৫. রক্তাক্ত পামির

চ্যাপ্টার

তাসখন্দের বেলা ৩টা। সুঁচ ফুটানো রোদ। পা দু’টি উঠতে চাইছিল না রোকাইয়েভার। ক্ষুধা এবং ক্লান্তি দুই-ই তাকে গ্রাস করতে চাইছে। ঘরের দরজা আর বেশী দুরে নয়। কিন্তু ঘরে গিয়ে দাদীকে কি খবর দেবে রোকাইয়েভা। আজও কোন কাজ তার যোগাড় হয়নি। পরিচিত সবাই যেন আজ অপরিচিত হয়ে গেছে। রোকাইয়েভা উপলব্দি করছে তার উপস্থিতিতে সবাই অস্বস্তি বোধ করেছে। এর কারন রোকাইয়েভা বুঝে। ‘বিশ্বাসঘাতক জামিলভের বোন রোকাইয়েভাও আজ সন্দেহের তালিকায়। তাকে চাকুরী দেয়ার অর্থ আহেতুক এক সন্দেহের শিকার হওয়া। কেউই এ সন্দেহের শিকার হতে চায় না। তাই পরিচিত জনদের সকল দরজা তার জন্য বন্ধ। গোটা পৃথিবী তার কাছে আজ ছোট হয়ে গেছে। সরকারের সহযোগী ‘ফ্র’- এর কথায় এমনটি হতোনা। ওরা বলেছিল, ভাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতাকে কনডেম করে সরকারের কাছে একটা স্টেটমেন্ট রেকর্ড করলেই পড়াশুনার সুযোগ এবং সরকারী বাড়ী দুই-ই পাওয়া যাবে। কিন্তু রোকাইয়েভা এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর পরিণতি কি সে জানত। কিন্তু যে পরিণতি হোক ভাইয়ের জীবন দেয়ার চেয়ে বড় কি? না তা নয়। সুতরাং হাসিমুখেই সে এ জীবন বরন করে নিয়েছে। তার নিজের জন্য কোন দুঃখ নেই। দুঃখ হচ্ছে দাদীর জন্য। কষ্ট সহ্যের বয়স তো আর নেই। ঘরের দরজায় এসে পড়েছে। দরজায় নক করল রোকাইয়েভা। হাত দু’টিকেও ভারী মনে হচ্ছে রোকাইয়েভার।
দরজা খুলে গেল। হাসিমুখে দাদী দাঁড়িয়ে। বিছানায় সেই জায়নামাজ এবং কোরআন শরীফ। রোকাইয়েভা বুঝল দাদী কোরআন শরীফ পড়ছিল।
দাদীর মুখে হাসি, কিন্তু দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে হাসির উপর আন্ধকার একটা ছায়া। দাদীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে এবং তার আধময়লা কাপড় দেখে ভেতর থেকে বেদনাটা উথলে উঠল রোকাইয়েভার। সে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদী? শেষের কথাগুলো রোকাইয়েভার ভেঙ্গে পড়তে চাইলো। দাদী রোকাইয়েভার পিঠ চাপড়ে অত্যন্ত পরিষ্কার কণ্ঠে বলল, আমার কোন কষ্ট নেই বোন। গোডাউনের মত এই গরাদ ঘরে থেকে আমি যে তৃপ্তি পাচ্ছি তা এতদিন এয়ারকন্ডিশন ঘরে থেকে পাইনি।
-সত্যই বলছ, সত্যই তোমার কোন কষ্ট হচ্ছেনা দাদী?
-হ্যাঁরে হ্যাঁ। সুখত মনের জিনিস, বাইরের দুঃখ দারিদ্রের সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। দাদীকে থামিয়ে দিয়ে তার মুখের উপর চোখ রেখে রোকাইয়েভা বলল এত শক্তি তুমি কোথা থেকে পাও দাদী?
-কোথা থেকে পাই? জাতির প্রতি ভালোবাসা থেকে।
আজ যুগ যুগ ধরে কম্যুনিষ্ট সরকার পশু শক্তি আমার মুসলিম ভাই বোনদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছে তার কোন পরিমাপ নেই। সে দিকে তুমি যদি একবার চোখ মেলে তাকাও তাহলে নিজের যে কষ্ট তাকে কষ্টই মনে হবে না।
ঘরে একটি মাত্র খাটিয়া। একটা টেবিল একটা চেয়ার। সাথে একটা বাথরুম। তাদের বাড়িটি কেড়ে নিয়ে সরকার এখানে এনে তাদের তুলেছে। সরকারের ইচ্ছামত বিবৃতি না দেয়ায় হুমকি দেয়া হয়েছে। এ ঘরটিও কেড়ে নেয়া হবে এবং বিদ্রোহী হিসেবে শ্রম শিবিরে পাঠান হবে। কিন্তু এর পরও রোকাইয়েভা পারেনি তার ভাইয়াকে বিশ্বাসঘাতক বলে আভিহিত করতে।
রোকাইয়েভা খাটিয়ায় গিয়ে বসল। পাশেই টেবিল। টেবিলে প্লেট দিয়ে একটা বাটি ঢেকে রাখা। রোকাইয়েভাই এটা সকালে রেখে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে কেউ তাতে হাত দেয়নি। মনটা আনচান করে উঠল রোকাইয়েভার। সে দ্রুত প্লেট তুলে নিল। দেখল বাটিতে একখণ্ড রুটি। এ রুটি দাদীর জন্য রেখে দিয়েছিল। দাদী রুটিতে হাত দেননি। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল দাদী তুমি রুটি খাওনি, না খেয়ে আছ এখন পর্যন্ত?
রুদ্ধ আবেগে গলা কেঁপে উঠল রকাইয়েভার . দাদী ধীরে ধীরে তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। তারপর সস্নেহে বলল, তুই খেয়ে না গেলে কি আমি খেতে পারি?
সেদিন সকালে একখণ্ড রুটি তাদের ছিল। তারা প্রায় খালি হাতে এখানে এসে উঠেছে। পরার কাপড় ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছুই তারা নিয়ে আসতে পারেনি। কিছু রুবল ছিল, সেটা দিয়েই কয়েকদিন তারা রুটি কিনেছে। আজ সকালে রোকাইয়েভা না খেয়েই কাজের খোঁজে গিয়েছিল। দাদীকে বলে গিয়েছিল রুটিটি খাবার জন্য।
দাদীর কথা শুনে রোকাইয়েভা তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে ফেলল। দাদীর শুকনো চোখ দিয়েও এবার নেমে এল অশ্রুর দুটি ধারা। চোখ দু’টি মুছে নিয়ে দাদী বলল, চল বোন রুটি ভাগ করে নেই। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। আমি জানতাম তুই খালি হাতে ফিরে আসবি। কোন দরজাই তোর সামনে খুলবেনা।
দাদীই রুটি ভাগ করল। একভাগ রোকাইয়েভার হাতে দিল। রোকাইয়েভা তার খণ্ডটি দাদীর দিকে তুলে ধরে বলল। এটা তুমি নাও তোমারটা আমাকে দাও।
দাদী স্লান হেসে বলল ঠিক আছে।
দু জনে শুকনো রুটি চিবিয়ে দু গ্লাস পানি খেয়ে নিল। এ সময় দরজায় নক হল। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাড়াল। দরজা খুলল। দেখল একজন ফুলওয়ালা। তাসখন্দের রাজ পথে এমন কাগজের ফুলওয়ালা অনেক পাওয়া যায়। ঘর সাজানো টেবিল সাজানোর জন্য এদের চাহিদা প্রচুর।
রোকাইয়েভা দরজা খুলে দাড়াতেই ফুলওয়ালা একটা সুন্দর ফুলের ঝাড় তার হাতে গুঁজে দিল। যেন ফরমায়েশি ফুলই সে নিয়ে এসেছে। রোকাইয়েভা মুখ খোলার আগেই ফুলওয়ালা বলল একটা নমুনা দিয়ে গেলাম, পছন্দ কিনা দেখুন বলেই সে পথ চলা শুরু করল। রোকাইয়েভা অবাক হবার চেয়ে বিরক্তই হল। দরজা বন্ধ করে দাদীর দিকে ঘুরে দাডীয়ে বলল। দেখ দাদী কি জ্বালাতন। পয়সা নিল না। কে একজন ফুলওয়ালা দিয়ে গেল।
-এমন তো হয়না কখনও। কি ব্যাপার? -বলল দাদী।
-কি জানি.. বলতে বলতে রোকাইয়েভা ফুলের গুচ্ছটি টেবিলের উপর রাখল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলো না, পড়ে গেল। মাটির তৈরি রঙ্গিন ফুলদানির তলাটা কেমন উঁছু। তলাটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখল, টেপ দিয়ে ফুলদানীর রংগের একটি কাগজ আটকে রাখা। রোকাইয়েভা তাড়াতাড়ি ওটা খুলে ফেলল। বের হয়ে একটি ভাঁজ করা কাগজ। একটি চিঠি, তার সাথে একটি পাঁচশ রুবলের নোট।
রোকাইয়েভা এবং দাদী দুজনেই বিস্মিত। রোকাইয়েভা চিঠি পড়লঃ

রোকাইয়েভা আমার সালাম নিও। আগামী কাল প্রাভদার তাসখন্দ সন্সকরনে পি ৯১ ক্রমিক নাম্বারে একটি ‘মিস্ট্রেস আবশ্যক’ বিজ্ঞাপন বেরুবে। বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ঠিকানায় তুমি ১০ টায় পৌছাবে। বাসাটা আমির ওসমানের। দ্বিধা করবেনা। তোমার দ্বীনি ভাইদের তরফ থেকেই এই কাজের ব্যবস্থা।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top