১
মিসেস গাজেনের বাড়িটা সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স। নিচের তলাতে থাকে আয়া ও পরিচারিকা। রান্না-বান্না, ষ্টোর সব নিচ তলাতেই। সব মিলিয়ে নিচ তলায় ৫টি ঘর।
নিচ তলা থেকে সার্চ শুরু করেছিল আহমদ মুসা।
কাজে লাগতে পারে এমন কিছুই পেল না সে নিচ তলায়।
নিচ তলায় সিঁড়ির গোড়ায় বড় একটা লাউঞ্জর মত জায়গা। নিচ তলার কেন্দ্র এটাই। এখান থেকে রান্নাঘর, স্টোর, ড্রয়িং, শোবার ঘর সবই দেখা যায়। এখানে দোল খাওয়া একটা ইজি চেয়ার।
আহমদ মুসা আয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ ইজি চেয়ারটা কার?’
সার্চের সময় আয়া ও পরিচারিকাকে আহমদ মুসা সাথেই রেখেছিল।
‘এখানে ম্যাডাম বসতেন। ছুটির দিন কিংবা অফিস থেকে আসার পর বিকেলে এখানে বসতেন। আমরা কাজ তরতাম, আর তিনি বসে বসে দেখতেন এবং গল্প করতেন।’ আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে বলল আয়া।
পরিচারিকা ও আয়া দু’জনেই মধ্যম বয়সের। পরিচারিকা গোবেচারা চেহারার, কিন্তু আয়ার চোখ-মুখ খুব শার্প। আর্মেনীয়, না তুর্কি বুঝা মুশকিল। তবে কথায় আর্মেনীয় টানটা একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়।
‘মিসেস গাজেন ছুটি ও অবসর আর কিভাবে কাটাতেন আয়া?’ জিজ্ঞাসা আহমেদ মুসার।
‘লিখে-পড়ে তিনি সময় কাটাতেন,’ বলল আয়া।
‘কি লিখতেন?’ জিজ্ঞাসি আহমদ মুসার।
‘‘দৈনিক ভ্যানের নিকল’-এ নিয়মিত তিনি ছদ্মনামে কলাম লিখতেন।’ আয়া বলল।
‘তাঁর সে কলামের কি কোন কালেকশন আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে অবশ্যই। তার স্টাডিতে পাওয়া যেতে পারে।’ আয়া বলল।
‘নিচের কাজ শেষ। চলুন উপরটা দেখব।’
বলে আহমদ মুসা ইজি চেয়ার ক্রস করে সিঁড়ির দিকে যাবার সময় ইজি চেয়ারের পেছনের ‘সেফারস প্লেট’ তার নজরে পড়ল। প্রস্তুতকারী প্রতাষ্ঠানের নামটাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। টার্কিস হরফে ‘আডিরা ফার্নিচারস’। ‘আডিরা’ হিব্রু শব্দ। অর্থ- ‘শক্ত’, ‘শক্তিশালী’। সেফারস প্লেটে একটা মনোগ্রাম। বহুকোণ বিশিষ্ট তারার মধ্যে আর্টিস্টিক কায়দায় হিব্রু অক্ষরে আডিরা লেখা।
হঠাৎ আহমেদ মুসার কি মনে পড়ল। একটু ঘুরে সামনে গিয়ে ইজি চেয়ারের একটা হাতলের উপর চোখ ফেলল। তার সন্দেহ ঠিক। এগুলোও হিব্রু অক্ষর। এগুলোও হিব্রু অক্ষর। উপর থেকে নিচে একটি করে অক্ষর বেশ স্পেস দিয়ে লেখা হয়েছে। মোট চারটি অক্ষর। চারটি অক্ষরকে একত্রিত করলে একটা শব্দ হয়ে যায়। সেটা হলো হিব্রু ‘বাটিয়া’ শব্দ যার অর্থ ‘ঈশ্বরের কন্যা’।
এগুলো নিশ্চয় মিসেস গাজেনের হাতের লেখা, তাহলে হিব্রু তিনি জানতেন, ভাবল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
আপনাতেই আহমদ মুসা বলল, ‘একটা কিছু লেখা দেখলাম। কিন্তু বুঝলাম না।’ বলেই আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে চলল।
উপরে উঠে এল আহমদ মুসা আয়াকে সাথে নিয়ে।
উপরে চারটি রুম। একটা ড্রইং, একটা মাস্টার বেড, একটি অতিথি কক্ষ এবং একটি স্টাডি রুম। মাস্টার বেড রুমের সাথে আরেকটা ছোট কক্ষ আছে। ওটা ড্রেসিং রুম।
মাস্টার বেডে ঢুকেই আহমেদ মুসা দেয়ালে দেখল একটা ছবি টাঙানো। নবযৌবনা এক মহিলা।
‘মিসেস গাজেনের ছবি, না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা আয়াকে।
‘জি হ্যাঁ, অনেক আগের ছবি তাঁর।’ বলল আয়া।
‘তোমার ম্যাডাম তো খুবই সুন্দরী, বিয়ে করেননি কেন? মিসেসই বা হলেন কেমন করে?’ ছবির দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল আয়া। তারপর বলল, ‘স্যার, এটা তার পার্সোনাল ব্যাপার। তিনি কোন দিন বলেননি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। তবে আমি শুনেছি, তিনি প্রথম যৌবনে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। কিন্তু এসব নিয়ে তার কোন দুঃখবোধ ছিল না। তিনি নিজেকে ‘ডটার অব গড’ ভাবতেন। যতদূর জানি, তাঁর মিসেস লেখার কারণ মানুষের কৌতুহল থেকে নিজেকে রক্ষা করা।’
‘উনি কোন ধর্ম অনুসরণ করতেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমি তাঁকে কোনদিন কোন ধর্মশালায় যেতে দেখিনি। বাড়িতে কোন ধর্মগ্রন্হও আমার চোখে পড়েনি।’
আয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা আয়ার সহযোগিতায় শোবার ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কাগজ-পত্র, খাতা-ডাইরি এসবই তার লক্ষ্য ছিল। আলমারি, ড্রয়ার, সবই দেখা হয়ে গেল। কিছুই পাওয়া গেল না।
স্টাডি রুমটাও দেখা গেল ফাঁকা। কিছু বই কিছু ফাইল ছাড়া কিছুই নেই। বইয়ের অধিকাংশই ইতিহাস বিষয়ক। প্রত্নতত্বের উপর কিছু বই আছে। চরিত্রের দিক দিয়ে বইগুলো সবই একাডেমিক ও প্রফেশনাল। ফাইলগুলো দুই ধরনের। তাঁর লেখার কালেকশান, অন্যদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিষয়ক অন্য লেখকদের লেখা একটি কালেকশন। মিসেস গাজেনের লেখার কিছু শিরোনাম দেখে বুঝল তার লেখার মূল বিষয় হলো, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে জাতিগত বিভেদের বিলোপ সাধন। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। মিসেস গাজেনের নাম খ্রীস্টান ধর্মযাযিকার হলেও তিনি লেখেন ইহুদি স্বার্থের পক্ষে। ইহুদিদের তথাকথিত মানবতাবাদের রাজনীতিকরা চাচ্ছে, দুনিয়ার সব ধর্ম ও সব জাতির বিলয় ঘটু। শুধু টিকে থাকুক বনি ইস্রাইল জাতি ও তাদের ইহুদি ধর্ম।
অবশ্য আহমদ মুসা স্বীকার করল তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের রাজনীতিতে মিসেস গাজেনের ভূমিকা খৃস্টানদের পক্ষে গেছে। কারণ এ অঞ্চলে তুর্কি স্বতন্ত্রের বিলুপ্তির পর হবে তুর্কি শাসনের বিলুপ্তি। মাউন্ট আরারাতকেন্দ্রিক পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়ার যে নীল-নকশা তার বাস্তবায়নের জন্যে এমন একটা পরিস্থিতিই দরকার।
কিছু বই, বইয়ের র্যাক, টেবিল, টেবিলের ড্রয়ার ও একটা কম্পিউটার ছাড়া স্টাডিতে আর কিছু নেই।
আহমদ মুসা কম্পিউটার চেক করল। কম্পিউটারে মাত্র কয়েকটি ফাইল আছে। ফাইল সবই লেখা এবং লেখা সংক্রান্ত তথ্যবিষয়ক। কোন গোপন ফাইল কম্পিউটারে নেই।
ড্রইংরুম ও গেস্টরুমও দেখা হয়ে গেছে। সেদু’টি রুম আরও ফাঁকা।
কোথাও কোন কিছু না পাওয়াই প্রমাণ করেছে, বিষয়টা অস্বাভাবিক। মিইজিয়ামে রক্তাক্ত অভিযানে জড়িতদের সাথে মিসেস গাজেনের যোগসাজশ, তার হিব্রু জানা, জিউইশ ব্যাকগ্রাউন্ডর ভ্যান-ক্রনিকল পত্রিকায় লেখা, তার নাম, তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে বড় কোন বিষয়ের সে একটা গ্রন্হি। যদি তাই হয়, তাহলে এর পরিচয় কোথাও না কোথাও সে রাখবে। সে ‘কোথাও’ টা কোথায়?
এ সম্পর্কে জানার হাতের কাছে একমাত্র মাধ্যম হলো আয়া মেয়েটা। এই বুদ্ধিমতি, চালাক মেয়েটা কিছুই জানে না, তা হতে পারে না।
আহমদ মুসা আয়া মেয়েটাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিসেস গাজেনকে না জানলে, হত্যাকারীদের মোটিভ বুঝা যাবে না। হত্যার মটিভ না জানলে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা মুষ্কিল। কিন্তু মিসেস গাজেনের পরিচয়মূলক কিছুই তো পেলাম না।’
মেয়েটার চোখে-মুখে চাঞ্চল্যের প্রকাশ ঘটল। বলল, ‘স্যার একটা জায়গা অবশিষ্ট আছে, কিন্তু…।’
‘কিন্তু কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার, বিষয়টা আমি পরিষ্কারভাবে জানি না। শোবার ঘরের আলমারির নিচ থেকে একটা কিছু বের করতে দেখেছি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
‘কি ধরনের জিনিস বের করতে দেখেছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ছোট আয়তাকার বাক্সের মত।’ বলল আয়া মেয়েটা।
‘চলুন তো দেখি।’ বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দু’জনে মাস্টার বেডে ঢুকে আলমারির গোড়ায় গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা নিজেই একটা স্টিক দিয়ে আলমারির নিচের জায়গাটা এদিক-ওদিক দেখল। কাঠিতে কিছুই বাঁধলো না।
এবার আহমদ মুসা আলমারির নিচটা হাত দিয়ে হাতড়াল। আলমারির তলা ও মাটির মধ্যবর্তী স্থান গোটাই ফাঁকা।
আরেকটা জিনিস দেখে বিস্মিত হলো। সেটা আলমারির বটমে দু’পাশ থেকে দূরত্বের ঠিক মাঝখানে আলমারির ‘মেকারস প্লেট’ লাগানো। আহমদ মুসার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হলো না। এ প্লেট সাধারণত আলমারির মাথায় লাগানো তাকে, যাতে সহজে মানুষের চোখে পড়ে। আরেকটা জিনিসও বিদঘুটে ঠেকল। মেকারস প্লেটটা অবস্থানগত ভারসাম্যের দিক দিয়ে যেখানে লাগানো দরকার ঠিক তার দুই তিন ইঞ্চি উপরে লাগানো। অন্য একটি বিষয় হলো, আলমারির দরজার নিচের কাঠামোটা যার সাথে আলমারির খুরা রয়েছে, সেটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চওড়া।
এ সবের সাথে কি আলমারির নিচ থেকে আয়তাকার বাক্স বের করার কোন সম্পর্ক আছে?
মেকার্স প্লেট নেড়েচেড়ে দেখার সময় দু’আঙুল দিয়ে দুই প্রান্তে চাপ দিল। সংগে সংগে প্লেটটি খসে পড়ে গেল। প্লেটটি চুম্বকে আটকে ছিল, বুঝল আহমদ মুসা।
মেকার্স প্লেট সরে গেলে সেখানে প্লেটটির আকার থেকে কিছুটা ছোট আয়তাকার একটা উইনডো বেরিয়ে এল। সেই উইনডো পথে সবুজ রংয়ের আংটার মাথা দেখা গেল।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চিত হলো সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
আংটা ধরে টান দিতেই ইঞ্চি খানেক বেরিয়ে এল। সংগে সংগেই কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো আলমারির তলায়।
আহমদ মুসা আলমারির তলায় হাত দিয়ে স্টিলের আয়তাকার একটা বাক্স বের করে আনল।
আয়া মেয়েটি আনন্দে বলে উঠল, ‘স্যার, এই বাক্সই আমি ম্যাডামের হাতে দেখেছি।’
আহমদ মুসা ঢাকনা খুলে দেখর বাক্সে একটা ডাইরি রয়েছে।
আহমদ মুসা আয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘বাক্সে একটা ডাইরি দেখে যতটা খুশি হয়েছি, বাক্স ভর্তি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হীরা পেলেও এত খুশি হতাম না। আপনি সাহায্য করেছেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ নয় স্যার, ম্যাডামের হত্যাকারীরা শাস্তি পেলেই আমি খুশি হবো।’ বলল আয়া মেয়েটা।
‘অবশ্যই ওরা শাস্তি পাবে।’ বলে উঠে দাঁড়ার আহমদ মুসা।
‘আমরা কী করব স্যার, আমাদের কী হবে?’ বলল আয়া।
‘আপনারা যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকবেন। আপনাদের কোন ভয় নেই। আপাতঃত পুলিশ পাহারা তো থাকছেই।’ আহমদ মুসা বলল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
একটা প্রাইভেট বাড়িকে আহমদ মুসা তার অফিস বানিয়েছে। ডিজিপি মাহির হারুন ও অন্যদিকে ড. আজদা, সাবিহা সাবিত, ড. সাহাব নূরী, ড. মোহাম্মাদ বারজেনজো ছাড়া এই বাড়ির নতুন পরিচয়ের খবর আর কেউ জানে না।
ড. মোহাম্মদ বারজেনজো সেই রাতের ঘটনার পর জরুরী প্রয়োজনে ইস্তাম্বুল গিয়েছিলেন।
সেই প্রাইভেট হাউস মানে আহমদ মুসার অফিসে তার বিশ্রাম কক্ষে আহমদ মুসা সেই ডাইরী নিয়ে বসেছে।
ডাইরির পাতা উল্টাচ্ছে আহমদ মুসা। ঠিক ডাইনী নয় এটা। বিচ্ছিন্ন স্মৃতিচারণ।
স্মৃতিচারণের বিষয় দেখে দেখে পড়তে লাগল আহমদ মুসা। শুরুতেই সে লিখেছে:
‘প্রথম যেদিন নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানলাম, দেখলাম জীবনটাই কৃত্রিমতায় সাজানো। যে পিতাকে মুসলিম পিতা হিসাবে জেনেছি, জানলাম তিনি একজন ইহুদি আর্মেনীয়। আর জানতাম আমার মুসলিম পিতা বিয়ে করেছেন কনভার্টেড সুন্দরী আর্মেনীয়কে, যার হাজারো দৃষ্টান্ত আছে তুরস্কে, আর্মেনিয়ায়। পরে জানলাম মায়ের এ পরিচয় ঠিক নয়। তিনিও আর্মেনীয় ইহুদি। মুসলিম ও আর্মেনীয় শব্দ মিলিয়ে আমার নাম হলো অ্যানোশ আব্দুল্লাহ্ গাজেন। আমি মুসলিম পরিচয় নিয়ে বড় হলাম। কিন্তু আমার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হলো ইয়েরেভিনের একটি হিব্রু স্কুলে। তারপর আমরা একদিন রাতের অন্ধকারে মাইগ্রেট করে তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ার সবচেয়ে বড় শহর ভ্যানে চলে এলাম আর্মেনিয়া থেকে পালিয়ে আসা এক মুসলিম পরিবার হিসেবে। ভ্যানে আমাদের জন্যে বাড়ি, ব্যবসা, নাগরিক কাগজপত্র সবই প্রস্তুত ছিল। কিভাবে ছিল তা তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝেছি। এসবই জগতজোড়া ইহুদি আণ্ডারওয়ার্ল্ডের কাজ।’
‘এ বিষয়গুলো আমি জানতে পারি, যখন আমার আঠারো বছর বয়স। তখন আমি ভ্যানের এক সুন্দরী কলেজ ছাত্রী। আমি মুষড়ে পড়ি আমার নতুন পরিচয়ে। কিন্তু আমার এই মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটে যখন আমি ভ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যখন আমি আর্মেনীয় বংশজাত একজন ইহুদি তরুণকে ভালোবেসে ফেলেছি। অতীতকে ভুলে গিয়ে আমি আমার প্রতিভাবান প্রেমিককে ঘিরে নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। তখন আমার সুখস্বপ্ন ষোলকলায় পূর্ণ হয় যখন আমি পূর্ব আনাতোলিয়ান সুন্দরী প্রতিযোগীতায় প্রথম হই এবং প্রেমিককে বিয়ে করার কথা প্রকাশ করে দিন-তারিখের জন্য পিতামাতাকে বলি।’
‘আমার স্বপ্নের ষোলকলা যখন পূর্ণ ভাবছি, তখনই আমার জীবনের অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু। একদিন গভীর রাতে আমাদের বাড়িতে আমার পিতা-মাতার সামনে তিনজন আগন্তুক আমাদের কম্যুনিটি লিডারের পরিচয় দিয়ে বলল, আংকারা সামরিক স্কুল থেকে অলরাউন্ডার, ব্রিলিয়ান্ট রেকর্ড নিয়ে পাস করে আসা ভ্যান সামরিক গ্যারিসনে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন অমিত সম্ভবনাময় সামরিক অফিসারকে ভালোবাসতে হবে। তাকে বিয়ে করতে হবে। আমি এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। উত্তরে সাপের মত ঠাণ্ডা গলায় ওরা জানায় যে, আমার জীবন, আমার বাপ-মায়ের জীবন, আমাদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই তাদের। তাদের কথার অন্যথা করার উপায় আমাদের নেই। তাদের কথা না মানলে পরের দিনই আমার প্রেমিকের লাশ আমি দেখতে পাব। তারপর আমার পিতামাতা, তার…। আমি তাদের কথায় রাজি হয়ে যাই। আমি হয়ে যাই তাদের হাতের পুতুল। সেই সামরিক অফিসারের সাথে তারাই আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম দৃষ্টিতেই সে আমাকে পছন্দ করে, তারপর ভালোবাসা, তারপর…। সে পাগল হয়ে উঠে। আমি বুঝতে পারি, সে অলক্ষ্যেই আমাদের স্বার্থের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। সে স্বার্থ কি আমি জানি না, জানে আমাদের কম্যুনিটির গুরুরা, যারা আমাদের ব্যবহার করে। সে গোপনে আমাকে বিয়ে করে। এই কথা সে প্রকাশ করতে পারেনি পারিবারিক ও আইনি কারণে। কারণ স্ত্রী আছে। আজও আমি তাঁর গোপন স্ত্রী। আজও আমার গোপন স্বামী আমাদের কম্যুনিটির স্বর্থে কাজ করছেন। সে স্বার্থটা কি আমি জানি না। জীবনটা যদি আমার এটুকুর মধ্যে শেষ হতো, তাহলেও ভালো ছিল।’
‘কিন্তু তা হয়নি। আমার সৌন্দর্য্য, আমার যৌবনকে এটুকু মূল্যে বিক্রি করে আমার কম্যুনিটি সন্তুষ্ট হতে চায়নি। তখন আমি আমার পিতা-মাতা থেকে আলাদা হয়ে এক গোপন বাড়িতে থাকি। এ গোপন বাড়িটি আমার গোপন স্বামীই ঠিক করে দিয়েছেন। আমার স্বামীর পোস্টিং তখন আংকারার হেডকোয়ার্টারের সেন্ট্রাল কমান্ডে। প্রতি উইক-এন্ডে আসেন। সেই সময় একদিন রাতে আমাদের কম্যুনিটির দু’জন এলেন। তারা দু’জন সামরিক অফিসারের ফটো দেখিয়ে তাদের পরিচয় বললেন। একজন ভ্যান-এর ব্রিগেড কমান্ডার। এরা এখন থেকে সপ্তাহের দুইদিন ভিন্ন দিনে আসবেন সময় কাটাবার জন্যে। আমাকে তাদের সংগ দিতে হবে। তারা নাকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে দেখেছেন এবং তারা নাকি আমার সাথে সাক্ষাতের জন্যে উদ্গ্রীব। উল্লেখ্য, যে ধরনের অনুষ্ঠানে তারা আমাকে দেখেছেন, সে সব অনুষ্ঠানের আয়োজক আমাদের কম্যুনিটির লোকেরা। শান্তি, সম্প্রীতির প্রসারমূলক ও বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনমূলক এসব অনুষ্ঠানে সম্ভাবনাময়, প্রতিভাবান সামরিক অফিসারদেরও ডাকা হয় গণসংযোগের কথা বলে। যথারীতি আমি এ প্রস্তাব অস্বীকার করে বলি, গোপন হলেও সে আমার স্বামী। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারবো না। তখন আবারও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তাদের কথার অমান্য করার সুযোগ আমার নেই। আমার জীবন তাদের, আমার নয়। এর সাথে ভয় দেখানোর পালা। তারাই জয়ী হয়। আমার জীবন আরও অন্ধকারে ডুবে যায়। এ ভাবেই চলছে আমার জীবন।’
‘মিউজিয়ামে চাকুরীর ব্যবস্থাটা আমার কম্যুনিটির লোকরাই করে দিয়েছে। আমার গোপন স্বামীর অনুমতিও এতে ছিল। চাকুরীর সুবাদে নতুন ডুপ্লেক্স বাড়িটাতে আছি আমি। এটা একদিকে সামরিক গ্যারিসন, অন্যদিকে মিউজিয়াম দু’টোরই কাছে। এ ডুপ্লেক্স বাড়ির ভালো দিক হলো, উপর তলাটা নির্জন, আমার অন্ধকার জীবনের জন্যে সুবিধাজনক।’
‘আমাকে ওরা সন্দেহ করছে কি? ডিজিপি মাহির হারুন সেদিন আমার সাথে যেভাবে কথা বলল, তাতে সেটাই মনে হয়। সেদিন আমার সাথে যেভাবে কথা বলল, তাতে সেটাই মনে হয়। সেদিন আমার কম্যুনিটির লোকেরা এসে আমাকে বলে গেছে, সবই ঠিক-ঠাক চলছিল, কিন্তু কি যেন আবু আহমদ নামের ঘোড়েল একজন লোক এসেছে ভ্যান-এ। আমি যেন কথা-বার্তায় সাবধান থাকি। বিশেষ করে সামরিক অফিসারদের পরিচয়ের ব্যপারটা খুবই স্পর্শকাতর। এটা কোনও ভাবেই প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না।’
‘সেদিন এক অনুষ্ঠানে দেখলাম, প্রথম যৌবনে আমি যেমন ছিলাম, সে ধরনেরই কিছু মেয়ের আনাগোনা। বুঝলাম, আমাদের কম্যুনিটির লোকেরাই তাদের আমদানি করেছে। আমার অফিসারদের সাথেও দেখি তাদের পরিচয় করানো হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না, তারা আমার মতই কোন হতভাগি। আমার মত এই হতভাগিদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের কম্যুনিটির লোকেরা যে ব্যবসায় করছে, সে ব্যবসায়ের স্বার্থ কি, লক্ষ্য কি?’
ডাইরিটা এ পর্যন্ত পড়েই আহমদ মুসা পড়া বন্ধ করল। আগে-পিছের পাতা উল্টাতে লাগল সেই সামরিক অফিসারদের নাম কোথাও আছে কিনা, কোনওভাবে নাম কোথাও পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু না, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নাম কোথাও পেল না। আশ্চর্য, অনাহুত বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার একজন মহিলা তার কম্যুনিটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। সব কথাই সে বলেছে, কিন্তু নামগুলো উল্লেখ করেনি। কম্যুনিটির স্বার্থ কি জানতো না, তবু কম্যুনিটির স্বার্থ সে রক্ষা করতে চেয়েছে, স্বার্থ রক্ষা করেছে তার সাথে সম্পর্কিত সামরিক উচ্চপদে আসিন। তাদের নাম-পরিচয় জানা একন এই মুহুর্তের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ।
আহমদ মুসা টেলিফোন করল মিসেস গাজেনের আয়া সোমিকে।
ওপার থেকে সোমির কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি মিসেস গাজেনের খবর নিতে চাই। আমার কয়েকটা কথা জানার আছে।’
‘ওয়েলকাম স্যার, বলুন।’ বলল গাজেনের আয়া।
‘মিসেস গাজেনের কি এক বা একাধিক বন্ধু ছিল যাদের সাথে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ওপার থেকে কোন জবাব এল না। নিরব সোমি, মিসেস গাজিনের আয়া।
সোমাকে নিরব দেখে আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘দেখুন সোমি, মিসেস গাজেনের হত্যাকারীদের পাকড়াও করতে আপনার সাহায্য আমরা চাই। ওদের পাকড়াও করতে যে প্রশ্ন আমি করেছি, তার উত্তর জানা খুবই জরুরী।’
‘স্যরি স্যার। ম্যাডামের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিব্রত লাগছে স্যার।’ সোমি ওপার থেকে বলল।
‘তিনি এখন নেই। এখন তাঁর পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিব্রত লাগছে স্যার।’ সোমি ওপার থেকে বলল।
‘তিনি এখন নেই। এখন তাঁর পার্সোনাল ব্যপার আর পার্সোনাল নেই। তার হত্যাকারীদের ধরার জন্যে সব কথা আমাদের জানা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি বলব বুঝতে পারছি না।’ প্রতি উইক এন্ডে নিয়মিত একজন আসতেন। শনিবার রাতে আসতেন। রোববার রাতে চলে যেতেন। ঘর থেকে তিনি বেরুতেন না। আমরা উপরে যেতাম না। খানা পরিবেশন ম্যাডামই করতেন। ম্যাডাম তার সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে আচার-ব্যবহারে তাঁকে স্বামীস্থানীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। পরের উইকে মঙ্গল ও বৃহঃস্পতিবার রাতেও তিনি বা কেউ আসতেন। সব আসাটাই রাত দশটার পর। রাত দশটার পর আমরা শুয়ে পড়তাম।’ আয়া সোমি বলল।
‘আপনারা তাঁকে বা তাদেরকে দেখেছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘মঙ্গল ও বৃহঃস্পতিবার রাতে যারা আসতেন, তাদের দেখার প্রশ্নই ওঠে না। রাতেই তারা চলে যেতেন। উইক এন্ডে যিনি আসতেন, তিনি দু’একবার পলকের জন্য আমার চোখে পড়েছেন মাত্র।’ বলল সোমি।
‘তার মুখের বা শরীরের কোন বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন আপনার মনে পড়ে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘কপাল চওড়া, হাসি মাখা মুখ। এটুকুই আমার নজরে পড়েছে।’ বলল সোমি।
‘ওদের কোন জিনিসপত্র, ফেলে যাওয়া কোন চিহ্ন?’ আহমদ মুসার আবার জিজ্ঞাসা।
‘স্যার, এ রকম কিছু মনে পড়ছে না।’ বলল সোমি।
‘কত দিন পর্যন্ত ওরা এসেছেন। মনে ওদের আসাটা অনাহুত ছিল কিনা, ওরা এখনও আসে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোন আসাটাই এখন আগের মত নিয়মিত নয় স্যার। তবে আসা বন্ধ হয়নি।’ বলল সোমি।
‘তোমার ম্যাডামের বয়স কত ছিল?’ জিজ্ঞেস করলো আহমদ মুসা।
‘স্যার, চল্লিশ হবে। তবে স্যার, তিনি বয়সের চেয়ে ছোট ছিলেন। অদ্ভুত ছিল তার দেহগঠন। মেকআপ না করলেও তাঁকে তিরিশের বেশি মনে হতো না।’ বলল সোমি।
‘তাই হবে। ওরা কম্যুনাটির শ্রেষ্ঠ মেয়েদেরকেই বাছাই করে তাদের স্বার্থক যুপকাষ্ঠে বলি দেয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা সোমিকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘দরকার হলে আপনাকে আবার বিরক্ত করব ম্যাডাম সোমি।’
কর অফ করে দিয়ে আহমদ মুসাও সোফায় গা এলিয়ে দিল।
মাথা খালি করে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের চিন্তা এসে ঘিরে ধরল।
ওয়েটার কফি দিয়ে সরে যেতেই সোহা’র (Son of Holy Ararat) প্রেসিডেন্ট মিহরান মুসেগ মিসিস বলল, ‘মি. জেনারেল, তাড়াতাড়ি আমাদের আসল কথাটা দরকার।’
‘বলুন।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
জেনারেল মেডিন মেসুদ তুর্কি সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের একজন। তিনি স্টাফ অফিসের প্রধান। অফিসারদের ট্রান্সফারের প্রধান ব্যক্তি সে।
মিহরান মুসেগ মাসিস তাকাল হোলি আরারাত গ্রুপের অন্যতম ভারদান বুরাগের দিকে।
ভারদান বুরাগ নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘দেখুন, গত কয়েকদিনে পূর্ব আনাতোলিয়ায় আমাদের আরারাত অঞ্চলে আমাদের প্রায় অর্ধশত নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে। অথচ মাদকের বিস্তারের মত সামাজিক অপরাধ দমনে আমাদের লোকরাই সেখানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। আমাদের লোকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন ও হত্যার জন্যে দায়ী শুধু পুলিশ, ঐ অঞ্চলের সেনা অফিসাররাও দারুন উৎসাহী।’
বলে ভারদান বুরাগ পকেট থেকে ভ্যান, অগ্রি, ইজদির ও কারস প্রদেশের সামরিক অফিসারদের তালিকা জেনারেল মেডিন মেসুদের সামনে রেখে বলল, ‘এই অফিসারদের সরিয়ে দিয়ে তাদের নামের বিপরীতে লিখা অফিসারদের এনে বসাতে হবে।’
ভারদান বুরাগের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মিরহান মুসেগ মাসিস বলল, ‘এটা করতেই হবে, না করলে আমাদের ধ্বংস করে ছাড়বে।’
‘কিন্তু এত স্টাফ এইভাবে বদল হয় না, করা যায় না।’ ক্ষোভ ঝরে পড়ল জেনারেল মেডিন মেসুদের কণ্ঠে।
তার চোখে-মুখে বিরক্তিরও চিহ্ন।
‘সবই সম্ভব। আপনারা ইচ্ছা করলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। অনেক সাহায্য করেছেন আপনি। এ সাহায্যও করতে হবে।’
‘তাহলে গোটা দেশের সেনা অফিসারকেই বদলি করুন। তাহলে অন্যকিছু ধারণা করার সুযোগ হবে না।’ ভারদান বুরাগই বলল।
দুই চোখ ছানাবড়া করে তাকাল জেনারেল মেডিন মেসুদ ভারদান বুরাগদের দিকে। বলল, ‘দেখুন, রসিকতা করার ব্যপার নয় এটা।’
‘আমরা রসিকতা করছি না। সত্যিই বলছি, শুধু চারটি প্রদেশে সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে কেউ। সুতরাং সারা দেশের সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার করার কথা আমরা সিরিয়াসলি বলছি।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। কোন যুক্তি নেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল। বিরক্তি ও অসন্তোষের ভাব ফুটে উঠল ভারদান বুরাগ ও মিহরান মুসেগের চোখে-মুখে। ভারদান বুরাগ বলল, আপনার কোন যুক্তি আমরা শুনতে চাই না। বলুন, আমরা যা বলেছি, তা করবেন কিনা। আপনি যদি অস্বীকার করেন, তাহলে কি ঘটতে পারে আপনি জানেন। আপনার মান-সম্মান শুধু নয়, চাকরিই শুধু নয়, কোট মার্শাল হবে আপনার।’
মুহুর্তেই মুষড়ে পড়ল জেনারেল মেডিন মেসুদ। নিচু হয়ে গেল তার মাথা। বলল, ‘আমি করব না বলছি না।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘এক সাথে করায় অসুবিধা আছে, আপনাদের প্রায়োরিটি বলুন।’
সংগে সংগে উত্তর না দিয়ে ভারদান বুরাগ ও মিহরাম মুসেগ পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল এবং ভারদান বুরাগ বলল, ‘ঠিক আছে, আগ্রি ও ইজদির প্রদেশের সেনা অফিসারদের আগে ট্রান্সফার করুন।’
ইজদির প্রদেশেই মাউন্ট আরারাত অবস্থিত।
আর আগ্রি এই প্রদেশের পশ্চাৎভুমি। ভ্যান প্রদেশ আগ্রির পেছনে। আর কারস ইজদির প্রদেশের উত্তরে।
‘ওকে, তাই হবে। তবে এমাসে নয়, বিভিন্ন সময়ে।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু বাকি দুই প্রদেশের ট্রান্সফার করতে হবে, একটু পরে হলেও।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘ঠিক আছে। কিন্তু এই ট্রান্সফার দিয়ে আপনারা কী করতে চান?’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
হাসল ভারদান বুরাগ। বলল, ‘অন্য কিছু নয়, লক্ষ্য আমাদের লোকদের বাঁচানো।’
‘কিন্তু শুধু সেনা অফিসারদের বদলি করলেই কি এলক্ষ্য অর্জন হবে? এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাই তো বড়।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ওটা আগে থেকেই আমাদের বিবেচনায় আছে।’ বলল মিহরান মুসেগ মাসিস।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ, ‘ওকে, আপনারা সফল হোন। কিন্তু আপনারা আমার প্রতি অবিচার করেছেন।’
‘কিন্তু আমরা আপনার জন্যে তো কম করিনি। আপনি যত দ্রুত এতদূর এসেছেন, তার পেছনে আমাদের অবদান অনেকখানি। আপনি তুরস্কের সবচেয়ে ধনী জেনারেলদের একজন সেটাও কি আমাদের কাজ নয়? আর আমরা তো অবিচার করিনি, আমরা উপকার চাচ্ছি আপনার কাছে। এটা কি চাইতে পারি না?’
‘চাইতে পারেনা। কিন্তু চাওয়াটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সীমাছাড়া।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
হাসল ভারদান বুরাগ। বলল, ‘কিন্তু আমাদের চাওয়াটা আমাদের কাছে এক ইঞ্চিও বেশি নয়। সুতরাং গাছাড়া চাওয়া এটা নয়।’
‘একথা ঠিক, প্রয়োজন থেকেই চাওয়ার সৃষ্টি হয়, কিন্তু সব চাওয়া পূরণ হবার মত নয়। কিন্তু আপনারা সেটাই করতে চাচ্ছেন।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘কি করব, এটাই আমাদের নীতি।’
‘আমাদের চাওয়া পূরণ হতেই হবে এবং আপনাকে তা করতেই হবে।’ ভারদান বুরাগ।
‘হ্যাঁ, আমি পণবন্দী।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল। তার মুখে অসহায় ভাব।
‘যদি এটাই ভাবেন, তাহলে…।’
বলেই উঠে দাঁড়াল ভারদান বুরাগ। বলল আবার জেনারেল মেডিনকে লক্ষ্য করে, ‘আমাদের সময় দেয়া, আমাদের সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ।’
মিহরান মুসেগ মাসিসও উঠে দাঁড়িয়েছে।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ভারদান বুরাগ ও মিহরান মুসেগের সাথে। অতিকষ্টে মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেছিল জেনারেল। বেরিয়ে এল তারা রেস্টুরেন্ট থেকে।
মিহরান মুসেগ ও ভারদান বুরাগ রেস্টুরেন্টের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। আর জেনারেল মেডিন মেসুদ ভিন্ন আর একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
গাড়িতে উঠল মিহরান মুসেগ ও ভারদান বুরাগ। ড্রাইভিং সীটে বসল মিহরান মুসেগ। গাড়িটা তারই। তার পাশের সীটে ভারদান বুরাগ। ভারদান বুরাগের মুখে হাসি।
কিন্তু ভাবছিল মিহরান মুসেগ মাসিস। বলল সে, ‘আজ জেনারেলকে আনউইলিং হর্স মনে হলো। আমি তার পিঠে চড়ে বসে আছি সেটা পছন্দ করছেন না।’
সেটাই স্বাভাবিক। তার উপর মুসলমানের বাচ্চা। বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ঈমান ওদের সরে যায় না। সুযোগ পেলেই মাথা তোলে। কিন্তু জেনারেল মাথা তুলে কোন ফল পাবে না। আমাদের কিছু ভিডিও অডিওর মধ্যে তার প্রাণ বাধা আছে। সুতরাং প্রাণ রক্ষা করতে চাইলে আমাদের পুতুল তাকে হতেই হবে।’ বলল ভারদান বুরাগ হাসতে হাসতেই।
‘তার ভাবান্তর ঘটেছে বেশ আগে থেকেই। গাজেনের গোপন স্বামী হওয়া সত্বেও অনেক আগে থেকেই তিনি মিসেস গাজেনের খোঁজ খবর নেওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ মিহরান মুসেগ বলল।
ওটা বড় কথা নয়। কারণ তার জন্যে নতুন সারপ্রাইজ ছিল। যাদের প্রতি তার আকর্ষণ মিসেস গাজেনের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং দেশপ্রেম তার মনে উঁকি-ঝুঁকি মরলেও সে সাধু হয়ে যায় নি। অতএব, ভয়ের কিছু নেই তার তরফ থেকে।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘কিন্তু ধরুন দু’টো প্রদেশ থেকে আমাদের বাঞ্ছিত সেনা অফিসারদের বসাল অন্যদের সরিয়ে দিয়ে, তাতেই কি আমাদের কাজ হয়ে যাবে? একাই একশ আবু আহমদ তো আছেই, কার সাথে এসে জুটেছে দেশভক্ত পুলিশ অফিসাররাও। তাদের ম্যানেজ করা না গেলে আমরা এগোবো কিভাবে?’ মিহরান মুসেগ মাসিস বলল।
‘ভাববেন না মি. মুসেগ। সেনাবাহিনী হাতে থাকলে খুব বেশি চিন্তা আর আমাদের থাকে না। আর আমরা তো দু’টো কাজ করব। এক, মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভান্ডার হস্তগত করার চেষ্টা, দ্বিতীয় হলো, আমাদের লোক দিয়ে গণবিদ্রোহ শুরুর মাধ্যমে গণহত্যা ঘটিয়ে এই অঞ্চলকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই দুই বিষয়ে পুলিশের করণীয় কিছু নেই। মাউন্ট আরারাত পাহারা দেয় সেনাবাহিনীর লোকেরা, সুতরাং সেখানে পুলিশ থাকছে না। অন্যদিকে সরকার ও পুলিশের গণহত্যা ইস্যু করে যে বিদ্রোহ হবে সেখানে কিছু করার শক্তি পুলিশের থাকবে না। ডাকা হবে সেনাবাহিনী যারা থাকবে আমাদের অনুগত। অতএব, চিন্তার কিছু নেই মি. মিহরান মুসেগ।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘এ দু’টো কাজই তো লং টার্মের। এখন আমরা কি করব?’ বলল মিহরান মুসেগ।
‘কি করব মানে? আমাদের মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভান্ডার অভিযানের গ্রাউন্ডওয়ার্ক তো চলছেই, চলবে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, এমন বাছাই করা লোকদের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে জেলে পাঠানোর কাজও যেমন চলছে, তেমনি চলবে।’ ভারদান বুরাগ বলল।
‘কিন্তু এই কাজগুলো তো বন্ধ হওয়ার পথে। কমপক্ষে দশ জায়গায় আমাদের লোকেরা হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। আর প্রাণহানির ঘটনা তো এলার্মিং। আমাদের বেস্ট জনশক্তির একটা অংশ শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা আমাদের কৌশল বুঝে ফেলেছে। এই পথে আমরা আর এগোতে পারবো বলে মনে হয় না। সব নষ্টের মূল আবু আহমদ। সেই আমাদের সব লোককে খুন করেছে। তার ব্যাপারে তো আমরা কিছুই করতে পারলাম না। তাকে এভাবে মাঠে রেখে কি আমরা এগোতে পারব? শোনা যাচ্ছে, মিউজিয়ামে হানা দেয়া ও হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সরকার নজীরবিহীনভাবে তাকেই দিয়েছে। ক্ষমতাহীনভাবে সে যতটা ভয়ংকর, ক্ষমতা পেয় সে কতটা ভয়ংকর হবে কে জানে।’ বলল মিহরান মুসেগ।
ভারদান বুরাগের চোখে মুখেও বিমর্ষতা নেমে এল। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ঐ লোকটা আমাদের ব্যর্থতার জীবন্ত নজীর। কিন্তু আমরা কি করব। চেষ্টার তো আমরা ত্রুটি করিনি। লোকটা যাদু জানে, কিংবা আগের-পরের সবকিছুই সে দেখতে পায়। তাকে কোন ফাঁদেই আটকানো গেল না। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল হলো, সামনের বাধা এড়িয়ে এগোবার নতুন পথ সৃষ্টি করা। আমরা তাই করেছি। আমাদের দু’টি লক্ষ্যই এধরনের। এখানে আবু আহমদ বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আর কোন স্কোপ নেই। এ অর্থ তাকে আমরা রেহাই দিচ্ছি না। সামনে এগোবার বিজয় রথ থেকে ঠিক সময়েই মোক্ষম অস্ত্রটি মারা হবে।’
‘ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।’ বলে স্লো হয়ে আসা গাড়ির গতিতে ব্রেক কষল মিহরান মুসেগ। পৌঁছে গেছে তারা হোটেলে।
২
প্লেনটা আছে আংকারার খুব কাছের শহর আংগোরায়। আংগোরা তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক সদর দফতর।
গন্তব্য আংগোরা হলেও আহমদ মুসাকে নামতে হবে আংকারা বিমান বন্দরে। সেখান থেকে পাহাড়ী পথে বিশ মিনিটের ড্রাইভে আংগোরা।
আংকারা বিমান বন্দরে তাকে রিসিভ করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আসতে চেয়েছিল জেনারেল মোস্তফা। কিন্তু আহমদ মুসা রাজি হয়নি। বলেছিল, আমার মিশনটা গোপন। শুরুতেই ভিআইপি পরিচয় পেলে মিশনটা আর গোপন কি! জেনারেলের পরিচয় তো জানাই গেছে। উত্তরে আহমদ মুসা বলেছিল, আমরা তাকে জানাতে পেরেছি, কিন্তু সে জানতে পারুক তা আমি চাই না। তার মাধ্যমে ষড়যন্ত্র জানা যায় কিনা, সেই চেষ্টাই আমরা করব। এজন্যই তাকে গ্রেফতারের আমি বিরোধিতা করেছি।
মিসেস আব্দুল্লাহ্ গাজেনের ডিইরি থেকে যে ইংগিত পাওয়া গেছে, তার ভাত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়েই জেনারেল মেডিন মেসুদের পরিচয় জানা গেছে। মিসেস গাজেনের ডিইরিতে জেনারেল সম্পর্কে কয়েকটা ক্লু পাওয়া গিয়েছিল। তার প্রশস্ত কপাল। সদা হস্যোজ্জ্বল মুখ। ট্রেনিং-এ ব্রিলিয়ান্ট রেকর্ডের অধিকারী। ট্রেনিং-এর পর প্রথম নিয়োগ পায় ভ্যান ইউনিটে। এনব ক্লু সামনে রেখে আহমদ মুসার অনুরোধে তুরস্কের অভ্যন্তনীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফা অনুসন্ধান চালিয়ে চারজন সিনিয়র জেনারেলকে চিহ্নিত করে। এই চারজন জেনারেলের ব্যক্তিগত জীবনের উপর অনুসন্ধান চালানো হয়। খোঁজ নেয়া হয় ভ্যান-এর সাথে কার যোগাযোগ বেশি, কে বেশি বেশি ভ্যান-এ যায়। এই অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে জেনারেল মেডিন মেসুদের নাম। সে এক সময় প্রতিটি উইক এন্ডে ছুটি কাটাতে ভ্যান-এ যেত। ভ্যান-এ তার কোন নিজস্ব বাড়ি নেই। সুতরাং ভ্যান-এ গেলে তার ওঠার কথা সেখানকার সবচেয়ে সুন্দর সেনা রেস্ট হাউজে। কিন্তু অধিকাংশ সময় সেনা রেস্ট হাউজে উঠতোই না। কোন কোন সময় যখন উঠতো, তখনও সে সেখানে থাকতো না। তার ফ্যামিলি রেকর্ড থেকে এটাও জানা যায় যে, তার দাম্পত্য জীবনে কোন সমস্যা না থাকলেও বিয়েটা তার অমতে হয়েছিল। তার সার্ভিস রেকর্ড থেকে আরেকটি বিষয়ও জানা যায়, সেটা হলো ভ্যান-এ তার প্রথম পোস্টিং হওয়ার পর সেখান থেকে তার ট্রান্সফার ঠেকানো এবং তদ্বির করে কয়েকবার ভ্যান-এ পোস্টিং নেবার তার একজন সেনা অফিসারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে এবং বিভিন্ন সাক্ষ্য থেকে সেনা অফিসার মেডিন মেসুদ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং মিসেস গাজেনের গোপন স্বামী হিসেবে জেনারেল মেডিন মেসুদের বিশাল সম্পত্তির সাথে তার আয়ের কোন সংগতি নেই। এটাও প্রমাণ করে তার অবৈধ আয়ের পেছনে তার কোন অবৈধ তৎপরতা বা যোগসাজশের সম্পর্ক আছে।
জেনারেল মেডিন মেসুদ চিহ্নিত হবার পর তাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এই সিদ্ধান্তে বাধা দেয়। বলে যে, তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু কোন্ ষড়যন্ত্রে সে যুক্ত, সে ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি ও পরিধি কি তা নাও জানা যেতে পারে। অথচ সেসব জানা, শাস্তি পাওয়ার চেয়ে অনে বেশি প্রয়োজন। আহমদ মুসার এ যুক্তিকে তুর্কি সরকার গ্রহণ করে এবং বিকল্প হিসাবে কি করা যায় সে দায়িত্ব তারা আহমদ মুসার উপরই অর্পণ করে।
সে দায়িত্ব নিয়েই আহমদ মুসা আজ যাচ্ছে আংগোরায়।
কারও ‘এক্সকিউজ মি!’ শব্দে আহমদ মুসার চিন্তার স্রোতটা বাধা পেয়ে থেমে গেল।
সুন্দর সুরেলা কণ্ঠ। মিষ্টি উচ্চারণ।
আহমদ মুসা মুখ তুলে চাইল। দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশ-বাইশ বছরের অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে।
দেখেই আহমদ মুসা চিনতে পারল। ইস্কান্দরুন থেকে এ মেয়েটি বিমানে উঠেছে। তার বাম পাশের প্যাসেজের ওপারে জানালার কাছের একটা সীটে বসেছিল মেয়েটি।
ভ্যান থেকে আহমদ মুসার বিমানটি উড়ে ইস্কান্দরুনে কয়েক মিনিটের একটা যাত্রা বিরতি করেছিলে। ইস্কান্দারুন তুরস্কে ভূমধ্যসাগর উপকুলের একটা গুরত্বপুর্ণ নৌবন্দর। এটা পর্যটন শহরও। সেই সাথে এটা তুরস্কের কৌশলগত নৌঘাঁটিও।
আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাতেই মেয়েটি বলল, ‘আমি আপনার পাশের সীটে বসতে পারি? আমি স্টুয়ার্ডকে বলেছি।’ মেয়েটির চোখে-মুখে বিব্রত ভাব। কণ্ঠে সংকোচ।
মেয়েটির বিব্রতভাব ও সংকোটকে মেকি বলে মনে হলো না আহমদ মুসার। তার চোখের ভাষায় কোন মতলবের চিহ্ন নেই। তার বদলে আছে অসহায়ত্বের প্রকাশ।
‘আসনটা শূন্য। আমার আপত্তি নেই।’
‘থ্যাংক ইউ…।’ মেয়েটি কথা শেষ করল না। প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে।
‘আবু আহমদ আব্দুল্লাহ।’ নিজের নাম বলল আহমদ মুসা।
‘থ্যাংক মি. আব্দুল্লাহ।’ বলে মেয়েটি আহমদ মুসার পাশের শূন্য সীটে বসে পড়ল।
‘স্যরি, টু ডিস্টার্ব ইউ। আমি ওখানে কমফোর্ট ফিল করছিলাম না।’ বসেই বলল মেয়েটি।
আহমদ মুসা এর আগেই লক্ষ্য করেছে মেয়েটার পাশের সীটে খুবই সুবেশধারী ক্রিমিনাল চেহারার একজান মানুষ।
আহমদ মুসা মেয়েটার কথার জবাবে বলল, ‘ওয়েলকাম মিস। আপনার অবশিষ্ট ভ্রমণ সুন্দর হোক।’
আহমদ মুসার পাশের শূন্য আসনটিতে বসতে গিয়ে বলল মেয়েটি, ‘আমার নাম সানেম, সালিহা সানেম।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি তো আংকারা যাচ্ছেন?’ মেয়েটির প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, আংকারা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি কি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেন?’ জিজ্ঞানা আবার মেয়েটির।
বিস্মিত আহমদ মুসা তাকাল মেয়েটির দিকে। বলল, ‘সেনাবাহিনীতে চাকুরীর কথা ভাবলেন কি করে?’
‘স্যরি, সেনাবাহিনীর অফিসাররা সাধারণঃত স্মার্ট হয়, চৌকশ হয় এবং শরীরাও সাধারণঃত মেদহীন হয়। আপনিও সেরকমই, তাই বলছিলাম।’ মেয়েটি বলল।
‘স্যরি, আমার ইমেজ আপনাকে বিভ্রান্ত করেছে। আমি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করি না।’ আহমদ মুসা বলল।
ট্রলিতে নাস্তা আসছে। সালিহা সানেমের চোখ ওদিকে গেল।
আহমদ মুসা উঠে টয়লেটের দিকে চলে গেল। ফিরে এসে দেখল নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে।
সালিহা সানেম মদ খাচ্ছে পানির মত। পুরা এক বোতল সে নিয়ে নিয়েছে।
তার নাস্তার সাথেও মদের বোতল দেখল আহমদ মুসা।
বিস্মিত আহমদ মুসা বসতেই সালিহা সানেম বলে উঠল, ‘আপনি ছিলেন না। আমি যা নিয়েছি, আপনার জন্যেও তাই নিয়েছি। ঠিক করিনি?’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
নাস্তা দেয়া শেষ করে নাস্তার ট্রলি নিয়ে ফিরছিল বিমান ক্রুরা।
আহমদ মুসা মদের বোতল ওদের ফেরত দিয়ে বলল, ‘এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিন।’
পানি দিয়ে ওরা চলে গেল।
‘আমি আমার বোতল শেষ করে ফললাম, আর আপনি ফেরত দিলেন?’
‘আমি মদ খাই না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডাক্তারের নির্দেশ? কোন অসুখ-বিসুখ?’ বলল সfলিহা সানেম।
‘কোন অসুখ-বিসুখ নয়। আমি মুসলিম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তো মুসলিম।’ বলল সলিহা সানেম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মুসলিম অবশ্যই, কিন্তু মুসলিমদের জন্যে মদ নিষিদ্ধ, এটা আপনি মানেন না।’
‘আমি কেন, আমার চারদিকের প্রায় সবই তো মদ খায়।’ সালিহা সানেম বলল।
‘তারাও মানেন না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম, আপনি ধর্ম মেনে চলেন। আমি আপনাকে আধুনিক মানুষ মনে করেছিলাম।’ সালিহা সানেম বলল।
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধর্ম মানলে বুঝি আধুনিক মানুষ হওয়া যায় না? ধর্ম ও আধুনিকতা কি দুই ভিন্ন জিনিস?’
‘স্যরি, আমি তাই মনে করি। যারা ধর্ম মানে, তারা অতীতমুখী। অতীতমুখী হয়ে আধুনিক হওয়া যায় না।’ বলল সালিহা সানেম।
‘আচ্ছা বলুনতো, যারা ধর্ম মানে, তারা কি আধুনিক ডিজাইনের বিল্ডিং-এ বাস করে না? তারা কি আধুনিক কল-কারখানায় তৈরি আধুনিক কাপড়ের, আধুনিক ডিজাইনের পোষাক পরে না, যেমন আমি? খাবার টেবিলে কি আধুনিক বাসন-কোসন ব্যবহার করে না তারা? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানসহ সব আধুনিক বিষয় কি তারা পড়ে না? তারা কি নানা ধরনের আধুনিক পেশায় নিয়োজিত নেই? তাদের ঘরে কি কম্পিউটার নেই? তারা কি সব ধরনের আধুনিক কম্যুনিকেশন সিস্টেম ব্যবহার করে না? তারা কি আধুনিক কালের সমৃদ্ধ ভাষা চর্চ্চা করে না? আধুনিক হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার খায় না? পর্যটন-দেশ ভ্রমণে তারা কি নেই? তারা কি স্কলারশীপ পায় না? স্কলারশীপ নিয়ে বা নিজ খরচে তারা কি দেশ-বিদেশে পড়ছে না? ধর্ম যারা মেনে চলে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, লেখক, কবি, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কি নেই?’ আহমদ মুসা থামল।
‘আপনার সব প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ‘হ্যাঁ’।’ বলল সালিহা সানেম। সে কিছুটা বিব্রত।
‘তাহলে ধর্ম যারা মানে তারা তো আধুনিক। অতীতমুখী হলো কেমন করে তারা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘বিশ্বাসে তারা অতীতমুখী।’ বলল সালিহা সানেম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সে বিশ্বাসগুলো কি? আল্লাহতে বিশ্বাস করা, সে বিশ্বাসের ভিত্তিতে আল্লাহর হুকুম অনুসারে নামায পড়া, রোযা রাখা, যাকাত দেয়া, আখেরাতে বিশ্বাস করা, ইহজগতের কৃতকর্মের জন্যে পরজগতে পুরস্কার অথবা শাস্তি পাওয়া, এসব কি?’
সালিহা সানেমের চোখে-মুখে বিব্রত অবস্থা বেড়ে গেছে। বলল, ‘হ্যাঁ, এসবই। আরও আছে যেমন বোরখা পরা, ছেলেমেয়েদের মেলা-মেশাকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা, ইত্যাদি।’ কণ্ঠ তার শিথিল।
‘ধন্যবাদ, কথাগুলো খোলাখুলি বলার জন্য। কিন্তু বলুন তো, আল্লাহতে বিশ্বাস করা যদি অতীতমুখিতা বা পুরাতনপন্থা হয়, তাহলে এর আধুনিক পন্থাটা কি হবে?’ খুব শান্ত ও নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
চোখ-মুখের সেই বিব্রত ভাব নিয়েই সে বলল, ‘না, ঠিক আল্লাহতে বিশ্বাস করা পুরাতন পন্থা বা অতীতমুখিতা নয়, এই বিশ্বাসকে উপলক্ষ্য করে যে বাড়াবাড়ি করা হয়, সেটাই অতীতমুখিতা।’
‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দাবী অনুসারেই তো নামায পড়া হয়, রোযা রাখা হয়, যাকাত দেয়া হয়। এসবকে আপনি কি বলবেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নামায, রোযা, যাকাত এসব কারও অভ্যাস হিসাবে ভালো জিনিস। কিন্তু এসব নিয়ে যখন বাড়াবাড়ি করা হয়, অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, এসব না করলে কাফের বলা হয়, তখন এই প্রবণতা অন্ধ অতীতমুখী মানসিকতার পর্যায়ে পড়ে যায়।’ সালিহা সানেম বলল।
‘সমাজে কখনও কখনও কেউ কেউ এটা করেন। কিন্তু আল্লাহ এটা করতে বলেননি। নামায, রোযার মত এবাদতগুলোতে যদি আন্তরিকতা না থাকে, নিজ ইচ্ছা না থাকে, একাগ্রতা না থাকে তাহলে তা আল্লাহ গ্রহণই করবেন না। কিন্তু একটা কথা বলুন মিস সালিহা সানেম, আপনি যা বিশ্বাস করেন, আপনি যা স্বীকার করেন, তা করা আপনার উচিত কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই তা করা উচিত।’ বলল সালিহা সানেম।
‘যদি তা না করেন, তাহলে মানুষ আপনাকে কি বলবে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ওয়াদা ভংগকারী বলবে, বিশ্বাস ভংগকারী বলবে’ বলল সালিহা সানেম।
‘আল্লাহকে যদি আপনি বিশ্বাস করেন, আপনি যদি নিজেকে মুসলিম মনে করেন, তাহলে বিশ্বাসের দাবী মুসলমান হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসাবে সে কাজগুলো, যেমন নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত, সৎ ও পবিত্র জীবন যাপন, হারাম পরিহার ইত্যাদি করা দরকার, সেগুলো না করলে আপনার পরিচয় কী হবে, কী বলবে মানুষ আপনাকে?’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগে উত্তর দিল না সালিহা সানেম। তার বিস্মিত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল। তারপর মুখ না তুলেই আস্তে আস্তে বলল, ‘তার মানে আপনি বলছেন, আমি বিশ্বাস ভংগকারী। আর বিশ্বাস ভংগকারী মুসলিম হওয়ার মানে অপরিহার্য শর্ত লংঘনকারী হিসাবে আমাকে কফের বলা যায়।’ বিস্মিত কণ্ঠ সালিহা সানেমের।
‘না মিস সানেম, আমি তা বলছি না। যদিও ‘কাফের’ শব্দের অর্থ বিশ্বাস অস্বীকারকারী, তবুও এ শব্দ কোন মুসলিমের উপর প্রয়োগ করা যায় না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে একজন মুসলিম নামায না পড়লেও, রোযা না করলেও, হারাম খেলেও, পবিত্র জীবন যাপন না করলেও সে তার বিশ্বাস বা ঈমান পরিত্যাগ করে না। কাজে-কর্মে ঈমানের প্রকাশ না ঘটলেও ঈমান তার মধ্যে থাকে। তাই তো দেখা যায় বেনামাযি লোক এক সময় নামায পড়ে, এক সময় রোযা না করলেও, কোন এক সময় সে একনিষ্ঠ রোযাদার হয়ে যায়। সুতরাং কোন মুসলিমকে কাফের বলা ঠিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। আপনি ঠিক বলেছেন। মুসলিম হিসাবে ইসলামের কোন অনুশাসন আমি অনুসরণ করি না, এ কথা ঠিক। কিন্তু আল্লাহর প্রতি আমার বিশ্বাস নেই, রসূলকে মানি না, এমন চিন্তা আমার মনে কোন সময় আসেনি। কিন্তু দেখুন, আমার পোষাক-পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণ, চলা-ফেরা দেখেই আমাকে কাফেরের খাতায় নাম লিখে দিয়েছে। এটাই তো অন্ধত্ব, পশ্চাৎমুখিতা।’ বলল সালিহা সানেম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওদের বাড়াবাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু আপনার পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, চলা-ফেরায় কি বাড়াবাড়ি নেই?’
সালিহা সানেম একটু ভাবল। বলল, ‘সোসাইটিতে যা প্রচলিত আছে, তার বাইরে আমি কিছুই করতে পারি না, কিছুই করি না। এসব আমার বাড়াবাড়ি নয়।’
‘আপনি আপনার সোসাইটির একজন। আপনার মত বহুজন নিয়েই আপনার সোসাইটি। সমাজ যা প্রচলন করে, সমাজে যা প্রচলিত হয়, তাতে সোসাইটির প্রত্যেক সদস্যের অংশ আছে। কিন্তু সে দায় সম্পর্কে আমার কোন কথা নেই। আমি জানতে চাচ্ছি, আধুনিকতা হিসাবে আপনি যা পরেন, যা করেন সে ব্যাপারে আপনার মন কি বলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কঠিন প্রশ্ন। এসব ব্যাপারে মন আলাদা কিছু বলে কিনা বুঝিনি, ভেবেও দেখিনি কখনও। আমি যা করছি, মন তো তার সাথেই আছে।’ বলল সালিহা সানেম।
‘আচ্ছা, আপনাদের ক্লাবে আড্ডায় যখন আপনি দেখেন ছেলেরা ফুলড্রেসে, আর মেয়েরা অর্ধনগ্ন বা নামমাত্র পোষাকে, তখন কি আপনার কিছুই মনে হয় না? কেন মেয়েদের এ পোষাক? কার স্বর্থে? সে স্বার্থ কি মেয়েদের?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শেষ হলেও তৎক্ষণাত উত্তর এল না সালিহা সানেমের কাছ থেকে। তার মাথাটা নিচু হয়েছে। ভাবছে সে।
ধীরে ধীরে মুখ তুলে সালিহা সানেম বলল, ‘আমি বুঝেছি আপনার কথা। আপনি বলতে চাচ্ছেন, নারীদের মনোরঞ্জনের উপকরণে পরিণত করা হয়েছে, ভোগের পন্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে নারীরা। আমি এভাবে কোনদিন ভাবিনি। আমি মনে করতাম এটা নারীদের অধিকার, স্বধীনতা । কিন্তু আপনি যেটা বোঝাতে চাচ্ছেন, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে মেনে নেয়ার জন্যে আরও ভাবতে হবে।’
‘অবশ্যই ভাববেন মিস সালিহা সানেম। ইসলাম বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানচর্চ্চাকে স্বাগত জানায়। আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই তো জ্ঞানময়, বিজ্ঞা…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই সীট বেল্ট বাঁধার ঘোষণা এল, ‘আংকারায় ল্যান্ড করতে যাচ্ছে বিমান।’
আহমদ মুসা থেমে গিয়েছিল। সীট-বেল্ট বাঁধায় মনোযোগ দিয়েছে সবাই। আহমদ মুসা এবং সালিহা সানেমও।
ট্যাক্সিএ সীটে গা এলিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা তার গন্তব্য আংগোরার কথাই ভাবছে। আংগোরা একটি সামরিক নগরী। পর্বত্য শহর। এখানে বেসরকারি কিছু লোকও আছে। কিন্তু তারাও সামরিক ব্যক্তিদেরই বংশধর। এখানে কয়েকটা ভালো হোটেল আছে পর্যটকদের জন্যে। সে হোটেলগুলোরই একটিতে আহমদ মুসার জন্যে সীট বরাদ্দ হয়েছে একজন পর্যটক হিসাবে।
রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলো আহমদ মুসা। চারদিকটা সবুজ টিলা, আর সবুজ উপত্যকায় ভরা। গাড়িটা যখন চড়াইয়ে উঠেছে তখন চারদিকের সবুজ দৃশ্য এবং টিলার উপরের ছবির মত রং-বেরং এর বাড়ি চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তার দু’ধারটাও ছবির মত সাজানো।
ড্রাইভারের কাছ থেকে জানল প্রাইভেট বাড়ি কিছু আছে, কিন্তু রাস্তার দু’পাশের অধিকাংশ বাড়িই হোটেল-মোটেল জাতীয়। প্রচুর পর্যটক আসে। তাছাড়া প্রচুর দেশীয় লোক এখানকার নিরিবিলি পরিবেশে ছুটি কাটাতে আসে।
আহমদ মুসার গাড়ি একটা সবুজ চড়াই অতিক্রম করছিল। দেখতে পেল, দু’টি মাইক্রো ও একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে একটা মেয়েকে পাঁচ-ছয় জনে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে রাস্তার পাশের একটা মোটেলে ঢুকে গেল। মেয়েটা প্রাণপণে চিৎকার করছিল বাঁচাও, বাঁচাও বলে।
ড্রাইভার বলল, ‘স্যার, এমনটা এই অঞ্চলে প্রায়ই ঘটে। বাড়িগুলো যেমন সুন্দর লাগছে, এখানে যারা সময় কাটাবার জন্যে আসে তারা সবাই কিন্তু এ রকম সুন্দর নয়। নানা রকম গ্যাং এখানে আছে, বাইরে থেকেও আসে। অপহরণ ও নানা অপরাধমূলক ঘটনা এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।’
আহমদ মুসার গাড়িটা চড়াই অতিক্রম করে একটা উপত্যকায় নামছিল। আহমদ মুসার কানে মেয়েটার বাঁচার জন্যে প্রাণপণ চিৎকার তখনও বাজছিল।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল মেয়েটার পরনে দেখা নীল প্যান্ট ও গোলাপী শার্টের কথা। মানে নীল প্যান্ট আর গোলাপী শার্টই সালিহা সানেমের পরনে ছিল। সেই সাথে আরও মনে পড়ল, সালিহা সানেম যে সীট ছেড়ে দিয়ে সরে এসেছিল সে সীটের পাশের সীটের সুবেশধারী ক্রিমিনাল চেহারার লোক ও তার লোলুপ দৃষ্টির কথা।
মনে পঢ়ার সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, ‘গাড়ি ঘুরাও ড্রাইভার। ঐ মেয়েটাকে যে বাড়িতে নিয়ে গেছে, সেখানে চল।’
ড্রাইভার বলল, ‘স্যার, ওখানে যেতে হলে সাত-আট মাইল ঘুরতে হবে। সামনে আরও তিন মাইল গেলে তবেই আমরা ফিরতি পথে যাওয়ার প্যাসেজ পাব।’
‘গাড়ি ঘুরিয়ে এই পথেই ব্যাক করো।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার ভীত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, তাহলে নির্ঘাত আমাকে জেলে যেতে হবে। গাড়িটাও আটক হয়ে যাবে বহুদিনের জন্যে।’
‘আমি সেটা দেখবো। গাড়ি ঘুরাও ড্রাইভার।’ ধমকে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠ।
ড্রাইভার একবার মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আর মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ্! এটুকু পথ যেন আমি পুলিশের হাতে পড়া ছাড়াই অতিক্রম করতে পারি।’
নির্বিঘ্নে পথটুকু পেরিয়ে এল গাড়িটি। যে বাড়িটিতে মেয়েটিকে তারা তুলেছে তার সামনে মেইন রোডের উপর আহমদ মুসা নেমে পড়ল।
ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে তার হাতে একশ ডলারের একটি নোট তুলে দিয়ে বলল, ‘তুমি থাকতে পারো, আবার চলেও যেতে পার।’
গাড়ির ভাড়া ঠিক হয়েছিল পঞ্চাশ ডলার। একশ ডলার হাতে পেয়ে ড্রাইভার আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, ‘স্যার, দরকার হলে সারাদিন আমি এখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা…।’
আহমদ মুসা দৃঢ় পদক্ষেপে এগোলো বাড়িটার দিকে, যেন সেও একজন কাস্টমার ঐ মোটেলের। মোটেলের প্রধান গেটে তাকে আটকাল দু’জন নিরাপত্তা প্রহরী। বলল, ‘স্যার, রুম খালি নেই। রেস্টুরেন্টও বন্ধ।’
আহমদ মুসা প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘যারা মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে গেছে, আমি তাদের দলের লোক। আমাকে নিয়ে চল তাদের কাছে।’
নিরাপত্তা প্রহরীদের একজন বলল, ‘স্যার, আমাদের গেট ছাড়ার অনুমতি নেই। আপনি ভেতরে গিয়ে অন্যদের বলুন।’
নিরাপত্তা প্রহরীরা বিশ্বাস করেছে তার কথা। খুশি হলো আহমদ মুসা।
‘বাইরে কার সাথে কথা বলছিস তোরা। কাউকে ভেতরে ঢকতে দিবি না। মোটেল বন্ধ।’ বলতে বলতে বিপুল বপু একজন লোক গেটে এসে দাঁড়াল।
নিরাপত্তা প্রহরী দু’জন তাকে স্যালুট করল। একজন বলল, ‘স্যার, এই লোক ওদের সাথের। যেতে চায় তাদের কাছে।’
বিপুল বপু লোকটি আহমদ মুসার দিকে তাকাল সন্দেহের দৃষ্টিতে। বলল, ‘বলুন তো, তাদের সাথে যে মেয়েটি আছে, তার পোষাক কেমন?’
‘নীল প্যান্ট ও গোলাপি শার্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটির দু’চোখ থেকে সন্দেহ সরে গেল।
বলল, ‘আসুন ভেতরে।’
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল। বলল, ‘ওরা কোথায়? আমাকে নিয়ে চলেন ওদের কাছে। জরুরি কথা আছে ওদের সাথে।’
‘ওদের কি কথা শোনার সময় আছে? যে মাল নিয়ে এসেছে, কোটিতে একটাও সে রকম মেলে না! ওরা এখন পাগল তাকে নিয়ে।’ বলল লোকটি।
‘সেটা আমি জানি।’
বলে আহমদ মুসা তাকাল মোটেলের দু’তলার সিঁড়ির দিকে। সেদিকে যাবার জন্যে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
‘আহা কি করেন, ওরা তো উপরের দিকে নেই। যে চিৎকার, আর্তনাদ চলছে, তাকি উপর তলায় বলে? ওরা আছে আন্ডার গ্রাউন্ডে।’
বলে বিশাল বপু লোকটি এগোলো উপরে ওঠার সিঁড়ির পাশের একটা রুমের দিকে। রুমের দরজা বন্ধ। লোকটি চাবি দিয়ে লক খুলে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে বড় একটি আলমারি। লোকটি এগোলো আলমারির দরজার দিকে। আলমারির দরজা বন্ধ। হাতল ঘুরিয়ে সে আলমারির দরজা খুলে ফেলল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘যান, ভেতরে বেজমেন্ট ফ্লোরে তাদের সবাইকে পাবেন।’
আলমারির দরজা আসলে একটা সিঁড়িমুখের গেট।
গেট পেরিয়ে সিঁড়ি মুখের স্ট্যান্ডিং-এ এসে দাঁড়াতেই সা নারী কণ্ঠের কান্না এবং কথা-বার্তা ও হাসির শব্দ শুনতে পেল।
পেছনে আলমারির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা শিকারী বাঘের মত নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করল। নেমে এল বেজমেন্টে। বিরাট ঘরের দু’পাশ জুড়ে ‘এল্’(L) প্যাটার্নে বেশ কিছু ঘর। সবগুলো ঘরই বন্ধ।
কান্নাকাটি ও কথা-বার্তার শব্দ আসছে শেষ প্রান্তের দিক থেকে।
সারিবদ্ধ ঘরগুলোর দেয়াল ঘেঁষে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা। তার জ্যাকেটর দু্ই পকেটে তার দুই হাত। দুই হাতের তর্জনী দুই রিভলভারের দুই ট্রিগারে। দুই রিভলভারের মিনি সাইলেন্সেরও অন করে নিয়েছে।
কিছুটা এগোনোর পর নিশ্চিত হলো ডান পাশের একটা ঘরের কোনার দিক থেকে কথা-বার্তা ও কান্নাকাটির শব্দ আসছে। শিকারী নেকড়ের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছে আহমদ মুসা। আর একটা কক্ষ পার হলেই করিডোরের বাঁকে পৌঁছে যাবে। করিডোরটা ঐখনে বাঁক নিয়ে ডান দিকে এগিয়ে গেছে, যেদিক থেকে কথা ও কান্নাকাটির শব্দ আসছে, সেদিকে।
করিডোরে পৌঁছাতে আর গজ দুয়েক জায়গা বাকি। হঠাৎ খুবই অস্পষ্ট একটা শব্দে গোটা দেহে উষ্ঞ শিহরণ জাগাল।
অজান্তেই থমকে গেল সে। শব্দটা স্পষ্ট হচ্ছে তার কাছে। পদশব্দ।
এগিয়ে আসছে কেউ। তার পায়ের শব্দই বলছে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে স্টেপ নিয়ে ফেলেছে।
এই চিন্তার সাথেই পকেট থেকে রিভলভার সহ ডান হাত বের করে সোজা লম্বা বসে পড়ল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে একটা লোহার রড ঘাড়ের উপর দিয়ে মাটিতে গিয়ে আঘাত করল। সে আঘাতের একটা অংশ তার ঘাড়েও অনুভূত হলো। ঘাড়টা থেঁতলে যাওয়ার মত চিন চিন করে উঠল। অন্যদিকে লোহার রডধারী লোকটিও ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তার মাথাটা এসে পড়ল আহমদ মুসার পিঠের উপর।
আহমদ মুসা বোঁ করে ঘুরেই রিভলভার চেপে ধরল তার মাথায়। কিন্তু সে সময়েই লোকটির দুই জোড়া পায়ের আঘাত দুই হাতুড়ির মত এসে পড়ল আহমদ মুসার মাথায়। আহমদ মুসা উল্টে পড়ে গেল। কিন্তু আহমদ মুসা হাতের রিভলভার ছাড়েনি।
লোকটি দু’পা দিয়ে আঘাত করেই পা দু’টি মাটিতে ছুড়ে দিয়ে তার ওপর ভর করে দক্ষ এ্যাক্রবেটের মত উঠে দাঁড়িয়েছে। কোমর থেকে ছুরি খুলে নিয়েই লোকটি ছুঁড়ে মারল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা আড়াল করল।
আঘাতটা ব্যর্থ হওয়ায় লোকটি পকেট থেকে পিংপং বলের মত একটি গোলাকার বস্তু হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারার জন্য হাত তুলল।
আহমদ মুসা আর সময় নষ্ট করল না। তার তর্জনি চেপে বসল তার রিভলভারের ট্রিগারে।
সাইলেন্সার লাগালো রিভলভার থেকে নিঃশব্দে একটা গুলি বেরিয়ে লোকটির কপাল দিয়ে ঢুকে মাথাটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। জ্যাকেটটা ঠিক করে বিভলভারটা হাতে নিয়েই এগোলো সামনের দিকে।
ঘরটির দেয়ালের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাওয়া করিডোরের দিকে উঁকি দিল। দেখল করিডোরে কেউ নই। করিডোরের দক্ষিণ পাশে একটা দরজা। দরজাটা আধাবন্ধ। ঐ ঘর থেকেই শব্দগুলো আসছে।
আহমদ মুসা করিডোরে নেমে গেল। নিঃশব্দ পায়ে এগোলো দরজার দিকে। দরজার পাশে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে সব কথা, সবার কথা পাচ্ছে, বুঝতে পারছে সে। কিছু একটা ঘটল, মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কান্নারত অবস্থায় বলছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমার সর্বনাশ করো না। আমি তোমাদের কী ক্ষতি করেছি? আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা।’
এখন নিঃসন্দেহ হলো যে, এটা সালিহা সানেমের গলা।
সালিহা সানেম থামতেই এজন লোক হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘অত বাহাদুরি কোথায় গেল? তুমি না জেনারেলের মেয়ে? কোথায় জেনারেল, ডাক? আমাদের চেন না। তোমার বাপের মত অনেক জেনারেল আমাদের পকেটে আছে। মন্ত্রীরাও আমাদের সালাম করে। আমাদের না হলে ওদের একদিনও চলে না। আমাদের কোন ক্ষতি করনি বলছো? নাইট ক্লাবে আমাদের সাথে নাচতে তো আপত্তি করনি। নেচে-গেয়ে তো আমাদের পাগল করেছ। যখন বললাম, এই পাগলকে শান্ত কর। তখন গালি-গালাজ শুরু করলে। অত সতী-সাধ্বী হলে নাইট ক্লাব গিয়েছ কেন? মানুষের মনে আগুন জালিয়েছ কেন? এটা ক্ষতি নয়? জামা খুলেছি। এবার শালির প্যান্ট কেটে ফেল, খুলে পড়ে যাক।’
সম্ভবতঃ ভিতরে কিছু ঘটল। সালিহা সানেম চিৎকার করে উঠল।
আহমদ মুসা ভাবল, আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
আমদ মুসা তার জ্যাকেটের পকেটে একটা রিভলভার রেখে ডান হাতে একটা রিভলভার বাগিয়ে ধরে এক লাফে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। নির্দেশ দিল সবাইকে মাথার উপর হাত তুল…
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। তার বাম দিকে কিছু দূরে এ দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো একজন লোক এদিকে ঘুরেই গুলি করল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
এমন ঘটনা আহমদ মুসার জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল না।
আহমদ মুসা নিজেকে এক পাশে সরিয়ে নিয়েই লোকটিকে গুলি করল।
লোকটি দ্বিতীয় গুলি করার আগেই বুকে গুলি খেয়ে ভূমিশয্যা নিল।
ইতিমধ্যে ঘরের অন্য পাঁচজনই রিভলভার পকেট থেকে আহমদ মুসার বাম হাত রিভলভারসহ বেরিয়ে এসেছিল। আহমদ মুসার ডান হাত গুলি করার সাথে সাথেই তার বাম হাতও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রথম গুলি করার পর ডান হাতও বাম হাতের সাথে যুক্ত হলো। পাঁচ জনের মধ্যে চারজনই গুলি খেয়ে পড়ে গেল। পঞ্চম লোকটি, মানে ক্রিমিনাল চেহারার সুবেশধারী লোকটি সালিহা সানেমের পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল।
লোকটি তার রিভালভারের নল সালিহা সানেমের মাথায় ঠেকিয়ে দাবী করল যে, আহমদ মুসা তার হাতের রিভলভার ফেলে না দিলে সে সালিহা সানেমকে গুলি করবে। সে আহমদ মুসাকে রিভলভার ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াবার নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসা রিভলভার ফেলে দিয়ে দুই হাত কান পর্যন্ত উঠাল।
লোকটি সালিহা সানেমের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘তুমি যেই হও, তোমার হাতের তারিফ করি। তেমার মত এত দ্রুত রিভলভার চালানোর মত লোক জীবনে আমি দেখিনি, ওয়েস্টার্ন উপন্যাসে পড়েছিই শুধু।’
লোকটি মুহূর্তের জন্যেও সালিহা সানেমের মাথা থেকে রিভলভার সরায়নি।
সে আহমদ মুসাকে নির্দেশ দিল হাত উপরে রেখে দরজা থেকে সরে পশ্চিমের দেয়ালের দিকে চলে যেতে।
আহমদ মুসা বিনা বক্য ব্যয়ে তাই করল।
লোকটি সালিহা সানেমকে দরজার দিকে হাঁটার নির্দেশ দিল।
হাঁটতে লাগল সালিহা সানেম।
লোকটিও তার রিভলভারের নল সালিহা সানেমের মাথায় চেপে ধরে চোখ দু’টো আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ রেখে সালিহা সানেমের সাথে হাঁটা শুরু করেছে।
আহমদ মুসা বলল, ‘বৃথাই চেষ্টা করছ। তোমার বাঁচার উপায় নেই। একবার দরজার দিকে তাকাও।’
লোকটি ফাঁদে পড়ে গেল। সত্যিই সে সংগে সংগে চোখ ফিরাল দরজার দিকে। এটুকু সুযোগেই আহমদ মুসা চাচ্ছিল।
লোকটি চোখ ফেরাতেই আহমদ মুসা মাথার পেছরে জ্যাকেটের গোপন এক পকেটে আটকানো রিভলভার ডান হাতে তুলে নিয়েই গুলি করল।
আহমদ মুসা গুলি করেছিল লোকটির রিভলভার ধরা হাতে।
লোকটি অসম্ভব ক্ষীপ্র। সে দরজার দিকে চোখের একটা পলক ফেলেই বুঝতে পেরেছে যে তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে।
সংগে সংগে সে তার রিভলভার ধরা হাত ও মুখ এক সাথেই আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়েছে। তার ফলে তার হাতটা আগের জায়গা থেকে সরে এসেছে। আর তার জায়গায় গিয়ে সেট হয়েছে তার মাথা।
হাতের বদলে মাথায় গুলি খেল লোকটা।
দেহটা তার পাক খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
মেয়েটা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে এবং ডুকরে কেঁদে উঠল।
আহমদ মুসা সালিহা সানেমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘শান্ত হও বোন, আর ভয় নেই।’
আহমদ মুসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গায়ের জ্যাকেটটা খুলে সালিহা সানেমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘জ্যাকেটটা পরে নাও।’
সালিহা সানেমের বোধ এতক্ষণে যেন ফিরে এল। বিব্রতকর এক অস্বস্তিতে তার মুখ কুঁকড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে তার প্রায় নগ্ন গায়ে জ্যাকেটটা পরে নিল।
তার গায়ের গোলাপি সর্টটা টুকরো টুকরো অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছিল।
আহমদ মুসা বাম হাতের রিভলভারটা পকেটে পুরে ডান হাতের রিভলভার বাগিয়ে ধরে ঘর থেকে বেরুবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, ‘এসো সানেম।’
সালিহা সানেম আহমদ মুসার পেছনে পেছনে চলতে লাগল।
আহমদ মুসা ওপরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠে এল।
রিসেপশন কাউন্টারেই পেল বিপুল বপু লোকটাকে। আহমদ মুসা এগোলো তার দিকে।
বিপুল বপু লোকটি আহমদ মুসার হাতে রিভলভার আর মেয়েটাকে বেঢপ জ্যাকেট পরা বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়াল।
‘আপনাদের আন্ডারগ্রাউন্ডটা ক্রিমিনালদের আড্ডাখানা, তাই না? ক্রিমিনালদের সাথে তাহলে ক্রিমিনালদের যোগ আছে? এখানকার থানার ফোন নম্বর দিন।’ ধমকের সুরে বলল আহমদ মুসা।
লোকটি পুলিশের কথা শুনে আর্তনাদ করে উঠল। বলল, ‘স্যার, বিশ্বাস করুন, আমরা প্রাণের ভয়ে ওদের কথা শুনতে বাধ্য হই। আমরা ক্রিমিনাল নই। আমরা ব্যবসায়ী।’
‘পুলিশের টেলিফোন নাম্বার দিন, তাদের কাছেই আপনার এ কথাগুলো বলবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
বিপুল বপু লোকটি আহমদ মুসার সামনে এসে হাত জোড় করে বলল, ‘স্যার, পুলিশকে ডাকবেন না দয়া করে। আমাদের ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে।’
‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে ছয়-সাতটা লাশ পড়ে আছে। পুলিশ না এলে ওগুলোর কী হবে?’
‘ছয়-সাতটা লাশ?’ উচ্চারণ করল বিপুল বপু লোকটি। তার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে।
তারপর ‘ও গড!’ বলে বসে পড়ল সে।
‘পুলিশের নাম্বার দিলেন না? আমি থাকা অবস্থায় পুলিশ এলে আপনাদেরই ভালো হতো?’ বলল আহমদ মুসা।
তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল বিপুল বপু লোকটি। বলল, ‘স্যার, দিচ্ছি টেলিফোন।’
বলে সে ছুটল রিসেপশন টেবিলে। ইনডেক্স দেখে নাম্বার বের করে নিজেই ডায়াল করল। বলল, ‘স্যার, রিং হচ্ছে। টেলিফোন নিন আপনি।’
‘তুমিই জানাও পুলিশকে। আসতে বল পুলিশকে তাড়াতাড়ি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। সেই ভালো। আমি বলছি পুলিশকে।’ বলল বিপুল বপু লোকটি।
সাত-আট মিনাটের মধ্যেই পুলিশ চলে এল। একজন পুলিশ অফিসার পাঁচ-ছয় জন পুলিশ নিয়ে রিসেপশন লিউঞ্জে প্রবেশ করল।
‘কি মি. নাদির। কী ঘটিয়েছেন আপনি? কোথায় খুন? কোথায় লাশ?’ লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে পুলিম অফিসারটি বিপুল বপু লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল।
তড়িঘড়ি ছুটে এল নাদির নামের বিপুল বপু লোকটি পুলিশের কছে। বলল, ‘স্যার আমি ঘটাইনি। ওরা সাক্ষী।’ আহমদ মুসাদের দেখিয়ে বলল নাদির সামের বিপুল বপু লোকটি।
আহমদ মুসা ও সালিহা সানেম তখন বসে রিসেপশনের সামনের দু’টি সোফায়। পুলিশ অফিসার তাকাল তাদের দিকে।
‘খুনের সময় আপনারা ছিলেন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ অফিসার।
‘ছিলাম শুধু তাই নয়, যাদের লাশ পড়ে আছে, তাদের আমিই খুন করেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি? তাহলে পালাননি কেন?’
‘পালাব কেন? লাশ আপনাদের হাতে তুলে দেবার জন্যে বসে আছি।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার একবার দৃষ্টি তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি খুন করেছেন? কেন?’
আহমদ মুসা তাকাল বিপুল বপু মি. নাদিরের দিকে। বলল, ‘বলুন মি. নাদির, পুলিশ অফিসারকে সব খুলে বলুন।’
বিপুল বপু পুলিম অফিসারকে বলল কিভাবে সাত আটজন লোক ক্রন্দনরত সালিহা সানেমকে হোটেলে নিয়ে এল, কিভাবে অস্ত্রের মুখে তারা বাধ্য করল বেজমেন্টের রুম তাদের ছেড়ে দিতে, কিভাবে আহমদ মুসা অস্ত্রধারীদের লোক পরিচয় দিয়ে বেজমেন্টে চলে গেল। শেষে সে বলল, ‘এই মাত্র বেজমেন্ট রুম থেকে এসে ইনি আমাকে বললেন, ঐ সাত-আটজন অস্ত্রধারী নিহত হয়েছে, পুলিশে খবর দাও। আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি স্যার। ওদের সাত-আটজন নিহত হওয়ার কথা শুনেছি, এখনও দেখিনি। আমরা পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছি।’
পুলিশ অফিসার ঘুরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘চলুন আমাদের সাথে। লাশগুলো আগে দেখব।’
‘আমরা এখানে বসে আছি। মি. নাদিরকে নিয়ে আপনারা দেখে আসুন।’ আহমদ মুসা বলল ঠান্ডা কণ্ঠে।
পুলিশ অফিসার ইতস্তত করছিল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘পালানোর ইচ্ছা থাকলে আগেই পালাতাম। এখনো পালাতে পারি। আপনারা কয়েকজন আমাদের আটকাতে পারবেন না।’
পুলিশ অফিসার মুহূর্ত কয় আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা বসুন। আমরা আসছি। নিয়ম অনুসারে একজন পুলিশ এখানে থাকবে।’
‘নিয়ম তো আপনাদের পালন করতেই হবে।’ বলে হাসল আহমদ মুসা।
একজন ছাড়া পুলিশ অফিসার অন্য পুলিশ সদস্য ও মি. নাদিরকে নিয়ে বেজমেন্টে নেমে গেল। ফিরে এল মিনিট দশেক পর।
পুলিশ অফিসার এলে আহমদ মুসা বলল, ‘ভিকটিম এই মেয়ের জবানবন্দী নিয়ে নিন। আমরা চলে যাবো।’
‘কিন্তু আপনাদের যে থানায় যেতে হবে।’ পুলিশ অফিসার বলল।
‘থানায় যাবার দরকার নেই। আপনি মেয়েটার জবানবন্দী নেবেন। আপনারা মামলা দায়ের করবেন। আপনারা ডাকলে মেয়েটি সাক্ষ্য দেবার জন্যে আসতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু নিয়ম হলো…।’ কথা বলতে শুরু করেছিল পুলিশ অফিসার। আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটাও নিয়ম।’
পুলিশ অফিসারের মুখে অসন্তোষ ফুটে উঠল।
বলল, ‘আমরা যে নিয়মের কথা বলব, সেটাই মানতে হবে।’
আহমদ মুসা সালিহা সানেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার আইডি কার্ড দাও।’
সালিহা সানেম তার আইডি কার্ড বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসাও নিজের আইডি কার্ড বের করে দু’টি আইডি কার্ড পুলিশ অফিসারের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘আপনি ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার লিখে নিন। দরকার হলে গিয়ে আমাদের এ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবেন। এখন আমাদের হাতে সময় নেই; আমরা চললাম।’
পুলিশ অফিসার দু’টি আইডি কার্ডের দিকে নজর বুলিয়েই চমকে উঠল। সংগে সংগে উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে স্যালুট করল। বলল, ‘স্যার, মাফ করুন। আপনাদের পরিচয় জানলে এসব কথা বলতাম না। স্যার, আমি ম্যাডামের জবানবন্দী লিখে নিচ্ছি, একটু সময় দিন স্যার।’
সালিহা সানেমের আইডি কার্ডে তার পরিচয় দেয়া ছিল ‘আংগোরা মিলিটারি স্টাফ কলেজের ট্রেইনি, জেনারেল মেডিন মেসুদের মেয়ে।’ আর আহমদ মুসার আইডি কার্ডে পরিচয় লেখা ছিল, ‘ভিভিআইপি সিকিউরিটি পারসোনেল।’ তার কার্ডে ইনস্ট্রাকশন ছিল, কার্ড হোল্ডার সব জায়গায় আ্যাকসেস পাবেন এবং যে সহযোগিতা তিনি চাইবেন, তা তাকে দিতে হবে।’ কার্ডে তুরস্কের পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন এবং তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি প্রধান জেনারেল মোস্তফা কামালের দস্তখত ছিল।
‘ঠিক আছে, ওর জবানবন্দী লিখে নিন। আমিও আমার ছোট্ট একটা মন্তব্য লিখে দেব।’ বলল আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের কথার জবাবে।
‘ধন্যবাদ স্যার!’ বলে পুলিশ অফিসার নিজেই লিখতে বসে গেল।
ড্রইং রুমের দরজা খুলে যেতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল সালিহা সানেমকে। সালিহা সানেমই প্রথম সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা ভেতরে দিল আহমদ মুসাকে।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ ভেতরে প্রবেশ করল।
সালিহা সানেম সোফা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন স্যার। আব্বা হঠাৎ টেলিফোন পেয়ে হেড কোয়ার্টারে গেছেন। এখনি এসে যাবেন। আমাকে এ্যাটেন্ড করতে বলেছেন আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
সালিহা সানেম আহমদ মুসার সামনে এক সোফায় বসল।
সালিহা সানেমের পোষাক দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। ফুলহাতা কামিজ পরেছে। একটা ওড়না মাথার উপর দিয়ে গলা পেঁচিয়ে গায়ের উপর নেমে এসেছে। পরনে ঢিলা সালওয়ার। মুখে বাহুল্য মেকআপ নেই। যেটুকু আছে সেটা খুবই স্বাভাবিক। মুখে গাম্ভীর্য।
গতকালের চেয়ে তার আজকের এই রূপ কত ভিন্ন। গতকাল পরনে ছিল টাইট প্যান্ট। বোতাম খোলা সার্ট। চোখে-মুখে উপচে পড়া চপলতা।
বসেই সালিহা সানেম বলল, ‘স্যার, আব্বা আপনার ভক্ত হয়ে গেছেন। গতকাল থেকে কতবার যে আপনার কথা তিনি বলেছেন! যতবার বলেছেন, ততবারই আব্বার কণ্ঠকে কান্নায় ভারি দেখেছি। আব্বাকে এমন ভেঙে পড়া অবস্থায় কখনও দেখিনি। জানেন, আজ ভোরে আমি আব্বাকে কুরআন শরীফ পড়তে দেখেছি। আব্বা যে কুরআন পড়তে জানেন, সেটাই আমি জানতাম না।’
‘সালিহা সানেম, এটা আমার প্রতি ভক্তির প্রকাশ নয়। আপনার প্রতি তার সীমাহীন ভালোবাসা এটা। আপনি তার একমাত্র সন্তান। আপনার বিপদে পড়া তার সমগ্র সত্তাকেই নাড়া দিয়েছে। কুরআন যে তিনি পড়েছেন, সেটা আপনার বিপদ মুক্তির জন্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তিনি আপনাকে এ্যাঞ্জেল, মানে আল্লাহর ফেরেশতা বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, ‘আমি সৈনিক হিসেবে ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত। কিন্তু জনাব আবু আহমদ যে পরিস্থিতিতে যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এবং যে ঝুঁকি নিয়েছেন, তা আমি পারতাম না।’’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এমন তিনি বলতেই পারেন। আপনার মুক্ত হওয়া তাকে সীমাহীন আনন্দ দিয়েছে। আর বেশি আনন্দিত হলে মানুষ কথা বেশি বলেন এবং বিশেষণও বেশি ব্যবহার করেন।’
‘আপনিও বেশি বলছেন স্যার, যাতে কোন প্রশংসা আপনার উপর আরোপ না হয়।’ বলল সালিহা সানেম।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রশংসা এভাবে অপাত্রে আরোপ করা হবে কেন? আমি যে কৌশল, বুদ্ধি, সাহস ও শক্তি দেখিয়েছি, তার কোনটা আমি সৃষ্টি করেছি বা কোনটার আমি মালিক? একটারও নয়। আমি যা পেয়েছি, তাতে আমিও বিস্মিত হয়েছি, কৃতজ্ঞ হয়েছি আল্লাহর প্রতি যে, তিনি এই শক্তি, সাহস, কৌশল আয় বুদ্ধি আমাকে দিয়েছেন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও সালিহা সানেম কিছু বলল না। গাম্ভীর্যের একটা ছাপ নামল সালিহা সানেমের চোখে-মুখে। সেই সাথে মাথাটা তার নিচু হলো।
মুহুর্ত কয় পর সে মাথা তুললো। বলল আস্তে আস্তে, ‘স্যার, গতকাল প্লেনে আমি বলেছিলাম, আমি আপনার কথা বুঝলাম তবে মানতে পারলাম না। মেনে নেয়ার জন্যে আমাকে আরও ভাবতে হবে। গতকাল ঐ ঘটনার সময় আমার মনে সেই ভাবনা এসেছিল। আমি গতকাল সারারাত এ নিয়ে ভেবেছি স্যার, ওরা আমার উপর যে আক্রমণ করেছিল, তাতে ওরা দোষী। কিন্তু ওদের চেয়ে আমি বেশি অপরাধী। আমি গত কয়েকদিন এস্কান্দারুন সী বিচে এবং এস্কান্দারুনের নাইট ক্লাবে যে পোষাক পরে যেভাবে ওদের সাথে মানে সবার সাথে নেচেছি, সেটা তাদেরকে আমার প্রতি প্রলুব্ধ করা ও আমন্ত্রণ জানানোর মতোই। তারা যখন প্রলুব্ধ হয়ে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে নগ্ন দাবী নিয়ে তখন তাদেরকে আমি অপমান করেছি। সে অপমানের শোধ তাদের নেবারই কথা। তার চেয়ে বেশি কিছু তো করেনি। আমার অপরাধই তাদের অপরাধী বানিয়েছে। আমি…’
কথা শেষ করতে পারলো না সালিহা সানেম। কান্নায় আটকে গেলে তার কথা। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
‘ধন্যবাদ সালিহা সানেম, তোমার উপলব্ধির জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘উপলব্ধি এল অনেক দেরিতে। অনেক পাপ করেছি আমি। আল্লাহর কাছে তো আমি দাঁড়াতে পারবো না। কী বলব আল্লাহকে আমি! আজ ফজরে আমি চেষ্টা করেও নামাযে দাঁড়াতে পারিনি।’ বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে সালিহা সানেম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি কুরআন শরীফ পড়া জান না?’
‘না, জানি না স্যার। ছোট বেলায় দাদার কাছে কিছু সূরা ও দোয়া শিখেছিলাম। তিনি নামাযও শিখিয়েছিলেন। এটুকুই আমার সম্বল।’
‘কুরআন পড়নি সে জন্যেই হতাশ হচ্ছ এবং আল্লাহর কাছে দাঁড়াবে কিভাবে সেটা ভাবছ। ভাবনার কিছু নেই সানেম। আল্লাহ রহমান, রহীম। তিনি গফুর। তিনি তাঁর বান্দাহদের মাফ করার জন্যে সর্বক্ষণ তৈরি আছেন। যতই গুনাহ নিয়ে বান্দার তাঁর ক্ষমার জন্যে প্রার্থনা করুক, তিনি মাফ করেন। কুরআন শরীফে তিনি বলেছেন, ‘বল (হে রসূল), হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ (অন্যায়, অবিচার, অনাচার, গুনাহের মাধ্যমে), আল্লাহর ক্ষমা সম্পর্কে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব অপরাধ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এস এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর সেই শাস্তি আসার আগে যখন তিনি আর ক্ষমা করবেন না।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সালিহা সানেম আহমদ মুসার দিকে। তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত, কিন্তু তাতে আশার ঔজ্জ্বল্য। বলল, ‘আমার জন্যে তো সেই শাস্তির সময় আসেনি, যখন আর তিনি ক্ষমা করবেন না?’
‘অবশ্যই না। গতকাল তো তিনি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এটা তো তোমার প্রতি আল্লাহর দয়া ও করুণা।’ আহমদ মুসা বলল।
সালিহা সানেমের চোখ দু’টি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া…’
কথা শেষ করতে পারল না সালিহা সানেম। আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখ তার অশুতে আবার ভরে গেল।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করল এক পরিচারিকা। বলল সালিহা সানেমকে, ‘ছোট ম্যাডাম, সাহেব এসেছেন। আসছেন তিনি।’
চলে গেল পরিচারিকা। সালিহা সানেম তাড়াতাড়ি চোখ মুছল।
ঘরে ঢুকল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
জেনারেলের পোষাক তার পরনে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল তার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্যে। কিন্তু জেনারেল মেডিন মেসুদ হ্যান্ডশেক নয়, জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আপনি আত্মীয়ের চেয়ে বড় আত্মীয় আমার। আপনাকে স্বাগত।’
সোফায় বসতে বসতে জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল, ‘দুঃখিত আমি, মি. আবু আহমদ। আমি সময় দিয়েও থাকতে পারিনি। অফিসে জরুরি কাজ পড়েছিল।’
বলেই তাকাল মেয়ে সালিহা সানেমের দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ মা, তুমি মেহমানকে এ্যাটেন্ড করেছ। চা-টা দিয়েছ মেহমানকে?’
‘জ্বী, আমি নিষেধ করেছি। আমি আপনার অপেক্ষা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
উঠে দাঁড়াল সালিহা সানেম। বলল, ‘বাবা তোমরা কথা বল। আমি ওদিকে দেখছি।’ ড্রইং থেকে বেরিয়ে গেল সালিহা সানেম।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমাকে সময় দেবার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. আবু আহমদ এই সৌজন্যের দরকার নেই। বলেছি, আপনি আমার আত্মীয় হয়ে গেছেন। আপনি আমার পরিবারের একজন।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘ধন্যবাদ আপনার এই শুভেচ্ছার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিশ্চয় আপনার কিছু কথা আছে। বলুন মি. আবু আহমদ।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা কিছু বলল না। ভাবল, সরাসরি কথাটা পাড়বে, না কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সবকিছু জানার চেষ্টা করবে। আহমদ মুসার মন বলল, জেনারেলের মন যে অবস্থায় আছে, তাতে সরাসরি কথায় আসা যায়। সত্যের একটা শক্তি আছে।
এসব ভেবে আহমদ মুসা বলল, ‘স্যার, কিছু জানার আগে আমার সম্পর্কে বলতে চাই। আমি পুলিশের লোক নই, আমি সেনাবাহিনীর লোক নই, কোন গোয়েন্দা বিভাগের লোকও নই। আমি শখের গোয়েন্দাও নই। আমি একজন স্বাধীন মানুষ। তবে নিজ ইচ্ছায় অথবা কোন আহবানে সাড়া দিয়ে কাউকে বা কোন দেশকে সাহায্য করতে আমি ভালোবাসি। এ রকম একটা কাজ নিয়ে আমার এখানে আসা।’
‘সত্য ও সুন্দর পরিচয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। বলুন কী কাজে এসেছেন? আমি কী সাহায্য করতে পারি?’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘আপনার সম্পর্কে কিছু কথা জানতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলুন কী কথা?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মেডিন মেসুদের।
‘এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে তুরস্কের শত্রু একটা সন্ত্রাসী সংগঠনের ট্র্যাপে পড়েছেন আপনি।’ ধীর, শান্ত, শক্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
কথাটা শুনে চমকে উঠল না জেনারেল মেডিন মেসুদ। ধীরে ধীরে চোখ তুলে একবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল তার মুখভাবে তেমন কোন পরিবর্তন নেই। আবার মুখ নিচু করল মেডিন মেসুদ।
বেশ সময় নিল সে কথা বলতে। একসময় মুখ তুলে সে বলল, ‘আমার উত্তর ‘না’ হলে আপনার কাজ কি হবে, আর ‘হ্যাঁ’ হলে আপনি কী করবেন?’
‘উত্তর ‘না’ হলে আমাকে আরও অনুসন্ধান করতে হবে। আর ‘হ্যাঁ’ হলে আমি পরবর্তী কাজে হাত দেবার চেষ্টা করবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার কথা জানার আগে আপনি কি বলবেন, আপনি কতটা জানতে পেরেছেন?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মেডিন মেসুদের।
‘মি. জেনারেল স্যার, মিসেস অ্যানোস আব্দুল্লাহ গাজেনের ডায়েরি থেকে আমি সবকিছুই জানতে পেরেছি। ডায়েরিতে আপনার নাম ছিল না। সে নামও যোগাড় হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো আপনার সবকিছুই জানা হয়ে গেছে। আর কী জানতে চান?’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘স্যার, দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে আপনার সাহায্য চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটা কী?’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘উল্কি চিহ্নধারী, যারা মিসেস অ্যানোস আব্দুল্লাহ গাজেনকে তাদের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করেছিল, যারা আপনাকে ট্র্যাপে ফেলেছিল, যারা এখন মাউন্ট আরারাত অঞ্চলে, বলতে গেলে গোটা পূর্ব আনাতোলিয়া জুড়ে এক শ্রেণীর লোককে উচ্ছেদ করে, অস্থানীয় এক শ্রেণীর লোককে বসাচ্ছে, তারা কারা? এটাই আমার প্রথম জানার বিষয়।’ আহমদ মুসা বলল।
ভাবছিল জেনারেল মেডিন মেসুদ। তার কপালে কয়েকটা ভাঁজের সৃষ্টি হয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। বলল, ‘মানবিক দুর্বলতার কারণেই আমি ওদের ট্র্যাপে পড়ি। আমি মিসেস আ্যানোস আব্দুল্লাহর অসহায়ত্ব দেখে সব বুঝেছিলাম। আমি তাকেও বাঁচাতে পারিনি, আমিও বাঁচতে পারিনি। চাকুরীকে আমি ভয় করি না, শাস্তিকেও নয়। কিন্তু ভয় করেছি আমার পরিবারের বিপর্যয়কে। আমি ওদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশনে যেতে পারিনি এ কারণেই। ওরা আমাকে ওদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছে। আমার অফিসে, আমার চার পাশেও অনেক দালাল সৃষ্টি করেছে। আমি ভয় করছি, আপনি এখানে এসেছেন, এটাও ওদের নজরে পড়বে।’ থামল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
ভ্রু কুচকে গেল আহমদ মুসার। বলল, ‘আমি এখানে এটাও কি ওদের নজরদারিতে পড়বে? এতটাই ক্লোজভাবে ওরা ওয়াচ করছে আপনাকে?’
‘শুধু আমাকে নয়, যাদেরকে ওরা ব্যবহার করে প্রত্যেককেই ওয়াচে রাখে। অতি সম্প্রতি আমার প্রতি ওয়াচ তাদের বেড়েছে। আমি তাদের অনেক কিছু জানি বলেই হয়তো অথবা ওরা বড় কিছু করতে যাচ্ছে। সে কারণেই তাদের এই বাড়তি সতর্কতা।’
একটু থামল জেনারেল মেডিন মেসুদ। টিপয়ে রাখা গ্লাসের পানি থেকে এক ঢোক পানি গিলে বলল, ‘আপনাকে কি ওরা চেনে?’
‘চেনাই স্বাভাবিক। অনেক কয়টা এনকাউন্টার ওদের সাথে আমার হয়েছে। তবে কতটুকু জানে, সবাই চেনে কিনা, তা আমি জানি না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আপনার পরিচয় ওদের সবার কাছে আছে অবশ্যই। এটাই ওদের নিয়ম।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘তাহলে আমি এখানে এসেছি তা ওদের নজরে পড়েছে বলছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমার তাই মনে হয়।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘ঠিক আছে। এতোটা আমি ভাবিনি। সাবধান হতে হবে। এবার প্লিজ বলুন আমি যা জানতে চেয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল জেনারেল মেসুদ।
তারপর সোজা হয়ে সোফায় বসল। বলল, ‘ওরা ওদের পরিচয় সম্পর্কে কোন সময়ই কিছু বলেনি। তবে আব্দুল্লাহ গাজেনের কাছ থেকে আমি জেনেছি, এখন ওরা দুই সংগঠন এক সাথে কাজ করছে। একটা হলো ‘সোহা’, মানে Son of Holy Ararat (SOHA), আর একটা ‘Lover of Holy Ararat’, সংক্ষেপে, ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ বলে এরা নিজেদের পরিচয় দেয়। এদের মধ্যে ‘সোহা’ সংগঠনটি কোন একটা রাজনৈতিক লক্ষ্যে কাজ করছে। আর ‘হোলি আরারাত’ বা ‘আর্ক’ গ্রুপটা ক্রিমিনাল সংগঠন। শুনেছি নুহ (আঃ)- এর নৌকার গুপ্তধন উদ্ধারের জন্যে এরা কাজ করছে। এই দুই সংগঠন কেন একত্রিত হলো, এটা অজানা রহস্য। ‘সোহা’ কী রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কাজ করছে, এটাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’
‘পূর্ব আনাতোলিয়ার কয়েকটি প্রদেশে বিশেষ করে মাউন্ট আরারাত অঞ্চলে মাদক ব্যবসার ফাঁদ পেতে ওরা শত-শত সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষকে জেলে পুরেছে, বহু পরিবারকে তারা বিরান করেছে এবং নতুন বসতি নিয়ে আসছে তারা এই অঞ্চলে। এ সম্পর্কে, এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনি কী জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। ভ্যান অঞ্চলে আমি বেশ কিছু দিন যাই নি।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ওদের সাথে সর্বশেষ যোগাযোগ আপনার কবে হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে জবাব দিল না জেনারেল মেডিন মেসুদ। নতুন একটা ভাবনার রেখা তার চোখে-মুখে। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘সাত দিন আগে ওরা এসেছিল।’
‘কোথায় এসেছিল? বাসায় না অফিসে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা অফিসে যায় না। বাসায় এসেছিল।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘এই সময় তো ওদের ক্রাইসিস ঐ অঞ্চলে। সে সব কোন বিষয় নিয়ে কি তারা এসেছিল?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘ওরা এসেছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবী নিয়ে।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘কী সেটা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তারা ইজদির, আগ্রি, ভ্যান, কারস প্রভৃতি প্রদেশে মোতায়েন করা সেনা অফিসারদের একটা তালিকা নিয়ে এসেছিল। এই মুহূর্তে ওদের ট্রন্সফার চেয়েছিল এই প্রদেশগুলোএ বাইরে কোথাও। সেই সাথে তারা এসেছিল সেনা অফিসারদের আরেকটি তালিকা। তাদের দাবী ছিল ওদের ট্রান্সফার করার পর ঐ শূন্য স্থানগুলো তাদের মনোনীত সেনা অফিসারদের দ্বারা পূরণ করতে।’ ভ্রূ কুচকে গেল আহমদ মুসার।
‘কেন তারা চেয়েছে এটা? কিছু বলেছে তারা?’
‘না বলেনি।’ জবাব জেনারেল মেডিন মেসুদের।
‘বদলি এবং নতুন নিয়োগগুলো কি হয়ে গেছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না, আমি সব ট্রান্সফারে রাজী হইনি। তাদের প্রচন্ড চাপ ও ভয় দেখানো সত্বেও আমি ইজদির প্রদেশ সব এবং আগ্রি ও কারস প্রদেশের দু’একটা ট্রান্সফারে রাজী হয়েছি।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘তাহলে ওদের দেয়া তালিকা অনুসারে ইজদির প্রদেশের সব ট্রান্সফার হয়ে গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, তারা কোন টাইম লিমিট দেয়নি। কিন্তু ‘অবিলম্বে’ করতে হবে এই দাবী ছিল।’
আহমদ মুসার কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো। ভাবছিল আহমদ মুসা। তাদের এই ট্রান্সফার চাওয়া এবং তাদের পছন্দমত লোক বসানোর অর্থ হলো সেনা বিরোধিতা পরিহার করা অথবা সেনা সহায়তা লাভ করা। কিন্তু কেন? তারা পুলিশের ক্ষেত্রে এমন ধরনের কিছু করেনি তা নিশ্চিত। কিন্তু কেন করেনি? হঠাৎ আহমদ মুসার অবচেতন মনের কোন অতল থেকে একটা প্রবল জিজ্ঞাসা ভেনে এলো। তাহলে কি বড় ধরনের এমন কিছু করতে চাচ্ছে যাতে সেনা সহযোগিতা অপরিহার্য? সেটা বিদ্রোহ ধরনের কোন কিছু যেখানে পুলিশের তেমন কিছু ভূমিকা পালনের নেই? চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল, ‘কী ভাবছেন মি. আবু আহমদ?’
‘ভাবছি, ওরা অপছন্দের সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার ও পছন্দের সেনা অফিসারদের সেখানে এনে কী করতে চায়, কী তাদের টার্গেট, এটাই ভাবছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এলাকায় কিছু কাজ তারা বাগিয়ে নিতে চায়, এটাই আমি মনে করেছিলাম।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘সেটাই ভাবা যেত যদি ট্রান্সফার ও রিপ্লেসমেন্টের ঘটনা এক, দুই বা কিছু জায়গায় হতো বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু তা হয়নি। তারা দেশের একটা অঞ্চলের চার-পাঁচটি প্রদেশ থেকে সরিয়ে দেশপ্রমিক সেনা অফিসারদের একখানে আনতে চায়, তাদের আজ্ঞাবহদের এলাকায়। এ ধরনের আয়োজন কিছু কাজ বাগিয়ে নেয়ার জন্যে হতে পারে না। আমার ধারণা, এর সাথে রাজনৈতিক বা ভূখন্ডগত স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
চমকে উঠল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
তার চোখের দৃষ্টিও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘মি. আবু আহমদ, আপনি সাংঘাতিক বিষয়ের দিকে ইংগিত করেছেন। তারা যে দাবী করেছে, একটা প্রদেশে তারা সে দাবী আদায় করে নিয়েছে। তার লক্ষ্য যে, আপনি যা বলেছেন, ঐ ধরনের কিছু হতে পারে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সেটা কী? তারা তো কোন রাজনৈতিক দল নয়। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে বলেও জানি না। আর ভূখন্ডগত লক্ষ্য অর্জনের ব্যপারটাতো আরও বড়।’ জেনারেল মেডিন মেসুদের কণ্ঠে চিন্তার সুর। মুখে তার উদ্বেগের চিহ্ন।
‘কিন্তু এমন হতে পারে আমরা হয়তো যা চিন্তা করতে পারছি না, এমন কিছু তো থাকতে পরে, ঘটতেও পারে। মাদক ব্যবসায়ের ফাঁদে ফেলে যাদের জেলে পাঠানো হচ্ছে, যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং যাদের সেখানে বসানো হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে তারা দুই শ্রেণীর মানুষ। ‘সোহা’ ও ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ সংগঠনগুলোর লোকজন এবং যাদের মাউন্ট আরারাত অঞ্চলে বসানো হচ্ছে, তারা দেখা যাচ্ছে আর্মেনীয় অরিজিন। তারপর তারা মাউন্ট আরারাতের উল্কি পরে। কিন্তু কেন? এই ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে সীমান্তের ওপারে আর্মেনিয়ায়। আর্মেনীয়দের ধর্মীয় জীবন শুধু মাউন্ট আরারাত কেন্দ্রিক নয়, মাউন্ট আরারাত কেন্দ্রিক তাদের একটা রাজনৈতিক দর্শনও আছে। আর্মেনীয়রা বলে প্লাবন সরে গেলে হযরত নূহ (আঃ)- এর কিস্তি যখন মাউন্ট আরাতের উপর এসে দাঁড়ালো, তখন প্লাবন থেকে জেগে ওঠা প্রথম ভূখণ্ড হিসাবে আর্মেনিয়ার রাজধানী ‘ইয়েরেভেন’কে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। এই দেখতে পাওয়া থেকেই হযরত নূহ (আঃ)-এর নাম দিয়েছেন ‘ইয়েরেভেন’। ‘ইয়েরেভেন’ অর্থ ‘দেখা গেছে’। আর্মেনীয়রা মনে করে থাকে, হযরত নূহ (আঃ) নিজেই মাউন্ট আরারাত ও আর্মেনিয়াকে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ করে গেছেন। এ ছাড়া তারা বলে মাউন্ট আরারাত সন্নিহিত গোটা অঞ্চল নিয়ে ছিল আর্মেনীয়দের ‘ওরারতু’ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের নাম থেকে মাউন্ট আরারাতের নামকরণ করা হয়। সুতরাং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই মাউন্ট আরারাত সন্নিহিত গোটা অঞ্চল আর্মেনীয়দের। তারা নিজেদের সেই ‘ওরারতু’ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনে করে। কে জানে আপনার কথিত ‘সোহা’ ও ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ কোন লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে আমি এটুকু জানি উল্কিওয়ালারা আর্মেনিয়ার অতিপ্রাচীন উগ্র জাতীয়তাবাদী একটা গ্রুপ। তারা গ্রেটার আর্মেনিয়ার জন্যে কাজ করে আসছিল। আমি জানি না, ‘সোহা’ ও ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ এর উল্কিওয়ালারা সেই উল্কিওয়ালাদের উত্তরসূরী কিনা!’ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল আহমদ মুসা।
জেনারেল মেডিন মেসুদ স্তম্ভিত চোখে চেয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, মি. আবু আহমদ, আপনি অদ্ভুত এক ইকুয়েশন করেছেন। যা মিলে গেছে উদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে। আমি বিস্মিত হয়েছি। আপনি তুরস্কের সাথে আর্মেনিয়ার সংঘাতের অত্যন্ত গভীরে প্রবেশ করেছেন। প্রফেশনাল প্রয়োজনেই সামরিক একাডেমিতে আমাকে দেশের ইতিহাস ও প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের ইতিহাস পড়তে হয়েছে। কিন্তু ইকুয়েশনটা এভাবে আমাদের সামনে আসেনি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। মাউন্ট আরারাত ও আর্মেনিয়া সম্পর্কে যা বলেছেন তাতো সত্যই। ওরারতু সাম্রাজ্য সম্পর্কে যা বলেছেন তা যে সত্য তার প্রমাণ আমাদের সামনেই রয়েছে। ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’- এর তুরস্কের চীফ যিনি তার নাম ‘ওরান্ত ওরারতু’। অর্থাৎ, ‘ওরারতু সাম্রাজ্য তারা ফিরিয়ে আনতে চায়’- আপনার এ কথা সত্য।’ বলে একটু থামল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। সে মুখে অপরাধবোধের একটা চিহ্ন। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘আমি জানি না তারা দেশের কী সর্বনাশ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। আমি তাদের সহযোগিতা করেছি, এখনও করছি। এখন বলুন আমি কী করতে পারি?’
‘জেনারেল মেডিন মেসুদ, শুধু আপনি কেন, এমন শত শত মানুষকে বিভিন্নভাবে ট্রাপে ফেলে ওরা ব্ল্যাকমেইলিং করছে। ওদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে ওদের শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই শুধু ওদের এই কালো থাবা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানো সম্ভব। আপনি সাহায্য করেছেন। ওদের পরিচয় আপনার মাধ্যমেই জানতে পারলাম। এখন ওদের কোন ঠিকানা অথবা ওদের কোন কনট্যাক্ট সূত্র আমাদের পাওয়া দরকার যাতে বড় কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই ওদের পাকড়াও করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ওদের কোন ঠিকানা কোন দিন পাইনি। টেলিফোন নাম্বারও না। তবে অ্যানোস আব্দুল্লাহ্ গাজেন কি এক প্রেক্ষাপটে আমাকে ওদের একটা কনট্যাক্ট পয়েন্ট দিয়েছিলেন। আমি কোন দিন সেটা খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করিনি। সেটা হলো…।’
কথা শেষ করতে পারলো না জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘বাবা, তোমরা সাবধান! সাবধান! ওরা প্রহরীদের মেরে ফে…।’ চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল সালিহা সানেম।
কিন্তু সে কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করল জনা পাঁচেক লোক। ওদের হাতে উদ্যত রিভলভার।
ওদের রিভলভার তাক করেছে জেনারেল মেডিন মেসুদ ও আহমদ মুসা দু’জনকেই।
আহমদ মুসা ও জেনারেল মেডিন মেসুদ দু’জনেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ঘটনাটা তাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই আকস্মিক।
আহমদ মুসার হাত দু’টি মাথা পর্যন্ত উঠেছিল। ওরা হাত তুলতে নির্দেশ দেয়নি তখনও। মনে হবে যেন আহমদ মুসা ভয়েই আগাম হাত তুলে ফেলেছে। আসল ব্যাপার হলো, আহমদ মুসার সাথের একমাত্র রিভলভারটা রয়েছে মাথার পছনে জ্যাকেটের গোপন পকেটে আটকানো। আরও একটা রিভলভার পকেটে ছিল। সেটা সিকিউরিটির লোকজন গেটেই রেখে দিয়েছে।
ড্রইংয়ে ঢুকেই ওদের একজন চিৎকার করে জেনারেল মেডিন মেসুদকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বিশ্বাসঘাতক, আমাদের সাথেও গাদ্দারী করলি? আমাদের শত্রু এক শয়তানকে আমাদের সব কথা বলে দিলি? এতক্ষণ তোর লাশ ফেলে দিতাম। কিন্তু সময় নিলাম এই কথা বলার জন্যে যে, তুই আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলি, কিন্তু তাতে লাভ হলো না। কারণ যে শয়তানকে সব কথা বলেছিস, তাকেও তোর সাথেই যেতে হবে পরপারে।’
বলে হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘মনে করেছিলি চারদেয়ালের ভেতর ষড়যন্ত্র করবি, কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু জানিস না তোকেও আমরা সার্বক্ষণিক পাহারায় রেখেছি। তোর বাড়ির ড্রইংরুমসহ কয়েকটি স্থানে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাসহ ট্রান্সমিটার পতা রয়েছে। তোর সব কথা সব দৃশ্যই আমাদের কাছে পৌঁছে যায়।’ একটু থামল লোকটি।
তাকাল সে ড্রইং রুমের ভেতরের দরজায় দাঁড়ানো সালিহা সানেমের দিকে। বলল, ‘ভালোই হলো জেনারেল। তোর প্রাণ-ভোমরা অতিব আদরের একমাত্র সন্তানও হাজির। সেই প্রাণ-ভোমরা চোখের সামনে গুলি খেয়ে ঢলে পড়তে দেখলে তোর কেমন লাগবে?’ বলেই রিভলভারের নল সে সালিহা সানেমের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
‘নিরস্ত্র একজন মহিলাকে মারতে আপনাদের লজ্জা হচ্ছে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে শয়তান তোকে দিয়েই শুরু করি।’ বলে রিভলভারের নল সে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসার মাথা পর্যন্ত তোলা হাত দু’টো মাথার পেছন পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। লোকটির কথার রেশ বাতাসে মেলাবার আগেই তার ডান হাত মাথার পেছন থেকে রিভলভার টেনে নিয়েই হাতটা সামনে এনেই গুলি করল লোকটির ঠিক কপাল লক্ষ্য করে।
গুলি করেই আহমদ মুসা বাঁ দিকে মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু তার চোখ এবং রিভলভার ধরা হাতটা লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।
অন্য চারজন ইতিমধ্যে আহমদ মুসাকে টার্গেট করে ফেলেছিল। গুলি তারা করল। কিন্তু ততক্ষণে আহমদ মুসার দেহটা মাটিতে গিয়ে পড়েছে। চারটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পেছনের দেয়ালে গিয়ে আঘাত করল।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই রিভলভারের ট্রিগার চেপে ধরেছিল। স্বয়ংক্রিয় রিভলভার থেকে একের পর এক বেরুতে লাগল গুলি। আহমদ মুসা শুধু তার রিভলভারের নলটাকে অবশিষ্ট চারজনের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। ওদিকে ওরা চারজন প্রথম গুলি করার পর দ্বিতীয় গুলির জন্যে রিভলভারের নল ঘুরিয়ে নিচ্ছিল নতুন টার্গেটের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় গুলি করার পজিশনে পৌঁছার আগেই আহমদ মুসার স্বয়ংক্রিয় রিভলভারের চারটি গুলি ওদের চারজনকে শিকার করে ফেলল।
ড্রইংরুমের ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সালিহা সানেম যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল।
আর বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল জেনারেল মেডিন মেসুদ। তার পরনে জেনারেলের ইউনিফর্ম। কিন্তু সে সশস্ত্র ছিল না। আহমদ মুসার সাথে আলোচনায় বসার আগেই রিভলভার রেখে এসেছিল।
গুলি খেয়ে শেষ চারজনকে পড়ে যেতে দেখল জেনারেল মেডিন মেসুদ। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসাএ হাতে রিভলভার। তখনও মেঝে থেকে ওঠেনি সে।
জেনারেল মেডিন মেসুদ ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আমি ঠিক আছেন তো মি. আবু আহমদ?’
‘আল হামদুলিল্লাহ। আমি ঠিক আছি জেনারেল।’
জেনারেল মেডিন মেসুদ জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আবু আহমদ। গতকাল আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন। আজ আবার আমাদের দুজনকেই বাঁচালেন। আল্লাহ্’র হাজার শোকর।’
জেনারেল মেডিন মেসুদ আহমদ মুসাকে টেনে এনে বসাল সোফায়।
এই সময় সিকিউরিটির লোকেরা দৌড়ে এসে ঘরে ঢকল। একজন অফিসার পাঁচটি লাশের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনারা ভলো আছেন তো? স্যার, গেটের তিন জন সিকিউরিটিকে মারতে ওরা সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার ব্যবহার করেছে। রাস্তায় গাড়িতে থাকা আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি।’
‘হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি। এই ভালো থাকার কৃতিত্ব তাঁর। মি. আবু আহমদের কাছে রিভলভার না থাকলে এবং তিনি বিস্ময়কর ধরনের ক্ষীপ্র না হলে ওদের বদলে আমাদের লাশই পড়ে থাকতো।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘স্যরি, ইট ইজ এ গ্রেট ল্যাপস অন আওয়ার পার্ট, স্যার।’ সেই অফিসারটি বলল।
‘ল্যাপস কিছু হয়নি তোমাদের। বল, ওরা সফল হয়েছিল।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ। সে একটু থেমেই আবার বলল, ‘লাশগুলোর ব্যবস্থা কর অফিসার।’
‘স্যার, পুলিশকে ইনফর্ম করেছি। ওরা আসছে। স্যার, আপনারা একটু ওদিকে বসুন। আমরা এদিকটা দেখছি।’ অফিসারটি বলল।
‘ওকে নিয়ে তুমি এসো বাবা ভেতরের লাউঞ্জে। আমি দেখছি ওদিকে।’ বলেই সালিহা সানেম ভেতরে ঢুকে গেল।
‘চলুন মি. আবু আহমদ। আমরা ওদিকে বসি।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘মি. জেনারেল, ওদের বলুন ওরা লাশগুলোকে ভালোভাবে যেন সার্চ করে। ওদের পরিচয়, ঠিকানা আমাদের দরকার।’
জেনারেল তাকাল অফিসারের দিকে। অফিসার স্যালুট দিয়ে বলল, ‘আমরা সবকিছু ভালোভাবে দেখব স্যার।’
‘আচ্ছা মি. আবু আব্দুল্লাহ, আপনার কাছে তো রিভলভার থাকার কথা নয়। ওটা তো সিকিউরিটরা গেটেই রেখে দেয়ার কথা।’ চলতে চলতে বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘আমার পকেটের রিভলভারটা ওদের দিয়েছিলাম। কিন্তু লুকানো দ্বিতীয় রিভলভার আমি দেইনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘গোপন করলেন কেন? আপনি কি জানতেন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে?’ বলল সালিহা সানেম।
‘জানার কথা অবশ্যই নয়। আমি আমার অভ্যাস বশতই আমার গোপন অস্ত্রটি আমার কাছে রেখেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। মি. আবু আব্দুল্লাহ। আপনার এই অভ্যেস আজ আমাদের বাঁচিয়েছে।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘আচ্ছা ধরুন স্যার, যদি আপনার কাছে রিভলভার না থাকতো, তাহলে কী করতেন আজ?’ জিজ্ঞাসা সালিহা সানেমের।
‘কী করতাম ঘটনা ঘটার পর বলা মুষ্কিল। তবে প্রথম সুযোগেই ওদের একজনের অস্ত্র দখল করার চেষ্টা করতাম। আল্লাহর সাহায্য চাইতাম…’
‘ধন্যবাদ মি. আবু আহমদ। সব বিষয়ই আল্লাহ্ আপনাকে অকৃপণ হাতে দিয়েছেন। তাঁর হাজার শোকর।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই সালিহা সানেম বলল, ‘আমরা এসে গেছি। আসুন, বসেই আমরা কথা বলি।’
সবাই এগোলো বসার জন্যে সোফার দিকে।
৩
আংকারা এয়ারপোর্ট।
ভি.ভি.আই.পি. পার্কিং-এ গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
একজন সামরিক অফিসার ছুটে এসে বলল, ‘স্যার আসুন।’
আহমদ মুসাকে নিয়ে অফিসারটি লিফটে প্রবেশ করল।
লিফট তাদেরকে ভি.ভি.আই.পি. লাউঞ্জে নিয়ে এল।
অফিসারটি আহমদ মুসাকে একটা সোফায় বসিয়ে তার তিন-চার গজ পেছনে গিয়ে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
মিনিট খানেকের মধ্যেই জেনারেল মেডিন মেসুদ সেখানে এল। সেনা অফিসারকে যেতে বলে আহমদ মুসার কাছে এল সে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করল। বলল, ‘সালিহা সানেম আসেনি?’
ম্লান হাসল জেনারেল মেডিন মেসুদ। বলল, ‘একদম ছেলে মানুষ। জেদ ধরে বসে আছে। আমাকে বলেছে, আমি স্যারকে বিদায় দিতে পারবো না। আমি যাব না এয়ারপোর্টে। এই জেদ থেকে তাকে নড়াতে পারিনি।’
বলে জেনারেল মেডিন মেসুদ পকেট থেকে একটা ফোল্ডার বের করে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে আপনার টিকেট ও বোর্ডিং কার্ড রয়েছে।’
‘ধন্যবাদ!’ বলে ফোল্ডারটি নিয়ে আহমদ মুসা হ্যান্ড ব্যাগের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার সাথে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের বৈঠক হয়েছে। সেখানে জেনারেল মোস্তফা এবং সেনাপ্রধানও ছিলেন। আপনার বিষয়টি নিয়েও আমি আলোচনা করেছি। আপনি পদত্যাগ করতে চান, সে কথাও আমি আলোচনা করেছি। তারা পদত্যাগের সাথে একমত হননি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তার তত্বাবধানে সেনা, পুলিশ ও বাছাইকরা কিছু গোয়েন্দা অফিসারকে নিয়ে ‘অ্যান্টি টেরোরিস্ট ব্যুরো’ (ATB) নামে একটা ‘অপারেশন সেল’ হচ্ছে, সেখানেই আপনাকে কো-ডাইরেক্টর হিসাবে নিতে চান। আমি এটাকে খুব ভালো মনে করেছি।’
‘আমি পদত্যাগ অফার করেছি আমার বিবেকের তাড়নায়। তবে আমার জন্যে তাঁরা যা ভালো মনে করছেন, আপনি যা ভালো মনে করছেন, তার মধ্যেই আমার কল্যাণ আছে বলে আমি মনে করছি।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ধন্যবাদ জেনারেল। প্রধানমন্ত্রী শিঘ্রই আপনাকে ডাকবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মেডিন মেসুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলা হলো না। সালিহা সানেম গট গট করে পা ফেলে সেখানে এসে হাজির হলো। তার পরনে তুর্কি সুলতান পরিবারের ঐতিহ্যিক পোষাক। মুখের একাংশে পাতলা একটা নেকাব।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ সালিহা সানেম, তুমি এসেছ সেজন্য।’
সালিহা সানেম নিজেকে সোফার উপর ছুঁড়ে দেবার মত ধপ করে বসে বলল, ‘ওয়েলকাম, স্যার। আমি এসেছি, কিন্তু বিদায় দেবার জন্যে নয়। একটা কথা বলার জন্যে এসেছি।’
‘কী কথা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আপনি কবে আসবেন, এ ওয়াদা নেবার জন্যে আমি এসেছি।’ বলল সালিহা সানেম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ভ্যান অঞ্চলে যে আমি আসব কখনও ভাবিনি, গতকাল আমি আংকারার আংগোরায় এসেছি, এটাও আমার ভাবনার অতীত ছিল। এভাবেই আবার একদিন হয়তো আংকারায় এসে পড়ব। ওয়াদা আমার নিও না বোন।’
বোন সম্বোধনে কেমন যেন ছায়া নেমে এসেই যেন আবার মিলিয়ে গেল।
একটু দেরি করল উত্তর দিতে। একটু ম্লান হাসি ফুটে উঠল মিস সালিহা সানেমের মুখে। বলল সে, ‘বোন বললে তো আসা মাস্ট হয়ে গেল। তাহলে তো ওয়াদা করতেই হবে।’
‘ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়াটাও বোনের জন্যে মাস্ট। আমি তোমাকে, জেনারেল সাহেব ও ম্যাডামকে মদীনায় আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এবারই হজ্জ্বে আসুন। অথবা ওমরার জন্যেও আসতে পারেন। আমরা খুশি হবো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া ঠিক বলেছেন বাবা। আমরা যাব। তুমি প্রোগ্রাম কর।’ সালিহা সানেম বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্। ওর আমন্ত্রণ খুবই মূল্যবান মা। খুবই আনন্দের হবে আমাদের জন্যে। হজ্জ্বের স্বপ্ন আমাদের মনে ছিল। সে স্বপ্ন উনি বাস্তবতায় নিয়ে এলেন। আমরা শীঘ্রই পারিবারিকভাবে বসে সিদ্ধান্ত নেব।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ওয়েলকাম জেনারেল। আমরা খুবই খুশি হবো। আমাকে প্লীজ আপনি জানাবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
একটু থেমেই আবার মুখ খুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘একটা বিষয় আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু বলতে ভুলে গেছি।’
‘আমি কি সানেম মাকে একটু ঘুরে আসতে বলব?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মেডিন মেসুদের।
‘না, ও থাকলে ক্ষতি নেই। বিষয়টা তেমন কিছু নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। শুরু করল আবার, ‘আপনি কি ভেবেছেন আপনার বৈঠকখানায় আমাদের আলোচনা ওরা সংগে সংগেই জানতে পারে, যার ফলে সংগে সংগেই ওরা আক্রমণ করে আমাদের হত্যার জন্যে। কিভাবে এটা সম্ভর হয়েছে?’
জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল, ‘বাড়ির কেউ এটা ওদের জানিয়েছে বলে সন্দেহ করেন? কিন্তু…’
জেনারেল মেডিন মেসুদের কথার মাঝখানেই বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘কিন্তু আপনার কথা ঠিকই, বড়ির কেউ সব কথা শোনেনি। শুনলেও একই সবকিছু শোনা ও বলা সম্ভব নয়।’
‘তাহলে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মেডিন মেসুদের।
‘আমি মনে করি আপনার বাসায় ওরা সিসিটিভি ক্যামেরা ও ট্রান্সমিটার বসিয়ে রেখেছে। আপনাকে সবসময় ওরা ওয়াচে রেখেছে এবং আপনার সব কথা-বার্তাও মনিটর করছে।’
মুখ মলিন হয়ে গেল জেনারেল মেডিন মেসুদের। বিস্ময়ও নামল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, এটাই ঘটেছে। ধন্যবাদ আপনাকে। আমি আজই এসব খুঁজে বের করব। এখনি খবর দিচ্ছি সেনাবাহিনীর আলট্রা সেন্সর টিমকে।’
‘ওরা কারা বাবা? ওরা তোমাকে অনেক কথা বলেছে।’ বলল সালিহা সনেম।
বিব্রত জেনারেল মেডিন মেসুদ কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘ওরা দেশের শত্রু বোন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল, ‘আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি মি. আবু আহমদ। মাউন্ট আরারাত অঞ্চলের যে সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার করা হয়েছিল এবং তাদের জায়গায় যাদের রিপ্লেস করা হয়েছিল, সেই ট্রান্সফার ও রিপ্লেসমেন্ট বাতিল করার অর্ডার তৈরি করেছি। কালকেই এটা কার্যকরী হবে।’
‘না মি. জেনারেল এটা করবেন না। ওদেরকে আমরা ওদের মত করে চলতে দিতে চাই। ট্রান্সফার ও রিপ্লেসমেন্ট বাতিল করলে ওরা বুঝতে পারবে যে, ওদের ষড়যন্ত্র আমরা ধরতে পেরেছি। তাদের এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছে এটা ওদের আমরা জানতে দিতে চাই না। আমরা দেখতে চাই, কী ষড়যন্ত্র ওরা করেছে। প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান জেনারেল মোস্তফা সবাই আমার সাথে একমত। এটা আমাদের জন্যে একটা সুযোগ। এই সুযোগ আপনিই সৃষ্টি করে দিয়েছেন মি. জেনারেল।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই এয়ার লাইন্সের একজন অফিসার এসে জেনারেল মেডিন মেসুদকে বলল, ‘স্যার, বোর্ডিং শেষ। স্যারকে নিতে এসেছি।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন অফিসার।’
হ্যান্ডশেকের জন্য আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিল জেনারেল মেডিন মেসুদের দিকে।
‘সময় খুব তাড়াতাড়িই চলে গেল। আমি কৃতজ্ঞ মি. আবু আহমদ। আপনার হতে আমার নতুন জন্ম হয়েছে।’ হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘আমি কিছুই করিনি জেনারেল। যেটা ঘটেছে, সেটা আপনার তকদির। আল্লাহ্ মানুষের জন্যে খেদমত চান। আল্লাহ্ আপনার সহায় হোন।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল সালিহা সানেমের দিকে। হসল। বলল, ‘এবার তুমি বিদায় না জানালেও আমি বিদায় নেব।’
‘আমি বিদায় জানাব না। তবে বলব আসুন।’ বলল সালিহা সানেম।
‘এটা বিদায় জানাবারই ভাষা।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল সালিহা সানেম। বলল, ‘আমি পরাজয় স্বীকার করলাম। জানেন তো মেয়েদের মন নরম।’
‘আল্লাহ্ নরম মন পছন্দ করেন। আল্লাহ্ হাফেজ বোন।’
বলে সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসার পেছনে চলল এয়ার লাইন্সের অফিসার। আহমদ মুসা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। এরপরও সেদিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে সালিহা সানেম।
জেনারেল মেডিন মেসুদ ধীরে ধীরে হাত রাখল মেয়ের কাঁধে। বলল, ‘চল মা।’
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল সালিহা সানেম। সেই সাথে চোখের অশ্রু মোছার চেষ্টা করল। বলল, ‘বাবা, ওকে না দখলে আমাদের পৃথিবী দেখা অসম্পুর্ণ থেকে যেত। পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাতো না। অর্থ ও এনজয়মেন্টের বাইরে আজকের মানুষ কিছুই ভাবে না। আমি ওকে বিদায় জানাব কি করে, উনি যে আমাকে নতুন জীবন দিয়ে গেলেন।’ আবেগে জড়িয়ে গেল শেষের কথাগুলো সালিহা সানেমের। নতুন করে সিক্ত হলো তার চোখ দু’টি অশ্রুতে।
‘মা, আমিও জীবনে প্রথম বারের মত এমন মানুষের মুখোমুখি হলাম। তুমি সব কথা জান না মা। উনি ইচ্ছে করলে আমার জীবন ধ্বংস করে দিতে পারতেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি আমাকে নতুন জীবন দিয়ে গেলেন। কুরআন শরীফে পড়েছি, আল্লাহ্ বান্দার জন্যে তার দয়াকে অবশ্যকর্তব্য করে নিয়েছেন। ইনি আল্লাহর সে ইচ্ছারই একজন সাক্ষাত দূত। অপরাধীরা এদের স্পর্শেই সোনার মানুষ হয়ে যান। আল্লাহ্ ওকে দীর্ঘজীবী করুন।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ওর পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানি না। কে উনি, ওর পরিচয় কী?’ জিজ্ঞাসা সালিহা সানেমের।
‘আমিও জানিনা মা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টও ওকে সমীহ করেন, শ্রদ্ধা করেন। তার যে কোন কথাই মেনে নেন। বিস্ময়কর এই মানুষ। তার পরিচয় সম্পর্কে আমিও কিছুই জানি না।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘এ কারণে আরও কষ্ট লাগছে বাবা।’ বলল সালিহা সানেম।
‘আমাদের এই কষ্টই ওদের জীবনের সার্থকতা মা। মানুষকে এভাবে জয় করতে পারার চেয়ে বড় সার্থকতা আর নেই মা।’
কথা শেষ করেই বলল, ‘চল মা।’ বাবা-মেয়ে দু’জনেই হাঁটা শুরু করল। আকাশে উড়ল আহমদ মুসার প্লেন।
‘বাবা, এ প্লেন কি ইস্কান্দারুন হয়ে ভ্যান যাবে?’ বলল সালিহা সানেম।
‘না মা, ভ্যানের জন্যে এটা বিশেষ ফ্লাইট। মি. আবু আহমদের জন্যে এই ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভ্যানকে এটা জানিয়েও দেয়া হয়েছে মি. আবু আহমদ নামে একজন বিশেষ মেহমান যাচ্ছে এই ফ্লাইটে।’
‘আলহমদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্ তার সম্মান বাড়িয়ে দিন।’ বলল সালিহা সানেম। লিফট থেকে নেমে তারা গাড়ির দিকে এগোলো।
ইজদির-ভ্যান হাইওয়ে ধরে একটা ব্রান্ড নিউ মাইক্রো ছুটে যাচ্ছে ভ্যানের দিকে।
মাইক্রোটি সেনাবাহিনীর। গাড়ির নাম্বার বলছে মাইক্রোটি ইজদির সেনা-ডিভিশনের। নাম্বার জিরো থারটিন।
মাইক্রোতে আরোহী পাঁচজন। ড্রাইভিং আসনে একজন সেনা ড্রাইভার। মাঝের সীটে দু’জন, সাধারণ পোষাক পরা লোক।
আর একদম পেছনের সীটে দু’জন সামরিক অফিসার। চলছে গাড়ি। মাঝের সীটে সাধারণ পোষাক পরা দু’জন কথা বলছিল। দু’জনের একজনের পরনে কমপ্লিট স্যুট। অন্যজন প্যান্টের সাথে জ্যাকেট পরেছে।
স্যুট পরা লোকটি পেছন দিকে সামরিক অফিসারের পোষাক পরা দু’জনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সাইমন, সোরেন শোন, এটা চুড়ান্ত একটা মিশন। এতে ব্যর্থ হওয়া যাবে না। তোমরা তাকে মারতে না পারলে, হয় সে মারবে তোমাদের, না হয় আমরা মারব তোমাদর। তোমাদের দু’জনের কোমরের বেল্টে বোমা পাতা আছে। তার রিমোট কন্ট্রোল আছে আমাদের হাতে। তোমরা তাকে মারতে ব্যর্থ হলেই তোমাদের দেহ উড়ে যাবে। আর যদি মারতে পার, তাহলে শুধু নতুন জীবন পাবে না, পাবে অঢেল টাকা, দুইজনে পাঁচ মিলিয়ন করে দশ মিলিয়ন ডলার।’
‘স্যার। আমরা মারতে যাচ্ছি, মরতে নয়। এটা নিশ্চিত হলেই হয় যে, তিনি এই ফ্লাইটে আসছেন। ভ্যান এয়ারপোর্টে নামছেন, ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ তিনি আসছেন গাড়িতে ওঠার জন্যে। তাহলে সে নির্ঘাত আমাদের হাতে মরবে যদি ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ ঢোকার আমরা সুযোগ পাই।’ বলল সেনা অফিসারের পোষাক পরা দু’জনের একজন।
সুটধারীই আবার কথা বলল, ‘যা নিশ্চিত হতে চাইছো, তা সবই নিশ্চিত। মি. আবু আহমদ এই ফ্লাইটেই আসছেন। কারণ এ বিশেষ ফ্লাইটটি আবু আহমদের জন্যেই। এয়ারপোর্টের কী পয়েন্টে বসা আমাদের লোক আজ সকালেই এই নিশ্চিত খবরটা দিয়েছে। ক’মিনিট আগেও জানিয়েছে বিশেষ প্লেনটি এখন মধ্য পথে। আর ভিভিআইপি লাউঞ্জ থেকে তারা যে এক্সিট প্ল্যান করেছে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির লোকরা, সেটাও আমাদের সেই লোকই যোগাড় করে দিয়েছে। তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে ভিভিআইপি লাউঞ্জে তার সাথে মিলিত হবেন ভ্যানের পুলিশ প্রধান মাহির হারুন, ড. আজদা, ড. সাহাব নূরী, সাবিহা সাবিত। তাকে নিয়ে নাম্বার ওয়ান ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ আসবে। এক নাম্বার ট্রাকে প্রস্তুত আছে তার জন্য গাড়ি। লিফট থেকে তারা বের হয়ে গাড়ির দিকে এগোবে গাড়িতে ওঠার জন্যে।
এই এক্সিট প্ল্যানটা নিশ্চিত। আর তোমাদের এয়ারপোর্টে ঢুকতে কোন অসুবিধা হবে না। ইজদির পদেশের সেনা ডিভিশনের একজন জেনারেল কমান্ডিং অফিসারের চিঠি তোমাদের কাছে থাকবে। চিঠিতে লেখা আছে তিনি তার একজন আত্শয়াকে রিসিভ করার জন্যে তোমাদের পাঠিয়েছেন। একজন ভিভিআইপি প্যাসেঞ্জারের নামও যোগাড় করা হয়েছে প্লেনের যাত্রী লিস্ট থেকে। ঐ যাত্রীকে যারা রিসিভ করতে যাবেন, এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখে তাদের গাড়ি আটকাবার ভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ ঢুকতে পারার ব্যাপারটাও নিশ্চিত।’
‘তাহলে স্যার, আবু আহমদের মৃত্যুর ব্যাপারটাও নিশ্চিত।’ বলল পেছন থেকে সামরিক অফিসারের পোষাক পা দ্বিতীয় লোকটি।
‘ধন্যবাদ, এই রকম ডিটারমিনেশনই তো চাই। তবে আবার সাবধান করে দিচ্ছি, আবু আহমদের রিভলভার অসম্ভব ক্ষীপ্র। তোমরা যদি আগে তার চোখে পড়ো, তাহলে তোমরা কিছুই করতে পারবে না তাকে।’ বলল স্যুট পরা লোকটিই আবার।
‘ধন্যবাদ স্যার। অবশ্যই আমরা সাবধান থাকবো। তবে জেনে রাখবেন স্যার, স্নেক গ্রুপের আমরা যারা, তাদের গুলি কখনো মিস হয় না।’ সেনা অফিসারের পোষাক পরা অন্যজন বলল।
‘ধন্যবাদ!’ বলল মাঝের আসনের স্যুট পরা সেই লোকটি। সীটে এবার সোজা হয়ে বসল মাঝের আসনের লোকটি।
ছুটে চলেছে গাড়ি। নিরবতা কয়েক মুহূর্তের।
নিরবতা ভাঙল মাঝের আসনের লোকটি। বলল একটু ছোট স্বরে, ‘আমি বুঝতে পারছি না আংকারায় আমাদের পাঁচজন লোক জেনারেল মেডিন মেসুদের বাড়িতে ঐভারে বেঘোরে মারা পড়ল কী করে? জেনারেল মেসুদ কি আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল?’
‘সর্বনাশের হোতা এখানেও সেই আবু আহমদ নামের শয়তান লোকটা। আমাদের লোক যারা জেনারেলের উপর চোখ রাখছিল, তারা গত পরশু আমাদের জানায়, আবু আহমদকে জেনারেলের মেয়ের সাথে জেনারেলের বাড়িতে ঢুকতে দেখা গেছে। আমরা তখনই বিপদের গন্ধ পাই এবং ঘটনা মনিটর করতে বলি। পরে রাতেই তারা আবার যোগাযোগ করে। তারা জানায় যে, আবু আহমদ জেনারেলের মেয়েকে গুন্ডাদের হাত থেকে রক্ষা করে তাকে পৌঁছে দেবার জন্যেই জেনারেলের বাড়িতে এসেছে। জেনারেলের মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। জেনারেলের সাথে আবু আহমদের যে কথা-বর্তা হয়েছিল তার বিষয়বস্তু ছিল গুন্ডাদের হাত থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার সম্পর্কে। এথেকে প্রাথমিক আশংকা আমাদের কেটে যায়। আরপর কি হলো আর জানা যায়নি। কিন্তু হঠাৎই গতকাল বেলা ১২ টার দিকে খবর আসে, আমাদের পাঁচজন লোক জেনারেলের বাসভবনে নিহত হয়েছে। তাঁরা জানায়, আমাদের আংগোরা ঘাঁটি প্রধানের নেতৃত্বে ঘাঁটির চারজন লোক তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে। তাদের নিহত হবার খবর আসে বেলা ১২ টায়। পরে রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও ট্রান্সমিটার মনিটর থেকে জানা গেছে সব ব্যাপার। জেনারেলের সাথে আমাদের গোপন সম্পর্কের বিষয়টি আবু আহমদ জানতে পেরেছিল আগেই। আবু আহমদের সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদে জেনারেল সব কিছু স্বীকার করে বসে। এটুকুই শুধু জানা গেছে। তবে সিসিটিভিতে দেখা গেছে, আমাদের লোকদের আবু আহমদ কিভাবে খুন করেছে। সম্ভবতঃ জেনারেল আবু আহমদের জিজ্ঞাসাবাদে সব ফাঁস করে দিলে আমাদের লোকরা জেনারেল ও আবু আহমদকে হত্যার জন্যেই ওখানে তাড়াহুড়া করে ছুটে যায়। সিসিটিভি’র রিপোর্টে দেখা গেছে, আমাদের লোকরা আবু আহমদ, জেনারেল ও ওখানে উপস্থিত সবাইকেই টার্গেট করেছিল।’ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল স্যুট পরা লোকটি।
‘তাহলে জেনারেল বিশ্বাসঘাতকতা করেছেই দেখা যাচ্ছে।’ বলল জ্যাকেট পরা লোকটি।
‘আবু আহমদের কাছে ধরা পড়ার পর সে গড় গড় করে সব বলে দিয়েছে।’ স্যুট পরা লোকটি বলল।
‘আবু আহমদকে জেনারেলের ওখানেই মারতে পারলে ভালো হতো। আমাদের লোকরা সে চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আবু আহমদ নিশ্চয় ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছে সব কিছু এবং তা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। এখন তাকে মেরে সেই ফলতো আমরা পাবো না।’ বলল জ্যাকেটওয়ালা।
‘আবু আহমদ দুনিয়ায় না থাকলে সরকার সবকিছু জানলেও আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। সরকার আমাদের কিনে ফেলা ও দুর্নীতিবাজ সেনা, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দিয়ে আমাদের আট-ঘাট বাধা পরিকল্পনাকে বাধা দিতে পারবে না। শুধু চাই আমরা এখন আবু আহমদের মৃত্যু।’ স্যুট পরা লোকটি বলল।
এয়ারপোর্টের প্রবেশ পথে এসে পড়েছে গাড়ি।
‘গেটের বাইরে পুলিশের যে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাও।’ নির্দেশ দিল স্যুটধারী লোকটি।
পুলিশের গাড়ির পাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। সেনা অফিসারের পোষাক পরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সেনা অফিসারের পোষাক পরা দু’জন পেছনের সীট থেকে মাঝের সীটে এসে বসল। স্যুট পরা লোকটি গাড়ির জানালার কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘তোমরা যাও। ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ তোমারা ঢুকে যাওয়ার পর আমরা ঢুকব। ভিভিআইপি কার পার্কিং-এর সর্বশেষ প্যাসেজে দাঁড়িয়ে থাকবে এই পুলিশের গাড়ি। এই গাড়িতে আমরা থাকব। মনে থাকে যেন দু’জনে দু’টি গুলি এক সাথেই করবে। টার্গেট গুলিবিদ্ধ হয়েছে নিশ্চিত হয়ে তোমরা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে আসবে। আমাদের পুলিশের গাড়ি তোমাদের ফলো করবে। তোমাদের কোন ভয় নেই। যাও তোমরা।’
গাড়িটা স্টার্ট নিয়ে চলল এয়ারপোর্টে প্রবেশের জন্যে।
স্যুট ও জ্যাকেটধারী পুলিশের গাড়ির কাছে যেতেই সামনের ও পেছনের দুই দরজা এক সাথে খুলে গেল।
গাড়িটার ড্রাইভিং সীটে ছেটে ছিল একজন পুলিশ। পেছনের সীটে ডিডিপি(ডেপুটি ডাইরেকটর অব পুলিশ) র্যাংকের একজন পুলিশ অফিসার। কিন্তু দু’জনের কাছেই ইজদির প্রদেশের ডিডিপি ও সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশের আইডি কার্ড আছে। কার্ডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষর। সেই সাথে তাদের কাছে ইজদির প্রশাসন-কতৃপক্ষের চিঠি। তারা এসেছে একজন ভিভিআইপি প্যাসেঞ্জারকে রিসিভ করে ইজদির নিয়ে যাবার জন্যে।
স্যুট পরা লোকটি বসল ডিডিপি’র পাশে। আর জ্যাকেট পরা লোকটি বসল ড্রাইভিং সীটে বসা ইন্সপেক্টরের পাশে।
বসেই স্যুট পরা লোকটি পকেট থেকে দু’টি আইডি কার্ড বের করে ডিডিপি-কে দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন আইডি কার্ড। আমরা দু’জন বোনাফাইড গোয়েন্দা অফিসার।’ হেসে উঠল দু’জনই হো হো করে।
গাড়ি ভিভিআইপি লাউঞ্জে রেখে লিফট দিয়ে উঠে ভিভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকল ড. আজদা, ড. সাহাব নূরী ও সাবিহা সাবিত। তারা দেখল, ভ্যান পুলিশের ডিজিপি মাহির হারুন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত।
ড. আজদাদের দেখেই ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘আমি আপনাদের কথাই ভাবছিলাম। আপনারা দেরি করছেন কেন?’
‘ধন্যবাদ স্যার। প্লেন সিডিউল সময়ে আসলেও পনের-বিশ মিনিট সময় আছে প্লেন ল্যান্ড করতে।’ বলল ড. আজদা।
‘আপনি বলছেন আরও পনের বিশ মিনিট দেরি আছে। কিন্তু আরও বিশ মিনিট আগে আংকারা থেকে পুলিশ প্রধান এরকেন আমাদের তাড়া দিয়েছেন যাতে তাড়াতাড়ি আমি এয়ারপোর্টে এসে আবু আহমদের সিকিউরিটির বিষয়টা দেখি।’ ডিজিপি মাহির হারুন বলল।
‘মি. আবু আহমদের নিরাপত্তা নিয়ে ওরা এত উদ্বিগ্ন?’ বলর ড. আজদা।
‘কারণ মি. আবু আহমদকে আমরা চিনি না, তারা চেনেন। এসব বিষয় নিয়ে আজ সকালেই প্রসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সেনা প্রধান ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধানের সাথে সম্মিলিত মিটিং করেছেন দীর্ঘক্ষণ ধরে। সেখান থেকেই তিনি সোজা এসেছেন আংকারা এয়ারপোর্টে।’ ডিজিপি মাহির হারুন বলল।
‘আসলে উনি কে স্যার? রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিরা যার সাথে দীর্ঘক্ষণ বসে মিটিং করেন, তিনি অতি অসাধারণ। কে তিনি?’ জিজ্ঞাসা সাবিহা সাবিতের। বিস্ময় তার চোখে।
‘আমি জানি না সাবিহা সাবিত। আমি বিস্মিত উপরের যারা জানেন, তারা কেউ মুখ খুলেন না। কয়েকদিন আগে আমি আংকারা গেলে পুলিশ প্রধান মি. এরকেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মি. আবু আহমদ আসলে কে? তিনি বলেছিলেন যে এ প্রশ্ন তারও। কিন্তু প্রশ্নটা তিনি অন্য কাউকে করতে সাহস পাননি। তিনি বলছেন, প্রসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও জেনারেল মোস্তফা ছাড়া আর কেউ তার পরিচয় জানেন না।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
মুখ হা হয়ে গেল ড. আজদা, ড. সাহাব নুরী ও সাবিহা সাবিতের। সাবিহা সাবিতই বলল, ‘এমন ব্যক্তিত্ব কে হতে পারেন স্যার, আমাদের দেশে কিংবা মুসলিম বিশ্বে?’
কিছু বলতে যাচ্ছিল ডিজিপি মাহির হারুন, এ সময় এয়ার লাইনসের প্রোটকল অফিসার এসে মাহির হারুনকে বলল, ‘স্যার, প্লেন ল্যান্ড করেছে। মি. আবু আহমদই প্রথম নামবেন।’
সবার চোখ গেল কাঁচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে বাইরে।
দুই তিন মিনিটের মধ্যেই এয়ার লাইন্সের সেই প্রোটোকল অফিসার আবু আহমদকে নিয়ে প্রবেশ করল ভিভিআইপি লাউঞ্জে।
বেশ দূরে থাকতেই আহমদ মূসা ডিজিপি মাহির হারুনসহ সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. মাহির হারুন কষ্ট করে এসেছেন সেজন্য।’
সবাই সালাম নিল। সালাম নিয়ে ডিজিপি মাহির হারুন বলল, ‘আমার কষ্টের কথা বললেন, ওদের কষ্টের কথা বললেন না। বৈষম্য করা হলো না?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা আমার ভাই-বোন তো। ভাইয়ের জন্যে ওরা একটু কষ্ট করতেই পারে।’
‘আমাকে ভাই বলা হোল না, এটাও তো একটা বৈষম্য।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন। তার মুখে হাসি।
‘আপনি ভাই অবশ্যই। কিন্তু তার সাথে আপনি ভ্যানের পুলিশ প্রধানও। আপনার কাজ, সব সময় আইনের নিয়ন্ত্রণ। অতএব সে সময় খুবই মূল্যবান। সব নাগরিকের এই মূল্য সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আবু আহমদ। সত্যিকার বড় যারা, তারা সবাইকে বড় করে দেখে। পুলিশকে এই মর্যাদার আসন কেউ দেয় না।’
আহমদ মুসা ডিজিপি মাহির হারুনের সাথে হ্যান্ডশেক করার পর ড. সাহব নূরীর সাথে হ্যান্ডশেক করে সাবিহা সাবিতের সামনে গিয়ে বলল, ‘ভাববেন না মি. মাহির হারুন সাবিহা সাবিতদের জেনারেশনকে দেখবেন ভিন্নভাবে। ওরা দেশ, জাতিকে বড় করবে, পুলিশকেও বড় করবে। কেমন, তাই না সাবিহা সাবিত?’
মুহূর্তের জন্যে কথায় ছেদ টেনেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘কি খবর, সাবিহা সাবিত? তোমাদের থিসিসের একটা শক্ত অংশ নিয়ে বিপদে পড়েছিলে, সেটা কেটেছে?’
হাসল সাবিহা সাবিত। সেই সাথে বিস্মিত তার চোখ। বলল, ‘ঐ ছোট ঘটনাও আপনার মনে আছে?’
‘ওটা ছোট ঘটনা নয়। ড. আজদাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। যারা ডক্টরেট করেছে তারা এটা জানে। তাই না ড. আজদা?’ বলল ড. আজদার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা। সবাই মিলে বসতে গেল।
বসতে গিয়ে আহমদ মুসা হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে বলল, ‘আপনারা বসুন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। অজু বাকি আছে, প্লেনে অজুটা করতে পারিনি।’
আহমদ মুসা এগোলো টয়লেটের দিকে।
সবাই বসেছে।
ড. সাহাব নূরী বলল, ‘তার মানে মি. আবু আহমদ সব সময় অজুর সাথে থাকেন?’
হ্যাঁ মামা, এটা আমি খেয়াল করেছি। আমি দেখেছি, নামাযের সময় নয়, তবুও তিনি অজু করে এলেন। তার মানে অজু ভাঙলেই তিনি অজু করেন।’ ড. আজদা বলল।
‘আমি শুনেছি দরবেশ-বুজুর্গদের এ গুণ থাকে। খুবই ভালো ও মহৎ গুণ এটা। এ গুণও মি. আবু আহমদের আছে! এটা এটা বড় ব্যাপার। একজন লোক যখন সব সময় আল্লাহমূখী থাকতে চায়, তখন তার মধ্যে এ গুণের সৃষ্টি হয় শুনেছি।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘একটা ব্যাপার আপনারা লক্ষ্য করুন। কিছুক্ষণ আমরাই আলোচনা করলাম যে তিনি বড় একজন ব্যক্তিত্ব, যার পরিচয় তুরষ্কের পুলিশ প্রধানকেও জানতে দেয়া হয়নি! প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যার পরিচয় সীমাবদ্ধ! সেই ব্যক্তিত্ব একমাত্র আমাদের মাঝে এলেন কিন্তু বুঝা গেল না যে তিনি এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব! তিনিই প্রথম আমাদের সালাম দিয়েছেন। কথাও বলেছেন তিনি আমাদের সাথে। আমার থিসিসের মত ছোট ঘটনার খবরও তিনি নিয়েছেন। এ সবের মাধ্যমে তিনি আমাদের গুরুত্বকেই বড় করে তুলে ধরেছেন, নিজের বড় ব্যক্তিত্বের, তার নিজের মর্যাদার কথা এবং তা প্রদর্শন করার বিষয় তিনি বিন্দুমাত্রও ভাবেননি।’ সাবিহা সাবিত বলল।
‘এটা সত্যিকার বড়ত্বের প্রমাণ। সত্যিকার বড়দের কাছে একজন পথের মানুষও পর্বতের মত বড়। বড়রা কিন্তু নিজেকে সবার চেয়ে ছোট মনে করে। মি. আবু আহমদের মধ্যে এইমাত্র এই গুণেরই তো আমরা প্রকাশ দেখলাম।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
আহমদ মুসা ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেছে। গল্পগুজব চলছে।
এরই মধ্যে স্ন্যাক্স পরিবেশন করেছে লাউঞ্জের লোকরা।
সিকিউরিটির একজন লোক এসে বলল ডিজিপি মাহির হারুনকে, ‘স্যার, সব রেডি। মেহমানের গাড়ি পার হবার পর, অন্য যাত্রীরা তাদের গাড়িতে উঠবেন।’
‘ঠিক আছে, আমরা উঠছি।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
সবাই উঠে দাঁড়াল। চলল সবাই লিফটের দিকে।
লিফটে উঠে ডিজিপি মাহির হারুন বলল ড. আজদাকে, ‘আপনাদের ট্রাভেল প্ল্যানটা কী ড. আজদা?’
‘ধন্যবাদ। আমরা একপাই গাড়ি এনেছি সবাই আমরা এক সাথে যেতে চাই বলে। স্যার ও মামা বসবেন পেছনের সীটে। সাবিহা সাবিত গাড়ি ড্রাইভ করবে। আমি বসব তার পাশের সীটে।’
‘অল রাইট। আমার গাড়িটা থাকবে আপনাদের গাড়ির পেছনে। আপনাদের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগোলে আমার গাড়ি স্টার্ট নেবে।’
লিফট থেকে ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ এসে ডিজিপি মাহির হারুন আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে তার গাড়ির দিকে এগোলো। আহমদ মুসাও এগোলো তার গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসার ডান পাশে সাবিহা সাবিত। তবে সে ধাপ খানেক সামনে এগিয়েছে, ড্রাইভিং সীটে যাবে বলেই তার এই এগোনোটা।
গাড়ির কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে তারা।
আশ-পাশটা দেখতে গিয়ে হঠাৎ সাবিহা সাবিতের চোখ দু’টি দুই তিন সারি সামনের একটা গাড়ির জানালায় আটকে গেল। দেখল গাড়িটার দু’টি জানালা অর্থাৎ ড্রাইভিং সীট ও পেছনের সীটের জানালা দিয়ে রিভলভারের দুই নল তাক করেছে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। রিভলভারের নলগুলো জানালার বাইরে বেরিয়ে আসেনি বলে সাধারণভাবে তা কারো নজরে পড়ার কথা নয়। বুঝতে পারল সাবিহা সাবিত কী ঘটতে যাচ্ছে।
কেঁপে উঠল তার গোটা অন্তরাত্মা। এখন তো চিৎকার করার সময় নেই, সাবধান করারও সময় নেই। পিছু হটে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার সময়ও নেই।
আর কিছু ভাবতে পারল না সাবিহা সাবিত। চোখের পলকে নিজের দেহটাকে সে সরিয়ে নিল আহমদ মুসার সামনে।
প্রায় একই সংগে দু’টি গুলি এসে বিদ্ধ হলো সাবিহা সাবিতের বাম বুকে। পড়ে যাচ্ছিল সাবিহা সাবিত পেছন দিকে।
আহমদ মুসার চোখে সবটা বিষয় ধরা পড়ে গেছে ততক্ষণে। জ্যাকেটের পকেট থেকে তার ডান হাতে উঠে এসেছে রিভলভার।
আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে সাবিহা সাবিতকে বুকে আঁকড়ে ধরে ডান হাত দিয়ে গুলি করল গাড়িটার সামনের টায়ারে।
গাড়িটা চলতে শুরু করেছিল। একটা বাঁক নিয়ে শব্দ করে গাড়িটা থেমে গেল। গাড়ি থেকে বের হয়ে দু’জন সেনা অফিসার ছুটে পালাচ্ছিল।
আহমদ মুসা গুলি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই দু’সেনা অফিসারের দেহই বিস্ফোরিত হলো। দু’টি দেহই অগ্নি গোলক হয়ে কিছুটা উপরে উঠে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল।
ডিজিপি ছুটে আসছিল আহমদ মুসার গাড়ির দিকে। আহমদ মুসা তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. মাহির হারুন, আপনি ওদিকটা দেখুন ওদের আরেকটা গ্রুপ ভিভিআইপি কারপার্কেই আছে।’
‘দেখছি আমি মি. আবু আহমদ।’ বলে ডিজিপি মাহির হারুন সন্ত্রাসীদের গাড়ির দিকে ছুটল।
ড. সাহাব নূরী, আপনি ড্রাইভে বসুন। আর ড. আজদা আপনি দরজা খুলুন। একে হাসপাতালে নিতে হবে। দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল ওদের লক্ষ্য করে।
গাড়ির দরজা খুলল ড. আজদা ছুটে এসে।
আহমদ মুসা সাবিহা সাবিতকে পাঁজকোলা করে নিয়ে গাড়িতে উঠল। সীটের উপর শুইয়ে দিতে গেল সাবিহা সাবিতকে।
‘স্যার, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখুন। ওরা আমাকে নিতে আসছে। আর একটু সময় চাই। একটা কথা বলতে চাই।’ খুব কষ্টের সাথে বেরিয়ে আসা এই কয়েকটা কথা প্রথম শোনা গেল সাবিহা সাবিতের কণ্ঠ থেকে।
‘ঠিক আছে আমি ধরে আছি তোমাকে। তোমার কিছু হবে না। আমরা নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে হাসপাতালে। কী বলবে বল তুমি।’
‘আমার চেয়ে সুখী মানুষ এই মুহূর্তে দুনিয়াতে আর কেউ নেই, স্যার। ওরা আপনাকে মারতে চেয়েছিল। আমি আপনাকে বাঁচাতে পেরেছি আল্লাহ্’র ইচ্ছায়।’ থেমে গেল সাবিহা সাবিতের কণ্ঠ।
চোখ দু’টি বুজে গেল তার।
‘তুমি এটা করতে গেলে কেন, সাবিহা? আমার তো দুনিয়াতে চাইবার কিছু নেই! কিন্তু তোমার তো জীবনের শুরু।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দুনিয়াতে আপনার চাইবার কিছু নেই। কিন্তু দুনিয়ার প্রয়োজন আছে আপনাকে। আমার মত সাবিহা সাবিত শত আছে, আরও শত জন্মাবে। কিন্তু আপনার মত লোকদের আল্লাহ্ কদাচিৎ দুনিয়াতে পাঠান। আমি খুব খুশি। আমি আপনার বাহুর উপর মরতে পারছি। আমি…।’
‘তুমি এত কথা বলো না সাবিহা। আল্লাহ্ তোমাকে বাঁচাবেন। আমরা যাচ্ছি হাসপাতালে।’ বলল আহমদ মুসা।
দু’চোখ বুজে গিয়েছিল সাবিহা সাবিতের। খুলে গেল আবার। গভীর ক্লান্তি সে চোখে। যেন ঘুমে ছেয়ে আছে তার দুই চোখ। তার অস্ফুট কণ্ঠে আমি সেটা জানার জন্যে তো আর বেঁচে থাকবো না। বলবেন কি স্যার আপনার পরিচয়।’
আহমদ মুসার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা অশ্রু। বলল, ‘আমার পরিচয় না দেয়া আমার অহংকার নয়, সাবিহা; সেটা আমার প্রয়োজন। দুঃখিত আমি এর জন্যে। আমি তোমাদের এক ভাই- আহমদ মুসা।’
দু’চোখ বুজে গিয়েছিল সাবিহা সাবিতের। চমকে ওঠার মত প্রচণ্ড শক্তিতে তা যেন খুলে গেল। স্থির হলো আহমদ মুসার মুখের উপর। প্রাণ ভরে সমগ্র সত্তা দিয়ে যেন দেখছে আহমদ মুসাকে।
ওদিকে সিটের এক কোনে কোন রকমে বসে সাবিহা সাবিতের মাথায় হাত রেখে অঝোরে কাঁদছিল ড. আজদা। আহমদ মুসার কণ্ঠের শেষ উচ্চারণ শুনে সেও চমকে উঠে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার সে চোখেও বিস্ময়ের ঝড় উঠেছে।
আবার চোখ দু’টি বুজে গেল সাবিহা সাবিতের। কিন্তু তার ঠোঁটে অসীম এক প্রাপ্তি ও প্রসন্নতার হাসি। বলল অস্ফুট কণ্ঠে চোখ বুজে থেকেই, ‘আলহমদুলিল্লাহ্! আমার সৌভাগ্য। আল্লাহ্’র অসীম দয়া। আল্লাহ্’র কাছে নিয়ে যাবার মত সঞ্চয় আমার কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন আল্লাহ্-কে বলতে পারবো, তার অতিপ্রিয় এক বান্দার পাশে আমি দাঁড়াতে পেরেছিলাম।’
চোখ দু’টি তার আবার খুললো। দৃষ্টি নিবদ্ধ আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘অনেক, অ-নে-ক বড় আপনি, পরকালেও কি পাশে থাকতে পা-রবো আপনার।’ তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে এবং তার কণ্ঠের শেষ শব্দের সাথে অবরুদ্ধ আবেগের একটা উচ্ছ্বাস যেন ভেঙে পড়ল। কেঁপে উঠল তার দেহটা। সেই সাথে তার মুখটা গড়িয়ে পড়ল এক পাশে। তার মুখে, দেহে নেমে এল প্রশান্তির এক নিখুঁত নিস্তব্ধতা।
সাবিহা সাবিতের মাথা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল ড. আজদা।
আহমদ মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। কাঁপা, ভাঙা কণ্ঠ আহমদ মুসার।
গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিল ড. সাহাব নূরী।
তার চোখ দিয়েও অশ্রু গড়াচ্ছে।
‘ড. নূরী, আপনি ড. মাহজুন মাজহারকে টেলিফোন করুন। তাঁকে ঘটনা জানিয়ে হাসপাতালে আসতে বলুন। আর চলুন আপনি হাসপাতালে।’
আহমদ মুসাই সাবিহা সাবিতের দেহ যেভাবে ধরে বসেছিল, সেভাবেই তাকে গাড়ি থেকে বের করে এনে হাসপাতালের ট্রলিতে তুলে দিল।
পাশেই সাবিহা সাবিতের পিতা ড. মাহজুন মাজহার দাঁড়িয়েছিল। মেয়ের রক্ত ভেজা লাশ দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল সে।
তার পাশে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো না আহমদ মুসা। কাঁদা উচিত। মিনিট খানেক অপেক্ষার পর হাসপাতালের লোকরাই বিনয়ের সাথে বলল, ‘স্যার, দয়া করে আমাদের কাজ করতে দিন,০ প্লীজ।’
ড. মাহজুন মাজহার মুখ তুলল। তাকাল ওদের দিকে। অশ্রু ধোয়া তার মুখ।
উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল বাবা, কোথায় যাবে।’
ট্রলি থেকে একটু সরে দাঁড়াতে গিয়ে দেখতে পেল আহমদ মুসাকে। সংগে সংগে জড়িয়ে ধরল তাকে। কেঁদে উঠল আবার।
‘স্যরি, স্যার। আমাকে বাঁচাতে গিয়েই জীবন দিতে হয়েছে সাবিহা সাবিতকে। আমি স্যরি।’ বলল আহমদ মুসা।
ড. মাহজুন মাজহার আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে তার দুই হাত আহমদ মুসার কাঁধে রেখে বলল, ‘স্যরি কেন?’ আমার মেয়ে কি যা করার নয় তাই করেছে, আমার মেয়ে কি অন্যায় কিছু করেছে? আমি কাঁদছি কি এই জন্যে যে আমার মেয়ে কেন জীবন দিতে গেল? না, তা নয় মি. আবু আহমদ। আমার এ কান্না গৌরবের। দেশের জন্যে বিনা দ্বিধায় জীবন দেয়ার মত সাহস আমার মেয়ে দেখাতে পেরেছে, এই দরনের মহৎ সিদ্ধান্ত সে নিতে পেরেছে, এই গৌরবেই আমি কাঁদছি। আলহামদুলিল্লাহ্! আমার মেয়ে ক’দিনেই আপনাকে চিনতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে যে, শত সাবিহা সাবিতের বিনিময়ে হলেও আপনাকে বাঁচানো দরকার। আমি…।’
আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরল ড. মাহজুন মাজহারকে। বলল, ‘স্যার, এভাবে বলবেন না। দুনিয়ার সব মানুষ সমান। আর কারও জন্যে পৃথিবীর কোন কাজ আল্লাহ্ আটকে রাখেন না। তিনিই সবকিছুর নিয়ামক ও নিয়ন্তা।’
ড. মাহজুন মাজহার বলল, ‘তোমার কথাও ঠিক। কিন্তু আল্লাহ্ যেমন পাঁচ আঙুলকে সমান করে সৃষ্টি করেননি তেমনি দুনিয়ার সব মানুষ মেধা, যোগ্যতার দিক দিয়ে সমান নয়।’
কথা শেষ করে বলল, ‘চল, আমরা ওদিকে যাই। ড. আজদা ও ড. সাহাব নূরী সাবিহা সাবিতের সাথে গেছে।’
দু’জনেই চলল হাসপাতালের ভেতরে।
এক ঘন্টা পরে ভ্যান-এর পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন এল হাসপাতালে।
আহমদ মুসা তখন বসেছিল হাসপাতালের ভিআইপি রিসেপশন লাউঞ্জে। সেখানে বসেছিল, আহমদ মুসা, ড. আজদা, ড. সাহাব নূরী, ড. মাহজুন মাজহার একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর।
ডিজিপি মাহির হারুন লাউঞ্জে প্রবেশ করতেই পুলিশ ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়াল।
‘তুমি একটু ওদিকে বস ইনসপেক্টর।’
পুলিশ ইনসপেক্টর একটা স্যালুট দিয়ে বাইরে চলে গেল।
ডিজিপি মাহির হারুন বসেই বলল, ‘স্যরি ড. মাহজুন মাজহার। সাবিহা সাবিত মেয়েটা অত্যন্ত ব্রাইট ছিল। সে আমাদের সবার আদরের। কেউই…।’
‘মি. মাহির হারুন, সাবিহা সাবিত বড় ছিল বলেই অতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, বড় সাহস দেখাতে পেরেছে।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার। তার শেষের কথাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ড. আজদা ড. মাহজুন মাজহারের পিঠে সান্তনার হাত রেখে বলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন আংকল। বুকে দুই দুইটি গুলি খাবার পরও তার চোখে মুখে দুঃখ-বেদনার কোন চিহ্ন ছিল না। একটুও কাঁদেনি, আর্তনাদ করেনি সাবিহা। মৃত্যুকে আসন্ন জেনেও সে বলেছে, আমার চেয়ে সুখি মানুষ এই মুহূর্তে, স্যার, ওরা আপনাকে মারতে চেয়েছিল, আমি আপনাকে বাঁচাতে পেরেছি আল্লাহ্’র ইচ্ছায়। দুনিয়াতে আপনার চাইবার কিছুনেই হয়তো, কিন্তু দুনিয়ার প্রয়োজন আছে আপনাকে। শেষ মুহূ…।’
ড. আজদার কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সাবিহা সাবিত ছিল এখানে আমাদের সবার ছোট, কিন্তু সবার চেয়ে বড় কাজ সে করেছে। আল্লাহ্ তার শাহাদাত কবুল করুন। তার জন্যে এখন দোয়াই হবে তাকে স্মরণ করার, শ্রদ্ধা জানানোর উপায়।’
‘প্লিজ আপনারা এটাই করুন। একজন শহীদের পিতা হওয়ার এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
সবাই বলে উঠল। আমিন। একটু নিরবতা।
‘মাফ করবেন সকালে, আমি মি. আবু আহমদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘তাহলে আমরা সবাই বাইরে যাবার দরকার নেই। আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দিলেই হলো।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘কোন অসুবিধা নেই। আমরা বরং খুশিই হবো।’ বলল ড. আজদা।
‘মি. আবু আহমদ, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ওদের আরেকটা গ্রুপ আরেকটা গাড়িতে ওখানে উপস্থিত ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, গুলি নিক্ষেপকারীরা ছিল সৈনিকের বেশে, অন্যদিকে আরেকটা গাড়িতে যারা ছিল, তারা ছিল পুলিশের গাড়িতে পুলিশের পোষাকে। পুলিশের গাড়ি হওয়ায় এবং গাড়িটাকে দ্রুত চলে যেতে দেখে আমি প্রথমটায় বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। আমি ধারণা করেছিলাম. পুলিশ হয়তো সন্দেহজনক কাউকে তাড়া করছে। কিন্তু যখনই মনে পড়ল গুলি নিক্ষেপকারীরা ছিল সৈনিকের পোষাকে, তখনই বুঝতে পারি আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল পুলিশের গাড়ি ভেবে গেটে কেউ তাদের আটকায়নি। শেষ পর্যন্ত গাড়িটার আর হদিস মেলেনি। গাড়ির নাম্বার পাওয়া গেছে, কিন্তু সেটা অবশ্যই ভুয়া নাম্বার হবে।’
একটু থামল ডিজিপি মাহির হারুন। মুহূর্ত কয় পরে আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আমি বিস্মিত হচ্ছি, গুলি নিক্ষেপকারীদের মরতে হলো কেন? ধরা যাতে না পড়ে এ জন্যেই কি?’
‘ধরা যাতে না পড়ে এটা নিশ্চিত করার জন্যই তাদের দেহে আগে থেকে বোমা বাঁধা ছিল, এটাই হতে পারে। তবে সাধারণঃত এমনটা হয় না। নিজেদের কাউকে যখন কোন মিশনে পাঠানো হয়, তখন তার ধরা পড়া রোধ করার জন্যে তাকে হত্যা করা হবে এটা তাকে জানতে দেয়া হয় না। নিজেদের কাউকে যখন কোন মিশনে পাঠানো হয়, তখন তার ধরা পড়া রোধ করার জন্যে তাকে হত্যা করা হবে এট তাকে জানতে দেয়া হয় না। কারও গায়ে বোমা বেঁধে যখন কাউকে কোন মিশনে পাঠানো হয় তখন সেটা হয় বাধ্য করে কাজ করানোর ঘটনা। আমার মনে হয় আজকের ঘটনায় এমনটাই করা হয়েছে। আমার মনে হয়, এই বন্দুকবাজ দু’জনকে অঢেল টাকা দিয়ে বা অন্যকোনভাবে বাধ্য করে এই শর্ত দেয়া হয়েছে যে, মারতে না পারলে তাদের মরতে হবে। মারাটা যাতে নিশ্চিত হয়, সেজন্যেই এমনটা করা হয়েছে। না মারতে পারলে যেহেতু তাদেরই মরতে হবে, তাই মরার ব্যাপারে সামান্যতম গাফলতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আবু আহমদ। আপনার চিন্তাটাই সঠিক। তাহলে ধরে নিতে হবে সেনা অফিসারের পোষাক পরা গুলি নিক্ষেপকারীরা এবং পুলিশের পোষাকে আসা যারা তাদের হত্যা করল, তারা এক গ্রুপের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হবার কথা ছিল।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘হওয়াটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা গাড়িটা অক্ষত আছে? গাড়িতে কিছু পাওয়া যায়নি? গাড়ির কাগজ-পত্র থেকে কোন ক্লু পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘গাড়ির কাগজপত্র ও গাড়ির নাম্বার, চেসিস নাম্বার দেখে কিছু বের করা যায় কিনা তা পরে ভেবে দেখতে হবে। গাড়িতে অন্য কোন কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। সিগারেটের একটা প্যাকেট পাওয়া গেছে। প্যাকেটের গায়ে কিছু হিজিবিজি লিখা আছে। এগারো ডিজিটের একটা নাম্বারও আছে, কিন্তু টেলিফোন নাম্বার নয়।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘সিগারেটের প্যাকেটটা কি আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, আমরা নিয়ে এসেছি। আমার কাছেই আছে।’ বলে ডিজিপি মাহির হারুন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল। আহমদ মুসা সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে একনজর উল্টে-পাল্টে দেখল।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ডিজিপি মাহির হারুন যাকে হিজিবিজি লেখা বলেছে, সেটা হিজিবিজি কিছু নয় কাঁপা হাতের হিব্রু ভাষায় লেখা। নাম্বারগুলোর দিকে চোখ নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার। এগারোটি ডিজিটের উপর একবার চোখ বুলিয়ে আহমদ মুসা ডিজিপি মাহির হারুনকে বলল, ‘মি. মাহির হারুন, জার্মান মোবাইল কোম্পানি ডিটিএল-এর বেসিক নাম্বার কি?’
‘জিরো থ্রি থ্রি সিক্স।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘বেসিক নাম্বারের চার ডিজিটের দুই জোড়ার পত্যেকটিকে উল্টিয়ে লিখেছে। জিরো থ্রি হয়েছে থ্রি জিরো এবং থ্রি সিক্স হয়েছে সিক্স থ্রি। তাহলে পরবর্তী জোড় সংখ্যাগুলোকেও নিশ্চয় এভাবে উল্টিয়ে লেখা হয়েছে। তবে সর্বশেষ বেজোড় ডিজিটটি ঠিক থাকার কথা।’
‘কি করে বুঝলেন? ওটা কি কোন টেলিফোন নাম্বার?’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘হ্যাঁ মি. মাহির হারুন। এটি ডিটিএল-এর মোবাইল নাম্বার বলেই মনে হয়। ডিটিএল-এর চারটি বেসিক ডিজিটের দুই জোড়ার প্রত্যেক জোড়ার দুই ডিজিটকে আগে পিছে লিখেছে। আমি মনে করি পরবর্তী জোড়াগুলোকেও এইভাবে আগে-পিছে করে লিখেছে। দেখুন, এইভাবে সাজালে ডিটিএল-এর একটা মোবাইল নাম্বার হয়ে যায়।
সিগারেটের খোলটা হাতে নিল ডিজিপি মাহির হারুন। একবার ভালো করে চোখ বুলিয়েই সে উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ধন্যবাদ আবু আহমদ। আপনি নির্ভুলভাবে ধাঁধাঁটাকে ভেঙেছেন। নিশ্চিতই কারো একটা মোবাইল নাম্বার হবে এটা। তাদের কারো কি?’
‘তাদের কারো হবার সম্ভাবনাই বেশি। মনে হয়, গাড়িতে বসেই কষ্ট করে টেলিফোন নাম্বারটা লিখেছে। দেখুন প্রত্যেকটি ডিজিটই কিছুটা আঁকাবাঁকা এবং মাঝের স্পেসগুলোর মধ্যে কোন ভারসাম্য নেই। তার মানে চলন্ত গাড়িতে বসেই নাম্বারটি লেখা হয়েছে। জরুরি বলেই কষ্ট করে এভাবে লেখা হয়েছে এবং আজ গাড়িতে বসেই এই নাম্বার লেখা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডিজিপি মাহির হারুনের। বলল, ‘আপনি রাইটলি আইডেনটিফাই করেছেন আবু আহমদ। টেলিফোন নাম্বারটি আমাদের কাজে আসতে পারে। অন্য হিজিবিজি লেখার কিছু বুঝলেন?’
‘অন্য হিজিবিজি লেখাটাও হিব্রু। চলন্ত গাড়িতে বসে লেখা হয়েছে বলেই একটু বেশি হিজিবিজি লাগছে। এই হিজিবিজি অক্ষারগুলো হচ্ছে একটা রাস্তার নাম এবং একটা লোকেশনের নাম্বার।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা এই ঠিকানাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করল। এখানে এভাবে সবার সামনে এই ঠিকানা প্রকাশ করা ঠিক মনে করল না। তাছাড়া হাসপাতালের এই ভিআইপি লাউঞ্জ কতটা নিরাপদ, এখানে কোন ইলেকট্রনিক চোখ বা কান আছে কিনা কে জানে। সুতরাং ঠিকানার বিষয়টা চেপে যাওয়াই ঠিক মনে করল আহমদ মুসা। ডিজিপি মাহির হারুনের পরবর্তী জিজ্ঞাসার জবাবে বলল আহমদ মুসা, ‘ওটা নিয়ে আর একটু ভাবতে হবে। সিগারেটের খোলটা আমার কাছেই থাক।’
‘ঠিক আছে মি. আবু আহমদ, ওটা আপনার কাছেই থাকা দরকার। তদন্ত পরিচালনার সব দায়িত্ব আপনার উপর দেয়া হয়েছে। তবে ওরা আপনাকে মারার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ চেষ্টা তারা শুরু থেকেই করছে। গতকাল আংগোরায় আপনার উপর আক্রমণ হয়েছে। আজ এখানে আপনাকে হত্যার একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা করেছিল। আমরা আপনার জন্যে উদ্বিগ্ন। এরপর থেকে আপনার নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। প্লিজ আপনাকে সাবধান হতে হবে। আমরা আপনাকে যে কোন সাহায্য করতে প্রস্তুত।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
‘ধন্যবাদ আপনাকে। সাবধান থাকা সব মানুষের মত আমারও খুব স্বাভাবিক একটা প্রবণতা। বাকি আল্লাহ্ ভরসা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ্ ভরসা। আমার মেয়ে যাদের ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছে, তাদের আমি শাস্তি চাই। প্রার্থনা করি, ওদের পাকড়াও করে মি. আবু আহমদ ওদের শাস্তি দিতে এবং ষড়যন্ত্র উচ্ছেদ করতে সমর্থ হোন।’ বলল ড. মাহজুন মাজহার।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আমি একটু উঠতে চাই। ওদিকে কি হচ্ছে তা একটু দেখা দরকার।’
‘অবশ্যই, চলুন আমরাও যাব।’ বলল ডিজিপি মাহির হারুন।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
৪
গাড়ি ছুটছে আহমদ মুসার। সূর্য উঠতে তখনও অনেক বাকি।
মাউন্ট আরারাতের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ইজদির প্রদেশের রাজধানী আর পাঁচ মিনিটের পথ।
তাহাজ্জুদ নামায শেষ করেই আহমদ মুসা ভ্যান থেকে গাড়িতে উঠেছে। ভোরের রাজপথ একদম ফাঁকা।
ঝড়ের বেগে ছুটতে পেরেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
রাজধানী ইজদির শহরের কাছাকাছি রাস্তার পাশের একটা মসজিদে ফজরের নামায পড়ে নিয়েছে আহমদ মুসা।
রাজধানী ইজদির শহরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
ইজদির শহরে কয়েকবার এসেছে আহমদ মুসা।
আরিয়াস রোড আহমদ মুসার চেনা।
আরিয়াস রোডে প্রবেশ করল তার গাড়ি।
আহমদ মুসাকে যারা হত্যার চেষ্টা করেছিল, যারা হত্যা করেছে সাবিহা সাবিতকে তাদের গাড়িতে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেটে এই রাস্তার নাম লেখা ছিল।
রাতের আঁধার নেই। কিন্তু আঁধারের রেশ তখনও আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি স্লো করে দিয়েছিল। রাস্তার পাশের বাড়ির নাম্বারগুলো দেখছিল সে।
ওয়ান থ্রি নাম্বার পেয়ে গেল আহমদ মুসা। আনন্দের প্রকাশ ঘটলো আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
গাড়ি দাঁড় করাল সে।
কিন্তু গাড়ির জানালা নামিয়ে বাড়িটার দিকে চাইতেই আনন্দ উবে গেল আহমদ মুসার মন থেকে।
ওয়ান থ্রি ওয়ান বাড়িটা একটা দু’তলা মসজিদ। মসজিদের সাথে একটা মাদ্রাসার সাইনবোর্ড। মসজিদ ও মাদ্রাসার একপাশে পেল খোলা গ্রাউন্ড, অন্যপাশে সুন্দর একটা সবজি বাগান।
হতাশ হলো আহমদ মুসা। এ রকম স্থানে তাকে হত্যার চেষ্টাকারী উল্কিওয়ালারা কিংবা হিব্রু জানা তুর্কি, ইহুদি বা আর্মেনীয় ইহুদিরা কেউ থাকার কথা অবশ্যই নয়।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল সিগারেটের প্যাকেটে টেলিফোনের নাম্বার লিখতে গিয়ে লেখক প্রত্যেকটা দুই ডিজিটের প্যাকেটে টেলিফোনের নাম্বার লিখতে গিয়ে লেখক প্রত্যেকটা দুই ডিজিটের জোড়ার অংক যদি আগপিছ করে লিখতে পারে, তাহলে রাস্তার লোকেশন নাম্বার লেখার ক্ষেত্রেও সে এটাই করতে পারে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ওয়ান থ্রি ওয়ান মানে ১৩১-এর প্রথম জোড়ার অংক আগে-পিছে করে নিলে জোড়ার অংক ‘১৩’-এর বদলে ‘৩১’ হয়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে রাস্তার নাম্বার দাঁড়ায় থ্রি ওয়ান ওয়ান অর্থাৎ ৩১১। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো এই থ্রি ওয়ান ওয়ানই তার টার্গেট নাম্বার।
গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। ছুটল গাড়ি।
অনেকটা সামনে হবে নাম্বারটি।
অনেকটা চলার পর রাস্তার পাশের বাড়ির নাম্বারের দিকে তাকাল আহমদ মুসা। প্রথমেই যে বাড়ির নাম্বারটি চোখে পড়ল তা হচ্ছে, থ্রি জিরো ওয়ান। আর একটু এগিয়েই পেয়ে গেল থ্রি ওয়ান ওয়ান।
দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার গাড়ি।
জানালার কাঁচের ভেতর দিয়েই তাকাল আহমদ মুসা বাড়িটার দিকে।
বাড়িটা ওল্ড প্যাটার্নের একটা গেটবক্স।
গেট থেকে ইটের একটা রাস্তা গিয়ে মিশেছে গাড়িবারান্দায়।
গাড়িবারান্দা থেকে তিন ধাপ উঠলেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটা ল্যান্ডিং বা বারান্দা।
বারান্দার মাঝ বরাবর বাড়ির ভেতরে ঢোকার একটা দরজা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। চারদিকটা নিরব। সূর্য তখনও ওঠেনি।
রাস্তায় গাড়ি চলা শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু কচিৎ দু’একটা চোখে পড়ছে।
জ্যাকেটের পকেটের রিভলভার এবং মাথার পেছনের রিভলভারের শরীরটা একবার স্পর্শ করে আহমদ মুসা উঠে গেল গেটে।
গেট লক করা। গেটম্যান নিশ্চয় ঘুমিয়ে আছে।
বাউন্ডরি ওয়াল খুব উঁচু নয়। ছয় ফুটের বেশি হবে না।
চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে আহমদ মুসা চোখের পলকে পাঁচিল চপকে ভেতরে ঢুকে গেল।
গেটবক্সে এসে আহমদ মুসা দেখল, গেটবক্সের দরজা খোলা। উঁকি মারল ভেতরে। দেখল গেটম্যান একটা চেয়ারে বসেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাশেই টেবিলের উপর তালা-চাবি।
আহমদ মুসা তালা-চাবি নিয়ে গেটবক্স লক করল। চাবিটা তালাতেই লাগানো অবস্থায় রেখে দিল। বাড়ির দিকে এগোলো আহমদ মুসা। গাড়িবারান্দা হয়ে উঠে গেল ল্যান্ডিং-এ।
দরজার সামনে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। তারপর ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে জোরের সাথে তিনবার নক করল সে।
মিনিট খানেক পার হয়ে গেল। কোন সাড়া নেই।
আবার নক করল আহমদ মুসা আগের চেয়ে আরও উচ্চ শব্দে।
তিন পর্যায়ে নয় বার নক করার পর দরজা খুলে গেল।
দরজা ফাঁক হলে প্রথমেই দেখা গেল রিভলভারের নল।
দরজা আরও খুলে গেলে দেখা গেল রিভলভার হতে দাঁড়ানো লোকটিকে।
তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একজন মাসলম্যান। মেদহীন ঋজু শরীর। হাফপ্যান্টের সাথে টি-শার্ট পরা। চোখের দৃষ্টি সাপের মত তীক্ষ্ণ। গোটা মুখ বিরক্তিতে ভরা। বলল তীব্র কণ্ঠে, ‘কে তুমি? আমার গেটম্যান কোথায়?’
আহমদ মুসা বুঝল কেউ আসলে গেটম্যানই তাকে ডাকে। ডাকারও নিশ্চয় নিয়ম রয়েছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে সে নিয়মের। সম্ভবতঃ এই কারণেই রিভলভার নিয়ে তার আগমন।
‘আমি একজন মানুষ। নাম বললে অবশ্যই চিনবেন না। আর আপনার গেটম্যান ঘুমুচ্ছে, তাকে তালাবন্ধ করে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির রিভলভারের নল একটু উপরে উঠে আহমদ মুসার মাথাকে টার্গেট করল। বলল সে কর্কশ কণ্ঠে, ‘যে অপরাধ করেছ তুমি, তাতে আমি এখনি তোমার মাথা উড়িয়ে দিতে পারি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গুলি আপনি এখন করবেন না। গুলি করার সময় আপনার পার হয়ে গেছে। শুরুতেই তা করেননি। আসলে আপনি আমাকে জানতে চান।’
আহমদ মুসার নির্মল হাসি, নির্ভয় চোখ-মুখ দেখে লোকটি বিস্মিতই হয়েছিল। আর যে ক্রিমিনাল চেহারা লোকটি দেখতে অভ্যস্ত, সে রকম চেহারা আহমদ মুসার নয়।
লোকটির দৃষ্টি একটু সহজ হলো। বলল, ‘আমার গেটম্যানকে বন্ধ করেছ কেন?’
‘আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই। আমি চাই আর কেউ তা না শুনুক। আর গেটম্যান তার ঘুমানোর শাস্তি পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির চোখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি। বলল, ‘মনে হচ্ছে, গেটম্যান যেন তোমার?’
‘গেটম্যান আমার বা আপনার এ প্রশ্ন নয়, গেটম্যান যারই হোক সে দায়িত্বে অবহেলা করবে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির রিভলভারের নল নিচে নেমে গেল। বলল, ‘কী বলতে চান বলুন।’
‘এভাবে দরজার দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে কোন কথা হয়?’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটি তাকাল একবার আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কালকে সবে এ বাড়িতে উঠেছি। এখনও কিছুই গোছগাছ করা হয়নি। আসুন ভেতরে।’ আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল।
শোবার ঘরটাই শুধু শোবার মত করে গোছ-গাছ করা হয়েছে। একটা বেড, তার পাশে বসবার জন্যে রয়েছে একটা সোফা।
লোকটি আহমদ মুসাকে সোফায় বসতে বলে নিজে বেডের উপর বসল পা ঝুলিয়ে।
তার হাতে তখনও রিভলভার।
লোকটি বসেই বলল, ‘আপনার তো সাংঘাতিক দুঃসাহস! চিন্তা-ভাবনা না করেই ঢুকে পড়েছেন! আমি যদি গুলি করে বসতাম!’
‘পারতেন না আপনি গুলি করতে। তার আগেই আমার গুলি আপনার কণ্ঠনালির পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার চাঁদি দিয়ে বের হয়ে যেত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি তো রিভলভার বেরই করেননি।’ বলল লোকটি। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘রিভলভার ছিল আমার জ্যাকেটের পকেটে। আমার ডান হাতের তর্জনি ছিল রিভলভারের ট্রিগারে। আর রিভলভারের নল ছিল আপনার থুতনি ও গলার সন্ধিক্ষণে। টার্গেট ঠিক করেই রেখেছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা। এরপর জ্যাকেটের ডান পকেট থেকে রিভলভার সমেত ডান হাতটা বের করে দেখাল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম।’ বলল লোকটি।
থামল একটু। বলল আবার সে, ‘হ্যাঁ বলুন, কী বলতে চান।’
‘গতকাল ভ্যান এয়ারপোর্টের ভিভিআইপি কার পার্কিং-এ যারা দু’জন লোককে বোমার সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সম্পর্কে জানতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা সরাসরি লোকটির চোখের উপর চোখ রেখে।
চমকে উঠল লোকটি। চমকানো অবস্থাকে সে গোপনও করল না।
চমকানো অবস্থা ছিল তার মুহূর্তের জন্য। তারপরই তার চোখে ফুটে উঠল আগুন। তবে ধীরে ধীরে নিভে গেল সে আগুন। বলল সে, ‘এ প্রশ্ন আমাকে কেন করছেন?’
‘যে দু’জন বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছে, তাদেরই একজন আমাদের এটা জানিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম না আমি কথাটা!’ বলল লোকটা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘তারা যে গাড়িতে যান, যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দেহ বিস্ফোরিত হয়, সে গাড়িতে পাওয়া একটা সিগারেটের প্যাকেট থেকে আপনার এই ঠিকানাটা পাওয়া গেছে। ঠিকানাটা গতকালই গাড়ি চলন্ত অবস্থাতেই লেখা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগে জবাব দিল না লোকটা। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। সে যেন আহমদ মুসার কথার সত্যাসত্য যাটাই করছে।
ইতিমধ্যে আহমদ মুসা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি বের করে লেখাটা লোকটার সামনে তুলে ধরল।
লেখাটার উপর একবার চোখ বুলিয়েই লোকটা বলল, ‘আপনি তো ঠিকানা ভুল করেছেন। যাবেন ‘১৩১’ নাম্বারে, এসেছেন ‘৩১১’ নাম্বার বাড়িতে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘লেখক প্রকৃত নাম্বারের প্রথম ডিজিটাল জোড়াকে এখানে উল্টে লিখেছেন। ‘৩১’ কে ‘১৩’ বানানো হয়েছে।’
বিস্ময়ে ছেয়ে গেল লোকটার মুখ। বলল, ‘লেখক যেটা লিখেছেন, সেটাই ঠিক হবার কথা। আপনি কি করে বলতে পারেন, প্রথম ডিজিটাল জোড়া তিনি উল্টিয়ে লিখেছেন?’
একটু হেসে উঠেই আহমদ মুসা আবার সিগারেটের প্যাকেটের টেলিফোন নাম্বারটা তার সামনে তুলে ধরে বলল, ‘দেখুন, এখানে টেলিফোনের নাম্বারসহ মোট পাঁচটি জোড়ার প্রত্যেকটির দুইটি করে জোড়া আগে-পিছে করা হয়েছে। বাড়ির নাম্বারের ক্ষেত্রেও এটাই করা হয়েছে।’
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল লোকটির মুখ।
‘অসম্ভব ব্যাপার, কি করে বুঝলেন বিষয়টি? এটা আমাদের নিজস্ব একটা রীতি। এ পর্যন্ত কেউ এ ধাঁধাঁ ভাঙতে পারেনি।’
‘এ বিষয়টা থাক। আমি ভাঙতে পেরেছি এটাই সত্য। এখন আপনি দয়া করে বলুন লোক দু’জনকে যারা খুন করেছে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, তারা কারা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি করে বুঝলেন যে, তারা এবং আমরা এক? তাদের সন্ধান আমরা আপনাকে কি করে দেব?’ বলল লোকটি।
‘নিজেদের লোককে গায়ে বোমা বেঁধে দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল নিজেদের হাতে রেখে কেউ কখনো মিশনে পাঠায় না। এটা বিশ্বাসঘাতকতা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন, আজকাল অনেক সুইসাইড স্কোয়াড পাঠানো হয় দেখা যাচ্ছে। তারা কি তাদের নিজেদের লোক নয়?’ বলল লোকটি।
‘সুইসাইড স্কোয়াডের লোকরা মটিভেটেড হওয়ার পর স্বেচ্ছায় সুইসাইড স্কোয়াডে যায় এবং এক বিশেষ মুহূর্তে স্বেচ্ছায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাদের বোমার রিমোট কন্ট্রোল বাইরের কারও হাতে থাকে না। নিজের লোক বলেই বোমা ফাটানো, না ফাটানোর এখতিয়ার তাদের হাতেই রাখা হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
লোকটির চোখ-মুখে এবার প্রতিশোধের আগুন। বলল সে, ‘আপনি ঠিক বলেছেন, তারা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু বলুন তো আপনি কে? আপনি এসব কেন জানতে চাচ্ছেন?’
‘আমি যেই হই না কেন, আমি পুলিশের লোক নই। আমি গোয়েন্দা বিভাগ কিংবা সেনাবাহীনির লোকও নই। আমি মানুষকে সাহায্য করি। এটা আমার একটা ব্রত। তারা যেমন আপনাদের দু’জন লোককে হত্যা করছে, তেমনি তাদের কারণে আমার এক বোন গাতকাল মারা গেছে। আমি চাই তাদের শাস্তি হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তারা আমাদের শিকার। আমরাই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করব। আপনার এ ব্যপারে মাথা না ঘামালেও চলবে।’ বলল লোকটি।
তাই যদি হতো, তাহলে কষ্ট করে আসতাম না। আপনারা ওদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেছেন, এটা আমরা জানতে পারতাম। আর আপনাদের একার পক্ষে ওদের উৎখাত করা সম্ভব নয়। কয়েকজন লোক মারলে ওরা শেষ হয়ে যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু ওদের কোন সুনির্দিষ্ট ঠিকানা আমাদের জানা নেই। ওদের কয়েক ব্যক্তির সাথে মাত্র আমরা পরিচিত।’ লোকটি বলল।
‘ওদের সাথে দেখা সাক্ষাত, যোগাযোগ কিভাবে হতো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা কোন সময় ওদের ঠিকানা নিয়ে যায়নি, কিংবা ঠিকানা দেয়নি। নানা জায়গায় ওদের সাথে দেখা হতো, বিশষ করে মাউন্ট আরারাতের দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালের ট্যুরিস্ট ক্যাম্প নাম্বার ওয়ানে পর্যটনের যে রেস্টুরেন্ট রয়েছে, সেখানেই ওদের সাথে বেশি দেখা হতো।’ বলল লোকটি।
‘ওদের চিনতেন কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ওরা মোবাইলে যোগাযোগ করত।’ বলল লোকটি।
‘ওদের কোন মোবাইল নাম্বার আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরাই মোবাইলে যোগাযোগ করত। তারা তাদের মোবাইল নাম্বার কখনও দেয় না। আমাদের একটা মোবাইল নাম্বার ওদের কাছে ছিল। ও নাম্বারেই ওরা যোগাযোগ করত। ওদের নাম্বার মোবাইল ডিসপ্লেতে থাকে না।’ বলল লোকটি। ‘ভীষণ চালাক ওরা। সব কাজে সব ব্যাপারেই নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখে ওরা। এ পর্যন্ত ওদের ঠিকানাই পাওয়া যায়নি, কোন নেতার পরিচয়ও জানা যায়নি। এইমাত্র আপনি বললেন, আপনারাও প্রতিশোধ নিতে চান কিন্তু দেখছি, আপনারাও ওদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না।’
‘আজ জানি না, কাল জানতে পারব। অসম্ভব নয় জানা। ওদের তো লক্ষ্য মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার লুট করা এবং পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের প্রশাসনকে কব্জা করা। সুতরাং তারা কাজ করছে, ওদের খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।’ বলল লোকটি।
‘মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার লুটের কথা বুঝলাম। ওদের বিশ্বাস হযরত নুহ (আঃ)-এর কিস্তিতে যে স্বর্ণভাণ্ডার উঠেছিল, তা এখন মাউন্ট আরারাতের একটা গুহায় লুকানো আছে। সেটা হাত করার গোপন তৎপরতা চলতেই পারে। কিন্তু পূর্ব আনাতোলিয়ার প্রশাসনকে তারা কব্জা করবে কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেটা আমি জানি না স্যার। ওদের অস্ত্রপাতি, অর্থ ও যোগাযোগ দেখে মনে হয় দেশের বাইরের সাথেও ওদের যোগাযোগ আছে। অবশ্য এটা আমার ধারণা।’ লোকটি বলল।
‘আপনাদেরও যোগাযোগ বাইরের সাথে আছে। আপনাদের লোকরা হিব্রু ভাষা শিখল কি করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আমাদের সংগঠনটা আন্তর্জাতিক। সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলো আমাদের শিখতে হয়। হিব্রু একটাআ গুরুত্বপূর্ণ ভাষা, অন্তঃত আন্ডার ওয়ার্ল্ডের জন্যে। তবে আমাদের সম্পর্ক টাকার সাথে। কোন দেশের রাজনীতির সাথে আমাদের কোন যোগ নেই।’
‘টাকার বিনিময়ে আমাদেরকেও সাহায্য করুন তাহলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তী সাহায্য?’ জিজ্ঞাসা লোকটির।
‘ওরা পূর্ব আনাতোলিয়ার প্রশাসনকে কব্জায় আনতে চাচ্ছে কেন? তাদের লক্ষ্য কী? এসব তথ্য আমাদের সংগ্রহ করে দিন। শুধুই খুনের কাজ করেন, নাকি সব কিছু? কিন্তু সবখানেই তো রাজনীতি আছে। ওরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যেই আমাকে খুন করতে আপনাদের নিয়োগ করেছিল। আমি বেঁচে গেছি, কিন্তু আরেকটি মেয়ে জীবন দিয়েছে আমাকে বাঁচানোর জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা আগে জানলে আপনাকে খুন করার এই কাজটা অবশ্যই নিতাম না।’ লোকটি বলল।
‘আপনি যে দেশের মানুষ, সে দেশের রাজনৈতিক স্বার্থ আপনি দেখবেন না?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেশ আমার স্বার্থ দেখেনি। আমি দ্বারে-দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছি, চাকুরী পাই নি। তারপর বিচারক অন্যের দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে আমাকে জেলে পাঠিয়েছে। বাধ্য হয়েই কিলার গ্রুপে নাম লিখিয়েছি।’ লোকটি বলল।
‘বিচারক যেমন অন্যের দায় আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে আপনাকে জেলে পাঠিয়েছে এবং যারা আপনাকে চাকুরী দেয়নি এমন কিছু লোকের দায় আপনিও তো অন্যায়ভাবে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু একজন বিচারক অন্যায়কে ন্যায় বলে রায় দিয়েছে, তাই আমিও এটাই ন্যায় হিসেবে গ্রহণ করেছি।’
বলে একটু থামল লোকটি। একটু ভেবে বলল, ‘তবে প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে সাহায্য করবো।’
‘আমাকে কেন, দেশকে সাহায্য করবেন না?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘কারণ, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। বন্দুকধারী কাউকে আমি কখনো এমন সুন্দর ব্যবহার করতে দেখিনি।’ বলল লোকটি।
‘ধন্যবাদ। কী সাহায্য করবেন, কিভাবে সাহায্য করবেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেটা আমি ঠিক করব। আমার দুই কলিগের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ আপনি নিতে পারলেও আমি খুশি হবো। তবে তার আগেই আমি চেষ্টা করবো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে।’
‘ধন্যবাদ, তাতে আমাদেরও লাভ হবে।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তাহলে এখন তো কথা আর নেই। সাহায্যের প্রতিশ্রুতির জন্যে ধন্যবাদ। আবার করে দেখা হবে?’
‘আমি নামায পড়ি না। কিন্তু আমি অদৃষ্টবাদী। ভাগ্য যখন আমাদের আবার দেখা করাবে, তখন দেখা হবে।’ বলল লোকটি।
বিমর্ষতা নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘দেশ না হয় দোষ করেছে, কিন্তু আল্লাহ্’র আদেশ মানবেন না কেন?’
‘আল্লাহ্ আমাকে কিলার বানিয়েছেন, আমি তো কিলার হতে চাইনি। আর কিলার হওয়ার পর আর নামায পড়ার সুযোগ থাকে না।’ লোকটি বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহ্ আপনাকে কিলার বানাবেন কেন? চাকুরী না পেয়ে বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে বিচারক আপনাকে জেলে পাঠানোর ফলে আপনি যে সংকটে পড়েছিলেন, সে সংকটের সুযোগ নিয়ে শয়তান আপনাকে কিলার বানিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সংকট থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচাননি কেন?’ বলল লোকটি।
‘আপনার মধ্যে ধৈর্য্যের অভাব, তাই। সে কারণেই সংকট আপনাকে কাবু করে ফেলেছিল এবং তার ফলে শয়তানের জন্যে পথ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ্ কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘কষ্টের পাশেই কষ্টের উপশম থাকে।’ আল্লাহ্’র এই ওয়াদার উপর বিশ্বাস করে ধৈর্য্য ধারলে কষ্টের উপশম জীবন্ত রূপ নিয়ে মানুষের সামনে আসে। আপনি উপশমকে কাছে আসার সে সুযোগ দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব কষ্টেরই উপশম হয় ধৈর্য্য ধরলে?’ বলল লোকটি।
‘বিশ্ব চরাচরের মালিক ও স্রষ্টা আল্লাহ্ বলেছেন, কষ্টের সাথেই উপশম। তাই কষ্টের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে পারলে উপশম আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ‘স্বাভাবিক’ শব্দের বিপরীতে ‘অ-স্বাভাবিক’ বা ‘ব্যতিক্রম’ শব্দ যখন রয়েছে, তখন ব্যতিক্রমী বিষয় হিসেবে কষ্টের উপশম কখনও কোন ক্ষেত্রে নাও আসতে পারে। কিন্তু এটা ধরার বিষয় অবশ্যই নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাকে। বিষয়টাকে এমনভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, সামর্থ্যও বোধ হয় ছিল না। কিন্তু যা ঘটার, যা হবার, তা তো ঘটেই গেছে। এখন এই সব আলোচনার কোন অর্থ নেই।’ বলল লোকটি।
‘অর্থ অবশ্যই আছে। কিলার হওয়াই শেষ কথা নয়, কিলার হওয়া কারো শেষ পরিচয়ও নয়। কিলার হওয়ার পর নামায পড়ার সুযোগ নেই, একথা ঠিক। তবে নামায সব পাপের কালো দাগ মুছে ফেলতে পারে। পাপের জীবন থেকে ফিরে আসার তওবা মানুষের পাপের ক্লেশক্লিষ্ট জীবনকে পবিত্র করে তুলতে পারে।’
আশার একটা চাপা ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠল লোকটির চোখে-মুখে। বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি খুব ভালো লোক। ভালো লোকরা মানুষের মনে হতাশার বদলে আশার উজ্জীবন ঘটায়। এমন ভালো লোকদের অবিশ্বাস করা চলে না। ঠিক আছে আবার দেখা হবে।’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আপনার নাম জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে?’
এতক্ষণে হাসল লোকটা। বলল, ‘আপনি আইনজীবী হলে বোধ হয় বেশি ভালো করতেন। আপনি কেমন বন্দুক চালান জানি না। কিন্তু কথা আপনার দারুন লক্ষভেদি। যাক, আমার নাম মেন্দারিস মালিক। ডবল এম। আপনার নাম কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলাম না।’
‘যাকে হত্যার জন্যে আপনাদের দু’জন লোককে নিয়োগ করা হয়েছিল, আমি সেই আবু আহমদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ, আবার দেখা হবে।’ বলে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল মেন্দারিস মালিক।
‘আস্-সালামু আলাইকুম।’ বলে লোকটির সাথে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসা।
‘আসি।’ বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
সাথে সাথে হাঁটতে লাগল মেন্দারিস মালিকও।
মেন্দারিস মালিক গাড়ি পর্যন্ত এসে আহমদ মুসাকে বিদায় জানাল।
মাউন্ট আরারাতের গোড়ায় টুরিস্ট বেজক্যাম্প নাম্বার ওয়ানে পর্যটন রেস্টুরেন্টে আহমদ মুসা বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর চোখ দু’টি নিবদ্ধ রেখেছে পাশেই মেলে রাখা পত্রিকায়।
কিন্তু পত্রিকার এক বর্ণও সে পড়ছে না। মনে তার ভিন্নরকম চিন্তার ঝড়।
ভ্যান-এর পুলিশ প্রধান ডিজিপি মাহির হারুন গত কয়েকদিন থেকে গোটা পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের রিপোর্ট গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তার কাছে পাঠাচ্ছে। এই ব্যবস্থা করা হয়েছে আংকারার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে।
গোয়েন্দা রিপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু দেখছে না আহমদ মুসা। উল্কিওয়ালাদের সুপারিশে তাদের বশংবদ হিসাবে ইজদির প্রদেশ ও আশে-পাশের কিছু অঞ্চলে যেসব সেনা অফিসার নিয়োগ পেয়েছিল তার তৎপরতার রিপোর্টও আসছিল আহমদ মুসার কাছে। তাদের তৎপরতায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে সব ব্যপারেই একটু বেশি সতর্ক মনে হয়।
তাদের চলাফেরায় ফ্রী-নেসটা আগের মত নেই। অন্যদিকে গোয়েন্দারা বড় কোন অস্বাভাবিক তৎপরতার খবর দিতে না পারলেও রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে মাউন্ট আরারাতের সেসব ক্যাম্পগুলোতে ভিজিটরের সংখ্যা বেড়েছে। আর গোটা ইজদির ও সন্নিহিত অঞ্চলে হঠাৎ করেই ফেরিওয়ালা, হোম সার্ভিস কোম্পানীর লোকজন ও খ্রীস্টান ধর্মগুরুদের আনা-গোনা বেড়েছে। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অ