৫. রক্তাক্ত পামির

চ্যাপ্টার

বিল জোয়ান ও খুজলাং পাহাড়ের মাঝখানে সংকীর্ন সমতল এক উপত্যকা। তাজিকিস্তানের এ কিরঘিজিস্তান এবং উজবেকিস্তানের সাথে যেন গলাগলি করে আছে। এর দক্ষিন ও পূর্বদিকটা ঘিরে কিরঘিজিস্তান এবং উত্তর দিকে উজবেকিস্তান। অবস্থানের দিক দিয়ে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন, স্থানটা দুর্গম, কিন্তু এখান থেকে শির দরিয়া নদী এবং ফারগানা সমরকন্দ রেলপথ খুব দূরে নয়। ঐতিহাসিক পামির সড়কটিও এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে। ঘোড়ায় চড়ে সেখানে পৌছতে সময় বেশী লাগে না। আর ফারগানা, তাসখন্দ এবং তাজিকিস্তানের রাজধানী স্টালিনবাদের মধ্যবর্তী এ উপত্যকা অবস্থিত বলে সবার সাথে সমান ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এ উপত্যকার চারদিকে যেসব পাহাড়ি কবিলা ছড়িয়ে আছে সকলেই সাইমুমের মুক্তি আন্দোলনে শরিক। সুতরাং নিরাপত্তার দিক দিয়ে নিশ্চিত। বিল জোয়ান ও খুজলং পাহাড় এবং মধ্যবর্তী উপত্যকা ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে সাইমুমের নতুন অপারেশন হেডকোয়াটার। এ হেড কোয়াটার আগে ছিল লেলিন স্মৃতি পার্কে। এখন সেটাকে অস্র-শস্রের সাপ্লাই কেন্দ্র এবং সাইমুম মহিলা শাখার প্রধান অবস্থান কেন্দ্র বানানো হয়েছে।
বিল জোয়ান ও খুজলাং পাহাড় এবং মধ্যবর্তী এ উপত্যকার একটা ইতিহাস আছে। কম্যুনিষ্টদের কবল থেকে মুসলিম মধ্য এশিয়াকে মুক্ত করার জন্য পরিচালিত প্রথম মুক্তি সংগ্রামের নেতা গাজী আনোয়ার পাশা ১৯২২ সালের ৪ঠা আগষ্ট এখানে এই উপত্যকাতেই শাহাদত বরণ করেন। তিনি মুসলিম মুজাহিদিনদের নিয়ে একটা মিটিং করেছিলেন, এই সময় কম্যুনিষ্ট চররা কম্যুনিষ্ট বাহিনীকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসে এবং আনোয়ার পাশা অতর্কিতে চারদিক থেকে আক্রান্ত হন। তিনি আত্নসমর্পন করেননি। কম্যুনিষ্ট বাহিনির বিরুদ্ধে লড়াই করে সাথীদের সমেত তিনি শাহাদত বরণ করেন। এই উপত্যকা মুসলিম মধ্য এশিয়ার বালাকোট। সে বীর শহীদদের পবিত্র রক্তে মাখা এ ভূমিকাতেই আহমদ মুসা তাঁর অপারেশন হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেছেন।
বিল জোয়ান পাহাড়ের এক গুহা-মুখে সদর দফতরের প্রধান তাঁবুটি অবস্থিত। গাছ-পালা তাঁবুটাকে ঢেকে রেখেছে। তাঁবুর পাশে বিরাট এক প্লাস্টিক ফলক। ফলকটিতে গাজী আনোয়ার পাশা শহীদের একটি চিঠি উৎকীর্ণ রয়েছে। চিঠিটি এই রকমঃ
‘আমার সালাম গ্রহণ করুন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের অপার অনুগ্রহে আমি ভাল আছি। আপনাদের একটা অর্থহীন পত্র পেলাম। তাতে আপনারা লিখেছেনঃ
‘শুরু থেকেই আপনি আপনার সকল শক্তি বোখারার বিপ্লবীদের জন্য ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন। কাজেই আপনার এ ত্যাগের প্রতিদান হিসেবে আমরা যখন আপনাকে একটা সামরিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত করতে যাচ্ছিলাম, তখন আপনি দায়িত্বহীন লোকের পাল্লায় পড়ে চলে গেলেন। আপনি ফিরে আসুন আপনার সকল অপরাধ ক্ষমা করা হবে।‘
আমার প্রতি আপনাদের এ অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে বলুন, আপনারা কি সেই তারা নন যারা কম্যুনিষ্টদের হাতে বোখারার পতন ঘটাতে সাহায্য করেছেন? জাতির বিপ্লবী শক্তির নিরপরাধ লোকদের রক্তনদী আপনারাই বইয়েছেন। আপনারাই তো আমাদের পবিত্র স্থান সমূহ, মসজিদ মাদ্রাসাকে ভূ-লুন্ঠিত করেছেন। আমাদের দরিদ্র জনগনকে বুর্জোয়া আখ্যা ব্যাপকভাবে হত্যা করেছেন। তাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করেছেন। মাত্র ভাত-কাপড়ের লোভে রাশিয়ানদের হাতে নিজেদের ঈমান বিক্রি করেছেন। আমাদের বোখারা এখনও ধূলি ধূসরিত। দারিদ্র ও আনাহারক্লিষ্টতার বীভৎসতা চলছে সেখানে। আমি জন্মভুমির একজন মুক্ত সন্তান। জাতির জন্য লড়ছি, ভবিষ্যতেও লড়ব। জন্মভূমিকে কম্যুনিষ্ট এবং আপনাদের মত বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে মুক্ত করব। বর্তমানে আমার সাথে দেড় লাখ মানুষ আযাদীর জন্য পাহাড়ে বন্দরে সর্বদা শত্রুদের সাথে লড়বার জন্য প্রস্তুত। আমরা কোন ভাড়াটিয়া সৈন্য নই, জাতির সেবক মাত্র। আমরা অচিরেই দেশকে রুশদের কবল থেকে মুক্ত করব। আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের বিশ্বাস ও পথ সুস্পষ্ট। আমাদের কর্মসূচী পরিষ্কার। পল্লী নগর হতে মুসলমানরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আমাদের সাথে শামিল হচ্ছে। তারা ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজত করতে চায়। তোমরা ও যদি দ্বীনের সৈনিক হতে চাও, তাহলে রাশিয়ানদের বিতাড়িত করার সংগ্রামে এসে যোগ দাও।‘
আনোয়ার পাশা এ চিঠি লিখেছেন ১৯২২ সালে লোভ প্রলোভনে যে সব মুসলমান কম্যুনিষ্ট দলে যোগ দিয়েছিল তাদের উদ্দেশে। আহমদ মুসা বলে, গাজী আনোয়ার পাশার এ চিঠির আবেদন এখনও আছে, কম্যুনিষ্টদের বিতাড়ণ না করা পর্যন্ত থাকবেই।
বিলজোয়ান পাহাড়ের এ প্রধান তাঁবুতে আহমদ মুসা বসে। তার পাশের কক্ষেই বসে হাসান তারিক। হাসান তারিক এ অপারেশন ঘাটির ষ্টাফ প্রধান এবং কেন্দ্রিয় অপারেশন কো-অডিনেটর।
সেদিন ভোরে আহমদ মুসা এক ঘাটি সফরের জন্য বেরিয়ে গেছে। হাসান তারিক অফিসে একা। টেবিলে বসে কাজ করছিল সে। রিপোর্ট পড়ছিল সে আয়েশা আলিয়েভার। মস্কোভা বন্দি শিবির থেকে শুরূ করে আরিস ষ্টেশনে পৌঁছা পর্যন্ত সব কথাই বিস্তারিত আছে রিপোর্টটিতে। একবার পড়েছে সে শুরুতে, আবার পড়ছে। আয়শা আলিয়েভার ভুমিকায় স্থম্ভিত হয়েছিল সে, আনন্দও লেগেছে তার।
হঠাৎ হাসান তারিকের মনে হল, আবার কেন সে রিপোর্ট পড়ছে। কেন ভালো লাগছে তার এটা পড়তে? একজন মহিলার জন্য ঐ ভুমিকা বিস্ময়কর বলেই কি? অস্বস্তি বোধ করছে হাসান তারিক। এ প্রশ্নের কোন সরল জবাব নেই তার কাছে। মনের অবচেতন অংগনের কোথায় যেন সংঘাত। চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। সে কি কোন অন্যায় করেছে?
এমন সময় সাইমুমের একজন রক্ষী ঘরে প্রবেশ করে বলল, মুহতারামা আয়েশা আলিয়েভা কথা বলতে চান।
প্রথমে হাসান তারিক চমকে উঠল, তারপর মনে পড়ল, আজ আয়েশা আলিয়েভাদের লেনিন স্মৃতি পার্কের ঘাটিতে যাওয়ার কথা। মহিলা শাখাকে ওখানেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোকাইয়েভাও তার সাথে যাছে। শিরিন শবনমকেও ওখানে রাখা হয়েছে। রোকাইয়েভার সাথে তার দাদীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা ওখানেই করা হবে। সাইমুমের একটা ইউনিট তাদেরকে ওখানেই পৌছে দেবে।
হাসান তারিক রক্ষীকে বলল, আসতে বল তাকে।
রক্ষী বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পরেই পর্দার আড়ালে পায়ের শব্দ হলো। আয়েশা আলিয়েভা এসেছে। সালাম দিল সে।
হাসান তারিকও সালাম জানিয়ে হাতের কাগজ টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল, আয়েশা আলিয়েভাই প্রথম কথা বলল। বলল সে, পরামর্শ নিতে এসেছি, দোয়া নিতে এসেছি।
উল্লেখ্য, সাইমুম মহিলা শাখার সিকিউরিটি বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আয়েশা আলিয়েভাকে। মস্কোভা বন্দি শিবির থেকে এ পর্যন্ত আয়েশা আলিয়েভা যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তাতে আহমদ মুসা খুশী হয়ে তার উপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। আয়েশা আলিয়েভার রিপোর্টে ফারহানার কথাও ছিল। আহমদ মুসা চমৎকৃত হয়েছে ফাতিমা ফারহানার ভুমিকাতেও। আয়েশা আলিয়েভা ফাতিমা ফারহানার সালাম পৌছিয়েছিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা সালাম গ্রহণ করে বলেছিল, ও ভালো আছে তো? ওদের কাছে আমি অনেক ঋনী। পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো আয়েশা আলিয়েভার মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এই কথায়। সে খুশী হয়েছিল, ফারহানার কাছে একটা ভালো চিঠি লেখার পয়েন্ট তার হলো।
হাসান তারিক তার হাতের কলমটি মৃদুভাবে টেবিলের উপর ঠুকছিল। আয়েশা আলিয়েভার কথায় উত্তরে টেবিলের উপর চোখ রেখে বলল, হেদায়েত যা দেবার আহমদ মুসা ভাই তো দিয়েছেন। আমি দোয়া করছি, আন্দোলন তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তা পালন করার তৌফিক আল্লাহ তোমাকে দান করুন। হাসান তারিক কথা শেষ করল।
ও দিকে আয়েশা আলিয়েভাও নিরব। এই নিরবতায় অস্বস্তি বোধ করছে হাসান তারিক। কিন্তু কি কথা আর বলবে সে।
পল পল করে সময় বয়ে যাছে। অসহ্য এক নিরবতার মধ্যে কেটে গেল কিছুক্ষণ। অবশেষে ওপাশে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর শব্দে এই নিরবতা ভেংগে গেল। উঠে দাড়িয়েছে আয়েশা আলিয়েভা বলল সে, আসি, দোয়া করবেন। আবার সালাম দিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
তার গলাটা ভারী মনে হল।
হাসান তারিক সালাম দিতে ভুলে গেল। এক ধরনের বিমুঢ়তায় মাথাটা তার চেয়ারে এলিয়ে পড়ল। কেন সে কথা বলতে পারলোনা? এই দুর্বলতা কেন তার? এ পরিষ্কার বিষয়টা ও নিশ্চয় ধরতে পেরেছে? বেদনায় ক্ষোভে চোখ দু’টি তার ভারী হয়ে উঠল। আর নিজেকে মনে হল খুবই দুর্বল। ভাবল সে, ও কি কষ্ট পেল মনে? তার গলাটা অমন ভারী শোনাল কেন? হাসান তারিকের মনে পড়ল আয়েশা আলিয়েভার তাসখন্দ জেল লাইব্রেরীর সে চিঠিটার কথা। এ দুনিয়ায় তার কেউ নেই, একা সে।
চেয়ার থেকে উঠে দাড়াল হাসান তারিক। বেরিয়ে এল তাবুর গেট দিয়ে। সাইমুমের ছোট কাফেলা তখন যাত্রা শুরু করেছে। সামনের দুটি ঘোড়ায় আয়েশা আলিয়েভা আর রোকাইয়েভা। বড় চাদরে ঢাকা ওদের গোটা দেহ। সামনের মুখটি একবার ফিরে তাকাল তাঁবুর দিকে। আয়েশা আলিয়েভার মুখ, হাসান তারিক তার চোখ নামিয়ে নিল তার চোখ থেকে। যখন আবার মুখ তুলল, কাফেলা চলে গেছে পাহাড়ের আড়ালে।
তাঁবুতে ফিরে আসার জন্য হাসান তারিক ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, এমন সময় দেখল ঘোড়া ছুটিয়ে আহমদ মুসা আসছে।
আহমদ মুসা এল। সালাম বিনিময় হলো। আহমদ মুসা বলল ভেতরে চল জরুরী কথা আছে। আহমদ মুসার মুখাবয়বে চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। আহমদ মুসা এবং হাসান তারিক দু’জনে তাঁবুর ভেতরে এসে আহমদ মুসার রুমে বসল।
চেয়ারে বসেই আহমদ মুসা কনুই টেবিলে রেখে একটু ঝুঁকে পড়ল সম্মুখে হাসান তারিকের দিকে। তার চোখে চাঞ্চল্য এবং চিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ। বলল সে, আরিসের জেল খনায় আমাদের পাঁচশ ভাই অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। সাইমুমকে কিছু করতে না পেরে তারা আরিস ষ্টেশনের সকল মুসলিম কর্মচারী এবং শহরের প্রায় চারশ মুসলিম যুবককে জেলে আটকিয়ে তাদের উপর অত্যাচার করছে সাইমুম সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, বল এখন আমাদের করণীয় কি?
-ওদের উদ্ধার করা দরকার। কম্যুনিষ্টরা হয় ওদের মেরে ফেলবে, নয়তো চালান দেবে সাইবেরিয়ায়। এর কোনটাই আমরা হতে দিতে পারিনা।
-ঠিক বলেছ, আরিস থেকে আলী খানও এই কথাই জানিয়েছে।
-তাহলে আমাদের তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
-আমি চিন্তা করছি, আজই একটা ইউনিট আমরা আরিসে পাঠিয়ে দেব। আরিসের সাইমুম ইউনিট তৈরী আছে। আজ রাতেই আমরা আরিস জেলখানায় আঘাত হানবো।
-অনুমতি দিলে একটা ইউনিট নিয়ে আমি এখনই আরিসে যেতে পারি। বলল হাসান তারিক।
-এই তো তুমি সেখান থেকে এলে, এবার আমি যাব মনে করছি! জবাব দিল আহমদ মুসা।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, আমার সাথে যাবে এমন একটা ইউনিট তুমি রেডি কর। আমরা যাতে জোহর পড়েই রওয়ানা হতে পারি।
হাসান তারিকের চোখে মুখে তখনও কিছু আপত্তির সুর। বলল, কাল কাজাখ রাজধানী আলমা-আতা থেকে আমাদের প্রতিনিধি দল আসবে। আপনি এসময় বাইরে গেলে …..।
হাসল আহমদ মুসা। হাসান তারিককে কথা শেষ করতে না দিয়েই সে বলল, সেতো আগামী কালের কথা। দোয়া কর সাইমুমের এ অভিয়ান আল্লাহ সফল করুন। ইনশাআল্লাহ ভোরেই আমরা ফিরে আসব।
‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে হাসান তারিক একজন রক্ষীকে ডেকে নির্দেশ দিল আলি ইউসুফজাইকে ডেকে আনার জন্য। আলী ইউসুফজাই এই ঘাটির একজন ইউনিট কমান্ডার। আহমদ মুসার নির্দেশ মোতাবেক হাসান তারিক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা। চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল। হাসান তারিকের কথা শেষ হলে সে বলল, কুতাইবার এখানে আসা দরকার, একটা জরুরী পরামর্শের জন্য, একথা বলে দিয়েছ তো আয়েশাকে?
সলাজ হাসি ফুটে উঠল হাসান তারিকের ঠোঁটে। বলল সে, দুঃখিত একদম ভুলে গেছি মুসা ভাই।
-কেন, কোন কথা হয়নি তার সাথে? বলে যায়নি সে?
-ও দোয়া নিতে এসেছিল, আর কথা হয়নি। মুখ একটু নিচু করে বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি। বলল, দোয়া করতে কথা বলতে হয়না, এজন্যই বোধয় দোয়াটা করতে পেরেছ, না?
মুখটা হাসান তারিকের লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। আহমদ মুসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে হাসান তারিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একটু ওদিকে দেখি, ইউসুফজাইকে ও পেল কিনা?
আহমদ মুসার সম্মুখ থেকে পালিয়ে গেল হাসান তারিক। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে হাসিতে পিতার স্নেহ আছে, ভাইয়ের ভালবাসা আছে, বন্ধুর সমবেদনা আছে।
আরিস শহরের জেলখানা। শহরের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া প্রধান সড়কটি থেকে একটা সরু কংক্রীটের রাস্তা চলে গেছে উত্তরে। কিছু দুর গিয়ে একটা বড় গেটে পৌছে রাস্তাটা শেষ হয়েছে। এটাই আরিসের জেলখানা। জেলখানার চারদিক দিয়ে বাগান। নানা রকম ফুলের গাছ সে বাগানে। সব্জিও ফলানো হয় এখানে। বড় তুলার গাছও কিছু আছে। বাগানটা অপেক্ষাকৃত ছোট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাগানের পরেই মুল জেল খানা। এটাও প্রাচীর ঘেরা। জেলখানার উত্তর অংশে অনেকটা জায়গা খালি। একে বলাহয় মৃত্যুমাঠ। এখানে যাদের আনা হয়, তারা আর ফিরে যায়না জেল ঘরে। পাঁচশ মুসলিম যুবকের উপর এই মুত্যু মাঠেই নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
সূর্য ডোবার পরেই সাইমুমের ইনফরমেশন ইউনিটের লোকরা জেল খানার চারদিকে অবস্থান নিয়েছে। অপারেশন ইউনিটের লোকেরা এল সাড়ে ৭টায়। পরিকল্পনা অনুসারে তারা জেলখানার মূল প্রাচীরের চার দিকে গাছের আড়ালে অবস্থান নিল। ইনফরমেশন ইউনিট আগেই জানিয়েছিল, জেলখানার বাগানে কোন প্রহরী নেই। বড় বড় কর্তারা জেল খানায় আসায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা আজ জেলখানা সিকিউরিটির হাতে নেই বলেই বোধ হয় রুটিন প্রহরার বাড়তি ব্যবস্থা তারা করেনি।
ঠিক সাড়ে সাতটাতেই আহমদ মুসা, আলী খানভ এবং আরও দু’জন একটা সামরিক জীপে এসে জেলখানার বাইরের গেটে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের গায়ে সামরিক অফিসারের পোশাক। মিলিটারী হ্যাট কপালের প্রান্ত পর্যন্ত নেমে এসেছে। এ সামরিক পোশাক ও সামরিক জীপ সাইমুমের যোগাড়ে আগে থেকেই ছিল।
আহমদ মুসার আজকের পরিকল্পনা নিঃশব্দে কাজ শেষ করা। গত কয়েকদিন থেকে শহরে যথেষ্ট পুলিশ ও সৈন্যের সমাবেশ করা হয়েছে। কাজ শেষ করার আগে জানাজানি হয়ে গেলে শহর থেকে বেরুনো, বিশেষ করে এত লোক নিয়ে কঠিন হবে।
জীপের ডাইভিং সিটে ছিল আহমদ মুসা। জীপ গেটের সামনে দাঁড়াতেই সিকিউরিটি বক্স থেকে দু’জন বেরিয় এল। আহমদ মুসা দ্রুত গেট খোলার জন্য হাতের ইশারা করল। তারা মুহূর্ত দ্বিধা করল তারপর খুলে দিল বিদ্যুৎ চালিত অটোমেটিক গেট। সাঁ করে জীপটি ভেতরে ঢুকে গেল। পেছনের সিট থেকে দু’জন লাফিয়ে নামল নীচে। নেমেই ওরা সিকিউরিটি বক্সের দিকে এগুল। দেখলে মনে হবে সিকিউরিটির লেকদের তারা কিছু বলতে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুসারে এ দু’জন সাইমুম কর্মীর দায়িত্ব হলো গেটের প্রহরী দু’জনকে কাবু করে সিকিউরিটি বক্স দখল এবং গেটটা সিল করে দেয়া যাতে আর কেউ ঢুকতে না পারে। অল্পক্ষণ দাঁড়াল জীপটি। তাকিয়েছিল আহমদ মুসা সিকিউরিটি বক্সের দিকে। তারপর সিকিউরিটিবক্স থেকে সাইমুম কর্মী হাত নেড়ে শুভ সংকেত দিলে আহমদ মুসার জীপ ছুটল সামনে। জেলখানার মুল গেটের সামনে রাস্তার ডান পশে প্রধান সিকিউরিটি অফিস। এ সিকিউরিটি অফিসেই রয়েছে জেলখানার বিদ্যূৎ নিয়ন্ত্রন কক্ষ। এ অফিসে সর্বক্ষণ ডজন খানেক সিনিয়র নিরাপত্তা অফিসার ডিউটিতে থাকে। সবাই রুশ দেশের, দেশীয় কেউ নয়।
জীপ নিরাপত্তা অফিসটির সামনে চলে এসেছে। কাউকেই বাইরে দেখা যাচ্ছেনা। খুশী হল আহমদ মুসা।
জীপ নিয়ে অফিসের সিঁড়িতে দাঁড় করাল। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল দু’জন দু’দিক থেকে। তর তর করে সিড়ি বেয়ে উঠে খোলা দরজায় গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। সোল্ডার হোলস্টার থেকে এম-১০ রিভলভার সে তুলে নিয়েছে হাতে। আলী খানভ আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল। তার হাতে এম-১০ রিভলভার।
ঘরে একটা গোল টেবিল ঘিরে বসেছিল ১২ জন সিকিউরিটি অফিসার প্রত্যেকের পাশে ষ্টেনগান রাখা। কয়েকজন তাস খেলে সময় কাটাচ্ছিল। অন্যান্যরা দেখছিল, কেউ গল্প করছিল। রিভলভার হাতে আহমদ মুসাদের দেখে টেবিলের ওপশে থেকে একজন চুপ করে টেবিলের নীচে বসে পড়ল। সংগে সংগে আলী খানভ বসে পড়ল। ওপাশে বসে ও ষ্টেনগান ঘুরিয়ে নেবার আগেই আলী খানভ এম-১০ এর ট্রিগার চেপে টেবিলের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে শুধু একটা যান্ত্রিক শীষ উঠল। দেহগুলো কারও টেবিলে, কারও মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
আলী খানভকে দরজার দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসা গিয়ে সুইচ রুমে প্রবেশ করল। এই জেলখানার ইলেকট্রিক ডিজাইনার উজবেক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। এখন সাইমুমের কর্মী। তার কাছ থেকে সুইচ বোর্ডের নক্সা সে মুখস্থ করেছে। সুইচ বোর্ড দেখেই সব কিছু চিনতে পারলো। সুইচ প্যানেলের বাম দিক থেকে ৭নং সুইচের দিকে তাকিয়ে দেখল ওটা অন করা। সুইচ সে অফ করে দিল। তারপর নক্সা অনুযায়ী ৩নং মেইন সুইচের ঢাকনা খুলে ফেলে সেখান থেকে নব খুলে নিল। বন্ধ করে দিল আবার মেইন সুইচ। এবার সুইচ অন করে দিলেও জেলখানার দেয়ালের তারগুলোতে বিদ্যুৎ যাবে না। জেলখানার দেয়ালের বিদ্যুতায়িত তারগুলোকে এইভাবে অকেজো করে দেয়া ছাড়া আর কোন লাইটে সে হাত দিলনা। অপারেশন শেষ করার আগে ওদেরকে এলার্ট হবার কোনই সুযোগ সে দিতে চায়না।
সুইচ রুম থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। তারপর সিকিউরিটি রুমের দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়ে আলী খানভকে নিয়ে আহমদ মুসা দ্রুত জেলখানার পূর্ব পাশের বাগানের পথ ধরে জেলখানার উত্তরের অংশে চলল। তারা চলা শুরু করতেই গাছের অন্ধকার থেকে দু’জন সাইমুম কর্মী বলল, চলুন আমরা আপনাদের অপেক্ষা করছি।
তারা জেলখানার উত্তর প্রান্তের দেয়ালের কাছে এসে পৌঁছাল। আসতে আসতে সাইমুমের ইনফরমেশন বিভাগের এ দু’জন কর্মী বলে ছিল, আজ রাত ৭টায় একসাথে অনেক গোলাগুলির শব্দ বাইরে থেকে শোনা গেছে। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল সংখ্যা কত হবে?
চল্লিশ পঞ্চাশটির বেশি হবে না, তারা বলল। অর্থাৎ রাত ৭টার দিকে, আহমদ মুসা ভাবল, আমাদের চল্লিশ পঞ্চাশ জন ভাইয়ের জীবন তারা কেড়ে নিয়েছে।
ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। সন্ধ্যা ৭টা ৫০মিনিট। আহমদ মুসা এদিকের গোটা প্রাচীরটা পরীক্ষা করে এল। দেয়ালের কাছ বরাবর সাইমুম কর্মীরা বসে আছে। ঠিক আটটা বাজার সাথে সাথে গলায় পিস্তল ঝুলিয়ে পঞ্চাশ জন সাইমুম কর্মী জেলখানার প্রাচীরে উঠে যাবে ঠিক করে রাখা হয়েছে। একজন সাইমুম কর্মীর উপর আর একজন দাঁড়াবে, এই দ্বিতীয় জনের কাঁধে পা রেখেই তারা পঞ্চাশজন প্রাচীর অতিক্রম করবে।
ব্যবস্থাপনা ঘুরে দেখা শেষ করে কয়েকজনকে দিয়ে দেয়ালের বিদ্যুতের তারগুলো আবার পরীক্ষা করাল, না ওগুলো মৃত। তারপর আলী খানভকে পরিকল্পনাটা আবার বুঝিয়ে দিয়ে বলল, সাইমুম কর্মীরা ভেতরে লাফিয়ে পড়ার সংগে সংগে দেয়ালের গোড়ায় পাতা দেয়াল মাইনে বিস্ফোরণ ঘটাবে। এতগুলো লোকের বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য এটাই একমাত্র সহজ পথ।
সব বুঝিয়ে দিয়ে আটটা বাজার কয়েক মিনিট বাকী থাকতে আহমদ মুসা জেলের পশ্চিমাংশের দিকে চলে গেল। জেলখানার তিন তলার বিল্ডিং পশ্চিম প্রাচীর যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখানে জেলখানার প্রাচীর এবং বিল্ডিং এর দেয়াল একসাথে মিশেছে। সে কোণা বেরাবর তিন তলার ছাদ থেকে একটা পানির পাইপ নীচে নেমে এসেছে। আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এটা দেখে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ৭টা বেজে গেছে। আহমদ মুসা পানির পাইপ বেয়ে প্রাচীরের মাথায় গিয়ে বসল। ভেতরের মাঠে তার নজর গেল। পাঁচশ’ যুবককে ঘিরে প্রায় পঞ্চাশজনের মত সিকিউরিটির লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীর বরাবর। হঠাৎ নজর পড়ল সামনে। দেখল, ঈষৎ উঁচু একটা মঞ্চে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। সামনে থেকে আর একজন পিস্তল তুলল তাকে লক্ষ্য করে। কার্ণিশের ছায়ায় প্রাচীরের উপর সে বসেছিল। দ্রুত সোল্ডার হোলষ্টার থেকে এম-১০ রিভলভারটি খুলে নিল। রিভলভার ঘুরিয়ে সে চেপে ধরল ট্রিগার। লক্ষ্য তার হাত বাঁধা যুবকের মাথার উপর দিয়ে ঐ লোকটি। এক ঝাঁক গুলি বেরিয়ে গেল রিভলভার থেকে। পিস্তল ধরা ঐ লোকটি এবং চার পাঁচ গজ পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আর একজন ঢলে পড়ে গেল মাটিতে।
সকলের চোখ দেয়ালের এদিকে। ওদিকে সাইমুমের পঞ্চাশজন কর্মী প্রাচীর ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়ছে মাটিতে। মাটিতে পা দিয়েই ওরা রিভলবার তাক করছে কাছের কারারক্ষীদের লক্ষ্যে। মুহূর্তে এক সাথে পঞ্চাশটি রিভলভার গর্জে উঠল। লুটিয়ে পড়ল প্রায় পঞ্চাশটির মত দেহ।
আহমদ মুসাও লাফিয়ে পড়েছে মাটিতে। কাছেই একজন কারারক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমটায় সে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু তারপরই ষ্টেনগান ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু সময়ে না কুলালে সে ষ্টেনগান গিয়েই সজোরে আঘাত করল আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্য করে। আহমদ মুসা চোখের পলকে মাথাটা নীচে চালান করে দিয়ে পায়ে জোড়া লাথি ছুড়ে মারল তার ষ্টেনগান ধরা হাত লক্ষ্য করে। তার হাত থেকে ষ্টেনগান ছিটকে পড়ে গেল, সেও আরেক দিকে ছিটকে পড়ে গেল। আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই হাতের রিভলভার একটু উঁচু করে ট্রিগারে চাপ দিল। ছুটে আসা দু’জন রক্ষী মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ছিটকে পড়া সেই লোকটি উঠে আবার তার ষ্টেনগান কুড়িয়ে নিচ্ছিল। আহমদ মুসার রিভলভারের নল তার দিকে ঘুরে এল। একটু চাপ দিল ট্রিগারে। ষ্টেনগান কুড়িয়ে নেবার জন্য সেই যে উঁচু হয়েছিল সে, আর উঠতে পারল না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
এই সময় উত্তর দিক থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ এল। সংগে সংগে জেলখানার উত্তর দেয়ালের একাংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে কোথায় উড়ে গেল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে নির্বাক যন্ত্রের মত মুত্যু মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির হাতের বাঁধন খুলে দিল। বলল, আমাদের সবাইকে এখন ভাঙা প্রাচীরের পথ হয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।
সাইমুম কর্মীরা শ্লোগান তুলেছে, জীবনের সাইমুম, মুক্তির সাইমুম, ইসলামের সাইমুম, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
কলিনকভ ও সাজি সোকলভ আহমদ মুসার গুলিতে প্রথমেই মারা গেছে। রক্ষীরা অধিকাংশই মারা পড়েছে। যারা দু’একজন ছিল জেলখানার ভেতর দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। জেলখানার সর্বত্র একটা ভয়ংকার ভীতি। জেলখানার ওদিকে যে রক্ষীরা ছিল তারা কি হচ্ছে, কি করবে তা বুঝার আগেই এদিক থেকে পালানোদের মুখে পড়ে তারা আর এমুখো হবার কোন চিন্তা করলোনা।
কারা রক্ষীদের ষ্টেনগান ও পিস্তলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সাইমুমের কর্মীরা সেই ভাঙা প্রাচীর পথে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার পিছনে আহমদ মুসা।
পাঁচশ যুবককে সাথে নিয়ে প্রায় দু’শ সাইমুম কর্মী বেরিয়ে এল জেলখানা থেকে। জেলখানার উত্তর দিকের সংকীর্ণ সড়ক ধরে এক সাথে এগিয়ে চলল সকলে। শ্লোগান দিতে নিষেধ করেছে আহমদ মুসা। এতগুলো লোককে কোন ঝুঁকির মধ্যেই সে ফেলতে চায়না। তাদের অবস্থান সম্পর্কে শত্রুদের যতটা বিভ্রান্ত রাখা যায় ততই মঙ্গল।
সাইমুমের এ মৌন মিছিল শহরের আবাসিক এলাকার মধ্য দিয়ে চলছে। জেলখানার পাগলা ঘন্টা অবিরাম বাজছে। তারই মধ্যে উদ্যত ষ্টেনগান হাতে এত লোকের মিছিল দু’পাশের মানুষকে বিস্ময়-বিমুঢ় করে দিচ্ছে। জানালা খুলে ভীত-বিহ্বল দৃষ্টি তারা মেলে ধরছে এ মিছিলের দিকে। মাঝে মাঝে দু’একজন পুলিশকে দেখা যাচ্ছে। ওরা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখছে, কিছুই বুঝতে পারছেনা।
শহরের উত্তর প্রান্তে জেলখানা। উত্তরে আর শহর বেশী নেই। আবাসিক এলাকাটার পরেই এক উর্বর পার্বত্য ভূমি। সাইমুমের মিছিল থামলে আহমদ মুসা বলল, আপনার নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারেন। কম্যুনিষ্ট বাহিনীর সাধ্য নেই রাতে ওরা শহরের বাইরে আসে। তারপর আহমদ মুসা আলী খানভকে বলল, খোঁজ নিন আমাদের সবাই ফিরেছে কিনা।
আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল সেই যুবক। যুবকটি আহমদ মুসাকে বলল, কি বলে আপনার শুকরিয়া আদায় করব, আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে বলল, না ভাই, সব প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। তিনি তোমাকে বাঁচিয়েছেন।
-ঠিক বলেছেন, সব প্রশংসা আল্লাহর। আমি যখন হাসি মুখে মৃত্যুর জন্য মঞ্চে উঠলাম, তখন ওরা আমাকে কি বলেছিল জানেন? মরেও নাকি আমি রেহাই পাবোনা, আমার স্ত্রী ছেলে-সন্তানকে ওরা শুকিয়ে মারবে।
-মানুষের জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা একমাত্র আল্লাহই করেন; আর কেউ নয়।
-জানেন, কিছুক্ষন আগে আমরা তকবির ধ্বনি করেছি, ‘সাইমুম জিন্দাবাদ’, শ্লোগান দিয়েছি।
-সাইমুমকে ভালোবাস তোমরা?
-আগে বাসতাম না, কিছুটা ভালো মনে হতো, কিন্তু জেলখানায় গিয়ে মৃত্যুর মুখো-মুখি দাঁড়িয়ে সাইমুমকে আমরা চিনেছি, তাকে ভালবাসতে শিখেছি।
-আলহামদুলিল্লাহ। সাইমুম জাতির খাদেম।
যুবকটির চোখ দু’টি উজ্জ্বল। আবেগ যেন ঠিকরে পড়ছে। বলল সে, শুধু আমরা সাইমুম কে ভালো বাসতে শিখিনি, জাতির সত্যিকার পরিচয় আমাদের সামনে ধরা পড়েছে, আমাদের জাতিসত্তাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি।
-তোমার নাম কি ভাই? সস্নেহে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
-আবদুল্লাহ নাসিরভ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। আলী খানভ ফিরে এল। ফিরে এসে বলল, সব ঠিক ঠাক। তারপর একটু থেমে বলল, এদের কি হবে, এরা কি করবে, এদের সম্পর্কে কিছু বলুন। বলে আলী খানভ উঠে দাড়িয়ে সকলকে বিশেষ করে সেই পাঁচশ যুবককে লক্ষ্য করে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা আপনাদের উদ্দেশ্যে আমাদের নেতা সাইমুমের নেতা আহমদ মুসা এখন কিছু বলবেন।
আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। বলল, প্রিয় ভাইয়েরা, আসুন আমরা আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করি। তিনি এক লড়াইয়ে আমাদের জিতিয়েছেন এবং আমাদের পাঁচশ ভাইকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করছেন। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহর সাহায্য আমরা অব্যাহত ভাবে পাব। আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিকে এবং আমাদের প্রানপ্রিয় জাতিকে কম্যুনিষ্ট কবল থেকে মুক্ত করতে পারব।
প্রিয় ভাইয়েরা, আপনারা যারা আজ জেল থেকে মুক্ত হলেন তারা আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাই। আপনাদের সুখ সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা আমাদের জীবনের মতই গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা যদি আমাদের সাথে জাতির মুক্তি সংগ্রামে শামিল হতে চান আমরা আপনাদের স্বাগত জানাবো। আপনারা যদি আপনাদের ঘরে ফিরে যেতে চান, আমরা আপনাদের সাহায্য করব। যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাদের নিরাপত্তা বিধানের।
সবশেষে বলতে চাই, আমরা সকলে আল্লাহর বান্দাহ। তার বন্দেগী করাই আমাদের জীবনের মূল কাজ। এর উপরই আমাদের মুক্তি, আমাদের পরকালীন চিরস্থায়ী কল্যাণ নির্ভর করছে। আমাদের এই মুক্তি সংগ্রাম আমাদের বন্দেগীরই একটি অংশ। আমরা যদি আন্দোলনকে সত্যিকার অর্থেই বন্দেগীতে পরিণত করতে পারি, তাহলে আল্লাহর সাহায্য আমাদের উপর অঝর ধারায় বর্ষিত হবে এবং সমস্ত ভয় ও বাধা অতিক্রম করে আমরা সাফল্যের সিংহধারে পৌঁছতে পারব। তাই সকলের প্রতি আমার আবেদন, আসুন আমরা ভাল মুসলমান হই, আল্লাহর সব বিধি নিষেধের আমরা পাবন্দ হই এবং এইভাবে আসুন আমরা অতীতের ব্যর্থতার বিধ্বস্ত ভূমিতে বিজয়ের নিশান উড্ডীন করি।
কথা শেষ করল আহমদ মুসা।
কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়াল সেই যুবক, আবদুল্লাহ নাসিরভ। বলল সে, আমরা অন্ধ ছিলাম, চোখ ফিরে পেয়েছি। আমরা আমাদের পতিত দশাকে বিধিলিপি ভাবতাম, সে ভুল আজ আমাদের ভেঙে গেছে। আমাদের সামনেটা জীবনের চিহ্নহীন মরুভূমি সদৃশ বিরাণ ছিল। ভাবতাম হতাশার সাগরে অন্তহীন ভাবে সাঁতার কাটা ছাড়া আমাদের করণীয় কিছুই নেই, কিন্তু আজ আমাদের সামনে জীবনের সবুজ সংগীত বাজছে। আমরা আর আমাদের পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চাইনা। সাইমুমের নগণ্য কর্মী হবার সুযোগ পেলে আমরা সুখী হব।
আবদুল্লাহ নাসিরভ শ্লোগান তুলল, জীবনের সাইমুম, মুক্তির সাইমুম, ইসলামের সাইমুম জিন্দাবাদ। আবদুল্লাহ নাসিরভের সংগে সংগে পাঁচশ কন্ঠে উচ্চারিত হলো এই ধ্বনি। রাতের নিরবতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল শত শত কন্ঠের সে শ্লোগানে।
আহমদ মুসা আলি খানভকে বলল, আমাদের এই পাঁচশ ভাইকে আজই আমাদের ৩ নং ঘাটিতে পাঠিয়ে দাও। এদের পরিবার পরিজনদের প্রতি নজর রাখ। তাদের যেন কষ্ট না হয় , ক্ষতি না হয়।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। আবদুল্লাহ নাসিরভকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুম্বন করে বলল, আবার দেখা হবে।
আহমদ মুসা এবং তাঁর ছোট কাফেলা যাত্রা শুরু করল গাজী আনোয়ার পাশা ঘাটির উদ্দেশ্যে। রাতেই পৌঁছতে হবে সেখানে, সকালেই আলমা-আতার প্রতিনিধিদল পৌঁছে যেতে পারে।

উপরে পরিস্কার আকাশ। অজস্র তারার মেলা। এই সুন্দর অন্তহীন আকাশের দিকে চাইলে আহমদ মুসা আর চোখ ফেরাতে পারে না। অত নিরবতা, অত উদারতা, অত প্রশান্তি আর কোথাও যেন নেই। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসা দুরের ঐ আদম সুরতের দিকে কিংবা হয়তো আরও উপরে -অন্তহীন অবারিত পথে ছুটছে তার দৃষ্টি।
ধীর গতিতে পার্বত্য পথ ধরে এগিয়ে চলছে কাফেলা।
গাজী আনোয়ার পাশা ঘাটিতে আহমদ মুসা, কুতাইবা এবং হাসান তারিক একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে। তাদের সামনে মধ্য এশিয়ার একটা মানচিত্র খোলা। আলোচনা করছিল তারা।এমন সময় রক্ষী প্রবেশ করল ঘরে। বলল দূত এসেছে তাসখন্দ থেকে।
আহমদ মুসা বলল, নিয়ে এস। দূত এল, সালাম করল। আহমদ মুসা তাকে বসতে বলে খবর জিজ্ঞেস করল। দূত একটি চিঠি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে। আহমদ মুসা চিঠি খুলল, আনোয়ার ইব্রাহিমের চিঠি।
দূত বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসা চিঠি পড়ল। আনোয়ার ইব্রাহিম লিখেছে, ‘এইমাত্র টেলিফোন পেলাম গুলরোখ রাষ্ট্রীয় খামার থেকে আমাদের ভাই মুহাম্মদ আতাজানভকে ‘ফ্র’ এর লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। ‘ফ্র’ এর ক্রুদ্ধ লোকজন গুলরোখ খামারের সেচ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিনষ্ট করে দিয়েছে। মানুষকে যথেচ্ছা মারধোর করেছে। আরেকটা খবর হল ‘ফ্র’ এর একটা বিরাট স্কোয়াড সরকারী লোকজনদের সমর্থণ পুষ্ট হয়ে পিয়ালং উপত্যকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।‘
চিঠি শেষ করে থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল তারপর, পিয়ালং সাইমুমের একটি আশ্রয় কেন্দ্র। সেখানে শত শত ছিন্নমূল পরিবারকে সাইমুম আশ্রয় দিয়েছে। ওখানে আছে সাইমুমের বিশাল খাদ্য গুদাম। পিয়ালং আমাদের নিরাপদ ট্রেনিং কেন্দ্র। এর উপর ‘ফ্র’ কে আমরা হাত দেয়ার সুযোগ দিতে পারি না।
হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, হাসান তারিক তুমিও যাও, সবাইকে প্রস্তুত করো। আমরা এখনি পিয়ালং যাব।
হাসান তারিক চলে গেল।
একটা হাসি ফুটে উঠল হাসান তারিকের ঠোঁটে। গুলরোখ তো সরকারী খামার; আমাদের নয়। ওর উপর এত রাগ কেন? বুঝা যাচ্ছে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এ দেশের মুসলমানদের কাউকেই আর ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশেষ করে সেদিন আরিস রেল স্টেশন এবং আরিস জেলখানার ঘটনার পর ওরা পাগল হয়ে গেছে। কলিনকভ ও সার্জি সোকলভের মৃত্যুতে বিশ্ব-জোড়া বিশাল কম্যুনিষ্ট সংগঠন ‘ফ্র’ এর মর্মমূল পর্যন্ত কাঁপন ধরেছে। সাইমুমের গায়ে হাত দিতে না পেরে সাধারণ মানুষের উপর তাদের আক্রোশ বাড়ছে। কিন্তু ওদের আক্রোশ এবার ওদেরকেই গিলে খাবে। এই মুসলিম মধ্য এশিয়া দখলের সময় অর্থ দিয়ে, পদ দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে মুসলমানদের মধ্য থেকে অনেক বিশ্বাসঘাতক ও মুনাফিক কে সাথে পেয়েছিল। তাই মুসলিম শক্তিকে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে পরাজিত করা তাদের পক্ষে সহজ হয়েছিল। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। এ দেশের কাউকেই ওরা সাথে পাবেনা, বিশ্বাস করে সাথে নিতেও পারবেনা। আহমদ মুসা কুতাইবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমার একবার গুলরোখ রাষ্ট্রীয় খামারে যাওয়া দরকার। ওখানকার দুর্গত মানুষের পাশে সাইমুমকে দাঁড়াতে হবে। সে ব্যবস্থা কর। আতাজানভের পরিবারের খোঁজ নিও, তাদের জন্য কি করা দরকার করো। আতাজানভকে মুক্ত করার জন্য কি করা যায়, কোথায় সে আছে, জানিও।
কুতাইবা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখনি যাত্রা করছি।
আহমদ মুসা ও উঠে দাঁড়াল।
অল্পক্ষন পরেই একটা মুজাহিদ কাফেলা বেরিয়ে এল গাজী আনোয়ার পাশা ঘাঁটি থেকে। অনেক ঘোড়ার একত্র পদশব্দ একটা ছন্দ তুলছে বাতাসে। অল্প অল্প ধুলা উড়ছে, পদাঘাতে ছোট ছোট পাথর টুকরা ছিটকে পড়ছে রাস্তা থেকে। সবার আগে আহমদ মুসা, তারপর হাসান তারিক, তারপর অন্যান্যরা। কাফেলা এগিয়ে চলেছে পিয়ালং উপত্যকার দিকে।

পরবর্তী বই

রক্ত সাগর পেরিয়ে

Top