৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

স্বপ্ন দেখছিল আহমদ মুসা।
দেখছিল, দু’জন মুখোশধারী লোক ড. আজদাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ড. আজদা প্রাণপণে ‘স্যার’, ‘স্যার’ বলে চিৎকার করছিল।
‘দাঁড়াও’, ‘দাঁড়াও’ বলে ঘুমের মধ্যেই উঠে বসেছে আহমদ মুসা।
ঘুম ভেঙে গেল তার।
স্বপ্ন নয়, এবার বাস্তবেও ড. আজদার ‘স্যার’, ‘স্যার’ চিৎকার শুনতে পেল সে। একদম তার দরজার সামনে। মনে হচ্ছে, কেউ তাকে তার দরজার সামনে থেকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
আঙ্কারা থেকে বিদায়ের সময় জেনারেল মোস্তফার দেয়া লেটেস্ট ভার্শন এম-১০ মেশিন রিভলভারটি বালিশের তলা থেকে বের করে হাতে নিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল সে।
ডান হাতে রিভলভার বাগিয়ে ধরে বাম হাত দিয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা। আহমদ মুসা দেখতে পেল, তার দরজা সোজা করিডোর দিয়ে দু’জন মুখোশধারী টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ড. আজদা আয়েশাকে।
আহমদ মুসা ওদিকে এগিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে এমন সময় বাঁ দিক থেকে একটা ধাতব শব্দে সেদিকে ফিরে তাকাল। দেখল, তার দিকে রিভলভার তুলেছে একজন মুখোশধারী সন্ত্রাসী। তার রিভলভারের সেফটি ফ্ল্যাসপপিন তোলারই শব্দ পেয়েছে সে। তার মানে গুলি আসছে।
চিন্তার মতই দ্রুত আহমদ মুসা বাম দিকে ফ্লোরের ওপর নিজেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। গুলিটা যেন তার ডান কাঁধ ছুঁয়েই বেরিয়ে গেল। মুহূর্ত সময়ের দূরত্বে মাথাটা বেঁচে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার দেহটা মাটি স্পর্শ করার আগেই তার ডান হাতের এম-১০ রিভলভার গুলি করেছিল সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে যাতে সে দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ না পায়।
তার পাশেই আরেকজন সন্ত্রাসী দাঁড়িয়েছিল। তার রিভলভার তাক করেছিল কয়েকজন ভীতসন্ত্রস্ত নারী-পুরুষকে। তারা ড. আজদার ফুপি, ফুপা, মামা ও মামাতো ভাই-বোনরা হবেন।
ড. আজদার পিতা ইঞ্জিনিয়ার নাফী আগা বারজানী এবং মাতা লায়লা আজদা বারজানী থাকেন সোভিয়েত ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে। সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানীর তিনি একজন শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ার। শোনা যায়, তারা কমিউনিস্ট পার্টি করেন।
আহমদ মুসা দেহটা মাটিতে পড়ার পর দ্বিতীয় গুলিটা করল দ্বিতীয় সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে।
সন্ত্রাসীও রিভলভার উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু তার গুলি করার সুযোগ হলো না। তার আগেই বুকে গুলি খেয়ে ভূমি শয্যা নিল।
যে দু’জন সন্ত্রাসী ড. আজদাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা ড. আজদাকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
তাদের দু’জনের রিভলভারই তাক করেছে আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ঘুরে ওদের তাক করার আগেই ওদের রিভলভার থেকে গুলি শুরু হলো।
আহমদ মুসা ফুটবলের মত দ্রুত গড়িয়ে গুলি যে দিক থেকে আসছে, সেদিকেই এগোলো। ঐদিকেই লাউঞ্জের পাশে করিডোরের প্যারালালে একটা পিলার রয়েছে। পিলারটাই আহমদ মুসার টার্গেট।
পিলারের আড়ালে গিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ওদের গুলি বন্ধ হয়নি।
ওরা গুলি চালাতে চালাতেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে দু’দিক থেকে তাকে টার্গেট করার আগেই ওদের ঠেকাতে হবে, ভাবল আহমদ মুসা
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল স্থির হয়ে দাঁড়ানোর পর দু’পাশের গুলির রেঞ্জ দেখে নিয়ে তার এম-১০ মেশিন রিভলভারের অটোমেটিক ফ্ল্যাসপপিন অন করে ওদের গুলির রেঞ্জ থেকে রিভলভারটা ওপরে তুলে ওদের গুলির শব্দ লক্ষ্যে রিভলভারের নল কৌণিক এ্যাংগেলে স্থির করে ট্রিগার চেপে ধরল তর্জনী দিয়ে।
রিভলভার থেকে অব্যাহত গুলির ঝাঁক বেরিয়ে যেতে লাগল। নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে তার রিভলভারের নল ঘুরতে লাগল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ওদের গুলি থেমে গেল।
চকিতে উঁকি দিয়ে ওদিকে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, দু’জন রিভলভারধারী মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে পেছন দিকে সরে যাচ্ছে। ওরা আহত হয়েছে মনে হলো। কিন্তু ড. আজদাকে দেখতে পেল না আহমদ মুসা। এদিকে নিশ্চয় আসেনি। তাহলে?
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে কি আরও সন্ত্রাসী ছিল? তারা ড. আজদাকে নিয়ে গেছে!
আর ভাবতে পারল না আহমদ মুসা।
সে গুলি করতে করতেই এগোলো গড়িয়ে চলা ওই দু’জনের দিকে। ওদিক দিয়েই বাইরে বেরুবার পথ।
এ সময় ড. আজদার মামা ও ফুপারা ছুটে এল। ওরা চিৎকার করে বলল, ‘দু’জন সন্ত্রাসী ড. আজদার মুখ চেপে ধরে বের করে নিয়ে গেছে এই মাত্র।’
আহমদ মুসা ছুটল বাইরে বেরুবার জন্যে।
সন্ত্রাসী দু’জনের দেহ লাফ দিয়ে ডিঙানোর সময় দেখল, দু’জনের দেহই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। বাইরের বারান্দায় এসে পৌঁছতেই দেখতে পেল, একটা গাড়ি দ্রুত চলে যাচ্ছে। চিৎকার শুনতে পেল ড. আজদার।
উপায় নেই দৌঁড়ে গিয়ে গাড়িকে ধরার।
রিভলভার তুলল আহমদ মুসা। অটোমেটিক ফ্ল্যাসপপিন অন করাই ছিল। ট্রিগার চাপল আহমদ মুসা।
বসে পড়ে মাটির এক ফুট উঁচু দিয়ে মাটির সমান্তরালে গুলি ছুঁড়েছিল আহমদ মুসা।
পেছন থেকে মাইক্রোর টায়ারে গুলি লাগানো খুব কঠিন। তবু তাড়াহুড়োর মধ্যে যা করেছে, এর বেশি কিছু করা যেত না। আল্লাহ ভরসা।
ভরসা ব্যর্থ হলো না। মুহূর্তের ব্যবধান। টায়ার ফাটার বিকট একটা শব্দ হলো।
ছুটল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে।
গাড়িটির গতি বেশি ছিল না। তাই টায়ার ফাটার পর গাড়িটি কয়েকগজ গিয়ে থেমে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে পৌঁছার আগেই মাইক্রোর দু’পাশের দরজা খুলে তিনজন বেরিয়ে এল। এপাশে নেমেছিল দু’জন। দু’জনের হাতে দু’টি স্টেনগান।
তারা নেমেই আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে স্টেনগান তুলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু আহমদ মুসা তার লেটেস্ট মডেলের এম-১০ মেশিন রিভলভার বাগিয়ে ধরেই দৌঁড়াচ্ছিল। শুধু ট্রিগার টিপতেই এক ঝাঁক গুলি গিয়ে ঘিরে ধরল ঐ দু’জনকে।
তৃতীয় জন বেরিয়েছিল ওপাশ দিয়ে। আহমদ মুসা তাকে দেখতে পায়নি।
গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে সে তার রিভলভার তুলেছিল।
তখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ড. আজদাও। সে দেখতে পেয়েছিল গাড়ির আড়ালে দাঁড়ানো লোকটিকে। সে লোকটির রিভলভারের লক্ষ্য দেখেই চিৎকার করে উঠেছিল, ‘গুলি, মি. আবু আব্দুল্লাহ।’
শেষ মুহূর্তেই মুখ তুলেছিল আহমদ মুসা। দেখতে পেয়েছিল লোকটির রিভলভারের নল। কিছুই করার ছিল না। কিন্তু দেহের দুর্বোধ্য সতর্কতা কোন অশরীরী নির্দেশে পলকেই দেহটাকে বাঁকিয়ে নিয়েছিল ডান দিকে।
গুলিটা এসে বিদ্ধ করল আহমদ মুসার বাম বাহুকে।
দেহটা একবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। যেন সে বুকেই গুলি খেয়েছে, এমন অবস্থা নিয়ে সে আছড়ে পড়ল। কয়েকবার কাতরানোর মত দেহটা এদিক-ওদিকে নড়িয়ে স্থির করে ফেলল দেহটাকে। লক্ষ্য, লোকটাকে আড়াল থেকে বের করে আনা।
আহমদ মুসার গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া গাড়ির আড়ালে দাঁড়ানো সন্ত্রাসীও দেখেছে। সে লাফ দিয়ে গাড়ির ওপর দিয়ে এপারে এসে ড. আজদার সামনে দাঁড়াল। তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলল, ‘ওর মত যদি মরতে না চাও তাহলে চল। এক মুহূর্ত দেরি করলে মাথা উড়িয়ে দেব।’
ভয় ও উদ্বেগে কাঠ হয়ে যাওয়া ড. আজদা গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াল যন্ত্রচালিতের মত।
আহমদ মুসা একটা গুলি করল। গুলিটা সন্ত্রাসীটির কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। গুলির উত্তাপ যেন পেল সে।
চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল সন্ত্রাসীটি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল তখন। তার রিভলভার তাক করাই ছিল সন্ত্রাসীটির দিকে। বলল আহমদ মুসা, ‘হাতের রিভলভার ফেলে দিয়ে হাত তুলে…।’
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। সন্ত্রাসী লোকটির রিভলভার বিদ্যুৎ বেগে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে ওপরে উঠল।
আহমদ মুসার কথা বন্ধ হয়ে গেল এবং সাথে সাথেই তার তর্জনী রিভলভারের ট্রিগারে চেপে বসল।
সন্ত্রাসী লোকটি আহমদ মুসার লক্ষ্যে রিভলভার তুলেছিল ঠিকই। কিন্তু ট্রিগার টেপার সময় হলো না। তার আগেই আহমদ মুসার রিভলভারের গুলি তার কপালে এসে বিদ্ধ হলো।
লোকটির দেহ এদিক-ওদিক কয়েকবার দোল খেয়ে খসে পড়ল মাটির ওপর।
ড. আজদা ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসার বাম বাহু রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।
‘স্যার আপনি ভালো আছেন? একি হলো! গুলি লেগেছে আপনার?’ আর্তকণ্ঠে বলে উঠল ড. আজদা আহমদ মুসার কাছে এসে।
ড. আজদার ফুপি, ফুপা, মামা সকলে ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।
ড. আজদার ফুপি কেঁদে উঠে বলল, ‘বেটা যেন সাক্ষাৎ আল্লাহর ফেরেশতা। সে আমাদের আজদাকে আবার বাঁচাল। বাঁচাল আমাদের পরিবারকে। একি হলো তার! কেমন আছ বাছা তুমি!’
আহমদ মুসা হাতের রিভলভার পকেটে রেখে বলল, ‘আমাকে নিয়ে আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমার তেমন কিছুই হয়নি।’ মুখে হাসি নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
ড. আজদারা আহমদ মুসার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হলো। সদ্য গুলিবিদ্ধ একজন মানুষের চেহারা এমন বেদনাহীন, স্বচ্ছ ও হাসিমাখা হতে পারে না। তাহলে কি গুলি লাগেনি! রক্ত কিসের তাহলে!
ওদের কারও মুখেই যেন কথা জোগাল না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ড. আজদাকে লক্ষ্য করে, ‘ড. আজদা, এখনি থানায় টেলিফোন করা দরকার।’
থানার কথা শুনতেই ড. আজদাসহ সকলের মুখে উদ্বেগ নেমে এল। বলল আজদা ভীতকণ্ঠে, ‘স্যার এতগুলো লোক মারা গেল। পুলিশ এলে কি ঘটবে স্যার! খুব ভয় করছে। গত রাতেও ওদের ব্যবহার দেখেছি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এর মধ্যেও গত রাতের কথা আপনার মনে পড়েছে? ভাববেন না। আমি আমার রিভলভার দিয়ে ওদের সাতজনকেই হত্যা করেছি। আমি ওদের এটাই বলব।’
গম্ভীর হলো ড. আজদার মুখ। বলল, ‘তাহলে আমাদের ভাবনাই আমরা ভাবব। আপনার ভাবনা আমরা ভাবতে পারবো না।’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল ড. আজদা।
‘মা আজদা ঠিকই বলেছে। আপনি আমাদের জন্যে সব করলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে। গুলিটা আপনার বাহুতে না লেগে বিপজ্জনক কোন জায়গায় লাগতে পারতো! আপনার কথাই তো আমাদের সবার আগে ভাবতে হবে। আসুক পুলিশ।’ বলল ড. আজদার মামা ড. সাহাব নুরী।
একটু থেমেই সে আবার বলল, ‘আমিই যাচ্ছি পুলিশকে টেলিফোন করতে।’
বলেই সে দ্রুত এগোলো বাড়ির দিকে।
‘পুলিশ যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ আমরা বাইরেই দাঁড়াব। যেখানে যা কিছু যেমন আছে, তেমনি থাকা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা সবাইকে লক্ষ্য করে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা এগোলো গাড়ির পাশে পড়ে থাকা তিনটি লাশের দিকে।
আহমদ মুসা নিহত তিনজনেরই জামার বোতাম খুলে বাহু পরীক্ষা করল। তারপর জামার বোতাম লাগিয়ে দিয়ে ফিরে এল ড. আজদাদের কাছে।
‘আপনি ওদের বাহুতে কি খুঁজলেন? আহত বাহু নিয়ে এসব করছেন কেন? রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি।’ বলল ড. আজদার ফুপা।
ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি একজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী। বিরাট সম্পত্তির মালিক। ইদানীং তিনি আংকারায় ব্যবসা করছেন। সেখানেও তিনি বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘পুলিশ এসে পড়লে ঐ অনুসন্ধান করা যেত না। আমি ওদের দেহে একটা চিহ্ন খোঁজ করছিলাম।’
‘চিহ্ন? কি চিহ্ন?’ বলল ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। একটু গাম্ভীর্য নেমে এল চোখে-মুখে। বলল, ‘বড় বড় অনেক গ্যাং-এর দেহে দলীয় চিহ্ন থাকে। সেরকম কোন দলের লোক কিনা ওরা, সেটাই দেখলাম।’
ড. আজদার ফুপা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় দু’টি হেডলাইট ড. আজদাদের বাগানের গেট পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছিল।
থেমে গেল ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি।
‘নিশ্চয় পুলিশ আসছে।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল সন্ত্রাসীদের মাইক্রোর ঠিক পেছনেই।
পুলিশের দু’টি গাড়ি। একটা জীপ, অন্যটি একটা ক্যারিয়ার।
জীপ থেকে নামল লোকাল থানার অফিসার ইনচার্জ। ক্যারিয়ার থেকে লাফ দিয়ে নামল কয়েকজন পুলিশ।
ড. আজদার বাড়ির সামনের লন-কাম-বাগানটিতে বিদ্যুতের ‍দু’টি খুঁটি। গোটা বাগানই আলোকিত। গাড়ি বারান্দাতেও আলো। তার ফলে বাড়ির দেয়াল সবটাই আলোতে ঝলমল করছে।
মাইক্রোর একটু সামনেই দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা ও ড. আজদারা।
পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নামলে ড. আজদা ও তার মামারা পুলিশ অফিসারের দিকে এগোতে লাগল।
পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান কয়েক গজ এগিয়ে ড. আজদাদের সামনে এসে ড. আজদাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনিই তো ড. আজদা, ইঞ্জিনিয়ার নাফী আগা বারজানির মেয়ে? আপনাকেই কিডন্যাপের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে?’
‘হ্যাঁ অফিসার।’ বলল ড. আজদা।
‘আপনার সাথে এরা কারা?’ পুলিশ অফিসার ওকালান বলল। তার চোখে সন্ধানী দৃষ্টি।
ড. আজদা মামা, ফুপা সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিল। আর আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, ‘আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। আমার মেহমান।’
সেই সাথে ড. আজদা গত রাতে তাকে কিডন্যাপের চেষ্টার ঘটনাও বলতে গেল।
‘আমি সে ঘটনা জানি মিস বারজানি। আমাকে জোনাল পুলিশ থেকে সব জানানো হয়েছে। তাহলে আপনার এই মেহমানই গত রাতে আপনার সাথে জোনাল পুলিশ অফিসে গিয়েছিলেন?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘জ্বি হ্যাঁ। ঘটনার সময় চলার পথে উনিও সেখানে দাঁড়ান। ইন্সপেক্টর দারাগ সব জানেন।’ ড. আজদা বলল।
‘কালকের ঘটনা জানেন, তবে সব জানেন না। উনি তো এ এলাকার লোক নন।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘এখানে তিনটি লাশ আর চারটি লাশ কোথায়?’
‘আর চারটি লাশ ভেতরে।’ বলল ড. আজদার মামা ড. সাহাব নুরী।
‘চলুন, দেখব।’ পুলিশ অফিসার বলল।
‘আসুন।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
চলার জন্যে পা তুলে পুলিশদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাদের দু’জন আমার সাথে এস। আর অবশিষ্টরা বাইরে পাহারায় থাক। গাড়ি, লাশগুলো, হাতিয়ার যা যেমন যেখানে আছে তেমনই থাকবে।’
মাত্র জনাচারেক পুলিশ ছাড়া সবাই পুলিশ অফিসারের সাথে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে ঢুকে ডান পাশে ড্রইংরুম ও বাম পাশে গেস্টরুমের মাঝে করিডোরটা পেরোলেই বেশ বড় একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের অন্য তিন দিক দিয়েও ঘর। আবার দু’তলায় ওঠার সিঁড়িও এই লাউঞ্জ থেকেই। সন্ত্রাসীরা পানির পাইপ বেয়ে ছাদে উঠেছিল। তারপর চিলে-কোঠার তালা ভেঙে দু’তলায় প্রবেশ করেছিল। দু’তলায় তিনটি মাস্টার বেড আছে। তার একটি থেকে ড. আজদাকে ধরে নিয়ে লাউঞ্জে নেমে পালানোর চেষ্টা করেছিল। লাউঞ্জের পূর্ব প্রান্তের গেস্টরুম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল আহমদ মুসা।
লাল কার্পেটে মোড়া লাউঞ্জটা বলতে গেলে ফাঁকাই। গুচ্ছাকারে সাজানো কয়েকটা সোফা সেট রয়েছে মাত্র।
বাইরের লাশগুলো যেভাবে দেখেছে, সেভাবে এ লাশগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখে পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান বলল, ‘এরা যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরা খুন হয়েছে তিন পর্যায়ে। প্রথমে লাউঞ্জে সিঁড়ির গোড়ায়, তারপর লাউঞ্জের এ প্রান্তে করিডোরের মুখে। সর্বশেষে বাইরে গাড়ির কাছে।’
কথাগুলো শেষ করেই পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করল ড. আজদাদের দিকে চেয়ে, ‘কথিত সন্ত্রাসীরা ড. আজদাকে কিডন্যাপ করার আগে আপনারা কে কোথায় ছিলেন?’
জবাব দিল ড. আজদা। বলল, ‘দু’তলায় আমার আব্বা যে মাস্টার বেডে থাকতেন, তার কাছাকাছি ফ্যামেলি গেস্টরুমে ছিলেন আমার ফুপা-ফুপি। আমার ভাইয়ের মাস্টার বেডটায় ছিলেন আমার মামা। আমি ছিলাম আমার মাস্টার বেডে। আর নিচতলার গেস্টরুমে ছিলেন আমাদের মেহমান জনাব আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।’
‘কথিত সন্ত্রাসীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন লাউঞ্জে নামার পর। তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন নিচ থেকে। তার মানে আপনাদের মেহমান আবু আহমদ আব্দুল্লাহ ড. আজদাকে রেসকিউ করতে এগিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের তিন পর্যায়ের যে হত্যাকাণ্ড তা তিনিই কি করেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান।
সংগে সংগে প্রশ্নের উত্তর এল না কারও কাছ থেকেই। ড. আজদা তাকাল তার মামা, ফুপা ও আহমদ মুসার দিকে।
উত্তর দিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার অনুমান সত্য অফিসার। সব সন্ত্রাসীকে হত্যা আমিই করেছি।’ স্বচ্ছ, সাবলীল কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘সন্ত্রাসীরা বোধ হয় আপনাকে দেখেই তাদের হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়েছিল! আর সেই সুযোগে ধীরে-সুস্থে দেখে-শুনে আপনি তাদের হত্যা করেছেন।’ বলল পুলিশ অফিসার। তার কণ্ঠে বিদ্রুপের সুর।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ বিষয়টা আপনারাই ভালো জানেন। ক্রিমিনালদের ডীল করাই আপনাদের প্রাত্যহিক কাজ।’
মুখটা গম্ভীর হলো পুলিশ অফিসারের। কিন্তু উত্তরে কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল পুলিশ অফিসার। বলল দু’জন পুলিশকে লক্ষ্য করে, ‘তোমরা এই লাউঞ্জে পাহারায় থাক। সবকিছু যেমন আছে, তেমন থাকবে।’
তারপর তাকাল ড. আজদাদের দিকে। বলল, ‘আপনারা কেউ কোথাও যাবেন না। এই ঘরেই অপেক্ষা করবেন। আরারাত রিজিওন ইজডির একজন শীর্ষ পুলিশ অফিসার ‘ডাইরেক্টর অব পুলিশ’ খাল্লিকান খাচিপ এখনি এসে পড়বেন। গোটা বিষয়টা তিনিই দেখবেন। আমি এর মধ্যে বাইরেটা একটু ঘুরে দেখি।’
বলে পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান বেরিয়ে গেলেন।
লাউঞ্জের দু’পাশে দু’জন পুলিশ তাদের হাতের স্টেনগান নিয়ে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
কয়েকটা সোফায় কাছাকাছি বসে আছে ড. আজদারা।
ড. আজদাদের মুখ বিষণ্ণ। তাদের কারও মুখে কোন কথা নেই।
তাদের সকলের মনেই ঘটনার পরিণতি নিয়ে তোলপাড় চলছে।
কিন্তু আহমদ মুসার চোখে-মুখে কোন ভাবান্তর নেই। পুলিশ অফিসার তার উদ্দেশ্যে যে তীর্যক কথাগুলো বলেছে, তাতে বরং মজাই পেয়েছে আহমদ মুসা। কিন্তু আরারাত রিজিওন ইজডির পুলিশ অফিসারের ‘খাল্লিকান খাচিপ’ নামের এই শেষ অংশ ‘খাচিপ’ তার মনে একটা ধাক্কা দিয়েছে। ‘খাল্লিকান’ শব্দ টার্কিশ, কিন্তু ‘খাচিপ’ শব্দটি যতদূর তার মনে পড়ছে আর্মেনীয়। আহমদ মুসা আর্মেনিয়া থাকার সময় একদিন গিফটশপে সেলসম্যানের কাছে একজনকে ‘খাচিপ’ চাইতে শুনেছিল। সেলসম্যান তাকে একটি ছোট ক্রস দিয়েছিল। আহমদ মুসা তার আর্মেনীয় সাথীকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিল, ‘খাচিপ’ অর্থ ‘ছোট ক্রস’। তবে এই প্রাচীন আর্মেনীয় শব্দ নাকি এখন প্রায় ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
কিন্তু প্রাচীন ‘খাচিপ’ মানে ‘ছোট ক্রস’ এই শব্দটি এই পুলিশ অফিসারের নামের সাথে কেন? এ শব্দের কি কোন ভিন্ন টার্কিশ অর্থ আছে!
এই ভাবনাতেই বুঁদ হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
বুটের আওয়াজ তুলে মোস্তফা ওকালানসহ কয়েকজন পুলিশ অফিসার ভেতরে প্রবেশ করল, তখনই সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা।
ড. আজদারা সবাই পুলিশ অফিসারদের স্বাগত জানাল।
পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালানের পাশের অপেক্ষাকৃত লম্বা গড়নের ভিন্ন রকমের পুলিশ অফিসারকে দেখে বুঝল, সেই হবে ‘ইজডির’ রিজিওনের ‘ডাইরেক্টর অব পুলিশ’ (ডিওপি) খাল্লিকান খাচিপ।
ড. আজদাদের কাছাকাছি হয়েই সেই পুলিশ অফিসার খাল্লিকান খাচিপ ড. আজদাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনাদের নিয়ে এসব কি হচ্ছে মিস আজদা? আপনারা কুর্দিস্থান ও তুরস্কের বিখ্যাত ও সম্মানিত একটা ফ্যামেলি। এই ফ্যামেলির মুখে আপনারা চুনকালি মেখে দিলেন। আপনার ভাই আতা সালাহ উদ্দিন বারজানি ড্রাগ ব্যবসা করে জেলে গেলেন। আর আপনাকে নিয়ে একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা। ভাগ-জোক নিয়ে এসব আপনাদের ইনফাইটিং নয় তো? যারা মারা গেছে, আপনারা যারা বেঁচে আছেন সবাই কি এক দলের? এমন প্রশ্ন উঠছে কারণ ড্রাগ ব্যবসা ব্যাপক হওয়ার আগে এ ধরনের ঘটনা আরিয়াস, ইজডির কেন গোটা তুরস্কেও ঘটেনি।’
ভয় ও বিব্রতকর অবস্থা ড. আজদার। কোন কথাই সে বলতে পারলো না।
ড. আজদার ফুপা কামাল বারকির চোখে প্রতিবাদের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। বলল সে, ‘কিন্তু অফিসার, আমাদের কথা না শুনে, ঘটনা ভালো করে না জেনেই তো আপনি মন্তব্য করছেন।’
অসন্তোষের ভাব ফুটে উঠল ডিওপি খাল্লিকান খাচিপের চোখে-মুখে। বলল, ‘আমি শুনে এবং জেনেই কথা বলছি জনাব। আরও বলতে চাই, ড্রাগ সিন্ডিকেটের এই ইনফাইটিং-এ আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে হায়ার করে আনা হয়েছে।’
কথা শেষ করেই ডিওপি খাল্লিকান খাচিপ থানার ইনচার্জ মোস্তফা ওকালানকে বলল, ‘আপনি সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ফেলুন তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি লাশগুলো ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে আমরা এদের সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ অফিসে নিয়ে যেতে চাই।’
আবার ড. আজদার দিকে ডিওপি খাল্লিকান খাচিপ তাকাল। বলল, ‘আপাতত আপনাকে ও আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে আমরা গ্রেফতার করছি। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে ড্রাগ ব্যবসায় ও ড্রাগ সিন্ডিকেটে যদি আপনাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকে, তাহলে আপনারা সম্মানের সাথে ছাড়া পেয়ে যাবেন।’
উদ্বেগ-আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ড. আজদা ও অন্যদের মুখ।
পুলিশ অফিসারের এমন সরাসরি ও নগ্ন পক্ষপাতিত্বমূলক হস্তক্ষেপে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। বলল ডিওপি খাল্লিকান খাচিপকে লক্ষ্য করে, ‘তুরস্কের আইনে কি বাদী ও আসামীকে একসাথে গ্রেফতার করতে হয়? আক্রান্ত ও আক্রমণকারীকে কি একচোখে দেখতে হয়?’
যেন চাবুকের একটা বড় ঘা খেল ডিওপি খাল্লিকান খাচিপ। একটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আহমদ মুসার দিকে তীব্র কণ্ঠে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যে রিভলভার দিয়ে এদের হত্যা করেছেন, সে রিভলভার কোথায়?’
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলভার বের করে ডিওপি খাল্লিকান খাচিপকে দেখাল।
ভ্রূকুঞ্চিত হলো ডিওপি খাচিপের। বলল ত্বরিত কণ্ঠে, ‘এ রিভলভার আপনি পেলেন কোথায়? পুলিশও এ রিভলভার পায়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়া সাধারণের কাছে এটা বিক্রির প্রশ্নই ‍ওঠে না। নিশ্চয়ই লাইসেন্স নেই এ রিভলভারের।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। জ্যাকেটের পকেট থেকে একখণ্ড কাগজ বের করে এগিয়ে দিল ডিওপি খাচিপের দিকে।
ডিওপি খাচিপ কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বোলাল। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘স্টেট সিকিউরিটি সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার থেকে পারমিশন ইস্যু হয়েছে? ওখানে কি আপনার লোকজন আছে? কিংবা কাগজটা নকল নয়তো?’
‘সেরকম মনে করলে সেখানে একটা টেলিফোন করুন না। টেলিফোন নাম্বারটা তো আছেই।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখটা চুপসে গেল পুলিশ অফিসারের। তাকাল একবার সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘টেলিফোন করার প্রয়োজন নেই। কোন কিছু নিশ্চিত করার পুলিশদের নিজস্ব পদ্ধতি আছে।’
ডিওপি খাল্লিকান খাচিপের কথার মাঝখানেই লোকাল থানা ইনচার্জ মোস্তফা ফিরে এলেন। ডিওপি খাচিপের কথা শেষ হতেই সে বলল, ‘স্যার, সুরতহাল রিপোর্ট কমপ্লিট।’
‘আলামতগুলো সব নেয়া হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা ডিওপি খাচিপের।
‘জ্বি, লাশগুলোও সব নেয়া হয়েছে।’ বলল থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালান।
ডিওপি খাচিপ থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল ড. আজদাদের দিকে। বলল, ‘তাহলে ড. আজদা ও মি. আবু আহমদ, আপনাদের যেতে হবে আমাদের সাথে।’
‘কোথায়?’ ড. আজদা কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল কথাটা।
‘আমার অফিসে খুব বড় ঘটনা এটা। আপনাদের স্টেটমেন্ট নিতে হবে।’
‘আমরা যাব থানায়। মামলা দায়েরের জন্যে। মামলার বিবরণীতে আমাদের সব কথা এসে যাবে। আমাদের স্টেটমেন্ট লাগবে না। এরপরও স্টেটমেন্ট নিতে চাইলে এখানেই নিতে হবে।’
মুহূর্তের জন্যে ভ্রূকুঞ্চিত হলো ডিওপি খাল্লিকান খাচিপের। ভাবনার একটা ছায়াও ফুটে উঠল তার মুখে। বলল, ‘আপনি যা বলছেন সেভাবেও হয়। আমি মনে করেছিলাম, আপনারা গেলে কেস নিয়ে আরও কথা হতো। আর সরকারিভাবেও তো কেস হচ্ছে, আপনাদের কেস করার দরকার আছে কি?’
‘সরকারি কেস এক ধারায়, আমাদের কেস হবে ভিন্ন ধারায়। সরকারি কেসের মূল কথা হবে, কিডন্যাপের চেষ্টা এবং এ চেষ্টা করতে গিয়ে ৭ জন কিডন্যাপার খুন, এ কিডন্যাপের মোটিভ কি, আর এর পেছনে আর কে আছে ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের কেসের মূল বক্তব্য হবে, আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এ পরিবারের ছেলে ড্রাগট্রেডের মিথ্যা অভিযোগে জেলে আছে। বাড়িতে ড্রাগ লুকিয়ে রেখে ড. আজদাকে ফাঁসাতে চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু যে ড্রাগ রাখতে এসেছিল, সে ধরা পড়ে যায়। তাকে থানায় নেয়ার পথে তাকে ষড়যন্ত্রকারীরাই হত্যা করে যাতে তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়া ছেলেটি ফাঁস করে না দেয়। এরপর ড. আজদা ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা গত সন্ধ্যায় এবং আজ রাতে আবার আক্রান্ত হয়েছেন। এ ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু এ পরিবার নয়, আরিয়াস-আরারাত এক কথায় আরারাত সন্নিহিত গোটা ইজডির প্রদেশের হাজার হাজার পরিবারের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র চলছে। হাজারো তরুণকে ড্রাগ ট্রেডার সাজিয়ে জেলে পুরা হয়েছে। শতশত পরিবার বিরান হয়ে গেছে অথবা এই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। এই ব্যাপারে এই পরিবার এবং এই এলাকার পক্ষ থেকে সরকারের আশু তদন্ত ও আইনি প্রতিকার চাওয়া হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার এই কথাগুলো বিস্ময়কর কোন কাহিনী ডিজক্লোস করার মত সকলের মনে তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল।
ডিওপি খাল্লিকান খাচিপের চোখ-মুখ যেন অনেকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। উদ্বেগের চিহ্নও আছে তার মধ্যে। আর থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে ড. আজদার মামা ও ফুপাদের চোখে বিস্ময় ও কৌতুহল। কিন্তু অপার বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে ড. আজদা। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তার, তার পরিবার ও তার অঞ্চলের একথাগুলো আবু আহমদ লোকটি জানল কি করে! শুধু জানা নয়, সে কথাগুলো মামলা দায়েরের ভাষায় এমনভাবে সাজিয়ে বলল, যা সে নিজেও কখনো কল্পনা করেনি। এ ধরনের কেস যে এই সময় করা যায়, সেটাও তার মাথায় নেই। কিন্তু লোকটির মাথায় এল কি করে! কে এই লোক? ড. আজদা আহমদ মুসাকে যতই দেখছে ততই যেন দেখার আগ্রহ বাড়ছে। কে এই বিস্ময়কর লোকটি?
ডিওপি খাচিপ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বলল, ‘আপনি এসব কি বলছেন? এ ধরনের অভিযোগ কখনও কেউ আমাদের কাছে করেনি।’
‘এবার অভিযোগ পাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
এবার হাসল ডিওপি খাচিপ। পুরোপুরিই নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। বলল, ‘ভালো! কেস দায়ের করুন। আপনার ভাষা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি তুর্কি নন। আপনি রিভলভারের লাইসেন্স কিভাবে পেয়েছেন আমি জানি না। আপনি কিভাবে এদেশে আছেন সেটাও জানি না। আমি দেখব এসব। কিন্তু বেশি ঝামেলা করলে আপনিও বিপদে পড়বেন।’
বলে উঠে দাঁড়াল ডিওপি খাল্লিকান খাচিপ। থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালানকে বলল, ‘চল, এখানকার কাজ শেষ।’
কথা শেষ করেই হাঁটতে শুরু করল খাচিপ।
থানা ইনচার্জ ওকালান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা শুনছিল। সেও যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াবার সময় ড. আজদাকে বলল, ‘আপনারা এখন আসতে পারেন।’
ড. আজদা তাকাল আহমদ মুসার দিকে সিদ্ধান্তের জন্যে।
‘চলুন।’ আহমদ মুসা বলল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল ড. আজদাও।
ড. আজদার মামা-ফুপারাও উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘মামা, ফুপা-ফুপি, আপনারা এ দিকটা দেখুন। আমরা থানা থেকে আসছি।’
ড. আজদার মামা, ফুপুরা ড. আজদার কথায় সায় দিল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা ও ড. আজদারা পুলিশের সাথে।

নাস্তার পর একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আহমদ মুসা এল লাউঞ্জে।
ড. আজদা, তার মামা ও তার ফুপা-ফুপুরা আগেই এসে বসেছিল লাউঞ্জে।
কথা বলছিল তারা আহমদ মুসা মানে তাদের মেহমান আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে।
ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি ড. আজদাকে লক্ষ্য করে শুরুতেই বলেছিল, ‘লোকটি আসলে কে আজদা? আমি আমার জীবনে এমন বিস্ময়কর মানুষ দেখিনি। শুধু অস্ত্রের যুদ্ধে অবিশ্বাস্যভাবে শত্রুকে পরাজিত করাই নয়, কথার যুদ্ধে প্রদেশের শীর্ষ পুলিশ অফিসারকে যেভাবে পরাজিত করেছে, আমাদের মামলার বিষয়টাকে সে যেভাবে সাজাল তা বিস্ময়কর। আগন্তুক বলে মনেই হলো না। যেন সেই এ বাড়ির কর্তা, সব জানে সে। এটা কি করে সম্ভব!’
কামাল বারকি থামতেই কথা বলে উঠেছিল ড. সাহাব নুরী। সে বলে, ‘উনি না থাকলে আজ কি ঘটত, তা ভাবতেও বুক কাঁপছে। আর উনি বুদ্ধি দিয়ে পুলিশ অফিসারকে কোণঠাসা করতে না পারলে আজদাকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যেতে হতো এবং নানা নাজেহালের শিকার হতে হতো।’
ড. আজদা ভাবছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। এ ধরনের মানুষের কথা কল্পনাই করা যায়, বাস্তবে দেখবে, এমন আশাও কেউ করে না। কিন্তু আশাতীত ঘটনা, আর আশাতীত মানুষকেই সে দেখছে। সত্যি কে এই লোক? কোত্থেকে হঠাৎ তার বিপদের সময় হাজির হলো?
ড. সাহাব নুরীর কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর কথা বলেছিল ড. আজদা। বলেছিল সে, ‘মামাজি, ফুপাজি, উনি কে আমিও জানি না এখনো। আসলেই উনি একজন বিস্ময়কর মানুষ। গত সন্ধ্যার সব কথা তো আপনাদের বলা হয়নি। উনি উপস্থিত না থাকলে, উনি ব্যাপারটাকে ট্যাকল না করলে আমাকে খুনের কেসে জড়াতে হতো। ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ সন্ত্রাসীদের পক্ষ হয়ে মিথ্যা কাহিনী তৈরি করেছিল, যাতে আমি খুনের আসামী হয়ে যাই। পুলিশের মিথ্যা কাহিনীর মোকাবিলায় আবু আহমদ আব্দুল্লাহ সাহেবও আমাকে বাঁচানোর জন্যে একটা কাহিনী তৈরি করেছিলেন এবং ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগকে বলেছিলেন, যদি এ কাহিনী রশিদ দারাগ মেনে না নেয়, তাহলে পুলিশ রশিদ দারাগকে মেরে ফেলে প্রমাণ করবেন, সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইন্সপেক্টর দারাগ নিহত হবার পর তিনি ঐ চারজন সন্ত্রাসীকে মেরেছেন রশিদ দারাগের রিভলভার দিয়ে। ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ আবু আহমদ সাহেবকে গুলি করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ পুলিশ অফিসারের কাঁধে গুলি করে এবং বলে যে, আমি আপনাকে বুকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু মারিনি। আশা করি সত্যটা মেনে নেবেন। না হলে মারার সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারি। বলে রিভলভার তুলেছিল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে। অবাক ব্যাপার, হঠাৎ যেন পুলিশ অফিসার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে! তখন কি ভেবে পুলিশ অফিসার আমাদের সহযোগিতা করেন। সেজন্যে আমি বেঁচে যাই।’
ড. আজদার মামা ও ফুপা-ফুপিরা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল ড. আজদার কাহিনী শুনে। ভাবছিল, লোকটি কি অদ্ভুত! তার কি কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে? মামা ড. সাহাব নুরী বলেছিল অবশেষে, ‘পুলিশ অফিসার খাল্লিকান খাচিপকে আবু আহমদ সাহেব তার রিভলভারের যে লাইসেন্স দেখিয়েছিলেন, তা ইস্যু হয়েছে স্টেট সিকিউরিটির হেড অফিস থেকে। হেড অফিস থেকে এ ধরনের যে লাইসেন্স ইস্যু হয়, তা বিশেষ ধরনের এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে ইস্যু করা হয়। কিন্তু এই আবু আহমদ কে যে, তার জন্যে এটা করা হলো!’
কিছু বলতে যাচ্ছিল ড. আজদা। দেখতে পেল, আবু আহমদ আব্দুল্লাহ লাউঞ্জে প্রবেশ করছে। থেমে গেল ড. আজদা। উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। সামনে সোফা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন স্যার। আমরা আপনার অপেক্ষা করছি।’
সবাইকে সালাম দিয়ে সোফায় বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসতেই ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আমরা কৃতজ্ঞ জনাব আবু আব্দুল্লাহ। আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আজদাকে আজ যে দেখা যাচ্ছে, সেটা আপনার কারণেই।’
‘এটা কি আমাকে বিদায় দেয়ার অনুষ্ঠান? বিদায় দেয়ার সময় এভাবে মানুষ কৃতজ্ঞতা জানায়।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই ড. আজদা ছুটে গিয়ে দু’হাত জোড় করে আহমদ মুসার পায়ের কাছে কার্পেটের ওপর বসল। বলল, ‘আমাদের ভুল বুঝবেন না স্যার। আমাদের কথার অর্থ ওটা নয়, প্লিজ। আমার এবং আমার পরিবারের যিনি ত্রাতা, তার সম্পর্কে কি কেউ এমন করে ভাবতে পারে?’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যরি ড. আজদা। আমার কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন আপনি। আমি একটু রসিকতা করছিলাম।’
ড. আজদা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, রসিকতা যেটা বলেছেন, সেটার ভারও বহন করার সাধ্য আমাদের হৃদয়ে নেই।’
‘স্যরি ড. আজদা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মাফ করবেন স্যার।’ বলে ড. আজদা উঠে গিয়ে তার আসনে বসল।
আহমদ মুসা ড. আজদার ফুপা কামাল বারকিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব, কৃতজ্ঞতা আমাকে নয়, কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার আল্লাহকে। আমি আপনাদের এই আরিয়াসকে চিনি না, এখানে আমার স্বজনও নেই, এখানে আমার নিজের কোন প্রয়োজনও ছিল না, তাহলে আমি এখানে এলাম কেন? কিভাবে এলাম? এর জবাব আমার কাছে একটাই, সেটা হলো, আল্লাহ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তারপর গত সন্ধ্যা থেকে আজ পর্যন্ত এখানে যা ঘটল, তা আমার কোন পরিকল্পনার অংশ নয়। গত সন্ধ্যা এবং রাতের দু’ঘটনায় আমি যা করেছি, তা আমার ইচ্ছায় হয়নি। আমাকে দিয়ে তা করানো হয়েছে। করিয়েছেন আল্লাহ। আমি মহান আল্লাহর একটা হাতিয়ার মাত্র। সুতরাং কৃতজ্ঞতা আপনাদের মহান আল্লাহকেই জানানো দরকার। তিনিই আমাকে এনেছেন, আমাকে দিয়ে এসব করিয়ে নেয়ার জন্যেই। তিনিই আপনাদেরকে আমার নতুন স্বজন বানিয়েছেন। হৃদয়ের সব কৃতজ্ঞতা তার দিকেই ধাবিত হওয়া দরকার।’ থামল আহমদ মুসা।
কারও কাছ থেকে কোন কথা এল না।
ড. আজদা, তার মামা ড. সাহাব নুরী, তার ফুপা কামাল বারকি এবং ফুপি লায়লা কামাল সবাই নীরব। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময় ও আবেগের একটা স্ফূরণ। হঠাৎ করেই তাদের মুখের ভাব, চোখের দৃষ্টি যেন গলিত মোমের মত অনেকটা নরম হয়ে গেছে। কারও কারও চোখে সেই দৃষ্টিতে একটা অপ্রস্তুতের ভাবও।
আহমদ মুসার কথাগুলোতেও একটা আবেগ ছিল। কথার শেষের দিকে তার কণ্ঠও ভারি হয়ে উঠেছিল।
অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙল ড. আজদার ফুপি লায়লা কামাল।
লায়লা কামালের বয়স ষাটোর্ধ্ব হবে। এই বয়সেও তার মেদহীন একহারা চেহারা। বোঝাই যায়, নিয়মিত উনি ব্যায়াম করেন এবং সম্ভবত ডায়েট কন্ট্রোলও করেন। চোখে তার দামী চশমা। নিয়মিত প্রসাধন ব্যবহার করেন, মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। পরনে আধুনিক পোশাক। ড. আজদার পরনে সালোয়ার কামিজসহ মাথায়-বুকে ওড়না থাকলেও মিসেস লায়লা পরেছেন ট্রাউজার ও শার্ট।
লায়লা কামালই নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘বেটা, তুমি আমাদের স্বজন বলেছ, আমরা তোমাকে পর ভাবতে পারি না। তুমি শুধু অসম সাহসী এবং সব দিক থেকে যোগ্যতাসম্পন্নই নও, বেটা তুমি খুব ভালো ছেলেও। কিন্তু বেটা, তুমি যাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে বলেছ, তিনি তো আমাদের জীবনে নেই। আজদার বাবা মা’র মত আমরাও কমিউনিস্ট পার্টি করতাম। কমিউনিস্ট পার্টি এখন আমরা ঐভাবে না করলেও সেই আদর্শে বিশ্বাস করি। যে নেই, তাকে কৃতজ্ঞতা জানাব কি করে?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘স্রষ্টা আপনার, বা আপনাদের জীবনে নেই বলেছেন। কিন্তু কোথাও নেই-এ কথা বলেননি। আসলে স্রষ্টা আছেন।’
‘আছেন স্রষ্টা, এ কথা আপনি বলছেন কি করে?’
‘আমি বলছি না, মানুষ, মানুষের ইতিহাস এ কথা বলছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা ড. আজদার ফুপি লায়লা কামালের।
‘মানুষের জীবনের শুরু আছে এবং শেষও আছে। তাই মানুষ সৃষ্ট। সৃষ্ট বলে তার স্রষ্টাও আছে। আর একটা কথা, মানুষও তার জন্যে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস সৃষ্টি করে। এগুলোর মধ্যে কোনটিই মানুষের জন্যে আপনা-আপনি সৃষ্টি হচ্ছে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মানুষ যেসব জিনিস তৈরি করে, সেক্ষেত্রে না হোক, প্রাকৃতিক জগতে তো সবকিছুই আপনা-আপনি সৃষ্টি হচ্ছে, কাউকেই তো সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সব জীবন ও বস্তুর মধ্যে সৃষ্টিগত ঐকতান আছে। এক আইন, একই দর্শন রয়েছে সব সৃষ্ট বস্তু ও জীব-জীবনের মূলে। এর অর্থ, এসব কোন কিছুই আপনা-আপনি সৃষ্টি নয়, একক এক স্রষ্টার সজ্ঞান পরিকল্পনা ও আইন কাজ করছে সৃষ্টি জগতের মূলে। আপনা-আপনি সৃষ্টি হলে সব বস্তু ও জীবের সৃষ্টিগত দর্শন ও আইন এক রকম হতো না। হতো ভিন্ন ভিন্ন।’ আহমদ মুসা থামল।
কিন্তু অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না লায়লা কামাল। গভীর একটা ভাবনার প্রকাশ তার চোখে-মুখে। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘কিন্তু স্রষ্টা নিজেকে আড়ালে রাখার কারণ কি? বিভ্রান্তি তো এখানেই।’
‘স্রষ্টা নিজেকে আড়ালে রাখেননি। আমরা তাঁকে দেখতে পাই না মাত্র। এটা আমাদের সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতা। যেমন, আপনি আপনার প্রয়োজনে রোবট তৈরি করলেন। রোবটটি আপনি যেমন চান সেভাবে কাজ করবে। কিন্তু তার চোখ আপনাকে দেখবে না, জানবে না এবং বুঝবে না যে, কে তার স্রষ্টা। এটা রোবটের সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতা।’ আহমদ মুসা বলল।
সূক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে লায়লা কামালের মুখে। বলল, ‘আমরা রোবটকে বানাই নির্দিষ্ট কাজের জন্যে। কিন্তু আমাদের কাছে স্রষ্টা কি চান?’
‘রোবটের স্রষ্টা হিসেবে মানুষ এবং মানুষের ‘স্রষ্টা’র মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মানুষ রোবট সৃষ্টি করে তার প্রয়োজনে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্যে। কিন্তু মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ অভাবশূন্য, প্রয়োজনশূন্য। তিনি কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। মানুষের কোন কাজের দ্বারা ‍উপকৃত হবার জন্যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেননি। বরং বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তিনি মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্যে। সূর্যের আলো মানুষ ও জীবজগতের জন্যে প্রয়োজন। সূর্য ‍ও পৃথিবীর পারস্পরিক আকর্ষণের ভারসাম্য পৃথিবীর কক্ষপথের স্থিতির জন্যে অপরিহার্য। চাঁদের আলো মানুষ, জীব ও উদ্ভিজ্জের জন্যে দরকারী। এইভাবে পৃথিবীর আলো, বাতাস, জীব-উদ্ভিজ্জ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবকিছুই মানুষকে তার জীবনধারণে সাহায্য করছে। রোবটের স্রষ্টা মানুষ এবং মানুষের স্রষ্টা আল্লাহর মধ্যে এটাই পার্থক্য। মানুষ স্বার্থপর, তাই তার সৃষ্ট রোবটের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করে, কিন্তু মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ মানুষের কাছে কোন উপকার চান না, নেন না। আর সে প্রয়োজনও মানুষের স্রষ্টার নেই।’
ড. আজদা, তার মামা ড. সাহাব নুরী এবং ফুপা কামাল বারকি আহমদ মুসার কথাগুলো যেন গোগ্রাসে গিলছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা।
আর ড. আজদার ফুপি লায়লা কামালের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা থামতেই সে বলে উঠল, ‘তাহলে স্রষ্টা কষ্ট করে মানুষকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য কি? কোন কাজে না লাগলে, কোন স্বার্থ পূরণ না হলে তিনি মানুষ সৃষ্টি করবেন কেন? করেছেন কেন?’
‘ধন্যবাদ। আপনার এ প্রশ্নটি চিরন্তনী একটা প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জবাব স্বয়ং স্রষ্টা আল্লাহ আল-কুরআনের বহু জায়গায় অনেকভাবে দিয়েছেন। তার একটি হলো: তিনি বলেছেন, ‘আমি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছি দেখার জন্যে যে, কে ভালো কাজ করে।’ অর্থাৎ আল্লাহ চান যে, মানুষ মন্দ কাজ না করে ভালো কাজ করুক। মানুষ কি করে এটাই তিনি দেখতে চান। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য তাঁর এটাই।’
ড. আজদার ফুপু লায়লা কামালের মুখে সূক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘অর্থাৎ তিনি মানুষকে পরীক্ষা করতে চান। তোমার কথায়, তিনি চান মানুষ ভালো কাজ করুক। তুমি নিশ্চয় আরও বলবে যে, ধর্ম মানে আল-কুরআন যে ভালো কাজ করার নির্দেশ ‍দিয়েছে, তা-ই। আর মানুষকে সে কাজ করতে হবে। কুরআন তো মুসলমানদের। কিন্তু আমরা আলোচনা করছি গোটা মানবজাতি নিয়ে। ভালো কাজের পরীক্ষা আল্লাহ তাদের কাছ থেকে কিভাবে নেবেন, যারা কুরআন দেখেনি বা চেনে না কিংবা একে গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি? স্রষ্টার পক্ষের ‘পরীক্ষা’র যে ইউনিভার্সেল তত্ত্বের কথা তুমি বললে, তার মধ্যে তো এরা পড়ে না। যাদের পরীক্ষা করা হবে, তারা তো পরীক্ষার বিষয় মানে কোনটাকে ‘ভালো’ বলা হয়েছে, আর ‘মন্দ’ই বা কি কি, তা তাদের জানা দরকার।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ প্রশ্ন বা এ অজুহাত যাতে কোন মানুষের পক্ষ থেকেই উঠতে না পারে, তার জন্যে ব্যবস্থা কিন্তু স্রষ্টা আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সাথে সাথেই করে দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আল্লাহ স্বভাবজাত একটা সাধারণ নীতিবোধ দিয়েছেন, সে নীতিবোধ থেকে সভ্যতা বা লোকালয় থেকে অনেক দূরে গহীন কোন জংগলে জন্মগ্রহণকারী এবং জঙ্গলেই বেড়ে উঠা একজন মানুষও বলতে পারে, মানুষকে ‘সাহায্য করা’ ভালো কাজ, ‘চুরি করা’ মন্দ কাজ। বলতে পারে, মানুষকে ‘ভালোবাসা’ ভালো কাজ, ‘গালি দেয়া’ মন্দ কাজ। বলতে পারে, পিতা-মাতাকে ‘মান্য করা, সম্মান করা’ ভালো কাজ, ‘অবাধ্য হওয়া’ মন্দ কাজ। বলতে পারে, একজন পথহারাকে ‘পথ দেখানো’ ভালো কাজ, তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার ‘ক্ষতি করা’ মন্দ কাজ। এভাবে মানুষের মধ্যে স্রষ্টার দেয়া ‘নীতিবোধ’ থেকে মানুষের মধ্যে স্বভাবজাতভাবেই ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’-এর দীর্ঘ তালিকা তৈরি হয়ে থাকে। এর ভিত্তিতেও স্রষ্টা আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নেবেন যে, মানুষ মন্দ হতে দূরে থেকে কতটা ভালো কাজ করে।’ থামল আহমদ মুসা।
ড. আজদার ফুপি লায়লা কামালের চোখে-মুখে একটা ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে। তার চোখের একটা মুগ্ধ দৃষ্টিও আহমদ মুসার প্রতি নিবদ্ধ। কিন্তু পরক্ষণেই তার ঠোঁটে একটা রহস্যপূর্ণ হাসি দেখা গেল। বলল সে, ‘ধন্যবাদ বেটা! তুমি একটা কঠিন প্রশ্নের একটা সুন্দর ও সহজ উত্তর দিয়েছ। কিন্তু উত্তর হিসেবে যে বিষয়টা বলেছ, তা অত্যন্ত ভারি। এর মধ্য দিয়ে একটা চিরন্তন দর্শন সামনে এসেছে। কিন্তু বেটা, এ দর্শন প্রমাণ করছে, ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ বেছে নেয়ার দায়িত্ব মানুষের স্বভাবজাত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাহলে নবী-রাসূল ও ধর্মগ্রন্থের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি কিন্তু তোমার নিজের ফাঁদেই নিজে পড়ে গেছ বেটা।’ বলেই হেসে উঠল লায়লা কামাল।
একটু উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ভালো ও মন্দ বেছে নেয়ার ক্ষমতা মানুষের স্বভাবজাত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নবী-রাসূল অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েন না। এর সহজ একটা দৃষ্টান্ত হলো, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক সব দিক দিয়েই প্রতিটি মানুষ তাত্ত্বিকভাবে স্বশাসিত হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সমাজ শৃঙ্খলা, সমাজ পরিচালনা, জাতি ও দেশের সামষ্টিক রক্ষার প্রয়োজনে সরকার ও শাসকের প্রয়োজন। কারণ, সমাজ ও জাতি দেহে বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং তার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে ধ্বংস ডেকে আনার শক্তি সমাজে প্রবল। সরকার ও শাসক এই শক্তির প্রতিরোধ করে। অনুরূপভাবে, মানুষের ‘নীতিবোধ’-এর বিপরীতে মানুষের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি প্রবণতার প্রবল শক্তি। প্রতিটি মানুষের এই ‘নীতিবোধ’ ও তার দুর্নীতি প্রবণতার মধ্যে বিরামহীন সংগ্রাম চলছে। যেহেতু ‘নীতিবোধ’-এর চাইতে ‘দুর্নীতি প্রবণতা’র মধ্যে মানুষের লাভ ও লোভ-লিপ্সা চরিতার্থের সীমাহীন সুযোগ রয়েছে, তাই দুর্নীতির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়। ফলে মানুষকে যে পরীক্ষার জন্যে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সে পরীক্ষায় অধিকাংশের ফেইল করার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এ কথা যে ঠিক, মানুষের ইতিহাস তার সাক্ষী। স্রষ্টার পরীক্ষায় মানুষের ফেইল করার অর্থ, দুনিয়ার জীবনে অশান্তি, বিপর্যয় এবং আখেরাতের জীবনে এর পরিণতি হিসেবে সীমাহীন শাস্তি। মানুষ এই ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পথে যাতে না যায়, এজন্যে দয়াময় আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে মানুষকে সাহায্য করার জন্যে যুগে যুগে নবী–রাসূল পাঠান সতর্ককারী হিসেবে, ‘নীতিবোধ’-এর প্রতি আহ্বানকারী হিসেবে। তাদের মাধ্যমে পাঠানো হয়, ‘ভালো’র দিকে আহ্বান ও ‘মন্দ’র প্রতি নিষেধের সুস্পষ্ট নীতিমালা, যাকে প্রচলিত ভাষায় আমরা বলি ধর্মগ্রন্থ, যেমন আল-কুরআন। সুতরাং মানুষের স্বভাবজাত নীতিবোধ যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি নবী-রাসূলদের আগমন ও ধর্মগ্রন্থের উপস্থিতি। মানুষর স্বভাবজাত নীতিবোধের সাথে তার স্বভাবজাত (শয়তান পরিচালিত) দুর্নীতি প্রবণতার চিরন্তন লড়াইয়ে মানুষের বিজয় অর্জনের হাতিয়ারই হলো নবী-রাসূল এবং তাদের মাধ্যমে আসা ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং, নবী-রাসূল ও তাদের মাধ্যমে আসা ধর্মগ্রন্থ অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং দুর্নীতিজাত ইহকালীন ধ্বংস-বিপর্যয় ও পরকালীন সীমাহীন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যে, স্বভাবজাত নীতিবোধকে বিজয়ী করার জন্যে এবং স্রষ্টার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্যে নবী-রাসূল ও তাদের মাধ্যমে আসা ধর্মগ্রন্থ মানুষের জন্যে অপরিহার্য।’
হাসি ও বিস্ময়-বিমুগ্ধতায় ভরে গিয়েছিল লায়লা কামালের চোখ-মুখ।
ড. আজদা ও তার মামা ড. সাহাব নুরী ও ফুপা কামাল বারকির চোখে-মুখেও অপার বিস্ময়-বিমুগ্ধতা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই লায়লা কামাল উঠে দাঁড়াল। কোমর বাঁকিয়ে মাথা নুইয়ে আহমদ মুসাকে ইউরোপীয় ঢংয়ে বাউ করে বলল, ‘বেটা, তুমি আমার সন্তানতুল্য। কিন্তু তুমি কাজ করেছ আমার গুরুর মতো। এভাবে ‘বাউ’ করা ছাড়া তোমাকে শ্রদ্ধা জানানোর এই মুহূর্তে আর কিছু আমি পেলাম না। তুমি আমার হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা গ্রহণ করো বাছা। আমি তোমার প্রতিটি কথা গ্রহণ করলাম। সেই সাথে মাফ চাইছি আমি স্রষ্টা আল্লাহর কাছে। আমি তাঁকে, তাঁর রাসূল(সাঃ)-কে, তাঁর বাণী(কুরআন)-কে চিনতে পেরেছি।’ লায়লা কামালের শেষ কথাগুলো আবেগ-ভরা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বসে পড়ল লায়লা কামাল।
‘উনি যা বলেছেন, সেটা আমারও কথা। বিস্ময়কর আপনি! অল্প কথায় অদ্ভুতভাবে আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। ভাবনার এদিকটা কোনদিন কল্পনাও করিনি। আপনি আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।’ প্রায় একসাথেই বলে উঠল ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি ও মামা ড. সাহাব নুরী।
অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল ড. আজদার দু’চোখ থেকে। তার আনন্দ যে, তার পরিবারে যে পরিবর্তন সে চাচ্ছিল, সে পরিবর্তন যেন আকস্মিকভাবেই ঘটে গেল। আজ যদি তার আব্বা-আম্মা এখানে উপস্থিত থাকতেন! আহমদ মুসার প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ল তার সমগ্র হৃদয়। অপরূপ এই মানুষ! বন্দুক হাতে যেমন অতুলনীয়, শান্তির বার্তাতেও তেমনি অভাবনীয় এক কুশলী মানুষ। আল্লাহর প্রতি সেজদায় অবনত হতে চাইল তার মাথা। আল্লাহ কোত্থেকে আনলেন অপরূপ সুন্দর, অসীম সাহসী, অকল্পনীয় কুশলী এই মানুষটিকে!
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার মুখ। ড. সাহাব নুরী ও কামাল বারকির কথা শেষ হলে আহমদ ‍মুসা বলল, ‘আমি আবারও বলছি, আপনার সব কৃতজ্ঞতা, সব প্রশংসা আল্লাহর প্র্তি হওয়া উচিত। তাঁর এবং রাসূল(সাঃ) –এর শেখানো কথারই কয়েকটা বলেছি মাত্র। মহান আল্লাহ আপনাদের কবুল করুন।’
বলেই আহমদ ‍মুসা তাকাল ড. আজদার দিকে। বলল, ‘আপনার চোখের অশ্রু মুছে ফেলুন ড. আজদা। আপনি কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে। আপনার চোখে থাকতে হবে অশ্রুর বদলে সংগ্রাম ও শক্তির আগুন।’
‘জনাব, এ অশ্রু আনন্দের, যা পাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারিনি তা পাওয়ার এই অশ্রু। আপনি শুধু আমার জীবন বাঁচিয়েছেন তা-ই নয়, আমার পরিবারকেও আপনি নতুন জীবন দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল ড. আজদা।
ড. আজদা থামতেই তার ফুপু লায়লা কামাল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলব বেটা।’
‘বলুন’। বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না বাছা। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তোমার পরিচয়। তুমি আমাদেরকে বিমুগ্ধ, বিস্মিত ও চমৎকৃত করেছ।’
‘আমার সম্পর্কে কি বলব! আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। মদিনা শরীফে আমার একটা ঠিকানা আছে। সেখানে আমার স্ত্রী ও একটি ছেলে আছে। স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে আমি ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলাম একটা কাজে। কাজ শেষে ইস্তাম্বুল থেকে আংকারা হয়ে এখানে এসেছি। তুরস্কের একটা বিশেষ বিমান ভ্যান এয়ারপোর্টে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে মদিনা শরীফে গেছে। আমি এসে…।’
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই কামাল বারকি বলে উঠল, ‘কিন্তু বিশেষ বিমান কিভাবে পেলেন? কে দিল?’
আহমদ মুসা একটু বিব্রত হলো। কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। একটু ভাবল আহমদ মুসা। মিথ্যা বলে কি লাভ! বলল সে, ‘আপনাদের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বিমানটি পেয়েছিলাম।’
কামাল বারকি, ড. সাহাব নুরী, লায়লা কামাল, ড. আজদা সবাই চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত, আমাদের প্রেসিডেন্ট তাকে বিশেষ বিমান দিয়েছেন! বলল লায়লা কামাল, ‘বুঝতে পারছি না, প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিমান কেন দিলেন তোমাকে? কে তাহলে তুমি, সেটাই আমাদের প্রশ্ন।’
‘আমার অনুরোধ আপনাদের সবাইকে, এ ধরনের কোন প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না এখন। আমি যাবার সময় সব প্রশ্নের উত্তর আপনাদের দিয়ে যাব। প্লিজ, আমাকে আপনারা সহযোগিতা করুন।’
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কামাল বারকি বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি যা ভালো মনে করেন, সেটাই হবে। আপনি যেন কি বলতে যাচ্ছিলেন, বলুন।’
কামাল বারকির কথা শেষ হতেই ড. আজদা বলে উঠল, ‘অন্য সব কথা থাক, একটা বিষয় তো বলা যায়। স্যার, আপনি ভ্যান বিমানবন্দরে নামলেন কেন? কেনই বা অখ্যাত আরিয়াসে এলেন? আর এসেই জড়িয়ে পড়লেন আমাদের ঘটনায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেখা যাচ্ছে, আপনি এখানকার ভেতরের পরিস্থিতির অনেক কিছুই জানেন। গোটা বিষয় কি কাকতালীয়, না এর কোন ব্যাখ্যা আছে?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, আমি এই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম।’
এইটুকু বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটা গাম্ভীর্য তার চোখে-মুখে। বলল, ধীর কণ্ঠে, ‘ড. আজদা আয়েশা, আমি আপনার আহ্বানেই এখানে এসেছি। আপনার…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই ড. আজদার মামা ড. সাহাব নুরী বলল, ‘আজদার আহ্বানে!’
অন্য সবার চোখে-মুখেও বিস্ময়।
বিস্ময়ে ‘হাঁ’ হয়ে গেল আজদার মুখ। বলল সে, ‘স্যার, আমার আহ্বানে আপনি এসেছেন! কিন্তু গতকাল সন্ধ্যার আগে তো আমি আপনাকে চিনতাম না! আর কোন আহ্বানই তো আমি কাউকে জানাইনি!’
আহমদ মুসা হাসল। জ্যাকেটের পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ ড. আজদার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ড. আজদা হাত বাড়িয়ে কাগজটি নিল। খুলল কাগজের ভাঁজ। শুরু করল পড়া।
কয়েক লাইন পড়েই চোখ তুলল ড. আজদা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আমার ওয়েবসাইটে দেয়া আমার একটা আপীল এটা। আমার ওয়েবসাইটে পেয়েছেন?’
‘আমি ওয়েবসাইট দেখিনি। আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী মহিলা আমার স্ত্রীর মাধ্যমে এ মেসেজটি আমার কাছে পাঠান বিষয়টিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করব এই ভেবে। সত্যিই বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ নিচু করেছিল ড. আজদা আয়েশা। আহমদ মুসার কথা শেষ হলে মুখ তুলল সে। তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরা। বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর। অসীম দয়ালু তিনি। আমি মনে করছি, আমার আপীল তিনি সবচেয়ে উপযুক্ত হাতে পৌঁছিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।’
বলে ড. আজদা তাকাল ফুপির দিকে। বলল, ‘ফুপু, আল্লাহ আছেন। তিনি কত কাছে আছেন, কত দ্রুত তিনি মানুষের আপীল শুনেন, এই আপীলের সাফল্যই তার প্রমাণ।’
বলে হাতের কাগজটি তুলে দিল ফুপুর হাতে। বলল, ‘এই আবেদন আমি আমার ওয়েবসাইটে দিয়েছিলাম এই বিশ্বাসে যে, আল্লাহ আমার এই আপীল দেখবেন এবং এই আপীল তিনি তার মনোনীত কাউকে দেবেন যাতে তিনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’
ড. আজদার ফুপু লায়লা কামাল আজদার দেয়া মেসেজটি পড়ল এবং মেসেজটি সে তার স্বামী কামাল বারকির হাতে দিল। কামাল বারকি এবং ড. সাহাব নুরী দু’জনেই একে একে মেসেজটি পড়ল।
ড. সাহাব নুরী মেসেজটি পড়া শেষ করে মুখ তুলে সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘যেমন অদ্ভুত মেসেজটি পাঠানো, তেমনি অদ্ভুত মেসেজ পেয়ে জনাব আবু আহমদ আব্দুল্লাহর চলে আসা।’
‘গোটা ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে গায়েবের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ এবং গায়েবের প্রতি বিশ্বাসের চেয়ে এটা ছোট বিষয়। সুতরাং আবু আহমদ বলার পর ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস বা বিস্ময়ের কিছু নেই। আর একটি কথা, রূপকথার মত বন্দী রাজকুমারীর আহ্বানে হাতি-ঘোড়া, লোক-লস্কর ছাড়া রাজকুমার আবু আহমদের এই আগমন আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতো আমি আগের অবস্থায় থাকলে, কিন্তু আবু আহমদের যে চৌকস পরিচয় ইতোমধ্যেই পেয়েছি, তাতে বিস্ময় বা অবিশ্বাসের কোন অবকাশ নেই।’
একটু থামল লায়লা কামাল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘বেটা আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, তোমার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমার ভয় করছে, আজদাকে সাহায্য করার জন্যে এখানে আসার আগে তোমার যে ইচ্ছা, যে সিদ্ধান্ত ছিল, গত সন্ধ্যা থেকে আজ পর্যন্ত যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তাতে তোমার সেই ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কিনা? বিপদ সম্পর্কে আমাদেরও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না, কিন্তু ভয়াবহ সব ঘটনা দেখে বুঝতে পারছি, বিপদটা খুবই বড়, এদের মোকাবিলা বিপজ্জনক হবে। বেটা আবু আহমদ, তুমি কি ভাবছ এ ব্যাপারে? আমরা কি বিপদ থেকে উদ্ধার পাব?’
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘বিপদ থেকে ড. আজদা ও আরিয়াসের মানুষ উদ্ধার পাবে কিনা, এটা আল্লাহ বলতে পারেন। এখানে আসার আগেই বিপদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমার উপলব্ধি ছিল। আমি জেনে বুঝেই এসেছি এবং আল্লাহ সহায় হলে বিপদের মূলোচ্ছেদ ঘটার পরই আমি যাব।’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ ড. আজদারা সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
‘স্যরি জনাব আবু আহমদ, আজদার মেসেজে তো বিপদের পরিচয় ও ভয়াবহতা সম্পর্কে কোন কথা নেই। এখানে আসার আগে তাহলে বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি আপনার কিভাবে হয়েছিল?’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘গত কয়েক বছর আগে আমাকে আর্মেনিয়ায় আসতে হয়েছিল আরেকটা কাজে। সে সময় আর্মেনিয়ায় বিপজ্জনক একটা গ্রুপের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমি অনেকটাই নিশ্চিত, সে গ্রুপটিই আরিয়াস-আরারাত অঞ্চলের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের সাথে জড়িত।’ আহমদ মুসা বলল।
আর্মেনিয়ার নাম শুনে সবাই যেন নড়েচড়ে বসল। তাদের চোখে দুর্ভাবনার চিহ্ন। কথা বলল কামাল বারকি। বলল সে, ‘এ বিষয়টার সাথে আর্মেনিয়া জড়িত? রাজনীতিরও কি যোগ আছে বিষয়টার সাথে?’
‘এর কোন সঠিক জবাব আমার কাছে নেই। আরও জানতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। যাই হোক, ভয় কিন্তু আমাদের বেড়ে গেল। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
ড. সাহাব নুরী থামলেও সংগে সংগে কেউ কথা বলল না। সবাই যেন ভাবছে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল ড. আজদা। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমরা তো মামলা করে এলাম। সরকারও একটা মামলা সাজাবে। এখন কি ঘটবে? আমাদের কি করণীয়?’
‘ধন্যবাদ ড. আজদা, এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার এখন। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আপনাদের নিরাপত্তা। ওরা পরাজয় মেনে নেয়নি। প্রথম আক্রমণে ব্যর্থতার পরপরই দ্বিতীয় আক্রমণ করেছে। দ্বিতীয় ব্যর্থতার পর অবশ্যই তারা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়েছে। আক্রমণের যে কোন সুযোগ তারা কাজে লাগাবে, রাত বা দিন যখনই হোক।’ আহমদ ‍মুসা বলল।
ভয়-উদ্বেগে ছেয়ে গেল ড. আজদাদের মুখ। কামাল বারকি বলল, ‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এখন কি করণীয়? আমরা কি পুলিশ প্রটেকশন চাইব?’
‘তা চাওয়া যায়, এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। কিন্তু কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটাই প্রশ্ন। ইজডির প্রদেশের পুলিশ প্রধান খাল্লিকান খাচিপকে যেমনটা দেখা গেল, তা আশাব্যাঞ্জক নয়। গত সন্ধ্যায় খাল্লিকানের ডেপুটি রশিদ দারাগকেও প্রথমে হোস্টাইল দেখা গেছে। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন। এখানকার পুলিশ স্টেশনের মোস্তফা ওকালানকে পরিষ্কার বোঝা যায়নি। আমার মনে হয়, ইজডির অঞ্চলের পুলিশ মাদকের ভয়াবহ বিস্তার নিয়ে খুব উত্তেজিত অবস্থায় আছে। মাদকের সাথে যাকে কিংবা যে পরিবারকেই যুক্ত দেখছে, তাদের বিরুদ্ধে তারা খড়গহস্ত হচ্ছে। ড. আজদার পরিবার সম্পর্কেও তারা খারাপ ধারণা নিয়ে বসে আছে। সুতরাং পুলিশের আন্তরিক কো-অপারেশন কতটা পাওয়া যাবে, ঠিক বলা যাবে না।’
‘তাহলে?’ প্রশ্ন ড. আজদার। তার মুখে এক অসহায় ভাব।
‘‘ভ্যান’ শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে, ‘কারস’ শহরেও আরেকটা বাড়ি আছে। আজদা মাকে আমরা সেখানে পাঠিয়ে দেব, না তাকে তার বাবা-মা’র কাছে মস্কোতে পাঠিয়ে দেব? গতকাল তার বাবা-মা টেলিফোন করেছিল। ওরা আসছেন। তারা চাচ্ছে, ড. আজদা মস্কোতে তাদের সাথে যাক। ওরা এলে আতা সালাহ উদ্দিনের ব্যাপারে আপীল করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা চূড়ান্ত হবে।’ বলল ড. আজদার ফুপু লায়লা কামাল।
লায়লা কামালের কথা শেষ হতেই ড. আজদার মামা ড. সাহাব নুরী বলল, ‘আমার সাথেও কিছু্ক্ষণ আগে আপা-দুলাভাইয়ের কথা হয়েছে। আতা সালাহ উদ্দিনের এ দুর্ঘটনার পর বিশেষ করে গত সন্ধ্যা ও আজ রাতের ঘটনা শোনার পর ওরা বলছেন আজদাকে অবিলম্বে মস্কো পাঠিয়ে দিতে, অথবা মস্কো যেতে না চাইলে তাকে জার্মানি পাঠিয়ে দিতে।’
‘এসব আপনাদের ব্যাপার, আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তা এই মুহূর্ত থেকেই করা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি মস্কো কিংবা জার্মানি কোথাও যাব না। আর পুলিশ কেসের জন্যে যে কোন সময় আমার প্রয়োজন হবে। আমি আমাদের ইজডির এলাকার বাইরে যেতে পারবো না।’ ড. আজদা বলল।
‘তাহলে তো অন্য সব চিন্তা করে লাভ নেই। নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নিয়েই ভাবতে হবে এখন।’ বলল কামাল বারকি।
‘বেটা আবু আহমদ, আমি একটা অনুরোধ করব?’ ড. আজদার ফুপু লায়লা কামাল বলল।
‘অনুরোধ নয়, বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের আজদাকে এখানে থাকতেই হচ্ছে। বাড়ি পাহারার জন্যে পুলিশকে আমরা হায়ার করব। কিন্তু বাছা, তোমাকেও থাকতে হবে এ বাড়িতে। তাছাড়া তুমি আজদার মেহমানও। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যতদিন সংকট দূর না হয়, ততদিন আজদার সাথে আমি এখানে থাকব।’ বলল লায়লা কামাল।
আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেল ড. আজদা। দুঃখের মধ্যে তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ফুপু আম্মা আমার কথাই বলেছেন। প্লিজ, আপনি হ্যাঁ বলুন। আর আরিয়াস-আরারাত অঞ্চলে যখন আপনি থাকছেন, তখন এখানে থাকাই সব দিক দিয়ে ভালো হবে।’ আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বলল ড. আজদা।
‘ধন্যবাদ, এ অঞ্চলে কোথাও আমাকে থাকতে হবে আর সে থাকাটা এখানে হলে আমার আপত্তি নেই। আর ফুপুজি ঠিকই বলেছেন, পুলিশকে হায়ার করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট পুলিশরাও এতে কিছু উপকৃত হয়। ওদের সার্ভিস ভালো পাওয়া যায় এবং ওদের কিছু নিয়ন্ত্রণও। এটা ইমিডিয়েটলি করা দরকার। দরখাস্ত নিয়ে গেলে থানা ইনচার্জ ওপর থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে এখনি এটা করে দিতে পারে।’
‘আমিই যাচ্ছি।’ বলে ড. সাহাব নুরী উঠে গিয়ে একদৌড়ে একশিট কাগজ ও কলম নিয়ে এল। কাগজ ও কলম ড. আজদাকে দিয়ে বলল, ‘নিজ হাতেই তুমি দরখাস্তটা লিখে দাও।’
ড. আজদা দরখাস্ত লিখে ড. সাহাব নুরীর হাতে দিয়ে বলল, ‘মামা, কিছু পয়সা ওদের এ্যাডভান্স করতে হয়।’
‘সে তুমি ভেব না মা। যা দরকার আমি করে আসব।’
বলে দরখাস্ত নিয়ে বেরিয়ে গেল ড. সাহাব নুরী।
ড. সাহাব নুরী বেরিয়ে গেলে ড. আজদার ফুপা তুরস্ক বিশেষ করে এ অঞ্চলের পুলিশের অবস্থা নিয়ে কথা তুলল।
এ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা চলল।
এই কথার মধ্যেই পরিচারিকা এল চা নিয়ে।
চা খাওয়া চলছে। এই সময় বাড়ির কেয়ারটেকার লোকটি অনুমতি নিয়ে লাউঞ্জে প্রবেশ করল। দরজা পেরিয়ে করিডোরের মুখে দাঁড়িয়ে ড. আজদাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ছোট ম্যাডাম, ইজডির হোম সার্ভিসের গাড়ি এসেছে। কিছু প্রয়োজন আছে? বলবেন কিছু?’
‘হ্যাঁ আংকল, ওদের দাঁড়াতে বলুন। আমি আসছি।’
চলে গেল কেয়ারটেকার।
ড. আজদা উঠতে যাচ্ছিল।
‘হোম সার্ভিস কি নিয়মিত আসে?’ জিজ্ঞেস করল ড. আজদাকে।
ড. আজদা আবার বসে পড়ল। বলল, ‘স্যার, নিয়মিতই বলা যায় আসে।’
‘কোন বিশেষ কোম্পানী, না যে কোন কোম্পানী?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অনেক কোম্পানী আছে, কিন্তু ইজডির কোম্পানীর জিনিস নিয়ে থাকি।’ বলল আজদা।
‘হোম সার্ভিস তো খুব সকালে আসে।’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘জ্বি, এর চেয়ে সকালে আসে। আজ এক ঘণ্টার মত লেইট করেছে।’ ড. আজদা বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
ভাবনার একটা ঝিলিক খেলে গেল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘ড. আজদা, আপনি বসুন। আমি গাড়ির দিকে একটু যাই, তারপর আপনি যাবেন।’
কৌতুহলের চিহ্ন ফুটে উঠল ড. আজদার চোখে-মুখে। পরপরই দুর্ভাবনার একটা কালো ছায়া নামল সেখানে। প্রশ্ন জেগে উঠল তার চোখে। কিন্তু প্রশ্ন না করে বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, আমি বসছি।’
আহমদ মুসা উঠে গেল।
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, হোম সার্ভিসের গাড়িটা বারান্দার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিস্মিত হলো সে এই দেখে যে, গাড়িটা তার মুখ ইতোমধ্যে ঘুরিয়েও নিয়েছে। ফেরার জন্যে সে প্রস্তুত।
হোম সার্ভিসের গাড়িগুলো কোনটা পেছন দরজা আবার কোনটা পাশের দরজা দিয়ে সাপ্লাই দেয়। কিন্তু গাড়ির কোন দরজাই খোলা নেই। ড্রাইভার তার ড্রাইভিং সীটে। আর ‘ইজডির হোম সার্ভিস কোম্পানী লিমিটেড’-এর ইউনিফর্ম পরা একজন লোক হাতে রিসিট ও কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ শুকনো ও চোখ দু’টিতে ভয়ের ছায়া দেখতে পেল সে।
আহমদ মুসার মনের অস্পষ্ট আশংকাটা এবার বাস্তব রূপ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তার জ্যাকেটের বড় পকেট দু’টিতে হাত পুরে গাড়ি বারান্দায় নামল। বলল কোম্পানীর লোকটিকে লক্ষ্য করে, ‘ছোট ম্যাডাম অসুস্থ বোধ করছেন। আমিই সাপ্লাই নেব, তুমি বিস্কুট ছাড়া বেকারী আইটেমের…।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। হঠাৎ উঁচু গাড়ির ওপরের অর্ধেকটা ঘর্ষণের মত একটা ধাতব শব্দ তুলে চোখের পলকে নিচে নেমে গেল।
উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া পথে দেখা গেল গাদাগাদি করে দাঁড়ানো অনেকজন মানুষ। সবার হাতে স্টেনগান। সামনে যারা দাঁড়ানো, টার্গেট লক্ষ্যে উঠে আসছে তাদের হাতের স্টেনগান।
ঘর্ষণের ধাতব শব্দ আহমদ মুসার সপ্ত ইন্দ্রিয়কে সতর্ক করে দিয়েছিল। বেরিয়ে এসেছিল তার ডান হাত চোখের পলকে। তার তর্জনীটা আগে থেকেই তার এম-১০-এর ট্রিগার স্পর্শ করেছিল।
গাড়ির পেছনের স্লাইডিং ডোরটা কিছুটা নামতেই আহমদ মুসার চোখ গাড়ির ভেতরটায় পৌঁছে গিয়েছিল। আর তার তর্জনীটা হুকুম পেয়েছিল সংগে সংগেই।
স্লাইডিং নেমে যাবার আগেই আহমদ মুসার এম-১০ গুলিবৃষ্টি শুরু করেছিল।
গাড়ির ভেতরে স্টেনগানধারীরা গাড়ির পেছনের দরজার ঘুলঘুলি দিয়ে নিরস্ত্র এবং হোম সার্ভিস আইটেমের অর্ডার দানরত আহমদ মুসাকে আগেই দেখেছিল। কিন্তু নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত এই লোকটির কাছ থেকে আক্রমণ হতে পারে, তা তারা কল্পনা করেনি। তারা মনে করেছিল, নিরস্ত্র এই কর্মচারী বা আত্মীয় লোকটিকে ধরে তার সাহায্যে ড. আজদাকে খুঁজে বের করে তাকে শেষ করার কাজটা আগে সমাধা করবে। আর যদি বাঁধা আসে, তাহলে সে কেন, কাউকেই ছাড়বে না। রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে হলেও তারা বারজন আজ দু’বারের ব্যর্থ মিশন সমাপ্ত করেই ফিরবে।
কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তারা আহমদ মুসার এম-১০-এর অসহায় শিকার হলো। যাদের হাতে স্টেনগান উদ্যত ছিল, তারা কিছুটা ওপরে উঠার সাথে সাথে গুলির ঝাঁকের গ্রাসে পরিণত হলো। তাদের পেছনে দাঁড়ানো অন্যরা স্টেনগান তাক করারও সুযোগ পেল না।
বারোজনের লাশে স্তুপীকৃত হয়ে পড়ল গাড়ির ভেতরটা।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পালাচ্ছিল।
ভয়ে কম্পনরত কোম্পানীর সেলসম্যান লোকটা শুকনো কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ‘স্যার একজন পালাচ্ছে।’
আহমদ মুসা তাকাল সেদিকে। দেখল, গাড়ির ড্রাইভিং ডোরের নিচে একটা স্টেনগান পড়ে আছে। সন্ত্রাসীটি তখন দৌঁড়ে গাড়ির সামনে পনের-বিশ গজের মত চলে গেছে। আহমদ মুসা তার পায়ের দিকে লক্ষ্য করে এক পশলা গুলি করল। আহমদ মুসা চাচ্ছিল তাকে জীবিত ধরতে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, লোকটি ঐখানে রাস্তার বাঁক ঘুরতে গিয়ে পায়ের সাথে পা বাড়ি খাওয়ায় পড়ে গেল। যে গুলি তার পায়ে লাগার কথা তা গিয়ে একদম লাগল তার বুকে।
অন্যদের মত সেও প্রাণহীন লাশ হয়ে গেল।
ড. আজদারা তখন কেউ আহমদ মুসার পেছনে, কেউ পাশে এসে দাঁড়াল।
ড. আজদা এসে আহমদ মুসার ডান পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। কাঁপছে সে। তাদের সকলের দৃষ্টি তখনও রাস্তার ওপর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়া লোকটির দিকে। গাড়ির ভেতরে চোখ তাদের যায়নি।
পেছনে দাঁড়ানো লায়লা কামালই প্রথম দেখতে পেল ভয়াবহ দৃশ্যটা। বলল চিৎকার করে, ‘আজদা গাড়ির ভেতরে দেখ।’
গাড়ির ভেতরে একবার তাকিয়েই চিৎকার করে উঠে ড. আজদা আহমদ মুসাকে আঁকড়ে ধরল।
‘বোন আজদা আয়েশা, যুদ্ধক্ষেত্রে ভীত হবার কোন সুযোগ নেই।’ নির্দেশসূচক গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে ড. আজদা মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। বিস্ময়কর এই মানুষটি তাকে বোন ডেকেছেন। কখন মহীরূহ রূপ এই মানুষটিকে সে জড়িয়ে ধরেছিল, সে বুঝতেই পারেনি। মনোবিজ্ঞানীও কি এই লোকটি! ঠিক প্রয়োজন মুহূর্তেই তিনি তাকে বোন সম্বোধন করেছেন। অসীম শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে নুয়ে এল ড. আজদার মাথা। গত ১২ ঘন্টারও কম সময়ে এই মহান লোকটি তাকে তিনবার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সে তো হোম সার্ভিসের কাছে আসার জন্যে উঠেই ছিল। এলে তো তাকেই এখন লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হতো!
‘ড. আজদা আয়েশা, তাড়াতাড়ি থানায় খবর দিন। ড. সাহাব নুরী নিশ্চয় এখনও থানায় আছেন। পুলিশ নিয়ে আসতে বলুন তাকে।’ বলল আহমদ মুসা ড. আজদাকে।
‘জ্বি ভাইয়া, আমি যাচ্ছি, এখনি থানায় খবর দিচ্ছি।’ অনেকটা রোবটের মত কথা বলল ড. আজদা। ঘটনার ভয়াবহতা তাকে যে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, সে ঘোর এখনও তার কাটেনি।
ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি ও ফুপু লায়লা কামালও অনেকটা নির্বাক। কি করে কি ঘটল, তা জিজ্ঞেস করার ভাষাও তারা যেন ভুলে গেছে। শুধু এটুকুই বুঝছে, হোম সার্ভিসের ছদ্মবেশে সন্ত্রাসীরা এসেছিল। আতংকে তারা শিউরে উঠছে এই ভেবে যে, হোম সার্ভিসের কাছে আসার জন্যে আজদা তো উঠেই দাঁড়িয়েছিল, আসলে তো সে-ই লাশ হয়ে যেত।
আহমদ মুসা হাতের রিভলভারটি পকেটে রেখে ডাকল ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানীর সেলসম্যান ছেলেটিকে।
ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে এসে আহমদ মুসার কাছে দাঁড়াল।
‘সন্ত্রাসীরা তোমাকে এবং তোমার গাড়ি কোথায় পেল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা ছেলেটিকে।
ছেলেটি কেঁদে ফেলল। বলল, ‘আমরা এদিকে আসছিলাম। ‘এলিকয়’ চৌরাস্তার ক্রসিংয়ে এরা গাড়ি থামায় এবং বলে, আমরা বেশি পরিমাণে বেকারীর জিনিস কিনব। আমাদের সাথে চল। বলে আমাদের আরাস নদীর তীরে পাহাড়ের আড়ালে এক নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। আমাদের ড্রাইভারকে ওরা মেরে ফেলে এবং বলে, তাদের কথামত কাজ না করলে আমাকেও মেরে ফেলবে। আমাদের গাড়ি থেকে সব মাল নামিয়ে ওরা বারজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ওদের অন্য একজন গাড়ি চালিয়ে এখানে নিয়ে আসে।’
‘ওদের নিজেদের মধ্যে কোন কথা বলতে শুনেছ কিংবা ওরা টেলিফোনে কারও সাথে কথা বলেছে কিনা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ওদের কারও হাতে মোবাইল দেখিনি। আমি ড্রাইভারের পাশে বসেছিলাম। সে কোন কথা বলেনি।’ বলল ছেলেটি।
‘ঠিক আছে, ভয় নেই। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে সত্য যা তাই বলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোন করে ভেতর থেকে আজদা এল। বলল, ‘স্যার, পুলিশ রওয়ানা দিয়েছে। মামারও কাজ হয়ে গেছে। তিনিও আসছেন।’
‘ভাই বলার পর আবার ‘স্যার’ কেন?’ বলল আহমদ মুসা আজদাকে। তার মুখে হাসি।
‘অভ্যাস হয়ে গেছে তো। আর বলব না। কিন্তু ‘বোন’ বলার পর ‘আপনি’ সম্বোধন করছেন কেন? এসবও তাহলে চলবে না। ড. আজদা নয়, শুধু আজদা আয়েশা আমি।’
‘ঠিক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ড. বারজেনজো শুনলে খুব খুশি হবে। সে আপনার দারুণ ভক্ত হয়ে গেছে। সকাল থেকে এ পর্যন্ত দু’বার টেলিফোন করেছে। আমি মামা, ফুপা-ফুপিদের পরিবর্তনের কাহিনী তাকে বলেছি। সে দারুণ খুশি হয়েছে। সে চাচ্ছে, তার পরিবারের সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে। ওখানে নাকি আপনি আরও ভালো করতে পারবেন।’ বলল ড. আজদা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে থেমে গেল আহমদ মুসা।
পুলিশের দু’টি গাড়ি। তাদের মধ্যে একটা ড. সাহাব নুরীর গাড়ি।
পুলিশের গাড়ি দু’টি গাড়ি বারান্দা থেকে বেরিয়ে রাস্তাটি যেখানে বাগানের দিকে টার্ন নিয়েছে, সেখানে একটি লাশ পড়েছিল, তার পেছনে এসে দাঁড়াল।
থানার ইনচার্জ অফিসার মোস্তফা ওকালান লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে লাশটা ভালো করে দেখল। তারপর চারদিকটার ওপর চোখ পড়তেই ‘সালাম’ দিয়ে হোম সার্ভিসের গাড়ির দিকে এগোলো।
গাড়ির পেছনে আহমদ মুসাসহ সকলেই দাঁড়িয়েছিল।
পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, ‘এখানেই তো লাশগুলো?’
‘জ্বি হ্যাঁ, গাড়ির ভেতরে।’ আহমদ মুসা বলল।
গাড়ির পেছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভেতরটা সে একবার গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘অভিনন্দন আপনাকে। সন্ত্রাসীদের আপনি গাড়ি থেকে নামতেই দেননি। বুঝতে পারছি, ওরা হোম সার্ভিসের ছদ্মবেশে এসেছিল। গাড়িতে হোম সার্ভিসের পণ্যের বদলে ছিল ওরা ১২ জন সন্ত্রাসী। ওরা ভেবেছিল, বাড়িতে যেহেতু মেহমান ছাড়া বাড়ির দায়িত্বশীল আর কেউ নেই, তাই ড. আজদাই অর্ডার নিয়ে আসবে। আর তাকে খুন করে তারা পালিয়ে যাবে। যদি আজদা না আসে তাহলে বাড়িতে ঢুকে তাকে খুঁজে বের করে খুন করার মত জনশক্তি নিয়ে তারা এসেছিল। কিন্তু তারা গাড়ি থেকে বের হতেই পারেনি। কি ঘটেছিল বলুন তো।’
আহমদ মুসা গোটা কাহিনীটা সংক্ষেপে বলল।
পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান কাহিনী শোনার পর তার চোখ-মুখের ওপর দিয়ে বিস্ময় ও কৌতুহলের ঢেউ খেলে গেল। ফুটে উঠল তার চোখে আহমদ মুসার প্রতি একটা সমীহ দৃষ্টি। বলল, ‘আপনি ড. আজদাকে বাঁধা দিলেন কেন? আপনার মনে হোম সার্ভিস সম্পর্কে সন্দেহ হলো কেন?’
‘বিষয়টা খুব সাধারণ ছিল। যে বাড়িতে রাতে এত গুলি-গোলা হলো, যে বাড়িতে পুলিশের এত আনাগোনা, যা আশেপাশের লোকেরা সবাই জানতে পেরেছিল, সে বাড়িতে সকালে হোম সার্ভিসের গাড়ি আসার বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, গাড়িটা নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা পরে আসাটা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। কারণ, হোম সার্ভিসের রুট শিডিউল, টাইম শিডিউল থাকে, সেটা ব্রেক করে না। হয় ঠিক সময়ে আসবে, না হলে আসেই না। কাস্টমাররাও এটা জানে। তৃতীয়ত, দ্বিতীয় আক্রমণের প্রকৃতি দেখে আমার আশংকা হয়েছিল, শত্রুদের তৃতীয় আক্রমণও এ পক্ষ গুছিয়ে উঠার আগেই ঘটতে পারে। রাতের ঘটনার পর পুলিশ ও অন্যান্য ঝক্কি ঝামেলা সামলাতে এ পক্ষের সকাল হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং এ পক্ষের সকালটা কাটবে অনেকটা নিশ্চিন্ত ও শিথিলভাবে। এই অবস্থা শত্রুপক্ষের তৃতীয় আক্রমণের জন্যে খুব অনুকূল হতে পারে। এ আশংকা মনে থাকায় হোম সার্ভিসের গাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখা স্বাভাবিক ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালানের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘মি. আবু আহমদ আবদুল্লাহ, নিশ্চয় আপনি কোন গোয়েন্দা সার্ভিসের লোক। পরিচয় আপনি গোপন করছেন। অথবা আপনি নিশ্চয় আর এক শার্লক হোমস। শার্লক হোমসের মতই আপনার বিবেচনা-বিশ্লেষণে কোন খুঁত নেই। ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু মি. আবু আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি ভিমরুলের চাকে ঢিল দিয়েছেন। ভালো ছিল এদের না ঘাঁটানো। এদের শক্তি সম্পর্কে আমার কোন আন্দাজ নেই, আপনিও পারবেন না।’
‘কারা এরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি না। এরা বহুরূপী। এদের আসল রূপ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। এরা অপরাধী সংগঠন নয়। বরং এরা পুলিশকে অপরাধ দমনে সাহায্য করছে। তাদের সাহায্যেই এই অঞ্চলের ড্রাগ-নেটওয়ার্ককে ভেঙে ফেলা গেছে। বহু অপরাধী ধরা পড়েছে। তাদের সাহায্যে বাকিদেরও আমরা ধরে ফেলব। শুধু ড্রাগ-ব্যবসায় নয়, চুরি, ডাকাতি, খুন সব অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেই তারা সাহায্য করছে। এদের সাথে বারজানি পরিবারের এই সংঘাতকে আমরা দুঃখজনক মনে করছি। ড. আজদার ভাই আতা সালাহ উদ্দিন বারজানি অপরাধ করেই জেলে গেছে। ড. আজদার কোন অপরাধ আমরা পাইনি। কিন্তু তার সাথে ওদের সংঘাত বাঁধল কেন? ওরা কেন ড. আজদাকে মারতে চায়, এ প্রশ্নেরও আমাদের কাছে কোন জবাব নেই। জানি না, তদন্ত কতদূর কি করতে পারবে!’
ড. আজদা, ড. সাহাব নুরী, কামাল বারকি ও তার স্ত্রী লায়লা কামাল গোগ্রাসে গিলছিল আহমদ মুসা ও পুলিশ অফিসারের মধ্যেকার কথাগুলো।
‘ওরা পুলিশকে এই সাহায্য করছে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশকে সহযোগিতা করা তো সব নাগরিকের দায়িত্ব।’ বলল পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান।
‘ওদের বহুরূপী বললেন কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এই কারণে যে, এই সাহায্যের কাজটা তারা নানা নামে করে। তবে তারা যে সবাই মিলে এক, সেটা আমরা বুঝি। তাহলে কেন বহু নাম, এক নাম নয়, সেটা আমরা জানি না। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। সাহায্য করছে, এটাই আমাদের কাছে বড় কথা, নাম নয়।’
‘আচ্ছা অফিসার, এই এলাকায় নতুন বসতি এবং পুরাতনরা উচ্ছেদ হওয়া, এ সম্পর্কে কিছু জানেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘উচ্ছেদের ঘটনা আমাদের সামনে আসেনি। জমি-জমা, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবার ঘটনা আছে। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন তো স্বাভাবিক ব্যাপার। নতুন বসতি বলতে যা ঘটছে, সেটাও স্বাভাবিক। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক মানুষ জমি-জমা কিনে এখানে বসতি করছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই।’
‘কারা যাচ্ছে, কারা আসছে, এ বিষয়টা আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এরকম কিছু আমরা দেখিনি, আমাদের দেখার কথাও নয়। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন কেন করছেন বুঝতে পারলাম না।’ বলল থানা ইনচার্জ অফিসার মোস্তফা ওকালান।
‘এমনিই বলছিলাম। তবে তুরস্কে জাতিগত একটা সংঘাত তো আছেই, তাই না? যেমন দেখুন, আর্মেনীয়রা এখনও সমস্যা হয়েই আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালান তাকাল আহমদ ‍মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, আপনি অনেক জানেন। আপনি খুবই দূরদর্শী। আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমরা সরকারি চাকুরে। বেশি জানতেও নেই, বেশি বলতেও নেই।’
বলেই মোস্তফা ওকালান নড়েচড়ে উঠে বলল, ‘কাজ শুরু করি। আমাদের বড় স্যার খাল্লিকান খাচিপ আসতে চেয়েছিলেন। শেষে জানালেন আসছেন না। আগের মতই এ ঘটনাটা। তদন্ত একই রকম হবে। তবে তিনি বলেছেন, কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি ইজডির বাইরে যাবেন না।’ থামল মোস্তফা ওকালান।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার স্যার আইনের কথা বলেননি। আমি আসামী নই। তাকে বলবেন, আমি তার আদেশ মানতে বাধ্য নই। আমি ইজডিতে থাকলে আমার ইচ্ছাতেই থাকব।’
‘মি. আবু আহমদ, এ বিষয় নিয়ে কথা বাড়াবার দরকার নেই। এসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দিন।’ বলল থানা ইনচার্জ মোস্তফা ওকালান।
কথা শেষ করে মোস্তফা ওকালান পেছন ফিরে সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাদের কাজ কত দূর?
‘স্যার, সুরতহাল শেষ হয়েছে। নিচের লাশটি গাড়িতে তোলা হয়েছে। এখন আমরা ওদের বক্তব্য এখানেও নিতে পারি। আবার ওরা থানায় মামলা রেকর্ড করাতে পারেন।’ বলল মোস্তফা ওকালানের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর।
মোস্তফা ওকালান তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘আমরা থানায় যাব মামলা রেকর্ড করার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে।’ বলে মোস্তফা ওকালান হোম সার্ভিসের সেলসম্যান ছেলেটিকে ডেকে বলল, ‘গাড়িটিকে ওরা কোত্থেকে হাইজ্যাক করেছে?’
ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘স্যার, এলিকয় ক্রসিং থেকে ওরা আমাদের কিছু জিনিস কিনবে বলে নিয়ে যায়। আরাস নদী এলাকায় একটা পাহাড়ের আড়ালে নিয়ে আমাদের ড্রাইভারকে ওরা হত্যা করে এবং গাড়ির জিনিসপত্র ওখানে নামিয়ে ফেলে। হত্যার ভয় দেখিয়ে ওরা বাধ্য করে আমাকে তাদের কথামত কাজ করতে।’
মোস্তফা ওকালান তার সহকারী সাব-ইন্সপেক্টরকে ডেকে বলল, ‘তুমি ছেলেটিকে গ্রেফতার কর। আর থানায় টেলিফোন করে আরাস নদীর ঐ পাহাড়ী এলাকা থেকে নিহত ড্রাইভার ও গাড়ির মালামাল উদ্ধার করে আনতে বল।’
স্যালুট দিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর হোম সার্ভিসের সেলসম্যান ছেলেটিকে নিয়ে একজন পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘একে গাড়িতে তোল।’ তারপর ওয়্যারলেসে কথা বলতে লাগল থানার সাথে।
আহমদ মুসা ও ড. আজদা তৈরি হবার জন্যে চলল বাড়ির ভেতরে। তাদের সাথে ড. সাহাব নুরী এবং কামাল বারকি ও লায়লা কামাল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই ড. আজদার ফুপা কামাল বারকি বুকে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘বেটা, নিশ্চয় আল্লাহর কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে তোমার। তুমি আজদাকে হোম সার্ভিসে যেতে বাঁধা না দিলে সে বেঘোরে মারা পড়ত। আমরা তুরস্কের হয়েও যা জানি না, তা তুমি জান কি করে? আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন বেটা।’
আহমদ মুসা কামাল বারকিকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। তিনি যেন সব সময় আমাদের এভাবে সতর্ক হবার সুযোগ দেন।’
‘ফি আমানিল্লাহ। তুমি ঠিক বলেছ বেটা। পুলিশের দারোগা ওকালানও দেখছি ভয় করে এ সন্ত্রাসীদের।’ বলল কামাল বারকি।
আহমদ মুসা নিচতলার লাউঞ্জে প্রবেশ করে তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল।
‘ভাইয়া, আপনার ঘর ওদিকে নয়। আপনার ঘরের ‘মেরাজ’ হয়েছে।’ বলল ড. আজদা। তার ঠোঁটে হাসি।
‘মেরাজ মানে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মেরাজ মানে আপনার ঘরের দু’তলায় ঊর্ধ্বগমন ঘটেছে। এখন থেকে দু’তলায় থাকবেন। আপনি কাছাকাছি থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকব, এই চিন্তাতেই আমরা এটা করেছি। চলুন, আপনার ঘর দেখিয়ে দিই।’ বলল ড. আজদা। কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
হাঁটতে লাগল ড. আজদাও।
ড. আজদার মামা ও ফুপা-ফুপিরা লাউঞ্জের সোফায় বসে বলল, ‘আমরা আর ওপরে উঠছি না। তোমরা তৈরি হয়ে এস। আমরা এখানেই বসছি।’
দু’তলায় উঠে গেল আহমদ মুসা ও ড. আজদা।
সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল লায়লা কামাল, ড. আজদার ফুপি। বলল, ‘এই জুড়িটা যদি জীবনের জন্যে হতো, তাহলে হাতে স্বর্গ পেতাম।’
‘ওরকম চিন্তা করে ওদের সম্পর্ককে ছোট করো না। আবু আহমদ আব্দুল্লাহ ছেলেটা একেবারেই অতুলনীয়। সব দিক থেকেই অসম্ভব সচেতন। দেখ, আজদা গাড়ির ভেতর রক্তে ডুবে থাকা লাশের স্তুপ দেখে আকস্মিকভাবে ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পাশে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে। মানুষের মন বড় বিচিত্র। অনেক সময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক যুগে যা ঘটে না, এক ‍মুহূর্তেই তা ঘটে যেতে পারে। আবু আহমদ আব্দুল্লাহ তেমন কিছুর পথ বন্ধ করার জন্যেই নিশ্চয় কোন দেরি না করে ‘বোন’ বলে সম্বোধন করেছিল আজদাকে।’ বলল কামাল বারকি, ড. আজদার ফুপা।
‘ধন্যবাদ ভাইসাহেব, বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি। সুন্দরী মেয়ের স্পর্শকে নানা পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন কারণে প্রশ্রয় না দেবার লোক হয়তো আছে, কিন্তু সংগে সংগেই তাকে বোন বলার মত সততা দেখানোর লোক আমি দেখিনি। সোনার মানুষ কেমন হয় আমি জানি না, কিন্তু সোনার মানুষ যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে তাকেই বলতে হবে। গত পনের-বিশ ঘণ্টার ইতিহাস এটাই বলে।’
দু’তলা থেকে নেমে এসেছে আহমদ মুসা ও ড. আজদা। ড. সাহাব নুরীর শেষ কয়েকটা কথা তাদের কানে গেল।
‘বিশ ঘণ্টার ইতিহাস কি বললে মামা?’ বলতে বলতে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল ড. আজদা। কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা।
‘না, কিছু না। আমরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তোমরা যাচ্ছ? গিয়ে কি হয়, আমাদের টেলিফোন করো। আমরা চিন্তায় থাকব।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘হ্যাঁ মামা, আমরা যাচ্ছি। দোয়া করো।’ বলল ড. আজদা।
‘হ্যাঁ, আসছি আমরা। পুলিশ অফিসার মোস্তফা ওকালান এখন টেলিফোন করেছিলেন, আমরা পাহারার জন্যে যে পুলিশ চেয়েছিলাম তারা এসেছে। দিনে দু’জন পুলিশ পাহারায় থাকবে, রাতে চারজন। আপনারা ওদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলে ভালো হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে হাঁটা ‍শুরু করল বাইরে বেরুবার জন্যে।
ড. আজদাও তার পিছু নিল।

Top