৪
গাড়ি ছুটছে আহমদ মুসার। সূর্য উঠতে তখনও অনেক বাকি।
মাউন্ট আরারাতের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ইজদির প্রদেশের রাজধানী আর পাঁচ মিনিটের পথ।
তাহাজ্জুদ নামায শেষ করেই আহমদ মুসা ভ্যান থেকে গাড়িতে উঠেছে। ভোরের রাজপথ একদম ফাঁকা।
ঝড়ের বেগে ছুটতে পেরেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
রাজধানী ইজদির শহরের কাছাকাছি রাস্তার পাশের একটা মসজিদে ফজরের নামায পড়ে নিয়েছে আহমদ মুসা।
রাজধানী ইজদির শহরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
ইজদির শহরে কয়েকবার এসেছে আহমদ মুসা।
আরিয়াস রোড আহমদ মুসার চেনা।
আরিয়াস রোডে প্রবেশ করল তার গাড়ি।
আহমদ মুসাকে যারা হত্যার চেষ্টা করেছিল, যারা হত্যা করেছে সাবিহা সাবিতকে তাদের গাড়িতে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেটে এই রাস্তার নাম লেখা ছিল।
রাতের আঁধার নেই। কিন্তু আঁধারের রেশ তখনও আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি স্লো করে দিয়েছিল। রাস্তার পাশের বাড়ির নাম্বারগুলো দেখছিল সে।
ওয়ান থ্রি নাম্বার পেয়ে গেল আহমদ মুসা। আনন্দের প্রকাশ ঘটলো আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
গাড়ি দাঁড় করাল সে।
কিন্তু গাড়ির জানালা নামিয়ে বাড়িটার দিকে চাইতেই আনন্দ উবে গেল আহমদ মুসার মন থেকে।
ওয়ান থ্রি ওয়ান বাড়িটা একটা দু’তলা মসজিদ। মসজিদের সাথে একটা মাদ্রাসার সাইনবোর্ড। মসজিদ ও মাদ্রাসার একপাশে পেল খোলা গ্রাউন্ড, অন্যপাশে সুন্দর একটা সবজি বাগান।
হতাশ হলো আহমদ মুসা। এ রকম স্থানে তাকে হত্যার চেষ্টাকারী উল্কিওয়ালারা কিংবা হিব্রু জানা তুর্কি, ইহুদি বা আর্মেনীয় ইহুদিরা কেউ থাকার কথা অবশ্যই নয়।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল সিগারেটের প্যাকেটে টেলিফোনের নাম্বার লিখতে গিয়ে লেখক প্রত্যেকটা দুই ডিজিটের প্যাকেটে টেলিফোনের নাম্বার লিখতে গিয়ে লেখক প্রত্যেকটা দুই ডিজিটের জোড়ার অংক যদি আগপিছ করে লিখতে পারে, তাহলে রাস্তার লোকেশন নাম্বার লেখার ক্ষেত্রেও সে এটাই করতে পারে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ওয়ান থ্রি ওয়ান মানে ১৩১-এর প্রথম জোড়ার অংক আগে-পিছে করে নিলে জোড়ার অংক ‘১৩’-এর বদলে ‘৩১’ হয়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে রাস্তার নাম্বার দাঁড়ায় থ্রি ওয়ান ওয়ান অর্থাৎ ৩১১। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো এই থ্রি ওয়ান ওয়ানই তার টার্গেট নাম্বার।
গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। ছুটল গাড়ি।
অনেকটা সামনে হবে নাম্বারটি।
অনেকটা চলার পর রাস্তার পাশের বাড়ির নাম্বারের দিকে তাকাল আহমদ মুসা। প্রথমেই যে বাড়ির নাম্বারটি চোখে পড়ল তা হচ্ছে, থ্রি জিরো ওয়ান। আর একটু এগিয়েই পেয়ে গেল থ্রি ওয়ান ওয়ান।
দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার গাড়ি।
জানালার কাঁচের ভেতর দিয়েই তাকাল আহমদ মুসা বাড়িটার দিকে।
বাড়িটা ওল্ড প্যাটার্নের একটা গেটবক্স।
গেট থেকে ইটের একটা রাস্তা গিয়ে মিশেছে গাড়িবারান্দায়।
গাড়িবারান্দা থেকে তিন ধাপ উঠলেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটা ল্যান্ডিং বা বারান্দা।
বারান্দার মাঝ বরাবর বাড়ির ভেতরে ঢোকার একটা দরজা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। চারদিকটা নিরব। সূর্য তখনও ওঠেনি।
রাস্তায় গাড়ি চলা শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু কচিৎ দু’একটা চোখে পড়ছে।
জ্যাকেটের পকেটের রিভলভার এবং মাথার পেছনের রিভলভারের শরীরটা একবার স্পর্শ করে আহমদ মুসা উঠে গেল গেটে।
গেট লক করা। গেটম্যান নিশ্চয় ঘুমিয়ে আছে।
বাউন্ডরি ওয়াল খুব উঁচু নয়। ছয় ফুটের বেশি হবে না।
চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে আহমদ মুসা চোখের পলকে পাঁচিল চপকে ভেতরে ঢুকে গেল।
গেটবক্সে এসে আহমদ মুসা দেখল, গেটবক্সের দরজা খোলা। উঁকি মারল ভেতরে। দেখল গেটম্যান একটা চেয়ারে বসেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাশেই টেবিলের উপর তালা-চাবি।
আহমদ মুসা তালা-চাবি নিয়ে গেটবক্স লক করল। চাবিটা তালাতেই লাগানো অবস্থায় রেখে দিল। বাড়ির দিকে এগোলো আহমদ মুসা। গাড়িবারান্দা হয়ে উঠে গেল ল্যান্ডিং-এ।
দরজার সামনে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। তারপর ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে জোরের সাথে তিনবার নক করল সে।
মিনিট খানেক পার হয়ে গেল। কোন সাড়া নেই।
আবার নক করল আহমদ মুসা আগের চেয়ে আরও উচ্চ শব্দে।
তিন পর্যায়ে নয় বার নক করার পর দরজা খুলে গেল।
দরজা ফাঁক হলে প্রথমেই দেখা গেল রিভলভারের নল।
দরজা আরও খুলে গেলে দেখা গেল রিভলভার হতে দাঁড়ানো লোকটিকে।
তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একজন মাসলম্যান। মেদহীন ঋজু শরীর। হাফপ্যান্টের সাথে টি-শার্ট পরা। চোখের দৃষ্টি সাপের মত তীক্ষ্ণ। গোটা মুখ বিরক্তিতে ভরা। বলল তীব্র কণ্ঠে, ‘কে তুমি? আমার গেটম্যান কোথায়?’
আহমদ মুসা বুঝল কেউ আসলে গেটম্যানই তাকে ডাকে। ডাকারও নিশ্চয় নিয়ম রয়েছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে সে নিয়মের। সম্ভবতঃ এই কারণেই রিভলভার নিয়ে তার আগমন।
‘আমি একজন মানুষ। নাম বললে অবশ্যই চিনবেন না। আর আপনার গেটম্যান ঘুমুচ্ছে, তাকে তালাবন্ধ করে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির রিভলভারের নল একটু উপরে উঠে আহমদ মুসার মাথাকে টার্গেট করল। বলল সে কর্কশ কণ্ঠে, ‘যে অপরাধ করেছ তুমি, তাতে আমি এখনি তোমার মাথা উড়িয়ে দিতে পারি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গুলি আপনি এখন করবেন না। গুলি করার সময় আপনার পার হয়ে গেছে। শুরুতেই তা করেননি। আসলে আপনি আমাকে জানতে চান।’
আহমদ মুসার নির্মল হাসি, নির্ভয় চোখ-মুখ দেখে লোকটি বিস্মিতই হয়েছিল। আর যে ক্রিমিনাল চেহারা লোকটি দেখতে অভ্যস্ত, সে রকম চেহারা আহমদ মুসার নয়।
লোকটির দৃষ্টি একটু সহজ হলো। বলল, ‘আমার গেটম্যানকে বন্ধ করেছ কেন?’
‘আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই। আমি চাই আর কেউ তা না শুনুক। আর গেটম্যান তার ঘুমানোর শাস্তি পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির চোখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি। বলল, ‘মনে হচ্ছে, গেটম্যান যেন তোমার?’
‘গেটম্যান আমার বা আপনার এ প্রশ্ন নয়, গেটম্যান যারই হোক সে দায়িত্বে অবহেলা করবে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির রিভলভারের নল নিচে নেমে গেল। বলল, ‘কী বলতে চান বলুন।’
‘এভাবে দরজার দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে কোন কথা হয়?’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটি তাকাল একবার আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কালকে সবে এ বাড়িতে উঠেছি। এখনও কিছুই গোছগাছ করা হয়নি। আসুন ভেতরে।’ আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল।
শোবার ঘরটাই শুধু শোবার মত করে গোছ-গাছ করা হয়েছে। একটা বেড, তার পাশে বসবার জন্যে রয়েছে একটা সোফা।
লোকটি আহমদ মুসাকে সোফায় বসতে বলে নিজে বেডের উপর বসল পা ঝুলিয়ে।
তার হাতে তখনও রিভলভার।
লোকটি বসেই বলল, ‘আপনার তো সাংঘাতিক দুঃসাহস! চিন্তা-ভাবনা না করেই ঢুকে পড়েছেন! আমি যদি গুলি করে বসতাম!’
‘পারতেন না আপনি গুলি করতে। তার আগেই আমার গুলি আপনার কণ্ঠনালির পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার চাঁদি দিয়ে বের হয়ে যেত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি তো রিভলভার বেরই করেননি।’ বলল লোকটি। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘রিভলভার ছিল আমার জ্যাকেটের পকেটে। আমার ডান হাতের তর্জনি ছিল রিভলভারের ট্রিগারে। আর রিভলভারের নল ছিল আপনার থুতনি ও গলার সন্ধিক্ষণে। টার্গেট ঠিক করেই রেখেছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা। এরপর জ্যাকেটের ডান পকেট থেকে রিভলভার সমেত ডান হাতটা বের করে দেখাল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম।’ বলল লোকটি।
থামল একটু। বলল আবার সে, ‘হ্যাঁ বলুন, কী বলতে চান।’
‘গতকাল ভ্যান এয়ারপোর্টের ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ যারা দু’জন লোককে বোমার সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সম্পর্কে জানতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা সরাসরি লোকটির চোখের উপর চোখ রেখে।
চমকে উঠল লোকটি। চমকানো অবস্থাকে সে গোপনও করল না।
চমকানো অবস্থা ছিল তার মুহূর্তের জন্য। তারপরই তার চোখে ফুটে উঠল আগুন। তবে ধীরে ধীরে নিভে গেল সে আগুন। বলল সে, ‘এ প্রশ্ন আমাকে কেন করছেন?’
‘যে দু’জন বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছে, তাদেরই একজন আমাদের এটা জানিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম না আমি কথাটা!’ বলল লোকটা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘তারা যে গাড়িতে যান, যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দেহ বিস্ফোরিত হয়, সে গাড়িতে পাওয়া একটা সিগারেটের প্যাকেট থেকে আপনার এই ঠিকানাটা পাওয়া গেছে। ঠিকানাটা গতকালই গাড়ি চলন্ত অবস্থাতেই লেখা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগে জবাব দিল না লোকটা। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। সে যেন আহমদ মুসার কথার সত্যাসত্য যাটাই করছে।
ইতিমধ্যে আহমদ মুসা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি বের করে লেখাটা লোকটার সামনে তুলে ধরল।
লেখাটার উপর একবার চোখ বুলিয়েই লোকটা বলল, ‘আপনি তো ঠিকানা ভুল করেছেন। যাবেন ‘১৩১’ নাম্বারে, এসেছেন ‘৩১১’ নাম্বার বাড়িতে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘লেখক প্রকৃত নাম্বারের প্রথম ডিজিটাল জোড়াকে এখানে উল্টে লিখেছেন। ‘৩১’ কে ‘১৩’ বানানো হয়েছে।’
বিস্ময়ে ছেয়ে গেল লোকটার মুখ। বলল, ‘লেখক যেটা লিখেছেন, সেটাই ঠিক হবার কথা। আপনি কি করে বলতে পারেন, প্রথম ডিজিটাল জোড়া তিনি উল্টিয়ে লিখেছেন?’
একটু হেসে উঠেই আহমদ মুসা আবার সিগারেটের প্যাকেটের টেলিফোন নাম্বারটা তার সামনে তুলে ধরে বলল, ‘দেখুন, এখানে টেলিফোনের নাম্বারসহ মোট পাঁচটি জোড়ার প্রত্যেকটির দুইটি করে জোড়া আগে-পিছে করা হয়েছে। বাড়ির নাম্বারের ক্ষেত্রেও এটাই করা হয়েছে।’
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল লোকটির মুখ।
‘অসম্ভব ব্যাপার, কি করে বুঝলেন বিষয়টি? এটা আমাদের নিজস্ব একটা রীতি। এ পর্যন্ত কেউ এ ধাঁধাঁ ভাঙতে পারেনি।’
‘এ বিষয়টা থাক। আমি ভাঙতে পেরেছি এটাই সত্য। এখন আপনি দয়া করে বলুন লোক দু’জনকে যারা খুন করেছে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, তারা কারা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি করে বুঝলেন যে, তারা এবং আমরা এক? তাদের সন্ধান আমরা আপনাকে কি করে দেব?’ বলল লোকটি।
‘নিজেদের লোককে গায়ে বোমা বেঁধে দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল নিজেদের হাতে রেখে কেউ কখনো মিশনে পাঠায় না। এটা বিশ্বাসঘাতকতা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন, আজকাল অনেক সুইসাইড স্কোয়াড পাঠানো হয় দেখা যাচ্ছে। তারা কি তাদের নিজেদের লোক নয়?’ বলল লোকটি।
‘সুইসাইড স্কোয়াডের লোকরা মটিভেটেড হওয়ার পর স্বেচ্ছায় সুইসাইড স্কোয়াডে যায় এবং এক বিশেষ মুহূর্তে স্বেচ্ছায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাদের বোমার রিমোট কন্ট্রোল বাইরের কারও হাতে থাকে না। নিজের লোক বলেই বোমা ফাটানো, না ফাটানোর এখতিয়ার তাদের হাতেই রাখা হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির চোখ-মুখে এবার প্রতিশোধের আগুন। বলল সে, ‘আপনি ঠিক বলেছেন, তারা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু বলুন তো আপনি কে? আপনি এসব কেন জানতে চাচ্ছেন?’
‘আমি যেই হই না কেন, আমি পুলিশের লোক নই। আমি গোয়েন্দা বিভাগ কিংবা সেনাবাহীনির লোকও নই। আমি মানুষকে সাহায্য করি। এটা আমার একটা ব্রত। তারা যেমন আপনাদের দু’জন লোককে হত্যা করছে, তেমনি তাদের কারণে আমার এক বোন গাতকাল মারা গেছে। আমি চাই তাদের শাস্তি হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তারা আমাদের শিকার। আমরাই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করব। আপনার এ ব্যপারে মাথা না ঘামালেও চলবে।’ বলল লোকটি।
তাই যদি হতো, তাহলে কষ্ট করে আসতাম না। আপনারা ওদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেছেন, এটা আমরা জানতে পারতাম। আর আপনাদের একার পক্ষে ওদের উৎখাত করা সম্ভব নয়। কয়েকজন লোক মারলে ওরা শেষ হয়ে যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু ওদের কোন সুনির্দিষ্ট ঠিকানা আমাদের জানা নেই। ওদের কয়েক ব্যক্তির সাথে মাত্র আমরা পরিচিত।’ লোকটি বলল।
‘ওদের সাথে দেখা সাক্ষাত, যোগাযোগ কিভাবে হতো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা কোন সময় ওদের ঠিকানা নিয়ে যায়নি, কিংবা ঠিকানা দেয়নি। নানা জায়গায় ওদের সাথে দেখা হতো, বিশষ করে মাউন্ট আরারাতের দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালের ট্যুরিস্ট ক্যাম্প নাম্বার ওয়ানে পর্যটনের যে রেস্টুরেন্ট রয়েছে, সেখানেই ওদের সাথে বেশি দেখা হতো।’ বলল লোকটি।
‘ওদের চিনতেন কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ওরা মোবাইলে যোগাযোগ করত।’ বলল লোকটি।
‘ওদের কোন মোবাইল নাম্বার আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরাই মোবাইলে যোগাযোগ করত। তারা তাদের মোবাইল নাম্বার কখনও দেয় না। আমাদের একটা মোবাইল নাম্বার ওদের কাছে ছিল। ও নাম্বারেই ওরা যোগাযোগ করত। ওদের নাম্বার মোবাইল ডিসপ্লেতে থাকে না।’ বলল লোকটি। ‘ভীষণ চালাক ওরা। সব কাজে সব ব্যাপারেই নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখে ওরা। এ পর্যন্ত ওদের ঠিকানাই পাওয়া যায়নি, কোন নেতার পরিচয়ও জানা যায়নি। এইমাত্র আপনি বললেন, আপনারাও প্রতিশোধ নিতে চান কিন্তু দেখছি, আপনারাও ওদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না।’
‘আজ জানি না, কাল জানতে পারব। অসম্ভব নয় জানা। ওদের তো লক্ষ্য মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার লুট করা এবং পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের প্রশাসনকে কব্জা করা। সুতরাং তারা কাজ করছে, ওদের খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।’ বলল লোকটি।
‘মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার লুটের কথা বুঝলাম। ওদের বিশ্বাস হযরত নুহ (আঃ)-এর কিস্তিতে যে স্বর্ণভাণ্ডার উঠেছিল, তা এখন মাউন্ট আরারাতের একটা গুহায় লুকানো আছে। সেটা হাত করার গোপন তৎপরতা চলতেই পারে। কিন্তু পূর্ব আনাতোলিয়ার প্রশাসনকে তারা কব্জা করবে কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেটা আমি জানি না স্যার। ওদের অস্ত্রপাতি, অর্থ ও যোগাযোগ দেখে মনে হয় দেশের বাইরের সাথেও ওদের যোগাযোগ আছে। অবশ্য এটা আমার ধারণা।’ লোকটি বলল।
‘আপনাদেরও যোগাযোগ বাইরের সাথে আছে। আপনাদের লোকরা হিব্রু ভাষা শিখল কি করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আমাদের সংগঠনটা আন্তর্জাতিক। সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলো আমাদের শিখতে হয়। হিব্রু একটাআ গুরুত্বপূর্ণ ভাষা, অন্তঃত আন্ডার ওয়ার্ল্ডের জন্যে। তবে আমাদের সম্পর্ক টাকার সাথে। কোন দেশের রাজনীতির সাথে আমাদের কোন যোগ নেই।’
‘টাকার বিনিময়ে আমাদেরকেও সাহায্য করুন তাহলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তী সাহায্য?’ জিজ্ঞাসা লোকটির।
‘ওরা পূর্ব আনাতোলিয়ার প্রশাসনকে কব্জায় আনতে চাচ্ছে কেন? তাদের লক্ষ্য কী? এসব তথ্য আমাদের সংগ্রহ করে দিন। শুধুই খুনের কাজ করেন, নাকি সব কিছু? কিন্তু সবখানেই তো রাজনীতি আছে। ওরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যেই আমাকে খুন করতে আপনাদের নিয়োগ করেছিল। আমি বেঁচে গেছি, কিন্তু আরেকটি মেয়ে জীবন দিয়েছে আমাকে বাঁচানোর জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা আগে জানলে আপনাকে খুন করার এই কাজটা অবশ্যই নিতাম না।’ লোকটি বলল।
‘আপনি যে দেশের মানুষ, সে দেশের রাজনৈতিক স্বার্থ আপনি দেখবেন না?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেশ আমার স্বার্থ দেখেনি। আমি দ্বারে-দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছি, চাকুরী পাই নি। তারপর বিচারক অন্যের দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে আমাকে জেলে পাঠিয়েছে। বাধ্য হয়েই কিলার গ্রুপে নাম লিখিয়েছি।’ লোকটি বলল।
‘বিচারক যেমন অন্যের দায় আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে আপনাকে জেলে পাঠিয়েছে এবং যারা আপনাকে চাকুরী দেয়নি এমন কিছু লোকের দায় আপনিও তো অন্যায়ভাবে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু একজন বিচারক অন্যায়কে ন্যায় বলে রায় দিয়েছে, তাই আমিও এটাই ন্যায় হিসেবে গ্রহণ করেছি।’
বলে একটু থামল লোকটি। একটু ভেবে বলল, ‘তবে প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে সাহায্য করবো।’
‘আমাকে কেন, দেশকে সাহায্য করবেন না?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘কারণ, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। বন্দুকধারী কাউকে আমি কখনো এমন সুন্দর ব্যবহার করতে দেখিনি।’ বলল লোকটি।
‘ধন্যবাদ। কী সাহায্য করবেন, কিভাবে সাহায্য করবেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেটা আমি ঠিক করব। আমার দুই কলিগের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ আপনি নিতে পারলেও আমি খুশি হবো। তবে তার আগেই আমি চেষ্টা করবো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে।’
‘ধন্যবাদ, তাতে আমাদেরও লাভ হবে।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তাহলে এখন তো কথা আর নেই। সাহায্যের প্রতিশ্রুতির জন্যে ধন্যবাদ। আবার করে দেখা হবে?’
‘আমি নামায পড়ি না। কিন্তু আমি অদৃষ্টবাদী। ভাগ্য যখন আমাদের আবার দেখা করাবে, তখন দেখা হবে।’ বলল লোকটি।
বিমর্ষতা নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘দেশ না হয় দোষ করেছে, কিন্তু আল্লাহ্’র আদেশ মানবেন না কেন?’
‘আল্লাহ্ আমাকে কিলার বানিয়েছেন, আমি তো কিলার হতে চাইনি। আর কিলার হওয়ার পর আর নামায পড়ার সুযোগ থাকে না।’ লোকটি বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহ্ আপনাকে কিলার বানাবেন কেন? চাকুরী না পেয়ে বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে বিচারক আপনাকে জেলে পাঠানোর ফলে আপনি যে সংকটে পড়েছিলেন, সে সংকটের সুযোগ নিয়ে শয়তান আপনাকে কিলার বানিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সংকট থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচাননি কেন?’ বলল লোকটি।
‘আপনার মধ্যে ধৈর্য্যের অভাব, তাই। সে কারণেই সংকট আপনাকে কাবু করে ফেলেছিল এবং তার ফলে শয়তানের জন্যে পথ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ্ কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘কষ্টের পাশেই কষ্টের উপশম থাকে।’ আল্লাহ্’র এই ওয়াদার উপর বিশ্বাস করে ধৈর্য্য ধারলে কষ্টের উপশম জীবন্ত রূপ নিয়ে মানুষের সামনে আসে। আপনি উপশমকে কাছে আসার সে সুযোগ দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব কষ্টেরই উপশম হয় ধৈর্য্য ধরলে?’ বলল লোকটি।
‘বিশ্ব চরাচরের মালিক ও স্রষ্টা আল্লাহ্ বলেছেন, কষ্টের সাথেই উপশম। তাই কষ্টের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে পারলে উপশম আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ‘স্বাভাবিক’ শব্দের বিপরীতে ‘অ-স্বাভাবিক’ বা ‘ব্যতিক্রম’ শব্দ যখন রয়েছে, তখন ব্যতিক্রমী বিষয় হিসেবে কষ্টের উপশম কখনও কোন ক্ষেত্রে নাও আসতে পারে। কিন্তু এটা ধরার বিষয় অবশ্যই নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাকে। বিষয়টাকে এমনভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, সামর্থ্যও বোধ হয় ছিল না। কিন্তু যা ঘটার, যা হবার, তা তো ঘটেই গেছে। এখন এই সব আলোচনার কোন অর্থ নেই।’ বলল লোকটি।
‘অর্থ অবশ্যই আছে। কিলার হওয়াই শেষ কথা নয়, কিলার হওয়া কারো শেষ পরিচয়ও নয়। কিলার হওয়ার পর নামায পড়ার সুযোগ নেই, একথা ঠিক। তবে নামায সব পাপের কালো দাগ মুছে ফেলতে পারে। পাপের জীবন থেকে ফিরে আসার তওবা মানুষের পাপের ক্লেশক্লিষ্ট জীবনকে পবিত্র করে তুলতে পারে।’
আশার একটা চাপা ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠল লোকটির চোখে-মুখে। বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি খুব ভালো লোক। ভালো লোকরা মানুষের মনে হতাশার বদলে আশার উজ্জীবন ঘটায়। এমন ভালো লোকদের অবিশ্বাস করা চলে না। ঠিক আছে আবার দেখা হবে।’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আপনার নাম জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে?’
এতক্ষণে হাসল লোকটা। বলল, ‘আপনি আইনজীবী হলে বোধ হয় বেশি ভালো করতেন। আপনি কেমন বন্দুক চালান জানি না। কিন্তু কথা আপনার দারুন লক্ষভেদি। যাক, আমার নাম মেন্দারিস মালিক। ডবল এম। আপনার নাম কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলাম না।’
‘যাকে হত্যার জন্যে আপনাদের দু’জন লোককে নিয়োগ করা হয়েছিল, আমি সেই আবু আহমদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ, আবার দেখা হবে।’ বলে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল মেন্দারিস মালিক।
‘আস্-সালামু আলাইকুম।’ বলে লোকটির সাথে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসা।
‘আসি।’ বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
সাথে সাথে হাঁটতে লাগল মেন্দারিস মালিকও।
মেন্দারিস মালিক গাড়ি পর্যন্ত এসে আহমদ মুসাকে বিদায় জানাল।
মাউন্ট আরারাতের গোড়ায় টুরিস্ট বেজক্যাম্প নাম্বার ওয়ানে পর্যটন রেস্টুরেন্টে আহমদ মুসা বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর চোখ দু’টি নিবদ্ধ রেখেছে পাশেই মেলে রাখা পত্রিকায়।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »