৫. রক্তাক্ত পামির

চ্যাপ্টার

তাসখন্দের বেলা ৩টা। সুঁচ ফুটানো রোদ। পা দু’টি উঠতে চাইছিল না রোকাইয়েভার। ক্ষুধা এবং ক্লান্তি দুই-ই তাকে গ্রাস করতে চাইছে। ঘরের দরজা আর বেশী দুরে নয়। কিন্তু ঘরে গিয়ে দাদীকে কি খবর দেবে রোকাইয়েভা। আজও কোন কাজ তার যোগাড় হয়নি। পরিচিত সবাই যেন আজ অপরিচিত হয়ে গেছে। রোকাইয়েভা উপলব্দি করছে তার উপস্থিতিতে সবাই অস্বস্তি বোধ করেছে। এর কারন রোকাইয়েভা বুঝে। ‘বিশ্বাসঘাতক জামিলভের বোন রোকাইয়েভাও আজ সন্দেহের তালিকায়। তাকে চাকুরী দেয়ার অর্থ আহেতুক এক সন্দেহের শিকার হওয়া। কেউই এ সন্দেহের শিকার হতে চায় না। তাই পরিচিত জনদের সকল দরজা তার জন্য বন্ধ। গোটা পৃথিবী তার কাছে আজ ছোট হয়ে গেছে। সরকারের সহযোগী ‘ফ্র’- এর কথায় এমনটি হতোনা। ওরা বলেছিল, ভাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতাকে কনডেম করে সরকারের কাছে একটা স্টেটমেন্ট রেকর্ড করলেই পড়াশুনার সুযোগ এবং সরকারী বাড়ী দুই-ই পাওয়া যাবে। কিন্তু রোকাইয়েভা এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর পরিণতি কি সে জানত। কিন্তু যে পরিণতি হোক ভাইয়ের জীবন দেয়ার চেয়ে বড় কি? না তা নয়। সুতরাং হাসিমুখেই সে এ জীবন বরন করে নিয়েছে। তার নিজের জন্য কোন দুঃখ নেই। দুঃখ হচ্ছে দাদীর জন্য। কষ্ট সহ্যের বয়স তো আর নেই। ঘরের দরজায় এসে পড়েছে। দরজায় নক করল রোকাইয়েভা। হাত দু’টিকেও ভারী মনে হচ্ছে রোকাইয়েভার।
দরজা খুলে গেল। হাসিমুখে দাদী দাঁড়িয়ে। বিছানায় সেই জায়নামাজ এবং কোরআন শরীফ। রোকাইয়েভা বুঝল দাদী কোরআন শরীফ পড়ছিল।
দাদীর মুখে হাসি, কিন্তু দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে হাসির উপর আন্ধকার একটা ছায়া। দাদীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে এবং তার আধময়লা কাপড় দেখে ভেতর থেকে বেদনাটা উথলে উঠল রোকাইয়েভার। সে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদী? শেষের কথাগুলো রোকাইয়েভার ভেঙ্গে পড়তে চাইলো। দাদী রোকাইয়েভার পিঠ চাপড়ে অত্যন্ত পরিষ্কার কণ্ঠে বলল, আমার কোন কষ্ট নেই বোন। গোডাউনের মত এই গরাদ ঘরে থেকে আমি যে তৃপ্তি পাচ্ছি তা এতদিন এয়ারকন্ডিশন ঘরে থেকে পাইনি।
-সত্যই বলছ, সত্যই তোমার কোন কষ্ট হচ্ছেনা দাদী?
-হ্যাঁরে হ্যাঁ। সুখত মনের জিনিস, বাইরের দুঃখ দারিদ্রের সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। দাদীকে থামিয়ে দিয়ে তার মুখের উপর চোখ রেখে রোকাইয়েভা বলল এত শক্তি তুমি কোথা থেকে পাও দাদী?
-কোথা থেকে পাই? জাতির প্রতি ভালোবাসা থেকে।
আজ যুগ যুগ ধরে কম্যুনিষ্ট সরকার পশু শক্তি আমার মুসলিম ভাই বোনদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছে তার কোন পরিমাপ নেই। সে দিকে তুমি যদি একবার চোখ মেলে তাকাও তাহলে নিজের যে কষ্ট তাকে কষ্টই মনে হবে না।
ঘরে একটি মাত্র খাটিয়া। একটা টেবিল একটা চেয়ার। সাথে একটা বাথরুম। তাদের বাড়িটি কেড়ে নিয়ে সরকার এখানে এনে তাদের তুলেছে। সরকারের ইচ্ছামত বিবৃতি না দেয়ায় হুমকি দেয়া হয়েছে। এ ঘরটিও কেড়ে নেয়া হবে এবং বিদ্রোহী হিসেবে শ্রম শিবিরে পাঠান হবে। কিন্তু এর পরও রোকাইয়েভা পারেনি তার ভাইয়াকে বিশ্বাসঘাতক বলে আভিহিত করতে।
রোকাইয়েভা খাটিয়ায় গিয়ে বসল। পাশেই টেবিল। টেবিলে প্লেট দিয়ে একটা বাটি ঢেকে রাখা। রোকাইয়েভাই এটা সকালে রেখে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে কেউ তাতে হাত দেয়নি। মনটা আনচান করে উঠল রোকাইয়েভার। সে দ্রুত প্লেট তুলে নিল। দেখল বাটিতে একখণ্ড রুটি। এ রুটি দাদীর জন্য রেখে দিয়েছিল। দাদী রুটিতে হাত দেননি। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল দাদী তুমি রুটি খাওনি, না খেয়ে আছ এখন পর্যন্ত?
রুদ্ধ আবেগে গলা কেঁপে উঠল রকাইয়েভার . দাদী ধীরে ধীরে তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। তারপর সস্নেহে বলল, তুই খেয়ে না গেলে কি আমি খেতে পারি?
সেদিন সকালে একখণ্ড রুটি তাদের ছিল। তারা প্রায় খালি হাতে এখানে এসে উঠেছে। পরার কাপড় ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছুই তারা নিয়ে আসতে পারেনি। কিছু রুবল ছিল, সেটা দিয়েই কয়েকদিন তারা রুটি কিনেছে। আজ সকালে রোকাইয়েভা না খেয়েই কাজের খোঁজে গিয়েছিল। দাদীকে বলে গিয়েছিল রুটিটি খাবার জন্য।
দাদীর কথা শুনে রোকাইয়েভা তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে ফেলল। দাদীর শুকনো চোখ দিয়েও এবার নেমে এল অশ্রুর দুটি ধারা। চোখ দু’টি মুছে নিয়ে দাদী বলল, চল বোন রুটি ভাগ করে নেই। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। আমি জানতাম তুই খালি হাতে ফিরে আসবি। কোন দরজাই তোর সামনে খুলবেনা।
দাদীই রুটি ভাগ করল। একভাগ রোকাইয়েভার হাতে দিল। রোকাইয়েভা তার খণ্ডটি দাদীর দিকে তুলে ধরে বলল। এটা তুমি নাও তোমারটা আমাকে দাও।
দাদী স্লান হেসে বলল ঠিক আছে।
দু জনে শুকনো রুটি চিবিয়ে দু গ্লাস পানি খেয়ে নিল। এ সময় দরজায় নক হল। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাড়াল। দরজা খুলল। দেখল একজন ফুলওয়ালা। তাসখন্দের রাজ পথে এমন কাগজের ফুলওয়ালা অনেক পাওয়া যায়। ঘর সাজানো টেবিল সাজানোর জন্য এদের চাহিদা প্রচুর।
রোকাইয়েভা দরজা খুলে দাড়াতেই ফুলওয়ালা একটা সুন্দর ফুলের ঝাড় তার হাতে গুঁজে দিল। যেন ফরমায়েশি ফুলই সে নিয়ে এসেছে। রোকাইয়েভা মুখ খোলার আগেই ফুলওয়ালা বলল একটা নমুনা দিয়ে গেলাম, পছন্দ কিনা দেখুন বলেই সে পথ চলা শুরু করল। রোকাইয়েভা অবাক হবার চেয়ে বিরক্তই হল। দরজা বন্ধ করে দাদীর দিকে ঘুরে দাডীয়ে বলল। দেখ দাদী কি জ্বালাতন। পয়সা নিল না। কে একজন ফুলওয়ালা দিয়ে গেল।
-এমন তো হয়না কখনও। কি ব্যাপার? -বলল দাদী।
-কি জানি.. বলতে বলতে রোকাইয়েভা ফুলের গুচ্ছটি টেবিলের উপর রাখল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলো না, পড়ে গেল। মাটির তৈরি রঙ্গিন ফুলদানির তলাটা কেমন উঁছু। তলাটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখল, টেপ দিয়ে ফুলদানীর রংগের একটি কাগজ আটকে রাখা। রোকাইয়েভা তাড়াতাড়ি ওটা খুলে ফেলল। বের হয়ে একটি ভাঁজ করা কাগজ। একটি চিঠি, তার সাথে একটি পাঁচশ রুবলের নোট।
রোকাইয়েভা এবং দাদী দুজনেই বিস্মিত। রোকাইয়েভা চিঠি পড়লঃ

রোকাইয়েভা আমার সালাম নিও। আগামী কাল প্রাভদার তাসখন্দ সন্সকরনে পি ৯১ ক্রমিক নাম্বারে একটি ‘মিস্ট্রেস আবশ্যক’ বিজ্ঞাপন বেরুবে। বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ঠিকানায় তুমি ১০ টায় পৌছাবে। বাসাটা আমির ওসমানের। দ্বিধা করবেনা। তোমার দ্বীনি ভাইদের তরফ থেকেই এই কাজের ব্যবস্থা।
ঐ ভাইদের তরফ থেকেই ৫০০ রুবল পাঠান হলো তাৎক্ষনিক খরচ মিটানোর জন্য।
ওয়াসসালাম-
‘যুবায়েরভ’

রোকাইয়েভা চিঠি পড়ে দাদীর হাতে দিল। দাদীও চিঠিটি পড়ল। পড়ে বলল কে যুবায়েরভ ?
-মনে আছে দাদী ভাইয়ার মৃত্যুর খবর এই যুবায়েরভের চিঠিতেই পেয়েছিলাম।
-মনে আছে, তাইত ভাবছি কে এই যুবায়েরভ!
-আশ্চর্যের কথা। আমরা কোথায় আছি আমাদের কি প্রয়োজন সবই তার জানা আছে!
দাদী কোন উত্তর দিল না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিলো। অনেক্ষন পরে চোখ খুলে রোকাইয়েভার দিকে চেয়ে বলল, রোকাইয়েভা, আমরা বোধহয় একা নই। কম্যুনিস্ট সরকার ও ‘ফ্র’ এর সমান্তরালে দেশে আরেকটা শক্তি অদৃশ্যভাবে কাজ করছে। যুবায়েরভ সে শক্তিরই প্রতিক।
দাদী থামল, আবার চোখ দুটি বন্ধ। চোখ দুটি খুলল তার অনেকক্ষন পর। দু’টি চোখ তার উজ্জ্বল। বলল, বুঝতে পেরেছি, প্রাভদার বিজ্ঞাপন তোকে একটা কাজ দেবার অধিকার সৃষ্টিরই কৌশল।
একটু থেমে আবার দাদী বলল, ওরা কি করছে, বলতে পারিস রোকাইয়েভা?
-না দাদী এদের জানিনা। কিন্তু গোপন পত্রিকা সামিজদাদ থেকে জানি, কারা একদল মানুষ এদেশের মুসলমানদের জাগরন ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে।
-সামিজদাদ কি? -বলল দাদী।
-সাইক্লোস্টাইল করা গোপন নিয়মিত পত্রিকা। ওতে থাকে এদেশের বিপ্লবী কর্ম তৎপরতার খবর, কম্যুনিস্ট সরকারের অপকীর্তি ও সন্ত্রাসের বিবরন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নানা তথ্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কয়েকটা কপি দেখেছি।
দাদীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল। তুই যাই বলিস, আমার খুব আনন্দ লাগছে। আমার জাতি জাগছে জেগে উঠেছে আমার জাতি। বলতে বলতে আবেগে উঠে দাঁড়াল দাদী। রোকাইয়েভা কাছে আসে, তার ঘাড়ে একটা হাত রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল আমার জামি কি এদের জানত নাকি?
-জানবেনা কেন দাদী? ভাইইয়াদের কাছেই সব তথ্য আসে।
-তাহলে বলছি, আমার জামিল এদের সাথে ছিল। তাইত সে জীবন দিল।
তারপর দু’টি হাত উপরে তুলে দাদী বলল, হে আল্লাহ কম্যুনিস্ট সরকারের সহযোগিতা করে এ পরবারে যে পাপ হয়েছিল, জামিলের রক্ত দিয়ে তুমি তার করে দাও।
দাদীর দু’গন্ড দিয়ে দ’তী অশ্রুর ধারা নেমে এল। রোকাইয়েভা অপলক ভাবে তাকিয়েছিল দাদীর দিকে। হঠাৎ যেন তার মনে হোল এ কান্না তার দাদীর নয়, গোটা মধ্য এশিয়ার। আমুদরিয়া ও শিরদরিয়ায় যে অশ্রু বইছে যুগ যুগ ধরে এ যেন সেই অশ্রু। সেও দাদীর সাথে হাত তলল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ‘আমিন’।
গভীর রাত। রোকাইয়েভা এবং দাদী গাঢ় ঘুমে অচেতন। তাদের দরজায় নক হলো ঠক ঠক ঠক। শক্তিশালী নক। ঘুম তাদের ভাঙ্গলোনা। আবার নক হলো ঠক, ঠক, ঠক।
এবার আগের চেয়ে জোরে। কিন্তু ঘুম তাদের ভাংলোনা। দাদি একটু নড়ে উঠলেন মাত্র। এবার দরজায় কারাঘাত, একবার, দুইবার, তিন………।
চমকে উঠে বসলো দাদী। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। তারপর যখন বুঝেত পারলো চমকে উঠলো। এত রাতে দরজায় নক করে কে?
আবার কারাঘাত হলো। দাদী রোকাইয়েভাকে জাগিয়ে দিল। সব শুনে রোকাইয়েভা আঁতকে উঠলো। এত রাতে কে আসতে পারে। না ভুল করে কেউ নক করছে এখানে। খোলা উচিৎ কিনা? একটু দরজার কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করল কে ?
-দরজা খুলুন। বাহির থেকে ভারি কন্ঠে উত্তর এল।
-কে আপনারা, কাকে চান? ভায়ার্ত কন্ঠ রোকাইয়েভার।
কোন জবাব এলনা। আগের সেই ভারি কন্ঠ আরো ভারি গলায় বলল, তাড়াতাড়ি খুলুন নইলে ভেঙ্গে ফেলবো।
জবাব না পেলেও রোকাইয়েভা বুঝল এরা সরকারের লোক। সরকারী লোক না হলে এমন উদ্ধত কন্ঠ আর কারোরই হতে পারে না। রোকাইয়েভা তার দাদীকে বলল ওরা সরকারের লোক না খুলে উপায় নেই। কিন্তু এই কথা বলার সাথে সাথে অন্তরটা ভীষণ কেঁপে উঠল রোকাইয়েভার। সেদিন সরকারি লোকেরা যে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল তা মনে পড়লো। দাদী ওরা নিয়ে যেতে এসেছে।
দাদীকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে রোকাইয়েভা। আবার প্রবল ধাক্কা এল দরজায়। ভীত- চকিত রোকাইয়েভা যন্ত্রের মত খুলে দিল।
দুজন লোক দীর্ঘাংগ। মাথাই ফেল্ট হ্যাট। মুখটা ভালো করে দেখা যায় না। দাদী এবং রোকাইয়েভা দেখেই বুঝতে পারলো ওরা পুলিসের লোক। দরজা খুলতেই একজন সেই ভারি গলায় রোকাইয়েভাকে বলল, আপনি আমাদের সাথে আসুন।
রোকাইয়েভা দু’পা পিছিয়ে গেল ঘরের ভিতর। বলল, কোথায় যাব, কেন যাব? কাঁপছে রোকাইয়েভা।
-সময় নষ্ট করবেন না, লাভ নেই। বেরিয়ে আসুন। রোকাইয়েভা গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরল। ঢুকরে কেঁদে উঠল। বলল, আমি যাব না, আমি দাদীকে ছেড়ে যাব না। দাদী পাথরের মত। তার চোখে কোন আশ্রু নেই। যেন কোন অনুভুতিই নেই তার। দু’জনের একজন ঘরে ঢুকল। বলল সময় আমাদের নেই, মাফ করবেন আমাদের।
বলে হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে গেল রোকাইয়েভাকে। রোকাইয়েভা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল দাদীর কেউ নেই, দাদীকে ছেড়ে একা আমি যাবনা। দাদীকেও নিয়ে চল।
কিন্তু সেই নিস্ফল চিৎকার। নিস্ফল আবেদন নিরব রাতে একটা বড় প্রতিধ্বনিই তুলল শধু। কোন ফলই হল না।
রাস্তায় একটা কাল গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। রোকাইভাকে তারা সেখানে নিয়ে তুলল। ছোট্ট একটা হিস হিস হিস হিস শব্দ তুলে চলতে শুরু করল গাড়ী।
দু’পাশে অনেক ফ্লাটের সারি। কিন্তু একজন অসহায় নারীর আর্ত চিৎকার কোথাও কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। একটা কৌতুহলি মুখ কোন জানালায় উঁকি দিলোনা। একটা জানালার পর্দাও একটু নড়ল না। যেন একটা মৃত্যু পুরী। কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের এটাই বাস্তবতা। ভয় এবং প্রতি মুহুর্তের উদ্বেগ কারো মধ্যে কোন জীবনাবেগ রাখেনি, সবাইকে একটা জীবন্ত লাশে পরিনত করছে। এ লাশে যন্ত্রিক কর্মক্ষমতা আছে, কিন্তু হৃদয় নেই, কোন অনুভুতি নেই।
সে দিন নাইট ডিওটি ছিল যুবায়েরভের। যুবায়েরভ গুপ্ত পুলিশ এবং বিশ্বরেড সংস্থা ‘ফ্র’ এর রেকর্ড সেকশনের একজন কর্মী। উল্লেখ্য, কম্যুনিস্ট সরকারের গুপ্ত পুলিশ এবং বিশ্বরেড সংস্থা ‘ফ্র’ এখন মধ্য এশিয়ায় এক হয়ে কাজ করছে।
যুবায়েরভের অফিসিয়াল নাম ভিক্টর কুমাকভ। তার দেহে রয়েছে মিশ্র রক্ত মা তুর্কি উজবেক। রুশ উজবেক মৈত্রির প্রমান দিতে গিয়ে তার মা হামুদা নাজিয়ানভাকে একজন রুশকে বিয়ে করতে হয়। সেই রুশ যুবক পেট্রভের কোন ধর্ম ছিল না। কিন্তু স্ত্রী হামুদা নাজিয়ানভার ধর্মনিষ্ঠা তাকে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট করে এবং অবশেষে স্ত্রীর কাছে সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তাদের একমাত্র ছেলে যুবায়েরভ। কিন্তু পেট্রভের ধর্মবিশ্বাস যেমন গোপন ছিল, তেমনি যুবায়েরভের নাম তারা গোপন রাখে। যুবায়েরভের সরকারি নাম ভিক্টর কুমাকভ। সব সরকারী খাতায়, সরকারী ও সামাজিক মহলে সে এই নামেই পরিচিত।
যুবায়েরভ মায়ের কাছে কুরআন পাঠ ও ধর্ম শিক্ষা লাভ করেছে। ইসলামের সোনালী কাহিনী শুনেছে সে মায়ের কাছে। যুবায়েরভ মায়ের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কাউকে মনে করে না।
রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্য্যন্ত যুবায়েরভের নাইট ডিউটি। একজন কর্মঠ রুশ হিসাবে পরিচিত। কাজে কোন ফাঁকি না দেয়া এবং বিশ্বস্ততার জন্য সকলের প্রিয় সে। একদিকে রক্তের পরিচয়ে রুশ, অন্যদিকে কর্তব্যনিষ্ঠা এই দুই কারনে রেকর্ড সংরক্ষনের মত গুরুত্বপূর্ন বিভাগে তাকে আনা হয়েছে। জামিলের প্রানদন্ডের পর নিরাপত্তা বিভাগে যে বিশাল হয়েছে। তারপরেই যুবায়েরভ এই দায়িত্ব পেয়েছে। মধ্য এশিয়া অঞ্চলের শাস্তি প্রাপ্তরা কে কোথায়, কোথায় যাচ্ছে, কোত্থেকে আসছে এর যাবতীয় রেকর্ড এখন তার কাছে। সকল রাজনৈতিক সাজা প্রাপ্তদের ফাইলের শেষ আস্তানা এখন তার সেকশনের সেফটি ভল্টগুলো।
সাইমুমের সাথে যুবায়েরভের সম্পর্ক তার ছাত্রজীবন থেকেই। সে এখন সাইমুমের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মী। সাইমুমের গোয়েন্দা ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল সে। চাকুরীর সময়টুকু ছাড়া সব সময় সে সাইমুমের কাজেই ব্যয় করে।
সেদিন রাত সাড়ে তিনটা। হাতে কোন কাজ নেই। বসে বসে ঝিমুচ্ছিল যুবায়েরভ। হঠাৎ টেবিলের লাল সংকেত জ্বলে উঠল। সেই সাথে পাশ দিয়ে ঘূর্ণায়মান স্বয়ংক্রিয় ক্যারিয়ারে কালো ফিতা মোড়া একটা লাল ফাইল এলো টেবিলে। কালো ফিতামোড়া দেখলেই মনটা আনচান করে ওঠে যুবায়েরভের। নিশ্চয় কেউ ফায়ারিং স্কোয়াডে গেল কিংবা কাউকে নিশ্চয় চালান করা হলো দাস শিবিরে। এ ফাইলটা দেখেও মনটা তার তেমনি হলো।
নিত্যদিনের মত বাম হাতে টেনে ফাইলটি কাছে নিয়ে পাশের ষ্টিল ভল্ট থেকে ফাইলের রেফারেন্স অনুসারে রেকর্ড রেজিষ্টার বের করলো। তারপর ফাইলটি খুলল যুবায়েরভ। ফাইলের শিরোনাম দেখেই চমকে উঠল সে। কিছুক্ষণের জন্য সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। এযে রোকাইয়েভার ফাইল। তাকে শ্রম শিবিরে চালান করা হলো। কিন্তু কখন? আজ বিকালেইতো …….।
ফাইলের পাতা উল্টালো যুবায়েরভ। দেখতে পেল ফাইলের ব্রিফ সামারি। আজ রাত দু’টায় গ্রেপ্তার। রাত তিনটায় কারগো প্লেনেই পাঠানো হয়েছে মস্কোর মস্কোভা শ্রম শিবিরে ওম্যান ব্রাঞ্চে।
যুবায়েরভের সমগ্র সত্তায় ঝড় বইছে। দু’চোখের কোণ তার সিক্ত হয়ে উঠল অশ্রুতে। বাঁচাতে পারলনা তারা অসহায় মেয়েটিকে। তাদের হিসাবে ভুল হয়েছে। তারা মনে করেছিল, বাড়ী ঘর সহায়-সম্পদ এবং যাবতীয় সুখ-ভোগ কেড়ে নেবার পর তাদের হিংসার পরিতৃপ্তি হয়েছে। আর কিছু না ঘটলে এই মুহূর্তে ঘাটাতে যাবেনা পরিবারটিকে। কিন্তু তাদের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো যুবায়েরভের।
দুর্বল হাতে রেকর্ড রেজিষ্টার টেনে নিল যুবায়েরভ। মস্কোভা শ্রম শিবিরে ওম্যান ব্রাঞ্চে মধ্য এশিয়া থেকে চালান হওয়াদের তালিকায় রোকাইভার নাম রেকর্ড করার জন্য সেই রেকর্ড রেজিষ্টারটি খুলল। নামের তালিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে আরেকবার চমকে উঠল যুবায়েরভ। একি! আয়েশা আলিয়েভাকে তাহলে অবশেষে মারা হয়নি? সেও ঐ মস্কোর মস্কোভা শ্রম শিবিরে? অথচ সবাই জানে তার প্রাণদন্ড হয়েছে। মনে হয় সরকার তার মত একটা প্রতিভাকে হাত করার আশা ত্যাগ করেনি। দুঃখের মাঝেও আয়েশা আলিয়েভা বেঁচে থাকার সংবাদে যুবায়েরভ খুশি হলো।
রেকর্ড রেজিষ্টারে আয়েশা আলিয়েভার পাশেই রোকাইয়েভার নাম উঠল। রেকর্ড রেজিষ্টারটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো রোকাইয়েভার দাদীর কথা। ফাইলে তাকে গ্রেপ্তারের কথা নেই। তাহলে কোথায় তিনি? চঞ্চল হয়ে উঠল যুবায়েরভের মন। ঘড়িতে দেখল যে ভোর চারটা বেজে গেছে। টেবিলের ফাইলগুলো গুটিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
আফিসের গাড়ীতে সে ন্যাশনাল পার্ক পর্যন্ত এল। তারপর পার্কে একটু বেড়াবে একথা বলে সে গাড়ী থেকে নেমে এল। সে ঠিক করে নিয়েছে, এখনই একবার রোকাইয়েভার ফ্লাটে গিয়ে সে রোকাইয়েভার দাদীর খোঁজ করবে।
রোকাইয়েভার সেই ফ্লাটে দক্ষিণ তাসখন্দে ১১ নং কলোনীতে এখান থেকে হেঁটে গেলে এক ঘণ্টার পথ। কিন্তু সেখানে সে অন্ধকার থাকতেই পৌঁছাতে হবে। কিন্তু এ সময় গাড়ি পাওয়া যায় না। মুস্কিলে পড়ল যুবায়েরভ। এ সময় পাশ দিয়ে দুধ সাপ্লাইয়ের গাড়ি যাচ্ছিল। যুবায়েরভ হাত তুলে দাঁড় করাল। জিজ্ঞাসা করে জানল গাড়িটি ডেইরী ফার্মে যাচ্ছে। ১১ নং কলোনীর পাশ দিয়েই যাবে। যুবায়েরভ নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে তাকে লিফট দেবার জন্য অনুরোধ করল। সিকিউরিটি বিভাগের কার্ড দেখে ড্রাইভার এবং ইনচার্জ একদম মোমের মত গলে গেল।
যুবায়েরভ সাড়ে চারটায় গিয়ে ১১ নং কলোনীর গেটে নামল। তারপর রোকাইয়েভাদের ফ্লাট খুঁজে নিতে তার কষ্ট হলো না।
এখনো অন্ধকার। ফ্লাটের সামনে রাস্তায় একটু দাঁড়াল যুবায়েরভ। চারদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। রোকাইয়েভার ফ্লাটের কাছাকাছি গিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল যুবায়েরভের। দরজা খোলা! কেন খোলা? তাহলে কি তিনি নেই? কোথায় যাবেন তিনি এই রাতে? গুম করা হয়েছে তাকে? নানা আশংকা, নানা প্রশ্নে যুবায়েরভের বুক তোলপাড় করে উঠল।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াল যুবায়েরভ। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যুবায়েরভ ধীরে ধীরে ডাকল ‘দাদী’। কোন সাড়া নেই। যুবায়েরভ ঘরে প্রবেশ করলো। দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর সতর্কভাবে টর্চের আলো ফেলল ঘরে। দেখল, বিছানা খালি। টর্চের আলো মেঝেই গিয়ে পড়ল। দেখা গেল লুটোপুটি করে পড়ে আছে একটা দেহ। তাড়াতাড়ি ঝুকে পড়ল যুবায়েরভ। যুভায়েরভ খুশী হলো, চোখ খুলেছেন তিনি। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, কে তুমি, কি চাও? আমার রোকাইয়া কোথায়?
-দাদী, আমি যুবায়েরভ। আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
-তুমি যুবায়েরভ। তোমার আগমন এতো দেরিতে কেন? আমার রোকাইয়েভা কোথায়? আমি কোথায় যাব?
-সব কথা বলব দাদী। কিন্তু এখনি আমাদের এখান থেকে সরতে হবে।
-কিন্তু রোকাইয়া যদি এসে এখানে আমাকে না পায়।
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল দাদীর কন্ঠ। যুবায়েরভেরও চোখের পাতা ভিজে এল। কিন্তু সময় নেই। অন্ধকার থাকতেই এ কলোনী থেকে তাকে বের হতে হবে। যুবায়েরভ বলল, দাদী রোকাইয়েভার চিন্তা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আপনি উঠুন।
বলে যুবায়েরভ দাদীকে হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, দাদী আপনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলুন।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যুবায়েরভ বলল, ফুলের ঝাড়টি তো টেবিলের উপর, কিন্তু চিঠিটা কোথায়?
-ওটা তোষকের তলে। বলল, দাদী।
যুবায়েরভ দাদীকে একটু দাঁড় করিয়ে টেবিল থেকে ফুলের ঝাড়টি এবং তোষকের তলা থেকে চিঠিটি নিয়ে নিল। তারপর দাদীকে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
কলোনীর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই যুবায়েরভ ঠিক করল তার সরকারী বাড়ীর চাইতে আমীর ওসমানের বাড়ীই দাদীর জন্য হবে উপযুক্ত আশ্রয়। ওখানে ভালো সঙ্গও পাবেন তিনি।
কলোনীর গেট দিয়ে যখন সে বেরিয়ে এল তখন অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু লোকজন কেউ বের হয়নি।
যুবায়েরভ রাস্তায় নেমেই একটা ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করাল।

Top