হেসে উঠল জোসেফাইন।
‘এমন সাময়িক বিচ্ছেদ আকর্ষণ বাড়ায়।’ বলে হেসে উঠল আহমদ মুসাও।
‘আর আকর্ষণ বাড়াতে চেও না, তাহলে ছুটি মিলবে না।’ বলে জোসেফাইন আহমদ মুসার বাহুবন্ধন থেকে বেরিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে গেল হাসতে হাসতে। বলল একটু স্বর চড়িয়ে, ‘ওঠো না, কফি আনছি।’

প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে একটি মার্সিডিজ আহমদ মুসাকে নিয়ে বের হচ্ছিল বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা ও জোসেফাইন পাশাপাশি বসেছে। তাদের পেছেনের সীটে বসেছে লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে।
‘ম্যাডাম জোসেফাইন, ব্যালকনিতে মাননীয় প্রেসিডেন্ট ও ম্যাডাম দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।’ বলল পেছন থেকে লতিফা আরবাকান।
লতিফা আরবাকান আহমদ মুসাদের সাথে যাচ্ছে প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর নির্দেশে। আহমদ মুসা মাউন্ট আরারাত অঞ্চলে যাওয়ার জন্যে ভ্যানলেক বিমানবন্দরে নেমে যাবে। লতিফা আরবাকান জোসেফাইনের সাথে মদিনা শরীফ যাবেন। জোসেফাইন যতদিন চাইবেন লতিফা আরবাকান তার সাথে থাকবেন। আহমদ আব্দুল্লাহর খুব ভাব হয়েছে লতিফা আরবাকানের সাথে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা ও জোসেফাইন দু’জন দু’পাশের খোলা জানালা ‍দিয়ে পেছনে তাকাল। দেখতে পেল প্রেসিডেন্ট ও তার বেগমকে।
আহমদ মুসা ও জোসেফাইন দু’জনেই হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, প্রেসিডেন্টের গাড়ি বারান্দায় তখন দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি। আহমদ মুসা তাদের উদ্দেশ্যেও হাত নাড়ল। তারাও হাত নাড়ল।
আহমদ মুসাদের গাড়ি প্রেসিডেন্ট হাউজের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসাদের সামনে ছিল জেনারেল মোস্তফা ও দীর্ঘ অসুখ থেকে সদ্য ফিরে আসা জেনারেল তারিকদের দু’টি গাড়ি। আর আহমদ মুসাদের পেছনের একটা মাইক্রোতে গোয়েন্দা পুলিশের একটা দল।
আহমদ মুসা হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে এগারোটা বাজে। শিডিউলের চেয়ে একটু বেশি সময় গেছে প্রেসিডেন্ট হাউজের অনুষ্ঠানে।
প্রেসিডেন্ট তার বাড়িতে জোসেফাইন ও আহমদ মুসার জন্যে প্রায় ঘরোয়া একটা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। এর আগের দিন আহমদ মুসারা আংকারা এসেছিল প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে। তাদের সাথে এসেছিল গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মোস্তফা এবং জেনারেল তাহির তারিক। প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলি পরিবেশে ঘরোয়া এ অনুষ্ঠানে হাজির ছিল প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, গোয়েন্দা প্রধান ও পুলিশ প্রধান। অনুষ্ঠানে খোদ প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসা ও বেগম আহমদ মুসাকে তার নিজের পক্ষ থেকে ও তুরস্কের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বলেছিল, কিন্তু কোন কৃতজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। আহমদ মুসা উত্তরে বলেছিল, ‘ভাইয়ের জন্যে যে কাজ তা নিজেরই কাজ। নিজের কাজের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা প্রত্যাশা বিব্রতকর। তুরস্ক আমার কাছে একটা স্বপ্নের দেশ। আজ বিদায় বেলায় মনে হচ্ছে, স্বপ্নের এই দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। তাই নিজেকে মনে হচ্ছে আরও সুস্থ, আরও সমৃদ্ধ।’
আহমদ মুসাকেও আবেগ স্পর্শ করেছিল। তার কণ্ঠও ভারী হয়ে উঠেছিল।
অনুষ্ঠান শেষে মাদাম প্রেসিডেন্ট একটা রূপোর কেসকেটে হীরার নেকলেস উপহার দিয়ে ‘মাই ডটার’ বলে জড়িয়ে ধরেছিল জোসেফাইনকে। আর প্রেসিডেন্ট তার ও তার দেশের পক্ষ থেকে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়েছিল আহমদ মুসা, জোসেফাইন ও আহমদ আব্দুল্লাহর জন্যে তুরস্কের নাগরিকত্বের তিনটি সনদ ও তিনটি পাসপোর্ট। আহমদ মুসা ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করেছিল তুর্কি প্রেসিডেন্টের এ রাষ্ট্রীয় দান।
বিদায়ের সময়টা হয়েছিল খুবই আবেগঘন।
আবেগের সে উত্তাপ এখনও অনুভব করছে আহমদ মুসা।
গাড়ি ছুটে চলছিল আংকারা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।