৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

সকাল ৭টা। কুরআন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই ঘরে ঢুকল ড. সাহাব নুরী। সালাম দিয়েই আহমদ মুসাকে বলল, ‘মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, আপনি কি একটু সময় দেবেন?’
‘এটা তো জিজ্ঞাসা বা সম্মতি দেয়ার বিষয় নয়! আপনাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। কি ব্যাপার বলুন তো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মধ্য ভ্যান-এ আমার বন্ধু পরিবার সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে। সেখানে আমাকে এখনি যেতে হবে। আপনিও যদি যান।’
গত রাতেই ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদার সাথে আহমদ মুসা লেকসিটি ভ্যান শহরে এসেছে। এই ভ্যান শহরের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাহাব নুরী।
আহমদ মুসা ভ্যানে এসেছে পুলিশ রেকর্ড থেকে উল্কিওয়ালাদের সম্পর্কে খোঁজ নেবার জন্যে। এ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের যারা মারা পড়েছে, সবাই উল্কিওয়ালা। সুতরাং উল্কিওয়ালাদের সম্পর্কে জানলে অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। জানা যাবে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সবই।
ড. সাহাব নুরীর কথা শেষ হতেই ঘরে প্রবেশ করেছে ড. আজদা।
‘কি বিপদ মি. সাহাব নুরী? আপনার এ বন্ধু কে বা কারা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমার অভিভাবক এবং শিক্ষক সাংঘাতিক পুলিশী ঝামেলায় পড়েছেন। এখনি যেতে হবে সেখানে। ওরা খুবই আপসেট হয়ে পড়েছেন।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘কাদের কথা বলছেন? কারা বিপদে পড়েছেন মামা?’ ড. আজদার জিজ্ঞাসা।
‘তুমি জান তাকে। ভ্যান পুরাতত্ত্ব জাদুঘরের প্রধান এবং জাদুঘরের মাউন্ট আরারাত সেকশনের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক ড. মাহজুন মাজহার। জাদুঘরে আজ কি এক ডাকাতি হয়েছে। এজন্যে পুলিশ তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার বাড়িতে আরও পুলিশ আসবে। স্যার খুব সরল-সোজা বিজ্ঞানী মানুষ। খুব নাকি ভেঙে পড়েছেন।’
ভ্যান জাদুঘরের মাউন্ট আরারাত সেকশনের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক শুনেই আহমদ মুসার আগ্রহ দারুণ বেড়ে গেল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
তার আগেই ড. আজদা কথা বলা শুরু করেছে। বলছে, ‘মামা, ঐ স্যারের মেয়ে সাহিবা সাবিত তো আমার বান্ধবী। কলেজে ক্লাসমেট ছিল আমার। এখন সে ভ্যান বিশ্ববিদ্যালয়েই পুরাতত্ত্বের ওপর পিএইচডি করছে। গতকালও টেলিফোনে তার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমাকেও যেতে হবে।’
‘বেশ, চল। ভালোই হলো। কিন্তু মি আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, আপনাকে যেতেই হবে।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘না ডাকলেও আমি যাব। ড. মাহজুন মাজহারকে আমারও প্রয়োজন। চলুন। আমি প্রস্তুত।’ আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
‘ধন্যবাদ আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। আমি কৃতজ্ঞ। আপনাকে সেখানে খুব বেশি প্রয়োজন। আসুন।’
বলে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে হাঁটা ‍শুরু করল ড. সাহাব নুরী।
‘চলুন ভাইয়া, ওরা খুব ভালো মানুষ। কিন্তু ভীষণ বিপদ ওদের।’ বলল ড. আজদা।
‘কিন্তু ঘটনাটাই এখনও জানতে পারলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ছয়টার খবরে না বললেও আটটার খবরে নিশ্চয় বিস্তারিত বলবে। আর কাগজেও বিস্তারিত জানতে পারব। ওখানে গিয়েই আমরা কাগজ পেয়ে যাব।’ বলল ড. আজদা।
আহমদ মুসা ও ড. আজদা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
সকালের প্রাচীন ও ব্যস্ত শহর ভ্যান। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে পৌঁছে গেল তারা ড. মাহজুন মাজহারের বাড়িতে।
ড. মাহজুন মাজহারের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি। তাদের বাগানঘেরা দু’তলা বাংলো সাইজের বাড়ির সব দিকেই পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
নিচেই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়েছিল সাহিবা সাবিত। তার চোখে –মুখে উদ্বেগের বিস্ফোরণ।
ড. সাহাব নুরী গাড়ি থেকে নামতেই সাহিবা সাবিত এসে তাদের ওপরে নিয়ে চলল। যাবার পথেই ড. আজদা সাহিবা সাবিতকে আহমদ মুসার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, ‘তোমাকে যে মেহমানের কথা বলেছিলাম, ইনি তিনিই। আমাদের পরিবারের চরম বিপদের সময়ের পরম বন্ধু। ইনি আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।’
শুনেই দাঁড়িয়ে গেল সাহিবা সাবিত।
সাহিবা সাবিতের মুখে দুঃখের মধ্যেও ফুটে উঠেছে বিস্ময় আর আনন্দের ঔজ্জ্বল্য।
হালকা নীল ট্রাউজারের ওপর সাদা শার্ট পরা সুন্দরী তরুণী সাহিবা সাবিত বাউ করল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আজদা আমাকে আপনার সম্পর্কে এত কথা বলেছে যে, আমি আপনাকে শার্লক হোমস ভেবে বসে আছি। তবে ইংরেজ শার্লক হোমসের চেয়ে আপনি অনেক সুন্দর। ওয়েলকাম স্যার।’
‘ধন্যবাদ সাহিবা সাবিত। আমি আপনাকে অন্য একটা অনুরোধ করব। আমার এখনি একটা পত্রিকা দরকার, যাতে মিউজিয়ামের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজকের সবগুলো পত্রিকাই আমি কিনেছি। চলুন, দেখবেন।’
বলে আবার হাঁটতে শুরু করল সাহিবা সাবিত।
সাহিবা সাবিত আহমদ মুসাদেরকে একেবারে ভেতরে ফ্যামিলি ড্রইংরুমে নিয়ে এল। সেখানেই বসেছিল তার আব্বা ভ্যান পুরাতত্ত্ব মিউজিয়ামের প্রধান ড. মাজহার।
আহমদ মুসাদেরকে দেখে ড. মাহজুন মাজহার উঠে দাঁড়িয়েছে। স্বাগত জানাল ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদাকে। আহমদ মুসার ওপর চোখ পড়তেই থমকে গেল তার কথা। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ড. সাহাব নুরীর দিকে।
কিন্তু সাহাব নুরী কিছু বলার আগেই সাহিবা সাবিত বলল, ‘বাবা, ইনিই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। আজদাদের বিপদে হাতেম তায়ী হয়ে এসেছে। তবে বাবা, এই হাতেম তায়ী কিন্তু একইসাথে শার্লক হোমস ও রবিনহুড।’
‘পুরাতত্ত্বের বর্ণনায় বিশেষণের ব্যবহার হয় না। কিন্তু মিস সাহিবা সাবিত পুরাতত্ত্বের ছাত্রী হয়ে যেভাবে বিশেষণের ব্যবহার করছেন, তা অবাক হওয়ার মত। যাক।’
বলে আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিল ড. মাহজুন মাজহারের দিকে।
আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেইক করে বলল, ‘ইয়ংম্যান, বিশেষণ আসে আসলে মানুষ যা আশা করে, তার চেয়ে বেশি পাওয়ার ইমোশন থেকে। সব কথা ধরতে নেই। যাক, হাতেম তায়ী, শার্লক হোমস কিংবা রবিনহুড না হোক, বিপদের সময় যে কোন শুভাকাংক্ষীর উপস্থিতি মূল্যবান।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনাদের ঘটনার কথা শুনেছি। অনুমতি হলে আজকের কাগজগুলো আমি দেখতে চাই। জানতে চাই পুরো ঘটনা।’ বলল আহমদ মুসা।
ড. মাহজুন মাজহার তাকাল মেয়ে সাহিবা সাবিতের দিকে।
সাহিবা সাবিত আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আসুন স্যার।’ বলে সাহিবা সাবিত হাঁটতে লাগল।
পেছনে আহমদ মুসাও।
ফ্যামিলি ড্রইংরুমের ওপাশে পরিবারের মিডিয়া রুম। সে রুমে টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটার, সংবাদপত্র এবং ছোট ছোট ওয়াল-ক্যাবিনেটগুলোতে বাছাই করা কিছু বই।
দৈনিক কাগজগুলো নিয়ে বসলো আহমদ মুসা একটা টেবিলে।
‘স্যার, আপনি বসুন। আমি ওদিকটা খোঁজ নিই। পুলিশ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘ঠিক আছে। পুলিশ এলে আমাকে একটু জানাবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শিওর স্যার। আপনার যে কোন সহযোগিতাকে ওয়েলকাম।’ বলল সাহিবা সাবিত।
বলেই ছোট একটা বাউ করে চলে গেল সাহিবা সাবিত।
কাগজগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল আহমদ মুসা। স্বাধীন ও সবচেয়ে দায়িত্বশীল ইংরেজি দৈনিক Van Times দেখল। ‘ভ্যান পুরাতত্ত্ব মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনে রহস্যজনক হানা। ছয়জন প্রহরী সেনা নিহত। নিহত সন্ত্রাসীদের একজন।’
আহমদ মুসা শিরোনামটা পড়ার পর নিউজ পড়তে শুরু করলঃ
ভ্যান, ২ আগস্ট, রাত ৩টা। গত রাত দু’টায় ভ্যান পুরাতত্ত্ব মিউজিয়ামে এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হানা হয়েছে। এই হানার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশন। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে কি ক্ষতি হয়েছে জানা যায়নি। সন্ত্রাসী-দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণে ছয়জন প্রহরী সেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়েছে। হানাদারদের একজন নিহত হয়েছে ঘটনা শেষে পালাবার সময়। মিউজিয়ামের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ মাউন্ট আরারাত সেকশনের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক ড. মাহজুন মাজহারের কোন গোপন ইনভলভমেন্ট এই ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঘটনার প্রাপ্ত বিবরণ ও অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ঐতিহাসিক ভ্যান ক্যালিস প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত পুরাতত্ত্ব মিউজিয়ামে প্রবেশের জন্যে দুষ্কৃতিকারীরা তিন দিক থেকে অভিযান চালায়। এভেনিউয়ের পাশ ছাড়া এই তিন দিকেই পাহারা দেয়ার জন্যে সেনাক্যাম্প আছে। তিন ক্যাম্পে তিন শিফটে পাঁচ পাঁচ করে মোট পনের জন সৈনিক পাহারায় থাকতো। এভেনিউয়ের দিকের মূল গেটে দু’টি গার্ড বক্স। এর একটিতে পুলিশ অন্যটিতে মিউজিয়ামের নিজস্ব গার্ড সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতো।
দুষ্কৃতিকারীরা মূল গেট ছাড়া অন্য তিন দিক থেকে সন্তর্পণে ক্রলিং করে পাহারায় থাকা সেনাদের অলক্ষ্যে তাদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলে অতর্কিতে তাদের ওপর চড়াও হয়। সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্রে তারা বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে ৮ জন সেনা মারা যায়। আহতদের তারা বেঁধে মুখে টেপ পেস্ট করে দেয়। তারপর ধীরে-সুস্থেই যেন ভ্যান ক্যালিস প্রাসাদে প্রবেশ করে।
মিউজিয়ামের সব সিকিউরিটি ব্যবস্থা সম্পর্কে দুষ্কৃতিকারীরা অবহিত ছিল। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও নেটওয়ার্কের একমাত্র সুইচটি ছিল মিউজিয়ামের রেক্টর ড. মাহজুন মাজহারের অফিস কক্ষে তার কম্পিউটার টেবিলের একটা গোপন স্থানে। সুতরাং তার অফিস কক্ষ বন্ধ থাকলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও এ্যালার্ম সিস্টেমকে অকেজো করার কোন উপায় থাকে না। রেক্টরের রুম ডিজিটাল লক ব্যবহার ছাড়া অন্যকোন উপায়ে খুলতে গেলে প্রধান গেটের সিকিউরিটি এ্যালার্ম বেজে উঠবে। আর রেক্টরের অফিস কক্ষের ডিজিটাল লক যদি প্রথম প্রচেষ্টায় খুলতে না পারে, একাধিক চেষ্টা করতে যায়, তাহলেও প্রধান গেটের সিকিউরিটি এ্যালার্ম বেজে উঠবে। দুষ্কৃতিকারীরা এ সব কিছুই জানতো। তারা রেক্টরের অফিস কক্ষের ডিজিটাল লক ব্যবহার করেই তার অফিসে প্রবেশ করে এবং ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, এ্যালার্ম নেটওয়ার্কের সুইচ অফ করে দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দুষ্কৃতিকারীরা মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশন ছাড়া অন্য আর কোন সেকশনে প্রবেশ করেনি। এমনকি ‘গোল্ড এন্ড ডায়মন্ড’ সেকশনেও প্রবেশ করেনি। সেখানে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ভ্যান রাজবংশগুলোর স্বর্ণমুদ্রা ও গোল্ড-ডায়মন্ড অলংকারের নমুনা প্রদর্শনী। নমুনা প্রদর্শনী হলেও আজকের টাকায় তার মূল্য কোটি টাকা হবে। ‍কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা সেদিকে যায়নি। তারা শুধুই প্রবেশ করেছে মাউন্ট আরারাত সেকশনে। এ সেকশনে আছে বিভিন্ন যুগে মাউন্ট আরারাতের ওপর লেখা পুরাতন সব পুস্তক- পুস্তিকা ও গ্রন্থের প্রদর্শনী। আর আছে সেখানে মাউন্ট আরারাতের ওপর তৈরি বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন সময়ের ভিডিও এবং প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বিভিন্ন মানচিত্র এবং ফটোগ্রাফের সংগ্রহ। মাউন্ট আরারাত সেকশনেও তারা ডিজিটাল লক ব্যবহার করে প্রবেশ করে। এ ডিজিটাল লকেরও কোড একমাত্র রেক্টর সাহেবই জানেন। আর এ কোড তিনি সংরক্ষিত রেখেছেন তার কম্পিউটারের গোপন ফাইলে।
মিউজিয়ামের আরারাত সেকশনে একটা অবাক ব্যাপার দেখা গেছে। সেটা হলো, সেকশনের সবগুলো জিনিস যেমন ছিল তেমনি আছে। চোর-ডাকাত ঢুকলে বা কোন কিছু খোঁজার জন্যে কেউ ঢুকলে যেমন একটা লণ্ডভণ্ড দশা হওয়ার কথা, তেমন অবস্থা নয়। দুষ্কৃতিকারীরা কেন ঢুকেছিল, কি নিয়ে গেছে, তা এখনও পরিষ্কার হয়নি। লগ দেখে সবকিছু মেলানোর পর বোঝা যাবে কি হারিয়েছে।
এই রক্তাক্ত ও দুঃসাহসিক ঘটনা কে বা কারা ঘটাল তা পরিষ্কার হয়নি। দুষ্কৃতিকারীদের যে একজন মারা গেছে, তাকে প্রাথমিকভাবে তুর্কি নাগরিক বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে মনে করা হচ্ছে, ঘটনা যে বা যারাই ঘটাক, মিউজিয়ামের রেক্টরের সহযোগিতা ছাড়া হয়নি। কারণ, রেক্টরের কক্ষের এবং মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনের ডিজিটাল লক খোলার ক্ষেত্রে তার সহযোগিতার বাইরে আর কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, এই সন্দেহবশেই রাতেই ভ্যানের সম্মানিত প্রবীণ অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ড. মাহজুন মাজহারের বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞ মহল বলছেন, কি সত্য বেরিয়ে আসবে তা পরে জানা যাবে, তবে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ড. মাহজুন মাজহারের মত একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে কোন প্রকার হয়রানি করা ঠিক হবে না। তিনি শুধুই একজন সম্মানিত ব্যক্তি নন, তার পরিবারও ঐতিহ্যবাহী। তুর্কি-আর্মেনীয় মিশ্র রক্তের এই পরিবারটির অবদান আছে ভ্যানের রাজনীতি ও ইতিহাসে। এই পরিবারটি অতীতেও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে। ড. মাহজুন মাজহারের একজন কৃতী পূর্বপুরুষ, ভ্যান শহরের জনপ্রিয় মেয়র বেড্রোম কাপামাসি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
সর্বশেষ খবর:
আমাদের পত্রিকার তৃতীয় সংস্করণ ছাপার জন্যে যখন প্রেসে যাচ্ছে, তখন সর্বশেষ খবর হলো, মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশন থেকে খৃস্টপূর্ব ৩শ’ অব্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ হারিয়ে গেছে। এই ম্যাপটি তৈরি হয়েছিল সেই সময়ের ওরান্তি রাজবংশের তত্ত্বাবধানে। ভিন্ন ধরনের এক গ্রীষ্মকালে মাউন্ট আরারাতের সব দিকের, সব অংশের এই বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করেছিলেন রাজসভার একজন ভূ-বিজ্ঞানী। মনে করা হচ্ছে, দুষ্কৃতিকারীরাই এই ম্যাপ নিয়ে গেছে।
কিন্তু একটা পুরানো ম্যাপের জন্য এতবড় রক্তাক্ত ও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালিত হওয়ায় সচেতন মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।’
আহমদ মুসা রিপোর্টটি কয়েকবার পড়ল। তার নিশ্চিত মনে হলো, ভ্যান পুরাতত্ত্ব মিউজিয়ামের এই ডাকাতির সাথে উল্কিওয়ালা অর্থাৎ ড. আজদাদের প্রতিপক্ষ যারা, তাদের যোগ আছে। সব বাদ দিয়ে মাউন্ট আরারাতের মানচিত্র হারাবার কারণ এটাই। কিন্তু মানচিত্রটিতে কি ছিল? কেন তা এত মূল্যবান হলো? এ বিস্ময় আহমদ মুসার মনে সৃষ্টি হলো।
আর এই ডাকাতির সাথে ড. মাহজুন মাজহারের যোগ আছে বলে তার মনেই হলো না। ড. মাহজুন মাজহারের চেহারা দেখেই তার মনে হয়েছে, তিনি নির্দোষ। আর নিউজে তার অপরাধী হওয়ার যে ভিত্তির কথা বলা হয়েছে, তাও খুব ঠুনকো। অনুসন্ধান তো পরের কথা, সাধারণ যুক্তিতেই তা টিকবে না।
ভাবনাতেই আপনা-আপনি আহমদ মুসার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পায়ের শব্দে চোখ খুলল আহমদ মুসা। দেখল, সাহিবা সাবিত আসছে।
সাহিবা সাবিতের হাসি-খুশি চেহারা গভীর উদ্বেগে ভরা। মুখ শুকনো। শুকনো কণ্ঠে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি কি ক্লান্ত? আপনার চোখ বুজে আসছে দেখলাম।’
‘না মিস সাহিবা সাবিত, ঘুমাচ্ছিলাম না, ভাবছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ভাবছিলেন এত গভীরভাবে?’ জিজ্ঞাসা সাহিবা সাবিতের।
‘ভাবছিলাম মিউজিয়ামে ডাকাতির ঘটনা নিয়েই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দেখলেন তো ব্যাপারটা কি সাংঘাতিক! আর বাবাকে দায়ী করা হয়েছে কিভাবে? সূর্য পূর্বে না উঠে, পশ্চিমে উঠা সত্য ভাবতে পারি, কিন্তু ঘটনার সাথে বাবা বিন্দুমাত্র জড়িত আছেন তা বিশ্বাস করবো না। কিন্তু পুলিশকে এ কথা বিশ্বাস করাবে কে?’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘স্যার, পুলিশের বড় কর্তা এসেছেন। আব্বাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আপনি কি যাবেন ওখানে?’
‘কে, কোন অফিসার এসেছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ভ্যানের পুলিশ প্রধান ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মাহির হারুন এসেছেন। তিনি পুলিশের পূর্ব তুরস্ক মানে আনাতোলিয়া জোনেরও প্রধান।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘চল যাই, দেখি ওনারা কি আলোচনা করছেন।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘চলুন স্যার।’ বলে হাঁটতে শুরু করল সাহিবা সাবিত।
নিচের তলার ড্রয়িং রুমে বসেছিল ভ্যানের পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন।
একটি সোফায় বসেছিল মাহির হারুন। তার সামনের সোফায় সাহিবা সাবিতের বাবা ড. মাহজুন মাজহার বসেছিল। আরও দু’জন পুলিশ ডিজিপি মাহির হারুনের পেছনের সোফায় বসেছিল।
ড. মাহজুন মাজহারের ডানপাশের আড়াআড়ি সোফায় বসেছে ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদা আয়েশা।
সাহিবা সাবিত পিতার পাশেই বসেছিল। সেখান থেকেই সে উঠে গিয়েছিল আহমদ মুসার কাছে।
দোতলা থেকে নামার সিঁড়ির গোড়াতেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। সেটাই বাড়ির অতিথি ড্রইং রুম। এখানেই বসেছে পুলিশ এবং ড. মাহজুন মাজহাররা।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছিল আহমদ মুসা ও সাহিবা সাবিত।
সাহিবা সাবিত আগে ছিল। আর আহমদ মুসা নামছিল তার পিছে পিছে।
ভ্যান পুলিশের ডিজিপি মাহির হারুনের সোফাটা ছিল সিঁড়িমুখী।
পায়ের শব্দেই সম্ভবত ডিজিপি মাহির হারুন মুখ তুলে তাকাল সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়ির ওপর তার চোখ পড়তেই চোখটি যেন চলে গেল আহমদ মুসার ওপর। সম্ভবত আহমদ মুসাকে পরিপূর্ণভাবে দেখা শেষ হতেই এক অপার বিস্ময়ে ছেয়ে গেল তার মুখ। ধীরে ধীরে বিস্ময়ের বদলে তার চোখে-মুখে নেমে এল সমীহ এবং দেহে একটা জড়সড় ভাব।
আহমদ মুসা সিঁড়ি থেকে ফ্লোরে নেমে এসেছে।
ডিজিপি মাহির হারুন এবং ড. মাহজুন মাজহারের কাছাকাছি এসে গেছে আহমদ মুসা।
ডিজিপি মাহির হারুন অনেকটা সম্মোহিতের মত উঠে দাঁড়িয়েছে। অজান্তেই যেন পা ঠুকে স্যালুট দিল আহমদ মুসাকে। তার চোখে ভেসে উঠেছে, জেনারেল মোস্তফার মত তুরস্কের ডাকসাইটে সিকিউরিটি চীফ এবং নাজিম এরকেনের মত তুরস্কের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও রাশভারী পুলিশ প্রধানের কথা। এই মি. খালেদ খাকানের ব্যক্তিত্বের কাছে তারা যেভাবে নরম হয়ে পড়েছে এবং সব ব্যাপারে তাকে যেভাবে সমীহ করেছে, তাতে মি. খালেদ খাকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্যে কঠিন।
স্যালুট দেয়ার পর ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে!’
আহমদ মুসা ডিজিপি মাহির হারুনের সাথে হ্যান্ডশেইকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় ডিজিপি মাহির হারুন। কিন্তু আপনি কি আমাকে চেনেন? আমার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না?’
ডিজিপি মাহির হারুন একটু মাথা নুইয়ে হ্যান্ডশেইক করে বলল, ‘স্যার, আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।’
‘কিভাবে?’ আহমদ মুসা বলল। কিছুটা বিস্মিত হয়েছে সে। আহমদ মুসা তো তুরস্কের এ অঞ্চলে কখনো আসেনি।
‘স্যার, আমি ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলাম তুরস্কের সিকিউরিটি প্রধান জেনারেল মোস্তফা কামালের সাথে দেখা করার জন্য। তিনি তখন ওখানেই ছিলেন। সেখানে জেনারেল মোস্তফার সাথে আপনাকে প্রথম দেখি। দ্বিতীয়বার দেখি আপনাকে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। আমি আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসারের সাথে আমাদের স্যার তুরস্কের পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে আপনাকে নিয়ে তার অফিসে ঢুকতে দেখেছিলাম। তৃতীয়বার দেখেছি আপনাকে প্রেসিডেন্ট ভবনে। তখন অফিসের এক কাজে আংকারা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম আমি। প্রেসিডেন্ট আপনাকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়ার অনুষ্ঠান করছিলেন। সেসময় প্রেসিডেন্ট হাউজের লনে অন্য অনেকের সাথে আমিও ছিলাম।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘ধন্যবাদ অফিসার।’ আহমদ মুসা বলল। সেই সাথে ভাবল, ডিজিপি মাহির হারুন এ কথা না বললেই ভালো হতো। কথাগুলো হাটে হাঁড়ি ভাঙার মত হয়েছে, যা এই পর্যায়ে আহমদ মুসার কাম্য ছিল না।
‘এক্সকিউজ মি স্যার। আপনি তো বিশেষ বিমানে সেদিন ম্যাডামসহ মদিনায় ফিরে গেলেন। কিন্তু ভ্যানে কিভাবে এলেন আপনি?’ বলল ডিজিপি মাহর হারুন।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘ম্যাডাম মদিনা গেছেন আর আমি ভ্যানে নেমেছি।’
বলে আহমদ মুসা ড. আজদা আয়েশাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর একটা আহ্বানে আমি এখানে এসেছি।’
‘ওয়েলকাম স্যার। আমাদের ‘ভ্যান’ ও আরারাত অঞ্চল সৌভাগ্যবান আপনাকে পেয়ে। আতিথ্য করার সুযোগ পেলে আমি ধন্য হবো স্যার।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘ধন্যবাদ অফিসার।’
বলে আহমদ মুসা একটা সিংগল সোফা পেছন থেকে টেনে নিয়ে বসতে যাচ্ছিল।
ডিজিপি মাহির হারুন তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়িয়ে নিজের আসনে আহমদ মুসাকে বসতে আহ্বান জানিয়ে আহমদ মুসার হাত থেকে সোফাটি নিয়ে নিল।
আহমদ মুসা গিয়ে ডিজিপি’র সোফায় বসলে মাহির হারুন আহমদ মুসার পাশে এসে বসল।
সাহিবা সাবিত, ড. মাহজুন মাজহার, ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদা সকলের মুখ বলা যায় বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার ডিজিপি হারুন তাদের আবু আহমদ আবদুল্লাহকে ‘স্যার’ বলছেন! তাকে স্যালুট করছেন! তাকে চেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন! তাদের আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন! তুরস্কের পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন ও তুরস্কের ‍সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান জেনারেল মোস্তফা তাদের আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বৈঠক করেন একান্তে! একি তারা শুনল! তাদের আবু আহমদ আব্দুল্লাহর নাম খালেদ খাকান! সব বিস্ময়ের সম্মিলিত ভারে তারা হতবাক, হতভম্ব। আহমদ মুসাকে চেয়ার দেয়ার কথাও তার ভুলে গেছে।
‘স্যার. আপনি ভ্যানে এসেছেন জানলাম, কিন্তু হঠাৎ এখানে?’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘আমি আরিয়াস থেকে ভ্যানে এসেছিলাম একটা কাজে। ড. মাহজুনরা ড. আজদাদের বন্ধু পরিবার। ড. মাহজুন মাজহারদের এই বিপদের কথা শুনে ড. আজদা, ড. সাহাব নুরী এসেছেন। আমিও তাদের সাথে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আমার জন্যে এক বিরাট সমস্যা। ড. মাহজুন মাজহার সম্মানিত পরিবারের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ভ্যান মিউজিয়ামের ভয়ানক ঘটনার দায় এড়াতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোন যুক্তি তার কাছেও নেই দেখলাম। এই অবস্থায় আইনের দাবি তো আমাকে পূরণ করতেই হবে। এটা আমার জন্যে এক উভয় সংকট স্যার।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
আহমদ মুসা ও ডিজিপি মাহির হারুনের কথা সবাই দারুণ আগ্রহে শুনছিল। ডিজিপি মাহির হারুনের শেষ বক্তব্যটা শুনে সাহিবা সাবিত ও ড. আজদাদের মুখ যেন অমাবস্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ডিজিপি মাহির হারুনের কথার অর্থ কি তারা বোঝে। আহমদ মুসার নতুন পরিচয় এবং ডিজিপির সাথে তার সম্পর্ক দেখে তারা যতখানি খুশি হয়ে উঠেছিল, ততখানিই তারা আবার হতাশায় ডুবে গেল।
ডিজিপির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠল। বলল ডিজিপি মাহির হারুনকে, ‘এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে পরে কথা বলছি। আপনি একটু বলুন, দুষ্কৃতিকারীদের যে লোকটি মারা গেছে, তার লাশ কোথায়?’
‘সুরতহাল রিপোর্টের পরপরই লাশ পোস্টমটের্মের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’ ডিজিপি বলল।
‘লাশটি এখন কোথায় খোঁজ নিয়ে একটু জানবেন? লাশের একটা বিষয় সম্পর্কে আমার জরুরি জানা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিষয়টা কি বলুন। জানার জন্যে চেষ্টা করে দেখি।’ ডিজিপি বলল।
‘লাশের দুই বাহু দেখতে বলুন তাতে কোন উল্কি আঁকা আছে কিনা। থাকলে উল্কিটা কিসের?’ বলল আহমদ মুসা।
ডিজিপি মাহির হারুন তার মোবাইল বের করে কল করল সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে। কানেকশন হয়ে গেলে ডিজিপি বিষয়টি অফিসারকে বুঝিয়ে বলে নির্দেশ দিল, ‘বিষয়টি জেনে অবিলম্বে আমাকে জানাও।’
মোবাইল অফ করে পেছনে বসা পুলিশ অফিসারদের কয়েকটি নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসার দিকে ঘুরতেই ডিজিপি মাহির হারুনের মোবাইল আবার বেজে উঠল।
কল অন করে ওপারের কথা শুনে বলল, ‘তুমি নিশ্চিত তো?’
ওপারের জবাব শুনে ‘থ্যাংক ইউ অফিসার’ বলে কল অফ করে দিল। তার মুখটা সাফল্যে উজ্জ্বল।
ডিজিপি আহমদ মুসার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি যা চাচ্ছিলেন, তা পাওয়া গেছে। লাশের ডান বাহুতে উল্কি আছে, মাউন্ট আরারাতের সিম্বলিক উল্কি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার, আমি এটাই আশা করছিলাম। এই একই গ্রুপ ভ্যান মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনে ঢুকেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আমি বুঝতে পারছি না এরা কোন গ্রুপ?’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘আমিও জানি না। আমি এটা বের করার চেষ্টা করছি। তবে উল্কিটাই এদের আইডেনটিফাইং মার্ক। এই গ্রুপই ড. আজদাকে এ পর্যন্ত একবার কিডন্যাপ ও দু’বার হত্যার চেষ্টা করেছে। এ খবর পত্রিকাতেও এসেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জ্বি স্যার, এ রক্তাক্ত ভয়ানক ঘটনার খবর আমি পত্রিকায় পড়েছি।’
বলে একটু থামল ডিজিপি হারুন। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘স্যার, আজদাকে বারবার আক্রমণ করা এবং মিউজিয়ামের আরারাত সেকশনে হানা দেয়া সন্ত্রাসীরা একই গ্রুপ, কিন্তু লক্ষ্যের সাজুয্য কোথায়? এরা কি চায়?’
‘অফিসার, এটাই এখনকার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এর সাথে সহযোগী প্রশ্নগুলো হলো, এরা মাউন্ট আরারাতের উল্কি বাহুতে লাগায় কেন? এরা মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনে হানা দিয়ে মাউন্ট আরারাতের একটা পুরানো মানচিত্র নিয়ে গেল কেন? তারা আরিয়াসসহ ইজডির অ্যাগ্রি, কারস, ভ্যান বিশেষ করে মাউন্ট আরারাত সন্নিহিত ইজডির এলাকা থেকে অত্যন্ত নীরবে বিশেষ ধরনের লোকদের জেল-জুলুমের শিকার বানিয়ে এলাকা ছাড়া করে এবং সে স্থানে বিশেষ শ্রেণীর লোকদের বসানো হচ্ছে কেন? সব প্রশ্নেরই জবাব প্রয়োজন।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কথা সরলো না ডিজিপি মাহির হারুনের মুখ থেকে। তার বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে, মাত্র ক’দিন হলো আহমদ মুসা এসেছে, এর মধ্যেই ভয়ানক ধরনের এত কথা জানল কি করে, যা সে এই অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশ অফিসার হয়েও জানে না! বলল সে একটু সময় নিয়ে, ‘স্যার, মাত্র কয়েকটা বাক্যে আপনি এই অঞ্চলের একটা ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেছেন। দুঃখিত স্যার, এভাবে আমি বিষয়টাকে জানি না। একটা ঝামেলা এই এলাকায় হচ্ছে, ড্রাগ সমস্যা হঠাৎ করেই যেন এই এলাকায় বেড়ে গেছে। পুলিশ এ সংক্রান্ত সব ঘটনাকেই সিরিয়াসলি দেখছে। কিন্তু এ সবের পেছনে কোন গভীর অর্থ বা গভীর ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা আমার সামনে নেই, পুলিশ অবশ্যই জানে না। তবে স্যার, আপনি যখন বলছেন, তখন এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশেষ শ্রেণীর উচ্ছেদ হওয়া এবং বিশেষ এক শ্রেণীর পুনর্বাসিত হওয়ার যে কথা বলেছেন, তার পেছনের উদ্দেশ্য কি?’
‘এই উদ্দেশ্য অনুসন্ধানের বিষয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন স্যার? আমার মনে হয়, আপনি বিষয়টিকে টেকআপ করেছেন।’ ডিজিপি মাহির হারুন বলল।
‘আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। বিষয়টি নিয়ে আমি এখনও খুব চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পাইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আপনি বিষয়টি দেখুন। আমরা আপনাকে সহযোগিতা করব।’
‘ধন্যবাদ অফিসার। এ নিয়ে আপনার সাথে পরে কথা বলব। এখন বলুন, ভ্যান মিউজিয়ামে হানা দেয়া সম্পর্কে। ড. মাহজুন মাজহারকে আপনাদের দোষী মনে হচ্ছে কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, দোষী মনে করা হচ্ছে না, দোষী হয়ে পড়ছেন। তার অফিস কক্ষে ঢুকেই এ্যালার্ম নেটওয়ার্ক ও ক্লোজ সার্কিট নেটওয়ার্ক নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। আর তার অফিস কক্ষের এবং মিউজিয়ামের আরারাত সেকশনে প্রবেশের ডিজিটাল লকের কোড একমাত্র তিনিই জানেন। অতএব দায়গুলো তার ওপরই বর্তাচ্ছে।’ ডিজিপি মাহির হারুন বলল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল ড. মাহজুন মাজহারের দিকে চেয়ে, ‘স্যার, আপনাদের মিউজিয়ামের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা মিউজিয়ামের কতটা কভার করে?’
‘মিউজিয়ামের সবটা কভার করে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এমনকি কম্পাউন্ডের ভেতর যে কয়জন স্টাফ বাস করেন, তাদের এলাকাও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চোখের আওতায় রয়েছে।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘ধন্যবাদ, আপনার অফিস কক্ষ ও মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনের বাইরের দরজা এলাকা এবং ভেতরের অবস্থান কি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চোখে রয়েছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘জ্বি, সবটাই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায়।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘ধন্যবাদ স্যার’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ডিজিপি মাহির হারুনের দিকে। বলল, ‘আমি বলছি, শুনুন প্লিজ। ভ্যান মিউজিয়ামের রেক্টর ড. মাহজুন মাজহার প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তার তর্জনী দিয়ে ডিজিটাল কী’তে নক করে দরজা খোলেন এবং প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে একইভাবে ডিজিটাল লকের কী’তে তর্জনী দিয়ে নক করে দরজা বন্ধ করেন। প্রতিদিনই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চোখ নিখুঁতভাবে প্রত্যক্ষ করে এবং সে নিখুঁত ছবিটি পাঠিয়ে দেয় সিকিউরিটি কক্ষের স্ক্রীনে। যারা সেখানে বসেন, তারা এটা প্রত্যক্ষ করেন এবং ছবিগুলো সিরিয়াসলি সংরক্ষিত হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আর্কাইভ ফাইলে। সিকিউরিটি রুমে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ডিসপ্লে স্ক্রীন যারা দেখেন, তারা ইচ্ছা করলে ড. মাহজুন মাজহার তর্জনী দিয়ে অফিস কক্ষ ও মাউন্ট আরারাত সেকশনের ডিজিটাল লকের যে নব বা কীগুলোতে নক করেন, তা মুখস্থ করে ফেলতে পারে। আবার প্রতিদিনের যে ছবিগুলো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আর্কাইভে জমা হয়, তা থেকেও ইচ্ছা করলে কেউ সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো সংগ্রহের মাধ্যমে ড. মাহজুন মাজহারের অফিস কক্ষ ও মাউন্ট আরারাত সেকশনের ডিজিটাল লকের ওপেনিং ও ক্লোজিং কোড নাম্বার করায়ত্ত্ব করতে পারে। যারা পরিকল্পনা করে ভ্যান মিউজিয়ামে রক্তাক্ত হানা দেয়ার কাজ করেছে, তারা এই দুই উৎস থেকে ডিজিটাল লক দু’টোর ওপেনিং ও ক্লোজিং কোড নাম্বার জোগাড় করতে অবশ্যই পারে। সিকিউরিটি সিস্টেমে এই লুক হোলস থাকার পর ড. মাহজুন মাজহারকে দোষ দেবার কোন সুযোগ নেই।’ থামল আহমদ মুসা।
ডিজিপি মাহির হারুন দুই চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তার মনে তোলপাড়। সত্যি তো, এ দিকটা তো তারা বিবেচনা করে দেখেনি। ডিজিটাল লক দু’টির সিক্রেট কোড এই দুই পথে ফাঁস হওয়া যতটা সহজ, ড. মাহজুন মাজহারকে দোষী বানানো ততটাই কঠিন। তার মন খুশি হয়ে গেল। সে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ খুলে দিয়েছেন। সত্যি বলেছেন, সিকিউরিটি সিস্টেমে এই লুক হোলস থাকার পর ড. মাহজুন মাজহারকে কিছুতেই দায়ী করার সুযোগ নেই।’
বলেই ডিজিপি মাহির হারুন পেছন ফিরে ভ্যান শহরের ডাইরেক্টর অব পুলিশ (ডিপি) আফেনদি আফেটকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি ভ্যান মিউজিয়ামের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মনিটরিং কক্ষসহ গোটা সিকিউরিটি অফিসে গত ছয় মাসে সিভিলিয়ান যারা প্রবেশ করেছেন, তার সব ফিল্ম সিজ করো। আর ক্লোজ সার্কিট নেটওয়ার্কের ফিল্ম আর্কাইভও তুমি বাজেয়াপ্ত করো। তারপর সিরিয়াসলি পরীক্ষা করে দেখ, কোন অংশ খোয়া গেছে কিনা, খোয়া গেলে খোয়া যাওয়া অংশটা কি?’
কথা শেষ করে ঘুরে বসল ডিজিপি মাহির হারুন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ড. মাহজুন মাজহারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমাদের মাফ করুন স্যার। আপনাকে এভাবে হয়রানি করার জন্যে দুঃখিত আমরা। এই সাথে আমরা শুকরিয়া আদায় করছি আমাদের সম্মানিত অতিথি খালেদ খাকানকে। তিনি আমাদের যে সহযোগিতা করেছেন তা অমূল্য। আর তিনি শুধু আমাদের কেন, সমগ্র তুরস্কের সম্মানিত বন্ধু। খোদ আমাদের প্রেসিডেন্ট তাকে অভিনন্দিত ও সম্মানিত করেছেন। আমরা আনন্দিত যে, আল্লাহ তাকে এখানে এনেছেন। আমাদের আশা, তার সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা আমরা পাব।’ থামল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘ধন্যবাদ অফিসার, এটা কোন হয়রানি নয়। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। রক্তাক্ত ও রহস্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে আমার প্রতিষ্ঠানে। আপনারা যা করেছেন, করছেন সবই আমাদের প্রতিষ্ঠান ও দেশকে সাহায্যের জন্যেই। আমার সম্মানিত অতিথি আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে ধন্যবাদ দেবার কোন ভাষা আমার জানা নেই। প্রেসিডেন্ট যাকে অভিনন্দিত করেন, যার প্রশংসা করেন, তার ব্যাপারে আমি আর কি বলব। তিনি আমাকে বিস্মিত, অভিভূত করেছেন। আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদাকে। তারাই এই সম্মানিত মেহমানকে এখানে এনেছিলেন। আমি মনে করি, এই রক্তাক্ত ঘটনার ব্যাপারে তার যে দূরদৃষ্টি ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দেখলাম, তাতে আমি নই, পুরো দেশই উপকৃত হবে। আল্লাহ তাকে এবং আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন।’ থামল ড. মাহজুন মাজহার।
ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদার চোখে-মুখে গর্ব ও আনন্দের মিশ্রণ। আর তরূণী সাহিবা সাবিতের সুন্দর মুখ অপার মুগ্ধতায় আরও অপরুপ হয়ে উঠেছে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা তার মুগ্ধ দৃষ্টি থেকে শ্রদ্ধা, সম্মানের যেন বন্যা ছুটছে আহমদ মুসার প্রতি। উজাড় করে দিচ্ছে যেন তার হৃদয়কে। নির্বাক সে।
‘দুঃখিত, ঘটনা যা নয় তা বলা সুবিচার নয়, বিব্রতকর। আমি যদি উল্লেখযোগ্য কিছু করে থাকি, বলে থাকি, তার সব কৃতিত্বই আল্লাহর, আমার স্রষ্টার। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, শক্তি যাকে আমাদের বলি, তা আমাদের নয়, আল্লাহর দেয়া। সুতরাং প্রশংসা আমাদের তাঁরই করা উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার, এটাও আমাদের জন্যে বড় শিক্ষা। মনে রাখব স্যার। আমরা উঠি।’
বলে উঠে দাঁড়াল ডিজিপি মাহির হারুন।
তারপর আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেইক করতে করতে বলল, ‘স্যার, আমার অফিসে, আমার বাড়িতে আপনাকে ওয়েলকাম। আর আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার অনুমতি দিন স্যার।’
‘ধন্যবাদ অফিসার! ড. আজদার কাছে আমার টেলিফোন নাম্বার পাবেন। আর আমার চেয়ে আপনাকেই আমার বেশি দরকার হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে হবে আমার সৌভাগ্য স্যার।’ বলে সালাম দিয়ে ডিজিপি মাহির হারুন ঘুরে দাঁড়াল যাবার জন্যে।
ড. আজদা তাড়াতাড়ি উঠে এসে আহমদ মুসার টেলিফোন নাম্বার লেখা একটা স্লীপ ডিজিপি মাহির হারুনের হাতে তুলে দিল।
ধন্যবাদ ড. আজদা।’ কাগজটি হাতে নিয়ে বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
পুলিশ অফিসাররা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘সাহাব, আজদা তোমাদের নাস্তা করা হয়নি নিশ্চয়? তোমরা তো খুব সকালে বেরিয়েছ।’ পুলিশ অফিসাররা বেরিয়ে যেতেই বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘ঠিক, নাস্তার কথা আমাদের খেয়ালই হয়নি। তবে এ নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।’ বলল ড. সাহাব নুরী সপ্রতিভ কণ্ঠে।
‘আমরাও নাস্তা করিনি। ঠিক আছে, চল ওপরে যাই।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘নাস্তা তৈরি হচ্ছে বাবা। আমি একবার ওপরে গিয়ে দেখে এসেছি।’ বলল সাহিবা সাবিত।
আহমদ মুসা বলল, ‘নাস্তার তুর্কি সময় এখনও হয়নি। ৯টা বাজতে এখনও অনেক সময় বাকি। আমি কাগজ পড়া শেষ করতে পারিনি।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ড. মাহজুন মাজহার বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। ৯টা বাজতে এখনও আধা ঘণ্টা বাকি।’
থামল একটু, আবার বল সাহিবা সাবিতের দিকে তাকিয়ে, ‘মা, ওকে স্টাডিতে নিয়ে যাও। আমরা আসছি। একসাথে নাস্তা করব।’
সাহিবা সাবিত খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে কয়েক ধাপ আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে বলল, ‘স্যার, আসুন।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দু’জন এগোতে শুরু করেছে দু’তলায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
ড. আজদা ডাকল সাহিবা সাবিতকে।
‘এক্সকিউজ মি!’ বলে ছুটে এল সাহিবা সাবিত ড. আজদার কাছে। ড. আজদা তাকে কানে কানে কিছু বলল, ‘রাঙা’ হয়ে গেল সাহিবা সাবিতের মুখ। ‘ওকে!’ বলে ছুটেই আবার ফিরে গেল আহমদ মুসার কাছে।
দু’জনে আবার হাঁটতে লাগল সিঁড়ির দিকে।
সামনে হাঁটছে সাহিবা সাবিত।
ঘাড় ফিরিয়ে সাহিবা সাবিত বলল, ‘স্যার, একটা কথা বলি?’
‘বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাঃ আবার আপনিতে উঠলাম! তখন স্টাডিতেই তো আমাকে তুমিতে নামিয়েছেন।’ বলল সাহিবা সাবিত। তার ‍মুখে দুষ্টুমির হাসি।
‘বলেছি নাকি! ঠিক আছে, কি বলবে বল।’ নির্বিকার কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি বলতে চাচ্ছি, বিশ্ববিখ্যাত চরিত্র ‘শার্লক হোমস’, ‘রবিনহুড’ যেমন তাদের আসল নাম নয়, তেমনি ‘আবু আহমদ আব্দুল্লাহ’ ও ‘খালেদ খাকান’ কোনটাই আপনার আসল নাম নয়!’ সাহিবা সাবিত বলল।
‘‘শার্লক হোমস’ ও ‘রবিনহুড’ সেই লোকদের আসল নাম ছিল কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমাকে তোমার সন্দেহ হওয়ার কারণ?’ বলল আহমদ মুসা। তার চোখে কিছুটা বিস্ময়।
‘ডিজিপি সাহেব আপনার নাম বললেন খালেদ খাকান, আর আমাদের কাছে আপনার নাম আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। তার মানে, তুরস্কের ওমাথা থেকে এমাথায় এসেই আপনি নাম পাল্টেছেন তাহলে ওমাথাতেও আপনি নাম পাল্টেছেন?’ সাহিবা সাবিত বলল।
‘চমৎকার যুক্তি দিয়েছ সাহিবা সাবিত। তোমার ওকালতি পড়া দরকার ছিল।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে এবার স্পষ্ট হাসি।
‘কথা অন্য দিকে ঘোরাবেন না প্লিজ স্যার, আমার কথার জবাব দিন।’ সাহিবা সাবিত বলল।
‘তুমি একটা জটিল প্রশ্ন করেছ। প্রশ্নটির ‍উত্তর দেয়া এখন সম্ভব নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জটিল প্রশ্ন? আসল নাম বলা জটিল হবে কেন? আমি এ যুক্তি মানছি না।’ সাহিবা সাবিত বলল। হালকা জেদ ফুটে উঠল সাহিবা সাবিতের কণ্ঠে।
‘জটিলতা আছে। অনেক সময় নানা কারণে নাম গোপন করতে হয়। মানে এটা তেমনই একটা সময়।’ বলল আহমদ মুসা। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
সাহিবা সাবিত পেছন দিকে ফিরে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসাকে বোঝার চেষ্টা করছে যেন।
‘ঠিক আছে, এই সময়ের জন্যে মানলাম, সব সময়ের জন্যে নয়।’ সাহিবা সাবিত বলল। তার মুখে হাসি।
তারা স্টাডি রুমে পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার আগের চেয়ারেই বসল।
‘স্যার, আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।’ বলে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে সাহিবা সাবিত।
আহমদ মুসা ‘ভ্যান টাইম’ আগেই পড়েছিল। এবার ভ্যানের আরেকটি বড় পত্রিকা ‘ভ্যান-এক্সপ্লোরার’ টেনে নিয়ে তাতে মনোযোগ দিল।
একসময় ঘরে পায়ের শব্দে মুখ তুলল আহমদ মুসা। দেখল সাহিবা সাবিতকে নতুন রূপে। পরনে হালকা সবুজ সালওয়ার এবং সেই হালকা সবুজ ফুলহাতা কামিজ। একই রঙের ওড়না মাথা ও গায়ে পেঁচানো। নতুন পোশাকের ওপর আহমদ মুসার চোখ আটকে গিয়েছিল।
‘স্যার কেমন লাগছে বলুন।’ মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল সাহিবা সাবিত।
‘একজন মুসলিম মেয়ের মত লাগছে।’ বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
‘তার মানে, আগে আমি মুসলিম মেয়ে ছিলাম না?’ বলল সাহিবা সাবিত প্রতিবাদের কণ্ঠে।
‘তুমি মুসলিম ছিলে, কিন্তু মুসলিমের মেয়ে ছিলে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইসলামের কি কোন কম্পালসারি ড্রেসকোড আছে?’ জিজ্ঞাসা সাহিবা সাবিতের। সে আহমদ মুসার মুখোমুখি এসে বসেছে।
‘‘ড্রেস কোড’ বলতে অনেকটা ইউনিফর্ম ড্রেস বোঝায়। সে রকম কোন ড্রেস কোড ইসলামে নেই। ইসলাম একটা প্রিন্সিপাল বলে দিয়েছে। বলেছে, মেয়েদের তাদের সৌন্দর্যের স্থানগুলোকে ঢেকে রাখতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সাহিবা সাবিতের মুখটা একটু রাঙা হয়ে উঠল। একটু ভাবল। বলল, ‘এই হুকুম ছেলেদের ওপর নেই কেন?’
‘ছেলেদের সম্পর্কেও বলা হয়েছে। তাদের পোশাক হাঁটুর ওপরে উঠতে পারবে না। তবে ‘সৌন্দর্যের স্থানগুলো ঢাকতে হবে’-এই ধরনের নির্দেশ ছেলেদের ক্ষেত্রে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই নির্দেশের কথাই আমি বলছি স্যার। এমন নির্দেশ মাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রে আসবে কেন?’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘এর পক্ষে অনেক যুক্তি, অনেক কথা আছে। আমি মাত্র একটা সহজ যুক্তির কথা বলব সাহিবা।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘সুন্দর ও মূল্যবান জিনিস আড়াল করতে হয় অন্যের নজর থেকে। কারণ, অন্যের লোভ অনর্থের সৃষ্টি করতে পারে। মেয়েরা বা মেয়েদের সৌন্দর্য তেমনি একটা বস্তু যা আড়াল করতে হয়।’
‘যুক্তিটা বুঝলাম স্যার। কিন্তু ছেলেদের সৌন্দর্য আড়াল করতে হবে না কেন? তা কি লোভের বস্তু নয়?’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘তোমার প্রশ্ন খুবই সংগত সাহিবা সাবিত। কিন্তু সমস্যা হলো, পুরুষরা নিজেদের রক্ষা করতে পারে, মেয়েরা তাদের রক্ষা করতে পারে না। আরেকটা বড় বিষয় হলো, মেয়েরা এই বিষয়ে পুরুষদের ওপর আক্রমণাত্মক নয়। অন্যান্য জীবজগতেও দেখবে, এটাই সত্য। প্রকৃতিগতভাবেই মেয়ে প্রজাতি এই ক্ষেত্রে নন-এ্যাগ্রেসিভ, সংরক্ষণবাদী। অন্যদিকে এক্ষেত্রে পুরুষরা একেবারেই ‍উল্টো। নারীরা, নারীদের সৌন্দর্য পুরুষদের শুধু আক্রমণ নয়, ভায়োলেন্সেরও শিকার হয়। প্রাচীন, আধুনিক সব ইতিহাস এ ধরনের ঘটনায় ভরপুর। সুতরাং নারী ও নারীর সৌন্দর্য প্রয়োজন অনুযায়ী আড়াল করা তাদের এবং সমাজের জন্যে কল্যাণকর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সব যুক্তি মানলাম স্যার। কিন্তু সব মানুষ খারাপ নয়, বরং বেশিরভাগই ভালো। ইতিহাস এরও সাক্ষী। তাহলে কিছু খারাপ লোকের কারণে মেয়েদের জন্যে এত আয়োজন করতে হবে কেন?’ সাহিবা সাবিত বলল।
‘নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এমন ভালো মানুষ অনেক আছে, আবার অনেকে আছে যারা সুযোগ ও সাহসের অভাবে ভালো থাকে, কিন্তু শয়তান যেহেতু আছে, শয়তানী প্রবণতা থেকে কোন মানুষই মুক্ত নয়। এই কারণেই আল্লাহ সাবধান হওয়ার বিধানকে সাধারণ করে দিয়েছেন। এ বিধানের যৌক্তিকতার আরেকটা দৃষ্টান্ত দেখ, চোর সমাজের ক’জন, অপরাধী সমাজের ক’জন, কিন্তু দেখ, সাধারণভাবে সবার জন্যে আইন তৈরি হয়েছে। আইন সবাইকেই পাহারা দেয়। মেয়েদের সৌন্দর্য আড়ালের ব্যাপারটাও এরকমই।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করল।
কিন্তু কোন কথা এল না সাহিবা সাবিতের কাছ থেকে। ভাবছিল সে। তার চঞ্চল চোখ দু’টিতে অনেক প্রশ্ন। বলল, ‘স্যার, আপনি যা আমাকে বললেন, আমার ২৪ বছর বয়সে, আমার বাবা তা আমাকে বলেননি কেন? আমার বাবার মত লাখো বাবা তো এটা বলেন না! কেন বলেন না? জ্ঞান-শিক্ষায় তারা তো সমাজের শীর্ষে!’
‘সাহিবা সাবিত, বিষয়টা বুঝতে সমাজ-সভ্যতার গভীরে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। সভ্যতা-সংস্কৃতির একটা চরিত্র আছে। যে জাতি রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যখন শীর্ষে পৌঁছে, তখন চারপাশে অন্যজাতির ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তখন আধিপত্যের অধীন জাতিগুলোর জীবনে আধিপত্যকারীদের শিক্ষা-সংস্কৃতিই প্রভাবশীল হয়ে থাকে। সেটাই হয়েছে আমাদের জীবনে, মুসলিম দেশগুলোতে। এটা আধিপত্যবাদী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রবল স্রোত। এই স্রোতেই ভেসে যাচ্ছে সবাই। এককভাবে বাবাদের কোন দোষ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্রোত আপনাকে ভাসাতে পারেনি কেন?’ জিজ্ঞাসা সাহিবা সাবিতের।
‘চাইনি বলে।’ আহমদ মুসা বলল।
সাহিবা কিছু বলতে যাচ্ছিল। স্টাডিতে প্রবেশ করল ড. আজদা। বলল, ‘নাস্তা রেডি। সবাই নাস্তার টেবিলে গেছে।’
‘চলুন স্যার।’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সাহিবা সাবিত তাড়া দিল আহমদ মুসাকে।
নাস্তার টেবিলে সবাই বসল।
সাহিবা সাবিতের দিকে তাকিয়ে ড. মাহজুন মাজহার কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘সাহিবা সাবিত মা, জন্মের পর এই প্রথম তোমাকে এই পোশাকে দেখলাম। হঠাৎ এই পোশাক?’
‘বাবা, আমি মুসলিম মেয়ে হয়েছি। দেড় দু’ঘন্টায় বাবা আমি স্যারের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। আরও শিখতে চাই বাবা।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘ধন্যবাদ মা। আমি ও তোমার মা একসাথে তোমাকে নিয়ে এই ধরনের কয়েক সেট পোশাক তৈরি করে দিয়েছিলাম। বোধহয় পোশাকগুলো পরাই হয়নি।’ বলল মাহজুন মাজহার।
‘হ্যাঁ, বাবা তখন পোশাক তৈরি হয়েছিল, কিন্তু মন তৈরি হয়নি।’ হেসে বলল সাহিবা সাবিত।
ড. মাহজুন মাজহারের ঠোঁটেও মিষ্টি হাসি। বলল, ‘মনটা তৈরি হলো কখন মা?’
‘আজদা কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলল, আমাদের মেহমান এ ধরনের পোশাক পছন্দ করেন না, আর এ পোশাক পরেই তুমি তার সামনে ঘুরছ। আমি ওকে নিয়ে ওপরে এলাম। এসেই পোশাক পাল্টে ফেললাম। কিন্তু মনটা পাল্টে দিয়েছেন উনি।’ বলল সাহিবা সাবিত। তার মুখে আবেগ-রাঙা হাসি।
‘পাল্টে দিয়েছেন? মন কি দু’এক মিনিটে পাল্টাবার জিনিস?’ বলল ড. আজদা। তার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি। মনে হয় ঠোঁটের পেছনে যেন আরও কথা আছে।
‘কি বল আজদা! এক পলকের দেখা, একটা কথাতেও মনে ওলট-পালট ঘটে যেতে পারে।’ সাহিবা সাবিত বলল।
ড. আজদা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই ড. মাহজুন মাজহার বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এটাই হোক। মনে হচ্ছে, আমার মনের একটা অব্যক্ত চাওয়া যেন পূরণ হলো। এ চাওয়াটা আমার কাছেও যেন খুব স্পষ্ট ছিল না। আজ তোমাকে এই সুন্দর পোশাকে দেখে মনটা যখন আমার খুশিতে ভরে গেছে, তখন বুঝতে পারছি, আমার মন এটাই চাইতো।’
‘ধন্যবাদ বাবা।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘ধন্যবাদ আমাকে নয় মা, কৃতজ্ঞ হও আবু আহমদ আব্দুল্লাহর কাছে। উনি যেন এক পরশমণি। ওনার পরশে ঘটনা পাল্টে যায়, মানুষও পাল্টে যায়।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে অস্বস্তি। বলল, ‘গরম সুন্দর নাস্তা কিন্তু আমরা নষ্ট করে ফেলছি।’
‘স্যরি, ঠিক বলেছেন জনাব আব্দুল্লাহ। আসুন আমরা শুরু করি।’
বলেই প্লেট টেনে নিয়ে কাঁটা চামচ হাতে নিল ড. মাহজুন মাজহার।
সবাই নাস্তার দিকে মনোযোগ দিল।
নাস্তা শেষে সবাই কফি খাচ্ছে ড্রইং রুমে সোফায় ফিরে গিয়ে।
ড. আজদা চারদিকে চাইল। দেখল, সাহিবা সাবিত নেই। কফি তো নিল সে। কোথায় গেল কফি নিয়ে?
কফি হাতে নিয়েই খুঁজতে বেরুল সাহিবা সাবিতকে ড. আজদা।
সাহিবা সাবিতকে পেল ড. আজদা ড্রইং রুমের পাশের একটা ঘরে।
সাহিবা সাবিতের হাতে ক্যামেরা। কফিটা তার ঠাণ্ডা হচ্ছে ঘরের একটা টেবিলে।
‘তোর হাতে এ সময়ে ক্যামেরা! ক্যামেরা নিয়ে কি করছিস?’ ড. আজদা বলল।
‘তোমাদের মেহমান, বাবার পরশমণির কয়েকটা ছবি নিলাম এই জানালা দিয়ে। প্লিজ, তুমি ওকে কিছু বলো না।’ বলল সাহিবা সাবিত।
জানালার দিকে এগিয়ে ড. আজদা দেখল, সত্যিই জানালা দিয়ে আহমদ মুসাকে সম্মুখ থেকে দেখা যাচ্ছে।
ফিরে দাঁড়াল ড. আজদা সাহিবা সাবিতের দিকে। বিস্ময় তার চোখে। বলল, ‘কি সাহিবা, পরশমণি স্পর্শ করে ফেলল নাকি!’
‘বিদ্রূপ করো না আজদা। এই স্পর্শ আমার মত মেয়েদের সারা জীবনের চাওয়া হতে পারে।’ বলল সাহিবা সাবিত। তার কণ্ঠ গম্ভীর, আবেগে ভারি।
ড. আজদা দু’ধাপ এগিয়ে সাহিবা সাবিতের কাঁধে হাত রেখে দরদভরা কণ্ঠে বলল, ‘আমি বিদ্রূপ করিনি সাহিবা, আমার কথা তুমি বুঝেছ?’
সাহিবা সাবিত জড়িয়ে ধরল ড. আজদাকে। বলল, ‘এসব কথা থাক। চল ড্রইংয়ে যাই। আমাদের আসাটা ‘অড’ হয়ে গেছে।’
ড. আজদা ও সাহিবা চলল ড্রইংয়ের দিকে।

Top