৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

ড. আজদা আয়েশার হাত স্টিয়ারিং হুইলে। দৃষ্টি সামনে।
চলছিল গাড়ি।
আনমনা হয়ে পড়েছিল ড. আজদা আয়েশা। ভাবছিল সে নিজেকে নিয়ে নয় শুধু। তার মাথায় আসছে না তার প্রিয় মাতৃভূমিতে এসব কি হচ্ছে! তার নিজের পরিবারের ওপর যেমন, তেমনি দেশের এই অঞ্চলের ওপর যেন একটা কালোছায়া নেমে আসছে সবকিছু গ্রাস করার জন্যে।
ড. আজদা আয়েশার গাড়ির নাক বরাবর এগিয়ে আসছিল একটা মাইক্রো রং সাইড নিয়ে।
সম্বিত ফিরে পেয়েছিল ড. আজদা আয়েশা। শেষ মুহূর্তে হার্ড ব্রেক কষেছিল সে।
মাইক্রোর সাথে সংঘর্ষ এড়াতে পারল ড. আজদা আয়েশা। সে বিস্মিত হলো, মাইক্রোটা রং সাইড নিয়ে এভাবে তার সামনে এল কেন?
তার মনের এই প্রশ্নের রেশটা না কাটতেই সে দেখতে পেল, মাইক্রো থেকে চারজন লোক লাফ দিয়ে নেমে দু’পাশ থেকে এসে তার গাড়ির দু’পাশে দাঁড়াল।
ড. আজদা আয়েশা কিছু ভাববার আগেই দু’দিক থেকে ওরা গাড়ির দু’পাশের দরজা টান দিয়ে খুলে ফেলল।
চোখের পলকে দু’জন ঝাঁপিয়ে পড়ল ড. আজদা আয়েশার ওপর। টেনে বের করল তারা ড. আজদাকে। তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল মাইক্রোর দিকে। একজন চিৎকার করে বলল, ‘তোর জন্যে আমাদের এক ছেলেকে মরতে হয়েছে। ধরা পড়া কাউকে যেমন আমরা রাখি না, তেমনি যার কাছে ধরা পড়ে তাকেও আমরা দুনিয়াতে রাখি না। আর তোকে আমরা গোরস্তানে নিয়ে মারব।’
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল ড. আজদা আয়েশা। বুঝতে পারছিল না কারা এরা, কেন তার ওপর এই আক্রমণ। কিন্তু ওদের কথা শুনে বুঝতে পারল সব ব্যাপার।
ড. আজদা আয়েশাকে যখন ওরা মাইক্রোতে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিল সে।
ঠিক এই সময়েই একটি জীপ এসে মাইক্রোর সামনে থামল।
পুলিশের জীপ।
জীপে একজন মাত্র পুলিশ। সেই ড্রাইভ করছিল গাড়ি।
জায়গাটা রাস্তার একটা মোড়। গোটা মোড় আলোকিত।
জীপটা দাঁড়াতেই পুলিশটি লাফ দিয়ে নামে গাড়ি থেকে। চিৎকার করে বলল, ‘কে তোমরা? ছেড়ে দাও মেয়েটাকে। হাত তুলে দাঁড়াও।’
ঠিক এ সময় আরেকটি কার এসে দাঁড়াল জীপের পাশে। কার থেকে একজন যুবক এসে দাঁড়াল পুলিশের পাশে।
পুলিশের নির্দেশ শুনে কিডন্যাপকারীরা একসাথেই তাকাল পুলিশের দিকে।
পুলিশটিকে মনে হলো ‍ওদের চেনা। ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওদের একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ইন্সপেক্টর দারাগ! চিন্তা নেই। আমরা হোলি আরারাতের লোক। হোলি আরারাত জিন্দাবাদ।’
কিডন্যাপারদের কথা শোনার সাথে সাথে পুলিশের চেহারা পাল্টে গেল। চোখ দু’টি তার লোভের আলোতে চক্ চক্ করে উঠল।
‘মেয়েটা কে?’ চিৎকার করে বলে উঠল পুলিশ।
‘আতা সালাহ উদ্দিনের বোন। আরেক ড্রাগ ট্রেডার। অশান্তি সৃষ্টি করছিল। আমাদের একজন লোকও আমার হারিয়েছি। অবশেষে আজ হাতে পেয়েছি ইন্সপেক্টর।’ বলল কিডন্যাপারদের একজন।
পুলিশের পাশে এসে দাঁড়ানো যুবকটি কিডন্যাপারদের কথা শুনে চমকে উঠল। ভালো করে তাকাল সে মেয়েটির দিকে। হ্যাঁ, ওরা ঠিক ঠিক বলেছে। আতা সালাহ উদ্দিনের বোন ড. আজদা আয়েশাই তো সে! ভীষণ চমকে উঠল যুবকটি। আজদাকে শয়তানরা কিডন্যাপ করছে!
যুবকটির ভাবনা হোঁচট খেল পুলিশের উচ্চকণ্ঠে। পুলিশ চিৎকার করে বলছে, ‘ঠিক আছে, নিয়ে যাও ওকে। পুলিশের সামনে পড়ো না। অযথা ঝামেলা হয় আমাদের। যাও তাড়াতাড়ি।’
যুবকটি ভীষণ অবাক হলো পুলিশের কথায়। কানকে যেন তার বিশ্বাস হলো না। তাকাল পুলিশের দিকে। পুলিশটি ইন্সপেক্টর লেভেলের একজন অফিসার। অবশ্যই তুর্কি, কিন্তু চেহারায় আর্মেনীয় ছাপ স্পষ্ট। তার মানে, তার মা আর্মেনীয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
যুবকটি পুলিশের কথার প্রতিবাদ করে বলল, ‘মি. অফিসার, আপনি এ কি বলছেন! ক্রিমিনালদের হাত থেকে মেয়েটিকে রক্ষা করা, ক্রিমিনালদের পাকড়াও করা আপনার দায়িত্ব।’
‘তুমি যেখানে যাচ্ছিলে যাও। পুলিশের কাজে নাক গলাতে এসো না। কে ক্রিমিনাল, সেটা পুলিশই ভালো জানে।’
বলেই পুলিশ কিডন্যাপারদের লক্ষ্য করে চিৎকার করে একটা গালি দিয়ে উঠল, ‘শয়তানের বাচ্চারা, এখনও যেতে পারলি না?’
কিডন্যাপাররা টেনে-হিঁচড়ে ড. আজদাকে তাদের মাইক্রোতে তোলার কাজ শুরু করল। আর ‍পুলিশ অফিসারটি তার জীপে ফিরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গেল।
যুবকটি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ চোখ দু’টি তার জ্বলে উঠল। সে আকস্মিকভাবে তার ডান হাত বাড়িয়ে পুলিশ অফিসারের কোমরের রিভলভার বক্স থেকে প্রবল একটা হ্যাঁচকা টানে রিভলভার বের করে নিল। রিভলভার ‍তুলল সে ড. আজদাকে পাঁজাকোলা করে ধরে মাইক্রোর দিকে এগোনোরত কিডন্যাপারদের দিকে। জ্বলছিল তখন যুবকটির দু’চোখ। পরপর সে চারটি গুলি করল।
অব্যর্থ লক্ষ্য যুবকটির।
চার কিডন্যাপারের সবাই কেউ মাথায়, কেউ পিঠে, কেউ বুকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল।
পুলিশ অফিসারটি ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমটায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারপরই সে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল যুবকটির ওপর।
যুবকটি কয়েক ধাপ এগিয়ে রিভলভার তাক করল পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘ওদের মত তুমিও ক্রিমিনাল। বাড়াবাড়ি করলে তোমাকেও গুলি করব।’
কিডন্যাপারদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ড. আজদা আয়েশা কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এসে যুবকটির গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ‍যুবকটি তার বাম হাত ড. আজদার পিঠে রেখে বলল, ‘ভয় পেয়ো না ড. আজদা। ক্রিমিনালদের ভয় কিসের।’
‘কিন্তু আমার জন্যে এই খুনোখুনির মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন কেন ড. মোহাম্মদ বারজেনজো? সময় খারাপ, পুলিশকে তো আপনি জানেন।’ বলল আজদা আয়েশা।
ওদিকে পুলিশ অফিসার থমকে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করে বলল, ‘তুমি পুলিশ অফিসারের রিভলভার ছিনতাই করে চারজন লোককে খুন করেছ, তোমার বাঁচার আশা নেই। রিভলভার নামাও। দাও আমাকে রিভলভার।’
‘না, রিভলভার তোমাকে দেব না। আমার বাঁচার আশা নেই বলেছ, তোমার মত ক্রিমিনালকে আমি বাঁচতে দেব না ভালো লোকদের বাঁচার স্বার্থেই।’
বলে যুবকটি রিভলভারের নল তাক করল পুলিশ অফিসারের দিকে।
পুলিশ অফিসার যখন কিডন্যাপারদের সাথে কথা বলছিল, সেই সময় আরেকটি গাড়ি এসে যুবকটির গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়েছিল। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল একজন মানুষ। কমপ্লিট ‍ইউরোপীয়ান পোশাক। মাথায় হ্যাট। কপাল পর্যন্ত নামানো।
যুবকটির পেছনে দাঁড়িয়ে সব কিছুই সে দেখছিল, শুনছিল।
‘তোমার মত ক্রিমিনালকে আমি বাঁচতে দেব না’ বলে যুবকটি যখন রিভলভার তুলল পুলিশকে লক্ষ্য করে, তখন পেছনের আগন্তুক লোকটি যুবকটির পাশে এসে দাঁড়াল। বলল যুবকটিকে লক্ষ্য করে, ‘রিভলভারটি নামান।’
যুবকটি তাকাল আগন্তুক লোকটির দিকে। দেখল, ঋজু দেহের এক মানুষ। যতটুকু দেখা যাচ্ছে লোকটির চোখ-মুখ ভাবলেশহীন, কিন্তু অসম্ভব দৃঢ় এক ব্যক্তিত্বের ছাপ তার মুখে। তার দু’শব্দের কথাটি শান্ত, কিন্তু তার মধ্যে একটা নির্দেশ আছে, তা যেন অলংঘনীয়। বিস্মিত হলো যুবকটি। রিভলভারের নল নামিয়ে নিল সে বিনা বাক্যব্যয়ে।
সংগে সংগেই পুলিশ অফিসারটি বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ আগন্তুক মহোদয়, এই যুবকটি আমার রিভলভার এক সুযোগে তুলে নিয়ে ঐ চারজন লোককে খুন করেছে। খুনির শাস্তি হতেই হবে।’
বলেই পুলিশ অফিসারটি যুবকটিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘রিভলভার দিয়ে দাও, আর তুমি আন্ডার অ্যারেস্ট। পালানোর চেষ্টা করো না।’
ড. আজদা আয়েশার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এই ভয়ই সে করছিল, খুনের দায় এবার মোহাম্মদ বারজেনজোর ঘাড়ে চাপবে। উদ্বেগ-আতংকে ড. মোহাম্মদ বারজেনজোর কাঁধ আঁকড়ে ধরল ড. আজদা।
‘ধীরে অফিসার, ধীরে। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। আপনি কিডন্যাপারদের পালিয়ে যেতে বলছিলেন কিডন্যাপডকৃত মেয়েটিসহ। আসল ক্রিমিনাল তো আপনি। ড. মোহাম্মদ তো কিডন্যাপারদের হত্যা করে মেয়েটিকে বাঁচিয়েছে।’ বলল আগন্তুক লোকটি।
‘কে বলল, ওরা কিডন্যাপার? খুনকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে মেয়েটি বলবে, ওরা তাকে কিডন্যাপ করছিল, কিন্তু আইনে টিকবে না এই কথা। আমার চোখের সামনে ঘটনা ঘটেছে।’ বলে হো হো করে হেসে উঠল পুলিশ অফিসারটি।
আগন্তুক লোকটির মুখ-চোখ কঠোর হয়ে উঠেছে। বলল, ‘তাহলে মি. অফিসার, আমিও একটা কাহিনী বানাই।’
বলে আগন্তুক লোকটি পকেট থেকে রিভলভার বের করল। তাক করল পুলিশ অফিসারকে। বলল, ‘আমি আপনাকে হত্যা করব। হত্যার পর এই রিভলভারটি মৃত ঐ চারজনের হাতে ধরিয়ে দেব। তারপর ড. মোহাম্মদ বারজেনজো থানায় গিয়ে খবর দেবে, ‘চারজন কিডন্যাপকারী ড. আজদাকে কিডন্যাপ করছিল। পুলিশ অফিসারটি ওদের বাঁধা দিলে ওরা পুলিশ অফিসারকে গুলি করে মারে। আমি পুলিশ অফিসারের পাশে ছিলাম সে সময়। আমি পুলিশ অফিসারের রিভলভার নিয়ে ওদের গুলি করে মারি। কেমন হবে এই কাহিনীটি, অফিসার?’
পুলিশ অফিসার আগন্তুক লোকটির কণ্ঠস্বর এবং তার কপাল বরাবর রিভলভারের নল উদ্ধত দেখে আতংকিত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘পুলিশ অফিসারকে গুলি করতে পার না। পুলিশ মেরে পার পাবে না।’
আগন্তুক লোকটি তার রিভলভার পুলিশ অফিসারকে তাক করে রেখে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল, ‘আমি নয়, প্রমাণ হবে কিডন্যাপকারীরা আপনাকে মেরেছে। তবে আপনার বাঁচার আরেকটা পথ আছে।’
‘কি সেটা?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘ঐ চারজন কিডন্যাপারকে হত্যার দায় আপনাকে নিতে হবে।’ বলল আগন্তুকটি। সেই ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর তার।
‘কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ অফিসারের।
আগন্তুক লোকটি তার রিভলভার পুলিশ অফিসারের দিকে ধরে রেখেই পাশে দাঁড়ানো যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ড. মোহাম্মদ বারজেনজো, আপনি আপনার হাতের পুলিশ অফিসারের রিভলভারটি রুমাল দিয়ে ধরে রুমাল দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলুন এবং রুমাল দিয়ে নলটি ধরে রিভলভারটি পুলিশ অফিসারকে দিয়ে দিন।’
‘কিন্তু রিভলভারে আরও দু’টি গুলি আছে মনে হয়।’ বলল যুবক ড. বারজেনজো।
‘ধন্যবাদ হুঁশিয়ার থাকার জন্যে। কিন্তু ভয় নেই। আমি দেখবো।’ বলল আগন্তুক লোকটি।
ড. মোহাম্মদ বরজেনজো আগন্তুকের নির্দেশ মত রিভলভারটি রুমাল দিয়ে তার হাতের ছাপ ভালো করে মুছে পুলিশ অফিসারের হাতে দিয়ে দিল।
পুলিশ অফিসার রিভলভার হাতে পেয়েই চোখের পলকে রিভলভারের নল ঘুরিয়ে নিল আগন্তুকের লক্ষ্যে। কিন্তু তার রিভলভারের নল থেকে গুলি বেরুনোর আগেই আগন্তুকের হাতের রিভলভার গর্জন করে উঠল। গুলি গিয়ে পুলিশ অফিসারের ডান কাঁধের বাহুসন্ধিস্থলকে বিদ্ধ করল।
রিভলভার পড়ে গেল পুলিশ অফিসারের হাত থেকে।
পুলিশ অফিসারটি বাম হাত দিয়ে কাঁধ চেপে ধরে আর্তনাদ করে বসে পড়ল।
আগন্তুক লোকটি বাম হাত দিয়ে রিভলভার তুলে নিয়ে চারজন কিডন্যাপারের লাশের দিকে ফাঁকা গুলি করে অবশিষ্ট গুলিটা শেষ করল।
পুলিশ অফিসার চিৎকার করে বলল, আগন্তুককে লক্ষ্য করে, ‘ক্ষমার অযোগ্য তোমার এই অপরাধের চড়া মূল্য তোমাকে দিতে হবে। তুমি একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করেছ।’
আগন্তুক লোকটি একটু হাসল। বলল শান্ত কণ্ঠে, ‘কিছুই করতে পারবেন না আমার। একটা নতুন কাহিনী আবার তৈরি হলো। আপনি কিডন্যাপারদের যখন চ্যালেঞ্জ করেন, তখন আমরা আপনার সাথে ছিলাম। কিডন্যাপাররা আপনাকে গুলি করে পালাতে চেষ্টা করে। আমি আপনার হাত থেকে রিভলভার নিয়ে কিডন্যাপারদের গুলি করে মারি।’
পুলিশ অফিসারটি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি বলব, এ কাহিনী ঠিক নয়।’
‘প্রমাণ বলবে, এই কাহিনীই ঠিক। যে রিভলভার দিয়ে আমি আপনাকে গুলি করেছি, এ রিভলভার আমি এখন কিডন্যাপারদের হাতে দিয়ে দেব। এতে থাকবে ওদের একজনের আঙুলের ছাপ।’
একটু থামল আগন্তুক। তারপর আবার বলল সেই ঠাণ্ডা, শান্ত কণ্ঠে পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘অফিসার, আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আমার প্রতি এই কারণে যে, আমি আপনার বুকে কিংবা মাথায় গুলি করিনি।’
আবার থামল আগন্তুক। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘হত্যা একটা জঘন্য কাজ, আত্মরক্ষার ক্ষেত্র ছাড়া। কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়েও কষ্ট করে টার্গেট চেইঞ্জ করে আপনার বাহুসন্ধিতে গুলি করে আপনাকে বাঁচিয়েছি কেন জানেন? ঐ কিডন্যাপারদের পরিচয় আপনি জানেন, সে পরিচয় আপনার কাছ থেকে জানার জন্যে।’
পুলিশ অফিসারের চোখ-মুখ থেকে ক্রোধের ভাব উবে গেল। কিছুটা শান্ত হলো সে। সেও মনে মনে স্বীকার করলো, তার সহজ টার্গেট বুক, মাথায় গুলি না করে বাহু সন্ধির মত ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক টার্গেটে গুলি করেছে নিশ্চয় আমাকে বাঁচানোর জন্যেই। কিন্তু সেই সাথে বিস্ময় এসে তাকে ঘিরে ধরল, কিডন্যাপারদের পরিচয় জানতে চায় কেন সে! আর লোকটি সাধারণ নয়, দারুণ তীক্ষ্ণ ধী-শক্তিসম্পন্ন ও ক্ষীপ্র!
‘কে আপনি? আমি ওদের পরিচয় জানি কি করে বুঝলেন? আর ওদের পরিচয় দিয়েই বা আপনি কি করবেন?’ গড়গড় করে প্রশ্নগুলো করে গেল পুলিশ অফিসারটি।
‘ওরা আপনাকে নাম ধরে সম্বোধন করেছে, আর আপনিও ওদের চিনতে পেরেই ওদের আপনি সুযোগ দিয়েছিলেন মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যেতে।’ বলল আগন্তুক লোকটি।
পুলিশ অফিসার সংগে সংগেই কোন উত্তর দিল না। তার চোখের স্থির দৃষ্টি আগন্তুক লোকটির দিকে। চোখে তার বিস্ময়, আগের সেই ক্রোধ এখন নেই।
কথা শেষ করেই আগন্তুক লোকটি ড. বারজেনজোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আমার রিভলভারটা কিডন্যাপারদের হাতে দিয়ে আসি।’
দু’হাতে দু’রিভলভার নিয়ে এগোলো আহমদ মুসা কিডন্যাপারদের লাশগুলোর দিকে।
ওখানে পৌঁছে আগন্তুক লোকটি নিজের রিভলভারটি ভালো করে রুমাল দিয়ে মুছে একজন কিডন্যাপারের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর ডান হাতে পুলিশ অফিসারের রিভলভার রেখে কিডন্যাপারদের লাশ উল্টে-পাল্টে প্রত্যেকের বাহু দেখে নিল এবং প্রত্যেকের মানিব্যাগসহ সব পকেট হাতড়েও দেখল কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কোন কাগজপত্র পেল না। এমনকি কোন আইডি কার্ডও নয়।
ফিরে এল আগন্তুক লোকটি ড. বারজেনজোদের কাছে।
পুলিশ অফিসার তার বাম কাঁধ চেপে ধরে তখন বসেই ছিল। সে দেখছিল আগন্তুকের কাজকর্ম। আগন্তুক ফিরে আসতেই সে বলল, ‘আপনি প্রত্যেকের বাহুতে কি দেখছিলেন, আর ওদের পকেট-মানিব্যাগেই বা কি খুঁজছিলেন?’
‘ওদের বাহুতে একটা চিহ্ন খুঁজছিলাম এবং মানিব্যাগে ও পকেটে ওদের পরিচয়সূচক কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম।’ আগন্তুক বলল।
‘কেন?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘না, এমনি। পরিচয় সম্পর্কে কৌতুহল আছে। আপনার কাছ থেকেও তো জানতে চেয়েছি।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল আগন্তুক, ‘আপনার পুলিশ কি আসছে লাশ নিতে? আমাদের মানে মি. বারজেনজো ও ড. আজদার কেইস তো রেকর্ড করাতে হবে।’
‘বলেছি, ওরা আসছে। আসলেই আমরা থানায় যাব।’
বলে ডান হাতটা বাড়াতে গিয়ে পুলিশ অফিসারটি বেদনায় কঁকিয়ে উঠল।
তখনও রক্ত ঝরছিল আহত স্থান থেকে।
‘ও! স্যরি। আপনার ওদিকে নজরই দেয়া হয়নি।’
বলে আগন্তুক ছুটল তার গাড়ির দিকে। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল একটা অটো-ব্যান্ডেজ নিয়ে। এগোলো সে পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘অফিসার, ফাস্ট এইড হিসেবে এই ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। আপনি আরাম পাবেন।’
‘এতো মিলিটারিদের ফিল্ড ব্যান্ডেজ! একদম লেটেস্ট। খুব দামি। আপনি এ ব্যান্ডেজ পেলেন কোথায়?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘হ্যাঁ, ব্যান্ডেজটা খুব কাজের। একদিকে রক্ত শুষে নিয়ে আহত জায়গাটা পরিষ্কার করে, অন্যদিকে ব্যান্ডেজটা ক্রেপ শক্তি চাপ সৃষ্টি করে রক্তপাতও বন্ধ করে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ব্যান্ডেজটা একটা ‘মেডিক্যাল কিট’। আহত জায়গার চিকিৎসাও শুরু করে দেয় ব্যান্ডেজটা।’
আগন্তুক কথা বলার সাথে সাথে ব্যান্ডেজের কাজও করছিল।
পুলিশ অফিসারটি বিস্ময়-দৃষ্টিতে দেখছিল আগন্তুককে। এমন অদ্ভুত লোক সে জীবনে দেখেনি। শত্রুতা করেছে, গুলি করে আহতও করেছে বটে। কিন্তু এ বিষয়টা তার কাছে আর বড় বিষয় নয়। তাকে যে সুযোগ পেয়েও হত্যা করেনি, এটাকেই সে বড় করে দেখছে। তারপর এ শুশ্রূষাও প্রমাণ করে, সে হিংসুটে কোন ক্রিমিনাল ধরনের লোক নয়।
অন্যদিকে ড. আজদা ও ড. মোহাম্মদ বারজেনজোর চোখে-মুখে বিস্ময় আর কৌতুহলের বন্যা। আগন্তুককে তাদের মনে হচ্ছে আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা। বু্দ্ধি, ক্ষীপ্রতা, সাহস ও মানবতা সব দিক দিয়েই তাকে ফেরেশতার মত কোন অতি উঁচুস্তরের কেউ মনে হচ্ছে। গুলি করতেও যেমন সে দ্বিধা করেনি, তেমনি আবার সেই আহতের শুশ্রূষাতেও তার কোন জড়তা নেই!
আগন্তুকের কথা শেষ হতেই পুলিশ অফিসার বলল, ‘কিন্তু আপনি এ ব্যান্ডেজ পেলেন কোথায়? যু্দ্ধক্ষেত্রের মত পরিবেশে সেনাবাহিনী এ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করে। সাধারণভাবে এটা ব্যবহারও হয় না, কিনতেও পাওয়া যায় না।’
পুলিশ অফিসারের প্রশ্নের কোন সরাসরি জবাব না দিয়ে বলল, ‘টাকা হলে বাঘের চোখ মেলে।’
ঠিক এ সময় দু’টি পিকআপে পুলিশ এসে গেল।
একটা পিকআপের সামনের কেবিন থেকে লাফ দিয়ে নামল দু’জন পুলিশ অফিসার।
ছুটে এল দু’জন পুলিশ অফিসার। তাদের বসের ব্যান্ডেজ বাঁধা বাহুসন্ধির দিকে একবার ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো স্যার? আর কোন অসুবিধা নেই তো?’
‘আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোমরা ব্যস্ত হয়ো না। তোমরা সুরতহাল করে লাশগুলো ও ‍ওদের মাইক্রোটা নিয়ে চলে এস। আমি যাচ্ছি ওদের নিয়ে। ঐ ভদ্রমহিলাকে ঐ ক্রিমিনালরা কিডন্যাপ করা থেকেই এই ঘটনা ঘটেছে। আমি ওদের কেইসটা রেকর্ড করাই। তোমরা এস।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘জ্বি স্যার, আপনি ওদের নিয়ে যান স্যার। আমরা আমাদের হাসপাতালে টেলিফোন করে রেখেছি স্যার। আপনার রেস্টও দরকার স্যার।’
মুখস্থ কথার মত গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেল একজন পুলিশ অফিসার।
‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তোমরা এস।’ বলল পুলিশ অফিসার রশিদ দারাগ।
‘স্যার, আপনি ওদের থানায় কেইস লেখানো রেখে চলে যাবেন হাসপাতালে।’ বলল সেই পুলিশ অফিসার।
‘হ্যাঁ, আমি ওদের ডিউটি অফিসারের হাতে দিয়েই চলে যাব।’ পুলিশ ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ বলল।
বলেই ইন্সপেক্টর দারাগ গিয়ে গাড়িতে উঠল। একজন পুলিশ উঠল তার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।
আগন্তুক লোকটি, ড. শেখ মোহাম্মদ বারজেনজো এবং ড. আজদা আয়েশা তিনজনেই গাড়ি নিয়ে ফলো করল ইন্সপেক্টর দারাগের গাড়িকে।
থানায় পৌঁছে ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ প্রথমে ডিউটি অফিসারকে দিয়ে নিজের একটি স্টেটমেন্ট রেকর্ড করাল। তাতে সে আগন্তুক লোকটি সর্বশেষে যে কাহিনী দাঁড় করিয়েছিল, সেটাই হুবহু বলে গেল। তারপর ড. আজদাদের বক্তব্য রেকর্ড করতে বলে সে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে তাকাল সে। বলল আগন্তুক লোকটিকে লক্ষ্য করে, ‘ইয়ংম্যান, আপনার নাম জানা হয়নি।’
‘আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।’ বলল আগন্তুক লোকটি।
‘আপনার পরিচয় জিজ্ঞেস করবো না। কারণ নামের মতই একটা কিছু শুনতে হবে। শুধু সাবধান করে দিচ্ছি, সাপের লেজে কিন্তু পা দিয়েছেন, ছোবল খেতে হবে। ড. আজদারা ছোবল খাচ্ছেন। আজকের ঘটনার পর ওদের কি হবে, তা বলার প্রয়োজন নেই। আবার দেখা হবে।’
আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে কথা কয়টি বলে পুলিশ ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ চলে যাচ্ছিল। আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহ তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘শুনুন অফিসার, আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে, ড. আজদারা আরও বড় বিপদে পড়ছেন। এটা বলা কিন্তু আপনাদের দায়িত্ব নয়, দায়িত্ব নাগরিকদের রক্ষা করা।’
পুলিশ অফিসারটি হাসল। বলল, ‘পুলিশরা খুব দুর্বল জীব। কিছু দায়িত্ব তারা পালন করে। সব দায়িত্ব তাদের নয়, সব দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাও তাদের নেই।’
‘সব দায়িত্ব পালনের কথা বলছি না অফিসার। ড. আজদাদের রক্ষার কথা বলছি।’ বলল আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।
‘এ ক্ষমতা পুলিশের নেই দেখতে পাচ্ছি।’ পুলিশ অফিসার দারাগ বলল।
‘কেন?’ জিজ্ঞাসা আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহর।
‘এই ‘কেন’-এর জবাব আমিও সব জানি না।’
বলেই পুলিশ অফিসার তার গাড়ির দিকে এগোলো।
আগন্তুক কণ্ঠ একটু চড়িয়ে বলল, ‘এই ‘কেন’ নিয়ে আপনার সাথে আরও কথা বলতে চাই অফিসার।’
‘আপনার পরিচয় সম্বন্ধেও আমার জানার আছে।’
বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসল পুলিশ অফিসার দারাগ।
পুলিশ অফিসার দারাগ চলে যেতেই থানার ডিউটি অফিসার ড. আজদাদের তাড়া দিল, ‘আপনারা আসুন, কাজটা সেরে ফেলি।’
ড. আজদা, ড. মোহাম্মদ বারজেনজো ও আগন্তুক আবু আহমদ আবদুল্লাহ সবারই বক্তব্য রেকর্ড করল ডিউটি অফিসার।
ডিউটি অফিসার ড. আজদা ও ড. মোহাম্মদ বারজেনজোর পরিচয় পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলছিল, ‘স্যার, আপনাদের দু’পরিবার আমাদের কুর্দি জাতির প্রাণ।’
ড. আজদা ‍ও ড. মোহাম্মদ বারজেনজো চাপ না দেয়া পর্যন্ত চেয়ারে বসেনি।
ড. বারজেনজো বলেছিল, ‘এ পরিবারের কোন সম্মান কি এখন আছে!’
ডিউটি অফিসার বলেছিল, ‘যারা মানুষ তাদের কাছে আছে, তবে কিছু মতলবি মানুষের কাছে নেই। তারা অন্য কিছু চায়, অন্য কিছু করে।’
আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমাদের অফিসার রশিদ দারাগ কি মতলবিদের দলে?’
ডিউটি অফিসার আগন্তুকের দিকে একবার তাকিয়ে একটু ভেবে বলেছিল, ‘তিনি চলমান স্রোতের বাইরে এক পা’ও রাখেন না। তবে তিনি দেশকে ভালোবাসেন। কিন্তু ঝামেলামুক্ত থাকতে চান সব সময়।’
ডিউটি অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়েছিল আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।
জবানবন্দী রেকর্ডের পর তিনজনই বেরিয়ে এল থানা থেকে।
থানা থেকে বের হবার জন্যে পা বাড়িয়ে স্বস্তিতে ভরে গেল ড. আজদার মন। খুনোখুনি ও পুলিশের আচরণের মুখে একসময় তার মনে হয়েছিল, তার মুক্ত জীবনের এখানেই শেষ। তার দুর্ভাগ্যের সাথে ড. বারজেনজো জড়িয়ে পড়ায় আরও মুষড়ে পড়েছিল সে। ড. বারজেনজো ও তার মধ্যে এখনও বড় দূরত্বের দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে, এরপরও বারজেনজো তার জন্যে স্বস্তির একটা আশ্রয়। সেও তার সাথে সাথে খুনোখুনির মত বিপদে জড়িয়ে পড়ায় বুক ভেঙে গিয়েছিল তার। এ সময়ই আল্লাহর মূর্তিমান সাহায্যের মত এলেন আগন্তুকটি। সিচুয়েশন নিজের আয়ত্তে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা, ঠাণ্ডা-শান্ত কথাগুলো তার, কিন্তু তার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে অমোঘ শক্তি। বু্দ্ধি, কৌশল, দূরদর্শিতা কোন ক্ষেত্রে তার ত্রুটি নেই, এরও প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। তার মানবিকতা ও দরদের দিকটাও প্রশংসনীয়। পুলিশ অফিসার নীরব হয়েছে তার ব্যবহারের কারণেই। হঠাৎ তার মনে হলো, আগন্তুকের গাড়িতে সর্বাধুনিক ধরনের ঐ ব্যান্ডেজ ছিল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানা তার কাছে পুলিশ অফিসারের চেয়েও অধিক জরুরি মনে হয়েছে। কিন্তু এর উত্তর সে পায়নি। আলো-অন্ধকারে কপাল পর্যন্ত নামানো ফেল্ট হ্যাটের কারণে আগন্তুক লোকটিকে তখন ভালো করে দেখা যায়নি। তখন তাকে চালাক ধরনের রাশভারী ও দুর্বোধ্য মুখাবয়বের লোক মনে হয়েছিল। কিন্তু থানা-কক্ষের উজ্জ্বল আলোতে ফেল্ট হ্যাট খোলা আগন্তুককে একদমই ভিন্ন মনে হয়েছে। একহারা ঋজু গড়নের অনিন্দ্যসুন্দর এক যুবক সে। তার চেয়ে সুন্দর তার মুখের স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা। এই মানুষ কিছুক্ষণ আগে অমন কঠোর ভূমিকা পালন করেছে, গুলি করেছে পুলিশ অফিসারকে, ভাবতেই কষ্ট লাগে।
থানা থেকে বেরিয়ে তারা তিনজনই এসে তাদের গাড়ির কাছে দাঁড়াল।
দাঁড়াতেই ভাবনার ইতি ঘটে গেল ড. আজদা আয়েশার। ড. আজদা আয়েশা পাশেই কিন্তু একটু দূরত্বে দাঁড়ানো আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, যদিও কোন ধন্যবাদ দিয়েই ঋণ শোধ হবে না, দায় শোধ হবে না, তবু ধন্যবাদ ছাড়া তো আর কিছু নেই দেবার। তাই আপনাকে ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি আল্লাহর সাহায্যের মত এসেছেন।’
ড. আজদার কথা শেষ হতেই ড. বারজেনজো বলে উঠল আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘আরও বেশি ধন্যবাদ আমার পক্ষ থেকে। আপনি আমাকে চার খুনের দায় থেকে মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়েছেন অদ্ভুত বু্দ্ধিমত্তা ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এ ঋণের কোন পরিশোধ নেই মি. আবু আব্দুল্লাহ।’
আগন্তুক আবু আব্দুল্লাহ হাসল। বলল, ‘ড. আজদা যা বলেছেন, আমি যদি আল্লাহর সাহায্য হই, তাহলে তো আমার কোন কৃতিত্ব থাকে না। সবটা কৃতিত্বই আল্লাহর। আপনার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। যাক, এসব কথা আর নয়। এখন তো গৃহে ফেরার পালা, রাত অনেক হয়েছে। ড. আজদাকে কি ড. বারজেনজো পৌঁছে দেবেন?’
ড. বারজেনজো কিছু বলার আগেই ড. আজদা বলে উঠল, আগন্তুক আবু আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমার অনুমান সঠিক হলে আপনি বিদেশী। আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন, কোথায় যাবেন এত রাতে সেটা আমাদের জানা দরকার।’
ড. আজদার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ড. বারজেনজো বলল, ‘ড. আজদা ঠিক বলেছেন। এটাই না আমাদের প্রথম জানা দরকার।’
‘আপনাদের অনুমান সত্য। আমি আংকারা হয়ে ইস্তাম্বুল থেকে এসেছি। ইস্তাম্বুলে এসেছিলাম কয়েক মাস আগে। আজ দুপুরে আপনাদের হ্রদ-শহর ‘ভ্যান’-এ এসে পৌঁছেছি। অসুবিধা নেই, আমি হোটেল বা রেস্টহাউজে জায়গা খুঁজে নেব।’ বলল আগন্তুক আবু আব্দুল্লাহ।
ড. আজদার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়েছিল আবু আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আপনি দুপুরে ‘ভ্যান’-এ পৌঁছে, সন্ধ্যাতেই আরিয়াসে এসে পৌঁছেছেন। তার মানে, আপনার গন্তব্য আরিয়াস।’
‘কেন, আমি আরিয়াস হয়ে অন্য কোথাও যেতে পারি না?’ বলল আবু আব্দুল্লাহ।
‘তা পারেন। আরিয়াস থেকে ইরান, আর্মেনিয়াও যেতে পারেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর ইরান ও আর্মেনীয় সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়। আপনি ইরান বা আর্মেনিয়ায় যেতে চাইলে রাতটা ‘ভ্যান’-এ থেকে সকালে যাত্রা করতেন।’ ড. আজদা বলল।
গম্ভীর হলো আগন্তুক আবু আব্দুল্লাহর মুখ। বলল, ‘আপনার কথা ঠিক। আমি আরিয়াসে এসেছি।’
‘তাহলে আপনি হোটেল খুঁজছেন কেন? আপনি নিশ্চয় ট্যুরিস্ট হিসেবে আরিয়াসে আসেননি। কোন ট্যুরিস্ট এভাবে আসে না। কোথায় এসেছেন আপনি আরিয়াসে?’ দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ড. আজদা।
‘আমার অনুরোধ, কথা আজ এ পর্যন্তই থাক। এখন কোন আলোচনার সময় নয়। পরে অবশ্যই দেখা হবে। এখন ড. আজদা কিভাবে যাবেন, সেটা বলুন। তার একা যাওয়া ঠিক হবে না। শুনেছেন তো পুলিশ অফিসারের কথা, সাপের লেজে পা দেয়া হয়েছে। ওরা নিশ্চয় সংগে সংগেই জেনে গেছে সব ব্যাপার। ওরা প্রতিশোধের জন্যে নিশ্চয় পাগল হয়ে উঠেছে। ড. বারজেনজো ড. আজদাকে বাড়িতে পৌঁছে দিন।’ বলল আগন্তুক আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।
উদ্বেগে পাংশু হয়ে উঠেছে ড. আজদা ও ড. বারজেনজো দু’জনেরই মুখ। প্রতিশোধের জন্যে ওদের পাগল হওয়ার যে কথা আগন্তুক বলেছেন, সেটা তারাও জানে।
শুকনো কণ্ঠে ড. বারজেনজো বলল, ‘আমি ড. আজদাকে পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু একটা সমস্যা আছে আমাদের। আমাদের মানে আমাদের দু’পরিবারের মধ্যে। আমি যেমন ওর সাথে ওদের বাড়ি যেতে পারি না, তেমনি এত রাতে তার বাড়ি ফেরাও তার পরিবার গ্রহণ করবে না।’
বিস্ময় ফুটে উঠল আগন্তুক আবু আব্দুল্লাহর চোখে-মুখে। বলল, ‘কেন, আপনাদের সম্পর্ক কি আপনাদের পরিবার মেনে নিচ্ছে না? প্রবলেমটা কি?’
ড. আজদা ও ড. বারজেনজো দু’জনেরই চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বিব্রত একটা ভাব ফুটে উঠল তাদের চোখে-মুখে।
দু’জনেই মুখ নিচু করেছিল।
মাথা তুলে জবাব দিল ড. বারজেনজো। বলল, ‘প্রবলেম হলো দু’পরিবারের রাজনৈতিক বৈরিতা। ড. আজদার গ্র্যান্ডফাদার মোস্তফা বারজানি বিখ্যাত বামপন্থী নেতা এবং কুর্দি বাম রাজনৈতিক আন্দোলন কুর্দি ডেমোক্র্যাট পার্টির ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। আর আমার গ্র্যান্ডফাদার শেখ মাহমুদ বারজেনজো ছিলেন আধুনিক কুর্দিস্থানের প্রথম রাজা এবং কুর্দি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী নেতা। আর আমার নানা সাইয়েদ নুরসি ‍শুধু কুর্দিস্থান নয়, গোটা তুরস্ক ও ইরানের ধর্মীয় নেতা ছিলেন। আমাদের কনজারভেটিভ পরিবারের সাথে ড. আজদার পরিবারের একটা স্থায়ী রাজনৈতিক বৈরিতা আছে, তাছাড়া আমাদের ধার্মিক পরিবারের সাথে ড. আজদাদের ধর্মনিরপেক্ষ পরিবারের রয়েছে যোজন যোজন মানসিক পার্থক্য। এই সমস্যার কারণে আমাদের সম্পর্কের কথা আমরা পরিবারকে বলার অবস্থাতেও নেই।’ থামল ড. বারজেনজো।
‘আর আপনারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও বিয়ে করতে পারছেন না পরিবারকে বাদ দিয়ে।’ বলল আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।
‘ঠিক তাই। আমরা পরিবারকে মাইনাস করার কথা কল্পনাও করতে পারি না।’ বলল ড. আজদা। ভারি কণ্ঠ তার।
‘বুঝেছি। এই কারণেই ড. বারজেনজো ড. আজদার বাড়ি যেতে পারছেন না। আবার এত রাতে ড. আজদাও একা বাড়িতে যেতে পারেন না, কথা উঠবে। তাহলে উপায় কি এখন?’
‘মি. আবু আব্দুল্লাহ, উপায় আপনিই করতে পারেন। আপনার থাকার জায়গা প্রয়োজন। আপনি ড. আজদার সাথে চলুন। আপনার থাকার জায়গাও হলো আর ড. আজদার সমস্যারও সমাধান হলো।’ বলল ড. বারজেনজো।
ড. আজদার মুখ প্রসন্ন হযে উঠল। যেন অন্ধকারে আলোর সন্ধান পেল। বলল, ‘উনি ঠিক বলেছেন স্যার। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমার বাড়িতে আপনার কোনই অসুবিধা হবে না, ‍যদিও এটা আমাদের গ্রামের বাড়ি। আমার ফুপা-ফুপি এসেছেন গতকাল, আজ মামা এসেছেন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আপনি ভালো সঙ্গও পাবেন স্যার।’
‘আমিও আপনাদের অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারব। চলুন, যাওয়া যাক।’ ড. বারজেনজো বলল।
আবু আহমদ আব্দুল্লাহর ছদ্মনামের আড়ালে আহমদ মুসা মনে মনে খুশিই হলো। সে তো ড. আজদার সন্ধানে ড. আজদার বাড়িতেই যাচ্ছিল। দুপুরে ‘ভ্যান’ লেক-শহরে পৌঁছার পরই আহমদ মুসা আরা আরিয়াস অঞ্চলের নাগরিক তালিকা সার্চ করে ড. আজদা আয়েশার ঠিকানা যোগাড় করেছে। সেই ঠিকানাতেই যাচ্ছিল সে। ‘মেঘ না চাইতেই পানি’র মত সেই বাড়িতেই যাওয়ার সুযোগ হলো তাদের মেহমান হয়ে। বলল আহমদ মুসা, ‘ঠিক আছে, আমার আপত্তি করার কোন ‍যুক্তি নেই।’
‘ধন্যবাদ মি. আবু আব্দুল্লাহ।’ বলল ড. বারজেনজো।
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। চলুন, যাওয়া যাক স্যার।’ বলল ড. আজদা।
সবাই তাদের গাড়ির দিকে এগোলো।
‘ড. বারজেনজো, আপনার সাথে আবার কিভাবে দেখা হবে? আমার কিছু প্রয়োজন আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
ড. বারজেনজো হাসল। বলল, ‘আমার মনেও কিছু প্রশ্ন, কিছু কৌতুহল আছে। আপনার সাথে দেখা হওয়া আমারও প্রয়োজন।’
ড. বারজেনজোর কথা শেষ হতেই ড. আজদা বলে উঠল, ‘আমার তো অনেক কৌতুহল, অনেক প্রশ্ন আছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌, কৌতুহল মেটানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম।’
‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আহমদ মুসা ড. বারজেনজোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তাহলে কিভাবে কোথায় দেখা হচ্ছে মি. বারজেনজো?’
‘ভেবে চিন্তে কাল সকালে ড. আজদার টেলিফোনে জানাব।’ বলল ড. বারজেনজো।
‘ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
সালাম বিনিময়ের পর সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল।
আহমদ মুসা উঠল ড. আজদার গাড়িতে।
আহমদ মুসা তার ভাড়া করা গাড়ি থানা পর্যন্ত পৌঁছে ছেড়ে দিয়েছিল।
চলতে শুরু করল দু’টি গাড়ি।
আগে আজদার গাড়ি, পেছনে ড. বারজেনজোর গাড়ি।