৪৯. বিপদে আনাতোলিয়া

চ্যাপ্টার

কিন্তু পত্রিকার এক বর্ণও সে পড়ছে না। মনে তার ভিন্নরকম চিন্তার ঝড়।
ভ্যান-এর পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন গত কয়েকদিন থেকে গোটা পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের রিপোর্ট গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তার কাছে পাঠাচ্ছে। এই ব্যবস্থা করা হয়েছে আংকারার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে।
গোয়েন্দা রিপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু দেখছে না আহমদ মুসা। উল্কিওয়ালাদের সুপারিশে তাদের বশংবদ হিসাবে ইজদির প্রদেশ ও আশে-পাশের কিছু অঞ্চলে যেসব সেনা অফিসার নিয়োগ পেয়েছিল তার তৎপরতার রিপোর্টও আসছিল আহমদ মুসার কাছে। তাদের তৎপরতায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে সব ব্যপারেই একটু বেশি সতর্ক মনে হয়।
তাদের চলাফেরায় ফ্রী-নেসটা আগের মত নেই। অন্যদিকে গোয়েন্দারা বড় কোন অস্বাভাবিক তৎপরতার খবর দিতে না পারলেও রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে মাউন্ট আরারাতের সেসব ক্যাম্পগুলোতে ভিজিটরের সংখ্যা বেড়েছে। আর গোটা ইজদির ও সন্নিহিত অঞ্চলে হঠাৎ করেই ফেরিওয়ালা, হোম সার্ভিস কোম্পানীর লোকজন ও খ্রীস্টান ধর্মগুরুদের আনা-গোনা বেড়েছে। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুসারে আনা-গোনার ফ্রিকোয়েন্সি আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। এসব তথ্য থেকে আহমদ মুসার মনে হচ্ছে এগুলো সবই গণসংযোগের কৌশল। কেন এই গণসংযোগ, তার জবাব আহমদ মুসার কাছে নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং সেটা বড় কিছু। মেন্দারিস মালিক বলেছে, ওরা এ অঞ্চলটা গ্রাস করতে চায়। কিন্তু সেটা কিভাবে? কোন একটা গ্রুপ কি এট পারে!
এসব চিন্তা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আহমদ মুসাকে। শেষ দিকে কফি খেতে ভুলে গেছে সে।
কিন্তু তার আচ্ছন্ন ভাব ছিন্ন হয়ে গেল পাশের টেবিলের দু’টি চেয়ার টানার কর্কশ শব্দে।
আহমদ মুসা তাকিয়ে দেখল, দু’জন যুবক এসে বসেছে পাশের টেবিলে। দু’জনের চেহারাই অদ্ভুত প্রকৃতির। তাদের চোখে-মুখে অপরাধের চিহ্ন। পরনেও তাদের কালো জিন্স ও কালো গেঞ্জি।
টেবিলে বসেই ভদকা ও কাবাব-রুটির অর্ডার দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভদকা, কাবাব-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং কথার ফুলঝুরি ছুটল তাদের মুখে।
একজন বলল, ‘খেয়ে নাও, খেয়ে নাও আমাদের দুঃখের দিন শেষ। অঢেল টাকা নয়, অঢেল সোনা আসবে আমাদের ঘরে।’
আহমদ মুসা সত্যিই পত্রিকা পড়া শুরু করেছিল। কিন্তু লোকটির এই কথাগুলো কানে যেতেই তার কান খাড়া হয়ে উঠল। অঢেল সোনা? কোত্থেকে? রহস্যের গন্ধ পেল আহমদ মুসা। আরেক কাপ কফির অর্ডার দিল সে।
পাশের টেবিলের প্রথম লোকটির খাওয়া শেষ হতেই দ্বিতীয় লোকটি বলে উঠল, ‘পূর্ণিমার সেই রাতটা কত দূরে, কয়দিন বাকি? সেদিন মাউন্ট আরারাতের সেই গোপন গুহার বহু শতাব্দীর গোপন মুখটা খুলে যাবে। বেরিয়ে আসবে স্বর্ণের ভাণ্ডার। ভাবতে অবশ্যই অবাক লাগছে। আসবে তো জুনের সেই পূর্ণিমার রাত? পাওয়া যাবে তো সেই গুহা? আছে তো সেখানে সেই স্বর্ণভাণ্ডার? বল ব্রাদার বল।’
‘এসব ফালতু চিন্তা বাদ দাও। এবার কোন ভুল হয়নি। আমি মি. ভারদার বুরাগের কাছে বিস্তারিত শুনেছি। খ্রীস্টপূর্ব ৫শ বছর আগের মিহরান মাসিসের আঁকা মাউন্ট আরারাতের সেই মানচিত্র এখন আমাদের হাতে। আজকের মত সেই সময়ের এক ভীষণ তপ্ত জুনে, যখন মাউন্ট আরারাতের হাজার ফিট পর্যন্ত বরফ গলে গিয়ে নুহের কিস্তি ও সব গুহার গোটা অবয়ব নগ্ন হয়ে পড়েছিল। সেই সময় আঁকা মাসিসের মানচিত্রটি। সেই মানচিত্র সামনে রেখে অত্যাধুনিক এ্যান্টি আইস ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবি থেকে নিখুঁতভাবে স্বর্ণভাণ্ডারের গর্তটি চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ‘গোল্ড সেনসেটিভ বিম ট্রান্সমিটার’ থেকে ‘রে’ ফেলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, অঢেল স্বর্ণের ভাণ্ডার সেখানে রয়েছে।’ বলল প্রথম লোকটি।
দ্বিতীয় লোকটি তার হাতের মদের গ্লাস টেবিলে রেখে হাত বাড়িয়ে প্রথম লোকটির সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘সোরেন, তোকে ধন্যবাদ। এত বড় একটা খবর তুই দিতে পারলি সেজন্য আমার ভাগ থেকে একটা অংশ স্বর্ণ তোকে বেশি দেব। কিন্তু আমরা নিরাপদে কাজটা করতে পারবো তো? শালার আর্মি বেটারা তো সারাক্ষণ চোখ রেখেছে পাহাড়টার উপর।’
সোরেন লোকটা তার হাতের আধা গ্লাস ভদকা গোটাটাই গলায় ঢেলে দিয়ে গ্লাসটা সশব্দে টেবিলে রেখে বলল, ‘আরে, এসব নিয়ে ভাবিস না। সব ব্যবস্থা পাকা-পোক্ত হয়েছে। আমরা যখন কাজ করব, তখন আর্মি স্বয়ং আমাদের পাহারায় থাকবে, আমাদের সাহায্য করবে।’
‘ফুলমুনটা আসতে আর কয়দিন বাতি, সোরেন? চাঁদের কয় তারিখ আজ? শালা দিন তো যাচ্ছে না।’ বলল আরেক নামের দ্বিতীয় লোকটা।
‘ফুলমুন যেদিন আসার সেদিনই আসবে। শালা আবার চাঁদের সহজ হিসাবটা ভুলে গেল।’ বলল সোরেন।
‘শালা, দুনিয়া ভোলার অবস্থা এখন, দিনের হিসাব দূরে থাক।’ আরেক নামের লোকটা বলল।
‘দুনিয়া ভুলে গেলেও সুন্দরী পার্টনারকে ভুলিস না।’ বলল সোরেন।
আরও একটা অশ্লীল কথা বলল।
ওদের আলোচনা অশ্রাব্য অশ্লীলতার দিকে টার্ন নিল।
আহমদ মুসার মুখ তখন অপার খুশিতো উজ্জ্বল। উল্কিওয়ালাদের দু’জনের সাক্ষাতই শুধু নয়, ওদের একটা বড় প্রোগ্রামেরও সন্ধান পাওয়া গেল এদের মাধ্যমে। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিল, ওদের ফলো করতে হবে। জানতে হবে ওদের ঠিকানা।
এক সময় ওরা উঠল। বেরিয়ে গেল ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে।
আহমদ মুসাও উঠল।
ওরা বেরিয়ে বেরিয়ে যাবার পর আহমদ মুসাও বেরুল রেস্টুরেন্ট থেকে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই আহমদ মুসা দেখল, ওরা দু’জন একটা লাল গাড়িতে উঠছে।
ওদের গাড়ি স্টার্ট নিল। রেস্টুরেন্টের কারপার্ক-লনটি অতিক্রম করে গাড়িটা রাস্তার দিকে এগোলো।
আহমদ মুসার গাড়িটিও স্টার্ট নিয়ে ছুটল গাড়িটার পেছনে।
রেস্টুরেন্টের বাইরের গেটের গেটম্যান আহমদ মুসার গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার গাড়িটা যখন গেট অতিক্রম করছিল, তখন গেটম্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার দৃষ্টি যে সামনের মোড়ে একটা রাস্তার বাঁকে আড়াল হতে থাকা লাল গাড়িটার দিকে নিবদ্ধ ছিল, সেটাও গেটম্যান তার দু’চোখ খুলে দেখার ও বুঝার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসার গাড়ি সামনের রাস্তার মোড়ে লাল গাড়িটার পথ ধরে চোখের আড়ালে চলে যাবার আগ পর্যন্ত গেটম্যান সেদিকে তাকিয়েছিল।
গেটম্যানের এই বাড়তি আগ্রহের কারণ কি, তা আহমদ মুসার জানার সুযোগ হলো না। আহমদ মুসার নজর সে সময় লাল গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে গেটম্যানের সন্ধানী চোখের দৃষ্টি তার চোখ এড়াত না।
আহমদ মুসার লক্ষ্য লাল গাড়ির ঐ দুই যুবককে অনুসরণ করে ওদের ঠিকানা জেনে নেয়া। তাই আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড় লাল গাড়িটার সমান রেখে সমান দূরত্বে থেকে ওদের অনুসরণ করে চলছে। অবশ্য মাঝে মাঝে গাড়ির গতির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। লাল গাড়ি চলছিল মাউন্ট আরারাতের উত্তরে পাহাড় পেরিয়ে। গাড়ি এগিয়ে চলছে এঁকে-বেঁকে সামনের দিকে। মাঝে মাঝেই সামনের লাল গাড়িটা হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আড়ালে। আহমদ মুসাকে তাই সামনের লাল গাড়িটাকে অনেক বেশি কাছ থেকে অনুসরণ করতে হচ্ছে। তবে পথের পার্বত্য অবস্থা সামনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আধা মাইলের মধ্যে একটা মোড় পাওয়া যাবে। পাহাড়ের পরেই এই মোড়টা। এটা রোড জংশনও। দক্ষিণের ভ্যান, দক্ষিণ-পশ্চিমের আগ্রি, উত্তর-পশ্চিমের কারস এবং উত্তরের ইজদির অঞ্চল থেকে আসা রাস্তা। সব এখানে এসে মিশেছে। আর অরিয়াস অঞ্চল থেকে আসা রাস্তা। সব এখানে এসে মিশেছে। আর অরিয়াস অঞ্চল থেকে যে রাস্তা এখানে এসে মিশেছে, সে রাস্তা দিয়ে তো আহমদ মুসারাই যাচ্ছে। একটা বিষয় ভেবে আহমদ মুসা খুশি হলো যে, লাল গাড়িটা যদি তার গাড়িকে খেয়াল করেও থাকে, পার্বত্য পথে ঢোকার পর তার গাড়ির কথা লাল গাড়িটা ভুলে যাবার কথা। এটাই যদি হয় তাহলে রোড জংশনের পর লাল গাড়িটাকে ফলো করা অনেকখানি সহজ হবে। আর যদি তার গাড়িটাকে লাল গাড়ি মনে রেখে থাকে, তাহলে জংশনের পর সমভূমির রাস্তায় লাল গাড়িকে অনুসরণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
আহমদ মুসার গাড়ি শেষ পাহাড়টার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে পাহাড়ের ছায়া থেকে।
সামনেই মোড়। মাত্র দু’শ-আড়াই’শ গজ দূরে।
আহমদ মুসা দেখল লাল গাড়িটা রোড জংশনটা পেরিয়ে কারসমুখী রাস্তায় ঢুকে গেল।
আহমদ মুসার গাড়ি রোড জংশনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এ সময় আহমদ মুসা দেখল বামে ‘ভ্যান’-এর দিক থেকে এবং ডানে ইজদির দিক থেকে দুটো গাড়ি তীব্র গতিতে ছুটে আসছে রোড জংশনের দিকে।
রোড জংশনে প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ি। তার সামনে পড়তেই দেখতে পেল কারসের রাস্তায় প্রবেশ করে সেই লাল গাড়িটা এ্যাবাউট টার্ন করে এদিকে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। আঘাতে ঘুমভাঙা বাঘের মত গোটা স্নায়ুতন্ত্রী এ সাথে জেগে উঠল। আহমদ মুসার মুখ থেকে আপনাতেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ‘ওরা আমাকে ট্র্যাপে ফেলেছে।’ পেছনে গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। তাকিয়ে দেখল, আরেকটা মাইক্রো পেছন দিক থেকে ছুটে আসছে। ওদের ট্র্যাপটা এবার সম্পুর্ণ হলো।
একটু ভাবল আহমদ মুসা। বিস্মিত হলো সে, এই আয়োজন ওরা কখন করল, কিভাবে করল? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, মাউন্ট আরারাতের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুবার জন্যে যখন গেটে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল, তখন তার দিকে চেয়ে থাকা গেটম্যানের দৃষ্টি অস্বস্তিকর লেগেছিল। তার হাতে একটা মোবাইলও ছিল। কিন্তু আহমদ মুসার চোখ লাল গাড়িটার পেছনে ছিল বলে গেটম্যানকে নিয়ে চিন্তা করার সে সময় পায়নি।
রোড জংশনের সার্কেলে প্রবেশ করে ডান বা বাম কোন দিকে টার্ন না নিয়ে গাড়ির ব্রেক কসেছে আহমদ মুসা। তার গাড়ির সামনে সার্কেলের দুই ফুট উঁচু আইল্যান্ড।
ট্র্যাপ থেকে বের হওয়া বা মোকাবিলা করার নানান কৌশল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আহমদ মুসার।
ডান বা বাম দিকের মাইক্রোকে ওভারটেক করে ডান বা বামের রাস্তায় যাবার সে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মাইক্রোর পাশ ঘেঁষে তাকে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে খুব কাছ থেকে মাইক্রোর গুলিবৃষ্টির মুখে সে পড়বে। এক হাতে ড্রাইভ করে অন্য হাতে গুলি চালিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। তাছাড়া বাম বা ডান যে দিক থেকেই সে বেরুবার চেষ্টা করুক, মাইক্রোকে সাহায্য করার জন্যে লাল গাড়িটা ছুটে আসবে। তার উপর আরেকটা বিপদও আছে। সেক্ষেত্রে সে পেছন থেকেও আক্রমণের শিকার হবে। এজন্যে পেছনের মাইক্রো তো আছেই। তার উপর যেদিকে সে যাবে, তার বিপরীত পাশের মাইক্রোও তার পিছু নেবে। সব দিক থেকে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার দশায় পড়বে।
এই অবস্থায় আহমদ মুসা আল্লাহ্’র উপর ভরসা করে আইল্যান্ডকে সামনে রেখে ওদেরকে প্রথমে আক্রমণে এনে আত্মরক্ষা ও আক্রমণের একটা কৌশল ঠিক করল।
আহমদ মুসার গাড়িটাও তার আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র হবে। কারণ এ গাড়িটা সেমি বুলেট গ্রুপ। গুলিবৃষ্টির মুখে তার গাড়ির সব কাঁচই ভেঙে যাবে, কিন্তু গাড়ির বডিকে কোন বুলেটই অতিক্রম করতে পারবে না। ভ্যান- এর পুলিশ প্রধান মাহির হারুন তাদের শ্রেষ্ঠ গাড়িটাই তাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে।
আহমদ মুসা তার পকেট থেকে মেশিন রিভলভারটা বের করে পাশে রাখল। দু’পাশ থেকে তার দিকে ছুটে আসা গাড়িগুলোকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে এ রিভলভার নয়, পয়েন্টেড গুলির জন্যে ভিন্ন রিভলভার দরকার। আহমদ মুসা তার মাথার পেছনে ঘাড়ের জ্যাকেটে রাখা মিনি রিভলভার হাতে নিল। এ রিভলভারের মিনি বুলেটে একটি করে পাওয়ারফুল বিস্ফোরক থাকে। এ রিভলভারই সে প্রথম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার আত্মরক্ষা ও আক্রমণের কৌশল কাজে লাগাবার জন্যে।
আইল্যান্ডকে সামনে রেখে গাড়ি ব্রেক কারার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আহমদ মুসার এই কৌশল-চিন্তা ও প্রস্তুতির কাজ শেষ হয়ে গেল।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়াবার পর মুহূর্তকাল দ্বিধা করেছে মাইক্রো দু’টো, তারপ দ্রুত ছুটে আসতে লাগল আহমদ মুসার গাড়ির দিকে। দু’দিক থেকে এসে মাইক্রো দু’টি আহমদ মুসার গাড়িকে স্যান্ডউইচ বানাতে চায়, এ রকমই একটা ভাব গাড়ি দু’টির গতিতে।
দু’টি গাড়িকেই আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে। তার রিভলভার প্রস্তুত। ট্রিগারে তর্জনি। দুই মাইক্রোকে থামাতে হলে তাকে দু’টি গুলিই করতে হবে মুহূর্তের ব্যবধানে।
বাম দিকের মাইক্রোর মাথাটাই প্রথম আইল্যান্ড থেকে বেরিয়ে এল। আহমদ মুসার চোখ গিয়ে পড়ল মাইক্রোর সামনের বাম চাকাটার উপর। এই চাকাই তার টার্গেট। এই চাকা ভেঙে পড়লে গাড়িটা নির্ঘাত আইল্যান্ডের সাথে ধাক্কা খাবে। চাকাটা দেখার সাথে সাথে তার তর্জনি চেপে বসল রিভলভারের ট্রিগারে। পরক্ষণেই মাইক্রোটার সামনের বাম চাকা বিস্ফোরিত হলো প্রচন্ড শব্দে। মাইক্রোটা কিছুটা কাত হয়ে বামে বেঁকে গিয়ে আঘাত করল আইল্যান্ডকে।
আহমদ মুসা গুলি করেই হাতের রিভলভার ঘুরিয়ে নিয়ে টার্গেট করল ডান দিকের মাইক্রোকে।
মাইক্রোটা সম্পূর্ণটাই আইল্যান্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসার রিভলভারের গুলি আগের মতই এ মাইক্রোর সামনের ডান চাকায় আঘাত করল। চাকা বিস্ফোরিত হবার সাথে সাথেই দ্রুত গাড়ির মাথাটা ডান দিকে বেঁকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল আইল্যান্ডের দেয়ালে।
আইল্যান্ডে ধাক্কা খাওয়া গাড়ি থেকে নামতে ওদের দেরি হবে। এই সুযোগে গাড়ি চালিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে ওদের ট্রাপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করল আহমদ মুসা।
দুই হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে, এসময় পেছরে আছে। দুই মাইক্রোর অবস্থা দেখেই সম্ভবত পেছনের গাড়িটা গুলি করতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট করল।
পেছনের গুলিবৃষ্টির মধ্যে দিয়েই তাকে এখনি এই ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। দুই মাইক্রো থেকে ওরা বেরিয়ে এলে তাকে ত্রিমুখি গুলিবৃষ্টির মুখে পড়তে হবে।
কিন্তু সময় পেল না আহমদ মুসা। গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার আগেই সে দেখল গুলিবৃষ্টিসহ পেছনের মাইক্রোটি তীব্র বেগে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাইক্রোটির আঘাত এড়িয়ে কোন দিকে গাড়িটা সরিয়ে নেবার সুযোগ নেই তার। ডান ও বাম পাশে দু’টি গাড়ি আইল্যান্ডে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের এড়িয়ে পথ করে নিতে হলে তার যতটা সময় ও সুযোগ দরকার, সেটা পেছনের মাইক্রো অসম্ভব করে দিয়েছে। মাইক্রোটি তার গাড়ির উপর এসে পড়ল। ওরা আজ যেভাবে হোক আহমদ মুসাকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোঝা যাচ্ছে।
গাড়ি থেকে তার নেমে যাবারও কোন উপায় নেই। দু’পাশের দুই মাইক্রো থেকে লোক বেরিয়ে আসছে অস্ত্র হাতে। নামলেই ওদের গুলির মুখে পড়তে হবে।
‘হাসবুনাল্লাহ্’ বলে চোখ বন্ধ করল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই পিছন দিক থেকে শব্দ কানে এল প্রচণ্ড বিস্ফোরণের। চমকে উঠে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
পেছনে তাকিয়ে দেখল পেছনের মাইক্রোটি দাউ-দাউ করে জ্বলছে। মাইক্রোটি তার গাড়ি থেকে মাত্র গজ তিন-চারেক দূরে এসে থেমে পড়েছে।
বিস্মিত আহমদ মুসা দু’পাশে তাকাল। দেখল, ডান ও বামের মাইক্রো থেকে লোকরা নেমে পড়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান। ডান পাশের মাইক্রোর লোকরাই আগে নেমেছে। ছুটে আসছে ওরা। আহমদ মুসাকে দেখতেও পেয়েছে। সংগে সংগেই ওদের স্টেনগান উপরে উঠল। আহমদ মুসার হাতের মেশিন রিভলভার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তর্জনি ছিল রিভলভারের ট্রিগারে। তর্জনি তার চেপে বসল ট্রিগারে। অব্যাহত গুলির বৃষ্টি ছুটে চলল স্টেনগানধারী ছয় সাতজন লোকের দিকে।
কিন্তু এই সময়ে বাম দিক থেকে অব্যাহত গুলিবৃষ্টি শুরু হলো। গুলি গুলো এসে ছেঁকে ধরল আহমদ মুসার গাড়িক।
গুলী বন্ধ করে নিরুপায় আহমদ মুসা ‘হাসবুনাল্লাহু নি’মাল ওয়াকীল, নি’মাল মাউলা ওয়া নি’মান নাসীর’ বলে শুয়ে পড়েছে গাড়ির মেঝেতে। তার এখন করণীয় কিছু নেই। ডান দিকের অস্ত্রধারীদের প্রতি তার গুলিবৃষ্টি কী ফল দিয়েছে, সেটা দেখারও সময় পায়নি আহমদ মুসা। তবে সেদিক থেকে কোন গুলি আসছ না।
গাড়ির ফ্লোরো আশ্রয় নেবার পর মুহূর্তও পার হয়নি, আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। এবার বিস্ফোরণটা বাম পাশে, একদম কাছেই হলো।
বিস্ফোরণের সাথেই বাম দিকের গুলিবৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল।
পার হলো কয়েক মুহূর্ত।
ফ্লোর থেকে উঠল আহমদ মুসা। গাড়ির সীটে বসে তাকাল বাম দিকে দ্বিতীয় বোমা বিস্ফোরণের স্পটের দিকে। দেখতে পেল অনেকগুলো মানুষের ছিন্ন-ভিন্ন দেহ। বাঁচার মত কাউকে মনে হলো না। তাকাল ডান দিকে। দেখল, তার গুলিতে কাজ হয়েছে। ওরা দৌড়ে সার বেঁধে ছুটে আসছিল। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে ওরা সারবেঁধেই পড়ে আছে।
কিন্তু তাকে রক্ষার জন্যে দু’টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটাল কে? বিস্ফোরণ দু’টি সাক্ষাত আল্লাহ্’র সাহায্য হিসাবে এসেছে। কিন্তু আল্লাহ্ কাকে দিয়ে এই সাহায্য করালেন? কে সে?
দুই হাতে দুই রিভলভার নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল, পেছনের জ্বলন্ত মাইক্রোর পাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে মেন্দারিস মালিক। তারও হাতে রিভলভার।
আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়ে সে ছুটে এল।
‘কেমন আছেন আপনি? ভালো তো? ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলাম আপনাকে নিয়ে। আল্লাহ্’র হাজার শোকর যে আপনাকে দেখতে পেলাম। ওরা আট-ঘাট বেঁধে পরিকল্পনা করেছিল।’ আহমদ মুসার সামনে এসে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল মেন্দারিস মালিক।
আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল, ‘আমাকে বাঁচানোর জন্যেই আল্লাহ্ আপনাকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ্’র মূর্তিমান সাহায্য হিসাবে আপনি এসেছেন। আল্লাহ্’র হাজার শোকর। আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘আপনি নিজেকে নিজেই বাঁচিয়েছেন।’
‘ডান ও বাম পাশের মাইক্রো দু’টিকে যদি আপনি অকেজো করে দিতে না পারতেন, তাহলে গাড়ি সমেত আপনাকে ওরা পিশে ফেলত। আবার ডান পাশের বন্দুকধারীদের আপনি ঠিক সময়ে ঠেকিয়েছেন। ওরা আপনার গাড়ির এত কাছে এসে পড়েছিল যে আমি দূরে থেকে জ্বলন্ত মাইক্রোর উপর দিয়ে ওদের উপর বোমা ফেলতে সাহস পাইনি।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘কিন্তু পেছনের মাইক্রো আমাকে তো প্রায় শেষ করেই ফেলেছিল। আপনার বোমা ঠিক সময়ে মাইক্রোকে আটকে দিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ্’র হাজার শোকর। আমি অনেকটা পেছন থেকে মাইক্রোর উপর বোমাটি ফেলেছিলাম। ভয় ছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায় কিনা। কিন্তু আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করেছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ্।’ মেন্দারিস মালিক বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্। যদি আপনি বাম পাশের গুলিবৃষ্টিরত বন্দুকধারীদের উপর ঠিক সময়ে বোমা না ফেলতেন, তাহলে কিন্তু আমার বাঁচা দায় হতো। আমাকে পাল্টা গুলি করার সুযোগ ওরা দিত না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটাও ছিল ভাগ্য। আমি যেখান থেকে শূন্য দিয়ে লক্ষ্য ছাড়াই জ্বলন্ত মাইক্রোর উপর দিয়ে বোমাটি ছুঁড়েছিলাম, তা পয়েন্টেড ছিল না। সেটা যে অস্ত্রধারীদের মাঝখানে পড়েছে, সেটা আমি বলছি লাক।’
থমল মেন্দারিস মালিক মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই বলল, ‘চলুন দেখি ওদের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা।’
‘চলুন।’ বলল আহমদ মুসাও।
হাঁটতে শুরু করে আহমদ মুসা টেলিফোন করল ডিজিপি মাহির হারুনকে। তাকে এখানকার সব ঘটনা জানাল সংক্ষেপে। ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো।’ তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি কিছু লুকাইনি মি. মাহির হারুন। আমি ভালো আছি। তবে স্নেক গ্রুপের একজন সদস্য সাহায্য না করলে আমি এভাবে কথা বলার অবস্থায় বোধ হয় থাকতাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্নেক গ্রুপ? ও তো কিলার গ্রুপ। তারা আপনাকে সাহায্য করল? কিভাবে। কেন?’ জিজ্ঞাসা ডিজিপি মাহির হারুনের।
‘স্নেক গ্রুপ কিলার ঠিকই। কিন্তু মি. মাহির হারুন, মানুষই কিলার হয়, কিলার মানুষও হতে পারে। সেই একজন মানুষই আমাকে সাহায্য করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হতে পারে। শুনেছি, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম সৈনিকদের হিংস্র প্রাণীরাও সাহয্য করতো। আপনি কিলারকে মানুষ করবেন, সেটা স্বাভাবিক। ধন্যবাদ। আমি আসছি। তাকে আমি ধন্যবাদ দেব। আমি ইজদির পুলিশকেও বলছি ওখানে যাবার জন্যে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘আসুন। ধন্যবাদ। আস্-সালামু ‘আলাইকুম।’
আহমদ মুসা মোবাইলের কল অফ করে মেন্দারিস মালিককে বলল, ‘ডিজিপি মাহির হারুন আসছেন। ইজদির পুলিশকেও উনিই জানাবেন। ডিজিপি মাহির হারুন খুব খুশি হয়েছেন আপনার উপর। উনি নিজেই আপনাকে ধন্যবাদ দেবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সত্যিই আমি মানুষ হতে পারব মি. আবু আহমদ?’ আহমদ মুসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আপনি মানুষই আছেন। পশুত্ব বা শয়তানের কিছু গুণ আপনার মনুষত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আপনার জেগে ওঠা মনুষত্ব সে অপশনগুলোকে উচ্ছেদ করেছে। ফেরেস্তারা যাকে সিজদা করেছিল, সেই মানুষই আপানি এখন হয়ে গেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
হঠাৎ মেন্দারিস মালিক আহমদ মুসার দুই হাত চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘এই মানুষ হওয়ার সৌভাগ্য কি আমার হবে? আমি কত লোককে হত্যা করেছি, সে সংখ্যা আমি বলতে পারবো না। আমার নিষ্ঠুরতার জন্যেই দলের নেতৃত্ব আমি পেয়েছি। আমার এই সীমাহীন পাপ কি আল্লাহ্ মাফ করবেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহ্ দয়ার অন্তহীনতা সম্পর্কে জানলে এই কথা আপনি বলতেন না। গোটা মানব জাতির পাপের সমষ্টি আল্লাহ্’র দয়ার সমুদ্রের তুলনায় একটা বারি-বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়। দেখুন, আল্লাহ্’র এক নাম ‘রহমান’, আরেক নাম ‘রহীম’। দুই নামেরই অর্থ ‘দাতা’, ‘দয়ালু’। কিন্তু তাঁর এই দুই দয়ার ক্ষেত্র ভিন্ন। তিনি রহমান, কারণ অপরাধী, পাপী, তাকে অস্বীকারকারী, তার ধর্মের শত্রু, কাফের, ফাসেক নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি তাদের প্রত্যেককেই আহার দেন, আশ্রয় দেন। তাদের কাউকেই তিনি দিনের আলো, উপকারী বাতাস, জীবন ধারনের পানি এবং সুখ-ভোগ থেকে বঞ্চিত করেন না। না চাইতেই সকল মানুষকে তিনি এই সব নিয়ামত দান করেন। আর রহীম তিনি এই কারণে যে, তিনি অসীম ক্ষমাশীল এবং বেনজীর দাতা। অপরাধ করে মানুষই। আর তার পাপের বোঝা যতবড়ই হোক, মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে বিনীতভাবে মহান আল্লাহ্’র সামনে দাঁড়ায় ক্ষমার জন্য, তিনি ক্ষমা করে দেন। মানুষ তখন তার প্রয়োজন নিয়ে হাজির হয় তাঁর কাছে, প্রার্থনা করে তার আশা পূরণ হওয়ার জন্যে, তখন তিনি তার আশা পূর্ণ করেন। তিনি তার বান্দাহ্ মানুষকে ভালোবাসেন, তাই তিনি চান মানুষ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাক, মানুষ তার কল্যাণের প্রয়োজন নিয়ে তার সামনে দাঁড়াক, প্রার্থনা করুক, আবেদন করুক অভাব পূরণের। তিনিই আমাদের মহান আল্লাহ্, মাহামহিম স্রষ্টা এবং অসীম দয়ালু প্রতিপালক। মি. মেন্দারিস মালিক আপনার পাপ তাঁর দয়ার মহাসিন্ধুর কাছে কিছুই নয়। বান্দাহ্ তাঁর দরবারে শুধু হাজির হওয়ার অপেক্ষা মাত্র, তিনি দু’হাত বাড়িয়ে আছেন বান্দাকে মাফ করার জন্যে, তার চাওয়া পূরণের জন্যে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই মেন্দারিস মালিক সিজদায় পড়ে গেল। কাঁদল অনেক সে।
যখন সিজদা থেকে সে উঠে দাঁড়াল, তখন অনেক শান্ত সে। আশার ঔজ্জ্বল্য তার চোখ। স্বস্তির স্নিগ্ধতা তার চেহারায়।
‘খোশ আমদেদ নতুন মেন্দারিস মালিক।’
স্বাগত জানাল আহমদ মুসা মেন্দারিস মালিককে। তার চোখে-মুখে আনন্দ।
‘মেন্দারিস মালিক যদি নতুন মানুষ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে থকে, তাহলে তার রূপকার আপনি। আল্লাহ্ আপনাকে এর যাযাহ্ দান করুন।’ বলল মেন্দারিস। গম্ভীর ও ভারি তার কণ্ঠ।
‘আলহামদুলিল্লাহ্। চলুন এবার আমরা আমাদের কাজ শুরু করি।’ বলল আহমদ মুসা মেন্দারিস মালিককে লক্ষ্য করে।
‘চলুন।’ বলে হাঁটতে শুরু করল মেন্দারিস মালিক।
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছিল আগেই।
একে একে সবগুলো বডিই সার্চ করল দু’জনে মিলে। কিন্তু তাদের পকেটে মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছু মিলল না।
মানিব্যাগগুলোতে শুধু টাকাই দেখা গেল। মাত্র একটা মানিব্যাগে টাকার সাথে সাদা কাগজের একটা শীট চারভাঁজ করা অবস্থায় পাওয়া গেল। মানিব্যাগটা ছিল সামান্য কিছু টার্কিশ নোট ছাড়া সবটা ডলারে ভর্তি। হতে পারে মানিব্যাগটা ছিল তাদের এই মিশনের নেতার। টাকা বিলি-বন্টনের নোট রাখার জন্যে কি ছিল সাদা কাগজের শীটটা!
টাকা সমেত মানিব্যাগটা তার পকেটে রেখে দিয়ে কাগজের শীটটা আহমদ মুসা নিজের কাছে রাখল, সাদা কাগজ দরকার হতে পারে এই ভেবে।
‘সোহা ও হোলি আর্কগ্রুপের লোকরা দারুণ সতর্ক। এরা অপরাধ করে, কিন্তু তাদেরকে ধরার মত কোন চিহ্ন রেখে যায় না।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আপনি সেদিন বলেছিলেন ওদের দলের নাম জানেন না, এখন যে নাম বললেন?’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল মেন্দারিস মালিক। বলল, ‘আপনার সাথে সেদিন কথা বলার পর আমি ওদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। কিছু জানতে পেরেছি।’
‘দলের নাম ছাড়া আর কী জানতে পেরেছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তেমন কিছু নয়। তবে আমার মনে হয়েছে শীঘ্রই বড় কিছু ঘটাতে যাচ্ছে ওরা। খুবই ওভার কনফিডেন্ট ওরা যে, ওদের বাধা দেবার সাধ্য কারও নেই। ওরা বলেছে, এটা ওদের শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় তাদের হাজার হাজার বছরের স্বপ্ন সার্থক করবে।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘কি তাদের যুদ্ধ, কি ঘটাতে চায় তারা?’ আহমদ মুসার স্বাগত কণ্ঠের জিজ্ঞাসা।
‘আমিও বুঝতে পারিনি। আজকাল ওরা খুব সাবধান হয়েছে। ওরা কাজ করার জন্যে লোকও পাল্টাচ্ছে। যাদের আমি চিনতাম। তাদের দেখা যায় না।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আপনি কখন কিভাবে আমাদের ফলো করলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ক’দিন ধরে রেস্টুরেন্টে আসছি। আমি জানতাম, ওদের সন্ধানে আপনিও সেখানে আসবেন। মুখে খ্রীস্টান সন্যাসীদের মত দাড়ি নিয়ে আজও এসেছিলাম। এসেই দেখলাম আপনাকে। মদ্যপ দু’জনের কথা আমিও শুনেছি একটু দূরে বসে। আপনি ওদের ফলো করলে আমিও উঠলাম। গাড়ি নিয়ে এলাম গেটে। আমি জানতাম বুদ্ধিমান গেটম্যান ওদের টাকা খায়। আমি গেট পার হবার সময় গেটম্যানকে ওদের স্টাইলে হাত নেড়ে বললাম, ‘মাসিস মুক্ত হোক।’ ওরা মাউন্ট আরারাতকে ‘মাসিস’ বলে। ওরা একে অপরকে দেখলে এই কথা বলেই স্বাগত জানায়। আমার কথায় গেটম্যান আমাকে তাদের লোক বলে ধরে নিল। আমাকে ইংগিতে দাঁড়াতে বলল। দাঁড়ালে সে বলল, ‘আপনাদের দু’জন লোককে একজন লোক ফলো করেছে। এটা আমি জানিয়ে দিয়েছি সবাইকে।’ আমি উদ্বিগ্ন হলাম। নিশ্চয় আপনি বিপদে পড়বেন। আমি পিছু নিলাম আপনাদের। অর্ধেক পথ এগোনোর পর আমি দেখলাম একটা রোড ক্রসিং-এর ডান দিকের একটা রাস্তা থেকে একটা মাইক্রো প্রবল বেগে ছুটে এসে আপনার পিছু নিল। আমার গাড়িতে একটা সমস্যা থাকায় তার মত স্পিডে আমি চলতে পারলাম না। কিন্তু পিছু ছাড়লাম না আপনাদের।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। শব্দ আসল ইজদির দিক থেকে।
‘তাহলে ইজদির থেকেই প্রথমে আসছে পুলিশ। ডিজিপি মাহির হারুনের আসতে দেরি হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডিজিপি সাহেব কি ‘ভ্যান’ থেকে আসবেন?’ জিজ্ঞাসা মেন্দারিস মালিকের।
‘না। আগ্রিতে এসেছেন উনি, ওখন থেকেই আসবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো তাড়াতাড়িই এসে পড়তেন।’ বলল মেন্দারিস মালিক।
‘আসুন আমার গাড়িতে বসি। গাড়ির সামনের ও পেছনের কাঁচ ভেঙেছে। গুলিতে বাইরেরও ক্ষতি হয়েছে। তবে ভেতরে বসা যাবে। আসুন।’
বলে আহমদ মুসা চলল তার গাড়ির দিকে।
মেন্দারিস মালিকও চলল তার সাথে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top