৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

‘সাহিবা, শোন মা।’ ডাকল ড. মাহজুন মাজহার সাহিবা সাবিতকে।
সাহিবা সাবিত তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
সাহিবা সাবিত ঘুরে দাঁড়িয়ে পিতার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘বলুন বাবা।’
‘আজ ভালো লাগছে শরীরটা?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েকে ড. মাহজুন মাজহার।
‘হ্যাঁ বাবা, ভালো।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘কিন্তু মা, মুখটাকে তোমার খুব বিষণ্ণ লাগছে।’ বলল সাহিবার বাবা।
‘ও কিছু নয়, রাত জেগে পড়েছি তো এই কারণে।’
কথাটা বলেই সাহিবা সাবিত ভাবল, এই মিথ্যা বলাটা তার ঠিক হয়নি।
‘আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে মা?’ জিজ্ঞাসা ড. মাহজুন মাজহারের।
‘না বাবা, আজ যাব না। ড. আজদা টেলিফোন করেছিল, সে আসছে। আমার স্টাডির একটা বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলাম তো।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘তোমার কাছে শুনেছিলাম, ডিজিপি মাহির হারুন গত রাতে আমাকে বললেন সেদিনের কথা। তিনি বললেন ঘটনাটা অলৌকিকের মত। আবার ড. আজদার কাছে ঘটনাগুলোর কথা শুনেছি, সেগুলোও বিস্ময়কর, অলৌকিকের মতই। সত্যিই বিস্ময়কর এই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। আমি ডিজিপি মাহির হারুনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার কোন পরিচয় তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন কিনা। তিনি বললেন, তার ব্যাপারে অনুসন্ধানের সুযোগ আমাদের নেই। স্বয়ং পুলিশ প্রধান তাকে সম্মান করে, সমীহ করে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর সাথে নাকি তার সম্পর্ক। আল্লাহই পাঠিয়েছেন আমাদের বিপদের সময় তাকে।’
রাঙা হয়ে উঠেছিল সাহিবা সাবিতের মুখ। কিন্তু তার বুকের মধ্যে তখন বেদনার ঝড়। কতকটা রোদ-বৃষ্টির মত অবস্থা। তার পিতা থামলে বলল সে, ‘সাধারণ বিবেচনার বাইরে উনি বাবা। ওরা মনে হয় আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। পরার্থেই ওদের জীবন। বাবা, আমাদের রক্ষার স্বার্থে উনি নিজেকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের মৃত্যু অবধারিত জেনেও। এই কুরবানীর কোন পরিমাপ হয় না বাবা।’ অপ্রতিরোধ্য এক উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ল সাহিবা সাবিতের কণ্ঠ। চোখ তার ভিজে উঠেছে অশ্রুতে।
ড. মাহজুন মাজহার তাকিয়েছিল তার মেয়ের দিকে। সাহিবা সাবিতের আবেগের উত্তাপ, অশ্রুর স্পর্শ তার হৃদয়কেও ছুঁয়ে গেল। এই আবেগ ও অশ্রুর মধ্যে ড. মাহজুন মাজহার একটা নতুনত্বের প্রকাশ দেখে চমকে উঠল।
এ সময় সিঁড়ি দিয়ে দু’তলায় উঠে এল ড. আজদা।
সাহিবা সাবিত চোখ মুছে ‘আসি বাবা’ বলে ছুটে গেল ড. আজদার দিকে।
সাহিবা সাবিতের দিকে নিবদ্ধ ড. মাহজুন মাজহারের চোখে উদ্বেগের একটা ছায়া নামল।
সাহিবা সাবিত ড. আজদাকে স্বাগত জানিয়ে তার হাত ধরে তাকে নিয়ে চলল তার নিজস্ব স্টাডি রুমে।
তারা স্টাডি রুমে গিয়ে টেবিলে না বসে মুখোমুখি এক সোফায় গিয়ে বসল।
‘তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, তুমি যখন আমাকে ডেকেছ তখন নিশ্চয় সুস্থ্। কিন্তু…।’
‘থাক এসব কথা আজদা। আমি ভালো আছি। এস, কাজের কথায় আসি।’ ড. আজদার মুখের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু রেখে কথাগুলো বলল সাহিবা সাবিত।
ড. আজদা তার নত মুখের দিকে মুহূর্তকাল চেয়ে থেকে স্নেহের সুরে বলল, ‘সাহিবা, তোমার কাজের কথা বল।’
সাহিবা সাবিত মুখ তুলল।
বলল, ‘ধন্যবাদ আজদা। আমার পিএইচডি থিসিসের যে অংশ নিয়ে আমি এখন কাজ করছি, সেটা তুরস্কের জাতিদেহে কুর্দিদের অবস্থান নিয়ে। এ ব্যাপারে তোমার একটা দৃষ্টিভংগি আমি জানতে চাই। এর সাথে আছে তুরস্কের এই পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলের ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে কথা। এ ব্যাপারেও তোমার একটা ব্রীফ চাই আমি।’
‘দুটোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথম বিষয় সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভংগির কথা বলতে পারি। আমি কুর্দি সম্প্রদায়ের সচেতন সদস্য হিসেবে বলছি, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, আজারবাইজান, আর্মেনিয়াসহ এই গ্রন্থিতে কুর্দি সম্প্রদায়কে নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, সে রাজনীতি কুর্দিদের সৃষ্টি নয়। যেভাবে ইসলামী খিলাফত বা ইসলামী সাম্রাজ্য ভেঙে তুর্কি, ইরাকি, সিরীয়, লেবাননী, জর্দানি ইত্যাদি জাতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, সেভাবেই কুর্দিদের দাঁড় করানো হয়েছে মুসলিম ভূ-খণ্ডগুলোকে আরও খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্যে। কুর্দিরা পশ্চিমী পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্টদের মধ্যকার পৌনে এক শতাব্দী কালের ঠাণ্ডা যুদ্ধেরও শিকার হয়েছে। এ সবের কোনটিই কুর্দিদের স্বার্থে হয়নি, হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে। সাম্রাজ্যবাদী এই ষড়যন্ত্রই তুরস্কে তুর্কিদের সাথে কুর্দিদের বিরোধ বাঁধিয়েছে। তুরস্কের সমাজে, রাষ্ট্রে, অর্থনীতিতে তুর্কি ও কুর্দি বলে কোন বিভেদ ছিল না। তুরস্কের ‍দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ইসমত ইনোনু একজন কুর্দি ছিলেন। আবার অষ্টম প্রেসিডেন্ট তুরগুত ওজালও একজন কুর্দি ছিলেন। তুরস্কের প্রশাসন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তুর্কি-কুর্দি কোন বিভেদ নেই। এই ঐক্য ও সংহতিকে মূল দৃষ্টি হিসেবে সামনে আনলে তুমি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রটা দেখতে পাবে এবং বাঞ্ছিত উপসংহারে পৌঁছতে পারবে।’
বলে থামল ড. আজদা। কথা শুরু করল আবার, ‘তোমার দ্বিতীয় বিষয়টার ওপর আমি কিছু বলতে পারবো না সাহিবা। তবে একজনের নাম বলতে পারি। তিনি খুব স্বচ্ছ দৃষ্টি রাখেন।’
‘কে তিনি?’ জিজ্ঞাসা সাহিবা সাবিতের।
‘তিনি আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।’ বলল ড. আজদা।
সাহিবা সাবিতের সারা মুখে রক্তের এক আবির রঙ খেলে গেল।
সে মুহূর্তের জন্যে মুখ নিচু করে আবার স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ আজদা। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারবো না।’ সাহিবা সাবিত বলল। তার সারা মুখে সেই বিষণ্ণভাব আবার ফিরে এসেছে।
ড. আজদা তাকাল সাহিবা সাবিতের দিকে। বলল, ‘তুমি ওকে ভুল বোঝ না সাহিবা। ওর বিবেচনাকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত।’
‘আমি ওকে ভুল বুঝিনি আজদা। আমি ভুল করেছিলাম, সেটাই আমি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু আজদা, তিনি ঐভাবে একটা হৃদয়কে সরাসরি গুলি করে বধ না করলেও পারতেন। তার কথা অন্যভাবে জানান দেয়া যেত। ব্যাপারটা একটা হৃদয়কে পয়েন্ট ব্ল্যাংক গুলি করার মত হয়েছে।’ বলল সাহিবা সাবিত। তার কণ্ঠ আবেগে কাঁপছিল।
‘তোমার দিক দিয়ে তুমি ঠিকই বলেছ সাহিবা। স্পর্শকাতর এ বিষয়টাকে অন্যভাবেও ম্যানেজ করতে পারতেন। কিন্তু তার দিকটাও ভাব সাহিবা। আমার মতে তিনি তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। তোমার মধ্যে বিভ্রান্তি যেন এক মুহূর্তও আর না থাকে, কষ্ট যাতে আরও গভীর হবার সুযোগ না হয়, এ জন্যেই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিভ্রান্তির নিরসনে এসেছেন।’ বলল ড. আজদা।
‘পেরেছেন কি তিনি কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে? পারেননি। যখন তিনি এ চেষ্টা করেছেন, তখন তো একটা জীবনের কুরবানী হয়ে গেছে। মরাকে কি আর বাঁচানো যায় আজদা!’ বলল সাহিবা সাবিত। তার কণ্ঠ কাঁপছে। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
ড. আজদা উঠে গিয়ে সাহিবা সাবিতের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল।
সাহিবা সাবিতের মাথাটি ঢলে পড়ল ড. আজদার কাঁধে। নীরব কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
কান্নায় বাঁধা দিল না ড. আজদা। শুধু বড় বোনের মত তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল।
সাহিবা সাবিত একটু শান্ত হলে ড. আজদা বলল, ‘তুমি এ ভুলটা কেন করলে সাহিবা? তুমি জানতে তিনি বিবাহিত।’
‘সব ভুলে গিয়েছিলাম, সব ভেসে গিয়েছিল বোধহয় সামনে থেকে। সেই সাথে আমি কখন অথৈ সাগরে ডুবে গেছি বুঝতে পারিনি। অন্যায় হয়তো হয়েছে, কিন্তু অন্যায় কিভাবে হলো আমি বুঝতে পারিনি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল সাহিবা সাবিত।
‘সব ঠিক হয়ে যাবে সাহিবা। একটু শক্ত হও। তবে মনে কোন অপরাধবোধ আনা ঠিক হবে না। যা ঘটেছে তা অন্যায় নয়।’ বলল ড. আজদা।
ড. আজদার কাঁধ থেকে মাথা তুলল সাহিবা সাবিত। চোখ ‍মুছে বলল, ‘না আজদা, আমার মধ্যে অন্যায় বোধ নেই। থাকবে কেন? আমি এখনও আমার অধিকারের মধ্যে রয়েছি, কারও অধিকার আমি লংঘন করিনি। আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা কারও ক্ষতি করেনি, ওরও নয়।’
‘সাহিবা, এভাবে না ভেবে তোমার সব ভুলে যাওয়া উচিত।’ বলল ড. আজদা।
‘এটা আমি বলতে পারবো না, তবে তোমাকে এ কথা দিতে পারি যে, ওকে বিব্রত করবো না, উনি নতুন সাহিবাকে দেখবেন।’ বলল সাহিবা ধীর কণ্ঠে।
বলেই সোজা হয়ে বসল সাহিবা। বলল, ‘এসব কথা থাক আজদা, এস আমরা আমাদের কাজের কথায় ফিরে যাই। আমার জিজ্ঞাসার ‍দ্বিতীয় বিষয়ের ব্যাপারে।’
‘সেটাই তো বলছিলাম, এ বিষয়ে আবু আহমদ ভাইয়া তোমাকে সাহায্য করতে পারেন। এ বিষয়টি নিয়ে ওর সাথে আমার একদিন আলোচনা হয়েছিল। দেখলাম, উনি এ বিষয়ে একটা তথ্যের ভাণ্ডার।’ বলল ড. আজদা।
সাহিবা সাবিতের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সেখানে নামল বিষণ্ণতা। বলল, ‘ওর কাছে কয়দিন আমি যাব না।’
‘কেন?’ বলল ড. আজদা।
‘ঐ যে তুমি শক্ত হতে বললে। সেটাই। মনটাকে আমার আগে শক্ত করতে হবে, যাতে ওর সংস্পর্শে ভেঙে পড়ে কোন নতুন অনর্থ না ঘটায়।’ সাহিবা বলল। ভারি কণ্ঠ তার।
‘ঠিক চিন্তা করেছ সাহিবা। মনটাকে তোমার শক্ত করা দরকার।’
বলে একটু থেমে আবার কথা শুরু করল ড. আজদা। বলল, ‘ছেলেমেয়েদের মেলামেশার ক্ষেত্রে ইসলাম যে সীমার নির্দেশ করেছে, সুস্থ সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে তা মানার কোন বিকল্প নেই। তোমার ক্ষেত্রে, আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, অবাধ মেলামেশার সুযোগ না থাকলে তা ঘটতো না।’
‘আমারটা তো বুঝলাম। তোমার ক্ষেত্রে কি ঘটেছে?’ বলল সাহিবা। তার চোখে বিস্ময়।
‘ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছে। সকালে যেদিন দুষ্কৃতিকারীরা আমাদের বাড়িতে হামলা করেছিল। সেদিন ভীতিকর এক পরিবেশে তার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এটা ছিল ওর কাছে আমার আশ্রয় খোঁজা। তিনিও নিশ্চয় এটা বুঝেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যকিছু ভাববার সুযোগ বন্ধ করার জন্যেই তিনি সংগে সংগেই আমাকে বোন বলে সম্বোধন করেছিলেন।’ ড. আজদা বলল।
‘এটা কি তুমি ড. বারজেনজো ভাইয়াকে বলেছ?’ একটু মিষ্টি হেসে বলল সাহিবা সাবিত।
ড. আজদার মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘এটা ওকে বলার মত কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়।’
‘গুরুত্বপূর্ণ নয় বলছ কেন? টার্নিং পয়েন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারতো। যেমন আকস্মিক ঝড় পুরানো স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনার দুয়ার উন্মুক্ত করে, তেমনি মুহূর্তের ঘটনা চিরজীবনের হয়ে দাঁড়াতে পারে।’ বলল সাহিবা সাবিত গম্ভীর কণ্ঠে।
‘ঠিকই বলেছ সাহিবা। এটাই অবাধ মেলামেশার কুফল। যার অসহায় শিকার আমাদের পশ্চিমী সমাজ। এখানে ঘরে-বাইরে আজ সম্পর্কের অস্থিরতা, দাম্পত্য-জীবনে অব্যাহত ভাঙন, পরিবার ব্যবস্থায় বিপর্যয়।’ ড. আজদা বলল।
‘হ্যাঁ আজদা, তিনি পাথর বলেই তিনি যেমন বাঁচলেন, তুমি বাঁচলে, আমার পথও বন্ধ করা হলো। কিন্তু সবাই তো তার মত বিকর্ষণকারী পাথর নয়, সবাই আকর্ষণ করে। বহুমুখী এই আকর্ষণ থেকেই বহুমুখী বিপর্যয় এসেছে আমাদের পশ্চিমী সমাজে। কিন্তু আমরা বাঁচবো কি করে? ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশাই তো আমাদের লাইফস্টাইল।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘এ লাইফস্টাইল স্বাভাবিক নয়, সুস্থ নয়, তাই ইসলামীও নয়। আবু আহমদ ভাইয়া স্বাভাবিক ‍ও সুস্থ ইসলামী লাইফস্টাইল অনুসরণ করেন বলেই তিনি বাঁচতে পারেন। আমাদেরও বাঁচিয়েছেন। তিনি একটা জীবন্ত মডেল আমাদের কাছে।’ ড. আজদা বলল।
সাহিবা সাবিত আকস্মিকভাবে ড. আজদার কাছ থেকে একটু সরে বসল। বলল, ‘দেখ আজদা, তুমি এভাবে ওর প্রশংসা করো না, মনকে কিন্তু শক্ত করতে পারবো না, বিগড়ে যাবে কিন্তু মন।’ মুখে হাসি নিয়ে বলল সাহিবা সাবিত।
কথা শুনে ড. আজদাও হেসে উঠল। একটু ‍উঠে সাহিবা সাবিতকে ধরে তার পিঠে কয়েকটি স্নেহের থাপ্পড় মেরে বলল, ‘কানে তালা লাগিয়ে বুঝি মনটাকে ঠিক করবে! মনকে ঠিক করতে হবে বাস্তবতা দিয়ে, বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে।’
সাহিবা সাবিত জড়িয়ে ধরল ড. আজদাকে। হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পেয়ো না আজদা। ওকে বিব্রত করবো না। বলেছি তো, উনি নতুন সাহিবাকে দেখবেন।’
সাহিবার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে অশ্রু।
‘ধন্যবাদ সাহিবা।’ বলল ড. আজদা। সেও জড়িয়ে ধরল সাহিবাকে।
সাহিবার চোখের অশ্রু তার দু’গণ্ডে গড়িয়ে পড়ল।

ভ্যান ক্যালিস প্রাসাদ মিউজিয়ামের ডিজি ড. মাহজুন মাজহারের অফিস।
ড. মাহজুন মাজহার একটা সোফায় বসে। তার সামনের সোফায় পাশাপাশি বসে ভ্যান পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন এবং ভ্যানের গোয়েন্দা প্রধান এরফান এফেন্দী।
কথা বলছিল পুলিশ প্রধান মাহির হারুন। বলল, ‘স্যার, তদন্তের ব্যাপারে সব আপনাকে বললাম। আমাদের তদন্তে খুঁত নেই। আবু আহমদ আব্দুল্লাহ যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবেই কাজ হয়েছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার গত ছয় মাসের ভিডিও ক্লিপ থেকে বাইরের তিনজন সন্দেহজনক লোককে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিউজিয়ামের গণসংযোগ বিভাগের ডাইরেক্টর মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ গাজেন পাস ইস্যু করে প্র্থমে তাদের ভেতরে ঢুকিয়েছে। পরে এই তিনজনই সাংবাদিক পরিচয়ে মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহর পাশে মিউজিয়ামের যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছে। এই তিনজনই আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট। দুঃখের বিষয়, এদের তিনজনকেই লেক ড্রাইভে এক ভয়ংকর অপারেশনে অস্ত্রধারী কমান্ডো হিসেবে মৃত পাওয়া গেছে। এদের সহযোগিতাকারী হিসেবে মিসেস অ্যানোশ গাজেনের নাম এসেছে। এখন তো আমাদের এ্যাকশনে যেতে হয়।’ থামল ডিজিপি মাহির হারুন।
ড. মাহজুন মাজহার বলল, ‘মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ গাজেন একজন পুরানো, অভিজ্ঞ অফিসার। মিউজিয়ামের সকলের কাছে সে সম্মানিতও। তার ব্যাপারটা একটু কেয়ারফুলি ডীল করুন, আমার অনুরোধ। আপনারা কি তার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছেন?’
‘জ্বি হ্যাঁ, তার সাথে আমরা কথা বলেছি। উনি বলেছেন, একটা রেস্টুরেন্টে ঐ তিনজনের সাথে তার পরিচয়। ওরা নিজেদের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছিল। পরে অবশ্য সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে এমন পরিচয়পত্র দেখিয়েছিল। মিউজিয়াম সম্পর্কে সেদিন তারা তাদের গভীর আগ্রহের কথা বলে এবং জানায় যে, তারা মিউজিয়ামের ওপর ধারাবাহিক গবেষণামূলক ফিচার প্রকাশ করতে চায়। এজন্যে তারা মাঝে মাঝে মিউজিয়ামে যেতে চায়। তারা আমার সাহায্য কামনা করে। যতটা সম্ভব তিনি তাদের সহযোগিতা করেন। এই ছিল তার বক্তব্যের সার কথা।’
‘ভেতরে কি আছে জানি না কিন্তু এই কথাগুলোকে আমার কাছে নির্দোষ বলেই মনে হয়।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘তার কথাগুলোকে নির্দোষ মনে হচ্ছে স্যার। কিন্তু তিনজন যে পরিচয় দেয় তা দোষযুক্ত। ভ্যানের ফ্রিল্যান্স কিংবা পেশাদার কোন সাংবাদিকই এদের চেনে না। নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে যে পত্রিকার আইডেনটিটি কার্ড তারা দেখিয়েছিল, ঐ নামের কোন সংবাদপত্র এখন ভ্যানে চালু নেই। কিন্তু মিসেস অ্যানোশ গাজেন এসব কোন কিছু খোঁজ না নিয়েই ওদেরকে মিউজিয়ামে ঢোকার অবাধ সুযোগ দিয়েছেন। এটা তার বোকামী, না অন্য কিছু, সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না।’
এই সময় ড. মাহজুন মাজহারের পিএস আহমদ মুসাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
ড. মাহজুন মাজহারসহ সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল।
ড. মাহজুন মাজহার আহমদ মুসাকে তার পাশের সোফায় নিয়ে বসাল।
‘আপনি কষ্ট করে এসেছেন, এজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। স্যার, আমি আপনাকে আমাদের মিউজিয়ামের ডাইরেক্টর পাবলিক রিলেশন্স সম্পর্কে একটা ইংগিত দিয়েছিলাম। এতক্ষণ ঐ তিনজন ও তার বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম।’
বলে ডিজিপি মাহির হারুন মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ গাজেন সম্পর্কে এতক্ষণ যে আলোচনা হয়েছে তা সংক্ষেপে আহমদ মুসাকে জানিয়ে বলল, ‘ঐ তিনজন মূল কালপ্রিটের মৃত্যুর পর একমাত্র মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ গাজেনই আছেন যার সাথে মিউজিয়ামের ভয়াবহ ঘটনার একটা লিংক আছে। এখন আমরা কি করব, সেটাই আলোচনার বিষয়।’
‘আমার মতে আশু করণীয় হলো, মিসেস অ্যানোশ গাজেনকে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা। উল্কিওয়ালারা যারা মিউজিয়ামে ডাকাতি করেছে, তারা মিসেস অ্যানোশ গাজেনকে হত্যা করতে পারে। কারণ, আমাদের সামনে একমাত্র সেই আছে যার মাধ্যমে ঘটনা ফাঁস হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
ডিজিপি, গোয়েন্দা অফিসার এরফান এফেন্দী এবং ড. মাহজুন মাজহারের চোখে-মুখে বিস্ময়। ডিজিপি মাহির হারুন ও গোয়েন্দা এরফান এফেন্দী ভাবল, এই সহজ কথাটা আমাদের মনে হয়নি কেন? এটাই তো স্বাভাবিক।
‘ঠিক আছে স্যার, আমি নির্দেশ দিচ্ছি, পুলিশের একটা দল সব সময় অলক্ষ্যে তার পাহারায় থাকবে। আরও আমাদের কি করণীয় স্যার?’ ডিজিপি মাহির হারুন পকেট থেকে ওয়্যারলেস বের করে পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বলল, ‘মিসেস অ্যানোশ গাজেনের বাড়িতে এখনি সাদা পোশাকে পুলিশের প্রহরা বসাও। এখন তিনি বাড়িতে থাকার কথা।’
‘ধন্যবাদ অফিসার। মিসেস অ্যানোশ গাজেন সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। তার বর্তমান পরিচয়ের আড়ালে আর কোন পরিচয় আছে কিনা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন এ কথা বলছেন স্যার? আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন?’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন। তার ভ্রূকুঞ্চিত।
‘আচ্ছা, মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ গাজেনের নামের অ্যানোশ ও গাজেন শব্দ দু’টি কি টার্কিশ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘শব্দ দুটি তুরস্ক, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানে কিছু কিছু ভিন্ন উচ্চারণে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘আচ্ছা, অ্যানোশ’ শব্দ কারও নামের অংশ হতে পারে, কিন্তু ‘গাজেন’ শব্দ কি তুরস্কে নাম হিসেবে মুসলমানরা ব্যবহার করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো ড. মাহজুন মাজহারের। বলল, ‘গাজেন’-এর টার্কিশ সমতুল্য শব্দ হলো ‘গায়িন’। এই ‘গায়িন’ শব্দ ছেলেদের নামের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তুরস্কে। কিন্তু ‘গাজেন’ নাম তুরস্কে ব্যবহার হয় না, এটা আর্মেনীয় শব্দ।’
‘শুধু এটা আর্মেনীয় নামবাচক শব্দই নয়। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ইতিহাস?’ জিজ্ঞাসা ড. মাহজুন মাজহার ও ডিজিপি মাহির হারুন দু’জনেরই।
‘ধর্মের জন্যে, আর্মেনীয় জাতির জন্যে জীবনদানকারী একজন খৃস্টান সন্ন্যাসিনীর নাম ‘গাজেন’। তার এই নামে আর্মেনিয়ার একটি চার্চেরও ‘গাজেন’ নামকরণ করা হয়েছে।’
ড. মাহজুনসহ সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘তাহলে মিসেস অ্যানোশ আব্দুল্লাহ তার নামের শেষে এই নাম গ্রহণ করেছেন কেন?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন। তিনি মুসলিম হয়ে এ নাম গ্রহণ করেছেন কেন? এ জন্যেই তার ব্যাপারে অনুসন্ধানের কথা আমি বলেছি। হতে পারে, তার পরিচয় আরও আছে। হতে পারে, তিনি ঐ তিনজনের ব্যাপারে যা বলেছেন, গোটাটাই মিথ্যা।’ আহমদ মুসা বলল।
ড. মাহজুন মাজহার নীরব।
নীরব ডিজিপি মাহির হারুন এবং গোয়েন্দা অফিসারও।
গোয়েন্দা অফিসার কানে কানে কি বলল ডিজিপি মাহির হারুনকে।
মাহির হারুন বলল, ‘তাহলে তো স্যার আমার গ্রেফতার করতে পারি মিসেস গাজেনকে। গ্রেফতারের জন্যে যথেষ্ট দলিল আমাদের হাতে আছে। আমি সেই কথাই ড. মাহজুন মাজহার স্যারকে বলছিলাম।’
‘না মি. ডিজিপি, তাকে গ্রেফতার না করে তাকে ফলো করে তার সম্পর্কের সূত্রগুলো বের করাতেই লাভ বেশি। আমরা চাই তার পেছনে কারা আছে, সেটা জানতে। একসময়তো তাকে গ্রেফতার করতেই হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার, আমরা এটাই করব। তবে তার বিরুদ্ধে একটা কেস দায়ের…।’
ডিজিপি মাহির হারুনের কথার মাঝখানেই তার ওয়্যারলেস অস্থিরভাবে বিপ বিপ করে উঠল।
কথা বন্ধ করে ‘এক্সকিউজ মি স্যার!’ বলে সে ওয়্যারলেস তুলে নিল।
ওয়্যারলেস তুলে নিয়ে কথা কিছুটা শুনেই ‘হোল্ড অন’ বলে কলটাকে হোল্ড করে সে আহমদ মুসার দিকে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, ঘটনা ঘটেই গেছে, মিসেস গাজেন নিহত হয়েছেন।’
‘কোথায়?’ দ্রুত প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমাদের পুলিশ তার বাড়ির চারদিকে পাহারা বসিয়েছে। তারাই জানাল, মিসেস গাজেন তার বাগানে কাজ করছিলেন, এ সময় গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন। বাগানের পাশে দাঁড়ানো একটা গাড়ি থেকে তাকে গুলি করা হয়। পরপর দু’টি গুলি করার পরই গাড়িটি পালিয়ে যায়।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘তার বাড়িতে আর কে আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘একজন পরিচারিকা এবং একজন আয়া ছাড়া তার বাড়িতে আর কেউ নেই। পরিচারিকা বাড়ির কাজকর্ম করে আর আয়া রাঁধা-বাড়াসহ মিসেস গাজেনের স্টাফ হিসেবে কাজ করে।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
‘মি. ডিজিপি, আত্মীয়ের পরিচয়ে বা অন্য কোন কথা বলে তার বাড়িতে লোক ঢুকতে চেষ্টা করতে পারে। তাদের বাঁধা দিতে হবে। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া যাবে না। আর আপনার পুলিশ বাড়িতে ঢুকে পরিচারিকা ও আয়াকেও গ্রেফতার করবে। দরকার হলে আরও পুলিশ যেতে বলুন সেখানে।’ আহমদ মুসা বলল।
ডিজিপি তার ওয়্যারলেসের কল অন করে বলল, ‘ওখানে এখন কি অবস্থা?’
ওপারের কথা শুনতে গিয়ে ডিজিপি মাহির হারুনের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কথা শোনার মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘শোন, বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না। বাড়াবাড়ি করলে গুলি কর। লাশ ওখানেই এখন থাকবে। আর তোমরা কয়েকজন ভেতরে ঢুকে যাও। বাড়িতে পরিচারিকা, আয়া বা যাকে পাও তাকেই গ্রেফতার কর। ওখানে কতজন পুলিশ পৌঁছেছে? দরকার হলে আরও পুলিশ ডেকে নাও। আমিও বলে দিচ্ছি। ওকে। যখন যা হয় আমাকে জানাবে। বাই।’
কথা শেষ করে ডিজিপি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আপনার কথা ঠিক। আত্মীয়ের পরিচয়ে কয়েকজন লোক এসেছে, তারা বাড়িতে ঢুকতে চাচ্ছে এবং লাশও হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করলে কেমন হয়?’
‘এতক্ষণে ওরা চলে গেছে। বাঁধা পাওয়ার পর, পুলিশ বলে আঁচ করতে পারলে, এক মুহূর্তও আর তাদের থাকার কথা নয়। গ্রেফতার করলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না। ওরা সম্ভবত ভাড়াটিয়া লোক হবে। আমার মনে হয়, ওদের পাঠানো হয়েছিল বাড়ি থেকে কম্পিউটার, ডায়েরি, নোটবই ইত্যাদির মত কিছু জিনিস নিয়ে যেতে, অথবা বাড়ির ঘরগুলো জ্বালিয়ে দিতে।’
কোন কথা না বলে ভ্যানের পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন ওয়্যারলেস তুলে নিয়ে যোগাযোগ করল মিসেস গাজেনের বাড়িতে পাহারায় থাকা সংশ্লিষ্ট পুলিশের সাথে। সংযোগ হতেই সে দ্রুত বলল, ‘ওরা যারা বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিল, তাদের কি খবর?’
শুনল ডিজিপি মাহির হারুন ওপারের কথা। ওপারের কথা শেষ হলে ‘ওকে’ বলে লাইন অফ করেই বলল, ‘স্যার, এবারও আপনি ঠিক বলেছেন। বাঁধা পাওয়ার পরই কিছু একটা সন্দেহ করেই দ্রুত ওরা পালিয়েছে।’
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা। তখনই তার মোবাইল বেজে উঠে তাকে থামিয়ে দিল।
‘এক্সকিউজ মি’ বলে মোবাইল বের করল পকেট থেকে। মোবাইলের স্ক্রীনে কলারের নাম দেখেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। টেলিফোন করেছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফা কামাল, ইস্তাম্বুলের কাজে আহমদ মুসার সবচেয়ে বড় সাথী।
আহমদ মুসা কল অন করেই বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। হ্যালো জেনারেল মোস্তফা। কেমন আছেন?’
‘ওয়ালাইকুম সালাম। আমরা ভালো আছি। আমরা খুব খুশি হয়েছি, আমরা আপনাকে যেতে দিলেও তুরস্ক আপনাকে যেতে দেয়নি।’ বলল ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফা।
‘হ্যাঁ, সেটাই ঘটেছে জেনারেল। একজন বিপদগ্রস্ত মেয়ের আবেদন আমি উপেক্ষা করতে পারিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ঘটনা বলুন তো?’ জিজ্ঞাসা ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফার।
ড. আজদার ইন্টারনেট আপীলের বিষয়টা সংক্ষেপে জানানোর পর বলল, ‘ড. আজদার বলা ঘটনাগুলো আমার কাছে খুব বড় ঘটনার আইসবার্গ বলে মনে হয়েছে। তাই ওদের পাঠিয়ে আমি ভ্যানে যাত্রা বিরতি করেছি।’
‘যে সব রিপোর্ট এখানে পেয়েছি, তাতে বিষয়টাকে খুব রহস্যপূর্ণ ও বড় কোন বিষয় বলে আমারও মনে হয়েছে। আপনি তো সরেজমিনে আছেন। ব্যাপার কি বলুন তো?’
‘আমি কাজ সবে শুরু করেছি। এখনও ঘটনার গভীরে যেতে পারিনি। তবে আমি ড. আজদার ইন্টারনেট থেকে যা আঁচ করেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল, আর্মেনিয়ার কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন এর সাথে জড়িত। কেন জড়িত, কি চায় ওরা এ ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট নয় এখনও। এই মাত্র আমরা খবর পেলাম, মিউজিয়ামে ডাকাতির ব্যাপারে আমাদের সামনে এগোবার একমাত্র লিংক পারসনকে ওরা হত্যা করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিষয়টা ওখানে খুব জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা কথা আপনি বলুন, বিষয়টার সাথে কোন রাজনীতির গন্ধ আছে কিনা।’ ওপার থেকে বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘খুব নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। তবে ওদের সকলের বাহুতেই মাউন্ট আরারাতের উল্কি আছে। আর আমি যা মনে করেছি, এদের গোড়া যদি আর্মেনিয়ায় থাকে, তাহলে এর সাথে ধর্ম ও রাজনীতি দুই-ই জড়িত আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা একটা খুব বড় ব্যাপার। আমাদের একটা অনুরোধ মি. খালেদ খাকান।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘বলুন মি. জেনারেল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আপনি ওখানে হাজির। আমাদের সবার অনুরোধ, ওখানকার বর্তমান বিষয়ে অনুসন্ধানের নেতৃত্ব আপনি নিন। ড. আজদার সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনার চ্যাপ্টার তো আপনি দেখছেনই। এখন গোটা বিষয়টার দায়িত্ব দয়া করে আপনাকে নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথেও আলাপ করেছেন। রাজনৈতিক বিষয় জড়িত থাকায় বিষয়টি জটিল হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে নিশ্চয় আপনি দেখেছেন, আমাদের পুলিশ ও আমলাতন্ত্রে কিছু কিছু প্রশ্নে সমস্যা আছে। এই তদন্তের ব্যাপারটা সে ধরনেরই একটি বিষয়।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘বুঝেছি জেনারেল মোস্তফা। আপনি যে সমস্যার কথা বললেন, সেটা আসলেই একটা বড় সমস্যা। ঠিক আছে, উল্কিওয়ালাদের বিষয়টা কি, সেটা দেখার আমারও একটা আগ্রহ আছে। আল্লাহ ভরসা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের বাঁচালেন মি. খালেদ খাকান। এখানকার আর্মেনীয় নাগরিক ও আর্মেনিয়া আমাদের জন্যে একটা মাথা ব্যথা। কিছু ঘটলেই এর সাথে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ যুক্ত হয়। সেই জন্যেই বিষয়টির নিশ্ছিদ্র ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন।’
মুহূর্তের জন্যে থামল জেনারেল মোস্তফা কামাল। আবার বলে উঠল, ‘ওখানকার পুলিশ ও প্রশাসনের সাথে আমরা কথা বলব।’
‘এখানে ভ্যানের পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন আমার সামনেই আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্লিজ মি. খালেদ খাকান, ওকে একটু দিন। আমার পাশে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও আছেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা ওপার থেকে।
‘ওকে, দিচ্ছি।’ বলে আহমদ মুসা তার মোবাইলটি ডিজিপি মাহির হারুনের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘আংকারা থেকে সিকিউরিটি চীফ জেনারেল মোস্তফা কামাল কথা বলবেন।’
মোবাইল নিয়েই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার আমি মাহির হারুন।’
তারপর ডিজিপি মাহির হারুন ‍শুধু অবিরাম ‘স্যার’, ‘স্যার’ বলে কথা শুনতেই লাগল।
কথা শোনা শেষ হলে ডিজিপি মাহির হারুন মোবাইল আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বল, ‘স্যার, স্যাররা আপনার সাথে আরেকটু কথা বলবেন।’
ওপারের সাথে সালাম বিনিময়ের পর বলল, ‘হ্যাঁ মি. নাজিম এরকেন, কেমন আছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ, ভালো আছি মি. খালেদ খাকান। আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা আপনি গ্রহণ করুন। জেনারেল মোস্তফা আপনার সাথে আর একটু কথা বলবেন।’ ওপার থেকে বলল তুরস্কের পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘আচ্ছা দিন তাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফার কণ্ঠ শোনা গেল। বলল সে, ‘ডিজিপি মাহির হারুন খুব সৎ ও দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসার। তার সহযোগিতা আপনি পাবেন। আর যখনি বলবেন, আমি ও নাজিম এরকেন ওখানে যাব।’
‘কিন্তু সমস্ত কেসের সাথে আমার জড়িত থাকার বিষয় গোপন থাকতে হবে। ডিজিপি মাহির হারুন ছাড়া পুলিশের আর কেউ জানবেন না, এটা আমার শর্ত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে, ডিজিপি মাহির হারুনকে এটা বলে দেব। আপনিও এটা তাকে নির্দেশ দিন।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ঠিক আছে, এখনকার মত তাহলে কথা শেষ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওকে মি. খালেদ খাকান, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ জীবন দিন এবং তিনি যা পছন্দ করেন, সব নিয়ামত আপনাকে দিন। আসসালামু আলাইকুম।’ কথা শেষ করল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে কল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা কল অফ করতেই ডিজিপি মাহির হারুন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আপনার সাথে কাজ করার সৌভাগ্য আমার পুলিশ জীবনের বড় পাওয়া হবে স্যার। আপনার নির্দেশে সবকিছু চলবে স্যার।’
‘বসুন অফিসার। এটা আপনার স্যারদেরকেও বলেছি আপনাকেও বলছি, আমি যে এই তদন্তে পুলিশের সাথে যুক্ত, এ বিষয়টা আপনি ছাড়া পুলিশের আর কেউ জানবে না। আমি ভিন্নভাবে কাজ করব, পুলিশকে যখন যা করতে হয় আমি আপনাকে বলব।’ আহমদ মুসা বলল।
ডিজিপি মাহির হারুন বসেই এ্যাটেনশন হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমি বুঝেছি স্যার। স্যার, মিসেস গাজেন হত্যাকাণ্ড ঘটনার এখন কি করব স্যার?’
‘আপনি চলে ‍যান সেখানে। আইন অনুসারে যা করার তা করুন। আমিও আসছি। আমি মিসেস গাজেনের বাড়ি সার্চ করব। আমি যাওয়ার আগে বাড়ির কোন কিছুতে কেউ হাত দেবেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই ড. মাহজুন মাজহার বলল, ‘এসব খুব বড় ও জটিল বিষয়। এ ব্যাপারে কিছু বলা বা করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে, আলহামদুলিল্লাহ, খুব খুশি হয়েছি যে, তদন্তের ব্যাপারে সবাই সচেতন হয়েছেন। বিশেষ করে আবু আহমদ আব্দুল্লাহকে এর সাথে যুক্ত করায় তার অসাধারণ বুদ্ধি ও শক্তির সাহায্যে আমরা সফল হবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু একটা কথা জনাব আবু আহমদ আব্দুল্লাহ। ইস্তাম্বুলে আংকারায় আপনি ‘খালেদ খাকান’, আর এখানে আপনি আবু আহমদ আব্দুল্লাহ কেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘নানা কারণে সত্য অনেক সময় প্রকাশ করা যায় না। ইস্তাম্বুল-আংকারা এবং এখানে সেটাই ঘটেছে। আসল পরিচয়টা গোপন করেছি স্যার। আপাতত তা গোপনই থাক, স্যার।’
‘ঠিক আছে, যার মধ্যে কল্যাণ বেশি সেটাই হওয়া উচিত।’
‘ধন্যবাদ স্যার!’ বলে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলল, ‘স্যার, এবার আমাদের উঠতে হয়।’
‘অবশ্যই, অবশ্যই। আমার একটু বাইরে বেরুতে হবে।’
বলে উঠে দাঁড়াল ড. মাহজুন মাজহার।
আহমদ মুসারাও উঠে দাঁড়াল।

ভাড়া করা ট্যাক্সি।
ড্রাইভারকে মিসেস গাজেনের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সীটে গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা। মিসেস গাজেনের চিন্তাই তার মাথায়।
গাজেনকে ওরা হত্যা করল কেন? মিসেস গাজেন যদি ওদের ভেতরের লোক হতো, তাহলে হত্যা না করে তাকে সরিয়ে নিত। তাকে হত্যা করা হয়েছে নিশ্চয় কোন কিছু ফাঁস হবার ভয়ে। তাহলে মিসেস গাজেনের সাথে তাদের কি সম্পর্ক ছিল? মিসেস গাজেনের নামের বৈশিষ্ট্য বলে যে, সে আর্মেনীয় অথবা আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত। জাতিগত কারণেই মিসেস তাদের সাহায্য করতো, না কোন আর্থিক সুবিধা নিতো সে, কিংবা সে কোন ভীতি বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার ছিল কিনা।
যাই হোক, মিসিং লিংক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে কোন একটা কিছু তাদের দরকার। সাহিবা সাবিতের কাছে এই মাত্র জানতে পেরেছে, মিসেস গাজেনের লেখার অভ্যাস ছিল। মাঝে মাঝে ছদ্মনামে তিনি পত্রিকার মতামতের কলামে লিখতেন। আরেকটা বড় খবর জানা গেছে তার কাছ থেকে। মিসেস গাজেনের জীবন একটা ট্র্যাজেডি। প্রথম যৌবনে একটা ছেলেকে ভালোবাসতো সে। কিন্তু ছেলেটির কাছ থেকে সে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। তারপর সে বিয়েই করেনি। এই ব্যাকগ্রাউন্ডের মেয়েরা হতাশাবাদী অথবা প্রতিহিংসাপরায়ণা হয়। দেখা যাক, মিসেস গাজেনের ভাণ্ডার থেকে কি পাওয়া যায়। কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, এটা স্পষ্টতই আঁচ করা যাচ্ছে যে, মাউন্ট আরারাত ঘিরে অথবা মাউন্ট আরারাতের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে একটা ষড়যন্ত্রের কুণ্ডলী দানা বেঁধে উঠছে। একটা নতুন বিপদ ঘনিয়ে আসছে আনাতোলিয়ার ওপর। কি বিপদ, কি সে ষড়যন্ত্র? এই অঞ্চলে, এই ভূ-খণ্ডে ষড়যন্ত্র নতুন নয়। কিন্তু পূর্ব আনাতোলিয়ার ওপর এবার এই ষড়যন্ত্রের ছোবল উদ্যত হয়েছে কেন?
আহমদ মুসার গাড়ি এসে মিসেস গাজেনের বাড়ির লনে প্রবেশ করল।
কিছু পুলিশ ছুটে এসে ঘিরে ধরল গাড়ি।
ডিজিপি মাহির হারুন ছিল কাছেই।
সে দ্রুত এসে পুলিশদের আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি একজন সিনিয়র সাংবাদিক। একে আমরা ডেকেছি। তিনি ঘটনা ও বাড়ির সবকিছু দেখতে ও জানতে এসেছেন। আমিই ওকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।’
ওদিকে আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
সালাম বিনিময় করল দু’জনে। তারপর ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘কিলিং স্পটটা আগে দেখবেন চলুন। এরপর ভেতরটা দেখা যাবে।’
বলে হাঁটতে লাগল ডিজিপি মাহির হারুন। তার সাথে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসাও।

পরবর্তী বই
‘বিপদে আনাতোলিয়া’