৪৯. বিপদে আনাতোলিয়া

চ্যাপ্টার

চাঁদ ডুবে গেল পশ্চিমে। সূর্যও উঠল পূবে। রাতটা বৃথাই গেল আহমদ মুসাদের।
‘মি. আবু আহমদ, নিশ্চয় ওরা কোনোভাবে টের পেয়ে গেছে যে আমরা ওদের প্ল্যান জেনে ফেলেছি।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘এটাও সম্ভব নয়। রাত ১২ টার আগ পর্যন্ত আপনার ও আমাদের লোকরা পাহাড়ের পথ থেকে বেশ দূরে দূরে এককভাবে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়েছে। তাদের দেখে বড় রকমে সন্দেহ করা অসম্ভব। অতএব সন্দেহ বশে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর রাত ১২ টার পর আমাদের লোকরা পাহাড়ে ওঠার কয়েকটি রাস্তার পাশে ক্লোজ হয়েছে, সেটাও দলবেঁধে নয়, এককভাবে অন্ধকারে ক্রলিং করে। এতে তাদের দেখতে পাওয়া এবং ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এককভবে কাউকে পেলে, সন্দেহ হলে তাকে পাকড়াও বা শেষ করার কথা। কিন্তু এমন ঘটনা একটিও ঘটেনি। অতএবত তারা ফিরে গেছে এ বিষয়টাকে আমরা হিসেবের বাইরে রাখতে পারি।’
‘তাহলে তারা না কেন?’ বলল ড. বারজেনজো।
এই ড. বারজেনজোরই বাগদত্তা ড. আজদা। ড. বারজেনজোকে তাদের পারিবারিক প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। কয়েকদিন হলো ফিরে এসেছে। আহমদ মুসা তাকে ডেকে নিয়েছে। আহমদ মুসা তার বাড়িতে গিয়েছিল। পরিচিত হয়ে এসেছে সবার সাথা।
ড. বারজেনজোর কথা শেষ হতেই সেখানে এলো অরিয়াস এলাকার ভারপাপ্ত পুলিশ অফিসার রশিদ দারাগ এবং আরারাত অঞ্চলের ডাইরেক্টর অব পুলিশ খাল্লিকান খাচিপ। খাল্লিকান খাচিপ বলল, ‘স্যার ঐ প্রশ্নটা আমারও, ওরা এল না কেন?’
‘এ প্রশ্ন আমারও। প্রশ্নটারই উত্তর সন্ধান করছি। মনে হয় উত্তরটা আমি পেয়েও গেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পেয়ে গেছেন? কী সেটা?’ উদগ্রীব কণ্ঠে বলল ড. বারজেনজো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মনে হয় শব্দের অর্থ গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের ভুল হয়েছে।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
তাকাল ডিপি, খাল্লিকান খাচিপের দিকে।
বলল, ‘ফুলমুন কী?’
‘কেন, ফুলমুন তো পূর্ণিমা।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘অমাবস্যা ফুলমুন নয় কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘অমাবস্যায় চাঁদ তো দেখা যায় না।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘দেখা যায় না, কিন্তু অমাবস্যায় মুন তো ফুলই হয়ে থকে। বলা যেতে পারে, এটা ডার্ক ফুলমুন, আর পূর্ণিমারটা লাইটেড ফুলমুন। অন্যভাবেও বলা যায়, একটা কৃষ্ঞপক্ষের ফুলমুন, আরেকটা শুক্লপক্ষের ফুলমুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চমৎকার! নতুন তত্ব। কিন্তু বাস্তবতা আমি মনে করি এটাই। নতুন তত্বটি আমরা মেনে নিলাম স্যার। কিন্তু স্যার, এই নতুন অর্থ গ্রহণ করে এর দ্বারা আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?’ বলল ড. বারজেনজো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘অপরাধীদের জন্যে শুক্লপক্ষ ভালো, না কৃষ্ঞপক্ষ ভালো?’
‘কৃষ্ঞপক্ষ।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘এ কারণেই কি তারা কৃষ্ঞপক্ষের ফুলমুনে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
কোন কথা এল না ডিপি খাল্লিকান খাচিপ, ইন্সপেক্টর রশিদ দারাগ এবং ড. বারজেনজোর দিক থেকে। নির্বাক তারা। বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে। ইন্সপেক্টর রশিদের মুখ তো বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে গেছে।
‘এই সহজ কথাটা আমাদের মাথায় আসেনি কেন? পূর্ণিমায় তো ওরা কিছুতেই আসতে পারে না। পূর্ণিমায় মাউন্ট আরারাতের বরফাবৃত অংশে তো আলোর মহামেলা বসে। বরফের উপর চাঁদের আলো পড়ে দিনের বেলার চেয়ে অনেক বেশি চোখ ধাঁধাঁনো উজ্জ্বল হাসি হাসে মাউন্ট আরারাত। এই আলোর মেলায় তো অন্ধকারের জীব অপরাথীরা অন্ধকারের কাজ নিয়ে আসতে পারে না। তাদের জন্যে কৃষ্ঞপক্ষের অমাবস্যা বা ডার্ক ফুলমুনই উপযুক্ত সময়। ধন্যবাদ মি. আবু আহমদ। অদ্ভুত আপনার বিশ্লেষণ। সত্যিই আপনি আল্লাহর সবিশেষ নেয়ামতে ধন্য।’ খল্লিকান খাচিপ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। এক বিরাট সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এখন তাহলে আমাদের কী করণীয়?’ বলল ড. বারজেনজো।
‘কিছু নয়, আসুন আমরা কৃষ্ঞপক্ষের ডার্ক ফুলমুনের অপেক্ষা করি।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, ‘আজকের মত কাজ আমাদের সাঙ্গ হলো। চলুন ফিরে যাই আমরা।’
কৃষ্ঞপক্ষের শেষ প্রান্ত। পূর্ণ অবয়ব নিয়ে চাঁদ বর্তমান। কিন্তু তা পৃথিবীর আড়ালে। এখন পৃথিবীও নিকশ অন্ধকারে ঢাকা, চাঁদও।
মাউন্ট আরারাতের সাড়ে ১৪ হাজার ফিট উপরে স্নো-লাইনের প্রায় প্রান্ত ঘেঁষে স্থাপিত ৫ম ট্যুরিস্ট বেজ ক্যাম্পের একটা তাঁবুতে বসা আহমদ মুসা তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ৯টা বাজে। তাঁবুতে আরও ৭ জন। সবাই ক্যাম্প-চেয়ারে বসে। সবারই পরনে ট্যুরিস্ট পোষাক।
আহমদ মুসারা ১ দিন আগে এই ৫ নং বেজ ক্যাম্পে এসেছে। তিন দিন আগে তারা যাত্রা করেছিল পর্বতের গোড়ায় স্থাপিত এক নম্বর বেজ ক্যাম্প থেকে।
ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা তাকাল মেন্দারিস মালিকের দিকে। বলল, ‘আপনি আর ড. বারজেনজো তাঁবুর বাইরেটা দেখে আসুন অবাঞ্ছিত কিছুর উপস্থিতি আছে কি না।’
মোবাইল বেজে চলেছে। বেজে থেমে গেল। ধরল না আহমদ মুসা। বাইরের রিপোর্ট পায়নি।
মিনিট দেড়েক পরে ড. বারজেনজো এসে বলল, ‘বাইরেটা ঠিক আছে।’
আহমদ মুসা মিসকলটায় কল করল।
ওপার থেকে কথা বলল ডাইরেক্টর অব পুলিশ খাল্লিকান খাচিপ। বলল, ‘স্যার, ওদিকের খবর কী?’
‘কোন খবর নেই মি. খাচিপ। কোন দিক থেকেই কোন নড়াচড়া নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওদের নড়া-চড়া আজকেও দেখা যাবে না বলেই মনে হচ্ছে। খবর পেলাম, সেনাদের একটা দল পাহাড়ের উপরে গেছে। ওরাও মনে হয় খবর পেয়েছে। এ জন্যেই তারা গেছে যাতে মাউন্ট আরারাতের কোন ক্ষতি না হয়, ক্রিমিনালরা যাতে উপরে গিয়ে কোন ঘটনা ঘটাতে না পারে। আমাদের বোধ হয় আজকেও খালি হাতে ফেরত যেতে হবে, স্যার।’
‘একটা বিষয়, মি. খাল্লিকান খাচিপ। মাউন্ট আরারাতে কোন অপরাধ ঘটতে যাচ্ছে বা অপরাধীরা এখানে একত্রিত হচ্ছে, এটা সেনাবাহিনী জানতে পারলে সে খবর পুলিশকে জানানোর কথা। তারা নিজেরাও যদি অভিযান পরিচালনা করতে চায়, তাহলেও পুলিশকে তারা জানাবে এবং পুলিশকেও তারা সাথে নেবে। তাই কি না, মি. খাল্লিকান খাচিপ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটই নিয়ম। কিন্তু ওরা তো কিছু জানায়নি। হতে পারে জানাবার সময় হয়নি। বিষয়টি ইমারজেন্সি বলেই তারা নিজেরাই এগিয়ে এসেছে।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘এটাও হতে পারে। কিন্তু অয়্যারলেস, মোবাইলের যুগে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ঠিক আছে। তবে ঐ সেনাদের আসা দেখে আমাদের পরিকল্পনার কোন হেরফের হবে না। প্লিজ, দেখবেন কোথাও যেন কোন শিথিলতা না আসে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটাই উচিত। ঠিক আছে স্যার। দায়িত্বের ক্ষেত্রে কোন অন্যথা হবে না।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘ধন্যবাদ। আস্-সালামু ‘আলাইকুম।’
কল ক্লোজ করে মোবাইল রেখে দিল আহমদ মুসা।
হন্ত-দন্ত হয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করল মেন্দারিস মালিক। বলল, ‘একদল সৈন্য এদিকে আসছে।’
তার কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে তাঁবুতে প্রবেশ করল একদল সৈন্য। তাঁবুতে প্রবেশ করেই একজন সৈন্য তার স্টেনগানের ব্যারেল সবার উপর দিয়ে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে বলল চিৎকার করবে না, তোমরা সকলে হাত তুলে দাঁড়াও। কেউ চালাকির চেষ্টা করলে তাকে কুকুরের মত গুলি করে মারবো।’ উপস্থিত সৈনিকদের দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা হাত তুলল।
সবাই আগেই হাত উপরে তুলেছিল।
আহমদ মুসা সৈনিকদের দেখছিল গভীরভাবে। সৈনিকদের পোষাকে কোন খুঁত নেই। পায়ের বুটও এই সৈনিকদের। সবার মাথার চুলই আর্মি কাট। মি. খাল্লিকান খাচিপ তাহলে এই সৈনিকদের কথাই বলেছিল। কিন্তু তারা এভাবে আমাদের উপর চড়াও হলো কেন!
এসব ভাবনা থেকে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনারা এভাবে আমাদের উপর চড়াও হয়েছেন কেন? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সৈনিকরা তখন তাঁবুর লোকজনদের বাঁধার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিছু সৈন্য তাদের স্টেনগান বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। অন্যরা বাঁধার কাজ করছিল।
আহমদ মুসার কথার উত্তরে একজন সেনা অফিসার বলল, ‘আমরা খবর পেয়ে ছি আজ মাউন্ট আরারাতে বড় একটি ক্রিমিনাল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ ঘটনা কারা ঘটাবে আমরা জানি না। সুতরাং ট্যুরিস্ট-ননট্যুরিস্ট যাদেরকেই আমরা মাউন্ট আরারাতে পাব, তাদেরকে এই রাতের জন্যে গ্রেফতার করে রাখব। সকালেই সকলে ছাড়া পেয়ে যাবেন।’ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ও কর্কশ কণ্ঠ সেনা অফিসারের।
কিছু বলার জন্যে হা করেছিল ড. বারজেনজো। আহমদ মুসা আশংকা করল সে আমাদের পরিচয় দিয়ে দিতে পারে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা ডাকল ড. বারজেনজোকে তার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্যে। বলল, ‘এঁরা ঠিকই বলেছেন। এঁদের আমাদের সহযোগিতা করা উচিত।’ বলে আহমদ মুসা তার তর্জনিটা ঠোঁটে ঠেকাল। বুঝতে পেরেছে সে। তার ঠোঁটে অস্ফুট একটু হাসি।
‘আমাদের সহযোগিতা করার কোন দরকার নেই। আমাদের কাজের জন্যে আমরাই যথেষ্ট। আমরা বেঁধে রেখে যাচ্ছি।’ আবার কর্কশ কণ্ঠ সেনা অফিসারের। সবার মত আহমদ মুসাকেও ওরা পিছমোড়া করে বাঁধল। অন্যদের মত পা’ও বাঁধা হলো তার।
তারপর সৈনিকরা সবাই বেরিয়ে গেল।
সৈনিকদের বেরিয়ে যাওয়ার ধরন দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মনে সন্দেহের যে ধোঁয়াটে অবয়ব ছিল তা যেন আলোর রূপ নিয়ে সামনে এল। ট্রেইন্ড সৈন্যদের পদক্ষেপ ও হাঁটা ওদের মত অমন হতেই পারে না। বিশেষ করে ডিউটিকালীন সময়ে।
সব সৈন্য বেরিয়ে গেলে সেনা অফিইসারটি ঘুরে দাঁড়াল। পকেট থেকে টেনিস বলের মত একটা গোলাকার বস্তু বের করল ছুঁড়ে মারার জন্যে।
আহমদ মুসা দেখেই বুঝল ওটা ক্লোরোফর্ম বোম।
অফিসার বস্তুট বের করেই ছুঁড়ে মারল তাঁবুর মাঝখানে।
পলকের মধ্যেই ঘটে গেল ঘটনা।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত, সবাই ঢলে পড়ল তাঁবুর মেঝেতে। আহমদ মুসাও।
পল পল করে সময় বয়ে গেল।
এক সময় আহমদ মুসা মাথা তুলে চারদিকটা দেখে উঠে দাঁড়াল। ছুটে এল তাঁবুর বাইরে। কাউকে দেখল না। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, দু’একটা শব্দ তার কানে এল। বোঝার চেষ্টা করল কোন দিক থেকে আসছে।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। যাকে দেখতে পেল সে হলো মেন্দারিস মালিক।
খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরল মেন্দারিস মালিককে আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ, আপনি ওদের ক্লোরোফর্ম বোমাকে ফাঁকি দিতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ, এই বিষয়কে আজ প্রথম প্রাকটিস করলাম।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আপনার কথার মধ্যে বড় একটা সত্য আছে। এ ধরণের ক্লোরোফর্ম বোমার কার্যকারিতা এক দেড় মিনিটের বেশি থাকে না। বিশেষ করে বিস্ফোরণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লোরোফর্ম গ্যাসের মাথার স্নায়ু অবশকারী অণুগুলো দ্রুত উপরে উঠে যায়। সুতরাং শুয়ে বা বসে থাকা কেউ মিনিট খানেক নিশ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারলে সে আর আক্রান্ত হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। এত বিস্তারিত আমি জানতাম না। ভবিষ্যতে কাজে দেবে।’
একটু থেমে বলল, ‘স্যার, সৈনিকরা আমাদেরকে এভাবে বাঁধল, সংজ্ঞাতীন পর্যন্ত করে দিল সবাইকে, এর অর্থ আমি বুঝতে পারছি না। আমাদের সন্দেহ করলে আমাদের ধরে নিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু তা না করে এক রাতের জন্যে সংজ্ঞাহীন করে গেল। ভোর হলেই সবাই ছাড়া পেয়ে যাবে! এতেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? রাত কি আর আসবে না? দুর্বোধ্য লাগছে তাদের আচরণ।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আর যদি ওরা সৈনিকই না হয়, তাহলে কি অর্থ পরিষ্কার হয় না?’
‘তার মানে, ওরা…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল মেন্দারিস মালিক। তার চোখে এক রাশ বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, ওরা সৈনিক নয়। ওরা সৈনিকের পোষাক পরে এসেছে। আমি মনে করি ওরাই তারা, যারা আজ রাতে মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার লুট করার জন্যে আসার কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ও গড! সৈনিকদের ইউনিফর্ম পুরানো মনে হয়েছে। ওদের কোড নাম্বার, বুকের নেমপ্লেট কোনটাই নতুন তৈরি বলে মনে হয় নি। অথচ ভূয়া সৈনিকদের পোষাক-পরিচ্ছদ সবই সাধারণত নতুন ভাবে তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আপনার পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ মেন্দারিস মালিক। এর একটাই জবাব, এই ইউনিফর্ম তারা সৈনিকদের কাছ থেকেই পেয়েছে। এর সুযোগ ওদের রয়েছে। সে আর এক কাহিনী।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন আমরা কী করব স্যার। আমার মনে হয় এদের বাঁধন খুলে দিয়ে ওদের জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করা দরকার।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
ওদের সবার বাঁধন কেটে দিয়ে আহমদ মুসা ও মেন্দারিস মালিক কয়েকটি স্টেনগান কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগল। আহমদ মুসার পিঠে একটা ব্যাগও ঝুলছে। পোষাকও তাদের পাল্টে গেছে। বরফের উপর দিয়ে চলার মত তাদের ক্লাইম্বারের পোষাক।
আহমদ মুসার চোখে নাইটভিশন গগলস্। সে আগে হাঁটছে তার পেছনে মেন্দারিস মালিক।
অন্ধকার হলেও এ পথ আহমদ মুসার চেনা।
এর আগে দু’বার এপথ দিয়ে ১৬ ফিট পর্য উপরে উঠেছে আহমদ মুসা। কিন্তু আজ কোন পর্যন্ত উঠতে হবে সে জানে না। প্রচারিত তথ্য অনুসারে সাড়ে ১৫,০০০ ফিট লেভেলের দুই শৃঙ্গের মাঝখানের এক উপত্যকায় প্লাবন শেষে নুহ আ.- এর নৌকা ল্যান্ড করেছিল। আজকের আরোহনের সীমা এই লেভেল পর্যন্ত হতে পারে।
বিশ মিনিট আরোহনের পর একটা চাপা কাশির অস্ফুট আওয়াজ কানে প্রবেশ করতেই আহমদ মুসা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। যে ঢাল দিয়ে তারা এগিয়ে এসেছে, তার গোটাটাই এখান থেকে দেখা যাচ্ছে নাইটভিশন গগলসের মধ্য দিয়ে। কিছুই চোখে পড়ল না। কিন্তু তার শোনাটা সত্য।
আহমদ মুসা আরও কিছুটা সময় দেখার সিদ্ধান্ত নিল। বলল মেন্দারিস মালিককে, ‘চলুন, এই গলিটা দিয়ে বরফের চাং-টার পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি।’
‘কোন বিশ্রাম নেবেন না, কিছু ঘটেছ?’ বলল মেন্দারিস মালিক। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘পেছন থেকে একটা শব্দ পেয়েছি। সেটার উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই পেছনটা একটু দেখা প্রয়োজন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই স্যার। চলুন।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
দু’জনে গিয়ে বরফের চাংটার পেছনে আশ্রয় নিল।
সময় বয়ে চলল পল পল করে। গত হলো মিনিট দু’য়েকের মত সময়।
বরফের একটা টিলার বাঁক ঘুরে বেরিয়ে এল একদল মানুষ। দশ বারোজনের মত হবে। হবে ওদের চেহারা স্পষ্ট নয়।
ঢালটার মাঝামাঝি আসতেই স্পষ্ট হয়ে গেল ওরা সশস্ত্র একদল মানুষ।
ওরা আরও কাছে এসে পড়ল। এখন তিন চার গজের মধ্যে ওরা। মুখ কারও দেখা যাচ্ছে না। পশমের টুপি ওদের কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে। জ্যাকেটের পশমের কলার নিচ থেকে পকেটের অর্ধেকেটা ঢেকে দিয়েছে।
ওদের গলায় দুলছিল লকেট।
ওরা বরফের চাংটার ওপাশ দিয়ে যাবার সময় লকেটের অবয়বটাও ভালোভাবে নজরে এল আহমদ মুসার। মাউন্ট আরারাতের খোদাই করা ছবির মাথায় ক্রস যেন পুঁতে দেয়া। ক্রস থেকে বিচ্ছুরিত তীক্ষ্ণ একটা আলোর প্লাবন সিক্ত করছে মাউন্ট আরারাতকে।
এরা কারা? উল্কিওয়ালাদেরই এটা দ্বিতীয় দল নিশ্চয়! ওদের গলায় লকেট নেই, এদের আছে। গায়ের উল্কি দেখা যায় না বলেই হয়তো প্রদর্শনীর এই বিকল্প ব্যবস্থা।
আহমদ মুসাদের সামনে দিয়ে চলে গেল ওরা সবাই।
ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল বরফের চাংটার আড়াল থেকে।
‘এরা ওদেরই লোক। ভাগ্য ভালো, আমরা ওদের চোখে পড়িনি।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘উল্কিওয়ারা গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতিকৃতিও কি ধারণ করে থাকে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এটা আমি জানি না স্যার। তবে উল্কিওয়ালা যাদের আমি দেখেছি, তাদের কারও গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতিকৃতি দেখিনি।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘কিন্তু এদের প্রত্যেকের গলায় যে ক্রসের সাথে মাউন্ট আরারাতের প্রতিকৃতিও দেখলাম!’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ রকম কখনও আমি দেখিনি। হতে পারে মাউন্ট আরারাতের অভিযানের সময় ওরা মাউন্ট আরারাতের বাড়তি প্রতিকৃতি পরেছে।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘হতে পারে, তবে সন্ত্রাসী বা গোপন দলগুলো প্রতীক বাছাই ও ব্যবহারের নীতির ক্ষেত্রে খুবই কনজারভেটিভ। এক্ষেত্রে তারা তাদের নীতির অন্যথা করে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তাই মনে করি স্যার। কিন্তু এক্ষেত্রে বাহুর উল্কি প্রতীকের রূপ একেবারে গলায় উঠে এল কেন, তার অর্থ বুঝতে পারছি না।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘থাক। এই বিষয়ে আর নয়। চলুন আমরা সামনে এগোই। এসব ভেবে লাভ নেই। চোর-বাপাড়েও মৈত্রী হয়। উল্কিওয়ালারা তো দুই দল এক সাথে কাজ করছে। আরও ভিন্ন কেউ তাদের সাথে যোগ দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন স্যার। চলুন।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
এগুতে লাগল তারা আবার। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে তারা পর্বতের প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ফিট লেভেলে পৌঁছে গেল। পর্বতের যে অংশটা তারা অতিক্রম করে এল, সেটা খুব দুর্গম নয়। সিঁড়ির মতই ঢালু অনেকটা। মাউন্ট আরারাতের দু’টি মূল শৃংগ বিস্তারিত এলাকা জুড়ে উঠে এসেছে উপরে। তবে পর্বতের অনেক এলাকা খুবই সুগম। চৌদ্দ হাজার ফুট থেকে সাড়ে পনের হাজের ফুটের মধ্যবর্তী এই রুট তেমনি একটা এলাকা।
সামানেই দু’টি ছোট বরফাচ্ছাদিত শৃংগের দেয়াল। দুই শৃংগের সংযোগকারী যে স্হান তাও বেশ উঁচু ও খাড়া। এর মধ্যে আবার এ পাশটা আরোহনের যোগ্য, কিন্তু ও পাশটা একেবারেই অগম্য। এ কারণেই এই শৃংগ ঘুরে ওপাশে পৌঁছাতে হয়।
আহমদ মুসা শৃংগের দেয়ালের গোড়ায় বসে পড়ল। বলল, ‘এ দেয়ালের ওপরেই সেই বহুল আলোকিত, বহুল কথিত স্থান, যেখানে হযরত নুহ আ.-এঁর কিস্তি প্লাবনের পানি সরে গেলে ল্যান্ড করেছিল। ওরা যে স্বর্ণভাণ্ডার খুঁজতে এসেছে তা ওপাশের উপত্যকার কোন একটা পাহাড়ের গুহায় রয়েছে। সুতরাং ওদের গন্তব্য এবং কর্মস্হল এই উপত্যকা। উপত্যকার সামনের ছোট দুই শৃংগের ওপাশে হলেও অনেক ঘুরে যেতে হয় ঐ উপত্যকার সামনের ছোট দুই শৃংগের ওপাশে হলেও অনেক ঘুরে যেতে হয় ঐ উপত্যকায়। একনিতে দশ মিনিটের পথ নয়। কিন্তু এই দুই শৃংগের পাদদেশটাই ঘুরে ওপাশের উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ঘন্টা খানেকের মত। এসময় খরচ করে ঐ উপত্যকায় গিয়ে এই মুহুর্তে তাদের কোন কাজ নেই। তার চেয়ে দুই শৃংগের মাঝখানে দেয়ালের মত জায়গায় গিয়ে উপত্যকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করাই এই মুহুর্তে তাদের বড় কাজ। উপত্যকায় তাদের কর্মস্থল থেকে কিঞ্চিৎ ব্যবধানে এই আড়ালে থাকবে আমাদের এই এখনকার সদর দফতর।’
‘কিন্তু এ সদর দফতর থেকে আমরা আর কী করব?’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘দুই শৃংগের মাঝখানের দেয়ালটার আড়ালে আমরা গিয়ে বসব। সেখান থেকে ওপাশের উপত্যকায় চোখ রাখব। দেয়ালের ওপাশটা খাড়া বলে গোটা উপত্যকাটাই আমাদের চোখের নিচে থাকবে এবং আমাদের আওতার মধ্যেও থাকবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের লক্ষ্য কী? কী কেতে চাচ্ছি আমরা?’ জিজ্ঞাসা মেন্দারিস মালিকের।
‘আমরা ওদের গোটা গ্যাংকে ধরতে চাই। এর মাধ্যমে আমরা ওদের সামনের পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমরা তো মাত্র দু’জন!’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আমাদের আর লোকরা তো সংজ্ঞা হারি য়ে পড়ে থাকল। আমাদের পরিকল্পনা মার খেয়েছে এর ফলে। ভালো কথা মনে করেছেন, এই বিষয়টা নিয়ে ডিপি খাল্লিকান খাচিপের সাথে আলোচনা করা দরকার। আগে কথা ছিল ওর বাহিনী বেজ ক্যাম্প ওয়ানেই থাকবে। কিন্তু এখন ওদের সাহয্য দরকার আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
বলেই আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। কল করল আরিয়াস-আরারাত অঞ্চলের পুলিশের ডাইরেক্টর খাল্লিকান খাচিপকে।
ওপারে খাল্লিকান খাচিপের কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, ‘মি. খাল্লিকান খাচিপ, আপনার বাহিনী কোথায়?’
‘আছে এই এলাকাতেই। তবে আমি মনে করছি স্যার, এ সবের আর প্রয়োজন নেই। মাউন্ট আরারাত তো আইনিভাবে সেনা-ব্যবস্থাপনার অধীন। ওরাই তো দেখছি মাউন্ট আরারাতের এই পর্যটন রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন তেমন একটা আছে বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘ওরাই এই পর্যটন ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে’- এ কথাটার অর্থ বুঝলাম না মি. খাল্লিকান খাচিপ?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার। তার কপাল কুঞ্চিত।
‘হ্যাঁ স্যার, আগে একটা সেনাদল গেছে এখন আর একটা সেনাদল উপরে উঠে গেল। এই কিছুক্ষণ আগে। ওদের অফিসারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওরা গোটা এই পর্যটন রুটে সারারাত ধরে টহল দেবে। তারা নাকি জানতে পেরেছে পর্বতের এই ঢালে কোথাও নাকি কিছু ঘটতে চলেছে। আর তারা আমাকে বলেছে, আপাতত আপনাদের কোন কাজ নেই। মাউন্ট আরারাত পুলিশ অফিসে আপনারা ফিরে যান। প্রয়োজন হলে আমরা ডাকবো।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
আহমদ মুসার কপালের কুঞ্চন আরও বেড়ে গেছে। তার মনে চিন্তার ঝড়। এই সেনাদল আবার কারা? এবার কি সত্যিই সেনাদল পাঠানো হয়েছে? না এরাও নকল। মাউন্ট আরারাত সেনা-ব্যবস্থাপনার অধীনে রয়েছে। সেনাবাহিনী পর্বত অঞ্চলের পর্যটন এলাকাসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্যে মাউন্ট আরারাতে সেনাবাহিনীর একটা ঘাঁটি রয়েছে। সেখান থেকে পর্বতের বিভিন্ন অংশে সনাটহল পাঠানো তাদের রুটিন কাজ। মি. খাল্লিকান কথিত সেনাদল সেই রুটিন কাজের অংশও হতে পারে। আবার তা নাও হতে পারে। কিন্তু এসব যাচাইয়ের সুযোগ এই মুহূর্তে নেই।
এসব চিন্তা করে আহমদ মুসা বলল, করে আহমদ মুসা বলল, ‘মি. খাল্লিকান খাচিপ, আপনারা বেজ ক্যাম্প থেকে নড়বেন না। আর দশ পনের জনের একটা পুলিশের দল আপনি উপরে পাঠিয়ে দিন।’
‘কিন্তু ওরা তো বলেছে আমাদের চলে যেতে।’ খাল্লিকান খাচিপ বলল।
‘বলুক। ওটা কোন অফিসিয়াল অর্ডার নয়। বাইদি বাই বলেছে। যাদের উপরে পাঠাবেন তাদের বলে দেবেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে তারা যেন বলে, ‘৫ম বেজ ক্যাম্পে চৌদ্দ-পনেরজন ট্যুরিস্ট হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে। তাই উপরের নির্দেশে ওদের রেসক্যু করার জন্যে আমরা যাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সংজ্ঞা হারানোর ঘটনা সম্পর্কে যদি তারা কিছু না দেখে?’ জিজ্ঞাসা খাল্লিকান খাচিপের।
‘ঘটনা সত্য। এখানে একটা ঘটনা ঘটেছে। শয়তানরা আমাদের চৌদ্দ জন লোককে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মারাত্মক ঘটনা। হ্যাঁ, এটা একটা বিষয়, পুলিশ সেখানে যেতে পারে।’ বলল খাল্লিকান খাচিপ।
‘হ্যাঁ, মারাত্মক ঘটনাই। কিন্তু ওটা নিয়ে এখন পুলিশের করণীয় কিছু নেই। সকালে এমনিতেই ওরা সংজ্ঞা ফিরে পাবে। আপনার লোকরা যেন ওখানে না দাঁড়ায়, সোজা যেন চলে আসে সাড়ে পনের হাজার ফিট উপরের লেভেলে। আর যাদের পাঠাচ্ছেন, তাদের দায়িত্বে যে পুলিশ অফিসার থাকবেন তার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে জানিয়ে দেবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা সালাম দিয়ে কল অফ করে দিল।
‘চলুন, ঐ দুই শৃংগের সংযোগকারী দেয়ালে আমরা উঠি। ওখান থেকে আমরা ঐতিহাসিক উপত্যকায় ওরা কী করছে, তা দেখতে পাব এবং আমাদের কিভাবে এগোতে হবে তাও ঠিক করতে পারবো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চলুন। কিন্তু ডিপি মি. খাল্লিকান খাচিপ কী বললেন? মনে হলো ডিপি লোক পাঠাচ্ছেন। কান্তু এত দেরিতে কেন?’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘আরো একটা সেনাদল উপরে উঠেছে এবং তারাই এই রুটের দেখভাল করার কথা বলেছে। তারা পুলিশকে চলে যেতেও বলেছে। তাই ডিপি মি. খাল্লিকান খাচিপ চলে যাবার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। এখন উনি একদল পুলিশ পাঠাচ্ছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ সেনাদল আবার কারা? পুলিশকে তারা ডিউটি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। লক্ষণটা ভালো মনে হচ্ছে না স্যার।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘আমিও সেটাই ভাবছি মি. মেন্দারিস মালিক। তবে না দেখে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ মাউন্ট আরারাত তো সেনা নিয়ন্ত্রণে। এখানে ওদের স্থায়ী ঘাঁটিও রয়েছে। এটা একটা দিক। অন্য দিকটা হলো, ঘাঁটির সেনাদলের একটা অংশ ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পারে। এর নিশ্চিত সম্ভাবনাও আছে, একথা আমি আগেই বলেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুই সম্ভাবনাই যদি থাকে, তাহলে খারাপ সম্ভাবনাকেই আমাদের সামনে রাখতে হবে স্যার।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘ঠিক বলেছেন মি. মেন্দারিস মালিক।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বলার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ও মেন্দারিস মালিক উঠছিল সেই পাহাড়ের দেয়ালে।
পাহাড়ে আরোহনটা এখানে বেশ মজার। পাহাড়ের দেয়ালটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে উপরে উঠেছে।
ওঠার গোটা পথটাই ছোট ছোট খুঁটির মত ডজন-ডজন টিলায় ভরা। যেন কোন ধ্বংসাবশেষ ছাড়া।
উঠে গেছে তারা দেয়ালের মাথা অনেকটা চিরুনীর মত অনেক টিলার সমষ্টি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। তাদের নিরাপদ আড়াল নেয়ার একটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আল্লাহ্ যেন করে রেখেছেন।
পাশাপাশি দুই টিলার আড়ালে গিয়ে বসল তারা। ওপাশের উপত্যকাটাই হলো ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকা। তাকাল তারা উপত্যকার দিকে। গোটা উপত্যকা তাদের নজরের আওতায়।
উপত্যকার দিকে চোখ ফেলতেই নজরে পড়ল, তারা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে নিচে বিশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে পাহাড়ের গায়ে ঠিক ‘ওয়েল ড্রিলিং’- এর মত আট ইঞ্চি ব্যাসের মেগা সাইজের পাইপ বসানো হয়েছে বরফের বুক চিরে। একটা বড় ইঞ্জিন এই পাইপ বসাতে সাহায্য করছে। ইঞ্জিনটা তখনও চলছে। শব্দ খুবই অস্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে সাইলেন্সার লাগানো হয়েছে ইঞ্জিনে।
কয়েকটা লম্বা স্ট্যান্ডের সাথে সেট করা টপসাইড ঢাকা কয়েকটা উজ্জল বাল্ব আলোকিত করে রেখেছে উপত্যকার সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে। চারদিকের অমাবস্যার গভীর অন্ধকারের মধ্যে জায়গাটিকে মনে হচ্ছে আলোর দ্বীপ।
দেখা গেল পাইপের মুখে একটা জটিল মেশিন ফিট করা হয়েছে। সেই মেশিন থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকটা নল স্ট্যান্ডের উপর রাখা একটা স্ক্রিনের পেছনে সংযুক্ত হয়েছে। কয়েকজন স্ক্রিনটার উপর ঝুঁকে পড়েছে। আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে স্ক্রিনটাকে।
ওদিক থেকে চোখ না ঘুরিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. মেন্দারিস মালিক, তেল কোম্পানি ড্রিল করে মেশিন দিয়ে তেল টেনে নেয়, এরা মনে হয় ড্রিল করে স্বর্ণভান্ডার থেকে স্বর্ণ টেনে নিতে চাইছে।’
‘কিন্তু স্যার, স্ক্রিনের দিকে ওরা হা করে চেয়ে বসে আছে কেন?’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘ওরা ড্রিল করে যে পাইপ বসাচ্ছে, তার মাথায় নিশ্চয় একটা সুসংরক্ষিত ক্যামেরা সেট করে রাখা হয়েছে। সেই ক্যামেরা যা কিছু দেখছে তার ছবি পাঠাচ্ছে স্ক্রিনে। ওরা সম্ভবত কথিত স্বর্ণভাণ্ডার যে গুহায় আছে, সে গুহাতেই ড্রিল করার পাইপ বসিয়েছে। এখন তারা কখন স্বর্ণভাণ্ডার দেখতে পাবে, তার অপেক্ষা করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রায় দু’শ থেকে তিনশ ফুট গভীর বরফের স্তর এখানে।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘দৃশ্যত এটা অসম্ভব। কিন্তু ওদের কাছে কয়েক শতাব্দী আগের একটা ম্যাপ আছে। সে মানচিত্রে হযরত নুহ আ. – এর নৌকার ল্যান্ডিং উপত্যকা এবং তার চারপাশের গুহাগুলো সুস্পষ্টভাবে চিহ্নত আছে। যা দেখে হিসেব-নিকেশ করে বলা যায় কোথায় কোন গুহার অবস্থান। ২শ থেকে তিনশ ফিট নিচে হাজার হাজার বছর থেকে জমে থাকা বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা সে গুহার অবস্থান তারা নিশ্চয় বের করেছে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন স্যার। পড়েছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মত দেশের কাছে এমন ক্যামেরা আছে যা দিয়ে আকাশ থেকেও তারা ভূ-গর্ভের কোথায় কী আছে, তার ছবি তুলতে পারে।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, হঠাৎ উপত্যকার ওপাশে স্ক্রিনে নজর রাখা লোকজনদের মধ্যে হাসি-আনন্দের একটা হুল্লোড় পড়ে গেল।
‘মি. মেন্দারিস মালিক, ওরা সত্যিই স্বর্ণের দেখা পেয়ে গেছে মনে হয়। এছাড়া তাদের আনন্দের আর কোন কারণ নেই বলে মনে করি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক স্যার। ঐ দেখুন, সবাই ছুটে আসছে স্ক্রিনের দিকে। সবার দৃষ্টি স্ক্রিনে নিবদ্ধ।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘হ্যাঁ, মি. মেন্দারিস মালিক, স্বর্ণই তারা দেখছে। দেখা যাক এখন তারা কী করে? মি. খাল্লিকান খাচিপের পাঠানো পুলিশ দল না আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দেখল, ওপাশের উপত্যকায় লোকজনদের মধ্যে আনন্দের পাশাপাশি ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। পাইপের কাছে স্ক্রিনটির পাশে আর একটা মেশিন তারা টেনে নিয়ে এল। পাইপটাকে তারা সেট করল পাম্প মেশিনের মত মেশিনটার সাথে। একজন বোতাম টিপে মেশিনটাকে স্টার্ট দিল।
বড় মেশিনটার স্টার্ট নেয়ার গর্জন আহমদ মুসাদেরও কানে এল। তবে সাইলেন্সার লাগানো না থাকলে শব্দটা নিশ্চয় আরও বিকট হতো।
পাম্প মেশিনটার নিচের দিকে একটা রিলেজিং পাইপ রয়েছে। সে পাইপটাকে সেট করা হলো একটা প্লাস্টিক ধরনের বক্সের সাথে। বক্সের টপে পানির ট্যাংকর মত গোল সাইড ওয়ালা একটা হোল রয়েছে। তার সাথেই সেট করা হয়েছে পাইপটাকে।
পাম্প মেশিনটাতে একটা স্ক্রিন রয়েছে। মেশিনটা চালু হবার পর সবার দৃষ্টি আগের স্ক্রিনটার মত এ স্ক্রিনটার উপরও নিবদ্ধ।
পল পল করে গত হলো আরও কিছুটা সময়।
হঠাৎ দ্বিতীয় স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে মহানন্দে ভীষণ নাচানাচি শুরু করে দিল সবাই। যেন আনন্দে তারা পাগল হয়ে গেছে।
‘মি. মেন্দারিস মালিক, স্বর্ণভাণ্ডারে স্বর্ণ দেখার পর এবার তারা স্বর্ণ হাতে পেয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাদের নাচানাচি দেখে তাই মনে হচ্ছে। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই তাদের দশা। কিন্তু স্বর্ণ তারা হাতে পেয়েছে কী করে বুঝা গেল?’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘পাইপটার সাথে নতুন যে মেশিন সেট করেছে দেখছেন, সেটা ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিন। এই পাওয়ার মেশিন যে কোন ধাতব বস্তুকে টেনে তার মধ্যে নিয়ে এসে অন্য একটি রিলিজিং পাইপ দিয়ে বের করে দিতে পারে। কোন ধাতব বস্তু যদি কোথাও লাগানো থাকে কিংবা ধাতব, চামড়া বা কাপড় ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক কোন প্যাকেটে ধাতব কোন বস্তু রাখা থাকে, তাহলে সেগুলোকেও টেনে নিয়ে আসতে পারে। আর এই ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিনে যে আরেকটা স্ক্রিন দেখছেন, সেটা দিয়ে দেখা যায় মেশিনটি কিভাবে পুল করে নিয়ে আসছে। আমার যেটা মনে হচ্ছে সেটা হলো, পাইপটিকে যে গুহা-মুখে সেট করা হয়েছে, সে পাইপের মাধ্যমেই গুহার স্বর্ণভাণ্ডার থেকে ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিনটি স্বর্ণ টেনে নিয়ে আসছে। আর সেই মেশিনের মাধ্যমে এসে প্লাস্টিকের বক্সটায় জমা হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে নুহ আ. – এর স্বর্ণভাণ্ডারের কথা সত্য হল? সত্য হলো হাজার হাজার বছরের লোককথা।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘ভুল বলছেন। এই স্বর্ণভাণ্ডার নুহ আ.-এর নৌকায় তোলা এবং নামানো যদি সত্য হয়েও থাকে, তাহলেও এই স্বর্ণভাণ্ডার হযরত নুহ আ.-এর নয়। তিনি এই স্বর্ণভাণ্ডার নৌকায় তুলেছিলেন এবং নামিয়েও ছিলেন তিনিই। যেহেতু প্রার্থনাগৃহটি প্লাবনে ধ্বংস হয়েছিল তাই সেই স্বর্ণের সাথে হযরত নুহ আ.-এর সম্পর্ক ছিল এ কথা কোথাও বলা হয়নি।’ নৌকায় কোন অজৈব সম্পদ নুহ আ. তোলেননি। আল্লাহ্’র নির্দেশক্রমে তিনি নৌকায় তুলেছিলেন প্রত্যেক জীব-প্রজাতির এক একটি জোড়া। এরাই দুনিয়ার সম্পদ। কারণ দুনিয়াকে আবাদ করে এরাই। আর তখন এদেরই সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। দুনিয়ার মেটালিক বা অন্য কোন সম্পদের সংরক্ষণের প্রয়োজন তখন ছিল না। তাই সে ধরনের কিছু নৌকায় তোলার প্রশ্নই ওঠেনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু তাঁর পক্ষ থেকে নৌকায় অন্য কেউ মেটালিক সম্পদ তুলে থাকতে পারেন। ঐ স্বর্ণভাণ্ডার হয়তো ঐ ধরনের একটা সম্পদ।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘বলা হয়, কিন্তু এর সত্যতার কোন প্রমাণ নেই। সত্য না হওয়াটাই যৌক্তিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আমরা দেখছি ঐ তো স্বর্ণ গুহা থেকে বের হচ্ছে। এটা তো চাক্ষুস সত্য।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘এই চাক্ষুস সত্য কিন্তু প্রমাণ করে না যে, এই স্বর্ণভাণ্ডার হযরত নুহ আ. এর নৌকায় উঠেছিল এবং তা থেকে নামিয়ে এই গুহায় রাখা হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্বর্ণভাণ্ডার তাহলে কোত্থেকে এল তার তো একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দরকার।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘সেকালে লুণ্ঠিত সম্পদ এভাবে নিরাপদ গুহায় লুকিয়ে রাখা হতো। আবার নানা কারণে উপাসনা গৃহের সম্পদও পাহাড়ের কোন নিরাপদ গুহায় গচ্ছিত রাখতো উপাসনাগৃহের প্রধানরা। মাউন্ট আরারাতের দুর্গম গুহাগুলো উপাসনা গৃহের পবিত্র সম্পদ গচ্ছিত রাখার উপযুক্ত জায়গা ছিল। এ গুহার স্বর্ণভাণ্ডারের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কিছু ঘটে থাকতে পারে। আমার মনে হয়, এ স্বর্ণভাণ্ডারকে হযরত নুহ আ.-এর সাথে এবং তাঁর নৌকার সাথে যুক্ত করেছিল এই কারণে যে, লোকেরা যাতে এই সম্পদকে পবিত্র মনে করে, ভয় ও শ্রদ্ধা করে এবং এই সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে সাহস না পায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার এই ব্যাখ্যাই ঠিক স্যার। এমন চিন্তা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। এ ধরনের সম্পদে হাত দেয়াকে মানুল অপরাধ জ্ঞন করে।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
আহমদ মুসাদের এই আলাপ আর এগোল না।
পেছনে অনেকগুলো পায়ের শব্দে দু’জনেই চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল। না, পায়ের শব্দ ঠিক পেছনে নয়, যে পর্যটন রুট থেকে তারা এখানে উঠে এসেছে, সেই রুট থেকেই শব্দগুলো ভেসে আসছে। নিঃশব্দ পরিবেশ হওয়ার কারণেই শব্দগুলো দূরে হলেও কানে এসে বাজছে।
‘আবার এক সেনাদল মি. মেন্দারিস মালিক। সংখ্যা আগের চেয়েও মনে হয় বেশি হবে।’ লোকদের দেখে বলল আহমদ মুসা।
‘এরা কি সেই সেনাদল যাদের কথা ডিপি মি. খাল্লিকান খাচিপ বলেছিলেন?’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘তাই হবে। তবে এরা সেনাবাহিনীর লোক নয়। এ ধরনের যৌথ অভিযানে এবং পার্বত্য পথে সেনাদলরা যেভাবে পথ চলে, এদের হাঁটার ধরন তার ধারে কাছেও নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে এরা প্রথমে যাওয়া সেনাদলেরই অংশ। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনটি গ্রুপ। দু’টি ভূয়া সেনা গ্রুপ। আর একটি গ্রুপ ক্রসের সাথে গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতীক পরা। একটা গ্রুপ সেনাবাহিনীর পোষাক ছাড়া হলো কেন? সেনা পোষাক পরে ক্যামোফ্লোজ করা ওদের যে কৌশল, তার সাথে এই গ্রুপের অবস্থান তো মিলে না।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘ঠিকই মেন্দারিস মালিক, হিসাব মিলে না। হতে পারে ওদেরকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পরিকল্পনা ছাড়াই আনা হয়েছে। তাই ওদের বোধ হয় সামরিক পোষাক পরানো যায়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা তো সবাই এসে গেল। আমাদের পুলিশরা কখন আসবে?’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘জানি না কোন বেজ ক্যাম্প থেকে ওরা আসছে! কী করা যাবে, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
সেনা দলটি ডান পাশের শৃংগের পাদদেশ ধরে বাঁকের দিকে চলে গেছে অনেকক্ষণ।
আহমদ মুসারা ঘুরল উপত্যকার দিকে আবার। উপত্যকায় তখন সে একই দৃশ্য। ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিন চলছি।
প্লাস্টিকের বড় বাক্সটি ভরছে গুহার স্বর্ণভাণ্ডার থেকে উঠে আসা স্বর্ণে।
সবার চোখ ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিনের স্ক্রিনের দিকে। স্বর্ণভণ্ডার থেকে কি সব বিচিত্র রূপের স্বর্ণ উঠে আসছে তাই দেখছে সবাই।
হঠাৎ ব্রাশফায়ারের শব্দে চারদিকের জমাট নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ল।
অনেকগুলো স্টেনগানের সম্মিলিত ব্রাশ ফায়ারের জমাট শব্দ।
কিছুই বুঝতে পারল না আহমদ মুসা। শুধু বিস্ময়ের সাথে দেখল আলোচিত স্থানটুকুতে যেখানে স্বর্ণ উত্তলন চলছে, এবং যারা কাজ করছিল তারা সবাই একে একে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছে। ওরা সবাই রিল্যাক্স মুডে ছিল। কারও হাতেই ছিল না অস্ত্র। আকস্মিক আক্রমণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে ওরা। আক্রমণ এতটাই আকস্মিক ও ব্যাপক ছিল যে গুলিবৃষ্টি এড়িয়ে শেল্টার নেবারও সুযোগ কেউ পায়নি।
মেশিন তখন চলছে। স্বর্ণ ভাণ্ডার থেকে স্বর্ণ তাখনও উঠে আসছে।
কারা ওদের আক্রমণ করল? এটা কি ওদের নিজেদের মধ্যে স্বর্ণভাণ্ডার দখলের লড়াই? গুলিবৃষ্টি তখনও চলছে।
গুলি করতে করতেই একদল লোক অন্ধকার থেকে আলোতে গিয়ে প্রবেশ করল।
দেখেই আহমদ মুসারা বুঝল এরাই গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতীক পরা সেই লোকগুলো। আহমদ মুসা ভাবল, সেনা-পোষাক পরা লোকদের থেকে কি এরা তাহলে আলাদা?
ঐ উপত্যকায় যা ঘটতে লাগল তা দেখে আহমদ মুসাকে তার চিন্তা আর এগিয়ে নিতে হলো না।
গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতীকধারী লোকরা আলোকিত এলাকায় প্রবেশ করে কেউ বেঁচে নেই দেখার পর গুলি করা বন্ধ করে দিল। তারপর তারা ভাঙতে শুরু করল মেশিনপত্রসহ সবকিছু। তারা প্রথমে ভাঙল জেনারেটর। ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিনটি স্বর্ণ উত্তোলনকারী পাইপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলল ড্রিলিং মেশিনও। স্বর্ণ জমা হওয়া প্লাস্টিক কনটেইনার থেকে ম্যাগনেটিক পুলিং মেশিনের পাইপ খুলে ফেলেছিল। এবার কয়েকজনে মিলে প্লাস্টিক বক্স ধরে যে পাইপ দিয়ে স্বর্ণ ঢালা হয়ে গেলে তারা প্লাস্টিক কনটেইনারটিকেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল। সবশেষে তারা পাইপের মধ্যে টাইম ডিনামাইট ঢুকিয়ে তাতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিল এবং উলট-পালট করে দিল ভেতরের গঠনকেও। এই সব কাজ শেষ করতে পঁচিশ-তিরিশ মিনিটের বেশি সময় লাগল না।
সব শেষ করে তারা সবাই হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনায় বসল। দু’হাত তুলে তারা প্রার্থনা করতে লাগল। আহমদ মুসাদের মনে এবার বিস্ময়ের পালা।
আবার শুরু হলো ব্রাশ ফায়ার। অনেক স্টেনগানের সম্মিলিত ব্রাশফায়ার ছুটে এল অন্ধকারের বুক চিরে। প্রার্থনারত সবাইকে এক সাথে পেয়ে গেল গুলির ঝাঁক।
গুলি খেয়ে সবাই উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। ওদের সবারই কাঁধে ঝুলানো ছিল স্টেনগান। প্রার্থনার আগে স্টেনগান কাঁধে রেখেই তারা সবকিছু ভাঙচুর করেছে। প্রার্থনার সময়ও স্টনগান ছিল তাদের কাঁধে। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে তারা সবাই নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিল।
আক্রমণকারীদের গুলি চলছিল তখনও। কিন্তু গুলিগুলো ছিল বৃথাই।
মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকদের উপর তা কোনই ক্রিয়া করছিল না। কেউ বেঁচে নেই নিশ্চিত হয়ে আক্রমণকারীরা অন্ধকার থেকে আলোতে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা দেখল ওদের পরনে সেনা পোষাক। বুঝল আহমদ মুসারা, এ সেনাদলই তাদের সামনে দিয়ে সবশেষে উপত্যকায় প্রবেশ করেছে।
সেনা-পোষাকের লোকরা প্রথমেই এগোচ্ছিল গুলি খেয়ে শেষ হয়ে যাওয়া লোকদের দিকে। তাদের লক্ষ্য সম্ভবতঃ ছিল এটা দেখা যে, ওরা কারা এবং কারা এই সর্বনাশ করল।
আক্রমণকারীরা লোকদের কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথেই মৃতদের মধ্যে থেকে কয়েকজন তড়াক করে পাশ ফিরে শুয়ে থেকেই গুলি করতে লাগল আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে। তাদের গুলি অবিরাম চলল।
দাঁড়িয়ে অগ্রসরমান আক্রমণকারীরা তাদের স্টেনগান তোলা কিংবা শুয়ে পড়া কিংবা কোন কিছুর আড়াল নেবারও সুযোগ পেল না। পয়েন্ট ব্লাংক গুলিবৃষ্টির মুখে পড়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই মুহূর্তের মধ্যে তাদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
গোড়া কাটা গাছের মত ওরা পড়ে গেল মাটিতে।
যারা এদের গুলি করেছিল, সেই চারজন উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু দাঁড়িয়েই আবার পড়ে গেল। সবই দেখছিল আহমদ মুসারা।
‘স্যার, এমন জীবন্ত ফিল্ম দেখতে পারব কোনদিন ভাবিনি। অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। কে কার শত্রু, কেন শত্রু কিছুই বুঝলাম না স্যার।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘ঠিক বলেছেন মেন্দারিস। একটা বিস্ময়কর দৃশ্য দেখলাম আমরা আজ। সেনা পোষাকধারীরা এক পক্ষ, এটা এখন পরিষ্কার। কিন্তু গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতীক ধারণকারীরা কারা? সোনা ভাগাভাগি, কিংবা সোনা কুক্ষিগত করার ঝগড়া এটা নয়। দেখাই তো গেল, স্বর্ণের প্রতি কোন লোভ তাদের নেই। যে পরিমাণ স্বর্ণ তোলা হয়েছিল, সেগুলো তারা আবার ফেরত পাঠিয়েছে পাইপ দিয়ে নিচে। তারপর তারা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুধু দিয়েছে, যাতে ঐ পথে পাইপ বসানো আর সম্ভব না হয়। কে এরা। কেন এমনটা করল সেটাই সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে না।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন, ছুটতে হবে এবার উপত্যকায়। আহত তিনজনকে বাঁচাতে হবে। আমাদের পুলিশ দলের জন্যে অপেক্ষা করার আর প্রয়োজন নেই।’
উঠে দাঁড়াল মেন্দারিস মালিকও। বলল, ‘হ্যাঁ, ঐ তিনজন বোধ হয় সিরিয়াসলি আহত। প্রতিপক্ষদের হত্যা করে এরা প্রতিশোধ নিতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তারা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারেনি।’
‘আল্লাহ ওদের বাঁচিয়ে রাখুন। বাঁচা ওদের দরকার। ওরা সেনা পোষাক পরে আসা দলটির বিরোধী পক্ষের, মানে ওরা মিহরান মুসেগ মাসিসদের ‘সোহা’ গ্রুপ ও ভারদান বুরাগদের ‘হোলি আর্ক’ গ্রুপের বিরোধী। এদের কাছ থেকে সন্ত্রাসী ঐ সংগঠন দু’টোর ষড়যন্ত্রের কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
চলতে শুরু করেছে আহমদ মুসা। মেন্দারিস মালিকও আহমদ মুসার পেছনে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘স্যার, আমার মনে হচ্ছে এরা খ্রীস্টানদের
কোন আলট্রা ধর্মীয় গ্রুপ। এরা দারুণ সংরক্ষণবাদী। কোন ধর্মীয় প্রতীক, ধর্মীয় স্থান ইত্যাদির সামান্য নড়চড়েরও এরা পক্ষপাতি নয়। আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয় ও তুরস্কে এদের সংখ্যা কম নয়।’
‘হ্যাঁ, এরকম গ্রুপ আছে। বিপজ্জনক হয়ে থাকে এরা। সন্ত্রাসীরা স্বার্থের জন্যে সন্ত্রাস করে। কিন্তু এরা এদের অন্ধ, মনগড়া ধর্মাচারের জন্যে হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে। এদের অন্ধ চরমপন্হা সত্যিই ভয়ংকর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের মুসলমানদের মধ্যেও তো এ রকম কিছু গ্রুপ আছে।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আল্লাহ্’র ক্বুরআন ও রসূলুল্লাহ্ স:-এর যে শিক্ষা তাতে মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের চরমপন্হী গ্রুপের উত্থান অসম্ভব। ইসলাম নীতি ও কর্মপন্হার দিক থেকে মধ্যম পন্হার ধর্ম। কিন্তু অনেক সময়ই বাইরের ষড়যন্ত্র এবং অন্ধ ও মনগড়া বিশ্বাসের দ্বারা তাড়িত বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে। চতুর্থ খলিফা হযরত ‘আলী রা.-এর শাসন যুগে খারেজী সম্প্র’দায়সহ এ ধরনের কিছু ফেৎনার আবির্ভাব ঘটে। এ ধরনের ফেৎনা এখনও আছে, যারা বিভিন্ন পরিভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে চাচ্ছে। ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র এদের পেছনে রয়েছে। তবে এই গ্রুপ কখনই ইসলামের মূলধারায় প্রবেশ করতে পারেনি। এদের অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ীও হয়নি। এর কারণ আল্লাহর কুরআন, রসূলল্লাহ স.-এর জীবন মানে হাদীস অবিকৃত অবস্থায় আমাদের সামনে রয়েছে। সত্যের এই তেজই সব ফেৎনাকে অবশেষে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া স্যার। এই সুযোগ কিন্তু খৃষ্টান ও ইহুদিদের নেই’। বলল মেন্দারিস মালিক।
‘কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত নেই এবং তাদের ধর্মগুরুদের জীবন ও কর্মও তাদের সামনে অবিকৃত অবস্থায় নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা উপত্যকায় প্রবেশ করেছি মি. মেন্দারিস মালিক।’
‘ওরা সবই ধ্বংস করেছে, কিন্তু লাইটগুলো জ্বলছে কেন স্যার?’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘কারণ লাইটগুলো ব্যাটারি চালিত। জেনারেটরের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটছে আহমদ মুসারা। যেখানে সম্ভব ডবল মার্চও করছে। বরফের সমুদ্রে না থাকলে ঘামে তাদের গোসল হয়ে যেত।
অল্পক্ষণের মধ্যে তারা আলোর প্রান্তসীমায় পৌছে গেল।
‘মেন্দারিস মালিক, তোমার স্টেনগান প্রস্তুত রাখ, আমরা যেন সেনা সদস্যদের মত বোকা না বনি।’
নিজের মেশিন রিভলভারটা হাতে নিতে নিতে বলল আহমদ মুসা।
অন্ধকার থেকে আলোর এলাকায় প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
তাদের দেখতে পেয়েছে আহত সেই তিনজন লোক।
অত্যন্ত ক্ষীপ্র লোকগুলো।
দেখতে পেয়েই তারা তাদের স্টেনগান তুলে নিয়েছে।
একেবারেই বেপরোয়া লোকগুলো। আহমদ মুসাদের রিভলভার ও স্টেনগান যে তাদের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে, সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই।
বিদ্যুতবেগে তাদের স্টেনগানের নল উঠে আসছে আহমদ মুসাদের লক্ষ্যে।
ওদের থামানোর আর কোন উপায় ছিল না। আহমদ মুসার রিভলভার চোখের পলকে তিনবার অগ্নিবৃষ্টি করল। তিনটি গুলি বেরিয়ে তিনজনের কারো কব্জিতে, কারো বাহুতে গিয়ে বিদ্ধ হলো। স্টেনগান পড়ে গেল ওদের হাত থেকে।
আহমদ মুসা রিভলভার বাগিয়েই দ্রুত এগুলো তাদের দিকে। বলল, ‘আমরা আপনাদের শত্রু নই। যারা সোনা তুলতে এসেছিল, আমরা তাদের লোক নই। সোনার প্রতি আমাদের কোন লোভও নেই। পাশের পাহাড়ের উপর থেকে আমরা আপনাদের লড়াই দেখেছি। আপনাদের আহত হতে দেখে আপনাদের সাহায্যের জন্যে আমরা এসেছি। আপনাদের থামানোর আর কোন পথ ছিল না বলেই আত্মরক্ষার জন্যে আমি আপনাদের হাতে গুলি করতে বাধ্য হয়েছি। মারতে চাইলে আমি আপনাদের বুকে, মাথায় গুলি করতে পারতাম।’
বলে আহমদ মুসা হাতের রিভলভার পকেটে রেখে তাদের দিকে এগোলো।
মেন্দারিস মালিকও তার হাতের স্টেনগান কাঁধে ঝুলিয়েছে।
আহত তিনজনও শান্তভাবে শুয়ে পড়েছে।
আহত তিনজনের মধ্যে দুইজনের দুই উরুই গুলিবিদ্ধ। আরেকজনের লেগেছে পাঁজরে গুলি।
তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাদের আহত স্থান থেকে।
‘অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তক্ষরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। আমি চেষ্টা করব, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।’ আহতদের লক্ষ্যে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার পিঠে ঝুলানো ব্যাগ নামিয়ে তার ভেতর থেকে অনেকগুলো প্রি-মেডিকেল ব্যান্ডেজ বের করে নিল।
এই প্রি-মেডিকেল ব্যান্ডেজ রক্তক্ষরণ বন্ধে কার্যকর। একই সাথে এটা ব্যান্ডেজ ও রক্তরোধক ঔষধও। এই ব্যান্ডেজ আহতস্থান থেকে অতিসহজে খুলে নেয়া যায়।
আহমদ মুসা অভিজ্ঞ ডাক্তরের মত সবার সব আহত স্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
আহতদের একজন বলল, ‘আপনি দেখছি ডাক্তার। কিন্তু গুলি করা দেখে মনে হয়েছিল আপনি একজন অতিদক্ষ বন্দুকবাজ।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি প্রফেশনাল ডাক্তার নই, প্রফেশনাল বন্দুকবাজও নই। আমি একজন সচেতন মানুষ।’
বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল আহমদ মুসা। কল করল যে পুলিশদের এখানে আসার কথা ছিল তাদের চীফকে।
পুলিশ অফিসার তার কলে সাড়া দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমরা সাড়ে ১৫ হাজার ফিট লেভেলে পৌঁছে গেছি।’
আহমদ মুসা তাকে ধন্যবদ দিয়ে ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকায় আসতে বলল এবং জানল, উপত্যকায় গুরুতর আহত তিনজন লোক রয়েছে। তাদের দ্রুত বেজ ক্যাম্পের হাসপাতালে নিতে হবে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই আহতদের একজন বলল, ‘আপনাদের সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আপনারা কে জানতে পারি কি?’
‘বলেছি আমরা আপনাদের শত্রুদের সাথের লোক নই। আপনাদের সাথেও আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা পুলিশও নই। তবে আমি পুলিশকে ডেকেছে। আপনাদের বেজ ক্যাম্প-১ এ নিয়ে যাবার জন্যে তাদের সাহায্য দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আপনারা কে, সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।’ বলল আহতদের সেই লোকটিই।
‘আমরা আপনাদের শুভাকাংখী। এটুকু পরিচয়ই থাক। পরে আলোচনা হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
তাদের কথা বলার আর সুযোগ না দিয়েই আহমদ মুসা চারিকের লাশগুলোর দিকে নজর দিল। পা বাড়াল ঘুরে দেখার জন্যে।
তার পাশে হাঁটছিল মেন্দারিস মালিকও।
‘সেনা পোষাক পরা লাশগুলোকে দেখুন মি. মেন্দারিস মালিক, কাউকে চিনতে পারেন কিনা। তবে ওদের সার্চ করে লাভ নেই। তাদর নকল সেনা পোষাক তাদের প্রকৃত পরিচয়ের কিছুই রাখেনি, সেটা নিশ্চিত।’ আহমদ মুসা বলল।
দু’জনেই ঘুরতে লাগল এক লাশ থেকে অন্য লাশের কাছে।
একটি লাশের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল মেন্দারিস মালিক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে দেখল লাশের মুখটাকে। তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, একে বোধ হয় আমি চিনতে পেরেছি। ইনি ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’- এর আরিয়াস অঞ্চলের প্রধান- ভারদান বুরাগ। লেক ভ্যান তীরের একটা ঘটনায় এই সংগঠনের প্রধান ওরান্তু নিহত হওয়ার পর ইনিই ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’- এর দায়িত্ব পেয়েছিলেন।’
আহমদ মুসার মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেও দেখল লাশটার চেহারা। বলল, ‘আপনি ভালো করে চেনেন একে?’
‘ভালো করেই চিনি। একটি মিটিং-এ ওরান্তু ওরারতু’র সাথে একদিন কথা হচ্ছিল। সে সময় ইনি তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। ওরান্তু ওরারতু তাকে ভারদান বুরাগ সম্বোধন করে তাঁর সাথে বসা আরেক জনের সাথে ভারদান বুরাগকে পরিচয় করে দিয়ে তাকে আরিয়াস অঞ্চলের প্রধান বলেছিল। একবার দেখলেও ভারদান বুরাগের চেহারা আমার মনে আছে।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাকে আপনার স্মরণশক্তির জন্যে মি. মেন্দারিস মালিক। আল্লাহ্’র হাজার শোকর যে আমাদের এক শত্রুকে আমাদের পথ থেকে তিনি সরিয়ে দিয়েছেন। উনি তো নেতা, দেখুন মি. মেন্দারিস মালিক, ওর পকেটে ওর মোবাইলটা পাওয়া যায় কিনা।’ বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই মেন্দারিস মালিক ভারদান বুরাগের পকেট সার্চ করল। পেল একটা মোবাইল। মোবাইলটি সে তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
মোবাইলটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মোবাইলটা কাজে দিতে পারে।’
পুলিশের বাঁশির আওয়াজ পেল আহমদ মসা। বাঁশির আওয়াজটা এল ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকার ওপ্রান্ত থেকে।
‘পুলিশ দল এসে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।

মাউন্ট আরারাতের বেজ ক্যাম্প-১ এর একমাত্র সরকররী হাসপাতালের ভিআইপি বেডে শুয়ে ফাদার আনতু আরামেহ। কথা বলছিল সে আহমদ মুসার সাথে।
ফাদার আনতু আরামেহ মাউন্ট আরারাতের সাড়ে পনের হাজার ফিট উপরে ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকা থেকে উদ্ধার করে আনা তিনজন আহতের একজন।
গলায় মাউন্ট আরারাতের প্রতীক পরা যারা ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকায় সেনা পোষাক পরা ভারদান বুরাগ ও তার বাহিনীকে হত্যা করে স্বর্ণভাণ্ডারের স্বর্ণ দখল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল, ফাদার আনতু আরামেহ সেই দলের নেতা।
আহমদ মুসার কাছে ফাদার আনতু আরামেহ অকপটে স্বীকার করেছে যে সে আর্মেনিয়ার নাগরিক। বহুদিন সে বাস করছে ইজদিরে। ইজদিরের সেন্ট মেরী গীর্জার সে প্রধান পুরোহিত।
এ সব দিয়েই আহমদ মুসার সাথে শুরু হয়েছিল তার কথা।
ফাদার আনতু আরামেহ গীর্জার প্রধান পুরোহিত জেনে আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘একজন শান্তিপ্রিয় ফাদার হয়ে ‘আর্ক অব নুহা’ উপত্যকার খুনোখুনির মত ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়লেন কিভাবে? আপনার সাথের লোকরাই বা কারা? গীর্জার লোক এরা নিশ্চয় নয়।’
‘না এরা গীর্জার লোক নয়। ‘আর্মি অব ট্রিনিটি’ নামে একটা সংগঠন আছে। ঈশ্বর যিশু ও মেরীর স্বার্থ রক্ষায় উৎসর্গিত এরা। ঈশ্বর যিশু ও মেরীর জন্যে এরা জীবন দিতে প্রস্তুত। গীর্জার ফাদার হিসাবে এরা আমারও ভক্ত। আমি যখন জানতে পারলাম প্রভূ নূহের নৌকার গচ্ছিত স্বর্ণভাণ্ডা অপহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে, তখনই আমি খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করি। সব তথ্য যোগাড়ের পর আমি নিশ্চিত হলাম ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ ও ‘সোহা’ নামের দু’টি সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক সংগঠন নিছক ব্যক্তিগত ও গ্রুপ স্বার্থে প্রভূ নূহরে স্বর্ণভাণ্ডার আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে। প্রভূ নূহের স্বর্ণভাণ্ডার মানে ঈশ্বরের স্বর্ণভাণ্ডার। এ স্বর্ণভাণ্ডার রক্ষা করা প্রতিটি ধর্মভীরু মানুষের দায়িত্ব। আমি ‘আর্মি অব ট্রিনিটি’- কে বিষয়টা জানালাম। শুনেই তারা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। তারা শপথ নিল ঈশ্বরের এ সম্পদ রক্ষায় তারা জীবন দিতে প্রস্তুত। আমার সাথে ‘আর্ক অব নূহা’য় এরাই এসেছিল। জীব্নও তারা দিয়েছে, কিন্তু রক্ষা করেছে ঈশ্বরের সম্পদ।’ থামল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘ফাদার, আপনি ‘সোহা’ ও ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’-কে রাজনৈতিক ও সন্ত্রিসী সংগঠন বললেন। আসলে ওরা কারা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, সোহা পুরোপুরি রাজনৈতিক সংগঠন। আর ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ একটি নিরেট সন্ত্রাসী সংগঠন। যে কোন উপায়ে যে কোন পথে অর্থ সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করা তাদের লক্ষ্য। প্রভু নূহের স্বর্ণভাণ্ডারেও অবশেষে তারা হাত দিয়েছে।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘কিন্তু একটি রাজনৈতিক এ একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে এই মিলন হলো কী করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘দুই গ্রুপ দুই উদ্দেশ্যে একে অপরকে ব্যবহার করছে। ‘হোলি আর্ক’ গ্রুপ টাকা দিয়ে ‘সোহা’র সমর্থন কিনে নিয়েছে যাতে তাদের পক্ষে প্রভু নূহের স্বর্ণভাণ্ডার লুট করা সহজ হয়। ‘সোহা’ গ্রুপের ব্যপক প্রভাব রয়েছে পূর্ব আনাতোলিয়অর পুলিশ ও সেনা দলের উপর। মাউন্ট আরারাতে প্রভু নূহের স্বর্ণভাণ্ডার লুটের জন্য পুলিশ ও সেনাদলের সাহায্য দরকার। কোটি কোটি ডলার খরচ করে ‘সোহা’র মাধ্যমে এদের সাহায্য পেতে চেয়েছে তারা এবং সেটা তারা পেয়েছে। অন্যদিকে ‘সোহা’ চেয়েছে ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’- এর টাকায় পূর্ব আনাতোলিয়ায় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে। তা তারা করেও ফেলেছে।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘সোহা’র এই রাজনৈতিক স্বার্থ কি ফাদার?’ আহমদ মুসা বলল।
প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ফাদার আনতু আরামেহ। বলল, ‘বিষয়টা বললে আমার গায়েও কালো দাগ পড়ে। কিন্তু তবু আমি বলব। কারণ, আমি আমার ধর্মের পক্ষে ও ন্যায়ের পক্ষে। কোন গোষ্ঠীগত বা জাতিগত ইগো অথবা আবেগের শৃংখলে বন্দী আমি নই।’
একটু থামল ফাদার আনতু আরামেহ। তারপর বলল, ‘তারা পূর্ব আনাতোলিয়া, বিশেষ করে এর মাউন্ট আরারাত অঞ্চলকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় এবং একে আর্মেনিয়ার অংশ বানাতে চায়। এক সময় ভ্যান পর্যন্ত গোটা পূর্ব আনাতোলিয়া আর্মেনিয়ার অংশ ছিল, তারও আগে এই অঞ্চল ছিল একটা খ্রীস্টান সাম্রাজ্য। তারা এই সাম্রাজ্য আবার ফিরে পেতে চায় এবং আর্মেনিয়াকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তারা বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়তে চায়।’
‘আপনি বললেন বিষয়টি আপনার গায়েও কালো দাগ লাগায়। মানে আপনিও এর অন্তর্ভুক্ত, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপনার নিজস্ব কোন ভাবনা আছে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার কথা, আমি আগেই বলেছি যে আমি ন্যায়ের পক্ষে। জাতিগত ইগো ও আবেগের হাতে আমি বন্দী নই। তাদের কথায় আবেগ ও ইগো দুইই আছে, কিন্তু যুক্তি নেই। ইহুদিরা যে অমূলক ও অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনে এসেছে এবং একটি রাষ্ট্র বাগিয়েছে, হোলি আর্ক গ্রুপদের দাবীও ঠিক এটা। এই দাবী সভ্যতা ও মানব ইতিহাসের ধারার বিরোধী। এ দাবী মেনে নিলে আমেরিকানদেরকে আমেরিকা, অস্ট্রেলীয়দের অস্ট্রেলিয়া এবং হিন্দু আর্যদেরকে ছাড়তে হবে ভারতবর্ষ। এভাবে কোন দেশই অক্ষত থাকবে না। সুতরাং এই ধরনের দাবী একটা পাগলামি। সেই পাগলামিই করছে ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ ও ‘সোহা’।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘ফাদার, আপনি বললেন, ‘সোহা’রা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। সম্পন্ন করে ফেলা তাদের সেই ষড়যন্ত্র বা কাজটা কী?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোন স্পেসিফিক ইনফরমেশন নেই। আমার ঐ কথা বলার কারণ হলো, ইদানিং তাদের নেতারা বলে বেড়াচ্ছে যে, আর মাত্র কয়েকদিন, এরপর আমাদের দিন আসছে। আমাদের রাজ কায়েম হবে। আর্মেনিয়ার সাথে এই অঞ্চলের দূরত্ব আর থাকবে না। ইয়েরেভেন হবে আমাদের রাজধানী, আর মাউন্ট আরারাত হবে আমাদের তীর্থকেন্দ্র। এসব কথা থেকে আই বুঝেছি, তাদের প্রস্তুতি শেষ, শুধু ফল প্রকাশটাই বাকি। তাছাড়া আমি জেনেছি, তারা গত কিছু দিন ধরে বিশেষ শ্রেণীর বা তাদের পছন্দমত লোকদের সাথে ডোর-টু-ডোর যোগাযোগ করছে। সব ক্রিমিনাল গ্রুপের সাথেও তাদের যোগাযোগ হয়েছে। টাকা দিয়ে তারা তাদের বশ করে ফেলেছে। কিন্তু তারা কী করতে চায়, ষড়যন্ত্র কী ধরনের, এত আয়োজন কিসের জন্যে, সেটা আমি জানতে পারিনি। তবে আমার গীর্জায় নিয়মিত আসে, এমন একজন কথাচ্ছলে একদিন বলেছে, ‘সামনের দিনগুলো ভালো নয়, ফাদার। গোটা পূর্ব আনাতোলিয়ায় নাকি আগুন জ্বলবে’।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘ধন্যবাদ ফাদার, আপনি মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। আচ্ছা ওদের কোন ঠিকানা বা কনট্যাক্ট পয়েন্ট জানা আছে আপনার, ফাদার?’
‘কয়েকটা ঠিকানা আমার লোকরা সংগ্রহ করেছিল, সেগুলোর একটিতেও তারা এখন নেই। ওরা একটা ঠিকানায় কয়েক সপ্তাহের বেশি থাকে না। তবে দু’টি জায়গায় ওরা খুব বেশি ওঠাবসা করে। তার একটি হলো মাউন্ট আরারাতের বেজ ক্যাম্প-১ এর পর্যটন হোটেল। অন্যটি আমাদের ইজদির প্রদেশের রাজধানী ইজদিয়ের ইহুদিদের সিনাগগের পাশের হোলি আরারাত হোটেল। অবশ্য আমি জানি না ‘আর্ক অব নূহা’ উপত্যকার ঘটনার পর তাদের আরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা। ‘সোহা’র নেতা মিহরান মুসেগ মাসিস খুব চালাক লোক।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
‘অনেক ধন্যবাদ ফাদার। আপনি অনেক সাহায্য করেছেন। এবার উঠি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, আমি চেষ্টা করব আরও স্পেসিফিক তথ্য জানার। পারলে আমি জানাব।’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘ফাদার, আমি আমার একটা কার্ড আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। ওতে টেলিফোন নাম্বার, ই-মেইল সবই আছে। আপনি ব্যবহার করতে পারবেন।’
বলে আহমদ মুসা তার নেমকার্ড বের করার জন্য জ্যাকেটের পকেটে হাত দিল। তার হাতটা প্রথমেই রিভলভারে গিয়ে পড়ল।
নেমকার্ড রিভলভারের তলায় চাপা পড়েছে। আহমদ মুসা নেমকার্ড বের করছিল রিভলভারের নিচ থেকে।
এই সময় ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। দরজায় দাঁড়ালো দু’জন পুলিশ গুলি খেয়ে দরজার উপরই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা চমকে উঠে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল এই দৃশ্য।
সংগে সংগে তার হাত পকেটের নেমকার্ড ছেড়ে দিয়ে রিভলভার চেপে ধরল। তার তর্জনি রিভলভারের ট্রিগার স্পর্শ করল।
দুই পুলিশর গুলিবিদ্ধ দেহ মাটিতে পড়ে যাবার পরপরই আরও তিনজন উদ্যত স্টেনগান হাতে দরজায় দাঁড়াল। একজন চিৎকার করে বলল, ‘মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও শয়তার ফাদার। তোমরা আমাদের সর্বনাশ করেছো। এবার আমরা তোমাদের সর্বনাশ করব। তোমার গোটা পরিবারকে সর্বনাশ করে এসেছি। এতক্ষণ গুলি করিনি তোমাকে শুধু এই খবর দেয়ার জন্যে। ফায়া…।’
‘ফায়ার’ শব্দ সে শেষ করতে পারলো না। জ্যাকেটের পকেট থেকে আহমদ মুসার মেশিন রিভলভার গুলিবৃষ্টি করল।
আদের পেয়ে স্টেনগানের ট্রিগার টেপার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পুলিশের লাশের পাশেই তাদের তিনটি লাশ পড়ে গেল।
ফাদার আনতু আরামেহ বিছানায় উঠে বসেছিল। ভাবলেশহীন তার মুখ। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি।
আহমদ মুসা তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বলল, ‘আমি দুঃখিত ফাদার, আপনার পরিবারের কথা আমাদের পুলিশের ভাবা উচিৎ ছিল।’
ফাদার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল ‘আমি আমার পরিবারের জন্যে ভাবছি না আবু আহমদ। আমি ভাবছি, ‘সোহা’ এবং ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ কতটা জঘন্য পর্যায়ে নেমে গেছে!’
মুহূর্তের জন্যে থেমে ফাদার আনতু আরামেহ বলল, ‘ধন্যবাদ মি. আবু আহমদ। দ্বিতীয়বার আপনি আমাকে বাঁচালেন। আমি দারুন বিস্মিত হয়েছি আপনার ক্ষীপ্রতা ও লক্ষ্যভেদ দেখে। পকেটে রিভলভার রেখে এই ক্ষীপ্রতা ও লক্ষ্যভেদ স্বাভাবিক নয়!’
‘বিপদে আল্লাহ্ এভাবেই সাহায্য করেন তার বান্দাহদেরকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার এই ধর্মভীরুতাকে আমার খুব ভালো লাগে। সত্যিকার ধর্মভীরু মানুষ যে ধর্মেরই হোক তারা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারে, তাদের মধ্যে সুন্দর সহাবস্থানও সম্ভব। গত দু’দিনে দু’বার আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছে। মনে হচ্ছে দু’যুগ থেকে আপনার সাথে আমার পরিচয়!’ বলল ফাদার আনতু আরামেহ।
হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল ডিপি মি. খাল্লিকান খাচিপ। বলল সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে, ‘সব আমি শুনেছি মি. আবু আহমদ। আল্লাহ্’র শোকর যে আপনি এ সময় ঘরে ছিলেন। তাতে ফাদারকে বাঁচালো গেছে।’
বলেই তাকাল ফাদার আনতু আরামেহ’র দিকে। বলল, ‘ফাদার, আমি দুঃখিত আপনার পরিবারের জন্যে।’
‘স্যার, যারা চলে গেছে, তাদের কথা না ভেবে দেশের, জনগণের যারা শত্রু, তাদের কথা ভাবুন। আমি আপনাদের পাশে আছি।’
বলে একটু থামল ফাদার আরামেহ। তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আবু আহমদ, আমি ‘আর্মি অব ট্রিনিটি’- এর গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধানকে খবর দিয়েছি। তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। সেও সত্যিকার একজন ধর্মভীরু মানুষ। অনেক খবর তার কাছে থাকার কথা। সে অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবে।’
‘ধন্যবাদ ফাদার। সবার সাহয্য পেলে আমরা খুশি হবো।’ আহমদ মুসা বলল।
বলেই আহমদ মুসা ফিরল ডিপি মি. খাল্লিকান খাচিপের দিকে। ফিরেই তাকে বলল, ‘মি. খাল্লিকান, ফাদারকে এখনি এখান থেকে সরিয়ে ইজদিরের পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অন্য কোন হাসপাতালে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার, আমিও এই চিন্তাই করছিলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে, ধন্যবাদ সকলকে। আমি উঠছি। জরুরী কিছু কাজ আছে।’
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।