৪৮. মাউন্ট আরারাতের আড়ালে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা ভ্যান ক্যালিস মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে নেমে এল লেক ভ্যানের তীরে। তারপর লেক ড্রাইভে উঠে তার গাড়ি ছুটে চলল দক্ষিণে।
লেক ড্রাইভ লেক ভ্যানের তীর বরাবর তৈরি মনোরম সড়ক। পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় এই সড়ক। একদিকে পাহাড়ের শ্রেণী, তার পাদদেশে পরিকল্পিত বনায়নের সবুজ-সমারোহ। অন্যপাশে হ্রদের দিগন্ত প্রসারিত নীল-শান্ত জলরাশি।
এই সুন্দর সড়ক লেক ড্রাইভ ধরেই এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ড. সাহাব নুরী, ড. আজদা ও সাহিবা সাবিতরাই আহমদ মুসাকে এনেছে এই লেক ড্রাইভ দেখার জন্যে।
আহমদ মুসা এসেছিল ভ্যান ক্যালিস মিউজিয়াম দেখতে। আসলে আহমদ মুসা সরেজমিনে যাচাই করতে চেয়েছিল মাউন্ট আরারাতের মানচিত্র চুরির বিষয়টা। তার সাথে এসেছিল ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদা। আর সাহিবা সাবিতকে ড. মাহজুন মাজহারই পাঠিয়েছিল গাইড হিসেবে।
মিউজিয়ামে সাহিবা সাবিতই প্রস্তাব করেছিল লেক ড্রাইভে যাবার জন্যে। বলেছিল, এ সময় লেক ড্রাইভ ফাঁকা থাকে, বেড়িয়ে আরাম আছে। সকালে বিকালে তো গাড়ির হাট বসে যায়।
ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদা বিষয়টা আহমদ মুসার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। আহমদ মুসা প্রথমে সাহিবা সাবিতের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। কিন্তু শেষে নাছোড়বান্দা সাহিবা সাবিতের জেদে আহমদ মুসা বলে, ঠিক আছে, চল আগে মিউজিয়ামে যাই।
মিউজিয়ামে এসে গাড়ি থেকে নেমেই সাহিবা সাবিত মিউজিয়ামের এক ড্রাইভারকে ডেকে তার হাতে টাকা দিয়ে বলেছিল, আমরা লেক ড্রাইভে যাব, আপনি গাড়িতে পেট্রল ভরে রাখুন। সকালে পেট্রল নেয়া হয়নি।
এর মাধ্যমে লেক ড্রাইভে আসা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আহমদ মুসাকে আসতে হয় লেক ড্রাইভে।
কিন্তু লেক ড্রাইভে যাত্রা করে কয়েক গজ যেতেই একটা মারাত্মক ঘটনার মুখোমুখি হয় তারা।
গাড়ি ড্রাইভ করছিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভ করে কয়েক গজ যেতেই আহমদ মুসার জ্যাকেটের বুক পকেটে গুঁজে রাখা কলমের মাথা থেকে খুব ধীরলয়ে বিপ বিপ শব্দ বেরিয়ে আসে এবং একটা লাল সিগন্যাল আসতে শুরু করে।
চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। একসাথেই তার সারা দেহের রক্ত কণিকায় একটা বিদ্যুৎ চমক খেলে যায়।
চোখের পলকে আহমদ মুসা গাড়ি রাস্তার কিনারায় ঘুরিয়ে নেয়। রাস্তার কিনারায় গিয়ে একটা হার্ডব্রেক কষে আহমদ মুসা। দ্রুত কণ্ঠে আদেশের স্বরে বলে, সবাই তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়ুন।
আহমদ মুসার পাশে বসেছিল ড. সাহাব নুরী এবং পেছনের সীটে বসেছিল ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত। আকস্মিকভাবে গাড়ি ঘুরিয়ে হার্ডব্রেক কষায় প্রায় সকলেই সীটের ওপর পড়ে গিয়েছিল।
এই অবস্থায় আহমদ মুসার নির্দেশ পেয়ে তারা বিমূঢ়ভাবে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল।
কিন্তু আহমদ মুসার শক্ত হয়ে ‍উঠা গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে তারা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
আহমদ মুসাও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ি ঘুরে বিমূঢ়ভাবে দাঁড়ানো ড. আজদাদের কাছে গিয়ে বলে, গাড়ির কোথাও বোমা বা কোন ধরনের বিস্ফোরক পাতা আছে। আপনাদের আরও সরে আসতে হবে গাড়ির কাছ থেকে।
‘বোমা? গাড়িতে বোমা পাতা আছে?’ আতংকিত কণ্ঠে বলল ড. সাহাব নুরী। আর ড. আজদা ও সাহিবা সাবিতের চোখ বিস্ফারিত। আকস্মিক আতংকে তারা প্রায় বাকরুদ্ধ।
তারা ফুটপাতের ওপর উঠে আরও কিছুটা দূরে সরে গেল।
গাড়ি তখন মিউজিয়ামের গেট থেকে খুব দূরে আসেনি। মিউজিয়ামের গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
আহমদ মুসা হাত তুলে তাদের ডাকে।
গেটের পুলিশের সাথে আহমদ মুসাকে পরিচয় করে দিয়েছিল সাহিবা সাবিত। সাহিবা সাবিত আহমদ মুসার অলক্ষ্যে পুলিশ অফিসারকে এ কথাও বলেছিল যে, খোদ ডিজিপি মাহির হারুন এনাকে ‘স্যার’ বলে, বুঝলেন!
আহমদ মুসার হাত ইশারা পেয়ে ছুটে আসে পুলিশের গাড়িটি।
আহমদ মুসা ইশারা করে তাদের গাড়ি থেকে একটু দূরে পুলিশের গাড়ি দাঁড় করায়।
দ্রুত পুলিশরা গাড়ি থেকে নেমে আসে। পুলিশ এসে স্যালুট দিয়ে আহমদ মুসাকে বলে, ‘কোন সমস্যা স্যার? গাড়ির কি কিছু হয়েছে স্যার?’
‘গাড়িতে বোমা বা কোন ধরনের বিস্ফোরক পাতা আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
শুনেই তটস্থ হয়ে উঠে পুলিশ। পুলিশ অফিসার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, ‘স্যার, তাহলে তো এখনি বোমা স্কোয়াডকে ডাকতে হয়।’
‘সে অনেক সময়ের ব্যাপার। আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি একটু দেখি, বোমা বা বিস্ফোরক বাইরে কোথাও পাতা আছে কিনা। বাইরে পাতা থাকলে খুব ঝামেলার বিষয় হবে না।’
বলে পা বাড়াল আহমদ মুসা তাদের গাড়ির দিকে।
ছুটে এসে সাহিবা সাবিত আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনাকে কিছুতেই গাড়ির দিকে যেতে দেব না।’
বলেই সাহিবা সাবিত তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘অফিসার, আপনি বোমা স্কোয়াড ডাকুন।’
আহমদ মুসাও বলল, ‘ঠিক আছে, ডাকুন বোমা স্কোয়াডকে।’
পুলিশ অফিসার সংগে সংগেই ওয়্যারলেস করল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।
‘ঠিক আছে সাহিবা, বোমা স্কোয়াড আসছে। আমি একটু দেখি, বোমাটা তারা কোথায় পেতেছে।’
সাহিবা সাবিত তাকিয়েছিল আহমদ মুসার চোখের দিকে। অদ্ভুত এক সম্মোহন শক্তি সে চোখে। সে দৃষ্টির সামনে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। মোমের মত গলে গেল যেন সে। আহমদ মুসাকে আর বাঁধা দিতে পারল না।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল গাড়ির মাঝের গেট বরাবর। মুহূর্তের জন্যে ভাবে, বোমা যদি সত্যিই পাতা থাকে, তাহলে তা পাতা হয়েছে, ড. আজদা অথবা আমাকে মারার জন্যে। সুতরাং তারা চাইবে, বোমার প্রথম আঘাতেই যেন তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়। সুতরাং গাড়ির মাঝখানে কোথাও তাদের বোমা পাতবে, এটাই যুক্তির দাবি।
গাড়িটি জাপানের মিতসুবিশি কোম্পানীর ৬ সীটের হাইল্যান্ডার জীপ। নিচের বটমটা দেখা খুব কষ্টসাধ্য নয়।
আহমদ মুসা গাড়ির প্রান্তে মুখ নিয়ে দেহটাকে মাটির সমান্তরালে এনে গাড়ির মধ্যাঞ্চলে একটু খোঁজাখুজি করতেই দেখতে পায়, গাড়ির লম্বালম্বি চেসিসের মধ্য বরাবর স্থানে আঠালো টেপ দিয়ে বোমাটি আটকানো।
দ্রুত ভালো করে দেখার জন্যে আহমদ মুসা মাথাটি ভেতরে নিয়েছিল। দেখতে পেল, টাইমারযুক্ত বোমা। টাইমারের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আহমদ মুসা। এখনও দেড় মিনিট বাকি।
আহমদ মুসা পকেট থেকে লেজার কাটার নিয়ে বাম হাতের বৃদ্ধা, তর্জনী ও মধ্যমা এই তিন আঙুল দিয়ে অতি সন্তর্পণে বোমাটি ধরে ডান হাত দিয়ে লেজার কাটারের সাহায্যে বোমাকে গাড়ির চেসিস থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল এবং বোমাটিকে ঐভাবে বাম হাতের তিন আঙুলে আলতোভাবে ধরে পেছনমুখী ক্রলিং করে ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাড়ির তল থেকে বের হয়ে এসেছিল।
ঘামে ভিজে গিয়েছিল আহমদ মুসার দেহ।
আহমদ মুসা বের হয়ে আসতেই পুলিশরা ছুটে এল।
‘স্যার, বোমা পাওয়া গেছে?’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘হ্যাঁ অফিসার, এটা টাইম বোমা। আর মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময়। কোন নিরাপদ জায়গায় একে ফেলতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আমাদের ফুটপাতের ওপারেই একটা পরিত্যক্ত ভাঙা স্থাপনা আছে, সেখানেই ছুঁড়ে দিন স্যার।’ বলল পুলিশ অফিসার।
ড. সাহাব নুরী, ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত আহমদ মুসার হাতে বোমা দেখে ও মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় আছে জেনে আতংকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত কয়েক পা হেঁটে ফুটপাতে উঠে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বাম হাতের তিন আঙুলেই বোমাটি ছুঁড়ে দিল পরিত্যক্ত স্থাপনার দিকে।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটল। মুহূর্তেই পাথরের তৈরি পরিত্যক্ত স্থাপনা ধুলো হয়ে গেল।
সকলের বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ সেদিকে।
পুলিশের বোমা স্কোয়াডও এসে গেছে।
ড. সাহাব নুরী, ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত এল আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা ঘুরে ফিরে আসছিল।
সাহিবা সাবিত আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘কি দরকার ছিল এই ঝুঁকি নেয়ার, স্যার? পুলিশের বোমা স্কোয়াড তো এসেই পড়ল।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তেমন বড় কোন দরকার ছিল না। তবে এটুকু হতো যে, বোমা স্কোয়াড এসে বোমা পেত না, আর তুমি গাড়ি পেতে না, আর আমি বোমাটা কোথাকার তৈরি তা জানতে পারতাম না।’
‘অমন লাখো গাড়িও আপনার সমান নয়। তবে আমি বলতে পারব না বোমাটা কোথাকার তৈরি তা না জানলে কি এমন ক্ষতি হতো?’ বলল বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে সাহিবা সাবিত।
পুলিশ অফিসার সামনে এগিয়ে এল আহমদ মুসার। বলল, ‘স্যার, বোমাটি কোথাকার তৈরি তা কি আপনি জেনেছেন?’
‘একটা ব্র্যান্ড চিহ্ন দেখেছি, নিশ্চিত করে কিছু বলার আগে আরও ভাবতে হবে অফিসার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আর একটা কথা, আমাদের মনে হয় মিউজিয়ামের ড্রাইভার তেল ভরার জন্যে গাড়ি নিয়ে যাবার পর গাড়িতে বোমা পাতা হয়েছে। তাকে গ্রেফতার করলেই সব জানা যাবে।’ পুলিশ অফিসারটি বলল।
‘তাকে গ্রেফতার করুন, জিজ্ঞাসাবাদ করুন, কিন্তু আমার মনে হয়, সে কিছুই জানে না। গাড়িতে তেল ভরার সময় বোমা পাতার কাজটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ঐ সময়টায় কি কি হয়েছে, কে কি দেখেছে, তা জানা গেলেই সত্যটা জানা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু স্যার, ওখানে তো অনেক লোক থাকে। এত লোকের মধ্যে কেউ ঐ ধরনের কিছু করে ফেলল, সেটা কতটা সম্ভব!’ পুলিশ অফিসার বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ওখানে শুধু তেল ভরাই হয় না, গাড়ির পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় অনেক কিছুই করা সম্ভব।’
অফিসার আহমদ মুসাকে একটা স্যালুট দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার, ঠিক বলেছেন আপনি।’
একটু থেমেই পুলিশ অফিসারটি আবার বলে উঠল, ‘স্যার, বোমার এ কেসটা কি ম্যাডাম সাহিবা করবেন? গাড়িটা তো তার।’
‘ওকে অফিসার, কেস আমিই করব। এখনি ফেরার পথে থানায় কেসটা রেকর্ড করে যাব।’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘ওকে ম্যাডাম’ বলে অফিসারটি সবাইকে সালাম দিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
পুলিশ চলে যেতেই সাহিবা সাবিত আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চলুন স্যার, আমরা ফিরি। ফেরার পথে কেসটা দায়ের করে যাব।’
‘কিন্তু সাহিবা সাবিত, আমি লেক ভ্যান দেখব বলে লেক ড্রাইভে যাবার জন্যে অলরেডি কিছুটা পথ এগিয়ে এসেছি। আমি লেক ড্রাইভটা ঘুরে আসি, তোমরা গাড়ি নিয়ে চলে যাও।’ বলল আহমদ মুসা।
বিমর্ষতার একটা ছায়া খেলে গেল সাহিবা সাবিতের মুখে। ভাবল সে, এভাবে সরাসরি ফিরে যাবার কথা বলা তার ঠিক হয়নি। সাহিবা সাবিত তাকাল ড. আজদার দিকে। আবার ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, এতবড় ঘটনা ঘটল, আপনার পোশাক ধূলি-ধূসরিত হয়েছে, এজন্যেই বলছিলাম স্যার। কিন্তু আপনার সিদ্ধান্তের সাথে আমি আছি স্যার।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সাহিবা, তোমার প্রস্তাবে আমি কিছু মনে করিনি। তুমি যেটা বলেছ সেটাই স্বাভাবিক। আমার অনুরোধ, তোমরা মামলা দায়েরের কাজটা শেষ করে যাও। আমি পরে আসব, মনে হচ্ছে আমার কিছু কাজ আছে।’
‘মনে হচ্ছে কিছু কাজ আছে, এর অর্থ কি ভাইয়া? আপনি লেক ড্রাইভে যাবেন, সেটাই কি কাজ?’ বলল ড. আজদা।
‘লেক ড্রাইভে যাওয়া কোন কাজ নয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, যে যাওয়াটা আমার বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে, সে যাওয়াটা আমার শেষ করা দরকার। এই ‘শেষ করা’টাকেই আমি কাজ বলছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে স্যার, আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন কেন?’ বলল সাহিবা সাবিত।
‘বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কেস দায়ের হওয়া জরুরি। এছাড়া তেমন আর কোন কারণ নেই।’
‘তাহলে ঘুরে এসেই আমরা কেস দায়ের করব। আমরা এখন যাত্রা করতে পারি।’ সাহিবা সাবিত বলল।
‘ভাইয়া, চলুন আমরা যাত্রা করি।’ বলল ড. আজদা।
সবাই গাড়িতে উঠল। আগের মতই আহমদ মুসা ড্রাইভিং সীটে। তার পাশে ড. সাহাব নুরী। পেছনের সীটে ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত।
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি ড. সাহাব নুরী। গাড়ি চলতে শুরু করলে সে বলল, ‘মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, মৃত্যু থেকে আমরা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ছিলাম। গাড়ি ঐ কয়েক মিনিট চললে আমাদের সাক্ষাৎ মৃত্যু ঘটতো। আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আপনাকে বিব্রত করবো না। কারণ প্রশংসা আপনি পছন্দ করেন না।’
বলে থামল ড. সাহাব নুরী। একটু থেমেই বলল, ‘কিন্তু একটা বিস্ময় আমার মনে মি. আবু আহমদ। বোমার অস্তিত্ব আপনি টের পেলেন কি করে?’
আহমদ মুসা ডান হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে বাঁ হাত দিয়ে পকেটের কলমটা বের করে বলল, ‘এই কলম আমাকে সিগন্যাল দিয়েছে।’
‘ওটা কি এক্সক্লুসিভ ডিটেক্টর জনাব?’ জিজ্ঞাসা সাহিবা সাবিতের।
‘আরও অনেক কিছু।’ হাসির সাথে বলল আহমদ মুসা।
কলমটি পকেটে রাখল আহমদ মুসা।
গাড়ি চলছিল পশ্চিম দিকে লেক অভিমুখে।
তীরের কাছাকাছি পৌঁছে লেক ড্রাইভে উঠল আহমদ মুসার গাড়ি। এবার গাড়ি চলতে শুরু করল তীর ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে।
গাড়িতে নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল সাহিবা সাবিত। বলল, ‘স্যার, পুলিশ সাহস করল না। বোমা স্কোয়াডকে ডেকে পাঠাল। কিন্তু আপনি বোমার সন্ধানে লাগলেন। বোমাটা বের করেও আনলেন। কিন্তু টাইম বোমার বার্স্ট হওয়ার সময় যদি ঐ সময়েই শেষ হয়ে যেত এবং বিস্ফোরণ ঘটত?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঐ বোমায় আমার মৃত্যু লেখা থাকলে, সেটাই ঘটতো, কিন্তু মৃত্যু লেখা ছিল না বলে টাইম বোমার সময় তখন দেড় মিনিট ছিল।’
আহমদ মুসার নির্বিকার এই জবাবে সবার চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
সাহিবা সাবিতের চোখে-মুখে তখন অপরিচিত এক বেদনার কালো ছায়া। বলল সে, ‘জীবনকে ভালোবাসা মানব ফিতরাতেরই একটা অংশ এবং এটা আল্লাহর দেয়া। আপনি এই ফিতরাতকে লংঘন করেছেন স্যার।’
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘তুমি খুব ভারি কথা বলেছ সাহিবা সাবিত। আমার ওপর তোমার অভিযোগটাও মারাত্মক এবং এটা সত্য। কিন্তু সাহিবা সাবিত, জীবনের ঝুঁকি জীবন সংগ্রামেরই একটা অংশ। একে বাদ দিলে জীবনের চাকা পদে পদে অচল হয়ে পড়তে পারে।’
‘জেনারেল রুল হিসেবে আপনার কথা সত্য। কিন্তু অনেক বিশেষ ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। যেমনঃ একটা গাড়ি রক্ষার জন্যে আপনি জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন না।’ গম্ভীর ও ভারি কণ্ঠ সাহিবা সাবিতের।
‘তোমার এ কথাও সত্য সাহিবা সাবিত। কিন্তু সাহিবা, এই ঘটনায় গাড়ি রক্ষা মূল বিষয় ছিল না। মূল বিষয়টা ছিল বিস্ফোরকের সন্ধান করা। পুলিশের বোমা স্কোয়াডও এটাই করতো। তারা যেটা করতো, আমিও সেটাই করেছি। গাড়ির বটমটা দেখতে দিয়ে গাড়ির চেসিসের সাথে বোমাটা দেখে ফেলি। একই সাথে দেখে ফেলি যে, বোমাটা টাইম বোমা এবং সময় দেড় মিনিট আছে। এই সময়ের মধ্যে বোমাটা বাইরে নিয়ে নিরাপদে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। আমি তাই করেছি। আল্লাহর দেয়া ফিতরাত আমি লংঘন করিনি সাহিবা।’ বলল আহমদ মুসা।
সাহিবা সাবিতের মুখ থেকে বেদনার মেঘ অনেকখানি কেটে গেছে। চোখে তার মুগ্ধতার একটা ঔজ্জ্বল্য। ঠোঁটে প্রসন্নতার অপরিস্ফুট হাসি। বলল, ‘স্যার, কথার রাজা যদি কেউ হন, তাহলে যুক্তিও তার হাতের মুঠোয় চলে যায়। সুতরাং আমার কোন কথা নেই। তবে স্যার, আমার মতটা বলি। এ ধরনের ঝুঁকি আমি নিজের জন্যে পছন্দ করি না, অন্য কারও জন্যে করব কেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার এই যুক্তিতে আমার সব ‍যুক্তি শেষ, সব কথা শেষ। তাহলে তোমাকে তো কথার সম্রাট বলতে হয়। কি বল তুমি আজদা?’
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আসলেই সে কথার সম্রাট। ওর গোটা একাডেমিক ক্যারিয়ারে ডিবেটে প্রথম স্থান ওর জন্যে বরাদ্দ।’ ড. আজদা বলল।
ড. আজদার কথাগুলো আহমদ মুসার কানে গেল না। তার চোখ তখন গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে নিবদ্ধ। রিয়ারভিউতে দেখতে পাচ্ছে সে একটা গাড়িকে। অনেকক্ষণ ধরেই দেখছে গাড়িটাকে। আহমদ মুসাদের গাড়ির সমান গতিতে আসছে। গাড়ির গতি অতিসন্তর্পণে কম-বেশি করে কমিয়ে-বাড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে, গাড়িটির নিজস্ব কোন গতি নেই। তার মানে, গাড়িটি তাদের অনুসরণ করছে। নিশ্চয় ওরা উল্কিওয়ালারাই। ওরাই বোমা পেতে ছিল। বোমার ফাঁদ ওদের ব্যর্থ হয়ে গেছে। বোমার ফাঁদ ব্যর্থ হলে বিকল্প চিন্তাও তাদের ছিল! আহমদ মুসা স্বীকার করল, আসলেই গ্রুপটা দূরদর্শী ও নাছোড়বান্দা। কিন্তু গাড়িটা আমাদের অনুসরণ করছে কেন? কি তাদের মতলব? আহমদ মুসা ডুবে গিয়েছিল চিন্তায়।
তার দু’হাত স্টিয়ারিং হুইলে এবং চোখ দু’টি সামনে প্রসারিত। কিন্তু তার মনটা পড়ে আছে দু’পাশের রিয়ারভিউ মিররে। মাঝে মাঝেই দু’চোখ চকিতে ফিরিয়ে এনে মনিটর করছে রিয়ারভিউয়ের দৃশ্য।
হঠাৎ আহমদ মুসার নীরব হওয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে ড. আজদাসহ সবার মধ্যে। পাশের সীটে বসা ড. সাহাব নুরী আহমদ মুসার চোখে-মুখের ভাবান্তর আরও কাছ থেকে লক্ষ্য করছে। তার বিস্ময় আরও বেশি। সে পেছন ফিরে ড. আজদাদের দিকে মুখ নেড়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল তাদের দিকে। তারাও প্রশ্ন ফিরিয়ে দিল।
কথা বলল আহমদ মুসাই প্রথম। বলল, ‘মি. সাহাব নুরী, এই রাস্তা এভাবে কত দূর গেছে?’
‘লেক হিল টানেল পর্যন্ত গেছে।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘তারপর?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তারপর রোড টানেলে ঢুকে গেছে। টানেল প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। টানেল শেষে রোড এভাবেই সামনে লেকের ও প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। তবে আমাদের সামনে যাওয়া শেষ হবে লেক হিল টানেলে গিয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ পারমিশন ছাড়া টানেলে ঢোকা নিষিদ্ধ।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘মাঝখানে রোড স্টেশন কিংবা এ জাতীয় কিছু আছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘সেরকম কিছু নেই। কেন এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন?’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘সামনে কি আছে আমি বুঝতে চেষ্টা করছি ড. সাহাব নুরী।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন? সামনে এগোলেই তো সব দেখা যাবে।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘সামনে যাওয়াটা কতটা নিরাপদ সেটাই আমি ভাবছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন এই ভাবনা, কিছু ঘটেছে?’ সাহাব নুরী বলল। তার কণ্ঠে দুশ্চিন্তার ছাপ।
কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবনার ছায়া নেমেছে ড. আজদা ও সাহিবার চোখে-মুখে।
‘ঘটেছে নয়, ঘটছে মি. সাহাব নুরী। আমাদেরকে পেছন থেকে ফলো করা হচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফলো করা হচ্ছে?’ বলল ড. সাহাব নুরী। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
মুহূর্তে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল ড. আজদাদের মুখেও।
ড. সাহাব নুরীও গাড়ির রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাল। দেখতে পেল গাড়িটাকে।
রাস্তায় এখন গাড়ি নেই বললেই চলে। আসলে লেক ড্রাইভে এ সময় কেউ আসে না। লেক ড্রাইভ জমজমাট হয়ে ওঠে বেলা ৩টার পর।
‘গাড়িটা আমাদের ফলো করছে, এটা কি করে বোঝা গেল মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ?’ জিজ্ঞেস করল ড. সাহাব নুরী।
‘এটা বোঝার জন্যে যা করা দরকার, তা করার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি গাড়িটা আমাদের ফলো করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওদের লক্ষ্য কি?’ বলল ড. সাহাব নুরী। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। সামনে ওদের লোকজন থাকতে পারে। কোথায় কিভাবে থাকতে পারে, সেটা আন্দাজ করার জন্যেই সামনে কি আছে তা জানতে চাচ্ছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন মি. আবু আহমদ। ওরা আমাদের শুধুই ফলো করছে তার অর্থ সামনে ওদের লোক আছে কোন এক জায়গায় ওঁৎ পেতে।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
ড. সাহাব নুরী কথা বললেও তার উদ্বিগ্ন চোখ নিবদ্ধ ছিল গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে।
কথা শেষ করেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, গাড়িটা এবার দ্রুত এগিয়ে আসছে। আপনি গাড়ির গতি বাড়ান।’
আহমদ মুসাও দেখতে পেয়েছিল যে, গাড়িটা ডাবল স্পীডে এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা তার গাড়ির গতি না বাড়ালে দু’তিন মিনিটের মধ্যেই গাড়িটা আহমদ মুসাদের সমান্তরালে এসে যাবে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির গতি বাড়াল না। বলল, ‘বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা গতি বাড়াব, সেটা ঐ গাড়িটা জানে এবং গাড়ির গতি বাড়িয়ে লাভ হবে না, সেটাও জানে। জানে বলেই গাড়িটা তার গতি বাড়িয়েছে।’ আহমদ মুসা থামল।
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয়?’ বলল সাহিবা সাবিত। তার কণ্ঠ শুষ্ক। চোখে-মুখে উদ্বেগ।
ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদারও উদ্বেগে মুষড়ে পড়া ভাব।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা কি করছে তা দেখা ছাড়া আমাদের কিছু করণীয় দেখছি না। পেছন থেকে গাড়িটা আসছে, দেখা যাক গাড়িটার কি ভূমিকা হয়।’
কথা বলছিল সামনের দিকে তাকিয়ে। সামনে আর কোন গাড়ি সে দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেল, ওপাশে ফেরার রাস্তা দিয়ে দু’টি মাইক্রো আসছে পাশাপাশি। ঐ দু’টি মাইক্রো ছাড়া ওপাশের ফেরার রাস্তাতেও কোন গাড়ি নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার খেয়াল হলো, তাদের ফলোকারী গাড়ি এবং সামনের মাইক্রোবাস দু’টির গতি একই রকম। শুধু তাই নয়, পেছনের গাড়ি এবং সামনের দু’টি মাইক্রো আহমদ মুসাদের গাড়ি থেকে সমান দূরত্বে।
ভাবতে ভাবতেই পেছনের গাড়ি এবং সামনের দু’টি মাইক্রো আহমদ মুসাদের গাড়ির আরও ক্লোজ হয়ে গেল।
হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল, তার গাড়ি থেকে বিশ-পঁচিশ গজ সামনে দু’পাশের রাস্তার একটি লিংক চ্যানেল।
লিংক চ্যানেলটা নজরে পড়তেই হঠাৎ যেন সব বিষয় আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মাইক্রো দু’টির টার্গেট লিংক চ্যানেল দিয়ে এ রাস্তায় ঢুকে পড়া এবং আহমদ মুসার গাড়ির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ানো।
আহমদ মুসার ভাবতে যতক্ষণ সময় লাগল, ততক্ষণে ঘটনা ঘটে গেছে। মাইক্রো দু’টি লিংক চ্যানেল দিয়ে এ রাস্তায় ঢুকে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে ছুটে আসছিল সমান্তরালে গোটা রাস্তা কভার করে।
‘সবাই সাবধান!’ বলে হার্ডব্রেক করল আহমদ মুসা।
সামনের দু’গাড়িও গজ চারেক এগিয়ে এসে আহমদ মুসার গাড়ির মতই হার্ডব্রেক কষল।
অনুরূপভাবে পেছনের ফলো করে আসা গাড়িটাও আহমদ মুসার গাড়ি থেকে চার গজ মত দূরে এসে বিকট শব্দ তুলে হার্ডব্রেক কষল।
সামনের দু’টি মাইক্রো থামার সংগে সংগেই দুই মাইক্রোর ছাদের একটা অংশ সামনে থেকে সরে গেল। সেখানে বেরিয়ে এল আহমদ মুসাদের গাড়ি তাক করা রকেট লাঞ্চার। আর দু’মাইক্রো থেকে নেমে এল আপাদমস্তক কালো পোশাকের আটজন মানুষ। ওদের সবার হাতে মিনি মেশিনগান। ওরা ‍ছুটে এল আহমদ মুসার গাড়ির সামনে।
কি ঘটতে যাচ্ছে আহমদ মুসা সবই বুঝতে পারল।
ওরা সামনে দাঁড়ানোর আগেই আহমদ মুসা তার এম-১০ রিভলভারের বাঁট দিয়ে তার সামনের উইন্ড স্ক্রীন ভেঙে ফেলল।
একটা রিভলভার হাতেই ছিল আহমদ মুসার এবং জ্যাকেটের বাম পকেট থেকে আরেকটা বাম হতে তুলে নিল।
তার দু’হাতে রিভলভার। তাক করা সামনের দিকে।
ওরা এসে দাঁড়াল সামনে। ওদের হাতেও মিনি মেশিনগান উদ্যত।
রিয়ারভিউয়ে আহমদ মুসা দেখতে পেল, পেছনের গাড়ি থেকেও দু’জন নেমেছে। তারা পজিশন নিয়েছে পেছনে।
এই সময় সামনের গাড়ি থেকে একজন চিৎকার করে বলল, ‘আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, তোমার খেলা শেষ। তোমাকে হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে, নয়তো তোমাদের সকলকে ধ্বংস হতে হবে। তোমাদের সমেত গাড়িটাকে ছাতু বানিয়ে দিতে আমাদের দু’রকেট লাঞ্চারের একটিই যথেষ্ট। তবে আমরা চাই তোমাকে ও ড. আজদাকে জীবন্ত হাতে পেতে। তোমরা আমাদের লোক মেরেছ। তোমাদের মারার আগে সেই শোধ আমরা তুলতে চাই। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। দু’মিনিটের মধ্যে তোমাকে জানাতে হবে, তুমি ও ড. আজদা আত্মসমর্পণ করছ কিনা।’
আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ড. আজদা, সাহিবা সাবিত ও সাহাব নুরীদের বাঁচানোর একটা বিকল্প তার সামনে এসেছে। কিন্তু এ বিষয়ের দিকে না গিয়ে সে বলল, ‘তোমরা কে জানি না, কিন্তু তোমাদের ঐ রকেট লাঞ্চার দিয়ে আমাদের ধ্বংস করার ভয় দেখিও না। তোমাদের হাতে যে রকেট লাঞ্চার দেখছি, তার ডেস্ট্রাকশন রেডিয়াস হল ৪০ বর্গফুট। সুতরাং আমাদের গাড়ি ধ্বংস করতে চাইলে তোমাদের তিন গাড়ি এবং তোমরাও ধ্বংস হয়ে যাবে। হ্যাঁ, তোমরা বন্দুকধারী, দশটি মিনি মেশিনগানের গুলি চালিয়ে আমাদের চারজনকে হত্যা করতে পার, কিন্তু শুনে রাখ, আমাদের চারজনকে মারতে হলে তোমাদের কমপক্ষে চারজনকে মরতে হবে। তবে আমার দুই হাতের রিভলভার আরও বেশি মারতে পারে, কারণ, আমার হাত তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্র এবং আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। সুতরাং তোমাদের প্রস্তাব নয়, আমার প্রস্তাবে তোমাদের রাজি হতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
ওদিক থেকে সংগে সংগেই উত্তর এল না।
এদিকে ড. সাহাব নুরী, ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত আতংকে একেবারে চুপসে গেছে। ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত দু’জনেই কাঁপছে। আর ড. সাহাব নুরী তার বুকের কাঁপুনি থামাতেই পারছে না।
কিন্তু তারা সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে আহমদ মুসার নির্ভয় ও স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, তারা যে ভয় দেখিয়েছিল, সে ভয় আহমদ মুসা তাদের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং তার প্রস্তাব ওদেরকে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে কার্যত সিচুয়েশনের কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু আবু আহমদ আব্দুল্লাহর প্রস্তাবটি কি, এ বিষয়টি বিরাট কৌতুহলেরও সৃষ্টি করেছে তাদের মধ্যে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার পর ওদের তরফ থেকে কোন কথা এল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর ওদিক থেকে একটা ভারি কণ্ঠ বলল, ‘ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বল, তোমার প্রস্তাব কি?’
‘আমি অনর্থক ভয় দেখাই না। আমি যা বলেছি, তাই ঘটবে। সে যাক, ড. আজদার কোন দোষ নেই। তাকে কিডন্যাপ করার জন্যে তোমাদের লোক যারা কয়েকবার গিয়েছিল, তাদের আমিই হত্যা করেছি। আমার প্রস্তাব হলো, ড. আজদা, ড. সাহাব নুরী ও সাহিবা সাবিত অর্থাৎ আমি ছাড়া গাড়িতে যারা আছেন, সবাই এ গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। আমি একাই আপনাদের হাতে থেকে যাব। এটাই আমার প্রস্তাব।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ‘না’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সাহিবা সাবিত। বলল, ‘এ প্রস্তাব চলবে না। যা ঘটার একসাথে ঘটবে। মরলে একসাথে মরব।’ আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ সাহিবা সাবিতের।
আহমদ মুসার প্রস্তাবে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে ড. আজদা ও ড. সাহাব নুরীর চোখ। এতো আত্মঘাতী প্রস্তাব আবু আহমদের! বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করার কথা তো ভাবেনি! যা ঘটবে একসাথেই তাদের ওপর ঘটবে, এটাই তো তারা ভাবছিল। এসব চিন্তাই এসে ঘিরে ধরেছে ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদাকে। তাদের কথাই ভাষা পেয়েছে সাহিবা সাবিতের আর্তনাদ ও কথার মধ্যে।
আহমদ মুসার প্রস্তাবের উত্তর এল ওপার থেকে। বলল আবার সেই ভারি কণ্ঠ, ‘তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি আমরা দুই শর্তে। এক. তোমার হাতের দু’টি রিভলভার তোমার গাড়ির ভাঙা উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে এদিকে ফেলে দিতে হবে। দুই. রিভলভার দু’টি ফেলে দেয়ার পর তুমি দু’হাত তুলে বেরিয়ে আসবে। তুমি এসে আমাদের লোকদের সামনে হাত তুলে দাঁড়াবার পর ড. আজদারা গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবে।’
‘আমাকে হাতে পাওয়ার পর এদেরকে নিরাপদে যেতে দেবে, তার গ্যারান্টি তোমাদের শর্তে নেই। ইচ্ছে করলে তোমরা আমাদের সবাইকে একসাথে মেরে ফেলতে পার। এই ব্যাপারে আমার শর্ত হলো, অস্ত্র আগে ছাড়ব না। অস্ত্র হাতে নিয়েই বের হবো এবং তোমাদের লোকদের সামনে দাঁড়াব। এরপর ড. আজদারা চলে যাবে। তারা নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার পর আমি অস্ত্র ত্যাগ করব।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আমরা বিরোধিতা করছি স্যার। আপনি এই প্রস্তাব থেকে সরে আসুন। যা ঘটে ঘটুক, একসাথেই আমাদের ওপরে ঘটুক।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল সাহিবা সাবিত।
‘আমারও কথা এটাই ভাইয়া। আপনি প্লিজ এমন কিছু করবেন না।’ বলল ড. আজদা। তারও কণ্ঠ কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ওদিক থেকে সেই কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো। বলল, ‘ঠিক আছে আবু আহমদ। তোমার কথা মেনে নিলাম। তুমি অস্ত্র নিয়েই বেরিয়ে এস। ড. আজদাদের গাড়ি কিছু দূরে চলে যাবার পর যখন আমরা বলব, তখন অস্ত্র ত্যাগ করে হাত তুলে দাঁড়াতে হবে।’
‘ঠিক আছে। আমি বেরুচ্ছি।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ড. সাহাব নুরীর দিকে।
ড. সাহাব নুরীর মুখ বেদনায় দীর্ণ। তার চোখ দিয়ে গড়াচ্ছে অশ্রু।
‘আমি যাচ্ছি। আপনি ড্রাইভিং সীটে এসে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তার বাঁ হাত ড. সাহাব নুরীর কাঁধে রেখে তাকে সান্ত্বনা দিল।
ড. সাহাব নুরী কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
একসাথে কেঁদে উঠেছে সাহিবা সাবিত ও ড. আজদা।
আহমদ মুসা তার হাতটা ড. সাহাব নুরীর কাঁধ থেকে নামিয়ে তাকাল পেছন দিকে। একটু উচ্চকণ্ঠে ডাকল ড. আজদা ও সাহিবা সাবিতকে।
তারা মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দু’জনেই মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে।
আহমদ মুসা তাদের বাঁধা দিয়ে বলল, ‘এখন কোন কথা নয়। এভাবে ভেঙে পড়া ঠিক নয়। আল্লাহর ওপর ভরসা কর এবং কিছু চাইলে, শুধু তাঁর কাছেই চাও। বিপদ দেবার ক্ষমতা তাঁরই, বিপদ থেকে বাঁচানোর ক্ষমতাও তাঁর। স্মরণ কর, আল্লাহ বলেছেন, ‘ফা-ইন্নামাআল উসরে ইয়োসরা, ইন্নামাআল উসরে ইয়োসরা (সংকটের সাথে সমাধান থাকে, নিশ্চয় সমাধান থাকে সংকটের সাথে)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ অমোঘ কথার ওপর ভরসা রাখো। কেঁদো না কেউ।’
বলে আহমদ মুসা তাদের কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নিচে নেমে গেল।
অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ল ড. আজদা ও সাহিবা সাবিত।
ড. সাহাব নুরী ড্রাইভিং সীটে এসে বসল এবং গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু করল।
গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসা ঠিক গাড়ির সামনে দাঁড়াল। তার দু’হাতের রিভলভার উদ্যত সামনের আট দুষ্কৃতিকারীর দিকে।
ড. সাহাব নুরী গাড়ি ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, তা পেছন দিকে না তাকিয়েও বুঝল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, পেছন থেকে পায়ের চারটি শব্দ এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা ভাবল, নিশ্চয় পেছনের গাড়ির লোক হবে তারা। কেন আসছে তারা? কি তাদের উদ্দেশ্য? গুলি করার ইচ্ছা থাকলে পেছন থেকে এতক্ষণে গুলি করতে পারতো।
পেছন থেকে পদশব্দ দ্রুত হয়েছে।
আরও কিছু ভাবার আগেই পেছন থেকে দু’জন তার দু’হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’টো রিভলভারই তার হাত থেকে ছুটে গেল।
রিভলভার দু’টি পেছন থেকে আসা দু’জনে তুলে নিয়েছে।
হো হো করে হেসে উঠল গাড়ির ভেতর থেকে সেই কণ্ঠ। বলল, ‘আবু আহমদ, হাত ওপরে তোল।’
আহমদ মুসা হাত ওপরে তুলল।
আবার হেসে উঠল সেই কণ্ঠ। বলল, ‘আবু আহমদ, প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে পারলাম না। কোন শিকার হাতের মুঠোয় আসার পর তাকে ছেড়ে দেয়া আমাদের নীতি নয়।’
আহমদ মুসা দেখল, একটি রকেট লাঞ্চার ওপরে উঠছে।
বুঝতে পারল আহমদ মুসা, ড. আজদাদের গাড়ি লক্ষ্যেই রকেট লাঞ্চার ওপরে উঠছে।
এই বিশ্বাসঘাতকতায় আহমদ মুসার সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরে গেল। ভাবল, এবার তার রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। তার দু’হাত উঠে আছে কান পর্যন্ত। সে হাতের কয়েক ইঞ্চি পেছনে জ্যাকেটে রাখা আছে যাদুকরী মিনি মেশিন রিভলভার। ট্রিগার টিপে ধরলেই এ রিভলভার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২৪টি গুলির মিছিল বেরিয়ে আসে। গুলিগুলো আকারে ছোট, কিন্তু প্রত্যেকটি একটি বোমার মত ভয়ংকর।
আহমদ মুসা তাকাল চারদিকে রকেট লাঞ্চারধারীদের দিকে। আহমদ মুসা নিরস্ত্র হবার পর ওরা এখন নিশ্চিন্ত। ওদের ভয়ংকর গানগুলোর ব্যারেল নিচে নামানো।
তখনও রকেট লাঞ্চারের সুঁচালো মাথা ওপরে ওঠা শেষ হয়নি।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ গতিতে ঢুকে গেল ঘাড়ের নিচে জ্যাকেটের পকেটে। হাতটি চোখের পলকে বেরিয়ে এল, তর্জনী রিভলভারের ট্রিগারে।
হাত বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। গুলি অব্যাহত রেখেই সে বসে পড়ল এবং পাল্টা গুলি থেকে বাঁচার জন্যে শুয়ে পড়ল। গুলিবর্ষণ তার থামেনি।
পাল্টা গুলিও চলছিল।
কিন্তু আহমদ মুসার রিভলভার এতই ক্ষিপ্রতার সাথে চারদিক ঘুরে এল এবং তার গুলি এতই পয়েন্টেড হলো যে, পাল্টা আঘাতের চেষ্টা যারা করছিল, তারাও গুলি খেয়ে ঢলে পড়ল মুহূর্তে। আহমদ মুসা দ্রুত তার অবস্থানের পরিবর্তন করায় পাল্টা যে গুলি হয়েছিল তা কাজে আসেনি।
গুলি করতে করতেই আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে সরে এসেছিল পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই মাইক্রোর মাঝখানে আড়াল নেয়ার জন্যে। গড়িয়ে সরে আসার সময় আহমদ মুসা একটা মিনি মেশিনগানও কুড়িয়ে এনেছিল।
আহমদ মুসাদের গাড়ির পেছনে ওদের যে গাড়িটি দাঁড়িয়েছিল, তার দু’জন লোক শুরুতেই আহমদ মুসার গুলিতে মারা পড়েছিল। অবশিষ্ট দু’জনও ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা সামলে গুলি করতে শুরু করেছিল।
আহমদ মুসা মাইক্রোর আড়াল নেয়ার পর কুড়িয়ে পাওয়া মিনি মেশিনগান দিয়ে ওদের লক্ষ্যে গুলি করা শুরু করে।
ওরা ফাঁকা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিল। তারা তাদের গাড়ির আড়াল নেবে, এমন আত্মরক্ষামূলক চিন্তা আগে করেনি। আহমদ মুসার গুলি শুরু হলে তারা এটা বুঝল এবং পেছন দিকে ছুটল গাড়ির আড়াল নেবার জন্যে। কিন্তু যাওয়া তাদের শেষ হলো না। ওদের গাড়ির সামনেই ওরা গুলি খেয়ে ঢলে পড়ল।
হঠাৎ আহমদ মুসার খেয়াল হলো, পাশের মাইক্রো থেকে যে লোকটি তার সাথে কথা বলেছে এবং শেষ সময়ে যে রকেট লাঞ্চার তাক করছিল ড. আজদাদের গাড়ি লক্ষ্যে, সে লোকটি কোথায়?
এই কথা মনে হবার সাথে সাথে আহমদ মুসা তার মিনি মেশিনগান ধরা হাত পাশের মাইক্রোর দিকে ঘুরিয়ে নিল অব্যাহত গুলির একটা দেয়াল সৃষ্টি করে।
এভাবে বাঁ দিকে ঘুরতে গিয়েই আহমদ মুসা দেখল, পাশের মাইক্রোর ওপাশ থেকে একজন লোক ছুটে ‍গিয়ে মাইক্রোর সামনে পড়ে থাকা নিহত একজনের মিনি মেশিনগান হাতে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু মিনি মেশিনগান হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াবার আগেই আহমদ মুসার গুলির দেয়ালের মধ্যে পড়ে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে একজন সাথীর মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, এই লোকটি অন্যদের চেয়ে আলাদা। এর পরনে আপাদমস্তক কালো পোশাক নেই। তার বদলে রয়েছে কুর্দিশ মৌলভির পোশাক।
এর এই পোশাক কেন? সংগে সংগেই এ প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। এটা কি উল্কিওয়ালাদের এক ক্যামোফ্লেজ? এটাও হতে পারে মানুষকে প্রতারণা করার জন্যে, নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বুঝল, মাইক্রো থেকে এই লোকটিই তার সাথে কথা বলেছিল এবং এর হাতেই ছিল রকেট লাঞ্চার। আর তার হাতে মিনি মেশিনগান ছিল না। ছিল না বলেই সে আক্রমণে আসতে পারেনি। অবশেষে একটা মিনি মেশিনগান কুড়িয়ে আনতে গিয়েই তাকে শেষ হতে হলো।
আহমদ মুসা চারদিকে চোখ বোলাল। দেখল, তেরটি লাশ তার সামনে। এরা শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকেই মারতে চেয়েছিল, সবাইকে মারতে গিয়েই এরা সবাই লাশ হয়ে গেল, হিসেব করল আহমদ মুসা। আল্লাহর অসীম অনু্গ্রহের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় বিনত হলো আহমদ মুসার হৃদয়-মন-মাথা সবই। নিজের জীবন দিয়ে হলেও তিনজন নিরপরাধ মজলুমকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম বলে আল্লাহ আমাকেও বাঁচিয়ে দিলেন! আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে সজল হয়ে উঠল আহমদ মুসার দু’চোখ।

গাড়ি সামনের দিকে চলছিল। কিন্তু সাহিবা সাবিত ও ড. আজদা দু’জনেই আকুল চোখে তাকিয়েছিল পেছনে। অবিরাম অশ্রু ঝরছিল তাদের চোখ দিয়ে।
সাহিবা সাবিত ও ড. আজদা দু’জনেরই চোখ নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসা যেখানে ঘেরাও হয়েছেন, সেই ঘটনাস্থলের দিকে।
হঠাৎ তারা গুলি-গোলার অব্যাহত শব্দ শুনতে পেল।
খোলা ছিল তাদের গাড়ির সবগুলো জানালাই।
ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল তারা দু’জনেই। তাহলে কি সব শেষ হয়ে গেল! বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠল সাহিবা সাবিতের। পেছনে তাকিয়ে সে চিৎকার করে বলল, ‘গাড়ি থামান মামা। ওখানে গুলি-গোলা হচ্ছে। দেখা দরকার ওর কি হলো। থামান মামা গাড়ি।’
‘না সাহিবা সাবিত, ওর নির্দেশ, আমাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হবে। তোমাদের, আমাদের বাঁচানোর জন্যেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তোমাদের কোন বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘না, ওর কথা আমি মানি না। উনি নিজের ওপর অবিচার করেছেন, আমাদের প্রতি অবিচার করেছেন। আমি যাব সেখানে।’
বলে ড্রাইভিং সীটের দিকে এগোলো সাহিবা সাবিত। বলল, ‘মামা, হয় আপনি সেখানে চলুন, না হয় ড্রাইভিং আমাকে দিন। আমি সেখানে যাব।’
‘তুমি পাগল সাহিবা। সেখানে গিয়ে তুমি, আমি, আমরা কি করব। এই চিন্তা করেই তো তিনি আমাদের চলে আসতে বাধ্য করেছেন। ঠিক আছে, চল আমরা এক জায়গায় গিয়ে গাড়ি পার্ক করি। ওরা চলে গেলে আমরা সেখানে গিয়ে খোঁজ নেব।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘সেখানে প্রচণ্ড গুলি-গোলার শব্দ শোনার পর আমি ফিরতে পারবো না। আপনারা আমাকে নামিয়ে দিন, হেঁটেই আমি সেখানে যাব।’ সাহিবা সাবিত বলল। স্থির সিদ্ধান্ত তার কণ্ঠে।
‘সাহিবা একটু বুঝতে চেষ্টা কর, আমরা সেখানে গিয়ে কি করব, কি করতে পারব?’ বলল ড. সাহাব নুরী। কণ্ঠ তার নরম।
‘ওর সাথে মরতে তো পারব!’ সাহিবা সাবিত বলল কান্নাজড়িত কণ্ঠে।
ড. সাহাব নুরী তাকাল ড. আজদার দিকে।
ড. আজদা বলল, ‘সাহিবা সাবিত যা বলেছে সেটাই আমার মত। উনি যদি না থাকেন, তাহলে আমরা পালিয়েও বাঁচতে পারবো না। মরতে যদি হয়, তাহলে তার সাথে মরাই ভালো।’ কান্নায় ভেঙে পড়া ড. আজদার কণ্ঠ।
‘ঠিক আছে, আল্লাহ ভরসা।’ বলে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল ড. সাহাব নুরী।
ছুটে চলল গাড়ি ফেলে আসা সেই ঘটনাস্থলের দিকে।
আহমদ মুসা সার্চ করছিল লাশগুলো উল্কিওয়ালা বলে তার কাছে পরিচিত এই গ্রুপটির ঠিকানা কিংবা এদের আরও পরিচয় পাওয়া যায় কিনা এজন্যে।
আপাদমস্তক কালো ইউনিফর্ম পরা লাশগুলো ওদের বিশেষ কমান্ডো বলে তার মনে হলো। এর আগে এই গ্রুপের আরও যাদের লাশ দেখেছে, তারা এই ধরনের ইউনিফর্ম পরা ছিল না।
এদের সার্চ করে কিছু পেল না আহমদ মুসা।
সব শেষে আহমদ মুসা সবার পরে নিহত হওয়া কুর্দিশ মৌলভীর পোশাক পরা লোকটির কাছে এল। এই লোকটিকেই দলনেতা মনে হয়েছে আহমদ মুসার।
তার পকেটে পেল একটা মানিব্যাগ। মানিব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ল কিছু আর্মেনীয় ও টার্কিশ টাকা এবং আইডি কার্ড। দ্রুত আইডি কার্ডটাই দেখল আহমদ মুসা। কার্ডটিতে লোকটির একটি কুর্দিশ নাম আছে। পরিচয় লেখা হয়েছে একটি কুর্দি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে।
আইডি দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, এটা ভুয়া। তুর্কি পুলিশকে বোকা বানানোর জন্যেই এই পরিচয় নেয়া হয়েছে।
মানিব্যাগটা আরও ভালো করে সার্চ করতে গিয়ে মানিব্যাগের একটা কেবিনে পেল চার ভাঁজ করা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। গুরুত্বপূর্ণ হবে কিছু, এটা মনে করে কাগজটা তাড়াতাড়ি খুলে দেখল, ওটা একদমই সাদা একটা চিরকুট। হতাশ হয়েও আহমদ মুসা ভাবল, একটা সাদা কাগজকে এভাবে সযত্নে ভাঁজ করে মানিব্যাগের গোপন পকেটে রাখা হবে কেন? একটা রহস্যের গন্ধ পেল আহমদ মুসা।
কাগজটি পকেটে পুরল আহমদ মুসা।
হঠাৎ পেছনে গাড়ির শব্দ পেয়ে ‘ডিজিপি মি. মাহির হারুন এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লেন’-এই বিস্ময় নিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল, ড. সাহাব নুরীর গাড়ি। গাড়িটি এসে দাঁড়িয়ে গেছে পেছনের সেই গাড়িটার কাছে।
গাড়ি থেকে নেমেছে ড. সাহাব নুরী ও ড. আজদা। যন্ত্রচালিতের মত তারা আসছে আহমদ মুসার দিকে। আনন্দ-বিস্ময় যেন ফেটে পড়ছে তাদের চোখ–মুখ দিয়ে।
ওরা এসে গেছে।
কোন কথা না বলে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ড. সাহাব নুরী।
আর পাশে দাঁড়ানো ড. আজদার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। আর ঠোঁটে ছিল হাসি।
আহমদ মুসা ড. সাহাব নুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘খুশির সময় এ কান্না কেন?
‘কান্না এটা নয়, অপার বিস্ময় ও সীমাহীন আনন্দের গলিত রূপ এটা।’ বলল ড. সাহাব নুরী।
‘আল্লাহর জন্যেই এ কৃতজ্ঞতার অশ্রু ভাইয়া। আপনি জীবিত আছেন, জীবন্ত আপনাকে দেখতে পাব, এটা ছিল সব হিসেব, সব কল্পনার অতীত।’ চোখ মুছে বলল ড. আজদা।
‘কিন্তু তোমরা গাড়ি নিয়ে ফিরে এলে কেন, কোন হিসেব থেকে? এমনটা তো হবার কথাই নয়?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
হাসল একটু ড. আজদা। বলল, ‘আমি উত্তর দিচ্ছি। আমার সাথে একটু আসুন ভাইয়া, প্লিজ!’
বলে পেছন ফিরে তাদের গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ড. আজদা।
ড. সাহাব নুরীর দিকে একবার তাকিয়ে ড. আজদার পেছনে হাঁটতে ‍শুরু করল আহমদ মুসা।
ড. সাহাব নুরীও হাঁটতে লাগল আহমদ মুসার পেছনে।
গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা ও ড. আজদা। তাদের পেছনে ড. সাহাব নুরী।
গাড়ির জানালা খোলা।
গাড়ির সীটে বসে দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে সাহিবা সাবিত। কান্নার বেগে কাঁপছে তার শরীর। নীরব কান্না।
আহমদ মুসা তাকাল ড. আজদার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে।
‘সাহিবাই আমাদের এখানে ফিরে আসতে বাধ্য করেছে ভাইয়া। গোলা-গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথে সে গাড়ি ঘুরিয়ে এখানে আসতে বলে। আপনার নির্দেশের কথা বলে মামা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সাহিবা বলে, গাড়ি যদি ফিরিয়ে না আনা হয়, তাহলে সে হেঁটে হলেও এখানে আসবে। এখানে এসে আমরা কি করব, এর ‍উত্তরে সে বলে, কিছু না পারলে আমরা তার সাথে মরতে তো পারব। আমিও তার কথায় একমত হই এবং আমরা ফিরে আসি। ফিরে আসার সময় সে শক্ত ছিল। কিন্তু এখানে এসে আপনাকে নিরাপদে দেখে সে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। এটা সুখের কান্না, স্বস্তির কান্না ভাইয়া।’ বলল ড. আজদা। তার মুখে হাসি।
কিন্তু আহমদ মুসার মুখে অস্বস্তির একটা ছায়া খেলে গেল। নিছক আনন্দের কান্না এত দীর্ঘ হয় না, এত গভীর হয় না। গোলা-গুলিতে সে নিশ্চয় আহমদ মুসাকে মৃত ভেবেছিল। তাই মরার জন্যেই সে এসেছিল এখানে। কিন্তু আহমদ মুসাকে নিরাপদ দেখে আকস্মিকভাবে কল্পনাতীত কোন প্রাপ্তি পাওয়ার আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ার নিয়ে হৃদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা তার বুক ধারণ করতে পারছে না। সে আনন্দময় এক বেদনা। সে বেদনারই কান্না এটা। মনে মনে উদ্বিগ্ন হলো আহমদ মুসা। এ কান্না শুধু সাহিবা সাবিতের নয়, এ কান্না নতুনভাবে প্রস্ফুটিত এক হৃদয়ের কান্না, যার পরিচয় সাহিবা নিজেও হয়তো জানে না। মনটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। ভাবল, বাঁচাতে হবে সাহিবা সাবিতকে।
ড. আজদার কথা শেষ হলে ড. আজদার হাসির সাথে আহমদ মুসাও হাসল। বলল একটু উচ্চকণ্ঠে, ‘ছোট বোনরা বড় ভাইয়াদের সব সময় একটু বেশি ভালোবাসে। সাহিবা সাবিত এটাই প্রমাণ করেছে ড. আজদা। আজ সকালেই আমি আমার স্ত্রীকে বলেছি, ড. আজদার পর আরও একটা মিষ্টি ছোট বোন পেয়েছি আমি।’
বলে আহমদ মুসা টান দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। বলল, ‘সাহিবা বোন, এস। বাইরে এস।’
ধীরে ধীরে মুখ তুলল সাহিবা সাবিত।
অশ্রু ধোয়া তার কোমল, সুন্দর মুখটি।
চোখ তুলে তাকিয়েছে সে আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু তার চোখে আহমদ মুসার সম্বোধনের প্রতি কোন সাড়া নেই। চোখ দু’টিতে তার তীরবিদ্ধ হরিণীর মত বিস্ময় ও বেদনার বিস্ফোরণ।
চোখ দু’টি তার কিছুক্ষণ পলকহীন স্থির থাকার পর আস্তে বুজে গেল। মুখ ঘুরে গেল। মাথাটি আবার ঝুলে গেল তার দু’হাঁটুর ওপর।
আবার তার সেই কান্না।
ফুলে ফুলে উঠছে তার দেহ কান্নার বেগে।
ওর কাঁদা উচিত, ভাবল আহমদ মুসা। কিন্তু বিব্রত হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা এখন কি বলবে সে এই ভেবে।
গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সেই সাথে পুলিশের গাড়ির সাইরেন।
একাধিক গাড়ির জমাট একটা শব্দ।
‘পুলিশ এসে গেছে ভাইয়া। কেমন করে খবর পেল ওরা?’ বলল ড. আজদা।
বিব্রতকর অবস্থা কেটে গেল আহমদ মুসার। ফিরে দাঁড়াল সে। বলল, ‘পুলিশের ডিজিপি মাহির হারুনকে আমি টেলিফোন করেছিলাম।’
‘চল দেখি কে আসলেন?’ বলে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
সবাই এগোলো তার সাথে।
পুলিশ বহরের সামনের জীপেই ছিল ডিজিপি মাহির হারুন।
পুলিশের গাড়ি থামতেই নেমে পড়েছে ডিজিপি মাহির হারুন। আহমদ মুসাকে ‍দেখতে পেয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে আহমদ মুসার দিকে।
‘স্যার, আসসালামু আলাইকুম। স্যার, টেলিফোনে সব কথা শুনে সংগে সংগেই রওয়ানা দিয়েছি। একটা বড় খবর আছে স্যার।’ উচ্চকণ্ঠে এই কথাগুলো বলে মুহূর্তের জন্যে থামল ডিজিপি মাহির হারুন।
মুহূর্ত পরেই আবার বলে উঠল, ‘আংকারা থেকে আমাদের হেডস্যার পুলিশ প্রধান আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। স্যার, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আপনার নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার জন্যে এবং আরও বলেছেন, আপনাকে সবরকম সহায়তা দেয়ার জন্যে।’
একনাগাড়ে তার কথা বলা শেষ হলে চোখ তুলে তাকিয়েছে সে আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা তার মুখোমুখি হয়ে সালাম নিয়ে হ্যান্ডশেইক করে বলল, ‘আপনাদের পুলিশ প্রধানকে ধন্যবাদ। কিন্তু প্লিজ অফিসার, এ কথাগুলো আপনি গোপন রাখুন। শত্রুপক্ষ এসব না জানলে আমাদের কাজের সুবিধা হবে।’
পুলিশ অফিসার ডিজিপি মাহির হারুনের উৎসাহের আগুনে পানি ছিটানোর মত ব্যাপার ঘটল। অনেকটাই চুপসে গেল ডিজিপি মাহির হারুন। বলল, ‘বুঝেছি স্যার! এখনও কাউকে এসব কথা আমি বলিনি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার। টেলিফোনে সব কথা সংক্ষেপে আপনাকে বলেছি। রেকর্ডের জন্যে লিখিত চাইলে, সেটাও আমি দেব। আপনি এদিকটা দেখুন। আমাকে ফিরতে হবে এখনি। এদের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই স্যার। আপনি ওদের নিয়ে যান। পুলিশের একটা গাড়ি আপনাদের সাথে পাঠাচ্ছি আপনার নিরাপত্তার জন্যে।’ ডিজিপি মাহির হারুন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ অফিসার। পুলিশ প্রটেকশন দরকার নেই। সাথে আমাদের আল্লাহর প্রটেকশন আছে। চলি।’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে ড. সাহাব নুরীদের বলল, ‘আসুন আমরা চলি।’
নতুন বিস্ময়ের ধাক্কা তখন ড. আজদা ও ড. সাহাব নুরীর চোখে। ডিজিপির কথা তারা শুনেছে। তুরস্কের পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের আবু আহমদ আব্দুল্লাহর নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে! আসলেই কে তাদের এই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ!
আহমদ মুসার আহ্বান পেয়ে আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে তারা।

Top